



২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ভারত ফাইনাল অবধি পৌঁছে গেল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly) ছিলেন সেই দলের ক্যাপ্টেন। যদিও ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার মানতে হল, তবুও সেই যাত্রাপথেই ভারত পেয়েছিল নিজেদের হারানো গৌরব। তাঁর সময় থেকেই ভারত বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে শুরু করে : তনুজা বন্দ্যোপাধ্যায়

দল তখন ছন্নছাড়া: ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্কটকাল
১৯৯৯–২০০০ সাল। ভারতীয় ক্রিকেট প্রায় অন্ধকারে। ম্যাচ-ফিক্সিংকাণ্ডে ধরা পড়েছেন বেশ ক’য়েকজন সিনিয়র খেলোয়াড়। বিশ্বাসের ভিত নড়ে গিয়েছে। দর্শকের আস্থা, বোর্ডের দৃঢ়তা আর খেলোয়াড়দের মনোবল সবকিছুই প্রশ্নের মুখে। ঠিক এমন সময় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নেতৃত্বের ভার তুলে দেয় এক তরুণ, আগ্রাসী ও স্পষ্টবাদী ক্রিকেটারের হাতে। তাঁর নাম সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। তাঁর কাঁধে চাপানো হয় ভাঙা মনোবল ও ছন্নছাড়া দলকে এক নতুন দিশা দেখানোর দায়িত্ব।

সৌরভ সেই সময় ছিলেন দেশের অন্যতম সেরা ওপেনার। ১৯৯৬-এ লর্ডস-এ টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি করে ততদিনে সকলের মন জয় করেছেন। কিন্তু অধিনায়ক হিসেবে তাঁর চ্যালেঞ্জ ছিল ভিন্ন ও অনেক কঠিন। তাঁকে শুধু খেলতে নয়, গড়তেও হত একটি নতুন ভারতীয় দল। এমন এক দল যে দল বিদেশের মাটিতে জিততে জানে চোখে চোখ রেখে লড়াই করে।

“দাদা” হয়ে ওঠার গল্প: এক নতুন ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ক্রিকেট মাঠে শুধু ব্যাট নয় মনোবল দিয়েও খেলতেন। ওঁর নেতৃত্বে ভারতীয় দল পেয়েছিল এক নতুন সত্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রতিভার উপর। মহেন্দ্র সিং ধোনি, যুবরাজ সিং, বীরেন্দ্র সেওয়াগ, জাহির খান, হরভজন সিং-এর মতো তরুণদের দলে এনে তিনি ভবিষ্যতের ভিত তৈরি করেছিলেন। শুধু দক্ষতা নয় সাহসী মনোভাব ও আগ্রাসনকেই সৌরভ দলের ইউএসপি বানিয়েছিলেন।

সৌরভের অধিনায়কত্বে ভারত ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেয় ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজে। কলকাতার ইডেনে ভিভিএস লক্ষ্মণ-দ্রাবিড়ের সেই ৩৭৬ রানের জুটি, আর হরভজন সিং-এর হ্যাটট্রিক সবটাই সম্ভব হয়েছিল তাঁর দৃঢ় নেতৃত্বের জন্য।

ওই সিরিজই বদলে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটের আত্মবিশ্বাস। এরপর ২০০২ সালে ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে জার্সি খুলে সৌরভের উদযাপন একটি সিম্বল হয়ে উঠেছিল নতুন ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির। তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন—ভারত এখন কাউকে ভয় পায় না।
ঐতিহ্যের ধারক, ভবিষ্যতের ভিত্তি: সৌরভের উত্তরাধিকার
২০০৩ সালের বিশ্বকাপে ভারত ফাইনাল অবধি পৌঁছে গেল। সৌরভ ছিলেন সেই দলের ক্যাপ্টেন। যদিও ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হার মানতে হল, তবুও সেই যাত্রাপথেই ভারত পেয়েছিল নিজেদের হারানো গৌরব। তাঁর সময় থেকেই ভারত বিদেশের মাটিতে টেস্ট জিততে শুরু করে : ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ইংল্যান্ড, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া সব জায়গায়।

সৌরভের বড় কৃতিত্ব ছিল ‘দল’ গড়ার দর্শন। যখন তিনি অধিনায়কত্ব ছাড়েন তখন একটি পরিণত, আত্মবিশ্বাসী ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দল রেখে যান। মহেন্দ্র সিং ধোনি এবং বিরাট কোহলির মতন পরবর্তী প্রজন্ম সেই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই ভারতীয় ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে।
পরবর্তীতে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তিনি বোর্ডকেও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালনা করার চেষ্টা করেন।

সৌরভ শুধু একজন ক্রিকেটার বা অধিনায়ক নন, তিনি হয়ে উঠেছেন ভারতীয় ক্রিকেটের এক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসের ধারক। ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীরা জানেন, “দাদা” নামটা শুধু প্রীতির নয়, ভরসারও। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এমন এক সময় দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যখন চারপাশে ছিল কেবল অন্ধকার। কিন্তু তিনি দেখিয়েছিলেন, আলো, আত্মবিশ্বাস, সাহস ও নতুন ভারতের ক্রিকেটীয় দৃষ্টিভঙ্গির। তিনি শিখিয়েছেন—লড়াই করে, মাথা উঁচু করে খেলাটাই আসল জয়। আর সেই জন্যই সৌরভ আজও শুধু এক নাম নয়, এক স্তম্ভ, এক আবেগ, এক অনুভব।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Singer Arijit Singh : অরিজিৎ সিং : জিয়াগঞ্জ থেকে বিশ্বমঞ্চে সুরের যাদুকর
