



সম্পাদকীয়
বসন্তর শেষ। কোকিলের কুহুতান, অথবা আম্রমুকুলের ঘ্রাণ, পলাশ ও শিমুলের ফাগুনজোড়া মোহময়ী তেজ হারিয়ে যাচ্ছে। বছরের শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে। ভুল করেও এটি ইংরেজি মাস ধরবেন না। আসলে যে মাসটির কথা আমরা বলছি সেটি বাঙলা ক্যালেন্ডারের শেষ মাস। এই মাসেই দোলের আনন্দ দিয়েই শেষ করে নতুন বছরের আনন্দকে আহ্বান করা হয়।
গাছেদের যেমন পাতা-ফুল-ফল ঝরে যায়, তারাও সেগুলি ধরে রাখতে পারে না। এই দৃশ্য দেখার পরে প্রতিটি মনেই প্রশ্ন জাগে, কৌতুহল জাগে যে, গাছ এভাবেই কেন বসন্তে পাতা ফেলে দেয়! এই কৌতুহলের শেষ নেই। বিজ্ঞান বিজ্ঞানের মতো বলে, প্রকৃতি তাঁর নিয়মেই চলে। প্রকৃতির নিয়মকে খণ্ডন করবার ক্ষমতা বিজ্ঞানের নেই বলেই আমার ধারণা। তাহলে প্রকৃতির মায়া-বশে এই নিয়ম ঘটে আসছে। তাহলে মানুষও প্রকৃতির থেকে সৃষ্টি। তাঁর মায়াতেও শরীর (স্থূল শরীর) এবং মন, প্রাণকে আলাদা করে দিয়েছে। সেই অর্থেই আমরা বলতে পারি একে-অপরের মনের সঙ্গে মিল নেই। যেমন তোমার সঙ্গে আমার, মায়ের সঙ্গে সন্তানের, স্বামীর সঙ্গে স্ত্রী’র। প্রেমীকের সঙ্গে প্রেমিকার ইত্যাদি। কোনও একটি বিষয় নিয়ে স্বামী-স্ত্রী’য়ের মধ্যে কোথাও না কোথাও মনোমালিন্য থাকে কোনও একটি বিষয় নিয়ে মার সঙ্গে সন্তানের বা বাবা’র সঙ্গে সন্তানের-। মন নিজের নিজের ভেতরেই সঠিক কাজে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থেকে যায়। তাহলে অপর মনের সঙ্গে কীভাবে আ’রেকটি মন মিলে যাবে! এখানে মনকে ধরার কৌশল ইচ্ছেশক্তি দ্বারা যদি কেউ ধীর গতিতে এগিয়ে যায় তাহলে মনকে একদিন নিশ্চয় ধরতে পারবে। আর এই মন ধরার সঙ্গে সঙ্গে স্থূল জগতের মায়া কেটে উঠবে।
তাহলে ‘আমার’ শব্দটি এখানে রইল না। কারণ ‘আমি’-ই তো আমার নই! 🦋
🍁গদ্য
কুণাল কান্তি দে
নীরবতার ভাষা…
…পত্র পাঠের ব্যতিক্রমী বিষয় “নীরবতা “। ভাবনার গভীরে ডুব দিতেই ৪৫ বছর আগের স্মৃতি ভেসে উঠলো মনের ভিতর। নীরবতা জীবনের এক শক্তিশালী অস্ত্র। যার দ্বারা প্রভাবিত মানবকুল নূতন দর্শনে জারিত হন। কথা না বলে নীরব থাকা।
____________________________________________
আমি অভিনেতা হিসেবে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছি। হঠাৎ ঝড়ের মতো একদিন একেবারে মুখোমুখি প্রস্তাব নিয়ে : কর্ণ কুন্তী করতে চাই, একে একে কচ ও দেবযানী, ওথেলো, দেশদিমনর মতো একমঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে।
_____________________________________________
ভাষা বা শব্দের প্রয়োগ নয়। আচার হয়ত বা আচরণ দেখে আন্দাজ করতে পারেন একে অপরের মনোভাব। নচেৎ নয়। নীরব চোখের চাহনি বলে দেয় সব কথা। সেই ইশারায় ” দেবা ন জানোনতি কুতো মনুষয়া “। নীরবতা তাই পুরুষ রমণী’র কাছে আজও রহস্যময়। আহবান, প্রত্যাখ্যান, সম্মতি, ইতিবাচক এমনটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়ে। আমারও তাই হয়েছিল। সেই ঘটনায় আমি জেনেছিলাম, নারীর অন্যতম ভূষণ নীরবতা। অনন্তকালের মতো গভীর যার তল পাওয়া যায় না। স্পর্শ করা যায়। শুধু অনুভূতি। তবুও খুঁজে বেড়ায় পরশ পাথরের মতো। আজ নারীকে আমার বড় ভয় এড়িয়ে চলি : তবুও নারী আমার চারিপাশে উঁকি মারে। নইলে কেন তাঁকে সারাজীবনের মতো পেলাম ক’য়েক বছর কাছে পেয়েও। মুখোমুখি হয়েও তল না পেয়ে পরাজিত হয়েছি তাঁর নীরবতার কাছে। তখন কতই বা তাঁর বয়েস। ওর কুড়ি পেরিয়েছে আমার তখন তিরিশ ও হয়নি। আমাদের জনপদের অঞ্চলে বাচিক শিল্পী হিসেবে নাম যশ সেই নারীর, আমি অভিনেতা হিসেবে কিছুটা জনপ্রিয়তা পেয়েছি। হঠাৎ ঝড়ের মতো একদিন একেবারে মুখোমুখি প্রস্তাব নিয়ে : কর্ণ কুন্তী করতে চাই, একে একে কচ ও দেবযানী, ওথেলো, দেশদিমনর মতো একমঞ্চ থেকে অন্য মঞ্চে। যুগ্মভাবে রেওয়াজ, অনুশীলন করে প্রশংসাও জুটল। অথচ প্রয়োজনের বাইরে “নীরবতা” ছিল অলংকার। থই পেতাম না। সময় গড়িয়ে যেত। আমি কেমন যেন উদ্বিগ্ন হতাম। তিনি নির্বিকার “নীরবতায় ডুবে থাকতেন। তবুও আমাদের ময়ূরপঙ্খী তর তর করে এগিয়ে চলল। দু’জনের বাড়িতে ফিসফাস, জানাজানি পর্ব শেষে গুজব আমরা অমরত্বের পথে এগিয়ে যাচ্ছি কাউকে না জানিয়ে! সেই নদী ও বিশাল তেঁতুলগাছটা আজও আছে তাদের অস্তিত্ব নিয়ে। আমরা শুধু নেই। অকস্মাৎ আবিষ্কার করলাম প্রাচীনপন্থী অভিভাবকের দল বিরুদ্ধে গেছেন। সেই গাছটির নিচে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতাম দু’জনে। উনি নীরবতা সম্বল করে আমার পাশে। আমি নীরব দর্শক।
তারপর একদিন বাতাস কানে কানে বলে গেল “তোমাদের দু’জনের পথ তো আলাদা।” ফিরে যাও নিজের হয়ে।
…সময় এত গড়িয়ে গেছে খেয়াল করিনি। সত্তরটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে আজও খুঁজে চলেছি সেই নারীকে যার নীরবতার বন্ধ দরজা আজও খোলার আশায়। জানি না, আজ ও-কোন গোলার্ধে আছে! 🦋
🍁কবিতা /এক
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
অশ্লীল ২০০
দুর্বিনীত টিভির রাক্ষুসে খিদের এবার চোখ
পড়েছে কচিকাঁচাদের ওপর…
ঝালমলে ঝকঝকে ফ্লোর, চারদিকে উজ্জ্বল
আলোর ঝলমোলিয়া কারিকুরি,
আকাশচুম্বি উজ্জ্বল বিচারকগনের বাহা-বাহা
চিৎকারে উজ্জীবিত শিশুদের দঙ্গল,
উল্লাসে ফেটে পড়ছে দর্শক, ওখানে ওদের বাবা-মায়েরাও আছে,…
উদগ্রীয় মিউজিক, গান, হায় বেবি সেক্সিসেক্সি
চুমা দে দে চুমা…, আজকে রাতে মন্দ হলে ক্ষতি কি
স্তনহীন বুকে দুলে দুলে উঠছে আগামীর জোড়া স্তন
কচিহাঃ কচি কোমর পাছায় বয়স্ক ছন্দ
কচিকচি শিশুদের মুখে যৌনবান আর যৌনবতীদের উল্লাস, তীব্র, উল্লাস, শিস, জব্বর হাততালি, হুইক হুইক শিটি হাঃ
ঐ ওপর থেকে ঝুলে আছে লক্ষ লক্ষ টাকার গাজর
লোভ, গ্ল্যামারের বিমূর্ত থাবা…
বিজয়ীদের মুখ উজ্জ্বল হাসি, খুশিখুশি বাপ্-মা
পরাজিতের চোখে টপটপ নোনা জল গড়াতে গড়াতে পৌঁছে যাচ্ছে সুকুমার মনের আতলান্ত গভীরে
অনেক দিন পর,
ঐ সব কচিকাঁচাদের মুখগুলো খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখি, ওরা সবাই হারিয়ে গেছে কোথাও, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না…
কল্পনা মিত্র
স্ফুলিঙ্গের অবশিষ্ট আগুন
শেষবাড়িটির নাম বনলতা
আমাদের শ্যাওলা ঘাটে কালো ঝাঁজিরা
জলের ভেতর থেকে
যেমন উঁকি ঝুঁকি খেলে বনলতাও গাছের আড়াল সরিয়ে
অন্ধকার মেখে
তাকে আমি দেখেছি গাছকোমর শাড়িতে
ভিজে শরীর ঢেকে পায়ে পায়ে
পেরিয়ে যেতে পথ
ওয়াচটাওয়ারের আলোয়
ধরে রাখা হরিণীর ছবি আর সে মিলেমিশে
ঘেটুফুলরঙ শাড়ি পায়ের মল বাজিয়ে
শিকারির অব্যর্থ লক্ষ্যে সে আর আমি
মাঝখানে পোড়া কিছু বারুদের গন্ধ
সৌমিত বসু
জীবন এক আশ্চর্য দূরবীণ /১৫
সব ডাকা একদিন জড়ো হবে উঠোনে তোমার
সমস্ত চিঠি জেনো একদিন উড়ে যাবে গ্রামের ওপারে
রাত্রিদের ভাইবোন নেই
সাদা চুল বিধবারা তার দুই হাত ধরে চলে যায় আগুনের দিকে
দরজার পাশে থাকা বন্দুকের নল তাকে ডাকে
নদীর ওপার থেকে ছুড়ে দেওয়া ভোরের আলোয় তারা চিনে নেয় অজানা ছুরির বাঁট।
এখনো কথার ফাঁকে ধুলো ওড়ে,জঙ্গলের ধার ঘেঁষে যেসব জীবন, দুহাত বাড়িয়ে ডাকি চইচই।
গীতা চক্রবর্তী
জীর্ণ পাতার আর্তনাদ
একটা গান্ধর্বের প্রজাপতি এল ঝরাপাতার বিকেলে
সেখানে সাহিত্যের ডালি সাজিয়ে দিচ্ছিল লোভনীয় সম্ভার
যা কিছু সব সব উজাড় করে।
লালে লাল লাল হয়ে ফিরে যাওয়া বসন্ত মনোমুগ্ধ হল।
লালিমা বিভ্রান্ত সেও কিছু দিতে চাইল
কি দেবে ভেবে ভেবে সে চুঁইয়ে পড়া বসন্ত দিল।
সাহিত্যের মিষ্টি, ঝাল পছন্দের কিছু কবিতা বেশ মজার উপভোগ্যও।
ধীরে ধীরে উপাচার দ্রবীভূত হয়ে টক ঝাল মিষ্টি নিয়ে এল।
কয়েকটি কালবৈশাখী সুশীতল বাতাস নিয়ে আসে স্নিগ্ধ সকালের উঠোনে।
অথচ
সুশীতল বাতাস বহমান নতুন আঙ্গিকে সুর তাল ছন্দ কেটে যাচ্ছিল।
ভাস্কোডা গামা যে পথে আবিস্কার করেছিলেন
সেখানেই ভারতবর্ষ।
পৃথিবীটাও গোল ।
সেখানে পরিযায়ী সম্পর্ক বাসা বেঁধেছে ধীরে ধীরে গহীনে একে অপরের পরিপূরক।
জীর্ণপাতা পথ বিছিয়ে তখনও
একেকটা কালবৈশাখী পথ পরিষ্কার করে যায়।
তবুও
জীর্ণপাতার আর্তনাদ বাতাসে ভেসে আসছে,
তুমি অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছ।
ময়ূখ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘর
ঘরের ভিতর আর-একটা ঘর ঘর
যোনির মতন ভাসমান
আমি তাঁকে জন্মগৃহের মতন মানি।
ঘরটাকে আমি আভূমি লুণ্ঠিত প্রণাম করি।
প্রেমাংশু শ্রাবণ
তীর্থ
এক.
যা কিছু অশ্রু,
তা-ই মেঘের সন্তান।
সমস্ত শোকই কোমল গান্ধার,
ভিক্ষের দু’টি ধান শুদ্ধ স্বর-
যা কিছু বিরহ,
তা-ই সত্য-
বিরহে দাঁড়িয়েছে ঈশ্বর।
দুই.
এই যে দিগন্ত জুড়ে ধানের গান,
মালকোষ বিলম্বিত,
বাতাসে মিঠে সুবাস,ডুবেছে চরাচর।
যেদিকে তাকাই, সেদিকেই দেখি
ভাতের রান্নাঘর।
তিন.
দীর্ঘ কবিতার পথে
আম্রপালি গাছ,
ভালোবাসা-
দাম্পত্যের ‘অভিমান’
দু’জনে শুয়েছি পাশাপাশি,
নরম মাটির কাছে
এ মুখ দেখাব কী তোমাকে!
ফলে ফলে আমাদের ঠোঁট লেগে আছে।
🍁গল্প /এক
মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
এখানে আকাশ নীল
এক.
বাড়ি ফিরে জানলার লাগোয়া চাতালটায় মুখ গোঁজ করে বসল নীল। আজ তার মুড এক্কেবারে ঠিক নেই। এমনিতে নীল বুঝদার। শুধু এই একটা ব্যাপার কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ছেলের কাছে এসে চুপচাপ দাঁড়ায় অদিতি। মাথায় আলতো করে হাত রাখে। এক ঝটকায় হাত সরিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে নীল,
“আর কক্ষোনো আমাকে আকাশের বাড়ি নিয়ে যাবে না। আমার ভালো লাগে না!”
“অমন বলতে নেই বাবা! ভালো না লাগলেও যেতে হয়…”
চাতাল থেকে লাফিয়ে নেমে মুখ বেঁকিয়ে চিৎকার করে নীল,
“তুমি আমাকে একদম ভালোবাস না, তাই না? তোমার সব ভালোবাসা খালি আকাশের জন্য! দেখো ও-কীভাবে আমাকে কামড়ে দিয়েছে…”
কব্জির কাছটা লালচে হয়ে ফুলে উঠেছে। মলম লাগানোর পরেও দাঁতের দাগ এখনও পুরোপুরি মুছে যায়নি। বুকটা মুচড়ে উঠল অদিতির। সত্যিই আকাশটা আজ বড্ড জোরে কামড়েছে নীলকে। আলতো করে লাল জায়গাটায় আঙুল বোলায় অদিতি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নীল,
“কেন নিয়ে যাও বারবার? আমার ওকে ভালো লাগে না! ও-আমার সঙ্গে কথা বলে না, খেলে না, মুখ দিয়ে বিচ্ছিরি আওয়াজ করে খালি।”
অসহায়ের মতো নীলের দিকে তাকিয়ে থাকে অদিতি। কী করে বোঝাবে ওকে? বয়সটা যে বড্ড কম!
“কতবার আমাকে আঁচড়েছে জানো? আমার একদম ইচ্ছে করে না ওর বাড়ি যেতে।”
ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে অদিতি।
____________________________________________
কিন্তু আজ এগুলো জরুরি। নীল লাফাতে লাফাতে পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসল। মা বলেছে, দেরি করে বাড়ি ফিরবে। অনেক অ..নে..ক গল্প করবে এখানে বসে।
খাওয়া দাওয়া যখন প্রায় শেষ পর্বে তখন ব্যাগ থেকে একটা চওড়া খাতা বের করে অদিতি। নিজের মনে পাতা ওল্টাতে থাকে। খপ করে খাতাটা কেড়ে নেয় নীল…
____________________________________________
দুই
নীল ঘুমিয়ে পাড়তেই সুমিকে ফোন করে। সুমি অদিতির স্কুল জীবনের বন্ধু। এত বছর পেরিয়ে তাদের বন্ধুত্ব এখন আত্মার বন্ধন। অথচ আজ কথারা যেন হারিয়ে গেছে। ওই প্রান্তে সুমির নিঃশব্দ কান্না এই প্রান্তে অদিতির চোখে প্লাবন ডেকে আনছে। এমন একটা কাণ্ডে সুমি খুব অপরাধ বোধে ভুগছে। ভাঙা ভাঙা গলায় সুমি বলে,
“ভুলটা আমারই। বারবার নীলকে আনতে বলি। ভাবি আকাশের ভালো লাগবে। কিন্তু নীলও তো বাচ্চাই! ওর ওপর এতটা বোঝা চাপিয়ে দেওয়া আমাদের উচিৎ নয়। নীল না চাইলে আর জোর করে আনিস না ওকে।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে অদিতি। তারপর কাঁপা গলায় বলে,
“বোঝা? আকাশ আমাদের বোঝা? অটিজম স্পেকট্রামে থাকা একটা বাচ্চাও বোঝা নয় সুমি! বরং বুঝবার দায় এবার সমাজকে নিতে হবে। এই বাচ্চাগুলোর আচরণ কেবলমাত্র সাধারণের চেয়ে আলাদা বলে ওদের সমাজ স্বীকৃতি দেবে না? দূরে ঠেলে রাখবে?”
“আমি তা বলতে চাইনি অদিতি! তবে এই অটিজম, এই স্পেক্ট্রাম – এই সব বোঝার বয়স তো নীলের হয়নি! ওকে না হয় আরেকটু বড় হতে দে…”
“আমি চাই আকাশ আর নীল একসাথে বড় হোক। এখন থেকে বাড়িতে না শেখালে নীল কোনওদিনও আকাশের সাপোর্ট সিস্টেম হয়ে উঠতে পারবে না!”
“সব চাওয়াই কী আর পাওয়া হয় রে পাগলি!” ম্লান হাসে সুমি। ও-জানে অদিতি হাল ছাড়বে না। অদিতির মতো মানুষরা আছে বলেই আকাশের মতো বাচ্চাদের জন্য দুনিয়াটা আজও বাস যোগ্য। শুধু আকাশ কেন, সুমিই কী পারত অদিতি ছাড়া এই কঠিন লড়াইটা চালিয়ে নিয়ে যেতে? কিন্তু আকাশের আচরণে নীলের কষ্ট হলে তাই বা কী করে মেনে নেওয়া যায়!
“সুমি, আছিস?”
“বল”
“চেষ্টা আমাদের করতেই হবে। আচ্ছা শোন, কাল একবার আমার অফিসের দিকে আসতে পারবি? আমি একটা কথা ভাবছি…”
এরপর দুই বন্ধু নিচু গলায় অনেক্ষণ কথা বলে। ফোন কেটে মোবাইলটা দূরে সরিয়ে রেখে আকাশের মাথায় আলতো চুমু দেয় সুমি। আঁকার খাতাটা বুকে আঁকড়ে ঘুমাচ্ছে আকাশ। ভীষণ কষ্ট পেলে আকাশ ওই খাতাটা কাছ ছাড়া করে না। নীলকে কামড়ে দেওয়ার পর ওকে ভীষণ বকুনি দিয়েছে সুমি। ছেলে আর কিছু বুঝুক না বুঝুক, মা যে কষ্ট পেয়েছে, রেগে আছে, এই কথাটা কেমন করে যেন টের পেয়ে যায়। আকাশ যে নির্বোধ, তা তো নয়। বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা, অদিতিমাসি ছাড়া একমাত্র নীলকেই ও-খুব ভালোবাসে। ওকে দেখলেই আনন্দের আতিশয্যে কী করবে ভেবে উঠতে পারে না। কখনও জোরে জোরে হাততালি দিয়ে চিৎকার করে, তো কোনওদিন আনন্দে মাটিতে গড়াগড়ি খায়। আজ একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে। নীলকে জাপ্টে ধরে গদিতে লাফ মেরেছে। নীল অস্থির হয়ে ছাড়াতে চেষ্টা করতেই বসিয়েছে কামড়। কিন্তু কেন? রাগ করে? সুমির তা মনে হয় না। হয়ত বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে!
বন্ধুকে হারিয়ে ফেলার ভয় কী সুমিরও নেই? সেই নার্সারি থেকে অদিতি আর সুমি একসাথে। যেন দুই বোন ভুল করে অন্য পরিবারে জন্মেছে। আকাশের দিক থেকে যখন প্রায় সব পরিজন, বন্ধুরা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, একমাত্র অদিতিই ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু নীল হয়তো আজকের পরে আকাশকে কোনোদিনও মেনে নিতে পারবে না। হয়তো একদিন পরিবারের চাপে পড়ে অদিতিও… এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছেলেকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে সুমি। দেখে ছোট্ট কপালের একটা কোণ লাল হয়ে ফুলে উঠেছে! নীলকে কামড়ানোটা যে ঠিক হয়নি সেটা বুঝে ফেলেই আকাশ দেওয়ালে জোরে জোরে মাথা ঠুকেছে। অপরাধ বোধ? নাকি নীলের ওইভাবে ধাক্কা মেরে এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার অভিমানে? কে জানে!
“হে ভগবান!” ঠোঁট দুটো নড়ে ওঠে অস্ফুট প্রার্থনায়। দীর্ঘশ্বাসে নিঝুম রাত আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে।
তিন.
আজ অদিতি হাফ-ডে নিয়ে নীলকে স্কুল থেকে আনতে গেছে। স্কুলের গেটে মা’কে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরল নীল। মায়ের ওপর হাজার অভিমান হলেও, বয়সটা তো মোটে আট! দুই গালে দুই চুমু দিয়ে, মাথার চুলগুলো আদরে ঘেঁটে দিয়ে অদিতি জিজ্ঞেস করে,
“আইসক্রিম খাবি?”
ঝলমলে চোখে খুশির ঝিলিক,
“আমি আজ ডাবল ফাজ খাব কিন্তু!” আইসক্রিমের সঙ্গে একটা বার্গার আর কিছুটা ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ নিয়ে নিল অদিতি। এমনিতে এসব খুব একটা খেতে দেয়না ওকে। কিন্তু আজ এগুলো জরুরি। নীল লাফাতে লাফাতে পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসল। মা বলেছে, দেরি করে বাড়ি ফিরবে। অনেক অ..নে..ক গল্প করবে এখানে বসে।
খাওয়া দাওয়া যখন প্রায় শেষ পর্বে তখন ব্যাগ থেকে একটা চওড়া খাতা বের করে অদিতি। নিজের মনে পাতা ওল্টাতে থাকে। খপ করে খাতাটা কেড়ে নেয় নীল,
“দেখি দেখি!”
আগ্রহ ভরে উল্টে পাল্টে দেখে। প্রতি পাতায় আকাশের নীচে, সবুজ মাঠে, শান্ত নদীর পারে বা প্রজাপতির ভিড়ে খেলে বেড়াচ্ছে একটা ছোট বাচ্চা আর এক খুদে সুপার হিরো যার গায়ে রামধনু রঙের পোশাক, মুখে মাস্ক, পিঠে কেপ, হাতের তালু থেকে বেরিয়ে আসছে লাভ-সাইনওয়ালা সুপার পাওয়ার। মুগ্ধ হয়ে পাতা ওল্টাতে থাকে নীল,
“ও মা! কী সুন্দর ছবিগুলো! কী দারুণ রঙ!”
যাক! নীলের ভালো লেগেছে তাহলে! তৃপ্তির হাসি ছুঁয়ে যায় অদিতিকে।
“মা দেখো, এই সুপার হিরোটার তলায় আমার নামও লেখা আছে! ওটা কি আমি, মা?”
এবার কথাগুলো মনে মনে একটু গুছিয়ে নেয় অদিতি,
“হ্যাঁ! তোর নাম যখন লেখা আছে, তখন তুইই হবি!”
“কিন্তু সুপার হিরো তো ফিকশ্যনাল! ওদের তো পাওয়ার থাকে, আমার তো নেই!” বলেই এক হাত ছড়িয়ে নানা কায়দায় কিছু অলৌকিক ঘটানোর চেষ্টা করে নীল। হাসে অদিতি। ছেলেমানুষ আর কাকে বলে!
“কে বলেছে তোর পাওয়ার নেই?”
“কই?”
“পাওয়ার কী আর চোখে দেখা যায়? ওটা অনুভব করতে হয়।”
কিছু না বুঝে মায়ের দিকে ভারি গম্ভীর মুখে তাকিয়ে থাকে নীল।
“এই দেখ ছবিটাতে, তোর সুপার পাওয়ার হল ভালবাসা আর বন্ধুত্ব।”
ছবিটা আবার মন দিয়ে দেখে নীল। একটা স্পেস-শিপ থেকে বড় বড় পাথর গড়িয়ে আসছে বাচ্চা ছেলেটার দিকে। আর সুপার হিরো নীল এক হাতে ছেলেটাকে জড়িয়ে অন্য হাত বাড়িয়ে লাভ সাইন ছুঁড়ে সব পাথরকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিচ্ছে। কেমন একটা আনন্দে শিহরিত হয়ে উঠল নীল!
“ছবিগুলো কে এঁকেছে জানিস?” দু’দিকে মাথা নাড়ে নীল।
“আকাশ এঁকেছে। ওর চোখে তুই এক মস্ত সুপার হিরো! যে কিনা বন্ধুত্ব দিয়ে, ভালবাসা দিয়ে ওর এই একটু আলাদা পৃথিবীটাকে রঙীন করে তুলেছে।”
“কিন্তু মা…”
“আমি জানি সোনা, তোর অনেক বন্ধু আছে। আর একজন নতুন বন্ধু না হলেও দিব্যি চলবে! কিন্তু ভেবে বল তো, তাদের মধ্যে কেউ কী তোকে এত্ত ভালবাসে? কেউ কী শুধু তোর ছবিতে একটা গোটা খাতা ভরিয়ে ফেলেছে কখনও?”
নীলের মুখটা ছোট্ট এতটুকু হয়ে গেছে। ওর বেস্ট বেস্টফ্রেণ্ড তুহিন সেদিন একটা ডাইনো-ইরেজারের জন্য কত্ত ঝগড়া করল! ওর মামা নাকি অস্ট্রেলিয়া থেকে পাঠিয়েছে। কিছুতেই নিতে দিলনা বন্ধুদের। অথচ আকাশের সমস্ত খেলনা নিয়ে নীল খেলে।
“আমি বলছি না, যে বাকিরা কেউ তোর বন্ধু নয়! ওরা তো আছেই। কিন্তু আকাশের কথা ভাব, ওর তো তুই ছাড়া আর কোনও বন্ধু নেই।”
মনটা কেমন টনটন করে ওঠে নীলের। মায়ের কথাগুলো একটু একটু বুঝতে পারছে।
“রোজ তো আর নয়, মাঝে মধ্যে একটু যাবি, খেলার চেষ্টা করবি। ও-তো এখনও মুখে কিছু বলতে পারে বা, তাই একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করবি ও-কী চাইছে, এই আর কী! পারবি না?”
নিশ্চুপ হয়ে মন দিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে কাঁদছে নীল। এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা করে জল ড্রয়িং বুকের ওই নদীটায় জমা হচ্ছে। অনুভূতির বান ডেকেছে নদীতে। কলকল করে দু’কুল ছাপিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে প্রতিটি ঘাস, গাছ, বাড়ি, প্রজাপতি, মেঘ, সূর্য, স্পেস-শিপ এমন কী পাথরগুলোকেও! ভালবাসার লাল চিহ্নগুলোয় ভর করে আঁকার খাতার ওপর ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে আকাশ-নীলের অন্য ভূবন। 🦋
🍁কবিতা /দুই
স্বপন পাল
একটু সময়
বিপদগ্রস্ত হয়ে কেন আসো
তোমার কি সুসময় নেই?
তুমি হাসো, তুমি কাঁদো, সব ভুলে
কেন যে কান্নার ভাগ দিতে আসো ছুটে?
ভুলেছি কি এ শহরে
কোনদিন ভিক্ষা করে গেছি,
বুকের কাপড়ে মুড়ে হৃৎপিণ্ড বেসামাল
সঞ্জীবনী খুঁজেছি কখনো?
কে চেনালো এ কালো, সেও বেশ কালো,
তখনো রোদের গন্ধ মেখে
ভিক্ষাই চেয়েছি, অনুদান নয়।
গাছের পুরনো পাতা ঝরছে দেখেও
মনে পড়বে না তা তো নয়,
একটু সময় দিলে কচি পাতা
তাও দেখে যাবো,
দেখে যাবো তোমারও সময় ঘুরে গেছে।
মিতা নূর
হাত
ধরা হাত মাঝ পথে যখব ছেড়ে চলে যায় মানুষ,
হাতটা তখন খুব শূন্যতায় ভোগে।
হৃদয় ছিঁড়ে বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে যায় ঠিক,
কিন্তু হৃদপিণ্ডে থেকে যায় স্পর্শ গুলো শ্বাস-প্রশ্বাসে।
কঠিন ভাবে আঘাত দিয়ে চোখ ঝাপ্সা করে আড়ালে গিয়েও,
আজীবন রয়ে যায় মনের আয়নায়।
যখন কথা দিয়েও কথা না রেখে চলে যায় অপর প্রান্তের মানুষটা,
তখন এক আকাশ নীরবতার মেঘ স্তব্ধ করে দেয় মুখ।
একসঙ্গে একই আকাশের নিচে কতই না বৃষ্টিতে ভেজা,
অথচ আকাশ ভেঙে ভিন্ন করার শখ হয় তার!
একসময় যে সবুজ ঘাসে বসে তার কাঁধে মাথা রেখে
অজস্র গল্প, কেচ্ছা জমাট বাঁধে, হঠাৎ সেই সবুজ ঘাস খুঁড়ে,
সবকিছুর কবর দেওয়ার চেষ্টা চলে পুরোদমে।
অরুনাভ ভৌমিক
শীত
অন্ধকারে শীত ছিল
ডেস্টিনেশন লাইট হাউস
আমরা দেখছিলাম শীতের কব্জি
শীতও স্নান করে!
কপিল কুমার ভট্টাচার্য্য
ভালবাসার তীক্ষ্ম ছোঁয়া
যখন এক টুকরো তিক্ত কষ্টের
স্মৃতি
জ্বেলে দেয় হৃদয় ভরা গণগণে
আগুন,
তখন তার ভালবাসার এক বিন্দু
ফোঁটা
নিভিয়ে দেয় হৃদয় ভরা সেই
আগুনের তেজ,
জীবন ভরে ওঠে স্নিগ্ধ
প্রাণরসে।
রুমানা আকতার
আমার সঙ্গে বেঁধো ঘর
আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে…?
একটা ভাঙাচোরা চুন সড়কির ঘর,
সিলিং জুড়ে নেই কোনো বিড়ম্বনা।
আছে মরচে ধরা গ্ৰিল
আর, একপশলা জোৎস্না।
বৃষ্টির দিনে উঠোন জুড়ে কাদামাটি,
শীতের সকালে শিশিরের ভেজা,
ঘাসের চাদরে জমতে থাকা জলকণা।
পূর্বী কোণে মস্ত এক কৃষ্ণচূড়া
ঠাঁই দাঁড়িয়ে বসন্তের অপেক্ষায়…!
চৈত্রের তাপে মাঝেও আকাশ যখন কালো ভীষণ
কালবৈশাখীর বাতাসের শীতল মনের উঠোন।
একটা উনুন , একটু আঁচ,
ধোঁয়া ঘোরে জলস্রোত গালের পরিখারয়।
রান্নাবাটির সংসারে
অফুরন্ত সোহাগ আর জর্জরিত মায়া
আদুরে ডাক, লেগে থাক ঠোঁটের কোণে
উষ্ণতা লেগে থাকুক বুকের মাঝে।
এবার বলো,
আমার সঙ্গে ঘর বাঁধবে…?
🍁গল্প /দুই
সাকী সোহাগ
পোড়া ইটের জীবন
একদিন কথা বলতে বলতেই নীলয়ের ফোনটা হাত থেকে পড়ে যায়। ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে যায়। শোনার পর রাবেয়া পয়তাল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে পরের দিন একটা ল্যাপটপ কিনে নীলয়কে কুরিয়ার করে। ততদিনে তাদের চ্যাটিং এর বয়স মাত্র সতের দিন। নীলয় কুরিয়ার থেকে পার্সেলটা বাসায় এনে খোলার পর অবাক হয়েছে। অবিশ্বাস্য লাগছিল। ল্যাপটপ কার্টুন থেকে বের করতেই অনেকগুলো এক হাজার টাকার নোট পরে গেলো। নীলয়ের চোখ তখন কপালে। সে নিজেই নিজেকে চিমটি কাটল। সে আসলে ঘুমের মধ্যে নাই তো? সবগুলো টাকা গুছিয়ে গুনে দেখা গেল সেখানে ছাব্বির হাজার টাকা। সঙ্গে ছোট একটা চিরকুট। তাতে একটা নিউ মডেলের মোবাইল ফোনের নাম লেখা।
নীলয় স্যালারি পাওয়ার পর একটা সুন্দর লাল রঙের শাড়ি ও কিছু কাছের চুড়ি কিনে কুরিয়ার করে রাবেয়ার ঠিকানায়। রাবেয়া সেগুলো পেয়ে অনেকটা হেসেছে। কারণ লাল শাড়ি আর কাচের চুড়ি সে পরা বাদ দিয়েছে তাও কুড়ি বছর হবে।
____________________________________________
নীলয়কে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে রাবেয়া। আহা, পোড়া হৃদয়ে যেন একটুখানি সজিবতা দেখা দেয়। সতেজ হয়ে উঠে পুরনো দিনের সেই কাম। কিন্তু ঠিক তখনি মস্তিষ্কে ভেসে উঠে কুলাংগারটার মুখছবি।
____________________________________________
রাতে নীলয়ের নতুন ফোনে ভিডিও কল দিয়ে রাবেয়া ধন্যবাদ জানায়-‘একদম না। নো থ্যাংকস। তুমি আমাকে ল্যাপটপ ফোন দিয়েছো আমি কি তোমাকে ওহ সরি তুমি করে বলে ফেলছি।’
‘প্লিজ নীলয়, তুমি আমাকে সব সময় তুমি করেই ডেকো।’
‘কিন্তু ইয়ে মানে… আপনি তো মানে তুমি তো…’
‘কী? কী আমি বলো? আমাকে তোমার ভালো লাগে না নীলয়?’
‘হ্যা লাগে, কিন্তু এটা কীভাবে সম্ভব?’
‘এখানে অসম্ভবের কিছু নেই নীলয়। আমি তো তোমার কাছে কিছু চাই না। না কোনও অর্থকড়ি না কোনও অধিকার। আমি শুধু তোমাকে একটু দেখতে চাই। কথা বলতে চাই। তোমাকে আমার ভালো লাগে।’
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
‘হুম, খুব।’
‘পরেছিলে?’
‘না পরিনি। কার জন্য পরবো? তুমি যদি কোনও দিন আমার বাসায় আসো সেদিন পরবো।’
তারপর একদিন দু’দিন দু’মাস করে আজ প্রায় ছ’মাস হচ্ছে ওদের সম্পর্ক। প্রতি মাসে নীলয় দু’তিনবার রাবেয়ার কাছে যায়। গিয়ে দেখে আসে। ঢাকায় রাবেয়াকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় খায়দায়। রাতে আবার রাবেয়ার নিজস্ব গাড়ীতে করে নীলয়কে খুলনায় রেখে যায় তার ড্রাইভার। নীলয়ের জন্য একটা ফ্লাট দেখছে রাবেয়া উত্তরায়। উপহার দিবে। শুধু রাবেয়ার ইচ্ছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নীলয় তার কাছে থাকুক। তাকে ভালবাসুক। আগলে রাখুক।
নীলয়ও যথাযথ তাই করছে। কখন কীভাবে যেন রাবেয়ার প্রেমে পড়েছে। রাবেয়ার কাছে গেলে মনে হয় একটা অবুঝ বালিকা। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে নীলয়ের দিকে। খাবার টেবিলে নীলয়কে তুলে খাওয়ায়। বিছানায় যাওয়ার আগে গুনগুন করে গান গায় আয়নার সামনে। সাজে৷ সাজতে নাকি তার খুব ভালো লাগে। সাজলে এই বয়সেও রাবেয়ার দিকে তাকানো যায় না। চোখে লজ্জারা এসে পরে। কি অপরুপ ভদ্রমহিলা। এই বয়সেও শরীরের কোথাও কোন ভাঁজ নেই। লম্বা কালো চুলে পিট ছেয়ে যায়। টানা টানা চোখগুলো নীলয়কে রুমের ড্রিম আলোয় গিলে খেতে চায় যেন।
নীলয় রাবেয়ার মায়ায় পড়েছে। প্রেম ভালবাসার কোনও বয়স লাগে না যার জলজ্যান্ত প্রমাণ এই দু’ইজন। দু’জন দু’জনার চোখের দিকে তাকিয়ে কীভাবে যেন একাকার হয়ে যায়। নীলয়ের ভালবাসায় রাবেয়ার বয়স নেমে এসে একুশে দাঁড়ায়। নীলয়কে বুকের সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে রাবেয়া। আহা, পোড়া হৃদয়ে যেন একটুখানি সজিবতা দেখা দেয়। সতেজ হয়ে উঠে পুরনো দিনের সেই কাম। কিন্তু ঠিক তখনি মস্তিষ্কে ভেসে উঠে কুলাংগারটার মুখছবি। যাকে জীবনের সমস্ত কিছু দিয়ে ভালবেসেছিল রাবেয়া। সে এখন লন্ডনে হাঁটুর বয়সী একটা ইংরেজ তরুণীকে নিয়ে সংসার পেতেছে। ভাবতেই দাউদাউ করে জ্বলে উঠে আগুন রাবেয়ার হৃদয়ে। সেই আগুন নীলয়ের ভালবাসার কাছে নিমিষেই শীতল হয়ে আসে। রাবেয়ার বুকটা হালকা লাগে। নীলয়ের মাথাটা বুকে উপর নিয়ে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে রাখে রাবেয়া।
নীলয় পদ্মা সেতু পার হওয়ার আগেই রাবেয়া আবার কল করে-
‘কতদূর তুমি?’
‘পদ্মা সেতুর কাছাকাছি।’
‘আচ্ছা সাবধানে এসো।’
পদ্মা সেতু পার হয়ে পনের মিনিটও হয়ে ওঠেনি নীলয়ের মা কল করেছে-
‘বাবারে বাবা আমার। ও-বাবা তোমার বড় মামা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে মারা গেছে বাবা গো। ও-বাবা তুমি তাত্তাড়ি চলে আসো বাবা। বাবা গো…। 🦋
🍁কবিতা /তিন
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
বন্ধুতে বান্ধবে
হাত রেখেছো হাতে আমার মুখ রেখেছো মুখে
লাল ধুলো সব উড়িয়ে দিলাম দুঃখ এবং সুখে
একবেলা প্রেম তোমার জন্য একবেলা বন্ধুকে
বন্ধু আমার সন্ধে হলেই বাড়ির দিকে ফেরে
বন্ধু আমার ভদ্র,পাগলপারা লেবুপাতার গন্ধ ছড়ায় গল্প এবং উপন্যাসের হিরোর মতো অনল ধাবায়…
হাত রেখেছো হাতে আমার মুখ রেখেছো বুকে
ঘুড়ির লাটাই উড়িয়ে দিলাম বন্ধুতে বান্ধবে, তখন
চোখ চলে যায় দিগন্তে আর মন থাকে সম্ভবে…
অনিকেত মৈত্র
রিপু
যে কাঁধের ওপর ভর করে সূর্য উঠল
যে চোখের নিচে শুয়ে পড়ল নারী
যে অশ্রুর ওপর ভেসে গেল দুঃখের নৌকা
যে ঘ্রাণের নিচে শতমুখী নদী
তুমি তাঁকে প্রণাম করো
এখন মেঘ ফেটে বৃষ্টি নামল
ঘরটা থৈ থৈ করছে
আস্ত একটা ভোর ধানের শীষের ওপর
লুটোপুটি করে গেল
রিপুর কাছে নিজেকে ছেড়ে দিও না বৈষ্ঠুমী
খাতুনে জান্নাত
প্রণয়িণী মৃত্যু
আমি তো আমার মৃত্যু লিখেছি কতবার!
রাই সরিষা আইল ধরে শিমুল সীমান্তে
পুইঁ পালংয়ের সবুজ ডানায়
কুয়াশার চোখে লিখেছি সর্বনাশ
স্মৃতি রোমন্থনে কতবার
কত নামে ডেকেছি তোমায়।
ভোর বিকেলকে সাক্ষী রেখে রাতের নির্জনতায় নতজানু
হে প্রেম
প্রেমেই হোক নির্বাণ
প্রণয়িনী মৃত্যু আমার…
সুপর্ণা চট্টোপাধ্যায়
আবেগের বশে
কাউকে বোলোনা তারে ভালোবাসো,
আবেগের বশে।
কারো দিকে হাত বাড়ায়ো নাকো
ভরসা দিও শুধু
বিপদে পাশে আছো।
ছোট বড়ো যেই হোক
আপন কিবা পর।
ভেবোনা তার কথা
যে কেবল মেতে আছে
এক চরম ব্যস্ততায়।
তার তরে রেখোনা কোন ভরসা
অথবা অভিযোগ।
থাকুক না সযত্নে মোড়া
বুকের ভেতর একরাশ অভিমান।
কোনদিন সে জানবে না
কোথায় তোমার ব্যাথা,
কি ছিল তোমার চাওয়া!
এইতো তোমার মুক্তি।
সকল চিন্তার এবার হোক অবসান।
মন দিয়ে শোন ঐ দূর থেকে ভেসে আসা কোকিলের কুহুতান।
যদিও আকাশ মেঘলা
তবু ভয় কি?
ঐ পাহাড়ের চূড়ায়
অন্তিম মুহূর্তে কখনো রামধনু
দেখা যায়।
শেখ কাকলী
তোমাকেই ভালোবাসি
তুমি মরুভূমি হলে আমি হবো জল
তোমার ক্লান্তিতে হবো আমি বল,
তুমি আকাশ হলে আমি হবো নীল
যেনো অবাধ বিচরণে মুক্ত শঙ্খচিল।
তুমি শীতল হলে আমি হবো কাঁথা
তুমি দুঃখ পেলে এই হৃদয়ে ব্যথা,
তুমি অরণ্য হলে আমি হবো সবুজ
তোমায় পেতে হবো আমি অবুঝ।
তুমি বাগান হলে আমি হবো মালি
তুমি অন্যের হলে হৃদয় হবে খালি,
তুমি ভুল হলে আমি হবো শুদ্ধ
তোমায় ভালোবেসে হবো আমি ঋদ্ধ।
তুমি কবিতা হলে আমি হবো কবি
তোমার স্মৃতিতে হবো ফ্রেমে বাঁধা ছবি,
তুমি বাস্তবতা হলে আমি অভিলাষী
তুমি অন্যের তবু তোমাকেই ভালোবাসি।
পার্বতী কাশ্যপ
স্বামী
রাগো, চিৎকার করো,
অগ্নি চক্ষে ভষ্ম করে দাও বুক…
তবুও
আমি তোমার সামনে দাঁড়ালেই
তুমি বহমান জলপ্রপাত,
আমার প্রেমিক।
আমি জানি, পথটা আমাদেরই।
অনাবিল আলোর ভেতর তুমি তাকিয়ে আছ,
আসলে দেখছ তো আমাকেই।
হ্যাঁ গো, আমার লজ্জা করে না বুঝি?
🌱কভার : প্রীতি দেব 🌱 অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
🌱
রাজনীতি, সাহিত্য, বিনোদন, দেশ, রাজ্য, বিদেশ ও স্থানীয় খবর নিয়ে আপনার সঙ্গে
সবার জন্য সবময়
