



সম্পদকীয়ের পরিবর্তে ✍️
“আমরা শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ আর মা সারদার জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই মায়ের জীবন কি সাধারণ ছিল! অসাধারণভাবে সাধারণ! আমাদের মতই সাধারণ!কখনো কখনো আমি ভাবি মা কে সারাজীবনে যা যা করতে হয়েছে, ঠাকুরকে তা করতে হলে ঠাকুর কি করতেন?!এক মানসিক ভারসাম্যহীন ভাইঝিকে সামলানো, ঘরের মেয়েদের দেখাশুনা করা, সন্ন্যাসী সন্তানদের যত্ন, ভক্ত ও দর্শনার্থীদের ভোজনের ব্যবস্থা, একদল লোভী আত্মীয়স্বজনের সাথে একত্রবাস, সংসারের সমস্যা সমাধান, নবঅঙ্কুরিত রামকৃষ্ণসঙ্ঘের সঙ্ঘজননীর দায়িত্ব পালন! আমার তো মনে হয় ঠাকুর তৎক্ষণাৎ সমাধিস্থ হয়ে যেতেন! (সবার হাসি) ঠাকুর কিচ্ছু করতেন না এসব! (হাসি) আর যদি বিবেকানন্দকে বলা হত – সারা পৃথিবী ঘুরে অদ্বৈত বেদান্ত প্রচার না করে, বাংলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে একগুচ্ছ অত্যন্ত সমস্যাসৃষ্টিকারী আত্মীয়দের সাথে থাকো, কূটনো কোটো, গোয়ালের গরুদের দেখাশুনা করো, আমি নিশ্চিত – বিবেকানন্দ প্রায়ই বলতেন ইচ্ছে করে এসব ছেড়ে হিমালয়ে গিয়ে তপস্যায় ডুবে যাই- তা উনি হিমালয়ে দৌড়াতেন! (হাসি)
মা কিন্তু সব করেছিলেন। দিব্যত্রয়ীর মধ্যে ওঁরই জীবনটা ছিল আমাদের মতন।ভাবো তো রামকৃষ্ণ, যিনি কিনা বেশীরভাগ সময়েই থাকতেন সমাধিস্থ, যাঁর সর্বদা প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল ঈশ্বরের সাথে, তিনি বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে ঈশ্বরকে দেখিয়ে দিতেন! অথবা বিবেকানন্দ! আর কজন বিবেকানন্দের মত হতে পারবে? এঁরা অসাধারণ। এইরকম দিব্যজীবন আমরা বারবার দেখতে পাব না! কিন্তু মা! তাঁকে যেন আমরা প্রত্যহ প্রত্যক্ষ করি আমাদের জীবনে।ঠাকুর যা বলেছেন, মা ঠিক তাই বাস্তবে জীবনে করে দেখিয়েছেন।আর এই কারণেই তাঁকে বোঝা দুষ্কর! আমি দেখেছি অনেক সন্ন্যাসী ভক্তজন মূলতঃ স্বামিজীর ব্যাক্তিত্বে আকৃষ্ট হন। স্বামিজীর হাত ধরে তারা ঠাকুরের কাছে আসেন। আর আরো অনেক অনেক আধ্যাত্মিক অগ্রগতির পর তারা রামকৃষ্ণ থেকে সারদার কাছে আসেন!আধ্যাত্মিক জীবনের উপান্তে তারা মায়ের শরণ নেন।স্বামী তুরীয়ানন্দের শেষ জীবনটা শুধুই ছিল – মা! মা! মা! আজই আমি স্বামী মহাযোগানন্দজীর থেকে শুনছিলাম – স্বামী জগদীশ্বরানন্দ নাকি স্বামী জগদানন্দ? (দর্শকাসন থেকে অস্পষ্ট উত্তর) ওঃ স্বামী অতুলানন্দ! ব্রহ্মজ্ঞানী। সর্বদা মুখে একটাই কথা – হরি ওম! শেষ জীবনে উনি খালি বলতেন – মা!অর্থাৎ আধ্যাত্মিক জীবনে অগ্রগতির সাথে সাথে আমরা স্বামীজি থেকে ঠাকুর থেকে মায়ের দিকে এগিয়ে যাই!এটা আমি প্র্যাকটিক্যালি নিজে দেখেছি। বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দির টি সবথেকে বড় এবং কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত – ওটিকে কেন্দ্র করে সবকিছু আবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু মায়ের মন্দিরটি বেশি জনপ্রিয়! আমি কত সময় দেখি মায়ের মন্দিরে মানুষজন এমনিই বসে আছে, প্রার্থনা করছে, ধ্যান করছে, কখনো বা কাঁদছে! বা এমনিই গল্প করছে। কিন্তু মায়ের মন্দিরে লোকের ভিড় বেশি!
একবার আমি মা সারদার মন্দিরের দিকে যেতে যেতে ভাবছিলাম – ঈশ্বরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা কি রকম? ঈশ্বর আমাদের কিভাবে দেখেন? আর মায়ের মন্দিরের সামনে যেতেই উত্তরটা ঝট করে আমার মনে এলো – সন্তান! আমরা ঈশ্বরের সন্তান! আর ঈশ্বর আমাদের মায়ের মত! ঈশ্বরের মাতৃভাবটিই আমার মনে হয় মূলভাব! পৃথিবীর অনেক প্রাচীন ধর্মেই জগৎ সৃষ্টির কারণ হিসেবে ঈশ্বরের মাতৃভাবটিকেই ধরা হয়েছে – মা! যাঁর থেকে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে, যিনি জগৎ পালন করছেন, যাঁর মধ্যে জগৎ লয় হয়ে যাবে!
মা সারদার ও মূলস্বরূপটি হচ্ছে – তিনি মা! তাঁর সম্বন্ধে যা কিছু আমরা পড়ি, যা কিছু আমরা শুনি, তার থেকে এই কথাটাই মনে হয়!
স্বামী অরূপানন্দ যিনি মায়ের দীর্ঘকালের সেবক, তিনি যখন মায়ের কাছে দীক্ষা নিতে এসেছিলেন, সেই সময়কার এক সুন্দর স্মৃতিচারণা করেছেন। অরূপানন্দজীর মা ছোটবেলাতেই মা.রা গিয়েছিলেন। যখন তিনি মাকে প্রথম দেখেন, তাঁর মুখমন্ডলের কমনীয় এবং স্নেহপূর্ণ ভাবটি দেখে প্রথম দর্শনেই মনে হয় – ইনিই আমার হারিয়ে যাওয়া মা! সেই ভাবটি তাঁর মধ্যে সারা জীবনের জন্য প্রোথিত হয়ে যায়। অরূপানন্দজীর সাথে মায়ের খুব সুন্দর একটি কথোপকথন আছে।
অরূপানন্দজী জিজ্ঞাসা করেছিলেন
– তুমি কি সত্যিই মা?
-হ্যাঁ আমি সত্যিই মা!
-আমাদের সবার মা?
-হ্যাঁ!তোমাদের সবার মা!
-এই যে গরু বাছুর কীটপতঙ্গ এদেরও মা?
– হ্যাঁ! আমি ওদেরও মা!
এমনকি ঘরে থাকা কুকুর বিড়াল গরু বাছুরও অনুভব করতো মা তাদের ভালোবাসেন এবং তাদের রক্ষা করেন। একটা বিড়াল ছিল, সবাইকে জ্বালাতন করে বেড়াত। কিন্তু কেউ মারতে গেলেই বা তাড়া করলেই ছুটে গিয়ে মায়ের পিছনে লুকিয়ে পড়ত। একবার এক সাধু আর সহ্য না করতে পেরে দু. ঘা বসিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে মা অত্যন্ত আহত হয়ে বলেন – ওকে মে.রো না!ওর মধ্যেও আমি আছি। মা বোধহয় চিরকালের জন্য সুনিশ্চিত করেছিলেন বিড়ালটার গায়ে যেন কেউ হা.ত না দেয়। (হাসি)আবার মজার ব্যাপার হচ্ছে মা মাঝেমধ্যে নিজেই ওর সাথে কঠোর ব্যবহার করতেন! মাঝেমধ্যে তিনি একটা লাঠি তুলে বিড়ালটিকে মা.রার ভ.য় দেখাতেন। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে বাকি সবাই ভ.য় দেখালে বিড়ালটা পালিয়ে যেত, কিন্তু মা ভ.য় দেখালে বিড়ালটা বড় বড় চোখ করে মা.য়ের দিকে তাকাত, তারপর মায়ের কোলের কাছে আরো ঘেঁষে বসত!বিড়ালটা মনে হয় আমাদেরই মতন, তাই না?(সবার হাসি)
বেলুড়মঠে তখন স্বামী বিবেকানন্দ আছেন। মঠ নির্মাণের কাজ চলছে। একজন শ্রমিক বোধহয় কিছু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে। স্বামীজী তাকে মঠ থেকে তাড়িয়ে দিলেন। সে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা চলে গেল মায়ের কাছে। গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সব কথা বলল। সে সময় মায়ের বাড়িতে বাবুরাম মহারাজ ছিলেন – স্বামী প্রেমানন্দ। মা তাকে ডেকে বললেন
– এই লোকটি বড় গরিব।কোথায় যাবে ? ওকে আবার তোমরা কাজে বহাল কর। মঠে গিয়ে বলো আমি বলেছি।
এবার বাবুরাম মহারাজ বললেন
– ওরে বাবা নরেন বিশাল রেগে যাবে।
মা শুধু বললেন
– নরেন কিছু বলবে না।ওকে বলো, আমি বলছি।
ব্যাস এটুকুই যথেষ্ট।
বাবুরাম মহারাজ লোকটিকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে বেলুড়মঠে ফিরে এলেন। আর দেখেন গেটের সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে? না স্বয়ং বিবেকানন্দ! বাবুরাম মহারাজ কে দেখিয়ে বিবেকানন্দ বলে উঠলেন
-দেখ দেখ! বাবুরাম কি করেছে?আবার ফেরত নিয়ে এসেছে।
বাবুরাম মহারাজ তখন বললেন
– কিন্তু মা বলেছে ওকে আবার নিয়ে নিতে। ও মায়ের কাছে গেছিল। লোকটি অত্যন্ত ভয়ে ছিল, বিবেকানন্দ বোধহয় খুব বকা দেবেন। কিন্তু বিবেকানন্দ হাসতে হাসতে বললেন
– সোজা হাইকোর্টে পৌঁছে গেছ!
জনৈকা মহিলা ভক্ত একবার আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন
– ঠাকুর কিন্তু আমাদের ভক্তজনদের অনেক বেশি ভালবাসতেন।
মা তাতে বলেছিলেন
– মনে হতেই পারে সে কথা! উনি তো নিজে বাছাই করে মানুষ নিয়েছিলেন, তাও আবার কত পরীক্ষার পর! আর আমার কাছে পাঠিয়েছেন পিঁপড়ের সারি!(সবার হাসি) সত্যিই মা কাউকে কখনো ফেরাননি!
মা কাউকে কৃপা করতেন, তাকে দীক্ষা দিয়ে।একবার তিনজন ভক্ত স্বামী ব্রহ্মানন্দের কাছে দীক্ষা নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু ব্রহ্মানন্দ তাদেরকে না করে দেন। তিনি বলেন – তোমরা জয়রামবাটি চলে যাও।সেখানে মা আছেন, তিনি যদি চান তিনি তোমাদের দীক্ষা দেবেন।কিন্তু আমি দিতে পারবো না। সম্ভবত তাদের অতীত জীবনের কর্ম খুব একটি ভাল ছিলনা। এমনটি মনে করা হয় দীক্ষার মাধ্যমে গুরু শিষ্যের সমস্ত পা.প নিয়ে নেন এবং তাকে ফলভোগ থেকে মুক্ত করেন।এই প্রথমবার মা কিন্তু সেই তিনজনকে মানা করলেন। দ্বিতীয়বার অনুরোধ করার পরেও মানা করলেন।তৃতীয়বার আর মা না বলতে পারলেন না। বেলুড়মঠে যখন সেই সংবাদ এসে পৌঁছায়, গঙ্গার ধারে বেঞ্চে স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী তূরীয়ানন্দ, স্বামী শিবানন্দ ও প্রমুখরা বসেছিলেন। সবাই খানিকক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। তারপর স্বামী প্রেমানন্দ বললেন
– কি মহাশক্তি! যে বিষ আমাদেরকে ভ.স্ম করে দিত, মা একটি শব্দ পর্যন্ত না করে তার ধারণ করলেন!
এই মানুষেরা কোনভাবে বুঝতে পারেন, আমাদের অতীত, আমাদের ভবিষ্যৎ। রামকৃষ্ণদেব কিন্তু কখনো এ ধরনের কথাবার্তা বলতেন না। কিন্তু একবার অত্যন্ত ভাব চলে আসায় তিনি এক অন্যরকম কন্ঠে মাষ্টার মহাশয় কে বলেন
– বল কি জানতে চাও! তোমার অতীত তোমার ভবিষ্যৎ সব আমি দেখতে পাচ্ছি! কি? পাচ্ছি না?
মাস্টার মহাশয় কিন্তু তৎক্ষণাৎ জোড়হস্তে মাথা নিচু করে বলেন
-হ্যাঁ !আমি জানি, আপনি সব জানেন!
মা বোধহয় সর্বত্রই দীক্ষা দিয়েছিলেন। রাস্তায়,নিজের ঘরে,মঠে, যে যখন যেখানে কৃপা চেয়েছে। একবার এক রেলওয়ে স্টেশনে একজন কুলি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। কুলি কিন্তু চিনত না কে তিনি। সে কিন্তু আচমকাই মায়ের কাছে গিয়ে কেঁদে পড়ে
– মেরে সীতা মাইয়া, আব তক কাঁহা থি তুম!
অদ্ভুত ব্যাপার বাকিরা অবাক হলেও মা কিন্তু অবাক হননি। তিনি শান্তচিত্তে কুলিটিকে ডেকে নেন এবং সেই রেলওয়ে প্লাটফর্মে দাঁড়িয়েই সেই মুহূর্তে তাকে দীক্ষা দেন। আসলে কোন নারীকে সীতা বলে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে হি.ন্দুমনের এক অনির্বাচনীয় ভক্তির আভাস পাওয়া যায়। আমরা জানি শ্রীবিষ্ণুর অবতার হচ্ছেন শ্রীরাম আর স্বয়ং মহাশক্তি লক্ষ্মীর অবতার হচ্ছেন মা সীতা। সুতরাং সেই নামে কাউকে সম্বোধন করার মধ্য দিয়ে তার প্রতি এক অদ্ভুত ভক্তি এবং ভালোবাসার পরিচয় আমরা পাই।
এতকিছুর পরেও কিন্তু মায়ের সাথে সাধারণ মানুষের এক বিরাট পার্থক্য ছিল। যেকোনো মুহূর্তেই মা তাঁর এক সম্পূর্ণ অন্য স্বরূপ প্রকাশ করতেন, যা অদ্ভুত ছিল এবং সময়ে সময়ে ভীতিপ্রদও ছিল। এই স্বামী অরূপানন্দজী, যিনি মায়ের দীর্ঘকালীন সেবক ছিলেন, জয়রামবাটিতে মায়ের নতুন কুটির নির্মাণ করার কাজে যুক্ত ছিলেন। এবার মায়ের ভাইয়েরা অত্যন্ত লোভী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তারা দেখতেন কলকাতা থেকে বহু মানুষ আসছে। এবং অরূপানন্দজীকে তারা বলতেন তোমরা যখন কিছু টাকা পয়সা পাচ্ছ, তাহলে আমাদেরও কিছু দাও। এবং এইভাবে বারবার অরূপানন্দজীকে বিরক্ত করায় তিনি একসময় মায়ের কাছে গিয়ে বলেন
– মা! মামারা বড্ড লোভী এবং সংসারিক।তারা আমাকে এইভাবে ক্রমাগত টাকার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু আমি তো সন্ন্যাসী হতে এসেছি। এসব তো আমার কাজ নয়! তাই আমি আপনাকে জানাতে এসেছি এই কাজ আমি আর করব না।
অরূপানন্দজী ভেবেছিলেন মা হয়তো তাকে উৎসাহ দেবেন কাজ করার জন্য বা জোর করবেন। মা সেই সময় দালানে খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এক অদ্ভুত দূরবর্তী দৃষ্টি নিয়ে তিনি অরূপানন্দজীর দিকে না তাকিয়ে, সম্পূর্ণ অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন
– ও! তুমি আমার কাজ করবে না? বেশ।তোমায় করতে হবে না!
আমি চেতনানন্দজীর মুখে শুনেছি সেই সময় অরূপানন্দজী মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এবং তিনি মায়ের চারপাশে এক সূক্ষ্ম দিব্যজ্যোতি দেখতে পান! অরূপানন্দজী বলেছিলেন
– মাকে তখন আর সাধারণ গ্রাম্য মহিলা বলে মনে হচ্ছিল না। সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছিল তাকে।
অরূপানন্দজী তৎক্ষণাৎ বলেন
– না, মা! তোমার সব কাজ আমি করব!🍁 -স্বামী সর্বপ্রিয়ানন্দ
🍂মহামিলনের কথা
গুরো! শঙ্কর! আমায় দীন করিয়া দাও প্রভো, যে দীনতা দিয়েছ, ইহা যেন চিরপ্রতিষ্ঠিত থাকে। আমি যে আচন্ডাল প্রত্যেক নরনারী হইতে দীন; পশু-পক্ষী, কীট, পতঙ্গ, বৃক্ষ, লতা হইতে দীন-এ বিশ্বাস দৃঢ় করিয়া দাও প্রভো, প্রত্যেকের কাছে আমার শিখিবার জিনিস আছে, প্রত্যেকে আমা হইতে উচ্চ, সকলেই আমার গুরু।
আমি গুণহীন, আমি বিদ্যাহীন, আমি শক্তিহীন, রূপহীন আমার কিছু নাই- একথা আমি যেন ভুলিয়া না যাই। প্রতি মানবে, জলে স্থলে, অনিলে অনলে, বিহগের কাকলিতে, ভ্রমরের গুঞ্জনে, বন-কুসুম-সৌরভে, তরুণ অরুণে, চন্দ্রকিরণে, নব নীরদে, এইরূপ ত্রিভুবনের যাহা কিছু সুন্দর তাহাতে তুমি ব্যষ্টিভাবে বিরাজ করিতেছ; পক্ষান্তরে বজ্রের ভৈরব গর্জ্জনে, মধ্যাহ্ন মার্ত্তণ্ডের প্রখর কিরণে, আদি-অন্ত-হীন বিশাল প্রান্তরে, পেচকের কর্কশ কন্ঠে, দাবদগ্ধ অরণ্যে, মরীচিকায়, – আমি মূর্খ কত বলিব- ভাল-মন্দ, অণু-পরমাণু সকলেই তুমি আছ; সকলই তুমি, -তুমিই এ কথা বলিয়াছ। তাহা হইলেই সকলেই আমার পূজ্য, সকলেই আমার প্রনম্য। তোমার আশীর্ব্বাদে সকলের পদতলে যেন এ উন্নত শির নত করিতে পারি, আমি দীন হইতে দীনতম-এ বিশ্বাস স্থায়ী করিয়া দাও- উপদেশপ্রদানেচ্ছু জিহ্বাকে নিরস্ত করিয়া কর্ণকে উপদেশ শুনিতে নিযুক্ত করিয়াছ, আমার দম্ভ আমার গর্ব্ব সব কাড়িয়া লইয়া আমায় ধূলিকণায় পরিণত করিয়াছ; প্রাণেশ্বর! চিরদিন যেন তোমার এ আশীর্ব্বাদ নিশ্চয়ল থাকে। –শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথ দেব
[ঋণ : শ্রীওঙ্কারনাথ-রচনাবলী / কিমি গঠিতস্তৎ কথায় মে]
🍂প্রচ্ছদ কথা | এক
খেজুরের গুড়ের গন্ধে তখন সারা পাড়া ম ম করছে। পাটালি গুড় বানানো হত যে পাটালিগুলো অনেক বড় বড় সাইজ তার থেকে ভাগ বসাতাম আমরা। এ পাটালি কিন্তু কখনো বিক্রি করা হত না। লিখেছেন : মমতা রায় চৌধুরী
শীতের খেজুর রস কোথাও এক নস্টালজিয়া তাড়া করে
হঠাৎ করেই ক্লাসের ফাঁকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মন চলে যায় উড়ে আমার সেই প্রাণ প্রিয় গ্রামে। তাই রবি ঠাকুরের ভাষাতেই যেন আপন মনে গান গেয়ে উঠি, ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ/আমার মন ভুলায় রে’। হেমন্তের বিষন্নতা আর শীতের রুক্ষতার মধ্যেও যেন কোথাও এক নস্টালজিয়া কাজ করে। মনে পড়ে যায়, সারি সারি খেজুর গাছের সমাহার আর শীতকাল মানেই খেজুর রস থাকবে না সেটা তো হতে পারে না। আজ শহরে এসে ভীষণভাবে মিস করি সেই রুপোলি দিনগুলো। হঠাৎ করেই এক নিমিষে মন যেন চলে যায় মেয়েবেলার সেই দিনগুলোতে। মনে পড়ে, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়ে সারিবদ্ধভাবে বসে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসা। কিন্তু মনটা তো পড়ে থাকে কখন সেই খেজুর কাকু আসবে আর গাছ থেকে পারবেন আর আমরা সবাই ভিড় করব গ্লাস হাতে খেজুর রস খাব বলে। মায়ের কড়া শাসন পড়া না করে কেউ খেজুর গাছের কাছে যাবে না কেমন লেখাটা পড়ে সবাই অবাক হবেন না পড়তে পড়তে খেজুর গাছ। একদমই তাই। আসলে আমাদের বাড়িতে চারপাশেই খেজুর গাছ ছিল। অবশ্য খেজুর গাছ রাখার কারণও ছিল। আমার মা ভীষণভাবে পাটি তৈরি করতে ভালবাসতেন। আমরা শুধু মুখিয়ে থাকতাম কখন মা একটু কলতলার দিকে যাবে, আর আমরা হাজির হব খেজুর কাকার কাছে। ‘খেজুর কাকার’ নামটা আমরাই দিয়েছিলাম। আসলে কাকার নাম ছিল সুনীল। মনটাও ছিল সুনীল আকাশের মত। কোনও কোনও দিন অবশ্য ধরা পড়েও যেতাম সেদিন মায়ের হাতের মার অবসম্ভাবী। হাঁড়ি হাঁড়ি খেজুরের রস এসে জমত আর ঠাম্মিকে দেখতাম, ধান সেদ্ধ করে তাপাল বলে একটা পাত্র আছে তাতে ঢালা হত আর বড় মাটির উনুন ছিল সেই উনুনে চাপিয়ে খড়কুটো, ডালপালা জ্বালানি দিয়ে জ্বালিয়ে রসটাকে আস্তে আস্তে গুড়ে পরিণত করতেন।
যখন রসটা জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গুড়ে পরিণত হয়নি ঠিক তার আগের মুহূর্তে ঝোলাগুড় বলা হয়ে যাকে সেখানেও আমাদের নজর থাকত আমরা প্রত্যেকে বাড়িতে ভাজা মুড়ির বাটি নিয়ে শেখানো হাজির হতাম। ঠাম্মির কাছে গিয়ে আমরা প্রত্যেকে জ্বালাতাম। শুধু আমরা বাড়ির ছেলে-মেয়েরা নই, পাড়া-প্রতিবেশীরা আমাদের সাথীরা এসে হাজির হত। আমরা প্রত্যেকে সেই ঝোলা গুড় দিয়ে মুড়ি মাখিয়ে খেতাম তৃপ্তি সহকারে। আর মা যখন এসে দেখতেন তখনই লাঠি নিয়ে তাড়া করতেন। আর আমাদের সঙ্গে পারেন আমরা তো যে যার মত দৌড় খোলা হাওয়া, খোলা মাঠ, খোলা আকাশের দিকে। মন ছুটে বেড়াত সারাক্ষণ এদিক থেকে ওদিক।
কিন্তু মায়ের রাগ কতক্ষণ থাকবে সারাক্ষণ সংসারের কাজ তারপর আমাদের পেছনে পড়ে থাকা মায়ের অত সময় ছিল না।
একসময় দেখতাম মা রান্নাবান্না করে গোয়ালের দিকে ছুটতেন ধবলী, কাজলী ওদের হাম্মা হাম্মা রবে বালতি নিয়ে মা দুধ দোয়াতেন আর তখনই ডাক পড়ত আমাদের কারণ একটা গামছা বা কোন এক ন্যাকড়া নিয়ে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ওদের মাছি, মশা তাড়াতে হতো। আর তখন মিষ্টি সুরে মা আমাদের ডাকতেন’ আয়রে কে কোথায় গেলি’ আর আমরাও সেই ডাক শোনার অপেক্ষায় থাকতাম আর সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হতাম। অন্যদিকে খেজুরের গুড়ের গন্ধে তখন সারা পাড়া ম ম করছে। পাটালি গুড় বানানো হত যে পাটালিগুলো অনেক বড় বড় সাইজ তার থেকে ভাগ বসাতাম আমরা। এ পাটালি কিন্তু কখনও বিক্রি করা হত না। এগুলো সবই আমাদের বাড়িতে রাখা হতো খাবারের জন্য। আর এই সময়তেই সেই পাটালী বানানো হতো ক্ষীরের মতো পায়েস অসাধারণ তার গন্ধ আর যে কি অপূর্ব টেস্ট বলে বোঝাতে পারব না। আর যখন আজকে আমরা কোনও খেজুরের গুড় খেতে চাই সেই গুড়ের মধ্যে রয়েছে কৃত্রিমতার ছোঁয়া। চিনি দিয়ে বানানো। এই জন্য আসল নকল তফাৎটা করতে পারে।
একবার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে আমরা কি রকম এই খেজুরের রসের ভক্ত ছিলাম প্রতিদিনই আমাদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল সকালে উঠে এক গ্লাস খেজুরের রস খাব সেদিন খেজুর কাকা আসতে পারেননি আমারা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারব কেন আমরা কেউ মনোনিবেশ করতে পারছি না। মনটা কেমন যেন উসখুস করছে। শেষ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কথা হল কে এই খেজুর গাছে উঠতে পারবে। আসলে আমরা প্রত্যেকেই ছিলাম গেছো মেয়ে।বিভিন্ন ফলের সমারোহ এবং তার গাছ যদি বাড়িতেই থাকে আর মন যদি চায় এ ফল খাব তাহলে তো নিজের তাগিদে তো গাছে উঠতেই হয়। গাছে ওঠার শেখাটা আর একটা কারণ ছিল। আমাদের বাড়িতে তখন অনেক ভেড়া ছিল। তার মধ্যে একটা পাঠা ভেড়া ছিল এবং সেটা এতটাই হিংস্র প্রকৃতির ছিল। মাঝে মাঝে একটা ষাঁড় আসত সেই ষাঁড়টার সঙ্গে লড়াই হত ওর। এমনকি ষাঁড় ভয় পেত ওই পাঠা ভেড়াটাকে। ছোট দেখতে হলে কি হবে? ঠিক যেন ধানি লঙ্কা। সেই ষাঁড়কে দূর থেকে ছুটে এসে এমন গুঁতো মারত ষাঁড় তখন বলতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। আর আমাদের স্কুল শেষে বিকেল বেলায় সমবয়সীরা সব আমাদের পুকুর পাড়ে জড়ো হতাম খাবার খেতে খেতে গল্প হতো তারপর পুতুল খেলার জন্য বসে পড়তাম। আর ঠিক সময় সেই ভেড়াটি মাঝে মাঝে কি হত ওর কে জানে আমাদেরকে তাড়া করত আর আমরা ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য গাছে উঠতাম। এক হিসেবে গাছে ওঠাটা থেকে ভালই করেছিলাম কিন্তু তাই বলে খেজুর গাছ খেজুর গাছে ওঠা নিয়েও আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো। কে কতটা উঠতে পারে যাই হোক সেই খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে আমরা খেতাম। একবার কি হয়েছিল, আমাদের মনে হল দুপুর বেলার খেজুরের রস খাব। সেদিন ছিল ছুটির দিন আমরা কি আর থোড়িই জানি যে, দুপুরের দিকে পাতা রস ওটা ঠিক খাবার যোগ্য নয়। ওটাকে বলা হয় ঝরা রস। আমরা সেই রস খেতে গিয়ে দেখি বাবা কি অখাদ্য খেতে। এভাবেই আমাদের শীতের দিনের খেজুরের রসে মন সব সময় জারিত হত। আর মায়ের বানানো খেজুরের পাতা দিয়ে তৈরি পাটি কত রকমের পাটি বানাতে পারত আমার মা। বড় পাটি, সরু পাটি, শীতলপাটি।
আজও মনে পড়ে সেই প্রিয় দিনগুলোর কথা আজ শহুরে জৌলুসে হারিয়ে গিয়েছে আমাদের মেয়েবেলার সেই দিনগুলো কিন্তু শীতকাল আসলে ঘুরে ফিরে মনের আনাচে-কানাচে উঁকি মারতে থাকে ঠিক মিঠে কড়া রোদের মতো।
এই শহরের বৈভবের মাঝে আজও শীতকালে সেই খেজুর রসের কথা মনে পড়ে। একবার আমার স্বামী তাদের জমি জায়গা আছে যেখানে চাষ করেন চাষীরা। এরকম আজাদ কাকা নামে আমাদের এক কাকা তিনি এই চাষের সুবাদে আমাদের বাড়িতে আসতেন। তিনি যখন শুনলেন যে বৌমা খেজুর রস খেতে ভালবাসে কি খুশি না হয়েছেন! গ্রামের মানুষ তো তার সঙ্গে বসে বসে কত সুখ দুঃখের কথা গ্রামীণ পরিবেশের অনাবিল আনন্দের কথা ভাগ করে নিতাম। একদিন হঠাৎ করে ভোর বেলায় এসে হাজির। অবাক লাগে আজও এই সারলে ভরা মানুষ তার অনাবিল অকৃত্রিম ভালবাসা দিয়ে প্রচণ্ড ঠাণ্ডাকেও উপেক্ষা করে খেজুর রস নিয়ে এসে হাজির। আমি তো খুব খুশি সেদিন তো আমি প্রায় দু’ গ্লাস খেজুর রস খেয়ে ফেলেছিলাম। কাকা আমার খেজুর রস খাওয়া দেখে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন আর বলেছিলেন জানো তো বৌমা আজকাল আর এই খেজুর রস নিয়ে কারুর মাতামাতি নেই। হ্যাঁ গুড় নিয়ে মাতামাতি আছে তবে আগের মত হয় না। আমি যখন বললাম কাকা, আমাকে একটু খাঁটি গুড় খাওয়াতে পারবেন। তিনি একটু কিন্তু কিন্তু করছিলেন।
তারপর হেসে বলেছিলেন ঠিক আছে খাওয়াবো, একদিন সত্যিই তিনি খেজুর গুড় হাজির করলেন তিনি তার সাধ্য মত নিশ্চয়ই চেষ্টা করেছিলেন ভালো গুড় দেবার কিন্তু আমি খেয়ে দেখলাম না এইগুলো সেই আমরা যে গুড় খেয়েছি সেই গুড়ের মত নয়। তবুও আজকের দিনে এসে সেই নস্টালজিক মন ভেসে যায় খেজুর রসের হাঁড়িতে তখন মন এমন পাগল পাগল হয়। পাগল মন গেয়ে ওঠে, “ওরে মন পাগল তুই কেন কেঁদে মরিস পরশ পাথর খুঁজতে গিয়ে বারে বারে কাঁদিস…।’’
মনে পড়ে, সকালবেলায় চাষীদের পরনের হাঁটুর ওপরে ছোট্ট মারকিন জাতীয় কাপড় আর মাথায় খেজুর পাতার বোঝা নিয়ে চলা আবার কাঁধের বাঁকের হাঁড়িতে খেজুর রস। তাই বসে বসে ভাবি, এখনকার প্রজন্ম এসব থেকে অনেক দূরে! তারা না পেল সেই রসের আস্বাদ আর না পেল সেই অনাবিল অকৃত্রিম গ্রাম্য প্রকৃতির হাতছানি। আবার যদি ফিরে পেতাম সেই সোনালী দিনগুলো প্রাণ ভরে সাজিয়ে নিতাম।🍁
🍂প্রচ্ছদ কথা | দুই
খেজুর রস নিয়ে দু’ কলম লিখতে হবে শুনে কত্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার কোনও স্মৃতিটিতি আছে কিনা এই ব্যাপারে। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে জানালেন, ঠিক রস নিয়ে নয় তবে গাছ নিয়ে নাকি এক মস্ত ঘটনা আছে। আমি খুশি হলুম। তিলের বদলে তাল পেলে ক্ষতি কী? লিখেছেন : মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
‘খেঁজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন’
পাটলীপুত্রের সঙ্গে যেমন পাটালি গুড়ের কোনও সম্পর্ক নেই, তেমন আমারও খেজুর রসের সাথে কোনও সরাসরি সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই খেজুর রস যে কিভাবে আমার অস্তিত্ব সঙ্কটে ফেলে দিয়েছিল সেই গল্পই প্রথমে শোনাই।
আমার পিসির বাড়ি ছিল গ্রামে। আজকালের মতো মফঃস্বল না। পুরোপুরি গ্রাম। শীতের ছুটিতে ভোর ভোর হাওড়া থেকে বাস ধরে খাঁদারঘাট। তারপর কুয়াশা মাখা রাস্তা চিরে ভ্যান-রিক্সায় চেপে প্রতাপপুরের মোড়। বাকিটা যেতে হতো পায়ে হেঁটে। পিসেমশাই আগের বিকেলে ফোন করে জানালেন যে আগামীকাল সকালে টাটকা খেঁজুর রস নামবে। পারো তো চলে এসো। বাবা-মাও রওনা হলেন ভোর ভোর। পিসির বাড়ি পৌঁছতে ঘন্টা দেড়-দুই লাগত।
প্রথমেই এক বড় গ্লাস খেঁজুর রস ঢকঢক করে খেয়ে প্রাতঃরাশে মন দিলেন বাবা। একটু বেলার দিকে, যখন রস একটু গেঁজে যেতে শুরু করেছে, তখন আরও এক গ্লাস খেয়ে ফেলেই ভুলটা করে ফেললেন। এর খানিক পর থেকেই বাবা যেন কেমন নেতিয়ে পড়লেন। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে, কিন্তু জ্ঞান নেই। হাত-পা নড়ছে না। গ্রামের সব ভালো। কিন্তু অসুখ বিসুখে বড় সমস্যা। বিশ্বাসযোগ্য হাসপাতাল আর ডাক্তার পাওয়া মুস্কিল। সেই অবস্থাতেই মা কিভাবে বাবাকে হাওড়া নিয়ে এসেছিলেন জানি না। প্রাইমারি ড্যামেজ কন্ট্রোল হওয়ার পর দীর্ঘদিন আমার দাদামশাইয়ের হোমিওপ্যাথিক ট্রিটমেন্টে থাকতে হয় বাবাকে। ওই রসের জন্য ঠান্ডা বুকে বসে নাকি এই গোলযোগ। এখন আপনারা প্রশ্ন করতেই পারেন,
“এ তো বাবার জীবন সঙ্কট, তোমার অস্তিত্ব সঙ্কট কই?”
হলো না, তবে হতে পারত। এই ঘটনার সময় নাকি আমি জন্মাইনি। সেদিন রসের বশে বাবার জীবন রসাতলে গেলে আমি আর…
আমার ছোট, বড়, মাঝারি সমস্ত বেলাই কেটেছে শহরে। তাই প্রতাপপুরে পিসির বাড়ি আর বাঘনাপাড়ায় মাসির বাড়ি যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। পুকুরে ছিপ ফেলে অথবা জাল ফেলে মাছ ধরা, হাস-মুরগির ডিম পাড়া, গরুর দুধ দোওয়ানো থেকে শুরু করে বড় মাঠে পায়ে করে ধান মাড়ানো, ঢেঁকি চালানো এমনকি তাঁত বোনা সব রকম অভিজ্ঞতাই হয়েছে আমার ওই দুই বাড়ি থেকে। মাসির গ্রামে এমনই কোনও এক বিকেলে হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিলাম খাঁজ কাটা কাটা গাছের গায়ে পা রেখে রেখে এক মাঝ বয়সী লোক দু’ খেপ করে উঠছেন। তারপর গাছটাকে জড়িয়ে হাতে থাকা দড়িটাকে কাণ্ডে বেড় দিয়ে নিশ্চিত করছেন পরবর্তী দু’ খেপের নিরাপত্তা। অবশেষে পাতার মুকুটের কাছাকাছি পৌঁছে ওই দড়িই কোমরে পাক দিয়ে বেঁধে গাছের সাদা অংশে কিছু একটা পুতে তার তলায় হাঁড়ি বাধলেন। এমন আজব কাণ্ড ছোট্ট আমি এর আগে কখনও দেখিনি। গাছের গায়ের সাদা অংশটা নাকি আগেই পাতা, বাকল ছেঁটে প্রস্তুত করা হয়েছিল। আজ রস বেরোনোর ব্যবস্থা করে হাড়ি লাগানো হলো। রস সংগ্রহ করা হবে আগামীকাল ভোরে, সূর্যের তেজ বাড়ার আগে। নইলে নাকি রস গেঁজে যায়। না:! অত ভোরে উঠে আর বাকিটা দেখা হয়নি। তবে এখনও
‘খেঁজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন’ শুনলে মনটা এক ছুটে ওই গাছের কাছে পৌঁছে যায়।
শীতকালে মিঠে রোদের মতোই নলেন গুড়ের ওম বাঙালির জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমিও ব্যতিক্রম নই। আমাদের কর্ম সহায়িকা মঞ্জুদি আসতেন বাগনানের কাছে এক গ্রাম থেকে। শীতে পাতলা বাদামী এক বড় শিশি নলেন গুড় ছিল আমাদের বরাদ্দ। সেই দিয়ে রুটি, পিঠে, পায়েস কী না খেয়েছি! নতুন গুড়ের জলভরা, সন্দেশ, রসগোল্লা সবকিছুই অমৃত। তবে পাঁউরুটি দিয়ে ঝোলাগুড় খেয়ে দেখেছি। আমাদের রসিক কবি যাই বলুন না কেন, আমি ওই জুটিকে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করতে পারলাম না।
খেঁজুর রস নিয়ে দু’ কলম লিখতে হবে শুনে কত্তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তার কোনও স্মৃতিটিতি আছে কিনা এই ব্যাপারে। তিনি অনেক ভেবেচিন্তে জানালেন, ঠিক রস নিয়ে নয় তবে গাছ নিয়ে নাকি এক মস্ত ঘটনা আছে। আমি খুশি হলুম। তিলের বদলে তাল পেলে ক্ষতি কী? কত্তার মুখ নিসৃত গল্পটি হুবহু তুলে ধরছি,
“একবার মামাবাড়িতে থাকার সময় পুকুর পাড়ে বসে কঞ্চি দিয়ে একটা সাপকে খোঁচাচ্ছিলাম। সেই সময়ে আমাকে একটা গরু তাড়া করল। আমার তখন জলে সাপ, ডাঙায় গরু অবস্থা! কী করি! কী করি! পিছনেই ছিল একটা খেঁজুর গাছ। তরতর করে উঠে পড়লাম। ওপর থেকে দেখলাম গরুটা ঠিক আমাকে না, অন্য কিছু দেখে তাড়া করেছিল। সে নীচ দিয়ে ছুটে অন্য দিকে চলে যেতেই টের পেলাম গাছের খোঁচায় বুকে ছিঁড়েকেটে গেছে। তখন ভয়ে ভয়ে নামতে গিয়ে লাফ দিয়ে পড়লাম মাটিতে।”
“তারপর?”
“তারপর কিছু না। মামাবাড়িতে ঢুকে পড়লাম।”
বরাবর শুনেছি গল্পের গরু গাছে ওঠে। কিন্তু কত্তামশাইয়ের গল্পে গরুর ঠেলায় তিনি নিজেই যখন গাছে চড়ে বসলেন তখন আপাতত আমারও নটে গাছটি মুড়োল!🍁
🍂ফিরে পড়া | ছোটগল্প : এক
_____________________________________________
অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটো বোন নারানী। বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল। সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম। এক দিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এ-সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না। সে সংকোচ নিজের জন্য নহে।
_____________________________________________
হৈমন্তী
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া।
আমি ছিলাম বর, সুতরাং বিবাহসম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি করিয়াছি, এফ.এ. পাস করিয়া বৃত্তি পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ, কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া উঠিল।
আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোন উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে। অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক, স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের। বিবাহের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে, আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার উপক্রম হয়।
সত্য বলিতেছি, আমার মনে এমন বিষম উদ্বেগ জন্মে নাই। বরঞ্চ বিবাহের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল। যাহাকে বার্কের ফ্রেঞ্চ্ রেভোল্যুশনের নোট পাঁচ-সাত খাতা মুখস্থ করিতে হইবে, তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের। আমার এ লেখা যদি টেক্স্ট্বুক্-কমিটির অনুমোদিত হইবার কোন আশঙ্কা থাকিত তবে সাবধান হইতাম।
কিন্তু, এ কী করিতেছি। এ কি একটি গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম। এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম। মনে ছিল, কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে , তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার ঝোড়ো বৃষ্টির মতো প্রবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব। কিন্তু, না পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে, কারণ, সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর, না পারিলাম কাব্য রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি। সেইজন্যেই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বসিয়াছে। না করিয়া করিবে কী। তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে। জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের অশ্রুশূন্য রোদন।
আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোন আশঙ্কা নাই। যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট। কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে, এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না। কিন্তু, যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই।
আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই। আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।
শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের ছোটো ছিল। অথচ, আমার পিতা যে গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না তাহা নহে। তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী, দেশের প্রচলিত ধর্মকর্ম কিছুতে তাঁহার আস্থা ছিল না; তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী; মানিতে তাঁহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে, সদরে বা অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ, ইনিও কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন। পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি। কোনোটাই সরল স্বাভাবিক নহে। তবুও বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ, মেয়ের বয়স বড়ো বলিয়াই পণের অঙ্কটাও বড়ো। শিশির আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে। বাবার বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে।
আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো-একটা মতের বালাই ছিল না। তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোন রাজার অধীনে বড়ো কাজ করিতেন। শিশির যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়। মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড়ো হইতেছে, তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই। সেখানে তাঁহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে।
শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো, সমাজের ষোলো নহে। কেহ তাহাকে আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না।
কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাশ করিবার পক্ষে যত ভালো হউক বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালো নয়।
বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফোটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো — একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।”
কোন একজন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া, খোঁপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া, বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি। কিন্তু, সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা সে আমি বলিতে পারি না। যেমন-তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া, পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাটা শতরঞ্চ ঝোলানো, পাশে একটা টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি পা।
পটের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের মধ্যে জাগিয়া উঠিল। সেই কালো দুটি চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর, সেই বাঁকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া লইল।
পঞ্জিকার পাতা উল্টাইতে থাকিল; দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। ও দিকে সামনে একটা অকাল চার-পাঁচটা মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার চক্রান্ত করিতেছে। শ্বশুরের এবং তাঁহার মনিবের উপর রাগ হইতে লাগিল।
যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল। সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার প্রত্যেক মুহূর্তটি আমি আমার সমস্ত চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে অক্ষয় হইয়া থাক্।
বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোল ; তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল। এমন আশ্চর্য আর কী আছে। আমার মন বারবার করিয়া বলিতে লাগিল, ‘আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম।’
কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।
আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর। যে হিমালয়ে বাস করিতেন সেই হিমালয়ের তিনি যেন মিতা। তাঁহার গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির হাস্য শুভ্র হইয়াছিল। আর, তাঁহার হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে-একটি প্রস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে চাহিত না।
কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বাবা, আমার মেয়েটিকে আমি সতেরো বছর ধরিয়া জানি, আর তোমাকে এই ক’টি দিন মাত্র জানিলাম, তবু তোমার হাতেই ও রহিল। যে ধন দিলাম, তাহার মূল্য যেন বুঝিতে পার, ইহার বেশি আশীর্বাদ আর নাই।”
তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়া বলিলেন, “বেহাই, মনে কোন চিন্তা রাখিয়ো না। তোমার মেয়েটি যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল।”
তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন; বলিলেন, “বুড়ি, চলিলাম। তোর একখানি মাত্র এই বাপ, আজ হইতে ইহার যদি কিছু খোওয়া যায় বা চুরি যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী নই।”
মেয়ে বলিল, “তাই বৈকি । কোথাও একটু যদি লোকসান হয় তোমাকে তার ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে।”
অবশেষে নিত্য তাঁহার যে-সব বিষয়ে বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে সম্বন্ধে সে বার বার সতর্ক করিয়া দিল। আহারসম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট সংযম ছিল না, গুটিকয়েক অপথ্য ছিল, তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি — বাপকে সেই-সমস্ত প্রলোভন হইতে যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক কাজ ছিল। তাই আজ সে বাপের হাত ধরিয়া উদ্বেগের সহিত বলিল, “বাবা, তুমি আমার কথা রেখো— রাখবে ?”
বাবা হাসিয়া কহিলেন, “মানুষ পণ করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই সব চেয়ে নিরাপদ।”
তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে কপাট পড়িল। তাহার পরে কী হইল কেহ জানে না।
বাপ ও মেয়ের অশ্রুহীন বিদায়ব্যাপার পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী অন্তঃপুরিকার দল দেখিল ও শুনিল। অবাক কাণ্ড! খোট্টার দেশে থাকিয়া খোট্টা হইয়া গেছে! মায়ামমতা একেবারে নাই!
আমার শ্বশুরের বন্ধু বনমালীবাবুই আবাদের বিবাহের ঘটকালি করিয়াছিলেন। তিনি আমাদের পরিবারেরও পরিচিত । তিনি আমার শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন, “সংসারে তোমার তো ঐ একটি মেয়ে। এখন ইহাদেরই পাশে বাড়ি লইয়া এইখানেই জীবনটা কাটাও।”
তিনি বলিলেন, “যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়াই দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে। অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা আর নাই।”
সব-শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন, “আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ, এবং লোকজনকে খাওয়াইতে ও বড়ো ভালোবাসে। এজন্য বেহাইকে বিরক্ত করিতে ইচ্ছা করি না। আমি মাঝে মাঝে তোমাকে টাকা পাঠাইব। তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি রাগ করিবেন।”
প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম। সংসারে কোন-একটা দিক হইতে অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন, তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তো দেখি নাই।
যেন ঘুষ দিতেছেন, এমনিভাবে আমার হাতে একখানা একশো টাকার নোট গুঁজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত প্রস্থান করিলেন; আমার প্রণাম লইবার জন্য সবুর করিলেন না। পিছন হইতে দেখিতে পাইলাম, এইবার পকেট হইতে রুমাল বাহির হইল।
আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম। মনে বুঝিলাম, ইহারা অন্য জাতের মানুষ।
বন্ধুদের অনেককেই তো বিবাহ করিতে দেখিলাম। মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে গলাধঃকরণ করা হয়। পাকযন্ত্রে পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির নানা গুণাগুণ প্রকাশ হইতে পারে এবং ক্ষণে ক্ষণে আভ্যন্তরিক উদ্বেগ উপস্থিত হইয়াও থাকে, কিন্তু রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে না। আমি কিন্তু বিবাহসভাতেই বুঝিয়াছিলাম, দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার চলে, কিন্তু পনেরো-আনা বাকি থাকিয়া যায়। আমার সন্দেহ হয়, অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে বিবাহমাত্র করে, পায় না, এবং জানেও না যে পায় নাই; তাহাদের স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা পড়ে না। কিন্তু, সে যে আমার সাধনার ধন ছিল; সে আমার সম্পত্তি নয়, সে আমার সম্পদ।
শিশির — না, এ নামটা আর ব্যবহার করা চলিল না। একে তো এটা তাহার নাম নয়, তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও নহে। সে সূর্যের মতো ধ্রুব ; সে ক্ষণজীবিনী উষার বিদায়ের অশ্রুবিন্দুটি নয়। কী হইবে গোপনে রাখিয়া। তাহার আসল নাম হৈমন্তী।
দেখিলাম , এই সতেরো বছরের মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো আসিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু এখনো কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া উঠে নাই। ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া পড়িয়াছে, কিন্তু বরফ এখনো গলিল না। আমি জানি, কী অকলঙ্ক শুভ্র সে, কী নিবিড় পবিত্র।
আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে, লেখাপড়া-জানা বড়ো মেয়ে, কী জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে হইবে। কিন্তু, অতি অল্পদিনেই দেখিলাম, মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের দোকানের রাস্তার কোনো জায়গায় কোন কাটাকাটি নাই। কবে যে তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রঙ ধরিল, চোখে একটু ঘোর লাগিল, কবে যে তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারিব না।
এ তো গেল এক দিকের কথা। আবার অন্য দিকও আছে, সেটা বিস্তারিত বলিবার সময় আসিয়াছে।
রাজসংসারে আমার শ্বশুরের চাকরি। ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার অঙ্কপাত করিয়াছে, কিন্তু কোন অঙ্কটাই লাখের নীচে নামে নাই। ইহার ফল হইয়াছিল এই যে, তাহার পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল হৈমর আদরও তেমনি বাড়িতে থাকিল। আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধতি শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র, কিন্তু মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই হাত দিতে দিলেন না। এমন-কি, হৈমর সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের ঘরে ঢুকিতে দিতেন না তবু তাহার জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না, পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয়।
এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পরিত, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘোর অন্ধকার দেখা গেল। ব্যাপারখানা এই — আমার বিবাহে আমার শ্বশুর পনেরো হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার টাকার গহনা দিয়াছিলেন। বাবা তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর পাইয়াছেন, ইহার মধ্যে পনেরো হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ করিতে হইয়াছে, তাহার সুদও নিতান্ত সামান্য নহে। লাখ টাকার গুজব তো একেবারেই ফাঁকি।
যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে তাঁহার কোনদিন কোন আলোচনাই হয় নাই, তবু বাবা জানি না, কোন্ যুক্তিতে ঠিক করিলেন, তাঁহার বেহাই তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা করিয়াছেন।
তার পরে, বাবার একটা ধারণা ছিল, আমার শ্বশুর রাজার প্রধান মন্ত্রী-গোছের একটা-কিছু। খবর লইয়া জানিলেন, তিনি সেখানকার শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ। বাবা বলিলেন, অর্থাৎ ইস্কুলের হেড্ মাস্টার — সংসারে ভদ্র পদ যতগুলো আছে তাহার মধ্যে সব চেয়ে ওঁচা। বাবার বড়ো আশা ছিল, শ্বশুর আজ বাদে কাল যখন কাজে অবসর লইবেন তখন আমিই রাজমন্ত্রী হইব।
এমন সময়ে রাস-উপলক্ষ্যে দেশের কুটুম্বরা আমাদের কলিকাতার বাড়িতে আসিয়া জমা হইলেন। কন্যাকে দেখিয়া তাঁহাদের মধ্যে একটা কানাকানি পড়িয়া গেল। কানাকানি ক্রমে অস্ফুট হইতে স্ফুট হইয়া উঠিল। দূর সম্পর্কের কোন-এক দিদিমা বলিয়া উঠিলেন, “পোড়া কপাল আমার! নাতবউ যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল। ”
আর-এক দিদিমাশ্রেণীয়া বলিলেন, “আমাদেরই যদি হার না মানাইবে তবে অপু বাহির হইতে বউ আনিতে যাইবে কেন।”
আমার মা খুব জোরের সঙ্গে বলিয়া উঠিলেন, “ওমা, সে কি কথা। বউমার বয়স সবে এগারো বৈ তো নয়, এই আসছে ফাল্গুনে বারোয় পা দিবে। খোট্টার দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে।”
দিদিমারা বলিলেন, “বাছা, এখনো চোখে এত কম তো দেখি না। কন্যাপক্ষ নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে বয়স ভাঁড়াইয়াছে।”
মা বলিলেন, “আমরা যে কুষ্ঠি দেখিলাম।”
কথাটা সত্য। কিন্তু কোষ্ঠীতেই প্রমাণ আছে, মেয়ের বয়স সতেরো।
প্রবীণারা বলিলেন, “কুষ্ঠিতে কি আর ফাঁকি চলে না।”
এই লইয়া ঘোর তর্ক, এমন-কি বিবাদ হইয়া গেল।
এমন সময়ে সেখানে হৈম আসিয়া উপস্থিত। কোন-এক দিদিমা জিজ্ঞাসা করিলেন, “নাতবউ, তোমার বয়স কত বলো তো।”
মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা করিলেন। হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না; বলিল, “সতেরো।”
মা ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “তুমি জান না।”
হৈম কহিল, “আমি জানি, আমার বয়স সতেরো।”
দিদিমারা পরস্পর গা-টেপাটেপি করিলেন।
বধূর নির্বুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা বলিলেন, “তুমি তো সব জান! তোমার বাবা যে বলিলেন, তোমার বয়স এগারো।”
হৈম চমকিয়া কহিল, “বাবা বলিয়াছেন? কখনো না।”
মা কহিলেন, “অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে ‘কখনো না’।” এই বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল; স্বর আরো দৃঢ় করিয়া বলিল, “বাবা এমন কথা কখনোই বলিতে পারেন না।”
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, “তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস?”
হৈম বলিল, “আমার বাবা তো কখনোই মিথ্যা বলেন না।”
ইহার পরে মা যতই গালি দিতে লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারি দিকে লেপিয়া গেল।
মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার বধূর মূঢ়তা এবং ততোধিক একগুঁয়েমির কথা বলিয়া দিলেন। বাবা হৈমকে ডাকিয়া বলিলেন, “আইবড় মেয়ের মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটিয়া বেড়াইতে হইবে? আমাদের এখানে এ-সব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি।”
হায় রে, তাঁহার বউমার প্রতি বাবার সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে এমন বাজখাঁই খাদে নাবিল কেমন করিয়া।
হৈম ব্যথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “কেহ যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে কী বলিব।”
বাবা বলিলেন, “মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিয়ো, ‘আমি জানি না; আমার শাশুড়ি জানেন’।”
কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয় সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমন ভাবে চুপ করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন, তাঁহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ হইল।
হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল। সেদিন দেখিলাম, শরৎ প্রভাতের আকাশের মতো তাহার চোখের সেই সরল উদার দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে ম্লান হইয়া গেছে। ভীত হরিণীর মতো সে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, ‘আমি ইহাদিগকে চিনি না।’
সেদিন একখানা শৌখিন-বাঁধাই-করা ইংরাজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিয়াছিলাম। বইখানি সে হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়া দেখিল না।
আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, “হৈম, আমার উপর রাগ করিয়ো না। আমি তোমার সত্যে কখনো আঘাত করিব না। আমি যে তোমার সত্যের বাঁধনে বাঁধা। ”
হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল। সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোন কথা বলিবার দরকার নাই।
পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পূজার্চনা চলিতেছে। এ-পর্যন্ত সে-সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূকে ডাক পড়ে নাই। নূতন বধূর প্রতি একদিন পূজা সাজাইবার আদেশ হইল; সে বলিল, “মা, বলিয়া দাও কী করিতে হইবে।”
ইহাতে কাহারো মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল মাতৃহীন প্রবাসে কন্যা মানুষ। কিন্তু, কেবলমাত্র হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু। সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল, “ওমা, এ কী কাণ্ড। এ কোন্ নাস্তিকের ঘরের মেয়ে। এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই।”
এই উপলক্ষ্যে হৈমর বাপের উদ্দেশে যাহা-না-বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটু কথার হাওয়া দিয়াছে হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়াছে। এক দিনের জন্য কাহারো সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই। আজ তাহার বড়ো বড়ো দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল। সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “আপনারা জানেন- সে দেশে আমার বাবাকে সকলে ঋষি বলে?”
ঋষি বলে! ভরি একটা হাসি পড়িয়া গেল। ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ করিতে হইলে প্রায়ই বলা হইত তোমার ঋষিবাবা! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল।
বস্তুত, আমার শ্বশুর ব্রাক্ষ্মও নন, খৃস্টানও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন। দেবার্চনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই। মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনোদিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোন উপদেশ দেন নাই। বনমালীবাবু এ লইয়া তাঁহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি যাহা বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হইবে।”
অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটো বোন নারানী। বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল। সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম। এক দিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এ-সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না। সে সংকোচ নিজের জন্য নহে।
হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত। চিঠিগুলি ছোটো কিন্তু রসে ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত। বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটি আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পূর্ণ হইতে পারিত না। তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটুকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত।
চিঠির মধ্যে অপরাধের কোন প্রমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি তাহাতে তাঁহারা আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন। বিষম বিরক্ত হইয়া তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য। বাপই যেন সব, আমরা কি কেহ নই।” এই লইয়া অনেক অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, “তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ো। কলেজে যাইবার সময় আমি পোস্ট করিয়া দিব।”
হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”
আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না।
বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, “এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল। বি.এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল। ছেলেরই বা দোষ কী।”
সে তো বটেই। দোষ সমস্তই হৈমর। তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরো; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালোবাসি; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্ত আকাশ আজ বাঁশি বাজাইতেছে।
বি.এ.ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায় দিতে পারিতাম কিন্তু হৈমর কল্যাণে পণ করিলাম, পাস করিবই এবং ভালো করিয়াই পাশ করিব। এ পণ রক্ষা করা আমার সে অবস্থায় যে সম্ভবপর বোধ হইয়াছিল তাহার দুইটি কারণ ছিল — এক তো হৈমর ভালোবাসার মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালোবাসার চারি দিকে ভারি একটি স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত। দ্বিতীয়, পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার প্রয়োজন তাহা হৈমর সঙ্গে একত্রে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না।
পরীক্ষা পাশের উদ্যোগে কোমর বাঁধিয়া লাগিলাম। একদিন রবিবার মধ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া মার্টিনোর চরিত্রতত্ত্ব বইখানার বিশেষ বিশেষ লাইনের মধ্যপথগুলা ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেন্সিলের লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময় বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোখ পড়িল।
আমার ঘরের সমুখে আঙিনার উত্তর দিকে অন্তঃপুরে উঠিবার একটা সিঁড়ি। তাহারই গায়ে গায়ে মাঝে মাঝে গরাদে-দেওয়া এক-একটা জানলা। দেখি, তাহারই একটি জানলায় হৈম চুপ করিয়া বসিয়া পশ্চিমের দিকে চাহিয়া। সে দিকে মল্লিকদের বাগানে কাঞ্চনগাছ গোলাপি ফুলে আচ্ছন্ন।
আমার বুকে ধক্ করিয়া একটা ধাক্কা দিল; মনের মধ্যে একটা অনবধানতার আবরণ ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল। এই নিঃশব্দ গভীর বেদনার রূপটি আমি এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই।
কিছু না, আমি কেবল তাহার বসিবার ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম। কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর-একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে, মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানো, খোলা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়া বুকের উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে। আমার বুকের ভিতরটা হুহু করিয়া উঠিল।
আমার নিজের জীবনটা এমনি কানায় কানায় ভরিয়াছে যে, আমি কোথাও কোন শূন্যতা লক্ষ্য করিতে পারি নাই। আজ হঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহ্বর দেখিতে পাইলাম। কেমন করিয়া কী দিয়া আমি তাহা পূরণ করিব।
আমাকে তো কিছুই ছাড়িতে হয় নাই। না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু। হৈম যে সমস্ত ফেলিয়া আমার কাছে আসিয়াছে। সেটা কতখানি তাহা আমি ভালো করিয়া ভাবি নাই। আমাদের সংসারে অপমানের কণ্টকশয়নে সে বসিয়া; সে শয়ন আমিও তাহার সঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছি। সেই দুঃখে হৈমর সঙ্গে আমার যোগ ছিল, তাহাতে আমাদিগকে পৃথক করে নাই। কিন্তু, এই গিরিনন্দিনী সতেরো-বৎসর-কাল অন্তরে বাহিরে কত বড়ো একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে। কী নির্মল সত্যে এবং উদার আলোকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কিরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুররূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এতদিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারি নাই, কেননা সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমান আসন ছিল না।
হৈম যে অন্তরে অন্তরে মুহূর্তে মুহূর্তে মরিতেছিল। তাহাকে আমি সব দিতে পারি কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না — তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায়? সেইজন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ গরাদের ফাঁক দিয়া নির্বাক্ আকাশের সঙ্গে তাহার নির্বাক্ মনের কথা হয়; এবং এক-একদিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখি সে বিছানায় নাই, হাতের উপর মাথা রাখিয়া আকাশ-ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাতে শুইয়া আছে।
মার্টিনো পড়িয়া রহিল। ভাবিতে লাগিলাম, কী করি। শিশুকাল হইতে বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত ছিল না— কখনো মুখোমুখি তাঁহার কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, “বউয়ের শরীর ভালো নয়, তাহাকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।”
বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে। তখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলি বউমা, তোমার অসুখটা কিসের।”
হৈম বলিল, “অসুখ তো নাই।”
বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য।
কিন্তু, হৈমর শরীরও যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমরা প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই। একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, “অ্যাঁ, এ কী। হৈমী, এ কেমন চেহারা তোর! অসুখ করে নাই তো?”
হৈম কহিল, “না।”
এই ঘটনার দিন-দশেক পরেই, বলা নাই, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত। হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয় বনমালীবাবু তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন।
বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায় লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল। এবার মিলনের দিন বাপ যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের জল আর মানা মানিল না। বাপ একটি কথা বলিতে পারিলেন না; জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না ‘কেমন আছিস।’ আমার শ্বশুর তাঁহার মেয়ের মুখে এমন-একটা কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল।
হৈম বাবার হাত ধরিয়া তাঁহাকে শোবার ঘরে লইয়া গেল। অনেক কথা যে জিজ্ঞাসা করিবার আছে। তাহার বাবারও যে শরীর ভালো দেখাইতেছে না।
বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন, “বুড়ি, আমার সঙ্গে যাবি?”
হৈম কাঙালের মতো বলিয়া উঠিল, “যাব।”
বাপ বলিলেন, “আচ্ছা, সব ঠিক করিতেছি।”
শ্বশুর যদি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া না থাকিতেন তাহা হইলে এ বাড়িতে ঢুকিয়াই বুঝিতে পারিতেন, এখানে তাঁহার আর সেদিন নাই। হঠাৎ তাঁহার আবির্ভাবকে উপদ্রব মনে করিয়া বাবা তো ভালো করিয়া কথাই কহিলেন না। আমার শ্বশুরের মনে ছিল তাঁহার বেহাই একদা তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস দিয়াছিলেন যে, যখন তাঁহার খুশি মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইতে পারিবেন। এ সত্যের অন্যথা হইতে পারে সে কথা তিনি মনেও আনিতে পারেন নাই।
বাবা তামাক টানিতে টানিতে বলিলেন, “বেহাই, আমি তো কিছু বলিতে পারি না, একবার তা হলে বাড়ির মধ্যে—”
বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ কী আমার জানা ছিল। বুঝিলাম, কিছু হইবে না। কিছু হইলও না।
বউমার শরীর ভালো নাই! এত বড়ো অন্যায় অপবাদ!
শ্বশুরমশায় স্বয়ং একজন ভালো ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন। ডাক্তার বলিলেন, “বায়ু-পরিবর্তন আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো হইতে পারে।”
বাবা হাসিয়া কহিলেন, “হঠাৎ একটা শক্ত ব্যামো তো সকলেরই হইতে পারে। এটা কি আবার একটা কথা।”
আমার শ্বশুর কহিলেন, “জানেন তো, উনি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উহার কথাটা কি—”
বাবা কহিলেন, “অমন ঢের ডাক্তার দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল পণ্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়!”
এই কথাটা শুনিয়া আমার শ্বশুর একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। হৈম বুঝিল তাহার বাবার প্রস্তাব অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে। তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।
আমি আর সহিতে পরিলাম না। বাবার কাছে গিয়া বলিলাম, “হৈমকে আমি লইয়া যাইব।”
বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, “বটে রে—” ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা করিলাম না কেন। স্ত্রীকে লইয়া জোর করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত। গেলাম না কেন? কেন! যদি লোকধর্মের কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব যদি ঘরের কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও যে ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের মধ্যে একজন। আর, আমিই তো সেদিন লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের গুণবর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে যে একদিন দ্বিতীয় সীতাবিসর্জনের কাহিনী লিখিতে হইবে, সে কথা কে জানিত।
পিতায় কন্যায় আর-একবার বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হইল। এইবারেও দুইজনেরই মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, “বাবা, আর যদি কখনো তুমি আমাকে দেখিবার জন্য এমন ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে আমি ঘরে কপাট দিব।”
বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, “ফের যদি আসি তবে সিঁধকাটি সঙ্গে করিয়াই আসিব।”
ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর একদিনের জন্যও দেখি নাই।
তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর বলিতে পারিব না।
শুনিতেছি, মা পাত্রী সন্ধান করিতেছেন। হয়তো একদিন মার অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না, ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ — থাক্, আর কাজ কী!🍁
🍂ফিরেপড়া : গল্প / দুই
_____________________________________________
পয়সা ছিল না, চক্রবর্তী প্রাতকৃত্য সারিয়া বাবুদের বাড়ির দিকেই চলিল, দুধের জন্য। কাছারি-বাড়িতে ঘটি হাতে দাঁড়াইয়া সে বাবুকে খুঁজিতেছিল। বাবু ছিল না। লোকজন সব ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া চলাফেরা করিতেছে। কেহ চক্রবর্তীকে লক্ষ্যই করিল না।
_____________________________________________
অগ্রদানী
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
একটা ছয় ফুট সাড়ে ছয় ফুট লম্বা কাঠিকে মাঝামাঝি মচকাইয়া নোয়াইয়া দিলে যেমন হয়, দীর্ঘ শীর্ণ পূর্ণ চক্রবর্তীর অবস্থাও এখন তেমনই। কিন্তু ত্রিশ বৎসর পূর্বে সে এমন ছিল না, তখন সে বত্রিশ বৎসরের জোয়ান, খাড়া সোজা। লোকে বলিত, মই আসছে—মই আসছে? কিন্তু ছোট ছেলেদের সে ছিল মহা প্রিয়পাত্র।
বয়স্ক ব্যক্তিদের হাসি দেখিয়া সে গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করিত, হুঁ। কী রকম, হাসছে যে?
এই দাদা, একটা রসের কথা হচ্ছিল।
হুঁ। তা বটে, তা তোমার রসের কথা—তোমার রস খাওয়ারই সমান।
একজন হয়তো বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া বলিয়া দিত, না দাদা, তোমাকে দেখেই সব হাসছিল, বলছিল—মই আসছে।
চক্রবর্তীর আকর্ণ দাঁত মেলিয়া হাসিয়া উত্তর দিত, হুঁ, তা বটে। কাঁধে চড়লে স্বগগে যাওয়া যায়। বেশ পেট ভরে খাইয়ে দিলেই, বাস, স্বগগে পাঠিয়ে দোব।
আর পতনে রসাতল, কী বল দাদা?
চক্রবর্তী মনে মনে উত্তর খুঁজিত। কিন্তু তাহার পূর্বেই চক্রবর্তীর নজরে পড়িত, অল্পদূরে একটা গলির মুখে ছেলের দল তাহাকে ইশারা করিয়া ডাকিতেছে। আর চক্রবর্তীর উত্তর দেওয়া হইত না। সে কাজের ছুতা করিয়া সরিয়া পড়িত।
কোনো দিন রায়েদের বাগানে, কোনো দিন মিঞাদের বাগানে ছেলেদের দলের সঙ্গে গিয়া হাজির হইয়া আম জাম পেয়ারা আহরণে মত্ত থাকিত। সরস পরিপক্ক ফলগুলির মিষ্ট গন্ধে সমবেত মৌমাছি বোলতারা ঝাঁক বাঁধিয়া চারিদিক হইতে আক্রমণের ভয় দেখাইলেও সে নিরস্ত হইত না; টুপটাপ করিয়া মুখে ফেলিয়া চোখ বুঁজিয়া রসাস্বাদনে নিযুক্ত থাকিত।
ছেলেরা কলরব করিত, ওই, অ্যাঁ—তুমি যে সব খেয়ে নিলে, অ্যাঁ! সে তাড়াতাড়ি ডালটা নাড়া দিয়া কতকগুলো ঝরাইয়া দিয়া আবার গোটা দুই মুখে পুরিয়া বলিত, আঃ।
কেহ হয়তো বলিত, বাঃ পুন্নকাকা, তুমি যে খেতে লেগেছ? ঠাকুর পুজো করবে না?
পূর্ণ উত্তর দিত, ফল ফল, ভাত মুড়ি তো নয়, ফল ফল।
ত্রিশ বৎসর পূর্বে যেদিন এ কাহিনীর আরম্ভ, সেদিন স্থানীয় ধনী শ্যামাদাসবাবুর বাড়িতে এক বিরাট শান্তি-স্বস্তয়ন উপলক্ষ্যে ছিল ব্রাহ্মণ ভোজন। শ্যামাদাসবাবু সন্তানহীন, একে একে পাঁচ-পাঁচটি সন্তান ভূমিষ্ঠ হইয়া মারা গিয়াছে। ইহার পূর্বে বহু অনুষ্ঠান হইয়া গিয়াছে, কিন্তু কোনো ফল হয় নাই। এবার শ্যামাদাসবাবু বিবাহ করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন; কিন্তু স্ত্রী শিবরাণী সজল চক্ষে অনুরোধ করিল, আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখ; তারপর আমি বারণ করব না, নিজে আমি তোমার বিয়ে দিয়ে দেব।
শিবরাণী তখন আবার সন্তানসম্ভবা। শ্যামাদাসবাবু সে অনুরোধ রক্ষা করিলেন। শুধু তাই নয়, এবার তিনি এমন ধারা ব্যবস্থা করিলেন যে সে ব্যবস্থা যদি নিষ্ফল হয় তবে যেন শিবরাণীর পুনরায় অনুরোধের উপায় আর না থাকে। কাশী বৈদ্যনাথ তারকেশ্বর এবং স্বগৃহে একসঙ্গে স্বস্ত্ব্যয়ন আরম্ভ হইল। স্বস্ত্ব্যয়ন বলিলে ঠিক বলা হয় না, পুত্রেষ্টিযজ্ঞই বোধ হয় বলা উচিত।
ব্রাহ্মণ ভোজনের আয়োজন বিপুল। শ্যামাদাসবাবু গলবস্ত্র হইয়া প্রতি পংক্তির প্রত্যেক ব্রাহ্মণটির নিকট গিয়া দেখিতেছেন—কী নাই, কী চাই। একপাশে পূর্ণ চক্রবর্তীও বসিয়া গিয়াছে, সঙ্গে তাহার তিন ছেলে! কিন্তু পাতা অধিকার করিয়া আছে পাঁচটি। বাড়তি পাতাটিতে অন্ন ব্যঞ্জন মাছ স্তূপীকৃত হইয়া আছে বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। পাতাটি তাহার ছাঁদা; তাহার নাকি এটিতে দাবী আছে। সেই শ্যামাদাসবাবুর প্রতিনিধি হইয়া ব্রাহ্মণদিগকে নিমন্ত্রণ জানাইয়া আসিয়াছে। আবার আহারের সময় আহ্বান জানাইয়াও আসিয়াছে। তাহারই পারিশ্রমিক এটি। শুধু শ্যামাদাসবাবুর বাড়িতে এবং এই ক্ষেত্র-বিশেষটিতে নয়, এই কাজটি তাহার যেন নির্দিষ্ট কাজ, এখানে পঞ্চগ্রামের মধ্যে যেখানে যে বাড়িতেই হউক এবং যত সামান্য আয়োজনের ব্রাহ্মণ-ভোজন হউক না কেন, পূর্ণ চক্রবর্তী আপনিই সেখানে গিয়া হাজির হয়; হাঁটু পর্য্যন্ত কোনোরূপে ঢাকে এমনই বহরের তাহার পোশাকী কাপড়খানি পরিয়া এবং বাপ পিতামহের আমলে রেশমের একখানি কালী নামাবলী গায়ে দিয়া হাজির হইয়া বলে, হুঁ, তা কর্তা কই গো, নেমন্তন্ন কী রকম হবে একবার বলে দেন? ওঃ, মাছগুলো বেশ তেলুল-তেলুল ঠেকছে! হুই হুই! নিয়েছিল এক্ষুনি চিলে।
চিলটা উড়িতেছিল আকাশের গায়ে, পূর্ণ চক্রবর্তী সেটাকেই তাড়াইয়া গৃহস্থের হিতাকাঙ্ক্ষীর পরিচয় দেয়। দুর্দান্ত শীতের গভীর রাত্রে পর্য্যন্ত গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ফিরিয়া সে সকলকে নিমন্ত্রণ করিয়া ফেরে; প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দ্বি-প্রহরেও আহারের আহ্বান জানাইতে চক্রবর্তী ছেঁড়া চটি পায়ে, মাথায় ভিজা গামছাখানি চাপাইয়া কর্তব্য সারিয়া আসে; সেই কর্মের বিনিময়ে এটি তাহার পারিশ্রমিক! যাক।
শ্যামাদাসবাবু আসিয়া পূর্ণকে বলিলেন, আর কয়েকখানা মাছ দিক চক্রবর্তী।
চক্রবর্তীর তখন খান-বিশেক মাছ শেষ হইয়া গিয়াছে। সে একটা মাছের কাঁটা চুষিতেছিল, বলিল, আজ্ঞে না, মিষ্টি-টিষ্টি আবার আছে তো! হরে ময়রার রসের কড়াইয়ে ইয়া ইয়া ছানাবড়া ভাসছে, আমি দেখে এসেছি।
শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, সে তো হবেই, একটা মাছের মুড়ো?
পূর্ণ পাতাখানা পরিষ্কার করিতে করিতে বলিল, ছোট দেখে।
মাছের মুড়াটা শেষ করিতে করিতে ও-পাশে তখন মিষ্টি আসিয়া পড়িল।
চক্রবর্তী ছেলেদের বলিল, হুঁ, বেশ করে পাতা পরিষ্কার কর, হুঁ। নইলে নোন্তা ঝোল লেগে খারাপ লাগবে খেতে। এঃ, তুই যে কিছুই খেতে পারলি না, মাছসুদ্ধ পড়ে আছে।—বলিয়া ছোট ছেলেটার পাতের আধখানা মাছও সে নিজের পাতে উঠাইয়া লইল! মাছখানা শেষ করিয়া সে গলাটা উঁচু করিয়া মিষ্টি পরিবেশনের দিকে চাহিয়া রহিল। মধ্যে মধ্যে হাঁকিতেছিল, এই দিকে!
ওপাশে সকলে তাহাকে দেখিয়া চোখ টেপাটেপি করিয়া হাসিতেছিল। একজন বলিল, চোখ দুটো দেখ, চোখ দুটো দেখ—
উঃ, যেন চোখ দিয়ে গিলছে!
আমি তো ভাই, কখনও ওর পাশে খেতে বসি না। উঃ, কী দৃষ্টি!
ততক্ষণে মিষ্টান্ন চক্রবর্তীর পাতার সম্মুখে গিয়া হাজির হইয়াছে!
চক্রবর্তী মিষ্টান্ন পরিবেশকের সহিত ঝগড়া আরম্ভ করিয়া দিল, ছাঁদার পাতে আমি আটটা মিষ্টি পাব।
বাঃ, সে তো চারটে করে মিষ্টি পান মশায়!
সে দুটো করে যদি পাতে পড়ে, তবে চারটে। আর চারটে যখন পাতে পড়ছে, তখন আটটা পাব না, বাঃ!
শ্যামাদাসবাবু আসিয়া বলিলেন, ষোলটা দাও ওর ছাঁদার পাতে। ভদ্রলোক বিনা মাইনেতে নেমন্তন্ন করে আসেন; দাও দাও, ষোলটা দাও।
পূর্ণ চক্রবর্তী আঁচল খুলিতে খুলিতে বলিল, আঁচলে দাও, আমার আঁচলে দাও।
শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, চক্রবর্তী, কাল সকালে একবার আসবে তো। কেমন, এখানে এসেই জল খাবে?
যে আজ্ঞা, তা আসব।
ওপাশ হইতে কে বলিল, চক্রবর্তী, বাবুকে ধরে পড়ে তুমি বিদূষক হয়ে যাও—আগেকার রাজাদের যেমন বিদূষক থাকত।
চক্রবর্তী গামছায় ছাঁদার পাতাটা বাঁধিতে বাঁধিতে বলিল, হুঁ। তা তোমার হলে তো ভালই হয়; আর তোমার, ব্রাহ্মণের লজ্জাই বা কী? রাজা-জমিদারের বিদূষক হয়ে যদি ভাল-মন্দটা—
বলিতে বলিতেই সে হাসিয়া উঠিল।
বাড়িতে আসিয়া ছাঁদা-বাঁধা গামছাটা বড় ছেলের হাতে দিয়া চক্রবর্তী বলিল, যা, বাড়িতে দিগে যা।
ছেলেটা গামছা হাতে লইতেই মেজো মেয়েটা বলিল, মিষ্টিগুলো?
সে আমি নিয়ে যাচ্ছি, যা।
অ্যাঁ, তুমি লুকিয়ে রাখবে। ষোলটা মিষ্টি কিন্তু গুনে নোব, হ্যাঁ।
আরে আরে, এ বলছে কী? ষোলটা কোথা রে বাপু। দিলে তো আটটা, তাও কত ঝগড়া করে।
মা, মা, দেখ বাবা মিষ্টিগুলো লুকিয়ে রেখেছে, অ্যাঁ।
চক্রবর্তী গৃহিনী যাহাকে বলে রূপসী। দারিদ্রের শতমুখী আক্রমণেও সে রূপকে জীর্ণ করিতে পারে নাই। দেহ শীর্ণ, চুল রুক্ষ, পরিধানে ছিন্ন মলিন বস্ত্র, তবুও হৈমবতী যেন সত্যিই হৈমবতী। কাঞ্চননিভ দেহবর্ণ দেখিয়া সোনার প্রতিমা বলিতেই ইচ্ছা করে। চোখ দুইটি আয়ত সুন্দর, কিন্তু দৃষ্টি তাহার নিষ্ঠুর মায়াহীন। মায়াহীন অন্তর ও রূপময় কায়া লইয়া হৈম যেন উজ্জ্বল বালুস্তরময়ী মরুভূমি, প্রভাতের পর হইতেই দিবসের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মরুর মতোই প্রখর হইতে প্রখরতম হইয়া উঠে।
হৈমবতী আসিয়া দাঁড়াইতেই চক্রবর্তী সভয়ে মেয়েকে বলিল, বলছি, তুই নিয়ে যেতে পারবি না। না, মেয়ে চেঁচাতে—
হৈমবতী কঠোর স্বরে বলিল, দাও!
ছেলেটা বলিল, বাবাকে আর দিও না মা। আজ যা খেয়েছে বাবা, উঃ? আবার কাল সকালে বাবু নেমতন্ন করেছে, বাবাকে মিষ্টি খাওয়াবে!
হৈম কঠিন স্বরে বলিল, বেরো বলছি আমার সুমুখ থেকে হতভাগা ছেলে। বাপের প্রতি ভক্তি দেখ! তোরা সব মরিস না কেন, আমি যে বাঁচি!
পূর্ণ এবার সাহস করিয়া বলিল, দেখ না ছেলের তরিবৎ যেন চাষার তরিবৎ।
হৈম বলিল, বাপ যে চামার, লোভী চামারের ছেলে চাষাও যে হয়েছে সেইটুকুও ভাগ্যি মেনো। লেখাপড়া শেখাবার পয়সা নেই, রোগে ওষুধ নেই, গায়ে জামা নেই, তবু মরে না ওরা। রাক্ষসের ঝাড়, অখণ্ড পেরমাই!
চক্রবর্তী চুপ করিয়া রহিল। হৈম যেন আগুন ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া গেল। চক্রবর্তী ছেলেটাকে বলিল, দেখ দেখি রে; এক টুকরো হত্তকি, কী সুপুরি এক কুচি যদি পাস! তোর মার কাছে যেন চাস নি বাবা!
সন্ধ্যার পর চক্রবর্তী হৈমর কাছে বসিয়া ক্রমাগত তাহার তোষামোদ করিতে আরম্ভ করিল। হৈম কোলের ছেলেটাকে ঘুম পাড়াইতেছিল। চক্রবর্তী এবং ছেলেরা আজ নিমন্ত্রণ খাইয়াছে। রাত্রে আর রান্নার হাঙ্গামা নাই, যে ছাঁদাটা আসিয়াছে তাহাতে হৈম আর কোলের ছেলেটারও চলিয়া গিয়াছে।
বহু তোষামদেও হৈম যেন তেমন প্রসন্ন হইল না। অন্তত চক্রবর্তীর তাহাই মনে হইল; সে মনের কথা বলিতে সাহস পাইল না! তাহার একান্ত ইচ্ছা যে রাত্রে কয়েকটা ছানাবড়া সে খায়। তাহার তৃপ্তি হয় নাই, বুকের মধ্যে লালসা ক্রমবর্ধমান বহ্নিশিখার মতো জ্বলিতেছে।
ধীরে ধীরে হৈমবতী ঘুমাইয়া পড়ল। শীর্ণ দুর্বল, দেহ, তাহার উপর আবার সে সন্তানসম্ভবা, সন্ধ্যার পর শরীর যে ভাঙ্গিয়া পড়ে। চক্রবর্তী হৈমর দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিল, হাঁ হৈম ঘুমাইতেছে! চক্রবর্তী আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া হৈমর আঁচল হইতে দড়ি বাঁধা কয়টা চাবির গোছা খুলিয়া ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
পরদিন প্রভাতে উঠিয়াই ছেলেরা নাচিতে নাচিতে চিৎকার করিতে আরম্ভ করিল, ছানাবড়া খাব! বড় ছেলেটা ঘুর-ঘুর করিয়া বার বার মায়ের কাছে আসিয়া বলিতেছিল, আমাকে কিন্তু একটা গোটা দিতে হবে মা!
হৈম বিরক্ত হইয়া বলিল, সব—সবগুলো বের করে দিচ্ছি, একটা কেন?
সে চাবি খুলিয়া ঘরে ঢুকিয়াই একটা রূঢ় বিস্ময়ের আঘাতে স্তব্ধ ও নিশ্চল হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। যে শিকাতে মিষ্টিগুলি ঝুলান ছিল, সেটা কীসে কাটিয়া ফেলিয়াছে, মিষ্টান্নগুলি অধিকাংশই কীসে খাইয়া গিয়াছে, মাত্র গোটা তিন-চার মেঝের উপর পড়িয়া আছে। তাও সেগুলি রসহীন শুষ্ক, নিঃশেষে রস শোষণ করিয়া লইয়া ছাড়িয়াছে! ছেঁড়া শিকলটাকে সে একেবারে তুলিয়া ধরিয়া দেখিল, কাটা না, টানিয়া কীসে ছিঁড়িয়াছে। অতি নিষ্ঠুর কঠিন হাসি তাহার মুখে ফুটিয়া উঠিল!
বাবু বলিলেন, গিন্নীর একান্ত ইচ্ছে যে তুমি এবার তাঁর আঁতুড়দোরে থাকবে।
এখানকার প্রচলিত প্রথায় সূতিকা-গৃহের দুয়ারের সম্মুখে রাত্রে ব্রাহ্মণ রাখিতে হয়। চক্রবর্তী সন্তানদের মধ্যে সব কটিই জীবিত, চক্রবর্তী-গৃহিনী নিখুঁত প্রসূতি; তাহার সূতিকা-গৃহের দুয়ারে চক্রবর্তীই শুইয়া থাকে। তাই শিবরাণী এবার এই ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছে, কল্যাণের এমনই সহস্র খুঁটিনাটি লইয়া সে অহরহ ব্যস্ত। শ্যামাদাসবাবুও তাহার কোনো ইচ্ছা অপূর্ণ রাখিবেন না।
চক্রবর্তী বলিল, হাঁ, তা আজ্ঞে—
একজন মোসাহেব বলিয়া উঠিল, তা না না—কিছু নেই চক্রবর্তী। দিব্যি এখানে এসে রাজভোগ খাবে, ইয়া পুরু বিছানা, তোফা ভরা পেটে বুঝেছ? বলিয়া সে ঘড়ঘড় করিয়া নাক ডাকাইয়া ফেলিল।
আহার ও আরামের বর্ণনায় পুলকিত চক্রবর্তী হাসিয়া ফেলিল বলিল, হুঁ, তা হুজুর যখন বলছেন, তখন না পারলে হবে কেন?
শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, বসো তুমি, আমি জল খেয়ে আসছি। তোমারও জলখাবার আসছে।—বলিয়া তিনি পাশের ঘরে চলিয়া গেলেন। একজন চাকর একখানা আসন পাতিয়া দিয়া মিষ্টান্ন পরিপূর্ণ একখানা থালা নামাইয়া দিল।
একজন বলিল, খাও চক্রবর্তী।
হুঁ। তা একটু জল, হাতটা ধুয়ে ফেলতে হবে।
আর একজন পারিষদ বলিল, গঙ্গাগঙ্গা বলে বসে পড় চক্রবর্তী। অপবিত্র পবিত্র বা, ওঁ বিষ্ণু স্মরণ করলেই—ব্যাস শুদ্ধ, বসে পড়!
গ্লাসের জলেই একটা কুলকুচা করিয়া খানিকটা হাতে বুলাইয়া লইয়া চক্রবর্তী লোলুপভাবে থালার সম্মুখে বসিয়া পড়িল।
পাশের ঘরে জলযোগ শেষ করিয়া আসিয়া শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, পেট ভরল চক্রবর্তী?
চক্রবর্তীর মুখে তখন গোটা ছানাবড়া; একজন বলিয়া উঠিল আজ্ঞে কথা বলার অবসর নেই চক্রবর্তীর এখন।
সেটা শেষ করিয়া চক্রবর্তী বলিল, আজ্ঞে পরিপূর্ণ, তিল ধরাবার জায়গা নেই পেটে।
সে উঠিয়া পড়িল।
শ্যামাদাসবাবু বলিলেন তোমার কল্যাণে যদি মনস্কামনা আমার সিদ্ধ হয় চক্রবর্তী তবে দশ বিঘে জমি আমি তোমাকে দেব। আর আজীবন তুমি সিংহবাহিনীর একটা প্রসাদ পাবে। তা হলে তোমার কথা তো পাকা—কেমন?
সিংহবাহিনীর প্রসাদ কল্পনা করিয়া চক্রবর্তী পুলকিত হইয়া উঠিল। সিংহবাহিনীর ভোগের প্রসাদ—সে যে রাজভোগ!
হুঁ। তা পাকা বইকি, হুজুরের—
কথা অর্ধসমাপ্ত রাখিয়া সে বলিয়া উঠিল, দেখ দেখি, ওহে, দেখি।
চোখ তাহার যেন জ্বল জ্বল করিয়া উঠিল।
খানসামাটা শ্যামদাসবাবুর উচ্ছিষ্ট জলখাবারের থালাটা লইয়া সম্মুখ দিয়া পার হইয়া যাইতেছিল। একটা অভুক্ত ক্ষীরের সন্দেশ ও মালপোয়া থালাটার উপর পড়িয়া ছিল। চক্রবর্তীর লোলুপতা অকস্মাৎ যেন সাপের মতো বিবর হইতে ফণা বিস্তার করিয়া বাহির হইয়া বিষ উদগার করিল। চক্রবর্তী স্থানাকাল সমস্ত ভুলিয়া বলিয়া উঠিল, দেখি দেখি, ওহে দেখি।
শ্যামাদাসবাবু হাঁ-হাঁ করিয়া উঠিলেন, কর কী, এঁটো, ওটা এঁটো। নতুন এনে দিক?
চক্রবর্তী তখন থালাটা টানিয়া লইয়াছে। ক্ষীরের সন্দেশটা মুখে পুরিয়া বলিল, আজ্ঞে রাজার প্রসাদ।
আর সে বলিতে পারিল না, আপনার অন্যায়টা মুহূর্তে তাহার বোধগম্য হইয়া উঠিয়াছে। কিন্তু আর উপায় ছিল না, বাকিটাও আর ফেলিয়া রাখা চলে না। লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া সেটাও কোনোরূপে গলাধঃকরণ করিয়া তাড়াতাড়ি কাজের ছুতা করিয়া সে পালাইয়া আসিল।
বাড়িতে তখন মরুতে ঝড় বহিতেছে। হৈম মূর্ছিত হইয়া পড়িয়াছে, ছোট ছেলেগুলো কাঁদিতেছে। বড়টা কোথায় পালাইয়াছে।
মেজো মেয়েটা কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল, মিষ্টিগুলো কীসে খেয়ে গিয়েছে, তাই দাদা ঝগড়া করে মাকে মেরে পালাল। মা পড়ে গিয়ে—
কথার শেষাংশ তাহার কান্নায় ঢাকিয়া গেল। চক্রবর্তীর চোখে জল আসিল। জলের ঘটি ও পাখা লইয়া সে হৈমর পাশে বসিয়া শুশ্রূষা করিতে করিতে সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে হৈমর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
চেতনা হইতেই হৈম স্বামীকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ছি ছি ছি! তোমাকে কী বলব আমি—ছিঃ।
চক্রবর্তী হৈমর পা জড়াইয়া ধরিয়া কী বলিতে গেল, কিন্তু হৈম চিৎকার করিয়া উঠিল, মাথা ঠুকে মরব আমি; ছাড় পা ছাড়।
সমস্ত দিন হৈম নির্জীবের মতো পড়িয়া রহিল। সন্ধ্যার দিকে সে সুস্থ হইয়া উঠিলে চক্রবর্তী সমস্ত কথা বলিয়া কহিল, তোমার বলছ, তোমার ওই সময়েই। তা না হয় কাল বলে দেব যে, পারব না আমি।
হৈম চিৎকার করিয়া উঠিল, না না না। মরুক মরুক, হয়ে মরুক এবার। আমি খালাস পাব। জমি পেলে অন্যগুলো তো বাঁচবে।
শ্রাবণ মাসের প্রথম সপ্তাহেই। সেদিন সন্ধ্যায় শ্যামদাসবাবুর লোক আসিয়া চক্রবর্তীকে ডাকিল, চলুন আপনি, গিন্নিমায়ের প্রসববেদনা উঠেছে।
চক্রবর্তী বিব্রত হইয়া উঠিল; হৈমরও শরীর আজ কেমন করিতেছে!
হৈম বলিল, যাও তুমি।
কিন্তু—
আমাকে আর জ্বালিও না বাপু, যাও। বাড়িতে বড় খোকা রয়েছে, যাও তুমি।
চক্রবর্তী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাহির হইয়া গেল। জমিদার-বাড়ি তখন লোকজনে ভরিয়া গিয়াছে। শ্যামাদাসবাবু বলিলেন, এস চক্রবর্তী, এস। আমি বড় ব্যস্ত এখন। তুমি রান্নাবাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে নিও।
চক্রবর্তী সটান গিয়ে তখনই রান্নাশালে উঠিল।
হুঁ, ঠাকুর কী রান্না হয়েছে আজ? বাঃ খোসবুই তো খুব উঠেছে। কী হে, ওটা মাছের কালিয়া, না মাংস?
মাংস। আজ মায়ের পুজো দিয়ে বলি দেওয়া হয়েছে কিনা।
হুঁ, তা তোমার রান্নাও খুব ভাল। তার ওপর তোমার বাদলার দিন। কতদূর, বলি দেরি কত? দাও না, দেখি একটু চেখে।
সে একখানা শালপাতা ছিঁড়িয়া ঠোঙা করিয়া একেবারে কড়াই ঘেঁসিয়া বসিয়া পড়িল। ঠাকুর বিরক্ত হইয়া বলিল, আচ্ছা লোভ তোমার চক্রবর্তী।
হুঁ, তা বলেছ ঠিক। তা একটু বেশি। তা বটে।
একটুখানি নীরব থাকিয়া বলিল, সিদ্ধ হতে দেরি আছে নাকি?
হাতাতে করিয়া খানিকটা অর্ধসিদ্ধ মাংস তাহার ঠোঙাতে দিয়া ঠাকুর বলিল, এই দেখ, বললে তো বিশ্বাস করবে না। নাও, হুঁ।
সেই গরম ঝোলই খানিকটা সড়াৎ করিয়া টানিয়া লইয়া চক্রবর্তী বলিল, হুঁ, বাঃ ঝোলটা বেড়ে হয়েছে। হুঁ, তা তোমার রান্না, যাকে বলে উৎকৃষ্ট।
ঠাকুর আপন মনেই কাজ করিতেছিল, সে কোনো উত্তর দিল না।
চক্রবর্তী বলিল, হুঁ। তা তোমার, এ চাকলায় তোমার জুড়ি দেখলাম না। মাংসটা সিদ্ধ এখনো হয় নি, তবে তোমার গিয়ে খাওয়া চলছে।
ঠাকুর বলিল, চক্রবর্তী, তুমি এখন যাও এখান থেকে। খাবার হলে খবর দেবে চাকররা। আমাকে কাজ করতে দাও। যাও, ওঠো।
চক্রবর্তী উঠিয়াছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু এই সময়ে তাহার বড় ছেলেটা আসিয়া ডাকিল, বাবা!
চক্রবর্তী উঠিয়া আসিয়া প্রশ্ন করি, কী রে?
একবার বাড়ি এস। ছেলে হয়েছে!
তোর মা—তবে মা কেমন আছে?
ভালোই আছে গো। তবে দাই-টাই কেউ নেই, দাই এসেছে বাবুদের বাড়ি; নাড়ী কাটতে লোক চাই।
চক্রবর্তী তাড়াতাড়ি ছেলের সঙ্গে বাহির হইয়া গেল।
ভয় নেই, ভালই আছি। তুমি শুদ্দুরদের দাইকে ডাক দেখি, নাড়ী কেটে দিয়ে যাক। আমাদের দাইকে তো পাওয়া যাবে না।
তাহাই হইল। দাইটা নাড়ী কাটিয়া বলিল, সোন্দর খোকা হয়েছে বাপু, মা বাপ সোন্দর না হলে কি ছেলে সোন্দর হয়। মা কেমন—তা দেখতে হবে।
হৈম বলিল, যা যা, বকিস নি বাপু; কাজ হল তোর, তুই যা।
চক্রবর্তী বলিল, হুঁ, তা হলে, তাই তো। খোকা যাক, বলে আসুক বাবুকে, অন্য লোক দেখুন ওঁরা।
হৈম বলিল, দেখ জ্বালিও না আমাকে। যাও, বলছি, যাও।
চক্রবর্তী আবার অন্ধকারের মধ্যে বাবুদের বাড়ির দিকে চলিল।
মধ্যরাত্রে জমিদার-বাড়ি শঙ্খধ্বনিতে মুখরিত হইয়া উঠিল। শিবরাণী একটি পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছে।
পূর্ব হইতে ডাক্তার আসিয়া উপস্থিত ছিল, সে-ই যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করিয়া নাড়ী কাটিল। গরম জলে শিশুর শরীরের ক্লেদাদি ধুইয়া মুছিয়া দাইয়ের কোলে শিশুটিকে সমর্পণ করিয়া সে যখন বিদায় হইল, তখন রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে।
প্রভাতে চক্রবর্তী বাড়ি আসিতেই হৈম বলিল, ওগো ছেলেটার ভোররাত্রে যেন জ্বর হয়েছে মনে হচ্ছে।
চক্রবর্তী চমকিয়া উঠিল, বলিল, হুঁ, তা—
অবশেষে অনুযোগ করিয়া বলিল, বললাম তখন, যাব না আমি। তা তুমি একেবারে আগুন হয়ে উঠলে? কীসে যে কী হয়—হুঁ।
হৈম বলিল, ও কিছু না, আপনি সেরে যাবে। এখন পওয়া-টাকের সাবু কি দুধ যদি একটু পাও তো দেখ দেখি। আমাকে কাটলেও তো এক ফোঁটা দুধ বেরুবে না।
পয়সা ছিল না, চক্রবর্তী প্রাতকৃত্য সারিয়া বাবুদের বাড়ির দিকেই চলিল, দুধের জন্য। কাছারি-বাড়িতে ঘটি হাতে দাঁড়াইয়া সে বাবুকে খুঁজিতেছিল। বাবু ছিল না। লোকজন সব ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া চলাফেরা করিতেছে। কেহ চক্রবর্তীকে লক্ষ্যই করিল না।
খানসামাটা বাড়ির ভিতর হইতে বাহির হইয়া কোথায় যাইতেছিল, সে চক্রবর্তীকে লক্ষ্য করিয়া বলিল, আজ আর পেসাদ-টেসাদ মিলবে না ঠাকুর; যাও, বাড়ি যাও।
চক্রবর্তী ম্লান মুখে ধীরে ধীরে বারান্দা হইতে নামিয়া আসিল। একজন নিম্নশ্রেণীর ভৃত্য একটা আড়াল দেখিয়া বসিয়া তামাক টানিতেছিল, চক্রবর্তী তাহাকেই জিজ্ঞাসা করিল, হ্যাঁ বাবা, ছেলের জন্যই গাই দোয়া হয়নি?
সে উত্তর দিল, কেন ঠাকুর, ধারসা খাবে নাকি? আচ্ছা পেটুক ঠাকুর যা হোক। না গাই দোয়া হয়নি, বাড়িতে ছেলের অসুখ; ওসব হবে না এখন, যাও।
শিশুর অসুখ বোধহয় শেষরাত্রেই আরম্ভ হইয়াছিল, কিন্তু বোঝা যায় নাই। সারা রাত্রিব্যাপী যন্ত্রণা ভোগ করিয়া শিবরাণীও এলাইয়া পড়িয়াছিল, রাত্রি জাগরণক্লিষ্টা দাইটাও ঘুমাইয়াছিল।
বেশ একটু বেলা হইলে শিবরাণী উঠিয়া বসিয়া ছেলে কোলে লইয়াই আশঙ্কায় চমকিয়া উঠিল। এ কী, ছেলে যে কেমন করছে! তাহার পূর্বের সন্তানগুলি তো এমন ভাবেই—। চোখের জলে শিবরাণীর বুক ভাসিয়া গেল। শিশুর শুভ্রপুষ্পতুল্য দেহবর্ণ যেন ঈষৎ বিবর্ণ হইয়া গিয়াছে।
শিবরাণী আর্তস্বরে ডাকিল, যমুনা, একবার বাবুকে ডেকে দে তো?
শ্যামাদাসবাবু আসিতেই সে বলিল, ডাক্তার ডাকাও, ছেলে কেমন হয়ে গেছে! সেই অসুখ।
শ্যামাদাসবাবু একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, দুর্গা, দুর্গা!
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তিনি ডাক্তার আনিতে পাঠাইলেন। স্থানীয় ডাক্তার তৎক্ষণাৎ আসিল এবং তাহার পরামর্শমতো শহরেও লোক পাঠানো হইল বিচক্ষণ চিকিৎসকের জন্য। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেখা গেল, শিবরাণীর আশঙ্কা সত্য; সত্যই শিশু অসুস্থ। ধীরে ধীরে শিশুর দেহবর্ণ হইতে আকৃতি পর্যন্ত যেন কেমন অস্বাভাবিক হইয়া আসিতেছে। এই সর্বনাশা রোগেই শিবরাণীর শিশুগুলি এমনই করিয়া সূতিকাগৃহে একে একে বিনষ্ট হইয়াছে।
অপরাহ্নে সদর হইতে বড় ডাক্তার আনিয়া শিশুকে কিছুক্ষণ দেখিয়া একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, চলুন আমার দেখা হয়েছে।
দাইটা বলিয়া উঠিল, ডাক্তারবাবু ছেলে—
তাহার প্রশ্ন শেষ হইবার পূর্বেই ডাক্তার বলিল, ওষুধ দিচ্ছি।
শ্যামাদাসবাবুর সঙ্গে ডাক্তার বাহির হইয়া গেল।
শ্যামাদাসবাবুর মাসীমা সূতিকাগৃহের সম্মুখে দাঁড়াইয়া দাইকে বলিলেন, কই ছেলে নিয়ে আয় তো দেখি।
ছেলের অবস্থা দেখিয়া তিনি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, মা আমার কপাল রে! বলিয়া ললাটে করাঘাত করিলেন। ঘরের মধ্যে শিবরাণী ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিলেন।
মাসীমা আপন মনেই বলিলেন, আর ও বার করে দিতে হয়েছে। কী করেই বা বলি! আর পোয়াতীর কোলেই বা—
ডাক্তার শ্যামাদাসবাবুকে বলিল, কিছু মনে করবেন না শ্যামাদাসবাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
বলুন।
ডাক্তার শ্যামাদাসবাবুর যৌবনের ইতিহাস প্রশ্ন করিয়া বলিল, আমিও তাই ভেবেছিলাম। ওই হল আপনার সন্তানদের অকালমৃত্যুর কারণ।
তা হলে ছেলেটা কি—
না, আশা আমি দেখি না!—বলিয়া বিদায় লইল।
শ্যামাদাসবাবু বাড়ির মধ্যে আসিতেই মাসীমা আপনার মনের কথাটা ব্যক্ত করিয়া বলিলেন, নইলে কি পোয়াতীর কোলে ছেলে মরবে। সে যে দারুণ দোষ হবে বাবা। আচার-আচরণগুলো মানতে হবে তো—
আচার রক্ষা করিতে হইলে বিচার করার কোনো প্রয়োজন হয় না! এবং হিন্দুর সংসারে আচারের উপরেই নাকি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং শিবরাণীর কোল শূন্য করিয়া দিয়া শিশুকে সূতিকাগৃহের বাহিরে বারান্দায় মৃত্যু-প্রতীক্ষায় শোয়াইয়া দেওয়া হইল। তাহার কাছে রহিল দাই এবং প্রহরায় রহিল ব্রাহ্মণ, আর মাথার শিয়রে রহিল দেবতার নির্মাল্যের রাশি। ঘরের মধ্যে পুত্রশোকাতুরা শিবরাণীর সেবা ও সান্ত্বনার জন্য রহিল যমুনা ঝি।
শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত্রি। চক্রবর্তী বসিয়া ঘন ঘন তামাক খাইতেছিল। তাহাদের ঘরেও শিশুটি অসুস্থ! কিন্তু সে সারিয়া উঠিবে। চক্রবর্তী মধ্যে মধ্যে আপন মনেই বিদ্রুপের হাসি হাসিতেছিল। সে ভাবিতেছিল, বিধিলিপি! তাহার শিশুটা মরিয়া যদি এটি বাঁচিত, তবে চক্রবর্তী অন্তত বাঁচিত। দশ বিঘা জমি আর সিংহবাহিনীর প্রসাদ নিত্য এক থালা। ভাগ্যের চিকিৎসা কি আর ডাক্তার করিতে পারে!
শিশুটি মধ্যে মধ্যে ক্ষীণ কন্ঠে অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করিতেছে।
চক্রবর্তী দাইটাকে বলিল, একটু জল-টল মুখে দেবে বাপু!
নিদ্রাকাতার দাইটা বলিল, জল কি খাবে গো ঠাকুর? তা বলছ, দিই। সে উঠিয়া ফোঁটা দুই জল দিয়া শিশুর অধর ভিজাইয়া দিল। তারপর শুইতে শুইতে বলিল, ঘুমোও ঠাকুর, তোমার কি আর ঘুম টুম নাই?
চক্রবর্তীর চক্ষে সত্য সত্যই ঘুম নাই। সে বসিয়া আকাশজোড়া অন্ধকারের দিকে চাহিয়া আপন ভাগ্যের কথা ভাবিতেছিল। তাহার ভাগ্যাকাশও এমনই অন্ধকার। আঃ, ছেলেটা যদি যাদুমন্ত্রে বাঁচিয়া ওঠে? চক্রবর্তী পৈতা ধরিয়া শিশুর ললাটখানি একবার স্পর্শ করিল।
অকস্মাৎ সে শিহরিয়া উঠিল। ভয়ে সর্বাঙ্গ তাহার থরথর করিয়া কাঁপে।
না, না, সে হয় না; জানিতে পারিলে সর্বনাশ হইবে। দেখিতে দেখিতে তাহার সর্বাঙ্গ ভিজিয়া উঠিল। সে আবার তামাক খাইতে বসিল।
দাইটা নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে। ঘরের মধ্যেও শিবরাণীর মৃদু ক্রন্দনধ্বনি আর শোনা যায় না। কলিকার আগুনে ফুঁ দিতে দিতে চক্রবর্তী আবার চঞ্চল হইয়া উঠিল; জ্বলন্ত অঙ্গারের প্রভায় চোখের মধ্যেও যেন আগুন জ্বলিতেছে।
উঃ, চিরদিনের জন্য তাহার দুঃখ ঘুচিয়া যাইবে! এ শিশুর প্রভাত হইতেই বিকৃত মূর্তি, তাহার শিশুও কুৎসিত নয়, দরিদ্রের সন্তান হইলেও, জননীর কল্যাণে সে রূপ লইয়া জন্মিয়াছে। সমস্ত সম্পত্তি তাহার সন্তানের হইবে! উঃ।
পাপ যেন সম্মুখে অদৃশ্য কায়া লইয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিতেছিল। গভীর অন্ধকারের মধ্যেও আলোকিত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চক্রবর্তীর চোখের সম্মুখে ঝলমল করিতেছে। চক্রবর্তী উঠিয়া দাঁড়াইল। শিশুর নিকট আসিয়া কিন্তু আবার তাহার ভয় হইল। কিন্তু সে এক মুহূর্ত। পরমুহূর্তে সে মৃতপ্রায় শিশুকে বস্ত্রাবৃত করিয়া লইয়া খিড়কির দরজা দিয়া সন্তর্পণে বাহির হইয়া পড়িল।
অদ্ভুত, সে যেন চলিয়াছে অদৃশ্য বায়ুপ্রবাহের মতো—নিঃশব্দ, দ্রুতগতিতে। অন্ধকার পথেও আজ সরীসৃপ, কীট, পতঙ্গ, কেহ তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে সাহস করে না, তাহারও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নাই। ভাঙা ঘর। চারিদিকে প্রাচীরও সর্বত্র নাই। হৈমের সূতিকাগৃহের দরজাও নাই, একটা আগড় দিয়া কোনোরূপে আগলানো আছে। হৈমও গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন।
চক্রবর্তী আবার বাতাসের মতো লঘু ক্ষিপ্রগতিতে ফিরিল।
দাইটা তখনও নাক ডাকাইয়া ঘুমাইতেছে।
রোগগ্রস্ত শিশু, মৃত্যু-রোগগ্রস্ত নয়। সে থাকিতে থাকিতে অপেক্ষাকৃত সবল ক্রন্দনে আপনার অভিযোগ জানাইল। দাইটার কিন্তু ঘুম ভাঙ্গিল না। চক্রবর্তী ঘুমের ভান করিয়া কাঠ মারিয়া পড়িয়া রহিল।
শিশু আবার কাঁদিল।
ঘরের মধ্যে শিবরাণীর অস্ফুট ক্রন্দন এবার যেন শোনা গেল।
শিশু আবার কাঁদিল।
এবার যমুনা ঈষৎ দরজা খুলিয়া বলিল, দাই, ও দাই। ওমা নাক ডাকছে যে। ঠাকুরও দেখছি মড়ার মতো ঘুমিয়েছে। ও দাই!
দাইটা ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিল। যমুনা বলিল, এই বুঝি তোর ছেলে আগলানো! ছেলে যে কাতরাচ্ছে, মুখে একটু করে জল দে।
দাইটা তাড়াতাড়ি শিশুর মুখে জল দিল, শুষ্ক কণ্ঠে শিশু চাটিয়া জলটুকু পান করিয়া আবার যেন চাহিল। দাই আবার জল দিল।
এবার সে আগ্রহে বলিয়া উঠিল, ওগো জল খাচ্ছে গো ঠোঁট চেটে চেটে।
শিবরাণী দুর্বল দেহে উঠিয়া পড়িয়া বলিল, নিয়ে আয়, ঘরে নিয়ে আয় আমার ছেলে, কারও কথা আমি শুনব না।
প্রভাতে আবার লোক ছুটিল সদরে। এবার অন্য ডাক্তার আসিবে। মৃত্যুদ্বার হইতে শিশু ফিরিয়াছে। দেবতার দান, ব্রাহ্মণের প্রসাদ। চক্রবর্তী নাকি আপন শিশুর পরমায়ু রাজার শিশুকে দিয়াছে। হতভাগ্যের সন্তান মারা গিয়াছে।
প্রায়ান্ধকার সূতিকা-গৃহে শিবরাণীর জ্বর-কাতর শিশুকে কোলে করিয়া বসিয়া আছে। তাহার ভাগ্য-দেবতা, তাহার হারানো মাণিক!
দশ বিঘা জমি চক্রবর্তী পাইল। সিংহবাহিনীর প্রসাদ এক থালা করিয়া নিত্য সে পায়। হৈম অপেক্ষাকৃত শান্ত হইয়াছে। কিন্তু চক্রবর্তী সেই তেমনি করিয়াই বেড়ায়।
লোকে বলে, স্বভাব যায় না মলে।
চক্রবর্তী বলে, হুঁ, তা বটে। কিন্তু ছেলের দল দেখেছ, এক একটা ছেলে যে একটা হাতির সমান।
হৈম ছেলেগুলিকে ইস্কুলে দিয়াছে। বড় ছেলেটি এখন ইতরের মতো কথা বলে না, কিন্তু বড় বড় কথা বলে, বাবার ব্যবহারে ইস্কুলে আমার মুখ দেখানো ভার মা। ছেলেরা যা-তা বলে। কেউ বলে, ভাঁড়ের বেটা খুরি। তুমি বাপু বারণ করে দিও বাবাকে।
হৈম সে কথা বলিতেই চক্রবর্তী সহসা যেন আগুনের মতো জ্বলিয়া উঠিল। তাহার অস্বাভাবিক রূপ দেখিয়া হৈমও চমকিয়া উঠিল।
চক্রবর্তী বলিল, চলে যাব আমি সন্ন্যাসী হয়ে।
ব্যাপারটা আরও অগ্রসর হইত। কিন্তু বাহির হইতে কে ডাকিল, চক্রবর্তী?
কী?
বাঁড়ুজ্জেরা পাঠালে হে। ওদের মেয়ের বাড়ি তত্ব যাবে, তোমাকে সঙ্গে যেতে হবে; ওরা কেউ যেতে পারবে না। লাভ আছে হে, ভাল-মন্দ খাবে, বিদেয়টাও পাবে।
আচ্ছা, চল যাই।
চক্রবর্তী বাহির হইয়া পড়িল। বাঁড়ুজ্জেদের বাড়ি গিয়া যেখানে মিষ্টি তৈয়ারী হইতেছিল, সেখানে চাপিয়া বসিয়া বলিল, ব্রাহ্মণস্য ব্রাহ্মণং গতি। হুঁ, তা যেতে হবে বইকি। উনোনের আঁচটা একটু ঠেলে দিই, কী বল মোদক মশায়?
সে সতৃষ্ণ নয়নে কড়াইয়ের পাকের দিকে চাহিয়া রহিল।
বৎসর দশেক পর শিবরাণী হঠাৎ মারা গেল। লোকে বলিল, ভাগ্যবতী। স্বামীপুত্তুর রেখে ডঙ্কা মেরে চলে গেল।
শ্যামাদাসবাবু শ্রাদ্ধোপলক্ষে বিপুল আয়োজন আরম্ভ করিলেন। চক্রবর্তীর এখন ওইখানেই বাসা হইয়াছে। সকালবেলাতেই ঠুকঠুক করিয়া গিয়া হাজির হয়, বসিয়া বসিয়া আয়োজনের বিলি-বন্দোবস্ত দেখে, মধ্যে মধ্যে ব্রাহ্মণ-ভোজনের আয়োজন সম্বন্ধে দুই একটা কথা বলে।
সেদিন বলিল, হুঁ, ছাঁদা একটা করে তো দেওয়া হবে। তা তোমার লুচিই বা কখানা আর তোমার মিষ্টিই বা কী রকম হবে?
একজন উত্তর দিল, হবে হবে। একখানা করে লুচি, এই চালুনের মতো। আর মিষ্টি একটা করে, তোমার লেডিকেনি, এই পাশ-বালিশের মতো, বুঝলে!
সকলে মৃদু মৃদু হাসিতে আরম্ভ করিল। শ্যামাদাসবাবু ঈষৎ বিরক্ত হইয়া বলিলেন, একটু থাম তো সব। হ্যাঁ, কী হল, পাওয়া গেল না?
একজন কর্মচারীর সঙ্গে তিনি কথা কহিতেছিলেন। কর্মচারীটি বলিল, আজ্ঞে, তাদের বংশই নির্বংশ হয়ে গিয়েছে।
তা হলে অন্য জায়গায় লোক পাঠাও। অগ্রদানী না হলে তো শ্রাদ্ধ হয় না।
আচ্ছা, তাই দেখি। অগ্রদানী তো বড় বেশী নেই, দশ-বিশ ক্রোশ অন্তর একঘর আধঘর।
কে একজন বলিয়া উঠিল, তা আমাদের চক্রবর্তী রয়েছে। চক্রবর্তী, নাও না কেন দান, ক্ষতি কী? পতিত করে আর কে কী করবে তোমার?
শ্যামাদাসবাবুও ঈষৎ উৎসুক হইয়া বলিয়া উঠিলেন, মন্দ কী চক্রবর্তী, শুধু দান সামগ্রী নয়, ভূ-সম্পত্তিও কিছু পাবে, পঁচিশ বিঘে জমি দেব আমি, আর তুমি যদি রাজী হও, তবে বছরে পঞ্চাশ টাকা জমিদারী সম্পত্তির মুনাফা দেব আমি, দেখ।—বলিয়াই তিনি এদিক-ওদিক চাহিয়া চাকরকে ডাকিলেন, ওরে চক্রবর্তীকে জলখাবার এনে দে। কলকাতার মিষ্টি কী আছে নিয়ে আয়।
শ্রাদ্ধের দিন সকলে দেখিল, শ্যামাদাসবাবুর বংশধর শিবরাণীর শ্রাদ্ধ করিতেছে, আর তাহার সম্মুখে অগ্রদান গ্রহণ করিবার জন্য দীর্ঘ হস্ত প্রসারিত করিয়া বসিয়া আছে পূর্ণ চক্রবর্তী।
তারপর গোশালায় বসিয়া তাহারই হাত হইতে গ্রহণ করিয়া চক্রবর্তী গোগ্রাসে পিণ্ড ভোজন করিল।
গল্পের এখানেই শেষ, কিন্তু চক্রবর্তীর কাহিনী এখানে শেষ নয়। সেটুকু না বলিলে অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইবে।
লোভী, আহার-লোলুপ চক্রবর্তী আপন সন্তানের হাতে পিণ্ড ভোজন করিয়াও তৃপ্ত হয় নাই। লুব্ধ দৃষ্টি, লোলুপ রসনা লইয়া সে তেমনই করিয়া ফিরিতেছিল। এই শ্রাদ্ধের চৌদ্দ বছর পরে সে একদিন শ্যামাদাসবাবুর পায়ে আসিয়া গড়াইয়া পড়িল। শ্যামাদাসবাবু তাঁহার দুই বৎসরের পৌত্রকে কোলে লইয়া শুষ্ক অশ্বত্থ তরুর মতো দাঁড়াইয়া ছিলেন।
চক্রবর্তী তাঁহার পা দুইটি জড়াইয়া ধরিয়া বলিল, পারব না বাবু, আমি পারব না।
শ্যামাদাসবাবু একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, না পারলে উপায় কী চক্রবর্তী? আমি বাপ হয়ে তার শ্রাদ্ধের আয়োজন করেছি, কচি মেয়ে—তার বিধবা স্ত্রী শ্রাদ্ধ করতে পারবে, আর তুমি পারবে না, বললে চলবে কেন, বল? দশ বিঘে জমি তুমি এতেও পাবে।
শ্যামাদাসবাবুর বংশধর শিশু-পুত্র ও পত্নী রাখিয়া মারা গিয়াছে, তাহারই শ্রাদ্ধ হইবে।
চক্রবর্তী নিরুপায় হইয়া চলিয়া আসিল।
শ্রাদ্ধের দিন গোশালায় বসিয়া বিধবা বধূ পিণ্ডপাত্র চক্রবর্তীর হাতে তুলিয়া দিল।
পুরোহিত বলিল, খাও, হে চক্রবর্তী।🍁
🍂কবিতা
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় -এর দু’টি কবিতা
পা
পরিদর্শনের পর ফিরে আসছে নিরুৎসব চোখ।
ভুল উদ্ধৃতি নিয়ে বেজে ওঠে ঘণ্টার আওয়াজ
স্টেশন সাঁতরে পর্যটন আবাসের দিকে
সারি সারি পা
এবং সম্মিলিত দাগ
জোরে কড়া নাড়ছে কেউ অথচ শব্দ হচ্ছেনা…
যে বৃত্ত আঁকার কথা
বারবার অর্থহীন পেন্সিলের দাগে
ফুরিয়ে যাচ্ছে পথ
কেবল একটা বিন্দু
চারপাশে রাস্তা আঁকতে গিয়ে দূরে সরে যাচ্ছে সে নিজেই
কবিতা এখন
এই ছেঁড়া বিধ্বস্ত সময়ে যে কথা বলার ছিল
তাও কি হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের ক্ষুদ্র মুঠি থেকে?
গভীর ভিক্ষার চালে এই হাত পুর্ণ হোক ভেবে
আকাঙ্ক্ষার ডানাগুলি অপার মহিমা নিয়ে সর্বগ্রাসী উড়ে যাওয়া বোঝে।
কোন গূঢ় রঙে আজ ভরে যায় চিত্রিত আঁচল?
ঝড়ের উদ্দাম বাহু নেচে ওঠে
এই আর্তনাদ থেকে পাশ ফিরে শুয়ে
প্রবাহিত বেদমন্ত্রে লেখা হয় দেবীর মহিমা।
তবুও শিকড় ছুঁয়ে ভূমিকম্পে একদিন কেঁপে নিজস্ব বিবেক।
মিঠুন চক্রবর্তী-এর দু’টি কবিতা
ভাল ও বাসা
দুটি শব্দ। হাত ধরে পাশাপাশি
হাঁটতে হাঁটতে
আকাশে ছড়িয়ে দিচ্ছিল রাঙা আবির
তারপর একদিন
ধোঁয়াশার ভেতরে হাত ছেড়ে গেল
দু’জন দুদিকে গিয়ে
একজন ভাল থাকল, অন্যজন বাসা পেল
যে বাসা পেল রোজ ভোরে উড়ে এসে
সারাদিন
হারানো পথে খুঁজে বেড়ায় অন্য শব্দটিকে
ভাল আছে যে, সে ফেরে কী করে!
বাসা জানে ভালবাসা কষ্টের ছুরি মারে
গাঁট
দু’টো সুতো
দু’জনকে আষ্টেপৃষ্ঠে সমান ভাবে জড়িয়ে ধরলে
গাঁট হয়,
বোঝেনি অবুঝ সুতো
তাই একা একা পাক খেয়ে অন্য সুতোকে
জড়িয়েছে হাজারবার
তারপর দিনের শেষে পশ্চিমে যখন আলো ডুবে গেছে
অনেক দূরের পূবে একই সূর্য ছড়িয়েছে নতুন সকাল
অন্য সুতো সহজ টানে মুক্ত হয়ে বলে ‘ফস্কা গেরো’
রাতের অন্ধকারে
দোমড়ানো মোচড়ানো বুকে দাঁড়িয়ে থাকে
অন্য সুতোর শূন্যতা জড়িয়ে একাকী সুতোটি
ফাল্গুনী চক্রবর্তী
প্রেম ফাইল ২৩
এসো চুপিচুপি দিনের শেষে সহজ
বয়ে যাই ঋতুর কৌশলে… প্রেমের
পাতাঘরে যাবতীয় আসবাব রাখি…
নিজেকে বিলিয়ে দিই মায়া নগরীর
মায়ায়… তার জলের ফুহারে ফুহারে
যেখানে সব পতনের কিচকিচ হারিয়ে
যায় তোমার বিজয় পতাকার মিছিলে
একটু একটু ভাঙা… একটু একটু গড়া
নির্মাণের পাঁচালী… এই শব্দ গুহায়
আয়তন বাড়ছে… ঢুকে পড়ছি বিশাল
খাঁজের ভেতর… যেখানে উত্তাল
সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়… তোমার
পূজোর বেদীতে কবিতা নামে কলি
সমাহারে… আগাছারা গা ঢাকা দেয়…
ওদের গাছ হবার স্বপ্নতলিতে একদিন
সূর্য উঠবে নিশ্চয়…
কৌশিক চক্রবর্ত্তী
সংবাদ শিরোনাম
একটা অন্ধকার ঘর কিনে দাও। আমি আলো লাগাব। তার দুই দেয়ালে টাঙাব ঝাড়বাতি। শখের বিছানা পেতে গাঢ় করব রক্তপাত। পুকুরঘাটে দাঁড়াতে শিখিনি কখনো৷ বরং দেয়াল তুলে ছাড়তে শিখেছি স্বনির্ভর সরীসৃপ। সমস্ত ডানাহীন যুগে আমি উড়ে গেছি নিরুপদ্রব ডালে। ঝড়ের আগে চেয়ে নিয়েছি সংকেত। ঘন কুয়াশার কথা লিখতে গেলে সাহস যুগিয়েছি নিজের অন্দরে।
ঘামে ভিজে গেছে ঠোঁট৷ ওজনে দারিদ্র সীমার নীচে থাকা মানুষের কথা দাঁড়িয়ে শুনেছি বারবার। ঘরগৃহস্থ উঁকি দেয়। সংযোগবিহীন গাছেদের গায়ে নির্লিপ্ত আঁকিবুঁকি৷
বিপন্ন দেয়ালের রং স্থায়ী হয়নি কোনোদিন। পোস্টারের পিছনে সংবাদ শিরোনাম। চেয়ে থাকছি আবার৷ যদি আরও কয়েকটা অন্ধকার ঘরে আলো নিয়ে অপেক্ষায় থাকো তুমি।
আবদুস সালাম
দৃশ্য পট
শূন্যতার ধূসর পথ
দীর্ঘ সময় যাপনে পূর্বপুরুষেরা কাব্যিক হয়
আরব্য রজনীর নাবিকেরা বাজায় বিচ্ছেদের সুর
করোনার ঢেউয়ে ভাসছে মূল্যবোধ সংঘাত মেনে হাত ধুয়ে নিয়ে সমুদ্রের ঘাটে
অসহায় মা বাবা আজ প্রবন্ধ যাপনে বাধ্য স্মৃতির প্রত্নপ্রান্তরে লিখে রাখি ধ্রুপদের স্বরলিপি
ভালোবাসার বাগানে শোভা পায় কুয়াশার ফুল
পলিথিনের বিছানায় শুয়ে আছে ছাদহীন শহর
রাত ঘুমিয়ে পড়ে শূন্যতার বালিশে,
শূন্যতা ডুগডুগি বাজায়
সার্কাসের জোকার সেজে মাতিয়ে রাখি আসর
শহর জুড়ে পড়ে থাকে অসম্পর্কের রোদ বুক পকেটে সাজিয়ে রাখি চৈত্রের দুপুর
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১০
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১০।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
দশ.
মাথায় ঘুরতে লাগলো মাহরির কথাগুলি
গ্রামে একটা হইচই পড়ে গেল। কলকাতা থেকে সরা এসেছে এবার দুর্গা পূজায়। এত সুন্দরী মেয়ে নাকি কেউ আজ পর্যন্ত দেখেনি অথচ সে এই গ্রামেরই মেয়ে। সরা মাল বয়স ষোলো। মা নেই, বাবা দ্বিতীয় পক্ষ বিয়ে করেছে। সৎমার সংসারে তার জায়গা হয়নি বলেই কলকাতায় বাবুদের বাড়িতে ঝি’র কাজ করতো। গ্রামে এসে দিদির বাড়িতে উঠেছে। এই দুর্গাপূজার কয়েকটা দিন থেকেই আবার সে চলে যাবে কলকাতায়। মুখে মুখে চারিদিকেই খবরটা রটে গেল। অনেকেই সরার দিদির বাড়িতে আনাগোনাও শুরু করে দিল।
শহরের আবহাওয়ায় খাওয়া পরার যেমন অভাব ছিল না তেমনি যত্নআত্তিও ছিল। গায়ে রোদ বৃষ্টি লাগতো না। তাই যেমন ফর্সা ধবধবে হয়েছে, তেমনি মাথার কোঁকড়া চুলগুলিও নায়িকাদের মতো সাপের ফণা হয়ে ঝুলে নেমেছে গালের দু’পাশে। একবার দেখলে বারবার চেয়ে দেখতে ইচ্ছে করবে। অথচ এই মেয়েই গ্রামে থাকলে মাঠে-ঘাটে গোবর কুড়িয়ে গরু চরিয়ে ক্ষেতের কাজকর্ম করে মলিন বর্ণ ধারণ করতো। গ্রামে যুবকরা তাকে কলকাতার রসগোল্লার মতোই ভাবতে লাগলো।
হঠাৎ পথের মাঝেই দেখা হয়ে গেল নিউ ক্লাবের সদস্য মাহরির সঙ্গে। মাহরি এই গ্রামেরই এক মাস্টার মশায়ের ছেলে। কিন্তু পড়াশোনায় খুব বেশি দূর আগাতে পারেনি। নিউ ক্লাবটি সংগঠিত করে তখন আমরা রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত প্রমুখ কবি-লেখকদের জন্মদিন যেমন পালন করি, তেমনি নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়েও মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করি। এমনকি গ্রামের ছোটখাটো বিচার-আচারের কাজেও আমাদের অংশগ্রহণ থাকে। সেই সূত্রেই মাহরির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ।
—মাহরি, এদিকে কোথায় গিয়েছিলিস?
—ওই যে নরাদের বাড়ি, নরা আমাদের বাড়ির কাজ করে। আজ কাজে আসেনি তাই ডাকতে গেছিলাম।
—তা এতটা বেলায়?
আর বলিস না, নরার বোন এসেছে কলকাতা থেকে। ওর সঙ্গে গল্প করতে একটু দেরি হয়ে গেল।
—নরা মানে তো নরানি মাল! তা নরার কত নম্বর বোন এটা? আমরা তো দেখিনি কখনো?
—আসলে ওতো এখানে থাকেইনি ছোট থেকেই কলকাতায় ছিল। আবার কলকাতা চলে যাবে, তাই নিষেধ করছিলাম।
— কেন, নিষেধ করছিলিস কেন?
—ওই বলছিলাম কি, নরা যদি কাজে না আসিস তো সরাই যাবে কাল থেকে। কলকাতা যেতে হবে না আমাদের বাড়িতেই কাজ করবে।
—তা খুব ভালো প্রস্তাব, তবে মেয়েটির বিয়ে-থা হয়নি তো?
—না না, ওর বিয়ের ব্যবস্থা আমরাই করে দেবো, নরাকে সে কথা বলে এসেছি।
—আজকে ক্লাবের একটা জরুরি মিটিং আছে, আমাদের একবার বসতে হবে সন্ধে সাতটা নাগাদ। অবশ্যই আসবি।
সরার কথা আমি কিছুটা শুনলেও তার রূপ যৌবন নিয়ে কোনো কথাই আর বললাম না মাহরিকে। মাহরি সম্পর্কে আমাদের একটু তির্যক দৃষ্টিও আছে। বেশ কয়েকবার সে কয়েকজন মেয়ের পেছনে পেছনে ঘুরেছে। এতে কিছু কেলেঙ্কারিও কম হয়নি। নরার বাড়ি গিয়ে সে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে চেয়েছে তাও আমাদের জানা দরকার। গ্রামের মাল-ডোমদের মেয়েরা সামান্য টাকাতেই পরপুরুষের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও তা হবে না কে জানে।
নিউ ক্লাবের সভাপতি দুর্জয় মণ্ডল। সেদিন ক্লাবে কতকগুলি কঠিন সিদ্ধান্তের কথা আমাদের জানালেন। শুধু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনাই নয়, অন্যায় বা অসঙ্গতির বিচার আচারও করা যাবে এই ক্লাবে। বিচারপ্রার্থী আবেদন করলে তার ভিত্তিতে তদন্ত করে সব কিছুর সমাধান করা হবে। গ্রামে যাতে সুস্থতা ও শান্তি বজায় থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। ইতিমধ্যে কার গরুতে কার জমির ধান খেয়েছে, কে কার পুকুরের মাছ ধরেছে, কে কার গাছের পাতা ভেঙেছে, কে কার চালের লাউ চুরি করেছে, কে কার বউয়ের মাটির কলসিতে ঢিল ছুঁড়ে কলসি ভেঙেছে এসব কিছুর সমাধান আমরা করে ফেলেছি। সামান্য কিছু জরিমানা করে, কান ধরে উঠবস করিয়ে তবে ছেড়েছি। দরকার হলে আমরা থানা পুলিশেও যেতে প্রস্তুত। এইসব আইন রেজুলেশনে লেখাও হলো। সুতরাং আমাদের নিউক্লাব যে জবরদস্ত একটি শক্তিশালী ক্লাব তা বলাই বাহুল্য।
বাড়ি ফিরে এসে কিছুটা স্বস্তি বোধ করতে লাগলাম এই ভেবে যে, আর কিছু হোক বা না হোক গ্রামের মানুষ এবার সুবিচার পাবে। সহজে অন্যায় কিছুই ঘটবে না। এমনি করে বেশ কিছুদিন কাটতে লাগলো। টিউশনি পড়িয়ে গাতানের বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেও আর ভয় পেতাম না। কারণ জোর করে আর অন্যায় কিছু করতে পারবে না এটাই ভরসা ছিল। ক্লাবের কাজকর্মেও গ্রামের মানুষ খুশি। পরের জমির আখ ভেঙে খাওয়াও অনেকটা কমে গেছে। পুকুরে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে গেলেও পুকুর মালিকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়াতে মনোযোগী হয়েছে। সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় শহর থেকে নামকরা অধ্যাপক- অধ্যাপিকাদের নিয়ে এসে তাঁদের হাত দিয়ে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়। সারা বছর ধরেই চলতে থাকে তার প্রস্তুতি। লোকে বলতে লাগলো— দুর্জয় বাবু কিছু ভালো কাজ করে দেখালেন। গ্রাম এখন শান্ত।
আমাদের অনার্সের পরীক্ষা তখন শেষ হয়ে গেছে। পরীক্ষার সিট পড়েছিল সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজে। বেশ কিছুদিন থাকতে হয়েছিল এক সহপাঠীর ভাড়া নেওয়া ঘরে। গ্রাম থেকে সিউড়ির দূরত্ব প্রায় সত্তর কিমি। প্রতিদিন এতটা পথ অতিক্রম করা যেমন ব্যয়বহুল, তেমনি সময় সাপেক্ষ। সুতরাং কোনো রকমভাবে এখানে থেকেই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। তারপরে বেশ কিছুদিন বাড়ি ছাড়াও ছিলাম। ঈদের মতো উৎসবেও বাড়ি আসতে পারিনি। রুমার দেওয়া নোটসগুলি পড়ে পড়ে কিছুটা আয়ত্ত করেছিলাম। বাকিটা ওই সহপাঠী বন্ধুর পড়া শুনে শুনেই মনে রাখতে পেরেছিলাম। পরীক্ষা যে খুব ভালো হয়েছিল তাও নয়। তবে রুমাও ভালো পরীক্ষা দিতে পারেনি। পরীক্ষা শেষ হলে অনেকটা নির্ভার মনে বাড়ি ফিরেছিলাম। মেজাজটাও ছিল ফুরফুরে।
বহুদিন পর সন্ধেবেলায় ক্লাবে এসে উপস্থিত হলাম। দেখি অন্ধকার ঘরের এক কোণে বসে আছে মাহরি। মাহরি ফাঁকা ক্লাবে একা কেন বসে আছে দেখে অবাকই হলাম। অনেক সময় ওকে ডেকেও পাওয়া যায় না, তাহলে কি আত্মগোপন করতে চাইছে?
—কী ব্যাপার মাহরি? অন্ধকারে একা একা!
—আর বলিস না! একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তায় পড়েছি। কী করা যায় তাই ভাবছি।
—এ বিষয়ে আমাকে বলা যাবে না?
—একটু সাহায্য চাই ভাই আমাকে বাঁচাতে হবে!
—কী বিষয়ে সাহায্য, আগে ব্যাপারটা তো শুনি!
—তাহলে বলি শোন। জানিস তো আমাদের বাড়িতে নরা দীর্ঘদিন ঝি’র কাজ করে। তোর সঙ্গে যেদিন রাস্তায় দেখা হলো সেদিন ওর বাড়িতেই গিয়েছিলাম।
—হ্যাঁ সেতো তুই সেদিনই আমাকে বলেছিস।
—যেটা বলছিলাম, আমি কিন্তু নিজে থেকে যাইনি। নরা আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। ওর ঘরে গিয়ে দেখি সরা আলুথালু বেশে বসে আছে। কী রূপ মেয়েটার! ওকে দেখেই বুকে আগুন জ্বলে গেল! দু’কূল প্লাবিত করা নদীর মতোই টলটল করছিল যৌবন। বুকের দুই চূড়া থেকে ঠিকরে পড়ছিল কোনো অলৌকিক আলো। সত্যি বলছি দেখে আর চোখ ফেরাতে পারিনি। নরা বললো, ‘যা, ঘরে যা, তোর জন্যই ওকে কলকাতা থেকে এনে রেখেছি। তোর হাতেই ওকে তুলে দিলাম।’ সেদিন বললে বিশ্বাস করবি না, আমি আর ধৈর্য ধরতে পারিনি। ঘরে সরাকে নিয়ে ঢুকলেই নরা বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছিল। তালা খুলেছিল ঘন্টা তিনেক পর। ওই তিন ঘন্টা ধরে আমি যেন কোনো স্বর্গীয় স্রোতে ভেসেছিলাম। পৃথিবীর যাবতীয় সুখ আমার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। শুধু মনে হয়েছিল সারাজীবন ধরে এই মেয়েটিকেই কাছে রাখবো। এমন তার শরীরী গঠন! এমন তার বিভঙ্গ তরঙ্গময় জানুজঙ্ঘা! এমন তার পর্বত চূড়া ও গোপন হ্রদ! এমন তার স্নিগ্ধ শিহরনময় তৃষ্ণাকাতর ঠোঁট! এসব কিছু পেয়েই আমি সব নীতি-নৈতিকতা ভুলে গিয়েছিলাম এক নিমেষে। নিজেকে দেবদূত বলে মনে হয়েছিল। এবং সেই যে তৃষ্ণা মেটানো শুরু হলো আজ দুই বছরে কখনো তার ছেদ পড়েনি। ইতিমধ্যে দুবার গর্ভপাত করিয়েছি। মেয়েটি বারবার জোর করেছে বিয়ের জন্য। তার দিদি যে বিয়ের জন্যই আমার হাতে তুলে দিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু একটা নিচু জাতের মেয়েকে আমার সমাজ, আমার পরিবার কেহই মেনে নেবে না। তাই কোনো মতেই এ বিয়ে করতে পারবো না। শুনেছি মেয়েটি ক্লাবে আবেদন করবে আমার সঙ্গে বিয়ের জন্যই। আর এখানেই আমার মিনতি, আমাকে রক্ষা করতে হবে।
—এত বড় অন্যায় করে, একজনের সর্বনাশ করে, সব সুখ চরিতার্থ করে তুই এবার অব্যাহতি চাস? কোন বিচারক আছে যে তোর স্বপক্ষে কথা বলবে? আমি তো পারবো না, দরকার হলে থানা পুলিশে যাব এবং এই বিয়ে করিয়েই ছাড়বো!
—তাহলে তো আমাকে অন্য পথ অবলম্বন করতে হবে। ভেবেছিলাম তোদের সাহায্য পাবো, কিন্তু তা যদি না পাই, তাহলে আমাকে বাঁচার পথ খুঁজতেই হবে।
—আমি দুর্জয় বাবুকে জানাবো সব আজকেই। তুই তো সব নিজের মুখে স্বীকার করলি, তারপরও নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে চাস? মনে রাখিস আমরা অন্যায়কে সাপোর্ট করার জন্য এই ক্লাব করিনি।
এই কথা শেষ হতে না হতেই মাহরি দ্রুত ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেল। তখন চারিদিকে আঁধার নেমে এসেছে। কোথায় সে হারিয়ে গেল আর খুঁজে পেলাম না। সেদিন ক্লাবে আর কেহই উপস্থিত হলো না। আমিও ভয়চকিত হরিণের মতো এদিক-ওদিক করতে করতে বাড়ি ফিরে এলাম। মাথায় ঘুরতে লাগলো মাহরির কথাগুলি। পুতুলের মতো লাল টুকটুকে সরার মুখটিও ভেসে উঠলো বারবার। সে যেন করুণ আবেদন করে চলেছে— ‘আমার অধিকার ফিরিয়ে দিন! আমি সুবিচার চাই!’ (চলবে)🍁
🍂ফিরে পড়া | কবিতা
সমর সেন
বিস্মৃতি
ভুলে যাওয়া গন্ধের মতো
কখনো তোমাকে মনে পড়ে।
হাওয়ার ঝলকে কখনো আসে কৃষ্ণচূড়ার উদ্ধত আভাস।
আর মেঘের কঠিন রেখায়
আকাশের দীর্ঘশ্বাস লাগে।
হলুদ রঙের চাঁদ রক্তে ম্লান হ’লো,
তাই আজ পৃথিবীতে স্তব্ধতা এলো,
বৃষ্টির আগে শব্ দহীন গাছে যে-কোমল, সবুজ স্তব্ধতা আসে।
অমিতাভ দাশগুপ্ত
এসো স্পর্শ করো
এসো।
ছোঁও।
সম্পূর্ণ পাথর হয়ে গেছি কিনা, দ্যাখো।
পাথরের বুক থেকে মাংস নাও,
পাঁজরের রিডে রিডে চাপ দাও দশটি আঙুলে,
আমাকে বাজাও তুমি
বিঠোফেন-বালিকার হাত,
বলো—
আমি প্রত্ন নই,
নই অন্ধ, জমাট খনিজ,
বলো—সব শেষ নয়,
এখনও আমার কিছু সম্ভাবনা আছে।
টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
মেটেনি কুসুম।
ভুল চাওয়া নিয়ে গেছে ভুল সিন্ধু পারে।
সেখানে মুখোশ, পরচুলো
বালির সাদায় ওড়ে দূরতম হাসির মতন,
গাঢ় শোচনার রঙে সন্ধ্যা নামে,
ডেকে ওঠে হাড়গিলে, অসুখী শকুন—
টিলার ওপরে হা হা সূর্যাস্ত দেখার সাধ
মেটেনি কুসুম।
দ্যাখো,
কতখানি দীন হয়ে গেছি আশায় আশায়
কত বেশি পেতে চেয়ে
নিজেকে ভেঙেছি অন্ধ, ভ্রুক্ষেপবিহীন,
ছেঁড়া শিমুলের আঁশে উড়িয়েছি সর্বস্ব আমার,
‘দাও’ ‘দাও’ হাহাকারে
কখন উঠেছে জেগে বৈজুনাথ—প্রধান চণ্ডাল;
সুনীলে পাতালে
এখন যে দিকে চাও
ব্যথিত প্রশ্নের হাড়, করোটি, কংকাল!
মকরবাহিনী-জলে
পোশাক ভাসিয়ে আজ এসে দাঁড়িয়েছি—
স্পর্শ করো,
অগ্নিতে সঁপেছি স্বাহা, অহংকার,
রাখো, ভাঙো মারো,
তুলনামূলক প্রেমে সারারাত জেগে থাক
আমাদের কাঠ ও করাত,
আমাকে বাজাও তুমি
বিঠোফেন-বালিকার হাত।
ভাস্কর চক্রবর্তী
উৎকণ্ঠা
সময় সামান্য আর আধোঘুমে কী তুমি বকছ?
অবশ্য কী আর আছে বলবার
রাত তিনটের আগে কেন যেন বিছানা ডাকে না
ঘুম, এপিকের মতো, বিদায় নিয়েছে।
আত্মহত্যাপ্রবণতা ছুঁয়ে বসে আছেন সভ্যতা।
রাত্রিবেলা সল্টলেকে মোটোরগাড়িটা
ঘুরছে তো ঘুরেই চলেছে
জামার বোতাম খুলে লম্বা ঘুমে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েগুলো।
দেশের অর্ধেক লোক চিন্তাবিদ
চোখ বুজে সে যে এক কী আবেগে বক্তৃতা দিচ্ছেন!
সন্তোষ, বিস্মিত হয়ে ফুটপাতে কী দেখছ দাঁড়িয়ে
বাড়ি যাও
কোথাকার জল গিয়ে কোথায় দাঁড়াল,লিখে রাখো–
চশমার ফাঁক দিয়ে পৃথিবীটা দেখে নিয়ে ওরা
স্বর্গের সিঁড়িতে সব পা ঠেকিয়ে ওপরে উঠছেন।
উৎপলকুমার বসু
নবধারাজলে ১
মন মানে না বৃষ্টি হল এত
সমস্ত রাত ডুবো নদীর পাড়ে
আমি তোমার স্বপ্নে-পাওয়া আঙুল
স্পর্শ করি জলের অধিকারে।
এখন এক ঢেউ দোলানো ফুলে
ভাবনাহীন বৃত্ত ঘিরে রাখে–
স্রোতের মতো স্রোতস্বিনী তুমি
যা-কিছু টানো প্রবল দুর্বিপাকে
তাদের জয় শঙ্কাহীন এত,
মন মানে না সহজ কোনো জলে
চিরদিনের নদী চলুক, পাখি।
একটি নৌকো পারাপারের ছলে
স্পর্শ করে অন্য নানা ফুল,
অন্য দেশ, অন্য কোনো রাজার,
তোমার গ্রামে রেলব্রিজের তলে
ভোরবেলার রৌদ্রে বসে বাজার।
আবিদ আজাদ
আমার অপেক্ষা
তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব
যেমন শীতে শুকনো গাছের জীর্ণশাখা
বসন্তের জন্য অপেক্ষা করে
তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব
যেমন ধু-ধু চর-পড়া তৃষ্ণার্ত গলা নিয়ে বাংলাদেশের
নদীনালা
উজানের পানির জন্য অপেক্ষা করে
তোমার জন্য আমি অপেক্ষা করব।
যেমন বারুদ, রক্ত ও মৃত্যুর মধ্যে মুক্তিকামী
একেকটি দেশ
স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষা করে।
🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১০
১৯৩৮ সালে শহীদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছাত্রদল শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, তাঁদের দলে হাই সাহেব ছিলেন অন্যতম। কবিকে নিয়ে শ্যামলীর সামনে একটি গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছিল। সেই ফটোটি হাই সাহেবের পড়ার ঘরে যত্নের সঙ্গে রাখা থাকত। এই মূল্যবান আলোকচিত্রটি রবীন্দ্র শতবার্ষিকী বছরের ‘সাহিত্য পত্রিকা’র ১৩৬৮ বর্ষা সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন এবং ওই সংখ্যাতেই “ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাষাতত্ত্বের বিচার বিস্তৃতভাবে করেছিলেন। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১০।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
সরকার ও তার তাঁবেদার অধ্যাপকগণ তাঁর ওপর খুশি ছিলেন না। বহু ঝড় ঝঞ্ঝা তাঁর মাথার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, বাংলা বিভাগকে গড়ে তুলতে গিয়ে হতে হয়েছে বহুবার বিপদের সম্মুখীন। কিন্তু তাঁর জীবনমন্ত্র রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বাঁধা, রবীন্দ্রনাথের কাছেই যেন তিনি দীক্ষা লাভ করেছিলেন…
‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
নিষ্কম্প দীপশিখার মতো তাঁর সারাটিজীবন আপন আদর্শের দিকে এমনি করে ঊর্ধ্বায়িত ছিল।
ছাত্রজীবনে তিনি রবীন্দ্র নাটকে অংশগ্রহণ করেছেন। এবং অধ্যাপক জীবনে রবীন্দ্র পঠনে-পাঠনে সেই আসক্তি বহুগুণে বেড়ে গিয়ে তাঁর জীবনের অংশে পরিণত হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব পড়ালেও রবীন্দ্র সাহিত্যের একটি ক্লাস প্রফেসর হাই নিতেন। রবীন্দ্রকাব্য তিনি কেমন তন্ময়ভাবে পড়াতেন তার একটি বর্ণনা দিয়েছেন তাঁরই ছাত্র হুমায়ুন আজাদ। বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন : “আমরা যারা তাঁর কাছে রবীন্দ্র কবিতা পড়েছি তারা জানি কী বিশ্বাস, বোধ এবং স্বাদের সঙ্গে তিনি আবৃত্তি করতেন। তিনি একেকটি কবিতা প্রথমাক্ষর থেকে শেষাক্ষর পর্যন্ত আবেগমগ্ন হয়ে আবৃত্তি করতেন। বলতেন, এর আর কী ব্যাখ্যা আছে, না একে ব্যাখ্যা করা যায়। বলতেন, আমরা আজকাল কবিতা পড়ি, আবৃত্তি করি না। তিনি আবৃত্তি করতে চাইতেন, করতেনও। একদিনের কথা বলি, চারিদিকে প্রবল বর্ষণ, তিনি পড়াচ্ছেন। শেষ ঘণ্টা বেজে গেছে। আমরা উঠি উঠি করছি। তিনি নিজস্ব হাসিটি হেসে বললেন, বাইরে বর্ষা, ভেতরে রবীন্দ্রনাথ, যাবে কোথায়?” (জার্নাল, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ জুন ১৯৬৯)।
ছাত্রজীবনে ১৯৩৮ সালে শহীদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে ছাত্রদল শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন, তাঁদের দলে হাই সাহেব ছিলেন অন্যতম। কবিকে নিয়ে শ্যামলীর সামনে একটি গ্রুপ ফটো তোলা হয়েছিল। সেই ফটোটি হাই সাহেবের পড়ার ঘরে যত্নের সঙ্গে রাখা থাকত। এই মূল্যবান আলোকচিত্রটি রবীন্দ্র শতবার্ষিকী বছরের ‘সাহিত্য পত্রিকা’র ১৩৬৮ বর্ষা সংখ্যায় প্রকাশ করেছিলেন এবং ওই সংখ্যাতেই “ভাষাতাত্ত্বিক রবীন্দ্রনাথ” শীর্ষক একটি প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথের ভাষাতত্ত্বের বিচার বিস্তৃতভাবে করেছিলেন। ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রও যে রবীন্দ্রনাথের হাতে সমৃদ্ধ হয়েছে, সে বিষয়টিকে তিনি সুন্দরভাবে তুলে ধরেছিলেন তাঁর এই প্রবন্ধে। হাই সাহেবের আলোচনাটি শতবার্ষিকী বৎসরের একটি শ্রেষ্ঠ আলোচনা হিসেবে গণ্য হয়েছিল এবং বিভিন্ন সংকলন গ্রন্থে ওই আলোচনাটি মুদ্রিত হয়েছে। তিনি আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ ভাষাবিজ্ঞানী না হয়েও যেভাবে বর্ণনাত্মক ভাষাবিজ্ঞানের বিচার বিশ্লেষণ করেছেন, সেটি ভাষাবিজ্ঞানে পারদর্শী বিশেষজ্ঞকেও ভাবিয়ে তোলে। তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘শব্দতত্ত্ব’ ও ‘বাংলা ভাষা পরিচয়’ বই দুটিকে অবিস্মরণীয় বলে উল্লেখ করেছেন। এই বই দুটির বিস্তৃত আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছেন যে অধুনা বাংলা ভাষায় যাঁরা ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তাঁদের আলোচনা পদ্ধতি আধুনিককালে পরিত্যক্ত হয়েছে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আলোচনা পদ্ধতি আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ভাষাতত্ত্ব আলোচনার কাছাকাছি। কবি কৃত আলোচনার ধারা তাঁর সময়কালে তেমন কেউই অনুসরণ করেননি। পরবর্তী সময়ে প্রফেসর আব্দুল হাই সাহেব কবির ধারাতেই কাজ করেছেন, কারণ সে ধারা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ধারায় পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত। (চলবে)
🍁অঙ্কন : প্রীতি দেব ও অন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
🍁সম্পাদকীয় ঋণ : সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে, মহামিলনের কথা, ফিরেপড়া বিভাগের গল্প ও কবিতা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।
