Sasraya News

Sasraya News | Sunday’s Literature Special | Issue 61 | 20 April 2025 | সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২০ এপ্রিল ২০২৫| সংখ্যা ৬১

Listen

সম্পাদকীয়

মরা নিজেদের মানুষ বলি। যেমন বলি আলো, জল, আগুন, মাটি, গাছ, পাখি, বাড়ি-ঘর ইত্যাদি। কিন্তু, বিষয় হল যে, এই পৃথিবী জুড়ে এখনও অনেক গভীর তত্ত্ব লুকিয়ে আছে যা খুঁজে প্রকাশ করতে হয়ত  আরও চার লক্ষের বেশি বছর লেগে যেতে পারে। হয় তো অনেক তত্ত্ব খুঁজে পাওয়া নাও যেতেই পারে। কারণ, গোপনে লুকানো যে শক্তি তার গভীর অনুভূতিগুলো শুধু আঁচড় কেটে কেটে ঘুরে বেড়াই।  আর তা মানুষের শত্রু ও মিত্র। ভাবতে গেলে অবাক হতেই হয় যখন কেউ এমন কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলে তার আত্মদর্শনের গভীরতা নিয়ে অনেক মিত্র পক্ষও শত্রু পক্ষে রূপান্তর ঘটে। এই জটিল বিষয় ঠিক পিপাসার মত। খেয়ে যাবে পিপাসা মিটল ভেবেও বোকা বনে যেতে হয়। হা হা হা। যদি বলি যে,
মন, প্রাণ ও আত্মার সম্পর্ক একটি জটিল এবং গভীর বিষয়, যা মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই সম্পর্কের বিশ্লেষণ কেবল তাত্ত্বিক নয়, বরং তা আমাদের দৈনন্দিন জীবন এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। মন, প্রাণ এবং আত্মা এই তিনটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে মিলে মানুষকে পূর্ণতা দেয়, এবং তাদের মধ্যে সম্পর্ক বোঝা না গেলে মানুষ নিজেকে সঠিকভাবে বুঝতে সক্ষম হয় না। এই সম্পাদকীয়তে মন, প্রাণ ও আত্মার সম্পর্ক এবং তাদের প্রাসঙ্গিকতা জীবনে কীভাবে চিত্রিত হয় তা সামান্য বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছি।

 

 

মন নিয়ে যদি কিছু বলি তাহলে বলতেই হয় প্রথম মানুষ মানে, মানব মন একটি অত্যন্ত জটিল এবং নানাবিধ অনুভূতির আধার। এটি শুধু চিন্তা, অনুভুতি এবং আবেগের সংকলন নয়, বরং আমাদের সচেতন এবং অচেতন চেতনার জন্য এক মূল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। মন একটি সেতু, যা আমাদের চিন্তা ও জ্ঞানের মাধ্যমে আমাদের আত্মাকে পৃথিবীর বাস্তবতার সঙ্গে সংযুক্ত করে। মন কখনও শান্ত থাকে, আবার কখনো বিশৃঙ্খল, কিন্তু এটি সবসময় মানুষের আচরণ ও সিদ্ধান্তের প্রভাব বিস্তার করে। ভালবাসার আস্তরণ, বোধ ও জ্ঞানের ঘর। আলোর থেকে আসা জ্ঞানের উৎসের প্রথম শক্তি বিকাশের একটি অদ্ভুত গুণ। ভালবাসা প্রেম সম্পর্ক এমনকি খুনের মত প্রক্রিয়াগুলো এই মনই নির্ধারণ করে। যদি বলা যায় তবে এই ভাবেই বলব যে, মনেরই কিছু শক্তির দ্বারা। মন আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কখনও সৃজনশীলতা সৃষ্টি করে, আবার কখনও আমাদের ভয়, দুঃখ এবং রাগের মতো নেতিবাচক অনুভূতি জন্ম দেয়। মন আমাদের চিন্তাধারা গড়ে তোলে এবং আমাদের মনের গভীরে লুকানো অজ্ঞতা ও নস্টালজিয়া জীবনের পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে, মন যদি শক্তিশালী ও সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি আত্মবিশ্বাস এবং সুখী জীবনযাপনের পথ খুলে দেয়।

প্রাণ, এই শক্তি এক অদ্ভুত শক্তি। প্রাণ প্রাণীর শক্তি যে প্রাণ নিয়ে আলোচনা করছি তা মানুষের প্রাণ। এই প্রাণ, মানব জীবনের শক্তি, যা শরীরের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে তাকে জীবিত রাখে। প্রাণ শারীরিকভাবে আমাদের পেশী, অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এবং স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রাণের অভাব হলে শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো কাজ করতে পারে না, এবং তখন জীবনের অস্তিত্বও ম্লান হয়ে যায়। প্রাণের শক্তি শুধু শারীরিক নয়, বরং এটি মানুষের অনুভূতি এবং মনের শক্তির সঙ্গেও সম্পর্কিত। প্রাণ, শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মাধ্যমে মনকে শক্তি প্রদান করে, এবং মন প্রাণকে পুনরুজ্জীবিত করে। এটাও একটি চক্র। যা প্রতি নিয়ত ঘুরছে। আমরা বুঝতে পারি না। আর বুঝলেও তা প্রকাশ করতে পারি না। যদি বলি যে, আমাদের চেতনা শক্তিকে প্রাণের দ্বারা রূপপ্রদান করি মন সেখানে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। তাহলে আমাদের পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, মন ও প্রাণের মধ্যে  একটি গোপনীয়তা কাজ করে। যদিও
বিভিন্ন ধর্মীয় ও দর্শনীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাণের সংজ্ঞা আলাদা আলাদা হতেই পারে। কিন্তু প্রথম শক্তিকে কেউই আলাদা আলাদা দেখানোর চেষ্টা করলেও বৃথাই হবে। এবং তা অপূর্ণই থেকে যাবে। যদিও, অনেক দর্শনবাদী এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে প্রাণকে এক আত্মিক শক্তি হিসেবে দেখা হয়, যা, শরীরের মৃত্যু পরবর্তীকালেও অব্যাহত থাকে। এটি জীবনের একটি পরিপূর্ণ সত্ত্বা হিসেবে বিবেচিত হয়, যা, মন এবং আত্মার মধ্যে এক বিশেষ মাধ্যমের কাজ করে। এই বিশেষ শব্দটিই আসলে গোপন শক্তি। যা কোনও শক্তিযন্ত্র দ্বারা বা কোনও আধুনিক বিজ্ঞানচর্চার দ্বারাও প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি কেও তা সম্ভব করবার চেষ্টা করেন তা কখনওই সফল হবে না বলেই আমার প্রকাশ।

 

 

অন্যদিকে আত্মা নিয়ে বলতে গেলে বলতে হয় যে, আত্মা হল, মানুষের অমর এবং অদৃশ্য শক্তি। এটি আমাদের সত্তার গভীরে বাস করে এবং আমাদের জীবনধারা, চিন্তা, বিশ্বাস এবং অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। আত্মা মূলত একটি অতিপ্রাকৃত এবং অদ্বিতীয় সত্ত্বা, যা আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে আমাদের সঙ্গে থাকে। আত্মার প্রকৃতি এবং অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবী জুড়ে বহু তাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় মতবাদ রয়েছে। আত্মার প্রকাশ শক্তি একটি ইলেকট্রিক বাতির জ্বলে উঠার মত ক্ষমতা বোঝায়। কিন্তু, এটা একটি অতি সাধারণ উদাহরণ বলা যেতে পারে। কোনও ব্যক্তি প্রাণ ত্যাগ করবার সময় কালে আত্মার হারিয়ে যাবার পরিষ্কার বিশেষ প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। বলা যায় যে, আত্মা আমাদের জীবনচেতনার এক অতিপ্রাকৃত অংশ, যা সত্য, ন্যায় এবং প্রেমের প্রতি আকর্ষিত। বিভিন্ন ধর্মে আত্মার অস্তিত্বকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। যেমন, সনাতন হিন্দু ধর্মে আত্মাকে ব্রহ্মের অংশ হিসেবে দেখা হয়, যা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বিচরণ করে। খ্রীষ্টান ধর্মে আত্মাকে ঈশ্বরের সৃষ্টি হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যা মৃত্যুর পর পরলোকের দিকে চলে যায়। ইসলামেও আত্মার এক অমরত্ব ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হয়। এই সব কথা উল্লেখ করলে দেখা যায় যে মুল তত্ত্ব একই এবং এই ধর্ম বিষয়টিই ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে মুল বিষয় কে নানান মতে ফেলে মিকচার করে পরিবেশন করছে। মুল বিষয় এবং প্রকৃত সম্পর্ক এক যেনেও অন্ধ করে রাখবার প্রকৌশল তৈরী করছে বিশেষ বিশেষ ধর্মগুরুরাই। এটা আর কিছুই নয় একনায়কতন্ত্র। সামাজিক শক্তি বাড়ানাও কৌশল মাত্র। কখনওই ভুলে গেলে চলবে না যে, আমাদের অস্তিত্ব এবং সৃষ্টি ও প্রকাশ শক্তি। ধর্মের সৃষ্টি তো সে দিনের কথা। এই বিষয়টি কারওরই বোধে উপস্থিত হয় না এমন কি হতে দেওয়া হয় না। কারণ যদি মন, প্রাণ, আত্মার মিলন ক্ষেত্র যদি শান্তি হয় তা হলে মানুষ বা মানব শক্তি কেন ধর্ম কেন্দ্রীক হবে। লক্ষ্য রাখতে হয় সমাজতন্ত্রের দ্বারা এই বিশেষ ধর্ম বা ধারণা সৃষ্টি ঘটেছে। কিন্তু, এটা ভুলে গেলে চলবে না যে মন, প্রাণ ও আত্মা এরা কেউই ধর্ম নিয়ে আসেনি। ব্যক্তি স্বার্থ রক্ষা করতে এর উৎপত্তি ঘটে। যা আজ পৃথিবীর চরমতম অশান্তির কারণ হয়ে উল্লেখ হচ্ছে। মন, প্রাণ ও আত্মার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এই সমস্ত কথা উল্লেখ করবার বিষয় হল যে, যারাই এই সম্পাদকীয় পড়বেন তাদের নিজেদের ভুল থেকে অতি ভুল কিছু সংশোধন করতে পারবো বলেই আমার প্রকাশ।
এখন, আবারও আমাদের আলোচনার মূল অংশেই আসা যাক। মন, প্রাণ ও আত্মার সম্পর্ক নিয়ে নানাজন নানান কথা বলে থাকেন। তবে আমার কাছে এই তিনটি উপাদান একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং একে অন্যের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে থাকে। ফলে, মন আমাদের চিন্তা এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, আর, প্রাণ আমাদের শারীরিক এবং অনুভূতিগত শক্তি প্রদান করে, এবং আত্মা আমাদের অমর এবং আধ্যাত্মিক সত্তার অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে কাজ করে।
মনের সিদ্ধান্ত এবং আবেগ প্রাণের উপর প্রভাব ফেলে। যখন আমরা কোনও দুঃখজনক চিন্তা বা অনুভূতি ধারণ করি, তখন আমাদের শরীরের সিস্টেমেও প্রভাব পড়ে। এতে হরমোনের নিঃসরণ বৃদ্ধি পায়, এবং শরীরের শক্তি এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়। কিন্তু যদি মন শান্ত থাকে এবং পজিটিভ চিন্তা ও আবেগ থাকে, তাহলে প্রাণ শক্তিশালী এবং কার্যক্ষম থাকে। এর মাধ্যমে, আমরা দেখতে পাই যে মন এবং প্রাণ একে অপরের ওপর বিরাট প্রভাব ফেলে। আত্মা, যদিও অদৃশ্য, তবুও এটি আমাদের জীবনযাত্রার দিশা দেয়। আত্মার বিশ্বাস এবং অনুপ্রেরণা মন এবং প্রাণকে শক্তি ও দিকনির্দেশনা দেয়। একজন মানুষ যদি আত্মিকভাবে উন্নত হয়, তবে তার মনও শুদ্ধ হয়, এবং তার প্রাণে এক ধরনের শক্তি সৃষ্টি হয়, যা তাকে সুস্থ ও সুখী রাখে।

 

তবে এই বিষয় নিয়ে অনেকের অনেক মত হলেও হতেই পারে। কিন্তু, তিনি পরিশেষে আমার লেখার ভেতরেই জীবনে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবেন। মন, প্রাণ ও আত্মার গভীর যোগ। এর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কোনও লাভ হবে না। এর কোনও ওজন বা ভার পরিমাপ করতে পারবেন না। এই তত্ত্বে খুঁজে পাবেন এক মাসহীন উপলব্ধি। এবং অলৌকিক দিশা। গভীর অনুভূতি এবং বোধের বিশ্বাসে আবদ্ধ হয়ে যোগের সূত্র প্রকাশের সূক্ষ্ম মাধ্যম। যদি কেউ এই লেখা পড়ে  নিজেকে নিজেই চিনে ফেলতে পারে তাহলে আমার প্রকাশ স্বার্থক হবে।
যদিও আবারও আমাদের মুল বিষয়ে ফিরে যাই যে, মন, প্রাণ ও আত্মার সম্পর্ক জীবনের প্রাসঙ্গিকতা বহুলাংশে নির্ধারণ করে। এই সম্পর্ক আমাদের জীবনের মানসিক, শারীরিক ও আধ্যাত্মিক দিকের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। যখন এই তিনটি উপাদান সঠিকভাবে সমন্বিত থাকে, তখন মানুষ একটি পূর্ণাঙ্গ এবং সুখী জীবন লাভ করতে পারে। মানসিক সুস্থতা, শারীরিক সুস্থতা এবং আধ্যাত্মিক শান্তি অর্জন করতে হলে আমাদের মন, প্রাণ ও আত্মার মধ্যে একটি সঠিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একে অপরের প্রতি সম্মান এবং আন্তরিকতা রেখে এগুলি মেলে চলে, এবং এভাবে এক ব্যক্তির জীবন সত্যিকারের অর্থপূর্ণ ও পূর্ণতা পায়। এই সামান্য বিষয় যা অর্থ দিয়ে কিনতে হয় না অথচ তা আমরা মূল্য দিতে শিখি না। মন, প্রাণ আত্মা
এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, যেখানে নিজের মনকে শান্ত রাখা, প্রাণের শক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা এবং আত্মার গভীরতাকে অনুধাবন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মধ্যে সঠিক সমন্বয় জীবনে শান্তি, সুখ, সফলতা এবং আত্মবিশ্বাস এনে দেয়।মন, প্রাণ এবং আত্মার সম্পর্ক মানব জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই তিনটি উপাদান একে অপরের সাথে সম্পর্কিত, এবং সঠিকভাবে সমন্বিত হলে মানুষের জীবনে পূর্ণতা এবং সুখ আসে। প্রতিটি মানুষের জীবনে এই সম্পর্কের প্রাসঙ্গিকতা অসীম, এবং এই সম্পর্কগুলো বুঝে চলতে পারলে আমরা আরও ভালভাবে নিজের জীবনকে গড়ে তুলতে পারি। জোর দিয়েই বলছি যে, এই বিশেষ শক্তি কাজে লাগিয়ে যে-কেউই তার মানসিক শান্তি লাভ করতে সক্ষম হবেই হবে।🍁

 

 


 

🍂মহামিলনের কথা 

 

 

শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
আমার প্রিয়তম শঙ্কর নারদকে বড় ভালোবাসেন, স্বয়ং পঞ্চমুখে নাম করেন। পার্ব্বতীমাতা আমার সহস্র নাম জপ না করে ভোজন করেন না;  কার্ত্তিক, গণেশ, সিংহ, ময়ূর, ইঁদুর এরাও নাম করে; বেশী কি, ভূতগণ সতত শিবের সঙ্গে রামনাম করে থাকে। লোকে বলে যে রাম নাম করলে ভূতের ভয় থাকে না— ভূত পালায়, কিন্তু শিবের ভূতেরা শিবের সঙ্গে নেচে নেচে রামনাম গায়। শিবের গোষ্ঠী আমার ভক্ত। শিব নিজে নাম করত তৃপ্ত হন, ভক্তগণকে আমার নামের মহিমা বলেন।

 

 

শিব নারদকে বলেছেন—
হে মুনে! যে ব্যক্তি অকপটে একবার ‘হরেকৃষ্ণ’ এ নাম উচ্চারণ করে সে নিশ্চয় যমাধিকারে গমন করে না, তার গতি বৈকুণ্ঠে হয়। ‘সকৃৎ’ –একবার, —একথা শুনে শঙ্কিত হসনে। একবার উচ্চারণ করলেই নাম তাকে অধিকার করেন, তার নাম ছাড়বার সামর্থ্য থাকে না। নাম সে ভক্তকে অবশ করত আয়ত্তীভূত করে নেন। তবে কপটতা ত্যাগপূর্ব্বক নাম করতে হয়।
কপটতা কাকে বলে?
একজন প্রতারক, অন্যায়কর্ম্মকারী, লোকবঞ্চক, পরনিন্দক, পরদ্রব্যহারী; সে লোককে বঞ্চনা করবার জন্য নাম করে। লক্ষ্য হল অপকর্ম্ম; নামকে অপকর্ম্মের সাধন করত যদি সাধারণকে ঠকায়, তাহলে নামের কাছে সে অপরাধী হয়ে যাতনা ভোগ করে থাকে। তাহলে কপট ব্যক্তিকে উদ্ধার করবার শক্তি নামের নাই?
নিশ্চয়ই আছে, তবে সে বিলম্বে কৃপা অনুভব করতে সমর্থ হয়।
ঋণ : শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী
শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী। (বানান অপরিবর্তিত) 🍁

 

 

🍂ফিরেপড়া | গল্প 

 

 

বিশেষত, বালিকার ক্রন্দন দেখিয়া বুঝিলেন ইহার হৃদয় আছে, এবং হিসাব করিয়া দেখিলেন, ‘যে হৃদয় আজ বাপ-মায়ের বিচ্ছেদসম্ভাবনায় ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে সেই হৃদয় আজ বাদে কাল আমারই ব্যবহারে লাগিতে পারিবে।’ শুক্তির মুক্তার ন্যায় বালিকার অশ্রুজল কেবল বালিকার মূল্য বাড়াইয়া দিল, তাহার হইয়া আর-কোনো কথা বলিল না।

 

সুভা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

মেয়েটির নাম যখন সুভাষিণী রাখা হইয়াছিল তখন কে জানিত সে বোবা হইবে। তাহার দুটি বড়ো বোনকে সুকেশিনী ও সুহাসিনী নাম দেওয়া হইয়াছিল, তাই মিলের অনুরোধে তাহার বাপ ছোটো মেয়েটির নাম সুভাষিণী রাখে। এখন সকলে তাহাকে সংক্ষেপে সুভা বলে।

দস্তুরমত অনুসন্ধান ও অর্থব্যয়ে বড়ো দুটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গেছে, এখন ছোটোটি পিতামাতার নীরব হৃদয়ভারের মতো বিরাজ করিতেছে।

যে কথা কয় না, সে যে অনুভব করে ইহা সকলের মনে হয় না, এইজন্য তাহার সাক্ষাতেই সকলে তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিত। সে যে বিধাতার অভিশাপস্বরূপে তাহার পিতৃগৃহে আসিয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছে এ কথা সে শিশুকাল হইতে বুঝিয়া লইয়াছিল। তাহার ফল এই হইয়াছিল, সাধারণের দৃষ্টিপথ হইতে সে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতে সর্বদাই চেষ্টা করিত। মনে করিত, আমাকে সবাই ভুলিলে বাঁচি। কিন্তু, বেদনা কি কেহ কখনো ভোলে। পিতামাতার মনে সে সর্বদাই জাগরূক ছিল।

বিশেষত, তাহার মা তাহাকে নিজের একটা ত্রুটিস্বরূপ দেখিতেন; কেননা, মাতা পুত্র অপেক্ষা কন্যাকে নিজের অংশরূপে দেখেন – কন্যার কোনো অসম্পূর্ণতা দেখিলে সেটা যেন বিশেষরূপে নিজের লজ্জার কারণ বলিয়া মনে করেন। বরঞ্চ, কন্যার পিতা বাণীকণ্ঠ সুভাকে তাঁহার অন্য মেয়েদের অপেক্ষা যেন একটু বেশি ভালোবাসিতেন; কিন্তু মাতা তাহাকে নিজের গর্ভের কলঙ্ক জ্ঞান করিয়া তাহার প্রতি বড়ো বিরক্ত ছিলেন।

 

সুভা তেঁতুলতলায় বসিয়া থাকিত এবং প্রতাপ অনতিদূরে ছিপ ফেলিয়া জলের দিকে চাহিয়া থাকিত। প্রতাপের একটি করিয়া পান বরাদ্দ ছিল, সুভা তাহা নিজে সাজিয়া আনিত। এবং বোধ করি অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চাহিয়া চাহিয়া ইচ্ছা করিত, প্রতাপের কোনো-একটা বিশেষ সাহায্য করিতে, একটা-কোনো কাজে লাগিতে, কোনোমতে জানাইয়া দিতে যে, এই পৃথিবীতে সেও একজন কম প্রয়োজনীয় লোক নহে।

 

সুভার কথা ছিল না, কিন্তু তাহার সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট বড়ো বড়ো দুটি কালো চোখ ছিল – এবং তাহার ওষ্ঠাধর ভাবের আভাসমাত্রে কচি কিশলয়ের মতো কাঁপিয়া উঠিত।

কথায় আমরা যে ভাব প্রকাশ করি সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতো; সকল সময়ে ঠিক হয় না, ক্ষমতা অভাবে অনেক সময়ে ভুলও হয়। কিন্তু, কালো চোখকে কিছু তর্জমা করিতে হয় না – মন আপনি তাহার উপরে ছায়া ফেলে; ভাব আপনি তাহার উপরে কখনো প্রসারিত কখনো মুদিত হয়; কখনো উজ্জ্বলভাবে জ্বলিয়া উঠে, কখনো মানভাবে নিবিয়া আসে, কখনো অস্তমান চন্দ্রের মতো অনিমেষভাবে চাহিয়া থাকে, কখনো দ্রুত চঞ্চল বিদ্যুতের মতো দিগ্বিদিকে ঠিকরিয়া উঠে। মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল যাহার অন্য ভাষা নাই তাহার চোখের ভাষা অসীম উদার এবং অতলস্পর্শ গভীর – অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো, উদয়াস্ত এবং ছায়ালোকের নিস্তব্ধ রঙ্গভূমি। এই বাক্যহীন মনুষ্যের মধ্যে বৃহৎ প্রকৃতির মতো একটা বিজন মহত্ত্ব আছে। এইজন্য সাধারণ বালকবালিকারা তাহাকে একপ্রকার ভয় করিত, তাহার সহিত খেলা করিত না। সে নির্জন দ্বিপ্রহরের মতো শব্দহীন এবং সঙ্গীহীন।


গ্রামের নাম চণ্ডীপুর। নদীটি বাংলাদেশের একটি ছোটো নদী, গৃহস্থঘরের মেয়েটির মতো; বহুদূর পর্যন্ত তাহার প্রসার নহে; নিরলসা তন্বী নদীটি আপন কূল রক্ষা করিয়া কাজ করিয়া যায়; দুই ধারের গ্রামের সকলেরই সঙ্গে তাহার যেন একটা-না-একটা সম্পর্ক আছে। দুই ধারে লোকালয় এবং তরুচ্ছায়াঘন উচ্চ তট; নিন্মতল দিয়া গ্রামলক্ষ্মী স্রোতস্বিনী আত্মবিস্মৃত দ্রুত পদেক্ষেপ প্রফুল হৃদয়ে আপনার অসংখ্য কল্যাণকার্যে চলিয়াছে।

বাণীকণ্ঠের ঘর নদীর একেবারে উপরেই। তাহার বাঁখারির বেড়া, আটচালা, গোয়ালঘর, ঢেঁকিশালা, খড়ের স্তূপ, তেঁতুলতলা, আম কাঁঠাল এবং কলার বাগান নৌকাবাহি-মাত্রেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গার্হস্থ্য সচ্ছলতার মধ্যে বোবা মেয়েটি কাহারও নজরে পড়ে কি না জানি না, কিন্তু কাজকর্মে যখনি অবসর পায় তখনি সে এই নদীতীরে আসিয়া বসে।

প্রকৃতি যেন তাহার ভাষার অভাব পূরণ করিয়া দেয়। যেন তাহার হইয়া কথা কয়। নদীর কলধ্বনি, লোকের কোলাহল, মাঝির গান, পাখির ডাক, তরুর মর্মর – সমস্ত মিশিয়া চারি দিকের চলাফেরা-আন্দোলন-কম্পনের সহিত এক হইয়া সমুদ্রের তরঙ্গরাশির ন্যায় বালিকার চিরনিস্তব্ধ হৃদয়-উপকূলের নিকটে আসিয়া ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে। প্রকৃতির এই বিবিধ শব্দ এবং বিচিত্র গতি, ইহাও বোবার ভাষা – বড়ো বড়ো চুপলববিশিষ্ট সুভার যে ভাষা তাহারই একটা বিশ্বব্যাপী বিস্তার; ঝিলিরবপূর্ণ তৃণভূমি হইতে শব্দাতীত নক্ষত্রলোক পর্যন্ত কেবল ইঙ্গিত, ভঙ্গি, সংগীত, ক্রন্দন এবং দীর্ঘনিশ্বাস।

এবং মধ্যাহ্নে যখন মাঝিরা জেলেরা খাইতে যাইত, গৃহস্থেরা ঘুমাইত, পাখিরা ডাকিত না, খেয়া-নৌকা বন্ধ থাকিত, সজন জগৎ সমস্ত কাজকর্মের মাঝখানে সহসা থামিয়া গিয়া ভয়ানক বিজনমূর্তি ধারণ করিত, তখন রুদ্র মহাকাশের তলে কেবল একটি বোবা প্রকৃতি এবং একটি বোবা মেয়ে মুখামুখি চুপ করিয়া বসিয়া থাকিত – একজন সুবিস্তীর্ণ রৌদ্রে, আর-একজন ক্ষুদ্র তরুচ্ছায়ায়।

সুভার যে গুটিকতক অন্তরঙ্গ বন্ধুর দল ছিল না তাহা নহে। গোয়ালের দুটি গাভী, তাহাদের নাম সর্বশী ও পাঙ্গুলি। সে নাম বালিকার মুখে তাহারা কখনো শুনে নাই, কিন্তু তাহার পদশব্দ তাহারা চিনিত – তাহার কথাহীন একটা করুণ সুর ছিল, তাহার মর্ম তাহারা ভাষার অপেক্ষা সহজে বুঝিত। সুভা কখন তাহাদের আদর করিতেছে, কখন ভর্ৎসনা করিতেছে, কখন মিনতি করিতেছে, তাহা তাহারা মানুষের অপেক্ষা ভালো বুঝিতে পারিত।

সুভা গোয়ালে ঢুকিয়া দুই বাহুর দ্বারা সর্বশরীর গ্রীবা বেষ্টন করিয়া তাহার কানের কাছে আপনার গণ্ডদেশ ঘর্ষণ করিত এবং পাঙ্গুলি স্নিগ্ধদৃষ্টিতে তাহার প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া তাহার গা চাটিত। বালিকা দিনের মধ্যে নিয়মিত তিনবার করিয়া গোয়ালঘরে যাইত, তাহা ছাড়া অনিয়মিত আগমনও ছিল; গৃহে যে দিন কোনো কঠিন কথা শুনিত সে দিন সে অসময়ে তাহার এই মূক বন্ধুদুটির কাছে আসিত – তাহার সহিষ্ণুতাপরিপূর্ণ বিষাদশান্ত দৃষ্টিপাত হইতে তাহারা কী-একটা অন্ধ অনুমানশক্তির দ্বারা বালিকার মর্মবেদনা যেন বুঝিতে পারিত, এবং সুভার গা ঘেঁষিয়া আসিয়া অল্পে অল্পে তাহার বাহুতে শিং ঘষিয়া ঘষিয়া তাহাকে নির্বাক ব্যাকুলতার সহিত সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করিত।

ইহারা ছাড়া ছাগল এবং বিড়ালশাবকও ছিল; কিন্তু তাহাদের সহিত সুভার এরূপ সম্যকভাবে মৈত্রী ছিল না, তথাপি তাহারা যথেষ্ট আনুগত্য প্রকাশ করিত। বিড়ালশিশুটি দিনে এবং রাত্রে যখন-তখন সুভার গরম কোলটি নিঃসংকোচে অধিকার করিয়া সুখনিদ্রার আয়োজন করিত এবং সুভা তাহার গ্রীবা ও পৃষ্ঠে কোমল অঙ্গুলি বুলাইয়া দিলে যে তাহার নিদ্রাকর্ষণের বিশেষ সহায়তা হয়, ইঙ্গিতে এরূপ অভিপ্রায়ও প্রকাশ করিত।


উন্নত শ্রেণীর জীবের মধ্যে সুভার আরো একটি সঙ্গী জুটিয়াছিল। কিন্তু তাহার সহিত বালিকার ঠিক কিরূপ সম্পর্ক ছিল তাহা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ, সে ভাষাবিশিষ্ট জীব; সুতরাং উভয়ের মধ্যে সমভাষা ছিল না।

গোঁসাইদের ছোটো ছেলেটি – তাহার নাম প্রতাপ। লোকটি নিতান্ত অকর্মণ্য। সে যে কাজকর্ম করিয়া সংসারের উন্নতি করিতে যত্ন করিবে বহু চেষ্টার পর বাপ-মা সে আশা ত্যাগ করিয়াছেন। অকর্মণ্য লোকের একটা সুবিধা এই যে, আত্মীয় লোকেরা তাহাদের উপরে বিরক্ত হয় বটে, কিন্তু প্রায় তাহারা নিঃসম্পর্ক লোকদের প্রিয়পাত্র হয় – কারণ, কোনো কার্যে আবদ্ধ না থাকাতে তাহারা সরকারি সম্পত্তি হইয়া দাঁড়ায়। শহরের যেমন এক-আধটা গৃহসম্পর্কহীন সরকারি বাগান থাকা আবশ্যক তেমনি গ্রামে দুই-চারিটা অকর্মণ্য সরকারি লোক থাকার বিশেষ প্রয়োজন। কাজে-কর্মে আমোদে-অবসরে যেখানে একটা লোক কম পড়ে সেখানেই তাহাদিগকে হাতের কাছে পাওয়া যায়।

প্রতাপের প্রধান শখ – ছিপ ফেলিয়া মাছ ধরা। ইহাতে অনেকটা সময় সহজে কাটানো যায়। অপরাহ্নে নদীতীরে ইহাকে প্রায় এই কাজে নিযুক্ত দেখা যাইত। এবং এই উপলে সুভার সহিত তাহার প্রায় সাক্ষাৎ হইত। যে-কোনো কাজেই নিযুক্ত থাক, একটা সঙ্গী পাইলে প্রতাপ থাকে ভালো। মাছ ধরার সময় বাক্যহীন সঙ্গীই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ – এইজন্য প্রতাপ সুভার মর্যাদা বুঝিত। এইজন্য সকলেই সুভাকে সুভা বলিত, প্রতাপ আর-একটু অতিরিক্ত আদর সংযোগ করিয়া সুভাকে ‘সু’ বলিয়া ডাকিত।

সুভা তেঁতুলতলায় বসিয়া থাকিত এবং প্রতাপ অনতিদূরে ছিপ ফেলিয়া জলের দিকে চাহিয়া থাকিত। প্রতাপের একটি করিয়া পান বরাদ্দ ছিল, সুভা তাহা নিজে সাজিয়া আনিত। এবং বোধ করি অনেকক্ষণ বসিয়া বসিয়া চাহিয়া চাহিয়া ইচ্ছা করিত, প্রতাপের কোনো-একটা বিশেষ সাহায্য করিতে, একটা-কোনো কাজে লাগিতে, কোনোমতে জানাইয়া দিতে যে, এই পৃথিবীতে সেও একজন কম প্রয়োজনীয় লোক নহে। কিন্তু কিছুই করিবার ছিল না। তখন সে মনে মনে বিধাতার কাছে অলৌকিক ক্ষমতা প্রার্থনা করিত – মন্ত্রবলে সহসা এমন একটা আশ্চর্য কাণ্ড ঘটাইতে ইচ্ছা করিত যাহা দেখিয়া প্রতাপ আশ্চর্য হইয়া যাইত, বলিত, ‘তাই তো, আমাদের সুভির যে এত ক্ষমতা তাহা তো জানিতাম না।’

মনে করো, সুভা যদি জলকুমারী হইত, আস্তে আস্তে জল হইতে উঠিয়া একটা সাপের মাথার মণি ঘাটে রাখিয়া যাইত; প্রতাপ তাহার তুচ্ছ মাছ ধরা রাখিয়া সেই মানিক লইয়া জলে ডুব মারিত; এবং পাতালে গিয়া দেখিত, রুপার অট্টালিকায় সোনার পালঙ্কে – কে বসিয়া ?- আমাদের বাণীকণ্ঠের ঘরের সেই বোবা মেয়ে সু – আমাদের সু সেই মণিদীপ্ত গভীর নিস্তব্ধ পাতালপুরীর একমাত্র রাজকন্যা। তাহা কি হইতে পারিত না। তাহা কি এতই অসম্ভব। আসলে কিছুই অসম্ভব নয়, কিন্তু তবুও সু প্রজাশূন্য পাতালের রাজবংশে না জন্মিয়া বাণীকণ্ঠের ঘরে আসিয়া জন্মিয়াছে এবং গোঁসাইদের ছেলে প্রতাপকে কিছুতেই আশ্চর্য করিতে পারিতেছে না।


সুভার বয়স ক্রমেই বাড়িয়া উঠিতেছে। ক্রমে সে যেন আপনাকে আপনি অনুভব করিতে পারিতেছে। যেন কোনো একটা পূর্ণিমাতিথিতে কোনো-একটা সমুদ্র হইতে একটা জোয়ারের স্রোত আসিয়া তাহার অন্তরাত্মাকে এক নূতন অনির্বচনীয় চেতনাশক্তিতে পরিপূর্ণ করিয়া তুলিতেছে। সে আপনাকে আপনি দেখিতেছে, ভাবিতেছে, প্রশ্ন করিতেছে, এবং বুঝিতে পারিতেছে না।

গভীর পূর্ণিমারাত্রে সে এক-একদিন ধীরে শয়নগৃহের দ্বার খুলিয়া ভয়ে ভয়ে মুখ বাড়াইয়া বাহিরের দিকে চাহিয়া দেখে, পূর্ণিমাপ্রকৃতিও সুভার মতো একাকিনী সুপ্ত জগতের উপর জাগিয়া বসিয়া-যৌবনের রহস্যে পুলকে বিষাদে অসীম নির্জনতার একেবারে শেষ সীমা পর্যন্ত, এমন-কি, তাহা অতিক্রম করিয়াও থম‌থম্ করিতেছে, একটি কথা কহিতে পারিতেছে না। এই নিস্তব্ধ ব্যাকুল প্রকৃতির প্রান্তে একটি নিস্তব্ধ ব্যাকুল বালিকা দাঁড়াইয়া।

এ দিকে কন্যাভারগ্রস্ত পিতামাতা চিন্তিত হইয়া উঠিয়াছেন। লোকেও নিন্দা আরম্ভ করিয়াছে। এমন-কি, এক-ঘরে করিবে এমন জনরবও শুনা যায়। বাণীকণ্ঠের সচ্ছল অবস্থা, দুই বেলাই মাছভাত খায়, এজন্য তাহার শত্রু ছিল।

স্ত্রীপুরুষে বিস্তর পরামর্শ হইল। কিছুদিনের মতো বাণী বিদেশে গেল।

অবশেষে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “চলো, কলিকাতায় চলো।”

বিদেশযাত্রার উদ্যোগ হইতে লাগিল। কুয়াশা-ঢাকা প্রভাতের মতো সুভার সমস্ত হৃদয় অশ্রুবাষ্পে একেবারে ভরিয়া গেল। একটা অনির্দিষ্ট আশঙ্কা-বশে সে কিছুদিন হইতে ক্রমাগত নির্বাক্ জন্তুর মতো তাহার বাপ-মায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিত – ডাগর চক্ষু মেলিয়া তাঁহাদের মুখের দিকে চাহিয়া কী-একটা বুঝিতে চেষ্টা করিত, কিন্তু তাঁহারা কিছু বুঝাইয়া বলিতেন না।

ইতিমধ্যে একদিন অপরাহ্নে জলে ছিপ ফেলিয়া প্রতাপ হাসিয়া কহিল, “কী রে সু, তোর নাকি বর পাওয়া গেছে, তুই বিয়ে করতে যাচ্ছিস ? দেখিস আমাদের ভুলিস নে।”

বলিয়া আবার মাছের দিকে মনোযোগ করিল।

মর্মবিদ্ধ হরিণী ব্যাধের দিকে যেমন করিয়া তাকায়, নীরবে বলিতে থাকে ‘আমি তোমার কাছে কী দোষ করিয়াছিলাম’, সুভা তেমনি করিয়া প্রতাপের দিকে চাহিল; সেদিন গাছের তলায় আর বসিল না। বাণীকণ্ঠ নিদ্রা হইতে উঠিয়া শয়নগৃহে তামাক খাইতেছিলেন, সুভা তাঁহার পায়ের কাছে বসিয়া তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কাঁদিতে লাগিল। অবশেষে তাহাকে সান্ত্বনা দিতে গিয়া বাণীকণ্ঠের শুষ্ক কপোলে অশ্রু গড়াইয়া পড়িল।

কাল কলিকাতায় যাইবার দিন স্থির হইয়াছে। সুভা গোয়ালঘরে তাহার বাল্য-সখীদের কাছে বিদায় লইতে গেল, তাহাদিগকে স্বহস্তে খাওয়াইয়া, গলা ধরিয়া একবার দুই চোখে যত পারে কথা ভরিয়া তাহাদের মুখের দিকে চাহিল – দুই নেত্রপলব হইতে টপ্‌টপ্ করিয়া অশ্রুজল পড়িতে লাগিল।

সেদিন শুকদ্বাদশীর রাত্রি। সুভা শয়নগৃহ হইতে বাহির হইয়া তাহার সেই চিরপরিচিত নদীতটে শষ্পশয্যায় লুটাইয়া পড়িল -যেন ধরণীকে, এই প্রকাণ্ড মূক মানবতাকে দুই বাহুতে ধরিয়া বলিতে চাহে, ‘তুমি আমাকে যাইতে দিয়ো না, মা। আমার মতো দুটি বাহু বাড়াইয়া তুমিও আমাকে ধরিয়া রাখো।’

কলিকাতার এক বাসায় সুভার মা একদিন সুভাকে খুব করিয়া সাজাইয়া দিলেন। আঁটিয়া চুল বাঁধিয়া, খোঁপায় জরির ফিতা দিয়া, অলংকারে আচ্ছন্ন করিয়া তাহার স্বাভাবিক শ্রী যথাসাধ্য বিলুপ্ত করিয়া দিলেন। সুভার দুই চক্ষু দিয়া অশ্রু পড়িতেছে; পাছে চোখ ফুলিয়া খারাপ দেখিতে হয় এজন্য তাহার মাতা তাহাকে বিস্তর র্ভৎসনা করিলেন, কিন্তু অশ্রুজল র্ভৎসনা মানিল না।

বন্ধুসঙ্গে বর স্বয়ং কনে দেখিতে আসিলেন – কন্যার মা-বাপ চিন্তিত, শঙ্কিত, শশব্যস্ত হইয়া উঠিলেন; যেন দেবতা স্বয়ং নিজের বলির পশু বাছিয়া লইতে আসিয়াছেন। মা নেপথ্য হইতে বিস্তর তর্জন গর্জন শাসন করিয়া বালিকার অশ্রুস্রোত দ্বিগুণ বাড়াইয়া পরীক্ষকের সম্মুখে পাঠাইলেন। পরীক্ষক অনেকণ নিরীণ করিয়া বলিলেন, “মন্দ নহে।”

বিশেষত, বালিকার ক্রন্দন দেখিয়া বুঝিলেন ইহার হৃদয় আছে, এবং হিসাব করিয়া দেখিলেন, ‘যে হৃদয় আজ বাপ-মায়ের বিচ্ছেদসম্ভাবনায় ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে সেই হৃদয় আজ বাদে কাল আমারই ব্যবহারে লাগিতে পারিবে।’ শুক্তির মুক্তার ন্যায় বালিকার অশ্রুজল কেবল বালিকার মূল্য বাড়াইয়া দিল, তাহার হইয়া আর-কোনো কথা বলিল না।

পঞ্জিকা মিলাইয়া খুব একটা শুভলগ্নে বিবাহ হইয়া গেল।

বোবা মেয়েকে পরের হস্তে সমর্পণ করিয়া বাপ-মা দেশে চলিয়া গেল – তাহাদের জাতি ও পরকাল রা হইল।

বর পশ্চিমে কাজ করে। বিবাহের অনতিবিলম্বে স্ত্রীকে পশ্চিমে লইয়া গেল।

সপ্তাহখানেকের মধ্যে সকলেই বুঝিল নববধূ বোবা। তা কেহ বুঝিল না সেটা তাহার দোষ নহে। সে কাহাকেও প্রতারণা করে নাই। তাহার দুটি চক্ষু সকল কথাই বলিয়াছিল কিন্তু কেহ তাহা বুঝিতে পারে নাই। সে চারি দিকে চায় – ভাষা পায় না – যাহারা বোবার ভাষা বুঝিত সেই আজন্মপরিচিত মুখগুলি দেখিতে পায় না – বালিকার চিরনীরব হৃদয়ের মধ্যে একটা অসীম অব্যক্ত ক্রন্দন বাজিতে লাগিল – অন্তর্যামী ছাড়া আর-কেহ তাহা শুনিতে পাইল না।

এবার তাহার স্বামী চক্ষু এবং কর্ণেন্দ্রিয়ের দ্বারা পরীক্ষা করিয়া এক ভাষাবিশিষ্ট কন্যা বিবাহ করিয়া আনিল।🍁

 

🍂কবিতা 

 

 

স্বপন কুমার দত্ত-এর একটি কবিতা

 

 

নেহাতই সূর্যাস্ত

সূর্যাস্ত হয়ে গেছে?

বেড়ালটার চোখে দরজা খোলার স্বপ্ন
আর খিস্তিগুলো খালি সূর্যাস্তে
ফিসফিস করছে, অথচ মোমবাতিতে…

সত্যি কথা বলতে কী, সূর্যাস্তের কাছে
একটা মিথ্যে পৌঁছানো আঁকা চামড়ায়
আমার গায়ের গন্ধ
খেলা করতে করতে আউলিয়া রঙ…
না না, সেকি
শেকলের টান, শেকলও ডাক ডাকছে :
এসো… গোলামীতে নামি…

এ-শহর গোলামীতে চলছে
উপপাদ্য, সমপাদ্য, সম্মোহন, নাকছাবি…
আহ! ঠিক আছে।

সূর্যাস্তে আর কিছু এসে যায় না।

 

 

বরুণ সাহা-এর একটি কবিতা 

 

 

বিমূর্ত 

সারা রাত ঘুম নেই
অন্ধকার ক্যানভাসে
একটা ছবি জ্বল জ্বল করছে
কালো মুখোশ পরা
একদল হিংস্র দস্যুর দল
বিশ্বাসের গোড়ায় আগুন জ্বালিয়েছে
আমি জ্বলন্ত আগুনে
জল দিতে গিয়ে ঝলসে গিয়েছি।
ঝলসানো ছাই হয়তো একদিন
জমতে জমতে পাথর হয়ে যাবে
আমি জানতেই পারব না
কোন্ শিল্পী সেই পাথর কেটে
একদিন মুর্তি গড়ে তুলবে।
মানুষ যারা, চোখ খুলে দেখবে
বলবে, আহা কথা বলছে।

 

আমিনা তাবাসসুম-এর তিনটি কবিতা

 

 

সময়ের ল্যান্ডস্কেপ

সকাল থেকেই
নরম মদিরার গন্ধ

সোনালী শস্যের গায়ে
আদর মাখাতে মাখাতে
ফাল্গুনী উপসংহার

বসন্ত ছুঁয়ে দিল বলেই তো
এসব রোজ চোখে দেখি

অথচ
মাংসের সংসার
প্রতিদিন সরে সরে যায়

যেভাবে
ছোট থেকে বড় হলে
সরে যায়
ছায়াময় হাত

আমরা দেখি
দূর থেকে মুছে যাচ্ছে
কুয়াশার সমুদ্র
ঝলমলে স্মৃতির
পাহাড়ি ঝর্ণাস্রোত

 

 

 

তেপান্তরের অলীক পুরাণ 

ঘাড় ধরে নিয়ে এসো
ক বৃত্তের যতটুকু যাপন

সাধারণ অবেলায় যা মস্তিষ্ক ও মাছির
সুদে আসলে
মনচিত্তির

আঁচলে শাড়ি গন্ধ মেখে
এই আলোয় দামাল প্রোতাশ্রয়
মুখে বুকে চোখে নিয়ে
সবুজ হলুদ ডোরা জামা পরে ছেলেটি
অন্ধকার ও মুক্তির সদসৎ ভ্যালেন্টাইন
জিপ পকেটে টেনে তোলে

আর ওবেলার যত্ন করে
শালিখ চড়ুই টুনটুনি
রাজকীয় মাছ নিয়ে
রূপকথার ভরা শূণ্যতায়
আকাশ ছুঁয়ে যায়

আমার শরীরে
একা পড়ে থাকে
তোমার রেখে যাওয়া ঘর

 

 

 

রাতের স্ক্রীৎজোফ্রেনিয়া  

এই নশ্বর রাত্রি
খিদে নিয়ে
আমার বুকের ভেতর হাতড়াতে থাকে
অগাধ জন্ম নেওয়া
টুকরো কথা

বুক ছিড়ে বের হয়ে আসে মাকড়সা
বড় বড় প্রজাপ্রতি
হায়েনা, রোদ্দুর
আর আসে ব্যাঙাচির ছোট ননদ
ভাইফোঁটা দিতে

রং চোখে নিয়ে মীরা ঘরছাড়া
পিকাসোর ভ্রম নিয়ে
দালি ফুকো মিশে যায়

আমাদের একটাই সংসার

চোখে যুদ্ধ জ্বেলে জ্বেলে
অবশ হয়ে গেছে গুরুদক্ষিণা

এখন যতবার ডাকো
প্রেম ছাড়া তোমাকে দেওয়ার
সাধ্য শুধু
আমাকেই তুলে দেওয়া

 

 

পরাণ মাঝি-এর একটি কবিতা

 

 

যাওয়া 

যেতে যদি হয়। অবশ্যই যাবো।

ঢের দূরে…

নতুবা কথার ব্যথা নিপাট ভদ্র আঁধারেও থেকে যায় অমলিন…

 

 

অশোক কুমার রায়-এর একটি কবিতা 

 

 

এদের জন্য দু’কলম কে লিখবে?

যারা কবিতা লেখেন
এদের জন্য চার অক্ষরও ব্যয় করেন না
এদের চোখের জল নদী হলে
বয়ে যায় আমাদের বুকের উপর দিয়ে।
হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলেও
এদের উর্বর বার্তার জন্য
পারিনা খাল কাটতে।
কবিরা বাদে আমরা সবাই অসহায়।
কবিরা দিব্যি কবিতা লিখে চলেছেন
ফুরফুরে মেয়েলী বাতাসে
গন্ধ শুকে বেড়ান।
কেউ কেউ গান গাইতে পারেন
এদের জন্য সুর নাকি বন্ধক দেওয়া আছে।
ওরা আমরা যে বড় অসহায়।
অবশেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা
তোমার কলম তুমি ধরো
ধরার বুকে শান্তি বর্ষণ হোক।

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর একটি কবিতা 

 

 

গুড ফ্রাইডে

গুড ফ্রাইডে এলেই বিপন্নতা বাড়ে

মনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে, সুদৃশ্য ক্রুশ গাছ
চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে, অপরাধের বিষন্ন বিকেল
আমি জ্যান্ত থাকি না

মনের মধ্যে জেগে থাকা, অভিনব এক পুরুষ
প্রতিদিন ক্রুশবিদ্ধ হয়

ঘুমিয়ে পড়া আমাদের ছত্রাক শহরে
পাশে এসে দাঁড়ায়— বিশ্বাসঘাতক জুডাস
তার হাতে আপেলরঙা রুমাল তুলে দিয়ে

ঝুলে পড়ি, পাষণ্ড ক্রুশ গাছে

 

তারক মণ্ডল-এর একটি কবিতা 

 

 

বৃষ্টি ভেজা রাত

বৃষ্টির রাত, জানালার ধারে সে চুপ,
হাতে এক কাপ চা, চোখে স্বপ্নের রূপ।
পাতার ফাঁকে ফোঁটা জল টুপ করে পড়ে,
প্রকৃতির এ খেলা তার হৃদয় জুড়ে।

মেঘের ডাকেও আছে এক মায়াবি টান,
হাওয়া ছুঁয়ে যায় তার ভেজা অভিমান।
সে ভাবে, কত যত্নে ভিজে চারদিক,
প্রকৃতির কোলে যেন খুঁজে পায় আশ্রয় ঠিক।

 

 

দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ

 

 

স্বপ্ন

ভালোবাসা ভালো লাগে
মনে মনে রঙে রঙে নীল
স্বপ্ন স্বপ্নীল হয় স্বপ্নায়
গভীর ক্ষত থেকে ভীষন
বিভীষিকা চুঁয়ে চুঁয়ে ঝরে—
দেখেছি তার উপরের রঙে
ঘন সবুজ ,অন্ধ বিশ্বাস।
সব একদিন ঢেকে দিল।
রক্তিম এক সাদা চাদরে।
সব স্বপ্ন, সত্যি কিছু নয়।

 

 

গন্ধ

ফুলের গন্ধে ভাবি আনন্দ
কখনোবা ভাবি কিছুই না
দিনে নয় রাতে নিস্তব্ধতা
হাতছানি দিয়ে নিয়ে যায়
ভোরে ঘুম ভেঙে খুব মিষ্টি
প্রেমের আবেশে অনবদ্য
দিনভর মাতলামি চলে
জীবনের যুদ্ধে জয়ী হয়ে
উপহার পাওয়া তোড়ার
শেষ নির্যাস টুকু সুখের।।

 

 

মন

মন বড় বিচিত্র রঙিন
ভাবনা বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্ষীণ
মনে মনে মন কষাকষি
ভাবনায় আগুন ধরিয়ে
সে আগুনে পোড়ে, মন দিয়ে
শক্ত হয়ে ওঠে, শান দেয়া
চকচকে ইস্পাতে কঠিন!
বিচিত্র জীবনে তুমি আমি,
যখনই মনে করি খেলা
হয় বর্ণময় বর্ণমালা।।

 

 

নিরঞ্জন

অদৃশ্য চৈতন্য এক বসে
সাজিয়েছে পথঘাট নদী,
পাহাড়ের চূড়ায় বরফ
রোজ সূর্যোদয় অনুভূতি
নতুন চমক আনে মনে
তবুও জটিল বাঁকা পথ
ধরে জীবনের কলতান
সবাই হাঁটছি যে মিছিলে
প্রতিদিন কাছে টানে মৃত্যু
ধীরে ধীরে নিরঞ্জনে চলে।।

 

 

ব্যস্ত

ব্যস্ত হয়ো না ব্যস্ত করোনা
জীবন দাঁড়িয়ে গেছে আজ
যেটা বহু আগেই চেয়েছি
শুধু একটু দাঁড়িয়ে যেতে
সময় ছিল না ছুটছুট
শুরু থেকে শেষ ছুট ছুট
হাসি কথা ভুলে শুধু ছুট
ক্লান্তিতে ব্যথায় অবসন্ন
ক্ষিপ্ত মন তনু দিগ্বিদিক
জ্ঞানহীন ছুটছে ছুটছে।।

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ২৩

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ২৩।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

তেইশ.

বিড়ির ধোঁয়ায় জীবন খুঁজতে খুঁজতে

 

কদিন সত্যি সত্যিই পিংকু নামের মেয়েটি মধুমঙ্গল বিশ্বাসের হৃদয়পুরের ঠিকানায় ‘দৌড়’ পত্রিকা দপ্তরে আমার খোঁজ করতে যাবে তা ভাবিনি। ‘দৌড়ে’র সাহিত্য আড্ডায় বেশিরভাগ সময়ই আমি ছুটে যাই এবং একটা রাতও কাটিয়ে আসি। মাঝে মাঝে দু’রাতও থেকে যেতে হয়। মধুদার কাছে যতখানি প্রশ্রয় পাই আর অন্য কোথাও পাই না। শুধু সাহিত্যের টানেই সেখানে যাই। বহু কবির সমাগম হয় এবং তাঁদের সঙ্গে পরিচিতি হওয়ারও একটা সুযোগ থাকে। এই অনুষ্ঠানে মন খোলসা করে কথা বলারও সুযোগ পাই। কবিতা বিষয়ে জানাতে পারি ব্যক্তিগত নানা উপলব্ধির কথা। কবিতা নিয়ে গদ্যলেখা এবং কাব্য নিয়ে সমালোচনা লেখা এখান থেকেই তার সূচনা হয়। মধুদাই বলেছিলেন, “তুমি লিখতে পারবে। তোমার লেখার ক্ষমতা আছে।” সেদিন এই সাহসটুকুই কম কথা ছিল না। লিখতেও শুরু করেছিলাম। সেই ‘দৌড়’ দপ্তরে পিংকু?

 

 

ঊর্মি চাকরি পেয়ে গেছে দুর্গাপুরের একটি কলেজে। একদিন কাজের সূত্রে তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অনেকক্ষণ তার জীবনকথা শুনতে পেয়েছি। সেই দিনই তার সঙ্গে প্রথম মোগলাই পরোটা খেয়েছিলাম। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। খেতে খেতে গল্প বলেছিল তার প্রথম জীবনের পথভ্রষ্ট হওয়ার গল্প। প্রেম করে একজনের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। তারপর কিছুদিন তার সঙ্গেই শয্যা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সুখ হয়নি। সে প্রেমিক ছিল না শুধু, ছিল এক উড়ন্ত ভ্রমর।

 

 

হুগলির শঙ্খবেড়িয়া থেকে মানব বিশ্বাস ‘শঙ্খ’ নামে একটি পত্রিকা বের করতেন। সেই পত্রিকায় লেখার সূত্রেই পিংকুর সঙ্গে পরিচয়। পিংকু নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে। বি-এ পাস। কিন্তু পণের অভাবে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে পারেনি। সমাজের প্রতি ছিল তার গভীর অভিমান। এমনকি সমাজের ধনাঢ্য মানুষদের প্রতিও ছিল তার গভীর ঘৃণা। তাই স্বাভাবিকভাবেই মাটির কাছাকাছি আমার লেখায় জীবনের ঘনীভূত উত্তাপ সে উপলব্ধি করেছিল। আমার চেতনার সঙ্গে তার চেতনার কোনো সংঘর্ষ হয়নি। দু’জনের ভাবনা যেন একই সমান্তরালে প্রবাহিত হতো। তাই সে আমার লেখার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। লেখার প্রতি টান অনুভব করেই আমার প্রতি টানও তার দানা বাঁধতে থাকে। ছন্নছাড়া জীবনকে গোছানোর জন্যই তখন খড়কুটো যোগাড় করার আগ্রহ দেখা দেয়। বসন্তের মরশুমে পাখিরা যেমন গাছের মগডালে বাসা বেঁধে স্বপ্ন দেখতে থাকে তাদের আগামী প্রজন্মের, তেমনি পিংকুও স্বপ্ন দেখতে চায়। কবিতায় আমাকে সে লিখে পাঠায় :

“আজ আমার নেইকো কোনো লাজ
তাই আমি আর মানি নাকো সমাজ।
তুমি যদি মেঘ আনো, আমি বৃষ্টি হতে পারি
তুমি যদি ঘর দাও, আমি জানালা তোমারই।
সংকট আসুক যত অটল হবো পথে
তুমি যদি ঘোড়া হও, আমি সারথি সেই রথে।
অন্ধকার ভেদ করে আলোকের পানে
আমার পিপাসা শুধু বুঝে নিও মানে।”

পিংকু যে কবিতা লেখে তা খুব সাধারণ কবিতা। বিশেষ করে পয়ার জাতীয় ছন্দ মিলের কবিতা। তার প্রতিটি চিঠিতেই এরকমই কবিতা থাকে। আমি চিঠির উত্তর লিখলেও সেখানে কবিতা লিখতে পারি না। সব কথা গদ্যেই লিখতে হয়, তবে সে গদ্যও কবিতার মতোই। শেষ চিঠিতে ওকে জানিয়েছিলাম, সত্যিই যদি ঘর বাঁধতে চাও তাহলে তোমার দ্বিধা কোথায়? চলো, আমরা সমাজ অতিক্রম করি। সমাজের আইনকে অতিক্রম করি। জীবনকে নিজেদের মতো চালনা করি। যদি না খেয়ে মরতে হয় তো মরবো। যদি খেয়ে বাঁচতে পারি তো বাঁচবো। চলো না, আমরা মানুষ হই!

তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। আমাদের আকাশে একটাই চাঁদ সূর্য। আমাদের পায়ের নিচে একটাই পৃথিবী। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসে একই বাতাস। আমাদের কান্নার অশ্রুতে লবণ থাকে। আমাদের হাসির ফোয়ারায় আনন্দ থাকে। আমাদের শিরায় শিরায় একই রক্ত প্রবাহিত হয়।

 

 

পিংকু তার শেষ চিঠিতে লিখেছিল, “ইচ্ছে করছে এখনই চলে যাই, কিন্তু যেতে পারছি না সমাজের ভয়ে নয়, অন্য কারো ভয়ে নয়, স্বয়ং আমার বাবা যদি শুনে থাকে আমি কোনো অন্য জাতের ছেলেকে বিয়ে ক’রছি তাহলে সঙ্গে সঙ্গে আমাকে তিন টুকরো করতে দেরি করবে না। আমি যেখানেই থাকি না কেন আমাকে কোনো মতেই ছাড়বে না। সারা জীবন যদি আমার বিয়ে না হয় তবুও ভালো, কিন্তু ভিন্ন জাতের ছেলেকে কখনোই নয়।” সুতরাং এরপরে আর কোনো পরিকল্পনা থাকতেই পারে না। শুধু কথা দিয়েই অনেক কথা বলা হয়ে গেছে। শুধু কল্পনার দ্বারাতেই অনেক সংসার করা হয়ে গেছে। এসব স্বপ্ন মাত্র। এসবের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। সুতরাং ওয়াক থু বলেই আমি আমার কাজে মনোযোগ দিয়েছিলাম। আমি আমার কবিতার কাছেই আমাকে মেলে ধরেছিলাম। তাহলে কেন পিংকু ‘দৌড়’ পত্রিকার দপ্তরে এসেছিল আমার খোঁজে?
অনেক পরে শুনেছিলাম ‘দৌড়’ পত্রিকা দপ্তরেই কোনো এক বন্ধুর মুখে এর কারণ। বিবাহের দিন যখন পিংকু মণ্ডপে উপস্থিত হয়েছিল, তখন নাকি পণের জন্য খুব দরাদরি করেছিল বরপক্ষ। এমনকি অপমানও করেছিল কন্যা পক্ষকে। পিংকু এর প্রতিবাদ করেছিল। বিয়ের বেনারসি পরেই মণ্ডপ থেকে উঠে চলে এসেছিল আর চেঁচিয়ে বলেছিল, “এরকম লোভী স্বার্থপর পরিবারের সন্তানকে আমি বিয়ে করবো না! চললাম, যেদিকে দুই চোখ যায়!” এই ছিল তার বিদ্রোহিনি রূপ। ক’য়েকদিন পরে সাহিত্য আড্ডায় আমি কলকাতায় এলে এসব খবর শুনতে পাই। কিন্তু আমাকে না পেয়ে পিংকু কী করেছিল আজ পর্যন্ত আমার কানে আসেনি। মাঝে মাঝে অবচেতনের স্তর ভেদ করে পিংকুর কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে কবিতায়। জাতপাত ধর্ম সমাজ এসব নিয়ে রাজনীতি চলে। এসব কখনো মানুষকে মানুষ হতে দেয় না। আমার আঠাশ বছরের আকাশে তখনও কোনো চাঁদের দেখা পাইনি। পৃথিবীতে কত চাঁদ উঠেছে, কত জোৎস্নার প্লাবন বয়ে গেছে। কত ডানাওয়ালা স্বপ্ন উড়ে উড়ে গেছে। আমি শুধু খালি হাত নিয়ে কাকতাড়ুয়ার মতো দাঁড়িয়ে থেকেছি প্রেমের খেতখামারে। আমার হৃদয়ের স্পন্দন কেউ শুনতে পায়নি।

ততদিনে ঊর্মি চাকরি পেয়ে গেছে দুর্গাপুরের একটি কলেজে। একদিন কাজের সূত্রে তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়ে অনেকক্ষণ তার জীবনকথা শুনতে পেয়েছি। সেই দিনই তার সঙ্গে প্রথম মোগলাই পরোটা খেয়েছিলাম। বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। খেতে খেতে গল্প বলেছিল তার প্রথম জীবনের পথভ্রষ্ট হওয়ার গল্প। প্রেম করে একজনের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল সে। তারপর কিছুদিন তার সঙ্গেই শয্যা গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সুখ হয়নি। সে প্রেমিক ছিল না শুধু, ছিল এক উড়ন্ত ভ্রমর। তাই সে ফুল পাল্টে পাল্টে বহু ফুলের মধু খাচ্ছিল যেটা একেবারেই ঊর্মি সহ্য করতে পারেনি। প্রেমের যে একনিষ্ঠতা যে একাগ্রতা তা ঊর্মির ছিল, কিন্তু ওর ছিল না। তাই সে আজ একা, বড় একা। তার কাছ থেকেই বুঝেছিলাম প্রেমের প্রাপ্তি যেমন শূন্যতা দূর করতে পারে না, তেমনি প্রেমের অপ্রাপ্তিও প্রেমের স্বপ্নকে মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না। রেলিং দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঊর্মির ঠান্ডা হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে তার উষ্ণতা অনুভব করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুতেই সেই উষ্ণতা জেগে ওঠেনি। নিভে যাওয়া আগুনের পাশে যেন দাঁড়িয়ে ছিলাম। আগুনের ফুলকি উড়ে আমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারেনি। তাই ফিরে এসেছিলাম ঊর্মির কাছ থেকেও। কবিতাকে এসব কথা বলতে বলতেই এক শূন্যের ভিতর দিয়ে হাঁটছিলাম। অনিশ্চিত জীবনের পরিধি বেড়েই চলেছিল কতদূর যেতে পারে এ জীবন? না, এসবের কোনো উত্তর পাইনি। চিঠি লেখাও কমে গিয়েছিল। চায়ের দোকানে মাথা গরম করে শুধু বিড়ির ধোঁয়ায় জীবন খুঁজতে খুঁজতে ক’য়েকটি পংক্তির জন্ম হচ্ছিল:
“ফেলে চলে গেছো
কত বর্ষাকাল একা একা মাঠে
বিদ্যুতের হুংকার
অথবা কালবৈশাখীর ধ্বংসনৃত্য
দেখতে দেখতে পুড়ছে সময়

ফসলহীন শুধু কর্তব্যের চাষে

বিধুর কৃষক আমি
নিয়ত আকালে বেঁচে আছি—
বেঁচে থাকার অভিধানে আর কী কী থাকে?
যন্ত্রণার বাগান, বাগানে আগুনফুল
ফুলে ফুলে অলীক ভ্রমর—
ঘামগন্ধ নুন আর ছেঁড়া জীবনের বৃন্ত
নীল, নীলমাধুর্যের কিশলয়…

কবে ফেলে গেছো আশ্বিন
একটিও অবশিষ্ট শিউলি নেই
শুধু মুখপোড়া দিন
আর প্রার্থনার মূর্খ দেবালয়” (অব্যবস্থা)
🍁(চলবে)

 

 

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার | কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার | অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : ফিরে পড়া : প্রবন্ধ, মহামিলনের কথা বিভাগের লেখা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment