



‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা’ -এর দ্বাদশ পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
‘লাঢ়’ বা “রাঢ়” নামটি ষষ্ঠ শতকে প্রচলিত হয়। অস্টিক ভাষায় যার অর্থ হল “লাল মাটির দেশ’। এই জেলার ইতিহাস যেমন গুরুত্বপূর্ণ ঠিক তেমনি পর্যটন আকর্ষণীয়।জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমনিপুর, মল্ল রাজাদের প্রাচীন রাজধানী বিষ্ণুপুর, পাহাড়ি উপত্যকা ঝিলিমিলি, শুশুনিয়া পাহাড়, জয়পুরের জঙ্গল এবং মা সারদার পবিত্র জন্মস্থান জয়রামবাটি। মূলতঃ কৃষি নির্ভর এই জেলা। কালিদাসপুরে রয়েছে কয়লা খনি, রয়েছে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
লালগড় আন্দোলনের (জঙ্গলমহলে মাওবাদী সন্ত্রাসের সময় যৌথ বাহিনী সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার) মাধ্যমে উঠে আসে ছত্রধর মাহাতো। লালগড় আন্দোলনের সময় পুলিশ সন্তোষ বিরোধী জনসাধারণ কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। সাল ২০০৮ নভেম্বর মাসে শালবনী বিস্ফোরণ ছত্রধর মাহাতোকে বিশেষ মাত্রা যোগ করে। মেদিনীপুর কলেজে পড়ার সময় মাননীয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র সংগঠনে ছাত্র পরিষদের সদস্য হন।
সিপিআইএম কর্মী হত্যার অভিযোগে ২০০৯ সালে তিনি গ্রেফতার হন। ১২ বছর বিচারাধীন অবস্থা কাটিয়ে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০২০ সালের ২ রা ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়েই তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং রাজ্য কমিটিতে স্থান পান।
মাওবাদী আন্দোলনে সবথেকে চর্চিত নাম ছিল মল্লোজুলা কোটেশ্বরা রাও ওরফে কিষেণজি। ভারতবর্ষের নিষিদ্ধ বিপ্লবী সংগঠন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাওবাদী)-এর পলিটব্যুরো সদস্য এবং সামরিক নেতা ছিলেন। জঙ্গল অধ্যুষিত এই জঙ্গলমহলে অশান্তি এবং অনুন্নয়নের জন্য জ্যোতি বসুকে দায়ী করে ২০১০ সালে জানুয়ারি মাসে একটি চার পাতার কাগজ মিডিয়াকে ফ্যাক্স করেছিলেন। পরবর্তীকালে এই জঙ্গলমহলের সহিংসতার জন্য মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নীতি ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে দায়ী করেছিলেন। ২০০৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব বাবুকে এমনকি হত্যা করার ষড়যন্ত্র করা হয়। ২০১১ সাল ২৪ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কোবরা বাহিনীর হাতে কিষেনজি নিহত হন। কিন্তু রাজনৈতিক মহলে এই মৃত্যুকে ঘিরে নানা প্রশ্ন দানা বাঁধে যা আজও সবার অজানা।
২০১৯ সালে বাঁকুড়া লোকসভা নির্বাচন কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী ডাক্তার সুভাষ সরকার ৪৯.২৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ৩৬.৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
বাঁকুড়া লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি ৪২ শতাংশের বেশি। মুসলিম সংখ্যালঘু ৮.০৪ শতাংশ।
এই কেন্দ্রে কিছু কিছু ইস্যু রয়েছে-
১) চাষের জল নিয়ে ক্ষোভ
২) নতুন এবং ধু্ঁকতে থাকা শিল্প কারখানা
৩) দলীয় কিছু ক্ষেত্রে অসন্তোষ
তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এই কেন্দ্রে কোনও কাজ না হওয়ার জন্য বিজেপি প্রার্থীকে আক্রমণ করে চলেছে। অপরদিকে শাসক তৃণমূলের অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উন্নয়নে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ লক্ষ্য নিয়ে মানুষ বিজেপির পক্ষে রায় দেবেন দাবি করেন।
গত ২৫ মে ২০২৪ ষষ্ঠ দফা লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী ডাক্তার সুভাষ সরকার তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী অরূপ চক্রবর্তী বিরুদ্ধে নির্বাচনের লড়াইয়ে আগের থেকে মার্জিন একটু কম হতে পারে কিন্তু জয়ী হবার সম্ভাবনা প্রবল।
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ১১
বিষ্ণুপুর লোকসভা
বাঁকুড়া জেলার মন্দির শহর হল বিষ্ণুপুর। এখানকার পোড়ামাটির স্থাপত্য ও ঐতিহ্য সকলকে আকৃষ্ট করে। পোড়ামাটির ইট থেকে স্থপতিরা ‘টেরাকোট’ কাজের সুন্দর একটি নতুন পথ স্থাপন করেছিলেন।
বিষ্ণুপুর সর্বদা বামফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত ছিল। ১৯৭৭ সালে বিষ্ণুপুর কেন্দ্র গঠিত হয়। বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি এবং তপশিলি উপজাতি প্রায় ৪২ শতাংশ। মুসলিম সংখ্যালঘু ৯.৮৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ ৪৫.৫০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
২০১৯ সালে বিষ্ণুপুর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র খাঁ ৪৬.২৫ শতাংশ ভোট পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হন। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামল সাঁতরা ৪০.৭৫ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।
শাসক তৃণমূল কংগ্রেস বিষ্ণুপুর লোকসভায় গত পাঁচ বছরে কোন কাজ হয়নি অভিযোগ করলে বর্তমান সাংসদ অভিযোগকে পাত্তা না দিয়ে বলেন-
১) গত পাঁচ বছরে উন্নয়ন তহবিলের মোট ১৯ কোটি টাকা খরচ করেছেন।
২) ৭ হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় প্রজেক্ট আনতে সক্ষম হয়েছেন যা দিয়ে রেললাইন সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে, বিষ্ণুপুর স্টেশনে চলমান সিঁড়ি, রেলওয়ে ওভার ব্রীজ, বিভিন্ন মন্দিরের মেরামতি এবং অন্যান্য কাজ করা হয়েছে।
২০২৪ বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে লড়াইটা মূলত তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে বিজেপির। বিজেপির প্রার্থী গত দু’বারের জয়ী সৌমিত্র খাঁ এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী সুজাতা মণ্ডল (সৌমিত্র খানের প্রাক্তন স্ত্রী)। বিষ্ণুপুর কেন্দ্রটি বর্তমান সাংসদ এবং তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী লড়াইকে কেন্দ্র করে ভীষণভাবে রাজনৈতিক তরজা শুরু হয়েছে।
অতীতকে বারংবার জনসমক্ষে টেনে নিয়ে আসাটা সাধারণ মানুষের কাছে খুবই খারাপ ব্যাপার। যেভাবে অঙ্গভঙ্গি বা ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে তা কখনও-ই কাম্য নয় বলে সাধারণ মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, যাঁরা সাংসদ হিসেবে জনতার প্রতিনিধিত্ব করবেন তাঁরা যদি জনসভা বা প্রকাশ্যে এরকম আচরণ করতে থাকেন তাহলে সাধারণ মানুষের কি হবে?
গত ২৫ শে মে ২০২৪ বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী সৌমিত্র খান তার নিকটবর্তী প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের সুজাতা মণ্ডল (সাংসদের প্রাক্তন স্ত্রী) বিরুদ্ধে জয়ী হবার সম্ভাবনা প্রবল।
পুরুলিয়া লোকসভা
১৯৫৬ সালে অবিভক্ত বিহার রাজ্যের মানভূম জেলার সদর মহকুমা টি পুরুলিয়া জেলা নামে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসনকালে আদিবাসী বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এটি একটি খনিজ সমৃদ্ধ জেলা। কয়লা, ফসফেট, চিনামাটি, ডলোমাইট, বালি, কায়ানাইড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ছৌ নাচ এখানকার বিখ্যাত। অযোধ্যা পাহাড়,জয়চন্ডী পাহাড়, বরন্তি, ঝালদা ইত্যাদি পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।
আদিবাসী কুড়মি সমাজ এই কেন্দ্রে বড় ফ্যাক্টর। মূলত লড়াই এখানে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের। কুড়মি সমাজের প্রধান উপদেষ্টা অজিত প্রসাদ মাহাতোকে প্রার্থী করেছে কুড়মি সমাজ। তাদের দাবি, কুড়মি সমাজকে তপশিলি জাতিভুক্ত করতে হবে।
একসময় জঙ্গলমহল ছিল সবার কাছে একটা আতঙ্ক। জঙ্গলমহল মূলত বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম ও পশ্চিম মেদিনীপুরে ২৩ টি ব্লক নিয়ে গঠিত। গোটা জঙ্গলমহল জুড়েই আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস। সমাজে সবথেকে পিছিয়ে পড়া মানুষ। মানুষের যে মৌলিক অধিকার এক কথায় “রোটি কাপড়া মাকান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি। যা সম্পূর্ণরূপে সরকারের দায়বদ্ধতা আর এই দায়বদ্ধতা সঠিক পালন না করার জন্য এই জনগোষ্ঠী মানুষগুলিকে মূল্য দিতে হয়।
পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতি প্রায় ৩৮ শতাংশ। মুসলিম সংখ্যালঘু ৭.৭৬।
২০১৯ সালে পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো ৪৯.৩৩ শতাংশ ভোট পেয়ে জয় লাভ করেন।
গত ২৫ শে মে ২০২৪ ষষ্ঠ দফা পুরুলিয়া লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো ও
তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী শান্তিরাম মাহাতো নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজেপি প্রার্থী জয় লাভের সম্ভাবনা ৬০ শতাংশ। কুড়মি সমাজের ভোট শতাংশ আকস্মিক অঘটন ঘটাতে পারে।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ১০
