



‘পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা’ -এর একাদশ পর্ব। কলম ধরলেন বাংলার রাজ্য রাজনীতি নিয়ে সাশ্রয় নিউজ এর পক্ষে প্রতিবেদক অগ্নি প্রতাপ
১০২১-১০২৩ খ্রীস্টাব্দে রাজা রাজেন্দ্র ঢোলের আক্রমণের পর তাম্রলিপ্ত সাম্রাজ্যের পতন হয়। এরপর ১১৩৫ খ্রীস্টাব্দে রাজা অনন্ত বর্মন মেদিনীপুরে তৎকালীন মিধুনপুর দখল নেন। প্রবাদ প্রতীম ইতিহাস প্রণেতা যোগেশচন্দ্র বসুর “বসুবংশ” গুরুত্বপূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রায় ১১৩ বছর পর উদ্ধার করলেন ইতিহাস গবেষক সন্তু জানা।
ব্রিটিশ আমলে একাধিক কৃষক বিদ্রোহ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এই মেদিনীপুর। এই মেদিনীপুরের মাটিতেই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং অনেক বিপ্লবী ও মহর্ষিদের জন্ম হয়েছিল। তাই মেদিনীপুরে মাটিকে বলা হয় সংগ্রামী মাটি।
পূর্ব মেদিনীপুরে বিখ্যাত জায়গাগুলি হল দীঘা,মন্দারমনি, তাজপুর, জগন্নাথ মন্দির, মহাপ্রভু মন্দির আরও অনেক পর্যটনের জন্য বিখ্যাত।
১ জানুয়ারি ২০০২ সালে মেদিনীপুর জেলা দু’টি ভাগে ভাগ করা হয় : ১) পূর্ব মেদিনীপুর, ও ২) পশ্চিম মেদিনীপুর।
২০০৭ সালে ১৪ ই মার্চ সশস্ত্র পুলিশ ও সিপিআই (এম) ক্যাডার বাহিনী সম্মিলিতভাবে অপারেশন চালায় নন্দীগ্রামে। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তখন মাননীয় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মহাশয়। ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলে। এই বাহিনী সামনের সারিতে ছিলেন মহিলা ও শিশুরা। পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় ১৪ জন গ্রামবাসী প্রাণহারান।
এই ঘটনায় সবাই হতবাক হয়ে যান। পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষ প্রতিবাদে এবং ধিক্কারে গর্জে ওঠে। যুগান্তকারী ৩৪ বছর সরকারের ভীত নাড়িয়ে দেয় নন্দীগ্রাম গণহত্যা আন্দোলন। পরিবর্তনের আন্দোলন এখান থেকেই বামফ্রন্ট সরকারের কফিনে পেরেক পড়ে যায়।
মূলত শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলতে থাকে। এই আন্দোলনের ভয়াবহতা এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে ছিল সিপিএমের ক্যাডার বাহিনী চেক পোষ্ট বানিয়ে সাংবাদিকদের পর্যন্ত প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবী করা হয় বলে উল্লেখ। তা বামফ্রন্টের অন্যতম শরিক পূর্ত মন্ত্রী ক্ষীতি গোস্বামী ৫০ টি দেহ যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তা তিনি স্বীকার করেছিলেন কিন্তু তাদের মধ্যে মৃত সংখ্যা বলতে পারেননি।
আবার নন্দীগ্রাম অশান্ত হয়ে ওঠে ২৯ এপ্রিল। বুদ্ধিজীবীদের এক অংশ ত্রাণ সামগ্রী বন্টন করে ফেরার সময় সিপিআই (এম) ক্যাডারদের হাতে আক্রান্ত হন। পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন বেশে কখনও গামছা বা অন্য কাপড় দিয়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় হাতে বন্দুক নিয়ে নির্দ্বিধায় গুলি চালানোর ঘটনাও সামনে আসে।
নন্দীগ্রামে এই গণহত্যায় কেন্দ্রীয় সংস্থা ঘটনাস্থল থেকে যে বুলেট গুলি উদ্ধার করেছিলেন তা পুলিশের ব্যবহার্য ছিল না। একমাত্র অপরাধ জগতেই সেই বুলেট ব্যবহার হতো। ৩০০ জন মহিলা এবং মেয়েকে শীলতাহানি ও ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে সিপিআইএম ক্যাডারের বিরুদ্ধে।
নন্দীগ্রাম হত্যাকাণ্ডে নাম জড়ায় তৎকালীন সিপিআইএম সাংসদ লক্ষণ শেঠের। অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্তে সিপিআই (এম)-এর তপন ও শুকুর গ্রেপ্তার হন। সিপিআই (এম) দলের পক্ষ থেকে তপন ও শুকুরকে দলের সম্পদ বলে দাবি করা হয়। বিরোধী এবং বুদ্ধিজীবীদের একটা অংশ পথে নেমে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের কাণ্ডারী মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তমলুক কেন্দ্র থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিআইএম প্রার্থী লক্ষণশেঠকে ১,৭২,৯৫৮ ভোটের বিপুল মার্জিন এ পরাজিত করেন। এবং ২০১৪ সালে তমলুক লোকসভা নির্বাচনে পুনরায় জয়যুক্ত হন ২,৪৬,৪৮১ বিপুল ভোটে। ২০১১ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠন করে। ২০১৬ সালে লোকসভা থেকে পদত্যাগ করায় তমলুক কেন্দ্রে উপ নির্বাচনে মাননীয় দিব্যেন্দু অধিকারীকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী করেন এবং বিজয়ী হন। ২০১৯ সালে তমলুক লোকসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী মাননীয় দিব্যেন্দু অধিকারী মহাশয় পুনরায় জয় লাভ করেন ৫০.০৮ শতাংশ ভোট পেয়ে।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার নির্বাচনের আগে মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী, তৃণমূল কংগ্রেস দল ত্যাগ করেন এবং বিজেপিতে যোগদান করেন। তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো তথা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রার্থী হলে মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী মহাশয় বিজেপি প্রার্থী হয়ে সেই চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করেন। আর নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্রে মাননীয়ার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ঐতিহাসিক জয় পান ১৯৫৬ ভোটে। ভোটের হার ছিল ৪৮.৪৯ শতাংশ।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী নন্দীগ্রাম গণহত্যা আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বর্তমান বিরোধী দলনেতা মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী মহাশয়কে নিশানা করে হত্যাকাণ্ডের দায়ে বেনজির আক্রমণ করেন। এই আক্রমণের ওপর বিরোধীরা প্রশ্ন করতে থাকেন-
১) তৎকালীন সময়ে বর্তমান বিরোধী দলনেতা তৃণমূল কংগ্রেসকে নেতৃত্ব দিতেন। তাহলে এতদিন কেন চুপ করে তিনি বসে থাকলেন?
২) ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর কেন তিনি কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন না?
৩) তাহলে এই হত্যাকাণ্ডে লাভবান কারা?
বর্তমানে শাসক নিয়োগ দুর্নীতি থেকে, কয়লা, গরু পাচার, রেশন দুর্নীতি সমস্ত কিছুতে নাম জড়িয়েছে চলছে তদন্ত। তার মাঝে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতের মতো ফেটে পড়েছে সন্দেশখালি ঘটনা, যা সমস্ত দেশবাসীর কাছে একটা লজ্জা।
একদা কেশপুরকে নিয়ে এই তৃণমূল কংগ্রেস শাসক বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে বারংবার সন্ত্রাসের অভিযোগ করে এসেছেন। সরকার বদল হয়েছে বদল হয়নি শুধু কেশপুর। আজও কেশপুর নিয়ে সমস্ত বিরোধীরা বারংবার লাগাতার সন্ত্রাসের অভিযোগ করেই যাচ্ছেন। তখন থেকে এখনও পর্যন্ত কেশপুরে হয়ে চলেছে মৃত্যু মিছিল।
এই মেদিনীপুরকে অধিকারী গড় বলা হয়ে থাকে। শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে আজকে এই গড় হচ্ছে তাদের কাছে প্রেস্টিজ ফাইট।
৫ মার্চ ২০২৪ হাইকোর্টের বিচারক পদ থেকে অভিজিৎ গাঙ্গুলী পদত্যাগ করেন। এবং বিরোধী দলনেতা মাননীয় শুভেন্দু অধিকারী ও বিজেপি রাজ্য সভাপতি ডক্টর সুকান্ত মজুমদারের হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করেন।
২০২৪ তমলুক লোকসভা আসন থেকে বিজেপি পদপ্রার্থী প্রাক্তন বিচারক মাননীয় অভিজিৎ গাঙ্গুলী মহাশয়। মাননীয় গাঙ্গুলী মহাশয় তিনি বিচারক থাকাকালীন নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় বহু গুরুত্বপূর্ণ রায়দান করেছেন। তার রায়দানের ফলে কেঁপে গেছে শাসকের ভীত। জনসমক্ষে চলে এসেছে অনেক আসল তথ্য।
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ৮
বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়ের দিনে প্রাক্তন বিচারক মাননীয় অভিজিৎ গাঙ্গুলী মহাশয়ের মত ব্যক্তিত্ব রাজনীতিতে আসা এক নতুন দিশা দেখাবে। কারণ বর্তমান রাজনীতিতে দূর্বৃত্তে ভরে গেছে। উনিই প্রথম সমস্ত ন্যায় প্রার্থীদের নতুন আশার আলো দেখান এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর হারিয়ে যাওয়া আস্থা ফিরিয়ে দেন। এর জন্য বারংবার তাকে শাসকের রক্ত চক্ষুর সামনে পড়তে হয়েছে এবং হচ্ছে। তিনি হচ্ছেন শাসকের জন্য “অশনি সংকেত”।
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ দীপক অধিকারী ওরফে দেব গরু পাচার মামলায় অবৈধভাবে টাকা ও দামি উপহার নেওয়া তিনি অভিযুক্ত এবং উনার আপ্তসহায়ক এর বিরুদ্ধে নিয়োগ দুর্নীতিতে নাম জড়িয়েছে। দেখতে দেখতে ভোট আসে যায় আর ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান পড়ে থাকে অবহেলায়।
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ৯
ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে জঙ্গলমহল। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম জেলার অন্তর্গত অঞ্চলটি এক কথায় জঙ্গলমহল বলে পরিচিত।
লালগড় আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে জঙ্গলমহলের কথা। জঙ্গলমহল মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অস্তিত্ব থাকায় তাদের প্রতি যে দায়বদ্ধতা সরকারের ছিল বা আছে পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায় হিসেবে যে ধরনের সুযোগ সুবিধা অনুদান পাওয়ার কথা, সেই দিক থেকে তারা অনেকটাই বঞ্চিত।
২০১১ সালে ২৩ টি ব্লককে নোটিফিকেশনের মাধ্যমে জঙ্গলমহল সিলমোহর দেওয়া হয়। এক সময় সমস্ত জায়গায় জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের আস্তানা ছিল।
এই আসনটি তপশিলি উপজাতি সংরক্ষিত।
গত ২৫ মে ২০২৪ ষষ্ঠ দফা লোকসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হল, মেদিনীপুরের চারটির মধ্যে ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র শুধু মাত্র ৫০-৫০। তমলুক, কাঁথি, মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম এর একটি লোকসভা কেন্দ্র থেকে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীদের জয়ী হবার সম্ভাবনা প্রবল।
এখানকার সব নির্বাচন কেন্দ্রে মূলত লড়াই হবে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে। তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী প্রাক্তন বিচারক মাননীয় অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় মহাশয়।
তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দেবাংশু ভট্টাচার্য। কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী সৌমেন্দু অধিকারী। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী উত্তম বারিক। মেদিনীপুর লোকসভা কেন্দ্র বিজেপি প্রার্থী অগ্নিমিত্রা পাল। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী জুন মালিয়া।
ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী ডক্টর হিরন ময় চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী দীপক অধিকারী (দেব)। ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রার্থী ডাক্তার প্রণত টুডু। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী কালিপদ সোরেন।
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Loksabha Election 2024 : পশ্চিমবঙ্গের ভোট রাজনীতির কড়চা ১০
