



পার্বতী কাশ্যপ ★ সাশ্রয় নিউজ : যখন কোনও পরিবারে নতুন অতিথি আসার খবর আসে, তখন খুশির জোয়ার বইতেই থাকে। কিন্তু সেই অতিথি যদি একজন নয়, হন দু’জন অর্থাৎ যমজ (Twins), তাহলে উচ্ছ্বাস যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, আগে থেকে কি বোঝা যায় যে, কোনও মা যমজ সন্তানের জন্ম দিতে চলেছেন? মায়ের শরীরই কি সেই বার্তা দেয়? চিকিৎসাবিজ্ঞান ও প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র দুই-ই এই বিষয়ে নিজের মতো ব্যাখ্যা দেয়। আধুনিক চিকিৎসা বলছে, গর্ভাবস্থার প্রথম থেকেই কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্মণ দেখা যেতে পারে যেগুলি যমজ গর্ভধারণের পূর্বাভাস দিতে পারে। যেমন, অস্বাভাবিক মাত্রায় ও দ্রুত গর্ভফুলে ওঠা, অতিরিক্ত বমিভাব, ক্লান্তি, ক্ষুধা বৃদ্ধি, এমনকী প্রাথমিক পর্যায়েই গর্ভের আকার বড় হয়ে যাওয়া। প্রসিদ্ধ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শর্মিলা সেনগুপ্ত (Dr. Sharmila Sengupta) বলেন, ‘যদি কারও গর্ভাবস্থার প্রথম দিকেই হরমোন HCG-এর (Human Chorionic Gonadotropin) মাত্রা স্বাভাবিকের থেকে বেশি থাকে, তাহলে অনেক সময় সেটা যমজ গর্ভাবস্থার ইঙ্গিত হতে পারে।’ অনেক সময় এই লক্ষ্মণগুলি সাধারণ একক গর্ভাবস্থাতেও দেখা যায়, তাই একমাত্র নিশ্চিত উপায় হল আল্ট্রাসোনোগ্রাফি। বিশেষ করে প্রথম ট্রাইমেস্টারে (First Trimester) একটি ‘ভায়াবেলিটি স্ক্যান’-এর মাধ্যমে বোঝা যায় ভ্রূণের সংখ্যা। চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, যমজ সন্তান দুই ধরনের হতে পারে। একজাইগোটিক (Monozygotic) বা একই ডিম্বাণু থেকে উৎপন্ন, যাদের চেহারা হুবহু একরকম হয়; ও ডিজাইগোটিক (Dizygotic), অর্থাৎ আলাদা দুটি ডিম্বাণু থেকে উৎপন্ন, যারা দেখতে আলাদা এবং সাধারণ ভাইবোনের মতো হয়।

এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, কাদের যমজ সন্তানের সম্ভাবনা বেশি? আধুনিক গবেষণা বলছে, বংশগতির প্রভাব এখানে মুখ্য। বিশেষত মাতৃপরিবারে যমজ সন্তান হওয়ার ইতিহাস থাকলে সেই সম্ভাবনা অনেকটাই বাড়ে। পাশাপাশি ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের মধ্যে ও যাঁরা ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যেও এই প্রবণতা বেশি। অন্যদিকে, প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্রেও (Ayurveda) রয়েছে যমজ সন্তানের পূর্বাভাসের ইঙ্গিত। প্রাচীন গ্রন্থ ‘সুশ্রুত সংহিতা’ (Sushruta Samhita) ও ‘চরক সংহিতা’ (Charaka Samhita)-তে বলা হয়েছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে একাধিক পুরুষবীজ ও একাধিক স্ত্রীরজ মিলনে যমজ সন্তান জন্ম নিতে পারে। শুধু তা-ই নয়, গর্ভধারণের সময় মায়ের স্বপ্ন, খাদ্যাভ্যাস বা আচরণ থেকেও ভবিষ্যতের সঙ্কেত পাওয়া যায় বলে মনে করা হত। আয়ুর্বেদাচার্য বৈভব মহাপাত্র (Vaibhav Mahapatra) জানান, “আয়ুর্বেদ অনুযায়ী, যদি গর্ভবতী নারীর ডান ও বাম দিকের শরীরে সমান ভারসাম্য থাকে, একই সঙ্গে হঠাৎ অতিরিক্ত বমি ও ক্ষুধা বৃদ্ধি দেখা দেয়, তা হলে তাকে সম্ভাব্য যমজ গর্ভাবস্থা বলা হত।” তবে আধুনিক বিজ্ঞান এই ব্যাখ্যাগুলিকে অতটা মান্যতা না দিলেও, মানুষের প্রাচীন অভিজ্ঞতা যে তাদের নিজস্ব মূল্য বহন করে, তা বলাই বাহুল্য।
অবশ্য আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি কিছু বিশেষ চিহ্ন আজও লোকমুখে প্রচলিত। অনেক পরিবারে মনে করা হয়, গর্ভবতী নারীর পেটের আকৃতি যদি বিশেষ ভাবে প্রশস্ত ও গোল হয়, তাহলে সেটি যমজ সন্তান আসার ইঙ্গিত। আবার একাধিক নড়া বা কিক অনুভব করা গেলেও অনেকে আগে থেকে ধারণা করে নেন গর্ভে যমজ সন্তান আছে। এখানে এবার একটি মজার পরিসংখ্যান জানলে চোখ কপালে উঠবে অনেকেরই। ভারতে প্রতি ১,০০০ গর্ভাবস্থার মধ্যে ৯-১২টি যমজ হয়। দক্ষিণ ভারতের কিছু অঞ্চল, বিশেষ করে কেরালার মালাপ্পুরাম (Malappuram) জেলার কোদিনহি (কদিনহি) গ্রাম, বিশ্বজুড়ে খ্যাত তার ‘টুইন ভিলেজ’ নামের জন্য। এখানে শত শত যমজ ভাইবোন রয়েছে ও এই প্রবণতা এখনও রহস্যই রয়ে গিয়েছে বিজ্ঞানীদের কাছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যমজ গর্ভাবস্থার ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি নজরদারি প্রয়োজন। যেমন রক্তচাপ, গর্ভজনিত ডায়াবেটিস, প্রি-ম্যাচিওর লেবার (Premature Labor) ইত্যাদির ঝুঁকি অনেক বেশি থাকে। সেই কারণেই গাইনোকোলজিস্টরা নিয়মিত চেক-আপ ও আল্ট্রাসোনোগ্রাফির পরামর্শ দেন। সব কিছুর পরেও, যমজ সন্তান মানেই একটি বিশেষ অভিজ্ঞতা, একটি দ্বৈত আনন্দ। আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে একাধিক সন্তান নিয়েও সুস্থ গর্ভাবস্থা ও প্রসব সম্ভব হচ্ছে। তাই শুরু থেকেই সঠিক চিকিৎসা ও পরিচর্যা থাকলে মা ও শিশুর উভয়ের পক্ষেই সুখকর অভিজ্ঞতা হতে পারে যমজ সন্তানের আগমন। ভবিষ্যতের সঙ্কেত কখনও শরীর দেয়, কখনও প্রযুক্তি। কিন্তু অন্তর থেকেই একজন মা বুঝতে পারেন, তাঁর গর্ভে শুধু এক নয়, দু’টি হৃদস্পন্দন একসঙ্গে সুর বেঁধেছে। এই অনুভবই হয়ত সবচেয়ে বড় বার্তা।
–প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
আরও পড়ুন : Condom| জন্মনিয়ন্ত্রণে কণ্ডোম, প্রাচীন সভ্যতা থেকে আধুনিক ভারতের পথে
