Sasraya News

Sunday, March 16, 2025

Sasraya News Sunday’s Literature Special | Issue 56 | 16 March 2025 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | সংখ্যা ৫৬ | ১৬ মার্চ ২০২৫

Listen

সম্পাদকীয়

সামাজিক বৈচিত্রে বসন্ত। মেখে আছে, ভেসে আছে, দুলে আছে মনে মনে । আদরে আদরে। এই সদ্য শেষ হলো দোল উৎসব, হোলি, এই উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত হয় রং আবিরের সাজ সজ্জা। এই উৎসব ঘিরে দোলা দিয়ে ওঠে সমগ্র সমাজ।

বসন্ত ঋতু বাংলায় একটি বিশেষ মাত্রা নিয়ে আসে। এই ঋতু আমাদের সৌন্দর্য, জীবনের নতুন শুরু এবং নতুন সম্ভাবনার প্রতীক রূপে ভাবা হয়ে থাকে। বসন্ত সাধারণত মাঘের শেষ থেকে ফাল্গুন, চৈত্র থেকে বৈশাখ মাসের শুরু পর্যন্ত হয়ে থাকে, কোকিলের কলতান, পাখিদের গুঞ্জন এবং বলা যায় যে, এ সময়ে প্রকৃতি নানা রঙের ফুলে ফুলে ভরে যায়।

সামাজিক বৈচিত্রে বসন্ত ঋতুর অভিব্যক্তি বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়ে। হাসিখুশিতে কেটে যায় বসন্তের দিনগুলি। বলা যায়, বাংলার মানুষের জীবনধারা, সংস্কৃতি এবং আচার-ব্যবহারে বসন্ত ঋতুর বিশেষ ভাবেই গুরুত্ব রয়েছে। বসন্তের আগমনে মানুষ বিভিন্ন উৎসব পালন করেন, যেমন বসন্ত উৎসব, বৈশাখী উৎসব ইত্যাদি। এই উৎসবগুলোতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ ঘটে, ফলে বিভিন্ন ভাবে যা সমাজের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে বলেই বোঝাও যায়।

 

ছবি : প্রতীকী। সংগৃহীত

 

বসন্তের সময় মানুষ উৎসাহী হয়, এবং নতুন নতুন পোশাক পরে, গাছে গাছে ফুলের মেলা এবং মানুষে মানুষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে। এই সময় সাধারণত মেলা, গান, নাচের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে, যা মানুষের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শক্তিশালী করে।

প্রকৃতির ঠিক মতো পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনের মধ্যে নতুন আশা, নতুন উদ্যম এবং নতুন সংকল্প জাগ্রত হয়। বসন্ত ঋতু সমাজের সামগ্রিক আবহাওয়া পরিবর্তন করে, যেখানে আনন্দ, উদ্দীপনা এবং নতুনত্বের অনুভূতি দেখা যায়।

সুতরাং, বসন্ত ঋতু শুধু একটি ঋতু নয়, বরং এটি বাংলার সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা সামাজিক বৈচিত্র্যকে উদ্‌যাপন করে এবং নতুন উদ্দীপনায় সমাজকে বলবৎ রাখে। ভালোবাসায় রাঙিয়ে দেয় প্রতিটি হৃদয়। প্রেমে ফুলে ফুলে সাজিয়ে তোলে নতুনের আগমনীর বার্তা।🍁

 

 

🍂মহামিলনের কথা

 

নব নব রূপে এসো

কিঙ্কর বিঠঠল রামানুজজী মহারাজ

 

 

শুদ্ধাহার সদাচার কালে উপাসন 

১.
শুদ্ধাহার

অধ্যাত্মজগতে প্রবেশলাভের জন্য বা উচ্চ অনুভবলাভের জন্য যে তিন বিষয়ে সর্বাগ্রে অবহিত হতে হবে শ্রীশ্রীঠাকুরের মতে সেগুলি হল : শুদ্ধাহার, সদাচার ও যথাকালে উপাসনা। শুদ্ধাহারের অর্থ আহারশুদ্ধি। আহারশুদ্ধি বিষয়ে সর্ব্বশাস্ত্র শিরোরত্ন বেদান্ত বলেছেন :
আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধিঃ সত্ত্বশুদ্ধৌ ধ্রুবা স্মৃতিঃ।
স্মৃতিলম্ভে সর্বগ্রন্থীনাং বিপ্রমোক্ষঃ।।
( ছন্দোগ্য উপনিষদ ৭/২৬ )
অর্থাৎ আহারশুদ্ধ হলে সত্ত্বশুদ্ধি বা অন্তঃকরণ শুদ্ধ হয়, আর সত্ত্বশুদ্ধি হলে, আত্মা বা পরমাত্মার নিশ্চলা স্মৃতিলাভ হয় ; এইরূপ ধ্রুবাস্মৃতির দ্বারা সমস্ত হৃদয়গ্রন্থির বিমোচন বা বিনাশ হয়।
‘ আহারশুদ্ধি ‘ দ্বারা আচার্য্য রামানুজ খাদ্যাখাদ্যের বিচার বলেছেন। আহারশুদ্ধি ঠিকমতো বজায় রাখতে গেলে আহার-সম্বন্ধিয় তিনটি দোষ পরিহারে সচেষ্ট থাকতে হয় —- জাতিদোষ, আশ্রয়দোষ ও নিমিত্তদোষ। প্রথমত ‘জাতিদোষ ‘—- খাদ্যে জাতিদোষের অর্থ হল খাদ্য বিশেষে প্রকৃতিগত যা দোষ তাই যেমন — মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ রসুন প্রভৃতি স্বভাবতই উগ্র, উত্তেজক ও অপবিত্র। খাদ্যের দ্বিতীয় দোষের নাম ‘আশ্রয়দোষ ‘। আশ্রয় দোষের অর্থ হল যে ব্যক্তির কাছ হতে আমরা খাদ্য গ্রহণ করছি তার সংস্পর্শে খাদ্যমধ্যে যে দোষ সঞ্চারিত হচ্ছে তাকেই বলে ‘আশ্রয় দোষ ‘। অশুচি বা চরিত্রহীন ব্যক্তির কাছে কোন খাদ্য গ্রহণ করলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রদত্ত খাদ্যে অপবিত্র পরমাণু সংক্রমিত হয়। এমনকি অপবিত্র ব্যক্তি যদি খাদ্য পরিবেশন করে অথবা তার সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে কেউ আহার্য্য গ্রহণ করে তার দ্বারাও অপবিত্র ভাব সঞ্চারিত হবার সম্ভাবনা থাকে। আহার বিষয়ে তৃতীয় দোষ হল ‘ নিমিত্ত দোষ ‘। এটি বোঝা খুবই সোজা। খাদ্য বস্তুর মধ্যে ধূলি, পোকামাকড়, কেশ ইত্যাদির সংস্পর্শ ঘটে গেলে যে দোষ সৃষ্টি হয় তাকেই বলে ‘ নিমিত্ত দোষ ‘। অপরের উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করলে একই দোষ সংক্রমিত হয়।
উপনিষদের উপরোক্ত শ্লোকের আর এক ব্যাখ্যা করেছেন আচার্য্য শঙ্কর। তাঁর মতে ‘আহ্রিয়তে ইতি আহারঃ ‘ অর্থাৎ যাহা কিছু গ্রহণ করা হয় তাহাই আহার। সুতরাং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়সমূহকেই ‘আহার ‘ বলে। তাহলে আহারশুদ্ধির ঠিকঠিক অর্থ দাঁড়ালো ইন্দ্রিয়-বিষয়ে যাতে আমাদের আসক্তি না আসে তার জন্য আমাদের বিষয়সম্পর্কিত দোষগুলি বর্জন করতে হবে। প্রথমত ঈশ্বর ভিন্ন আর কোন বিষয়ে তীব্র আসক্তি থাকবে না। দ্বিতীয়ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোন বিষয় নিয়ে আমাদের অন্তরে যেন ঈর্ষা বিদ্বেষ উৎপন্ন না হয়। বিষয়জাত এই ঈর্ষা বা দ্বেষ আমাদের পরিহার করে চলতে হবে। বিষয়জাত তৃতীয় দোষ হল ‘মোহ ‘। নানাভাবে আমরা বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মোহমুগ্ধ হয়ে যাই। শংকরাচার্য্যর মত-অনুসারে অনুরাগ, ঈর্ষা, মোহরূপ বিবিধ দোষশূন্য হয়ে ইন্দ্রিয়ের বিষয় সমূহকে গ্রহণ করার মানসিক পদ্ধতিটিকেই ‘আহারশুদ্ধি ‘ বলে। এইরূপ আহারশুদ্ধি অর্জন করলেই ‘সত্ত্বশুদ্ধি ‘ লাভ হয় এবং সেই সত্ত্বশুদ্ধির দ্বারা ঈশ্বরের স্মরণ মনন অখণ্ডভাবে চলতে থাকে। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে আচার্য্য রামানুজ যখন আহার শুদ্ধির দ্বারা স্থূল খাদ্যবস্তুর শুদ্ধির কথাই বলেছেন, আচার্য্য শঙ্কর সেক্ষেত্রে আহারশুদ্ধির দ্বারা সূক্ষ্মভাবে ‘চিত্তশুদ্ধি ‘ বুঝিয়েছেন।
বর্তমান যুগের যুগনায়ক স্বামী বিবেকানন্দ আচার্য্য শঙ্কর ও আচার্য্য রামানুজের এই দুই মতের মধ্যে বড় সুন্দর সমন্বয় সাধন করে বলেছেন : শঙ্কর ও রামানুজের ব্যাখ্যা দুইটি আপাত বিরোধী বলিয়া বোধ হইলেও উভয়টিই সত্য ও প্রয়োজনীয়। সূক্ষ্ম শরীর সংযম করিতে হইলে অগ্রে স্থূলের সংযম বিশেষ আবশ্যক। অতএব আহার সম্বন্ধে গুরুপরম্পরা যে সকল নিয়ম প্রচলিত আছে, প্রবর্তকের পক্ষে সেগুলি পালন করা আবশ্যক। (স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ৮৮ পাতা, ৪ র্থ খন্ড)।

২.

ব্যক্তিগত ভাবে অধ্যাত্ম-জগতে উচ্চস্থিতি নিবন্ধন জ্ঞানাগ্নির দ্বারা খাদ্যাখাদ্য পরিপাকের শক্তি স্বামী বিবেকানন্দ অর্জন করলেও আহারশুদ্ধির বিষয়ে আচার্য্য রামানুজের মতবাদ প্রবলভাবে সমর্থন করে স্বামী বিবেকানন্দ বলছেন —‘আরও কতপ্রকার খাদ্য আছে, সেগুলি শরীরে পরিবর্তন সাধন করে, পরিণামে মনকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ইহা একটি বিশেষ শিক্ষণীয় তত্ত্ব। আমরা যত দুঃখভোগ করিয়া থাকি তাহার অধিকাংশই আমাদের আহার হইতে জাত। আপনারা দেখিয়াছেন, অতিরিক্ত ও গুরুপাক ভোজনের পর মনকে সংযত করা বড়ই কঠিন, তখন মন অবিরত ছুটিতে থাকে। কতকগুলি খাদ্য উত্তেজক — সেইগুলি খাইলে দেখিবেন, মনকে সংযত করিতে পারিতেছেন না। অধিক পরিমাণে সুরা বা অন্যান্য মাদকদ্রব্য পান করিলে মানুষ বুঝিতে পারে, মনকে আর সংযত রাখা যাইবে না। মন তাহার আয়ত্তের বাহিরে চলিয়া যায়। সর্বপ্রকার উত্তেজক খাদ্য পরিত্যাগ করিতে হইবে….. যথা, মাংস। মাংসাহার ত্যাগ করিতে হইবে, কারণ উহা স্বভাবতই অপবিত্র। ( স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ৮৯ পাতা,৪র্থ খন্ড )।
….. ভক্ত হইতে গেলে মাংস ভোজন পরিত্যাগ করিতে হইবে। এতদব্যতীত অন্যান্য উত্তেজক খাদ্য যথা পেঁয়াজ, রসুন, সাওয়ার ফ্রুট প্রভৃতি দুর্গন্ধ খাদ্য ত্যাগ করিতে হইবে। আরও পূতি, পর্যুষিত এবং যাহার স্বাভাবিক রস প্রায় শুকাইয়া গিয়াছে, এরূপ খাদ্যও বর্জন করিতে হইবে। ( স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা ৮৯ পাতা ৪র্থ খন্ড )।
সর্বশাস্ত্রসার শ্রীমদভগবৎ গীতা আহারকে সাত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এই তিনভাগে ভাগ করে সাত্বিক আহারই যে গ্রহণীয় এবং রাজসিক ও তামসিক আহার যে বর্জনীয় এই নির্দেশই প্রকারান্তরে দান করেছেন : যে সকল আহার সত্ত্ব, বল, আরোগ্য, সুখ ও প্রীতির বর্ধক, রসযুক্ত স্নিগ্ধ যাহার সারাংশ দেহে স্থায়ীভাবে থাকে এবং যাহা চিত্ত তৃপ্তিকর তাহাই সাত্বিকদিগের প্ৰিয়। অতি কটু, অতি অম্ল, অতি লবন, অতি উষ্ণ, অতি তীক্ষ্ণ, রুক্ষতাকারুক তাপ-বর্ধক, দুঃখ-শোক-রোগ-জনক এতাদৃশ আহার রাজস ব্যক্তিগণের প্ৰিয়। যে খাদ্য অর্ধ পক্ক বা অতি পক্ক বা অতি শীতল, নীরস বা শুষ্ক, যাহা দুর্গন্ধ, পূর্বদিন পক্ক, উচ্ছিষ্ট ও যাহা যজ্ঞাবশিষ্ট নহে এজন্য অশুচি, তাহাই তামসগণের প্ৰিয়।
(শ্রীমদভগবৎ গীতা ১৭/৮,৯,১০)

 

৩.

সমস্ত শাস্ত্রগ্রন্থ, মুনিঋষিগণ এবং বর্তমানকালের অধিকাংশ সাধু মহাত্মাগণই অধ্যাত্ম- জীবনে উন্নতি লাভের জন্য শুদ্ধাহার তথা নিরামিষ আহারের উপরই বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এই বিষয়ে সর্বপেক্ষা স্পষ্ট বিবৃতি রয়েছে শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী বিষয়ে সুবিখ্যাত গ্রন্থ শ্রীশ্রীসদগুরু সঙ্গে। সেই মহামূল্যবান গ্রন্থ হতে কিছু একান্ত প্রয়োজনীয় উদ্ধৃতি : মধ্যাহ্নে গোস্বামী মহারাজের নিকটে গেলাম। নির্জনে অবকাশ পাইয়া বলিলাম ‘ সাধনের সময়ে যে সব দর্শন হইত, এখন আর তাহা কিছুই হয় না।
গোঁসাই — অনেকপ্রকার অনিয়মে ওরূপ হয়ে থাকে। আহারাদির অনিয়মেও দর্শন বন্ধ হয়। আমি — মাছ, মাংস কখনও খাই না। উচ্ছিষ্ট খাওয়ারও তো সম্ভাবনা নাই।….. গোঁসাই — তা বললে কি হয় ? কারও আকাঙ্খার বস্তু, লোভের বস্তু, তাকে না দিয়ে খেলে অনিষ্ট হয়। কোন তমোগুণাক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে এক আসনে বসে আহার করলেও অনিষ্ট হয় ; এমনকি একস্থানে বসে খেলেও হয়। আহারের বস্তুতে তমোগুণীর দৃষ্টি পড়লেও ক্ষতি হয়। এসব বিষয়ে যখন দৃষ্টিটি খুলে যাবে, পরিষ্কার দেখতে পাবে, এসব লোকের দৃষ্টিমাত্র আহারের বস্তুতে কিটাণু ব্যাপিয়া পড়ে। এসকল পূর্বে তো কিছুই বুঝতে পারতাম না, মানতামও না। কিন্তু প্রত্যক্ষ হলে আর অবিশ্বাস করে কিরূপে ? আহারের বস্তুতে লোকের সংস্পর্শে ও দৃষ্টিতে বিশেষ অপকার করে। তমোগুণাক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টি আহার্য্য বস্তুতে পড়লে উহা ভোগে লাগে না, নষ্ট হয়। এজন্য দরজা বন্ধ করে ভোগ প্রস্তুত করারও নিয়ম আছে। ভাবদুষ্ট, স্পর্শদুষ্ট, ও দৃষ্টিদুষ্ট বস্তু আহার করলে ক্ষতি করে ; দেবতাকে দিলেও অপরাধ হয়। আহারের দোষে অনেকপ্রকার উৎপাতের সৃষ্টি হয়, ওতে সমস্ত রিপুরই উত্তেজনা জন্মে। এইজন্য এইসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়।…. আহারটি সর্বশ্রেষ্ঠ ভজন। প্রণালীমত আহার করতে পারলে তাতেই সব হয়, আর কিছুই করতে হয় না। ( শ্রীশ্রীসদগুরুসঙ্গ, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১০০-১০১)।
আহারের জাতিদোষ, আশ্রয়দোষ, নিমিত্তদোষের কথা আগেই বলা হয়েছে। শ্রীশ্রীবিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীজীর উদ্ধৃতি থেকে এ বিষয়ে আরও কিছু সুস্পষ্টরূপে আমরা জানতে পারিলাম। শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব ইদানীংকালের এক অদ্বিতীয় শাস্ত্রমূর্তি। তিনি উচ্চকণ্ঠে নানা ক্ষেত্রে শাস্ত্রমহিমাই ঘোষণা করেছেন যা তাঁর সুদীর্ঘ অতুলনীয় অধ্যাত্মসাধনা তথা অনুভবের দ্বারাও সুপরিপুষ্ট। আহারশুদ্ধি বিষয়ে তাঁর সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য :
শ্রীভগবান বলেছেন —-
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্বিধম্।।১৪
—– আমি জঠরাগ্নি হয়ে প্রাণীদিগের শরীরের ভিতরে প্রবেশ করে তার উদ্দীপক প্রাণ অপান বায়ুর সহিত প্রাণীসকলের ভুক্ত ভক্ষ্য- ভোজ্য- লেহ্য- চোষ্য -চতুর্বিধ অন্ন পরিপাক করি। অগ্নিতে যদি উত্তম ঘৃতের দ্বারা হোম করা হয় তাহলে সেই হোম-ধূম-গন্ধ মানুষের দেহ মনকে পবিত্র করে। শুধু মানুষকে নয়, স্থাবর জঙ্গম পবিত্র হয় হোম-ধূম-গন্ধে। আর যদি সেই আগুনে পোড়ানো হয় মুরগি, মাছ, মাংস পেঁয়াজ, ডিম তখন দুর্গন্ধে সেখানে থাকা যায় না, শরীর অসুস্থ হয়, চরাচর প্রাণীগণের দেহমনকে সেই চামসা গন্ধ দূষিত করে দেয়। তদ্রুপ শ্রীভগবান জঠরাগ্নি হয়ে দেহে বিরাজ করছেন, তাতে মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, ডিম আহুতি দিলে তিনি সেই দুষ্ট অপবিত্র দুর্গন্ধ রজো তমোগুণ বর্ধক বিষাক্ত আহার্য্যগুলি পরিপাক করেন, সমান বায়ু সমস্ত শরীরকে তার দ্বারা পোষণ করে থাকেন, সেই বিষ সমুদয় শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, দেহের সমস্ত উপাদানগুলি বিষাক্ত হয়ে যায়। (অংশ বিশেষ)

[বানান অপরিবর্তিত ]

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৮

 

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।

 

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

 

আঠেরো.

চম্পা ফুলের মতো সেই হাসি আমাকে চমকে দিল

 

দু‘বছর বহু কষ্টে কাটিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে। কী করে প্রত্যেক মাসে টাকা যোগাড় হতো, কে কে পাঠিয়েছিলেন তা মনে আছে সবই। তবে বেশি মনে রেখেছি আমাদের দু’বছরের সিনিয়র দাদা নুরুল হককে। পাকুড়ের সীতেশ নগরে তার বাড়ি ছিল। এম-এ পাস করার পর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তাই সে পাটনাতেই থাকতো। বাড়ি থেকেই নিয়ে যেত চাল-আটা ও বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য। আমাকে ভাইয়ের মতোই এক আধবেলা সেসব খাবার দিত। তার সঙ্গেই ঘুরতে যেতাম পাটনার বহু জায়গায়। স্যারদের বাড়িতেও তার সঙ্গেই যেতে শিখেছিলাম। পাটনার বাঙালিটোলা, বাংলা একাডেমি এবং বইমেলাতেও তার সঙ্গেই গেছি। নুরুলদা ছিলেন মাটির মানুষ। খুবই সাদাসিধে এবং নিরহংকারী। বেশ কয়েকবার তার গ্রামের বাড়ি সীতেশ নগরেও গেছি। আম আর লিচুর বাগানে খাট পেতে ঘুমানোর আনন্দ এবং কলাইডালের রুটি খুব ভালোবেসেই খেয়েছি।

শিবেশ চ্যাটার্জি অবসর নেওয়ার পর আমাদের ডিপার্টমেন্টের প্রধান হন ললিতা সান্যাল। সে বছরই আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা। নুরুলদাও পাটনা ছেড়ে চলে যাবেন। পরীক্ষার পরে আমাদেরও আর কারো পাটনায় থাকার ইচ্ছা নেই। আমাদের সহপাঠী মিতালী চক্রবর্তী তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার আমাদের খাইয়েছে। রাজবাড়ির মতন তাদের বাড়ি। তার স্বামীও একটা বড় চাকরি করেন। একদিন আমাদের বললেন, “তোমরা যাবে কেন? এখানেই পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নাও। নেট পাশ করলেই অধ্যাপনার চাকরিতে নিয়োগ হওয়া সহজ।”

আমরা আপাতত সম্মতি জানিয়ে ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু এম-এ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে আর সেখানে টিকতে চাইনি। তাই সরাসরি সব গুটিয়ে নিয়ে বাড়ি এসেছিলাম।

 

কথাগুলি বলতে বলতেই আমার রুমার কথা মনে পড়লো। আমার প্রথম জীবনের সেই চুম্বন অনুভূতি। তারপর ভালোবাসা নিয়ে প্রথম কবিতা। একসঙ্গে চোখাচোখি হওয়া। কত কত মুহূর্ত নীরবতার মধ্যে পার করা। এসব ভাবতে ভাবতেই এক নিমেষেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

 

বাংলা ছেড়ে আমরা বিহারে থাকতে পারবো না এ বিষয়ে আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। তাই গঙ্গার তীরবর্তী কাটানো একান্ত মুহূর্তগুলি, ইউনিভার্সিটির সহপাঠীদের মনোরম হাতছানি, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের ভালোবাসা কোনো কিছুই আমাদের বেঁধে রাখতে পারেনি। মানসী সেনগুপ্তের কথা বেশ কয়েকবার মনে পড়েছিল, অন্তত চোখের দেখা দেখতে চেয়েও মন ব্যাকুল হয়েছিল, কিন্তু তাকেও আর খুঁজে পাইনি। শুধু মাঝে মাঝে পূর্ণেন্দু মুখোপাধ্যায় স্যারের কথা খুব মনে পড়তো। তিনি আমাদের পড়িয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। ওরকম কবিতার পাঠ আর কোথাও কখনো শুনিনি। তাঁর পাঠ শুনে মনে হতো জীবনানন্দ দাশ যেন আমাদের সম্মুখে দণ্ডায়মান। তাঁর অবচেতন মনের ক্রিয়াগুলিও স্পষ্ট হয়ে উঠতো আমাদের অনুভূতিলোকে। শুধু বাংলা ভাষা জানলেই জীবনানন্দ দাশকে বোঝা সম্ভব এ কথা আমরা মানতে পারতাম না। পূর্ণেন্দু স্যার যেমন ফরাসি সাহিত্য পড়েছিলেন, তেমনি গ্রিক, রোমান এবং ইংরেজি সাহিত্যও পড়েছিলেন। বলেই হয়তো জীবনানন্দ দাশকে সারাবিশ্বের সাহিত্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। ললিতা সান্যাল পড়াতেন ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য। রাবণের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের দীর্ঘশ্বাসও যেন মিশে যেত তাঁর পড়ানোর গুণে। বুঝতে পারতাম কবির আত্মরসায়ন কিভাবে মহাকাব্যের চরিত্রের মধ্যেও প্রতিফলিত হয়েছে। শিবেশ চ্যাটার্জি পড়িয়েছিলেন বিহারীলাল চক্রবর্তীর ‘সারদামঙ্গল’। সাধকের প্রাণের আকুতি কিভাবে মহাশূন্যে এক ঐশ্বর্যময় মহাব্যাপ্তির ধারক হয়ে ওঠে তা তিনি বুঝিয়েছিলেন। প্রিয়া প্রেম দেবী সেখানে একাকার। পাটনা ইউনিভার্সিটি যা দিয়েছিল তা গঙ্গার মতোই দু’কূল প্লাবিত করেই দিয়েছিল। চূড়ান্তভাবে সাহিত্যে দীক্ষা নিয়েই ফিরে এসেছিলাম বাড়ি।

ইতিমধ্যে এক্সচেঞ্জ অফিস থেকে কয়েকটি বিদ্যালয়ে ইন্টারভিউয়ের ডাকও এসেছিল, কিন্তু চাকরি পাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকার দাবি ছিল বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। এছাড়া ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের জেলা সেক্রেটারির সার্টিফাইপত্রও কর্তৃপক্ষ চেয়ে বসেছিলেন। দুটি ক্ষেত্রেই আমি অসফল হয়েছিলাম। হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরেও একটি পত্র লিখে আনতে পারিনি। বাড়িঘর বিক্রি করে দুই লক্ষ টাকা সংগ্রহ করাও আমার পক্ষে মুশকিল ছিল। কোনোমতেই বাড়ির দাম দুই লক্ষ টাকা হতো না। সুতরাং চাকরির আশা একপ্রকার ছেড়ে দিতেই হয়েছিল। এক্সচেঞ্জের আরো একটি কল পেয়েছিলাম পুলিশ ইন্সপেক্টর এর। যাবতীয় মাপজোক ও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও মোটেও আমি ছুটতে পারতাম না। সেক্ষেত্রেও কিছু টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকাও জোগাড় করার সামর্থ্য হয়নি।

শেষপর্যন্ত টিউশানি করাটিই একমাত্র জীবিকা হয়ে উঠেছিল। শুধু টিউশানি করাই নয়, লেখাপড়া শিখে বাবুয়ানা করা আমাদের মতো বাড়ির ছেলেদের সাজে না। সুতরাং মাঠে-ঘাটেও যেতে হতো কাজ করতে। ঘাসকাটা, গমকাটা, ধানকাটা ইত্যাদি কাজগুলো করতে হতো। এসব করতে করতেই পেয়ে যেতাম নতুন রসদ। ছাত্রজীবনে যাদের সঙ্গে কাজ করেছিলাম তারাই তখনও কাজ করে চলেছে। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গী হতে পেরে বরং খুশিই হতাম। দুপুরে গাছতলায় বসে কত-কী আলাপ হতো, ছায়ায় এলিয়ে দিত শরীর ও মন।

—কখন বিয়ে করছিস?

—আমাদের মতো গরিব বেকার ছেলেদের কে বিয়ে করবে বল?

—তুই তো অনেক লেখাপড়া করলি নিশ্চয়ই চাকরিও পাবি একদিন।

—সেই আশাতেই তো রয়েছি। কিন্তু এ যুগে টাকা না থাকলে চাকরি পাওয়া সম্ভব হবে না।

—সে কথা অবশ্য ঠিক। তবে চাকরি পেলেই তো আমাদের ভুলে যাবি। এই যে মাঠে একসঙ্গে ঘাস কাটছি, ধান কাটছি, বীজ তুলছি, মাটি কাটছি এসব কি তোর মনে থাকবে?

—অবশ্যই থাকবে এই জীবনের কথা কখনোই ভুলতে পারবো না।

—কোথায় কোথায় এতদূর পড়ে এলি কোনো মেয়েকে কি তোর ভালো লাগেনি কখনো?

—তা কি আর না লাগে! কিন্তু কী বলবো, সেই ভালো লাগাকে কি ভালোবাসাতে পরিণত করা যায়?

—ভালোবাসা তো কিছুই দেখে না, জাত-ধর্ম, ধন-ঘরবাড়ি কিছুই প্রয়োজন হয় না, শুধু মন থাকলেই হলো!

—তুই এত কী করে জানলি! ভালোবাসার জন্য শুধু মনই দরকার হয়। মনে মনে এক মন হলে তবেই ভালোবাসা।

কথাগুলি বলতে বলতেই আমার রুমার কথা মনে পড়লো। আমার প্রথম জীবনের সেই চুম্বন অনুভূতি। তারপর ভালোবাসা নিয়ে প্রথম কবিতা। একসঙ্গে চোখাচোখি হওয়া। কত কত মুহূর্ত নীরবতার মধ্যে পার করা। এসব ভাবতে ভাবতেই এক নিমেষেই স্তব্ধ হয়ে গেলাম।

—কমল বললো, চুপ করে গেলি কেন বল!

কী আর বলবো! সেরকমই একজন ছিল কিন্তু আমাদের জাতের নয়, তা বলতে পারিস তোদেরই জাতের।

—কিন্তু কেন তাকে ছাড়লি, এখন কি সে নাই?

—হয়তো আছে, অথবা নাও থাকতে পারে! পরীক্ষায় সে পাস করতে পারলো না বলে বাড়ি থেকে তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে নাকি সেরকমই শুনেছি।

—পরীক্ষায় পাস করাটাই কি সব! তাই বলে তুইও ওকে ছেড়ে দিলি?

—আমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছি, নিজের জীবনই কাটাতে পারি না, এই জীবনে আরেকজনকে জড়িয়ে হয়তো বাঁচার রাস্তাটাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাই ছাড়তে বাধ্য হলাম।

—আচ্ছা, বলতো, কেউ যদি তোকে ভেতরে ভেতরে ভালবাসে এখনো কোনো কথা বলতে পারেনি, যদি তোর সব দুঃখ সব কষ্ট হাসিমুখে গ্রহণ করে নেয়, যদি সে জাত-ধর্ম কিছুই না মানে তাহলে কি তুই তাকে ভালোবাসতে পারবি?

—আমি তো মানুষ হিসেবে সকলকে দেখি, জাত-ধর্মের লোক হিসেবে নয়। কিন্তু এই শূন্য জীবনে সেরকম কি কেউ আছে আমি ভাবতেও পারছি না!

—হয়তো আছে তুইও তাকে চিনিস হয়তো, সেও তোকে সব কথা বললেও ভালোবাসার কথাটি বলতে পারে না, তুই কি সে কথা বুঝতে পারিস!

—কিছুটা পারি বইকি! কিন্তু আমি অগ্রসর হতে নারাজ। চারিপাশের লোকজন, সমাজ, রাষ্ট্র এবং প্রতিবেশীরাও হয়তো ভালো চোখে মেনে নেবে না। এসবকেও ভয় পাই।

—কোথাও তো পালিয়ে যেতে পারিস, যেখানে প্রতিবেশী থাকবে না, যেখানে সবাই অচেনা, যেখানে সামান্য মানুষদের জন্য রাষ্ট্রও ভালোবাসাকে কলঙ্কিত করবে না।

—সে অবশ্যই পারি! কিন্তু সেরকম মন পেলে সেরকম মানুষ পেলে তবেই তো সে শক্তি জেগে উঠবে!

কমল আর উত্তর দিতে পারলো না, সে মাথা নিচু করলো। প্রচণ্ড ঝাঁঝ শ্রাবণ মাসের দুপুরের রোদে। কমল আর আমি একটি কদম গাছের ছায়ায় বসে আছি। নিচু কণ্ঠে চলছে আমাদের কথাবার্তা। কিছুটা দূরে মাধবী আর কান্তি চিত হয়ে পড়ে আছে। আমাদের পিঠজুড়ে ফোসকা পড়ে গেছে রোদের তাপে। ছায়ায় কিছুটা ঠান্ডা হলে আবার কাজে লেগে পড়তে হবে। কমল মাত্র উনিশ বছরের মেয়ে। গায়ের রং শ্যামবর্ণা। মুখশ্রী চমৎকার। কোমর পর্যন্ত তার মাথার চুল ঝুলে পড়েছে। এত গরমেও বুকের কাপড় সরে যায়নি। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে আর স্কুল যাবার সুযোগ হয়নি। মাঠের কাজে নেমে পড়েছে। মাধবী ও কান্তি দুজনেই বিবাহিতা। দুজনের বুকেই মনে হচ্ছে বেআব্রু দুটি পাহাড় তার উন্নত চূড়ার অবাধ্যতা ঘোষণা করে চলেছে। অন্যান্য পুরুষ মুনিষেরা অন্যত্র বীজ তোলার কাজে ব্যস্ত আছে। আমরা এসেছি বীজ রোপণ করতে। এই এক বিঘা জমি চারজনে রোপণ করা হলে তবেই ছুটি পাব। আমি কমলের দিকে চেয়ে রইলাম গভীর তির্যক দৃষ্টিতে। বাপ-মা মরা মেয়েটি কিভাবে এতটা শালীনতা বজায় রাখতে পারে? আশ্চর্য হই তার চালচলনে কথাবার্তায়। পাশের গ্রামেই তাদের বাড়ি। ভাঙা একখানা মাটির বাড়িতে কাকা-কাকিমার সঙ্গে থাকে। বিয়ের জন্য জোরাজুরি করেও ফিরে গেছে বহু যুবকের দল। কেন সে এতদিন বিয়ে করেনি? সে কথা জিজ্ঞেস করলে কমল বলেছে : “আমাদের জাতের পুরুষগুলোকে দেখেছি, বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে বউয়ের শরীর বিক্রি করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিজেরা মদ গিলে মাতলামি করে জীবন কাটায়। আর বউরা করে পর পুরুষের সেবা। এরকম সমাজে জন্ম হওয়াটাই আমার কাছে একটা ঘৃণার বিষয়। অবশ্যই আমি সেরকম পুরুষ পেলে বিয়ে করবো।”

তার এতটা সমাজ নিরীক্ষা আর অভিজ্ঞতার কথা শুনে আমি অবাক হই। এই অর্ধশিক্ষিত মেয়েটি এত কম বয়সে কি করে এতটা অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে তা ভেবে দেখার মতো লোক আমাদের সমাজে নেই। তাই তাকে নিয়ে আলাদা করে ভাবতেই হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনকে শক্ত করে বলি, চল কোমল কাজে লাগি তারপর আমরা রাস্তা খুঁজবো!

কমল একটু হাসলো। সূর্যের তাপের মাঝেও চম্পা ফুলের মতো সেই হাসি আমাকে চমকে দিল। নিঃশব্দে উঠে এলাম আমাদের কর্মস্থলে। 🍁(চলবে)

 

🍂কবিতা 

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর দু’টি কবিতা 

দোল

শরীরে রং দাও, বসন্ত আসবে
মনে রং লাগাও, আগুন জ্বলবে

পুড়ে যাবে, মনের সমস্ত অন্ধকার
পুনর্জন্ম মেনে উড়ে যাবে, নতুন কোন ফিনিক্স

পাড়াতে পাড়াতে ঝুলছে যে হোর্ডিং
তাতে ভালোবাসার একটা বর্ণও নেই

মিথ্যাচারে ভরে ওঠা লোকালয়ে এখন দোল
শিথানে জিইয়ে রাখা অন্ধকার মেখে
যে কিশোর খেলছে কালো রং
তার দোল নিয়ে পৃথিবী আঁকুক, অন্য বসন্ত উৎসব

 

 

হৃদয়ে জমিলো মেঘ

সমস্ত প্রতিবন্ধকতা ভেঙে নেমেছি, প্রলোভনের রাস্তায়
মাথার উপর জ্বলছে, ঠা ঠা রোদ
উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি, আজ ভিজবো বলে…

ডানা মেলা আদম আমি, ইডেন উদ্যানের খোঁজে
আজও পথ হাতড়াই, পৃথিবীর প্রথম মানব

অনুষঙ্গ দেখিয়ে বহুবার সরে গেছো, মহাপ্লাবনের দিনে
বুঝিনি সেই সব খেলাচ্ছল ; সামলে রাখা দিনের ঐশ্বর্য

আকাশ জুড়ে জমে ওঠে, মেঘ সঙ্গমের বিকেলে
বৃষ্টি তো নামবেই
এইতো তোমাকে আঁকা ঘোলাটে বিকেল
হৃদয়ে জমানো মেঘ ভেঙে হয়তো বৃষ্টি নামছে…

 

 

 

সুশীল গোস্বামী-এর একটি কবিতা

বিষণ্নতা

বিষণ্ণ মৃত্যুকে ‌পাহারা দিতে
বসে আছি একা।
উদাসী বাতাসে ওড়ে দিন,
পাতা ঝরা ডালে উঁকি মারে
উদ্গ্রীব জীবন।
যারা বলেছিলো এনে দেবে
রোদ্রে ভরা দিন,
শীতার্ত প্রেয়সীর বুকে
এনে দেবে প্রাণিত উত্তাপ,
মাঠের ফসল যারা তুলে নিতে ঘরে
বের হ’ল সকাল সকাল—
তারা কেউ ফেরেনি, কথা রাখেনি।
আমি একবার যাবো
কুলিদের ঘ্রাণ বুকে নিয়ে
পায়ে পায়ে বহুদূর—
যেখানে সন্ধ্যা নামে হিজল‌
ছায়ায়,
সুখ দুঃখ অনুভবে, আমৃত্যু আবেশে।

 

 

 

 

সুচিতা সরকার-এর একটি কবিতা 

রঙের রঙ্গ

প্রতিটি মুহূর্তে এখানে, কাপড়ের মতো
রং বদলায় মানুষ,
তবুও জানি না কেন,
হোলির অপেক্ষায় থাকে মানুষ?

মন প্রশ্ন করে আমায়,
এইবার কি আবির লাগবে গায়ে?
এই মূর্খকে বোঝাই কীভাবে,
আর কতবার রক্তে রাঙাবি নিজেরে?

যে ক্ষত লুকিয়ে রেখেছি,
সেটা ভিজে যাবে আবার অশ্রুর রঙে।
যে মাটির রঙে, মুখ ঢেকেছি,
সেই মাটিতেই মিলিয়ে যাব, কবরের বুকে।।

এই কোলাহল তবে শুধু এক দিনের হয় কেন?
উৎসব শুধু আবিরেরই হয় কেন?
যে রক্ত রাস্তায় শুকিয়ে গেল,
তার লাল রং চোখে পড়ে না কারোর কেন?

 

 

আশিস সরকার-এর একটি কবিতা

রক্ত মাংস আর মুখোশ

রক্ত কোথায়, মাংস কোথায়
এগুলো ছাড়া কবিতা— মানে হয়
বৃষ্টির কবিতা, বাতাসের কবিতা
কী আসে যায় এসব না লিখলে
রক্তাক্ত মুখের কবিতা
চোখ ফেটে ঝরা রক্ত
তার সাথে নতুন একটা
ইমেজারি আনো
মাংস— মাংস ছাড়া দেহ, দেহ ছাড়া মাংস
দেহ আর মাংস দিয়েই ক্ষমতা
ক্ষমতা দেহ আর মাংস নিয়ে খেলা করে
মস্তিষ্ক ও সব বাজে ওগুলো লাগে

তবে মুখোশের কাজে।

 

 

 

ফাল্গুনী চক্রবর্ত্তী-এর একটি কবিতা 

দোল এলো

আজ গুলিয়ে যাওয়া
আজ গুলে দেয়া
উৎসবের বহরে সই রাখছে
মাতোয়ারা মন
রাঙিয়ে যাওয়া ফাগুনের চিঠি
রকমারী রঙের ফোয়ারায়
এই মেঘলা মন
উড়ু রং উড়ু চা এর ধোঁয়া
গুলালের সাথে আছে কিছু কথা
ওই দূর ঝোপড়ি তার মায়ায়
যাও মাখিয়ে এসো
তোমার যাবতীয় প্রেমের মোহর
আজ থেকে অন্ধকারের পথে
ছুটতে ছুটতে
ওরা যেন দেখতে পায়
হাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা
ফেনের মারফত রঙিন আলোর উৎস
দিগন্তের কৌশল
জশনে দিল কি গলিয়ারা

 

 

 

অমিত পাল-এর একটি কবিতা 

আজি প্রেমের বসন্তে

গোলাপের চোখে আজি স্বর্ণালী অস্তরাগ
তবুও, বিদীর্ণ ও বিকৃত তোমার মেকি প্রেম।
নীল, সবুজ, হলুদের মাতামাতি চারিপাশ
আমার হৃদয়ের ক্যানভাস বিবর্ণ…

তুমি নিয়ে এসো সখা নতুন প্রেমের রঙ
রাঙিয়ে তোলো আমার নিঃসঙ্গতাকে।
একটুকরো চুম্বন আর একবাটি ভালোবাসা
যেখানে থাকবে না মেকি প্রেমের গন্ধ…

আজি প্রেমের বসন্তে তোমাকে চাই।
নব রঙের আছিলায় তোমাকে রাঙানো—
কুণ্ঠিত হৃদয় সমর্থন দিক,
আজি প্রেমের বসন্তে প্রতীক্ষায় রত…

 

 

 

 

মুন চক্রবর্তী-এর একটি কবিতা 

নৈর্সগিক পথ

একটি জায়গা থাকুক শিশুর মতো, শরৎ পদ্মে
বয়সের ঊর্ধ্বেসীমাকে ছুঁতে না পারার বায়না
জীবনের বলিরেখায় হাঁটুক খেয়াল খুশিতে
উড়ে যাক রঙিন ঘুড়িতে মন সীমাহীন আকাশে।
অভিমান ভাঙানোর জায়গাটা শিশুর মতো থাকুক
তার সেই খেলাঘরে জমা হোক দুরন্তপনা
ভাঙুক মনের খেয়ালের দেওয়াল মুক্ত পাখির ডানায়
একটি জায়গা থাকুক শিশুর মতো, জীবন সন্ধ্যায়
পাতায় পাতায় লেখা থাক দুষ্টমি,ভয়ে জড়ো বকুনিতে
দিনান্তে অভিমান আর বায়নাতে থাকুক স্নেহস্পর্শ।
ছুটে আসা হাঁসের দলে ভিড়ে যাক শিশুমন
জলের বুকে কাগজ ডিঙায় লেখা থাক বৃষ্টির বিন্দু
বাঁশ বাগানে অন্ধকারে শিহরিত শরীরে ছুঁয়ে থাক ভৌতিক গল্প
দলছুট অর্থহীন গল্পের হাসিতে জোছনা ঝড়ে পড়ুক
অকারণে পেট ব্যথার চোখের জলে স্কুল ফাঁকি
চাঁদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে শিশুর মতো চড়কা কাটা বুড়ির বন্ধুত্ব খোঁজে নেওয়া।
বয়সের ঊর্ধ্বসীমায় মনটা জুড়ে থাকুক শিশুর নৈর্সগিক পথ সুবাসিত কবিতায়।

 

 

 

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১৭
‘বাউল’ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতভেদ আছে। এ নামটি উক্ত সম্প্রদায়ের স্বপ্রদত্ত নয়। পনের শতকের শেষ পাদের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে এবং ষোলো শতকের শেষ পাদের চৈতন্যচরিতামৃতে ‘ক্ষেপা’ ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে ‘বাউল’ শব্দের আদি প্রয়োগ দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে এখনও বাউলকে ক্ষেপা বলে। কেউ বলেন ‘বাউল’ শব্দটা বাউর (এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল) থেকেই উৎপত্তি হয়েছে।
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৭।

 

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

 

রেহানা বীথি 

 

 

 

 

বাউল পদাবলী

“মধ্যযুগের বাঙলা গীতিকবিতা” গ্রন্থের ভূমিকায় প্রফেসর হাই বাউল-পদাবলী নিয়েও সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনা আজকের এই সময়ে এসেও সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ তার তথ্যসমৃদ্ধতার কারণে। আলোচনাটি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলঃ
যোগ ও সাংখ্য— এই দু’টো অতি পুরানো অনার্য দর্শন। পুরুষ (চৈতন্য স্বরূপ) ও প্রকৃতি (উপাদান) তত্ত্বই সাংখ্য দর্শনের ভিত্তি। আর দেহচর্যার দ্বারা আত্মোপলব্ধির পদ্ধতির নাম যোগ শাস্ত্র। সাংখ্য নিরীশ্বর আর যোগ ঈশ্বরবাদী। ব্রাহ্মণ্য সমাজে যোগ ও সাংখ্য দর্শন জটিল হয়ে ওঠে, পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ও জৈনদের হাতে যোগ স্বতন্ত্রভাবে বিকাশ লাভ করে। ‘তন্ত্র’ বলে অপর একটি অনার্য-শাস্ত্রও যোগ ও সাংখ্যতত্ত্বের সাথে মিশ্রিত হয়ে একটি জটিলতর মিশ্র তত্ত্বের উদ্ভব ঘটায়। ব্রাহ্মণ্য-শৈবতন্ত্র ও বৌদ্ধতন্ত্রের সংমিশ্রণে সম্ভবত সাত শতকের দিকে যোগী-তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। এই তান্ত্রিক বৌদ্ধ সম্প্রদায় বজ্রযান, কালচক্রযান ও সহজযান নামে তিনটি শাখায় বিভক্ত ছিল। বজ্রযান ও কালচক্রযান ধরে পরবর্তীকালে হিন্দু তান্ত্রিক ধর্মের বিকাশ ঘটে আর সহজযান দুটো উপমার্গ ধরে পরিপুষ্ট হতে থাকেঃ এর একটি বামাচার বা কামাচার ভিত্তিক(মিথুনাত্মক) যোগসাধনা (সহজিয়া), অপরটি প্রকৃতি বর্জিত যোগচর্চা (নাথপন্থ)। প্রথমটি থেকে কালে বৈষ্ণব সহজিয়া মতের উদ্ভব হয়েছে আর দ্বিতীয়টি পরবর্তীকালে বৈরাগ্যবাদী শৈব ধর্মের ভিত্তি হয়েছে এবং উভয় মতের মিশ্রণেই সম্ভবত বাউল মতের উদ্ভব।

 

বৈষ্ণবেরা একান্তভাবে প্রেমিক ও প্রেমসাধক, আর বাউলেরা তাত্ত্বিক। বৈষ্ণবেরা পার্থিব জীবন ব্যাপারে উদাসীন। কিন্তু বাউলেরা জীবন, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন। বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ভজন, সঙ্গীত ও সাহিত্য। সূফী-বৈষ্ণবদের মত বাউলদেরও গানের মাধ্যমে সাধন ভজন চলে

 

এককালে এই নাথপন্থ ও সহজিয়া মতের প্রাদুর্ভাব ছিল বাঙলায়। এ দু’টো সম্প্রদায়ের লোক একসময় ইসলামে ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়, কিন্তু বদ্ধমূল পুরানো বিশ্বাস-সংস্কার বর্জন করা সম্ভব হয়নি বলেই ইসলাম ও বৈষ্ণব ধর্মের আওতায় থেকেও তারা পুরাতন প্রথায় ধর্ম সাধনা করে চলে। তারই ফলে হিন্দু-মুসলমানের সমবায়ে বাউল মতের উদ্ভব হয়েছে। অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতে মুসলমান মাধববিবি ও আউল চাঁদই এতের প্রবর্তক এবং মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্রই বাউল মত জনপ্রিয় করেন। বাউলেরা অশিক্ষিত। এজন্য তাদের কোনও লিখিত শাস্ত্র নেই এবং তাদের মতবাদের কালিক কিংবা দার্শনিক পরিচয়ও তারা দিতে পারে না। সমাজের নিচের তলার লোকের ধর্ম বলে বাউল মত শিক্ষিত লোকের কৌতুহলও জাগায়নি। রবীন্দ্রনাথই এদের প্রতি শিক্ষিত লোককে উৎসুক করে তোলেন।

বাউল মত মূলত প্রাচীন ভারতীয় তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলিম প্রভাবে তথা সুফীমতের প্রত্যক্ষ সংযোগে এর উদ্ভব। মুসলিম বিজয়ের পরে হিন্দু-মুসলমানের বিপরীতমুখী ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘর্ষে প্রথমে দক্ষিণ ভারতে, পরে উত্তর ভারতে এবং সর্বশেষে বাঙলাদেশে হিন্দুসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ আলোড়নের বাহ্যরূপ— ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয় প্রয়াস। হিন্দুর মায়াবাদ, তজ্জাত ভক্তিবাদ ও সূফীতত্ত্বই এসব আন্দোলনে প্রেরণা যুগিয়েছে। দক্ষিণ ভারতের ভক্তিবাদ, উত্তর ভারতের সন্তু ধর্ম এবং বাঙলার বৈষ্ণব ও বাউল মতবাদ সুফী মতের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফল। সেদিন নির্যাতিত নিম্ন শ্রেণীর বঞ্চিত মনে ইসলামের সাম্য, ভাতৃত্ব ও মৈত্রী অধিকারবোধের যে উত্তেজনা এবং মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা জাগিয়েছিল, তারই ফলে মন্দির ছেড়ে মসজিদের পথে না গিয়ে উদার আকাশের তলে স্রষ্টার সঙ্গে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক পাতাবার এ নতুনত্ব প্রয়াসমাত্র।

জীবাত্মা পরমাত্মারই অংশ। জীবাত্মার মধ্যেই পরমাত্মার স্থিতি। কাজেই আপনার আত্মার পরিশুদ্ধি ও পরিচয়ই খোদাপ্রাপ্তির উপায়। তাই আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির সাধনাই বাউলদের ব্রত। এদের আদর্শ হচ্ছেঃ Knoweth thyself ; আত্মানং বিদ্ধি– নিজেকে চেন ; হাদীসের কথায় ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্ বাহু’ — যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে জেনেছে। জীবনের পরম ও চরম সাধনা হচ্ছে খোদাকে চেনা। বাউলের রূপক অভিব্যক্তিতে সে পরমাত্মা হচ্ছেন— মনের মানুষ, অটল মানুষ, অধর মানুষ, মানুষ রতন, মনমনুরা, অচিনপাখি ও অলখসাঁই (অলক্ষ্য স্বামী)।

‘বাউল’ নামের উৎপত্তি সম্বন্ধে নানা মতভেদ আছে। এ নামটি উক্ত সম্প্রদায়ের স্বপ্রদত্ত নয়। পনের শতকের শেষ পাদের শ্রীকৃষ্ণবিজয়ে এবং ষোলো শতকের শেষ পাদের চৈতন্যচরিতামৃতে ‘ক্ষেপা’ ও বাহ্যজ্ঞানহীন অর্থে ‘বাউল’ শব্দের আদি প্রয়োগ দেখা যায়। রাঢ় অঞ্চলে এখনও বাউলকে ক্ষেপা বলে। কেউ বলেন ‘বাউল’ শব্দটা বাউর (এলোমেলো, বিশৃঙ্খল, পাগল) থেকেই উৎপত্তি হয়েছে। অবশ্য উত্তর ভারতের ‘ বাউর’ শব্দের সাথে আমাদের বাউলের যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। আবার ‘আকুল’ থেকে ‘আউল’ এবং ‘ব্যাকুল’ থেকে ‘বাউল’ শব্দের উৎপত্তিও অসম্ভব নয়। আবার কেউ কেউ বলেন – এ মতের উদ্ভব যুগে দীন-দুঃখী উলঝুল একতারা বাজিয়েদের জনসাধারণ ‘বাতুল’ বলে উপহাস করত। এ ‘বাতুল’ শব্দ থেকে বাউল নামের উদ্ভব। কারও মতে সংস্কৃত ‘বায়ু’ শব্দের সাথে ‘ল’ যুক্ত হয়ে বাউল অর্থাৎ বায়ুভোজী উন্মাদ অথবা শ্বাস-প্রশ্বাসের দ্বারা সাধনাকারী অর্থে বাউল শব্দ প্রযুক্ত হয়েছে।
সমাজের উঁচুস্তরে বাউলেরা কোনওকালেই শ্রদ্ধা বা মর্যাদার আসন পায়নি। তাই অনুমান করা যায়, ব্যাকুল (ভাবোন্মত্ত) বা বাতুল (অপদার্থ) অর্থে উপহাসছলে তাদের এ নামকরণ হয়েছে।

বাউল দু’প্রকার— গৃহী ও বৈরাগী। বর্তমানে এরা বহু উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত। যথাঃ হজরতী, গোবরাই, পাগলনাথী, খুমিবিশ্বাসী, সাহেবধনী, জিকির ফকির, আউল, বাউল, সাঁই, ন্যাড়া, বলরামী, সম্ভুচাঁদী, রামবল্লভী প্রভৃতি।

মুসলমান বাউলেরা সাধারণত বেশরা ফকির, নেড়ার ফকির, বেদাতী ফকির, মুর্শীদপন্থী, মারফতী ফকির নামে পরিচিত।

বৈষ্ণবেরা একান্তভাবে প্রেমিক ও প্রেমসাধক, আর বাউলেরা তাত্ত্বিক। বৈষ্ণবেরা পার্থিব জীবন ব্যাপারে উদাসীন। কিন্তু বাউলেরা জীবন, সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন। বাউল গান একাধারে ধর্মশাস্ত্র, দর্শন, ভজন, সঙ্গীত ও সাহিত্য। সূফী-বৈষ্ণবদের মত বাউলদেরও গানের মাধ্যমে সাধন ভজন চলে—
বীণার নামাজ তারে তারে
আমার নামাজ কণ্ঠে গাই।’

বাউলগান লোকসাহিত্য মাত্র নয়, এগুলো দেশের সাধারণ মানুষের প্রাণের কথা, মনীষার ফসল এ সংস্কৃতির স্বাক্ষর। বাউল কবিদের মধ্যে লালন, মদন, পাগলা কানাই, ঈশান, গঙ্গারাম, দীনু, পাঞ্জুশাহ্, যাদুবিন্দু প্রভৃতি প্রধান।

জগৎ ও জীবনের, সৃষ্টি ও স্রষ্টার গভীরতর রহস্য ও তত্ত্ব কত সহজভাবে বাউল গানে উদঘাটিত হয়েছে। লালন বলেনঃ

‘এই মানুষে আছে রে মন
যারে বলে মানুষ রতন
ডুবে দেখ দেখি মন তারে
কিরূপ লীলাময়।
যারে আকাশ পাতাল খোঁজ
এই দেহে তিনি রয়।’

এ ঘটে আত্মারূপে সেই পরমাত্মাই বিরাজ করেন। কাছে থাকেন, দেখা দেন না, তাঁকে ধরা যায় না তাই ক্ষোভ, তাই বেদনা। এ কারণেই আমাদের চিরন্তন কামনাঃ

‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়
ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।’

তিনি ইসলামের ঐতিহ্য ও সাহিত্য সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন। ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে সেই ঐতিহ্যের নির্যাস ‘ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা’ ও ‘ইসলামের শাসন সংহতি’ নামক দুটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে অত্যন্ত সুকৌশলে ব্যক্ত করেছেন। যার মধ্য থেকে মূল ইসলাম সম্পর্কে একটি ধারণা পাঠকেরা নিতে পারবেন। ‘ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকা’ প্রবন্ধে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের দৃষ্টিভঙ্গির আদল পাওয়া যায় কিন্তু মুসলমান হিসেবে যা বিশ্বাস করা শাস্ত্রসম্মত তারই আলোকে তিনি ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিশ্লেষণ করেছেন। এই প্রবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন কিভাবে এবং কোন আত্মিক বলে ইসলাম অল্প সময়ের মধ্যে বেইজিং থেকে গ্রাণাডা পর্যন্ত নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। শুধু তলোয়ার দ্বারাই এ বিরাট সাম্রাজ্য গড়ে ওঠেনি। ইসলামের সার্বজনীন মনুষ্যত্বের অন্তর্নিহিত শক্তির জোরে এই বৈপ্লবিক অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছিল। তিনি বলেছেন:
“ইসলামের বৈপ্লবিকতার মূলে ছিল সুস্থ, মানবতাবোধ, মুক্তবুদ্ধি, নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারহীনতা, আত্ম-জিজ্ঞাসার তাগিদ, বিচারসহ মান, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও পরীক্ষা পদ্ধতি এবং যুক্তিবাদের অবতারণা। সর্বোপরি মানুষকে মানুষ হিসেবেই তার সর্বনিম্ন অধিকার সম্বন্ধে যেভাবে সচেতন করে দিয়ে গেল, তারই মধ্যে নিহিত রয়েছে ইসলামের বৈপ্লবিক বীজ।” (সাহিত্য ও সংস্কৃতি পৃ. ১৩৮)

ইসলাম তার নিজস্ব সুস্থ সমাজ চেতনার কারণে ভারতবর্ষে এসে অন্য সভ্যতার মত হারিয়ে যায়নি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দোর্দণ্ড প্রতাপের দিনেও বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। পারস্পরিক লেন- দেনের ভিত্তিতে ভারতীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, অথচ ভারতবর্ষের শিক্ষিত হিন্দু শ্রেণী ইসলামিক সংস্কৃতির পূর্ণ মর্যাদা দেননি। এ সম্পর্কে হাই সাহেব বলেছেন—

“ভারতবর্ষ তার অজ্ঞাতসারে ইসলামিক সংস্কৃতির বহু কিছু আত্মসাৎ করেছে এবং পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সংমিশ্রণও নানাদিকে নানাভাবে ঘটেছে। একথা সত্য যে, ইসলামের সভ্যতার গৌরব বুকে ধারণ করেই ইউরোপ জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে পৃথিবীর দিশারী হয়ে উঠল। অথচ উত্তরাধিকার সূত্রে মানব সভ্যতার এ আশীষ পাওয়া সত্ত্বেও ইসলামিক সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতাবশত সজ্ঞানে ভারতবর্ষ তাকে বর্জন করেছে এবং ভারতভূমি থেকে তাকে চিরতরে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ইংরেজ আমলের শেষ একশ বছরেে নিছক ভারতীয় তথা হিন্দু সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন প্রয়াসের মধ্যেই আমাদের এ উক্তির সত্যতা যথার্থ অনুধাবন করা যাবে। (সাহিত্য ও সংস্কৃতি পৃ. ১৪০- ৪১)।” 🍁(ক্রমশঃ)

 

 


 

শোকজ্ঞাপন

 

কবি মিহির সরকার


বর্ষীয়ান কবি ও ‘সহজ’ পত্রিকার সম্পাদক মিহির সরকার-এর প্রয়াণে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি। -সম্পাদকমণ্ডলী, সাশ্রয় নিউজ। রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল 

 

 


অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনীলেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সম্পাদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা বিভাগে লেখাটি আন্তর্জাল থেকে সংকলিত

 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment