



🦋ফিচার
বাড়িতে তখন দাদামশাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখে একইসঙ্গে দাদামশায় ও নাতির যূগ্ম সঙ্গীত পরিবেশন, দাদামশায়ের নাটকের, অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথকৃত অভিনয় অবলোকন, এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বঙ্গ সাহিত্য-রবীন্দ্রসাহিত্য-ভারতীয় সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের অবাধ চর্চায় সমৃদ্ধ করলেন নিজেকে। লিখেছেন : নার্গিস পারভিন
দক্ষিণডিহির পিরালী ব্রাহ্মণ পঞ্চানন কুশারীর বংশধর, জোড়াসাঁকোয় পত্তন করেছিলেন যে ঠাকুরবাড়ির, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই সেই ঠাকুরবাড়ি সমাজের সম্মুখে জাজ্বল্যমান নিদর্শন হয়ে উঠতে থাকে। সুদক্ষ ব্যবসায়ী, রাজা রামমোহনের একনিষ্ঠ বন্ধু, দ্বারকানাথ ঠাকুর যেমন অর্জন করেছিলেন বিপুল ধনসম্পত্তি, তেমনি দেশকে, সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে সমাজ সংস্কারমূলক কাজেও ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। দ্বারকানাথ ঠাকুরের পর, পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর আর এক উচ্চতর শিখর। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলতেই মনে আসে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া দ্যূতি। জোড়াসাঁকোর উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। যাঁর প্রভা চিরন্তন, চির উজ্জ্বল। সেই সুবিখ্যাত ঠাকুরবাড়ির কৃতি সন্তান, লেখক তথা রাজনীতি নিষ্ঠ সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠপুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র সৌম্যেন্দ্রনাথ, পিতা ছিলেন কবি সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠাকুরবাড়ির যোগ্য উত্তরসূরি সৌম্যেন্দ্রনাথের নামকরণ করেছিলেন মহর্ষি নিজে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে সৌম্যেন্দ্রনাথ ছিলেন ঠাকুরবাড়ির ‘শেষ দীপশিখা’। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতির মন্দটুকু বর্জন করে, ভালো টুকু ধরে রাখা এবং পাশ্চাত্য ও আরব্য-পারস্য-ইসলামী সংস্কৃতির যেটুকু ভালো তাকে মুক্তমনে গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ঘটেছিল তার সুরটি পুত্রদের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয়ে প্রপৌত্র সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মধ্যেও বহমান ছিল সমানভাবে।
শিশু বয়স থেকেই সাহিত্যচর্চার পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য-সংগীত- নাট্য চর্চার মধ্য দিয়ে লালিত সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যরসবোধের মাত্রা নির্ণিত হয়েছিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মানদণ্ডে। কবিতা, সঙ্গীত চর্চা, বাঁশি বাজানো রপ্ত করেছিলেন সহজাতভাবেই। বাড়িতে তখন দাদামশাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্রনাথের কাছে শিখে একইসঙ্গে দাদামশায় ও নাতির যূগ্ম সঙ্গীত পরিবেশন, দাদামশায়ের নাটকের, অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথকৃত অভিনয় অবলোকন, এসবের মধ্যেই বেড়ে উঠলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
বঙ্গ সাহিত্য-রবীন্দ্রসাহিত্য-ভারতীয় সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যের অবাধ চর্চায় সমৃদ্ধ করলেন নিজেকে। ঠাকুরবাড়ির প্রথানুযায়ী যুক্তিহীন প্রথার বর্জন, নির্ভীকতা কিংবা যুক্তির আলোকে হৃদয়কে উন্মুক্ত করার পাশাপাশি তৎকালীন দেশীয় এবং বিশ্ব রাজনীতির উত্তাল তরঙ্গ-স্পর্শে নিজেকে নতুন রূপে গড়ে নিয়েছিলেন তিনি।বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, ইংরেজ সরকারের প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কিংবা রবীন্দ্রনাথের রাখিবন্ধন উৎসব প্রচারের সেই উত্তাল মুহূর্তে শিশু বয়স থেকেই দেশপ্রেমের জোয়ার বয়ে যেত সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনে। সেই জোয়ারই ঠাকুরবাড়ির সন্তানকে একদিন তার যুবক বয়সে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল প্রত্যক্ষ রাজনীতির প্রাঙ্গণে। ঠাকুরবাড়ির সন্তান সাহিত্য চর্চা করবেন, অন্যায়ের প্রতিবাদে প্রবন্ধ রচনা করবেন, এটাই ছিল প্রত্যাশিত। তা না করে, সম্পূর্ণ প্রথা বহির্ভূতভাবে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ!আসলে এই ঠাকুরবাড়িই বার বার প্রথা ভেঙে নতুন পথের দিশারী হয়েছে সব সময়। সুতরাং সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ ঠাকুরবাড়ির সন্তান হয়েই বোধহয় সম্ভব ছিল। কারণ ঠাকুরবাড়ির সন্তানেরা পারিবারিক প্রভাবে যেমন মার্জিত, সূক্ষ্ম রসবোধের একটা বিশেষ পর্যায়ে নিজেদের উন্নীত করতেন ঠিক তেমনিভাবেই সেখানে ছিল স্বাধীন মনের অবাধ বিচরণ। ঠাকুরবাড়ির প্রাঙ্গণে, দক্ষিণের বারান্দায় বিতর্কের ঝড় উঠতে পারে, একজন অন্যজনের সঙ্গে সহমত না হতে পারেন, কিন্তু কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মানসিকতা পোষণ করতেন না অভিভাবকরা। রক্তচক্ষু শাসন তো নৈব নৈব চ। সুতরাং পিতা সুধীন্দ্রনাথের বুক ভেঙে গেলেও সন্তানকে শাসনের বেড়াজালে আটকে রাখেননি তিনি। যদিও তিনি জানতেন সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে রাজনীতির পথ আসলে দহনের পথ আহুতির পথ।
যুবক সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বুকে তখন দেশপ্রেমের আগুন। সেই আগুন তাঁর মনে জ্বেলে দিয়েছিলেন দেশনায়ক মহাত্মা গান্ধী। সৌম্যেন্দ্রনাথ সেদিন সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে, এক লহমায় ঠাকুরবাড়ির ঐশ্বর্য ত্যাগ করে, নগ্নপায়ে, খাদি বস্ত্রে এসে দাঁড়িয়েছিলেন পথে। মানুষের কল্যাণে পথে নেমেছিলেন দ্বিধাহীনভাবে।বিদেশি দ্রব্য বর্জন, অসহযোগ আন্দোলন, সম্প্রীতির প্রচার কি না করেননি সেদিন। এমনকি মহাত্মা গান্ধীর রাজনৈতিক নীতির সমালোচক, দাদামশাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিতর্ক করতেও পিছপা হননি। রবীন্দ্রনাথও ধৈর্য ধরে শুনেছিলেন যুবক সৌমেন্দ্রনাথের যুক্তি। পরবর্তীতে অবশ্য সৌমেন্দ্রনাথ সরে এসেছিলেন মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশিত পথ থেকে। দেশের স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে মহাত্মার অহিংস আন্দোলনের ফাঁকফোকর গুলো দৃশ্যমান হয়েছিল তাঁর কাছেও। তখনই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের যুক্তিগুলো। গান্ধীর আহ্বানে সেই যে পথে নেমেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ, পরে গান্ধীর পথ থেকে সরে এলেও ঘরে ফেরেননি কোনোদিনই। বরং অনবরত খুঁজে বেড়িয়েছেন একটা সঠিক পথ, যে পথে ঘটতে পারে প্রকৃত বন্ধন মোচন। স্বপ্ন দেখেছেন একটা স্বাধীন দেশের, যেখানে মানুষ পাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সহ সব রকম অধিকার। সঠিক পথের দিশার জন্য হন্যে হয়ে ফিরেছেন পথে পথে। ভাবসর্বস্ব ঠাকুরবাড়ির পরিবেশ তখন অসহ্য হয়েছে উঠেছে তাঁর কাছে। বাস্তবে মানুষের জীবনযুদ্ধের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির সংযোগহীনতা ধরা পড়েছে তাঁর দৃষ্টিতে। ছুটে গেছেন প্রত্যন্ত গ্রামে। চেষ্টা করেছেন মানুষের সঙ্গে মিশে তাদের মতো জীবন যাপন করে তাদের কষ্টের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে। তাদের মাঝে থেকে তাদের সার্বিক উন্নতিতে শামিল হতে। একটা সময় আবার ব্যক্তিমানুষের সেই চেষ্টার নিষ্ফলতা অনুধাবন করেছেন। এভাবেই পথের অন্বেষণে এসে যুক্ত হয়েছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে। সেইসময় পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল কমরেড মুজফ্ফর আহমেদ, কবি নজরুল ইসলাম, নলিনী গুপ্তের নেতৃত্বে। কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘লাঙল’ পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকলো তাঁর লেখা। পরবর্তীতে নাম বদলে রাখা হয় ‘গণবাণী’। এই ‘গণবাণী’তেই তিনি ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’র বাংলা অনুবাদ করেন। একসময় গ্রেপ্তার এড়াতে, দলের সিদ্ধান্তে রাশিয়া পাড়ি দিলেন। সেখানে ঘনিষ্ঠভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নকে পর্যবেক্ষণ করলেন তিনি। তবে স্টালিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার কমিউনিস্ট কাজকর্মকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্পূর্ণভাবে মেনে নিয়েছেন তা বলা যায়না। প্রতিবাদ করতেও পিছপা হননি। দেশে ফিরে এসে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর মতপার্থক্য দেখা দেয়। সমান্তরাল একটি কমিউনিস্ট দল ‘লীগ অফ ইন্ডিয়া’ গড়ে তোলেন। এভাবেই নির্ভীক সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর যুবক বয়স থেকেই সারাজীবন মানুষের পাশে থেকেছিলেন। বারবার কারাবরণ করলেও প্রতিবাদ থেমে থাকেনি তাঁর। সুভাষচন্দ্র বসুর মুক্তির দাবিতে অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা দিয়ে কারাবরণ করেন ১৯৩৫ সালেও। এমন কি স্বাধীন ভারতবর্ষেরও প্রথম বন্দী সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুরই।
রাজনীতি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং লেখালেখির মধ্যে দিয়ে একটি অতিব্যস্ত কর্মমুখর জীবন অতিবাহিত করে ১৯৭৪ সালের মে মাসে ইহলোক ত্যাগ করেন ঠাকুরবাড়ির সন্তান সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। যুবক বয়সে, বিলাসবহুল জীবন এবং ঐশ্বর্য ত্যাগ করে সেই যে পথে নেমেছিলেন, সেইপথেই সারাজীবন সাধারণ মানুষের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলেছিলেন সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমরা জানি ঠাকুরবাড়ি সমাজ সংস্কারমূলক কাজে সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করলেও দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে দূরত্ব ছিল অনেকখানি। সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যেন নিজের জীবন যাপনের মধ্যে দিয়ে ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সেই দূরত্ব মিটিয়ে দিয়ে ছিলেন অনেকটাই। 🍁
ছবি : আন্তর্জালিক
আরও পড়ুন : Book Review : শমীক সেন এর কাব্যগ্রন্থ কৃপা
