



🍂মহামিলনের কথা
শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
সব তুমি?
হাঁ,সব আমি।
কি করে ‘সব তুমি’ আমি প্রত্যক্ষ করতে পারবো?
নাম করলে। নিরন্তর নাম করলে আমি স্বয়ং এসে তোকে ধরা দেবো।
তুমি সকলকেই ধরা দাও? মহাপাপী যদি নাম করে তাকেও তুমি ধরা দাও?
নিশ্চয়ই দিই। নাম করলে কি তার পাপ থাকেরে? সাত জন্মের পাপও নামকারীর নষ্ট হয়ে যায়।
যে মানব ‘শ্রীকৃষ্ণ’ এই নামকীর্ত্তন করতে থাকে তার মুখে নাম শুনে দক্ষিণদিকের অধিপতি ধর্ম্মরাজ যম তার শত জন্মের পাপ খাতা থেকে মুছে ফেলেন।
গোপনে পাপ করলে যম কি করে জানতে পারেন?
মানুষ যত গোপনে যেখানে পাপ করুক না কেন, সূর্য্য, অগ্নি, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সন্ধ্যা,
দিবারাত্রি, জল, পৃথিবী, আর স্বয়ং ধর্ম্ম—এঁরা সে পাপের সাক্ষী থাকেন।
চিত্রগুপ্ত তার খাতায় জন্ম-জন্মান্তরের পাপ লিখে রেখে দেয়,জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে পাপের দণ্ড দিতে থাকে। যে জন্মে পাপী আমার নাম একান্তভাবে আশ্রয় করে,যমরাজ স্বয়ং তার সমস্ত পাপ মুছে ফেলেন।
তোমার এসব কথায় বিশ্বাস করবার শক্তি আমাকে দাও।
তুই কি নামের মহিমায় সন্দেহ করিস্?
না না; যম মুছে ফেলেন—এসব ঠিক বুঝতে পারি না। আমায় বেশ করে বুঝিয়ে দাও। তোমার নামের মহিমা বল।
জগন্মঙ্গল আমার সঙ্কীর্ত্তন মহাপাপেরও একবারে নাশকারী। অজামিল নামাভাসেই মুক্তিলাভ করেছিল।
নাম করে মুক্তিলাভের কথা কেবল অজামিলেরই শোনা যায়।
অজামিল,রত্নাকর,গণিকা,শুক আরও কত ভক্ত নাম নিয়েই কৃতার্থ হয়েছে। ভক্ত নামকেই একমাত্র সম্বল করে। নাম অবলম্বনেই ভক্ত আমাকে চিরপ্রেমে বন্দী করে। যে নাম অবলম্বন করে,তাকে প্রাণরূপে ধরা দিই,তারপর তার প্রাণনাথ হয়ে যাই।🍁 *বানান অপরিবর্তিত
ঋণ: শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী ||শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী
🍂ফিরেপড়া | প্রবন্ধ
শিবনাথের প্রকৃতির একটি লক্ষণ বিশেষ করিয়া চোখে পড়ে; সেটি তাঁহার প্রবল মানববৎসলতা। মানুষের ভালোমন্দ দোষগুণ সব লইয়াই তাহাকে সহজে ভালোবাসিবার শক্তি খুব বড়ো শক্তি। যাঁহারা শুষ্কভাবে সংকীর্ণভাবে কর্তব্যনীতির চর্চা করেন তাঁহারা এই শক্তিকে হারাইয়া ফেলেন। কিন্তু শিবনাথের সহৃদয়তা এবং কল্পনাদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি দুই-ই ছিল এইজন্য মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়া দেখিতে পারিতেন, তাহাকে সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো বাজারদরের কষ্টিপাথরে ঘষিয়া যাচাই করিতেন না। তাঁহার আত্মজীবনী পড়িতে পড়িতে এই কথাটিই বিশেষ করিয়া মনে হয়। তিনি ছোটো ও বড়ো, নিজের সমাজের ও অন্য সমাজের নানাবিধ মানুষের প্রতি এমন একটি ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছেন যাহা হইতে বুঝা যায় তাঁহার হৃদয় প্রচুর হাসিকান্নায় সরস সমুজ্জ্বল ও সজীব ছিল, কোনো ছাঁচে ঢালাই করিয়া কঠিন আকারে গড়িয়া তুলিবার সামগ্রী ছিল না।
ব্যক্তিপ্রসঙ্গ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শিবনাথ শাস্ত্রী
শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠ ছিল না। তাঁহাকে আমি যেটুকু চিনিতাম, সে আমার পিতার সহিত তাঁহার যোগের মধ্য দিয়া।
আমার পিতার জীবনের সঙ্গে তাঁহার সুরের মিল ছিল। মতের মিল থাকিলে মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা হয় ভক্তি হয়, সুরের মিল থাকিলে গভীর প্রীতির সম্বন্ধ ঘটে।
আমার পিতার ধর্মসাধনা তত্ত্বজ্ঞানের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না। অর্থাৎ তাহার সাধনা খালকাটা জলের মতো ছিল না, সে ছিল নদীর স্রোতের মতো। সেই নদী আপনার ধারার পথ আপনি কাটিয়া সমুদ্রে গিয়া পৌঁছে। এই পথ হয়তো বাঁকিয়া-চুরিয়া যায়, কিন্তু ইহার গতির লক্ষ্য আপন স্বভাবের বেগেই সেই সমুদ্রের দিকে। গাছ আপন সকল পাতা মেলিয়া সূর্যালোককে সহজেই গ্রহণ করে এবং আপন জীবনের সহিত তাহাকে মিলিত করিয়া আপনার সর্বাঙ্গে সঞ্চারিত ও সঞ্চিত করিয়া তুলে। এই গাছকে বাধার মধ্যে রাখিলেও সে স্বভাবের একাগ্র প্রেরণায় যে-কোনো ছিদ্রের মধ্য দিয়া আপন আকাঙক্ষাকে সূর্যালোকের দিকে প্রসারিত করিয়া দেয়। এই আকাঙক্ষা গাছটির সমগ্র প্রাণশক্তির আকাঙক্ষা।

তেমনি বুদ্ধিবিচারের অনুসরণে নয় কিন্তু আত্মার প্রাণবেগের ব্যাকুল অনুধাবনেই পিতৃদেব সমস্ত কঠিন বাধা ভেদ করিয়া অসীমের অভিমুখে জীবনকে উদ্ঘাটিত করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সমগ্রজীবনের সহজ ব্যাকুলতার স্বভাবটি শিবনাথ ঠিকমতো বুঝিয়াছিলেন। কেননা তাঁহার নিজের মধ্যেও আধ্যাত্মিকতার এই সহজ বোধটি ছিল।
তিনি ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের ঘরে যে সংস্কারের মধ্যে জন্মিয়াছিলেন তাহার বাধা অত্যন্ত কঠিন। কেননা, সে শুধু অভ্যাসের বাধা নহে; শুধু জন্মগত বিশ্বাসের বেষ্টন নহে। মানুষের সব চেয়ে প্রবল অভিমান যে ক্ষমতাভিমান সেই অভিমান তাহার সঙ্গে জড়িত। এই অভিমান লইয়া পৃথিবীতে কত ঈর্ষা দ্বেষ, কত যুদ্ধবিগ্রহ। ব্রাহ্মণের সেই প্রভূত সামাজিক ক্ষমতা, সেই অভ্রভেদী বর্ণাভিমানের প্রাচীরে বেষ্টিত থাকিয়াও তাঁহার আত্মা আপনার স্বভাবের প্রেরণাতেই সমস্ত নিষেধ ও প্রলোভন বিদীর্ণ করিয়া মুক্তির অভিমুখে ধাবিত হইয়াছিল। তমসো মা জ্যোতির্গময় এই প্রার্থনাটি তিনি শাস্ত্র হইতে পান নাই, বুদ্ধিবিচার হইতে পান নাই, ইহা তাঁহার জীবনীশক্তিরই কেন্দ্রনিহিত ছিল, এইজন্য তাঁহার সমস্ত জীবনের বিকাশই এই প্রার্থনার ব্যাখ্যা।
জাগ্রত আত্মার এই স্বভাবের গতিটিই সকল ধর্ম-সমাজের প্রধান শিক্ষার বিষয়। সাধকের মধ্যে ইহারই রূপটি ইহারই বেগটি যদি দেখিতে পাই তবেই সে আমাদের পরম লাভ হয়। মতের ব্যাখ্যা এবং উপদেশকে যদি বা পথ বলা যায় কিন্তু দৃষ্টি বলা যায় না। বাঁধা পথ না থাকিলেও দৃষ্টি আপন পথ খুঁজিয়া বাহির করে। এমন-কি, পথ অত্যন্ত বেশি বাঁধা হইলেই মানুষের দৃষ্টির জড়তা ঘটে, মানুষ চোখ বুজিয়া চলিতে থাকে, অথবা চিরদিন অন্যের হাত ধরিয়া চলিতে চায়। কিন্তু প্রাণক্রিয়া প্রাণের মধ্য দিয়াই সঞ্চারিত হয়। আত্মার প্রাণশক্তি সহজ প্রাণশক্তির দ্বারাই উদ্বোধিত হয়। কেবল বাহিরের পথ বাঁধায় নহে, সেই অন্তরের উদ্বোধনে যাঁহারা ব্রাহ্মসমাজকে সাহায্য করিয়াছেন শিবনাথ তাঁহাদের মধ্যে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি।
শিবনাথের প্রকৃতির একটি লক্ষণ বিশেষ করিয়া চোখে পড়ে; সেটি তাঁহার প্রবল মানববৎসলতা। মানুষের ভালোমন্দ দোষগুণ সব লইয়াই তাহাকে সহজে ভালোবাসিবার শক্তি খুব বড়ো শক্তি। যাঁহারা শুষ্কভাবে সংকীর্ণভাবে কর্তব্যনীতির চর্চা করেন তাঁহারা এই শক্তিকে হারাইয়া ফেলেন। কিন্তু শিবনাথের সহৃদয়তা এবং কল্পনাদীপ্ত অন্তর্দৃষ্টি দুই-ই ছিল এইজন্য মানুষকে তিনি হৃদয় দিয়া দেখিতে পারিতেন, তাহাকে সাম্প্রদায়িক বা অন্য কোনো বাজারদরের কষ্টিপাথরে ঘষিয়া যাচাই করিতেন না। তাঁহার আত্মজীবনী পড়িতে পড়িতে এই কথাটিই বিশেষ করিয়া মনে হয়। তিনি ছোটো ও বড়ো, নিজের সমাজের ও অন্য সমাজের নানাবিধ মানুষের প্রতি এমন একটি ঔৎসুক্য প্রকাশ করিয়াছেন যাহা হইতে বুঝা যায় তাঁহার হৃদয় প্রচুর হাসিকান্নায় সরস সমুজ্জ্বল ও সজীব ছিল, কোনো ছাঁচে ঢালাই করিয়া কঠিন আকারে গড়িয়া তুলিবার সামগ্রী ছিল না। তিনি অজস্র গল্পের ভাণ্ডার ছিলেন– মানববাৎসল্য হইতেই এই গল্প তাঁর মনে কেবলই জমিয়া উঠিয়াছিল। মানুষের সঙ্গে যেখানে তাঁর মিলন হইয়াছে সেখানে তার নানা ছোটোবড়ো কথা নানা ছোটোবড়ো ঘটনা আপনি আকৃষ্ট হইয়া তাঁহার হৃদয়ের জালে ধরা পড়িয়াছে এবং চিরদিনের মতো তাঁর মনের মধ্যে তাহা থাকিয়া গেছে।
অথচ এই তাঁর মানববাৎসল্য প্রবল থাকা সত্ত্বেও সত্যের অনুরোধে তাঁহাকেই পদে পদে মানুষকে আঘাত করিতে হইয়াছে। আত্মীয়-পরিজন ও সমাজকে তো আঘাত করিয়াইছেন, তাহার পরে ব্রাহ্মসমাজে যাঁহাদের চরিত্রে তিনি আকৃষ্ট হইয়াছেন, যাঁহাদের প্রতি ব্যক্তিগত শ্রদ্ধা ও প্রীতি তাঁহার বিশেষ প্রবল ছিল তাঁহাদের বিরুদ্ধে বার বার তাঁহাকে কঠোর সংগ্রাম করিতে হইয়াছে। মানুষের প্রতি তাঁহার ভালোবাসা সত্যের প্রতি তাঁহার নিষ্ঠাকে কিছুমাত্র দুর্বল করিতে পারে নাই। যে ভূমিতে তিনি জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন তাহা মানব-প্রেমের রসে কোমল ও শ্যামল, আর যে আকাশে তিনি তাহাকে বিস্তীর্ণ করিয়াছিলেন তাহা সত্যের জ্যোতিতে দীপ্যমান ও কল্যাণের শক্তিপ্রবাহে সমীরিত।🍁
ঋণ : প্রবাসী, অগ্রহায়ণ, ১৩২৬
🍂ফিরে পড়া | কবিতা
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-এর একটি কবিতা
না-লেখা চিঠি
আর কতক্ষণ আমি চোখ বুজে বসে থাকব?
এবারে আমি তাকাতে চাই।
তাকিয়ে দেখতে চাই,
তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছ।
অনেক দিন হল আমি তোমাকে দেখি না।
অনেক মাস, অনেক বছর।
অনেক দিন তোমার গলা শুনি না।
অনেক মাস, অনেক বছর।
এবারে তুমি এসো।
গেল বছর আমাদের গুলঞ্চ গাছটায় খুব
ফুল এসেছিল।
তার আগের বছর আমাদের নদীতে খুব
জল এসেছিল।
তার আগের বছর..আশ্চর্য..তার আগের বছর
কী যে হয়েছিল, আমার মনে নেই।
এবারে আমাদের গাছে একটাও ফুল আসেনি।
নদীতে জল আসেনি।
তুমি এসো।
দিব্যেন্দু পালিত-এর একটি কবিতা
উড়োচিঠি
আসবেই…
একদিন না একদিন…
ঘুমচোখ কচলে নিয়ে দেখবে হঠাৎ,
সোনালি রোদ্দুর থেকে উড়ে এসে
পড়েছে মেঝেয়।
হতে পারে দুঃখ তার সর্বাঙ্গে জড়ানো
হতে পারে শোক
বিদ্ধ করার আগে ঘাতকের অকম্পিত ছুরি
হতে পারে সুখ এক
কার্পাস তুলোর ঢঙে, এলোমেলো
আনন্দের ব্যাখ্যা নেই কোনো।
যদি দুঃখ হয় তাকে একা রেখো বুকে…
যদি সুখ হয় তার সুগন্ধ ছড়িয়ে দিও, যেন
বেড়াতে এসেছো একা ভোরবেলা অচেনা বাগানে।
শুধু অনুভব কোরো…
যে পাঠালো তার কথা জিজ্ঞেস কোরো না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর তিনটি কবিতা
ফেরা না ফেরা
ফিরে এসো, ফিরে এসো, আমার মাথার দিব্যি,
ফিরে এসো
দেখোনি পথের কাঁটা, দেখোনি তমসা?
স্বপ্নের ভেতরে জাগে শূল, অপাপবিদ্ধের শুভ্র
অভিশাপ হাসি
প্রতিটি ধ্বংসের পর কারা দেয় এত সকৌতুক করতালি?
আর কেউ নেই, আমি ছাড়া আর কেউ নেই, যে দেবে নিশান
তাহলে কোথায় যাবো, কার কাছে যাওয়া এই না ফেরার পথে?
ফিরে এসো, ফিরে এসো, আমার মাথার দিব্যি,
ফিরে এসো।
দেখোনি স্থাণুর কীট? দেখোনি সমস্ত দিন
ভূলের কাঁকর আর মুখ ভরা অনিচ্ছার ধুলো?
এ রকম কথা ছিল? যখন তখন সব
প্রয়াসে বিলিয়ে দেওয়া শপথ ছিলো না?
ছিঁড়ে যাই হাজার অদৃশ্য সুতো, আরও কিছু
যার নাম মায়া
যাবো না? যেতেই হবে, এখন না যদি যাই, তবে আর কবে?
ফিরে এসো, ফিরে এসো, আমার মাথার দিব্যি,
ফিরে এসো!
ইচ্ছে হয়
এমনভাবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নাকি
ভিড়ের মধ্যে ভিখারী হয়ে মিশে যাওয়া?
এমনভাবে ঘুরতে ঘুরতে স্বর্গ থেকে ধুলোর মর্ত্যে
মানুষ সেজে এক জীবন মানুষ নামে বেঁচে থাকা?
রূপের মধ্যে মানুষ আছে, এই জেনে কি নারীর কাছে
রঙের ধাঁধা খুঁজতে খুঁজতে টনটনায় চক্ষু-স্নায়ু।
কপালে দুই ভুরুর সন্ধি, তার ভিতরে ইচ্ছে বন্দী
আমার আয়ু, আমার ফুল ছেঁড়ার নেশা
নদীর জল সাগরে যায়, সাগর জল আকাশে মেশে
আমার খুব ইচ্ছে হয় ভালোবাসার
মুঠোয় ফেরা!
অনির্দিষ্ট নায়িকা
ফিরে যাবো, শীত শেষে অবিশ্বাসী মরালের মতো
অন্ধকার শুভ্ৰ হলে, ফিরে যাবো, হে সখি নিরালা,
উরসে চন্দন গন্ধ, বিন্দু বিন্দু রক্ত ইতস্তত
তোমার শিশির-স্বাদ মুখ আর দৃষ্টিপাত মালা—
ফেলে আমি চলে যাবো, নির্বাসনে, হে সখি নিরালা।
যৌবন আশ্রিত বুঝি দীর্ঘ ঋজুরাত্রির শরীরে ;
দিনের আলোয় তুমি, ভীরু প্ৰাণ পতঙ্গের মতো ।
আমাকে ডেকেছো তাই স্রোতস্বিনী তমসার তীরে
অসহিষ্ণু বাসনায় নিজেকে ঢেকেছো অবিরত !
দিনের আলোয় তুমি মৃত্যুমুখী পতঙ্গের মতো।
করুণ শয্যায় লগ্ন ঘন নীল তোমার বসন–
সমুদ্র, আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল,
তুলে নাও নতমুখে, লজ্জা ঢাকো, বিচ্ছেদের ক্ষণ
বিষাদের নীল শিখা চক্ষে জ্বলো, তারো সঙ্গে মিল
সমুদ্র আকাশ কিংবা শৈশব-স্মৃতির মতো নীল।
ফিরে যাবো সব ফেলে দুঃখে, সুখে, হে সখি নিরালা,
শরীরে স্পর্শের শ্বাস মুছে নেবে দিবসের চোখ
জনারণ্য উপহার দেবে শুধু অতৃপ্তির জ্বালা
আবার উষসী এলে ফিরে পাবো বিচ্ছেদের শোক।
চতুর্দিকে রবে শুধু দিবসের শত তীক্ষ্ণ চোখ।
মল্লিকা সেনগুপ্ত-এর একটি কবিতা
বৃষ্টিমেয়ে
আমরা তোমরা বৃষ্টি শহর, মিটিং হচ্ছে ত্রিপাক্ষিকে
রাস্তায় আমি ভেজা টুপটুপে নন্দলালের জলরংছবি
ভাবছি শাড়ি তুলব কিনা হাঁটুর ওপর এমনসময়,
এমনসময় মধ্যবয়স ও কর্পোরেট পুরুষ তুমি
বৃষ্টিধোয়া উইন্ডস্ক্রিনে আমার চোখে তাকিয়েছিলে
শহর তখন জল ছপছপ, উপচে পড়া নর্দমারা—
অমন করে তাকাতে হয়,পা পিছলে পড়ে যেতাম!
তোমাদের এই ছলচাতুরি কটাক্ষপাত বুঝতে পারি
বুঝি এবং লিখতে থাকি তার বিরুদ্ধে আগুনঝরা
তবু হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল প্যারাডাইম
চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে পারি কিন্তু কেন?
কিন্তু কেন তাকিয়েছিলে অমন করে ও কর্পোরেট?
হাঁটুর ব্যথা, মাঝবয়সী অধ্যাপিকার বোরখা খুলে
হঠাৎ একটি ফিচকে মেয়ে বেরিয়ে আসে ঝাঁ-চকচকে
ভিজতে থাকে খাতার পাহাড়, ভিজতে থাকে বিদ্যেবুদ্ধি
স্মৃতির শহর ভিজতে থাকে রোমান্স তখন হলিউডি
এই শহরের রিচার্ড গিয়ার গাড়ির ভেতর উইন্ডস্ক্রিনে
গড়িয়াহাট রোডের ধারে আমিই তখন প্রিটি উম্যান।
হেলাল হাফিজ-এর একটি কবিতা
হৃদয়ের ঋণ
আমার জীবন ভালোবাসাহীন গেলে
কলঙ্ক হবে কলঙ্ক হবে তোর,
খুব সামান্য হৃদয়ের ঋণ পেলে
বেদনাকে নিয়ে সচ্ছলতার ঘর
বাঁধবো নিমেষে। শর্তবিহীন হাত
গচ্ছিত রেখে লাজুক দু’হাতে আমি
কাটাবো উজাড় যুগলবন্দী হাত
অযুত স্বপ্নে। শুনেছি জীবন দামী,
একবার আসে, তাকে ভালোবেসে যদি
অমার্জনীয় অপরাধ হয় হোক,
ইতিহাস দেবে অমরতা নিরবধি
আয় মেয়ে গড়ি চারু আনন্দলোক।
দেখবো দেখাবো পরস্পরকে খুলে
যতো সুখ আর দুঃখের সব দাগ,
আয় না পাষাণী একবার পথ ভুলে
পরীক্ষা হোক কার কতো অনুরাগ।
তসলিমা নাসরিনের একটি কবিতা
ব্যস্ততা
তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম, যা কিছু নিজের ছিল
দিয়েছিলাম,
যা কিছুই অর্জন-উপার্জন!
এখন দেখ না ভিখিরির মতো কেমন বসে থাকি!
কেউ ফিরে তাকায় না।
তোমার কেন সময় হবে তাকাবার! কত রকম কাজ
তোমার!
আজকাল তো ব্যস্ততাও বেড়েছে খুব।
সেদিন দেখলাম সেই ভালবাসাগুলো
কাকে যেন দিতে খুব ব্যস্ত তুমি,
যেগুলো তোমাকে আমি দিয়েছিলাম।
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ২০।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
কুড়ি.
অর্ধেক রাত জেগেই শুনেছিলাম রফিকুলের কবিতা
১৯৯৪ সাল। সে বছরই প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কোথায় পা রাখি’ প্রকাশিত হয়েছে। দশটা কবিতা আছে এই কাব্যে। মধুমঙ্গল বিশ্বাস ‘দৌড়’ পত্রিকার প্রকাশনা থেকেই কাব্যখানি বের করেছেন। আনন্দ আর আনন্দ। সাইড ব্যাগে কাব্যগুলি ভ’রে নিয়ে বেড়াচ্ছি কলেজ দাপিয়ে। সকলকে এক কপি করে কিনতেই হবে এই আমার আবদার। তা কেউ-ই অমত করেননি। সবাই কিনেছেন আমি যাকেই বলেছি। কলেজের দো-তলার সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ মৃদুলা আমার হাতখানি চেপে ধরল। বলল, “কী অসাধারণ কবিতা লিখেছ তার জন্য এই পুরস্কার।” কথাটি বলতে বলতেই আর অপেক্ষা করলো না, হঠাৎ আমার মুখের কাছেই তার ঠোঁট দুটো এগিয়ে নিয়ে এলো। একটি কাব্য লিখে এই একটি চুম্বন যেন আমার প্রাপ্য ছিল। বলাবাহুল্য এটিই ছিল আমার শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। মৃদুলা বাংলা সাহিত্যেরই ছাত্রী আমার দুই বছরের সিনিয়র। দীর্ঘদিন একজনের সঙ্গে প্রেম করেও ছেলেটি তাকে ফাঁকি দিয়েছে বলে আজও সে বিয়ে করেনি। অপেক্ষায় আছে শুধু একটি চাকরির। চেহারার জৌলুস অনেকটাই কমেছে। তবুও বেশ প্রাণবন্ত চনমনে। রবীন্দ্র সংগীত গাইতে পারে, কবিতাও ভালো আবৃত্তি করতে পারে। আমার নতুন কাব্যগ্রন্থ থেকে বেশ কয়েকটি কবিতা সে পড়ে শোনালো। নিজের কবিতা তার মুখে শুনতে শুনতে আমারও শিহরন জেগে উঠলো। “তুমি পারো মৃদুলাদি, কী চমৎকার তোমার কন্ঠ, উচ্চারণের কোথাও জড়তা নেই!” কথাটি শুনে সে হেসে উঠলো। হাসির সঙ্গে সঙ্গেই টোল পড়লো তার দুই গালে। আরও তাকে সুন্দর দেখালো। সূর্য প্রায় ডুবতে যাচ্ছে তখন। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরবো। মৃদুলার কাছে বিদায় নিলাম।
হোস্টেলের ছাদে উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখি ব্যস্ত শহরে কত হাঁকডাক। মানুষজন ছুটে চলেছে। চলমান আলোগুলি সাপের ফণার মতো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। জ্যোৎস্না নেমে এসেছে ছাদেও। কুয়াশা বেশ হালকা, কিন্তু প্রকৃতির সহাস্য উদারতায় এক ধরনের স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে।
মালঞ্চ পল্লির হোস্টেলে চার নম্বর রুমে সেদিন আর কেউ ছিল না। আমার রুমমেট দু’জন শিক্ষক দুজনেই বাড়ি গেছে। সেদিন নিভৃতে অনেক কথাই ভাবতে লাগলাম। মৃদুলাদির চুম্বনে যতটা উত্তাপ অনুভব করলাম আগে তো এমন করিনি। রুমা কতবার আমাকে চুম্বন করেছে, কিন্তু সেই চুম্বনে এতটা উষ্ণতা ছিল না। তাহলে স্নেহের চুম্বন কি আলাদা হয়? এই চুম্বনটাও কি স্নেহের ছিল নাকি অন্য কিছু? ভাবতে ভাবতেই অন্ধকার হয়ে গেল। আমি আলো জ্বালাতেও ভুলে গেলাম। আশ্চর্য একটা প্রতিক্রিয়া শরীর ও মনে ছড়িয়ে পড়েছে। সেদিন আর পড়াতে মনোযোগ দিতে পারলাম না। খাবারের ঘন্টা পড়লে উঠে আলো জ্বালালাম। তারপর কিচেনের দিকে রওনা হলাম। মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগলো সেই উষ্ণতাটুকু।
জীবনে বারবার নারী এলেও বারবার আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে কয়েক পা অগ্রসর হয়ে আবার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। এর অন্যতম কারণ হলো জীবনের অনিশ্চয়তা। অন্ধকারময় এক ভবিষ্যৎ। মৃদুলা ভরা কলসের মতো। তার মধ্যে প্রচণ্ড ঢেউ আছে। প্রবল স্রোত আছে। যৌবনের স্থিরতা আছে। সবই অনুভব করতে পারি, কিন্তু তাকে আপন করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। আমার হৃদয় এমন একটা বাড়ি যে বাড়িতে অতিথিকে ডেকে এনে আপ্যায়ন করার মতো কিছুই নেই। শুধু হাওয়া আর এক উদাসীন বাউলের গুন গুন ছাড়া আর কিবা সম্বল? স্বপ্নগুলি প্রত্যহ যাওয়া-আসা করে, কিন্তু সবই ধূসর। মরুভূমিতে বেঁচে থাকার মতো তাদের দশা। একদিকে বাড়ির চিন্তা, আগামী মাসটা কিভাবে যাবে, কিভাবে দুশো টাকা সংগ্রহ করবো ইত্যাদি। ভাবতে ভাবতেই চোখে ঘুম ধরে গেছে। কখন আলো জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙছে ভোরবেলায় একটি স্বপ্ন দেখে। বিশাল একটা নদী। ওপারে যাবার জন্য একটি নৌকার অপেক্ষা করছি। দূর থেকে একটা নৌকা নিয়ে কে একজন এগিয়ে আসছে। আমি ব্যাকুল হয়ে ডাকছি তাকে নৌকায় ওঠার জন্য। কিন্তু কিছুতেই সে থামছে না। নৌকা নিয়ে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। না কিছুতেই আমাকে ওপারে নিয়ে যাবে না। আমি ভীষণ কষ্ট পেয়ে তখন মাঝিকে তিরস্কার করতে শুরু করেছি। আর সেই অবসরেই ঘুম ভেঙে গেছে। স্বপ্নটি একটা প্রতীক মাত্র। নিজের মনে মনেই তার ব্যাখ্যা করে ফেললাম। নৌকা আসলে একটি সাফল্যের মাধ্যম মাত্র। নদীর স্রোত প্রবহমান সময়। সময়ের কাছে আমি হেরে যাচ্ছি। নৌকায় উঠতে না পারা আমার ব্যর্থতা। মাঝি তো যুগস্রষ্টা, আমার নিয়তি। আমি শুধু নিয়তিকেই দোষারোপ করে চলেছি। ব্যাখ্যাটি মনে মনে নিজেকেই বোঝাচ্ছি। তারপর খাতা ও কলমটি নিয়ে সেই দিনই লিখে ফেলেছিলাম একটি কবিতা।
“এপারেই আমার নির্বাসন
নির্বাসন আমাকে মানায়
দূরের কল্লোলে কারা যায়?
তাদের রহস্য বুঝি নাকো
আমার হৃদয় শুধু গ’লে গ’লে ঝরে
কত যে ফাগুন যায়, কত কাকলির বার্তা আসে
নৌকাটিও যায় ভেসে ভেসে
আমার নিয়তি শুধু আমাকে বোঝায়
আমার শূন্যতা এসে আমাকে গিলে খায়।”
চিরদিনই শূন্যতার কাছে আমি দায়বদ্ধ হয়ে উঠি। হাত বাড়িয়ে যা কিছু ধরতে চাই, হাতে শুধু শূন্যতাই উঠে আসে। হোস্টেলের ছাদে উঠে চারিদিকে চেয়ে দেখি ব্যস্ত শহরে কত হাঁকডাক। মানুষজন ছুটে চলেছে। চলমান আলোগুলি সাপের ফণার মতো দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে আবার মিলিয়েও যাচ্ছে। জ্যোৎস্না নেমে এসেছে ছাদেও। কুয়াশা বেশ হালকা, কিন্তু প্রকৃতির সহাস্য উদারতায় এক ধরনের স্নিগ্ধতা বিরাজ করছে। একদল কাক না নিশাচর কোনো পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল বুঝতে পারলাম না। ধীরে ধীরে নেমে এলাম নিচে।
সকাল সকাল কলেজে এসে জানতে পারলাম আজকে আমাদের ক্লাস ডেমোনস্ট্রেশনে যেতে হবে। অনেকটা দূরের পথ। মৃদুলাদি এবং আমি একই স্কুলেই পড়েছি। স্কুলের নাম বিভূতিভূষণ হাইস্কুল। কিন্তু এখনো মৃদুলাদি এসে পৌঁছায়নি। এই মাসে বাড়ি যেতেও পারিনি। যাদের টিউশানি পড়াতাম তারা অপেক্ষায় থাকবে, কারণ তাদের বলে এসেছিলাম প্রতি মাসেই ছুটি পেলে চলে আসবো। কিন্তু এ মাসে সম্ভব হলো না। মাসে কয়েক দিন পড়িয়ে দিলেই অন্তত কিছু টাকা হাতে আসতো যা আমার কাছে খুবই প্রয়োজনীয় ছিল। আর ভাবনার বিষয় তো সেই কারণেই। এই মাসে হয়তো দুশো টাকা সংগ্রহ করাও সম্ভব হবে কিনা সেটাই ভাবছিলাম। হঠাৎ কে এসে ঘাড়ে হাত রাখলো। একেবারে চমকে উঠেছি। পিছন ফিরে দেখি রফিকুল হক। হ্যাঁ, তরুণ কবি রফিকুল। মালদহের গাজোলে বাড়ি। গত বছরই সে এই কলেজ থেকে বি-এড ট্রেনিং করেছে। মালদহের একটি গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের অনুষ্ঠানে তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। প্রথম দর্শনেই মুগ্ধ করেছিল রফিকুল। তার কবিতার মধ্য দিয়েই শুনতে পেয়েছিলাম জীবনের প্রতিধ্বনি। সেই থেকেই মূলত রফিকুলের সঙ্গে সম্পর্ক।
—কলেজেই এসেছিলাম একটি প্রয়োজনে। তোমরা কোথায় বেরোচ্ছো?
—আজকে ক্লাসডেমোনস্ট্রেশন আছে। আরেকজনের জন্য অপেক্ষা করছি।
—তা কোন স্কুলে দিয়েছে?
—বিভূতিভূষণ হাইস্কুল।
—চলো তাহলে আমার সঙ্গে, তোমাকে পৌঁছে দিই, তারপর আজকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব।
— তুমি কি আবার আসবে?
—হ্যাঁ তোমাকে নিয়ে যেতে আসবো।
বহুদিনের আমার ইচ্ছে ছিল রফিকুল এর বাড়ি যাওয়ার। আজকে যখন সুযোগ পেয়েছি তখন আর হাতছাড়া করি কেন? মৃদুলাদির জন্য আর অপেক্ষা করলাম না বেরিয়ে পড়লাম রফিকুলের সঙ্গেই। গাজোল যেতে হলে ওই পথেই যেতে হবে।
সেদিন মৃদুলাদি কী কারণে কলেজ আসতে পারেনি তা আর জানতে পারিনি। আমি ক্লাস শেষ করে রফিকুল এর সঙ্গে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। গাছপালায় ঘেরা শান্ত নির্জন তার এলাকা। চারিদিকেই আমবাগান। কোথাও খলপা দিয়ে তৈরি করা ছোট ছোট বাড়ি। কোথাও ইটের সঙ্গে মাটির প্রলেপে তৈরি করা দেয়াল। রফিকুলের বাড়িটি টিনের ছাউনি করা মাটির বাড়ি। দো-তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠেই রফিকুলের পড়ার ঘর। খাতাপত্র ও বই ছড়ানো আছে খাটের ওপর। সেখানে গিয়েই বসলাম। রফিকুল এর বাবা নেই তার মা আছে। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। মায়েরও বয়স হয়েছে। তবু সেই সন্ধ্যা বেলায় ছোলার সঙ্গে মুড়ি আর চা খেয়েছিলাম। তারপর অর্ধেক রাত জেগেই শুনেছিলাম রফিকুলের কবিতা। তার তুলাদিকে নিয়ে অনেক সিরিজের কবিতা মনকে ব্যাকুল করে দিয়েছিল। তুলাদির জন্য রফিকুলের বিরহ এবং কষ্ট ছত্রে ছত্রে উঠে এসেছিল কবিতার। এক মানবিক আবেদনের প্রত্যয় ভুমিতে দাঁড়িয়ে রফিকুল তার ঈশ্বরকে খুঁজেছিল। কবিতা যে কতখানি হৃদয় থেকে আসে কতখানি আবেগের স্রোত হয়ে জীবনযাপনকে প্লাবিত করে তা সেই দিনই বুঝেছিলাম। তার দো-তলার মাটির কোঠায় বসে বসে খেয়েছিলাম ভাতের সঙ্গে অরহড়ের ডাল আর পটল ভাজা আর আলু সেদ্ধ। সাদাসিধে জীবনযাত্রা আর কবিতার মধ্যে ডুবে থাকা রফিকুল যে খুব মাটির কাছাকাছি বাস করে এবং অহংকারহীন একটি জীবনকে বহন করে নিয়ে চলে তাতে আমি মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। পরের দিন কলেজে আসার মুহূর্তেই রফিকুল আমার সঙ্গে এসেছিল। রফিকুলের মা বলেছিলেন, “আবার আসিও বাবা, আমাদের গ্রাম তোমার কেমন লেগেছে তা জানি না, তবে আমরা খুব সাধারণ মানুষ, আমার রফিকুল এখনো পর্যন্ত বেকার হয়েই থেকে গেল।”
আমিও বলেছিলাম, “হ্যাঁ খালা, আমিও জানি, খুব ভালো লাগলো আপনাদের গ্রাম। সময় পেলে অবশ্যই আবার আসবো। রফিকুল খুব ভালো ছেলে , ওকে আমার প্রথম থেকেই ভালো লেগেছে।”
রফিকুলের মা আমাদের জন্য হাত তুলে দোয়া করেছিলেন তারপর বেরিয়ে এসেছিলাম তাদের বাড়ি থেকে। পরে আরো কয়েকবার গেছি,পেয়েছি আদর যত্নও। রফিকুলের একটি কাব্য প্রকাশিত হয়েছিল ‘দৌড়’ প্রকাশনা থেকে ‘মানুষ এবং মানুষ’। রফিকুল চণ্ডীদাসের, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এবং নজরুলের মতোই উচ্চারণ করেছিল ‘মানুষ এবং মানুষ’। ধর্ম নয়, জাত নয়, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ নয়, কালো-সাদা নয়, শুধু মানুষ। রফিকুলের কাছে মানুষই মহৎ মানুষই বিস্ময়, মানুষই বিরাট।🍂 (চলবে)
🍂কবিতা
বৃন্দাবন দাস-এর কবিতা সিরিজ
এইসব পাঠক্রম
তুমি যে কথা বোঝো আমিও
তোমার ঘরের ভিতরে যে ঘর আমারও
তুমি যে সোজাকথা বলো তাও
প্রতিমুহূর্তে এগিয়ে যাচ্ছি আর একটু শূন্যতায়
২.
একটু আগে রকের স্বপ্ন দেখছিলে
প্রান্তর ভাঙতে ভাঙতে আমি অবাক সন্ন্যাস
অভিশাপ কুড়োতে কুড়োতে বিস্ফার অক্ষর
একটু পরেই নিশ্চল তুমি সামাজিক বড়
৩.
কোনো কথা নয় আমাদের জড়-হৃৎপিণ্ড
ধুলো উড়িয়ে শস্য কিনবে মাটিও
খনির ভিতর দহন ঈথার সেখানেও
খান খান ভেঙে যাচ্ছে আঙুল ও স্পর্ধা
৪.
তুমি যে বৃত্তের কথা বলো জলস্রোত
তুমি যে বীজের সন্ধান করো আর্তনাদ
যে সঙ্গমের কথা জানো আগ্নেয়গিরি
জল ভেঙে ভেঙে জাগিয়ে তুলছো রোমশ পাপ ও পূর্ণিমা
অরুণ দেব-এর একটি কবিতা
সিঁদুর মোছার কাল
এই শেকল ভাঙার জন্য নয়
একে মুছতে হবে
একে ভুলতে হবে
এ এক সিঁদুর মোছার কাল।
এই যে বাঁধন ভেবে বাঁধো
একে নিয়ম থেকে ছাঁটো
একে আর করো না খাটো
এ এক শাঁখা ভাঙার কাল।
এই সমাজ সমাজ খেলা
একে গুদাম ঘরে রাখো
একে অসামাজিক ডাকো
এ এক বিচার খোঁজার আকাল।
এই যে রক্ত মাংস শরীর
একে একবার চেনো
একে আদর দিয়ে কেনো
এক পৃথিবী মানুষ তোমার বন্ধু চিরকাল।
এই ঘরে সব আপন আপন
এক পিতা, এক মাতা স্বজন
এক পুত্র, এক কন্যা বোন
কে কার হবে, কেউ কারও নয় ছিন্ন হোক বাঁধন।
অভিজিৎ দত্ত-এর একটি কবিতা
ঈদ
ঈদ মানেই আনন্দ
ঈদ মানেই বন্ধুত্ব
ঈদ মানেই সকলকে একসাথে
নিয়ে চলার মন্ত্র।
ঈদ মানেই সম্প্রীতি
ঈদ মানেই প্রেম-প্রীতি
ঈদ মানেই দয়া-মায়া
ঈদ মানে সহানুভূতির ছোঁয়া।
ঈদ মানেই একতা
ঈদ মানেই মায়া-মমতা
ঈদ মানেই সকলের সঙ্গেই
আনন্দকে ভাগ করে নেয়া।
ঈদ মানেই নয় শুধু কোন
ধর্মীয় উৎসব পালন
এর মাধ্যমেই হয় আমাদের
বিবেকের নতুন করে জাগরণ।
বাণীব্রত-এর দু’টি কবিতা
তবুও…
মনের গহীন তটে আঁকা সময়
শান্ত জোছনা মেখে নেয় লাল মেঠো পথ
মোরাণ রাঙানো পথের একাকিত্বে
স্নিগ্ধতা যাচে প্রেম
আবীরের আঁচলে পলাশের গন্ধ মেখে
নীল নিকানো আসমানে শান্তি খোঁজে
এক দল বালিহাঁস।
তবুও…
আবার হবে তো দেখা
চৈত্র মাসের দগ্ধ দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীরে
তোমাকে দেখলাম, চোখে জলন্ত দৃষ্টিভঙ্গি।
চোখের পরে চোখ রাখলে এক সময়।
অস্ত মিত হলো সেই দৃষ্টি।
কতো জল বয়ে গেলো সময়ের হাত ধরে।
কতো শব্দ রচিত হোলো জীবনের পাতায়, শেষে রয়ে গেল…
আবার হবে তো দেখা?
🍂গল্প
কাজল হসপিটাল থেকে ফিরল একটা স্কচের বোতল নিয়ে। সারা মুখে আনন্দ ছড়ানো। বলল ডারলিঙ আজ আমাদের সেলিব্রেশন হবে। মনে আছে সেই দিনের কথা? তার আগে চল কিচেনে, কটা চিকেন পকৌড়া বানিয়ে নিই। তারপর প্রীতমার কানে কানে যা বলল তাতে প্রীতমার ভয়, আনন্দ মিলে মিশে শরীরে একটা কাঁপন অনুভব হল। এক লহমায় যদি কিন্তু সব উড়ে গেল।
বেস্ট ফ্রেন্ড
পাপড়ি ভট্টাচার্য
অফিস থেকে ভর সন্ধেবেলা ফিরে দরজা খোলা মাত্র প্রীতমাকে কাজল জড়িয়ে ধরে এক পাক ঘুরে সোফায় ধপাস করে বসে পড়ল।
প্রীতমা বলল, আরে কি হয়েছে বলবি তো। –বলব বলব আগে কড়া করে দুকাপ কফি বানিয়ে আনত।
–ঠিক আছে।তুই ফ্রেস হয়ে নে,শোন গিজার টা চালিয়ে নিস। হঠাৎ ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে কিন্তু। ওকে, ওক্কে।
কাজল যখন বাথরুম থেকে বেরল, প্রীতমার কফি রেডি। সেই সঙ্গে প্রীতমার ভাবনার লম্বা সুতো আরও লম্বা হলো। কি বলতে চায় কাজু?তার নিজের শরীরের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা মেডিসিনের সম্পর্ক কি এবার শেষ হল? আর কতদিন এ লড়াই চলবে কে জানে।প্রীতমা একটা বড় শ্বাস ফেলে।
ট্রেতে বিস্কিট সাজিয়ে দুমগ কফি সেন্টার টেবিলে প্রীতমা রাখতে যাবে কাজল হাঁ হাঁ করে উঠল। ঝাঁকড়া চুলের জল ছিটিয়ে প্রীতমার থুতনি নেড়ে বলে উঠলো,না ওখানে নয় বেডরুমে চলো। বাইরের ঘরে বসে ঘরের কোনও কথা হবে না।
আরে কে আছে যে তোর সিক্রেট কথা শুনবে। —কেন দেওয়াল? —ঠিক আছে চল, তোর পাগলামি দেখছি বেড়েই চলেছে। –পাগল না হলে কি তোকে এভাবে পেতাম? সেই কবে থেকে…
-সেই ক্লাস সেভেনে থাকতে।নে নে কফি খা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।
মাঝে মাঝে কাজলের ক্লান্তি এসে যায়। তবু মানুষকে সুস্থ করতে প্রাণপণ লড়াই করে যেতে হচ্ছে। তার অবশ্য একটা মেডিক্যাল টিম সব সময় তার পাশে থেকে হেল্প করে। তবে সেই আকাঙ্খিত কেসটি এলে মনটা তার ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সেটা হলো মাতৃত্ব। একটি নারী পূর্ণতা পায় মাতৃত্বে।
দুজনে খাটে হেলান দিয়ে বসে একে অন্যের কাঁধে মাথা রেখে কফি খেতে খেতে সুদূর অতীতে ফিরে গেল।কাজল বলল– যখন ক্লাস নাইনে এক কোচিং এ ক্লাস করতাম, তখন একদিন কোচিং বন্ধ থাকলে বা একদিন তুই ক্লাসে না এলে তোকে খুব খুব মিস করতাম। কেন এমনটা হতো জানিনা। সব সময় তোর মুখটা লুকোচুরি খেলত। কত কত সুন্দরী মেয়ে তো ছিল ক্লাসে। খুব মজা করত ওরা আমাকে নিয়ে, তুই ওদের গা ঘেঁষে বসতিস। আমার খুব রাগ হত তখন।
আর তুই যখন দেরি করে এসে স্যারের বকুনি খেয়ে মুখ কাচুমাচু করে আমার গা ঘেষে বসতিস, আমি তখন তোর তোর মাথায় চোখে মুখে আদর দিতাম মনে মনে। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। তোকে তো সেদিন থেকেই খুব ভালোবাসি।এখন তুই আমাকে পাশবালিশ করে রাতে ঘুমোলে, আমিও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
এই কাজু জানিস তো কাল ওপাশের ফ্ল্যাটের একটা বাচ্চা মেয়ে পার্কে খেলছিল।আমি খুব চটকে মটকে আদর করেছি।কি ছটফটানি তার। ছিটকে মায়ের কাছে চলে গেল। জানিস কি সফ্ট বাচ্চাটা…
এই ঘুমিয়ে গেলি নাকি? ধ্যাৎ কাকে কি বলছি।
কাজল চোখ বুজে শুয়ে ছিল।সে জানে প্রীতমা বেবী চায়। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সম্ভব নয়। আরও কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
প্রীতমা ভোর ভোর ওঠে। উঠেই সংসারের কাজে হাত দেয়না। একটা ডায়েরি নিয়ে বসে। সকালে প্রথম মনে আসা ভাবনা লিখে রাখে। তারপর ওভেনে চায়ের জল চাপায়। পাতা ভিজিয়ে কাজল কে ডাকে।ওর বেড টি র অভ্যেস।
এই ভোরে মাকে খুব মিস করে প্রীতমা।
ক্লাস এইট পর্যন্ত মা ছিল তার বেস্ট গাইড। জীবনের সেই দিনগুলো, অর্থাৎ ছোটবেলার স্কুল লাইফ, বলতে গেলে মা গুছিয়ে দিয়েছিল সব সব। বাবাকে একটু ভয় পেত প্রীতমা। কাছে যেতনা সহজে। দূরত্ব তৈরি হয়েছে ছোটবেলা থেকেই। বাবা খুব মেজাজী মানুষ। তবে দিদি শ্রীতমা খুব বাবা ভক্ত। বাবার সঙ্গে যত কথা বলে মায়ের সঙ্গে তত না।সে শুনেছে পিসির কাছে। দিদির পর বাবা একটি ছেলে আশা করেছিল, কিন্তু সে মেয়ে হয়ে জন্ম নিল।তাই হাসপাতালে বাবা যায়নি তাকে দেখতে। ছোট থেকে
সে একধরনের অবহেলা পেত। মায়ের আদরে সেটা পূর্ণ হতো যদিও, তবু সেটা বাবার আদর হত না। সে মাকে বুঝতে দিত না। ঐ ছোট বয়সেই সে যেন অনেকটা বড় হয়ে গিয়েছিল। এরপর যখন ক্লাস নাইন তখন স্কুল, কোচিং, সবশেষে কলেজ এবং কেরিয়ার পর্যন্ত কাজল তার বেস্ট ফ্রেন্ড ফিলজফার অ্যান্ড গাইড। ও যেন তার জীবনে এক টার্নিঙ পয়েন্ট।
ওর প্রতিটা কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিয়েছে বলে আজ সে একজন সম্পুর্ণ মানুষ। অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট কাজল দত্ত।
ওর জীবনের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ সোনার সোপান। মাঝে মাঝে প্রীতমার নিজেকে অপরাধী মনে হয়।ওর বাবা-মায়ের প্রচুর আর্থিক সাপোর্ট থাকলেও, কাজলকে নিজেদের মতে কেরিয়ারের দিকে নিতে পারেননি। ওদের কথামত ডাক্তারি পড়েছে। তবে ওঁরা ছেলে গাইনোকলজিস্ট হোক, ওঁরা সেটা চাননি। গাইনো তো কত ছেলেই হয়। নিজেদের ইচ্ছে ছেলের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কি অদ্ভুত মানসিকতা।আর প্রীতমাকে ছোটবেলা থেকেই ভালবেসেছে। তাঁদের সেটাও না পছন্দ। অপছন্দের মূল কারণ প্রীতমা খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী নয়।রূপে তাদের ছেলেকে ভুলিয়েছে। তবে মেডিসিনের হেড অব দা ডিপার্টমেন্টের ডক্টর উৎপল দত্ত, কাজলের বাবা পছন্দ করেন প্রীতমাকে খুব। কিন্ত সেটা…
ভোরে ঘুম ভাঙলেও লেখার টেবিলে প্রীতমাকে দেখে মটকা মেরে পড়ে রইলো কাজল। এই মটকা মারার যে কি সুখ… মায়ের পিটুনি, বাবার বকুনি, ভাইয়ের খুনসুটি আজও মিস্ করে সে।
মায়ের হাতের বেড টি এসে গেলে সব কুড়েমি উধাও হয়ে যেতো।এই ফ্ল্যাটে এসে একমাত্র বেড টি র অভ্যেস টা চালু আছে। বাকি সব তার উল্টে পাল্টে গেছে।
এই নে তোর চা। আরে ওঠ ওঠ।
এই প্রীতি তোর লেখা লেখি হয়ে গেছে তো, এবার একটু আমার কাছে বোসতো। –কি যে বলিস, একি শেষ হবার মতো লেখা?যদ্দিন বাঁচব লিখব।
কি এত লিখিস, একটা কবিতা শোনাত।
সত্যি শুনবি? তোর যা তাড়া… চায়ে লম্বা চুমুক দিয়ে কাজল বলল,নে শুরু কর। প্রিতমা টেবিল থেকে ডায়েরিটা এনে পড়তে শুরু করে।
কবিতার নাম ‘আমার অসামান্য লুকাসিয়াকে, আমাদের বন্ধুত্ব নিয়ে’
“কারণ তুমিই সেই সবকিছু যা আমি দামি মনে করি,/আমার আনন্দ, আমার জীবন, আমার বিশ্রাম।/কোনো নতুন স্বামীর,বা কোনো মুকুট বিজয়ীর ফুর্তি/আমার সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেনা;/তাদের সংগ্রহ পৃথিবীর সামান্য কিছু অংশ,/তোমার মধ্যে আমি সমগ্র বিশ্বকে পেয়েছি।”
–বাহ বাহ্ খুব সুন্দর,কার লেখা ডারলিঙ?
–“ক্যাথারিন ফিলিপস”তাঁকে ওরিন্ডা বলে সবাই চিনতো। অনেক পুরনো আমলের। অনেক শতাব্দী পেরিয়ে…
কোথায় পাস এই সব বই? –কেন লাইব্রেরীতে। –ও তাইতো, সপ্তাহে দুদিন তো যাস ন্যাশানাল লাইব্রেরীতে। বেশ ভালো অভ্যেস। তবে ম্যাডিকেল স্টোরের এতো কাজের মধ্যে এসব করিস কখন?–ঐটুকুইতো আমার খোলা জানালা।তা কবিতা কেমন লাগল? –আমার তো মনে হচ্ছে ওটা আমাকে নিয়ে তুইই লিখেছিস। কাজল প্রীতমার গালে টুসকি মেরে ঢুকে গেল বাথরুমে। একেবারে স্নান সেরে বেরোবে, ঘুম থেকে ওঠার সময় আলস্য করলেও তারপর একেবারে টাইম টু টাইম।আর যখন হসপিটালে এক একটা অপারেশন সাকসেসফুল হয় তখন ঘরে ফিরে সব আনন্দ শেয়ার করে সে প্রীতমাকেই।
খুব খুব ভাল সার্জেন কাজল। ইদানিং ওর এই স্পেশালিটিতে নাম যশ ছড়িয়েছে। মানুষ নিজের মনের চাহিদাকে যত গুরুত্ব দেবে, নিজের শরীরকে যত বুঝতে শিখবে তত প্রযুক্তির নির্ভরতা বাড়বে। কাজলের স্বপ্ন আর প্রীতমার স্বপ্ন সফল করতেই সে ডাক্তারির এক একটা হার্ড সোপান পার করে চলেছে।সব সময় একটা চাপ কাজলের মাথায় খুব যন্ত্রনা সৃষ্টি করে।প্রত্যেক দম্পতি সন্তানের স্বপ্ন দেখে।তারাও দেখে, তবে তাদের দুজনের… জীবন সম্পূর্ণ আলাদা।এই অনিশ্চয়তার দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেতে প্রীতমা নিজেকে কবিতার জগতে ডুবিয়ে রেখেছে।
কাজল ভাবে, প্রীতমার মা হতে একটু সময় লাগবে।ওর শরীরের জটিলতা আছে। কাজল বুঝিয়েছে সব কারণ। ঠিক সময়ে তারাও বেবী আনবে। কিন্তু প্রীতমা সব বোঝে বলেই খুব ভয় পায়।
প্রীতমা এখন একদম চুপচাপ থাকে।
এখন প্রীতমা ফ্ল্যাটে একা, ডাক্তারি কনফারেন্সে কাজল বিদেশ গেছে। ভিডিও কলে গভীর রাতে কাজল জানায় নিউইয়র্ক, গেটিসবার্গ, নায়াগ্রা, ওয়াশিংটন এবং সবশেষে আমেরিকা। তারপর ফিরবে।
প্রীতমার সারাদিন মাথার মধ্যে কিছু শব্দ ঘুরপাক খায়। ভীষণ একা ফিল করলে মাকে ফোন করে। ভাই, দিদি সবার খবর নেয়। আবার ভাবে তার তবে কেন এমন হল। সব গুলিয়ে যায় তার।কত মেয়ের কত সহজে সন্তান আসে। আর তার বেলা? তবে কি মা এই বিয়ে কোনোদিনই মানবেন না? অথচ পুজোর সময় দু’জনের জন্য জামা কাপড় পাঠান। মা আর ছেলের অভিমান কবে যে ভাঙবে। তার উপর তার এই সমস্যার কথা জানতে পারলে হার্ট এ্যাটাক হয়ে যাবে। বাবাকেও জানায়নি কাজল।
অন্যান্য সময় সরকারি হাসপাতালে হাজার রকম পেশেন্ট এবং নানা জটিলতর প্রবলেমও আসে। সেগুলো খুব কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করতে হয়, সবরকম পরিস্থিতি, সবরকম ডাক্তার তৈরি থাকে।
এরপর তো আছে আ্যকসিডেন্ট, মাথায় আঘাতজনিত সমস্যা। ইদানিং ভয়ন্কর কোভিড পরিস্থিতি। পাগল পাগল অবস্থা। মাঝে মাঝে কাজলের ক্লান্তি এসে যায়। তবু মানুষকে সুস্থ করতে প্রাণপণ লড়াই করে যেতে হচ্ছে। তার অবশ্য একটা মেডিক্যাল টিম সব সময় তার পাশে থেকে হেল্প করে। তবে সেই আকাঙ্খিত কেসটি এলে মনটা তার ফুরফুরে হয়ে ওঠে। সেটা হলো মাতৃত্ব। একটি নারী পূর্ণতা পায় মাতৃত্বে। কত রাত তার স্টাডি রুমে কেটে যায়। প্রীতমা কাঁধে হাত রেখে বলে–একটু ঘুমোবিতো নাকি। প্রীতমা কাজলের চুলে বিলি কাটতে থাকে।
প্রায় এভাবে দিন কেটে যাচ্ছে। কোভিডের প্রকোপ কিছুটা কমেছে। প্রীতমার টানা মেডিসিন থেকে কিছুটা রেহাই মিলল। সারা শরীরে মুখে লাবন্য ছড়িয়ে পড়েছে।
কাজল হসপিটাল থেকে ফিরল একটা স্কচের বোতল নিয়ে। সারা মুখে আনন্দ ছড়ানো। বলল ডারলিঙ আজ আমাদের সেলিব্রেশন হবে। মনে আছে সেই দিনের কথা? তার আগে চল কিচেনে, কটা চিকেন পকৌড়া বানিয়ে নিই। তারপর প্রীতমার কানে কানে যা বলল তাতে প্রীতমার ভয়, আনন্দ মিলে মিশে শরীরে একটা কাঁপন অনুভব হল। এক লহমায় যদি কিন্তু সব উড়ে গেল।
এরপর কাজল-প্রীতমা, স্কচ-পকৌড়া… সব সারা শরীরে মাদলের বোল তুলছে। দু’জনের শিরায় শিরায় জ্বলে উঠল আগুন।
উন্মাদনার ক্লান্তি শেষে কাজল বলল–আজ আমার বক্তব্য সকলের সামনে বলতে পেরে খুব হাল্কা লাগছে। একটু পরে শুরু হবে সোনালী আনন্দের চ্যানেলে আমার ইন্টারভিউ। যদিও একদম নতুন চ্যানেল ‘সোনালী আনন্দ’, তবু খুব জনপ্রিয় হয়েছে ।অন্যরকম মাতৃত্ব নিয়ে মানুষদের কাজ করার জন্য।
পাশে বসে থাকা কাজলকে টিভির রঙিন পর্দায় দেখে খুব খুশি প্রীতমা।
“ঠিক কথা, সম্পর্ক মেনে নেওয়া। একসঙ্গে থাকা, বিয়ে, এসবের পরেও যেটা ভাইটাল তা হলো সন্তান।অনেকের এই ইচ্ছের কথা ভেবে আমার
বক্তব্য–স্বাভাবিক দুই নিঃসন্তান দম্পতি খুব সহজেই শিশু দত্তক নিতে পারেন কোনও মানুষের জন্য মানুষের সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো খুব জরুরী।সবাই একই রক্তে মাংসে মানুষ। মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় নারীর গর্ভে সন্তান আসে। কোনো কারণে না এলে তারজন্য তো আমরা রয়েছি। সুচিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে।
হঠাৎ খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল প্রীতমার। আকাশের পূর্বদিকে লালচে আভা লাগেনি তখনও। এই ব্রহ্মমুহূর্তে একটা পাখি সুরেলা তান ধরেছে। কাজল অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ওর চা রেডি করে মোবাইল খুলতেই একটা ম্যাস্যেজ মায়ের। তুই এক্ষুনি চলে আয় আমাদের খুব বিপদ।
রাত দেড়টার সময় মা লিখেছে।সেই ম্যাসেজটা কাজলকে ফরোয়ার্ড করে দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল প্রীতমা।
কাজল যখন পৌঁছাল দেখল প্রীতমের দিদি কোভিডে মৃত। সবাই দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে…
প্রীতমা তার দিদির একমাসের বাচ্চাকে বুকে আগলে দাঁড়িয়ে আছে।
কাজল ব্যালকনিতে বসে আছে। মনটা তার খুব অস্থির। এই সময় মাকে সব বলা যেত। কিন্তু…
**
প্রীতমার কাছে ওর দিদির মেয়ে মানুষ হচ্ছে। একটা আয়া আছে দিনের বেলার জন্য। অবাক লাগে তার দিদির বাড়ির কেউ একবার দেখতে পর্যন্ত এলনা। কুনাল দা নিজের মেয়ের প্রতি একটু মায়াও নেই। আশ্চর্য।🍁
কভার মডেল : মনামী ঘোষ | অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
সম্পাদকীয় ঋণ : ফিরে পড়া : কবিতা, ফিরে পড়া : প্রবন্ধ, মহামিলনের কথা বিভাগে লেখা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।
