Sasraya News

Friday, March 28, 2025

21 February : একুশ আমাদের প্রেরণা ও আবেগঘন মর্যাদার প্রতীক | লিখেছেন : হাননান আহসান

Listen

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকেরা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ইঙ্গিতে আপামর বাঙালির উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন। বলা যায় জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ পর্ব। লিখেছেন : হাননান আহসান

 

 

একুশ আমাদের প্রেরণা ও আবেগঘন মর্যাদার প্রতীক 

 

কুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির একান্ত গর্বের, আবেগ ও প্রেরণার একটি অবিস্মরণীয় দিন। প্রতি বছর ঠিক এই দিনের জন্য বাঙালি অপেক্ষা করে থাকে। হৃদয় নিঙড়ানো ব্যথা অনুভব করে। ভোর হতে না হতে শহীদ স্মরণে মেতে ওঠে মানুষ। বাংলা ভাষার জন্য যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের স্মরণ তো আছে, বুকভাঙা উচ্ছ্বাসে সারাদিন কেটে যায় ভালোবাসার বাংলাকে নিয়ে। চারদিকে স্মরণীয় বরণীয়দের নিয়ে বক্তৃতামালার আয়োজনে ঘাটতি থাকে না। অন্ততপক্ষে বছরে একবার প্রিয় বাংলাভাষা আমাদের ঘরদোর ছাপিয়ে উঠোন ভাসিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়।
তারপর আমাদের ভুল হয়ে যায়, আমরা
বাংলাকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। অফিস-আদালতে ইংরিজি চালাই। নিজের সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে স্বস্তির ঢেকুর তুলি। কথাবার্তায়, বক্তৃতায় বাংরিজি বলতে পারলে নিজে গর্ব অনুভব করি। গর্বে অন্যদের-ও বুক চওড়া হয়। অথচ আপনি মনে করে দেখুন একবার, এই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় ছিনিয়ে আনতে গিয়ে আমাদের কত রক্ত দিতে হয়েছে। কত লড়াই চালিয়ে যেতে হয়েছে। তার ফলে এই ভাষা এখন আন্তর্জাতিক। অন্তত আর কেউ না করুক, পৃথিবীর যেখানে যেখানে বাঙালি আছে, একুশ ফেব্রুয়ারি এলে তারা নড়েচড়ে বসে। বাংলা আমার প্রাণের ভাষা বলে চিল চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ছাড়েন। ঠিকই তো, বাংলা আমাদের আবেগ। বাংলা আমাদের প্রাণের ভাষা। সেই ভাষাকে সম্মান দিতে আমরা কুণ্ঠিত হব কেন। আসলে আমাদের মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায় যে, একুশে ফেব্রুয়ারি বোধহয় একটা মাত্র দিন। একদিনেই এর আয়ু শেষ হয়ে যায়। সেই ভাবনা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়।
বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। আমরা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম, যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকেরা মুহাম্মদ আলি জিন্নাহর ইঙ্গিতে আপামর বাঙালির উপর উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রকৃতপক্ষে ছিল ঔপনিবেশিক প্রভুত্ব ও শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম প্রতিরোধ আন্দোলন। বলা যায় জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ পর্ব। সেদিন মাতৃভাষা বাংলার জন্য লড়তে গিয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত ও সফিউররা। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য প্রকাশ্য রাজপথে এমন করে বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়ার নজির নেই। সেদিন এই বীর শহীদদের রক্তের বিনিময়ে মায়ের ভাষা উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল। এই উজ্জীবনের মন্ত্র ত্বরান্বিত করেছিল মুক্তিযুদ্ধের পথ। যার ফলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এই কারণে একুশ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয় জুড়ে অবস্থান করছে। একুশ তাই প্রেরণার প্রতীক। আবেগঘন মর্যাদার প্রতীক। সেই কারণে ভাষা শহীদদের স্মরণ করতে আমাদের ভুল হয় না। চারদিকে ধ্বনিত হয় অমর একুশের অমর গান— ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি…।’ এ গানে আমরা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। আমাদের হৃদয় নিঙড়ানো ওমের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এই দিন আমাদের বাঙালির শেকড়কে সুদৃঢ় করেছে। সুতরাং বাঙালির পক্ষে ভোলা সম্ভব নয় এই একুশকে।
আমরা ভারতীয়, এখানে যারা বাংলায় কথা বলে, বাংলা যাদের মাতৃভাষা, তারাও এই দলে পড়ে যাই। ওসব বাংলাদেশের বলে আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কেননা, বাংলাদেশ আমাদের পথপ্রদর্শক, তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলা এখন বিশ্বের দরবারে প্রভূত মর্যাদার দাবি রাখে।

 

 

বাংলাভাষার রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসন লাভ করেছে। ভুললে চলবে না, এই ভাষার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থ লিখে ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ প্রথম বাংলা ভাষাকে বিশ্বস্তরে উন্নীত করেছেন। জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ১৩ মার্চ বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। জাতির পিতা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বাংলাভাষার এক রাষ্ট্র আছে এই পৃথিবীতে আর সেটা হল বাংলাদেশ। এই দেশের সবাই বাংলায় কথা বলে। এ তো বিরলের মধ্যে বিরলতম নজীর। ১৯৫২ সালে বাংলাভাষার উন্নতশির যে পথের সূচনা হয়েছিল, ১৯৭৪ সালে তা আরও সুদৃঢ় হল সন্দেহ নেই। বাংলাভাষার এই পরম্পরায় খুলে গেল সোনারকাঠি-রুপোরকাঠির সদর দরজা। যখন ইউনেসকো বাংলাভাষাকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ছাড়পত্র দিল। সেটা ১৯৯৯ সালে। আর জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ২০০০ সালে ঘোষণা করে এখন থেকে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে।
এবার একটু পেছনের দিকে তাকানো যাক।
ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত সূচনা হয় ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমের তৈরি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক  সংগঠন তমদ্দুন মজলিশের হাত ধরে। ১৫ সেপ্টেম্বর তমদ্দুন মজলিশ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে যার শিরোনাম ছিল ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা-না উর্দু ?’ এই পুস্তিকার লেখক কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমেদ ও অধ্যাপক আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে ভাব বিনিময়, অফিস আদালতের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে জোরালো দাবি করেন। পরের বছর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে উর্দু ও ইংরিজিকে সরকারি ভাষা হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। গণপরিষদে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে উর্দু ও ইংরিজির পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পাকিস্তান গণপরিষদে তার প্রস্তাব আগ্রাহ্য হলে পূর্ব বাংলায় শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ২৭ ফেব্রুয়ারি এক সভায় গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সভায় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে ১১ মার্চ বৃহস্পতিবার সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত  নেওয়া হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত  ১১ মার্চ তারিখটি রাষ্ট্রভাষা দিবসরূপে পালিত হয়।
২১ মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এক নাগরিক সংবর্ধনায় ঘোষণা করেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’। সমাবেশস্থলে উপস্থিত ছাত্রনেতারা ও জনতা সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে। কিন্তু জিন্নাহ সেসবে কান দেওয়ার লোক ছিলেন না। একগুঁয়ে ও ক্ষমতা লিপ্সু দালাল হয়ে উঠেছিলেন। এই সময় তার সহমর্মিতা থাকলে বাংলাভাষার জন্য এত তরুণের প্রাণ হয়তো যেত না। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এক ভাষণে বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবিকে পুরোপুরি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একটি এবং সেটি উর্দু, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের মুসলিম পরিচয় তুলে ধরে।’ জিন্নাহর এই গোঁয়ার্তুমির কারণে এরপর ভাষা আন্দোলন জোর কদমে শুরু হয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন শাসক খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণে আগুন জ্বলে যায়। এদিন পলটন ময়দানের এক জনসভায় জিন্নাহর কথাই পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। তার বক্তৃতার প্রতিবাদে সভা এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। সেদিন ছাত্র-ছাত্রীরা আমতলায় সমবেত হয়ে ৪ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল পালনের সিদ্দান্ত নেয়। পরে তারা মিছিল নিয়ে বর্ধমান হাউসের দিকে অগ্রসর হয়। একদিন পর মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ জনের এক সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ গঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে। তারাও ২১ ফেব্রুয়ারির হরতালে সিলমোহর দেয়। তবে আলাদাভাবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের শাসকরা বসে থাকার বান্দা ছিলেন না। বাঙালি হয়ে বাঙালির বিরুদ্ধে গিয়ে ২১ তারিখ থেকে একমাস ১৪৪ ধারা জারি করে দেয়। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দমবার পাত্র ছিলেন না। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্ত্বরে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের বাংলা ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে। বেলা ২টোর দিকে আবদুল মতিন এবং গাজীউল হক সহ অন্যান্য নেতারা দাবি আদায়ে অনড় থাকে। ছাত্ররা ছোটো ছোটো দলে মিছিল নিয়ে ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্য করে। এমনকী ছাত্রীরাও এই আক্রমণ থেকে রেহাই পায়নি। ছাত্র-ছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইটপাটকেল ছোঁড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। পুলিশ বিক্ষুদ্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে আসা মিছিলের ওপর গুলি চালায়। গুলিতে আব্দুল জব্বার, রফিকউদ্দিন আহমেদ ও আবুল বরকত নিহত হয়। বহু আহতকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগণ তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে। উপায়ন্তর না দেখে ২২ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন সরকার তড়িঘড়ি করে আইন পরিষদ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন এবং প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। ১৯৫৪ সালের ৭ মে যুক্তফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে পাকিস্তানের সরকার বাংলাকে একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের গণপরিষদ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৫৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান জাতীয়  সংসদ বাংলা এবং উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান পাস করে। ওই বছরের ৩ মার্চ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী পাকিস্তানের সংবিধান কার্যকর হয় এবং ১৯৪৭ সালে তমদ্দুন মজলিশের মাধ্যমে মায়ের ভাষায় কথা বলার যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল তার সাফল্য অর্জিত হয়। কিন্তু ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি পালিত হয়ে আসছে ১৯৫৩ সাল থেকে। রাষ্ট্রীয় পর্যায় বাংলাভাষা ব্যবহারকারী দেশের সংখ্যা মূলত একটি। সে দেশের নাম বাংলাদেশ। সাংবিধানিকভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, অসমের বরাক উপত্যকার অন্যতম প্রশাসনিক ভাষাবাংলা, ফলে ভারতের ক্ষেত্রে বাংলা একটি প্রদেশিক ভাষা। ভারত উপমহাদেশের বাইরে একমাত্র আফ্রিকার সিয়েরালিওনে বাংলাভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া  হয়েছে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদ বাংলাকে স্বীকৃতির বিল পাস করে। ফলে বাংলাভাষা লাভ করে এক অনন্য মর্যাদা। এই মুহূর্তে বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ, সেখানে প্রতি বছর হাজার হাজার অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছে। এছাড়া চিনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরিজি ও জাপানি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বাংলাভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পর ব্রিটেন ও আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চিন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষার সংস্কৃতি চর্চা হচ্ছে। আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলাভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইর্য়ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের ৬টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলাভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিওতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হচ্ছে। ব্রিটেনে ৬টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলাদেশি মালিকানাধীন ও বাংলাভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। বিট্রেনে ১২টি বাংলা সাপ্তাহিক প্রত্রিকা বের হয়। ‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিও স্টেশন রয়েছে। ইউরোপের ইতালিতে বর্তমানে ৫টি বাংলা দৈনিক পত্রিকা, রোম ও ভেনিশ শহর থেকে ৩টি রেডিও স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ৬টি অনলাইন টেলিভিশন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু  রয়েছে। এছাড়া ডেনমার্ক সুইডেনসহ ইউরোপের ৮টি দেশ ও মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে বাংলাভাষার মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
বাংলা ভাষার এই বিশ্বব্যাপী বিস্তার কিন্তু একুশের ভাষা আন্দোলন আর বাংলাদেশ নামক একটি দেশের কল্যাণে। এই ভাবনাকে খন্ডন করা কঠিন। সে না হয় হল, কিন্তু বাংলা ভাষার সূদুরপ্রসারী উন্নয়ন ও বিস্তার লাভের নিরন্তর চেষ্টার অভাব সর্বত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও আগামী প্রজন্ম অনাগ্রহী হয়ে পড়লে বাংলা বিশ্ব মানচিত্র থেকে ক্রমে ক্রমে হারিয়ে যাবে না তো! সে সন্দেহ থেকে আমরা মুক্ত হতে চাই, কিন্তু হওয়া কঠিন। ইংরিজি যেভাবে আমাদের মজ্জাগত হয়ে উঠছে তাতে আগামী দিন যে ভয়ংকর হতে চলেছে সে বিষয়ে হলফ করে বলা যায়। পশ্চিবঙ্গের এক সমীক্ষা পর্যবেক্ষণে জানা যাচ্ছে যে এই প্রজন্মের শহুরে বাচ্চাদের পঞ্চাশ শতাংশের বেশি বাংলায় সড়গড় নয় অথবা বাংলা খবরের কাগজ পড়তে তাদের অনীহা। এর জন্য বাচ্চার দোষ দেখা উচিত হবে না। দোষী তাদের বাবা-মা’রা। গতিশীল পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে তারা ইংরিজির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। আমরা দোকানের সাইনবোর্ড বাংলায় লিখতে পারি না। বাসের নম্বরও ইংরিজি লিখি। অফিস-আদালত কোথাও বাংলার চল নেই। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোতেও ইংরিজিতে উত্তরপত্র তৈরি করতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে গদগদ হয়ে উঠি আর সারা বছর ইংরিজি চর্চা করব, সেটা হতে পারে না। একুশ আমাদের গর্বের ধন, একুশ দীর্ঘজীবী হোক।

[লেখক : সাংবাদিক, সম্পাদক  কবি ও সাহিত্যিক ]

ছবি : সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 16th February 2025 | Issue 52 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | সংখ্যা ৫২

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment