Sasraya News

Sasraya News Sunday’s Literature Special | Issue 70, 21st June 2025 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | সংখ্যা ৭০, ২২ জুন ২০২৫| রবিবার

Listen

সম্পাদকীয়

“আমার প্রতিটি শব্দে তুমি আছো। কেন আছো বা থাকবে এর উত্তর নেই। তবে তুমি থেকে যাবে অনন্তের মত।” এই উপলব্ধি যদি শুধু কবি-সাহিত্যিকের না হয়ে সমস্ত মানুষের শব্দ হত। তাহলে খুশি হতো তৃতীয় কোষ মানে মন। আর আত্মার কাছে পৌঁছতে গেলে অনেক অনেক শুভেচ্ছা কুড়িয়ে পুড়িয়ে ছড়িয়ে যেতে হয়। ভালোবাসা প্রেমময় হলে পরম আত্মার বোধি জ্ঞান উপলব্ধি হয়। কিন্তু জেনেও লাভ নেই। কারণ স্কুলে বা গুরুকুলে পাঠ শেষ হলে বা সেই দিন শিখেই ফিরে রাস্তা চলতি বা অন্য কোথাও কাউকে হেনস্থা করা, মিথ্যা কর্ম করা, বা পরিবেশ দূষিত করা করতেই থাকে। এই সমস্ত দৃশ্য প্রতিদিন ঘটছে ঘটবে।

এরও কারণ আছে। পঠন-পাঠন। এর বিষয় যদি ধ্যান দিত বা ধারণা তৈরি করত সরকার তাহলে আমাদের প্রথম বদল ঘটত। কিন্তু তা হল কই! ধর্ম নিয়ে সরকার বিষ ঢুকিয়ে জনগণকেই আরও হিংস্র করে তুলেছে। এই দৃষ্টি আকর্ষণ করুক সমাজে। আসলে ধর্ম বিষয়টি একটি বস্তুর শক্তি যেমন জলের ধর্ম যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রেই ধারণ করে। বরফের ধর্ম গলে জল হওয়া। আবার জল আগুনে ফোটালে বাষ্পে রূপান্তিত হওয়া। কিন্তু মানুষের ধর্ম কি এটা কি কেউ জানার চেষ্টা করেছেন? না করতে চান? প্রশ্ন। এই বিষয়টি আসলেই ভোট রাজনীতির। কৌশল মাত্র। এই বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। সময় এসেছে। না হলে নিজেরাই নিজেদের হত্যা করতে শুরু করেছি।
ভালবাসা মানুষের প্রথম ধর্ম। আর এই শব্দটি কে বা কারা কথা থেকে এনেছেন জানা নেই কারোরই। কিন্তু সব ভাষায় এর মাহাত্ম আছে। এটাই শেখানো হয়নি।  তারপর প্রেম। আসলে প্রেমে পৌঁছাতে গেলে মানুষ কে প্রথম ভালবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতে হবে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো মন্ত্র শক্তি। যত তন্ত্র মন্ত্র আছে তাতে এই বিষয়টিই লক্ষ্য করা যায়। যত ধর্মগুরু আছেন প্রত্যেকেই এর মাহাত্ম জেনে প্রকাশ করেন। আর এর বাইরে যদি কোনও ধর্মগুরু অন্য কিছু বা ক্রোধ শেখানো প্রকাশ করেন এতে সমস্যা অসুবিধা অনেক সামাজিক ক্ষতি সম্ভব হয়ে ওঠে। ভালবাসা ও প্রেমের দ্বারা পৃথিবীর বৃহত্তম কাজও সম্ভব। বুঝতে হবে মানুষ মানুষের জন্য। এই বিষয়টি পরিষ্কার না হলে যুদ্ধ, অধিকার এবং মহা সংঘর্ষ নিশ্চিত। 🍁

 

 

🍂মহামিলনের কথা 

রে! যখন বিবশভাবে নাম উচ্চারণ করলে কোটি জন্মের পাপ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তুমি আগ্রহের সহিত নাম করতে চেষ্টা করছো— তোমার সে পাপ সূর্যোদয়ের অন্ধকারের মতো,ঝড়ের কাছে শুকনো পাতার মতো— কোথায় উড়ে চলে যাবে।

কোনো চিন্তা নাই,চালাও নাম। কাম ক্রোধ বলছো? যখন নাম করতে আরম্ভ করেছ তখন তুলোর গাদায় আগুন লেগে গেছে। নাম করতে করতে তোমাকেই খুঁজে পাওয়া যাবেনা— তা তোমার পাপ কাম ক্রোধ।  জগতে যত মধুর দ্রব্য আছে তা সকল হতে মধুর,সমস্ত মঙ্গলের মঙ্গল,নিখিল পবিত্রকারক বস্তুর পবিত্রকারক একমাত্র হরির নাম, ব্রহ্মা হতে তৃণগুচ্ছ পর্যন্ত অখিল সংসার মায়াময় | সত্য সত্য পুনরায় বলছি একমাত্র হরিনামই সত্য। 🍂 —শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব। ★ ঋণ : ওঙ্কারনাথ রচনাবলী 

 

 

 

🍂বিতা 

 

আলাপন বিশ্বাস-এর একটি কবিতা

আমাদের দৈনন্দিন কৃষিকথা অথবা প্রেমকাব্য 

এত মেঘ সাজিয়ে রেখেছ আমার জন্য
তোমার চোখে গ্রীষ্মের আকাশ
এখানে ধোঁয়া হয়ে ওঠে
তার ভেতর একটা না বলা কবিতার শুরু

এই আগুন, এই জল, এই করুণা
আমি দগ্ধ হই, আবার জেগে উঠি ভিজে ঘাসের ওপর
তোমার স্পর্শে আগুন নরম হয়ে যায়
কে ঢেলে দেয় নিঃশব্দ করুণার জল!

এই যে পৃথিবী উর্বরা হল, তুমি আনন্দে বেড়েছ পান্তা।
তোমার পায়ের ছন্দে ঝরে পড়ছে ছায়া ও রৌদ্র
এখন ফসলের খেত তোমার হাসিতে ডুবে যায়
আমি দেখি, কীভাবে নিঃসঙ্গতা হয়ে ওঠে শস্যগোলা।

এই যে রাতের পান্তা
তোমার দেওয়া একটু স্নেহ, একটুখানি লবণ,
হাতের উষ্ণতায় জেগে ওঠা ঢেঁকিছাঁটা চালের গন্ধ,
অনাহারে তারাই লেখে কৃষিকথা

এই যে তোমার নিঃশ্বাসে জমে থাকে অতীতের গান
আমার আজকের কাঁপা হাত ছুঁয়ে দেখে ভবিষ্যৎ
আর আমি, একাকী শ্রোতা হয়ে শুনি,
শুধু মেঘে, আগুনে, জলে, করুণায় লেখা অনন্ত প্রেমকাব্য।

 

 

স্বপন কুমার দত্ত-এর দু’টি কবিতা

দাঁত বাঁধাই সংক্রান্ত

দাঁত বাঁধাই করতে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না।

কী? জানার দরকার নেই।

বড় বড় চোখ, মুখ, টকটকে লাল।
থর থর থর থর। ব্যাঙ্ক থেকে লোন
ভিড় জমিয়ে ফেলছে।
অ্যাম আই গেট লস্ট?

স্পর্ধা কাঁপছে।
কাটা কলা গাছ মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।
ভাইটাল ভ্রূ-কুঁচকে…

কোথায় যাচ্ছি? দাঁত বাঁধাইয়ে?
আমার সঙ্গে, একটু যেতে হবে তোকে।

 

 

শুরুর আগে 

হ্যাঁ। শুরু করছি। আবার কী!
কিন্তু কোথা থেকে? কী নিয়ে?
কেনই বা শুরু করব, বলতে পারিস?

অ্যাঁ। শুরু করো! শুরু করলে কী টাকা দিবি?
আর দিসই যদি, ক-টাকা দিবি?
অন্তত একদিনও কী মহাভোগ হবে?
আরে মহা ভোগ! মানে তোদের মত প্যানপেনে ভোগ নয়।
যাতে থাকবে… না না উচ্চারণ করব না।

ঠিক আছে রে ভাই। শুরু তো করেই দিয়েছি।
এবার যদি টাকার ঝলকানি দেখি,
তাহলে তোতে, আমাতে… এই দ্যাখো,
এতক্ষণে তো তুই জানাসইনি, শুধু লিখে জানিয়েছিস
শুরু করতে, কিন্তু
তুই মেয়ে কী ছেলে… আ.. না না..না…
বেশি আর এগোব না।
কিন্তু যদি তোকে ভাবি মেয়ে
তাহলে শুরুটা দারুণ কিংবা নিরারুণ
কিংবা একাবারেই রাস্তা… কে জানে!

চাকরি তোর গেছেই, অবশ্য বলছিনে গেছেই
কেননা, এখনও টিউশনি ঘরে ঢোকে…
আর টিউশনিতে শান দিতে দিতে এধার আর ওধার তাকাই।
যদি একটা মিলে যায়! কী মিলে যায়?
ওটা তোমরাই ভেবে দ্যাখো।
তাহলে এক নম্বরের শুরুটা যখন হয়েই গেছে তখন
দু-নম্বরের শুরুটাই করি।
এবং এই শুরুটা করতে গেলে
দু-নম্বরে এসে পৌঁছে দেখছি,
আকাশটা আমার পায়ের তলায়।
আমি আকাশের চেয়েও নিচুতে…
নাহ! এখন আর কাউকে কিছুতে দেখতে পাচ্ছি নে।
চারধারে এটা অন্ধকার, না আলো!
তা-ও বুঝতে পারছিনে।
কেবল বুঝতে পারছি, আমি দলিত,
তাই আকাশের ওপারে শীত…

দলিত মানে? দলিত। দলিত…
নাহ। দলে যাচ্ছে। দলে যাচ্ছে শুধু।
শুরুতেই দলে যায়, তাই আকাশের ওপারে থেকে যায়।

আকাশ আমার নিচে। কিন্তু নিচে যখন তাকাই?
কিছু নেই। একি রে ভাই!
কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা আকাশের তলায়, নাকি পাতালের তলায়—
সেখানেও কী একই— দেখিছি না তো
কোনও দাউদাউ আগুন
দেখছি না তো, কোন হিমবাহের হিম!
তাহলে কী দেখতে পাচ্ছি, কী?
কিছুই নয়…

এবার তিনেই শুরুতেই যাই।
তিনের শুরু! তিনে তো ওরা বলে বৃহস্পতি।
বৃহৎ-পতি। আমি কী তা-ই?
বৃহৎ হলে ক্ষতি কিছু নাই।
শুধু কেমন যেন মনে হয়, ঝুমঝুম ঝুমঝুম
ঘুঙুরের শব্দ শুনি।
সেকি আমার পায়ের ঘুঙুর?
তাহলে, আমি কী নারী? নাকি নর?
নাকি কোনওটা-ই নই!
শুধু পায়ের ঘুঙুর… বুঝতে পারি না।
বুঝতে পারি না, শুরুটা কখন
কে করে দিয়েছে।
বুঝতে পারি না, শুরুতেই রয়ে গেছে!
অথবা… অথবা… আমি, তুমি, সে
কাউকে খুঁজে পাই না।
শুধু জানি, এখনও শুরুটা শুরু হয়নি।

আরেব্বাস! শুরুটা শুরুই হয়নি, তাহলে?
তাহলে কী? শুরুর আগে যেটা থাকে সেটা কী?
সেকি আমি?

 

 

গীতা চক্রবর্তী-এর একটি কবিতা 

দোষ

আমার অনেক দোষ, আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দিয়েছি
জলের মতো করে গ্রীষ্মের তৃষ্ণার্ত দুপুর ভেবে।

কাছে টেনে নিয়েছি নিজের করে আম জাম কচু লিচু বেগুন লঙ্কা,
আমার অনেক দোষ, আবেগবশত না বলতে পারি না।

বারবার একই ভুল অভ্যাস যত… কার্পণ্য চার আঙুলের দিকে।
কেউ তাকায় না শুকিয়ে যাওয়া গাছ নিয়ে বিদ্রুপ আঁকে যতটা সম্ভব।

 

 

আমিনা তাবাসসুম-এর একটি কবিতা 

অনিকেত বৃষ্টান্নের কশেরুকা

নিঃসাড়তার আলজিভ দেখি
বহুদিনের অমিতাক্ষ গাছ
শুকনো একা

মাকড়সার থাবা
উর্ণনাভ বিস্মৃতি
যেখানে অগণিত রশ্মিকা মেঘে
এক পশলা চুম্বক

একটা শামুক ঘেরা জল
হাতের কফিনে সাদা রক্ত।

ফুলে ওঠে, চোখে বর্ষার
খেয়ালী রঙিন সব ঘুড়ি—
উড়ে যায়
অথবা যেতে যেতে
পিচ গলা রাস্তায় ঘুরে বসে
অন্ধকারের মুখোমুখি

বিশ্রুত অন্ধকারকে ধ্রুবক ধরে
শ্রুতাক্ষরে শুনি ভুল স্বাসাঘাত

 

ঋপণ ঘোষ-এর একটি কবিতা

বাঁকে

কিছু তো ছিল তোমার ভেতর
আঁকড়ে ধরা বাঁকের খাঁজে
আমরা না হয় এমনই বাউন্ডুলে
তবু বেশ তো আছি, ভালবাসায়।

ঝুলে থাকা বিকেলের আলো
শুধু তোমার মুখটাই মনে পড়ে,
তপ্ত শরীরের মৌন কথায়
ঘুমিয়ে থাকা শহর জেগে ওঠে।

তুমি কি জানো, শিরীষ গাছের নিচে
আজও বসে থাকি একা একা…
হাত ছুঁয়ে যায় বাতাস, অথচ
তোমার আঙুলের ঠান্ডা নেই।

ভালবাসা কি তবে শেষ হয় এভাবে?
নাকি রয়ে যায়, ছায়ার মতো পাশে?

 

 

অসীম দাস-এর একটি কবিতা 

শেকড় সুখে শীষের ঝিকিমিকি

পাথর শোকের স্থবির গুহা গলে
আবার হবে ক্ষিপ্র খরস্রোতা,
এই আশাতেই অনড় ঈগল ডানায়
আকাশ-পোরা দিগন্ত – বীজ পোঁতা।

ব্যক্তি বিষাদ জমিয়ে তুষের মতো
আর কতো টন পুড়বে ধিকিধিকি?
হোক পুরোনো উপমা, অক্ষত
শেকড় সুখে শীষের ঝিকিমিকি।

যাপন মানে চিৎ সাঁতারই শুধু!
ডুব সাঁতারে বন্ধ দমের ভয়
কাটিয়ে ওঠাই জীবন জিনের ঋত
সময় গুরু হাত বাড়ালেই জয়।

আসবে সময় পক্ষীরাজে চড়ে
রূপকথা নয়, জাতক তিতিক্ষায়,
চক্র ঘোরে নিত্য জন্ম ক্ষেতে
আঁশ ছাড়ালেই, আসল প্রতীক্ষায়।

 

 

অশোক কুমার রায়-এর একটি কবিতা

অর্থহীন ছবি

শুল্কহীন প্রাপ্য বলে
জন্মসূত্রে আকাশ দেখি
দূরে অথবা কাছ থেকে।
ঘূর্ণিঝড়ে টুকরো টুকরো কাগজের মত
জীবনের অংশগুলো
ভাগে ভাগে সাজাতে সাজাতে
সমর্পণ করি হাঙ্গরের মুখে।
শর্তহীন ভূমিকায় স্বাক্ষর করি আমি
আয়ুরেখার দৌড় প্রতিযোগিতা।
এভাবেই ভাসতে ভাসতে
বিষাদ সাগরে দীর্ঘশ্বাস ফেলি
এবং দেখি শূন্য থেকে আরো শূন্যে অর্থহীন ছবি।

 

 

শ্বেতা সেন-এর তিনটি কবিতা

এইটুকুই

এইটুকু ছুঁয়ে দিলে বেঁচে উঠি রাতব‌্যাপী
তোমার চোখে ভোর নামে কুয়াশা-ঘেরা দ্বীপ।
এই শরীর নদী হয়, ধরি শুধু জোয়ার…
ওষ্ঠপুটে চুম্বন রাখ ভাঙে আমার গোপন দ্বার…

তোমার ঠোঁটের খাঁজে লেখা নিষিদ্ধ বাসরের গান
মৃদু নিঃশ্বাসে জেগে ওঠে উন্মনা সব উচাটন…
এই যোনি তো চায়নি আর কিছু নিরবধি
শুধু কেঁপে ওঠা, খুঁজি কল্পনায়, জলে ভেঙে যায়

এই মায়া কাকে দেব, বলো তুমি নেবে
জন্মজলের স্বাদ রাখি তোমার প্রতিমায়
রোজ রাতে নিজেকে খুঁড়ি নিঃসঙ্গ নিরালায়
আহ! তখন তুমি হ’লে যেন পূর্ণ এক কুসুম-দ্বীপায়ন
আমার প্রাণের বেশ্যা পুরুষ।

 

উন্মাদিনী

এই শরীর আমার পাথর, নিয়েছে পাহাড়ের রূপ,
তুমি তো সেই পাহাড়, চুম্বনে ভাঙো নীরব অনুপ,
যোনিপথে খোলো রাতের গোপন অন্ধ কুহেলি,
আমি তো জানি না কিছু, শরীরই তো আত্মার শিখি।

পথে দাঁড়িয়ে থাকি আমি, ঘরে আনি কামনামত,
প্রতিদিন নতুন মুখে পুরুষের পরিচয় খুঁজি।
ওরই পায়ে রাখি তখন পদ্মবৃন্তের সারি,
ওরই স্পর্শে জেগে উঠি রক্তমাখা নারী।

রাত্রি পিষে চলে যেন স্তনে স্তনে বিষাক্ত চাঁদ,
চন্দনে পুরুষ দেহে আঁকি তীব্র পরাজয়গাথা…
আহ্! সাদা বীর্যের স্রোতে স্নান করি, প্রণমি কামের দেব…
আমি যে উন্মাদিনী তারি

 

যোনীপথ

যোনীপথেই লেখা আছে রাত্রির প্রাচীন মানচিত্র,
শরীর খোলে, ভাঙে দেয়াল, ডাকে একান্ত সঙ্গীত।
তপ্ত পেটিকোট ছুঁয়ে ওঠে বেদনার অন্ধ দরজা,
ওখানেই জন্ম হয় প্রেমের, যদিও আসে পরাজয় সাজা…

কোনও পুরুষ আসে শুধু শরীর ছোঁবে বলে,
কিন্তু কেউ কেউ রয়ে যায়, ভাঙে হৃদয়ের কলে।
ওই ঠোঁট বলে—”তুই ঈশ্বর, তোর যোনি মন্দির”,
আমি তখন কেঁপে উঠি, শরীরে বেজে ওঠে চণ্ডী তানপুর…

রাত্রি তখন বসে পড়ে মাথা নিচু করে ধীরে,
তার বুকে আমি আঁকি প্রেম, তবু কাঁদি রক্ত নীর।
ওপারের কেউ দেখে না, এই শরীর মানে কী,
যোনীর ভাষা বোঝে না কেউ, শুধু শূন্যতায় ধিকি…

তবু আমি খুলে দিই দরজা, প্রেম নাকি কাম, কে জানে?
তবু আমি তৃষ্ণা রাখি, যোনীপথে লিখি ঈশানের রং…

 

গোলাম কবির-এর একটি কবিতা 

নিজস্ব নদী

প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব একটা নদী
থাকে হৃদয়ের একদমই গভীরে!

হৃদয়ে কখনো ঝড় উঠলে নদীটা একদমই
অন্য রকম আচরণ করে যা আর কেউ
বুঝতে না পারলেও যার নদী সেই শুধু বোঝে!

প্রত্যেক মানুষেরই সেই নিজস্ব নদীর
ছলাৎছলাৎ জলের ঢেউ যখন হৃদয়ের
একূল ওকূল ভাসিয়ে নিয়ে যায় ,
তখন সেই শুধু বোঝে আর কেউ না বুঝলেও!

প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের গভীরে
যে নদীটা থাকে সেখানকার জল
হৃদয় যখন খরাক্রান্ত হয়
কিংবা যখন মন কেমনকরা রোগে
আক্রান্ত হয় তখন আকাশের মেঘ হয়ে যায়,
তারপর সেখানে প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়!

কখনো কখনো নিজে নিজেই হেসে ওঠে
পোয়াতি জ্যোৎস্নার মতো
যদি একটুখানি ভালোবাসা পায়!

আবার কখনো কখনো বিকট শব্দের
বজ্রপাতে যেমন মানুষ ভয় পায়
তেমনি করে ভয় পাইয়ে দেয় নিজেকেই
অথচ অন্যেরা তা টেরও পায় না!

 

 

রানী সেন-এর একটি কবিতা 

চাঁদের বাড়ি 

নীল আকাশে উড়ে যায়
সাদা বলাকার সারি,
কিজানি কত দূরে ওরা
সবাই দেবে পাড়ি।

ছোট্ট খোকা ভাবছে বসে
থাকলে দুটো ডানা,
ওদের সাথে উড়ে যেতো
করতোনা কেউ মানা।

মেঘের চাদর গায়ে মেখে
যেতো চাঁদের বাড়ি,
ঠাম্মি কেমন চরকা কাটে
খবর নিতো তারি।

তারপরে বাড়ি এসে মা’কে
বলতো ঠাম্মির কথা
ঠাম্মির কষ্টের কথা শুনে যে
মা’র মনে লাগতো ব্যথা।

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর একটি কবিতা 

চিঠির মেয়েটি

যে মেয়েটি আমাকে ঠকিয়েছে, তাকে প্রতিদিন
তুলে দিই, একগুচ্ছ রুমেলিয়া ফুল

ফুলের কোন গন্ধ ছিল না বলে
প্রতিবার আমাকে শাসিয়েছে , তার উদ্ধত কলম
গোপন যাতায়াত, চুরিয়ে লেখা চিরকুট ছেড়ে উড়ে যায়
উত্তরের মেঘ

ইদানিং মেয়েটি বৃষ্টি ভালোবাসেনা…
কেননা বিগত কোন কালবৈশাখীর বিকেলে
তার আঁকা গোপন খাম থেকে বৃষ্টি মুছে নিয়ে গেছে,
সতেরো বছরের প্রণয়ের দাগ

শব্দহারা মেয়েটি প্রতিদিন সূর্যাস্তের বিকেলে
ঈশ্বরের নামে সাজাতে থাকে, বয়ঃসন্ধির দুরন্ত অভিশাপ

 

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস
শুরু হচ্ছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

বত্রিশ.

অবিকল আমার পিসার মতোই একটা লোক গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে

০০৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। বেশ কিছুদিন থেকেই ভ্যাপসা গরম শুরু হয়েছে। সর্বত্রই একটা অস্বস্তি। মাটির বাড়ির দাওয়ায় বসে তালপাতার একটা হাতপাখা নিয়ে নিজেকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই ঠান্ডা হতে পারছি না। শরীর দিয়ে অনবরত ঘাম ঝরে যাচ্ছে। দুপুর অতিক্রান্ত হতে না হতেই মর্মান্তিক একটা খবর এসে পৌঁছালো। এই কিছুক্ষণ আগেই আমার মেজ পিসা মৃত্যুবরণ করেছেন। কর্মঠ মানুষ কী করে মারা গেলেন? যে সংবাদ দিতে এসেছিল সেই জানালো : সকালে চাট্টি ভেজা ভাত খেয়ে ধানের জমি নিড়ানি করতে বেরিয়েছিলেন। জমি নিড়ানি করে ঘাস কেটে বাড়ি ফিরতেন। বাড়িতে দু’টি গরু-বাছুর আছে। মাঠেও ঘাসের অভাব নেই। তাই প্রতিদিনই ঘাস কেটে বাড়ি নিয়ে আসেন। সেদিনও তাই করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম। জমি নিড়ানি শেষ হলেই বেশ কিছুটা ঘাসও কাটা হয়। তারপরে শুরু হয় বুকে ব্যথা। রোদের মধ্যেই প্রায় তড়পে তড়পে মারা যান। মুখে জল দেওয়ারও কেউ ছিলেন না। পরিমড়ি করে ছুটলাম পিসার বাড়ি। মল্লারপুরে নেমে তালোয়া গ্রামে। মাটির একখানা ছোট্ট ঘর। তালপাতার বেড়া দিয়ে ঘেরা আছে। বাড়ির পাশেই একটা চালা এবং সেই সঙ্গে গোয়ালঘরও। রোদের মধ্যেই সাইকেল চালিয়ে রামপুরহাটে এসে বাস ধরে পৌঁছালাম সেই গ্রাম। তবে অনেকটা পায়েও হাঁটতে হলো। গিয়ে দেখি তখনও সমস্ত শরীরে কাদামাটির সঙ্গে লেগে আছে ঘাম। মুখ দিয়ে ফেনার মতো বেরিয়ে এসেছে লালা। তাহলে কি হার্ট স্ট্রোক?

আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, চোখ দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল ক’য়েক ফোঁটা অশ্রু। সকলে মিলে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। আরেক দল লোক ছোট ছোট বাঁশের টুকরো কবরের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকলো। বাঁশ দেওয়া হলে তার ওপর বিছিয়ে দিল খড়। খড়ের ওপর কাদামাটি দিয়ে ভালো করে লেপন দিতে থাকলো। লেপন দেওয়া শেষ হলে শুকনো মাটি তার ওপরে চাপাতে লাগলো সকলে মিলে আঁজলা ভ’রে। একটা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলেই সে লাশ হয়ে যায়।

কথাটা লুফে নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম জানালো, স্ট্রোক ছাড়া আর কী? সকালের ভেজাভাত আর রৌদ্রের তাপ প্রচণ্ডভাবে তাকে গ্যাস-অম্বল হয়ে গেছে। পিসির দিকে তাকাতে পারলাম না। প্রায়ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। মাথায় জল ঢেলে পাখার বাতাস করে তাকে সামাল দিতে পারছে না।

সামান্য বিঘা খানেক জমি আর দু’টি গরু-বাছুর ও মুরগি-হাঁস পুষেই সংসার চলতো তাদের। পিসি অবসর টাইমে তার ছেলেমেয়েদের কুড়িয়ে আনা মাঠের গোবরগুলোতে ঘুঁটে দিত। সেগুলো শুকিয়ে গেলে তখন বিক্রি করতো। সেভাবেই দু-চার পয়সা জমিয়ে রাখতো। অভাব পড়লে তখন তাতেই চালিয়ে নিতো। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই এই পিসির বাড়িতে বেড়াতে আসতাম। সারাদিন দ্বারকা নদীর ধারে ধারে ঘুরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতাম। পিসির বাড়িতে খুব আনন্দ হতো এই কারণেই যে তাদের গ্রামটি নদীর ধার সংলগ্ন। পৌষ সংক্রান্তিতে একটা মেলা হতো সেইখানে। মেলায় ঘুরতেও খুব ভালো লাগতো। পিসা হাত ধরে মেলায় নিয়ে যেতেন। সবচেয়ে বড় বড় মিষ্টি যারা তৈরি করতো তাদের কাছে গিয়ে বলতেন, “কোন মিষ্টিটা খাবে খাও!” মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরলে সেই রাত্রে আবার তিলপিঠা তৈরি করতো পিসি। অন্য সময় পিসির বাড়ি এলে মাঠে-ঘাটেই বেশি ঘুরে বেড়াতাম। তাদের জমির ধারে গিয়ে বসতাম। আলুর গাছ দেখতাম। কচুর গাছ কত বড় হয়েছে তার পরীক্ষা করতাম। তারপর দুপুর বেলায় ছুটতাম নদীতে স্নান করতে। বালির ওপর দিয়ে
ছুটোছুটি করতে ভালো লাগতো। কিছুতেই আগাতে পারতাম না। নদীর ধার থেকে দু-একটা শেয়াল বেরিয়ে আসতো। তাদের পিছন পিছন দৌড়াতাম। দু-একটা জামের গাছ থেকে জাম পেড়ে প্রায় পেট পুরে খেয়ে ফেলতাম। বাড়ি ফিরলে পিসি বলতেন, “বাবা সারাদিন পেরিয়ে গেল! কখন তোমরা খাবে?”
তখন তাড়াতাড়ি খেতে বসতাম। মাছ বা মাংস রান্না করলে তার সঙ্গেও পিসি বড় বড় হাঁসের ডিম সেদ্ধ করে দিতেন। ‘এত খাওয়া যায়!’ বলে থালার ধার থেকে সরিয়ে রাখতাম। পিসি একপ্রকার জোর করেই খাওয়াতেন। খুব মনে পড়ে, একবার পিসি বাড়ি ফেরার সময় পাঁচটা টাকা আমার হাতে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, “মল্লারপুরের মিঠাই খুব ভালো। যাওয়ার সময় পাঁচ টাকার মিঠাই কিনে খেয়ো।” আমি মাথা নেড়েছিলাম। তালোয়া থেকে হেঁটে এসে মল্লারপুরে প্রবেশ করি। বড় রাস্তার দুইপাশে দেখতে পাই সারি সারি মিষ্টির দোকান। পাঁচ টাকায় তখন পাঁচটা বড় বড় মিষ্টি পাওয়া যেত। না, আমি মিষ্টি কিনলাম না। টাকাটা অন্য কাজে লাগাবার স্বপ্ন ছিল। তখন ১৯৭৭-৭৮ সাল হবে। কিছুদিন আগেই কাজি নজরুল ইসলাম মারা গেছেন। রামপুরহাট স্টেশনে অন্ডাল লোকাল ধরতে এসে দেখেছিলাম রেলওয়ে স্টলে ঝাঁকড়া চুল কাজি নজরুল ইসলামের ছবি লাগানো একটি বই। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “বইটির দাম কত?” ফর্সা মতন দোকানের মালিক হিন্দি উচ্চারণে বলেছিল, “পাঁচ টাকা।” বইটি একবার হাতে নিয়েও দেখেছিলাম। কিন্তু আমার বয়স কম বলে দোকানদার হেসে বইটি কেড়ে নিয়েছিল। তখন থেকেই মনে খুব দুঃখ হয়েছিল বইটি না কিনতে পারার জন্য। সেই ইচ্ছাটি পূরণ করার জন্য মিষ্টির দোকান পাশ কাটিয়ে এসেছিলাম। তারপর বইটি কিনে বাড়ি ফেরার রাস্তায় পড়তে পড়তে এসেছিলাম। নজরুলের জীবনের গর্জন আমার জীবনের গর্জনে পরিণত হয়েছিল। সেই সময় নজরুলকে স্বপ্নেও দেখতাম খুব। নজরুলের বিখ্যাত বই ‘সঞ্চিতা’ কেনারও ইচ্ছা জেগেছিল তখন থেকেই।
পিসা লেখাপড়া প্রায় জানতেনই না, কিন্তু খুব সামাজিক মানুষ ছিলেন। কাকে কখন সম্মান শ্রদ্ধা করতে হয় সে আদব-কায়দা ভালো করেই জানতেন। আমার সহপাঠী নিতাই দত্ত ছিল তালোয়া গ্রামেরই কাছাকাছি তারাচি বলে একটি গ্রামে। নানা সময়ে তার বাড়ি যেতে হতো। তখন পিসা আমাকে ডাকতে চলে যেতেন তাদের ঘরেই। নিতাই দত্তের বাবা ছিলেন একজন শিক্ষক। পিসা মূর্খ হলেও তাকে ভীষণভাবে সম্মান করতেন। একবার নিতাইও আমাকে পিসার বাড়ি ডাকতে গিয়েছিল। পিসা তাকে ডেকে এনে ছোট্ট ঘরেই চৌকির ওপরে বসিয়েছিলেন। তারপর যতটুকু সেবা যত্ন করা যায় তার ত্রুটি রাখেননি। তারপর থেকেই নিতাই আমাকে বলতো, “তোর পিসা গরিব হতে পারে, কিন্তু ওরকম ভালো মানুষ আমি আর দেখিনি!” পিসার মৃত্যু আমার কাছে আরো একটা কারণে খুব যন্ত্রণার ছিল। স্কুল সার্ভিস কমিশনে পাস করে আমি ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছি পিসা তা আগেই শুনেছিলেন। এই সংবাদটি তিনি এপাড়া-ওপাড়া, গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে বেড়াতেন। আনন্দে ও গর্বে তার বুক ভরে গিয়েছিল। যাকেই দেখা হতো বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হলেও তিনি বলতেন, “এবার আমার সম্বন্ধীর ছেলে চাকরি পাচ্ছে হাইস্কুলে। খুব ভালো পরীক্ষা দিয়েছে। চাকরি হলেই তোমাদের মিষ্টি খাওয়াবো। আর দু-এক মাসের মধ্যেই হয়ে যাবে।” কথাটা বলেই তার যে কী মুখটা রাঙা হয়ে উঠতো এবং বুকটা ফুলে উঠতো তা যে দেখতো সেই বুঝতে পারতো। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সংসারে পিসা আমাকে নিয়েই যেন স্বপ্ন দেখতেন। আমি লেখাপড়া করি বলে ছোটবেলায় ঘাড়ে চাপিয়ে আমাকে নিয়ে ঘুরতেন মোড়লদের বাড়িতে। চাকরির প্যানেল এখনো বেরোয়নি। স্কুলসার্ভিস কমিশন সূত্রে খবর নভেম্বর মাসেই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু তার আগেই পিসা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। জানতেও পারলেন না আমি চাকরি পেলাম কিনা।
খাটিয়া থেকে লাশ নামানো হলো কবরে। মুখের পর্দাটি সরিয়ে দেওয়া হলো। আত্মীয়-স্বজনরা শেষ দেখা দেখলেন। আমিও কবরের দিকে মুখ বাড়িয়ে একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম পিসার ওই করুণ অসহায় মুখের দিকে। মৃত্যুর পর চোখ দু’টো অনেকটাই বসে গেছে। মুখটা হাঁ হয়ে গেছে। না, মাথার চুল একটাও পাকেনি। তিনি যেন কিছু বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষ কথা বলা হলো না। পাশ থেকে মানুষেরা বললো, “আর বেশিক্ষণ মুখ খুলে রাখবেন না, পর্দা দিয়ে ঢেকে দিন।”
মুখের ওপরে শেষ পর্দা চাপিয়ে দেওয়া হলো। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না, চোখ দিয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ল ক’য়েক ফোঁটা অশ্রু। সকলে মিলে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলো। আরেক দল লোক ছোট ছোট বাঁশের টুকরো কবরের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকলো। বাঁশ দেওয়া হলে তার ওপর বিছিয়ে দিল খড়। খড়ের ওপর কাদামাটি দিয়ে ভালো করে লেপন দিতে থাকলো। লেপন দেওয়া শেষ হলে শুকনো মাটি তার ওপরে চাপাতে লাগলো সকলে মিলে আঁজলা ভ’রে। একটা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হলেই সে লাশ হয়ে যায়। তারপর কোথায় হারিয়ে যায়। কিছুদিন তাকে খুব মনে পড়ে, কিন্তু আস্তে আস্তে তার কথা ভুলে যায় সবাই। সেদিন পিসাকে কবরস্থ করে অনেক রাতে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। ওদের শোকাচ্ছন্ন বাড়িতে আর থাকতে পারছিলাম না। পিসার ব্যবহৃত সমস্ত জিনিসগুলি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছিল। মৃত্যুকালীন কিভাবে তড়পে তড়পে উঠেছিল সে-সবেরই গল্প হচ্ছিল চারিদিকে। রামপুরহাট থেকে অন্ধকারে প্রায় হেঁটেই গ্রামে ফিরছিলাম। গ্রামে ঢোকার মুখেই আমাদের বিস্তৃত কবরস্থান। চারিদিকে ঝোপঝাড়। দূরে একটা গাছতলায় কাউকে যেন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। এত রাতে কবরস্থানে কে দাঁড়াবে? ভাবতে ভাবতে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠলো। দেখলাম অবিকল আমার পিসার মতোই একটা ফতুয়া গায়ে দিয়ে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতটুকুও নড়ন-চড়ন নেই বললেই চলে। না, কথা বলার সাহস হলো না। দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটতে লাগলাম। (চলবে)

 

 

🍂গল্প

 

টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম ছুটে চলেছে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরিয়ে, রাসবিহারী হয়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের দিকে। নিধি জানালার ধারে বসে আর সায়ক তার পাশে। হঠাৎ করে নিধির মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা। যখন ছোট ছিল, বাবা তাকে নিয়ে যেত ভিক্টোরিয়ার ধারে ঘোড়ার গাড়ি দেখতে। তারপর মা বলত, “বাবা, ডাক্তার হবি তুই। কলকাতা চেনে যে, সে রোগ চেনে আরও সহজে।”

 

ট্রামের জানালায় ভেসে যাওয়া

শ্রেয়সী চৌধুরী

টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর ভেতরে ছায়া ছায়া বিকেল। নিধি ধীর পায়ে হাঁটছিল। আজ সকালেই সে রাতের শিফ্‌ট শেষ করে এসেছে এসএসকেএম (SSKM) হাসপাতাল থেকে। সাড়ে তিন ঘণ্টা ঘুমিয়ে উঠে আবার বেরিয়েছে। হাতে একটা ছোট্ট নীল ব্যাগ, তাতে স্টেথোস্কোপ, দু’টো মেডিকেল জার্নাল, আর একটা ছোট্ট লাঞ্চবক্স যেটা নিজের জন্য বানায় না, অন্যের জন্য রাখে।
আজ নিধি যাচ্ছে ঢাকুরিয়া লেক পেরিয়ে ভিক্টোরিয়া মাঠের দিকে। সায়কের সঙ্গে দেখা হবে। সায়ক, তার জুনিয়র হলেও এখন একসঙ্গে কাজ করে নিউরোসার্জারির রিসার্চ প্রোজেক্টে। তবু, সায়ক শুধুই সহকর্মী নয়৷ একটা অন্যরকম সম্পর্ক, যেটার কোনও নাম নেই, কিন্তু রোজকার দিনে নিধির শিরায় শিরায় ছড়িয়ে থাকে।
ওদের প্রথম দেখা হয়েছিল দু’জনের হাসপাতালের করিডোরেই। সায়ক নতুন জয়েন করেছে, তখন সদ্য পাস করে বেরিয়েছে এমবিবিএস। নিধির হাতে চাপা ছিল একগাদা পেশেন্টের পেপার, আর সায়ক হঠাৎই এসে তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া একটা রিপোর্ট তুলে দিয়েছিল। সেদিন নিধির চোখে প্রথম আলো দেখেছিল ছেলেটা।
শরীরে হালকা চাপা গড়ন, উজ্জ্বল গমরঙা ত্বক, চোখে এক ধরনের প্রাঞ্জলতা। নিধির মনে হয়েছিল, এমন চোখ অনেক কিছুর ভিতর দিয়ে এসেছে, তবু স্বচ্ছ থেকেছে।
তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয় ক্যান্টিনে। রাতের শিফ্‌টে একসঙ্গে ওটি শেয়ার করতে করতে, ট্রাম ধরে বাড়ি ফেরা আর মেট্রোয় একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা। সেসব থেকেই ধীরে ধীরে গড়ায় অন্য কিছুর দিকে।

আজকের বিকেলটা একটু অন্যরকম।
আজ সায়ক বলেছে, “নিধি, আমি তোকে কিছু বলতে চাই। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছে বলব, কিন্তু ঠিক সময়ে বলতে পারিনি।”
নিধির মনে একসঙ্গে অনেক অনুভূতির ঢেউ খেলছিল। তবে মুখে কিছু না বলে সে শুধু ট্রামে চেপে বসে।
টালিগঞ্জ থেকে ট্রাম ছুটে চলেছে, বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পেরিয়ে, রাসবিহারী হয়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিটের দিকে। নিধি জানালার ধারে বসে আর সায়ক তার পাশে।
হঠাৎ করে নিধির মনে পড়ে যায় পুরনো দিনের কথা। যখন ছোট ছিল, বাবা তাকে নিয়ে যেত ভিক্টোরিয়ার ধারে ঘোড়ার গাড়ি দেখতে। তারপর মা বলত, “বাবা, ডাক্তার হবি তুই। কলকাতা চেনে যে, সে রোগ চেনে আরও সহজে।”
কলকাতার মতো সম্পর্কগুলিও জটিল, অথচ অনবদ্য। নিধি ভাবছিল, সায়ক যেন এই শহরেরই মতো। যে সময়ের ভিতর দিয়ে বদলায়, কিন্তু নিজেকে ফেলে না কখনও।
“তুই চুপ করে আছিস?” সায়ক জিজ্ঞাসা করল।
নিধি তাকায়। চোখে একটু ক্লান্তি, কিন্তু ঠোঁটে একফালি হাসি।
“বলি বলি করে তুই তো কিছু বললি না আজও।”
সায়ক একটু গম্ভীর হল। তারপর বলে, “আমি জানি, তুই আমার সিনিয়র। আমি জানি, তুই অনেক বেশি ম্যাচিওর। তবু, আমি তোকে প্রতিদিন একটু একটু করে ভালবেসে ফেলেছি নিধি। এটা প্রেম, এটা একসঙ্গে হাঁটার ইচ্ছে, এটা তোকে ছুঁয়ে থাকার ইচ্ছেও।”
নিধির বুকের ভিতর কেমন খটখটে করে উঠল। সে জানত, সায়ক ঠিক বলছে। তারা আজকাল একসঙ্গে দুপুর খায়, একসঙ্গে ওটি করে, সব মিলিয়ে সায়ক একটা নীরব আশ্রয় হয়ে উঠেছে।
“তুই কি এই কলকাতার সঙ্গে থাকতে পারবি সায়ক? এই শহরের জ্যাম, এই শহরের ট্রাম, এই শহরের ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়ার মতো প্রেম?”
সায়ক হেসে ফেলে, “আমি এই শহরেরই ছেলে, নিধি। নিউ আলিপুরে বড় হয়েছি। বাবার সঙ্গে ট্রামে চেপে কলেজস্ট্রিট যেতাম। আমি তোর পাশে থাকতে পারি, যদি তুই থাকতে দিস।”
ট্রাম এসে থামে মৌলালিতে। ওরা নামে না। শুধু জানালার বাইরের কাঁচে ঝিরঝিরে বিকেলের আলো পড়ে নিধির গাল ছুঁয়ে যায়। তার চোখে তখন একটু জল, আর ঠোঁটে সেই একই নিষ্পাপ হাসি।
“চল, লেকে যাই,” নিধি বলে।
দু’জনে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে ঢাকুরিয়া লেকের দিকে যায়। সন্ধ্যা নামছে। আকাশে ছায়া নেমেছে, জলেও ছায়া পড়েছে। হাঁটার পথ জুড়ে কচিপাতা ঝরে পড়ে আছে। নিধির হাত নিজের অজান্তেই সায়কের হাতে গিয়ে মিশে যায়।
সায়ক বলে, “তুই চাইলে আমাদের এই পথটা একসঙ্গে কাটাতে পারি। তুই ডাক্তার, আমি ডাক্তার। রোগ-যন্ত্রণার বাইরে একটা জীবন তৈরি করতে পারি, তুই আমি আর এই কলকাতা।”
নিধি চুপ করে। তারপর আস্তে করে বলে, “আজ থেকে শুরু হোক? তবে একটা শর্ত আছে।” সায়ক তাকায়।
“সন্ধ্যে নামলে প্রতি শনিবার ধর্মতলা যাবি আমার সঙ্গে। আর সেখান থেকে ভিক্টোরিয়ার মাঠে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আমাদের পুরনো কষ্টগুলোকে মাফ করে দেব, আর নতুন করে গড়ব।”
সায়ক ধীরে মাথা নাড়ে।
সেদিন রাতে ওরা মেট্রো ধরে ফিরছিল। নিধি গড়িয়া নামবে, সায়ক যাবে নিউ আলিপুর। দু’জন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, স্টেশন পেরচ্ছিল একের পর এক। চোখে চোখে কথা হচ্ছিল। ভিড়ের মধ্যেও একটা পরিপূর্ণ নির্জনতা।
“নিধি?” সায়ক বলে।
“হ্যাঁ?”
“তোর কপালে আজ আমার হাত রাখা ছিল বোধহয়।”
নিধি হেসে ফেলে। মেট্রো ঢোকে টালিগঞ্জ স্টেশনে।
দরজা খোলে।
সায়ক নামে। নিধিও।
দু’জনে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
“তোর চোখে এই শহরের সব আলো, নিধি। আমি শুধু তার ছায়া হয়ে পাশে থাকতে চাই।”
আর নিধি বলে,
“তুই থাক। এই ব্যস্ত শহরে ভালবাসা অনেকের হয় না। কিন্তু যাদের হয়, তারা জানে।ট্রামডিপোর ছায়া থেকেও প্রেম জন্ম নিতে পারে।”
শহরটা চুপচাপ সেদিন। শুধু দুই ডাক্তার মানুষের হৃদয়ের নীরব প্রেমে মুখর হয়ে ওঠে কলকাতার গলি, মাঠ, ট্রাম আর লেক।🍁

 

 

🍂ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।

 

 

কিশানগঞ্জের ফেলুদা

তাপস রায়

পর্ব : ৮

না না বোঁদেকে সব জায়গায় নিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। সেদিন কালিম্পং-এ ফুস করে কোথায় কেটে পড়ল কে জানে! তারপর মাল-টাল খেয়ে হোটেলে ফিরে বাওয়ালি। মালবাবুর কাছে মান রাখাই দায়। মুখ থেকে ভক ভক করে মদের গন্ধ বের হচ্ছিল। ফেলুদা ভেবেছে, এটা ঠিক করেনি বোঁদে। সেই স্কুল ছাড়ার পর থেকে নিজের সুনাম তৈরি করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর সেই সুনামে কালি পড়বে এই ছেলেটার জন্য! দুর্নামের ছিঁটে-ফোঁটা যাতে না লাগে তার জন্য ফেলুদা মদ ছেড়ে দিয়েছে। মানে কালে-ভদ্রে খায়। আর মেয়েদের থেকেও শত হস্ত দূরে থাকে। ফেলুদা জানে, এই দু’টোই যে কোনও সময় দুর্নাম রটাতে খুব সহজ অস্ত্র।

পঙ্কজ থাপার শেষ উচ্চারণের উত্তরে খানিকটা জোরে হয়ে গিয়েছিল বোঁদের কথা। “না না, উনি কর্মার হাজব্যান্ড হতে যাবেন কেন! লেপচা হতে যাবেন কেন! উনি তো আমাদের কিশানগঞ্জের বনবিহারী পান্ডে!”
“চেঁচিয়ো না। ওদের অফিস উঁচুতে হলেও, মানে তিন-চারটে ধাপের পরে হলেও কথাবার্তা খালি পাহাড়ে শোনা যায়।”

খবর এসেছিল এই নতুন বালি খাদানের স্বত্ত্ব খুব কম দামে পাওয়া যেতে পারে। এসব কাজে সঙ্গে একজন থাকলে ভাল হয়। আর বোঁদের বিকল্প কে এমন আছে, যাকে বেশি ভরসা করা যায় !
নেই। তবুও দোনামোনা করে ফেলুদা একাই এসেছে। যেমন প্রতি সপ্তাহে একবার করে নিজের খাদান দেখতে আসে। কিন্তু চিন্তা হল, বোঁদে বেশ ক’দিন হল তার কাছে আসছে না। খোঁজ নিয়েছে ফেলুদা, বোঁদে নাকি কিশানগঞ্জে নেই। নিজের মোবাইলটা অফ রেখেছে। সে নাকি স্টেশন রোডের দিলিপ সিং, যে মোবাইলের সিম আর কম দামের মোবাইল কভার-টভার বেচে, তাকে নাকি বলেছে, গুপ্তধন পেয়েছে, ক’দিন লুকিয়ে থাকতে হবে। হাতে এসে গেলেই ভুস্‌ করে ভেসে উঠবে।
ফেলুদা জানে ওর গুপ্তধন মানে পঞ্চায়েতের কোনও কাজের হয়ত বড় ঠিকা। আগেও পেয়েছে। একটু একটু করে নিজের ঘর-বাড়িও হচ্ছে। করুক করুক কাজ করুক। যত কাজ করবে পরিবারটা ঠিকঠাক দাঁড়াবে। ওদের পরিবারে অনেকগুলো পেট। ভাইপো-ভাইঝিদের লেখাপড়ার খরচ আছে। বিধবা কাকিমার ডায়ালেসিসের খরচ। বাড়িতে রোজ ন’জোড়া পাত পড়ে। তাছাড়া ফেলুদার মতো বোঁদে তো আর সন্ন্যাস জীবন যাপনে যাবে না। পূর্বপল্লীর একটা মেয়েকে ওর মনে ধরেছে। মাঝে মাঝেই বাইক নিয়ে ওইদিকে ছোটে। করুক, সংসার করুক। নিজের পায়ে ভাল করে দাঁড়াক।
কিন্তু বোঁদের পায়ের তলা থেকে পাহাড় সরে যাচ্ছে যেন। হোয়াটস অ্যাপে পঙ্কজ থাপার পাঠান ছবি দেখে চক্ষু চড়ক গাছ হয়ে গিয়েছিল। আর আজ সারাদিন কালিম্পংয়ের রাস্তায় পঙ্কজের বাইকের পেছনে সওয়ারি হয়ে দুঁদে গোয়েন্দা হয়ে উঠেছে। কিন্তু ঠিক করতে পারছে না, নিজে নিজে কেসটা সামলাতে পারবে কি না! রহস্যটা হয়ত ভাঙতে পারবে, কিন্তু অপরাধী ধরার মতো লোকবল যে তার নেই। হোমড়া-চোমড়া লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ যা সব গুরুর।
কুকুরের যে রঙিন ছবিটি এসেছে তাতে মনে তো হচ্ছে গঙ্গারাম। কিন্তু গঙ্গারাম যে দু’জনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার একজনের ছবি দেখে বোঁদের চুল খাড়া হয়ে গেছে। ওই লোকটাকে তো চেনে বোঁদে। মাথায় অল্প টাক। একটা অর্কিড গাছের ছায়ায় ছবিটা তোলা। মোবাইলে দূর থেকে তুলেছে বোঝা যাচ্ছে। বেশি বড় করলে ছবি ফেটে যাচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। কুকুরটার মাথা বাঁদিকে ঘোরানো। ফলে একদিকের মুখ দেখা যাচ্ছে। সেখানেও অল্প রোদের টুকরো পড়ায় রঙের হেরফের হয়েছে। কিন্তু বোঁদে নিজের মোবাইলে থাকা গঙ্গারামের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গিয়ে দেখেছে দু’টি ছবিরই কুকুরের গলার চামড়ার কলার একদম এক। দামি বকলস বলে কোম্পানির নামের আদ্যক্ষর ‘কে’ খোদাই করা স্পষ্ট। বোঁদে ভাইঝির জ্যামিতি বাক্স থেকে আতশকাচ এনে ছবির উপর নানা দূরত্বে রেখে দেখেছে, হ্যাঁ একদম এক।
বোঁদে গুরু ফেলুদাকে না জানিয়েই চলে এসেছে। ফেলুদাকে সে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় গুরুর মতো তার নামও ফাটুক। অনেক অনেক কাজই তো সে করে দেয়। ফেলুদাকে বাইকের পেছনে নিয়ে সব জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। খবরাখবর আনে। শুধু শেষবেলা গুরু এমন কী যেন একটা ক’রে দুয়ে দুয়ে চার কেন, বাইশ, কখনও বা শূন্য করে তোলে। যখন যেমন করলে কাজ পটে যায়।
পঙ্কজ থাপার যে কুকুরের নেশা তা জানা ছিল না বোঁদের। সে কুকুর ভালবাসে। কুকুরের বাচ্চা বিক্রি করার সাইড বিজনেসও আছে।
বোঁদের কুকুর হারানোর গল্প শুনে তার কুকুর প্রেম জেগে উঠেছিল সেদিনই। কুকুরের ছবি দেখে আর ভাবে, সে হারানো কুকুরকে তার মণিবের হাতে ফেরাবেই। পঙ্কজ থাপা জানে, থাই কুকুরেরা মণিব ছাড়া বিশেষ চলতে পারে না। মণিব না খেতে দিলে খাবেও না, এমন অভিমান। আর মনিবের জন্য জান কবুল।
একটা কম্প্যুটরের দোকান, আর একটা পান, বিড়ি, চায়ের দোকান। এছাড়া অন্য কিছু নেই। রাস্তা সোজা উপরে উঠে গেছে। রাস্তার পাশে একদিকে পাহাড়ের গায়ে ফার্ণ ঘন হয়ে পাথরের রুক্ষতা ঢেকে দিয়েছে। পঙ্কজ বাইক থামিয়ে দু’টো চায়ের অর্ডার দিয়ে একটু সরে এসে দাঁড়িয়েছে। যাতে উপরের কটেজগুলোর অনেকটাই চোখে পড়ে। একদম উপরের ধাপে নিয়ন আলোর গ্লোসাইন-এ রিসর্টের নাম লেখা। নিচের রাস্তা থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, লেখা আছে ‘হেভেন হোকাস-পোকাস’। পঙ্কজ থাপা বলল, “এরকম আর একটি পুরনো রিসর্ট আছে এই রাস্তার উপরেই, একটু আগে। সেটির নাম ‘হলুম্বা হেভেন’।
নিচের ধাপের তিন ঘরের কটেজ চোখে পড়ছে এখান থেকেই রাবার গাছ, গোলাপ গাছ, আর ডালিমের লাল ফুলের ভেতর থেকে সবুজ সাদা রঙের কাঠ, কাচ আর টিনের ছাদের কটেজ বাড়ির সামনে মাথায় কাঠের আর্চের উপর ইংরেজিতে লেখা আছে ‘শ্যালে’।
পঙ্কজ থাপা বলছে, “শ্যালে মানে জানো তো, রাখালদের বাড়ি। মানে যারা ইউরোপে শীতের দেশে ভেড়া চড়ায়, তারা এরকম ঘরে থাকে।”
বোঁদের চোখে পড়ল সামনের ভাল করে ছাটা ছোট্ট ঘাসের লনে পুরনো দিনের রেল স্টেশনের কাঠের বেঞ্চের মতো বেঞ্চ পাতা। এখানে বসে সোজাসুজি তাকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা। আর বাড়িটার পাশ থেকে ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে পাথরের সিঁড়ি। তাতে কোথাও অল্প মাটির যোগ পেয়ে দুর্বো গাছ হয়েছে। কোথাও অল্প নাম না জানা গুল্ম। ওই পথের দু’পাশে অর্কিডের ফুলও ফুটে আছে।
“এই তো এখানটায়, মানে ওই যে পাথরের ধাপ নেমে এসেছে বাড়িটার মাথার কাছে, রাবার গাছটার নীচে ছবিটা উঠেছিল।” বোঁদের স্বরে খুব উত্তেজনা। সে চিনতে পেরেছে।
“বাঁদিকে গোল মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখের মহিলা হলেন পাহাড়ের এই অংশের মালকিন। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ঝর্ণা, আর প্রায় এক হাজারেরও বেশি অর্কিড আর প্ল্যান্টের অধিশ্বরী ম্যাডাম কর্মা। বাবা টি কর্মা পেম্পাহিশের কোনও ছেলে না থাকায় মেয়ে কর্মাই এই বিশাল সম্পত্তির মালিক। আর তার পাশে কাউবয় টুপিতে রয়েছেন তাঁর স্বামী।”
পঙ্কজ থাপার শেষ উচ্চারণের উত্তরে খানিকটা জোরে হয়ে গিয়েছিল বোঁদের কথা। “না না, উনি কর্মার হাজব্যান্ড হতে যাবেন কেন! লেপচা হতে যাবেন কেন! উনি তো আমাদের কিশানগঞ্জের বনবিহারী পান্ডে!”
“চেঁচিয়ো না। ওদের অফিস উঁচুতে হলেও, মানে তিন-চারটে ধাপের পরে হলেও কথাবার্তা খালি পাহাড়ে শোনা যায়।”
“একটু উপরে উঠে দেখা যাবে না? যদি কুকুরটা চোখে পড়ে, তুলে নিয়ে বাইকে চেপে চলে গেলেই তো হয়!”
থাপার মুখে একটা গালি এসে গিয়েছিল। দিল না। তেমন নৈকট্য নেই। বলল, “এটা পাহাড়। তোমার নিচের সমতল নয়। একটাই রাস্তা বের হবার। তিস্তা বাজারের পর ব্রীজের মুখ দরকার হলে ওরা আধবেলা আটবে দেবে তোমাকে ধরতে। লোকজন, নেতা, পুলিস— সব এদের পকেটে। যদি একজনেরও চোখে পড়ে ওদের কুকুর চুরি করে পালাচ্ছ, পাকদণ্ডি বেয়ে নেমে ঠিক পৌঁছে যাবে সেবকের মুখে। তারপর কুঁকড়ি আছড়ে পড়বে। কেউ কিছু বলার মতও কাউকে পাবে না।” 🍁(চলবে)

 

 

🍂গল্প| দুই 

 

ঋদ্ধিমা যেন আরও অনেক কিছু জানতে চায়। আরে তাকে লোকাল ডাক্তার দেখিয়েছে, ও ছেলে যা রোজগার করে সবই তো ওর পেছনে ঢালে। আমরা কত ওকে বারণ করেছি, “ওরে তুই একা মানুষ এইসব তুই সামলাতে পারিস?”

 

উমাশঙ্করের দুর্গা

মমতা রায় চৌধুরী

কাশ জুড়ে মেঘ জমেছে চারিদিকটা অন্ধকার হঠাৎ করে ওয়েদার কেমন বদলে গেল। ঋদ্ধি ছিল ঘরের ভেতর জানলা দিয়ে দেখছিল দূরের বটগাছটা। জানলা দিয়ে প্রায়ই এই গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন যুগান্তরের কোন পুরুষ ওখানে বাসা বেঁধেছে। চারিদিকে এতটাই জটা জুট ধারণ করেছে কেমন একটা রহস্যময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। আর ঠিক ওই বটগাছটার নিচে প্রতিদিন গিয়ে বসে থাকে উমাশঙ্কর। প্রথম প্রথম ওর নাম জানত না ঋদ্ধি পরে সাবিত্রী মাসির কাছ থেকে জানতে পেরেছে।
‘ও বাবা ওকে চেনো না?’
ঘর ঝাড় দিতে দিতে দ্রুতগতিতে ছুটছিল আর বলছিল।
মাসিকে আর কি বলবে ঋদ্ধি বাড়ি থেকে বেরোয়ই বা কতটুকু। যাইহোক চুপচাপ থেকে গেল।
‘ও একটা ক্ষ্যাপা ছেলে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা মারা যায়। বাবার কাছে থাকতো। বাবাটা একটা বড্ড মাতাল। এত জল ঢোকে নিত্য সে আর বাঁচে কি করে, মা মরা ছেলেটির দিকে তাকানোর সময় তার ছিল না।’
বাপরে কত চুল। ঘর মুছতে গিয়ে হাতে চুল পড়লে ভাল লাগে!‘
তারপর ন্যাতার জলটা ভাল করে না নিঙড়ে ন্যাতাটা মেলাতে মেলাতে বলল,
“ভগবান তাকেও তুলে নিল।
কপাল! ‘বলেই সাবিত্রী মাসির চোখ দু’টো ছলছল করে উঠল।
আর কিছু বলেনি সেদিন কিন্তু ঋদ্ধির মনের ভেতরে থেকে গিয়েছিল হাজারো প্রশ্ন।
ঠিক দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেল হবে তখনই সে বট গাছটার নিচে এসে বসত সঙ্গে থাকত একটা ছোট্ট বাচ্চা সারমেয়।
দু’জনে মিলে কত কথা বলত এখান থেকেই ঋদ্ধি বুঝতে পারত। কখনও দেখা গেছে ওই সারমেয়কে গলা জড়িয়ে ধরছে। কখনও বা পিঠের উপর উঠছে আবার কখনও দেখা যাচ্ছে উমাশঙ্কর ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। তারপর দু’জন পাশাপাশি বসে থাকত তাকিয়ে থাকত নীল আকাশের দিকে।শেষে বিকেলের পড়ন্ত বেলায় কামরাঙ্গা মেঘের মতো সূর্যের আলোটা যখন ঢলে পড়ত পশ্চিম দিকে, তখন তারা আস্তে আস্তে উঠে চলে যেত এটা ছিল নিত্যদিনের।

মেয়েকে সান্ত্বনা দিল বটে কিন্তু দিদিমার মনের ভেতরটাও একটা অসম্ভব কষ্টের সৃষ্টি হল। এ কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না কাউকে খুলে বলা যায় না কারণ এই কষ্টের অনুভূতিটা সবাই বুঝতে পারবে না।

ঋদ্ধিমা সাধারণ গৃহবধূ। সারাদিন বাড়ির ভেতরেই থাকতে হয় সংসারে কাজ কম নাকি! স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা যত্ন। বর বেরিয়ে যাবে তার অফিসের টিফিন গুছিয়ে দেওয়া সকালের খাবার রেডি করা সকাল থেকে তাকে কতটা নাস্তানুবাদ হতে হয়।তারপর তার একটা ছোট্ট বাচ্চা আছে। শ্বশুর-শাশুড়ি মা’কে টাইমে টাইমে খাবার দেওয়া তাদের ফাই ফরমাস খাটা অর্থাৎ যখন যেটা বলবে সেটা করে দেওয়া। সারা দুপুর এভাবেই চলতে থাকে তারপর দুপুরের খাবারের শেষে শাশুড়ি মা যখন রেস্ট করতে যান তখন ঋদ্ধি বিছানায় শুতে গিয়ে শুতে পারে না উঠে পড়ে ওই বটগাছটা কেমন যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই সে উঠে পড়ে জানলা দিয়ে তাকিয়ে থাকে আর উমাশঙ্কর ও তার সারমেয়টির খুনসুটি দেখতে থাকে। এরপর প্রজাপতির স্কুল থেকে ফেরার সময় হয়ে যায়। যখন শাশুড়ি মা উঠে পড়েন তখন সে জানলার কাছ থেকে সরে আসে। কি করে যে সময়টা পার হয়ে যায় বুঝতেও পারে না। হঠাৎই ক’দিন উমাশঙ্করও তার সারমেয়টিকে দেখতে পাচ্ছে না। কেমন যেন ঋদ্ধি র মনের ভেতরেও একটা ঝড় ওঠে কি হল ছেলেটির কিংবা কি হল সারমেয়টির? কদিন তো সাবিত্রী মাসি কাজেও আসছে না। কাকে জিজ্ঞেস করবে তবু আশার আলো সাবিত্রী মাসি কাজে আসলেই জিজ্ঞেস করবে। আজকাল যেন ঋদ্ধিমার অলস সময়টুকু কাটতে চায় না। হ্যাঁ সাবিত্রী মাসে বলেছিল তো উমাশঙ্করের ওই সারমেয়টির নাম দুর্গা। নামটাও কি সুন্দর। উমাশঙ্কর আর দুর্গা।
মনের ভেতরে হাজারো প্রশ্ন কিছু কি হলো? না,
না, না কি আর হবে হয়ত কোথাও বেড়াতে গিয়েছে। আহারে! একে তো বাপ মা মরা ছেলে।
ঋদ্ধির ভাই বেঁচে থাকলে এরকমই বয়সের হত
মনটা কেমন হু হু করে ওঠে।
“ও বৌমা, বৌমা, বৌমা।” ক্রমশঃ শাশুড়িমার আওয়াজ তীব্র হচ্ছে।
হঠাৎ তীব্র স্বর কানে পৌঁছাল ঋদ্ধিমার।
তড়িঘড়ি ছুটল শাশুড়ি মার ঘরে।
“কটা বাজে দেখেছ?
তোমার শ্বশুর মশাই তো বেরোবেন চা দিলে না এখনও।”
“এই দি মা।”
শ্বশুরমশাই বললেন, “আহা ওভাবে বলছ কেন রোজই তো টাইমেই দেয় একদিন…।”
শাশুড়ি মা কথাটা শেষ করতেই দিলেন না। বললেন, ‘এই তুমি থাম তো টাইমেই তো দিতে হবে। অভ্যাসটা ওর বদল করে দিও না’। যাও দাঁড়িয়ে রইলে কেন?এই তোমার বদ অভ্যাস।”
ঋদ্ধি রান্না ঘরে ঢুকল হঠাৎই মনে হল এই যা আজকে প্রজাপতি এখনও স্কুল থেকে ফিরল না কেন? চায়ের জলটা বসিয়ে দিয়ে ফ্রীজ থেকে আদা নিতে নিতে ভাবল ফোনটা একবার চেক করবে ফোন করেছিল কিনা।
হ্যাঁ ফোনটা চেক করে দেখে ফোন করেছিল কি হল কে জানে
একবার ফোন করল স্কুলে?
“হ্যালো…”
“হ্যাঁ বলুন…”
“প্রজাপতির স্কুল ছুটি হয়নি?”
“হ্যাঁ হয়েছে তো কিন্তু আপনাদের গাড়িটি আসেনি।”
“সে কি!”
“আপনাকে ফোন করা হয়েছিল ওকে নিয়ে যাবার জন্য।”
“ঠিক আছে আমি পাঠাচ্ছি।”
তাড়াতাড়ি রতনদাকে ফোন করল, “রতনদা আপনি প্রজাপতির স্কুলের দিকে থাকলে ওকে নিয়ে আসুন।”
এরপর চা করে শ্বশুরমশাই ও শাশুড়িমাকে দিতে গেলে
“কি হলো বৌমা প্রজাপতি ফিরল না”। শাশুড়িমার কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধপ করে উঠল।
“হ্যাঁ ওদের গাড়ি যায়নি আমি রতনদাকে পাঠালাম”।
“তাই বলি দিদিভাই তো এতক্ষণ এসে যায়। দুদিন অন্তর গাড়ির ছেলেটা ওরকম কামাই করে কেন কে জানে বাবা।”
ইতিমধ্যে সিঁড়ি দিয়ে সাবিত্রী মাসির ওঠার আওয়াজ পেল। সঙ্গে প্রজাপতি কথা বলা ভেসে আসল।
“এই দেখো প্রজাপতির মা, প্রজাপতি এসে গেছে।”
“তা তো বুঝলাম তুই এত কামাই করছিস কেন রে সাবী” কমলাসুন্দরী বললেন।
শাশুড়িমার কাছেই জব্দ সাবিত্রী মাসি, কেমন আমতা আমতা করে কথা বলল’ না মানে মাসিমা… আমাদের ওখানে উমাশঙ্কর বলে ছেলেটি বোধহয় পাগলই হয়ে যাবে।”
“তাতে তোর সাথে কামাই-এর কি সম্পর্ক।”
‘কি যে বল না মাসিমা!একই পাড়ায় থাকি, ওরকম হাহাকার দেখলে তোমারও কষ্ট হবে।”
ঋদ্ধিমা মুখিয়ে ছিল উমাশঙ্করের খবরটা জানার জন্য,
“কেন কি হয়েছে গো সাবিত্রী মাসি।”
ঋদ্ধিমার বুকের ভেতর কেমন তাঁত বুনে যাচ্ছিল।
“আর বোলো না ওই যে কুকুরছানাটি কেউ বোধহয় মেরেছিল। আহা রে, বেচারা নিজে খেতে না পেলেও কষ্ট করে হলেও ওর জন্য কত কিছু করত।অসুখ-বিসুখ হলে ডাক্তার দেখানো তারপর দুধ খাওয়ানো, কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে জানো আর সেই বাচ্চাটিকে আঘাত করেছে কে জানে বাচ্চাটা ঘাড়টা পুরো বেঁকে গেছে এইবার ছেলে তো পাগলের মত করছে।”
“তারপর কি হয়েছে?“
ঋদ্ধিমা যেন আরও অনেক কিছু জানতে চায়।
আরে তাকে লোকাল ডাক্তার দেখিয়েছে, ও ছেলে যা রোজগার করে সবই তো ওর পেছনে ঢালে।
আমরা কত ওকে বারণ করেছি ওরে তুই একা মানুষ এইসব তুই সামলাতে পারিস?”
“সেই তো…” ঋদ্ধিমা বলে।
“কি বোলতো জানো বৌমা?”
“বলতো মাসি আমার যদি দু’বেলা দুটো অন্ন জোটে তা এই বাচ্চাটাকে আমি খাওয়াতে পারব না। অবলা জীব দেখলে কেমন কষ্ট লাগে গো আমার ভেতরটা কেমন হাহাকার করে। ওদের জন্য যদি কিছু করতে পারি তাহলে আমার মনটা খুব ভালো থাকে।”
“কত বড় মনের মানুষ বল তো বৌমা।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ সে তো ঠিক কথাই। আজকালকার দিনে কেইবা করে। যাদের এত আছে তারাই কিছু দেয় না।”
ওই বাচ্চাটাকে খাবার দেওয়া নিয়ে কত কথা ওকে শুনতে হয়। “এই পটি করেছে, এই হিসু করেছে কেন? এই তো দুর্গা পটি করেছে। তোর দুর্গা হিসু করেছে। নালিশের পর নালিশ। কিন্তু বেচারা মুখ বুজে সব সহ্য করত পরিষ্কার করে দিত। তারপরেও কেন মানুষের এত জ্বলুনি ধরেছিল কে জানে।”
“এইজন্য ক’দিন ধরে এই বটগাছটার নিচে এসে বসতে দেখিনা গো মাসি।”
“দেখবে কি করে? ওতো লোকাল ডাক্তার দেখিয়েছে। কিন্তু কিছুই করতে পারেনি। তারপর শেষ পর্যন্ত চন্দননগর নিয়ে যাবে বলে ঠিক করল গাড়ি ও ভাড়া করেছে নিয়েও গেল কিন্তু ওকে বাঁচাতে পারল না।”
আহা রে! কি মায়া শরীর ছেলেটার। আসলে ছোট থেকে মা-বাবা সবাইকেই হারাল। বেচারা এখন একেও হারাল। ওর ভেতরে যে শূন্যতা সেটা কি করে মিটবে বলো?”
‘নে তোকে আর মেলা বকতে হবে না কাজে হাত দে।” কমলা সুন্দরী ঝাঁঝের সুরে বললেন।
“দেখলে বৌমা তোমার শাশুড়ি মার কি কোন মন নেই গো।”
ঋদ্ধিমা শুধু চোখ টিপল
“প্রজাপতি এসো ইউনিফর্ম ছাড়িয়ে দিই। একি আজকে তোমার টিফিন পড়ে আছে কেন?”
“ম্যাম আজকে খাইয়েছেন।”
“কোন ম্যাম! “
“ওই যে তৃপ্তি ম্যাম। “
“কেন?”
আজকে ম্যামের জন্মদিন ছিল।”
“তা বেশ তা বলে ওইটুকু টিফিন খেতে পারনি।”
“সেটা বলব না” বলেই নাচতে নাচতে চলে গেল ওয়াশরুমে।
সাবিত্রী মাসি বাসন মাজতে মাজতে বলতে লাগল কি জানি ছেলেটার মনটা কবে ঠিক হবে কে জানে।”
বলেই সাবিত্রী মাসির ও-চোখ দু’টো জলে ভরে উঠল।
“দুর্গাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার আগেই তো মারা যায় সেই দুর্গাকে ফেরত নিয়ে আসে তারপর তাকে মালা পরিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়।”
“হ্যাঁ, খুবই প্যাথেটিক”।
আর বলতে থাকে আর আসিস না মা এই পৃথিবীতে। এখানকার মানুষ সব অমানুষ তোকে বাঁচতে দিল না কেউ। এত দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে আসিস না তোর মুক্তি হোক আলোয় আলোয়। আমিও যদি তোর সঙ্গে এইভাবে মুক্তি পেতাম”।
“কি বলছ গো মাসি”…
“তাছাড়া কি বলছি বৌমা!”
কত বোঝাচ্ছি যে ওর যেটুকু আয়ু নিয়েছিল সেটুকুই তো পাবে।”
“জন্ম মৃত্যু বিধাতা এসব ঈশ্বরের লীলা।”
“ও মানতে নারাজ।”
বলতে থাকে মাসি ভগবান আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছে আমি এই অবলা প্রাণীটাকে ঘিরে বাঁচার স্বপ্ন দেখতাম। ওর কত কথা বলত আমার সঙ্গে জানো? আমি সব কথা ওর বুঝতাম আমার দুঃখ কষ্ট ও আমাকে সোহাগে আদরে ভুলিয়ে দিত। সারাদিন কাজ করে আসার পর ওর জন্য আমার বাড়ি ফেরার একটা তাগিদ থাকত।”
আজ ও নেই আমার বাড়ি ফেরার কোনও ইচ্ছেও থাকে না। মানুষ তো বেইমান। কিন্তু ওরা বেইমান নয় ওরা যাকে ভালবাসে প্রাণ দিয়ে ভালবাসে, বিশ্বাস করে। আমি কি করে থাকব কেন আমার দুর্গাকে এভাবে মারল আমি তো যার যেখানে পটি হিসু করে আমি সব পরিষ্কার করে দিই তারপরে কেন ওকে মারল মাসি।”
“সত্যিই তো তাই একটা অবলা জীব তাকে মারে কি করে এরা কি মানুষ!”
“তাহলেই বোঝো বৌমা।”
“না গো মাসি, ছেলেটার একটু যত্নআত্তি কর তোমরা।”
“সে তো করব কিন্তু আমরাও তো পাঁচ বাড়ি কাজ করে খাই কতক্ষণ ওকে সময় দেব বল।”
“না যাই আমরা ক’য়েকজন মিলে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করছি তবে আমরা জানি কে মেরেছে জানো বৌমা।”
“কে মেরেছে গো?”
“কি বলব তোমাকে আমরা ছাপোষা মানুষ বড়লোক মানুষের সঙ্গে আমরা পেরে উঠব? তবে এ কথাটা ওকে আমরা বলিনি। ও তো এখন পাগলের মত দেখলে হয়ত তাকেও আঘাত করে বসবে। ওর তো সে হুশ নেই। ওর প্রিয়জনই তো ছেড়ে চলে গেছে।”
“ঠিক।”
“ও এখন হিংস্র হয়ে উঠতে পারে তাই আমরা ওকে কিছু বলিনি।।”
“তবে দেখো, বৌমা যে মেরেছে ওরা শাস্তি পাবেই পাবে। এই তো কিছুদিন আগেও দুর্গার গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছিল সে নিয়ে কম হল।
তার দু’দিন পরেই সে বাড়ির করতাম আর ভীষণ শরীর খারাপ।”
“না চললাম গো বৌমা।”
“হ্যাঁ মাসি এসো। “
মাসি চলে যাবার পর ঋদ্ধিমা ওই বটগাছটার দিকে আবার তাকালো বিকেলের পড়ন্ত কামরাঙ্গা আলোয় আজও সুন্দর একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু আজকের পরিবেশটা যেন সবই বেমানান সেখানে নেই উমাশঙ্কর আর তার দুর্গা ওই বটগাছটার কাছে যখন উমাশঙ্কর আর দুর্গা এসে বসতো, সেই জায়গাটাই যেন আলাদা লালিত্য দান করত।
উমাশঙ্কর আর দুর্গার কথা মনে করে ঋদ্ধিমার ও দু’চোখ জলে ভরে উঠলো। তার মেয়ে প্রজাপতি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের চোখে জল দেখে হাজারো প্রশ্ন।
“ মা তুমি কাঁদছো কেন?”
মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল “এমনি মা।”
“না, না আমি টিফিন খাইনি বলে।”
“না, না অন্য কারণে তোমার মনে কষ্ট হয়েছে মা
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যাঁ কষ্ট হয়েছে।”
“কিসের কষ্ট মা দুর্গার জন্য।”
“ও মা দুর্গার জন্য। মা দুর্গার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে।”
হ্যাঁ।”
মা দুর্গা তো দেবী তারা তো সবকিছুই কষ্ট দূর করেন তাহলে আমার মায়ের চোখে জল কেন দূর করছেন না।”
“না মা এ দুর্গা সে দুর্গা নয়। এ দুর্গা একটি কুকুরের নাম।”
“কুকুর!”
“হ্যাঁ।”
“সে কোথায় থাকত?”
“না চলো তোমাকে একদিন ওর কথা বলব এখন তুমি চটপট দুধ খেয়ে নাও তো একটু পরে তোমাকে পড়াতে চলে আসবেন তোমার টিচার।” মেয়েকে সান্ত্বনা দিল বটে কিন্তু ঋদ্ধিমার মনের ভেতরটাও একটা অসম্ভব কষ্টের সৃষ্টি হল। এ কষ্ট কাউকে বোঝানো যায় না কাউকে খুলে বলা যায় না কারণ এই কষ্টের অনুভূতিটা সবাই বুঝতে পারবে না।
শুধু ঋদ্ধিমা বলল “ভালো থেকো দুর্গা, না ফেরার দেশে। ভালো থেকো।” 🍁

 

🍂গল্প | তিন 

 

এখন মনে হয়, সবই হয়ত স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন কুয়াশার মতন মিলিয়ে গেল। কেন? কারণ ভগবান চায়নি। আর ঠিক সেই সময়েই সৌরভ এসেছিল। সৃষ্টির বাবার শ্রাদ্ধের কিছুদিন পর।

 

ফিরে দেখা আলো

রুনা লাইলা

 

সৃষ্টি ঘুমিয়ে ছিল। জানালার বাইরে ধানক্ষেতের ওপর রাতের জ্যোৎস্না ধীরে ধীরে নেমে আসছিল। বর্ধমানের এই গ্রামটা যেন একটা জীবন্ত সান্ধ্য কাব্য। সেখানেই ব্যথা, স্মৃতি আর নিঃসঙ্গতা মিলেমিশে আছে।
জমি-জায়গা, ধানচাষ, সেচ, গরু সবকিছুর দায় এখন সৃষ্টির ওপর। প্রথমে দাদা, তারপর বাবা দু’জনেই চলে গেল হঠাৎ। জীবন কেমন যেন থেমে গেল। একটা সময় ছিল, যখন বউদি এই ঘরে হাসিমুখে রান্না করত। অথচ দাদার মৃত্যুর পরে সে যেন আর থাকতে পারেনি। একদিন চুপিচুপি চলে গিয়ে বিয়ে করল অন্য কাউকে। ঠাকুমা বয়সের ভারে কিছুই বোঝেন না প্রায়, শুধু মাঝে মাঝে হাত ধরে বলতেন, তুই আছিস বলেই তো চলছি রে মা…। এখন চুপ। একদম চুপ।

একটা পাতা খসে পড়ল। দূরে শালিক ডেকে উঠল। সৃষ্টি প্রথমবার সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠাকুমা এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখানে বসে থাকো, আমি চা এনে দিচ্ছি। সৌরভ হাসল, সেই পুরনো হাসি। যেন অনেক যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া আলোটা আবার ফিরে এসেছে।

দেখতে গেলে, সৃষ্টির জীবনটা অন্যরকম হতে পারত। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে কলেজে বসে থাকার কথা, বান্ধবীদের সঙ্গে আড্ডা আর চায়ের কাপের খচখচানি, শেষ ক্লাস করে বাসে বাড়ি ফেরা। এখন মনে হয়, সবই হয়ত স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেই স্বপ্ন কুয়াশার মতন মিলিয়ে গেল। কেন? কারণ ভগবান চায়নি।
আর ঠিক সেই সময়েই সৌরভ এসেছিল। সৃষ্টির বাবার শ্রাদ্ধের কিছুদিন পর। সাদা পাঞ্জাবি পরে, হাতে একটা ছোট ফুলের তোড়া, চোখে অপরাধবোধের ছায়া।
বলেছিল, এই তোমাকে চিনতে পারছি না… এই তুমি সেই তুমি? তুমি আমার সঙ্গে চলো, বলেছিল সৌরভ। ওর গলা যেন একরাশ কুণ্ঠায় ঢাকা।
সৃষ্টি সেদিন কিছু বলেনি। শুধু একবার নীরব হেসে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। সৌরভ হয়ত বুঝে গিয়েছিল, সৃষ্টির জীবনে আর জায়গা নেই তার জন্য।
তারপর সময় পেরিয়ে গিয়েছে। চাষের জমি, দিনমজুর, রাতের নোনা ঘাম, বর্ষায় জল জমে যাওয়ার উৎকণ্ঠা, এইসবই এখন সৃষ্টির জীবন। মাঝেমাঝে যদিও সৌরভ মেসেজ পাঠাত। ফোন করত। কখনও শুধু এক লাইন, আকাশটা আজ খুব নীল মনে হচ্ছে, তোমার কথা মনে পড়ছে। আবার কখনও হয়ত একটা ছবি, কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের, অথবা শান্তিনিকেতনের কোণার কোনও রাস্তার।
কিন্তু সৃষ্টি কোনওদিন উত্তর দেয়নি। সে জানে, উত্তর দিলে তার মন ভেঙে যাবে। নিজের ভিতরে তৈরি করা এই নিষ্প্রভ অথচ স্থিত পৃথিবীটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

সন্ধেবেলা। ঠাকুমার ওষুধ দিয়ে এসে সৃষ্টি উঠোনে বসে ছিল। চারপাশে জোনাকির কিচিরমিচির আলো। দূরে একটা বাঁশঝাড়ের মাথায় নিশাচর পাখির ডাক।
হঠাৎ গেট খুলে কেউ ঢুকল। সৃষ্টির বুক ধক করে উঠল। লাইটের নিচে দেখা গেল সৌরভ।
সাদা শার্ট, প্যান্টে ধুলো, মুখে ক্লান্তি। কিন্তু চোখে সেই পুরনো আলোটা। যেন এক পৃথিবী হেঁটে এসেছে সে, এই উঠোনে এসে থামল।
তুমি? সৃষ্টি অবাক হয় না। অনেকদিন পরে দেখা হলেও অবাক নয় ও।
হ্যাঁ, আমি। আজ আর মেসেজ না। ফোন না। সামনে এসে বলব বলে এলাম।
সৃষ্টি চুপ করে রইল। দু’জনের মাঝে নীরবতা জমতে লাগল।
সৌরভ ধীরে ধীরে বলল, আমি জানি, তুমি এখানে থাকো নিজের ইচ্ছেতে না। তুমি জীবনটাকে আগলাচ্ছো, যেন একটা জমা দায়িত্ব। কিন্তু সৃষ্টি, এইভাবে বেঁচে থাকা কি সত্যিই বেঁচে থাকা?
সৃষ্টি তাকিয়ে রইল। চোখে জল নেই, কিন্তু ভিতরটা কাঁপছে।
তুমি জানো, আমি অপেক্ষা করেছিলাম। ভাবতাম, একদিন তুমি আসবে। কিন্তু তুমি আসোনি। আজ আমি এলাম। কারণ বুঝেছি, যদি আর দেরি করি, তোমার জীবনে আমি থাকব না।
সৃষ্টির ঠোঁট কেঁপে উঠল। তুমি জানো না, আমি কী কী ছেড়েছি। কী কী ভুলেছি। সব কিছু পেছনে ফেলে আবার শুরু করা এত সহজ?
সৌরভ এগিয়ে এল। তুমি বলো, তোমার ঠাকুমা আমার মা হয়ে থাকবেন। এই বাড়ি আমার বাড়ি হবে। ধানখেত, কাকভোরের হাওয়া, সবই তোমার সঙ্গে ভাগ করে নেব।
সৃষ্টি ধীরে ধীরে বলল, আর যদি একদিন তোমার ক্লান্তি আসে? যদি মনে হয়, শহরের জীবন ভাল ছিল?
সৌরভ এক পা এগিয়ে এসে বলল, তখন আমি তোমার কাঁধে মাথা রেখে বলব, সৃষ্টি, চলো, ধানখেতে হাঁটি। আমি ফিরে যাব না, আমি এসেছি থাকতে।

একটা পাতা খসে পড়ল। দূরে শালিক ডেকে উঠল।
সৃষ্টি প্রথমবার সৌরভের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠাকুমা এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। এখানে বসে থাকো, আমি চা এনে দিচ্ছি। সৌরভ হাসল, সেই পুরনো হাসি। যেন অনেক যুগ আগে হারিয়ে যাওয়া আলোটা আবার ফিরে এসেছে।
সৃষ্টির চা-পাতা গরম জলে ছেড়ে দিতে দিতে হঠাৎ মনে হল, এই জীবনটা কি তবে আবার শুরু হতে পারে? ধানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়া সন্ধ্যে, দু’জনে একসঙ্গে মাঠে যাওয়া, ক্ষেত দেখা, আলপথ ধরে হাঁটা, ঠাকুমার হাসি, সন্ধের পর ঘরের আলোয় বসে গল্প শোনা? হয়ত, এইবার ভগবান অনুমতি দেবেন।
পরদিন সকালে, প্রথম সূর্যের আলোয় ধানক্ষেত ঝিকমিক করছিল। সৌরভ আর সৃষ্টি একসঙ্গে মাঠে যাচ্ছিল। ছোট কুঁয়ো থেকে বালতিতে জল তুলতে তুলতে ঠাকুমা, গান গাইছিল,
“তুই যদি রে কান্দিস নে, জীবন একদিন হাসবে রে…”
এই আর একটা নতুন সকাল শুরু হল বর্ধমানের ওই চুপচাপ গ্রামে।
নতুন জীবন, পুরনো আলো।
সৃষ্টির গল্পটা এবারও ফেলে রাখা হল না। সে আবার শুরু করল। জমির ফাঁকে, ধানের পাতায়, আর একজন অপেক্ষমান ভালবাসার পাশে।🍁

 

 

 

অমিত পাল-এর গুচ্ছ কণাগদ্য 

:

আমি হয়ে উঠি

ভেজা ভেজা শীতল সন্ধ্যা নেমে আসে যখন পাড়ার মোড়ে, আমি সন্ধ্যার রাগ মিশিয়ে চা-এ চুমুক দি৷ হঠাৎ হৃদয়ের দেরাজ খুলে বেরিয়ে আসে অতৃপ্তির সুর…। জ্যোৎস্নার মধ্যে আকস্মিক ভাবে যেমন বিদ্যুতের ঝলকানি চোখে পরে, তেমনই তোমার হাসির আশার মধ্যে নৈরাশ্য প্রবেশ করে৷ এক ঘন্টা নয়৷ মিনিট পনেরো হবে হয়ত! আমি এই কিছু মুহূর্তের জন্য বাড়ির বাইরে বের হই৷ সন্ধ্যার তপ্ততা খুঁজি শীতের অবকাশে৷ অথচ তা শুধু বেমালুম ভুল প্রত্যাশা মাত্র…। সকালটা আমার একটু অন্যভাবেই কাটে৷ সংসারে যে টানাপোড়েন আমার অদৃশ্যে চলছে তা আমি এই প্রত্যুষে ভুলে যায়৷ ঘুম চোখে ওঠা এই সময়টুকু আমি আমার মতো৷ বিষাদ রাত্রির খাওয়া শেষ হলেই আমি যেন এক অন্য আমিতে পরিণত হই৷ নিজেকে চিনতে পারি নিজের মতো করে৷ তখনই আমি হয়ে উঠি…

 

 

খোলস বিবৃতি

ছেলেটি সাপের খোলস দেখে আঁতকে উঠেছিল৷ সে ভাবেনি শীত ঋতুতে এমনটা আজ হতে পারে! সে সর্ন্তপণে এগিয়ে গেল,একটি কাঠি নিয়ে খোলসটিকে সেখান থেকে সরিয়ে দিল৷ তার কাজ ছিল যে নিজেদের ঘরের ধান গুলোকে শীতের মেঘের উপদ্রব থেকে আড়ালে সুরক্ষিত রাখা৷ পলিথিনের আবেশ জড়াতে জড়াতে এমন ঘটনা ঘটতে পারে তা সে বুঝতে পারেনি৷ তাই বিস্ময় হওয়াটাই স্বাভাবিক৷ বংশবিস্তারটি এমন ভাবে ঘটে যাবে তা সে কোনদিনও কল্পনায় উপলব্ধি করতে পারেনি৷ ধান গুলিকে তাদের খামার বাড়িতে তিন দিন আগে এনে মজুত রাখা হয়েছিল৷ শীতকালের মেঘ দেখে আজ এই সাবধানতা…। খোলসগুলিকে সে প্রত্যক্ষ করতে করতে মনে মনে পরীক্ষা করেছিল এখানে একটি নয় দুটি সাপের খোলস আশ্রয় গ্রহণ করেছে৷ সে আরও ভেবেছিল শীতকালে এত তাড়াতাড়ি কীভাবে অপ্রত্যাশিত জায়গায় তাদের বিচরণ ঘটতে পারে! এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত…

 

সর্বনাশ দেখি

র্পণের অপর প্রান্তে পারদ অন্তরালে লুকানো থাকে সর্বজন ত্রুটি বিচ্যুতি৷ তাই নিজেকে যখন আয়নার সামনে নিয়ে যায়, জানোয়ার বলে মনে হয়৷ পাষণ্ড সমাজ – অমানসিকতার অবলীলা ক্রম, হিংস্র হাসি গুলি আছড়ে পড়ে৷ বিকৃতি গুলি ধামাচাপা দেবার শেষ রাত্রি, বিগলিত আশা গুলি শুধু হৃদয়ে প্রস্ফূটিত৷ আমি ব্যঙ্গ করি নিজেকে৷ চোখের তারাতে নিজের সর্বনাশ দেখতে পাই…

 

নবরূপ পেয়েছে সে

ছেলেটা হঠাৎ কেঁদে উঠে ছিল৷ বুকে জন্ম নিয়েছিল অদৃশ্য নীল আগুন৷ রক্ত তঞ্চন শিরায় শিরায় বিষের সঙ্কেত জানাচ্ছিল৷ সে একটু একটু করে পা ফেলছে৷ তাৎক্ষণিক গতি৷ এগিয়ে যাওয়ার পথে আলো বলতে কিছু ছিল না৷ পুরোটাই নিদারুণ অন্ধকার৷ সে জেনে গিয়েছে, আজ সে বঞ্চিত সব কিছু থেকে৷ কিন্তু কালই ফিরে পাবে সব৷ তার ফুসফুস ভরা রক্তমাংসের উঠানে জন্ম নিচ্ছে নতুন ভাবে বাঁচার চারাগাছটি৷ সে আবার হারিয়ে গেল নতুন আবেশে, নতুন আবেগে৷ ভেঙে ফেলছে সীমাবদ্ধ সভ্যতা৷ বসন্তের খোঁজ পেয়েছে সে৷ আর পলাশ বনটিতে দেখতে পেয়েছে হলুদ তুলিটি আলপনায় মত্ত…

রাত এসেছিল নতুন ভাবে৷ চন্দ্রও হেসেছিল ক্ষণকাল৷ গোলাপী সূর্য্যের দেখা মিলল যে…

 

নারীত্ব

পুরুষেরা ঘর সাজাতে ভালো জানে না৷ আসলে এই বিষয়ে সঠিক আইডিয়া এদের মাথায় খেলে না৷ এই ঘর সাজানোটা নারীর হাতেই মানানসই৷ আসলে এই কাজে তারা জন্মগত দক্ষতা অর্জন করে থাকে৷ তাই হয়ত ঘর সাজানোর অনুভূতিটা এদের মধ্যেই সত্বর জেগে ওঠে৷ ছেলেরা অবশ্যই চাই ঘর সাজাতে৷ তবে নারীদের মতো সাজানো তাদের কাছে অসম্ভব৷ আসলে কোনও এক নৈঃশব্দের মন্ত্রে নারীরা এই কাজে পারদর্শী৷ তারা জন্মজন্মান্তর ধরে এই সাজানোর কাজটির উপযুক্ত শক্তি পেয়ে থাকে ঈশ্বরের কাছ থেকে৷ তারা হল সমাজের এক সম্পদ৷ তাদের ব্যতীত এই সমাজ অচল৷ পুরুষের প্রয়োজন ঠিকই কিন্তু নারীর গুণও সমপরিমাণ৷ শাসনটা তাই পুরুষতান্ত্রিকতার নয়, নারীর মানসম্মান নিয়ে ভাবা হোক এবং তাদের দেওয়া হোক সমমর্য্যাদা৷

আসলে পুরুষ ও নারী হল সমাজ রক্ষার ক্ষেত্রে একই মুদ্রার দুই পিঠ…🍁

 

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার,  কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকারঅঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read