Sasraya News

Saturday, March 15, 2025

Itu Brata : ইতু ব্রতের কথা…

Listen

হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় : উ-লু- লু- লু- লু- লু- ! আর শঙ্খধ্বনির জোরালো সুর আকাশে বাতাসে, হেমন্তের আকাশ থেকে নিম্নচাপের চাদরটা সরে যেতেই জাঁকিয়ে শীতের আমেজ। ইতু ঠাকুরুনের আজ স্পেশাল পুজো (Itu Brata /Itu Puja)। কাকভোরে মাটির উঠোন নিকিয়ে চুকিয়ে তকতকে। গোবর লালমাটি সহযোগে খড়ের নুড়ো দিয়ে মাড়ুলির সজ্জা। চারপাশে দুধসাদা বাহারি আল্পনা। শঙ্খলতা, খুন্তিলতা, চালতেলতার চিত্তির, লক্ষ্মীর প্যাঁজ, আর ফুলকারি নক্সা। শিশির ভেজা তুলসিতলা, ওখানেই পাতা হয় ইতুর আটন। একটা মাটির সরা বা মালসায় একতাল মাটি। তাতে ধান কচু মান, হলুদ গাছ। পাঁচকলাই ছড়ানো অংকুর। কোথাও বা খাড়া কঞ্চির উপর ঝুলছে ধানের শিস্। একখানি মাটির পিদিম জ্বলছে মৃদু আলো ছড়িয়ে। ইতুর ঘটে সিঁদুর দিয়ে পুতুল আঁকা। ঘটের কানায় কানায় জড়ানো কলমি আর শুশনির দলদাম। পাড়ার গিন্নীরা সকলেই স্নান করে শুদ্ধ কাপড় পরে তৈরি। ইতু পুজো নিয়ে আসতেন আমার জ্যেঠুর বাড়িতে ‌।পুজো শেষে মহিলারা গোল হয়ে হাতে আলচাল আর দূর্বা নিয়ে শুনতে বসতেন ব্রতকথা। আমার জ্যেঠাইমা (বামুন‌ গিন্নী) সুর করে বলতেন ইতু ব্রত কথা। অবাক হয়ে শুনতাম…

অষ্টচাল অষ্টদূর্বা কলসপত্র ধরে। 
ইতুকথা একমনে শুন প্রাণভরে।।
ইতু দেন বর,
ধনে জনে বাড়ুক ঘর।।

 

 

 

 

এই ব্রতের প্রচলিত কাহিনী হল-

এক দেশে এক গরিব ব্রাহ্মণ বাস করতেন। বামুনের অভাবের সংসার তবু একদিন তার পিঠে খাবার বড় সাধ জাগে। গিন্নীকে চালগুড়ো, নারকেল, তেল, গুড় জোগাড় করে এনে বামনিকে পিঠে ভাজার আদেশ দিয়ে রান্নাঘরের পেছনে চুপ করে লুকিয়ে থাকেন। একটা করে পিঠে ভাজা হলে একটি দড়িতে গিঁট মারতে থাকেন। এরপর খাওয়ার সময় উপস্থিত হলে দুটো পিঠে কম হয়। বামুন ভয়ানক রেগে গিয়ে বলেন,  আর দুটো পিঠে কোথায়? এরপর জানতে‌ পারেন তার দুই মেয়ে দুটো পিঠে খেয়ে ফেলে। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তৎক্ষণাৎ বামুন ওই মেয়ে‌ দু’টিকে‌ মাসির বাড়ি দিয়ে আসার নাম করে জঙ্গলে ছেড়ে চলে আসেন। ভীত দুই বোন পথ চলতে চলতে গৃহস্থের বাড়ির সন্ধান পেয়ে ওখানে ইতু পুজো করে। দেবতা সন্তুষ্ট হলে তারা পিতার বাড়িতে ধন এবং পুত্র কামনা করে। কিন্তু ধন প্রাপ্তিতে মাতা সুখী হতে পারেন না অবশেষে দুই মেয়ে বাড়ি ফিরে এলে সমস্ত ঘটনা জেনে সংসারে সুখ শান্তি ফিরে আসে।

 

 

 

 

এই ইতুপুজো রাঢ় অঞ্চলে ইবতি নামে পূজিতা হন। পূর্ববঙ্গের মানুষ এর নামকরণ করেছেন চুঙীর ব্রত। ইনি কোনো অঞ্চলের লৌকিক দেবী নন। মূলতঃ ইতু হলেন শস্য দেবীর অন্যতম রূপ। তাছাড়া বৈদিক মতে ভগবান সূর্য নারায়ণের পত্নী দেবী ঊষাই শ্রী রূপে পূজিতা হতেন। সূর্যের অপর নাম মিত্র। এই অগ্রহায়ণ মাসে সূর্যের নাম হয় মিত্র বা রবি। এই‌ কারণেই অগ্রহায়ণ মাসে রবিবারে ইতুর পুজো হয়। প্রাচীন পারস্যদেশে একসময় মিথু পুজো হতো।

 

মিত্র -মিতু- ইতু… 

 

বর্তমানে এসব ব্রতকথা বিলুপ্তপ্রায়। তবু এই কথাগুলো অনেক বেশি শিক্ষণীয়। যেমন দড়িতে গিঁট বেঁধে মনে‌ রাখার প্রথা প্রাচীন গ্রন্থ লিপিকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পেরু, পলেনেশিয়া এমনকি প্রাচীন চীনেও এই লিপির প্রচলন ছিল। এর নাম কুইপান বা কুইপু লিপি।

আরও একটি বিষয় বীজ থেকে অঙ্কুরোদগমের সহজ পাঠের অনুশীলন। জলে ভেজালেই বীজ অঙ্কুরিত হয়ে ফসল দেয় না, তারজন্য মাটি, মাটির -সরসতা সৃষ্টি হয় জল দিয়ে। এর থেকে বীজ রসদ পায়, অঙ্কুরিত হয়, তারপর বড় হয়ে মাটির উপরে উঠে এলে তার আলোবাতাসের প্রয়োজন হয়।একে সহজ কৃষিপাঠ বলা যেতেই পারে।

আজ আমিও ইতুপুজো করেছি, তবে আমার শ্বশুর বাড়িতে আজ নবান্নের উৎসব এবং বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে ভোগ নিবেদন করা হয়। আগে কখনও এসব কাজ করতে হয়নি, মামনি সামলে নিতেন। তার মতো গুছিয়ে কতোটা পারি জানি না! তবে আশৈশব গায়েত্রী মন্ত্র উচ্চারণে ঘুম ‌ভাঙতো, পুজোটা কেউ শিখিয়ে দেয়নি হাতে ধরে, টলমল হাতে ঠাকুরের কাজ করা কখন রক্ত মিশে গিয়েছিল জন্মসূত্রেই। স্নান শেষে আপন মনেই মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ে আদ্যাস্তোত্রম্ , নবগ্রহস্তোত্রম্, আপদউদ্ধার স্তোত্রম্। সেই সূত্রের হাত ধরেই… আজ।

 

 

 

তবে আমি সহজসরল ব্যাখ্যা করেছি এই নবান্নের।  শহরের মতো গ্রামাঞ্চলে এতো আনন্দ বা বিনোদনের কোনো ক্ষেত্র নেই তাই গ্রাম বাংলার মানুষের কাছে এ এক খুশির উৎসব, শিক্ষারও বটে। তোমার যা কিছু নতুন ফসল তোমার যা কিছু আনন্দ সকলের তরে বিলিয়ে দাও, আজ আর একটা কথা বড় মনে পড়ছে আমাদের মধ্যে অনেক মেয়েই ইতু পুজো করতো হস্টেলে। আমি অবশ্যই একবার করেছিলাম তবে ওটা ছিল স্বাদ পাল্টানোর ভক্তি। রোজ রোজ ওই এক‌‌ খাবার থেকে মুক্তি পেতে একদিন ওই লুচির লোভে উপোস… হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ! তবে আমাদের ‌ হস্টেলে নবান্নের উৎসব হতো আর যতো মানুষ আসতো তাদের মাটির খুড়িতে করে প্রসাদ বিতরণ করতাম আমরা ভারি আনন্দের ছিল সে দিনগুলো।

অনেক মানুষ আমাকে প্রশ্ন করেছেন আপনি লেখালেখি করেন সমাজের বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিবাদ করেন কিন্তু পুজো , উপোস এগুলো কেন করেন বুঝিনা মানে ‘মানুষ’ আপনি কি ধর্মভীরু? উত্তরে মুচকি হেসে বলি আমি আদতে কি সেটা আমার মন জানে কিন্তু কারুর সংস্কারে আঘাত করে নিজেকে জাহির করার মধ্যে কোনো মহত্ব আছে কি না আমার জানা নেই। এটাই আমার আশৈশবের শিক্ষা। যেখানে ধর্ম মানুষের ক্ষতি করে না সেখানে ধর্মের অবমাননা করার দরকার কি? প্রতিবাদ তখন করা উচিত যখন ধর্ম কে শিখন্ডি করে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা হয়।🍁

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s literature Special | 15th December 2024 | Issue 43 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৩

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment