



সাশ্রয় নিউজ ★ শর্মিষ্ঠা সাহা মৈত্র : বাংলা চলচ্চিত্রে কোয়েল মল্লিক (Koel Mallick) একটি নাম নয়, একটি পরিচয়। তাঁর চোখে-মুখে লুকানো মিষ্টি হাসি, স্বভাবসিদ্ধ স্বতঃস্ফূর্ততা আর সংযত অভিনয় তাঁকে আজকের দিনে এনে দিয়েছে এক অনন্য উচ্চতা। তিনি শুধুমাত্র একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী নন, বরং এক প্রজন্মের ভালোবাসার প্রতীক, যাঁর অভিনয়ের সঙ্গে বাংলার হাজারো দর্শকের আবেগ জড়িত।

কোয়েল মল্লিকের জন্ম ১৯৮২ সালের ২৮শে এপ্রিল, কলকাতায়। তাঁর পুরো নাম রুশত্রী মল্লিক হলেও চলচ্চিত্র জগতে তিনি পরিচিত কোয়েল নামে। অভিনয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা যেন উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া।

তাঁর বাবা রঞ্জিত মল্লিক (Ranjit Mallick) বাংলা সিনেমার এক কিংবদন্তি অভিনেতা, যিনি ৭০ ও ৮০’র দশকে একাধিক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন।

রঞ্জিত মল্লিকের ব্যক্তিত্বপূর্ণ অভিনয় এবং মার্জিত কণ্ঠ আজও অনেকের স্মৃতিতে অম্লান। এমন এক পরিবারের সন্তান হিসেবে কোয়েলের বেড়ে ওঠা হয়েছে অভিনয়ের ঘ্রাণ নিয়েই। ছোট থেকেই চলচ্চিত্র জগতের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, সিনেমার সেটে যাওয়া, বাবার অভিনয় দেখে অনুপ্রাণিত হওয়া—এসবই যেন তাঁর রক্তে ঢুকে গেছে।
২০০৩ সালে, কোয়েল মল্লিক বাংলা সিনেমায় পা রাখেন রাজ চক্রবর্তীর পরিচালনায় নির্মিত ‘নাটের গুরু’ ছবির মাধ্যমে, যেখানে তাঁর বিপরীতে ছিলেন জিৎ (Jeet)। সিনেমাটি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, এবং কোয়েল-জিৎ জুটি তখন থেকেই দর্শকের কাছে প্রিয় হতে শুরু করে। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘শুভদৃষ্টি’, ‘বান্ধব’, ‘চাঁদের বাড়ি’, ‘মন মানে না’, ‘হেমলক সোসাইটি’, ‘প্রেম কি বুঝিনি’, ‘অরুন্ধতী’, ‘মিতিন মাসি’—এরকম বহু হিট ছবি উপহার দিয়েছেন কোয়েল। তার অভিনয়ের বৈচিত্র্য, চরিত্রের গভীরতা এবং এক্সপ্রেশনের সূক্ষ্মতা তাঁকে সমসাময়িক অভিনেত্রীদের মধ্যে এগিয়ে রেখেছে। বিশেষ করে ‘মিতিন মাসি’ চরিত্রে তাঁর গোয়েন্দা রূপ বাঙালি নারীর এক আধুনিক রূপ তুলে ধরে, যা অনেক দর্শকের মন ছুঁয়েছে।

২০০৯ সালে কোয়েল মল্লিক বিয়ে করেন নিসপাল সিং রানেক। নিসপাল একজন সফল প্রযোজক ও এসকে মুভিজের (SK Movie’s) অন্যতম কর্ণধার। এই বিয়েকে ঘিরে অনেক গুঞ্জন ছিল। কারণ নিসপাল একটি ব্যবসায়ী পরিবার থেকে এলেও বিনোদন জগতে তাঁর বিচরণ ছিল বলেই দু’জনের পরিচয় হয় এবং ধীরে ধীরে প্রেমে রূপ নেয় তাঁদের সম্পর্ক। এই দম্পতির দু’টি পুত্রসন্তান রয়েছে। মাতৃত্ব কোয়েলের জীবনে এক নতুন অনুভব এনে দেয়। সোশ্যাল মিডিয়াতে তিনি মাঝে মাঝে সন্তানদের নিয়ে ছোট ছোট মুহূর্ত ভাগ করে নেন, যা তাঁর ভক্তদের খুব কাছে নিয়ে আসে তাঁকে।

কোয়েল মল্লিক কেবল বাণিজ্যিক ছবির নায়িকা নন, বরং একাধারে তিনি নারীপ্রধান ছবি, থ্রিলার, কমেডি ও সামাজিক সিনেমাতেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর অভিনয় কখনওই অতিনাটকীয় হয়ে ওঠে না; বরং সংযম, আত্মবিশ্বাস এবং বাস্তবতার ছোঁয়া পাওয়া যায় তাঁর অভিনয়ে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকে বদলেছেন। একসময় যাঁকে শুধুমাত্র রোমান্টিক হিরোইনের ভূমিকায় দেখা যেত, সেই কোয়েল এখন একা একটি সিনেমার ওজন বহন করতে সক্ষম। দর্শকপ্রিয়তার বিচারে কোয়েল মল্লিক বাংলা সিনেমার এক অন্যতম মুখ। তাঁর ফ্যানবেস শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। শুধু সিনেমায় নয়, বিভিন্ন বিজ্ঞাপন, টেলিভিশন শো এবং সামাজিক অনুষ্ঠানেও কোয়েল একজন পরিচিত মুখ।

তাঁর বিনয়, পরিমিতি বোধ এবং ভদ্র ব্যবহার তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। চলচ্চিত্র জগতে দীর্ঘদিন ধরে থেকেও অহংকার তাঁর মধ্যে নেই বললেই চলে। এই কারণেই তিনি সহকর্মী ও সাধারণ দর্শক সকলের কাছে সমান প্রিয়।

বর্তমানে কোয়েল মল্লিক সিনেমা জগতে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছেন, যেখানে তিনি তাঁর অভিজ্ঞতা, সৃজনশীলতা এবং উপস্থিতির মাধ্যমে বাংলা সিনেমার মান উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। একদিকে যেমন তিনি এখনো নিয়মিতভাবে অভিনয় করছেন, অন্যদিকে তাঁর প্রযোজনা সংস্থা ‘Surinder Films’-এর সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি সিনেমা নির্মাণেও মনোযোগী হয়েছেন।কোয়েল নারীপ্রধান কনটেন্ট, সাহসী গল্প ও নতুন পরিচালকদের সুযোগ দেওয়ার বিষয়েও ভীষণ সরব। কোয়েল মল্লিক আজ বাংলা সিনেমার এক সমৃদ্ধ অধ্যায়ের নাম। তিনি শুধু রঞ্জিত মল্লিকের কন্যা নন, নিজের যোগ্যতায়, নিষ্ঠায় এবং প্রতিভায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি আজকের বাঙালি মেয়েদের জন্য এক অনুপ্রেরণা—যিনি পারিবারিক দায়িত্ব, মাতৃত্ব ও কেরিয়ারের ভারসাম্য রাখতে জানেন। কোয়েলের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় যেন একটি সিনেমা—ভালবাসা, সংগ্রাম, অর্জন ও গর্বে ভরা। এবং এই সিনেমার গল্প এখনো শেষ হয়নি। বরং আরও অনেক অধ্যায় এখনও বাকি। দর্শক তাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে—কোয়েল আবার কী নতুন রূপে ধরা দেবেন পর্দায়?
সব ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Kailash Satyarthi : কৈলাস সত্যার্থী: ‘শিশুরা যেন শুধু স্বপ্ন দেখে না, সেই স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলতে পারে’
