West Bengal Voting-politics: পশ্চিমবঙ্গের ভোট-রাজনীতি: এগিয়ে কে-বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম না কংগ্রেস (আজ আঠেরো-তম কিস্তি)

SHARE:

পশ্চিমবঙ্গের ভোট-রাজনীতির বিশ্লেষণ, তৃণমূল, বিজেপি, সিপিএম ও কংগ্রেসের শক্তি, ইস্যু, সংগঠন ও সম্ভাবনার বিস্তারিত আলোচনা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত দর্শনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজ্যের এক বিশেষ রূপবদলের সময় আগামী ‘২৬ যা এক নতুন যুগের সূচনা ঘটতে চলেছে। কে হবে এই রাজ্যের মুখ্য মুখ। জনগণ কি চাইছে সমস্ত কিছু নিয়ে রাজনৈতিক কলমে কলম ধরলেন–
দেবব্রত সরকার

(আজ আঠেরো -তম কিস্তি)

কোভিডের ভয়াল ছায়ায় পশ্চিমবঙ্গ ভোট ২০২১: কঠোর নির্দেশিকা, নজিরবিহীন নিরাপত্তা ও নির্বাচনী সতর্কতা

এক ভয়াবহ অতিমারীর (Pandemic) মধ্যেই আয়োজিত হয়েছিল ভারতের গণতন্ত্রের অন্যতম বড় উৎসব, ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন (West Bengal Assembly Election 2021)। একদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, অন্যদিকে আট দফার দীর্ঘ ভোট প্রক্রিয়া, এই দুইয়ের সংঘাতে ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (Election Commission of India – ECI) বাধ্য হয় একাধিক কঠোর স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। ভোটের আয়োজন থেকে শুরু করে ভোটগণনা পর্যন্ত, প্রতিটি ধাপেই অনুসৃত হয়েছিল বিশেষ প্রোটোকল যা ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।

বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ (COVID-19) অতিমারীর প্রেক্ষাপটে ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটের আয়োজনের জন্য জারি করেছিল স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত কঠোর নির্দেশাবলি। ভোটার, প্রার্থী ও নির্বাচনী কর্মীদের জন্য বাধ্যতামূলক করা হয় মাস্ক পরা, স্যানিটাইজার ব্যবহার, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং পোলিং বুথে প্রবেশের আগে থার্মাল স্ক্যানিং (Thermal Scanning)। প্রতিটি বুথ নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করার নির্দেশও দেওয়া হয়। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে, প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটারের সংখ্যা ১৫০০ থেকে কমিয়ে ১০০০ করা হয়, ফলে বুথের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। এর ফলে নির্বাচন কমিশনকে (ECI) প্রায় ২০ শতাংশ বেশি বুথ প্রস্তুত রাখতে হয়েছিল, যা ছিল এক বিশাল লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ। রাজ্যে কোভিড সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে কমিশন আরও কঠোর হয়। ১৬ এপ্রিল থেকে রাত ৭টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত সব ধরনের রাজনৈতিক সভা, মিছিল, সমাবেশ ও পথনাটিকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কমিশনের এক আধিকারিক বলেন, “জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ না করলে সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব নয়। তাই রাজনৈতিক দলগুলিকে কঠোরভাবে সতর্ক করা হয়েছে।”

দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াল পরিস্থিতি মাথায় রেখে ২২ এপ্রিল নির্বাচন কমিশন (ECI) ঘোষণা করে, সপ্তম ও অষ্টম দফার ভোটে সাইকেল, বাইক বা যে-কোনও যানবাহন নিয়ে রোড শো (Road Show) করার অনুমতি আর থাকবে না। পাশাপাশি, জনসভায় ৫০০ জনের বেশি উপস্থিত থাকার অনুমতিও প্রত্যাহার করা হয়। পরবর্তীতে ২৭ এপ্রিল কমিশন বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, ভোটগণনার দিন বা তার পর বিজয় মিছিল (Victory Rally) সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

কোভিড নির্দেশিকা যেমন ছিল কঠোর, তেমনই কঠোর ছিল আইন-শৃঙ্খলার বিষয়েও নির্বাচন কমিশনের অবস্থান। ভোটের আগে একাধিক হিংসা, হুমকি ও সংঘর্ষের ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক (Ministry of Home Affairs) ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে রাজ্যে ১২ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী (Central Armed Police Forces – CAPF) মোতায়েনের নির্দেশ দেয়। পরবর্তীতে ২৫ ফেব্রুয়ারি আরও ১২৫ কোম্পানি বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিশেষত সংবেদনশীল এলাকাগুলিতে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের ওপর জোর দেওয়া হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬০ কোম্পানি সেন্ট্রাল রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স (CRPF), ৩০ কোম্পানি সশস্ত্র সীমা বল (SSB), ২৫ কোম্পানি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (BSF), ৫ কোম্পানি সেন্ট্রাল ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি ফোর্স (CISF) ও ৫ কোম্পানি ইন্ডো-তিব্বতান বর্ডার পুলিশ (ITBP) মোতায়েন করা হয়। ধাপে ধাপে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২৫ কোম্পানিতে।

আরও পড়ুন : West Bengal Voting-politics: পশ্চিমবঙ্গের ভোট-রাজনীতি: এগিয়ে কে-বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম না কংগ্রেস (আজ ষোল-তম কিস্তি)

তৃতীয় দফার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঠেকাতে আরও ২০০ কোম্পানি সিআরপিএফ পাঠানো হয়, ফলে মোট বাহিনীর সংখ্যা ছুঁয়ে ফেলে ১০০০ কোম্পানি। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলায় কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে ওঠে। নির্বাচন কমিশনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছিলেন, “বিশেষভাবে সংবেদনশীল বুথে বাড়তি বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে, যাতে কোনও প্রকার বিশৃঙ্খলা না ঘটে।” দ্বিতীয় পর্যায়ের ভোটের সময় তমলুক ও হলদিয়া মহকুমায় ১৪৪ ধারা (Section 144) জারি করা হয়, যাতে কোনও ধরনের জমায়েত বা সংঘর্ষের আশঙ্কা না থাকে। চতুর্থ দফার পর আবারও অতিরিক্ত ৭১ কোম্পানি বাহিনী রাজ্যে পাঠানো হয়, ফলে মোতায়েন করা মোট বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১০৭১ কোম্পানি।

ভোটের দিনগুলোয় নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি দুটো-ই ছিল প্রশাসনের কাছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ভোটের উপকরণ পরিবহণ, ইভিএম (EVM) এবং ভিভিপ্যাট (VVPAT) সরঞ্জাম বিতরণে নির্বাচনী কর্মীদের হাতেই ছিল বিশাল দায়িত্ব। ৫ এপ্রিল উলুবেড়িয়ার এক বিতরণ কেন্দ্রে দেখা যায়, কর্মীরা পূর্ণ সুরক্ষা সামগ্রী পরে ইভিএম বহন করছেন। ভোটগ্রহণের দিনেও দৃশ্য ছিল আলাদা। রিজেন্ট পার্কের (Regent Park) নেহেরু কলোনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (Nehru Colony Primary School) প্রথমবারের ভোটারদের হাতে দেখা গিয়েছিল ভোটের কালির চিহ্ন, মুখে মাস্ক, হাতে স্যানিটাইজার, কিন্তু চোখে ছিল গণতন্ত্রের উজ্জ্বল গর্ব। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এত কঠোর স্বাস্থ্যনির্দেশ মেনে নির্বাচনী আয়োজন ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত ছিল। অনেকেই একে “Election under Mask” বলে উল্লেখ করেছেন।

উল্লেখ্য যে,  সমালোচকরা মনে করেন, দীর্ঘ আট দফার ভোট সংক্রমণ বৃদ্ধির একটি বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতা, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনা, নদীয়া, ও মালদহ জেলাগুলিতে ভোটের সময় সংক্রমণ চরমে ওঠে। রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee) ও বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী (Suvendu Adhikari)  উভয়কেই প্রকাশ্যে সভায় মাস্ক ছাড়া দেখা গিয়েছিল, যা বিতর্কের সৃষ্টি করে।

যদিও নির্বাচন কমিশনের তরফে জানানো হয়েছিল, তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনেই নির্বাচন আয়োজন করেছে। এক কমিশন আধিকারিকের কথায়, “সংক্রমণের আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের চাকা থেমে থাকতে পারে না। তাই সমস্ত সতর্কতা নিয়েই ভোট পরিচালনা করা হয়েছে।” কোভিডবিধি মানা ও আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার সমন্বয়ে ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন এক অনন্য অধ্যায় হয়ে থাকবে ভারতীয় গণতন্ত্রে। এই নির্বাচন প্রমাণ করেছে- ভয়, সংকট ও বিধিনিষেধের মধ্যেও ভারতের ভোটযন্ত্র থেমে থাকে না।

ভোটের হার

পর্যায় আসন সংখ্যা মোট ভোটারের সংখ্যা প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা শতাংশ হার
প্রথম ৩০ ৭৩,৮০,৯৪২ ৮৪.৬৩%
দ্বিতীয় ৩০ ৭৫,৯৪,৫৪৯ ৮৬.১১%
তৃতীয় ৩১ ৭৮,৫২,৪২৫ ৮৪.৬১%
চতুর্থ ৪৪ ১,১৫,৮১,০২২ ৭৯.৯০%
পঞ্চম ৪৫ ১,১৩,৪৭,৩৪৪ ৮২.৪৯%
ষষ্ঠ ৪৩ ১,০৩,৮৭,৭৯১ ৮২.০০%
সপ্তম ৩৪ ৮১,৮৮,৯০৭ ৭৬.৮৯%
অষ্টম ৩৫ ৮৪,৭৭,৭২৮ ৭৮.৩২%
পরে ৪,৯০,২১২
মোট ২৯৪ ৭,৩২,৯৮,৪২৮ ৫,৯৯,৩৫,৯৮৯ ৮২.৩০%

(চলবে)

ছবি: প্রতীকী ও সংগৃহীত 

আরও পড়ুন : West Bengal Voting-politics: পশ্চিমবঙ্গের ভোট-রাজনীতি: এগিয়ে কে-বিজেপি, তৃণমূল, সিপিএম না কংগ্রেস (আজ সতেরো-তম কিস্তি)

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

আরো পড়ুন