



হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায় : লুপারকালিয়া – রক্ত, উর্বরতা ও উৎসবের আগুন। কালের অতল গহ্বরে, যখন রোম ছিল দেবতা ও রাজাদের নগরী, তখনই জন্ম হয় এই অদ্ভুত উৎসবের। প্রতি বছর ১৩ থেকে ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, রোমাণ তরুণেরা ছুটে আসত নগরীর পথে পথে,হাতে রাখা থাকত বলিদান দেওয়া ছাগলের চামড়া। সেই চামড়া দিয়ে তারা ছুঁয়ে দিত নারীদের, বিশ্বাস করত — এ ছোঁয়া নারীর গর্ভকে করবে উর্বর, মাতৃত্ব দেবে আশীর্বাদের ছোঁয়া।লাল রঙে রাঙানো ছিল এই উৎসবের প্রতীক। লাল মানে রক্ত — প্রাণের প্রতিশ্রুতি, উর্বরতার অগ্নিশিখা,বন্য উন্মাদনার রং। দেবতা লুপারকাস বা ফাউনাস যিনি ছিলেন প্রকৃতির রক্ষক , তিনি ছিলেন এই উৎসবের কেন্দ্রে। বলিদানের ছাগল ও কুকুরের রক্ত দিয়ে আঁকা হত তরুণদের কপাল, আর নগরী বয়ে যেত বাঁধভাঙা উল্লাসে। কিন্তু এই উৎসবের পেছনে ছিল এক সুপ্ত ছন্দ,যা কালের স্রোতে এক নতুন রূপ নিতে যাচ্ছিল।
ভ্যালেন্টাইনের শহীদত্ব — এদিকে সম্রাট ক্লডিয়াস যখন রোমে শাসন করছেন — তাঁর কঠোর শাসনে , তখন প্রেমের মন্দিরে জমেছিল কালো মেঘ। তিনি ঘোষণা করলেন – যুবকেরা যদি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয় , তবে তারা যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়বে। তাই ভালোবাসা এবং প্রেমের উভয়ক্ষেত্রেই কোনো শপথ রইল না। কিন্তু বাধ সাধলেন একজন পুরোহিত। প্রেমের শপথের সামনে শাসকের নিষেধাজ্ঞা তাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ। তিনি গোপনে প্রেমিকযুগলকে বিবাহবন্ধনে বাঁধতেন। সত্য প্রকাশিত হল। ভ্যালেন্টাইন বন্দী হলেন, শাস্তি হল মৃত্যু। ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি, ভালোবাসার সেই যাজক রক্ত দিয়ে লিখলেন এক প্রেমের কবিতা। কিংবদন্তী বলে, ওই চিঠি উনি ওঁর প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন। পৌরাণিক উৎসব থেকে খ্রিস্টীয় পবিত্রতায়। কিন্তু ভালোবাসার শপথ কি কখনও হারিয়ে যায়? সময় এগিয়ে চলে ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দ। পোপ গেলাসিয়াস ঘোষণা করলেন– ভালোবাসার নামে উৎসর্গ হবে এই দিন, কিন্তু উন্মাত্ততার নামে নয়।
তবে কি রোমানদের রক্তাক্ত উৎসব মুছে গেল? না, মুছে গেল না বরং রূপ নিল প্রেমের এক নতুন কাব্যে।
এসব ইতিহাস রেখে এবার একটু নিজের অবস্থানে ফিরে আসছি। আচ্ছা, বলুন তো ,বাঙালি ঠিক কবে থেকে ভালবাসতে শিখল? সে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি রাতে এক গাল মাছি। আসল কথা হল, বাঙালি এই হালে ভালোবাসতে শিখেছে। প্রাচীন যুগ ছেড়ে দিন, এমনকি মধ্যযুগেও বাঙালি ভালবাসতে শেখেনি। খেয়াল করে দেখবেন একজন বৈষ্ণব কবি এত এত প্রেমের পঙক্তি লিখলেন, মন আর চোখ ভরালেন কিন্তু ভালোবাসা শব্দটা লিখলে না! তবে তাঁরা কি লিখতেন? লিখতেন মূলত প্রেম ,প্রীতি তার চেয়েও বেশি “পিরীতি”। চন্ডীদাস লিখেছেন,
” কালিয়া প্রেমের মধু” কিংবা” “আমি তো দুঃখিনী, কুলকলঙ্কিনী/ হইনু করিয়া প্রীত” অথবা ” আপন সুখেতে করে যে পিরীতি/ তাহারে বাসিব পর”।
শেষ বাক্যটি খেয়াল করুন “পিরীতি”র সঙ্গে “বাসিব” শব্দটিও আছে। তাহলে ঠিক কবে ভালোবাসা এই পিরীতি-কে সরিয়ে দারুণভাবে আমাদের মনের কোমল পর্দায় রিনরিনে ধ্বনি তুলল?
আর পিরীতি নাম বদলে পিরিত হয়ে বেশ খানিকটা অশ্লীল অশ্লীল শব্দ বয়ে নিয়ে এল? অবশ্যই ইদানিং পিরীতি অনেক গানেই জায়গা করে নিচ্ছে। এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে পাশাপাশি প্রেম শব্দটি বেশ গম্ভীর হয়ে উঠছে। “অরিন্দম আর উজ্জয়িনী পিরিতি করে” … ওরা দুজনেই ভালোবাসে, তোমরা দুজনেই প্রেম করে। শেষের শব্দটি লক্ষ্য করে দেখুন কানে কেমন ঠেকছে! অরিন্দম আর উজ্জয়নীর নাম থেকে গোটা স্পটলাইট প্রেমে গিয়ে পড়বে। যাইহোক কথা হচ্ছিল ভালোবাসা শব্দ নিয়ে। ভালোবাসার দুইটি অংশ – ভাল আর বাসা। এরমধ্যে ভালো শব্দ টা আদৌ বাংলা নয় এটা মৈথিলী। স্বয়ং কবিগুরু বলেছেন “ভালো” শব্দটি ভদ্র শব্দজ । ‘ বড়ো’ বৃদ্ধ হইতে উৎপন্ন, “ছোটো” ক্ষুদ্র অংশের অপভ্রংশ। মূল শব্দগুলির শেষ বর্ণ যুক্ত-যুক্তবর্ণের অপভ্রংশে হসন্ত বর্ণ না হওয়ারই সম্ভাবনা।”গোদা বাংলায় ভালো আছি এর অর্থ ভদ্রস্থ আছি। ঠিকঠাক আছি অথবা চলে যাচ্ছে। আর “বাসা” শব্দ বাসনা- র উৎস। ১৩১৭ সালে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় খগেন্দ্রনাথ মিত্র লিখেছেন “বাসি শব্দটিও এখন বাসি হইয়া গিয়াছে”। যদিও বিক্রমপুর অঞ্চলের সম্ভাষণে “কেমন বাসতে তে আছেন”? শুনা গিয়া থাকে। ” বাসা শব্দের মানে তাই ইচ্ছে, আকুতি। অর্থাৎ ভালবাসা মানে ভদ্রস্থ থাকার বাসনা। যা মোটামুটি সবার থাকে… হায় রে ! এদিকে কালে কালে তাঁর মানে এমন বদলেছে যে অভিধান খুললে ভালোবাসা মানে পাই ” কোন জিনিস বা ব্যক্তি বিশেষ কে প্রাণাধিক বলে জ্ঞান করা ;মনোমতো মনে করা; প্রীতি, স্নেহ বা শ্রদ্ধা করা…” ।
যাইহোক তবুও রসে বসে বাঙালিকে থাকতেই হবে।উৎসব মুখর বাঙালি কোনো উৎসব থেকেই নিজেকে দূরে রাখতে পারেন না। তাই আজ বাঙালির প্রেম দিবস। লাল গোলাপ, চকোলেট,টেডি , থেকে শুরু করে আজ পুজোর শেষ দিন। কবিগুরুর ভাষায় যদিও বলা যেতেই পারে ” আমার সকল রসের ধারা তোমাতে, আজ হোক না…. অথবা তুম হি হো… সে যাই হোক বাঙালির উৎসব , ভূরিভোজ সবকিছু নিয়ে আজ এক বিশেষ দিন।মান, অভিমান ভুলে প্রেয়সীর মিষ্টি হাসি আজ বড় দামী। কতকটা আঁতেলদের মত আমিও ভেবেছিলাম সত্যি এসবের প্রয়োজনীয়তা খুব বেশি নেই কিন্তু যখন দেখলাম আজ অরিন্দম একটা লাল গোলাপ নিয়ে উজ্জয়িনীর কাছে উপস্থিত হয়েছে কিন্তু একটা গোলাপের দাম আশি টাকা! এরপর ভাবলাম শুধুমাত্র ওরা কেন সারা পৃথিবী আজ প্রেমে থাক ওদের কেনা গোলাপে গরম ভাতের গন্ধ উৎলে উঠুক আমার গরীব ভাই বোনেদের ঘরে। প্রেম ছাড়া বাঙালি একথা ভাবাও পাপ! আসুন পৃথিবীতে ভালবাসা সংক্রামক হোক এই প্রার্থনা করি। ভ্যালেন্তি পুজোর সাফল্য কামনা করি। 🍁
