



আজ দ্বিতীয় পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
পশ্চিমবঙ্গ ★ সাশ্রয় নিউজ : একদা উত্তরবঙ্গকে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি বলে চিহ্নিত করা হতো। বেশিরভাগ সময়ে কংগ্রেসের প্রার্থীরাই এখান থেকে জয় লাভ করতেন। ৬০ এর দশক থেকে রাজনৈতিক লড়াইটা হতো এখানে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মধ্যে। এবং দেখা গেছে এখানকার ভৌগোলিক অবস্থা, আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা এবং সম্পূর্ণ বর্ডার ভিত্তিক হবার ফলে উত্তরবঙ্গবাসী প্রথম থেকে কেন্দ্রের সরকারের প্রতি একটু হলেও তাদের সমর্থন দিয়ে এসেছেন এবং এখনও আস্থা রাখছেন। এর মাঝে এই উত্তরবঙ্গে বহু আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। যেমন কামতাপুর আন্দোলন, নকশালবাড়ি আন্দোলন, ছিট মহল আন্দোলন, পাহাড় সমস্যা।
মূলত জমি সংক্রান্ত বিষয়, গোর্খা সম্প্রদায় নিজেদের স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবি এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভৌগলিক অবস্থানের জন্য ক’য়েক দশক এই আন্দোলন চলতে থাকে। সেই সময় বামপন্থীরা বেশ কিছুটা এই আন্দোলনের ফলে উত্তরবঙ্গে তাদের ছাপ ফেলতে শুরু করে। কিন্তু বেশিদিন তার প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী করা যায়নি। কারণ বামপন্থীদের মধ্যে (নকশাল) বিশ্বাস করত জঙ্গি আন্দোলনের মধ্য দিয়েই জমি আন্দোলনের সমস্যা নিষ্পত্তি সম্ভব। পরবর্তীকালে এই মতবাদ থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বামপন্থীরা (নকশাল) মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ভোটের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।
২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের সরকার বদলের পর জাতীয় কংগ্রেস আবারও উত্তরবঙ্গে প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হয়। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালে কেন্দ্রে সরকার বদলের ফলে বিজেপি সরকার গঠন হয়। বিজেপি সরকার তথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজির উদ্যোগে অবশেষে ৩০ শে নভেম্বর ২০১৫ ছিট মহল সমস্যা সমাধান হয়। তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন এক বাঙালি শ্রীযুক্ত প্রণব মুখার্জি মহাশয়।
আসলে সারাদেশেই তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতিদের প্রতি কংগ্রেসীদের যত্নবান না হবার ফলে এবং বামপন্থীদের ক্ষমতা চ্যুত হবার পর একটা বড় শতাংশ ভোটার ভারতীয় জনতা পার্টির ওপর আস্থা রাখে। ২০১৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রীযুক্ত রামনাথ কোবিন্দ (তপশিলি জাতি) মহাশয় নির্বাচিত হন। আর এখান থেকেই শুরু হয় বিজেপির জয়যাত্রা। ২০১৯ সালে ফল স্বরূপ ভারতীয় জনতা পার্টি উত্তরবঙ্গে অভাবনীয় ফল করে। পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবারের জন্য চল্লিশ শতাংশের বেশি ভোট পায় (লাভ করে ১৮ টি লোকসভা আসনে জয় লাভ করে।)
মূলত এখানকার তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি এবং ১৯৭১ এর যুদ্ধের পর বাংলাদেশ গঠন হওয়ার ফলে একটা বড় অংশ হিন্দু সম্প্রদায় উত্তরবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হয়। তারা উত্তরবঙ্গে ভারতীয় জনতা পার্টিকে বিপুল জনসমর্থন দিয়েছিলেন। বর্তমানে উত্তরবঙ্গে জাতীয় সড়ক থেকে রেললাইন সম্প্রসারণ মাধ্যম দিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থাকে উন্নত করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি প্রকল্পগুলি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করা।
গত ২০১৯ সালে ভোটে সমগ্র ভারতবাসীর কাছে ভারতীয় জনতা পার্টি অঙ্গীকার পত্র ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীরকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তুলে ধরা যার ফলস্বরপ জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করা, জঙ্গীযোগ এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ যথেষ্ট হ্রাস পাওয়া, বিগত দিনের থেকে প্রচুর পরিমাণে সারা বছর পর্যটকের যাওয়া আসা, সমগ্র জাতীয়তাবাদী মানুষের উপর ভীষণভাবে প্রভাব পড়েছে।
২০২২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মু নির্বাচিত হন। তিনি তপশিলি উপজাতি শ্রেণী ভুক্ত।বিরোধীদের ভারতীয় জনতা পার্টির বিরুদ্ধে শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে বিরোধিতা করার রাস্তা ও বন্ধ হয়ে গেছে।
লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাননীয় অমিত শাহ জী নাগরিকত্ব আইন চালু করার ফলে প্রতিবেশী দেশ থেকে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব পাওয়ার প্রক্রিয়া সরলীকরণের মাধ্যমে দেওয়ার উদ্যোগ শাসক তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিরোধীদের কাছে যথেষ্ট মিথ্যা রাজনীতি অপপ্রচারে চাপের কারণ।
সালটা ২০২২, তারিখ ৪ অক্টোবর দুর্গাপূজার প্রতিমা ভাসান করতে গিয়ে জলপাইগুড়ি মাল নদীতে হড়পা বানে অসংখ্য মানুষ ভেসে যায়। স্থানীয় প্রশাসন ৮ জনের মৃতদেহ সনাক্ত করতে সক্ষম হয় কিন্তু নিখোঁজের সংখ্যা ছিল অজানা। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ ছিল, তৃণমূল পরিচালিত পুরসভার অসতর্কতার জন্যই এই প্রাণহানি বা বিপর্যয়। স্বজন হারা আর্তনাদ আজও মানুষ মনে রেখেছে।
৪ অক্টোবর ২০২২ প্রাণঘাতি বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই ২০২৩ সালে তিস্তা নদীর অস্বাভাবিক জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। এই সময় তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনৈতিক চাপান-উতর স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়তে থাকে।
সমতল থেকে পাহাড় পর্যন্ত বিস্তীর্ণ চা বাগানের শ্রমিক শ্রেণী থেকে শুরু করে জলপাইগুড়ি রাজবংশী সম্প্রদায় যা তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতি শ্রেণীভুক্ত মানুষ ততদিনে নিজেদের জাতির প্রতিনিধি তথা ভারতবর্ষের সর্বোচ্চ পদাধিকার রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে শুধু ই পশ্চিমবঙ্গই নয় সারা ভারতবর্ষ জুড়ে তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতি সম্প্রদায় মানুষ ভারতীয় জনতা পার্টিকে সম্মিলিতভাবে নিঃস্বার্থ সমর্থন করে চলেছেন।
আজকের দিনে কারুরই অজানা নয় এই তৃণমূল কংগ্রেস এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে ঘিরে এই তপশিলি জাতি এবং উপজাতিকে সমর্থন দেননি।
প্রথম দফা এবং দ্বিতীয় দফায় ভোট শতাংশ কম হওয়ার কারণ একটা হল, শাসক তৃণমূল কংগ্রেস অনেক চেষ্টা করেও ভোটের আগে হুমকি ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি করেও জাতীয় নির্বাচন কমিশনারের তৎপরতায় প্রক্সি বা ছাপ্পা ভোট করতে অসমর্থ হওয়ায়।
দিনে দিনে তৃণমূল কংগ্রেসের অধীনে থাকা পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পৌরসভা এবং পৌরনিগমের যে লাগামহীন দুর্নীতি মানুষ এতে নিঃশব্দে বিপ্লবের পথে হেঁটেছেন। ২০১১ সালে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরিবর্তনে সমস্ত স্তরের মানুষ জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সামিল হয়েছিলেন আর তখন তৃণমূল কংগ্রেসের স্লোগান ছিল “বদলা নয় বদল চাই”। ফলাও করে বলা হয়েছিল ডিজে নয় চারিদিকে রবীন্দ্র সঙ্গীতের কথা। আর মানুষ দেখল চারিদিকে উৎসবের নামে মানুষের করের টাকায় চলতে থাকা বাঘা তেঁতুলদের গানের তালে তালে নিজেদের না পাওয়া ইচ্ছাগুলোকে চরিতার্থ করা।
হ্যাঁ, ঠিকই। বদল অবশ্যই হয়েছে। মানুষকে পরিষেবার নাম করে কাটমানি, মানুষকে শোষন এবং তোষন নীতি, মিথ্যাচার আজ তৃণমূল কংগ্রেসের রন্ধে রন্ধে ঢুকে পড়েছে। যা প্রকাশে বেরিয়ে পড়েছে ২৫ এবং ৭৫ এর টাকা শতাংশ ভাগের কথা।
গণতন্ত্রের উৎসবের নামে লুট করা হয়েছে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। বর্তমানে শাসক তৃণমূল কংগ্রেস দুর্নীতির জালে এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে সেখান থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। এমত অবস্থায় ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের প্রথম দফা গত ১৯ এপ্রিল কোচবিহার নিশিথ প্রামানিক, আলিপুর দুয়ার মনোজ টিগ্গা ,জলপাইগুড়ি ডাক্তার জয়ন্ত কুমার রায় এবং দ্বিতীয় দফা গত ২৬ এ এপ্রিল দার্জিলিং রাজু বিস্তা, রায়গঞ্জ কার্তিক পাল,বালুরঘাট ডক্টর সুকান্ত মজুমদার এই ছটি কেন্দ্রেই ভারতীয় জনতা পার্টির মনোনীত প্রার্থীরা জয়লাভ করার সম্ভাবনা প্রবল।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতি কড়চা
