



হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রকৃতপক্ষে শিব কে? তিনি কোথায় থাকেন? তাঁর পুজোর মাহাত্ম্যই বা কী? ব্রহ্মা-বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতারাই এ প্রশ্নের উত্তর দিতে অক্ষম। মানুষ তো অতি সাধারণ! মনে করা হয় ত্রিজগতের সবকিছুই শিবময়। জগতের সর্বক্ষেত্রেই তাঁর প্রকাশ। অষ্টমূর্তিতে তিনি জগত সংসারে বিরজমান। মর্তে তিনি মহাকাল, সৃজনে নটরাজ ,পশুপালনে পশুপতি ,শাসনকর্মে তিনি কালভৈরব, দারিদ্র্যহরণে কুবের ভাণ্ডারী; বৈদ্যনাথ রূপে রোগারোগ্য আর মৃত্যুঞ্জয় রূপে করেন প্রাণদান। কর্মে তিনি আবার বায়ুপুত্র মহাবীর হনুমান ,ভক্তিতে আশুতোষ ,প্রেমে অর্ধনারীশ্বর, সন্তানে বটুক, মুক্তিদানে বিশ্বেশ্বর বিশ্বনাথ। তিনিই আবার সৃষ্টি আর ধ্বংসের সমন্বয়কারী হরিহর। তিনি নিখিল বিশ্বের সব জীবের হৃদয়গুহাবাসী আত্মার স্বরূপ— সোহহম্।
শিব বিবাহিত, তাই তিনি ব্রহ্মচারী নন আবার তিনি শ্মশানবাসী– গৃহস্থও নন। তিনি সর্ব ঐশ্বর্যময়; সন্ন্যাসী নন— তিনি তো অস্ত্রধারী। তিনি ব্রাহ্মণ- ক্ষত্রিয়- বৈশ্য নন। কারণ তিনি বেদপাঠ/ যজ্ঞ করেন না। তিনি প্রজা রক্ষার পরিবর্তে প্রলয়প্রিয়। তিনি নির্ধান ও চেষ্টাহীন। তিনি নাগযজ্ঞোপবীত ধারী — তাহলে তো শুদ্রও নন। তিনি লিঙ্গেশ্বর — আবার অর্ধনারীশ্বর। লোককথায় তিনি অনাদি। প্রলয়কালে দেববিনাশ করেন— তবুও তিনি পাপহীন। এখন প্রশ্ন, তাহলে…!
মনে করা হয়, মাতা পার্বতীইকেবলমাত্র জানেন ‘শিবতত্ত্ব’ — স্কন্দপুরণাদি শাস্ত্রাদিতেও এ কথার সমর্থন পাওয়া যায়।
সমস্ত জগতই তাঁর রূপ— তাই তিনি উলঙ্গ, তিনি ত্রিগুণের আধাররূপ শূলধারী–শূলী, ভূত সংসার থেকে মুক্ত— ভূগগণের অধিপতি। তাঁর আবাসস্থল শ্মশানভূমি হল সংসার, যেখানে তিনি জীবল্যাণে সদা বিরাজমান। ধর্মরূপী বৃষ তাঁর বাহন, রিপুরূপী সর্প তাঁর ভূষণ, বিবিধ কর্মই তাঁর জটারাশি, বেদ তাঁর ত্রিনয়ন। পশুভাবকে দমিয়ে ব্যাঘ্রচর্ম পরিধান করেন। তাঁর হাতের ডমরু বৈরাগ্য আর ডমরুধ্বনি শব্দব্রহ্ম– যা বর্ণমালা ব্যাকরণের উৎপত্তিস্থল। তিনি পঞ্চানন-পূর্ব মুখ তৎপুরুষ, পশ্চিম মুখ সদ্যোজাত, দক্ষিণ মুখ অঘোর, উত্তর মুখ বামদেব এবং ঊর্ধ্বমুখের নাম ঈশান। তাই শিব অর্থে মঙ্গল বা মঙ্গলবিধায়ক।
সন্ন্যাসীর আদি গুরু হলেন সদাশিব। আবার গৃহস্থের আরাধ্যও তিনি। সংসারী মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণসমূহের আধারস্থল হলেন শিব। নৃত্য – গীত- বাদ্য – ব্যাকরণশাস্ত্র , চিকিৎসাশাস্ত্র, অস্ত্রবিদ্যা , তন্ত্র – মন্ত্র – হঠযোগের আদি গুরু তিনি। ভক্তকে এসবই তিনি দান করেন। তাইতো তাঁর মধ্যে মিশে যায় ‘সন্ন্যাসীর জ্ঞান ও গৃহীর ভক্তি’– সনাতনী সব আদর্শ ,জ্ঞান আর বিদ্যার জীবন্ত বিগ্রহ তিনিই।
ব্রহ্ম একদিকে নির্গুণ, আবার সগুণ নিরাকার বা আকার। সেভাবে নিষ্ফল শিব দুই প্রকার। লিঙ্গরূপী শিব নিরাকার আর সগুণশিব সাকার। মহাভারতের কাহিনী অনুযায়ী কুন্তীপুত্র অর্জুন আর দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামা দু’জনেরই ব্রহ্মাস্ত্র ছিল। তাঁরা এই অস্ত্র শিবের প্রসন্নতায় লাভ করেন। কিন্তু অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্র অর্জুনের ব্রহ্মাস্ত্রের কাছে ব্যর্থ হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে,কারণ কী বিশালবুদ্ধিসম্পন্ন মহর্ষি ব্যসদেব বলেছেন — অশ্বত্থামা জন্মান্তরে শিবের প্রতিমায় আরাধনা করে তাঁর বরপ্রাপ্ত হয়ে এই দিব্য অস্ত্র লাভ করেন। অন্যদিকে জলান্তরে অর্জুন অস্ত্রটি লাভ করেন শিবলিঙ্গে আরাধনা করে। তাই অর্জুন হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠতর বীর। শাস্ত্র মতে, ভারতে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ দ্বাদশটি প্রধান শৈবতীর্থ আছে। এগুলি সবই জ্যোতির্লিঙ্গ। এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা পরে কোনওদিন করব।
প্রকৃতপক্ষে শিবপুজোর অধিকারী সবাই– সব বর্ণ জাতি ও শ্রেণীর মানুষ স্ত্রী -পুরুষ সবাই। শৈব ,শক্তি, বৈষ্ণব প্রভৃতিরাও।
শিবপুজোর একটি মহাক্ষণ হল শিবরাত্রি। তত্ত্বানুসারে শিবরাত্রি পাঁচ প্রকার। যথা – সৃষ্টিতত্ত্ব ও আদি শিবরাত্রি, স্থিতিতত্ত্ব ও ব্যক্ত শিবরাত্রি, সংহারতত্ত্ব ও অব্যক্ত শিবরাত্রি, তিরোধানতত্ত্ব ও গুহ্য শিবরাত্রি এবং অনুগ্রহতত্ত্ব ও পরম শিবরাত্রি।
শিবরাত্রির শিবপুজোয় তিনি সব থেকে বেশি প্রসন্ন হন– এটি শিববাণী।
শিবরাত্রির দিন চার প্রহরে চারটি উপাদানে শিব পূজিত হন। প্রথম প্রহরে শিব পুজো গ্রহণ ইশান নামে, পুজোর উপকরণ দুধ। দ্বিতীয় প্রহরে শিবের নাম অঘোর , পুজোর দ্রব্য দই। তৃতীয় প্রহরে তিনি মহা বামদেব– পুজো হয় ঘি দ্বারা এবং সব শেষে বা চতুর্থ প্রহরে তাঁর নাম সদ্যজাত; এই সময় তিনি মধুর পবিত্র ধারায় স্থান করেন। শিবলিঙ্গকে দুধের ধারায় স্নানের ফল– শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি ও রোগমুক্তি। দই দিয়ে স্নান করালে– সব পাপ নাশ হয়। কি দিয়ে স্থানের ফল– ভক্তের দুঃখ দারিদ্র্য শোক আর রোগভোগের অবসান। মধু দিয়ে স্নান করালে প্রভু ভক্তকে অভিশাপ আর রাজযক্ষ থেকে মুক্তি দান করেন।
স্কন্দপুরাণে বলা হয়েছে , ‘ শিব রাত্রিতে মানুষ অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপবাসে, জাগরণে এবং শিবলিঙ্গের পুজায় অক্ষয়লোক লাভ করে এবং অন্তে শিবসাযুজ্য প্রাপ্ত হয়’।
শিবরাত্রির দিনে সব লিঙ্গেই ভগবান শিব অধিষ্ঠিত হন। আকন্দ, ধুতুরা শিবের প্রিয় ফুল ।আর প্রিয় ফল বেল।
অখন্ড বেল পাতা দিয়ে শুধুমাত্র একবার শিবলিঙ্গের অর্চনা করলে সব পাপ থেকে মুক্তি আর শিবলোকে সম্মান অক্ষয় বাস হয়– ভবিষ্যপুরানে এর সমর্থন মেলে।
শিবলিঙ্গে বেলপাতা দিলে সব কামনা বাসনা পূর্ণ হয় আর দরিদ্রতা থেকে মুক্তি হয়। ধুতুরা ফুল দিলে লক্ষ্য গোদানের সমান ফল পাওয়া যায়। জল প্রাণের প্রতীক বেলপাতার তিনটি পাতা সত্ত্ব – রজ: ও তম গুণের প্রতীক। শিবলিঙ্গ ব্রাহ্মের প্রতীক। ভাই শিবলিঙ্গে জল ও বেলপাতা দেওয়ার অর্থ ‘ নির্গুণ পরব্রহ্মে প্রাণাদিবৃত্তি সমেত উক্ত তিনটি গুণকে লয় করানো। ‘ এর জন্যই শাস্ত্র বলেছেন ,শিব মানে মঙ্গল, রাত্রি মানে অভিষ্ট পূরণকারিনী আদ্যাশক্তি। আর এর জন্য শক্তিসহ শিবের উপাসনার পরম জ্ঞান দান করেন এই বিশেষ রাত্রিই – পরম শিবরাত্রি। শিবের প্রসন্ন তাই জীবের কাম্য, শিবই একমাত্র অভয় দাতা শরণদাতা। একটি বিশেষ রুদ্র স্তুতি আছে যেটি ভগবান শিবের প্রসন্নতা বর্ধন করে।
শিবরাত্রির দিন বা শিবলিঙ্গ অর্চনার পর এই স্তব পাঠের ফল অতীব শুভ
ওঁ নমো ভগবতে রুদ্রায় ।।
দুলিছে রুণ্ডমুন্ডমাল আসিছে কটিতে ব্যাঘ্রছাল,
গলেতে ব্যাল করে কপাল বিভূতিলিপ্ত দীপ্তভাল।
বাজিছে ডমরু বিকটতাল ববম্ – ববম্ বাজিছে গাল,
প্রলয়কাল রুদ্রচাল দেখিয়া কাঁপিছে লোকপাল।
মেলে জটাজাল প্রমথ পাল নাচে ভৈরব তাল – বেতাল,
মহাকালী সনে ক্রূরকরাল ভয়ালনৃত্যে নাচিছে কাল।
সর্ব অঙ্গ প্রলয়াসঙ্গ মরে ভ্রুভঙ্গে কত অনঙ্গ,
ঊর্ধ্ব গঙ্গে শত- তরঙ্গ উগরে গরল যত ভুজঙ্গ।
নৃত্যরঙ্গ ললিতভঙ্গ বাজিছে দামামা ঘোর মৃদঙ্গ,
ভয়ালভঙ্গি ভ্রুকুটিভঙ্গ কাঁপিছে তরাসে দিঙ্মাতঙ্গ।
ধ্বংসজঙ্গে রথতুরঙ্গ বহ্নিগর্ভে যেন পতঙ্গ,
গরজে জলদ জলধি মন্দ্র খন্ড খন্ড ললাটে চন্দ্র।।
পরিশেষে নিজস্ব উপলদ্ধি থেকে কিছু কথা। পুজোর অর্থ হল শৃঙ্খলা। যা কিছু কল্যাণকর তাই আহ্বান করা। কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে– ‘আত্মনিগ্রহের দম্ভে আধ্যাত্মিকতা যেন ক্ষীণ না হয়ে যায় ‘।
তথ্য ঋণ : সনাতন গ্রন্থাবলম্বী
