



আদিম আমেরিকান ইন্ডিয়ান জনগোষ্ঠী ‘মায়া’ হল ‘মেসোআমেরিকা’র আদিবাসীদের একটি জাতিভাষাগত গোষ্ঠী। উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ ভাগ এবং বেশিরভাগ মধ্য আমেরিকার একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল এবং সাংস্কৃতিক এলাকা ‘মেসোআমেরিকা’ নামে পরিচিত। প্রাচীন ‘মায়া’ লোকসংস্কৃতিতে জাগুয়ারকে বলা হত ‘জঙ্গলের রাজা’। রাজার মতোই ছিল তার হাবভাব! রাজার মতোই ছিল তার চালচলন! সেই জাগুয়ার আর বুদ্ধিমান হরিণকে নিয়ে ‘মায়া’দের মধ্যে একটি সুন্দর উপকথা প্রচলিত আছে। লিখলেন : রাখী নাথ কর্মকার
জাগুয়ার আর হরিণের গল্প
[মধ্য আমেরিকার মায়া আমেরিকান ইন্ডিয়ান উপকথা ]
একদিন এক জাগুয়ার জঙ্গলের মধ্যে নিজের একটা বাড়ি তৈরি করবে বলে মনোমতো জায়গা খুঁজতে শুরু বেরোল। এদিকে হয়েছে কী, ঠিক সেই সময়েই এক হরিণও তার নিজের ঘর বানানোর জায়গা খুঁজতে শুরু করেছিল। জঙ্গলের মাঝে বিশাল বিশাল ওক গাছের তলায় একটা জায়গা হরিণের বেশ পছন্দ হল। ওদিকে জাগুয়ারও খুঁজতে খুঁজতে এসে হরিণ যে জায়গাটা বেছে নিয়েছিল সেখানেই এসে পৌঁছল এবং সেই জায়গাটা তারও ভারি ভাল লেগে গেল। জাগুয়ারও স্থির করল, সেখানেই সে তার বাড়ি তৈরি করবে।
পরের দিন সকালে সূর্য উঠতে না উঠতেই হরিণ এসে তার শিং দিয়ে জায়গাটা পরিষ্কার করে এল। আর জাগুয়ার একটু বেলা হতে রাজকীয় চালে হেলতে দুলতে সেখানে এসে দেখল, সে আসার আগেই জায়গাটা কেউ পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। সে মনে মনে বলল-“কেউ নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করছে।” তারপর জাগুয়ার সেই মাটিতে কয়েকটা বড় খুঁটি আটকে কাঠামো স্থাপন করে এল।
_____________________________________________
সেই রাতে হরিণ যেমন জাগুয়ারের শিকারের কথা মনে করে ঘুমাতে পারছিল না; জাগুয়ারও হরিণের শিকারের কথা ভেবে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। দু’জনেই মনে মনে প্রচন্ড খুব ভয় পেয়ে গেছিল।
_____________________________________________
পরের দিন আবার ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই হরিণ ফিরে এল এবং এসে যখন সে কাঠামোটা দেখল, সে বলল – “মনে হয় কেউ আমাকে সাহায্য করছে।” তারপর হরিণ কাঠামোর ওপর ডালপালা দিয়ে ঢেকে সুন্দর একখানি চালা বানাল আর দুটো ঘর তৈরি করে ফেলল। একটি তার জন্য এবং অন্যটি যে তাকে সাহায্য করছে তার জন্য।
এদিকে সেদিন জাগুয়ার বেলার দিকে হেলতে-দুলতে এসে দেখল ঘরের কাজ সব শেষ। সে নিশ্চিন্তে শিকারটিকার করে, খাওয়াদাওয়া শেষ করে সন্ধে হতেই দুটো ঘরের একটা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে হরিণ এসে অন্য ঘরে ঘুমোতে গিয়েই দেখল পাশের ঘরে এক বড়সড় প্রাণী শুয়ে রয়েছে।
জাগুয়ার হরিণকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, “তুমিই কি আমায় বাড়ি বানানোর কাজে সাহায্য করছিলে?”
হরিণ উত্তর দিল, “হ্যাঁ, আমিই ছিলাম।”
তা শুনে জাগুয়ার বলল, “বেশ তো, চল আমরা একসাথে থাকি!”
“হ্যাঁ, সেই ভাল। চল আমরা একই বাড়িতে একসাথে থাকি।” হরিণ সঙ্গে সঙ্গে রাজী হয়ে গেল। এদিকে রাত হয়ে গিয়েছিল। তারা দুজনেই যে যার ঘরে ঘুমাতে চলে গেল।
পরের দিন সকাল হতে জাগুয়ার হরিণকে ডেকে বলল, “আমি শিকারে যাচ্ছি, তুমি সেই ফাঁকে ঘরের মেঝে ঝাঁট-টাট দাও, নদী থেকে পারলে জল-টল তুলে এনে রাখো। কারণ ফিরে এলেই আমার বেদম জোর খিদে পেয়ে যাবে!”
এই বলে জাগুয়ার শিকার করতে জঙ্গলে চলে গেল। সেদিন সে একটা খুব বড় হরিণ শিকার করেছিল। জাগুয়ার সেটাকে বাড়িতে নিয়ে এসে তার সঙ্গীকে ডেকে বলল, “চল, যা শিকার করে এনেছি, আমরা দুজনে ভাগ করে তা খাই।” কিন্তু হরিণ তো জাগুয়ারের শিকার দেখেই বেজায় ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ না করে বলল-“আজ আমার পেট ভর্তি, ভাই। তুমি খেয়ে নাও। আমি আজ আর কিছু খেতে পারব না।”
হরিণ আসলে সেই মুহূর্তে এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে সে সারাটা রাত ঘুমোতেই পারল না।
পরের দিন খুব ভোরে হরিণ জঙ্গলে গিয়ে জঙ্গলের অন্য প্রান্তে যে বড় জাগুয়ার থাকত, তার সঙ্গে দেখা করল। তারপর সে একটা রগচটা, দশাশই ষাঁড়ের কাছে গিয়ে বলল –“জানো, আজকেই আমার সঙ্গে একটা জাগুয়ারের সাথে দেখা হল, যে তোমার নামে অপমানজনক কথা বলছিল!”
ষাঁড় তো ভয়ানক ক্ষেপে গিয়ে সেই জাগুয়ারের কাছে গিয়েই কোনো কথা না বলে তার পেটে নিজের বিশাল শিংদুটো ঢুকিয়ে তাকে মেরে ফেলল।
হরিণ তো এই মুহূর্তের অপেক্ষাতেই ছিল। একটু পরে সে মৃত জাগুয়ারটাকে টানতে টানতে বাড়ি ফিরল। তারপর সে তার সঙ্গী জাগুয়ারকে ডেকে বলল -“এসো, আজ আমি যা ধরেছি তা দুজনে মিলে ভাগ করে তা খাই।”
জাগুয়ারের তো হরিণের শিকার দেখে চক্ষু চড়ক গাছ! জাগুয়ার ঘাবড়ে গিয়ে বলল- “আজ আমার পেট ভর্তি আছে। তুমি বরঞ্চ খেয়ে নাও!” বলে পাশের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
সেই রাতে হরিণ যেমন জাগুয়ারের শিকারের কথা মনে করে ঘুমাতে পারছিল না; জাগুয়ারও হরিণের শিকারের কথা ভেবে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। দু’জনেই মনে মনে প্রচন্ড খুব ভয় পেয়ে গেছিল।
দু’জনে ভিতরে ভিতরে এতটাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, যে ভোররাতে ঘুমের ঘোরে হরিণের মাথার শিংগুলো বাড়ির কাঠের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে এক ভয়ঙ্কর শব্দের সৃষ্টি করতেই…বাপরে! সেই ভীতিজনক শব্দ শুনে জাগুয়ার ও হরিণ দু’জনেই লাফিয়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে এল!
তারপর দু’জনেই দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে ছুট দিল যেদিকে দুচোখ যায়!
তারপর থেকেই নাকি হরিণ এবং জাগুয়ার কেউ কারোর ছায়া মাড়াত না!
-প্রতীকী চিত্র
আরও পড়ুন : Athoi Movie Review : মানুষের অনুভূতিগুলি একই রয়ে গিয়েছে
