



অনেকেই ইতিমধ্যে এটা জানেন,সঙ্গীতশিল্পী শিল্পী অরিজিৎ সিং (Arijit Singh) মিডিয়ায় প্রায় অনুপস্থিত। সামাজিক মাধ্যমে নিরুত্তাপ। সাক্ষাৎকার এড়িয়ে চলেন।এই ধাঁচে চলা অরিজিৎ আজকের দিনে এক ব্যতিক্রমী তারকা। লিখেছেন : সুকোমল বন্দ্যোপাধ্যায়
মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ শহর—একটি শান্ত, ঐতিহ্যবাহী জনপদ। এখানেই ২৫ এপ্রিল ১৯৮৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন অরিজিৎ সিং (Arijit Singh) ছোটবেলা থেকেই সঙ্গীত তাঁর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মা ছিলেন গৃহিণী ও সঙ্গীতপ্রেমী। বাবা পঞ্জাবি হলেও সঙ্গীতের দিক থেকে বাড়ির বাঙালি সংস্কৃতিই তাঁকে বেশি প্রভাবিত করেছিল। পরিবারের অনুপ্রেরণায় অরিজিৎ ছোটবেলা থেকেই ধ্রুপদী সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিক বাংলা গানের প্রতি আকৃষ্ট হন।

অরিজিৎ সিং-এর প্রাথমিক শিক্ষা হয় জিয়াগঞ্জের একটি স্কুলে। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হয় গুরু রাজেন্দ্র প্রসাদ হাজরার কাছে। পরবর্তীতে ধ্রুপদী সঙ্গীতের দীক্ষা নেন দীর্ঘদিন। কিশোর বয়সেই অরিজৎ অল ইন্ডিয়া রেডিওতে গান গাইতেন। এবং স্থানীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন। সঙ্গীতের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা ছিল এতটাই গভীর যে পাঠ্যবইয়ের চেয়ে হারমোনিয়াম ও তানপুরা ছিল বেশি আপন।

২০০৫ সালে, মাত্র আঠেরো বছর বয়সে অরিজিৎ সিং অংশ নেন জনপ্রিয় সঙ্গীত প্রতিযোগিতা ‘ফেম গুরুকুল’-এ। যদিও সেখানে তিনি জয়ী হননি। কিন্তু বিচারকদের নজরে পড়ে যায় তাঁর কণ্ঠের গভীরতা, আবেগ আর নিখুঁত স্কেল। সঙ্গীত পরিচালক শান্তনু মৈত্র ও বিশাল শেখরের মতো মানুষরা তাঁকে চিনে ফেলেন। আর সেটাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
‘তুম হি হো’ থেকে ‘কেরালা স্যুট’: এক বহুমাত্রিক শিল্পী
অরিজিতের বলিউড যাত্রা সহজ ছিল না। দীর্ঘদিন স্টুডিওতে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং প্রোগ্রামিংয়ের কাজ করেন। ইমতিয়াজ আলির ‘আশিকী ২’ সিনেমার গান ‘তুম হি হো’ দিয়ে তিনি মূলধারার দর্শকের হৃদয়ে নিজের স্থায়ী আসন করে নেন। সেই গানটি শুধু এক গায়ককে নয় একটি যুগকেও সংজ্ঞায়িত করে।

গভীর আবেগ, পরিমিত উচ্চারণ ও ব্যথাতুর সুরের সংমিশ্রণ এক অনন্য সঙ্গীতধারা সৃষ্টি করে। যেটিকে বহু সমালোচক ‘অরিজিত যুগ’ বলে অভিহিত করেন।
‘চন্না মেরেয়া’, ‘আগার তুম সাথ হো’, ‘রাএস’–এর ‘জালিমা’ থেকে শুরু করে ‘কেশরিয়া’ কিংবা ‘হাওয়া বেঁধে রাখে’– সব গানেই অরিজিৎ প্রমাণ করেছেন যে তিনি শুধু রোমান্টিক নয়, বরং এক বহুমাত্রিক শিল্পী। তিনি ক্লাসিক্যাল, রক, ফোক ও ইলেকট্রনিক সঙ্গীতেও সমান সাবলীল। অরিজিৎ হিন্দি ছাড়াও বাংলা, তামিল, তেলুগু, মারাঠি, গুজরাটি, ওড়িয়া সহ একাধিক ভাষায় গান গেয়েছেন। বাংলা গানের প্রতি তাঁর টান বরাবরই স্পষ্ট। ‘মন মজা’, ‘তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব’, ‘এক তুমি’ প্রভৃতি গান বাংলাভাষী শ্রোতাদের হৃদয়ে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর এই প্রেমই প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক তারকা হয়েও অরিজিৎ নিজের শিকড়কে ভোলেননি।
অরিজিৎ সিং ২০২৩ সালে একটি কেরালা ভাষার ফোক ফিউশন প্রজেক্টে অংশ নেন। ওটি দক্ষিণ ভারতের শ্রোতাদের মধ্যে দারুণ সাড়া ফেলে। এই প্রজেক্টে অরিজিৎ শুধু কণ্ঠই দেননি বরং এর সুর ও সঙ্গীতায়োজনেও অংশ নেন—যা তাঁর বহুমুখী প্রতিভার এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলে মনে করা হয়।
জীবনচর্যা, নিঃশব্দ মানবতা ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন
অরিজিৎ সিং কেবল গায়ক নন—তিনি একজন নিঃশব্দ সমাজকর্মীও। লাইমলাইট থেকে নিজেকে দূরে রেখেই তিনি বহু সমাজকল্যাণমূলক কাজ করে থাকেন। কোভিড-১৯ মহামারির সময় হাজার হাজার মানুষকে অক্সিজেন, ওষুধ এবং চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছেন সম্পূর্ণ নীরবে।

অনেকেই ইতিমধ্যে এটা জানেন, এই শিল্পী মিডিয়ায় প্রায় অনুপস্থিত। সামাজিক মাধ্যমে নিরুত্তাপ। সাক্ষাৎকার এড়িয়ে চলেন।এই ধাঁচে চলা অরিজিৎ আজকের দিনে এক ব্যতিক্রমী তারকা। তাঁকে দেখা যায় সাধারণ জামা-কাপড়ে বিমানবন্দরে নিজের হাতেই ব্যাগ টেনে নিয়ে যেতে। কোনও দেহরক্ষী ছাড়া স্টেজে উঠতে। তাঁর এই সাদাসিধে জীবনচর্যাই তাঁকে সাধারণ মানুষের আরও কাছের করে তোলে।
ওঁর ব্যক্তিজীবনও তেমনই নিরিবিলি। স্ত্রী কোয়েল রায় এবং সন্তানদের নিয়ে তিনি মূলত জিয়াগঞ্জেই থাকেন, কলকাতা ও মুম্বাইয়ে কাজের প্রয়োজনে যাতায়াত করেন।
ভবিষ্যতে তাঁর স্বপ্ন—একটি সঙ্গীত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা। যেখানে ধ্রুপদী ও আধুনিক দুই ধারার শিক্ষার সংমিশ্রণ থাকবে। এছাড়া তিনি বাংলা ফোক সঙ্গীতকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিয়ে যাওয়ার জন্যও কাজ করছেন। তিনি বিশ্বাস করেন : “ভাষা নয়, সুরই মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দেয়।”
অরিজিৎ সিং শুধুই একজন গায়ক নন, তিনি এক আবেগ। এক সময়। এক ধ্রুপদী সৌন্দর্য যার সুরের মধ্যে বাস করে ভালবাসা, বিরহ, শান্তি ও জীবনবোধ। তাঁর মতন শিল্পী যুগে যুগে একবারই জন্ম নেন। আর আমরা সৌভাগ্যবান, যে এই যুগে তাঁর গান শুনে হৃদয় ভরাতে পারছি।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Sasraya News Sunday’s Literature Special | 1st June 2025, Issue 67 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১ জুন ২০২৫, রবিবার। সংখ্যা ৬৮
