



গৃহস্থ বাঙালির খুব আদরের এবং পরম ভরসার জায়গা এইসব পঞ্জিকা, যাকে গোদা বাংলায় আমরা অনেকেই পাঁজি বলে থাকি। লিখেছেন : পিনাকী চৌধুরী
নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত সাদা মেঘের ভেলা, অনাদরে অবহেলায় পড়ে থাকা শিউলি ফুলের সুবাস, ভোরের নরম আলো, আন্দোলিত কাশফুল, এসবই যেন জানান দিচ্ছে দেবী দুর্গার আগমনীবার্তা! আর ঠিক তখনই উৎসবপ্রিয় বাঙালি অধীর আগ্রহে জানতে চায় এই ১৪৩১ বঙ্গাব্দে (২০২৪ সাল) দুর্গা পুজোর নির্ঘণ্ট এবং মহাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করবার সময়, সন্ধিপুজোর সঠিক সময় ইত্যাদি। তাহলে উপায়? হাতের কাছে পঞ্জিকা রয়েছে তো! এছাড়াও আজ প্রায় প্রতিটি বাঙালির ঘরে ঘরে রমণীরা প্রত্যহ একবার অন্তত চোখ বুলিয়ে নেন পঞ্জিকায়। আসলে গৃহস্থ বাঙালির খুব আদরের এবং পরম ভরসার জায়গা এইসব পঞ্জিকা, যাকে গোদা বাংলায় আমরা অনেকেই পাঁজি বলে থাকি। এ যেন ঠিক সব পেয়েছির দেশ। এইসব পঞ্জিকায় ব্যক্তিগত রাশিফল, লগ্নফল, অমাবস্যা, পূর্ণিমার দিনক্ষণ, গঙ্গায় জোয়ার ভাটা ইত্যাদির বিবরণ তুলে ধরা হয়। এছাড়াও শারদীয়া দুর্গোৎসব, কার্তিক অমাবস্যায় কালীপুজো, ভাতৃদ্বিতীয়া ইত্যাদির যথাযথ বিবরণ আমরা পাই। শুধু কি তাই? আমাদের হিন্দু ধর্মের প্রায় প্রতিটি পুজোর সঠিক মন্ত্র পঞ্জিকায় বর্ণিত হয়। আরও আছে, মৃতদেহ সৎকারের পদ্ধতি এখানে পাতা ওল্টালেই দৃশ্যমান হয়। বস্তুতঃ পঞ্জিকা ছাড়া বাঙালির যাপিত জীবন অসম্পূর্ণ।

আসলে এইসব পঞ্জিকা হল হিন্দু ধর্মের প্রথাগতভাবে ব্যবহৃত চান্দ্র নক্ষত্র পঞ্জিকা সমূহের সমষ্টিগতভাবে এক বিশেষ নাম। প্রত্যেক পুরোহিত এইসব পঞ্জিকা অনুসরণ করেন। এখানে বলে রাখা ভাল, এইসব বেশিরভাগ পঞ্জিকাই কিন্তু পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকের, মানে গুপ্তযুগের বরাহমিহির এবং আর্যভট্টের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যার ফসল। কিন্তু প্রথম কবে চালু হয়েছিল হিন্দু পঞ্জিকা? সম্ভবত বৈদিক যুগে প্রথম শুরু হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের পঞ্জিকা। তবে হিন্দু পঞ্জিকার গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায় সূর্য সিদ্ধান্ত নামক সেই বিখ্যাত গ্রন্থ থেকে। এখানে উল্লেখ্য, সুপ্রাচীন বৈদিক যুগে কিন্তু বছরের শুরুটা হত অগ্রহায়ণ মাসে ( অগ্র = প্রথম + অয়ন = সূর্যের গতি)। এই অগ্রহায়ণ মাসে সূর্য বিষুবরেখাকে অতিক্রম করে। যদিও পরবর্তী সময়ে কিছু পঞ্জিকা বৈশাখ মাসকে নতুন বছরের আরম্ভ মেনে নিতে বাধ্য হয়, যেটা কিনা বর্তমানে প্রচলিত।
১৯৫৭ সালে এই হিন্দু পঞ্জিকার ওপর ভিত্তি করেই ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জি শক সংবৎ গঠিত হয়। আক্ষরিক অর্থেই যেন এক নতুন অধ্যায় রচিত হয়। বর্তমানে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাটি জনপ্রিয়, এছাড়াও গুপ্ত প্রেস পঞ্জিকাও বাজারে রয়েছে। তবে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা ১২৯৭ বঙ্গাব্দে (১৮৯০ খ্রীস্টাব্দ ) বিখ্যাত গণিতঞ্জ মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়। তারপর থেকেই আজ অবধি নিরবচ্ছিন্নভাবে পঞ্জিকাটি প্রকাশিত হয়ে আসছে। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতিটি শাখা এবং মঠ এই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে তাদের যাবতীয় ধর্মীয় উৎসব সম্পন্ন করে। ভারতবর্ষ তখন সদ্য স্বাধীন এক দেশ। ১৯৫২ সালে ভারত সরকার ‘পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি’গঠন করে পঞ্জিকায় সংস্কার সাধন করে নতুন রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ গঠন করে। আশ্চর্যের বিষয় হল, সেই পঞ্জিকার বিজ্ঞান ভিত্তিক গণণার সঙ্গে বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার গণণা হুবহু এক! সময় থেমে থাকেনি, তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল। আজ একবিংশ শতাব্দীর চরম ব্যস্ততার যুগেও হয়ত এইসব পঞ্জিকার চাহিদা রয়েছে বাজারে, কিন্তু কিছুটা হলেও জৌলুস হারিয়েছে পঞ্জিকা। বিভিন্ন জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন আজও রয়েছে, নজর কাড়ে ‘আশ্চর্য আংটি ফ্রি’ নামক বহুল প্রচলিত বিজ্ঞাপন। কিভাবে পছন্দের নারী ও পুরুষকে বশীকরণ করা যায়, তার বিজ্ঞাপনও স্থান পায়। অনেক পৃষ্ঠায় হিন্দু দেবদেবীদের ছবি সম্বলিত উজ্জ্বল উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। এছাড়াও রতিক্রিয়া সম্পর্কিত চটুল বিজ্ঞাপনও সকলের নজর কাড়ে! বিভিন্ন জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন সসম্মানে স্থান পেয়েছে পঞ্জিকায়! এছাড়াও শ্বেতী বা দাগ দূর করবার বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি।
ছবি : সংগৃহীত
