



সম্পাদকীয় ✍️
আমি বসে আছি চাতালে। কতগুলি অচেনা রংবেরঙের পাখি এসে ঘোরা ফেরা করছেন। মনে হয় তারা পরিচিতজন। মানুষের মত তাদের বেশ বৈভব। মনে হচ্ছে তারা আমাকে কিছু একটা বলছে। আমি বুঝতে পারছি না। শীতের সূর্য। মাঝে মাঝে উঁকি মারছে। আজ ৫ জানুয়ারী ঠাণ্ডা পড়বে। আর ঠাণ্ডা পড়াটাই স্বাভাবিক কারণ এই বছর তেমন ঠাণ্ডা পড়েইনি।
আগে যে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা পেয়েছিলাম এখন তেমন নেই। শীত ধরব বলে বলে খালি গায়েই বসে থাকি কিন্তু মনে হয় কোথায় শীত! লোমকুপের আন্দরে শীত অনুভব হয়নি। আসলে আমি কি ভাবে অনুভব করব। আমি তো সর্বক্ষণ বাড়িতে ঘরে আর বারান্দায় সময় কাটিয়ে চলেছি দুই শীত। তাই হয়তো শীত আমার কাছে আসে না। সেও ভাবে এর কাছে গিয়ে লাভ কি। কিন্তু কয়েকদিন আগে রাত্রি ১ টা নাগাদ মাথা ধুয়ে শুয়েছি আর ঐ শীত দুই নাড়িতে বসল। মানে নাক বন্দ হয়ে গেল পরদিন। তখন বুঝলাম শীত মোকায় ছিল। কখন ভুল করি হা হা হা! আর ঠিক সময়েই চেপে ধরেছে। কিন্তু এখনো একটু আধটু শরীরে লেগে আছে বেশ মজার বিষয়। নাকে শন শন শব্দ করে কিন্তু বাইরে আসে না। নাড়ি দু’টির গলা চেপে ধরে মাঝে মধ্যে। যখন টান হয়ে বসি তখন কোন দিক দিয়ে পালাই খুঁজেই পাই না। কিন্তু সামান্য একটা পাতলা জামা আর হাফ হ্যাপ্যান্টেই কাটলো সারাটা শীত। সোয়েটার বা চাদর কোনোটাই ভালো ভাবে নেবার সুযোগ পাইনি। মা জোর করে গায়ে দিয়ে দেয় সন্তানের যত্নের কারণে। হা হা হা। আসলে গিন্নি থাকলে যে কি করত কে যানে! হা হা হা। যাদের স্ত্রী আছেন মানে বৌ তারা ভালোই অনুভব করেন নিশ্চয়। মায়ের সোয়েটার পরান আর বৌয়ের সোয়েটার ছুঁড়ে দেওয়ার পার্থক্য। হা হা হা। অবশ্যই অনেক বৌ-ই কিন্তু কখনো-সখনো মা হয়ে যান। তাদের বাদ দিয়ে যে সমস্ত কেয়ার টেকর স্ত্রী লোক রয়েছেন বা বউই রয়েছেন তাদের কথা উল্লেখ মাত্র। এখানেও কিন্তু আমাদের মাস লেস ম্যাজিক লুকিয়ে আছে। ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখতে পাওয়া যাবে। বিষয়টি ভাঙার প্রয়োজন নেই। মা ও সন্তানের মন। স্বামী ও বৌয়ের মন। পার্থক্য গত ধারণা করলেই খুঁজে পাবেন তাকে। চলার গতি বিধি জীবনের সমস্ত নিয়ম রক্ষা অনুসারে সত্যের পক্ষে এগিয়ে যায়। বউটিই তো মা হবেন । হা হা হা। স্বামীই তো বাবা হবেন। হা হা হা।
আজকে একটু মজার সঙ্গেই উল্লেখ করে ফেললাম আমাদের সম্পাদকীয়। কারণ পাখিগুলি মন নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। ক’য়েকটি পোষ্য পাশে এসে বসেছে। বাবার নাম দেওয়া টিনিও যদিও আমি কিট্টি বলে ডাকি। সেও দেখছি আজ কাছ থেকে সরেনা। তবে কি আমাকে কেউ ডাকতে এসেছে! সে যায় হোক বুঝলেও বোঝানো যায় না। শুনলেও শোনানো যায় না। আসলেই আমি এক মোস্ত পাগল আরকি। না না আমি নই আমি নই যারাই লেখেন তারাই নাকি মস্ত ও আস্ত পাগল। আমি বলি কি ঠিকই বলেছেন আসলে পাগলের মনে তো কোনও পাপ থাকে না। তারা সদায় শিশু। শিব শিব। নারায়ণ নারায়ণ। যীশু যীশু। আল্লা আল্লা। বুদ্ধ বুদ্ধ। কৃষ্ণ কৃষ্ণ। রাধে রাধে। জয় গুরু জয় গুরু। কালী কালী। দুগ্গা দুগ্গা। শিব শিব। এই শব্দগুলো যাদু জানেন। যাদু দেখতে গেলেই উচ্চারণ করেই দেখুন। অনেক কথা লিখেই যাচ্ছি। পাখিগুলি যা বলল উড়ে এসে দেখেও যাচ্ছে কি লিখছি। মা পুজো করছেন। পোষ্যগুলো সবাই নিস্তেজ। চুপচাপ। শুধু ক’য়েকটি অচেনা পাখি 🐦🐦🐧🐥🦉 🐣 কথা বলে যাচ্ছে। আমি শুনে যাচ্ছি আর লিখে যাচ্ছি। রোদ্দুর এলো। হাওয়া বয়তে শুরু করলো আর পাখিগুলো ঐ উড়ে পালালো ঐ পালালো উড়ে পালালো ফুড়ুৎ।🍁
🍂মহামিলনের কথা
“খুব খিদে পেয়েছে,
কি আছে-দে, রোজ রোজ শুধু সীতারামই খাওয়াবে, তোরা একদিনও খাওয়াবি নে?”
সীতারাম লীলা আলেক্ষ্য
অধ্যাপক শ্রীপ্রমোদরঞ্জন গুপ্ত
গোপাল ভাব…
হৃষীকেশ আশ্রম, সন্ধ্যা বেলা।
শোনা গেল, সীতারাম দিনে ভোগ নেননি। সারাদিন জমাট ভাব মাঝে মাঝে সমাধিস্থ। রাত-ও এভাবে কাটলো। সীতারামের সঙ্গে সেবকরাও উপবাসী। ভোর হতেই আশ্রমের যে অংশে মায়েরা ছিলেন সেখানে গিয়ে হাজির, বললেন,
-খুব খিদে পেয়েছে- খেতে দে।
কি আছে-দে, রোজ রোজ শুধু সীতারামই খাওয়াবে, তোরা একদিনও খাওয়াবি নে?
দে বার কর-কি আছে?
সবাই অপ্রস্তুত। অত সকালে কি দেওয়া যায়, কিছুই কারো কাছে নাই। যাঁকে সাধ্য সাধনা করে কিছু গ্রহণ করান যায় না-আজ তিনি খেতে চাইছেন। কি মুশকিল! যা হোক, শেষ পর্যন্ত একজনের কাছে কিছু ফল পাওয়া গেল-তিনি রেখে ছিলেন হরিদ্বারে আনন্দময়ী মা’কে দেবার জন্য। মায়ীটি বললেন, -“এগুলো দেওয়া যাবে তো?”
সবাই বলে উঠলেন, -“হাঁ হাঁ, দিয়ে দাও তো, ঠাকুর যখন চাইছেন।”
দু’হাত বাড়িয়ে সীতারাম তুলে নিলেন ঝোলাভর্তি ফল। মহাআনন্দ তাঁর; বললেন- এই তো কত ফল।”
হাতভরে বিলিয়ে দিলেন প্রসাদ সবাইকে। অভুক্ত মায়ীরা ফলাহার করে তৃপ্ত হলেন।
আচার ..”শ্রীবিষ্ণুসহস্র নামের” ফলশ্রুতিতে আছে-
“সর্ব্বাগমানামাচারঃ প্রথমং পরিকল্পতে।
আচারপ্রভাবো ধর্ম্মো ধর্ম্মস্য প্রভুরচ্যুতঃ।।”
সমস্ত আগমের (বেদের) মধ্যে আচারই (স্নান সন্ধ্যাবন্দনাদি) প্রথম (পূর্ব্ব কর্ত্তব্য) বলে পরিকল্পিত হয়েছে, আচার ধর্ম্মের প্রভাব বা উৎপত্তিকারণ আর অচ্যুত (শ্রীকৃষ্ণ) সেই ধর্ম্মের প্রভু বা নিয়ন্তা। একদিন অধ্যাপক ‘বিজ্ঞান’ মহামহোপাধ্যায় ডক্টর শ্রীযোগেন্দ্র নাথ তর্ক-সাংখ্য-বেদান্ততীর্থ মহাশয়কে জিজ্ঞেস করে, “পণ্ডিত মহাশয়! আচারের প্রয়োজন কি? অনেক আচারই তো অর্থহীন।
পণ্ডিত মহাশয় বলতে থাকেন, -একবার ট্রেনে সারাব্রিজের উপর দিয়ে যাচ্ছি- সঙ্গে এক ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু। তাকে জিজ্ঞেস করলাম- ব্রীজটি তো কতকগুলো পিলারে দাঁড়িয়ে আছে। তবে ঐ টানাগুলো কেন?
উত্তরের সে বলে, “ঐ টানাগুলোই তো আসল। ওরা ব্রীজকে ধরে রেখেছে। পিলার গুলো ভেঙ্গে গেলেও ঐ টানাগুলোর জন্য ব্রীজ পড়বে না। আমাদের আচারগুলো হল ঐরূপ ‘টানা’ – ধর্ম্মসেতুকে ধরে রেখেছে।
সীতারাম খুঁটিনাটি সব আচার মেনে চলেন, সবাইকে মানতে উপদেশ দেন। হৃষীকেশ আশ্রমে একদিন বাবা রোদ পোহাচ্ছেন। হঠাৎ একদল তীর্থযাত্রী এসে হাজির। কলকাতার সব। কোটপ্যান্ট পরা ঘড়ি হাতে। মেয়েরাও খুব সেজেগুজে। ফেরার পথে সাধুদর্শন করে যাবে এই বাসনা। একে একে প্রণাম করলেন সবাই, তবে চরণ স্পর্শ করতে দিলেন না সীতারাম। মৌন ছিলেন, লিখে লিখে বললেন, ‘প্যান্ট পরেছো কেন, ঘড়ি হাতে কেন? গলায় পৈতা আছে? গায়ত্রী করো? ডিম পেঁয়াজ রসুন মাংস খাও?- মরে কুকুর হবে।…।”
সাধু দর্শন করতে এসে বেচারিদের কি অবস্থা! যাবার উপক্রম করলে সীতারাম সমস্ত ব্যাপারটা লিখে তাঁদের বুঝিয়ে দিলেন –
৺৭শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ 🍁
[প্রসঙ্গ : শ্রীশ্রী ঠাকুর সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথ দেব ]
🍂ফিরে পড়া | ছোটগল্প /এক
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক সতীনাথ ভাদুড়ী। তাঁর অজস্র গল্প পাঠকদের সাহিত্যপাঠের রসনাতৃপ্ত করেছে। আজকে সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাশ্রয় স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য রইল লেখকের ‘হিসাব নিকাশ’ শীর্ষক বহুল প্রশংসিত ছোটগল্পটি।
হিসাব নিকাশ
সতীনাথ ভাদুড়ী
এককড়ির কোনও আচরণেই বাড়ির লোকরা অবাক হয়না, তাই একটা খালি বোরা হাতে নিয়ে রাত সাড়ে দশটার সময় জামাই বাড়ি পৌঁছতে দেখে মেয়ে আশ্চর্য হল না; শুধু হাত থেকে বোরাটাকে নিয়ে ভাঁড়ার ঘরে রেখে বলল “এখনই খেতে বসে যাও বাবা”। খাওয়া দাওয়ার পাট তখনও শেষ হয়নি। বেয়ানের শ্রাদ্ধ আগের দিন হয়ে গিয়েছে। সেদিন ছিল মৎস্যমুখের নেমন্তন্ন। খেতে বসেই জানিয়ে দিলেন যে, তিনি ‘এদের’ নিতে এসেছেন। এদের মানে স্ত্রীপুত্রকন্যাদের। তাঁরা এসেছেন দিনকয়েক আগে, বেয়ানের শ্রাদ্ধের কাজটা সামলে দেবার অজুহাতে।
ভোর সাড়ে চারটার গাড়িতেই যেতে হবে। দেরি করবার উপায় নাই; কেন না প্রতিবেশী সিংহিবাবুদের বাড়িতে মেয়ের বিয়ে। কালকেই। তাঁরা স্বামীস্ত্রীতে গিয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের দায় উদ্ধার না করে দিলে, দেখায় অত্যন্ত খারাপ।
এককড়ি দাসের পরোপকারের প্রবৃত্তিটা ভাল নয়। একটানা কোনও কাজে লেগে থাকার রুচি নাই। কাজেই পরোপকার করেই সে নিজের জীবিকা সংস্থান করে। সেইজন্য মেয়ে খালি বোরাটা ভরে দিল বেল, আলু, পাটালিগুড়, শিলনোড়া—অর্থাৎ ভাঁড়ার ঘরের যে জিনিস চোখের সম্মুখে পড়ল, তাই দিয়ে।
গাড়ি রাখা থাকে স্টেশন-ইয়ার্ডে সারারাত। শেষরাত্রিতে এতগুলি কাচ্চাবাচ্চাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে স্টেশনে নিয়ে যাওয়ার নানান লেঠা। তাই জামাই তাঁদের তখনই তুলে দিয়ে এল গাড়িতে। কুলির মাথা থেকে ভারী বোরাটাকে নামাবার সময় জামাই বলল, “একটা বোটকা বোটকা গন্ধ পাচ্ছি যেন বোরাটা থেকে।”
শ্বশুর শুঁকে বললেন—“না তো।”
বাবলু জিজ্ঞাসা করে—“মেজদি, বোটকা কিরে?”
বাবা তাড়া দিলেন—“হল আরম্ভ বাবলুর, এই রাত দুপুরে। শুয়ে পড়!”
মশার কামড়ে ঘুম হয়নি সারারাত। ভোর হতেই এককড়িবাবু জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন গার্ডসাহেব আসছেন, মেমসাহেবকে সঙ্গে নিয়ে। দুটো কুলির মাথায় লটবহর। বেয়ারাটা পিছনে পিছনে আসছে হাতের টিফিন বাস্কেটটাকে অতি সন্তর্পণে আলগোছে ধরে। মেমসাহেব উঠলেন গার্ডের গাড়িতে। গার্ডসাহেব এইবার চলেছেন চায়ের স্টলের দিকে। এককড়িবাবুও গাড়ি থেকে নেমে ছুটলেন চায়ের দোকানের দিকে।
গাড়ি এখনও না ছাড়ায় বাবলুও অস্থির হয়ে পড়েছে। গার্ডসাহেব নিশান নেড়ে বাঁশি বাজাবে, তবে তো গাড়ি ছাড়বে। সাহেব দেখলেই তার ভয় ভয় করে। গার্ডসাহেব হেসে বাবার সঙ্গে কথা বলছে চায়ের দোকানে। বাবা সায়েব দেখে একটুও ভয় পায় না। সায়েব দোকানদারকে কি যেন বলছে। দোকানদার সায়েবকে চা দিল মাটির খুরিতে আর বাবাকে দিল কাপে করে। বাবাকে দোকানদার সায়েবের চেয়েও বেশি ভয় করে। বাবা পকেট থেকে পয়সা বার করে দিতে যাচ্ছে, সায়েব দিতে দিল না। সায়েব খুরিতে চা নিয়ে চলে গেল। বাবা বাসিমুখে চা খাচ্ছে। বাবার মতন অত গরম চা আর কেউ খেতে পারবে না; সায়েবও পারবে না; এনজিন-ড্রাইভারও পারবে না। বাড়িতে তাদের চা হয় না; বাবা চা খায় অন্য লোকের বাড়িতে।
বাবা গাড়িতে ফিরতেই বাবলু জিজ্ঞাসা করে—“বাবা, সায়েবরা খুরিতে করে চা খায়?”
“না।”
“ওই যে নিয়ে গেল।”
“ও নিয়ে গেল দুধ।”
“সায়েবরা খুরিতে কবে দুধ খায়?”
“চুপ করে বস! দেখছিস না গাড়িতে কত লোক উঠছে!”
সত্যিই গাড়ি একেবারে লোকে ভরে গিয়েছে ট্রেন ছাড়াবার আগে। এককড়িবাবুর স্ত্রীর কোলে খুকু কাঁদছে। দীপি আর মিনা ঘুমুচ্ছে। তারপর বসেছে বাবলু। তারপর বসেছে বাবলুর মেজদি আর সেজদি। অন্য যাত্রীরা দেখা গেল প্রায় সকলেই সকলের চেনা। একজন বললেন ‘চারটে পঁয়ত্রিশ তো হল।’
“হ্যাঁ, কারেক্ট টাইমে-ই ছাড়বে; গার্ড সাহেবের নিজেরই চাড় আছে আজ।”
“কেন, মেমসাহেব সঙ্গে আছে বলে?”
“হ্যাঁ। দেড় বছর পর মিসেস রবার্টসন ফিরে এসেছে টি বি স্যানেটোরিয়াম থেকে।”
“আজকাল আর টি বি-তে লোক মরে না। বেশ স্বাস্থ্য হয়েছে মেমসাহেবের।”
“হ্যাঁ। কাল রাত্রিতে যদি দেখতে রবার্টসনকে। একেবারে আনন্দে ডগমগ, প্ল্যাটফর্মে মেমসাহেবকে দেখে।”
গাড়ির ঘণ্টা পড়ায় এদের গল্পে বাধা পড়ল। এককড়িবাবুর মুখের উদ্বেগের ভাবটা যেন একটু কাটল। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন—“এরা সব রেলে কাজ করে।”
গাড়ি ছাড়ায়, বাবলুর গল্পের উৎসাহ বাড়ে।
“টেলিগ্রাফের তার ছুঁলে মানুষ মরে যায়, তবে পাখিরা মরে না কেন মেজদি?”
‘পাখিরা যে পাখি, আর মানুষরা যে মানুষ।”
“ও।”
বাবলু জানত, কিন্তু ভুলে গিয়েছিল।
“ওগুলো অমন সার বেঁধে বসেছে কেন মেজদি?”
“নেমন্তন্ন খেতে বসেছে বোধহয়।”
“ধেৎ! পাখিরা আবার নেমন্তন্ন খায় নাকি।”
“আমরা নেমন্তন্ন খাব আজ, আর পাখিরা খাবে না?”
“পাখিরা যে পাখি।”
“তা হলই বা।”
“আমরা কাল খেয়েছি নেমন্তন্ন, পরশু খেয়েছি নেমন্তন্ন। পাখিরা খেয়েছিল?”
“জানি না যা!”
মেজদি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসল। বাবলুর দরকার কথা বলবার লোকের।
“এই দীপি ওঠ। আর চারটে ইস্টিশান পরেই রাধানগরে পৌঁছে যাবে গাড়ি; এখনও ঘুমুচ্ছে।”
মা তাড়া দিলেন—“ও কি হচ্ছে বাবলু! ও ঘুমুচ্ছে, ওকে চিমটি কাটছিস কেন?”
“রাধানগরে ওদের ঘুম ভাঙিয়ে, নামাতে নামাতে যদি গাড়ি ছেড়ে যায়?”
“তোকে সর্দারি করতে হবে না। এখনই উঠে আবার খাওয়ার জন্য চেঁচামেচি আরম্ভ করে দেবে।”
“আমি মা লেডিকেনি খাব।”
বাঙ্কের উপর হাঁড়িতে মেয়ের দেওয়া লেডিকেনি রয়েছে; সেইটাই বাবলুর লক্ষ্য।
“ওখানে গিয়েই তো নেমন্তন্ন বাড়িতে কত কি খাবি। এখন হ্যাংলাপনা করিস না একগাড়ি লোকের মধ্যে!”
বাবা বকে উঠলেন—“বাবলু, হচ্ছে কী। মুখ না ধুয়ে খায় না কি লোকে?”
“তুমি তো মুখ না ধুয়ে চা খেলে।”
“ওকি নিজে থেকে খাওয়া নাকি; সাহেব খাওয়াল, তাই খেতে হল।”
“ও।”
বড়দের যুক্তি বাবলু ঠিক বুঝতে পারে না, তবু ভাব দেখায় যেন বুঝেছে। তার এখন ইচ্ছা করছে খাওয়ার গল্প করতে।
“সেখানে পৌঁছেই আমরা বিয়ে বাড়ি যাব, না?”
“স্নান করে তবে তো যাবি।”
“জলখাবার খাব বিয়ে বাড়িতে গিয়ে—না?”
“হ্যাঁ।”
“তারপর দুপুরবেলা নেমন্তন্ন খাব, রাত্রিতে নেমন্তন্ন খাব।”
“হ্যাঁ। তবে কাজ করতে হবে কিন্তু বিয়েবাড়িতে।”
“কী কাজ?”
“কাক তাড়াবি; জুতো পাহারা দিবি।”
“ধুৎ! দীপি, মিনা, খুকু এরা কিন্তু কাজ না করেই নেমন্তন্ন খাবে।”
“ওরা যে একেবারে বাচ্চা। দেখিস না ওদের টিকিট লাগে না ট্রেনে।”
“আমার টিকিট লাগে?”
“হ্যাঁ, হাফ-টিকিট। তোর হাফ-টিকিট, সেজদির হাফটিকিট, মেজদির হাফটিকিট।”
একটা স্টেশনে গাড়ি থামায়, বাবলুর মনোযোগ অন্যদিকে গেল। জানলা দিয়ে সে প্ল্যাটফর্ম দেখছে।
“মেজদি! মেজদি! ওই দ্যাখ মেমসাহেব। গার্ডের গাড়ির কাছে। ওর কোলে একটা কালো বিড়াল রয়েছে।”
“ফের যদি জানলা দিয়ে ঝুঁকেছ, তা হলে দেব কান ছিঁড়ে!”
এককড়িবাবু বাবলুকে টেনে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিলেন বেঞ্চের উপর। তারপর সম্মুখের বেঞ্চের খবরের কাগজ পাঠরত ভদ্রলোকটির দিকে হাত বাড়ালেন।
“দেখি দাদা একখানা পাতা। হ্যাঁ আসল পাতাখানাই হাতে এসেছে ঠিক।”
“কোনখান? ও জ্যোতিষশাস্ত্রের উপর খুব বিশ্বাস বুঝি মশায়ের?”
“বিশ্বাস! বিশ্বাস বলছেন? হুবহু মিলে যায়। আমার নিজের জন্মের রাশিটা ঠিক জানা ছিল না আগে। একদিন একখানা পুরনো কাগজ নাড়াচাড়া করতে করতে দেখি, মিথুনরাশির ফলাফল আমার সেই সপ্তাহের জীবনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। সেই থেকে আমি ধরে নিয়েছি যে মিথুনরাশিতে আমার জন্ম। তারপর থেকে প্রতি সপ্তাহে মিথুনরাশির ফলাফলের সঙ্গে আমার জীবনের ঘটনাগুলোকে মিলিয়ে আসছি। একেবারে মিলে যায় মশাই। একটুও বাড়িয়ে বলছি না।”
কাগজের দিকে চোখ থাকলে কি হয়, এককড়ি কান খাড়া রেখেছে রেলের বাবুদের গল্পের দিকে। তাদের মধ্যে কি করে যেন রবার্টসনের কথা আবার উঠেছে। সেইটাই হয়েছে তার দুশ্চিন্তার বিষয়। তাদের গল্প কানে আসছে।
“মেমসাহেব স্যানেটোরিয়াম থেকে ফিরতি পথে ওখানে পৌঁছেছিল বিকালের গাড়িতে। আসবার কথা ছিল রাত বারোটার গাড়িতে; কিন্তু পৌঁছে গিয়েছিল আগেই। রবার্টসন সাড়ে ন’টার গাড়ি নিয়ে যখন ওখানে পৌঁছল, তখন মেমসাহেব একমুখ হাসি নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে, স্বামীকে ‘রিসিভ’করবার জন্য।”…
প্রয়োজনের চেয়েও জোরে জোরে চেঁচিয়ে এককড়ি হঠাৎ সম্মুখের ভদ্রলোককে জ্যোতিষশাস্ত্র বোঝাতে লাগল।
“একেবারে অঙ্ক মশাই। জ্যোতিষশাস্ত্রের মধ্যে জালজোচ্চুরিও নেই, ধর্মকর্মও নেই, মুনিঋষিও নেই। অঙ্ক ঠিকভাবে কষো, আর পাতা উলটে উত্তর মিলিয়ে দেখে নাও, ঠিক হল কি না।”
ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন—“আপনার এ সপ্তাহ কেমন যাবে, সে সম্বন্ধে কাগজে কী বলে?”
“শুনুন। রাজ কর্মচারীরা জাতকের উপর সদয়। বন্ধুভাগ্য ভাল। সুযশ ও অর্থাগমের সম্ভাবনা।”…
“তবে তো মশাই মেরে দিয়েছেন!”
“মেজদি, বাবা কি পড়ল রে কাগজে?”
“ওসব হাত গোনার কথা। তুই বুঝবি না।”
এককড়ির চিৎকারে ছোটখুকু জেগে উঠেছে। তাই স্ত্রী চটেছেন স্বামীর উপর। “একটু আস্তে কথা বলো না! এখানে কালা কেউ নেই।”
রেলের বাবুদের গল্প তখন বেশ সরস জায়গায় পৌঁছেচে।
“প্ল্যাটফর্মের উপর, এক হাট লোকের মধ্যে, দুজন দুজনকে জড়াজড়ি করে, রবার্টসন আর তার মেমের সে যে কি চুমো খাওয়ার ঘটা কাল রাত্রিতে।”…
এককড়ি তাড়া দিয়ে উঠল—“গাড়িতে মেয়েছেলে রয়েছে দেখতে পাচ্ছেন না! কী রকম ভদ্রলোক মশাই আপনারা?”
“কেন, কী অভদ্রতা করলাম আমরা?”
“নিজের মা-বোনের সম্মুখে আপনারা এই সব অশ্লীল কথা বলেন?”
“আমরা গল্প করছি নিজেদের মধ্যে, সে কথা আপনাদের কান খাড়া করে শোনবারই দরকার কি।”
“চোখের পাতা যখন ইচ্ছা বোঁজা যায়, কিন্তু কান ইচ্ছামতো বন্ধ করবার কোনও ব্যবস্থা যে ভগবান করে দেননি।”
“এত যাঁদের শুচিবাই তাঁরা পুরুষদের গাড়িতে মেয়েছেলেদের ওঠান কেন?”
“রেলে কাজ করেন কিনা; তাই ভাবেন গোটা রেলগাড়ি খানাই আপনাদের। জেনুইন প্যাসেঞ্জারদের সুবিধা দেখবেন কেন আপনারা।”
“দেখুন অনর্থক গায়ে পড়ে আমাদের সঙ্গে ঝগড়া করতে আসবেন না। হ্যাঁ, তারপর যে কথা হচ্ছিল—সায়েবমেম যখন উল্লাসে আত্মহারা, ঠিক সেই সময় একজন আধপাগলা গোছের লোক চটের থলিতে একটা বিড়াল নিয়ে ওই ট্রেন থেকে নেমেছে। সবাইকে তার সঙ্গে ঠাট্টা তামাসা করতে দেখে মেম জিজ্ঞাসা করে—ওখানে গোলমাল কিসের ডিয়ার? পাগলা লোকটা জানাল যে, কালো বিড়াল বড় অমঙ্গুলে বলে সেটাকে সে এখানে ছেড়ে দেবার জন্য নিয়ে এসেছে। সাহেব তো অবাক। কালো বিড়াল অমঙ্গুলে? কে বলে? ওই বিড়ালটা আমার ট্রেনে ছিল বলেই প্রত্যাশিত সময়ের আগে আমি মেমসাহেবদের দেখা পেয়েছি। মিসেস রবার্টসন বলল—বিড়ালটাকে আমি পুষব, ডিয়ার। লোকটা চটের থলেটা দিতে কিছুতেই রাজি হল না। অতি কষ্টে বিড়ালটাকে ঢোকান হল মেমসাহেবের টিফিন বাস্কেটে।”
বাবলু ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে—“কি হয়েছিল রে মেজদি কালো বিড়ালের?”
“ওসব অসভ্য কথা শুনিস না।”
বাবলু জানলার দিকে মুখ ফিরিয়ে সুস্থির হয়ে বসল। কালো বিড়ালের খবরটা জানবার জন্য তার খুব ইচ্ছা করছে; তাই সে কান পেতে আছে অসভ্য কথার দিকে।
সমর্থন পাবার আশায় এককড়ি সম্মুখের ভদ্রলোককে বলে—“সবাই ‘কমপ্লেন’ করে যে ভিড়ের ঠেলায় রেলগাড়িতে ওঠা যায় না। আরে ভিড় কমবে কোথা থেকে। প্যাসেঞ্জারের শতকরা নিরানব্বই জনই যে রেলে কাজ করে। সব ‘ফ্রি’ পাসের দল!”
ভদ্রলোকটি কাগজের পাতা থেকে মুখ সরালেন না।
একজন টিকিটচেকার এসে ঢুকেছেন গাড়িতে। বাবলুর সাহেব দেখলে ভয় করে, পুলিশ দেখলে ভয় করে, আর রেলগাড়িতে টিকিটচেকার দেখলে ভয় করে। এঞ্জিনড্রাইভারের চেয়েও সাহস বেশি টিকিটচেকারদের। ডাকাতসর্দারের মতো অন্ধকার রাত্রিতে তারা এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে যেতে পারে। চেকার টিকিট ফুটো করবার সাঁড়াশিটা বাবার মুখের সম্মুখে ধরেছে, ঠিক ডাকাতসর্দাররা যেমন করে পিস্তল ধরে। বাবা টিকিট দেখাচ্ছে। দীপি, মিনা, খুকু কারও টিকিট নাই। যদি ওদের ধরে নিয়ে যায়, তা হলে কি হবে! ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করে বাবলুর।
এককড়ি খবরের কাগজ থেকে চোখ না তুলে অতি তাচ্ছিল্যের সঙ্গে টিকিটগুলোকে দিল চেকারের হাতে।
“আপনারা কজন?”
“এই যে কজনকে দেখতে পাচ্ছেন এখানে।”
“টিকিট দিলেন তো সাড়ে তিনখান।”
“হ্যাঁ দুখান ফুল আর হাফ তিনখান।”
“আর একখান হাফ টিকিটের দরকার হচ্ছে যে। ছোট দুটির না হয় লাগবে না।”
“না, ওরও লাগবে না। ওর বয়স দুবছর চার মাস।”
“দেখুন, আমরাও মশাই পুত্ৰপরিবার নিয়ে ঘর করি; গেরস্তর দুঃখদরদ বুঝি। অন্যদিন হলে ছেড়ে দিতে পারতাম। আজ উপায় নেই। আজ রাধানগরে magisterial checking হবে, খবর পেয়েছি। নিজের চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে। আপনাকে মশাই আর একখান হাফটিকিট কিনতে হবে।”
“কেন কিনব? বলছি, বিশ্বাস করুন, ওর বয়স আড়াই বছরের নীচে। ঠিকুজি কুষ্ঠিতো এখানে দেখাতে পারি না; আমার কথাই আপনাকে বিশ্বাস করতে হবে।”
“না সে হয় না।”
“হবে না কেন শুনি!”
“তিনজন ফ্রি টিকিটে যাবে, সে হয় না।”
“হয়। হয়। একশোবার হয়!”
আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে এককড়ির।
“হবে না কেন। এক সঙ্গে পাঁচজনেরও জন্ম হয় পৃথিবীতে; কিন্তু সেরকম দাবি তো আপনার নেই। সাড়ে ছ’আনা পয়সার তো মামলা। এ নিয়ে কেন এত কথা বাড়াচ্ছেন?”
টিকিট-চেকারের কথাবার্তার ধরন দেখে এককড়ির মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে। সব চেয়ে গা জ্বালা করে অন্য সব রেলের বাবুদের হাসি দেখে। সবাই মজা দেখছে! এক গাড়ি প্যাসেঞ্জার; কিন্তু সবাই টিকিট-চেকারের দিকে! সবাই ধরে নিয়েছে যে সে টিকিট ফাঁকি দিতে চায়! ইডিয়টের দল!
“কথা বাড়াচ্ছি আমি, না আপনি? এ সাড়ে ছ’ আনার প্রশ্ন নয়; আইনের প্রশ্ন। Rule is rule. রেলের রুল অনুযায়ী ওর টিকিট লাগবে না।”
“অযথা তর্ক করেন তো আমি নাচার। অতি ছোট ছেলেটাও যে কথা বোঝে, আপনি বুঝেও সে কথা না বোঝবার ভান করছেন।”
“মুখ সামলে কথা বলবেন!”
“দেখুন এক মায়ের পেটের তিনটি মেয়ের টিকিট লাগবে না সরকারি নিয়ম অনুযায়ী—এরকম কথা ভুল, যে কচি ছেলেটা সবে কর গুনতে শিখেছে সেও ধরতে পারবে। আর নিজেই যখন স্বীকার করছেন যে, ওদের মধ্যে যমজও কেউ নয়, আটাশেও কেউ নয়।”
“আমাকে অঙ্ক শেখাতে এসেছেন! তিনটে দোকানদারের ইনকামট্যাক্সের খাতা লিখে দিই আমি প্রতি বছরে। কর গোনা শেখাতে এসেছেন? কোত্থেকে যে রেল কোম্পানি এই সব গবেটগুলোকে ধরে এনে চাকরি দেয় জানি না! আপনাদের একমাত্র কাজ genuine passenger দের harass করা! সব বুঝি। কেবল ঘুষ খাওয়ার মতলব।”
“সাড়ে ছ’আনার টিকিটে কত আর ঘুষ খাব। যাক, আপনি যখন টিকিট কিনতে রাজি না, তখন আপনাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে অ্যাপিয়ার হতেই হবে। ভাল কথায় বললাম, তা হল না। জরিমানা দেবার সাধ গিয়েছে, তার আর আমি কি করি।”
এককড়ির মেজাজ সপ্তমে চড়েছে। গাড়ি কখন পরের স্টেশনে থেমেছে সেকথা তার খেয়াল নাই।
“আপনাদের ওসব ম্যাজিস্ট্রেট-ফ্যাজিস্ট্রেটের তোয়াক্কা রাখে না এককড়ি দাস। দেখে নেব আমি আপনাকে। আপনার চাকরি খাব! Simple যোগ বিয়োগও কি কোনওদিন শেখেননি?”
সে অনর্গল চিৎকার করে যাচ্ছে। গাড়ির দরজার সম্মুখে লোক জমে গিয়েছে। প্যাসেঞ্জারদের প্রত্যেকেই সমর্থন করছে টিকিটচেকারকে। কেউ কেউ সন্দেহ করছে লোকটা হয়তো ছিটগ্রস্ত।
“বেশি গোলমাল করেন তো এখানেই নামিয়ে পুলিশে হ্যান্ডওভার করে দেব।”
উঠে দাঁড়িয়েছে এককড়ি। হাতাহাতি হবার উপক্রম। কয়েকজন প্যাসেঞ্জার এসে দুজনকে আলাদা করে দিল। ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। বাবলুর মা স্বামীকে হাত ধরে বেঞ্চিতে বসাতে চাচ্ছেন। এককড়ি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে—“আমি আপনার নামে ক্রিমিনাল কেস আনব। রেলের বিরুদ্ধে ‘ড্যামেজ স্যুট’ আনব। লোকসভায় প্রশ্ন করাব এ নিয়ে। ভাববেন না যে এখানেই এ ব্যাপার শেষ হল!”
ভিড় ঠেলে গার্ডসাহেব এসে গাড়িতে ঢুকলেন।
“কী ব্যাপার? কিসের গণ্ডগোল?”
“তিনটে মেয়েকে ফ্রি টিকিটে নিয়ে যেতে চান এই প্যাসেঞ্জার।”
রবার্টসন সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন এককড়ির দিকে।
“ইউ! আপনি! আপনার দেওয়া পুসিটা দুধ খাওয়াবার পর থেকে পোষ মেনে গিয়েছে। এখন বেশ আরাম করে শুয়ে রয়েছে আমার স্ত্রীর কোলে।”
রেলের বাবুরা উপহাসে নির্দয় হয়ে উঠেছে।
“ইনিই তা হলে কাল রাত্রের তিনি!”
“ট্রান্সপোর্ট বিজনেস করেন।”
“অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স আনলিমিটেড।”
খেপে উঠেছে এককড়ি।
“সাট আপ! ভেবেছেন এককড়ি দাস ইংরাজি রসিকতার মানে বোঝে না! স্ত্রীপুত্র পরিবারের সম্মুখে এই সব ইনডিসেন্ট কথা বলে আমাকে অপমান করা!”
“হ্যাঁ, জেনুইন প্যাসেঞ্জারকে।”
রবার্টসন সাহেব রেলের বাবুদের থামিয়ে দিয়ে, টিকিট-চেকারকে জিজ্ঞাসা করলেন—“কত দিতে হবে?” পকেট থেকে পয়সা বার করছেন দেখে এককড়ি হুঙ্কার দিয়ে উঠেছে।
“আমি ভিখিরি নই। কারও দানের প্রত্যাশী নই। আমি শুধু চাই রেলকর্মচারীরা, গভর্নমেন্টের তয়ের করা নিয়ম মেনে চলুক!”
“তবে যা মন চায় করুন।”
গার্ডসাহেব চলে গেলেন।
গাড়ি ছেড়েছে। এর পরের স্টেশনই রাধানগর। গাড়িতে একটা থমথমে ভাব এসেছে। রেলের বাবুরা টিপ্পনী কাটা বন্ধ করেছেন। ছেলেমেয়েদের কান্না বন্ধ হয়েছে। বাবলুর মুখে পর্যন্ত কথা নাই। আসন্ন বিপদের ভয়ে ভাইবোন সকলে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছে। বাবলুর মা মাথা নিচু করে বসে আছেন। স্বামীর কাণ্ডতে লজ্জায় তাঁর মাথা কাটা যাচ্ছে। শেষ মুহূর্তে তিনি সব প্যাসেঞ্জারদের সহানভূতি আকর্ষণ করতে পেরেছেন। একজন সাহস সঞ্চয় করে তাঁকে বলল—“আপনি একটু বুঝিয়ে বলুন ওঁকে।”
“আপনি আমার স্ত্রীর উপরও কর্তৃত্ব ফলাতে চান দেখছি। এককড়ি দাস মেয়েমানুষের কথা শুনে চলে না।”
রাধানগর স্টেশনে যখন গাড়ি থামল তখনও এককড়ির আস্ফালন থামেনি।
“চলুন কোথায় যেতে হবে।”
ওয়েটিংরুমে কোর্ট বসেছে ম্যাজিস্ট্রেটের। লটবহর, স্ত্রী ছেলেমেয়ে সবসুদ্ধ এককড়িকে হাজির করা হল তাঁর সম্মুখে। লোকে লোকারণ্য।
ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করলেন—“আপনি সাড়ে ছ’আনা দিয়ে দিতে প্রস্তুত আছেন?
“আপনিও সার এই কথা বলছেন! টিকিটচেকারটা আপনাকেও হিপনটাইজ করল নাকি?”
“সাবধানে কথাবার্তা বলবেন এখানে। এটা কোর্ট। অন্যায় করেছেন, কোথায় লজ্জিত হবেন, তা নয় আবার উদ্ধতভাবে কথা বলছেন।”
“লজ্জিত হবার মতো কিছু আমি করিনি। রেলের নিয়ম অনুযায়ীই আমি আমার ছোট মেয়ে তিনটিকে নিয়ে যাচ্ছি বিনা টিকিটে।”
“তা হলে দেখান সে রুল আমায়।”
“রুল দেখাবার দরকার নেই। শুধু যোগবিয়োগ জানলেই হবে। ওই তিনটির মধ্যে বড়টির বয়স দু’বছর চার মাস। ওর কি টিকিট লাগবে?”
“ওর বয়সটাতো আমরা অবিশ্বাস করছি। আপনার তিনটি সন্তান ফ্রি টিকিটে যেতে পারে না। সম্ভব অসম্ভব বলেও তো একটা জিনিস আছে।”
“অসম্ভব? একটি সন্তান মায়ের পেটে থাকে কতদিন? দশ মাস?”
“দশ মাস কেন, আমি আরও কমিয়ে দিচ্ছি। Period of gestation ২৭৩ থেকে ২৮০ দিন পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ ধরুন ন’মাস তিনদিন।
“আমি কনশেসন চাচ্ছি না সার—দশ মাসই আপনি রাখুন। একজনের বয়স যদি দুই বছর চার মাস হয় এবং তার পরেরটি যদি এক বছর পর জন্মায়, তা হলে তার বয়স হয় এক বছর চার মাস। কেমন কিনা? আর আমার ছোট মেয়েটি আঁতুড়ঘর থেকে বেরিয়েছে মাসখানেক আগে। বিশ্বাস না হয়, ওর মাকে জিজ্ঞাসা করুন। এর মধ্যে সম্ভব অসম্ভবের কথা কি করে আসছে? সোজা হিসাব। অথচ লোকে গুলিয়ে ফেলছে। জালজোচ্চুরি দেখতে দেখতে লোকের এমন অভ্যাস হয়ে গিয়েছে, সার, যে যেই দেখল তিনটি মেয়েকে বিনাটিকিটে নিয়ে যাচ্ছে, অমনি ধরে নিল যে নিশ্চয়ই ফাঁকি দিচ্ছে লোকটা। লোকে বলল কাকে কান নিয়ে গিয়েছে, অমনি তার পেছু পেছু ছোট। আপনি তো তবু আমার কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন; চেকারবাবুর সে সময় কোথায়! আর প্যাসেঞ্জারদের কথা বাদ দেন। একজন যেই বললে চোর অমনি সবাই চেঁচাল ‘ধর! ধর!’—সবাই মিলে আমায় হেসেই উড়িয়ে দিল সার।”
ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব চেকারকে তাড়া দিলেন অনর্থক জেনুইন প্যাসেঞ্জারকে কষ্ট দেবার জন্য।
“ঠিক আছে সার। আমি চেকারের বিরুদ্ধে ড্যামেজ স্যুট আনব, আর আপনাকে সে কেসে সাক্ষী মানব, বলে রাখলাম। এখন আমার একটু বিশেষ তাড়াতাড়ি আছে। এই কুলি! মাল ওঠাও।”
দোরগোড়াতেই মিস্টার আর মিসেস রবার্টসন দাঁড়িয়ে। গলায় রিকনবাঁধা একটা কালো বিড়াল মেমসাহেবের কোলে। জটিল বিষয়কে সরল করবার অদ্ভুত প্রতিভাসম্পন্ন এই funny বাবুটির সঙ্গে করমর্দন করবার জন্য সাহেবমেম দুইজনেই হাত বাড়ালেন। কী হল ঠিক বলা যায় না; কুলির মাথার প্রকাণ্ড বস্তাটার গন্ধ পেয়ে, কিংবা এককড়ি তাকে আবার ধরতে আসছে ভেবে, বিড়ালটা লাফ মেরে ম্যাজিষ্ট্রেটের টেবিলের উপর দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল।
স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরবার পথে বাবলু মেজদিকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করল—“বাবা অঙ্কে ফাস্ট—নারে?”
“হ্যাঁ।”
“ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব সেকেন্ড?”
“হ্যাঁ।”
“গার্ডসাহেব থার্ড?”
“হ্যাঁ।”
“আর টিকিটচেকার লাস্ট।”
বাবলুর মা এতক্ষণে মুখ খুললেন।
“কাঁধে করে বিড়াল বয়ে নিয়ে যাবার হুজুগ আবার উঠেছিল কেন তোমার? মাথা খারাপ হল না কি!”
“আরে তুমিও যেমন! বিয়েবাড়িতে বিড়ালটা পরিত্রাহি চিৎকার করছিল। বাড়ির গিন্নি বললেন, কালো বিড়ালের ডাক বিয়েবাড়িতে অমঙ্গল ডেকে আনে। আর যাবে কোথায়। সিংহিবাবুকে তো জানই। তখনই হুকুম হয়ে গেল, যে ওটাকে ধরে দূরে নিয়ে গেয়ে ফেলে দিয়ে আসতে পারবে তাকে দশটাকা দেবেন তিনি। বিড়াল ধরা কি যে সে লোকের কম্ম। শেষ পর্যন্ত সেটাকে ধরল সিংহিবাবুর নেপালি দারোয়ান। নেপালি বলেই পেরেছিল। তখন মালিকের মনে পড়ল যে, বিয়েবাড়ির গেট ছেড়ে দারোয়ানের কিছুতেই বাইরে যাওয়া উচিত না। কাজেই আমাকেই নিতে হল ওটাকে দূরে ফেলে আসবার ভার।”
“কেন, আর কি পৃথিবীতে লোক ছিল না তুমি ছাড়া?”
“লোকের অভাব কি পৃথিবীতে; অভাব হচ্ছে টাকা পয়সার। নেপালিটার সঙ্গে দরকষাকষির পর ঠিক হল—সে পাবে ওটাকে ধরবার জন্য চার টাকা, আর আমি পাব রাহা খরচ ছাড়া ওটাকে ফেলে আসবার জন্য চার টাকা। আমি ভাবলাম তোমাদের জামাইবাড়ি থেকে আনবার খরচটাও উঠে যাবে; শ্রদ্ধবাড়িতেও একবার হাজরি দেওয়া হবে; তারপর বিয়েবাড়িতেও বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে দিনকয়েক বেশ…”
কথাটাকে আর শেষ করল না এককড়ি। মুখ দেখে বুঝল যে গিন্নি বুঝে গিয়েছেন, শেষ করবার আগেই। তারপর এককড়ি হিসাব খতিয়ে নিল মনে মনে।
যাবার সময়ের রেল ভাড়া—তেরো আনা। ওখানকার কুলিভাড়া দিয়ে দিয়েছে—জামাই। ওখান থেকে আসবার রেলভাড়া—দুই টাকা সাড়ে তেরো আনা।
রাধানগরে কুলিভাড়া—তিন আনা।
স্টেশন থেকে বাড়ি ফেরবার গাড়িভাড়া—এক টাকা
মোট খরচ চারটাকা তেরো আনা।
বাঁচল—এক টাকা তিন আনা। আর জামাইবাড়িতে চটের বোরাটা নিয়ে গিয়ে ঠিকই করেছিল সে। তার হিসাবে কোথাও ভুল হয়নি। যা করেন শ্রীহরি!
গিন্নি বললেন—“ওই নোংরা বোরার জিনিসপত্রগুলোকে কিন্তু আমি না ধুয়ে ঘরে তুলতে দেব না। ওটা থাক আজকে উঠোনে পড়ে। এখনই বিয়েবাড়িতে যেতে হবে। ধোয়াধুয়ি করবার সময় হবে না এখন।”
গাড়ি থেকে নেমে সবে বাড়ির মধ্যে ঢুকেছেন; বাইরে হুঙ্কার শোনা গেল। সিংহিদের বাড়ির নেপালি দারোয়ান। ছুটতে ছুটতে এসেছে বলে হাঁপাচ্ছে। চক্ষুরক্তবর্ণ; ভোজালির খাপে হাত। কোথায় বেইমান এককড়িবাবু! টাকার বখরা নিয়েছে, অথচ তার মনিবের কাজ করে দেয়নি! বিয়েবাড়িতে হুলস্থূল কাণ্ড বেধেছে। মনিব চটে লাল। মাইজিরা কাঁদছে। কালো বিড়ালটা এখনই ফিরে এসেছে, সেই বিদঘুটে ডাকটা মুখে নিয়ে।…
দড়াম করে সদর দরজার খিল এঁটে দিল এককড়ি, নেপালিটার মুখের উপর।
কুয়োতলা থেকে বাবলুর গলা শোনা যাচ্ছে।
“বাবা হাত গোনায় ফাস্ট, নারে মেজদি; আর মা সেকেন্ড?” 🍁
🍂ফিরে পড়া | ছোটগল্প /দুই
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর লেখা অজস্র ছোটগল্প, রহস্য উপন্যাস ও উপন্যাস বিভিন্ন বয়সের পাঠকদের সাহিত্যপাঠের রসনাতৃপ্ত করেছে। ‘কর্নেল’ সিরাজ সাহেবের অন্যতম সৃষ্টি। আজও একইভাবে ‘কর্নেল’ ভারতীয় সাহিত্যে সমাদৃত। আজকে সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাশ্রয় স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য রইল লেখকের ‘কর্নেলের হেঁয়ালি’ শীর্ষক বহুল প্রশংসিত ছোটগল্পটি।
কর্নেলের হেঁয়ালি
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ
হাড়কাঁপানো শীতের সকালে বরমডিহি রেলস্টেশনে যখন ট্রেন থেকে নামলাম, তখনও চারদিকে গাঢ় কুয়াশা। কয়েক হাত দূরে কিছু দেখা যায় না। কর্নেল হনুমানটুপি পরেছেন। তাই ওঁর দাড়ি ঢেকে গেছে এবং মুখের খানিকটা মাত্র দেখা যাচ্ছিল। সম্ভবত এখন এটাই ওঁর ছদ্মবেশ! একটা ওভারকোটও চাপিয়েছেন। গায়ে। প্রকাণ্ড শরীর আরও প্রকাণ্ড দেখাচ্ছে। পিঠে আটকানো বোঁচকা এবং হাতে সুটকেস। গলায় ঝুলন্ত বাইনোকুলার ওভারকোটের ভেতর লুকিয়ে আছে।
আমার মাথায় টুপি এবং আষ্টেপিষ্টে জড়ানো মাফলার। পুরু জ্যাকেটের ভেতরও শীতের ঠাণ্ডা হিম থাবা টের পাচ্ছি। কর্নেলের পরামর্শে পশমের দস্তানা পরেছি। হাতে একটা হাল্কা সুটকেস।
বরমডিহি একটা হিলস্টেশন। পাহাড় দুভাগ করে রেললাইন চলে গেছে। পাড়ের গায়ে জঙ্গল কুয়াশায় ঢাকা। অক্টোবরে আমরা এখানকার নিসর্গের অন্যরূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। ডিসেম্বরের সকালে এখানকার নিসর্গের অন্য রূপ দেখে আমি ভড়কে গেলাম। এর চেয়ে দার্জিলিং-কালিম্পং অনেক আরামদায়ক, যদিও সেখানে বরফ পড়ে। এখানে বরফ পড়ে না। কিন্তু এ কী বিচ্ছিরি ঠাণ্ডা!
কিন্তু এই সাংঘাতিক ঠাণ্ডার মধ্যেও কী ভিড়! কর্নেল হনুমানটুপির আড়াল থেকে বললেন, শীতে মুনলেক ট্যুরিস্টদের বড় আকর্ষণ। এ সময় কালো দৈত্যের উপদ্রব হয় না। তবে বেশিরভাগই বাঙালি। পিকনিক করতে আসে আশেপাশের শিল্পাঞ্চল থেকে। সব হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ, সরকারি বাংলো গিজগিজ করে। কলকাতার বাবুদের বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে কেয়ারটেকাররা এ সময় প্রচুর কামিয়ে নেয়।
উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম, তা হলে এবার আমরা উঠব কোথায়?
তরুণবাবুর বাংলোবাড়িতে।
তরুণবাবু? কোন তরুণবাবু?
তোমাকে যখন তরুণবাবু বলছি, তখন তোমার বোঝা উচিত এখন একজন তরুণবাবুই আছেন, যাঁকে তুমিও চেনো।
অবাক হয়ে বললাম, শচীনবাবুর ভাই তরুণবাবু? ওঁর এখানে বাংলোবাড়ি আছে নাকি?
থাকা স্বাভাবিক। বৈমাত্রেয় দাদা ওঁকে পৈতৃক বাড়িতে ঢুকতে দেননি। কাজেই বিত্তবান ছোটভাই ক্ষোভে দুঃখে এবং জিদ করেই এখানে সুদৃশ্য বাংলোবাড়ি তৈরি করেছেন।
কিন্তু তরুণবাবুর সঙ্গে আপনার এ ব্যাপারে কখন কথা হল?
কাল দুপুরে তুমি যখন ঘুমোচ্ছিলে, তখন টেলিফোনে কথা হয়েছে। কর্নেল হনুমানটুপির আড়ালে হাসলেন এবং চোখে সেই কৌতুকের হাসি জ্বলজ্বল করে উঠল। দাদাকে চিট করার জন্য তরুণবাবু সব সময় তৈরি। কাজেই আমি সেই সুযোগটা নিয়েছি আর কী! এবার দেখা যাক, ঝুলির ভেতর থেকে কার বেড়াল বের হয়।
আপনি ওঁকেও কি বলেছেন শ্যামবাবুরই রক্তাক্ত লাশ দেখেছিলেন?
বলেছি। তাই শুনেই উনি–যাক্। এখন এসব কথা নয়। যা অবস্থা দেখছি, যানবাহন পাব না। পায়ে হেঁটে যেতে হবে।
বাংলোবাড়িটা কোথায়? কত দূরে?
এখান থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার হবে। শচীনবাবুর সেই বাড়ির উল্টোদিকে কিছুটা দূরে একটা টিলার মাথায়। বাড়িটার নাম হিলটপ। তরুণবাবু জিদ করে আস্ত একটা পাহাড় কিনে ফেলেছিলেন।
সেই কনকনে ঠাণ্ডা এবং কুয়াশায় বাঁদিকে নতুন টাউনশিপ এবং বাজার এলাকা ছাড়িয়ে আমরা যে রাস্তায় মোড় নিলাম, সেটাই বরমডিহি-জাহানাবাদ রোড। সৌভাগ্যক্রমে একটা খালি ট্রাক পাওয়া গেল। ট্রাকটা একটা কাঠগোলা থেকে সবে স্টার্ট দিয়ে রাস্তায় উঠেছিল। ট্রাক ড্রাইভাররাও যে এই মরশুমে বেশ কামিয়ে নেয়, তা বুঝলাম। পঞ্চাশ টাকা হেঁকেছিল। তিরিশে রফা হল। তখন তিরিশ টাকা অনেক টাকা!
কিন্তু কী আর করা যাবে? কর্নেল যা পারেন, আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। মিলিটারির লোক। তার ওপর এই বয়সেও গায়ে সাংঘাতিক জোর। এদিকে ওইটুকু হেঁটেই আমি ভিজে বেড়ালছানা হয়ে গেছি।
কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে ট্রাকটা সাবধানে যাচ্ছিল। প্রায় আধঘণ্টা পরে ড্রাইভার বলল, হিলটপ বাংলো বোলা? উতারিয়ে।
টাকা মিটিয়ে দুজনে নামলাম। ততক্ষণে কুয়াশা কিছুটা কমেছে। সূর্যের চেহারা বিবর্ণ হলুদ থালার মতো এবং মাঝে মাঝে কুয়াশার প্রবাহ চলেছে। ট্রাকটা চলে গেল। কর্নেল পা বাড়িয়ে বললেন জয়ন্ত! তোমার দুর্ভাগ্য! হাঁটতেই হবে।
কেন?
মনে হচ্ছে, আধ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি। হু! ওই তো মুনলেক যাওয়ার রাস্তা!
খাপ্পা হয়ে বললাম, ট্রাক ড্রাইভারটা তো মহা পাজি!
নাহ। ওর দোষ নেই। আমিও তো কুয়াশায় কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। চলো, মুনলেক রোড দিয়ে ঘুরে শর্টকাট করি। ওই রাস্তার উত্তরে হিলটপ বাংলো। সেবার বাইনোকুলারে দূর থেকে দেখেছিলাম। কর্নেল হাঁটতে হাঁটতে বললেন, এস। জগিং করা যাক্। তা হলে ঠাণ্ডাটা কেটে যাবে। কাম অন!
বলে সত্যিই উনি জগিং শুরু করলেন। অগত্যা আমিও শুরু করলাম। কিন্তু সুটকেস হাতে জগিং বা দৌড়ব্যায়াম সহজ নয়। তাতে পাথর, ঝোপঝাড়, উঁচুউঁচু গাছের জঙ্গল। একবার হোঁচট খেয়ে পড়তে পড়তে সামলে নিলাম। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। কর্নেল আমাকে টেনে ওঠালেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা মোটামুটি কেটে গেল। হিলটপ বাংলো কর্নেলের বাইনোকুলারে ধরা পড়ল। তারপর কী করে যে চড়াই বেয়ে বাংলোর গেটে পৌঁছুলাম কে জানে! কর্নেল হয়তো একটা আস্ত চুম্বক।
কেয়ারটেকার আমাদের দেখে দৌড়ে এলেন। আপনি কি কর্নেল সায়েব? নমস্কার স্যার। সায়েব ট্রাঙ্কল করেছিলেন ওঁর লোকাল ব্রাঞ্চ অফিসে। সেখান থেকে কাল সন্ধ্যায় আমাকে খবর দিয়ে গেছে। কিন্তু ওখান থেকে স্টেশনে গাড়ি পাঠানোর কথা। যায়নি গাডি? কী আশচর্য! বৈজু! বৈজু! ইধার আও।
একজন লোক দৌড়ে এল। কেয়ারটেকারের নির্দেশে সে আমাদের সুটকেস দুটো নিয়ে গেল। কর্নেল সহাস্যে বললেন, গাড়ি নিশ্চয় গিয়েছিল। তবে গাড়ি সম্ভবত সাদা দাড়ি খুঁজছিল এবং দাড়ির দর্শন পায়নি। কারণ তা ঢাকা ছিল।
কেয়ারটেকার হেসে ফেললেন।
সুন্দর সাজানো একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে তিনি রুম হিটার চালিয়ে ঘর গরমের ব্যবস্থা করলেন। কর্নেল বললেন, আপনিই নন্দবাবু?
আজ্ঞে হ্যাঁ। আমার নাম নন্দকুমার রায়। সায়েব কিংবা তাঁর গেস্ট এলে আমি আগাম চলে আসি। নৈলে বৈজই সব দেখাশোনা করে। বেজু জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবেতেই এক্সপার্ট। চায়ের ব্যবস্থা করে আসি।
কফি পেলে ভাল হয়। আমি কিন্তু কফিরই ভক্ত।
নন্দবাবু হাসলেন। কফিও আছে। কোনও অসুবিধা নেই স্যার! সায়েবও আসবেন বলেছেন। তাই সব ব্যবস্থা করে রেখেছি।
নন্দবাবু চলে গেলে বললাম, আপনি ভবিষ্যতে আর দাড়ি ঢাকবেন না। ওঃ! আপনি দাড়ি না ঢাকলে এই কষ্টটা পেতাম না।
ডার্লিং! কথায় আছে না কেষ্ট পেতে হলে কষ্ট করতে হয়?
কী কেষ্ট পেলেন শুনি?
কর্নেল চোখে হেসে বললেন, শুধু কেষ্ট নয়, তার সঙ্গিনী রাধাকেও।
অ্যাঁ?
চেপে যাও, ডার্লিং! স্পিকটি নট। বলে ওভারকোট এবং হনুমানটুপি খুলে ফেললেন কর্নেল। চাপা স্বরে ফের বললেন, ট্রাক ড্রাইভারকে বখশিস দেওয়া উচিত। আমাকে ঠিক জায়গায় সে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।
নন্দবাবু এলেন। কফি এসে যাচ্ছে। ব্রেকফাস্ট কখন খাবেন স্যার?
ঘড়ি দেখে কর্নেল বললেন, এখন সাড়ে আটটা। ন-টায় খাব বরং।
বৈজু আছে। কোনও অসুবিধে হবে না। আমি একবার বাড়ি ঘুরে বাজার টাজার করে আসছি।
আপনি কি বরমডিহির বাসিন্দা?
আজ্ঞে তিনপুরুষের বাসিন্দা। বলে নন্দবাবু ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেলেন। আমি বাথরুমে যাচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, নন্দবাবু সাইকেল নিয়ে লনে হাঁটছেন। বোঝা গেল, ভদ্রলোক যদিও কেয়ারটেকার, এই বাংলোয় আসেন কদাচিৎ। সম্ভবত বৈজুই কার্যত কেয়ারটেকারের সব দায়িত্ব পালন করে।
বাথরুম থেকে ফিরে দেখি, টেবিলে কাপ, ট্রেতে কফির পট, দুধ, চিনি এবং দুটো মস্ত পেয়ালা। প্লেট ভর্তি নানারকম স্ন্যাক্সও আছে। রুম হিটারের কাছাকাছি বসে আরামে কফি খেতে খেতে বললাম, দা হলে দৈবাৎ বিগ সন্ধান পেয়ে গেছেন?
কর্নেল চোখ কটমট করে তাকালেন।
বললাম, সরি! স্পিকটি নট।
কিছুক্ষণ পর বৈজু ট্রে নিতে এল। কর্নেল চুরুটের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা বৈজু! দেখো তো ইধার। ইয়ে আদমিকো পহচানতা তুম?
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামবাবুর ছবি বের করে তাকে দেখালেন। বৈজু ঝুঁকে ছবিটা দেখল। গম্ভীর মুখে বলল, মালুম, কোহি জগাহ্ পর দেখা। লেকিন য়্যাদ নেহি আতা।
খ্যালসে দেখো, বৈজু!
সে মাথা চুলকে বলল য়্যাদ নেহি আতা হজুর!
আচ্ছা! ইয়ে চার পিকচার দেখো!
কর্নেল পকেট থেকে শ্যামসুন্দরের চারটে রিটাচ করা ছবি টেবিলে সাজালেন। এইসব ছবিতে বয়সের ছাপ দেওয়া হয়েছে এবং কোনও ছবিতে গোঁফ, কয়েকরকম ছাঁটের দাড়ি আঁকা।
বৈজু ঝুঁকে ছবিগুলো দেখছিল। চিবুকে দাড়িওয়ালা ছবিটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে একটু হাসল। ইয়ে তো ওহি আদমি।
কৌন?
দেড়-দো মাহিনা আগে সাব কা সাথ মুলাকাত করনে আয়া।
উসটাইম তুমকা সাব হেঁয়া থা?
সাব দো-দিনকে লিয়ে আয়া, হজুর! ফির চলা গেয়া কলকাত্তা।
ইয়ে আদমি উনহিকা সাথ চলা গেয়া?
নেহি হুজুর! সাব একেলা চলা গেয়া। ইয়ে আদমিকা সাথ সাবকা বহত বাতচিত করার হুয়া। সাব ইসকো নিকাল দিয়া ঘরসে।
দো মাহিনা নেহি! দেড় মাহিনা আগে।
বৈজু একটু হাসল। হোগা দেড় মাহিনা। তো কাহে হামকো ইয়ে সব বাত পুছতা হুজুর?
কর্নেল পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে দিয়ে বললেন, বখশিস্ বৈজু। কিসিকো মাত বোলো হাম তুমকো পিকচার দেখায়, কী ইস্ তরাহ কোই বাত কিয়া। সমঝা?
হাঁ হুজুর!
সে সেলাম ঠুকে সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বললাম, তা হলে দেখা যাচ্ছে, তরুণবাবুও আপনাকে অনেক কথা গোপন করছেন! অক্টোবরে শ্যামবাবুর সঙ্গে তরুণবাবুর এখানে দেখা করার কথা ছিল এবং দেখা হয়েছিল। সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিগ্রহের দরদাম নিয়ে তর্ক হয়েছিল। বেশি দাম চাওয়ায় চটে গিয়ে তরুণবাবু তাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কিও আমার অবাক লাগছে, তরুণবাবু বিগ্রহচোরকে তক্ষুনি পুলিশে দেননি। কেন? তারও পূর্বপুরুষে অমূল্য সম্পদ ওই বিগ্রহ। চোরকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিলেন কেন?
কর্নেল চোখ বুজে চরুট টানছিলেন। আমার কথাগুলো যেন ওর কানে ঢুকল না। হঠাৎ চোখ খুলে বেমক্কা হাঁক দিলেন, বৈজু! ইধার আও! বৈজু কিচেনের দিক থেকে সাড়া দিল। তারপর তেমনই সন্দিগ্ধ ভঙ্গিতে আড়ষ্টভাবে ঘরে ঢুকে সেলাম দিল।
কর্নেল বললেন, ঔর এক পিকচার দেখো বৈজু!
উনি এবার পকেট থেকে জাল ভোলা ওরফে হারাধনের ছবি বের করে দেখালেন। বৈজু কঁচুমাচু হেসে বলল, হুজুর। ইয়ে তো সাবকা সাথ কলকাত্তাসে আয়া। সাবকা সাথ চলাভি গেয়া। ইস্কা নাম–
হারাধন।
হাঁ হুজুর! সাবকা নোকর-উকর হোগা। লেকিন বলে সে হাত জোড় করল। হুজুর! মুঝে মালুম নেহি পড়ে, কাহে আপ ইয়ে সব বাত পুছতা! হাম গরিব আদমি হুজুর! নোকরি চলা যায় তো ভুখসে মর যায়েগা।
কর্নেল আর একটা দশ টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিয়ে ওকে আশ্বস্ত করলেন। বৈজু আড়ষ্টভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কর্নেল হিন্দিতে বললেন, তোমার সায়েব থাকার সময় কি এখানে কালো দৈত্যের উপদ্রব হয়েছিল?
বৈজু বলল, হ্যাঁ হুজুর! তার পরদিন সায়েব কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন।
কর্নেল আপন মনে বললেন, ২৬শে অক্টোবর তরুণবাবু কলকাতা ফিরে যান।
হুজুর?
কিছু না তুমি এস বৈজু। চিন্তা কোরো না। এসব কথা কেউ জানবে না।
বৈজু চলে গেল। কর্নেলকে গম্ভীর দেখাচ্ছিল। বাইনোকুলার হাতে বাইরের বারান্দায় গেলেন উনি। বাইরে ততক্ষণে রোদ ফুটেছে।
একটু পরে বারান্দায় গেলাম। দেখলাম লনে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ প্রকৃতিবিদ বাইনোকুলারে কিছু দেখছেন। জায়গাটা উঁচু বলে চারদিকে বহু দূর দেখা যাচ্ছে। পূর্বদিকে গাছপালার ফাঁকে একটা চওড়া পিচের পথ দেখতে পেলাম। তারপরই চোখে পড়ল–হ্যাঁ, ওই তো সেই পোড় দোতলা বাড়িটা! অত দূর থে যেন হিংস্র চোখে তাকিয়ে আছে। কঙ্কালের মতো ভয়ঙ্কর একটা বাড়ি।
কর্নেল হঠাৎ ঘুরে একটু হেসে বললেন, বাইনোকুলারে ভুতুড়ে বাড়িটা দেখবে নাকি জয়ন্ত?
নাহ্! আপনি দেখুন!
ব্রেকফাস্টের সময় হয়ে এল। খেয়ে নিয়ে বেরুব। তুমি—
ঝটপট বললাম, নাহ্। ঘুমোব।
কর্নেল অট্টহাসি হাসলেন। তোমার মনে যে প্রশ্নগুলো এসেছে, আমার মনেও এসেছে। তবে এখন এ নিয়ে মাথা ঘামানোর অর্থ হয় না। তরুণবাব। আসুন। তারপর আশা করি, ব্যাখ্যা পেয়ে যাব। ওঁর এখানে আসার উদ্দেশ্য আমাকে ব্যাখ্যা দেওয়া এবং বৈমাত্রেয় দাদাকে চিট করা। এক ঢিলে দুই পাখি বধ। ওয়েট অ্যান্ড সি।
আপনি বলেছিলেন বিগ্রহের খোঁজ পেয়ে গেছে। কোথায় কীভাবে পেলেন?
সমস্যা হল, জয়ন্ত! কখন আমার মুখ দিয়ে একটা কথা বেরিয়ে যায় এবং তুমি তা নিয়ে বড় বেশি চিন্তাভাবনা করে ফেলো! ওটা একটা আইডিয়া।
আহা, খুলে বলতে অসুবিধা কী?
কর্নেল বারান্দায় এসে বেতের চেয়ারে বসলেন। আমিও বসলাম। কর্নেল বললেন, বনজঙ্গল, পাথর, তার ফের চড়াই ভেঙে ওঠার সময় বাংলা প্রবচনটা আমার মাথায় এসেছিল : কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। হ্যাঁ, কষ্ট কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একবার হোঁচট খেতে দেখলাম তোমাকে। দ্বিতীয়বার হোঁচট খেয়ে তুমি পড়ে গেলে। তোমাকে টেনে ওঠালাম। ওঠাতে গয়ে আইডিয়াটা মাথায় এল।
উনি থেমে গেলেন হঠাৎ। হাঁক দিলেন, বৈজু ব্রেকফাস্ট লাও!
মাঝে মাঝে কর্নেলের এইসব হেঁয়ালি ন্যাকামি মনে হয়। বিরক্ত হয়ে চুপ করে থাকলাম।
কর্নেল বললেন, যা বলছিলাম। কষ্ট করে আরোহণের সময় পদঙ্খলন হতেই পারে। একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে কষ্ট করে মানুষ এগোচ্ছে। হঠাৎ পা পিছলে পতন। দা আইডিয়া!
বৈজু বারান্দার টেবিলে ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেল।
মাখনটোস্টে কামড় দিয়ে কর্নেল বললেন, তো যেখানেই কেষ্ট সেখানেই রাধা।
ওঃ কর্নেল! আপনি বিগ্রহ পেয়ে গেছেন বলছিলেন?
দা আইডিয়া! আইডিয়া যদি সঠিক হয়, তা বাস্তবে কাজে লাগালেই সঠিক প্রাপ্তি। যা চাইছি, তা পেয়ে যাবই। তোমার পতনের সময় যে আইডিয়া মাথায় এসেছিল তা সঠিক বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। কাজেই বিগ্রহ পেয়ে গেছি, এটা নিশ্চিত। শুধু উদ্ধারের অপেক্ষা মাত্র।
নাহ্। আর মুখ খুললে আবার ক্রমাগত হেঁয়ালি শুনতে হবে। কাজেই চুপচাপ ব্রেকফাস্টে মন দেওয়াই উচিত।… 🍁
🍁ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ৯
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ ‘একটি বিষণ্ণরাতের তারা’ উপন্যাসের পর্ব ৯।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
নয়.
রাস্তায় চলার অধিকার আমার আছে
মচকে যাওয়া পা সেরে উঠতে প্রায় এক সপ্তাহ লেগে গেল। একটা খবরও রুমাকে দিতে পারিনি। এক সপ্তাহ ধরে সে আমার সম্পর্কে কী কী ভেবেছে তাও জানি না। ওকে না জানাতে পেরে আমার কষ্টটাও কম হয়নি। এক সপ্তাহ পর উঠে দাঁড়িয়েও এখনো সম্পূর্ণ ভার দিয়ে পায়ের ওপর দাঁড়াতে পারি না। ডাক্তার একটা মালিশ লিখে দিয়েছে। সেটা কিনে এনে দু’বেলা মালিশ দিলে ব্যথা দূর হবে। কিন্তু এই অবস্থাতেই আমি আর বাড়িতে বসে থাকতে পারলাম না। বাস ধরার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখি প্রতিমা দাঁড়িয়ে আছে, তার পরনে নতুন শাড়ি, সিঁথিতে সিঁদুর, আলতা রাঙা পা। একেবারে দুর্গা প্রতিমার মতোই মনে হচ্ছে তাকে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে তারই বর। বরটা তার সঙ্গে একেবারেই মানানসই হয়নি। কালো বেঁটে, দেখতেও ততটা ভালো নয়। এমন সুন্দরী একটি মেয়েকে এরকম বর দেখে কেন বিয়ে দিলেন? আমার বুকটা ছ্যাঁত্ করে উঠলো। স্কুল জীবনের কৈশোর বেলার প্রথম ভালোলাগা ছিল প্রতিমা। তার কণ্ঠের রবীন্দ্র সংগীতের কী জাদুতে সেদিন মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম! জন্ম নিয়েছিল তার প্রতি এক পরম দুর্বলতা। অনেকবার খাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলেছিলাম তাকে নিয়ে লেখা কবিতগুলি। আজকে হাসতে হাসতে শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে। কবে ওর বিয়ে হলো?
মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলাম।
—আমাদের নিমন্ত্রণ করলি না? জানতেই পারলাম না কিছু!
—হঠাৎ হয়ে গেল! অনুষ্ঠান করার সুযোগই হয়নি! তারাপীঠের একটি লজেই দুই পক্ষের লোক এসেছিল। সেখানে একটি ছোট্ট অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই শুভ কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
—এইটাই বুঝি বর?
—হ্যাঁ এটাই বর।
তারপর প্রতিমা তার বরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললো, আমরা একসঙ্গে পড়েছি। ও এখন কলেজে পড়ে।
প্রতিমার বর হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করলো। কী খরখরে কড়া হাত! মনে হলো লোহালক্কড়ের কাজকর্ম করে। কিন্তু সে-কথা জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না। বরের বয়স প্রতিমার থেকে অনেক বেশি। বাসে ওঠার সময় লক্ষ্য করলাম প্রতিমার হাত ধরে সে বাসে উঠালো। সাঁড়াশির মতো ওর হাত যে কিছুতেই ছাড়ানো যাবে না তা বেশ বুঝিয়ে দিল। বাসের কেবিনের কাছে ওরা বসে পড়লো দু’জনেই। আমি একটু দূরত্বে দাঁড়ালাম। ওদের দেখে মনে হলো কাকের বাসায় যেন একটা রঙিন প্রজাপতি। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। পুরনো ভালোবাসা, অপ্রকাশিত ভালোবাসা কখনো কখনো এমন নিভৃতে যন্ত্রণা দিতে জানে। হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। প্রতিমার কথা ভাবতে ভাবতেই ভুলে গেলাম রুমার কথা। সাত দিন ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। কেমন করে আমার পা মচকে যাওয়ার কথা বলবো সেসব কথার প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল, কিন্তু কিছুই হলো না। সারা রাস্তা মনের মধ্যে দাগ কাটতে লাগলো এক অকাল প্রতিমা। অবশ্য প্রথম যৌবনের অনেকটাই শিহরন তার মধ্যে অনুভব করেছি। প্রতিমারা গ্রামের সবচেয়ে ধনী পরিবার। কিন্তু কেন যে বেশি দূর লেখাপড়া করলো না তা জানি না। আমি আবার রুমার কথা ভেবে তার দিকেই মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলাম।
গ্রাম থেকে শহরে আসতে প্রায় পৌনে এক ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। ঘনঘন স্টপেজে লোকজন ওঠানামা করেছে। সেদিকে আমার কোনো খেয়ালই হয়নি। খালাসির চিৎকারে চেতনা ফিরে এলে বুঝতে পারলাম কলেজ মোড়ে এসে পৌঁছেছি। দ্রুতবাস থেকে নেমে ভিতরে যাবার চেষ্টা করলাম।
তখন ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ‘ভিতরে আসতে পারি?’ অনুমতি নিয়েই প্রবেশ করলাম ক্লাসে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলাম, কিন্তু কোথাও রুমাকে দেখতে পেলাম না। তাহলে সে কি আজ কলেজে আসেনি? আবারো মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। ওর বান্ধবী সুমিতাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ক’য়েকদিন থেকেই আমার জন্য খুব উদ্বেগে ছিল। আমি কেন কলেজে আসছি না এই প্রশ্ন তার। কিন্তু কোনো কারণই জানতে পারেনি। আমি বেশিক্ষণ আর ক্লাসে থাকতে পারলাম না। কলেজ থেকে সটান বেরিয়ে পোস্ট অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। ১৫ পয়সায় একটি পোস্টকার্ড কিনে তাতেই লিখে ফেললাম—
“রুমা, আজ কলেজ এসে তোমাকে দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এক সপ্তাহ যাবত কলেজ আসতে পারিনি। শেষ যেদিন তোমার সঙ্গে দেখা করে আসি, সেই দিনই বাস থেকে নামতে গিয়ে নিচে পড়ে যাই। ডান পায়ের পাতাটি দুমড়ে গেলে ভীষণভাবে আহত হই। আজ কেবল শয্যা থেকে উঠে কলেজে এসেছিলাম। এই পোস্ট কার্ড পাওয়া মাত্রই তুমি অবশ্যই কলেজে আসবে।”
তখনকার দিনেও চিঠির শেষে একটি ছদ্মনাম ব্যবহার করতাম। তাই লিখেছিলাম— ইতি তোমার ‘পথিক’।
কলেজে আ’রেকজন আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল তার নাম সুবোধ। সুবোধের বাড়ি ছিল দস্তরপুর, ব্রহ্মাণী নদীর ওইপারে। কতবার সাইকেল ঠেলে তার বাড়ি যেতাম। প্রতিবছর নবান্ন উৎসব এলে তার বাড়িতে সারাদিন কাটাতাম। সে-ই কেবল আমার সব কথা জানতো। কিছুদিন সাইকেল চালিয়ে কলেজেও আসতে শুরু করেছিলাম, কিন্তু রাস্তা খারাপ বলে সাইকেল নিয়ে আসতে ভালো লাগতো না। তাই কুড়ি পয়সা টিকিট দিয়ে বাসে যাতায়াত করাটাই ছিল উত্তম।
আমার পোস্টকার্ডের চিঠিটা দ্রুত পৌঁছে গেছিল রুমার কাছে। তিনদিন পরেই দেখি রুমা এসে উপস্থিত হয়েছে কলেজে। পায়ের কোথায় লেগেছে, কী কী ওষুধ খেয়েছি এবং ডাক্তারে কী বলেছে সবকিছুর ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে তাকে। আরো বিশ্রাম দরকার কিনা এবং আরো কিছু পথ্য দিতে হবে কিনা এক নিমেষে সবকিছুই সে জানতে চাইলো। আমি কলেজ না আসার কারণে সেও এতদিন কলেজ আসেনি। শুধু আমার কথা ভেবে ভেবেই নাকি তার এক সপ্তাহ কেটেছে। গত এই এক সপ্তাহে কী কী পড়া হয়েছে বিষয়টি অবগত হওয়ার জন্যই আমাকে সুবোধের সাহায্য নিতে হয়েছিল।
প্রতিদিন কলেজ থেকে ফিরেই সন্ধেবেলায় টিউশানি পড়ানোর জন্য আমাকে যেতে হতো পাশের গ্রামে। ফিরতে ফিরতেই প্রায় রাত্রি দশটা পেরিয়ে যেত। শীতকালে দেখতাম কাছাকাছি কোথাও শেয়াল ডাকছে। কিন্তু কেমন ভয় পেতাম না। বাবার ছিল রাত্রে যোগানদারের কাজ। মাঝে মাঝে আমিও বাবার সঙ্গে মাঠে যেতাম। ধানের জমি পাহারা দিতে গিয়ে দেখতাম জমির অপর প্রান্তে গরুর মতো কিছু প্রাণী ধান ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেই তারা আবার নিমেষের মধ্যেই অন্য প্রান্তে চলে আসছে। এভাবে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সারারাত ছুটোছুটি করলেও কিছুতেই তাদের তাড়ানো যেত না। টর্চের আলো ফেললে কিছুই দেখা যেত না। বাবা বলেছিল, এরা ধানখেকো জ্বীন। যেকোনো সময় যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারে। ভয় পেলে হয় না।
সুতরাং আমার ভয় ছোটবেলাতেই ভেঙে গেছিল। ক’য়েক আঁটি ধান বেঁধে দিয়ে আমার মাথায় তুলে দিলে আমি একাই বাড়ি নিয়ে চলে আসতে পারতাম। একদিন একটা শেয়াল রাস্তা ঘিরে দাঁড়িয়েছিল কিছুতেই সরছিল না। আমি রেগে গিয়ে ধানের বোঝাটি তার ওপর ফেলে দিতে চেয়েছিলাম। চেঁচিয়ে বলেছিলাম, শালা শেয়ালকে আজ শেষ করে ফেলব!
কিন্তু তৎক্ষণাৎ শেয়ালটি সরে গিয়েছিল। সেই থেকে ধানের বোঝা মাথায় থাকলেও অবশ্যই সঙ্গে একটি লাঠি রাখতাম। কিন্তু সেদিন দেখলাম অন্য একটি দৃশ্য যা আমি কখনো দেখিনি। অন্ধকারে দু’জন নারী-পুরুষ একেবারে নগ্ন অবস্থায় পরস্পরকে আঁকড়ে ধরেছিল। তাদের মুখমণ্ডল দেখতে পাইনি, কিন্তু শরীর দেখে বুঝেছিলাম একজন এই গাঁয়েরই বউ এবং অন্যজন এই গাঁয়েরই এক মাষ্টার মশাই। আমাকে দেখেও তারা যখন পালাছিল না, তখন নিজেই লজ্জিত হয়ে টর্চের আলো বন্ধ করে অন্ধকারে হারিয়ে যাবার চেষ্টা করেছিলাম। শরীরে ঘাম ঝরতে শুরু করেছিল। অন্ধকারে দু’টি ছায়ামূর্তি যখন বীভৎস হয়ে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়েছিল তখন ধান খেতে দেখা সেই জ্বীনদের থেকেও ভয়ংকর মনে হয়েছিল। বুঝতে পেরেছিলাম নারী পুরুষের অবৈধ লীলা এভাবেই মাঠে-ঘাটে অন্ধকারে নির্লজ্জের মতো চলতে থাকে। ধান খেকো জ্বীনদের মতো তারা একে অন্যের দেহ খেতে আসে। সমাজের কোনো যোগানদারেরই তাগদ হয় না তাদের শাসন করার। সুতরাং কথাটি আমাকে চেপে যেতে হয়েছিল। বাড়ি আসার রাস্তাও পরিবর্তন করতে হয়েছিল। কিন্তু সেটাও ছিল আর একটা বিপদ। মাঝখানে রাস্তা ভেঙে যার বাড়ির পাশ দিয়ে যাতায়াত করতাম, সেও সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। কেননা তার বাড়িতেও অবিবাহিতা সুন্দরী একটি মেয়ে থাকে। পাড়ার ছেলেরা ঢিল ছুঁড়তে বাকি রাখেনি। বারবার নিরীক্ষণ করতে করতে একদিন রাত সাড়ে দশটা নাগাদ আমার রাস্তা ঘিরে দাঁড়ায় মেয়েটির মা। তারপর বলতে থাকে:
—কী মাস্টার, সোজা রাস্তা থুয়ে রেতের বেলায় ইদিকে!
—উ-দিকে ডর লাগে তাই।
—ই-কথা তো মিছা কথা সবই আমরা বুঝি!
আসল কথা তো বলছো না!
—আসল কথা আর কী কথা? আমার তো জানা নাই!
—ওসব ন্যাকামি করতে হবে না, একদিন ঠিক বুঝতে পারবা!
মেয়েটির মায়ের নাম ছিল গাতান। পাড়ার লোকেরা সবাই ওকে ভয় পেতো। ভয় পাওয়ার কারণও ছিল। থানায়, কোর্ট-কাছারিতে সর্বত্রই তার যাতায়াত ছিল অবাধ। বিয়ের জন্য তার মেয়েকে কেউ দেখতে এলে সে নিজেই ছেলেপক্ষকে উকিলের মতো জেরা করতো। তার জেরার চোটে ভয়ে-ডরে কেউ বিয়ে দিতে রাজি হতো না। এমনি করেই মেয়েটির বয়স কখন চব্বিশ বছরের অধিক হয়ে যায়। মেয়েটিও হাইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। পাত্র নির্বাচন করতে গিয়েও উকিল মোক্তার ডাক্তার ইত্যাদির খোঁজ করেছে। আমি যেহেতু কপর্দকশূন্য বেকার এবং বয়সে অনেক নবীন একজন ছাত্র—তাই আমাকে পাকড়াও করার কোনো ভয় ছিল না। কিন্তু হঠাৎ তার সামনাসামনি হওয়াতে মনের মধ্যে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সূচনা হলো। বয়স কম বলে চূড়ান্ত সাহসও ছিল। তাই যেকোনো সংকটই আসুক কোনো কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে নিজের মতোই চলতে শুরু করলাম। যেতে যেতে বললাম : রাস্তা কারো বাবার নয়, রাস্তায় চলার অধিকার আমার আছে। আর আমি চোরও নই যে চুরি করার জন্য এই রাস্তা দিয়ে হাঁটি!
গাতান অন্ধকারে কী ভাবল, কেমন তার মুখের ভঙ্গি হলো তা আর আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। হন্-হন্ করে এগিয়ে যেতে লাগলাম আমার বাড়ির রাস্তায়। (চলবে)🍁
🍂কবিতা
পরাণ মাঝি
ষোড়শ শর্বরী
অনামিকা শ
দগ্ধ রজনী! চোখ নিদ্রাহীন
তবু আছি, বেশ-
বিদায়ের কালে বিরহী হৃদয়ে
চিরন্তনী প্রলেপ।
স্বয়ং-
বয়ে আনি বিধৃত বার্তার অশনি
দেহমন জুড়ে বিরাজিত পুলক; অপূর্ব
জানি-
ব্যস্ততার প্রকৃতি এখন প্রবলতর,
বিস্তৃত জগত;
সেখানে হৃদয় নেই…
বুঝেছি,
ওখানে আমিও ঠিকানাহীন
অনেক প্রয়োজনের ভীড়ে হৃদয় পরিত্যাজ্য
সেখানে শূন্যতা কিছু নয়
বরং-
নব আনন্দ আয়োজনে আছো বুঁদ হয়ে!
তোমার কাছে ছুটেছে; অবুঝ হৃদয়
অথচ উদাসীন ও অসহ্য বাতাস ছড়িয়েছিল নিঃশ্বাস; বিষাক্ত
সুজনেষু!
হৃদয় ভাঙতে তো চেয়েছিলে; নিঃস্ব করে
মুছে দিতে চেয়েছিলে – স্মৃতিমহল
বলো-শূণ্য করেছো কতটুকু?
সুখ তো সাময়িক
তবুও প্রতীক্ষা;
শুধু-আগমনীর ষোড়শ শর্বরীর…
গোলাম কবির-এর দু’টি কবিতা
হেলাল হাফিজ
একটা একলা জীবন কাটিয়ে দিলে
ব্যর্থ প্রেমের বিরহে,
একটা একলা জীবন কাটিয়ে দিলে
প্রেম ও দ্রোহের কবিতা লিখে!
একটা একলা জীবন কেটে গেল
তাঁর কবিতার রাজকুমার হয়ে,
একটা জীবন কেটে গেল কবিতা লিখে লিখে!
একটা জীবন কেটে গেল
নিঃসঙ্গতার গহীন আঁধারে,
একটা জীবন কেটে গেল
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়!”
এই ঈর্ষনীয় জনপ্রিয় শ্লোগানে মুখর
কবিতা লিখে নিজেই ইতিহাস হয়ে!
একটা জীবন কাটিয়ে দিলে
অচল প্রেমের পদ্য লিখে,
একটা জীবন কাটিয়ে দিলে
কষ্ট ফেরি করে!
সেই তো আমাদের কবি “হেলাল হাফিজ!”
আক্ষেপ
একটা জীবন কেটে যাচ্ছে
অপচয়ে, তোমার সাথে এখনো
ভরপুর প্রেম জমে উঠলো না!
একটা জীবন কেটে যাচ্ছে
লবণ, তেল, চাল, মাছ মাংসের দাম
অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাচ্ছে
এই ভাবনায়, এখনো
নিজেকেই চেনা হলো না!
একটা জীবন কেটে যাচ্ছে
ভীষণ অনিশ্চয়তার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে
অথচ এখনো মুক্ত পাখির মতো
ডানা মেলে বিশ্ব দেখা হলো না!
একটা জীবন কেটে যাচ্ছে
সংসার নামের ভুল ভালোবাসার ফাঁদে পড়ে,
আসল ভালোবাসা যার সাথে হবার জন্য
এই জন্ম তাঁর সাথে ভালোবাসা হলো না!
একটা জীবন কেটে যাচ্ছে
ভীষণ স্বার্থপরের মতো নিজের জন্য নিজেকে নিয়ে,
প্রকৃত প্রেমের স্বাদই পাওয়া হলো না!
একটা জীবন কী তবে এমন বৃথাই কেটে যাবে আমৃত্যু, শুধু তোমাকে পাবার তৃষ্ণা নিয়ে?
আমিনা তাবাসসুম
একটি আনমনা হৃদয়
অতঃপর আর কোনো নাম খুঁজে পেলাম না
একটা অন্যমনা হৃদয়
হঠাৎই তো ছুটে ছুটে যায়
যেভাবে গভীর রাতে তুমি আসো
এমন অন্ধকারে
এমন ঘন নিবিড়তায়
তোমার মতো করে কেউ তো ছুঁতে চায়নি
ফুটফুটে জোৎস্না
গনগনে আগুন
কেউ মাপেনি এভাবে
বুকের তোলপাড় কখনো
রাত সরে গেলে অন্ধকার আলগা হয়ে যায়
অথচ
তুমি তখনও পেলব
তুমি তখনও বুকের বাঁ পাশে
শূন্যতা নয়
তবু, এ হৃদয়ের কোনো নাম খুঁজে পেলাম না
কুন্তল দাশগুপ্ত-এর দু’টি কবিতা
ফুরন্ত
হলুদ ফোঁটার ঘরে অগরু প্র-বাস।
ফাল্গুনে গুটি কাটে স্বপ্ন উড়ান।
ঈশ্বর নেমে এসে বাকল কুড়ান…
পৃথিবীর তিনভাগ দীর্ঘনিশাস—
পাতায় পাতায় ফেলে, ফেলে বারোমাস,
রং-হীন একঘেয়ে, আর অফু্রান
ঢেউ তুলে বিক্ষোভে কী গর্জমান
জলতরঙ্গে গড়ে করুণ প্রভাস!
এই মতো পরিণতি, চাও না তা জানি।
আমিও চাই না— দেখি, জীবদ্দশায়।
সুভাষে ঢেকেছ স্থিতি কৃষ্ণাভিমানী।
কণ্ঠের কথামালা-বর্ণ কষায়।
ফুরন্ত ট্যাংকের দুঃস্থ তলানি
আমাকে টানছে দিতে পৌঁছে প্রসায়।
অনমগ্ন
প্রজাপতি-ঘর আর বেশি দূরে নয়।
পৃথিবীর তিন ভাগে ভাসাভাসি চর—
মাছের ফিকিরে ডোবে যে নিরন্তর,
নিতলতা আবাহনে তার ডারি ভয়।
সে জেনেছে শুধু প্ল্যাঙ্কটন সঞ্চয়।
পলক বিহীন মাছ লোভে জর্জর
আগ্রাসী চেতনায় এ জীবন ভর
ক’রে চলে অকাতরে বোধ বিক্ষয়।
মাছেরা প্রকৃতিগত ভারি পিচ্ছিল।
দু’হাতের ছাই আনে আয়ত্তাধীনে,
তাই খাক হয়ে খুঁজো অন্তর মিল
জ্যোতিষ্কহীন কোনো বেমক্কা দিনে।
মগ্ন চরার থেকে উঠে ঘন নীল
বিষ তবে ছেয়ে যাবে সবুজ বিপিনে!
তীর্থঙ্কর সুমিত
হৃদগোলাপের পাপড়ি
কত সবুজ…
মাঠে মাঠে কত কথা
কড়াইশুঁটির অনন্ত বিকেল
আর তুমি —
এখন অনেকটা নতুন হয়ে গেছো।
শহুরে আদব কায়দায় জল ভরে নাও
মননে এখন উপন্যাস
কবিতা ঘুমিয়ে পড়েছে।
জাগাওনি তুমি
তোমার নরম ঠোঁটের চুম্বন আঁকোনি।
অভিমানী কবিতা এখন হেঁটে চলছে
সবুজ থেকে চির সবুজের পথে
প্রশস্ত পথ, ধানক্ষেত সবই বদলেছে
তবুও কোথায় যেন একটা গ্রাম, গোধূলির বিকেল
সন্ধ্যের হ্যরিকেনে পুড়ে যায় হৃদগোলাপের পাপড়ি।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
অভিনব নীরার স্কেচ
ইদানিং কফি হাউজের টেবিলে
নীরার চোখে ঝকঝকে অন্ধকার
সারাটা শহর ভেঙে পোষ্য মান্দাস ডিঙিয়ে
আর কেউ খোঁজেন নি, নস্টালজিয়ার নীরার মুখ
পরিচ্ছন্ন আকাশ তছনছ করে
আজও উড়ছে, ভিক্টোরিয়ার পাথর পরি
একদিন সমস্ত ইচ্ছে নিয়ে উড়ে যাবে মানসিক বৃষ্টির দিন
তখন বিষন্ন কোন উড়ালপুলে বসে
এঁকে যাব অভিনব নীরার স্কেচ
🍂ছোটগল্প
‘আরে আমার দাদা বাপ্পা, ও এরকম ছিল। জানো, একবার মেলা দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। যে পুরো মেলাটাকেই নাকি ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।’ এবার পিয়ালী, পম্পা, মিতা, তিতলি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে।
আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে
মমতা রায় চৌধুরী
তিতলির আজ সকাল থেকেই তিরিক্কি মেজাজ
আর অভিলাসের কথাবার্তার জন্যই মেজাজটা আরও বিগড়ে গেছে। তবে তার প্রকাশ ঠিক ঠাক করতে পারছে না ঠিক ধুলো বোঝাই মোরাম রাস্তায় গাড়ি চালানো যেমন কষ্ট, তিতলিরও সেই অবস্থা। সকালবেলায় কাজের অন্ত নেই। আজকে সুমনাদি কাজে আসেনি। রাজ্যের কাজ পড়ে এদিকে স্কুল, ওদিকে অবলা পোষ্যগুলো ওদের খাবার ব্যবস্থা করা। নিজেদের খাবার রেডি হোক না হোক ওদের খাবার তো রেডি করতেই হবে। ওরা যে ভরসা, বিশ্বাস ভালোবাসা ভরা চাউনিতে হৃদয় ভরা ক্ষুধা নিয়ে এক অতৃপ্ত ভালবাসার আশ্বাসে তিতলির ওপর নির্ভরশীল। রেগে গেলেও ওদের কাজটা ঠিক করবেই।
এদিকে কনকনে ঠাণ্ডা। ওদেরও খুব কষ্ট হচ্ছে তার মধ্যে তুতুর সাতটা বাচ্চা, বাচ্চাগুলোর একটু কাশি হয়েছে ওদেরকে ওষুধ খাওয়ানো। ওদেরকে খাবার খাওয়ানো। বাচ্চাদের খাবার আলাদা করে রেডি করা বড়দের খাবার আলাদা করে রেডি করা এগুলো তো সময় সাপেক্ষ ব্যাপার স্কুলেও যেতে হবে। এদিকে স্কুলের কলিকরাও বলে তোর আর বাড়িতে কি কাজ। তিতলি ভাবে তাইতো কাজ কি, তার তো আর বাচ্চাকাচ্চা কিছু
নেই। কাজ নেই। দেবা-দেবী দু’জন।
সকালবেলায় অভিলাসের দু’একটা রগ চটা কথা শুনে মাথাটা খাপ্পা হয়ে গেছে। সারাক্ষণ মাথার ভিতরে একটা কথাই শাল্টে গেছে তাহলে সে সত্যিই অযোগ্য। কোনও কাজেরই যোগ্য নয়। এত কিছু করেও কাউকে একটু আনন্দ দিতে পারে না। না, না কথাটা ভুল হল। আনন্দ দিতে পারে না, আনন্দ দিতে পারে ওর পোষ্যগুলোকে। ওদের ভালোবাসায় বুঝতে পেরেছে। এজন্য তো পারিবারিক কলহ ওদেরকে নিয়েই শাশুড়ি মা তো আরেক ধাপ এগিয়ে। আর ওর জা তো নিজেকে দেবীরূপে কল্পনা করে। যদিও তার নিজের জা নয় জেঠতুতো। অথচ তিতলির শাশুড়ি মা এমন ভাব করেন যেন মনে হয় ওই বৌমাই তার নিজের বউ মা।। প্রতিনিয়ত জাকে বড় করে তোলেন। ঠিক কাঁসা থেকে পিতলের দাম বেশি ভাবটা এমন।
আজকাল এসব আর মাথায় নেয় না নইলে সারাদিন ওই কথাগুলো সালটে বেড়ালে মাথার ভেতরে ইতিউতি উঁকি মারে সব কাজে গণ্ডগোল হয়।
স্কুলে গিয়ে তিতলি নিজের টেবিলে ব্যাগটা রাখে তারপর নিজের রুটিন দেখে নেয়।
না আজ বৃহস্পতিবার। আজকে ফার্স্ট ক্লাস নেই। একটু বসেছে। তিতলিদের স্টাফরম তিনটি ভাগে বিভক্ত। ওরা যে ভাগে বসে সেখানে পিয়ালী, পম্পা, মান্যতা ওরা তিনজনেই বসে আছে।
‘কি রে পিয়ালী ফার্স্ট ক্লাস নেই।’
‘না গো তিতলিদি ক্লাস ছিল কিন্তু ক্লাসটা হেনাদি চেয়ে নিল’।
‘ও আচ্ছা, আচ্ছা।’
‘তোমার?’
‘আজকে তো বৃহস্পতিবার। প্রথম ক্লাস নেই।’
কথা বলতে বলতেই হঠাৎ করে টিআইসি পেছন থেকে এসে বললেন ‘তিতলি একবার একাদশ শ্রেণির ক্লাসে তুমি
যাও।’
‘আজকে ফার্স্ট ক্লাস নেই।’
‘জানি। তবু যাও।’
ঠিক আছে আর একটু আগে দিলে ভালো হতো। সিলেবাস কিছুটা বাকি আছে। সুবিধা হতো।’
‘তখন থেকে পাখিকে বলছি যাও তিতলিকে দাও ও ঠিক যাবে।’
পাখিদি এসে খাতাটা দিয়ে বলল’ এই নিন দিদি। তাড়াতাড়ি যান আর বেশি সময় নেই।’
‘এ বাবা পাখিদি, আমি তো ক্লাসে যাব বলেই তাড়াতাড়ি করছি। তাছাড়া আমার তো প্রথম ক্লাস ছিল না। আজকে
আয়েশার ক্লাস ছিল। ঠিক আছে কোন অসুবিধা নেই।’
‘তিতলি ক্লাসে গিয়ে মেয়েদের অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে ওদের বিজন ভট্টাচার্যের’ আগুন ‘নাটকটি পড়াচ্ছিল। আগুন নাটকটা পড়াতে পড়াতেই মনের ভেতরেও যেন কেমন আগুন জ্বলে উঠল। যাইহোক ক্লাসের ঘন্টা পড়ে গেল ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসতেই মেয়েরাও পিছন পিছন তিতলিকে ধাওয়া করল। না ধাওয়া ঠিক নয়। মেয়েরা এসে আঁকড়ে ধরল।
‘কি ব্যাপার আবার তোমরা আমার পিছনে পিছনে আসছ কেন?’
‘ম্যাম ‘আগুন’ নাটকটা পড়াচ্ছিলেন এত ভাল লাগছিল।
সত্যি স্বার্থবাজ, দুর্নীতিবাজ, কালো বাজারী মানুষেরা কি করে নিরীহ খেটে খাওয়া গরিব মানুষের এক মুঠো খাবারের প্রাপ্য অধিকারটুকু কেড়ে নেয়।’
‘হ্যাঁ গো, ১৩৫০ এর মন্বন্তরের সময় এরকমই অবস্থা হয়েছিল। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য চোখে আঙ্গুল দিয়ে তার লেখনীর মধ্যে দিয়ে সেই আগুন ঝরিয়ে দিয়েছেন মানুষের ভেতরে গণচেতনা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।’
‘হ্যাঁ ম্যাম।’
‘ঠিক আছে নেক্সট দিন বাকি অংশ বুঝিয়ে দেব।’
‘ওকে ম্যাম।’
টিআইসি আড়চোখে দেখছিলেন।
তিতলি স্টাফরুমে এসে অ্যাটেন্ডেন্স খাতাটা রেখে নিজের টেবিলে গিয়ে জলের বোতলটা খুলে জল খাচ্ছে। ঠিক তখনই পিয়ালী, পম্পা, সবাই একযোগে হেসে উঠল।
তিতলি ব্যাপারটা বোঝার আগেই পিয়ালীর মুখের দিকে তাকাল। ইশারায় জিজ্ঞেস করল ব্যাপারটা কি? অনেক কিছু মিস করে গেল মনে হচ্ছে।
পিয়ালী চোখের ভাষাতেই হেসে উত্তর দিল আরে না, না। তুমি কোন কিছুই মিস করনি। বস আমার ছেলের কান্ড শোনো।’
‘কেন তোর ছেলে আবার কি কাণ্ড ঘটালো?’
‘ছেলেকে কি করে মানুষ করব গো।’
‘কেন তোর ছেলে তো কি সুন্দর !’
আর সুন্দর বলো না গো, লেখাপড়া তো কিছুই করছে না।’
তার মধ্যে অসীমাদি এসে বলল’ ছাড় তো সব সময় পড়া পড়া করিস না ঠিক করে নেবে।’
‘কি জানি কি করবে? কালকে মাথাটা এত গরম হয়ে গেছিল না কি বলবো? মেরেওছি ছেলেকে।’
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল’ কেন কেন মেরেছিস কেন!’
‘মারব না? জানো, পাক্কা দেড় ঘন্টা ধরে ওকে পড়াতে বসে একটা অক্ষর আমি ওকে লেখাতে পারিনি।’
সবাই তো আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম।
‘শেষে আমার গলার স্বর আস্তে আস্তে পারদ চড়তে লাগল।’
যখন খুব রেগে গেলাম বুঝতে পারল ছেলে যে রেগে গেছি ঠাণ্ডা মাথায় আমাকে প্রশ্ন করল ‘তুমি চেঁচিয়ে কথা বোলো না।’
পম্পা বলল ‘তখন কি করলে?’
পিয়ালী বলল ‘তুমি তো লিখছ না’।
‘তখন জানো মাথাটা আমার গরম হচ্ছে। আর ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছি পেন্সিলটা নিয়ে একটা অক্ষরের হাফ লিখেছে ।
তখন কেমন মনে হয়’। পিয়ালী খুব করুন সুরে বলল।
তারপর পম্পা বলল,
‘রাগটাকে কন্ট্রোল করছি। আর বললাম পুরোটা লেখ।’
‘আমার লিখতে ভালো লাগছে না। ‘
‘লিখতে ভালো লাগছে না।’
আবার রাগটাকে কন্ট্রোল করে বললাম ‘লেখো ‘
তখন জানো কি করলো পুরো জানালার দিকে তাকিয়ে রইল।আমি নিজেকে কন্ট্রোল করার জন্য নিজের ঘরে এসে পায়চারি করতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম’ মাথা ঠাণ্ডা হোক, মাথা ঠাণ্ডা হোক। ঠিক দশ মিনিট পর আবার আসলাম ঘরে, এসে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলছে তোর মাথা ঠাণ্ডা হয়েছে?’
‘তখন তুমি কি বলবে? হাসবে না কাঁদবে কি বলবে?’
আমরা তো সবাই হো হো করে হেসে উঠছি
তিতলি বলল,’ তারপর কি করলি?’
আমি বললাম’ জানলার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিলে?’
‘আমি বই মেলায় যাব।’
‘তুমি বইমেলায় যাবে?’
তিতলি বলল ‘বই মেলায় যেতে চায় কি ভালো বাচ্চা।’
‘শোনো তাহলে ও-কেন বই মেলায় যেতে চায়, বই দেখতে বা বই পড়তে নয় ।’
আবার আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম আর উৎসুক মুখে আছি।
শোনো বই মেলায় যাবে বেলুন কিনতে।
‘বলিস কি রে, মিতাদি বলল।’
‘হ্যাঁ তাহলে আর বলছি কি।
বইমেলায় কি পাওয়া যায় জানিস? ‘বইমেলায় বই পাওয়া যায়। আর ওখানে গিয়ে বই পড়তে হয়।’
‘আরও কি বলল জানো? বলল, আমি জানি ওখানে বেলুন পাওয়া যায়।’
পম্পা বলল ‘আসলে কি বলত সব মেলাতেই বেলুন পাওয়া যায় ও জানে।’
‘হ্যাঁ, সেই আর কি। আমার হাড়ে দুব্ব ঘাস গজিয়ে গেল এই একটা বাচ্চাকে লেখাপড়া শেখাতে গিয়ে।’
‘হ্যাঁ গো আমার ছেলেটা কি গোমুখ্য থেকে যাবে। বল দেখি?’
পিয়ালী এমন অসহায়ভাবে সকলের মুখের দিকে তাকাল।
তারপর বলল, ‘জানো আমি আর তখন রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না আর একবার বললাম, ‘তোমাকে লিখতে বলছি লেখ এই।’
কোন কথাই শুনলো না আর বলল, ‘আমার লিখতে ভাল লাগছে না ‘
এখন আমি গিয়ে ওকে দু-ঘা দিলাম। তারপর নিজের ঘরে এসে অনুতপ্ত হতে লাগলাম। আমি বোধহয় পৃথিবীর সব থেকে বাজে মা।’
তখন কি করি আবার গেলাম ছেলের কাছে। গিয়ে বললাম, ‘বাবা একটু লেখাপড়া করলে কি হয় না।’
‘আমার লেখাপড়া করতে ভালো লাগে না।’
তখন মাথাটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। ওই যে বর বলেছিল যে ‘যখন তোমার মাথা গরম হবে তখন তুমি রুম থেকে বেরিয়ে যাবে। রুম থেকে বেরিয়েছিলাম। আর চিন্তাটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য ঘরে এসে ফোনটা ঘাটছিলাম। ফোনে হঠাৎ করে দেখি একটা ঘটনার কথা দেখতে পাই সেটা হল মা মেয়েকে খাওয়াতে গিয়ে মেরেছে।মেয়ে মারা গেছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি উঠে আছি। তারপর ওই পড়ার ঘরে গিয়ে ছেলেকে খুঁজে বেড়াই ছেলেকে ছেলের নাম ধরে তাতাই তাতাই বলে ডাকতে থাকি। তখন ধীরে ধীরে ছেলে আমার কাছে আসে। আমি ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলতে থাকি, ‘বাবা তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস।’
মান্যতা বলল ‘তুমি এসব করো এই কথাগুলোই মনে রেখে দেবে।’
আসলে ‘আমি বললাম ক্ষমা করে দিস।’
ও বলল ‘ক্ষমা করে দিয়েছি।’
‘কেন তুই আমাকে ক্ষমা করলি?’
‘তুমি আমাকে মেরে ছিলে সেইজন্য।’
তিতলি অবাক হয়ে বলল ‘সে কিরে!
তাহলে আর বলি কি! এইরকম দস্যু পেটে ধরেছি। আমার হয়েছে জ্বালা।
তার থেকে তিতলি দিয়ে ভাল আছে বাচ্চাকাচ্চা নেই।’
‘না রে জ্বালা জ্বালা করিস না যারা ছোটবেলা এরকম, বড় হয়ে তারা খুব ভালো হয়। এটা মাথায় রাখিস। অসীমা দি বলল।
‘আর কি যে ভাল হবে কে জানে?’
অসীমাদি বলল, ‘আরে আমার দাদা বাপ্পা, ও এরকম ছিল। জানো, একবার মেলা দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। যে পুরো মেলাটাকেই নাকি ওর বাড়িতে নিয়ে যেতে হবে।’
এবার পিয়ালী, পম্পা, মিতা, তিতলি সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে।
‘হ্যাঁ গো রাস্তায় গড়াগড়ি দিচ্ছে। ভাব বেগতিক দেখে তখন পুলিশের ভয় দেখানো হয়। ও পুলিশকে খুব ভয় পায়।
শেষে এক পুলিশ এসে ভয় দেখানোতে ও বাড়ি আসে।’
ভাবো কাণ্ড পম্পা বলল।
‘সে আজকে কত বড় ডাক্তার।’ অসীমা দি বলল।
আরেকটা ঘটনা বলি ‘এইজন্যেই বলছি তোর ছেলেকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে যাস না ।ঠিক হবে।দেখিস।’
একবার কি হয়েছিল জানিস, অসীমাদি তার দাদার গল্প বলতে গিয়ে এবার আপন মনে তার সঙ্গে ছন্দ রঙ মিশিয়ে দেন।
একবার একবার পরীক্ষার সময় পরীক্ষা না দিয়ে বাড়ি চলে আসে।
পরীক্ষা না দিয়ে নয়, পরীক্ষা হলে বসেছে কিন্তু কিছু লেখেনি, বাড়িতে আসলে ওকে জিজ্ঞাসা করা হলে ও বলে ও কিছু লেখেনি।’
বাড়িতে তো সবাই অবাক হয়ে
যায়।’ কেন লিখিস নি কেন?
‘সবাই লিখছিল তাই আমি লিখিনি।’
‘বোঝো তাহলে আমার দাদাটা কেমন বিচ্ছু ছিল।’
‘কাজেই চিন্তা করিস না ঠিক হবে।’
তিতলি বলল, ‘হ্যাঁ হবে ঠিকই ,তবু মায়ের চিন্তা তো হয়।’
‘হ্যাঁ তারপরে কি হলো বল পিয়ালী তোর ছেলের কথা।’
‘কি বলব, ফেসবুকে ওই ঘটনাটা দেখে আমার তো প্রাণটাই কেঁদে উঠল। দূর ছাই পড়াশোনা করে করুক, না করে না করুক।’
শম্পা বলল, ‘হ্যাঁ, তখন তোমার মনে একটাই কথা বাজছিল’। আমার সন্তান থাক দুধে ভাতে’।
‘বাবা একদম ঠিক কথা বলেছিস
তো।’
‘তোমারও তো বাচ্চা আছে তিতলিদি।’
‘হ্যাঁ একদম ঠিক কথা। আরে মানুষ পশুতে কোন তফাৎ নেই। আমার বাচ্চা বিশেষত আমার গজ ও কি করে জান? ও ঘরের মধ্যে যদি ওর রাগ হয় বা আমরা কেউ না থাকি তাহলে ও হিসু করতে থাকে।’
সবাই তো হো হো করে হেসে উঠল।
‘এই ধরো ঘরটা পরিষ্কার করে সবেমাত্র বাথরুমে ঢুকেছি তারপর বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখব দরজা খুলে আবার হিসু করেছে কিন্তু ওকে কিন্তু ঘরে দেখা যাচ্ছে না। তখন রাগে গজগজ করতে করতে যখন ন্যতা নিয়ে মুছতে থাকি। ও দরজা থেকে উঁকি মেরে আমায় দেখতে থাকে।’
মান্যতা বললl’ কি দুষ্টু!’
তখন মাথাটা আরও গরম হয়ে যায়। মারতে যাই কিন্তু মারতে পারি না ও ঠিক খাটের উপরে উঠবে আমার গলা জড়িয়ে ধরবে। এরপর কি আর মারা যায় বলো। এ বন্ধন তো ভালোবাসার বন্ধন। তাহলে এত অন্যায় করলেও তো তুমি ওদের ভালোবাসো, আঁকড়ে ধরে থাকতে চাও। ওদের ভালো চাও। তাই তো।’ পম্পা বলল।
‘একদমই তাই।’
‘তাই তোমার ক্ষেত্রেও তো ঐ কথাটাই প্রযোজ্য যার ছেলে মেয়ে যেরকমই হোক সে থাকুক দুধে ভাতে।’
‘এটা কিন্তু সঠিক কথা। এ যে অপত্য স্নেহে অন্ধ মা বাবা।’ 🍁
🍂ফিরেপড়া | কবিতা
বিনয় মজুমদার -এর কবিতা
আর যদি নাই আসো
আর যদি নাই অসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহন হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
নীরাকে দেখা
আমার দূরত্ব সহ্য হয় না, নীরা, ঝড়ের রাত্রির মতো কাছে এসো
যেমন নদীর গর্ভে গুমরে ওঠে নিদাঘের তোপ
প্রতিটি শিমুল বৃক্ষ সর্বাঙ্গে আগুন মেখে যেমন অস্থির আমি প্রতীক্ষায় আছি
বৃষ্টির চাদর গায়ে, হাল্কা পায়ে, দিক্ বধূর মতো তুমি
এই দরদালানে একটু বসো
মুখের একদিকে আলো, অন্যদিকে বিচ্ছুরিত, উদ্ভাসিত কালো
ভুরুতে কিসের রেণু, নরম আঙুলে কোন্ অধরার লীলা ওরে তোকে ভালো করে দেখি, কিছুই তো হলো না দেখা
সামান্য জীবনে
নির্লজ্জ শরীরবাদী এই লোকটা এখনো তোমায় ছোঁয়নি স্থাণুর শিকড়ে
দ্যাখো তার হাতে হাঁসের পালকে লেখা বসন্ত প্রবাস।
নশ্বর
কখনো কখনো মনে হয়, নীরা, তুমি আমার
জন্মদিনের চেয়েও দূরে—
তুমি পাতা–ঝরা অরণ্যে একা একা হেঁটে চলো
তোমার মসৃণ পায়ের নিচে পাতা ভাঙার শব্দ
দিগন্তের কাছে মিশে আছে মোষের পিঠের মতন
পাহাড়
জয়ডঙ্কা বাজিয়ে তাঁর আড়ালে ডুবে গেল সূর্য
এসবই আমার জন্মদিনের চেয়েও দূরের মনে হয়।
কখনো কখনো আকাশের দিকে তাকালে চোখে পড়ে
নক্ষত্রের মৃত্যু
মনের মধ্যে একটা শিহরণ হয়
চোখ নেমে আসে ভূ-প্রকৃতির কাছে;
সেই সব মূহুর্তে, নীরা, মনে হয়
নশ্বরতার বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধে নেমে পড়ি
তোমার বাদামী মুষ্টিতে গুঁজে দিই স্বর্গের পতাকা
পৃথিবীময় ঘোষণা করে দিই, তোমার চিবুকে
ঐ অলৌকিক আলো
চিরকাল থমকে থাকবে!
তখন বহুদূর পাতা-ঝরা অরণ্যে দেখতে পাই
তোমার রহস্যময় হাসি—
তুমি জানো, সন্ধেবেলার আকাশে খেলা করে সাদা পায়রা
তারাও অন্ধকারে মুছে যায়, যেমন চোখের জ্যোতি–এবং পৃথিবীতে
এত দুঃখ
মানুষের দুঃখই শুধু তার জন্মকালও ছাড়িয়ে যায়।
ভালােবাসা
শরীর ছেলেমানুষ, তার কত টুকিটাকি লোভ
সব সাঙ্গ হলে পর, ঘুম আসবার আগে
নতুন টাকার মতন সরল নিবারণ – দু’খানি শরীর
বিছানায় অবিন্যস্ত।
ঠাণ্ডা বুকের কাছে স্বেদময় মুখ
ঊরুর উপরে আড়াআড়ি ফেলে রাখা – এইমাত্র লােভহীন হাত।
চরাচরে তীব্র নির্জনতা, এই তো সময় ভালোবাসার- ভালোবাসা মানে ঘুম, শরীর-বিস্মৃত পাশাপাশি
ঘুমােবার মতো ভালােবাসা;
কৃতঘ্ন শব্দের রাশি
চিঠি না-লেখার মতো দুঃখ আজ শিরশির করে ওঠে
আঙুলে বা চোখের পাতায়
নিউ মার্কেটের পাশে হঠাৎ দুপুরবেলা নীরার পদবী ভুলে যাই —
এবং নীরার মুখ!
জলে-ডোবা মানুষের বাতাসের জন্য হাঁকুপাকু—সেই অস্থিরতা
নীরার মুখের ছবি–সোনালি চশমার ফ্রেম, নাকি কালো!
স্তম্ভের ঘড়িকে আমি প্রশ্ন করি, সোনালি? না কালো? ধনুক কপালে বাঁকা টিপ, ঢাল চুলে বাতাসের খুনসুটি তবুও নীরার মুখ অস্পষ্ট কুয়াশাময়
জালে ঘেরা বকুল গাছকে আমি ডেকে বলি
বলো, বলো, তুমিও তো দেখেছিলে?
নীরার চশমার ফ্রেম সোনালি না কালো?
সিঁড়ির ধাপের মতো বিস্মরণ বহুদূর নেমে যায়
ভুলে যাই নীরার নাভির গন্ধ
চোখের কৌতুকময় বিষণ্ণতা নীরার চিবুকে কোনো তিল ছিল?
এলাচের গন্ধমাখা হাসি যেন বাতাসের মধ্যে উপহাস
বিস্মৃতির মধ্যে শুনি অধঃপতনের গাঢ় শব্দ
নিউ মার্কেটের পাশে হঠাৎ দুপুরবেলা
সব কিছু ভুলতে ভুলতে আমার অস্তিত্ব
শূন্য কিন্তু মগ্ন হয়ে ওঠে—
ছিঁড়ে যায় নীল পর্দা, ভেঙে পড়ে অসংখ্য দেয়াল
হিজল বনের ছায়া চকিতে মেঘের পাশে খেলা করে তীব্রভাবে বেজে ওঠে কৃতঘ্ন শব্দের রাশি, সেই মুহূর্তেই চোয়াল কঠিন করে হাত তুলি, বজ্ৰ মুঠি, ঝলসে ওঠে
রক্তমাখা ছুরি।
সাত সকালে নীরা
শায়ার ওপর পুরুষ-জামা, সাত সকাল
চিরুনি-ভোলা খোলা চুলের চালচিত্রে মুখ
পেস্ট না ছোঁয়া ঠোঁটে এখন ঘুম ভাঙার গন্ধ
হাত দুখানি নিরাভরণ, কানের লতি মুক্ত
জানলা খুলে এক ঝলক বাতাস মেখে নিলে…
প্রসাধনহীন নীরা হঠাৎ এ ভোর বেলা আমাকে সুদূরে নিয়ে গেল
তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা লক্ষ বছর আগে
নদীর নাম সরস্বতী, অথবা নামই ছিল না
বৃক্ষটিও শাল্মলী বা শিংশপার মতন
তার ছায়ায় আগুন মাখা সেই গোধূলি বেলা
গাছের ছাল ঘিরে রেখেছে অর্ধতনু, চুলে
ধুলো কিংবা ফুলের রেণু, একটি লোভী ভ্রমর
তোমার ওষ্ঠাধরের মধু পানের আশায় ঘুরছে
কালিদাসের উপমা চুরি, হয়তো মার্জনীয়
তুমি ঈষৎ ভ্রূভঙ্গিতে হানলে এক বিদ্যুৎ
ঠিক তখনই বৃষ্টি এল, তুমি বসন খুলে
নেমে পড়লে নদীর জলে, নদীটিও তো নগ্ন
দুলতে লাগল স্রোতের ধারায় তিনটি বুনো হংসী
আমার বনবাস, সেই স্মৃতি, একটুও মলিন হয়নি আজও দেখ
কয়েকখানা পাতার ঢাকা কোমর, আমি কাছেই
লগুড় হাতে দাঁড়িয়েছিলাম, তখনো বাল্মিকী
ক্রৌঞ্চবধে উচ্চারণ করেননি তাঁর শ্লোক
আমার কোনো ভাষা ছিল না, তবু রূপের বিভায়
যেন ক্ষণেক অন্ধ হয়ে পড়ছি ভূমিতলে
অস্ত্র ফেলে দু ‘হাত দিয়ে জড়িয়ে প্রকৃতিকে
যেন তুমিই, তুমিই নীরা, করেছি কত আদর
হীরা পাথর, চুনী পাথর, মাটিতে সোনা রুপো…
এবার বাথরুমে যাবে, সারাদিন অন্য ছবি, সব প্রয়োজন অকারণ
দেখি মৃত্যু
আমি তাে মৃত্যুর কাছে যাইনি একবারও
তবুও সে কেন ছদ্মবেশে
মাঝে মাঝে দেখা দেয়।
এ কেমন অভদ্রতা তার?
যেমন নদীর পাশে দেখি এক চাঁদ খসা নারী
তার চুল মেলে আছে
অমনি বাতাসে ওড়ে নশ্বরতা
ভয় হয়, বুক কাঁপে, সব কিছু ছেড়ে যেতে হবে!
যখনই সুন্দর কিছু দেখি,
যেমন ভােরের বৃষ্টি
অথবা অলিন্দে লঘু পাপ
অথবা স্নেহের মতাে শব্দহীন ফুল ফুটে থাকে
দেখি মৃত্যু, দেখি সেই গােপন প্রণয়ী।
ভয় হয়, বুক কাঁপে সব কিছু দিয়ে যেতে হবে!
তসলিমা নাসরিন-এর কবিতা
দেখা না হওয়ার যন্ত্রণায়, তবু বলবো না, এসো
তোমার সঙ্গে আমার দেখা হবে না।
বছর পেরোবে, তোমার সঙ্গে দেখা হবে না আমার,
দেখা না হতে না হতে ভুলতে থাকবো
তোমার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ঠিক কেমন ছিল
কী রঙের সার্ট পরতে তুমি,
হাসলে তোমাকে ঠিক কেমন দেখাতো,
কথা বলার সময় নখ খুঁটতে,
চোখের দিকে নাকি অন্য কোথাও তাকাতে,
পা নাড়তে, ঘন ঘন চেয়ার ছেড়ে উঠতে,
জল খেতে কিনা, ভুলতে থাকবো।
দেখা না হতে না হতে ভুলতে থাকবো
তুমি ঠিক দেখতে কেমন ছিলে,
তিলগুলো মুখের ঠিক কোথায় কোথায় ছিল,
অথবা আদৌ ছিল কিনা।
তোমার চুমু খাওয়াগুলো ঠিক কেমন,
জড়িয়ে পেঁচিয়ে চুলে বা বুকে মুখ গোঁজাগুলো
ঠিক কেমন, ভুলতে থাকবো।
অনেকগুলো বছর পেরিয়ে যাবে,
তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না।
এক শহরেই, অথচ দেখা হবে না।
পথ ভুলেও কেউ কারও পথের দিকে হাঁটবো না,
আমাদের অসুখ বিসুখ হবে, দেখা হবে না।
কোনও রাস্তার মোড়ে কিংবা পেট্রোল পাম্পে কিংবা মাছের দোকানে, বইমেলায়, রেস্তোরাঁয়, কোথাও দেখা হবে না।
আরও অনেকগুলো বছর পর, ভেবে রেখেছি, যেদিন হুড়মুড় করে
এক ঝাঁক আলো নিয়ে সন্ধ্যে ঢুকতে থাকবে আমার নির্জন ঘরে,
যেদিন বারান্দায় দাঁড়ালে আমার আঁচল
উড়িয়ে নিতে থাকবে বুনো বৈশাখি
এক আকাশ চাঁদের সঙ্গে কথা বলবো
যে রাতে সারারাত-
তোমাকে মনে মনে বলবোই সেদিন,
কী এমন হয় দেখা না হলে,
দেখা না হলে মনে হতো বুঝি বেঁচে থাকা যায় না,
কে বলেছে যায় না, দেখ, দিব্যি যায়!
তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি কয়েক হাজার বছর,
তাই বলে কি আর বেঁচে ছিলাম না?
দিব্যি ছিলাম! ভেবেছি বলবো,
তুমি তো আসলে একটা কিছুই-না ধরনের কিছু,
আমার আকাংখা দিয়ে এঁকেছিলাম তোমাকে,
আমার আকাংখা দিয়ে তোমাকে প্রেমিক করেছিলাম,
আমার আকাংখা দিয়ে তোমাকে অপ্রেমিকও করেছি
তোমাকে না দেখে লক্ষ বছরও বেঁচে থাকতে পারি!
অপ্রেমিককে না ছুঁয়ে, অনন্তকাল।
এক ফোঁটা চোখের জল বর্ষার জলের মতো
ঝরে ধুয়ে দিতে পারে
এতকালের আঁকা সবগুলো ছবি,
তোমার নাম ধাম দ্রুত মুছে দিতে পারে চোখের জল।
তোমাকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
আমাকে একা বলে ভেবো না কখনো,
তোমার অপ্রেম আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
🍂গল্প
তিনি আবার মনে মনে আওড়ালেন যদি দেখি লাইটটা একমিনিট অফ হয়ে অন হয়েছে। তাহলে বুঝতে পারব বাবা তুমি আজ আমাদের সত্যি রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছো। পরবর্তীতে ঠিক তাই হল।
চারুলতা
হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
[আগের সংখ্যার পরে… ]
কোমললতার কথা আজও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে মুখে মুখে ঘোরে। গ্রামগঞ্জে এসব ঘটনা বিরল নয়। কিন্তু মফস্বল শহরগুলোতেও এমন ঘটনা ঘটে কিন্তু সব কেমন ইঁট,বালি ,পাথরে চাপা পড়ে যায়। যদিও অনাদি বাবু ভাবেন এটা কাকতালীয়। কিন্তু তার স্ত্রী রত্নাদেবী কিছুতেই মানতে চায় না। তিনি মনে করেন,ভূতের কারসাজি যেন এই পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।
—- ভৈরব নাথ মুখোপাধ্যায়ের ছোটো ছেলে পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। তার ফার্স্ট পোস্টিং সিউড়ি সদর শহরে। সদ্যজাত কন্যা সন্তান এবং স্ত্রী রত্না দেবীকে সঙ্গে নিয়ে সিউড়ি শহরের সেহেরা পাড়ার একটি ছোট্ট দু’কামরার ঘরে ভাড়া নিলেন।
—- ওখানে জেলা স্কুলেই পড়াশোনা করার সুবাদে ওখানেই প্রচুর বন্ধুবান্ধবের বাস। দিনের বেলায় সকলে একসাথে হাতে হাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। রাত তখন আটটা হবে , অনাদি বাবু স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে গৃহে প্রবেশ করেন।
—- ঘরে ঢোকার সময় রত্নাদেবীর কেমন গা ছমছম্ করে ওঠে। এরপর শিশুকে খাটের উপর শুয়ে দিয়ে বাথরুমে ঢুকলেন হাত,পা ধোয়ার জন্য। ঠিক এমন সময়…
— রত্না দেবী চিৎকার করে উঠলেন একটা ছায়ামূর্তি দেখে।
— অনাদি বাবু ছুটে গিয়ে বললেন, কী হয়েছে? টিকটিকি?
—- কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রত্না দেবী বলেন, এ বাড়িতে কেউ একজন আছেন। অনাদি বাবু তখন আশ্বস্ত করে বললেন, ” এটা চারুলতা দেবী নামে এক ভদ্রমহিলার বাড়ি। তিনি মারা গেছেন একবছর হল। তাঁর ছেলে এ বাড়িতে থাকেন না। ফাঁকা পড়ে থাকবে বলে ভাড়া দিয়েছেন। একথা বলতে বলতেই…
—- শিশু কন্যাটি বিকট চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ওরা স্বামী- স্ত্রী দুজনেই দৌড়ে এসে দেখে শিশুটি বিছানা থেকে পড়ে গেছে এবং কিছু একটা দেখতে পেয়ে যেন ভয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছে।
— রত্না দেবীর মনে সন্দেহ হয়। তিনি জোরে জোরেই বলতে থাকেন চারপাশে বালিশ দেওয়া এরমধ্যে মেয়ে কি করে পড়ে যায়? অনাদি বাবু বলেন, মেয়ে তোমার চঞ্চল হয়েছে। কিন্তু রত্নাদেবী মা , মন থেকে ঘটনাটা মুছে ফেলতে পারলেন না।
—– পরদিন সকালে অনাদি বাবু ভোর ভোর উঠে অফিসে চলে গেলেন। সেখানে প্ল্যান্ট চলছে অনাদি বাবুর গুরুদায়িত্ব। রত্নাদেবী এরপর উনুনে আঁচ দিয়ে খাবারের জোগাড় করতে লাগলেন। সে সময় মিক্সি ছিল না কাজেই মশলা বাটার জন্য শিলনোড়া ছিল একমাত্র উপায়।শিলে পোস্ত দিয়ে বাটছেন। পোস্ত রান্না হবে আর ডিমের ঝোল। দুটি তো খাওয়ার মানুষ। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ওনার সঙ্গে সঙ্গে কেউ বাটনা বাটছে। রান্না করছেন কিন্তু অন্যত্র কোথাও হাতা খুন্তির টুংটাং শব্দ।
যাহোক এতোটা গুরুত্ব দিলেন না। আশেপাশে কেউ থাকে না পুরো বাড়ি জুড়ে এই তিনটি প্রাণী।সে নিজে নিজেই ভাবল এটা তার মনের ভুল। যাহোক অনাদি বাবু ফিরে এলেন দুপুরে। খাওয়াদাওয়া করে আবার আপিসে বেরিয়ে গেলেন। রত্নাদেবী মেয়েকে দুধ খাইয়ে, সাজিয়ে গুছিয়ে শুয়ে দিলেন। ফর্সা টুকটুকে একটি মেয়ে। রত্নাদেবী খুব সাজান মেয়েটিকে। বাবা, মা এর চোখের মণি। ছোট্ট পুপসী।
—- সবে সন্ধ্যা লেগেছে অনাদি বাবু অফিস থেকে ফিরে হাতমুখ ধুয়ে মেয়েকে কোলে নিতে যাবেন হঠাৎ দেখলেন মেয়ে কাঁদতে শুরু করেছে আর ভয়ে ভয়ে চারিদিকে চাইছেন। ঠিক দেখে যেন বোঝা যাচ্ছে শিশুটিকে কেউ ভয় দেখাচ্ছে।
—- মেয়েকে শান্ত করতে বাবা কোলে করে বাইরে নিয়ে এলেন। তখন কিন্তু মেয়ে চুপচাপ। হাসছে , খেলছে নিজের মনে বাবার কোলে শুয়ে শুয়ে…।
—- আবার ঘরে ঢুকলেই কান্নাকাটি শুরু। রত্নাদেবীর মনে কেমন সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে।
—- হঠাৎ শিশুটি অসুস্থ হয়ে পড়ল। বাড়িতে তখন অনাদি বাবুর দাদা, বৌদি এসেছেন গ্রামের বাড়ি থেকে। শিশুটির এই অবস্থা দেখে তারা পরামর্শ দিলেন শুধু ডাক্তার দেখালেই হবে না। কোনো অশুভ হাওয়া বাতাস লেগেছে বাচ্চার গায়ে। বিজ্ঞানে বিশ্বাসী অনাদি বাবু দাদার এই কথাটি মেনে নিতে নারাজ অগত্যা রত্নাদেবীকে বললেন, ” তুমি কাল মেয়েকে নিয়ে মালী পাড়া চল। ওখানে বুড়িমার থানে জলপোড়া দেওয়া হয়।”
— পরদিন সকালে রত্না দেবী মেয়েকে নিয়ে দেবীর থানে গেল। ওখানে এক ভৈরবী মায়ের দেখা মিলল। বাচ্চাকে দেখেই ভদ্রমহিলা বলে দিলেন,” ওকে ভূতে খাচ্ছে, সব শেষ করে দেবে। তোর কোল খালি করে দেবে বলে রাখলাম।”যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা , রাস্তায় দাঁড়া গিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওই বুড়ি তোর সব আত্মসাৎ করে নেবে।
—- বাড়িতে ফিরে রত্না দেবী সব জানালেন কিন্তু অনাদি এসব কথা বিশ্বাস করতে নারাজ। কিন্তু এরপর থেকে অত্যাচার দ্বিগুণ মাত্রায় বেড়ে গেল।
—- হঠাৎ বাথরুমের মধ্যে কারুর উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে তো কখনও
ঘরের মধ্যে হঠাৎ করে দুমদাম আওয়াজ। বাগানের মধ্যে একটি বেলগাছ ছিল। ওখান থেকে মাঝেমধ্যে আঁশটে গন্ধ ভেসে আসত, কখনও কখনও মনে হত ওখানে কোনো নারীর চাপা করুন আর্তনাদ। কখনও কখনও হঠাৎ হঠাৎ কালো বিড়াল ঘুরে বেড়াত গোটা বাড়িতে। সবসময় যেন একটা ছমছমে ভাব। কিন্তু অনাদি এগুলো মানতে নারাজ। ঈশ্বরকে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যা স্মরণ করতে কোনো ভুল হয় না তার। কিন্তু একদিন হয়েছে কি! বেলপাতা তুলতে গিয়ে অনাদি দেখে উঁচু থেকে দুটো কালো হাত নেমে আসছে। সেদিন কিন্তু অসম্ভব ভয় পেয়েও চুপ থাকে সে। পাছে রত্না দেবী ভয় পান। কিন্তু সেদিন থেকে মনে মনে একটু ভয় পেতে থাকে সে। দিনের পর দিন মেয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে কোনো ওষুধ কাজে লাগছে না শিশু কন্যাটির অথচ বাইরে নিয়ে গেলেই শিশু হাসে , খেলা করে।
—- একদিন মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে টের পাওয়া যায় দুমদাম আওয়াজ। মনে হচ্ছে টালিরচালের উপর যেন হাতি চলে বেড়াচ্ছে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই উপলদ্ধি করে সে ভয়ঙ্কর শব্দ। এর পরের দিন অনাদি এ পাড়ার একজন পুরোনো বাসিন্দাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারেন বাড়িটি চারুলতা নামে এক মহিলার। তাঁর স্বামীর মৃত্যুর পর নিঃসন্তান বুড়ি বড় একা হয়ে যায়। এরপর একটু বয়স হতেই কিছু গুন্ডা বাহিনী এসে বুড়িকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিয়ে যায়। কিন্তু বুড়ির এই বাড়ি ছিল আত্মা। একদিন পাড়ার সকলে দেখে বুড়ি ঘরের মধ্যে…
—- ঘরের মধ্যে কী ? প্রশ্ন করেন অনাদি। গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু পাড়ার সকলেই বলে এটা সত্য নয়। সত্য হল কেউ বা কারা বুড়িকে গলা টিপে মেরে ঝুলিয়ে দেয়। আর যেই ছেলেটা ওর ছেলে বলে দাবি করছে সে বুড়ির ছেলে নয়। কারণ বুড়ি নিঃসন্তান ছিল।
— এই কথাগুলো শুনে অনাদি তাড়াতাড়ি বাড়িতে ফিরে আসে এবং রত্না দেবীকে সব কথা খুলে বললেন। তখন ওরা উভয়েই পারস্পরিক নিজেদের ভয়ের অভিজ্ঞতার কথা বলতে থাকে।
— একটু রাত বাড়তেই দুজনেই দেখছে ঘরের ছাদে কে যেন বড় বড় ঢিল ছুঁড়ছে। দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ, পরক্ষণেই মনে হচ্ছে কেউ একজন ঘরে দরজা ঠেলে ঢোকার চেষ্টা করছে।
— অনাদি বাবু গায়েত্রী জপ করতে শুরু করলেন। এদিকে তার শিশুটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে আর হা, হা করে বোতলের পর বোতল দুধ খেতে থাকে। রত্না দেবী তো ভয়ে পাথর হয়ে গেছে।
— অনাদি বাবু মনস্থির করে বোলপুরের নিকট সাঁওতায় যাবেন। আর তো উপায় নেই। মনে মনে স্মরণ নিয়েছেন তাঁকে। তিনি এও বললেন মনে মনে, ” আজ রাতের মত স্ত্রী, সন্তান নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো। আজ রাত্রিটা আমাদের রক্ষা কর। যদি তুমি সত্যি থেকে থাক আর সত্যি যদি তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে থাক তাহলে লাইটটা অফ হয়ে আবার জ্বলে উঠবে। যেই ভাবা সেই কাজ। কিন্তু এতেও অনাদি বাবুর পরীক্ষার নিবৃত্তি হল না। ভাবলেন ইলেকট্রিসিটির গন্ডগোল। তিনি আবার মনে মনে আওড়ালেন যদি দেখি লাইটটা একমিনিট অফ হয়ে অন হয়েছে। তাহলে বুঝতে পারব বাবা তুমি আজ আমাদের সত্যি রক্ষাকর্তা হয়ে এসেছো। পরবর্তীতে ঠিক তাই হল।”
—- পরদিন ভোর হতে না হতেই সাঁওতা চললেন। সেখানে একটি অন্ধকার ঘরে বসে আছে তারা। হঠাৎ দেখলেন চারিদিকে অন্ধকার যেন আর ও তীব্র হয়ে গেল। ঘরের মধ্যে কেমন যেন ঝুপঝুপ করে বালি পড়ছে। হঠাৎ নাকি সুরে…
— বীরভূম নিবাসী অনাদি তার স্ত্রী এবং কন্যাকে নিয়ে হাজির হয়েছে। এরপর বলেন,” তুই তো বেটা আমাকে পরীক্ষা করছিলি! যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পারলে আজকেই স্ত্রী, কন্যাকে নিয়ে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। ওটা চারুলতার বাড়ি। ওকে মেরে ফেলে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় কিন্তু ওর আত্মা শান্তি লাভ করেনি ওখানেই ঘুরঘুর করে। আসলে তোর শিশু কন্যা এই অতৃপ্ত আত্মাকে দেখতে পায় তাই ওকে ভীষণভাবে ভয় দেখায় বুড়ি। ওর বোতলের পর বোতলের দুধ সব খেয়ে ফেলে। তোর সন্তানকে মেরে ফেলবে আজ রাতেই। তোরা যে এখানে এসেছিস ও টের পেয়ে গেছে।
—- “পালিয়ে যা ওখান থেকে। ওই বাড়িতে কেউ বাস করতে পারে না। তোর আগেও অনেকবার অনেকেই থাকতে এসেছিল পারেনি। ওখানে বুড়ি কাউকে টিকতে দেবে না। বাঁচতে চাইলে পালিয়ে যা আজই।” এরপর বালি পড়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে আলো জ্বলে উঠল।
— সেইদিন ওরা দেশের বাড়িতে চলে আসে। সেদিন থেকে শিশুটি আর চিৎকার করে না। বোতল বোতল দুধ খায় না। শিশুটি হাত পা নেড়ে খেলতে শুরু করে।
— এই হল চারুলতার কাহিনী। এরপর অনাদি ট্রান্সফার নিয়ে বেলডাঙায় চলে আসে। এর বহু বছর পর খবর পাওয়া যায় এক প্রোমোটার ওইখানে এক বিরাট ফ্ল্যাট বাড়ি তোলেন। তবে আর কোনো কথা শোনা যায়নি। হয়ত ইঁট, কাঠ,পাথরে বালিতে চাপা পড়ে গিয়েছিল সে বুড়ির আত্মা।
— জানি অনেকেই বলবেন এসব গাঁজাখোর গল্প। কিন্তু এসব কিছুই সত্য ঘটনা। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন।
—– ওঁরা আসে। বারবার ফিরে আসে কারণ অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি হয় না। দেখবেন খুঁজে কান পাতলেই শোনা যায় আজ ও ওদের কান্না…! 🍁
🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ৯
তৎকালীন গভর্ণর মোনেম খাঁ হাই সাহেবকে ডেকে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি সরকারি নীতির কাছে নতি স্বীকার করেননি, সরকারের অনুরোধকে তিনি ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে তাঁর শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ৯।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
রেহানা বীথি
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ঋণ স্বীকার করেছেন। “ধ্বনিবিজ্ঞান ও বাংলা ধ্বনিতত্ত্ব” (নভেম্বর ১৯৬৪), সম্পাদিত গ্রন্থ “ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ ১৩৭০” তাঁর প্রতি উৎসর্গীকৃত। সাহিত্য পত্রিকার ১৩৭২ বর্ষা সংখ্যা ‘শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা সংখ্যা” রূপে হাই সাহেব বের করেন। শহীদুল্লাহ সাহেবের প্রিয় ছাত্র হতে পারাকে হাই সাহেব নিজের পরম সৌভাগ্য ও ঈশ্বরের অপার করুণা বলে মনে করতেন।
প্রফেসর হাই-এর রবীন্দ্র ভাবনা
প্রফেসর হাই ছিলেন ছোটবেলা থেকেই ভাবুক
ধরনের। প্রকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সৌন্দর্য উপভোগ করতেন নিবিড়ভাবে। ঘুরে বেড়াতেন মাঠে মাঠে। প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা ছিল তাঁর কাছে অনেকটা নেশার মত। ভালবাসতেন কবিতা। ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কখনও নিজের মনেই আবৃত্তি করে উঠতেন প্রিয় কোনো কবিতার দু’চার লাইন। আর তাঁর প্রিয় কবিতা ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা। রবীন্দ্রনাথের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডারে যেন হারিয়ে ফেলতেন নিজেকে। বিশ্বকবির সুরেই ঝংকৃত হয়েছে তাঁর সমস্ত জীবন। তাঁর স্বরেই বেজে উঠেছে হাই সাহেবের হৃদয়ের স্বরলিপি। অনেক কবির কবিতার মাঝে রবীন্দ্রনাথের কবিতাই তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। এই কবিতাগুলো বারবার আবৃত্তি করে তিনি তৃপ্ত হতেন।
রবীন্দ্র সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি বিশিষ্ট আয়ুব শাহীর কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচার বন্ধে ফরমান জারি করেছিল। হাই সাহেব তার বিরোধিতা করেন। কতিপয় বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে এক যুক্ত বিবৃতির মাধ্যমে তিনি এই অপকর্মের তীব্র প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, পূর্ব বাংলার মানুষের মন ও চিন্তাধারার সাথে রবীন্দ্রনাথের যোগ অবিচ্ছেদ্য ও অনিবার্য। এর আগেও ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণীর পাঠ্যসূচি থেকে হিন্দু সাহিত্যিকদের রচনাবলী, বিশেষ করে বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার প্রস্তাব সরকার থেকে উঠেছিল। তৎকালীন গভর্ণর মোনেম খাঁ হাই সাহেবকে ডেকে পাঠিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। তিনি সরকারি নীতির কাছে নতি স্বীকার করেননি, সরকারের অনুরোধকে তিনি ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফলে তাঁর শত্রুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তাঁর মতো অনমনীয় ও সাহসী বিভাগীয় প্রধান না থাকলে সেদিন রবীন্দ্র-সাহিত্য বাদই পড়ে যেত। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “এটা আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়। নীতিকে বিসর্জন দেয়া আর জীবন বিসর্জন দেয়ার মধ্যে পার্থক্য কি! রবীন্দ্রনাথকে বাদ দেয়া মানে আমার জীবনের কথা, ভালোবাসা প্রেম সবকিছুই বাদ দেয়া। আমি পারবো না।” (চলবে)
🍂অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
🍁সম্পাদকীয় ঋণ : মহামিলনের কথা, ফিরে পড়া গল্প ও ফিরে পড়া কবিতা বিভাগ-এর লেখাগুলি আন্তর্জাল সংকলিত। ওই সমস্ত বিভাগের লেখাগুলির বানান অপরিবর্তিত।
