Sasraya News

Wednesday, April 2, 2025

Sasraya News Sunday’s Literature Special | 23 rd March 2025 | Issue 57 || রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল, ২৩ মার্চ ২০২৫। সংখ্যা ৫৭

Listen

🍂মহামিলনের কথা 

 

 

শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
সব তুমি?
হাঁ, সব আমি।
কি করে ‘সব তুমি’ আমি প্রত্যক্ষ করতে পারবো?
নাম করলে। নিরন্তর নাম করলে আমি স্বয়ং এসে তোকে ধরা দেবো।
তুমি সকলকেই ধরা দাও? মহাপাপী যদি নাম করে তাকেও তুমি ধরা দাও?
নিশ্চয়ই দিই। নাম করলে কি তার পাপ থাকেরে? সাত জন্মের পাপও নামকারীর নষ্ট হয়ে যায়।
যে মানব ‘শ্রীকৃষ্ণ’ এই নামকীর্ত্তন করতে থাকে তার মুখে নাম শুনে দক্ষিণদিকের অধিপতি ধর্ম্মরাজ যম তার শত জন্মের পাপ খাতা থেকে মুছে ফেলেন।
গোপনে পাপ করলে যম কি করে জানতে পারেন?
মানুষ যত গোপনে যেখানে পাপ করুক না কেন, সূর্য্য, অগ্নি, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র, সন্ধ্যা,
দিবারাত্রি, জল, পৃথিবী, আর স্বয়ং ধর্ম্ম— এঁরা সে পাপের সাক্ষী থাকেন।
চিত্রগুপ্ত তার খাতায় জন্ম-জন্মান্তরের পাপ লিখে রেখে দেয়,জন্ম-জন্মান্তর ধরে সে পাপের দণ্ড দিতে থাকে। যে জন্মে পাপী আমার নাম একান্তভাবে আশ্রয় করে,যমরাজ স্বয়ং তার সমস্ত পাপ মুছে ফেলেন।
তোমার এসব কথায় বিশ্বাস করবার শক্তি আমাকে দাও।
তুই কি নামের মহিমায় সন্দেহ করিস্?
না না; যম মুছে ফেলেন— এসব ঠিক বুঝতে পারি না। আমায় বেশ করে বুঝিয়ে দাও। তোমার নামের মহিমা বল।
জগন্মঙ্গল আমার সঙ্কীর্ত্তন মহাপাপেরও একবারে নাশকারী। অজামিল নামাভাসেই মুক্তিলাভ করেছিল।
নাম করে মুক্তিলাভের কথা কেবল অজামিলেরই শোনা যায়।
অজামিল, রত্নাকর, গণিকা, শুক আরও কত ভক্ত নাম নিয়েই কৃতার্থ হয়েছে। ভক্ত নামকেই একমাত্র সম্বল করে। নাম অবলম্বনেই ভক্ত আমাকে চিরপ্রেমে বন্দী করে। যে নাম অবলম্বন করে,তাকে প্রাণরূপে ধরা দিই, তারপর তার প্রাণনাথ হয়ে যাই। শ্রীশ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ দেব🍁

ঋণ : শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী। শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী
(বানান অপরিচিত)

 

 

 

 

🍂বিতা 

 

 

স্বপন দত্ত-এর দু’টি কবিতা

 

 

পরমহংসের সাথে একটি রোমান্স স্ট্রাকচার

তুই কাদামাখা খালি পা পরমহংস

তলায় ভিজে মানুষ

শূন্য নয়, অসীমও নয়
ডানা মেলে কষ্টও—

পৃথিবীর রাস্তায়
কাছে উত্তরণ হু হু করে
মাঠে পুজো উঠে আসে

এক বুক ক্লান্ত ক্লোরোফিল
বুভুক্ষু মুঠোয় মুঠো খোঁজে—
ছিঁড়েখুঁড়ে কী খোঁজে
কামনায় পরিবেশ…
খোঁজে আলিঙ্গন ভাস্কর্য উত্তরণ

অসম্পূর্ণ সঙ্গেই থাকে

 

 

 

নিশুতি ভয় বিছানায় তুমি ছিলে উপাসনা

ভয় জমবে। দুষ্টু রাত।
জীবন লটকা-লটকি…

ভয় কী হিমেল?
কাটাকুটি খেলা হিমেল রাতেই জমে।

ভয় কিন্তু করে নেশাতুর।
নেশা কী ভয়?

তখন খুব শীত করে
ভয় ছাড়া উপাসনায় যেটা আমি না
তাহলে দুনিয়ায় লেপ্টে আছে যত উপাসনা
সব কি আমার ভয়ের ছায়ার তীব্র ঘন খিদে জ্বালার মাতন-বুনন!

 

 

 

গৌতম হাজরা-এর কবিতাগুচ্ছ 

 

 

ক’য়েক টুকরো

১.
ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলে নির্জলা নদীও ভারি হয়
স্রোতস্বিনী হয়ে ওঠে ক্রমে
গাছপালার গা গতরেও লাবণ্য ফুটে ওঠে
মলিন বেঞ্চগুলো স্নান সেরে পোশাক পাল্টায়
সেজেগুজে মশগুল হয় নতুন তাগিদে!

২.
মান-অপমান, লজ্জা-ঘৃণার ভেতরও
জীবন ঠিক এগিয়ে চলে নিজস্ব নিয়মে!

৩.
শুষ্ক তৃণের মাঠ পা জড়িয়ে ধরছে
ঘণকৃষ্ণ মেঘের কাছে
বৃষ্টিপাতের আকুল অভীষ্পায়
মেঘ তাকে পারেনি দিতে কুশল সংবাদ
তাই আজ বিষণ্ণতায় কেঁদে উঠছে
গ্ৰামীণ গোলাঘর!

৪.
নিঃসঙ্গতার কোনও ঘেরাটোপ নেই
নেই কোনও লেখচিত্রও
কিংবা নিজস্ব সংলাপ

নিঃসঙ্গতা তাই কখনো কখনো
স্মৃতিমেদুর হয়ে ওঠে!

৫.
দূরের পাহাড়টা আমার বন্ধু।
কাছে গেলে নীল রং বদলে সবুজ হয়ে ওঠে
তখন পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমি গান গাই
আর সেই গান শুনে একটা নদী আছড়ে পড়ে নীচে
তারপর ক্ষীণ হয়ে ছুঁয়ে দেয়
সীমান্তের বেড়া!

 

 

 

বৃন্দাবন দাস-এর একটি কবিতা

 

 

ঘ্রাণ

বিপন্ন আলোয় ফুটে উঠছে অহংকার

সাধারণ ভাষাতেই ও বলে দিতে পারে
কার কথা ইতিহাস হবে

অতিজ্ঞানীর স্থিতধী প্রজ্ঞা জ্বেলে যেকেউ কলবল করে উঠতে পারে
রাজগুন রাজার মহিমা

আমার মেধার ভিতর কি যেন বৈঠকী গান
এক মুঠো অন্য হয়ে ঘোরে ফেরে
আমরণ ঘ্রাণের ভিতর—

 

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর দু’টি কবিতা

 

 

অপবাদের ভাষা

অপবাদগুলো ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠে
আয়নায় আঁকা মুখের মত

নিন্দের ভয় করি না, পাড়াতুতো সংলাপে
কখনো বেপাড়ায় হাঁটিনি, নেশাগ্রস্ত মাতালের মত
তবুও শরীরের উপর কারা যেন
সাজিয়ে দিয়েছে, অপবাদের রঙিন তাঁবু

সমস্ত সামলে ইদানিং হেঁটে যাই, নির্লিপ্ত…
অদূরে কিন্ডারগার্টেন দেব শিশুরা খেলছে
নিরাপত্তাহীন পৃথিবীতে

বেড়ে যাচ্ছে হোর্ডিং, নিষেধ রেখার দূরত্ব
মায়েদের ভালোবাসা ক্রমশ দুরস্থ নক্ষত্র শহরের মতো

ভালোবাসা এখন অপবাদ হয়ে উঠেছে
তৃতীয় বিশ্বের এইসব নকল শহরে

 

 

 

পলায়নের কবিতা 

ছায়া গুলো সরে যাচ্ছে…
অবয়ব জুড়ে বেড়ে উঠছে, কালপুরুষের দীর্ঘ শরীর
আমরা পরস্পর কৃপণ হয়ে যাচ্ছি

সন্তর্পণে জেনেছিলাম, সেই ঋদ্ধিকথা—
ডান হাত ছুঁলে, বাম হাত জেনে যাবে, এইসব গোপন

অশ্বত্থতলায় দাঁড়িয়ে, তোমার হাতে যে শব্দগুলো
তুলে দিয়েছিলাম, ভয়াবহ বিকেলে
নিন্দার ভয়ে পিছাতে পিছাতে, তুমিও একদিন
প্রবাল দ্বীপের অন্তরাল…

তারপর একদিন আলোকবর্ষের দূরত্ব কমতেই
মেনে নিলাম, নিষিদ্ধ সেই দুর্গ
যেখানে একদিন তান্ত্রিকের উচ্চারণে মিশে গিয়েছিলাম
গুহার কৃষ্ণ অন্ধকারে

শতাব্দী পেরিয়ে আজও ফেরা হলো না, গোষ্ঠে

 

 

 

আদিত্য মুখোপাধ্যায় (আদি) -এর একটি কবিতা

 

 

মৌটুসি মন চুঁয়ে

তখনও সন্ধে নামেনি। শীত বসেছে জাঁকিয়ে
তেষ্টা পায়; শরীরে আলো
মৌটুসি মন চুঁয়ে গল গল সংরাগ

ধীর লয়ে হাঁটছে বাতাসী
বুক ভর্তি উঁচাটান
ওই বুঝি উড়ে যাবে পাখি; পরিযায়ী

পাশব শীত; চাদরের ওম চুষে নেয় একনলা বন্দুক

আঁধার মুছে দেয় সাদা খাতা আর কলম

গঙ্গা সাগর আর কুম্ভমেলার ঢেউ আছড়ে পড়ে
টুসুগানে আর পৌষ পার্বণে; মাঝখানে ঝড়ে পড়ে কত কথার ইতিকথা

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী-এর একটি কবিতা

 

 

আমার এখন গভীর অসুখ

আমার এখন গভীর অসুখ বলি কাকে
যাকে বলতাম সে এখন অনেক দূরে
খুঁজি তাকে তারার মাঝে।

আমার এখন গভীর অসুখ
হেঁটে বেড়াই পথে পথে
পথের ধারে পড়ে থাকা ভাঙ্গা বোতল উচ্ছিষ্ট
সব আমার দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপ করে
আমাকে দেখে হাসে ক্রূর দৃষ্টিতে তাকায়
বলতো কেমন লাগে
বলতো কেমন করে খুঁজি তোমায় সেই ঠিকানায়
মনটা যেন কেমন পাগলপারা, ছন্নছাড়া
তোমায় ছাড়া, শুধু তোমায় ছাড়া।

এখন আমার গভীর অসুখ
কে আমাকে বলবে আমি আছি তোমার পাশে
ঠিক যেমনি থাকতে আগে
আমি হাত বাড়িয়ে খুঁজে বেড়াই।
এখন আমার দরকার
শুধুই তোমাকে দরকার
স্বার্থপরের দুনিয়াতে ভরে গেছে মিথ্যেতে
কেমন করে কাটিয়ে উঠবো আমি
আবার গায়ে মাখবো শ্বেত পদ্মের রেণু
শীতের ভোরের কুয়াশা কাটিয়ে টিয়া পাখির
ঠোঁটে নেমে আসবে আবার সেই উজ্জ্বল সূর্যের কিরণ।
আমার এখন গভীর অসুখ
নার্ভগুলো ক্রমশ দুর্বল হচ্ছে
অথচ কি একটা অদৃশ্য শক্তি বলে যাচ্ছে
আছো তুমি নদীর স্রোতে ,হয়তো আছো অরণ্যের মাঝে, হয়তো বা আছো আমারই আশেপাশে
খুব চেনা চেনা গন্ধ লাগে
ভেতরে ভেতরে আবার অরণ্য পাখির গান,
নদীর কলতান আমাকে শক্তি যোগায় আবার আমি ঘুরে দাঁড়াই।
আর যখনই এই গভীর অসুখ আমাকে তাড়া করে
আমি শুধু খুঁজে বেড়াই আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করি আজও তোমাকে।

 

 

 

কপিল কুমার ভট্টাচার্য্য-এর একটি কবিতা

 

 

বইয়ের মজা

বইমেলায় এসে
গেলাম খুশীতে ভেসে,
বই তুলে পড়া
গল্প কবিতা ছড়া,
সঙ্গে কফির কাপ
মনে ছন্দের ছাপ,
লাগল ভীষণ ভালো
জাগল মনে আলো।

 

 

ভানু কিশোর ঘোষ-এর একটি কবিতা

 

 

ঠিকানার খোঁজ

সুরের ঠিকানা
আকাশেরও জানা নেই
পুকুর পাড়ে অশ্বত্থ ছায়ায়
যে পথিক বাঁশির সুরে
ভালোবাসার আলপনা আঁকে
পাখি গাছ ফুল নদী
যে সুরে স্বপ্নের রঙ মেশান
বয়ে যাওয়া সুরেলা পথ
সীমানা জানে না—
মানে না মরু দুর্গম নিষিদ্ধ ভূমি
বন্দুক প্রাচীর সীমানার কাঁটাতার
হৃদয় ভাঙা পাড়ে, নদী চড়ে
তৃষ্ণায় ক্লান্ত বাউল—
ভরা কোটাল যৌবন জলরাশির
তুফানী ঢেউয়ের মাঝে
একতারার বৈঠা ঠেলে ঠেলে
সুর ঠিকানা খুঁজে ফেরে।

 

 

পরাণ মাঝি-এর একটি কবিতা

 

 

 

যাওয়া

যেতে যদি হয়। অবশ্যই যাবো।

ঢের দূরে…

নতুবা কথার ব্যথা নিপাট ভদ্র আঁধারেও থেকে যায় অমলিন…

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ১৯ 

 

শুরু হয়েছে  আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ১৯। 

 

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

 

উনিশ.

বিচিত্র সার্কাসের মতো এই ট্রেনিং কলেজ

লেখাপড়া শিখে কোনোদিনই আমার কোনো আভিজাত্য তৈরি হয়নি। তাই সাধারণ মানুষের মতোই ধূলিমলিন দিনযাপনের মধ্য দিয়েই জীবন কাটছিল। শ্রমিকের পেশায় মজুর খাটা যেমন চলছিল, তেমনি টিউশানি পড়ানোও বন্ধ ছিল না। গ্রামের ছেলে-মেয়েরা দশ-বিশ টাকা থেকে শুরু করে কেউ কেউ পঞ্চাশ-একশো পর্যন্ত মজুরি দিত টিউশানির। কয়েকটা টিউশানি বাড়ি বাড়ি গিয়েও পড়াতে হতো। সারাদিন কর্মশ্রান্ত থাকার পর রাত্রে টিউশানি করাটাও ছিল খুব কষ্টের। তবু বুঝতে পেরেছিলাম কষ্টের সংসারে বেঁচে থাকতে হলে এভাবে লড়াই করতে হবে। কোনো কাজ করাই ছোট কাজ নয়। বাড়ি বাড়ি টিউশানি পড়ানোতে আর একটা লাভ ছিল, কারো না কারো বাড়িতে কিছু না কিছু খাবারও জুটে যেত। পুজোর সময় দু-একটা কাপড়-চোপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এ-পাড়া ও-পাড়া ঘুরে নবান্ন উৎসবে আমন্ত্রণও পেতাম। সহপাঠী সুফলও তখন আমন্ত্রণ জানাতো। পড়ানোর চাপ এতটাই বাড়তে লাগলো যে, মাঠের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। কমলের সঙ্গে আর শেষ দেখা হলো না। সেবার ধান কাটতে গিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। কমল বলেছিল, “আমাকে আর হয়তো দেখতে পাবি না!”

জানতে চেয়েছিলাম, কেন দেখতে পাবো না?

উত্তরে সে বলেছিল, “কাকা আর আমাকে রাখতে চাইছে না। একরকম জোর করেই আমার বিয়ে দিয়ে দিবে। মোড়লদের কয়েকজন যুবক কাকাকে খুব জ্বালাতন করছে। আমার জন্য কাকার অপমান আমিও সহ্য করতে পারি না।”

কী করবি ভাবছিস? আমি জানতে চেয়েছিলাম।

সে বলেছিল, “দুনিয়া ছেড়ে পালাবো, না হলে ঘর ছেড়ে পালাবো—দুটো রাস্তাই আমার কাছে খোলা আছে।”

দুনিয়া ছেড়ে পালাস না অন্তত এটাই আমার মিনতি! এটুকুই বলতে পেরেছিলাম সেদিন ওকে।

 

ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হতে গিয়েই প্রথম দিনেই দেখা হয়েছিল মৃদুলা দাসের সঙ্গে। মৃদুলা দাস পাটনা ইউনিভারসিটির আমাদের দু-বছরের আগের ব্যাচ। বেশ সুন্দরী এবং স্মার্ট একজন মেয়ে ছিল সে। তার বাড়ি ওল্ড মালদাতেই। ভালোই হলো দুজনে অন্তত একই ক্লাসে থাকতে পারবো। বহুদিন পর মৃদুলাদিকে দেখেই এক ঝলক উজ্জ্বল আলো যেন আমার চোখে মুখে পতিত হলো। মৃদু হেসে হে কাছে এসে দাঁড়ালো। সুঠাম স্বাস্থ্যবতী এক ওক গাছের মতোই মনে হলো আমার। বহুদিন পর যেন আমি এক পথিক তার ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে।

 

 

না, সে দুনিয়া ছেড়ে পালায়নি, প্রথমে ঘরই ছেড়েছিল। কাকার পছন্দের এক যুবককে বিয়ে করে সংসার পেতেছিল। গর্ভবতী অবস্থায় সন্তান প্রসব করতে গিয়েই তার মৃত্যু ঘটে। সন্তানও বাঁচেনি সেও বাঁচেনি। তার কথা খুব মনে পড়ে। আরেকটি খুব মর্মান্তিক দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আষাঢ় মাসের দিন মাঠে সবাই বীজ রোপণ করছি আমরা। কড়্ কড়্ শব্দে মেঘ ডেকে হঠাৎ চোখে মুখে বিদ্যুতের ঝলকানি লাগে। প্রায় অজ্ঞান হয়ে আমরা পড়ে যাই। আমাদের পাশের জমিতেই কাজ করছিলেন পাশের গাঁয়ের কৃষক জামাল উদ্দিন। সমস্ত শরীরেই দেখি তার কালশিটে দাগ। ভয়ংকর মৃত্যু দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। চোখদুটি খোলা অবস্থায় চিৎ হয়ে তিনি পড়ে আছেন জমিতে। ধড়ে প্রাণ নেই। নিজের জমিটুকুতেই সারাদিন কাজ করছিলেন। ঠিকমতো খাওয়াও হয়নি। সেই জমিতেই তিনি চিৎ হয়ে পড়ে রইলেন। কমল সেদিন কেঁদে ফেলেছিল। আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়েছিলাম, মৃত্যু ঈশ্বর প্রদত্ত ভাগ্যের লিখন। কান্না করলেও কেউ বাঁচবে না!

সেই কমল শুনেছিলাম মৃত্যুকালে খুবই কষ্ট পেয়েছিল। সময় মতো হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি। যখন পৌঁছেছিল তখন সব শেষ।

সময় চলে যাচ্ছে। আমাদের পরীক্ষার রেজাল্টও এক সময় প্রকাশিত হয়েছে। সব থেকে বেশি নাম্বার পেয়েছি আমি। কিন্তু নাম্বার নিয়েই বা কী হবে? চাকরির যা হাল তাতে সবই বৃথা। একদিন সব বন্ধু মিলেই ট্রেনে চড়ে ইউনিভার্সিটি থেকে রেজাল্ট নিয়ে এসেছি। ডক্টর ললিতা সান্যাল আমাকে ডেকে বলেছিলেন, “তুমি ইউনিভার্সিটিতেই পার্টটাইম লেকচারার হিসেবে জয়েন করো। ভবিষ্যতে একটা সুরাহা হবে।”

কিন্তু আমার থাকতে আর মন চাইনি। সব সহপাঠীরাই চলে এসেছিল। আমিও সেখানে একা থাকতে চাইনি। আমাকে নির্বাসিত নির্বাসিত মনে হতো। তাই আমি বলেছিলাম, এখন আর পার্টটাইম করতে রাজি নই, আগে বি-এডটা করার ইচ্ছা আছে। যদি কোনো স্কুলে চাকরি পাই সেটাই ভরসা।

পার্টটাইম না করাটাকেও অনেকেই আমার বোকামি বলেছিল সেদিন। হয়তো সামান্য টাকায় আমার কোনো রকম বেঁচে থাকা যেত। কিন্তু যে বাংলার উর্বর ভূমিতে মেহনতি মানুষদের সঙ্গে আমার দিনযাপন, যে বাংলার প্রকৃতির সঙ্গে আমার জীবনদর্শন মিশেছিল তাকে আমি ভুলতে পারছিলাম না। শহরের যান্ত্রিক জীবন আমাকে মোটেও ভালো লাগছিল না। তাই সব ছেড়ে চলে এসেছিলাম। বি-এড করার জন্য বহু কলেজেই দরখাস্ত করেছিলাম। অধিকাংশ কলেজেই ভর্তির সুযোগও এসেছিল। কিন্তু খরচ চালাবার ভয়ে ভর্তি হতে পারিনি। অবশেষে বহু ভেবেচিন্তে মালদহ গভর্নমেন্ট ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে ভর্তি হওয়ার একটিই কারণ ছিল, প্রত্যেক মাসে একশো টাকা ভাতা পাওয়া যেত। এইটিই আমার কাছে ছিল বড় প্রাপ্তি। আর একশো টাকা বাড়ি থেকে জোগাড় করে নিলেই দুশো টাকায় দিব্যি আমার মাস চলে যেত। এই ট্রেনিং কলেজে ভর্তি হতে গিয়েই প্রথম দিনেই দেখা হয়েছিল মৃদুলা দাসের সঙ্গে। মৃদুলা দাস পাটনা ইউনিভারসিটির আমাদের দু-বছরের আগের ব্যাচ। বেশ সুন্দরী এবং স্মার্ট একজন মেয়ে ছিল সে। তার বাড়ি ওল্ড মালদাতেই। ভালোই হলো দুজনে অন্তত একই ক্লাসে থাকতে পারবো। বহুদিন পর মৃদুলাদিকে দেখেই এক ঝলক উজ্জ্বল আলো যেন আমার চোখে মুখে পতিত হলো। মৃদু হেসে হে কাছে এসে দাঁড়ালো। সুঠাম স্বাস্থ্যবতী এক ওক গাছের মতোই মনে হলো আমার। বহুদিন পর যেন আমি এক পথিক তার ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। অনেকক্ষণ বিশ্রাম নিতে হবে। মৃদুলাদি বললো, “তুমি এখানে ভর্তি হবে আমি একবারও ভাবতে পারিনি। আজ আমার খুব আনন্দ হচ্ছে!”

আনন্দ তো আমার হচ্ছে দিদি! তোমাকে পাবো আমিও ভাবতে পারিনি।

সেদিন একসঙ্গে বসে চাও খেয়েছিলাম। কথায় কথায় জেনে নিয়েছিলাম ট্রেনিং কলেজ থেকে তার বাড়ির দূরত্ব। বাবা রেলে চাকরি করতেন, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। এক দিদির বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাবা-মা আর মৃদুলাদি তিনজন সদস্য মাত্র। পেনশনের টাকায় সংসার চলে। বি-এড করে চাকরি পেতে হবে এটাই একমাত্র লক্ষ্য। বাস স্টপেজের দিকে আসার পথেই সেদিনের মতো বিদায় নিয়েছিলাম তার কাছ থেকে। হাত বাড়িয়ে আমার হাত স্পর্শ করেছিল মৃদুলা। তার হাতে কী ছিল জানি না, সেদিন একটা নতুন শিহরন উপলব্ধি করেছিলাম। মনটা গুনগুন করে উঠেছিল। স্টেট বাস ধরে রামপুরহাট মুখে ছুটতে ছুটতে মনে হয়েছিল আবার কবে ফিরে আসবো। আবার কবে দেখতে পাবো মৃদুলাদিকে!

বি-এড করতে গিয়ে অনেক কিছুই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। হোস্টেল ছিল মালঞ্চপল্লিতে। প্রতিটি রুমেই তিনজন করে থাকতাম। ছুটি পেলেই বাস ধরে বাড়ি। অবশ্য বহু বন্ধুবান্ধব পেয়েছিলাম সেখানেও। প্রতিদিনই শিক্ষক-শিক্ষিকারা নতুন কোনো কিছুর আয়োজন করতো। কারো সঙ্গে কারো প্রেম, কারো সঙ্গে কারো বিবাহ প্রায় ঘটতেই থাকতো। হোস্টেল জুড়ে তখন মিষ্টিমুখ চলতো। আবার অনেক বিবাহিত পুরুষ পরকীয়াসক্ত হয়ে পড়তো। তাদেরও বহু হাস্যকর কার্যকলাপ চোখের সামনে দেখতে পেতাম। এমনি করেই কাটছিল আমাদের সময়। তবে কিছু পরহেজগার মানুষও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। নিয়মিতই তারা স্রষ্টাকে স্মরণ করতেন এবং সর্বদা পবিত্রতা রক্ষা করে চলতেন। এক বিচিত্র সার্কাসের মতো এই ট্রেনিং কলেজ। শাসন এবং পাশফেলেরও ততটা ভয় ছিল না। সন্ধ্যার আঁধারে এমনও কেউ ছিল হোস্টেলের ছাদে উঠে উলঙ্গ নৃত্যে মেতে উঠতো। সঙ্গে থাকতো নেশার পানীয় দ্রব্য।

হোস্টেলের চারিপাশে বহু উদ্বাস্তু মানুষের ছোট ছোট কুঁড়েঘর। সন্ধ্যের প্রদীপ জ্বলে উঠলেই দেখতাম তারা বাইরের রাস্তায় কত রকম জিনিস ফেরি করছে। কারো চলছে বিড়ি বাঁধা। কেউ কেউ বুনছে শুয়েটার। কেউ কেউ নিছক গল্পগুজব করে কাটাচ্ছে। আমরা মসলা মুড়ি কিনে এনে খেতাম। আর চেয়ে থাকতাম রাস্তার সেইসব মেয়েদের দিকে। ওরাও আমাদের দিকে তাকিয়ে হি-হি হেসে উঠতো। কখনো কখনো নিজেদেরও দেখাতে চাইতো। খোলামেলা পোশাক পরিচ্ছদে কেউ কেউ পয়োভারে আন্দোলিত হতো। যুবকরা ভাবতো সমুদ্র মন্থনের অমৃত স্বাদ হয়তো ওখানেই লুকিয়ে আছে। 🍁(চলবে)

 

 

 

🍂ফিরেপড়া | কবিতা 

 

 

শুভ দাশগুপ্ত-এর একটি কবিতা

 

 

 বাঁশিওয়ালা 

এক বাঁশিওয়ালা এসেছিল…

তখন ফাল্গুন মাস
গাছে গাছে কত রঙ কত শোভা,কত পাখির কলতান। নদীতে কী অপরূপ ছায়াময় ঢেউ
দূরপথে কী মায়াবী আলো
বাতাসে কী সুগন্ধ

এক বাঁশিওয়ালা এসেছিল
তাঁর বাঁশির সুর মোমের আলোর মত স্নিগ্ধ
তাঁর বাঁশির শব্দ পাতা পাতা ঝরার মতো পেলব
তাঁর বাঁশি কী করুণ
কী মোহময়!

সে এসেছিল জানলার পর্দা উড়লো হাওয়ায়
দুয়ারের আগল গেল খুলে
বাগানের গাছের পাতার ডালে
ছড়িয়ে পড়ল প্রজাপতির মতো রঙিন গান

আমার তখন অনেক কাজ। অনেক
ঘর সংসার সমাজ পরিবার দায়দায়িত্ব
অনেক অনেক।
মনটা আনচান করে উঠল
ভেতর থেকে কে যেন ঠেলা লাগালো…যাও যাও
দেরি কোরো না

কিন্তু আমার দেরি হয়ে গেল।
আমার পুজো,আমার গেরস্থালি,আমার কর্তব্য
আমার নিত্যদিনের
সাত-সতেরো ঝামেলা…
আমার দেরি হয়ে গেল।

যখন সব সেরে, সব চুকিয়ে ছুটে গেলাম
বাইরে বড় দরজাটারও বাইরে
রাঙাধুলোর বিষণ্ণ পথে
তখন বাঁশিটি পড়ে ছিল..ভাঙা, সুরহীন,স্তব্ধ
গোধূলির সোনালি আলোয়
বাঁশিটিকে মনে হল
যেন এক ঝরাপাতা বুঝি

আমি আমার সবটুকু দিয়ে বাঁশিওয়ালাকে খুঁজলাম।
সন্ধ্যালগনে আকাশে ফুটে ওঠা
প্রথম তারাটি বলল…আমি এখানে।

 

 

🍂কণাগল্প

 

 

ছোট্ট পাখিটিকে দেখে আমার মনে মায়া জাগত৷ আমি মনে মনে ভাবতাম, সবুজ পালকের আবেশ জড়ানো ঐ পাখিটির সঙ্গে আমার যেন যুগ যুগ আগেকার সম্পর্ক রয়েছে৷ সম্পর্কটি ভালোবাসার সম্পর্ক৷
হাজার বছরের পুরনো অতীত ইতিহাস ঘেঁটে সেদিন দেখেছিলাম, কল্পনার আরব্য রজনী৷ সেখানে একটি পুরুষ পাখি আর একটি স্ত্রী পাখি ছিল৷ দু’টি কণাগল্প লিখেছেন : অমিত পাল

সুইসাইড নোটটা…

 

 

বলি স্বর্গ বলেও একটা স্থান আছে৷ গাঙ্গেয় তীর ধরে না হেঁটে বেহুলার মতো অপার, গহন তল যুক্ত মায়াময় স্রোতে নিজেকে ভাসালে আমি স্বর্গে পৌঁছুতে পারি—- একথার গল্প আমাকে বিরহ কাতর স্বপ্নেরা জানিয়ে দিয়েছে৷
স্বর্গে নিজের একটা স্থান করতে পারব কিনা জানি না৷ সেখানে গেলে কি হয় সেকথার আভাস আমি একসময় পেয়েছি৷ তবে সেই কথার রহস্য উন্মোচন করতে চাইনি…
সুইসাইট নোটটা খুলে দেখো, সেখানে সুইসাইটের বিভিন্ন বিবরণ ও তার কারণ দিয়েছি৷ কিন্তু শুরুতেই ঈশ্বরের কাছে আমার একপত্র প্রেরণ করেছি৷ পত্রে ঈশ্বর মহলে আমি জানিয়েছি—-
“প্রভু প্রণাম, যদি আমাকে স্বর্গে কর্মরত করতে না চান, তাতে দ্বিধা নেই৷ তবে আমার অনুরোধ আমায় অন্ততপক্ষে পৃথিবীর বুভুক্ষু হৃদয়ে ফেরাবেন না৷ ইতি…”
যাই হোক সুইসাইট নোটটা আমার মৃত্যুর অনেক আগেই লিখে ফেলেছি৷ জেনে গিয়েছি, হাজার বছরের জীবন-যাপনের ইতিহাসের পর যা কিছু স্মৃতি এবার সুইসাইডকেই বেছে নিতে বলছে!
ঝোলা বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকি—- যদি তুমি দ’রজার ধারে দাঁড়াও৷ বিরহ কাতর কাঠবেড়ালির মতো নিজের ফুসফুসকেও শান্ত করতে ব্যর্থ৷ রাজনৈতিক ব্যস্ততায় আমার বেকারত্ব লাভ৷ পারিবারিক ঋণ, দীনতার ছাপ—- এই সবই কিছু কিছু বিবরণ ও তার কারণ সুইসাইট নোটে এঁটে দিয়েছি৷
ব্লেড দিয়ে নয়৷ বিষ পান করে নয়৷ শুধু জ্বলন্ত বুকে বিষাদের সিগারেট ও মদ ছুঁয়েই গাঙ্গেয় পার হয়ে স্বর্গের দ্বারে পৌঁছাব৷ তুমি খুঁজলেও আর অচিন পাখির খোঁজ পাবে না৷

মা ও বাবার দুঃখটা আমি অনুভব করতে পারছি৷ শুধু এটাই ব্যর্থতা৷ তোমার আর কিছু জানার থাকলে আমার সুইসাইট নোটটা খুলে দেখো…🍁

 

 

পুনর্জন্ম

 

 

পাখিটিকে আমি দেখতে পাই প্রভাতে তন্ময়তায়৷ আমার মামার বাড়ির দোতলায় ঘরের জানালার কাঁচে ঠক ঠক করে ঠোকর মারত৷ সে আসত দু’টি সময়— এক প্রভাত বেলায় আমার ঘুম ভাঙাতে আর বৈকালের ক্লান্তি কাটাতে৷ সেই একই ভাবে, একই নজরে৷
আমি ভাবতাম সে কি কিছু বলতে চাই আমাকে? পাখিটিকে দেখে আমি অনুমান করতে পারি এটি মহিলা পাখি৷ তবে তার কোনো সঙ্গী বা সাথী ছিল না৷
এই ছোট্ট পাখিটিকে দেখে আমার মনে মায়া জাগত৷ আমি মনে মনে ভাবতাম, সবুজ পালকের আবেশ জড়ানো ঐ পাখিটির সঙ্গে আমার যেন যুগ যুগ আগেকার সম্পর্ক রয়েছে৷ সম্পর্কটি ভালোবাসার সম্পর্ক৷
হাজার বছরের পুরনো অতীত ইতিহাস ঘেঁটে সেদিন দেখেছিলাম, কল্পনার আরব্য রজনী৷ সেখানে একটি পুরুষ পাখি আর একটি স্ত্রী পাখি ছিল৷ বাকিটা আপনাদের জানা…
আমি ভাবতেই পারিনি পুনর্জন্মটা কি এই ভাবে ঘটতে পারে? হায়! বাস্তব বড় কঠিন জিনিস…🍁

 

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ১৮

 

 

আধুনিক সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের কাহিনী ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে প্রফেসর হাই বিবৃত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অপবাদ থেকে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও ইসলামি সাহিত্য রচনার সাড়া পড়ে যায়। এই ইসলামি সাহিত্যের বিস্তৃত তথ্য প্রফেসর হাই এই গ্রন্থে দিয়েছেন যা এযাবৎকালে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অলভ্য ছিল। আলোচনার সুবিধার জন্য ইসলামি সাহিত্যকে তিনি পাঁচ ভাগ করে আলোচনা করেছেন।
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ১৮।

 

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি 

 

 

 

 

১৮

ঊনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজা রামমোহন রায় যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, পরে সেটি রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ- বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবন আন্দোলনে পর্যবসিত হয়।

 

“পূর্ব পাকিস্তানের নব্য মুসলিম বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি হিন্দুদের কথা। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও মানবতার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে, অফুরন্ত সৃষ্টি প্রেরণা নিয়ে বাঙালি হিন্দু সেদিন যে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে, হিন্দু পটভূমিকায় রচিত হলেও তা হয়েছে বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য। যে মুক্ত জীবনকল্পনা মুসলমানকে পাকিস্তান রচনায় দুরন্ত ও উন্মত্ত করে তুলেছিল, প্রতীচীর নবতম আলোকে সৃষ্টিপাগল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি হিন্দুর মতোই মক্তিপাগল আজকের এই বাঙালি মুসলমান জাতিও তেমনি তার বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করবে।”

 

ইংরেজ অধিকারের পরেই হিন্দুরা যেমন ইংরেজি শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করে নতুন রাজশক্তির স্নেহচ্ছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল, মুসলমানরা তেমনি ইংরেজি শিক্ষা বর্জন করে বেঁচে থাকার সংকল্প নিল। ফলে প্রতিযোগিতায় তারা অনেকটাই পিছিয়ে গেল। আর ঊনবিংশ শতকে বাংলাদেশের যে আন্দোলন হলো তা প্রধানত হিন্দু আন্দোলন। ফলে মুসলমান একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। ধর্মে ও কর্মে হিন্দু-মুসলমান দুটো পৃথক সংস্কৃতি গড়ে উঠতে লাগল। যার ফলশ্রুতিতে দেশ ভাগ হয়ে গেল। ধর্মের গোঁড়ামিকে হাই সাহেব একেবারেই প্রশ্রয় দেননি। ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও ধর্মের উদার ভিত্তিভূমিতে পাকিস্তান সঞ্জীবিত হোক, যেমন একদিন বৈপ্লবিক উদারতার দ্বারা ইসলাম মানবসভ্যতার ইতিহাসে অমর কীর্তি রেখে গেছে, তারই প্রাণস্পর্শে পাকিস্তান অবগাহন করুক, এটাই তাঁর চাওয়া ছিল। তিনি বলেছেন—
“যে শক্তিতে ইসলাম একদিন পৃথিবীতে বিদ্যুৎগতিতে বিস্তারিত হয়েছিল, পাকিস্তানের মুসলমানেরা সেই শক্তিতেই পাকিস্তানে সত্যকার দারুল ইসলামে পরিণত করুক। পাকিস্তানে খাঁটি ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক। তার বৈপ্লবিক রূপ ফিরে আসুক। পাকিস্তান থেকে ইসলামের বিলম্বিত রেনেসাঁর শুরু হোক। যুদ্ধ-জর্জরিত পৃথিবীতে মজলুম মানবতা ইসলামের আদি স্বরূপে অবগাহন করে শান্ত হয়ে উঠুক” (ইসলামের বৈপ্লবিক ভূমিকাঃ সাহিত্য ও সংস্কৃতি পৃ. ১৪১)।

কোনও জাতি জেগে উঠে নিজস্ব ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক চেতনার মাধ্যমে নিজস্ব ঐতিহ্যের কর্ষণ না করলে, তার অতীত কেমন ছিল তা না জানলে সে জাতি পুনরুজ্জীবিত হয় না। উনিশ শতকের নবজাগরণের আন্দোলনে হিন্দু জাতির উত্থান তার বড় প্রমাণ। প্রফেসর হাইও চেয়েছেন অতীতের মহান ঐতিহ্যচেতনায় মুসলমানও জেগে উঠুক। তার মতে—
“জাতীয় জীবনে উত্থান ও পতন আছে স্বীকার করি। কিন্তু এও মানতে হবে যে পতন থেকে অভ্যুদয়ের পথে এগুতে তার সাহিত্যই তাকে প্রেরণা দেয়। সাহিত্য জাতির জীবনের আরসি। সুতরাং যে জাতির সাহিত্য নাই তার আর রয়েছে কী?”

এখানে তাঁকে ভুল বোঝার অবকাশ থাকতে পারে। মনে হতে পারে, তিনি সাহিত্যকেও ইসলামের কলমা পড়িয়ে নিতে চান। কিন্তু তা নয়। তিনি বলতে চেয়েছেন, হিন্দুর রামায়ণ, মহাভারত পুরাণ ও গীতা উপনিষদ যেমন তার সাহিত্যের অফুরন্ত উৎস হয়ে রয়েছে এবং হিন্দু সেই অফুরন্ত সম্ভার থেকে ভাবসম্পদ আহরণ করে তার নবযুগের সাহিত্যকে বিরাট মহনীয়তা দান করেছে, মুসলমানদের সাহিত্যও তেমনি কোরআন ও মুসলমানী উপকথার বিরাট বিরাট চত্বরের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হবে। এই সাহিত্যের দেহ ও মন হবে মুসলমানের কিন্তু আত্মা হবে সকল কালের সকল দেশের মানুষের। এককথায় সার্বজনীন অর্থাৎ বিশ্বের। যা-ই রচিত হোক না কেন, তাকে সাহিত্যের ও শিল্পের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হতে হবে। যথেষ্ট পড়াশোনা, নানা দেশের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, ভিন্ন মতাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং উদার মনোভাব সাহিত্যের ক্ষেত্রে বড় প্রয়োজন।
উনিশ শতকের বাংলাদেশের নবজাগরণে হিন্দু সাহিত্যিকদের সাহিত্যসৃষ্টির উন্মাদনা থেকে অনুপ্রেরণা নেবার কথা তিনি বলেছেন—
“পূর্ব পাকিস্তানের নব্য মুসলিম বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করতে গিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি হিন্দুদের কথা। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও মানবতার আদর্শে দীক্ষিত হয়ে, অফুরন্ত সৃষ্টি প্রেরণা নিয়ে বাঙালি হিন্দু সেদিন যে বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টি করেছে, হিন্দু পটভূমিকায় রচিত হলেও তা হয়েছে বাংলা ও বাঙালির সাহিত্য। যে মুক্ত জীবনকল্পনা মুসলমানকে পাকিস্তান রচনায় দুরন্ত ও উন্মত্ত করে তুলেছিল, প্রতীচীর নবতম আলোকে সৃষ্টিপাগল ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি হিন্দুর মতোই মক্তিপাগল আজকের এই বাঙালি মুসলমান জাতিও তেমনি তার বাংলা সাহিত্য সৃষ্টি করবে।”

পূর্ববঙ্গে এইভাবে সাহিত্যের মধ্যে সে জাতীয় ঐতিহ্যকে খুঁজে পেয়েছিল বলে পূর্ব পাকিস্তান আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে।
বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের ভূমিকা কি ছিল সেই ইতিহাস প্রফেসর হাই তুলে ধরেছেন তাঁর ‘বাংলাদেশের মুসলিম অধিকারের যুগ ও বাংলা সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধে। বাংলা সাহিত্যে মুসলমানরা যে যুগান্তর এনেছিলেন সেই ঐতিহ্যের ধারকরূপে ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পায়। আধুনিক সাহিত্যে মুসলমানদের অবদানের কাহিনী ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে প্রফেসর হাই বিবৃত করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর অপবাদ থেকে ইংরেজি শিক্ষিত মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও ইসলামি সাহিত্য রচনার সাড়া পড়ে যায়। এই ইসলামি সাহিত্যের বিস্তৃত তথ্য প্রফেসর হাই এই গ্রন্থে দিয়েছেন যা এযাবৎকালে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অলভ্য ছিল। আলোচনার সুবিধার জন্য ইসলামি সাহিত্যকে তিনি পাঁচ ভাগ করে আলোচনা করেছেন। সেগুলো হল—
ক. ইসলামী ইতিহাস ও তামাদ্দুনমূলক রচনা।
খ. ইসলামের মর্মব্যাখ্যা, তাসাওওফ, ইসলামী নীতি ও সমাজ জীবন।
গ. পবিত্র কোরআনের অনুবাদ ও মর্মবাণী সংকলন।
ঘ. হযরত মোহাম্মদ (দঃ), সাহাবী এবং অন্যান্য পীর পয়গম্বরদের জীবনী ও বাণী।
ঙ. কারবালা সংক্রান্ত সাহিত্য।

এসব বইয়ের মাঝখানে তাঁর লঘু ও হালকা মেজাজের বই “তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা” বের হয় ১৯৫৯ -এর ডিসেম্বরে। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য, ভাষা ইত্যাদি প্রসঙ্গের ওপর রসসিক্ত আলোচনা করেছেন তিনি এই বই -এ। লঘুচালে গুরু কথা তাঁর লেখার গুণে পাঠকের বিন্দুমাত্র বিরক্তির উদ্রেক করে না। এই বইয়ের কিছু প্রবন্ধ যেমন ‘ওরা ও আমরা’, ‘মহাভয় ও মহৎ গুণ’, ‘বেসুর’ যথাক্রমে অধ্যাপক ছদ্মনামে মাসিক মোহাম্মদীর চৈত্র ১৩৫৩, শ্রাবণ ১৩৫৪, আশ্বিন ১৩৫৪ সংখ্যায় বেরোয়। ‘ওরা ও আমরা’ রচনাটি ভারতে হিন্দু-মুসলমান ধর্মসংস্কৃতির ঘাত-প্রতিঘাত, মিল-অমিলের ইতিহাস প্রমথ চৌধুরীর ‘আমরা ও’ অনুকরণে রচিত হয়। এই রচনাটি যখন মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় বের হয় তখন তার জবাবস্বরূপ শনিবারের চিঠি ১৩৫৩ চৈত্র সংখ্যায় সংবাদ সাহিত্য বিভাগে বেতালভট্ট ‘তোমরা ও আমরা’ নামে একটি রচনা প্রকাশ করেন।
বাংলা সাহিত্যের পরম রমণীয় গ্রন্থরূপে “তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা” স্মরণীয় হয়ে আছে আজও। আর শুধু রমণীয়তার জন্যে নয়, রমণীয়তার সঙ্গে করণীয় সাহিত্যতত্ত্বের সংমিশ্রণ প্রফেসর হাইয়ের এই বইটিকে দিয়েছে এক স্নিগ্ধ ঔজ্জ্বল্য, যা আজও সমৃদ্ধ করে আমাদের। 🍁(ক্রমশঃ)

 

 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনীলেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান।-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

সম্পাদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা ও ফিরেপড়া কবিতা বিভাগে প্রকাশিত কবিতা অন্তর্জাল থেকে সংকলিত 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment