



🍂নিবন্ধ
লেখক রাজীব রায় পেশায় একজন স্বনামধন্য আইনজীবী। বিভিন্ন ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকাতে তিনি স্বমহিমায় নিবন্ধ লিখে চলেছেন। এমনকি দলীয় মুখপত্রতে নিয়মিত তাঁর লেখা ইতিমধ্যে পাঠকের মনে দাগ কেটেছে। বর্তমানে লেখক সিপিআই (এম এল) লিবারেশন দলের মুর্শিদাবাদ জেলার সম্পাদক। অন্যদিকে তিনি একজন জনদরদী নেতা।

সুখেন রায় বিপ্লবী কম্যুনিস্ট
রাজীব রায়
সুখেন রায় (Sukhen Roy) -এর জন্ম এবং আদি বাসস্থান মুর্শিদাবাদ জেলার খড়গ্রাম থানার কলগ্রাম গ্রামে। তাঁর পিতার নাম অভয়পদ রায়। মাতা মৃণালিনী রায় ছিলেন সাগরদীঘি থানার যোগপুর গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ আচার্যের কন্যা, তিনি ১৯৪৩ সালের মড়কে মারা যান। সুখেন রায়ের পড়াশোনা শুরু হয় বাতুর গ্রামে সৃষ্টি পণ্ডিতের পাঠশালায় শুভঙ্করী পাঠ দিয়ে। সেখান থেকে বালিয়া পরেশনাথ হাইস্কুল। তিনি কিছু দিন পূর্ব বর্ধমান জেলার চুড়ুলিয়া স্কুলে পড়েছেন। এছাড়া কান্দুরিয়া হাইস্কুল, এবং কান্দি রাজ হাইস্কুলে পড়েছেন, সম্ভবত কান্দি রাজ হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছেন। ১৯৫০ সালে কাঁদি রাজ কলেজ শুরু হয়, তিনি প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তখন কলেজের কোনও হস্টেল ছিল না, ছাত্ররা রাজ কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করতেন। তিনি সেই হস্টেল থেকেই ১৯৫০ সালে হোল টাইমার হয়ে আর সি পি আই (RCPI) পার্টিতে যোগ দেন। তখন পান্নালাল দাসগুপ্ত এলাকায় এলাকায় মুক্তাঞ্চল গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন।
সুখেন রায় সপ্তম শ্রেণীতে পাঠরতকালে বেলে ভেড়ামারা মাঠে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এক সভা করেন, তিনি সেসময় থেকে কম্যুনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। সৌমেন ঠাকুর-এর কম্যুনিস্ট লীগ দল ১৯৩৬ সালে আর সি পি আই নামে আত্মপ্রকাশ করে। মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে আর সি পি আই দলের প্রভাব ও কার্যক্রম খুব বেশি ছিল। মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯৩৬ সালে তারা প্রথম লাল-ঝাণ্ডা তুলেছিল। স্বাধীনতার ঠিক পূর্ববর্তী সময়ে সামাজিক পরিস্থিতি দুরন্ত হয়ে ওঠে, যেমন পুলিশী অত্যাচার বাড়তে থাকে তেমনি শ্রমিক কৃষকের মধ্যে বিপ্লবী তেজ বাড়তে থাকে। আর সি পি আই দলের অভ্যন্তরে তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব বাড়তে থাকে। ১৯৪৮ সালে যোগাই সম্মেলনে পান্নালাল দাসগুপ্ত (যোগাই থিসিস) আওয়াজ তোলেন, ‘সমাজতন্ত্র কেন এখনি নয়?’ তাঁর তত্ত্ব ছিল আঘাতের পর আঘাত হেনে রাস্তা তৈরি করতে হবে, চীন, ভিয়েতনামের মতো গণবাহিনী গঠন করে আঞ্চলিক ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে এগোতে হবে। ১৯৪৮ সালে সি পি আই দ্বিতীয় কংগ্রেস পার্টিকে সংগ্রামী ধারায় পুনর্গঠনের সঙ্কল্প গ্রহণ করে। সারা দেশে এক নূতন ধারায় কম্যুনিস্ট রাজনীতি ও কর্মকাণ্ড শুরু হয়। আর সি পি আই এর নেতৃত্বে অস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। সুখেন রায় জঙ্গি কৃষক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন, মুর্শিদাবাদ বীরভূম ও বর্ধমান জেলাগুলির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাঁর কাজ শুরু করেন। একের পর এক কৃষক প্রতিবাদ সভা ও মিছিল সংগঠিত করতে থাকেন। কান্দি, আন্দুলিয়া, মাটিয়ারা, সাদপুর, পাখুরিয়া, হলদি, বোলপুর প্রভৃতি অংশে জোতদারদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হয়। বড়ঞা থানার ক’য়েকখানি গ্রামে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্লোগান ওঠে হলদির লড়াই বিশ্বের লড়াই। মুক্তির ডাক। সেসময় কম্যুনিস্ট নেতাদেরকে খুব কষ্ট করতে হতো, এমনকি সবদিন খাওয়া জুটতো না, অনেক সময় বিশ পঞ্চাশ কিলোমিটার রাস্তা হেঁটে যেতে হতো। এমনও হয়েছে একখানা ধুতি দু’ভাগ করে সুখেন রায় ও শ্যামাপদ মণ্ডল লুঙির মতো করে পড়েছেন। সশস্ত্র লড়াইয়ের অংশ হিসেবে বীরভূমে ডাক লুঠ হয়, খড়গ্রাম থানার গোপীনাথপুর মাঠে মহীষার ডাক লুঠ ঘটে সম্ভবত ১৯৫১ সালে সুখেন রায়, শ্যামাপদ মণ্ডল ও অনাদি পালের নেতৃত্বে। শ্যামাপদ মণ্ডল ও অনাদি পাল রাইফেল সহ ধরা পড়েন।
১৯৫১ সালের পর আর সি পি আই এবং সি পি আই যৌথ কর্মসূচী করতে থাকে অনেক। কান্দিতে ব্যক্তি স্বাধীনতা কমিটি, মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজ এক বৃহৎ জনসভা হয়েছিল। আর সি পি আই এর পক্ষে গীতা ব্যানার্জী, সুখেন রায়, কালী ভট্টাচার্য প্রমুখ, সি পি আই -এর জ্যোতি বসু ছিলেন, গীতা ব্যানার্জী সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫২ সালে পান্নালাল দাসগুপ্ত জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গান্ধীবাদী হয়ে ওঠেন। ফলে, আর সি পি আই -এর নেতা কর্মীগণ হতোদ্যম হয়ে বেশিরভাগ সি পি আই-এ যোগ দেন। সুখেন রায় ১৯৫৩ -এর প্রথম দিকে সি পি আই -এর সঙ্গে যুক্ত হোন। আর সি পি আই -এর কর্মীদের মধ্যে দ্বিধা ছিল দল ছাড়ার বিষয়ে। ১৯৫৩ সালে বীরভূমের কুনুটিয়াতে আর সি পি আই-এর এক অধিবেশন হয় সেখানে সুখেন রায় প্রস্তাব দেন আর সি পি আই-এর প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়েছে এবং সি পি আই য়ে যোগ দিতে, প্রস্তাব পাস হয় এবং গোটা সংগঠন সি পি আই য়ে যোগ দেন। সি পি আই ছিল বহরমপুর কেন্দ্রিক সীমিত পকেটের সংগঠন; আর সি পি আই -এর নেতা কর্মীগণ যোগ দেওয়ায় সি পি আই মুর্শিদাবাদে জেলা জুড়ে জনগণের সংগঠন হয়ে উঠল। সুখেন রায় মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, বর্ধমান ডি কে সি (District Kishan Cell )-তে কাজ করতেন। বিশেষত মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে কৃষক সমিতিতে করতেন। ২১-২২ মে ১৯৫৩ জ্যোতি বসুর আমন্ত্রণে হাওড়ার বাগনানে প্রাদেশিক কৃষক সভার ১২ তম বার্ষিক সম্মেলনে ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৩ জুলাই তিনি কৃষক আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন এবং পরে জামিনে মুক্তি পান। ২রা জানুয়ারি ১৯৫৫ পাখুরিয়াতে হরেকৃষ্ণ কোঙার, আব্দুল্লা রসুল এবং সুখেন রায় বীরভূম ডি কে সি-এর সঙ্গ মিটিং করেন। ২৭-২৮ এপ্রিল ১৯৫৫ হুগলির বড় কামালপুরে ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাদেশিক কৃষক সভার রাজ্য সম্মেলনে তিনি মুর্শিদাবাদকে নেতৃত্ব দেন। তখন মুর্শিদাবাদে কৃষক সভার সভাপতি ছিলেন ফায়েজুদ্দিন ও সম্পাদক ছিলেন ধীরেন বাগ। ১৯৫৭ সালে তিনি কৃষক সভার জেলা সম্পাদক হন এবং রাজ্য কমিটিতে যুক্ত হন। ৩০-৩১ অক্টোবর ১৯৫৭ বনগ্রামে রাজ্য সম্মেলন হয়, এবং ১-৩ নভেম্বর ১৯৫৭ বনগ্রামে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সভার সম্মেলন হয়, প্রকাশ্য জনসভায় সভাপতিত্ব করেন এ কে গোপালন। ১৯৬৪ সালে স্বেচ্ছাবসর পর্যন্ত তিনি ঐ পদে ছিলেন। ১৯৬০ সালে কাকদ্বীপ কৃষক সভার রাজ্য সম্মেলনে তিনি যোগ দেন ও রাজ্য কমিটিতে যুক্ত থাকেন, এবং ইরিগেশন সাব কমিটির সদস্য হন। কিষাণ সভা ক্যানাল ব্যবস্থা নিয়ে আন্দোলন করে। যদিও সুখেন রায় দীর্ঘদিন ক্যানাল আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, ১৯৫৩ ডিসেম্বরে প্রফুল্ল গুপ্ত-এর ‘নির্দেশ’ পত্রিকার ৪র্থ সংখ্যায় ‘ক্যানাল ব্যবস্থা ও জনমত’ শিরোনামে তাঁর মতামত প্রকাশ করেন। ১১ জানুয়ারি ১৯৬০ বর্ধমান ডিইসি -এর তারাপদ মণ্ডল, মুর্শিদাবাদ ডিইসি-এর সুখেন রায়, বীরভূম ডিইসি ও পিইসি -এর হরেকৃষ্ণ কোঙার বীরভূমে মিটিং করেন ও তিন জেলায় ক্যানাল আন্দোলন শুরুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, তিন জেলার নামে লিফলেট বিলি হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬০ বড়ঞার তেলডুমা গাঁয়ে ২৫০০ জনের উপস্থিতিতে ক্যানাল কনভেনশন করেন, সুখেন রায়, হরেকৃষ্ণ কোঙার, এবং আব্দুল ওয়াদুদ নেতৃত্ব দেন। গোকর্ণ, বাগোর (নবগ্রাম) প্রভৃতি এলাকায় বিশ্বনাথ মুখার্জি ও তিনি অনেকগুলি জনসভা করেন। বেলডাঙ্গা, ভরতপুর, শক্তিপুর (রঙ্গলাল সিকদার), কাঁঠালিয়া (বৈদ্যনাথ বিশ্বাস) প্রভৃতি এলাকায় জনসভা হয়। ১৯৬৩ বহরমপুর থানার বৈদ্যনাথপুর চরে দখলকার চাষীদের উচ্ছেদ জন্য চক্রান্ত শুরু হলে ৮ এপ্রিল ১৯৬৩ সুখেন রায় ও বৈদ্যনাথ বিশ্বাস তাঁদের সঙ্গে মিটিং করেন। আন্দোলন শুরু হয়, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, সূর্য মণ্ডল ও অন্য কৃষক গ্রেফতার হন ও পরে জামিনে মুক্তি পান। হাজারি লাল বিশ্বাস অ্যাডভোকেট হিসেবে কাজ করেন। বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, রমানাথ সরকার, সুখেন রায়-এর নেতৃত্বে দক্ষিণ হিজলে ব্যানা বন সরিয়ে জমি দখলের লড়াই শুরু হয়েছিল। আরও পর উত্তর হিজলে আন্দোলন হয়েছিল।

বাংলায় বরাবর ধানের বিকল্প অর্থকরী ফসল ছিল পাট। কিন্তু সরকারের পাট চাষ বাঁচাতে নির্দিষ্ট ভাবনা ছিল না। পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ জেলা ও আসামে পাট চাষ চলত। পাট চাষ গভীর সঙ্কটে পড়ছিল, মন প্রতি ৪৫ টাকা ন্যূনতম দাম দাবি ওঠে। পাট উৎপাদক চাষীদের আন্দোলন গড়ে তুলতে ‘jute growers’ দের ইউনিয়ন তৈরি করে পার্টি। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬১ নদীয়ার কালিগঞ্জ হাটে ১৫০ জন ডেলিগেট নিয়ে জুট গ্রোয়ার্স কনভেনশন হয়, ওপেন সেশন সভাপতিত্ব করেন বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, বক্তব্য রাখেন অজিত গাঙ্গুলি, অপর্ণা কিঙ্কর ভট্টাচার্য, সুখেন রায় ও নরেন বিশ্বাস। ১৪-১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ মুর্শিদাবাদ জেলার ইসলামপুরে জুট গ্রোয়ার্স রাজ্য সম্মেলন হয় ২০৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে। সুখেন রায় মুখ্য আয়োজক ছিলেন, ২৯ আগস্ট থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৬২ তিনি ইসলামপুরে অবস্থান করেন। চাঁদা তুলতে একাধিক টিম গঠিত হয় হরেকৃষ্ণ কোঙার, আব্দুল্লা রসুল, বীরেন রায়, সুখেন রায় প্রমুখের নেতৃত্বে। প্রেসিডিয়ামে ছিলেন আব্দুল্লা রসুল, মুন্সী কলিমুদ্দিন এবং বৈদ্যনাথ বিশ্বাস। ওপেন সেশনে বক্তৃতা দেন আব্দুল্লা রসুল, হরেকৃষ্ণ কোঙার, প্রাণেশ বিশ্বাস (আসাম), ভবানী রায়চৌধুরী, সুখেন রায়, সনৎ রাহা ও বীরেন রায়। প্রায় ১০ হাজার জমায়েত হয়েছিল। ১০ ডিসেম্বর ১৯৬৩ কলকাতায় জুট কমিটির মিটিং হয়। কেন্দ্র সরকার পাট চাষ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হয়ে মান সিংহ কমিটি তৈরি করে মুর্শিদাবাদে পাঠায়, কমিটি সুখেন রায় -এর সহিত দীর্ঘ আলোচনা করেন। সরকার পাট চাষীদের স্বার্থে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
ভূমি সংস্কার ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির অন্যতম দাবী। পার্টি এবং কৃষক সভা বর্গাচাষ, দাদন প্রথার অবলুপ্তি ,পাট্টা বিলি ও খাস জমি উদ্ধার বিষয়ে আন্দোলনে নামে। কান্দি থানার উগরা গ্রামে ২০-২১ নভেম্বর ১৯৬০ District Land Reforms Conference হয়, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস সভাপতি ছিলেন, সুখেন রায় ও হরেকৃষ্ণ কোঙার বক্তব্য রাখেন। ১৪ জুন ১৯৬৩ নবগ্রামে প্রকাশ্য জনসভা হয়। পরবর্তীকালে হরেকৃষ্ণ কোঙার ভূমি মন্ত্রী হয়ে ল্যান্ড রিফর্মস আন্দোলনের অনেক দাবি ও প্রস্তাব ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে কার্যকরী করেন। ১১ নভেম্বর ১৯৫৫ সি পি আই -এর মুর্শিদাবাদ জেলা সম্মেলন হয় রাজ্য পর্যবেক্ষক প্রমোদ দাসগুপ্ত-এর উপস্থিতিতে। সুখেন রায় সম্মেলনে ৫৩ বার বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য রাখেন। তিনি জেলা কমিটির সদস্য হন এবং ১৯৬৪ পর্যন্ত জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। ১৯৬৩ সালে অপর্ণা কিঙ্কর ভট্টাচার্য পার্টি ত্যাগ করলে তিনি অবিভক্ত পার্টির জেলা সম্পাদক হন ও ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। পার্টির মধ্যে ভাঙন আশঙ্কা তীব্র হয়ে ওঠে। ভূপেশ গুপ্ত এবং এম এন গোবিন্দননায়ার কলকাতা, মুর্শিদাবাদ, বর্দ্ধমান, বীরভূম, নদীয়া ও বাঁকুড়া জেলার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যগণ ও তফশীল জাতির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন, আসবার কথা ছিল এস এ ডাঙ্গের। সুখেন রায় সমস্যাগুলো তুলে ধরেন। ১৯৬৪ জুলাই পার্টির চার দিনের রাজ্য কাউন্সিল মিটিংয়ে তিনি উপস্থিত ছিলেন। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হলে তিনি পার্টির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। পূর্বেই অপর্ণা বাবু, ধীরেন বাগ, রঞ্জিত গুপ্ত পার্টি ত্যাগ করেছিলেন। যদিও তিনি পরে পুনরায় সি পি আই-তে যোগ দিয়েছেন এবং ১৯৮৫ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।
১৯৫৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় বাংলা বিহার সংযুক্তির প্রস্তাব করলে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরা তার বিরোধিতা করেন। সারা রাজ্যে Linguistic State Reorganization Committee গঠিত হয় এবং সুখেন রায় বিভিন্ন কমিটিতে যুক্ত ছিলেন ও অনেক আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত রাজ্য সংযুক্তি সম্ভব হয়নি, বামেদের ভূমিকা তাতে কম ছিল না।
খাদ্য আন্দোলন ১৯৫৬ -এর বন্যার পর বাংলাকে নাড়িয়ে দেয়। খাদ্য আন্দোলনে প্রচুর মিছিল হয়, এমনকি হাঙ্গার প্রসেসন, এস ডি ও অফিসগুলিতে বিক্ষোভ দেখান পার্টির নেতৃত্বে জনগণ। কান্দিতে ২৭ মে ১৯৫৭ হাঙ্গার প্রসেসন ও ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সত্যাগ্রহ পালিত হয়। ২০ মার্চ ১৯৬০ কলকাতা মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে রাজ্য ফুড কনফারেন্স হয়, ২১ মার্চ প্রকাশ্য সভা হয়। সুখেন রায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। কাঁদির বন্যা যুগ যুগের সমস্যা। ম্যাসাঞ্জোর ব্যারাজ তৈরি হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গে সেচের উপকার হলেও বন্যাতে ভাসিয়ে দেওয়া নিত্য ব্যাপার ছিল। তিনি মুর্শিদাবাদ সমাচার ও স্বাধীনতা পত্রিকায় প্রচুর লেখালেখি করেন। কান্দি বন্যা বিষয়ে তাঁর ও ড. সচ্চিদানন্দ ঘোষ-এর বক্তব্য বিধানসভায় ২১ জুন ১৯৫৭ হরেকৃষ্ণ কোঙার উত্থাপন করেন। কান্দি মহকুমা ও বীরভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ভুক্তভোগী ছিল। যার বিরুদ্ধে সি পি আই দীর্ঘ আন্দোলন গড়ে তোলে, সিউড়িতে সুখেন রায়, দুর্গা ব্যানার্জী, ড. রাধানাথ চট্টোরাজ, সরদীশ রায় প্রমুখের নেতৃত্বে “Abolition of Tilpara Bridge Gate” বৃহৎ জনসভা হয়েছিল। এবং দুই জেলায় অনেকগুলি জনসভা হয়েছিল তাঁদের নেতৃত্বে। ১১ মার্চ ১৯৬০ সুখেন রায়, ডঃ সচ্চিদানন্দ ঘোষ, খুদু চন্দ্র ও সরদীশ রায় ম্যাসাঞ্জোর এবং কানাডা ড্যাম পরিদর্শন ও তদন্ত করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযোগিতায়। সিউড়ি এবং ম্যাসাঞ্জোর এর বিভিন্ন আধিকারিক ও ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে আলোচনা হয়। সুখেন রায় ২১ মার্চ ১৯৬০ পার্টির মুর্শিদাবাদ জেলা কমিটির কাছে তাঁর রিপোর্ট ও বন্যা নিয়ন্ত্রনে কি করতে হবে ড্রাফট জমা দেন যা অনুমোদিত হয়। ২২ মার্চ ১৯৬০ জাতীয় ফ্লাড এনকোয়্যারি কমিশন (FEC) তিনি ও সনৎ রাহার সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। FEC নীতিগতভাবে একমত হয়েছিল তাঁর পরিকল্পনার সঙ্গে, যা পরবর্তীতে কান্দি মাস্টার প্ল্যান নামে খ্যাত হয়। সুখেন রায় কান্দির বন্যা রোধে দীর্ঘ লড়াই চালান। পিপলস রিলিফ কমিটি (PRC) মানুষের দুর্দশা ও চিকিৎসায় সহায়তার লক্ষ্যে সি পি আই-এর মধ্যে গঠিত হয়। মুর্শিদাবাদে পি আর সি-এর দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল রাজ্য পার্টির পক্ষে মনিকুন্তলা সেনের উপর। মুর্শিদাবাদ জেলায় PRC -কে পার্টির পক্ষে ১৯৫৩-৬৪ পর্যন্ত সুখেন রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। ড. অনাথবন্ধু আচার্য, ড. সচ্চিদানন্দ ঘোষ, ড. সুধাংশু শেখর মুখার্জি, ড. রাধানাথ চট্টোরাজ প্রমুখ পি আর সি -এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ ও ১৯৫৯ সালের বন্যার পর কান্দি মহকুমা বিদ্ধস্ত হয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় বাঁশ টাইলস যোগাড় হয় এবং বন্যার্তদের মধ্যে সেগুলো ও ওষুধ বিতরণ ও ডাক্তার ক্যাম্প করা হয়। সাদপুর ও সৈয়দপুরে ড. অনাথবন্ধু আচার্য দাতব্য মেডিক্যাল সেন্টার তৈরি করেন। এমনকি মানুষের সুবিধার জন্য সুখেন রায়ের উদ্যোগে এবং পি আর সি ‘র আর্থিক সহায়তায় জেলায় টালি কারখানা তৈরীর চেষ্টা হয়েছিল, রাজ্য পি আর সি ২৫০০ টাকা দিবে প্রস্তাব দিয়েছিল। পার্টি ভাগ হওয়ার পর পি আর সি তার বহুমুখীতা হারিয়েছে। বর্তমানে সি পি আই (এম) দল পি আর সি কে দাতব্য চিকিৎসার কাজে ভালভাবে কাজে লাগিয়েছে।
শিক্ষক আন্দোলন সম্পর্কে সি পি আই ১৯৫৪ সালে আগ্রহী হয়ে ওঠে। পার্টির পক্ষে সুখেন রায় ও সন্তোষ ভট্টাচার্য সেকেণ্ডারী ও প্রাথমিক শিক্ষকদের সঙ্গে মিটিং করতে থাকেন, শিক্ষকদের দাবি বিশেষত বেতনের নিশ্চিতি, বিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রসার, নির্দিষ্ট আইন তৈরি প্রভৃতি বিষয়ে আন্দোলন শুরু করেন। শিক্ষক আন্দোলনের পেশাগত নতুন নেতৃত্ব গড়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে তিনি নিজে শিক্ষকের পেশায় যুক্ত হন, তিনি তাঁর শিক্ষক বিনয় মুখার্জির সহযোগিতায় খড়গ্রাম থানার থিরা গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। শিক্ষক আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর আমৃত্যু সম্পর্ক ছিল। সুখেন রায় ছিরুটিতে জেলেদের কোঅপারেটিভ গড়ার উদ্যোগ নেন ১৯৬০ সালে। তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছেন। মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন (AITUC ) গড়ে তোলেন কান্দিতে স্থানীয় শ্রমিকদেরকে সঙ্গে নিয়ে, কাঁঠালিয়ার অবনী প্রামানিক (চটর ভান্ডারী) তাঁর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বহরমপুরে মুর্শিদাবাদ মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে তোলেন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন নবকৃষ্ণ চ্যাটার্জী। তিনি উভয় ইউনিয়নে সম্পাদক ছিলেন। পরে নিত্য গোপাল দাস এবং তারপর জয়দেব মণ্ডল সম্পাদক হয়েছিলেন। ১৯৬৬ সালে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের মোটর শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর মধ্যে সমন্বয় ও বৃহৎ ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যে দুমকায় ২রা ডিসেম্বর ১৯৬৬ অধিবেশন হয়, তিনি অন্যতম প্রধান ভূমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮৫/৮৬ সালে সৈয়দ আসাদুল হোসেন -এর সঙ্গে অপর একটি (CITU) ইউনিয়ন গড়ে তোলেন সবরকম মোটর যান শ্রমিকদের নিয়ে। তিনি সভাপতি ছিলেন এবং সৈয়দ আসাদুল হোসেন সম্পাদক ছিলেন। তাঁর মৃত্যু তক্ ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তাঁকে কেন্দ্র করে বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমে বিভিন্ন বাস শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষার্থে এক সমন্বয় কমিটি গড়ে উঠেছিল, যাতে বর্ধমানের এম ইসলাম, আসানসোলের মি হরি সিং, রঘুনাথগঞ্জের অচিন্ত্য সিংহ, কান্দির বিনয় সাহা, বহরমপুরে জয়দেব মণ্ডল নেতৃত্ব দেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার জিলা পরিষদে প্রেস যন্ত্র বসালে জেলার প্রেসগুলো সংকটের মুখে পড়ে। তাঁর সুপরামর্শে প্রেস মালিকদের ও কর্মীদের বৃহৎ আন্দোলন গড়ে ওঠে। পরে তাঁর মধ্যস্থতায় সংকটের কিছুটা নিরসন হয়। দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের ভাগীরথী আন্দোলন NDDB র মিশনের অংশ ও অধিনে। এই আন্দোলনে সুখেন রায় দীর্ঘদিন যুক্ত ছিলেন। ভাগীরথী পরিচালনায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ আনার লক্ষ্যে ও দুগ্ধ উৎপাদনকারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে মিল্ক প্রোডিউসারর্স অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন বেলডাঙ্গার পরিমল ঘোষ, রুকুনপুরের সত্যপদ ঘোষ, বড়ারের অশোক ঘোষ, নিয়াল্লিশপাড়ার চন্দ্রশেখর দাস, নবগ্রামের ভগীরথ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে। তিনি বোর্ড অব ডাইরেক্টরে যুক্ত হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি সমেত ১৭ জন প্রতিনিধি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে গুজরাটের আনন্দে এনডিডিবি-এর চেয়ারম্যান V J Kurien -এর সঙ্গে ভাগীরথী ও দুধ উৎপাদন এর বিভিন্ন সমস্যা বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁর প্রস্তাবে সারা ভারতে দুধের দাম বৃদ্ধি করে এনডিডিবি। সেসময় ভাগীরথী দুধ উৎপাদনে জেলায় এক বৈপ্লবিক ভূমিকা নেয়।
সুখেন রায় থিরা গ্রামে বাস করতেন। কান্দি বাতুর খড়গ্রাম রাস্তার কান্দি থেকে চন্দ্রসিংহবাটী পর্যন্ত কোনও রাস্তা ছিল না। সুখেন রায় থিরা, বাতুর, বড়ার, হরিপুর, চন্দ্রসিংহবাটী, বেলেহাট প্রভৃতি গ্রামের মানুষকে নিয়ে রাস্তাটি তৈরি করান। কান্দি থানার ওসি তাঁকে ও ক’য়েকজন গ্রামবাসীকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু এস ডি ও কান্দি ড. সতীশ কুমার মগন খুব সাহায্য করেন এই রাস্তা তৈরিতে।
সুখেন রায় স্বাধীনতা পত্রিকার নিজস্ব সাংবাদিক ছিলেন। মুর্শিদাবাদ সমাচার, মুর্শিদাবাদ বার্তা, স্বাধীনতা, পরিচয়, কালান্তর পত্রিকায় তাঁর প্রচুর লেখা বেরোয়। নাম্বুদ্রিপাদ সরকারকে কংগ্রেস সরকার ভেঙে দিলে ‘কেরালায় প্রতিক্রিয়াশীলদের চক্রান্ত’ বইটি লিখেছেন পার্টির কান্দি আঞ্চলিক শাখার নামে, প্রকাশক এস এ ওয়াদুদ, যা সমগ্র রাজ্যে সমাদৃত ও প্রচারিত হয়। তাঁর লেখা আর একটি বই ছিল।
সুখেন রায় ২২ জানুয়ারি ১৯৯৯ কলকাতা সি সি সি সি নার্সিংহোমে অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম ও ব্রঙ্কো নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রয়াত হন।🍁
