



এই সময়ের পরিচিত মুখ কবি কুন্তল দাশগুপ্ত। লেখেন গল্প, কবিতা, গদ্য। লেখকের বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পুস্তক পাঠক মহলে সমাদৃত। সাশ্রয় নিউজ-এর এই নিয়মিত লেখক পাঠকদের জন্য লিখছেন স্যাটায়ারধর্মী লেখাটি।
একটা গঙ্গুলে জল্প
কুন্তল দাশগুপ্ত
সিংহটার দাপট ছিল খুব। বাঘে গোরুতে জল খেত এক ঘাটে। বাঁদরদের বাঁদরামি গুটিয়ে যেত এক হাঁকারে। সক্কলে বেশ ছিল।
দিন কি আর একভাবে চলে? সিংহটার যে কী হল! শিকারের যোগান নির্বিবাদে পেতে পেতে তার হাঁকারের জোর গেল ক’মে আর সেই অবসরে বাঁদরগুলোর বাঁদরামি উঠল চরমে। সিংহ দেখেও দেখলে না।
গাধা চরছিল নদীর ধারে। চড়াই, যে নাকি খুব ভীতু সে গিয়ে গাধাকেই ধ’রে পড়লে। ‘করো না বাপু কিছু একটা, বাঁদরামি যে আর সহ্য হয় না ‘। চড়াই-এর কথা শুনে গাধা ভাবলে তার কিছু একটা করা কর্তব্য বটে। তবে গাধা কিনা গাধা, সে কোথা থেকে কাঠিতে ক’রে আগুন এনে তাই ছড়িয়ে দিলে জঙ্গল মহলে।
শুকনো পাতায় ভালোই ধরে গেল আগুন। সক্কলে বলল সিংহটার অপদার্থতার জন্যই এই আগুন। সবাই মিলে সিংহটাকে ধরে তার ছাল ছাড়িয়ে তাকে পাঠিয়ে দিলে দূরে নির্জন পাহাড়ের গুহায় আর সিংহের ছাল পরিয়ে দিলে গাধাটাকে। সিংহের ছাল পরে গাধা বসলে পশু শাসন করতে।
জঙ্গলে শুরু হল গাধাতন্ত্র।
বাঁদরগুলো তক্কে তক্কে ছিল। ঘিরে দাঁড়ালে গাধার চারপাশে। গাধাও দেখলে তার পিঠ চুলকানোর হাত চাই। সেও বাঁদরগুলোকে কাছে টানলে। পোড়া জঙ্গলে বাঁদরামি উঠল বেড়ে।
গাধার চিরকাল গান গাওয়ার শখ। সে বাঁদর বাহিনীর তদারকিতে গান করলে শুরু। তোতার দল আহা উহু করতে করতে সেই রাসভ কীর্তন গলায় তুলে নিলে। বুলবুলি বললে, ‘এ কি গান ?’ গাধা তো গাধা, সে হ্রস্বই দীর্ঘঈ এর তফাৎ বোঝে না। বুলবুলির কথায় সে যারপরনাই আহ্লাদিত হল। কেবল কোকিল গুরু গম্ভীর হয়ে গেলেন।
কোকিল আর গান ধরেন না। জঙ্গলে বসন্ত এসে খর নিদাঘে গড়িয়ে গেল কুহুতান ছাড়াই।
জঙ্গলে ঘাসজমিগুলো সব বাঁশবন হয়ে গেছে, শেয়ালের তো পোয়াবারো। এমনিতে শেয়াল রাতের কারবারি কিন্তু জঙ্গলে এখন কিবা দিন কিবা রাত, তাই সর্বক্ষণই শেয়াল চরে। সিংহের ছালটার ওপরে শেয়ালের ভারী লোভ। কিন্তু কীভাবে পাবে সেটা, ওরা যা ভীতু!
ওদের আবার খুব ভুতের ভয়। বক কিনা খুব ধার্মিক তাই সে এক পায়ে ধর্মের ধ্বজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর চোখ রাখে মাছের দিকে, তো শেয়ালের ভুতের ভয় তাড়াতে গম্ভীর মুখে বকধার্মিক তাকে রাম নাম জপতে বললে। সব শেয়ালের তো এক রা ,তাই শেয়ালের দল শোরগোল পাকিয়ে তুললে রাম নামে।
এদিকে একদল তোতাও নতুন জপের মন্ত্র পেয়ে খুব হেঁকে ডেকে শুরু করলে রামনাম জপা। গাধারাজের জলসায় তারিফদার গেল একটু কমে।
গাধারাজের গানের গুঁতোয় জঙ্গলে তো কাক বসে না তাই বশংবদ বাঁদরের দল গাছে গাছে কাকের ছবি টানিয়েছে। তারা সেই ছবির আড়াল থেকে গাধারাজকে বললে, ‘ রামনাম তো ভুতের হিসেব নেবে আপনি ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে গান চালিয়ে যান ‘। এই শুনে গাধারাজ হৃষ্টচিত্তে তার কীর্তন আরোও ঘনিয়ে তুললে।
বাঁদর গুলো সুযোগ বুঝে টুনটুনির ধন হাতিয়ে নিলে, তাই দেখে বকধার্মিক বললে, ‘ এ তো ধর্মে সইবে না ‘। এই বলে সে ফেউকে পাঠিয়ে দিলে ব্যাপারটার তদন্তে।
ফেউ দেখে গাধারাজ এমনি তাল ঠুকতে আর তানকারি করতে শুরু করলে যে ফেউ-এর কানে লেগে গেল তালা।
গাধারাজের দৌলতে বাঁদরদের ধর্ম রক্ষা পেলে। বাঁদর তো আসলে হনুমানেরই জাতভাই, রামভক্তি ওদের রক্তে সে কথা গাধারাজ বিলক্ষণ জানে আর তাই নিশ্চিন্ত মনে গাইতে থাকলে এইটা বুঝে নিয়ে যে সিংহের ছালটা তার গায়েই রেখে ধর্মাচরণ ক’রে যাবে বক আর তার অনুগত শেয়াল, বাঁদর, তোতার দল।
জঙ্গলে হল্লাগুল্লা উঠল চরমে। তার ধাক্কা গিয়ে সেঁধুলো দূরে পাহাড়টার গুহায়। সিংহটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলে। তার গায়ের ঘা সেরে
এসেছে। নতুন চামড়া গজিয়েছে। কেশরের গাম্ভীর্য আগের মত ফেঁপে ওঠেনি বটে তবে সেটুকু তো কেবল সময়ের অপেক্ষা।
সিংহটা গুহা থেকে বেরিয়েই মুখোমুখি পড়ে গেল খরগোশের। হল্লাগুল্লায় অতিষ্ঠ খরগোশ জঙ্গল থেকে পালিয়ে পাহাড়ে উঠছিল কোনো পাথরের খাঁজে একটু নিশ্চিন্তে ঝিমুবে বলে। কিন্তু সিংহের সামনে পড়েই হল বিপত্তি।
দুজন দুজনের দিকে ড্যাবড্যাব ক’রে তাকিয়ে রইলে। সিংহ ভাবছিল খরগোশ বুঝি তাকে আবার ইঁদারায় ফেলবার মতলবে এসেছে আর খরগোশ ভাবছিল সিংহটা নিশ্চয়ই তার হেনস্থার শোধ তুলবে এইবার। একে অপরের দিকে চেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।
নিশ্বাস রুদ্ধ ক’রে জঙ্গল অপেক্ষা করতে লাগল বিশ্বাস ফিরে আসবার।।
খরগোশটা সিংহের ওপর বিশ্বাস রাখতে পারলো না। নিজের গতির ওপর খরগোশের বিপুল আস্থা, তাই সে পিছু ফিরে দিল দৌড়, ফের গিয়ে ঢুকলো জঙ্গলে। শেয়াল ছিল তক্কেতক্কে। সে তো জানে যে খরগোশটা প্রাণভয়ে দৌড় মেরেছে পেছন দিকে, তাই সে ছুটন্ত খরগোশের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে হেঁকে বললে — “ভয় কী? ভয় কী? রাম নামে ভয় ভাঙে, তেড়ে রাম নাম করো “।
শেয়ালের হাঁক শুনে থমকালো খরগোশ। এদিকে পাহাড়ের ওপর থেকে সিংহটা বলেই চলছিল,” ভয় পেও না ,ভয় পেও না, ভয় ভাবলেই ভয়
খরগোশ কান খাড়া ক’রে শুনলো সিংহের কথাগুলো কিন্তু তার মনে এখনও সিংহকে ভেট পাঠানোর স্মৃতি জ্বলজ্বলে তাই সে ভাবলে এ নিশ্চয়ই সিংহের একটা ছল, তাকে তুইয়ে তাইয়ে আবার জঙ্গল কব্জা করার মতলব। খরগোশ মাথা চুলকোতে লাগলো। ততক্ষণে রামভক্ত হনুমানেরা তাকে ঘিরে ধরেছে।শেয়ালও সমানে বলে চলেছে, “রাম নাম কর, রাম নাম কর “। রাসভকীর্তনে বিরক্ত আর সিংহে আস্থা টলে যাওয়া খরগোশ ভাবলে দেখিই না কী হয় , এই ভেবে সে রাম ধুনে গলা মেলালে।
এদিকে গাধারাজের কীর্তনসভায় ধরেছে ভাটার টান। শুধু ভেড়ার পালের গোদাকে বকশিস টকশিস দিয়ে গাধারাজ এমন বশ করেছে যে গোদা আর কীর্তনসভা থেকে নড়তেই চায়না। ভেড়াদের রীতি হল পালের গোদাকে প্রশ্নহীন অনুসরণ, তাই ভেড়ার পালও সভা আলো ক’রে বসে থাকে। গাধারাজ ভেড়া আর তার বশংবদ বাঁদর দলের তারিফ পেয়ে কীর্তন আরোও ঘনিয়ে তোলে আর ভাবে হনুমানগুলোর লাফালাফিই সার, শেয়াল কখনই তার গায়ে চাপানো সিংহের ছাল কব্জা করতে পারবে না। খরগোশের অনুপস্থিতি গাধার চোখেই পড়ে না। রামনামে মত্ত খরগোশকে শেয়াল বলে, “দেখেছে, ভেড়াগুলো ঘাস খেয়ে খেয়ে ঘাসজমিগুলোকে কেমন ন্যাড়া করে ফেলেছে, তোমাদের পেটে টান পড়লো ব’লে । যদি বাঁচতে চাও তবে ভেড়াগুলোকে শায়েস্তা করো “। খরগোশ নির্বিরোধী প্রাণী। নিজেদের মধ্যে খুনসুটি, কামড়াকামড়ি করেছে বটে তবে অন্য জাতিকে কামড়ানো তার ধাতে নেই। সে শিয়ালের উসকানিতে প্রথম প্রথম পাত্তা দিলে না, কিন্তু শেয়াল হরবখত খরগোশের কানের গোড়ায় প্যাচাল পাড়তে লাগল, “ভেড়াগুলোকে শায়েস্তা করো, করো করো”। অতিষ্ঠ খরগোশ গেল বকধার্মিকের কাছে কর্তব্য স্থির করতে। বক কিনা ধার্মিক, সে তাই মাছের দিক থেকে চোখ সরালো না কিন্তু কান তার খোলা সে খরগোশের কথা শুনে গম্ভীর গলায় বলল, ” তোর দাঁত আছে কেন? ” খরগোশ বললে ,”কেন আবার, আখরোট ভাঙতে”। বক বললো , “ঐ দাঁত দিয়ে ভেড়াগুলোকে কামড়ে কামড়ে বিষিয়ে দে, নইলে আখরোট আর পেতে হচ্ছে না, সব ওরাই ফাঁকা করে দেবে”।
বকের ধর্মকথায় খরগোশ ভুলে গেল তার নিজস্বতা। সে তার জাতভাইদের বোঝাতে লাগল দাঁতের যথার্থ ব্যবহার। বাস, জঙ্গলের সব খরগোশ দাঁত শানিয়ে ভেড়ার পালের ওপর চড়াও হল। ভেড়ারাও তাদের শিং-এর ব্যবহারে পিছিয়ে রইলো না । জঙ্গলে শুরু হল ভয়ংকর কামড়াকামড়ি আর গুঁতোগুঁতি। এ সব থামাতে গাধারাজ চীৎকার করে চললো বটে কিন্তু ভেড়া বা খরগোশ কেউই তাতে কর্ণপাত করলে না। এই হুড়োহুড়িতে গাধারাজের বশংবদ বাঁদর দলের কেউ কেউ হনুমানদের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতিয়ে ফেললে। শেয়াল দেখলে এই সুযোগ, দল পাল্টানো বাঁদর দিয়েই গাধারাজের গায়ে থাকা সিংহের ছাল ছিনিয়ে নিতে হবে।
শেয়ালের ফোসলানিতে উত্তেজিত দল পাল্টানো বাঁদরগুলো চরম কামড়াকামড়ি আর গুঁতোগুঁতির মধ্যেই গাধারাজের গায়ের সিংহের ছালে দিল টান। এই গণ্ডোগোলের মধ্যে কে যেন আবার জঙ্গলের শুকনো পাতায় ধরিয়ে দিলে আগুন,সে যে কে তা বোঝা গেল না তাই সবাই সবাইকে জোর গলায় দোষারোপ করতে লাগলো।
সিংহটা দূর থেকে দেখতে লাগলো তার সাধের জঙ্গল কিভাবে পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে।
আগুন লাগতেই ধার্মিক বক নিরাপদ দূরত্বে উড়ে গিয়ে বসলে, তখনও তার চোখ দিঘির মাছের দিকেই। আগুন নির্বিবাদে খেলে বেড়াতে লাগলো জঙ্গলের বুকের ওপর দিয়ে আর উত্তর থেকে, দক্ষিণ থেকে, পুব থেকে, পশ্চিম থেকে হা হা ক’রে বয়ে যাওয়া বাতাসে ধ্বনি উঠল — রাম নাম সৎ হ্যায়, রাম নাম সৎ হ্যায়, রাম নাম…।
ছবি : আন্তর্জালিক
