



দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় মন্দিরে যেমন একসঙ্গে অনেক ঠাকুরের সহাবস্থান, এখানেও তেমনই। কালী মন্দিরে দশ অবতারে বিষ্ণু, নয় অবতারে দুর্গা, শনিদেব সহ আছেন বাঙালীর একান্ত আপন সাবেকী একচালার মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ। আমরা যখন পৌঁছলাম, পুজো প্রায় শেষ। পুরোহিতমশাই সকলকে জানালেন এরপর প্রসাদ আর বাকি সবকিছু বাইরে হবে। তখন সন্ধে নেমে গেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর কী কার্যকলাপ হবে ভেবে পেলাম না। ছেলেকে ওর বাবা ঘুরে ঘুরে ঠাকুর চেনাতে লাগল। আমেরিকার ম্যাসাচুসেট্সের দুর্গা পুজো নিয়ে লিখলেন মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়।
অন্য পুজো ২০২৪
এ বছরের পুজো অন্যরকম। বছর ঘুরে ছেলেমেয়ে নিয়ে উমার বাপের বাড়ি আসার আনন্দের উপর মর্ত্যলোকের অসুররা এক বিষণ্ণ কুয়াশার চাদর জড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। প্রবাসে থেকেও দেশের সুখ-দুঃখ সতত আমাদের ছুঁয়ে যায়। তাই পুজোর উচ্ছ্বাস এবার ছুঁয়ে যেতে পারল না।
ম্যাসাচুসেট্স জুড়ে যে কয়টা বড় বড় পুজো হয়, তার বেশরভাগেই টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। খাওয়া-দাওয়া, কনসার্ট দেখার জন্যও একই ব্যবস্থা। কিছু পুজো শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায় তিথি মেনে পুজো শুরু হওয়ার আগেই। কোথাও বা পুজো শুরুই হয় কলকাতায় ঠাকুর বিসর্জনের পরে। একমাত্র মন্দিরে পুজো হয় তিথি মেনে। আগে থেকেই ঠিক করেছিলাম, এবার পুজোয় বাড়িতেই থাকব। এত আন্দোলনের পরও ধর্মতলায় ছ’জন পড়ুয়া ডাক্তার না খেয়ে বসে! মন খারাপ চূড়ান্ত। তবু বচ্ছরকার দিনে মায়ের মুখ না দেখলেও মন ভালো রাখা যায় না।
শনিবার দুপুরে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ উরস্টারের (ISW) পুজোয় গেলাম। এটা ওদের দ্বিতীয় বছর। পরিবেশ ঘরোয়া। জাঁকজমক নেই বললেই চলে। পুজো, অঞ্জলি সেই সবে শুরু হয়েছে। এক ভদ্রমহিলা ঠাকুর আরতি করছেন দেখে মন ভরে গেল। একটু পরেই হারমোনিয়ামের আওয়াজ কানে এল। দু’জন সেই হারমোনিয়াম বাজিয়ে পুনোর মন্ত্র বা গান উচ্চারণ করতে লাগলেন। পুরো হলের লোকজন গলা মেলালেন তাঁদের সঙ্গে। পুজো শেষ হতেই আমরা বেরিয়ে আসি।
বিকেলে বাড়ি থেকে প্রায় এক ঘন্টা ড্রাইভিং ডিস্টেন্সের এক কালী মন্দিরে যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। ম্যাসাচুসেটসে আসার পরের দু’বছর ওখানেই পুজো দেখতে যেতাম। কোভিডের পর থেকে আর যাওয়া হয়নি। মন্দিরের ভিতর মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ। দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় মন্দিরে যেমন একসঙ্গে অনেক ঠাকুরের সহাবস্থান, এখানেও তেমনই। কালী মন্দিরে দশ অবতারে বিষ্ণু, নয় অবতারে দুর্গা, শনিদেব সহ আছেন বাঙালীর একান্ত আপন সাবেকী একচালার মা দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ। আমরা যখন পৌঁছলাম, পুজো প্রায় শেষ। পুরোহিতমশাই সকলকে জানালেন এরপর প্রসাদ আর বাকি সবকিছু বাইরে হবে। তখন সন্ধে নেমে গেছে। ঠাণ্ডা হাওয়ায় আর কী কার্যকলাপ হবে ভেবে পেলাম না। ছেলেকে ওর বাবা ঘুরে ঘুরে ঠাকুর চেনাতে লাগল। ততক্ষণে যে প্রসাদ শেষ তা আমরা খেয়াল করিনি। মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। এত দূরে এসেও একটু প্রসাদ পেলাম না? মনে মনে বললাম, “ইচ্ছে করে তো দূরে সরে থাকিনি মা! তুই সব জানিস।”

এদিকে উদ্যোক্তারা বারবার বাইরে যেতে অনুরোধ করছেন। যেহেতু এই মন্দিরে ভারতের নানা প্রান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন, তাই দুর্গাপুজো হলেও সমস্ত ঘোষণা ইংরাজিতেই হচ্ছিল। মন্দিরে আর বিশেষ কিছুই করার ছিল না। আর দেরি না করে বাইরে এলাম। চোখে পড়ল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। একটি ছোট মাতৃমূর্তি পার্কিং লটে বসানো। বলে রাখা ভালো যে, বার্লিংটনের এই মন্দিরটি পরিসরে বেশ ছোট। একটি শপিং কমপ্লেক্সে নানাবিধ দোকানের এক কোণে এর প্রবেশদ্বার। তাই পার্কিং লটে এভাবে মূর্তি রাখার মানে কী আমরা ভেবে পেলাম না। গাড়িতে গিয়ে বসলাম বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব বলে। কিন্তু ওই চত্বরে ভিড় বাড়তে লাগল। এদিকে যে বন্ধু পরিবারের সঙ্গে আজ রাতে একসঙ্গে নৈশভহলাম। পরিকল্পনা ছিল, তারা জানালো আর দশ মিনিটে তারাও মন্দিরে পৌঁছবে। অগত্যা আমরাও শীত-পোশাক পরে নিয়ে ভিড়ে সামিল হলাম।
পণ্ডিতমশাই বেশ অল্পবয়সী কিন্তু কড়া ধাতের মানুষ। বাচ্চাদের কথায় কথায় বকে দিচ্ছেন, বড়দেরও রেওয়াত নেই। যদিও সবটাই দক্ষিনী ভাষায়। এবার উনি মাইক হাতে ইংরাজিতে গল্প বলতে শুরু করলেন। দুই ভলান্টিয়ার দু’টো জোরালো আলো ফেলেছেন মধ্যিখানে। পার্কিং চত্বরে প্রায় দেড়শ’ লোকের ভিড়। সকলে মগ্ন হয়ে শুনছে মায়ের কৈলাশ থেকে এবার মর্ত্যে আগমন ঘোড়ায়! তাই বহু মণ্ডপে নাকি ঘোড়া আর সিংহের মিশ্রণে এক জন্তুকে বাহনরূপে দেখা গেছে। ঘোড়া নাকি একই সঙ্গে সূর্য আর বৃহস্পতির প্রতীক। আমি এসব বিশেষ জানি না। তবে শুনতে খুব ভালো লাগছিল। কিছু বাচ্চা বেশ উসখুস করছে। এইবার উনি বললেন, কিভাবে অসুর নানা জন্তুর রূপ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে মাকে আক্রমণ করত। যেদিকে দুর্গামূর্তি বসানো তার ঠিক উল্টোদিকে বসানো এক হাতির মাথাওয়ালা মূর্তি (যাকে এতক্ষণ আমরা গণেশ ভেবে ভুল করছিলাম)। ইনি হলেন গজাসুর। পণ্ডিতমশাই আটজন ভলান্টিয়ারকে ডেকে নিলেন। তার মধ্যে চারজনকে দিলেন পাতলা প্লাস্টিকের গা-মাথা ঢাকার আবরণ। প্রথম চারজন দেবীমূর্তি কাঁধে তুলে নিলেন আর প্লাস্টিক ঢাকা চারজন গজাসুরকে। এবার গজাসুর বহনকারীরা মায়ের চারপাশে তিনপাক ঘুরল। পণ্ডিতমশাই মন্ত্র পড়ে চলেছেন! মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুই দল দেবী আর গজাসুরকে নিয়ে চার পা করে এগিয়ে আসে, আবার চার পা করে পিছিয়ে যায়। ভেসে আসছে উলুধ্বনি, ঢাজের শব্দ। চোখের সামনে যেন মহালয়া অভিনীত হচ্ছে। লড়ছেন মা দুর্গা দুর্ধর্ষ অসুরের সঙ্গে! এবার পরপর দু’বার ফাটানো হল কনফেট্টি। শব্দ করে ঝরে পড়ল ফুলের মতো একরাশ কাগজ। এইবার সময় আসন্ন। পুরুতমশাই আসল ত্রিশূলটি মায়ের মাথায় ঠেকিয়ে সোজা বসিয়ে দিলের গজাসুরের গলায়। শুধু বসালেনই না। ওই ত্রিশূল দিয়ে ক্রমাগত খোঁচা মারতে মারতে এক সময় গজাসুরের মাথাটা উৎখাত করলেন দেহ থেকে। দর্শকরা করতালি আর কলরবে মেতে উঠল। আমার একই সঙ্গে মহালয়া থেকে রাশমেলার যাত্রাপালা সবকিছু মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়! গজাসুরের বাহকরা এবার মুণ্ডহীন দেহটিকে অনবরত নাড়াতে লাগল। আর গলার ভিতর দিয়ে ক্রমাগত বের হতে লাগল ফিনকি দিয়ে রক্ত! আসলে লাল জল আগে থেকেই পাইপের মাধ্যমে পুরুলের ভিতর ঢোকানো ছিল।
ঠিক একইভাবে ওই পাইপ লাগানো ধড়ের উপর একে একে বসানো হলো সিংহ, অসুর আর শেষে মহিষের মুখ। বারেবারে অভিনীত হল মা আর অসুরের যুদ্ধ দৃশ্য। শেষবেলায় তো পুরো পার্কিং লট জুড়ে ঘোরানো হল অসুর আর দেবীকে – ঠিক যেন মা তাড়া করেছেন তাঁর শিকারকে! শেষ দৃশ্য অভিনীত হওয়ার পর বারেবারে হাততালি দিতে দিতে অনুভব করলাম কখন যেন আমি আমার ছেলের বয়সীই হয়ে গেছি। পণ্ডিতমশাই যতই কড়া মানুষ হন না কেন, ভাবী প্রজন্মের বুকে আমাদের পুরাণকে, আমাদের সংস্কৃতিকে এমন স্থায়ীভাবে এঁকে দিলেন আজ, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায় এবার আমাদের নিতেই হবে। ইতিমধ্যে বন্ধু পরিবারটিও ভিড়ে সামিল হয়েছিল। ওদের সঙ্গে আরও একবার মন্দিরের দিকে এগোলাম। আরও একবার প্রণাম সেরে দেখি একরাশ প্রসাদে আবারও ভরে উঠেছে ডালাটি। মা কী আর সন্তানকে না খাইয়ে রাখতে পারে?
ছবি : লেখক
