Sasraya News

Sasraya News Sunday’s Literature Special | Issue 71, 29th June 2025 | Sunday | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৯ জুন ২০২৫, সংখ্যা ৭১| রবিবার

Listen

সম্পাদকীয় 

হাতে গোনা কয়েকটি রহস্যমাখা দিন। এই দিন নিয়ে যত কিছু খেলা। আজ আর কালের পার্থক্যগুলো কেউ খুঁজে বারকরতে পারবে না। কারণ সময়ের জন্য জীবনে প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডে কি অপেক্ষা করে সত্যিই কেউ আমরা জানি না। আর জানি না বলেই হয়ত জীবনের বেঁচে থাকার স্বাদ অন্যরকম। আমরা প্রত্যেকেই তার বিচার করবার চেষ্টা করতে গিয়ে অসফল হয়েছি। আর আগামীতেও হতে হবে। এই মায়া রহস্যে ঘেরা পৃথিবীলোকে আমাদের জীবনদশা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্নরকম। তবুও আমরা কিন্তু সব কিছুই বুঝতে বা মানিয়ে নিতে শিখেছি সামাজিক তত্ত্বাবব্যধানে যা কিছু শিখি তাই দিয়ে। জীবনের সঙ্গম স্থল মন। এই মনের দ্বারা মৈথুনক্রিয়া প্রতি নিয়ত ঘটতে থাকে ফলে প্রাণ শক্তি এক গভীর অনুভূতি। যাঁরা যাঁরা বিশ্রাম নেই না। তাঁদের জন্য নতুন বছর বা সময় বলে কিছুই ঘুরেফিরে না। তাঁরা শুধুই চলমান তাঁরা শুধুই বহমান। প্রতিটি মানুষের ভিড়ে আমরা শান্তি, সুখ সমৃদ্ধি, কামনা ও বাসনা খুঁজি। কিন্তু জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এক বিশেষ আকর্ষণের বন্ধনের প্রয়োজনে আটকে যায়। কিন্তু নিঃশ্বাস শেষ হলেই পথের ধুলো যা সেই দেহ তাই।

এটা বড়ো হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই বুঝে উঠতে শিখেছি। কিন্তু মোহ ত্যাগ করতে হয় জেনেও ঐ যে মায়া রহস্য আর আমিত্বের জালে ঘিরে এলোমেলো। আমাদের পরিচিতির জন্য একটি সুন্দর নাম, ব্যবহার হয়ে থাকে। এই নামের অর্থ কিন্তু চিহ্ন। মানে পরিষ্কার যে আমাকে যখনই নামের ছত্রে ফেলা হয় তখন আমাকে বোঝাতে চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। এই সমস্ত খেলায় হল ‘মাসলেশ ম্যাজিক’ যা ভরহীন জাদুতত্বের একটি উদাহরণ। যার মধ্যেই সমস্ত কিছু প্রবাহমান। বয়ে চলেছে। মন স্থির করলেই আমরা সবটাই পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। কিন্তু মন স্থির হবে কি করে! তার জন্য অনেক অনেক পরিষ্কার হতেই হবে। প্রতিটি মুহূর্ত আসে নতুনের খোঁজে। আর বহমান নতুন চলে যায় বয়তে বয়তে। আমাদের বয়স কমতে কমতে হারিয়ে যায়। আবার নতুনকে স্বাগতম করে উঠি।

ঈশ্বর মঙ্গলময়। মঙ্গল হোক সকলের সুস্থতা কামনা করি সুখ শান্তি দুঃখ এগুলি যাদের সঙ্গে আড্ডা মস্করায় ভাগ করে নিতে পারি তারাই তো আসলে বন্ধু। আর এই বন্ধু প্রেমের সম্বোধন। প্রীতির সম্বোধন। ভালবাসার সম্বোধন। এই সম্পর্ক চিরটুট বন্ধন। 🍁

 

 

🍁মহামিলনের কথা 

 

শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
যে আমাকে সহস্রনামের দ্বারা স্তব করতে ইচ্ছা করে—যদি সব পাঠে সমর্থ না হয়, মাত্র একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেও আমি স্তুত হয়ে থাকি। স্তবকারীকে আমি বড় ভালবাসি।
স্তবকারীকে তুমি ভালবাস কেন?
দেখরে জীব আমার অংশ। আমাকে ভুলে দেহাত্মবোধে উন্মাদ হয়ে কত দুঃখ ভোগ করে। জন্ম-জন্মান্তর ধরে বহু বহু আকাঙ্খা করে কত কষ্ট পায়। সে যা চায় আমি তাই হয়ে তাকে আত্মদান করি।
তুমিই সব হও?
হাঁ, যখন জীব স্ত্রী চায়, আমি স্ত্রী হই; যখন সে পুত্র, মিত্র, আত্মীয়-স্বজন মান সম্ভ্রম বিদ্যা তপস্যা চায়,আমি তাই হয়ে তার সেবা করি,কিন্তু তাতে অশান্তি ভিন্ন শান্তি পায় না। যতক্ষণ বহুদর্শন থাকে,ততক্ষণ শান্তির আশা করা উন্মাদ কল্পনা। সহস্র সহস্র জন্ম যাতনা পেয়ে যখন সে প্রকৃত আমাকে চায়,তখন আমি তাকে ধরা দিই। প্রকৃতরূপে চাইবার সহজ সরল পথ হল আমার নাম করা,স্তব করা।

বল, তোমার মুখে তোমার স্তব শুনতে বড় ভাল লাগে।
আমার মুখ ভিন্ন আর মুখ কি আছে? জগতে যত মাথা আছে,যত হাত পা জ্ঞান কর্ম্মাদি ইন্দ্রিয় আছে, সব আমার। আমি সব হয়ে সব ব্যাপ্ত করে অবস্থান করি। অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডে অনন্ত অনন্ত কোটি স্থাবর জঙ্গম হয়েও আমি ফুরিয়ে যাই না। পূর্ণ আমি অনন্ত সেজেও স্বরূপে সেই পূর্ণই থাকি। তোর কি আমার এই রূপ দেখতে ইচ্ছা করে না?
আমি তোমার। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা তুমি সব নাও। তোমার যা ইচ্ছা তাই কর। আমি আর তোমায় কিছু বলবো না। আমি তোমার শরণাগত।
হাঁ, এ কথাটি স্মরণ রাখতে চেষ্টা কর, আমি তোর যোগক্ষেম বহন করবো, অনন্য ভক্তের যোগক্ষেম আমিই করে থাকি।
তোমার ‘তবাস্মি’ এ মন্ত্রটি আমাকে চিরদিনের জন্য দাও। আমি যেন একপল মাত্র ‘তবাস্মি’ এই মহামন্ত্রটি না ভুলে যাই।
বল্, কেবল বল্—
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ! কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ!
আবার বল্—
জয় ব্রজনাথ জয় জয় ব্রজনাথ।
জয় ব্রজনাথ জয় জয় ব্রজনাথ॥
ঋণ : 🍁শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী | শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী

 

🍂প্রচ্ছথা
 
সেই মুহূর্তে শহরের উপরে ভেসে চলে এক অলিখিত সুর : এই শহর বৃষ্টি ভালোবাসে, এই শহরেই বৃষ্টি মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। এভাবেই কলকাতার বৃষ্টি রোজ নতুন গল্প লেখে, নতুন কবিতা লেখে, আর মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, জীবনের ক্লান্তির মধ্যেও রঙ আছে, সুর আছে, ভালবাসা আছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকে বৃষ্টির গন্ধ…

 

আমাদের বৃষ্টিবিলাসের শহর কলকাতা

নিয়ামাল নাসির

লকাতার আকাশ সকাল থেকেই মুখ গোমড়া। কিন্তু এই গোমড়া মুখও যেন একধরনের স্বস্তি নিয়ে আসে। বর্ষার প্রথম স্পর্শেই শহরের রঙ বদলে যায়। দিনের আলো ম্রিয়মাণ হয়ে আসে। অথচ তাতেই যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে রাস্তার মোড়গুলো। নিউ মার্কেটের ধারে পুরনো দোকানগুলোর সামনের রাস্তায় জমে ওঠা জল পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, এই তো সেই কলকাতা, যার কথা রন্ধ্রের কথা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে সুমন গেয়েছেন বারবার। ছাতার ফাঁক দিয়ে যখন ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ে, তখন নিউ মার্কেটের পলিশহীন ছাদের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষেরা অদ্ভুত শান্তিতে মগ্ন হয়ে যান। কেউ কাগজে মোড়া গরম ভেজা চপে কামড় বসান, কেউ ভেজা শাড়ির আঁচল ঠিক করেন। দোকানদারদের হাঁকডাকেও সেই বৃষ্টির সুর মিশে যায়। একপাশে সস্তার জুতো আর পলিথিনের ছাতা সাজানো, অন্যপাশে রঙিন সালওয়ার-কামিজ, আর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে একের পর এক প্লাস্টিকের কভারের ওপর। এই নিউ মার্কেট যেন এক আশ্চর্য যাদুর বাক্স, বৃষ্টি এলেই যার ঢাকনা খুলে যায়।

 

একটু হাত-ছোঁয়া দূরেই, ভবানীপুরের গলিগুলো বর্ষার দিনে অদ্ভুত ছন্দে ভরে ওঠে। এখানে বৃষ্টি মানেই শঙ্খের ধ্বনি, উলুধ্বনি, কদমফুল, আর মোড়ের চায়ের দোকানে দীর্ঘ আড্ডা। পুরনো বাড়িগুলোর বারান্দায় বসে থাকা মানুষজন বাইরের ভিজে রাস্তা দেখতে দেখতে চুপ করে থাকেন। কেউ হয়ত এফএম-এ বাজে বৃষ্টি স্পেশাল গান, “রিমঝিম গিরে সাওয়ান” বা “আজ মেঘের খামে চিঠি”।

 

অন্যদিকে, এক্সাইড মোড়ের লাল-সবুজ ট্রাফিক লাইট বৃষ্টিতে ভিজে ঝাপসা হয়ে আসে। অফিসযাত্রীদের ছাতার রং গুলিয়ে যায়, একটিমাত্র লাল ছাতা আকাশের ধূসরের মধ্যে আলাদা হয়ে থাকে। মোড়ের ধারে চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোর ছেলেটি গরম চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। পাশেই ফুটপাথের বইয়ের দোকানদার পলিথিন চাপা দিয়ে বই বাঁচাচ্ছে। বৃষ্টি যেন এক অদ্ভুত দৃশ্যকল্প তৈরি করে। এই মুহূর্তের জন্য এখানে প্রত্যেক মানুষ নায়ক, প্রত্যেকটি গল্পের আলাদা সুর। রাস্তাঘাট, গাড়ির চাকা, বাসের জানলা, সবকিছুতেই জমে ওঠে ধুলো-ধোয়া জলের ঘ্রাণ।
আবার নন্দনে গিয়ে বৃষ্টি দেখা আর বৃষ্টি ভেজা ছাতার ফাঁক দিয়ে সিনেমার পোস্টার চোখ আটকে যাওয়া, কলকাতাবাসীর কাছে তা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। দুপুর গড়িয়ে বিকেলে যখন হালকা আলোয় ছাতা মাথায় কফি বা চা খেতে খেতে কেউ রবীন্দ্রসদন পেরোয়, তখন সে নিজেকে কোনও ছবির চরিত্র মনে করতেই পারেন। নন্দনের চাতালে বসে থাকা ছাত্র-ছাত্রীরা, টলমল করে হেঁটে যাওয়া বয়স্ক দম্পতি, ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়ানো পর্যটক-সবাই মিলে যেন তৈরি করে ফেলছেন এক অদৃশ্য চিত্রনাট্য। বৃষ্টির দিনগুলিতে নন্দন যেন আরও গভীর, আরও ঘন আরও রঙিন হয়ে ওঠে।

একটু হাত-ছোঁয়া দূরেই, ভবানীপুরের গলিগুলো বর্ষার দিনে অদ্ভুত ছন্দে ভরে ওঠে। এখানে বৃষ্টি মানেই শঙ্খের ধ্বনি, উলুধ্বনি, কদমফুল, আর মোড়ের চায়ের দোকানে দীর্ঘ আড্ডা। পুরনো বাড়িগুলোর বারান্দায় বসে থাকা মানুষজন বাইরের ভিজে রাস্তা দেখতে দেখতে চুপ করে থাকেন। কেউ হয়ত এফএম-এ বাজে বৃষ্টি স্পেশাল গান, “রিমঝিম গিরে সাওয়ান” বা “আজ মেঘের খামে চিঠি”। বৃষ্টি নামলেই ভবানীপুরের অলিগলি দিয়ে কাগজের নৌকো ভেসে চলে। না এখন তেমন নয়, কিন্তু মন তো এই মুহূর্তে বিচরণশীল। শিশুরা সেই নৌকোয় হাত বুলিয়ে আনন্দ পায়, আবার বড়রাও ছুঁয়ে দেখেন, মনের গোপন কোণে হয়ত তারাও ফিরে যান ছোটবেলায়।

এই শহরের বৃষ্টি মানেই আড্ডা। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান কফি হাউস থেকে শুরু করে গড়িয়া হাটের ছায়াঘেরা চায়ের দোকান, সবখানেই জমে ওঠে কথা। ‘আজ স্কুলে ছুটি হয়ে গেল?’, ‘কাল ক্লাস টেস্ট আছে, পড়ছিস?’, ‘সেই জানিস তো, অরিজিৎ-এর নতুন গানটা শুনলি?’এমন হাজার কথা। সঙ্গে গরম চায়ের কাপে চুমুক আর তেলেভাজার গন্ধ। বৃষ্টি যেন কথারও গন্ধ বাড়িয়ে দেয়। বন্ধুরা প্ল্যান করে, ‘এই রবিবার পিকনিকে যাবি? ডায়মন্ড হারবার না বাগনান?’ আবার কেউ বলে, ‘বৃষ্টি থামুক আগে, তবেই তো যাওয়া…।’ তবু ঠিকই বেরিয়ে পড়ে তারা, প্লাস্টিকের বাটি, কাগজের প্লেট, স্যান্ডউইচ আর কোল্ডড্রিঙ্ক নিয়ে। হুগলির ধারে বা সোনারপুরের ফাঁকা মাঠে বৃষ্টি ভেজা পিকনিক মানেই খোলা আকাশের নিচে হাসি, গান, আর কাদা মাখামাখি।

বৃষ্টির দিনে গান ছাড়া কিছুই সম্পূর্ণ নয়। রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে হেমন্ত, মান্না, লতা, আশা, শ্রেয়া, অরিজিৎ সকলেই আছেন বৃষ্টি বিলাসে। কেউ ওয়্যারলেস রোডের ফ্ল্যাটে বসে বাজায় ‘বরষা এসে গেছে’, কেউ নিউ আলিপুরের ফ্ল্যাটে চালায় ‘চোখে চোখে কথা বলো’। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হেডফোনে বৃষ্টি গান শোনা যেন ভিজে পাতা ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই এক নিঃশব্দ আনন্দ।

এই শহরে বৃষ্টি মানেই ভিজে ঠাণ্ডা বাতাস। শিয়ালদহ থেকে হাওড়া, টালা থেকে টালিগঞ্জ, সবকিছুতে মিশে থাকে কাঁচা বৃষ্টির গন্ধ, পুরনো ট্রাম লাইনের ধোঁয়া ধোয়া সোঁদা গন্ধ। মানুষগুলির তাড়া থাকে, কিন্তু তবুও থমকে যেতে হয় বৃষ্টির সামনে। অনেকে বিরক্ত হয়, কারণ রাস্তা জলমগ্ন, ট্রাফিক জ্যাম, গন্তব্যে পৌঁছনো দেরি। কিন্তু এই দেরিই বোধহয় কলকাতার বর্ষাকে পূর্ণতা দেয়। এক্সাইড মোড়ের বাসগুলো যখন থেমে থাকে, তখন জানলার ধারে বসে থাকা যাত্রী দেখে বাইরে অঝোরে বৃষ্টি। জানলার কাঁচ বেয়ে ফোঁটা গড়িয়ে যায়, সেই ফোঁটা দেখে কেউ হয়ত লিখে ফেলে একটা কবিতা, কেউ লিখে ফেলে প্রিয় মানুষটিকে একটি মেসেজ, ‘শুনছো, আজ বৃষ্টি নামল… রাতে খিচুড়ি, ঘি আর ডিমভাজা হয়ে যাক…’

এই শহরের বৃষ্টি কেবল মেঘ থেকে নেমে আসা জল নয়। এটা এক ধরনের আড়াল, যা ঢাকা দেয় ভিড়, গরম, ক্লান্তি, হাহাকার। আবার এই আড়ালই খুলে দেয় মানুষের ভেতরের কথাগুলো। বৃষ্টি পড়তে পড়তে গানের লাইন মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায় স্কুলের সেই রেইনকোট, সাইকেলের ক্যারিয়ারে রাখা ভিজে খাতা, শীতল বর্ষার সকালে প্রথম প্রেমের চিঠি। নিউ মার্কেট থেকে এক্সাইড মোড় হয়ে নন্দন, সেখান থেকে ভবানীপুর, হাজরা মোড়… আমাদের শহরজুড়ে বৃষ্টি নামে, আমাদের শহর জেগে ওঠে। আর সেই বৃষ্টিকে আলাদা করে সাজিয়ে তোলে আড্ডা, গান আর পিকনিকের গল্প। বৃষ্টির ফোঁটার মতো ছোট ছোট আনন্দ জমে ওঠে মনে। আকাশ ভেঙে পড়া বৃষ্টির দিনে কলকাতা যেন নতুন করে জেগে ওঠে, নতুন করে বাঁচতে শেখায়। রাস্তার জল-কাদা, গাড়ির হর্ণ, ট্রাফিক জ্যাম, ছাতা ভাঙা কিছুই তখন আর অসুবিধা নয়। এইসব নিয়েই তো শহরের আসল বৃষ্টিবিলাস। শেষ দুপুরে যখন আকাশ একটু ফাঁকা হয়, নিউ মার্কেটের এক কোণে চা খেতে খেতে দুজন তরুণী প্ল্যান করে, চল, কালকে নন্দনে সিনেমা দেখতে যাব। এক্সাইড মোড়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটি ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে, ক্যাপশন : ‘Rain kissed Kolkata’। ভবানীপুরের এক গলিতে সদ্য প্রেমে পড়া মেয়ে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে, “এই আকাশে আমি যে রঙ দেখেছি, তার নাম দাও তো…” আর ঠিক সেই মুহূর্তে শহরের উপরে ভেসে চলে এক অলিখিত সুর : এই শহর বৃষ্টি ভালোবাসে, এই শহরেই বৃষ্টি মানুষকে ভালবাসতে শেখায়। এভাবেই কলকাতার বৃষ্টি রোজ নতুন গল্প লেখে, নতুন কবিতা লেখে, আর মানুষকে মনে করিয়ে দেয়, জীবনের ক্লান্তির মধ্যেও রঙ আছে, সুর আছে, ভালবাসা আছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকে বৃষ্টির গন্ধ, আর সেই গন্ধেই বেঁচে থাকে আমাদের প্রতিদিনের বৃষ্টিবিলাস।🍁

 

 

 

🍁বিশেষ গদ্য
জীবনে তো অসম্ভবও আছে; অঘটনও ঘটে। চরিত্রের মাহাত্ম্যে, প্রেমের মাহাত্ম্যে, দানের মাহাত্ম্যে বা দৃঢ় সংকল্পের মাহাত্ম্যে অসম্ভব উজ্জ্বল সৌভাগ্য ধরা দিতে পারে, আর তা ঘটলেই আমরা বলি ‘রূপকথা’। সবসময় গড়পড়তা জীবনে তাকে দেখা যায় না বটে দিনদুবেলা, তা কিন্তু আছে। আলাদিনের মতো আশ্চর্য ভাগ্যবানের কাছে আসে জিন, আসে হাতে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নিয়ে।দয়াবান আবুল কাসেমকে উদ্ধা্র করতে আসে জিন তার বান্ধবী পরির সঙ্গে। গাথা, সাগা তৈরি হবে কী করে যদি কল্পনা— বাস্তবে মিলে বিরাট জীবন, অপূর্ব বস্তুর বিদ্যমানতা না থাকে!

 

সাহিত্যে রূপকথা

তন্বী মুখোপাধ্যায়

ত বিষমকে সৌষম্য দেওয়ার, বহু বন্ধুরকে মসৃণ করবার, বিরুদ্ধ অবস্থাকে মেলাবার দাবিতে জন্ম হয়েছে রূপকথার। রূপকথার উদ্দেশ্য বুঝি জন্ম-জন্মান্তর ধরে অসম্ভবের প্রশ্নটাকে লুপ্ত করে দেওয়া। নিত্যদিনের সত্য ঘটনা যেখানে দৃঢ়ভাবে মুদ্রিত সেখানে সিংহভাগই যন্ত্রণা-প্রসর উপাখ্যান।মানুষের জীবনের একটা অত্যন্ত নরম অভ্যন্তর আছে, তা রূঢ়, তীক্ষ্ণ, পরুষ, নিষ্ঠুরকে ভয় পায়। সেই মনস্তত্ত্বে রূপকথা ভীরু কোমলকে নিরাপত্তা দিতে পারে হয়ত। যদিও রূপকথা ক্লেশের কথা কিছু কম বলে না, অসংখ্য বিপদ তথা বিপথের ভয় সেখানে, নিষ্ঠুরতার ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত রয়েছে সর্বত্র। কিন্তু রূপকথা আসলে উপযুক্তকে সম্মানিত করতেই চায় বলে রূপকথার কোথাও কখনও বিচ্ছিন্নতা নেই।

রূপকথা আজকে শিশুদের জন্য আরও বহুবার লেখা হয়েছে। বদল ঘটেছে প্রচুর। সমাজনীতিই বরাবর এর নিয়ন্ত্রক।কালের দাবিতে আধুনিক লেখকরা রূপকথাকে পরিমার্জিত করেছেন। মুখের রূপকথার মোটা-দাগের একটা ধাঁচ ছিল, সেই স্থূলতাটি লেখার রূপকথায় ক্রমশ মার্জিত হয়ে উঠেছে। মুখের রূপকথার অথচ সজীবতা অতুলনীয়…

প্রকৃত রূপকথা সংস্কার অনুযায়ী সুখদ। মূল চরিত্র কোথাও ঘুণাক্ষরে পরাজিত হবে সে শঙ্কা জাগে না।রূপকথা বর্মের মতো গায়ে পরে নিলে কষ্ট-ভয়-নিগ্রহ আঘাত করতে পারে না। এই রূপকথার ছাঁচ, আজ আমরা জানি।শিশুরা সম্ভবত তাই রূপকথা শুনে আরো শুনতে চেয়েছে। নানা সব অনভিপ্রেত বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে বটে কিন্তু নিশ্চিত আছে রাজা-রাজপুত্রের জয়লাভ, আর সব অন্যায়ের প্রতিবিধানকল্প। নায়ক রূপে অদ্বিতীয়, গুণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, কাজে অপ্রতিরোধ্য।সংকটের তীব্রতা সবসময় নায়কের জয়ের তুলনায় গৌণ, মৃদু হয়ে থেকে যায়। কোন কৌশলে রাক্ষসী-দত্যি-দানো, সুয়োরানিদের ভীতিকর কার্যকলাপসুদ্ধ সংক্ষিপ্ত করে দেওয়া যায় বন্দিনী রাজকন্যার অসহায়তা, সেটাই রূপকথাকে শিশুসাহিত্য করে তুলেছে। ইতিবাচক সমাপ্তির ওপর সর্বদা বেশি আস্থা থাকে কথকের, ততোধিক বেশি আস্থা থাকে সম্ভবত শ্রোতাদের।একটু একপেশে বই কি, তবু জীবনকে কীভাবে সুন্দর করা যায়, সে দুরূহ ভাবনা আছে।

একদিকে দৈব আর অন্য দিকে রূপকথা, এই দুই রকমে অসম্ভব ভয়ঙ্করের বিরুদ্ধে শুভঙ্করের জিৎ।রূপকথা রাজা-রানির রূপ-সাহস-শক্তির কিংবদন্তি গড়ে তুলেছে।যতো ভীষণই রাজ্যের অনিষ্টকারি শক্তি হোক রাজপুত্র বা রাজশক্তি তথা রক্ষাকর্তাকে প্রজাসাধারণ দুর্বার অপরাজেয় বলে অনুভব করেছে, এবং আশ্বস্ত হয়ে ক্ষণিক স্বস্তিতে সুনিদ্রা উপভোগ করেছে। শুভকারি শক্তির সহায়তা করে অসংখ্য প্রাণী-যেমন- ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমী, শুকসারি, কখনও বামন,পরি, জিন, গ্রিফিন এইসব। কল্পনার সুন্দর মনোহারি দ্রব্যে রূপকথার ভান্ডার সদাই ভরা।এজন্য পরিণত বয়স্কের এই সাহিত্যের কলা-রস, সমাজচেতনা নিয়ে ভাবতে খারাপ লাগার কথা নয়।
তথাপি সাহিত্যে যুগবদল হয় প্রায় প্রতি পক্ষে। বেশির ভাগ নতুনত্ব আসে ধীরেধীরে, সময়ের দায়িত্বে।রাজা যে সর্বদা নায়ক হন তা নয়, ‘ফেয়ারি টেলস’–এ সমাজে নগণ্য মানুষও নায়ক হয়েছেন। বুদ্ধিমান ব্যক্তি, সৎ ব্যক্তি বরাবর নমস্য। নরসুন্দর তাই ভূতের গল্পে নায়কের জায়গায়।অসাধারণ বুদ্ধি দিয়ে দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করতে পারেন, ভূত হয়ে পড়ে ভৃত্যবৎ। অসাধ্যসাধনের প্রকৃতিতে যেন রূপকথা আছে। আরব্যোপন্যাসে ‘আলিবাবা ও চল্লিশ চোর’ গল্পে দীন কাঠুরে আলিবাবা নায়ক, তাঁর বাড়ির বুদ্ধিমতি পরিচারিকা মর্জিনা নায়িকা। ক্রমশ সাধারণ ব্যক্তির নিজের ওপর আস্থা ফিরে আসছে, সে গল্প রূপকথায় বলা হয়েছে। ঊনবিংশ শতকে রূপকথার আধুনিক ইন্দ্রজালরসে মগ্ন-করার লেখক হান্স আন্দেরসন তাঁর নায়ক করে তুললেন ‘দি আগলি ডাকলিঙ’ –কে। এক কুরূপ হাঁসের ছানা, দেখা যায়, ক্রমশ রূপান্তরের রূপকথাতে উদ্ভাসিত হচ্ছে।

সাহিত্যে আমরা কি দুরবস্থায় সান্ত্বনা পেতে চাই? কষ্টের অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে চাই? হয়ত, সাহিত্যে আমরা বহুজনের হিতের কারণে গ্রাহ্য-সামাজিক নীতির জয় দেখতে চাই? নাকি সাহিত্যে বিরাট জীবনধারার যে দিক অদেখা তাকে দেখতে চাই? কিংবা আমার জীবনের প্রতিবিম্বই দেখব ব’লে সাহিত্য পড়ি? জীবনের দেখা-অদেখা সত্যিগুলো কি আমরা প্রায়শ সাহিত্যের কষ্টিপাথরে যাচাই করে দেখি? না, না? আমাদের যে ছবি সাহিত্য বর্ণনা করে তা ভুল তো নয়ই, বরং হুবহু মিলে যায় কত কিছু। রহস্যময় অজানা দুর্বোধ্য গল্পকথাও সাহিত্যের মাধ্যমে উপনীত হয় একেবারে চোখের সামনে। সাহিত্য সম্ভবত অবাক করার বিষয়বস্তুর সঙ্গে একান্ত চেনা কাহিনি- চরিত্র-ভাষা- আচরণ- সংস্কৃতিকে একইসঙ্গে পরিবেশন করতে পারে। সাহিত্যের অন্য শিল্পের মতোই বোধহয় একটা হৃদ্দীপ আছে,তাকে আত্মাও বলা যায়।রস বা ধ্বনি না বলে তাকে বলা যায় হয়তো রাহসিক দিক। সাহিত্যের উপরিভাগে থাকে জীবনসত্য। কিন্তু পোয়েটিক সত্যটি অনস্বীকার্য-সাধারণ সত্যের অতিরিক্ত কিছু, ছাঁকা আবেগের ধর্মে তাকে লক্ষ করি; সেটি ক্ষণে ক্ষণে বিরাজমান। ক্ষণে ক্ষণে উজ্জ্বলতর। অন্যতর উপলব্ধির দ্বারা সেস্থানে পাঠক ও সাহিত্যিকের মিল হয়। রূপকথার এরকম বিশেষ উপলব্ধি তথা কাব্যসত্য আছে, এমনকী বৈচিত্র্য আছে রূপকথার কত শত আলাদা আলাদা গল্পে।তাই তাকে সাহিত্য বলতে বাধা নেই।

রূপকথার জগৎ নানা রসে রসাপ্লুত করে তুলতে পেরেছেন একাধিক কথাকোবিদ। সাহিত্যের যেমন রূপকথারও তেমন পাঁচমেশালি রকমের বক্তব্য।কোন কোন রস যে মেশালে সব পেয়েছির মুলুকে গল্পের শ্রোতাকে নিয়ে পৌঁছানো যাবে, এবং নিজেও রচনাকারি হাজারও না-মেটা আকাঙ্ক্ষা ভুলে সব পাওয়ার নিবিড় স্বাদে বুঁদ হতে পারবেন, তা জানতেন রূপকথাকার ঠাকুরমারা, সেই মতো ঝুলিতে ঘটতো বৈচিত্র্যময় রসের ভিয়েন।কল্পনায় তা বড়ো বেশি, এ-কথা ঠিক, সে-জন্যই তাকে নিয়ে সন্দেহ। রূপকথা রূপকথাই, নাকি তা সাহিত্যধর্মের অনুগত? কল্পনা বিপুল হওয়ায় যেমন রূপকথা পলকে হাওয়ায় ভাসায়, তেমনই আঁধার কাটলে সত্যি দিবালোকে তাকে সবরকমে রূপকথা বলে বুঝে নিতে কোনদিন অসুবিধা হয় না। তা সত্ত্বেও শিল্প-সাহিত্য মানবমনের দর্পণ, রূপকথাও। আবহমান সভ্যতা সংস্কৃতি রূপকথার কথায় চিহ্নিত হয়ে থেকেছে। শুধু তাই নয় মানবসভ্যতার ক্রম বিবর্তনের ইতিহাস রূপকথা-উপকথা –নীতিকথার মতো লোকমুখে বলা সাহিত্যের কাছে আজন্ম ঋণী।কতো প্রামাণ্য যে রূপকথা ধরে রাখে এবং রাখতে পারে!

জীবনে তো অসম্ভবও আছে; অঘটনও ঘটে। চরিত্রের মাহাত্ম্যে, প্রেমের মাহাত্ম্যে, দানের মাহাত্ম্যে বা দৃঢ় সংকল্পের মাহাত্ম্যে অসম্ভব উজ্জ্বল সৌভাগ্য ধরা দিতে পারে, আর তা ঘটলেই আমরা বলি ‘রূপকথা’। সবসময় গড়পড়তা জীবনে তাকে দেখা যায় না বটে দিনদুবেলা, তা কিন্তু আছে। আলাদিনের মতো আশ্চর্য ভাগ্যবানের কাছে আসে জিন, আসে হাতে ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নিয়ে। দয়াবান আবুল কাসেমকে উদ্ধার করতে আসে জিন তার বান্ধবী পরির সঙ্গে। গাথা, সাগা তৈরি হবে কী করে যদি কল্পনা- বাস্তবে মিলে বিরাট জীবন,অপূর্ব বস্তুর বিদ্যমানতা না থাকে! রূপকথা এক বিশেষ মেজাজের সাহিত্য।যা কাম্য তা সেখানে অমূলক হলেও ধরা দেয়। সদয় হৃদয় ও নির্দয় হৃদয় যুগপৎ রূপকথার চরিত্র। লৌকিক ও অনিবার্য, অলৌকিক ও প্রার্থিতকে নিয়ে রূপকথার কাহিনীর ধরতাই।তবে শ্রেষ্ঠ অবশ্যই হৃদয়বান মানুষ, প্রায় সকল কালের সকল দেশের রূপকথার এটি বক্তব্য।আপামর মানবের তেমনটাই প্রার্থিত।
রূপকথা মুখে মুখে বলা হতো। পরে সেগুলি সংগৃহীত সংকলিত হয়েছে। শুধু তা শিশুভোলানো ছিল না। সমাজের দুষ্ট-শিষ্ট, ভাল-মন্দ সবরকম মানুষের জীবন-কাহিনী বলতে চেয়েছেন এই কথকরা। রাজা ও রাখালের বন্ধুত্বে রাখালের অর্ধাংশে যথেষ্ট গুরুত্ব আছে। নিজেরা দায়বদ্ধ থেকেছেন বাস্তবের কাছে, নিজেদের অভিজ্ঞতার প্রতি ঘোর অবিচার করেননি। অত্যন্ত বিবেচকের মতো, সততা, সাহস, বুদ্ধিমত্তার মূল্য দিয়েছেন, শিশুমনে যোগ্যতার পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টিকে একনিষ্ঠভাবে মুদ্রিত করে দিয়েছেন। যুগান্তরের পালটে যাওয়া প্রেক্ষাপটে এ-কারণে এগুলি একইরকম সপ্রতিভ টিঁকে থাকার দাবিতে আবির্ভূত হয়েছে।

রূপকথা আজকে শিশুদের জন্য আরও বহুবার লেখা হয়েছে। বদল ঘটেছে প্রচুর। সমাজনীতিই বরাবর এর নিয়ন্ত্রক।কালের দাবিতে আধুনিক লেখকরা রূপকথাকে পরিমার্জিত করেছেন। মুখের রূপকথার মোটা-দাগের একটা ধাঁচ ছিল, সেই স্থূলতাটি লেখার রূপকথায় ক্রমশ মার্জিত হয়ে উঠেছে। মুখের রূপকথার অথচ সজীবতা অতুলনীয়, যেমন রূপার গাছে সোনার ফল রঙের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো, তেমনই রূপ-তরাসী ভয় দেখায়-
“ও- মা! !” মাথা দেখিয়াই রাণী- নিজ মূর্তি ধারণ করিল-
“করম্ খাম্ গরম খাম্
মুড়্ মুড়িয়ে হাড্ডি খাম্!
হম্ ধম্ ধম্ চিতার আগুন
তবে বুকের জ্বালা যাম্! !”
আজকের রূপকথায় প্রচ্ছন্ন থেকেছে আজকের রাজনীতি, আজকের বিশেষ ভয়-ভীতির দুনিয়া। আজকের-কালকের সংকট।লুইস ক্যারলের ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’, স্যাঁত একজুপেরির ‘দি লিটল প্রিন্স’ –এর কথাও এপ্রসঙ্গে আসে।

অন্যভাবে দেখলে, রূপকথার বিশেষ এক শিল্পকৌশল ছিল। এই শিল্পকৌশল সরল হলেও সেইটি যে সকলে আয়ত্ত করতে পারতেন তা মনে হয় না, তার জন্য সাহিত্যকারের প্রয়োজন ছিল। এই রীতি কিন্তু পরীক্ষিত হয়েছে যতবার, ততবার সফলও হয়েছে।এককথায় একটি কালজয়ী শিল্পকৌশল। রবীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, উপেন্দ্রকিশোর এই রূপের রূপকথায় সিদ্ধ হয়েছিলেন।বিম্ববতীর মতো কবিতাও রবীন্দ্রনাথ লেখেন সরাসরি রূপকথা নিয়ে।
আধুনিক সাহিত্য এই আঙ্গিকের চমৎকারিত্বে মুগ্ধ হয়েছে, গ্রহণ করেছে বিবিধ সাহিত্যের প্রকরণে। সেক্সপিয়র তো বটেনই, আরও অনেক শিল্পি হয়তো সজ্ঞানে না থেকেও রূপকথার আদল অনুসরণ করেছেন। ত্রৈলোক্যনাথ; কখনও রাধারানী, সুবর্ণগোলকের বঙ্কিম; লীলা মজুমদার; সত্যজিৎ; শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, স্বকীয়ধারার চিন্তায় রূপকথার আঙ্গিক নির্বাচন ব্যবহার করেছেন,এমনকী বাদল সরকার রূপকথাকে অন্য পাত্রে এনে দিতে পেরেছেন। সলিল চৌধুরীর গানেও ‘রূপকথা নয় সে নয়’ বলতে গিয়ে নিষ্ঠুর সময়ের ঘাতে- প্রতিঘাতে রূপকথার মায়াকেই টানতে দেখেছি। শিল্পিপ্রতিভার কুশলতায় আমাদের জীবনের আধুনিক সমস্যাজর্জর প্রাত্যহিকের ভাঙা কাহিনিতে কতো সময় রূপকথার ক’য়েক রত্তি অনুপ্রবেশ জুড়ে দিয়েছে অনেককিছু, পরিপূর্ণ হয়েছে সাহিত্যের ডালা।🍁

 

 

🍁ধারাবাহিক উপন্যাস 
শুরু হচ্ছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

তেত্রিশ.

আমি অনেকক্ষণ ভাবতে থাকি এইসব ভাবনার বিষয়গুলি 

সে রাতে আর ভালো করে ঘুম এলো না। পিসার নাম ছিল খলিল খাঁ। আটপৌরে ছেঁড়াখোঁড়া জীবনে মাত্র ষাট বছর আয়ুতেই পার্থিব জীবন শেষ করলেন। আমাদের বাড়ি এলে আগে আমারই খোঁজ করতেন। স্কুল যাওয়ার কাল থেকেই গর্ববোধ করতেন। অভাবের সংসার বলে নিজের ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারেননি। তারা মাঠে-ঘাটে গরু বাছুর চরিয়ে এবং মাটি কাটার কাজ করে বড় হয়েছে। তবুও তেমন রোজগারপাতি করতে পারেনি তখনও।

আরেকটা দিনের ঘটনা খুব মনে পড়ে। সেটাও ছিল এরকমই বর্ষাকাল। খুব বৃষ্টি হয়নি ঠিকই কিন্তু পুকুর নালা বেয়ে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে। সেই দিনের বিকেলে বাবা বললেন চল খাঁপুকুরে দেখি কিছু মাছ পাওয়া যায় কিনা। ঘাড়ে একটা জাল নিয়ে আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা বেরিয়ে পড়লেন। পুকুরের ঘাটে বাইরে থেকে জল এসে প্রবেশ করছে। সেইখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাবা জালটা ফেললেন জলের স্রোতের ওপরেই। নিমেষের মধ্যেই একটা শোল মাছ জালে পড়ে গেল। পিতা-পুত্র মিলে দুজনেই সেদিন শোল মাছটি ঘরে এনেছিলাম।

 

এ অবস্থায় একটি সংসার প্রায় দুঃখে ভরে গেল। হয়তো আরো অভাব নেমে আসবে। সেসব কথা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগলো। একবার প্রচণ্ড বন্যার সময় আমার বাবাও এই পিসার বাড়িতেই বেশ কয়েকদিন ছিলেন। এখানে এসে পিসার সঙ্গে মাঠে মুনিষ খাটতেন। আমরা কার্যত গৃহবন্দী। বেশ কয়েকদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি বলে রাস্তাঘাট প্রায় ডুবে গেছিল। বাড়ি থেকে বের হওয়ার উপায় ছিল না। সেই সময় প্রায় সারাদিনই কাঁদতাম আমি। কারো বাড়িতে চেয়ে-চিনতেও কিছুই পাওয়া যেত না। সবাই প্রায় অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই প্রতিদিনই বাবার অপেক্ষা করতাম হয়তো তিনি আমাদের জন্য যাইহোক কিছু খাদ্যশস্য নিয়ে ফিরবেন। কিন্তু বাবার আজকে প্রায় পাঁচ দিন সময় অতিবাহিত হয়েগিয়েছিল। যে রাত্রে প্রথম এসেছিলেন তাও জলে ডুবে ভেসে। পুঁটুলিতে কেজি পাঁচেক চাল নিয়ে মাথায় করে ফিরছিলেন। কিন্তু সেই চালও রক্ষা পায়নি। জলে ভিজে সবই ভাতের মতো হয়ে গিয়েছিল। এতই জলে ভিজেছিল যে, বাবার সারা শরীরও জলে ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছিল। সেই চালই রান্না হয়েছিল। আমরা বেশ কয়েকদিন পর মাড়ভাত খেয়েছিলাম কেবলমাত্র নুন সহযোগে। এরপরে পিসা একদিন আমাদের বাড়ি এসে এই কথা স্মরণ করে খুব আফসোস করেছিলেন। কিন্তু কিছুই করার ছিল না, রাস্তাঘাটে তখন কোনো যানবাহনই চলাচল করেনি। নদীতে নৌকাও ছিল না। বাবা কী করে তা সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন ওই পাঁচ কেজি চাল নিয়ে তা খুব আশ্চর্যের ব্যাপার। এখনো স্পষ্ট মনে আছে। সারাদিন খুদকুড়ো কী খেয়েছিলাম মনে নেই। রাত্রেও ঘুম আসছিল না বলে কাঁদছিলাম। সেই সময় বাবা হুহু করে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ঢুকেছিলেন। বাড়ি এসে বলেছিলেন, “আমাকে একটু সেঁক দাও তো! পানিতে সারা শরীর অবশ হয়ে গেছে! হাতে পায়ে বশ নেই!” মা জানতে চেয়েছিলেন, “এই কদিন কোথায় ছিলে?”
“ওই যে খলিলের ঘরে ছিলাম! দুদিন মাত্র কাজ করেছি আর কাজে বেরোতে পারিনি! চারিদিক পানিতে ছয়লাপ হয়ে গেছে!”
“কোনো কিছু খাবার কি খেতে পেয়েছো?”
“না! কোথায় পাব খাবার? কারো বাড়িতেই রান্না হয়নি। শুকনো চাট্টি মুড়ি খেতে দিয়েছিল ওরা। তাতেই কেটে গেছে এই ক’য়দিন।”
মা তাড়াতাড়ি ভেজা চালগুলোই রান্নার জন্য চড়িয়ে দেয়। আমরা বহু রাত জেগে তাই খেয়ে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছিলাম।

আরেকটা দিনের ঘটনা খুব মনে পড়ে। সেটাও ছিল এরকমই বর্ষাকাল। খুব বৃষ্টি হয়নি ঠিকই কিন্তু পুকুর নালা বেয়ে জলস্রোত বয়ে যাচ্ছে। সেই দিনের বিকেলে বাবা বললেন চল খাঁপুকুরে দেখি কিছু মাছ পাওয়া যায় কিনা।
ঘাড়ে একটা জাল নিয়ে আর আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাবা বেরিয়ে পড়লেন। পুকুরের ঘাটে বাইরে থেকে জল এসে প্রবেশ করছে। সেইখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর বাবা জালটা ফেললেন জলের স্রোতের ওপরেই। নিমেষের মধ্যেই একটা শোল মাছ জালে পড়ে গেল। পিতা-পুত্র মিলে দুজনেই সেদিন শোল মাছটি ঘরে এনেছিলাম। সেদিন আমাদের কোনো ভাতের চাল ছিল না। শুধুমাত্র মাছ রান্না খেয়েই আমরা রাত কাটিয়েছিলাম। মাছটা বিক্রি করার জন্য চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন কারণ কেনার মতো কেউ ছিল না। শুধু মাছই আমাদের ভরসা হয়ে উঠেছিল। পিসা আমাদের বাড়ি এলে যত অভাবই থাকুক অন্তত আমার জন্য কিছু নিয়েই আসতেন। মল্লারপুরের রসগোল্লা অথবা জিলিপি তিনি ঠোঙায় ভরে আনতেন। তখন মাটির ভাঁড়েরও খুব চল ছিল। পিসার আসা দেখে আমরা ছুটে যেতাম। আর হাত থেকে প্রায় কেড়ে নিতাম সেই মিঠাইয়ের ঠোঙা। পিসা আদর করে কোলে তুলে নিতেন আর দুই গালে অনবরত চুমু খেতেন। বাড়ির বড় ছেলে বলে আমারই যেন অধিকার বেশি ছিল সবকিছুতেই। তাই পিসার মিষ্টিও আমি বেশি করে পেতাম। বাড়ি ফিরে যাবার দিনে ভিসা পকেট থেকে হাতড়ে দেখতেন খুচরা পয়সা আছে কিনা। থাকলে দশ-পনেরো-বিশ পয়সা কিংবা পঁচিশ পয়সা হাতে দিতেন। সেইটা পেয়ে যে কী আনন্দ হতো তা আজ লাখ লাখ টাকা পেয়েও অত আনন্দ পাই না। সেই পয়সাটা কখনো খরচ করতাম না। স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের দেখাতাম। একটা ছোট্ট কৌটোতে জমিয়ে রাখতাম। এমনি করে করে চার টাকা কী পাঁচ টাকা হলে স্বপ্ন দেখতাম ঈদ এলে একটা হাফপ্যান্ট কিংবা হাওয়াই শার্ট কিনবো। আমাদের ছোটবেলায় আরো একজনের ভীষণ স্নেহ পেয়েছিলাম তিনি আমার বড় মাসি। একটি মাত্র সন্তানকে নিয়ে বিধবা হয়ে গেছিলেন। অভাবের সংসারে বহু কষ্টে ছেলেটিকে বড় করেন তারপর বিয়ে থা হলেও অভাব কিছুতেই দূর হয় না। জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে মাসিকে তাই বনের পাতা কুড়িয়ে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। পেট চালানোর পরেও দু-চার পয়সা করে জমিয়ে রাখতেন। যখন আমাদের বাড়ি আসতেন তখন বিভিন্ন রকম ফলমূল এবং নতুন চালের পিঠে তৈরি করে নিয়ে আসতেন। আমার হাতেও দু-চার পয়সা দিয়ে যেতেন। সেই মাসিও আমার পিসার মৃত্যুর বহু আগেই মারা যান। একে একে সব আপনজনদের হারিয়ে আমি প্রায় নিঃস্ব হয়ে বসে ছিলাম। সবচেয়ে কষ্ট পেতাম ঈদের দিনগুলিতে যদি একটা নতুন কাপড় না কিনতে পারতাম। বাবা-মায়ের কাছে জেদ করেও যদি কোনো ফল না হতো, তাহলে দরজা বন্ধ করে ঘরের মধ্যে কান্নাকাটি করতাম। দুই চোখ ফুলে যেত কেঁদে কেঁদে। বলতাম, “আমি যাব না ঈদের ময়দানে! আমার ভালো হাফপ্যান্ট নাই, জামা নাই, কী পরে যাব আমি?” তখন মা পুরনো হাফ প্যান্টের ছিঁড়ে যাওয়া পেছন দিকটায় অন্য কোনো কাপড় দিয়ে সেলাই করে দিতেন। বড্ড বেমানান লাগতো, তবুও তাই পরতে হতো। বাবা হাত ধরে নিয়ে যেতেন ঈদের ময়দানে। তারপর একধারে বসিয়ে দিতেন।
কবরস্থান সংলগ্ন সেই ঈদের ময়দানটি এখনো আছে। আমি ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে গিয়ে যেখানে বসতাম সেই জায়গাটি এখনো ভুলতে পারিনি। তারপর একে একে কত আপনজনেরা সেই কবরস্থানে চলে গেছেন। মাটির সঙ্গে তাদের কবর বিলীন হয়ে গেছে। ছোটবেলায় সেই ময়দানেই ঈদের নামাজ শেষ হলে দুই হাত তুলে দোয়া করতাম। যারা আমাদের আপনজন চলে গেছেন তাদের মাগফেরাত কামনা করতাম। ইসলাম ধর্মে পরকাল সম্পর্কে গভীর বিশ্বাস রাখতে হয়। ছোটবেলা থেকেই আমার সেই বিশ্বাস জন্মে। বাবা শিখিয়ে দিয়েছিলেন, পার্থিব জীবনে মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে ঠকানো যাবে না। কারো সঙ্গে প্রতারণা করা ভীষণ পাপের কাজ। আবার মিথ্যা কথা বলাও যাবে না। আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে সর্বদা সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। ঈদের দিন বড়দের সালাম করতে হবে। বাবা বলে দিয়েছিলেন মানুষের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে পরকালে তার হিসেব দিতে হবে এবং শাস্তি ভোগ করতে হবে। ছোট থেকেই তাই আমি খুব সচেতন ছিলাম। আমার সহ্যগুণও অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। পুরনো কাপড় চোপড় যত বেমানানই হোক তাকে ঘৃণা করতাম না। রাগ দুঃখ অভিমান সবকিছুকে জয় করতেই আমাকে লড়াই করতে হতো বাবার নির্দেশ মতো।
যত কষ্টই থাকুক ঈদের দিন কিন্তু ছিল অনেক সুখের দিন। গ্রামের ছোট বড় সবাই মিলে ঈদের চাঁদ দেখে আনন্দ পেতাম। একসঙ্গে ময়দানে উপস্থিত হয়েও সকলের সঙ্গে মিলেমিশে শুভেচ্ছা বার্তা বিনিময় করে মনের মধ্যে একটা সাম্য ভাব জেগে উঠতো। বাড়ি এসে দেখতাম আমাদের রান্না-বান্না না হলেও পাড়া-প্রতিবেশীরা অনেকেই ক্ষীর-সেমাই আমাদের দিয়ে গেছেন। কারো কারো বাড়িতে মাংস রান্না হয়েছে তাও দিয়ে গেছেন। কেউ আবার পোলাও দিয়েছেন। বছরের এই একটা দিন তাই মন ভরিয়ে দিত। গ্রামের সকলেই যেন একটা পরিবারের মতো। বিকেলের দিকে সবাই মিলে ফুটবল ম্যাচ খেলতাম। একটা বড়দের দল, একটা ছোটদের। আজকের দিনে আর সেসব নেই। আজও সেই ঈদ আসে কিন্তু সেই সমতা ভাব এবং আনন্দ সঙ্গে আনে না। কেমন যেন এক উদ্ধত অহংকারী সব পাড়া-প্রতিবেশী। ঈদের ময়দানে ঘাসের উপর বসে আর নামাজ পড়ারও চল নেই। এখন মাদুর বা কার্পেট পেতেই নামাজ পড়ে। সাজ-পোশাকেও কেতাদুরস্ত।
ময়দানের সেই প্রান্ত থেকে ফিরতে ফিরতে মনে হয় আমার বাবা আমার হাতটি ধরে আছেন। আমি বাবার কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি ভিড় কমে গেলে তবেই আমি ফিরবো। আনমনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে কখন দেখি সবাই চলে গেছে, ময়দানে আমিই শুধু একা। নিজের মনেই ডাকি, “বাবা তুমি এখনো রয়েছো আমার কাছে?”
অদৃশ্য কোনো কথন প্রবাহ যেন ভেসে আসে, “হ্যাঁ, আমি আছি তো! সর্বদা আমি তোর সঙ্গেই আছি! পার্থিব শরীর খুব সীমিত, কিন্তু অনন্ত শরীর বহু বিস্তৃত! চারিপাশে চেয়ে দ্যাখ, তোর সব আপনজনেরা এখানেই রয়েছে! বাতাসে তাদের দীর্ঘশ্বাস মিশে আছে। মাটিতে তাদের শরীর মিশে আছে। আকাশে তাদের বাস্প মিশে আছে। তোর ভাবনার মধ্যেই তাদের ভাবনাও মিশে আছে।”
আমি অনেকক্ষণ ভাবতে থাকি এইসব ভাবনার বিষয়গুলি। তারপর আমার পিতামহ-পিতামহী, বাবা-মা-ভাই, কাকা-কাকি-পিসি সবার কবরের দিকেই এগিয়ে যাই। দুই হাত তুলে বলতে থাকি— হে পরম দয়ালু করুণাময়, তুমি আমার সকল আত্মীয়-স্বজনকে পরকালের সমস্ত কষ্ট থেকে মুক্তি দাও। তাদের জীবনের ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয়ই আমিও একদিন তাদের পাশেই শায়িত হবো। নিশ্চয়ই একদিন আমিও তোমার সম্মুখীন হবো। সেই দিনের সেই ভয়াবহ শাস্তি থেকে আমাকেও রেহাই দাও।
বলতে বলতেই কখন অনেক বেলা হয়ে গেছে টের পাইনি। বাইরে খুলে রাখা চপ্পল জোড়া পায়ে গলিয়ে দ্রুত হাঁটতে থাকি বাড়ির দিকে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ আমার দেরি দেখে বাড়ির লোক উতলা হয়ে গেছে।🍁(চলবে)

 

🍂বিতা 

 

সোমনাথ আচার্য-এর একটি কবিতা

হৃদয়ের ভিতর একটি কাঠবিড়ালি

একটি শব্দ নড়ে ওঠে হাতের তালুতে,
তাকে ছুঁয়ে দেখি সে তো গাছের প্রাণ।
মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে দেখি,
আমার বুকের ভিতর ছোটে এক কাঠবিড়ালি
যার চোখে প্রতিফলিত হয় শীতকালীন বিস্ময়।
সে লুকিয়ে রাখে আমার ভাবনা,
পাতার নিচে, কড়ির পাশে।
জীবন যেন তারই মত
ছুটে বেড়ায়, তবু থেকে যায় একটাই বৃন্তে
শব্দহীন, শান্ত, রুদ্ধ বিস্ময়ে।

 

সিদ্ধার্থ রায়-এর একটি কবিতা 


তবুও দিয়ে যাব

যখন হারিয়ে যাব হেমন্তের নরম হাওয়ায়
রেখে যাব তবু তোমার জন্য কিছু স্পর্শিত শব্দ
পাতার ঘ্রাণে মিশে থাকবে অনুচ্চারিত স্নেহ
ফুলের গন্ধে লুকিয়ে থাকবে আমার চেনা হাসি
তুমি সন্ধ্যার ছায়ায় খুঁজে ফিরবে এক ম্লান মুখ
আমি থাকবো আকাশের নীল নিঃশ্বাসে গাঢ়
রাতের শিশিরে পড়বে আমার নিঃশব্দ নাম
পদে পদে ছড়িয়ে থাকবে ভালবাসার কাঁকর…

 

 

মমতা রায়চৌধুরী-এর একটি কবিতা

তোমার যন্ত্রণাগুলো আমাকে দাও

তোমার যত যন্ত্রণা আছে আমায় দাও
তোমার বিষণ্ণতাগুলো আমায় দাও
আমি নীরবে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়ে বিষণ্ণতায়
আবার ফিরে পাব তোমার ভালবাসা
শ্রাবণের বৃষ্টির ধারাপাত মাখব
যেমন প্রথম মেখেছিলাম উষ্ণ ঠোঁটে
তোমার ভালবাসা।

তোমার যন্ত্রণাগুলো আমায় দাও
এক সমুদ্র ভালবাসা উপহার দেব
শুধু বিশ্বাস কর আর দু’টো হাত রাখ
তোমার প্রসন্ন চাউনি আর মৃদু হাসি
ঝরে পড়ুক আমার বুকের উপর
কামরাঙ্গা পড়ন্ত বিকেলের ঘাসে।

তুমি আমি পাশাপাশি বসে
যন্ত্রণাগুলো ভাগ করে নেব
আমার বুকের পাঁজরে
শুধু বিশ্বাস রাখ পৃথিবীতে বিবাদ বিষণ্ণতা আছে
তাই বলে কি প্রেম মরে যাবে ভালবাসা ঝরে যাবে
একবার বিশ্বাস করে তোমার যন্ত্রণাগুলো–
আমাকে বইবার জন্য দাও

 

 

মধুসূদন পাল-এর একটি কবিতা


ঝরে পড়ে সময়

কোনও এক ভোরে আলো আসেনি ঠিকঠাক,
রেখে গেছে কেবল ছায়ার নকশা।
একটি ঘুমন্ত পাখির ঠোঁটে
বুনে দেওয়া হয় কিছু অপূর্ণ উচ্চারণ।
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একা মানুষটি
নিজের ছায়ায় মেপে নেয় ব্যথার দৈর্ঘ্য।
সে জানে, প্রতিটি পদক্ষেপেই
সময় ফসকে পড়ে গর্ভজলে।
তার দিকে তাকালেই বোঝা যায়
ভোর কাকে বলে।

 

 

জাহ্নবী সেন-এর একটি কবিতা

কান্নার রঙের ভাষা

একটি পাথর সারাদিন রোদে পড়ে থাকে
আর রাত্রে শোনে এক মধুর ক্রন্দন
কে যেন গর্তে পুঁতে রেখেছে কাগজের চিঠি
যার অক্ষরে শুকিয়ে গেছে জল
পায়ের নিচে কাঁদে নিঃশব্দ রাস্তা
সে জানে, কেউ ফিরে আসবে না
তবুও গন্ধ ভেসে আসে দূর থেকে
যা মৃত মানুষের নাভিমূল থেকে উথলে ওঠে
এত অল্প আলোয়ও
মাটি শিখে নেয় প্রার্থনার ব্যাকরণ

 

 

🍂গল্প

 

দু’জন মিলে হেঁটে বেড়ায় কলেজ স্ট্রিটের ভেজা রাস্তা দিয়ে। বইয়ের দোকানের ওপর ছাউনি থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে। কোথাও বৃষ্টির মধ্যে ছাত্ররা বই লুকিয়ে দৌড়চ্ছে, আবার কোথাও এক জোড়া হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে মোড়ে।

 

সে বৃষ্টি ও সেই তুমি

শংকর মুখোপাধ্যায়

জুলাই মাস। কলকাতা শহরের আকাশ যেন সারাদিনই অশান্ত প্রেমিকার মত, একবার হেসে ওঠে, আবার হঠাৎ ফুঁপিয়ে কাঁদে। সকাল থেকে মেঘের দল লাট্টুর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল আকাশে। হাওড়া ব্রীজের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় এমনই এক সাদা-ধূসর মেঘ ঠিক মাথার ওপর এসে জমে ছিল, আর সেই মেঘ থেকে হঠাৎ করেই ঝরে পড়ল বৃষ্টি।
নন্দিতা তখন ট্রামে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ধরেছে, গন্তব্য গড়িয়াহাট। বৃষ্টি দেখে সে জানলার ধারে বসে ছিল। হঠাৎ একটু থতমত খেয়ে গেল। কিন্তু বৃষ্টি মানেই তার অন্য এক ভালবাসা। ছাতা খুলে হাঁটতে ভাল লাগে না তার। পা ভিজিয়ে, চুল এলোমেলো করে, এই ভেজা শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে একা একা ভাবতে ভালবাসে সে।
ট্রামটা গন্তব্যের মোড়ে এসে দাঁড়াতেই সে নেমে গেল। হঠাৎ কি মনে হল, গড়িয়াহাট না গিয়েই ঘুরে ফিরে যাবে কলেজ স্ট্রিট। বৃষ্টির জন্য ঠিক এদিকটায় একটা পুরনো ক্যাফে ছিল ‘বুক বাইন্ডার’স কফি’ একটা ধূসর দোতলা বাড়ি, যার ভেতরটা যেন সময়ের চেয়েও পুরনো।
এই ক্যাফেটাই ছিল নন্দিতার আর অর্কর প্রথম দেখা হওয়ার জায়গা। তখন তারা দু’জনেই প্রেসিডেন্সিতে পড়ে। অর্ক দর্শন, আর নন্দিতা ইংরেজি সাহিত্য। প্রথমদিকে একে অপরকে চিনতই না। বইয়ের খোঁজ করতে করতে একদিন ক্যাফেটায় ঢুকে এক টেবিলে বসে পড়েছিল দু’জনেই। পাশে রাখা অর্কর বই দেখে নন্দিতা হেসে বলেছিল,
–Spinoza পড়ছেন! মনখারাপ নাকি প্রেমে পড়েছেন?
অর্ক চমকে তাকিয়েছিল, তারপর হেসে বলেছিল,
—দু’টো তো প্রায় একই জিনিস, তাই না?
সেই হাসি, সেই কথার রেশ ধীরে ধীরে জমে উঠেছিল অন্যরকম এক সম্পর্কের ভিত। তারা প্রায়ই দেখা করত এই ক্যাফেটায়। কখনও কফির কাপ ঠোঁটে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তর্ক, কখনও বা চুপচাপ তাকিয়ে থাকা জানলার বৃষ্টিতে ভেজা রাস্তাটার দিকে।
তবে সেই দিনগুলো এখন অতীত।
**
নন্দিতা আজ হঠাৎ ফের ফিরে এসেছে সেই ক্যাফেটায়। কী এক অদ্ভুত টানেই যেন এসেছে। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা গেল, সব কিছু একই আছে। একই কাঠের গন্ধ, টেবিলের দাগ, দেয়ালে ঝুলন্ত পুরনো সিনেমার পোস্টার, এমনকি মেঝেতে জমে থাকা জল নিয়ে কেয়ারটেকার জালু কাকুর বিরক্ত মুখও।
সে জানলার ধারে গিয়ে বসে। বাইরে তখন অঝোর বৃষ্টি, এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই…
—এক্সকিউজ মি, এখানে বসা যাবে?
নন্দিতা তাকিয়ে দেখে, সামনে দাঁড়িয়ে আছে অর্ক। চুলগুলো আগের মতই কোঁকড়ানো, কিন্তু এখন সামান্য পাক ধরেছে। চোখ দু’টো একটু ক্লান্ত, কিন্তু সেখানে সেই চেনা উষ্ণতা এখনও রয়ে গেছে।
—তুমি? তুমি এখানে?
—তুমি…?
নির্বাক হয়ে দু’জনেই বসে পড়ে। যেন শব্দগুলো হঠাৎ করেই হারিয়ে গিয়েছে এই বৃষ্টির শব্দে। কফির অর্ডার আসে। নন্দিতা চুমুক দেয়, আর ভাবে, এই কফির গন্ধটাই বোধহয় তাদের আবার কাছে নিয়ে এল।

**
—এখনও কবিতা লেখ?
অর্ক একটু চমকে যায়।
—না… এখন শুধু রিপোর্ট লিখি, আর মাসিক মিটিংয়ে গলা ফাটাই।
—আর প্রেম?
—সেটাও তো মাসিক মিটিং-এর মতই… স্লাইড দেখিয়ে বোঝাতে হয়।
নন্দিতা হেসে ওঠে। অনেক বছর পর এমন খোলা হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেয় যেন।
—তুমি এখনও তেমনই বোকা রয়ে গেছ অর্ক।

তারা ধীরে ধীরে কথা বলে। শোনা যায় পুরনো অভিমান, না বলা কথাগুলো।
—সেই সময়টা… মানে, যেদিন তুমি মেসে ফিরে গেলে না… আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
—আমি জানি, কিন্তু তখন আমার ভেতরে খুব বড় একটা ভাঙন চলছিল। বাবার মৃত্যু, চাকরির চাপ, তোমার অসীম নির্ভরতা… আমি হঠাৎ হাঁপিয়ে উঠেছিলাম।
—তুমি যদি বলতে?
—তোমার চোখ দু’টো এত বড় প্রত্যাশা নিয়ে তাকাত, আমি ভয় পেতাম তোমাকে ব্যথা দিতে।

বৃষ্টি তখন জানলার কাঁচ ভিজিয়ে চলেছে। বাইরে ছাতা খুলে মানুষগুলো দৌড়চ্ছে, আর এই টেবিলের ওপরে দু’টো হাত ধীরে ধীরে কাছাকাছি চলে আসছে।

**
—তুমি কি এখন একা?
—হ্যাঁ, মানে বিয়ে করিনি। কিছু সম্পর্ক এসেছিল, কিন্তু কেউ তোমার মত মনের গভীরে পৌঁছতে পারেনি।
—আর তুমি?
—একবার করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় ডিভোর্স। বুঝলাম, ভালবাসা একবারই আসে। পরে সব শুধু মানিয়ে নেওয়া।
কথাগুলো যেন অনেকদিন বুকের ভিতর জমে ছিল। আজ বৃষ্টির দিনে ওরা বেরিয়ে এল।
অর্ক হঠাৎ বলে,
—চল আজ একটু হেঁটে আসি?
নন্দিতা একটু ইতস্তত করে। তারপর বলল,
—চলো। ছাতা নেই কিন্তু।
—তাতেই তো মজা। আবার ভিজে যাই সেই কলেজের মত!

**
দু’জন মিলে হেঁটে বেড়ায় কলেজ স্ট্রিটের ভেজা রাস্তা দিয়ে। বইয়ের দোকানের ওপর ছাউনি থেকে টুপটাপ করে জল পড়ছে। কোথাও বৃষ্টির মধ্যে ছাত্ররা বই লুকিয়ে দৌড়চ্ছে, আবার কোথাও এক জোড়া হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে আছে মোড়ে।
—তুমি জানো? আমি এখনও রোজ একবার করে এই রাস্তায় হাঁটি। মনে করি, তুমি হঠাৎ সামনে এসে পড়বে।
—তোমার মতো করে আমিও অপেক্ষা করতাম।
হাঁটতে হাঁটতে দু’জন পৌঁছায় কলেজ স্কোয়ারের ধারে। বৃষ্টি এখন একটু কমেছে। ছোট ছোট জলকণা আকাশে লুকোচুরি খেলছে।
নন্দিতা হঠাৎ থেমে বলে,
—তুমি কি আবার… মানে, শুরু করতে চাও?
অর্ক চুপ করে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে,
—আমরা তো কখনও শেষ করিনি, নন্দিতা। আমরা শুধু বিরতি নিয়েছিলাম। এবার বর্ষার জল ধুয়ে নিয়ে যাক সেই বিরতির ধুলো।🍁

 

 

 

🍂অণুগল্প 

 

আমার এখন বয়স কত বুঝতে পারছি না! সামনে এগোবটা কী করে? বরং, আস্তে আস্তে নিচু হই। হামাগুড়ি দিই। একী রে ভাই, এয়্যাঁ! ন্যায্যই যে নিজেকে বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে যেন! নুনকুটা…! আরে ছিঃ ছিঃ। নুনকুর কাছে একটা মালার মত কী ঝুলছে?

 

পাথুরে অন্ধকার

স্বপন দত্ত

 

 

কী ভয়ঙ্কর! চোখে কোন ব্রহ্মাণ্ড এসে ঢুকে গেল। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি নে। আহ! সমস্তটা কুয়াশায় ছেয়ে যাচ্ছে।
অন্ধকার।

ও-দিতে পারবে? সত্যি করে কী রাধা হয়ে, দুধ দেবে? গোপালের রাধা। কৃষ্ণের রাধা নয়। গোপালের রাধা।একটু…একটু ক্ষীর, ননী… নাকি চাকরি?

একটা পাথুরে অন্ধকারের মধ্যে হাঁটতে আর সাহস হচ্ছে না। কোনওকালে আমার দেখতে পাওয়া ছিল কী? এখন আর মনে করতে পারছি নে! কত আলোকবর্ষ পরে এই জায়গায় পৌঁছেছি, জানি না। কিন্তু হাঁটছিলাম তো! কার সঙ্গে? সঙ্গে কে ছিল?
তাঁর নাম কী ছিল? নীরবতা? আরে ধ্যাৎ, নীরবতা কারুর নাম হয়? তাহলে? আচ্ছা, আমি কী করে এখানে এলাম? আমার এখন বয়স কত বুঝতে পারছি না! সামনে এগোবটা কী করে? বরং, আস্তে আস্তে নিচু হই। হামাগুড়ি দিই। একী রে ভাই, এয়্যাঁ! ন্যায্যই যে নিজেকে বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছে যেন! নুনকুটা…! আরে ছিঃ ছিঃ। নুনকুর কাছে একটা মালার মত কী ঝুলছে? এতো… এতো গোপালের পরনে থাকে। যাব্বাবা আমিই কি গোপাল গোপাল হয়ে গেলাম? তাহলে ননী চুরি করব।
ননী কোথায়?
ক্ষীর কোথায়? ক্ষীর। শালা। আজ এগারো সাল থেকে খুঁজছি। খুঁজছি…খুঁজছি…খুঁজছি…। কত ঘষতে ঘষতে পাথর লোকা ছেঁচে ছেঁচে তবে বেকার জীবন কাটাল না। বাড়িতে মুখ দেখাতে পারি না। কবেই ছেড়ে চলে গেছে, তারও কাজ ছিল না। কিন্তু সে তো মেয়ে! বোধহয় কিছু করে। আজ যদি আসে। তাহলে তো আমি ওঁর কোলে চড়ব। ও-আমায় দুদু…! ও-দিতে পারবে? সত্যি করে কী রাধা হয়ে, দুধ দেবে? গোপালের রাধা। কৃষ্ণের রাধা নয়। গোপালের রাধা।একটু…একটু ক্ষীর, ননী… নাকি চাকরি? কি… জানি না। নাকি চোখ? কি জানি না। এই পাথর। এই অন্ধকার…🍁

 

 

 

🍂ধারাবাহিক রহস্য পন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।

কিশানগঞ্জের ফেলুদা

তাপস রায় 

 

পর্ব : আট.
খানিকটা অপরাধীর মতো মুখ করে চায়ের গ্লাসে নজর চালিয়ে চুমুক দিতে দিতে বোঁদে ভাবল, ঠিক কথা। এরা খুব যে একটা ভেবে টেবে হিংসা করে তা না। মনে পড়ল, টিভিতে দেখেছিল, দার্জিলিং-এ ম্যাল-এর মতো জনবহুল জায়গায় মদন তামাং বলে এক নেতা পড়ে আছে। তার গলা থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। পরে জেনেছিল, তার পরিচিত লোকেরাই কুঁকরি ঝেড়েছে। কাগজে বের হল কীসব মুক্তি মোর্চার নেতা গুরুঙ্গের নাম।
বোঁদে অনেকটা গভীর হয়েছে। পঙ্কজ থাপা বলেছে,” বেশি জানাজানি কোরো না বন্ধু। এদের হাত তো অনেক লম্বা, আমারও বিপদ হতে পারে। তবে তুমি জেনে রাখো কুকুর আমি তার মালিকের কাছে ফেরাবই। কুকুরের কষ্ট আমি সহ্য করতে পারি না।”
বোঁদের সহ্য হচ্ছিল না যে। গুরুর কষ্ট সত্যি প্রাণে ধাক্কা দিয়েছে। ফেলুদার সাথে অনেকদিন থেকে আছে। সে যেটুকু যা দাঁড়িয়েছে তা ফেলুদার জন্য। ফেলুদা সেদিন আক্ষেপ করছিল, “হেরে গেলামরে। পঞ্চায়েতের টিকিটটা মনে হয় দেবে না। ওই চাঁদ মিঞাকেই টিকিট দেবে। ভেবেছিলাম,পঞ্চায়েতের কাজ করার যদি সুযোগ পাই আমার সামর্থ আর ভালবাসা দিয়ে গরিব মানুষদের জন্য কিছু একটা করব। কিন্তু দু’দুটো গায়েব। আর তার কিছুই হদিশ হচ্ছে না। আমার গায়ে ফেলের দুর্নাম সেঁটে দেবার জন্য তো ওঁত পেতে বসে আছে ওরা। এতদিন পাইনি, আর পাব না। মনে হয় কুকুরটাকে মেরে ফেলেছে এতদিনে। ওই ধর্মনগরের মিশ্রাজীর গোষ্ঠী। ওরা চায় চাঁদ মিঞা যেন টিকিট পায়। তাহলে কিশানগঞ্জের পঞ্চায়েতের ট্রান্সপোর্টের কন্ট্রাক্ট সব হাতাতে পারবে। মনে হয় ওরাই কুকুরটাকে সরিয়ে দিয়েছে। মরে না গেলে এতোদিনে ঠিক হদিশ করে ফেলতাম রে!”
সে যে একটা আশার আলো দেখেছে, তা বলতেও পারছে না গুরুকে। পঙ্কজ থাপার নির্দেশ। পঙ্কজের নির্দেশ মতো বোঁদে বনবিহারী লোকটা আসলে কে তা জানতে চায়। মানে সে কালিম্পং-এর ম্যাডাম কর্মার বর না অন্য কেউ তা স্পষ্ট হতে চায়।
এখানে গুরুকে দরকার। সে ফেলুদাকে অল্প অল্প করে শুধু সন্দেহের কথা বলেছে। পঙ্কজ থাপার কোনও গল্প বলেনি। তবে এটা কায়দা করে বলেছে যে বনবিহারী পান্ডের কাছেই কুকুরের হদিস আছে। তাকে একটু নজরে রাখলে বেরিয়ে পড়বে সব।

 

থার্ড রানিং বিলের টাকাটা এসে গেছে পাটনা থেকে। মালবাবুকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে বনবিহারী বলল, “শুনেছ, মুখ্যমন্ত্রী না কি খুব খুশি হয়েছেন, সময়ের আগেই কাজ শেষ হওয়ায়। তিনি কিশানগঞ্জের সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।” সবজির ব্যাগে ভর্তি করে সব দু’হাজার টাকার নোট ঘরের ভেতর নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে বনবিহারী। টাকা নেবার সময়-ই বলা ছিল ক্যাশে ফেরত দিতে হবে।

ফেলুদা তেমন আশ্বস্ত না হলেও বোঁদের কথা কোনওকালেই ফেলেন না। বনবিহারী গান্ধীচকে থাকেন। নানা রকমের কারবার তাঁর। কখনও রেডিমেড গার্মেন্টস-এর সাপ্লাই করেন। কখনও রোড সারান। তার মাল্টিপার্পাস কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন। হেড অফিস গান্ধীচক, কিশানগঞ্জ।
কিশানগঞ্জের টেলিফোনের টিডিএম সাহেবকে বনবিহারীর ল্যান্ডলাইন নাম্বার ০৬৪৫৬-২২৩১২০ আর মোবাইল নাম্বার ৯৭৭৫৯৫৫৪৮৩ দিয়ে গত তিন মাসের কল লিস্টটা যদি পাওয়া যায়, বলে রিকোয়েস্ট করলেন ফেলুদা। টিডিএম অখিলেশ সাহেব ফেলুদাকে খুব পছন্দ করেন। তিনি বলেছেন, “দো-দিন রুক জাইয়ে, মিল যায়েগা। প্রিয়রঞ্জন ছুট্টিমে হ্যায়। উনকো আনে দিজিয়ে।”
বোঁদে সকাল সকাল বাড়ির ছাদে বড় এক মাগ লাল চা, আতশ কাচ আর কল লিস্ট নিয়ে বসেছে। ফেলুদা কললিস্ট বাছাই করার কাজ দিয়েছেন। বোঁদে সঙ্গে নিয়েছে স্বপনকুমারের একটা বই, একটা ডায়েরি আর কলম। ওর যা যা খটকা মনে হচ্ছে, ডেট অনুযায়ী সাজিয়ে রাখছে।
দীপক চ্যাটার্জীর অ্যাসিস্টান্ট রতনলাল তো এরকমই করত! কোথায় কী নতুন দেখা-দেখি হচ্ছে লিখে রাখছে বোঁদে। কালিম্পং-এর ঘটনা তো বলতে পারেনি ফেলুদাকে। যদি বোঁদে ধরতে না পারে কালপ্রিট, এই ডায়েরি তুলে দেবে ফেলুদাকে। সে নিশ্চই পারবে।
ছাদ থেকে দেখা যায় নতুন ফ্লাইওভারটা প্রায় হয়ে এসেছে। বোঁদে জানে মুখ্যমন্ত্রী এসে উদবোধন করবেন। পঞ্চায়েতের ভোটের আগেই শেষ করা গিয়েছে, তিনি ব্যাপারটায় বেজায় খুশি। শুধু এ অঞ্চলে নয়, অন্যান্য জায়গাতেও এই ফ্লাইওভারের কাজ দেখিয়ে উন্নয়নের কথা বলে ভোট নেওয়া সহজ হবে। পঞ্চায়েত ভোট আসতে আর মাসখানেক দেরী।
উদ্‌বোধনের জন্য ফ্লাইওভার সাজানোর তোড়জোর চলছে। ডেকরেশনের কাজ বোঁদের। লোকাল সাইট থেকে ভাঙাচোরা আর আর মালপত্র সরানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। জায়গাটা সাফ-সুতরো হয়ে গেলে গোটা ফ্লাইওভারে রঙের কাজ শেষ করবে বনবিহারী পাণ্ডের দল। এই ফ্লাইওভারের সাব কন্টাক্ট বনবিহারীর। ক’দিন আগে বোঁদে শুনেছে এই কাজে প্রায় পঞ্চাশ লাখ টাকা ইনভেস্ট করেছে মালবাবু। কিন্তু মালবাবু এত টাকা পান কোথা থেকে!
বনবিহারীর ল্যান্ডলাইনের কললিস্ট ঘেঁটে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। ফোন কল খুবই কম। কিন্তু তিন চারটে নাম্বারেই মাঝে মাঝে কথা হয়েছে। বোঁদে ডায়েরিতে লিখে রাখল কোন কোন ডেটে বেশিক্ষণ কথা হয়েছে, আর তার নম্বর। পুরো লিস্ট চেক করে দেখল দুপুরের দিকেই কথা হয়। আর তা ০৩৫৫২-২৫৪৪৩৫, কালিম্পং-এর নাম্বারে। একটা দু’টো কল, বোঁদে তেমন মাথা ঘামাল না।
ল্যান্ড লাইন শেষ করে মোবাইল ফোনের কললিস্ট ঘাঁটতে গিয়ে দেখল সেখানেও খুবই কম কল হয়েছে গত এক মাসে। একটা কল হয় দুপুর সাড়ে বারোটায়। ফোন যায় কালিম্পং-এর ০৩৫৫২-২৫৪৪৩৫ নম্বরে। আর দু’দিন ভোরের দিকে কিশানগঞ্জেরই কোনও সিম-এ।
বোঁদে হঠাৎ যেন দুঁদে গোয়েন্দা হয়ে গিয়েছে। সে দেখল ল্যান্ড লাইন আর মোবাইল থেকে বনবিহারীর কলগুলির ভেতর এই দু’টি নম্বর কমন। বোঁদে কি মনে করে নিজের ট্যাগ কাজে লাগাতে চাইল। দিলীপ সিংকে ফোন করল। দিলীপ কিশানগঞ্জ টেলিফোন অফিস-এ ফ্রাণচাইজির লোক। দিনের বেলায় অফিসের ফাইফরমাস খাটে। রাতে এক্সচেঞ্জে থাকে। এখনই বনবিহারীর ফোন করার সময়। কাকে ফোন করছে, সে কোথায় আছে তা মোবাইল টাওয়ার দিয়ে আইডেন্টিফাই করা যায়।

দিলীপ জানাল মোবাইলে যার সঙ্গে কথা বলছেন বনবিহারী বাবু তার সিম কিশাণগঞ্জের হলেও কথা হচ্ছে কালিম্পং-এ। মানে বিহারের সিম বাংলায় ব্যবহার হচ্ছে। আশ্চর্য!
“দিলীপ তালে তুই দেখ কালিম্পং-এ যে নাম্বার ব্যাবহার হচ্ছে তার কল লিস্ট।”
দিলীপ এক ঘন্টার ভেতর জানিয়ে দিল ঐ নম্বার থেকে সব থেকে বেশি নেট চলেছে সপ্তাহে একটি বিশেষ দিনে শেষ রাতে। সেটাও হয় অন্য একটি কিশানগঞ্জ মানে বিহারের নাম্বারে। কালিম্পং-এ বসে কেন তবে বিহারের সিম! সেই কলটা হচ্ছে কালিম্পংয়েই। বোঁদে এই কলটার সময় আর তারিখ ডায়েরীতে নোট করল। সে উত্তেজিত। এক্ষুনি কি বন্ধু পঙ্কজকে ফোন করে জানিয়ে দেবে নম্বরটি! না আলোচনা করবে ফেলুদার সাথে! তালে কি পঙ্কজ থাপার কথাই সত্যি! রহস্য কি লুকিয়ে আছে কালিম্পংয়ের রিসর্টে!

**

থার্ড রানিং বিলের টাকাটা এসে গেছে পাটনা থেকে। মালবাবুকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে বনবিহারী বলল, “শুনেছ, মুখ্যমন্ত্রী না কি খুব খুশি হয়েছেন, সময়ের আগেই কাজ শেষ হওয়ায়। তিনি কিশানগঞ্জের সবাইকে ধন্যবাদ দিয়েছেন।” সবজির ব্যাগে ভর্তি করে সব দু’হাজার টাকার নোট ঘরের ভেতর নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে বনবিহারী। টাকা নেবার সময়-ই বলা ছিল ক্যাশে ফেরত দিতে হবে।
“সে তো বুঝলুম বনবিহারী, পালংশাকের আঁটির নিচে পঞ্চাশ লাখই এনেছ। কিন্তু পঞ্চাশ নামিয়ে যদি পঁচাত্তর ঘরে না আসে তবে নামানোই বা কেন!” মালবাবুর গলায় হতাশা।
খুব আন্তরিক গলায় বনবিহারী বলেন, “আরে হ্যাঁ হ্যাঁ, সেসব পেয়ে যাবে। এখনও তো ফাইনাল বিল পাইনি। পি ডব্লিউ ডি আগে কমপ্লিশন রিপোর্ট দিক, তবে তো ওরা ছাড়বে! আমিও ঘরে লাভ তুলিনি এখনও। সবার কাছ থেকে নেয়া মূল টাকা শোধ করছি। শেষ টাকাটা এলে সবার লাভ আমি দিয়ে দেব। তুমি তো জানো আমি কারও টাকা মারি না।”
তা ঠিক। মালবাবু জানেন, অনেক বছর হয়ে গেল, বনবিহারীর সঙ্গে গোপন কারবার করছেন সরকারী চাকরি বাঁচিয়ে। বনবিহারী ঠিক সময় মত সুদে মূলে টাকা ফেরৎ দিয়েছে। মালবাবু কথা ঘোরাতে চাইলেন। এই যে লাভের অংশ চেয়ে বসে তিনি খানিকটা অপ্রতিভ হয়েছেন। সেখান থেকে ফিরতে বললেন, “এই যে টাকা ফিরে এল, কিন্তু আমার গঙ্গারাম কতদিন হয়ে গেল এখনও ঘরে ফিরল না।”
গঙ্গারামের কথা ওঠায় বনবিহারীর মুখে একটা আফশোসের ধ্বনি উঠল বটে, তবে মুখে একটা কালো মেঘের ছায়া পড়ল। তো তো করতে করতে বললেন, “এতদিন গঙ্গারাম ফেরেনি যখন, তার আশা ছেড়ে দাও। আমি না হয় তোমার জন্য ভাল জাতের একটা কুকুর কিনে এনে দি।”
“কী বলছ বনবিহারী! গঙ্গারাম কি কুকুর মাত্র, সে আমার পরিবারের একজন। ওকে ছেড়ে থাকাটাই তো কষ্টের।” 🍁 (চলবে)

 

🍁গদ্য 

 

জগন্নাথদেবের রথযাত্রা

অভিজিৎ দত্ত

 

থযাত্রা বা রথদ্বিতীয়া আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। ভারতের ওড়িশায়, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হয়। যদিও ভারতবর্ষের মধ্যে রথযাত্রা বিখ্যাত ওড়িশার পুরীতে।এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরের মাহেশের রথযাত্রা, ইস্কনের রথযাত্রা বা বাংলাদেশের ধামরাহা রথযাত্রা বিখ্যাত।

কেউ বলেন রথযাত্রায় বেরালে ভক্তদের ইচ্ছাপূরণ হয়।যাইহোক রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর মানুষ বা ভক্তদের যেমন সমাগম হয় তেমনি এই উৎসব উপলক্ষ্যে অনেক জায়গাই মেলা বা অনুষ্ঠান হয়। জগন্নাথকে বলা হচ্ছে জগতের নাথ বা প্রভু।জগন্নাথদেবের মূর্তি নির্মাণ নিয়েও কাহিনী আছে।

 

২০২৫ সালে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় ২৭ জুন শুক্রবার। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লাপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা শুরু হয়।এই রথযাত্রায় ভগবান জগন্নাথদেবের সঙ্গে থাকেন ভাই বলভদ্র ও বোন সুভদ্রা। এই তিনটি রথ একসঙ্গে বের হয়।কথিত আছে বোন সুভদ্রা দাদা শ্রীকৃষ্ণকে বাইরে বেরাতে যাবার বায়না করলে শ্রীকৃষ্ণ বোন সুভদ্রা ও বড় ভাই বলরামকে রথে করে নিয়ে মাসির বাড়ি যান। সেখানে সাতদিন থেকে আবার ফিরে আসেন।এই যাওয়াকে সোজা রথ ও ফিরে আসাকে উল্টোরথ বলে। ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রায় রথগুলোকে বিশেষভাবে সাজানো হয়। ভগবান জগন্নাথদেবের রথের নাম নন্দী ঘোষ। রথটি লাল ও হলুদ রঙের হয়। উচ্চতা প্রায় ৪৫ফুট। এটি শুধুমাত্র নিমকাঠ দিয়ে তৈরি হয়।অক্ষয় তৃতীয়া থেকে এর প্রস্তুতি শুরু হয়। রথটিতে ১৬টি চাকা রয়েছে। বলরামের রথের নাম তালধ্বজ। যার উচ্চতা প্রায় ১২,৯ মিটার। সুভদ্রার রথের নাম দেবদলন। এর উচ্চতাও প্রায় ১২,৯ মিটার। ভগবান জগন্নাথদেবের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে ওড়িশার পুরীতে লক্ষাধিক লোকের সমাগম হয়। এই উপলক্ষ্যে পুরীতে প্রতিবছর প্রচুর মানুষের বা ভক্তদের সমাগম হয়। টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয়।রশি দিয়ে রথগুলোকে চালানো হয়।কথিত আছে এই রশি দিয়ে রথ টানলে মানুষ মোক্ষ লাভ করে।ভগবান জগন্নাথদেবকে দর্শন করলে ভক্তদের দুঃখ, কষ্ট দূর হয়। আরেকটা ধারণা আছে রথযাত্রায় দান করলে অক্ষয় ফল লাভ হয়। কেউ বলেন রথযাত্রায় বেরালে ভক্তদের ইচ্ছাপূরণ হয়।যাইহোক রথযাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর মানুষ বা ভক্তদের যেমন সমাগম হয় তেমনি এই উৎসব উপলক্ষ্যে অনেক জায়গাই মেলা বা অনুষ্ঠান হয়। জগন্নাথকে বলা হচ্ছে জগতের নাথ বা প্রভু।জগন্নাথদেবের মূর্তি নির্মাণ নিয়েও কাহিনী আছে। দ্বাপর যুগের শ্রীকৃষ্ণ কলিযুগে জগন্নাথ হয়ে এসেছেন আমাদের উদ্ধার করতে। জগন্নাথদেবের রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ হল,রথ হচ্ছে আমাদের শরীর বা ইন্দ্রিয়। বিগ্রহ হচ্ছে মন। রশি বা দড়ি হচ্ছে বিবেক। এই বিবেক যদি জগন্নাথ হয় তাহলেই সংসারের মঙ্গল। কিন্ত বিবেক যদি আসুরিক প্রবৃত্তি দ্বারা চালিত হয় তাহলেই হবে সমাজ বা সংসারের অমঙ্গল। আর কলিযুগে এই আসুরিক প্রবৃত্তি এতই বেড়ে গেছে যে সমাজ ও সংসারে অবক্ষয় শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই জগন্নাথদেবের রথযাত্রার সময় তার কাছে একটাই প্রার্থনা তার আর্শীবাদে মানুষের মধ্যে যেন প্রকৃত মনুষ্যত্ব ফিরে আসে।মানুষ যেন রথযাত্রার অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবন করতে পারে।এটা যেন নিছক আনন্দ বা চিত্ত বিনোদনের অনুষ্ঠানে পরিণত না হয়। তবে জগন্নাথদেবের রথযাত্রা হবে সার্থক। জয় জগন্নাথ।🍁

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার,  কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকারঅঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read