Sasraya News

Tuesday, March 18, 2025

Old Calcutta : পুরনো কলকাতার গঙ্গার ধার

Listen

নাড়াজোলের মহারাজা নরেন্দ্রলাল খাঁ-র কন্যার নামে। তার সাথে বিয়ে হয়েছিল বাগবাজারের হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর পুত্রের। এখন এর পাশে ভাগবত সভা তৈরি হয়েছে (১৯৮৬, ৯ জুলাই উদ্বোধন)। সেখানে প্রমোদাসুন্দরীর একটি আবক্ষ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। এর পরে লঞ্চ ছাড়ার ঘাট ও তার পরে অন্নপূর্ণা ঘাট। বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী এখানে অন্নপূর্ণা বিগ্রহ স্থাপন করে বলে এই নামকরণ। ঘাটের বাঁ পাশে একটা শতাব্দী প্রাচীন বটগাছ আছে, তার জন্য অনেকে বটতলা ঘাটও বলে থাকে। লিখেছেন : বৈদূর্য্য সরকার

 

 

পুরনো কলকাতার গঙ্গার ধার

পমহাদেশে অধিকাংশ নগর গড়ে উঠেছে নদীর পারে। গঙ্গার পারে কলকাতা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী গঙ্গার জল মুখে দিলে মৃতের আত্মা স্বর্গে যায়। পান আহার পুজো থেকে স্নান সবই একটা সময় পর্যন্ত চলতো গঙ্গার জলেই। গঙ্গাযাত্রার প্রথা বা শ্মশানের উপস্থিতিও গঙ্গাকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।
প্রাচীনতম আপজনের ম্যাপে শহরের প্রান্ত হিসেবে ওল্ড পাউডার মিল ও উত্তরের অংশকে দেখানো হয়েছে। গঙ্গার পাশেই চার্লস পেরিনের বাগান। ফার্সিতে বাগানকে বাগ বলে আর সংলগ্ন সুতানুটির সুতোর বাজার… দুয়ে মিলে বাগবাজার। অনেকে বলে থাকেন, গঙ্গার যে বিশাল বাঁকটি দেখা যায় এখানে তার পাশে বসা বাজার থেকে বাঁকবাজার শব্দটি পরে বাগবাজারে রূপান্তরিত হয়েছে। এর পরেই খাল। অনেকের বক্তব্য অনুযায়ী, বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজোর মাঠ থেকে খাল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল পেরিনের বাগান। যেখানে পরে ইংরেজদের বারুদের কারখানা হয়। সেটি গেছিল বর্তমানের হরলাল মিত্র স্ট্রিট পর্যন্ত। লোকশ্রুতি অনুযায়ী, এখানেই ভোলা ময়রার মিষ্টির দোকানটি ছিল। লোকে বলত,
“ময়রা মুদি কলাকার
তিন নিয়ে বাগবাজার”
বাগবাজারের উত্তরে চিৎপুর রোড গঙ্গা যেখানে বেঁকেছে, সেখানে চারফুট চওড়া ও দশফুট উঁচু ইটের সীমান্ত স্তম্ভ তৈরি হয়েছিল। বর্গীদের আক্রমণ রুখতে মারাহাটা ডিচ খোঁড়া শুরু হয়েছিল কাছাকাছি কোনও জায়গা থেকে। সেটি বুজে যাওয়ার পর মারাহাটা ডিচ রাস্তাটার জন্ম হয়েছিল বলে ধরা যায়।

 

 

টালার প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্রের প্রপিতামহের ভাই কাশীশ্বর মিত্র শবদাহের জন্যে এই ঘাট তৈরি করান (১৭৭৪ খ্রিঃ)। তার নামেই কাশী মিত্র ঘাট ও সংলগ্ন রাস্তার নাম। বহু পরে ১৯৯০ খ্রীঃ নাগাদ এখানে ইলেকট্রিক চুল্লী চালু হয়েছে। অনেকে বলে শেষ সতীদাহ নাকি এখানেই হয়েছিল। সেই সূত্রে নাম সতীঘাট।

 

বাগবাজারের প্রান্তের খালটি কাটা হয়েছিল (১৮২৪-১৮৩০ খ্রিঃ) কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট গ্যালিফের সময়।ম্যাজিস্ট্রেটের নাম থেকেই রাস্তার নাম হয় গ্যালিফ স্ট্রিট। ১৮৫৫-এ খালের মুখে বসে স্লুইস গেট। বেশ কিছু পরে ১৯৩৪খ্রিঃ নাগাদ খালটির ওপর তৈরি হয় চিৎপুর ব্রীজ।

 

 

খালের মুখ থেকে খানিক দক্ষিণ দিকে এগোলে দুর্গাচরণ মুখার্জির ঘাট। রাজশাহীর কালেক্টরের দেওয়ান ছিলেন দুর্গাচরণ মুখার্জি। তার বড় ছেলে শিবচন্দ্র কাস্টমস হাউসের দেওয়ান হয়েছিলেন। তার পৃষ্ঠপোষকতাতে গড়ে ওঠে বাগবাজার তথা পুরনো কলকাতার বিখ্যাত পক্ষ্মীর দল। সেই থেকে কলকাতার আকাশে বাগবাজারেরা উড়তে শুরু করে। ভদ্র বাড়ির ছেলেরা বোধহয় সেই প্রথম গাঁজার আড্ডায় বসল। এর আগে গাঁজা ছিল মূলত নিম্নবিত্তদের অবলম্বন।
শিবচন্দ্রের গাঁজার আড্ডার নাম ছিল গোচর্মবিহার। তার তিনটে বিভাগ ছিল। গাঁজা টানার এলেম অনুযায়ী একেক পক্ষ্মীর নামে একেকজনকে চিহ্নিত করা হতো সেই অনুযায়ী তারা ডাকাডাকি করতো। ফরাসডাঙার ধুতি, শান্তিপুরের উড়নি, এলবার্ট চুলের কাট, চোগা চাপকান বুকপকেটে সোনার চেনে ঝোলানো ঘড়ি, আঙুলে দামী আংটি পরা ছেলেরা পক্ষ্মীদলে যোগ দিয়ে হয়ে উঠছে একেকজন গাঁজারু। এখন এটির আশপাশে সারদা মায়ের ঘাট গড়ে উঠেছে। ১৯০৯ খ্রীঃ থেকে সারদা মা এখানেই জীবন কাটিয়েছেন আনাড়ম্বরভাবে। তাঁর বাসগৃহ ছিল ১ নং উদ্বোধন লেন। লোকে বলে, শ্রীমা এখান থেকে খালি পায়ে রাস্তা হেঁটে গঙ্গা স্নানে যেতেন। এই ঘাট থেকে এগোলে রাজার ঘাট। এখানে এখন যাবতীয় প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। আগে রাজা রামকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণের নামে দু’টি আলাদা ঘাট ছিল। পরে সংস্কারের সময় তা মিলে যায়। এর পাশেই বিচালি ঘাট। সুতানুটিতে ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বিচালির ব্যবসা চলত। সেসব গোয়ালাদের অবশ্য এখন শহরের বাইরে বিতাড়িত করা হয়েছে আর কুমোরটুলিতে খড় বোঝাই লরি এসে প্রয়োজন মেটায়। তবে লোকে মুখে ঘেসোপট্টি কথাটা রয়ে গেছে এখনও।

 

 

এর দক্ষিণে রসিক নিয়োগীর ঘাট। তিনি ছিলেন ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা ভুবনমোহন নিয়োগীর বাবা। পুরনো কলকাতার কোনও ঘাটই এই ঘাটের মতো সাজানো ছিল না। ঘাটের ওপরে চাঁদনি ছিল, ছিল হলঘর। নাট্যগুরু অমৃতলাল বসু এলাকার ছেলে ছোকরাদের নিয়ে এখানে নীলদর্পণ নাটকের রিহাসার্ল করে শোনা যায়। এমনকি এখানেই নাকি নাট্যাচার্য গিরিশ বাবুর সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল বিনোদিনী নামের স্টার নটীর। সেই হলঘর এখন অবশ্য বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তার জায়গায় গড়ে উঠেছে লোকনাথ ব্রহ্মচারীর মন্দির।
এর ঠিক পাশে আছে মহিলাদের জন্যে নির্দিষ্ট প্রমোদাসুন্দরীর ঘাট। নাড়াজোলের মহারাজা নরেন্দ্রলাল খাঁ-র কন্যার নামে। তার সাথে বিয়ে হয়েছিল বাগবাজারের হরিশ্চন্দ্র নিয়োগীর পুত্রের। এখন এর পাশে ভাগবত সভা তৈরি হয়েছে (১৯৮৬, ৯ জুলাই উদ্বোধন)। সেখানে প্রমোদাসুন্দরীর একটি আবক্ষ মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়।
এর পরে লঞ্চ ছাড়ার ঘাট ও তার পরে অন্নপূর্ণা ঘাট। বিষ্ণুরাম চক্রবর্তী এখানে অন্নপূর্ণা বিগ্রহ স্থাপন করে বলে এই নামকরণ। ঘাটের বাঁ পাশে একটা শতাব্দী প্রাচীন বটগাছ আছে, তার জন্য অনেকে বটতলা ঘাটও বলে থাকে। প্রসূন বন্দোপাধ্যায়ের উত্তর কোলকাতার কবিতায় উল্লিখিত চিত্রটিকে যেন এখানকার বলেই মনে হয়:
“অতিকাল যাও…
আমার অপর এই গঙ্গাধ্ধারে বটবৃক্ষমূলে দ্যাখো গামছা পেতেছে… বাঁকুড়ার
গোলাপী গামছা… আহা কী শীতল… অতিকাল
যাও… ওকে একটু শুতে দাও বিরক্ত কোরোনা…”

আগে এটির নাম ছিল বনমালী সরকারের ঘাট। তিনি দেওয়ানি করে বহু টাকা ও সম্পত্তি করেছিলেন। অনেকে বলে সরু গলিপথ পেরিয়ে নিবেদিতা গঙ্গাস্নানে আসতেন এখানে।
এখান থেকে গঙ্গার সাথে দক্ষিণমুখে এগোলে কাশীমিত্র ঘাটে এসে পৌঁছানো যাবে। টালার প্রথম বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার নীলমণি মিত্রের প্রপিতামহের ভাই কাশীশ্বর মিত্র শবদাহের জন্যে এই ঘাট তৈরি করান (১৭৭৪ খ্রিঃ)। তার নামেই কাশী মিত্র ঘাট ও সংলগ্ন রাস্তার নাম। বহু পরে ১৯৯০ খ্রীঃ নাগাদ এখানে ইলেকট্রিক চুল্লী চালু হয়েছে। অনেকে বলে শেষ সতীদাহ নাকি এখানেই হয়েছিল। সেই সূত্রে নাম সতীঘাট।

 

 

এর পরের ঘাট কুমোরদের এলাকা। নাম স্বাভাবিকভাবেই কুমোরটুলি ঘাট। পাশের রাস্তা কাশীমিত্র ঘাট লেনে বিখ্যাত ভাস্কর জি পালের স্টুডিও। আলো আঁধারিতে ভরা সরু গলিতে গ্রীল ঘেরা বাড়ির দাওয়ায় বসে থাকা গ্রাম্য বুড়োবুড়ির মূর্তিকে আসল বলে ভুল হয় অনেক পথচলতি মানুষের। কলা সমালোচক কমল সরকার লিখেছিলেন, “গোপেশ্বরের প্রধান গুণ ছিল, অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে যে কোনও মানুষের মাটির মুখাকৃতি রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন”।
১৯২৪ খ্রীঃ লণ্ডনের এক্সিবিশানে নিজের শিল্পকীর্তি প্রদর্শন করে যুবক গোপেশ্বর (১৮২৪-১৯৪৪ খ্রীঃ) তৎকালীন ইংল্যান্ডের রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যদের মুগ্ধ করেন। তার আগে কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতে তার তৈরি কালীমূর্তি দেখে গর্ভন জেনারেল লর্ড বেন্টলি মুগ্ধ হয়েছিলেন ও তারই উদ্যোগে গোপেশ্বর পালের লণ্ডণ যাওয়া সম্ভব হয়েছিল। সেখানে ব্রিটিশ সরকারের আনুকূল্যে ইতালিতে মার্বেল স্কাল্পচার শিক্ষা করে দেশে ফিরে এসে রিয়েলিস্টিক আর্টে মনোনিবেশ করেন।
এককালে কুমোরটুলিতে বাস করতেন ব্ল্যাক জমিদার গোবিন্দরাম মিত্র। চিৎপুরে ১৭৩০-এ তার নির্মিত নবরত্ন মন্দিরটি আজও পুরনো কলকাতার ছবিতে উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ্য করা যায়। বলা ভাল, ওটাই ছিল তখনকার কলকাতার আইকন। ১৭৩৭ খ্রীস্টাব্দের ভয়ানক ঘূর্ণিঝড়ে এটি ক্ষতিগ্রস্থ হলেও এখন অবস্থানটা মোটামুটি বোঝা যায় ওই চেহারার একটি মন্দির দেখে। তার উল্টোদিকেই সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির। একটু দূরেই মদনমোহনতলা। আরও কিছু দূরে ভুবনেশ্বর শিবের আটচল্লিশ মন্দির।
চিৎপুর ধরে এগোতে থাকলে পড়বে নন্দরাম সেন স্ট্রিট। যার প্রবেশপথে নন্দরামের প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন মন্দিরটি এখনও দাঁড়িয়ে আছে কোনওক্রমে।
এগোতে থাকলে শহরের প্রাচীন ওষুধ বিক্রেতা বটকৃষ্ণ পালের বাড়ি দেখা যায়। তার নামেই বি কে পাল এভিনিউ। এখান থেকে বাঁ হাতে বটতলা এলাকা। এককালের বাংলা বইয়ের প্রধান ক্ষেত্র। সেসব এখন উঠে গেলেও থেকে গেছে যাত্রাদলের অফিস। রথের দিন সেখানে হালখাতা হয়। এর লাগোয়া গরানহাটা। শোনা যায় এক সময় সুন্দরবন থেকে নদী বেয়ে গরান কাঠ এসে এখানে জমা হতো। এখানকার এক ভাড়াবাড়িতেই প্রথম হিন্দু কলেজ শুরু হয়েছিল। পরে ফিরিঙ্গি কমল বসুর বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়, এখন প্রেসিডেন্সির অবস্থানে সেটি সরেছে পরে।
গরানহাটার গোরাচাঁদ বসাকের বাড়িতে স্থাপিত ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। এখানেই ১৮৫৪ খ্রীঃ-এ স্থাপিত হয় ‘স্কুল অফ ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল আর্ট’, পরে যা পরিণত হয়েছে ‘গর্ভনমেন্ট আর্ট এন্ড ক্রাফটে’।
গরানহাটা সংলগ্ন অঞ্চলে সোনাগাজি পীরের মাজার। সেটি অবশ্য ভূভারতে সোনাগাছি হিসেবে সকলের আশা আকাঙ্ক্ষার জায়গা হয়ে উঠেছে। দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটেও রূপোবিলাসিনীর কাজকারবার চলে। কালীপ্রসন্ন সিংহের উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো বেশ্যাদের সরকারি নির্দেশে এই অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল।
গঙ্গার ধারে শুদ্ধ হতে ফিরে এলে কুমোরটুলির পাশে দেখা যাবে চাঁপাতলা ও রথতলা ঘাট। বাবু হরচন্দ্র মল্লিক ঘাট দু’টো তৈরি করিয়েছিলেন। রথতলা ঘাটে ধনী শোভারাম বসাকের রথ থাকতো বলে এই নাম হয়। এর পাশে আহিরীটোলা ঘাট। কেউ কেউ বলে এটি সাবেক কলকাতার গোয়ালাদের বাসভূমি। অনেকে বলে পুরনো কলকাতার আর্মেনিয়ানদের বস্তি ছিল এই অঞ্চলটাকে ঘিরে। এখন লোকমুখে নাম হয়েছে দত্তদের ঘাট। হাটখোলার দত্ত পরিবারের বিখ্যাত মনমোহন দত্ত ঘাটটি নির্মাণ করিয়েছিলেন। ব্যবসা বাণিজ্য তেজারতিতে তার বিপুল রোজগার ছিল। পাশের ঘাটটি তার ছেলে রতনতনু দত্তের উদ্যোগে হয়েছিল। সেই থেকে নাম টুনুবাবুর ঘাট।
একটু দূরেই নিমতলা মহাশ্মশান। ভূগোল অনুযায়ী সেটি জোড়াবাগান অঞ্চলে। প্রাচীন কলকাতার বিখ্যাত ব্যবসায়ী বৈষ্ণবচরণ শেঠের পাশাপাশি দু’টো বাগানের নাম থেকে জায়গাটার নাম হয় জোড়াবাগান। অনেক কিছুর মতো সেটি অবলুপ্ত হলেও নামটি থেকে গেছে অবশ্য।
১৮২৪-এ নিমতলা ঘাট তৈরি হয়েছিল। মূলত শ্মশানের ডোমেদের উদ্যোগে সংলগ্ন শিব মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। রানি রাসমনির স্বামী রাজচন্দ্র দাস শ্মশান যাত্রীদের জন্যে এখানে পাকা ঘর নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। এখনকার শ্মশানটি তৈরি হয় ১৮৭৬ খ্রীস্টাব্দে এবং বৈদ্যুতিক চুল্লী বসে ১৯৭৩খ্রিঃ নাগাদ।
জোড়াবাগানের পাশে কাটমার ঘাট। তাঁতিদের উদ্যোগে এটি তৈরি বলে জানা যায়। কিছু দূরে পাথুরিয়া ঘাট। পাথর দিয়ে তৈরি হয়েছিল বলে এমন নাম ।
নিমতলা ঘাট স্ট্রিটে জোড়াবাগানের বাসিন্দা রাধামাধব বন্দোপাধ্যায় তৈরি করেছিলেন আনন্দময়ী কালীমন্দির। তা এখনও বেশ সুসজ্জিত।
নিমতলা ঘাট স্ট্রিট ধরে এগোলে চিৎপুর ও রবীন্দ্র সরণির মিলন স্থলে আজও দাঁড়িয়ে কোম্পানি বাগান। বর্তমান নাম রবীন্দ্র কানন। বহু ঐতিহাসিক সমাবেশের সাক্ষী হয়ে আছে এই মাঠটি। এখানেই ছিল মহারাজা নন্দকুমারের বাসভবন। ১৮৯৬ খ্রীঃ জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বন্দেমাতরম গেয়েছিলেন এখানেই। খানিকটা দূরে জোড়াসাঁকো রাজবাড়ি। আরও কিছুটা গেলে ঠাকুরবাড়ি ও আদি ব্রাহ্ম সমাজের বাড়ি।
কাঠমার ঘাটের পরে জগন্নাথ ঘাট। এখানটা পাইকারি ফুল বিক্রির জন্যে অধিক পরিচিত হলেও এটি ছিল শোভারাম বসাকের ঘাট। শোভারাম গঙ্গার ধারে জগন্নাথ দেবের মন্দির নির্মাণ করেন বলে নামটি থেকে গেছে। ঘাটটি লোহার থামের ওপর খিলানের স্ট্রাকচার তৈরি করে নির্মাণ করা হয়েছিল।
গঙ্গার ধারে কলকাতার সাবেক ইতিহাসের অধিকাংশ খুঁজলে পাওয়া যায়। যদিও সব তত্ত্বতালাশ এখন আর মানুষের মনে নেই। তাই সংক্ষেপে খানিকটা পরিচয় দেওয়া গেল। বইয়ের পাতা ধরে এগোলে বিস্তারিত জানা যাবে আশা রাখা যায়।
রবীন্দ্র সরণি আর মদনমোহন তলা স্ট্রিটের সংযোগে দুর্গসদৃশ এই অট্টালিকা ১৭৩০-এ তৈরি করেছিলেন গোকুল চন্দ্র মিত্র। তখন বাংলার বাণিজ্যে নুন ছিল প্রধান পণ্য। সেই নুনের ব্যবসায় মুনাফা কীর’ম ছিল তা গোকুল মিত্রের অবস্থা দেখেই আন্দাজ করা যায়। পলাশির যুদ্ধের আগে নুনের কারবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল এসব ব্যবসায়ীদের হাতে।
গোকুল চন্দ্র মিত্রের আদি বাড়ি বালিতে। সম্ভবত বর্গি হামলার সময় বাগবাজার অঞ্চলে এসে ইনি বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেই বর্গি হামলাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ চৈতন্য সিংহ জমিদারি রক্ষা করতে বিপুল অঙ্কের টাকা ধার করেন গোকুল মিত্রের থেকে। সেটাও নাকি স্বপ্নাদেশে । বন্ধক রেখেছিলেন কুলদেবতা মদনমোহনের বিগ্রহ।
ইংরেজ কোম্পানির কাছে গোকুল মিত্র আর নবকৃষ্ণ দেব মিলে কলকাতা আর ২৪ পরগনার ইজারা চেয়েছিলেন। ক্লাইভ অবশ্য রাজী হয়নি। সেকালের কলকাতার দু’জন ক্ষমতাবান লোকের দ্বারা পাছে প্রজারা অত্যাচারিত হয়। সিরাউদৌল্লা ১৭৫৬-তে ইংরেজদের শায়েস্তা করতে কলকাতা আক্রমণ করলে চিৎপুর রোডে বড় বড় গাছ দিয়ে ব্যারিকেড করা হয় গোবিন্দরাম নবকৃষ্ণ গোকুল মিত্র বনমালী সরকারদের উদ্যোগে। এ পথে কলকাতায় ঢুকতে পারেনি নবাবের সেনারা।
ইজারা না পেলেও মদনমোহনের আশীর্বাদেই (হয়তো) গোকুল মিত্র ১৭৪৮-এর লটারিতে চাঁদনি চক বাজারের স্বত্ব লাভ করলেন। লোকমুখে প্রচারিত হল— ‘মদনমোহনের দয়ায় পেলেন বাজার চাঁদনি’। আসলে তখনকার কলকাতার ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ছিল এই লটারি। লটারি কমিটি তৈরি হয়েছিল লভ্যাংশের টাকায় রাস্তা তৈরি পুকুর কাটার মতো জনহিতকর কাজগুলোর জন্যে। তাতে টিকিট কেটে কেউ কেউ মূল্যবান অলঙ্কার, অট্টালিকা, সম্পত্তি, সৌখিন আসবাব জিততেন। ভাগ্যবান গোকুল মিত্র সেই লটারির জোরেই জাঁকিয়ে বসলেন মদনমোহনতলায়।

 

 

চারপাশে ২৫২ বিঘে জমি নিয়ে গোকুল মিত্রের সম্পত্তি ছিল। মূল বাড়ি এক বিঘেরও বেশি জায়গা নিয়ে তৈরি বাড়ির দোতলায় মন্দির, বারান্দার একপাশে বিরাট ভাঁড়ার। দোতলা বাড়ির প্রধান প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। ঢোকার মুখের ঘরের দেওয়ালে ঝুলছে এক বাইসনের মুণ্ড ও শিঙয়ের মলিন স্মৃতি। একতলায় সুরম্য ঠাকুরদালান, একদিকে বিরাট রান্নাঘর, একটু দূরে রাসমঞ্চ। অনুষ্ঠানের দিন বিগ্রহকে বরাবর বসানো হয় এই রাসমঞ্চটিতে। বিস্তৃত নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো রাস দোলের উৎসবে ভিড় লেগে থাকতো। সব জায়গাতেই যেন অবহেলার কালশিটে আজ।
কিছুকাল পরে সৌভাগ্যের প্রতীক বিগ্রহটি টাকা শোধ করে ফিরিয়ে নিতে চান মল্লরাজ চৈতন্য সিং। কিন্তু ততদিনে গোকুল মিত্রের বিশ্বাস জন্মে গেছে, এই বিগ্রহ আসার পরেই তার শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে উত্তরোত্তর। তাছাড়া তার বালবিধবা কন্যা মদনমোহনের পুজো ও প্রেমে বিমোহিত। মদনমোহনের সঙ্গে তার হৃদয় বিনিময় হয়েছে। ফলে স্বামী মদনমোহন বিহনে তার প্রাণত্যাগও সম্ভব। তাই এখানকার বিগ্রহে রাধাকৃষ্ণের পাশে গোকুল কন্যাও আছেন।
ফলে সহজে বিগ্রহ ফেরত দেওয়া হল না। বদলে করা হল কারসাজি। মূল বিগ্রহের অনুরূপ বিগ্রহ দিয়ে বিদেয় করা হল রাজাকে। ফেরার সময় স্বপ্নাদেশে তিনি জানতে পারলেন ঘটনা। ফলে মতবিরোধ, বিশ্বাসভঙ্গের জন্যে মকদ্দমা শুরু হল। শেষপর্যন্ত নাকি ভগবানই একটা মাছি হয়ে বসে, রাজাকে চিনিয়ে দিয়েছিল আসল বিগ্রহ আর গোকুল মিত্রকে দিয়েছিলেন আশ্বাস— প্রতি অন্নকূটের দিন আসার।
সেই থেকে অন্নকূটের দিন মহা ধুমধাম। অন্নকূটে আয়োজন থাকে অগুন্তি পদের। ভাত, ছয় সাত রকমের ডাল, নানারকম তরকারি, চাটনি নিয়ে একত্রিশ পদ। একতলায় সেই প্রসাদী অন্ন পেতে বহু লোকের ভিড় জমে। শোনা যায়, প্রতিদিনের ছানা দুধ ও মিষ্টান্ন সরবরাহের জন্যে নবীন ময়রা আর দ্বারিক ঘোষকে বসানো হয়েছিল এ অঞ্চলে। ব্যক্তিগত স্মৃতিতে মদনমোহনের সকালের জলখাবারের প্রসাদ পাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি… রাজকীয় কথাটার সঠিক ব্যঞ্জনা। মিষ্টি নোনতা ভাজা নিয়ে অন্তত কুড়িরকম পদ নিবেদিত হয় প্রাতঃরাশে আজকের দিনেও।
তবে এখন বাঙালির ব্যবসার মতোই এই মন্দিরের জৌলুসও কমতির দিকে। চাঁদনি আর দালানে চলছে ভাড়া বসিয়ে কুমোরটুলির প্রতিমা গড়ার কাজ। রাজকীয় বাড়িটার গা থেকে এখন মলিন পলেস্তরা খসে পড়ছে সময়ের অসহযোগিতায়। শরিকদের মধ্যে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা হয়ে ভেঙে পড়ছে সাবেক বনেদি বাড়ির ঐতিহাসিক চিত্র।

ছবি : আন্তর্জালিক 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | Issue 56 | 16 March 2025 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | সংখ্যা ৫৬ | ১৬ মার্চ ২০২৫

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment