Sasraya News

Sasraya News, Sunday’s Literature Special | Issue 60 | 13 April 2025| Nababarsho Issue | সাশ্রয় নিউজ, রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | নববর্ষ সংখ্যা | ১৩ এপ্রিল, ২০২৫

Listen

সম্পাদকীয়

য়লা বৈশাখ নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন কিছু বলবার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু, বাঙালিয়ানা ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে পয়লা বৈশাখের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
তাই বলতে পারি যে, পয়লা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, বাঙালিদের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। এটি কেবল একটি ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টে যাওয়া নয়, বরং এটি বাঙালির সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জাতিসত্তার এক উজ্জ্বল প্রতিফলন।
বাংলার ইতিহাসে গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক (৭ম শতক, আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্টাব্দে) প্রথম একজন শাসক যিনি স্বতন্ত্র বাংলা ক্যালেন্ডার চালু করেন বলে কিছু ঐতিহাসিক ধারণা করেন। যদিও তার ব্যবহৃত ক্যালেন্ডার ঠিক কেমন ছিল তা নিয়ে বিতর্ক আছে, তবে “শকাব্দ” বা “শশাঙ্কাব্দ” নামে এক ধরণের স্থানীয় বর্ষপঞ্জি ব্যবহারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এটি বাংলা অঞ্চলের এক নিজস্ব সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রারম্ভ হতে পারে বলে জানা যায় তবুও বলা যায় যে, পয়লা বৈশাখ শুধুই নতুন বছরের শুরু নয়, এটি বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পরিচয়ের এক গৌরবময় প্রতীক। শশাঙ্কের সময় থেকে শুরু করে আকবরের প্রশাসনিক প্রয়োজনে এর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ—সবকিছুই এক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার ফল। আবার উল্টো দিকে জানা যায় যে, বাংলা সনের উৎপত্তি ঘটে মোগল সম্রাট আকবরের শাসনামলে (১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দ)। হিজরি চান্দ্র বছরের সঙ্গে মিল রেখে কৃষিকাজ ও রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে আকবর বাংলা সনের প্রচলন করেন, যার ভিত্তি ছিল সৌর বর্ষ। বিশেষ ভাবে বলা যায় যে, এর আগেও য়খন বঙ্গ অঞ্চলে রাজা শশাঙ্কের স্থানীয় ক্যালেন্ডার ব্যবহারের সূচনা করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ পাওয়া যায়, তবে এটি ছিল এক স্বতন্ত্র কালের নির্দেশক। বাংলা সনের সূচনা মোগল সম্রাট আকবরের আমলে (১৫৮৪ সাল) হলেও, তারও বহু আগে বাংলায় স্থানীয় ক্যালেন্ডার ব্যবহৃত হতো। আকবর প্রশাসনিক প্রয়োজনে ফসলি সনের ভিত্তিতে হিজরি ও সৌর ক্যালেন্ডারের সমন্বয়ে বাংলা সাল প্রবর্তন করেন, যাতে খাজনা আদায়ের সুবিধা হয়। এই সনকে বলা হয় “ফসলি সন” বা “বাংলা সন”, যা পরে “বাংলা বর্ষ” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই আকবরের সময়কার ক্যালেন্ডারই কালক্রমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ‘পয়লা বৈশাখ’ উদযাপন ঐতিহ্যরূপে গড়ে ওঠে।

 

 

বাঙালি বলতে মূলত বাংলা ভাষাভাসি মানুষের কথায় উল্লেখ হয়ে থাকে যেখান বাঙালি জাতির ঐতিহ্য আজও চিরন্তন।
আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের সূত্র ধরে এই বাংলা বর্ষপঞ্জি একটি সৌর পঞ্জিকা, যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে পয়লা বৈশাখ হিসেবে পালিত হয়। ১৯৬৬ সালে বাংলাদেশে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি বাংলা সনের সময় গণনায় সংস্কার আনে, যাতে প্রতি বছর পয়লা বৈশাখ একই দিনে আসে। বর্তমানে, বাংলাদেশে এটি ১৪ই এপ্রিল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ১৫ই এপ্রিল পালিত হয়। আমাদের জীবনে পয়লা বৈশাখের উদযাপন ও বাঙালিয়ানার ঐতিহ্য রক্ষা করা আমাদের আগামী  প্রজন্মের কাছে আমাদের সংস্কৃতি ও বাঙালি আদবকায়দায় এই বিশেষ দিনটি পালন করা। পয়লা বৈশাখ উদযাপন এখন কেবল একটি দিন নয়—এটি বাঙালির প্রাণের উৎসব। ভারতবর্ষ এর পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের নববর্ষ শুরু হয় কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “এসো হে বৈশাখ” গানের সুর তুলে বিভিন্ন মঞ্চে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে বসন্তের বিদায় বেলায় রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীদের কণ্ঠে আকাশ বাতাস জাগরীত করে। অনেকে স্থানেই কবিতা গান বাউল এমন কি বৈশাখী মেলাও দেখতে পাওয়া যায়। উল্টো দিকে ওপার বাংলায় মানে আমাদের বাংলাদেশে সকালেই “সুবহে সাদিক”-এর আলো ছুঁয়ে রমনা বটমূলে ছায়ানটের গান দিয়ে ঢাকায় শুরু হয় নববর্ষ।
সুন্দর করে বলতে গেলে বলা যায় যে, গ্রামে-গঞ্জে হয় বৈশাখী মেলা, নাগরদোলা, হাট-বাজারে হালখাতা। দোকানদাররা পুরনো দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতা খোলেন, যার নাম হালখাতা। এই উপলক্ষ্যে ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করানো হয়। নারীরা পরে লাল-সাদা শাড়ি, পুরুষেরা পরে পাঞ্জাবি-পাজামা। ঘরে ঘরে রান্না হয় পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ ও নানান ঐতিহ্যবাহী খাবার। পয়লা বৈশাখ উদযাপনে বাঙালিরা বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী রীতি ও আচার পালন করে।

সময় বদলেছে, প্রযুক্তি বদলেছে, জীবনধারা বদলেছে—তবুও পয়লা বৈশাখে বাঙালির প্রাণের টান আজও অমলিন। শহুরে জীবনেও এই দিনে একটুখানি “গ্রামীণ ঘ্রাণ” পাওয়ার চেষ্টা চলে। ডিজিটাল যুগেও মানুষ হারিয়ে যেতে চায় সেই পুরনো বৈশাখী আবহে—মাটির গন্ধে, লাল-সাদা পোশাকে, বৈশাখী গানের সুরে। পয়লা বৈশাখ আমাদের কাছে কেবল একটি দিন নয়—এটি বাঙালির সংস্কৃতির প্রতীক, ঐক্যের বন্ধন, আনন্দের উপলক্ষ। বংশপরম্পরায় চলে আসা এই দিন আমাদের ঐতিহ্যের স্মারক হয়ে বেঁচে আছে আগামীতেও থাকবে । সময়ের সাথে এর রূপ বদলালেও, এর মূল আবেগ আজও বাঙালির হৃদয়ে একইরকমভাবে জাগ্রত। পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে ফিরে আসে নবজাগরণের বার্তা নিয়ে, যেমন করে আসে নতুন দিনের সূর্য।
নতুন পোশাকে নতুন সাজে শুভ নতুন বছরের আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও ভালবাসা জানাই আমাদের সকল পাঠক পাঠিকা লেখক লেখিকা সাংবাদিক ও অফিস কর্মীবৃন্দদের ।
সকলেই ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন আগামী বছর শুভ হোক সকলের। এক আকাশ ভালবাসা রইল আগাম।

 

 

 

🍂মহামিলনের কথা 

 

শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
যে আমাকে সহস্রনামের দ্বারা স্তব করতে ইচ্ছা করে—যদি সব পাঠে সমর্থ না হয়, মাত্র একটি শ্লোক উচ্চারণ করলেও আমি স্তুত হয়ে থাকি। স্তবকারীকে আমি বড় ভালবাসি।
স্তবকারীকে তুমি ভালোবাস কেন?
দেখরে জীব আমার অংশ। আমাকে ভুলে দেহাত্মবোধে উন্মাদ হয়ে কত দুঃখ ভোগ করে। জন্ম-জন্মান্তর ধরে বহু বহু আকাঙ্খা করে কত কষ্ট পায়। সে যা চায় আমি তাই হয়ে তাকে আত্মদান করি।
তুমিই সব হও?
হাঁ, যখন জীব স্ত্রী চায়,আমি স্ত্রী হই ; যখন সে পুত্র,মিত্র,আত্মীয়-স্বজন মান সম্ভ্রম বিদ্যা তপস্যা চায়,আমি তাই হয়ে তার সেবা করি,কিন্তু তাতে অশান্তি ভিন্ন শান্তি পায় না। যতক্ষণ বহুদর্শন থাকে,ততক্ষণ শান্তির আশা করা উন্মাদ কল্পনা। সহস্র সহস্র জন্ম যাতনা পেয়ে যখন সে প্রকৃত আমাকে চায়,তখন আমি তাকে ধরা দিই। প্রকৃতরূপে চাইবার সহজ সরল পথ হল আমার নাম করা,স্তব করা।
বল, তোমার মুখে তোমার স্তব শুনতে বড় ভাল লাগে।
আমার মুখ ভিন্ন আর মুখ কি আছে? জগতে যত মাথা আছে, যত হাত পা জ্ঞান কর্ম্মাদি ইন্দ্রিয় আছে,সব আমার। আমি সব হয়ে সব ব্যাপ্ত করে অবস্থান করি। অনন্তকোটি ব্রহ্মাণ্ডে অনন্ত অনন্ত কোটি স্থাবর জঙ্গম হয়েও আমি ফুরিয়ে যাই না। পূর্ণ আমি অনন্ত সেজেও স্বরূপে সেই পূর্ণই থাকি। তোর কি আমার এই রূপ দেখতে ইচ্ছা করে না?
আমি তোমার। আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা তুমি সব নাও। তোমার যা ইচ্ছা তাই কর। আমি আর তোমায় কিছু বলবো না। আমি তোমার শরণাগত।
হাঁ,এ কথাটি স্মরণ রাখতে চেষ্টা কর,আমি তোর যোগক্ষেম বহন করবো,অনন্য ভক্তের যোগক্ষেম আমিই করে থাকি।
তোমার ‘তবাস্মি’ এ মন্ত্রটি আমাকে চিরদিনের জন্য দাও। আমি যেন একপল মাত্র ‘তবাস্মি’ এই মহামন্ত্রটি না ভুলে যাই।
বল্,কেবল বল্—
কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ! কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ!
আবার বল্—
জয় ব্রজনাথ জয় জয় ব্রজনাথ।
জয় ব্রজনাথ জয় জয় ব্রজনাথ॥

—শ্রীশ্রী ঠাকুর সীতারাম দস ওঙ্কারনাথ দেব 

ঋণ : শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী
শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী 🍁 (বানান অপরিবর্তিত)

 

 

 

 

🍂ফিরেপড়া | প্রবন্ধ

তাঁহার চিত্তের মধ্যে ভারতের একটি মানসী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই মূর্তিটি ভারতেরই সনাতন বাণীর উপকরণে নির্মিত। সেই বাণীর সহিত তাঁহার নিজের ধ্যান নিজের মনন সম্মিলিত ছিল। তাঁহার সেই স্বদেশপ্রীতির মধ্যে ব্রাহ্মণের জ্ঞানগাম্ভীর্য ও ক্ষত্রিয়ের তেজস্বিতা একত্র সংহত হইয়াছিল।

ব্যক্তিপ্রসঙ্গ

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

 

রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী

“আমার শরীর ভালো নাই আমার অবকাশও অল্প। রামেন্দ্রসুন্দরের সম্বন্ধে মনের মতো করিয়া কিছু লিখিব এমন সুযোগ এখন আমার নাই। শুধু শ্রদ্ধা নহে, তাঁহার প্রতি আমার প্রীতি সুগভীর ছিল, এ কথা আমি পূর্বেও বলিয়াছি। কিন্তু এ কথা বলিবার লোক আরও অনেক আছে। যে কেহ তাঁহার কাছে আসিয়াছিল, সকলেই তাঁহার মনীষায় বিস্মিত ও সহৃদয়তায় আকৃষ্ট হইয়াছে। বুদ্ধির, জ্ঞানের, চরিত্রের ও উদারহৃদয়তার এরূপ সমাবেশ দেখা যায় না। আমার প্রতি তাঁহার যে অকৃত্রিম অনুরাগ ছিল তাহা তাঁহার ঔদার্যের একটি অসামান্য প্রমাণ। আমার সহিত তাঁহার সামাজিক মতের ও ব্যবহারের অনৈক্য শেষ পর্যন্ত তাঁহার চিত্তকে আমার প্রতি বিমুখ করিতে পারে নাই; এমন-কি, প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাহিত্য-পরিষদের পক্ষ হইতে একদা আমার প্রশস্তিসভার আয়োজন করিতে তিনি কুণ্ঠিত হন নাই।

বাংলার লেখকমণ্ডলীর মধ্যে সাধারণত লিপিনৈপুণ্যের অভাব দেখা যায় না; কিন্তু স্বাধীন মননশক্তির সাহস ও ঐশ্বর্য অত্যন্ত বিরল। মনন ও রচনারীতি সম্বন্ধে রামেন্দ্রসুন্দরের দুর্লভ স্বাতন্ত্র্য ছিল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁহার সেই খ্যাতি বিলুপ্ত হইবে না। বিদ্যা তাঁহার ছিল প্রভূত, কিন্তু সেই বিদ্যা তাঁহার মনকে চাপা দিতে পারে নাই। তিনি যাহা বলিতেন, তাহার বিষয়বিচারে অথবা তাহার লেখন-প্রণালীতে অন্য কাহারো অনুবৃত্তি ছিল না।

দেশের প্রতি তাঁহার প্রীতির মধ্যেও তাঁহার নিজের বিশিষ্টতা ছিল; তাহা স্কুলপাঠ্য বিলাতী ইতিহাস হইতে উদ্ধৃত তৎকালীন কন্‌গ্রেস তোতাপাখি-কর্তৃক উচ্চারিত বাঁধাবুলির দ্বারা পুষ্ট ছিল না। তাঁহার চিত্তের মধ্যে ভারতের একটি মানসী মূর্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। সেই মূর্তিটি ভারতেরই সনাতন বাণীর উপকরণে নির্মিত। সেই বাণীর সহিত তাঁহার নিজের ধ্যান নিজের মনন সম্মিলিত ছিল। তাঁহার সেই স্বদেশপ্রীতির মধ্যে ব্রাহ্মণের জ্ঞানগাম্ভীর্য ও ক্ষত্রিয়ের তেজস্বিতা একত্র সংহত হইয়াছিল।

জীবনে তিনি অনেক দুঃখ পাইয়াছিলেন। প্রিয়জনের মৃত্যুশোক তাঁহাকে বারংবার মর্মাহত করিয়াছে। তিনি যে-সকল ব্রত গ্রহণ করিয়া প্রাণপণে পালন করিতেছিলেন তাহাতেও নানাপ্রকার বাধাবিরুদ্ধতা তাঁহাকে কঠোর ভাবে আক্রমণ করিয়াছে। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও তাঁহার অজস্র মাধুর্যসম্পদের কিছুমাত্র ক্ষয় হয় নাই– রোগ তাপ প্রতিকূলতার মধ্যে তাঁহার প্রসন্নতা অম্লান ছিল। বিরোধের আঘাতে তাঁহাকে গভীর করিয়া বাজিত, অন্যায় তাঁহাকে তীব্র পীড়া দিত, কিন্তু তিনি ক্ষমা করিতে জানিতেন। সেই মাধুর্য সেই ক্ষমাই ছিল তাঁহার শক্তির প্রকাশ।

তিনি যদি কেবলমাত্র বিদ্বান্‌ বা গ্রন্থরচয়িতা বা স্বদেশপ্রেমিক হইতেন, তাহা হইলেও তিনি প্রশংসালাভ করিতে পারিতেন। কিন্তু তাঁহার মধ্যে স্বভাবের যে একটি পূর্ণতা ছিল, তাহারই গুণে তিনি সকলের প্রীতি লাভ করিয়া গিয়াছেন। এমন পুরস্কার অতি অল্প লোকেরই ভাগ্যে ঘটে।”

২৮ ফাল্গুন, ১৩২৪

 

 

 

🍂প্রচ্ছদ কথা 

 

 

আমাদের মেয়েবেলা বা ছেলেবেলার সময়গুলোতে দেখেছি বৈশাখ মাস আসার আগে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীরা যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে নৃত্য এবং সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আনন্দ দেবার চেষ্টা করতেন শুধু তাই নয়, এই সময় বহুরূপীরাও নানা রূপ ধারণ করতেন শিব দুর্গা, হনুমান, রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ এই বহুরূপীর সাজগুলো যেন ক্রমশ যান্ত্রিকতার কবলে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে।

 

 

এসো হে বৈশাখ এসো এসো…

মমতা রায় চৌধুরী

 

 

হেলা বৈশাখ সম্পর্কে বলতে গেলে বা নববর্ষ সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানটি বারবার মনে নাড়া দিয়ে
যায়। বাঙালির আবেগ যেন এই গানটিকে ঘিরে বর্ষবরণের এই উৎসবকে ঘিরে আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। তাই কবির কথাতেই আসি :
‘হে নূতন দেখা দিক আর বার
জন্মের প্রথম শুভক্ষণ
তোমার প্রকাশ হোক
কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন।’
একদমই তাই পহেলা বৈশাখ যেন আমাদের মনের ভেতরের সেই কুহেলিকা উদঘাটনকারী নতুন সূর্যের আলো। মনের ভেতরের জমানো যত যন্ত্রণা কষ্ট, দুঃখ, জরা, জীর্ণতা, ক্লান্তি সব ধুয়ে মুছে দিয়ে বাঙালি যেন এই প্রভাতে নতুন করে জেগে ওঠে।
তাই বৈশাখ মানেই বাঙালি জাতির ঐতিহ্যবাহী এই বর্ষবরণের দিন। আর বৈশাখ মানেই বাঙালিয়ানা উৎসবের ঘনঘটা।

 

সেই দিনগুলোতে আমরা প্রত্যেকে রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে পড়তাম সেই নগর সংকীর্তন দেখার জন্য। আজ আর সেসব কিছু হয় না বরং সেসব জায়গায় নববর্ষ উদযাপনের ভেতরে যেন আলাদা চাকচিক্য এসেছে কিন্তু সেই চাকচিক্য মনে ভয়াবহ বাতাতারণ সৃষ্টি না করে।

 

পহেলা বৈশাখ হল বাংলা অব্দের প্রথম দিন তথা বাংলা নববর্ষ।বাংলা আকাদেমি কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক বাংলা পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই দিনটি পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতবর্ষের নানা স্থানে এবং ভারতবর্ষের বাইরে বাংলাদেশেও খুব সুন্দরভাবে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল আর আমাদের দেশে তথা পশ্চিমবঙ্গে চান্দ্রসৌর পঞ্জিকা অনুসারে ১৫ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। শুধু তাই নয় এই পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশসহ পশ্চিমবঙ্গে সরকারি ছুটির দিন হিসেবেও পালন করা হয়।

 

 

বাংলা নববর্ষের সূচনা হয় সম্রাট আকবরের সময় থেকে। সুষ্ঠুভাবে কর আদায়ের সুবিধার্থে এই দিনটাকে বেছে নেওয়া হয়। তাছাড়া হালখাতা নববর্ষে করা হয় তাতে ব্যবসায়ীকেরা চৈত্র মাসের সমস্ত ধার বা বকেয়া খরিদ্দারদের কাছ থেকে চুকিয়ে নেন এবং নববর্ষের প্রথম প্রভাতে মিষ্টি মুখের মধ্যে দিয়ে পরস্পরের মধ্যে আবার একটা হার্দিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রচেষ্টা করা হয়। সে যাই হোক, এটা একটা অর্থনৈতিক ব্যাপার পরস্পরের মধ্যে। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে রয়েছে বাঙালির এক আত্মিক মেলবন্ধনের শুভ প্রচেষ্টা। এই দিনটিতে ভাল খাওয়া, ভাল পরা যেন বাঙালি ভবিষ্যতের মঙ্গলময় একটা বার্তা দিতে চায়। এই দিনটিতে আত্মীয় পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সকলকে গৃহে আমন্ত্রণ করা হয় তারপর নানা খাবার দাবার এবং মিষ্টিমুখের মধ্যে দিয়ে হার্দিক শুভেচ্ছা বিনিময় করা হয়। আসলে নববর্ষ বাঙালির জাতীয় জীবনের এক সর্বজনীন উৎসব এটা আমরা বলতেই পারি। এই দিনটিতে বাঙালি জাতি নানা উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকে। এটি একটি অসাম্প্রদায়িক উৎসবও আমরা বলতে পারি।নববর্ষ বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে এক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আনে। গতানুগতিক জীবন ধারার মধ্যে নববর্ষ নিয়ে আসে এক নতুন সুর, নতুন উন্মাদনা ,নতুন আবেগ, নূতন ছোঁয়া পুরনো দিনের গ্লানি, ক্লান্তি, জরাকে মুছে দিয়ে একরাশ হিমেল হাসি, আনন্দ আর গান দিয়ে ভুলিয়ে দিয়ে যায় নববর্ষ। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে তাই এটি একটি বাঙালির অতন্দ্র প্রাণের উৎসব। তাই এই দিনটিকে স্বাগত জানাতে বাঙালিরা কোনও কার্পণ্য করে না।

এই দিনটি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমে আমাদের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। তবে আমাদের ছেলেবেলার সঙ্গে আজকালকার ছেলেবেলা বা মেয়েবেলার দিনগুলো অনেক পাল্টেছে। এখন স্মার্টফোন হাতে পেয়েছে ছেলেমেয়েরা। যেটা আমাদের সময় ছিল না তাই আমরা উৎসবকে যেন আরও অনেক বেশি আত্মিক দিক থেকে উপভোগ করতে পারতাম। মনে পড়ে আমাদের মেয়েবেলা বা ছেলেবেলার সময়গুলোতে দেখেছি বৈশাখ মাস আসার আগে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীরা যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে নৃত্য এবং সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে আনন্দ দেবার চেষ্টা করতেন শুধু তাই নয়, এই সময় বহুরূপীরাও নানা রূপ ধারণ করতেন শিব দুর্গা, হনুমান, রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ এই বহুরূপীর সাজগুলো যেন ক্রমশ যান্ত্রিকতার কবলে কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। তবুও যখন দেখতে পাই, দু-এক জায়গায় এই বহুরূপীর তখন মনটা কেমন যেন হুহু করে ওঠে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে আমাদের সেই স্মৃতি মধুর দিনগুলোতে। আর গাজন উৎসবকে কেন্দ্র করে আমাদের মনের ভেতরে থাকত একটা টানটান উত্তেজনা। তবে একটু ভয়ও পেতাম সন্ন্যাসীরা পিঠে বরশি বিধিয়ে যখন পাই পাই করে ঘুরতেন তখন সন্ন্যাসীদের জন্য করুণায় মনটা কেমন যেন করত। বর্ষের শেষ দিনে অর্থাৎ চৈত্র মাসে শেষ দিনের অবসান হলেই আস্ত সেই প্রতীক্ষিত নতুন ভোর, নতুন প্রভাত বৈশাখের প্রথম দিন আর এই দিনটিকে ঘিরে আমাদের সবার এদের মধ্যে একটা টানটান উত্তেজনা। আমরা হয়ত সেই সময় নতুন পোশাক সব সময় পরতে পারতাম না কিন্তু মনের ভেতরে সেই উচ্ছ্বাস ওই দিনটাকে ঘিরে বিশেষত দোকানে হালখাতা সেই হালকা খতার মিষ্টির প্যাকেট কারা কতগুলো জমাতে পেরেছে কাদের বেশি হয়েছে সে উত্তেজনা নিয়ে সঙ্গী-সাথীদের দেখাতে যেতাম। তারপর বাড়িতে মা’কে দেখতাম বা জেঠিমা ঠাকুমাদের দেখতাম যে নূতন চালের পায়েস করে আমাদের গোপাল ঠাকুরের জন্য ভোগ করতে। যদিও নববর্ষের প্রথম প্রভাতে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই এরকম ভাল মন্দ খাওয়া চলত। আমাদের বাড়িতে ছিল গোপাল ঠাকুরকে পায়েস করে খাওয়ানো গোপাল ঠাকুরের নতুন জামা পরানো হত। আর নববর্ষের প্রথম প্রভাতে ঠাকুর ঘরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করতে হতো এই রীতিটা ছিল আমাদের। শুধু তাই নয় আমাদের গ্রামেতে দেখতাম নববর্ষের প্রথম প্রভাতে নগর সংকীর্তন করতে। চারিদিকে ধুপ-ধুনুর ধোঁয়ায় এক স্বর্গীয় মায়া-ময় পরিবেশের সৃষ্টি করত সে এক নস্টালজিক দিন ছিল। সত্যি সেই দিনগুলোতে আমরা প্রত্যেকে রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে পড়তাম সেই নগর সংকীর্তন দেখার জন্য। আজ আর সেসব কিছু হয় না বরং সেসব জায়গায় নববর্ষ উদযাপনের ভেতরে যেন আলাদা চাকচিক্য এসেছে কিন্তু সেই চাকচিক্য যেন মনে ভয়াবহ বাতাতারণ সৃষ্টি না করে। যান্ত্রিকতা যেন এই নববর্ষের মিষ্টি হিমেল সুন্দর মুহূর্তকে গ্রাস করতে চাইছে। তাই ডিজের মতো মাইকের ব্যবহার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। শুধু মনে হয় কবির কথায় :
‘বছর শেষে ঝরা পাতা
বলল উড়ে এসে
একটি বছর পেরিয়ে গেল
হাওয়ার সাথে ভেসে
নতুন বছর আসছে
তাকে যত্ন করে রেখো…
স্বপ্নগুলো সত্যি করে
খুব ভালো থেকো।’

নববর্ষের প্রথম প্রভাত আসলে এই কথাগুলোই সব থেকে বেশি মনের ভেতরে দানা বাঁধে। বৈশাখ মানেই নতুন পোশাক, খুশির উল্লাস বৈশাখ মানেই মুখ মিষ্টি, বাঙালির তৃপ্তি, বৈশাখ মানেই রবীন্দ্র স্মরণে বিশ্ব কবি।
এ কথা যেন আমরা না ভুলি।
তাই নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে এ কথাই বারবার বলতে চাই এই নূতন প্রভাত থেকেই বাঙালির মন গেয়ে উঠুক
‘নব কিরণে জাগো
আজি নব রবি কিরণে’।
পয়লা সবার হোক। নববর্ষের প্রথম প্রভাতে বিশ্বের কল্যাণ হোক। শত শত শঙ্খের ধ্বনিতে ঘুচে যাক শত দুঃখ কষ্ট।” তাই এভাবেই বারবার ফিরে এসো বৈশাখ।🍁

 

 

🍂 বিতা 

 

 

আদিউত্তম-এর একটি কবিতা 

 

 

পয়লা বৈশাখ

আজ তুমি এসে নতুনের ডাক দিয়ে যাও
আমি চেয়ে থাকি বসন্ত কোকিলে
শেষ চৈত্রের রাতে শেষ ডাক শুনে
বোশেখের ডাকে যেন গেয়ে যায় গান
তুমি আমার সমান
বাঙালিবেলার গানে
আড্ডা আবহের টানে
মিশে যায় বাঙালি সম্মান
তুমি আমার বৈশাখ
তুমি পয়লা বৈশাখ।

 

 

অচিন নীল-এর একটি কবিতা 

বৈশাখের ডাক

 

 

ঘর থেকে ঘুরে গেল রাত

রাত পোহালেই তুমি এক নতুন রূপেই ব্যস্ত—
গান গাও সুর তোলো নতুন ফসলে

আদরের ডাকে আমি তোমাকে ডাকি
তুমি নতুন পোশাকে এসে গেলে
আমি হলুদ কুড়োই

প্রথম প্রেমের মত ডাকো
ভালবেসে ডাকো
পহেলা বৈশাখ

নতুন বছরের আগে চৈত্রের শেষে
নীলষষ্ঠীর উপবাস থাকে
ছত্রে ছত্রে সেজে ওঠে আদি অনন্ত উন্মাদ
ভক্তের যুগল ভালোবাসা দিয়ে লাল সালু মুড়ে চরকের ডাক
তুমি অনন্ত আদিনাথ

আমার প্রেমিকা প্রথম পোশাক এই পয়লা বৈশাখ
আজও আছে আগামীতেও থাকবে যুগ যুগান্তর ধরে বাঙালির আহ্বান

এ আমার ইতিহাস
এ আমার সংস্কৃতি
এ আমার বিশ্বাস

 

 

তন্বী মুখোপাধ্যায়-এর দু’টি কবিতা

 

পেঁচা

ঝুপ করে ঝাঁপ দিয়ে শুধু শাদা-কালো আলসে ছেড়ে
বাতাসে ভেসে আসার পর পুরোনো কবরখানায় এখনও চলে ইঁদুর শিকার

শরতের পাতা- ঝরা ডালে হাল্কা পাতার মতো লেগে থেকে
শক্ত হয়ে নখে নখে বেঁধে থেকে এখনও শাদা পেঁচা নিরাপদ বোধ করে-
অন্ধকার নৈশতা নিষ্পাপ চরিত্র থেকে
তেলতেলে চটচটে মজে ঘন বাষ্পে লুকিয়ে নিত্য বিস্মৃত
বদল হয় কোটর ছাপিয়ে, দূরে বিবরে ওঠে তাপ-গন্ধ সমস্ত রঙের ধূসর পেঁচার গায়ে সাত-চূর্ণ— রোজ পড়ে কলরব শুরু করে বেঁচে থাকা ভোরের কাকেরা—

 

পরতে পরতে বাঁধন

নিমীল নয়ন, নয়ন মণি কেউ দেখে না।
ঢেউ দেয়, বাতাস বিরুদ্ধ, জল উঁচুতে উৎক্ষিপ্ত, ভেঙে পড়ে বারবার-

মিশে যেতে বাধা পায় মহাসাগরের বান ফিরে আসে।
দুর্বহ ক্লান্তি নিয়ে রাতজাগা কাজ যে-কোনো সময় ধ্বসে পড়বে এমন পাঁচিল -আমাদের পাঠশালার আশেপাশে জেগে ওঠে
নামতা পড়তে সুর লাগে না-
আশঙ্কা ক্রমশ দলছুট আরো লোক ওদের সঙ্গে মিশে যাবে-

 

 

গোলাম কবির-এর একটি কবিতা

 

 

নির্ভীক ছাই

ভেজা ও শুকনো কাঠ পুড়ে কয়লা হয়।
কয়লাও একটা সময়
ইচ্ছে করলে পোড়াতে পারো
কিন্তু আমি তো নই
শুকনো কিংবা ভেজা কাঠ অথবা কয়লা,
যাকে তুমি ইচ্ছে মতো পোড়াবে!

ভালবাসার আগুনে পুড়ে পুড়ে
আমি এখন ছাই হয়ে
তোমার আকাশে উড়ছি তো উড়ছিই!

আমি এখন নির্ভীক ছাই!
আমাকে এখন আর
পুড়ে যাবার ভয় দেখিও না।

ভেজা ও শুকনো কাঠ পুড়ে কয়লা হয়।
কয়লাও একটা সময়
ইচ্ছে করলে পোড়াতে পারো
কিন্তু আমি তো নই
শুকনো কিংবা ভেজা কাঠ অথবা কয়লা,
যাকে তুমি ইচ্ছে মতো পোড়াবে!

ভালবাসার আগুনে পুড়ে পুড়ে
আমি এখন ছাই হয়ে
তোমার আকাশে উড়ছি তো উড়ছিই!

আমি এখন নির্ভীক ছাই!
আমাকে এখন আর
পুড়ে যাবার ভয় দেখিও না।

 

রামপ্রসাদ দাস-এর একটি কবিতা

 

 

একজীবনে সে ও আমি

কাল যে ছিল আজ সে নেই, অরুন্ধতী নেই,তেমন কোনো ঝগড়া নেই, অন্তরঙ্গতা ও কিছুই ছিল না, তবুও সে আজ নেই, সাদা কাপাস তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ে গেল, আমি অবশ্য খোঁজার কোনো চেষ্টা করিনি, জানতেও চাইনি কেন সে নেই, নিভৃতে লুকানো হয়তো কিছু, গতকাল শান্ত ছিল প্রকৃতি, আজ হঠাৎ কালো মেঘ, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া, তেমন বৃষ্টি হয়নি, ঠিক অরুন্ধতী যেমন করে কাঁদে, খুব কষ্টে চোখ থেকে দু’এক ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে, আসলেই এখন আমার জাদু কোনো কাজ করে না, অবোধ আড়ালে কষ্টি পাথরের মন, ঝড় জল রোদে তার কোনো পরিবর্তন নেই, মাঝে মধ্যে নিজের প্রতি বিরক্তি আসে, সবাই উপদেশ দেয় আপোষ করে নাও, কার সঙ্গে? গাছের সঙ্গে কিংবা দেওয়ালের সঙ্গে, সবই কত তুচ্ছ অথচ মূল্যবান উপদেশ, এ যেন নদীর ওপর থেকে ব্রিজ ভেঙ্গে দেওয়া, এপার ওপার মানুষজন আটকে পড়বে, দুই পারের মানুষ আন্দোলন করবে, একে অপরের ওপর দোষারোপ করবে, মারামারি হবে পুলিশ লাঠি ছুঁড়বে কাঁদানে গ্যাস, আসলে নকল কোনো আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হয় না, এটাও একরকমের পলিসি, জীবন বীমার মতো ,মরতে হবে জেনেও বিমা করা, তার থেকে দেখি না কি না হয়, একটানা একজীবন তো হয় না, একান্ত কিছু না হলে, খোলা ময়দানে ঘাসের বিছানায়, একটা নিশ্চিন্ত ঘুম…

 

সানি সরকার-এর একটি কবিতা

 

 

গান ও গন্তব্য 

গান বিছানার ওপর ঘুমিয়ে পড়েছে
আর বাজতে বাজতে জলের গ্লাসের মত
গড়িয়ে পড়ছে
আস্তে-আস্তে
যেভাবে কংক্রিট পুড়তে পুড়তে
ওপরে ওঠে
গান
তেমনি
ঝোরার জলের মত ধীর
নৌকোর মতনই ছলাৎছল বইছে
পাঁচটি শেকলের ভেতর একি চমৎকার বহমান
আমি শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে
ছাদের ওপর, শীতের ঘ্রাণ ও চাঁদের তাপ
বুকে নিয়ে দেখছি
আমার সাপের খোলসের মতন দেহ-কাঠামো
ভীষণ নিথর এবং সেটি বরফের গাছের মতন

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ২২
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ২২।

একটি বিষণ্ণ রাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

বাইশ.

এই বিকেলটুকু একটা গাছতলায় বসেছি 

বিদঘুটে একটা সময় গ্রাস করেছিল। সারাদিন টিউশানি করে ঘুরে বেড়াই। সন্ধ্যাবেলায় সাইকেলের বেল বাজিয়ে বাড়ি ফিরি। বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারি না মনে হয় সব অক্সিজেন ফুরিয়ে গেছে। ক’য়েকটি পত্রিকায় লেখা পাঠাই, লেখা ছাপাও হয়, ডাকযোগে পত্রিকা আসে। শীতের রোদ্দুরে বাইরে গিয়ে বসি। খড়ের গাদা। মাঝে মাঝে খড়ের উপর শুয়ে পড়ি। ছোটবেলায় মাঠে মাঠে ঘুরে ঝরা ধান কুড়িয়ে জমা করতাম। ইঁদুর গর্তের ধান মাটি কেটে তুলে আনতাম। তারপর একটু বড় হয়ে মাঠে মাঠে মুনিষ খেটে রোজগার করতে হতো। ঘাস কেটে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। এখন ভরা যৌবনে খড়ের গাদায় শুয়ে থাকি। একটা খাতা ও কলম হাতের কাছে থাকে। আন্দামান থেকে প্রকাশিত ‘বাকপ্রতিমা’ পত্রিকায় লিখতে হবে একটি গদ্য তারই প্রস্তুতি চলছে। বেশ কিছু আগে থেকেই ওই পত্রিকায় কবিতা লিখে আসছি। আমার কবিতা পড়ে কিছু পাঠিকাও তৈরি হয়েছে। হঠাৎ করে একটা চিঠিও পেয়েছি এক পাঠিকার। সম্পাদকের কাছে ঠিকানা নিয়েই সে আমাকে চিঠি লিখেছে।
“মাননীয় কবি,
আপনার ‘ভুল’ কবিতাটি আমাকে খুব ভালো লেগেছে। মানুষের জীবনের একটি ভুল কতখানি মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে এবং সারা জীবনের ভুল হয়ে ধরা দেয় তা এই কবিতাটিতেই বুঝতে পেরেছি। ছোট্ট তিন লাইনের কবিতাটিতে একটা সমগ্র জীবনের অভিজ্ঞতাকে আপনি মন্থন করে তুলে এনেছেন। আপনার আরো কবিতা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। ইতি আপনার অনুরাগিনী
বিনীতা”

 

একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছিল চিঠি লেখার। চিঠি যে একটা নিখুঁত সাহিত্যচর্চা তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্র’ চিঠিতেই সাজিয়েছেন। ব্যক্তি জীবন থেকে প্রকৃতি, লেখার নানা অনুষঙ্গ, সমসাময়িক জীবনদর্শন, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও দেশপ্রেম সেসব চিঠির মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। আমাকেও সেই কবিতা নিয়ে চিঠি লিখতে লিখতে জীবনের অনেকখানি ভিতরেই প্রবেশ করতে হয়েছে। কেননা চিঠি কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না।

 

ছোট্ট চিঠিটা পেয়ে আমি অভিভূত। কবিতা নিয়ে বহু চিঠি পেলেও একজন মুগ্ধ পাঠিকার চিঠির মূল্য অবশ্যই অন্যরকম। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে চিঠিটি উড়ে এসেছে। দূরের একটি চিঠি। সেখানেও আমার কবিতার পাঠিকা আছে এটা জেনেই গর্বে আমার হৃদয় ভরে গেছে। কবিতাটি এরকমই ছিল—
‘ব্যর্থ প্রেমের আড়াই লাইন’

“একটা ভুল আর একটা ভুলের কাছে যায়
একটা ভুল রাস্তা হারিয়ে ফেলে
একটা ভুল শুধু ভাসে কান্নায়”
প্রেমে ব্যর্থ মানুষ সর্বদা তার জীবনের ভুল পদক্ষেপের কথাই স্মরণ করে। একবার ভুল করে পুনরায় সে আবার ভুল করে। আর বারবার তার সেই ভুলের ভোগান্তি তাকে পোহাতে হয়। কবিতাটি যে ছিল সেই ভুলেরই একটি অভিজ্ঞতার উচ্চারণ। আন্দামান থেকে যে মেয়েটি লিখেছিল এই কবিতাটির কথা সেও এই ভুলের পথ দিয়েই আ’রেকটি ভুলে এসে পৌঁছেছিল। কেননা আমিই ছিলাম সেই ভুলের মশাল। আমাকে আলো ভেবেই সে চিঠি লিখেছিল— “একটি কবিতাই আমার জীবনের একটি মহাকাব্য চিরন্তন উচ্চারণকে মুদ্রিত করেছে। একটি কবিতা আমার অকথিত অনেক কথা বলে দিয়েছে।”

 

 

এই একটি ছোট্ট চিঠি লিখেই শুরু হল চিঠির আদান প্রদান। যতটা কবিতা লিখেছিলাম প্রায় সবগুলোরই সে মতামত পাঠাতো। শুধু মতামত পাঠিয়েই ক্ষান্ত হতো না, আমার প্রতিক্রিয়াও তার কাঙ্ক্ষিত ছিল। সুতরাং একটা বাড়তি দায়িত্ব এসে পড়েছিল চিঠি লেখার। চিঠি যে একটা নিখুঁত সাহিত্যচর্চা তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথ ‘ছিন্নপত্র’ চিঠিতেই সাজিয়েছেন। ব্যক্তি জীবন থেকে প্রকৃতি, লেখার নানা অনুষঙ্গ, সমসাময়িক জীবনদর্শন, সমাজ, ইতিহাস, রাজনীতি ও দেশপ্রেম সেসব চিঠির মধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে। আমাকেও সেই কবিতা নিয়ে চিঠি লিখতে লিখতে জীবনের অনেকখানি ভিতরেই প্রবেশ করতে হয়েছে। কেননা চিঠি কখনো এক জায়গায় থেমে থাকে না। কখনো একমুখী বিষয় নিয়েও লেখা হয় না। বিনীতা জেনে নিয়েছে কৌশলেই বাড়িতে কে কে আছে, আমি এখন কী করি, ভবিষ্যতে কী করবো, জীবন কি এভাবেই চলবে না এর পরিবর্তন হবে? আমার ধর্মবিশ্বাস, আমার উদারতা, আমার ব্যক্তিচেতনার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ও। সেই সঙ্গে সে নিজের কথাও আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। একদিন হঠাৎ করেই আন্দামানের ম্যাপ সম্বলিত একটি পুস্তিকা এবং পুস্তিকার সঙ্গে তার একটি পোস্টকার্ড সাইজ ফটোকপি আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আর বারবার অনুরোধ করে জানিয়েছে আমিও যেন আমার ছবি পাঠায় তাকে। হঠাৎ করে তার এই আবদার এবং ছবি প্রাপ্তি আমাকে অনেকখানি ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। বিনীতা এম-এস-সি পাস করে একটি বনস্পতি কোম্পানির চাকরিতে যোগ দিয়েছে। বাবা-মা নেই তাই তার কোনো দায়ও নেই। নিজেই সে নিজের অভিভাবক। দরকার হলে যেকোনো সময় পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো প্রান্তে সে চলে আসতে পারে। মেয়ে হলেও তার মাথায় মাথা ভর্তি চুল নেই। গায়ের রং শ্যামবর্ণ। মুখমণ্ডল আকর্ষণীয় নয় ঠিকই কিন্তু এক প্রতিজ্ঞাপ্রবণ কাঠিন্য ফুটে উঠেছে চেহারায়। চোখ দুটি অনেকটাই বড় বড়। শরীরের উচ্চতাও প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি। “তোমার পূর্বপুরুষ কোথাকার ছিল বিনীতা?” তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে সে জানিয়েছিল, “আমার পূর্বপুরুষ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী। আমার বাবা বহুদিন আন্দামানের সেলুলার জেলে বন্দী ছিলেন। মাও সেলের বন্দিনীদের মধ্যে অন্যতম। তাদেরই সন্তান আমি।” ওর কথাটা আমাকে বিশ্বাস করতে হয়েছিল। কারণ তার দৃঢ়তা, স্বাধীনচেতা মনোভাব এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অসাধারণ। সে আমাকে তার জীবন সংগ্রামের সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি কি সম্মতি জানিয়েছিলাম?
না, চূড়ান্তভাবে আমি কোনো সিদ্ধান্ত জানাইনি। বরং পাঠিকা হিসেবে তার মেধার মূল্য দিতে শিখেছিলাম। তার সহানুভূতিশীল উদার হৃদয়ের স্পন্দন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। তাই সহজে তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিইনি। সঙ্গিনী হিসেবে নয় বরং সহযোগী হিসেবেই সে আমার সাহিত্যের প্রিয় পাঠিকা হিসেবেই গণ্য হয়েছিল।

সেই নয়ের দশকেরই মাঝামাঝি সময়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় বহু দীর্ঘ চিঠি লিখেছিলাম। বিশেষ করে কোনো নামকরা কবির কবিতা প্রকাশিত হলে সেই কবিতা নিয়েই চিঠি লিখতাম। চিঠিগুলি বহু পাঠক-পাঠিকার কাছেই ভালো লাগার বিষয় হয়ে উঠেছিল। কেননা কবিতা বোঝার ক্ষেত্রে চিঠিগুলিতে থাকতো বিশ্লেষণ। বহু তথ্যের আমদানি ও তুলনামূলক আলোকপাত। এরকমই বেশ কিছু মুগ্ধ পাঠিকার মধ্যে একজন ছিল ঊর্মি বসু। সে তখন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। প্রত্যেকটা চিঠি পড়েই লিখতো আমাকে চিঠি আর প্রত্যেকটা চিঠিতেই থাকত তার অসাধারণ নানা চিত্রলিপি। নাচের মুদ্রার চিত্রলিপি এবং নাচের নানা ইন্সট্রুমেন্ট সে এঁকেই বুঝিয়ে দিত। ঝকঝকে হাতের লেখা। বেশিরভাগ চিঠিই লিখতো ইনল্যান্ড লেটারে। চিঠির খামের উপরেও কিছুটা নকশা এঁকে দিত। তার চিঠিতে পেতাম বিভিন্ন কবির বিভিন্ন কবিতার উদ্ধৃতি। কিছুটা উদাস হয়েই চেয়ে থাকতাম আমার নিজস্ব নীরবতায়। কোনো ক্লান্ত দুপুরে গাছের ছায়ায় নিজেকে মেলে ধরতাম। পাখিগুলি নেমে আসতো। বটফল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যেত। সব দেখতে দেখতে খুঁজে পেতাম কবিতার ক’য়েকটি পংক্তি। চিঠিগুলির উত্তর লিখতে হবে। শুরু হতো সেইসব কবিতার পংক্তি দিয়েই উত্তর লেখা—
“কল্যাণীয়াসু,
তোমার চিঠি আমার অন্তর্জীবনের মগ্নতা প্রকট করেছে। হ্যাঁ, তুমি হোস্টেলের জানালার দিকে চেয়ে চেয়ে যে নীল আকাশের ছবি এঁকেছ, যে উড়ন্ত পাখির দৃশ্য তোমার গতিমানতাকে স্বয়ংক্রিয় করে তুলেছে তা আমি উপলব্ধি করতে পারছি। আসলে তুমি নাচ শেখো, ঘুঙুর পরো, বাজনার তালে তালে তোমার নাচের মুদ্রা মিলিয়ে শরীর চালনা করো, তোমার মধ্যে সেই রোমান্টিক উপলব্ধি তো থাকবেই। কত কবিতার পংক্তি তোমার মুখস্থ। আবার হাতের অংকন চিত্রকলাও আমাকে আকৃষ্ট করে। কত গুণ তোমার! তুলনামূলক সাহিত্যের ছাত্রী তুমি। মা ছিলেন গার্লস বিদ্যালয়ের হেডমিস্ট্রেস। বাবা রাজনীতির লোক কিন্তু তবুও চাকরিজীবী। একমাত্র মেয়ে তুমি তাদের। কবিতা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কবিতার সমালোচনা করতেও তোমার ভালো লাগে এটা কি কম কথা?
এই মুহূর্তে আমি কী করছি তা জানতে চেয়েছো। কতগুলো ছাত্র-ছাত্রী পড়িয়ে এই বিকেলটুকু একটা গাছতলায় বসেছি। সামনে বিশাল কবরস্থান। মৃত মানুষগুলির উপস্থিতি টের পাচ্ছি তবুও। তাদের সঙ্গে কিছুটা গল্প করে নিচ্ছি। বীরভূমের রাঙামাটি রুক্ষশুষ্ক প্রান্তর। দূরে কোথাও বাউল হেঁটে যাচ্ছে। কানে আসছে তার মনের মানুষকে খোঁজার সেই সুর ‘আমি কোথায় পাব তারে’… হ্যাঁ, বীরভূম এরকমই। তুমি বীরভূমের যে প্রান্তেই যাও জয়দেব, চণ্ডীদাস, লক্ষ্মণ দাস, পূর্ণদাস কত বাউলের চিত্তভূমিকে অনুভব করতে পারবে। তোমার মধ্যেও জেগে উঠবেন তাঁরা। বাতাস বইলেও তাদের কণ্ঠস্বর বাতাসেই শুনতে পাবে।”

চিঠি লিখতে বসলে সেই চিঠি যেন আর শেষ হতেই চায় না। কত প্রসঙ্গ চলে আসে। কত কথা বলে ফেলি। এম-এ বি-এড করা একটা ছেলে, টিউশনি করে ক’য়েক টাকা আয় করা একটা ছেলে, দরিদ্র বাবার একটা বড় বেকার ছেলে, একটা প্রেমহীন যুবক, একটা কবিতা লেখা মানুষ। মাটির ঘরে খড়ের চাল দেওয়া দু’টো কামরায় কোনোরকম মাথা গুঁজে থাকা একটা পরিবারের স্বপ্ন। সন্ধ্যা নেমে আসছে চারিদিকে। পাখিরা সবাই বাসায় ফিরছে একে একে। আমিও দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ি ফিরে দেখি, তখনো আমাদের উনুনে আগুন জ্বলছে। মাটির দু’মুখো উনুনে মা দুটো হাঁড়ি চড়িয়ে পাতার জ্বাল দিচ্ছে। একটিতে ফুটছে ভাত, আরেকটিতে কচুর লতি সেদ্ধ হচ্ছে।
—এখনো হয়নি মা? আমার যে খুব খিদে লেগে আছে সারাদিন?
—আরেকটু দাঁড়াও বাবা, এই হয়ে যাবে!
—বাবার আজ এত দেরি হলো আসতে?
—যাদের বাড়ি গেছিল খাটতে, তাদের কাজটা শেষ না করে আসতে দেয়নি। তাই উনুন ধরাতে দেরি হলো।
—আচ্ছা মা আমাকে ডেকে দিও।
—বাইরে কোথাও যেও না এই সন্ধ্যেবেলা!🍁 (চলবে)

 

🍂দীর্ঘ বিতা 

 

 

স্বপন দত্ত-এর দীর্ঘ কবিতা

 

 

ক্রমেই অর্ফিউস, ক্রমেই পাথর

আমার নারী করছে খেলা
উথাল-পাথাল গোপন জাগাল
অচীন নদী পাখপাখালি
ও বাউল মাঝি কোথায় গেলি
এই বিহানবেলা

আতিপাতি সময় খুঁজি
হায় রে সময় শূন্য বাঁশি
কে কখন সময় কাটে
রক্ত ঝরে
ঝরে নিথর সময় পাখ
তা হোক, তবুও তো সময় সরণী উদাসীয়া নিশ্চুপ অবেলা
একটু তো আমার নারীকে জাগাতে হয়
ঠোঁটে ঠোঁটে আকাশ রেখে
একটু তো সুর ঢালা ন্যাংটো নদীটি
মাটি দিতেই হয়
না হলে ভোর হবে কী এঁকে
বল না— কী এঁকে
তা হোক না কেন আকাশ আঁকা ওই ঠোঁটে
হোক না কেন

ও নারী আমায় নিভিয়ে নিয়ে যা
চাকরি যে উড়েই গেল
অজস্র লোকের মাঝে আমাকে ডুবতে হবে
বেশ— ডুবেই না হয় সময় কুড়িয়ে নেব
তখন তো আমি আর এলেবেলে কেউ নই
আমার হাতের ক্যানভাসে অনন্ত
পোকা পার হওয়া সেতু
অফুরন্ত সময় হৃদয় কলকল

ও নারী, হুকুম দিতে পারিস না
তুমি আমি স্বপ্ন হেঁটে সেতুর ভেতর
চুমুক দিয়ে চুমুক দিয়ে
নাহহহ—
মাঝখানে মাঝ রাত দিয়ে কোন চাকরি
খুঁজেই পাই না
ওখানে—ওখানেই কোথাও
লুকিয়ে আমার নারীর হাত
বৃষ্টি এলেই উঁকি দেবে ভেসে যাওয়া পাপ
বাতাস বইলে— উঁহু হু চুল ওড়া
না না অশ্লীল ভাষা নয়
নয় অশ্লীল গন্ধ

এই পুলিশ কাকু আমায় ধরছ কেন
দুমড়ে-মুচড়ে ছাড়ছ কেন
আমি তো— আমি তো একটু বলছি না
এটুকুও বলছি নে জাগুন দেশ…
জেগে দেখুন… না না বলছি না… বলছি না
সময় হতে আমার মুখের মদের গন্ধ
মুছে গেছে— বলছি না
কখন আবার দেখুন না
এই পুলিশ কাকু দেখুন আবার মদের গন্ধে ভরে গেছে
এটাই স্থির অন্ধকার
আমার আকাশের নীল নীল বসন নিরাভরণ—
হ্যাঁ, নিরাভরণ শঙ্খ লাগে
শঙ্খ লাগে লাটাই ঘুড়িটা
ঘুড়িটা যে কোথায় জাগে
ও আমার নারী, দরজায় কে যেন কড়া নাড়ে
আমার তো হাত নেই, চাকরি নেই…
কে যেন কেটে নিল হাত
তাই কড়া নাড়ছে কড়া নাড়ছে…

ক্যানভাস আড়াল করছেন কেন
মনে হচ্ছে মনে হচ্ছে ঠুকড়ে ঠুকরে খেতে চাইছে কেউ
সেকি ক্যানভাস, সেকি আমার নারী, না-কি
আমার নারীর সময় কেঁপেছে কবেই
এই ভর লম্বা এই আগুন পুরানী ছবি আঁকা ক্যানভাস
হে প্রভু, এই ঈশ্বরী, আপনাদের বেশ্যা হয়ে দেশ মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে
এখন তো বেশ— বিশ্বাস রাখুন
বিশ্বাস রাখুন এখনও মরতে পারি
আড়বাঁশিটা আড়বাঁশিটা কোথায় যে গেল
সময় কখন অন্তর্জলী—
হ্যাঁ হ্যাঁ আর না— আর না— আর কেন, কেন
ক্যানভাসের সেতু ধরে
পাতালের দিকে হেঁটে হেঁটে অর্ফিউস হয়ে যাওয়া আমার নারী দিকে—
না — আর ভয়ে ভয়ে নিজেই ভাঙতে ভাঙতে
পেছন ফেরা
ও অকূল চুল– চুল বলছি তো—অশ্লীল না
কেন, চুল নরম ছায়া, ড্রাগনের গন্ধ
পায়ের শব্দ, শুনতে শুনতে– আমি তো জানি সময় ওমে
আমার প্রাপ্তি আমি তো জানিই–
সময় ওমে পাথর, নিরেট পাথর
ক্রমেই আমি—
আমার শ্বাস নেই বিশ্বাস করো,
হে নারী, হে প্রভু, হে ঈশ্বরী
তুই পা-থর, পা-থর…

 

 

 

🍂কণাগদ্য 
মুহূর্তের চিহ্ন বহন করে স্পষ্ট হয়ে বেশ কিছু লেখা। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ মিলে মিশে যায় তৈরি হয় এক নব্য স্রোতধারা… তেমনি কিছু লেখা, লিখেছেন : অমিত পাল 

 

 

যন্ত্রমানব

 

কবি লিখছেন তো লিখেই চলেছেন৷ ভাবান্তর চরম সীমা পর্যন্ত — শিরায় শিরায় চলমান৷ যেন উদভ্রান্ত নাবিক সঠিক দিক খুঁজে পায়নি৷ উথাল পাতাল ভাষার সমুদ্রে কলম রূপ দাঁড়টি দিয়ে খাতার স্বরূপ নিজস্ব নৌকাটিকে ভাসিয়ে চলে দিক শূন্য হয়েছে— কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ রচনার মধ্য দিয়ে৷

কবি ব্যথাতুর বেদনায় বধির৷ কোনও এক অলৌকিকতা তার অন্তরে সতত সঞ্চরমান৷ শুধু নিজের ভাবনাকে বিলিয়ে দিচ্ছে খাতায় শব্দ ও ভাষার বিনিময়ে৷

কি জানি কি ছন্দ, কি তাল, কি অলঙ্কার আছে তার লেখায়— লোকের কাছে প্রশংস্যায় পঞ্চমুখ৷ তাতে তার কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই৷ তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন এক যন্ত্রমানবে৷

তার নিজের টার্গেট পূরণ করতে হবে মৃত্যুকাল পর্যন্ত৷ কোনও বিশ্রাম নেই, বিরাম নেই, নেইকো ঘুম ৷ শুধু হৃদয়ের মসি কলমের মধ্য দিয়ে বহমান…

কেউ হয়ত তাকে জন্মমান্তর গত শর্ত দিয়ে রেখেছে৷ জানি না কত রাত, কত দিন পালন করবে এই শর্ত৷ তবে কবি এখনো সেই শর্ত মেনে চলেছেন…

 

নবরূপ পেয়েছে সে

ছেলেটা হঠাৎ কেঁদে উঠে ছিল৷ বুকে জন্ম নিয়েছিল অদৃশ্য নীল আগুন৷ রক্ত তঞ্চন শিরায় শিরায় বিষের সংকেত জানাচ্ছিল৷

সে একটু একটু করে পা ফেলছে৷ তাৎক্ষণিক গতি৷ এগিয়ে যাওয়ার পথে আলো বলতে কিছু ছিল না৷ পুরোটাই নিদারুণ অন্ধকার৷

সে জেনে গিয়েছে, আজ সে বঞ্চিত সব কিছু থেকে৷ কিন্তু কালই ফিরে পাবে সব৷ তার ফুসফুস ভরা রক্তমাংসের উঠানে জন্ম নিচ্ছে নতুন ভাবে বাঁচার চারাগাছটি৷

সে আবার হারিয়ে গেল নতুন আবেশে, নতুন আবেগে৷ ভেঙে ফেলছে সীমাবদ্ধ সভ্যতা৷ বসন্তের খোঁজ পেয়েছে সে৷ আর পলাশ বনটিতে দেখতে পেয়েছে হলুদ তুলিটি আলপনায় মত্ত…

রাত এসেছিল নতুন ভাবে৷ চন্দ্রও হেসেছিল ক্ষণকাল৷ গোলাপী সূর্য্যের দেখা মিলল যে…

 

 

নিত্যদিনের কাজ

সেদিন এক ঝটকা মারপিট হয়ে গেল দু’জনের৷
চোলাই মদের বাহার খানা বেশ– নোংরা কাঁচের গ্লাসে পচা ভাতের রস৷ আহা! কি স্বাদ দু’জনের মুখে, যেন অমৃত খাচ্ছে৷

শালা হারামজাদা, শালা শুয়োরের বাচ্চা এই নিয়েই বিবাদ দু’জনের মধ্যে৷ মদের নেশার ঘোরে বাক সংযোগ করতে পারেনি তারা৷ বংশী ডোমের বাড়িটায় ভাল আলো জ্বলে না সন্ধ্যায়৷ তবুও হাতাহাতিটা লক্ষ্য করার মতো৷

সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর এই তো তাদের একটুকরো বিশ্রাম…🍁

 

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ২০
হাই সাহেবের সময় বিভাগীয় প্রধান পদটি এখনকার মত আবর্তিত হত না— একজনের জন্যেই নির্দিষ্ট থাকত। দীর্ঘদিন বিভাগীয় কাজকর্ম করতে গিয়ে কারও কারও বিরাগভাজন হওয়া স্বাভাবিক। মানুষ সবসময় সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। একজনের সব কাজ সবার মনঃপুত হবে এমনটাও আশা করা যায় না। পেশাগত কারণে সহকর্মীদের সঙ্গে মতান্তর হতে পারে এবং সেটাকে কেন্দ্র করে ঈর্ষাও হতে পারে। আর এই ঈর্ষা বড় ভয়াবহ।
রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ২০।

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি 

 

 

পর্ব ২০.

চলে গেলেন অনন্তলোকে…

প্রফেসর আব্দুল হাই-এর বইগুলো একটার পর একটা যত পড়েছি, বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছি। একজন মানুষ তাঁর ক্ষণস্থায়ী জীবনে কতটা শ্রম, কতটা মেধা, একাগ্রতা আর ভালবাসা থাকলে এরকম সৃষ্টি সম্ভব! তাঁর বইগুলোর মাঝে একরকম হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে। নিজের অজ্ঞতা নিয়ে লজ্জিত হই। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গর্বও অনুভব করি একজন বাঙালি হিসেবে, আমরা তাঁকে পেয়েছিলাম! তাঁর মত একজন অনন্য সাধারণ মানুষের ভালবাসার ছোঁয়া পেয়েছে আমাদের ভাষা ও সাহিত্য। কিন্তু তিনি তাঁর সেই ভালবাসার সঠিক প্রতিদান পেয়েছিলেন কী? কেন এমন বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্য দিয়ে হল তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি?

মাত্র পঞ্চাশ বছরের জীবন তাঁর। আর এই পঞ্চাশ বছরেই আমাদের ভাষা সাহিত্যের অনন্ত সম্ভারের অধিকারী প্রফেসর আব্দুল হাই একেবারে হঠাৎই চলে গেলেন অনন্তলোকে। হৃদয়বিদারক এক ট্রেন দুর্ঘটনা কেড়ে নিল এক অমিত সম্ভাবনাময় জীবন। প্রশ্ন থেকে যায়, প্রশ্ন থেকে গেছে আজও। একাধিক জিজ্ঞাসা চিহ্ন এঁকে দিতে পারি আমরা এই দুর্ঘটনায়। এমন মৃত্যু কেন?

হাই সাহেবের সময় বিভাগীয় প্রধান পদটি এখনকার মত আবর্তিত হত না— একজনের জন্যেই নির্দিষ্ট থাকত। দীর্ঘদিন বিভাগীয় কাজকর্ম করতে গিয়ে কারও কারও বিরাগভাজন হওয়া স্বাভাবিক। মানুষ সবসময় সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। একজনের সব কাজ সবার মনঃপুত হবে এমনটাও আশা করা যায় না। পেশাগত কারণে সহকর্মীদের সঙ্গে মতান্তর হতে পারে এবং সেটাকে কেন্দ্র করে ঈর্ষাও হতে পারে। আর এই ঈর্ষা বড় ভয়াবহ। এর কারণে মানুষের মনে জন্ম নেয় প্রতিহিংসা এবং হয়েছেও তাই। হয়েছে তাঁর জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে। তাঁর সামনে কেউ কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে বিরুদ্ধভাব পোষণ করত অনেকেই। সেটা পুঞ্জিভূত হতে হতে বিরুদ্ধবাদীরা সুযোগও পেয়ে যায়। প্রফেসর হাই ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৯ সালের ৩০ জুন— দশ মাসের ছুটিতে কলম্বিয়ার মিসৌরী বিশ্ববিদ্যালয়ের South Asia Language and Asia Centre -এর পরিচালক ড. পেল ওয়ালেসের আমন্ত্রণে Visiting Professor হিসেবে তিনি বিদেশ গমন করেন। তাঁর যাওয়ার পরেই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার খেলা শুরু হয়ে যায়। একদিকে আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উত্তেজনা বাড়তে থাকে, অপরদিকে বিভাগীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে যারা তাঁর কাজকর্মে খুব একটা সন্তুষ্ট ছিলেন না তারা জোট বাঁধতে থাকেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে উপাচার্যের জরুরি তলবে ছুটি শেষ হওয়ার আগেই হাই সাহেবকে ফিরে আসতে হয়। দু’টো সেমিস্টারের জন্য ছুটি নিলেও কোনও রকমে একটা সেমিস্টার শেষ করেই ১৯৬৯ সালের ১৫ জানুয়ারি দেশে ফিরে বিভাগীয় প্রধানের কার্যভার গ্রহণ করেন। এর আগে বাংলা বর্ণমালা সংস্কারের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কমিটি ১৯৬৭ সালের ২৮ মার্চ গঠন করেছিলেন তার প্রতিবেদন দেশের বিদ্বৎ সমাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। কমিটির তিনজন সদস্য হাই সাহেব, ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুনির চৌধুরী ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁরা তিনজন সম্মিলিতভাবে যে স্বতন্ত্র প্রতিবেদন দাখিল করেন তাতে তাঁদের ভাষা ছিল দ্ব্যর্থহীন—
“আমাদিগকে বাধ্য হইয়াই সামগ্রিকভাবে প্রস্তাবগুলি হইতে ভিন্নমত পোষণ করিতে হইল। অধিকন্তু, আমরা মনে করি যে, বাংলা লিপি ও বানান সরলায়ন ও সংস্কারের আশু প্রয়োজন নাই। এইরূপ কাজে হাত দিলে নিশ্চিতরূপে ভ্রান্তি বিভ্রান্তিতে পরিণত হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষা দ্রুত উন্নয়ন বিশেষভাবে ব্যাহত হইবে।”

এই ভিন্নমত প্রদানে সরকারি মহলে তিনি বিরাগভাজন হন। এর আগে সরকারের রবীন্দ্র সাহিত্য পঠন-পাঠন, রবীন্দ্র সঙ্গীতের বিকল্প সৃজন, রবীন্দ্র সঙ্গীতের প্রচার বন্ধ করার আদেশের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন। বাংলার বদলে উর্দু বা আরবি প্রচলন, আরবিতে বাংলা লিখন পদ্ধতির প্রবর্তন, রোমান হরফে বাংলা লেখার ইত্যাদি সরকারি খামখেয়ালির বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন বলে সরকার তাঁর প্রতি মোটেই প্রসন্ন ছিলেন না। এসবকিছুর পরে বর্ণমালা সংস্কারে তাঁর ভিন্নমতে সরকার আরও রুষ্ট হলেন। এই সুযোগটিই গ্রহণ করলেন হাই সাহেবের বিরুদ্ধবাদীরা। যেহেতু ‘সাহিত্য পত্রিকা’ পুরোপুরি কেন্দ্রীয় অর্থে প্রকাশিত হতো, তাই সরকার মনে করতেন সরকারের কাজকর্ম তিনি সমর্থন করুন। সরকারি সাহায্য নিয়েও সরকারের মত অনুযায়ী তিনি কাজ করেননি। দেশ জাতি এবং মাতৃভাষার উন্নতির জন্য যা ক্ষতিকর বলে মনে করেছেন, তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে তিনি পিছু হটেননি।

এদিকে হাই সাহেবের অনুপস্থিতিতে আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে সারাদেশে আন্দোলন শুরু হয় প্রধানত বর্ণমালা সংস্কার কমিটির প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করেই। ১৯৬৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর ৪২ জন বুদ্ধিজীবী প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে এবং ভিন্নমত পোষণকারীর পক্ষে এক বিবৃতি প্রচার করেন। ১১ অক্টোবর হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন। আয়ুব খান-এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে ওঠে এবং তা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে। সরকার এই আন্দোলনকে কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা করে। সরকারের এই দমননীতির প্রতিবাদে ১৩ ডিসেম্বর সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ১৯৬৯ সালের ১৮ জানুয়ারি বাংলা একাডেমিতে ‘লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ -এর মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ সভা ও মিছিলের আয়োজন করা হয়। এই মিছিলের ওপর পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে। এর ফলে ঐতিহাসিক ১১ দফা আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদের মৃত্যু, ১৬ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্রের সাজানো মামলার আসামি সার্জেন্ট জহরুল হকের মৃত্যু, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সেনাবাহিনী কর্তৃক ড.শামসুজ্জোহার হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি ঘটনা আয়ুবশাহী শাসনের অবসান ত্বরান্বিত করে। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৬ মার্চ মিলিটারি জেনারেল ইয়াহিয়া খান-এর হাতে শাসনভার দিয়ে আয়ুব খান সরে পড়েন। শাসক বদল হলেও শাসনের চরিত্র একই রয়ে গেল। ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমে গেলেন অনেকেই। ব্যক্তিগত হিংসা চরিতার্থ করার জন্য কিংবা নিজের অপরাধ ধামাচাপা দেবার জন্য অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে চেষ্টা করলেন। হাই সাহেব এসব ঘোড়েলদের চিনতে পারেননি মোটেও। তিনি ছিলেন সহজ সরল। কখনও কোনও কিছু বাঁকাভাবে ভাবেননি। এই সরল বুদ্ধিতে তিনি এসব ঘোড়েলদের মতিগতি বুঝতে পারেননি। হাই সাহেবের অজান্তেই তারা যে ঘাপটি মেরে বসেছিল, সরল বুদ্ধিতে তিনি সেটা ধরতেও পারেননি। একেবারে আচমকাই তাঁর বিরুদ্ধে উঠল দুর্নীতির অভিযোগ। ‘সাহিত্য পত্রিকা’ সরকারি অর্থে চলত। তিনি বিদেশ যাবার আগে সবকিছু গোছগাছ করে গিয়েছিলেন। তাঁর অবর্তমানে বিল ভাউচার সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তাঁকে নানাভাবে অপদস্থ করা শুরু হয়। হাই সাহেব ছিলেন পূর্ববঙ্গে উদ্বাস্তু, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক জীবনে তাঁর আধিপত্য এমনভাবে অপরিহার্য ও অনিবার্য হয়ে পড়েছিল যা ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায় অনেকের। আসাদুজ্জামান (১৯৪১—১৯৯০) এই প্রসঙ্গে বলেছেন —

“আব্দুল হাই জন্মেছেন পশ্চিমবঙ্গে… সে দেশের মানুষের প্রতি বিজাতীয় মনোভাব স্বাভাবিক তেমনি সে দেশের মানুষের সাংস্কৃতিক আধিপত্য সাধারণভাবে ঈর্ষাযোগ্য। মুহম্মদ আব্দুল হাই –এর এই প্রেক্ষিত তাঁর জীবিতকালে আত্মপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তেমন বিঘ্ন সৃষ্টি না করলেও নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। জীবিতকালেই তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পরিচালিত হয়েছিল অপর এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীর দ্বারা, যারা সবসময় প্রতিষ্ঠিত সরকারের পদলেহন করে নিজেদের মেদ-মাংস বৃদ্ধির ব্যবস্থা করে। … যে পরিবেশ মানুষকে আত্মহত্যা বা অপঘাত মৃত্যুর পথে প্ররোচিত করে, সে পরিবেশই হত্যাকারীর ভূমিকা লাভ করে। শুধু হত্যার অস্ত্রটি নিজে ব্যবহার না কনে সুকৌশলে জীবন-বিতৃষ্ণ ব্যক্তিটির হাতে তুলে দেয়। এর ফলে সে আইনের চোখে নিরাপরাধ প্রতিপন্ন হলেও বিশ্ববিধানের দৃষ্টিতে নিষ্পাপ থাকতে পারে না। মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর মৃত্যু যে এমনই বৈরী প্রতিবেশ প্রণোদিত, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই” (প্রফেসর আব্দুল হাই সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ ১৯৮২ বুলেটিন ৩)।
রাশভারি ব্যক্ত্বিত্বসম্পন্ন হাই সাহেবকে তাঁর পদ থেকে সরাতে না পেরে মরিয়া হয়ে ওঠে কুচক্রীমহল। তাঁর খ্যাতি ও প্রতিপত্তির ওপর নানাভাবে কালিমালেপন করে তাঁর চরিত্র হননের চেষ্টা করে তারা। এমনকি ফোনেও লোক মারফত শাসানো হতে থাকে। অজ্ঞাত ব্যক্তিদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতে থাকেন নানাভাবে। তাঁর মতো একজন নম্র ভদ্র প্রকৃতির মানুষের জন্য এসব ঘটনা কতটা পীড়াদায়ক সেটা আমরা অনুমান করতে পারি সহজেই। আজন্মকাল যিনি অবিচল থেকেছেন ন্যায় আর সত্যের পথে, চর্চা করেছেন সুন্দরের, তাঁর বিরুদ্ধে অপ্রীতিকর এবং অরুচিকর আক্রমণ মেনে নিতে পারেননি তিনি। মানতে পারার কথাও নয়। তাই তো প্রচণ্ড কষ্টে ভেঙে পড়েছিলেন মানসিকভাবে। বেদনায় ছিন্নভিন্ন হয়েছিল তাঁর মন। এই ছিন্নভিন্ন মন নিয়ে ১৯৬৯ সালের ৩ জুন মঙ্গলবার, অন্যান্য দিনের মত প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তিনি। যাবার আগে স্ত্রীকে বলে গেলেন ফিরে এসে নাস্তা করবেন। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনের খিলগাঁও এলাকায় তাঁর বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রের কাছে যাচ্ছেন আর একজন ছাত্রের ঠিকানা আনতে। ঘটে গেল এক হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা। ছিন্নভিন্ন মনের সঙ্গে সঙ্গে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল প্রফেসর আব্দুল হাই–এর দেহটাও চলন্ত ট্রেনের ধাক্কায়। বাড়ি ফিরে নাস্তা করা আর হল না তাঁর। চলে গেলেন অনন্তলোকে, মাতৃভাষা আর সাহিত্য-সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ সেবক। আমরা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম তাঁকে।

৫ জুনের The Pakistan Observer ( বর্তমানের The Bangladesh Observer) দৈনিক সংবাদপত্রে তাঁর মৃত্যু সংবাদটি নিম্নোক্তভাবে প্রকাশিত হয় :

“Accident
PROF. HAI KILLED

By a Staff Correspondent

Prof. Muhammad Abdul Hai, Head of the Department of Bangali, Dacca University was Killed in a train accident on Tuesday morning. He was run over by the Ulka at Gulbag near khilagaon at 8-40 a.m. Death was instantaneous.

There was a long delay of nearly two hours before Prof. Abdul Hai was identified as his body lay Between two tracks miles away from his residence within the Dacca University campus. There was a scar on the head, bruises on the chest and shoulder and the left leg was completely broken.”

ঢাকার আজিমপুর নতুন গোরস্তানে ওইদিন বৃষ্টিঝরা সন্ধ্যার পর তাঁকে সমাহিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে তাঁর ছেলেরা তাঁর কবরটি বাঁধিয়ে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেন। কবরটির স্থপতি আলী ইমাম। তাঁর স্মৃতির প্রতি উৎসর্গীকৃত ফলকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুজ্জামান বিরচিত যে সনেটটি লেখা রয়েছে, সেই সনেটটির চূড়ান্ত রূপায়ণে সাহায্য করেছেন কবি আব্দুল কাদির, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আলাউদ্দিন আল আজাদ এবং মনজুরে মওলা। এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি অধ্যাপক আব্দুল হাই -এর বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মনজুর হাসান -এর লেখায়। লেখাটি নিম্নরূপ—

“এপিটাফ : মুহাম্মদ আব্দুল হাই
মনজুর হাসান

আমার পিতার মৃত্যুর দিন তেসরা জুন উনিশশ ঊনসত্তর–এ আমি বস্টনে ছিলাম। মৃত্যুর খবর পাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরে জুন জুন মাসে ঢাকায় ফিরে আসি দারুণ ব্যথিত হৃদয় নিয়ে। মা আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। তাঁর সে কান্না সহজে থামেনি। এরপর আর আমেরিকা ফেরৎ যাওয়া হয়নি। বস্টন ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স ডিগ্রী হয়ে গেছিল এবং অগাস্ট ১৯৬৯ -এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে সহকারী অধ্যাপকের পদে যোগ দিই।

যেদিন ঢাকায় ফেরৎ আসি সেদিন আজিমপুর নতুন গোরস্তানে যেয়ে দেখলাম দৈনিক ইত্তেফাক কাগজের প্রতিষ্ঠাতা অকুতোভয় সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার পাশের কবরে আমার পিতা সমাহিত। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটি টিনের ফলকে লেখা আছেঃ মুহম্মদ আব্দুল হাই, প্রাক্তন অধ্যক্ষ বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা অবস্থায় কয়েক বছর ছিল এবং বেশ কয়েকজন আমাকে বলেছিলেন যে কবরটা ভালো করে বাঁধাবার কথা। আমার ইচ্ছা ছিল সেখানে বাঁধানো কবরে প্রস্তর ফলকে সুন্দর কিছু কথা লেখা হবে আর ফলকের নিচে থাকবে সবুজ ঘাস। সমাধিটা যেন বিস্তৃত হয় সেজন্য পেছনের জায়গাটাও কিনে নিয়েছিলাম এবং বস্তুত দুইটি কবরের জায়গায় বর্তমানের সমাধিটা। কবরটির ডিজাইনের একটা স্কেচ করেছিলাম যার ভিত্তিতে তরুণ স্থপতি আলী ইমাম নকশা এঁকে দেন।

আমি কযেকজনের কাছে এপিটাফ হিসাবে কি লেখা যায় জানতে চেয়েছি এবং প্রায় সকলেই দুই একটা প্রচলিত বাক্যের কথা বলেছেন। ইতিমধ্যে আমার ভগ্নিপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনিরুজ্জামান (বর্তমানে অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান) একটা পূর্ণ চতুর্দশপদী কবিতা লিখে ফেললেন। আমি নিজে সাহিত্যিক নই, তাই ঠিক করলাম কবি সাহিত্যিকদের এটা দেখাই এবং তাঁদের মতামত নিই। মনিরুজ্জামানের মূল সনেটটি ছিল নিম্নরূপঃ

মরিচা, মুর্শিদাবাদঃ জন্মভূমি তাঁর
আমৃত্যু রৈবিক প্রেমে প্রজ্বলন্ত শিখা
এবং পাণিনি ধ্যানে একক দর্শিকা
ছিলেন ধ্বনিতত্ত্বেও; একান্ত সবার
স্মৃতিমান্য অবিনাশী স্তম্ভমহাজনঃ
বিপুলবিত্ত প্রাণ অধ্যাপক ধীর
উদাত্ত স্বর বা কখনো নিবিড়;
অনুপম ব্যক্তিত্বভার সদাহাস্যানন।
বাংলার অমেয় কৃষ্টি সংশয়িত হলে
প্রতিকূল শক্তিনাশী অতন্দ্র প্রহর
দিয়েছিন বারংবার ; তবু অশ্রুতলে
বিদ্যার তীর্থ আজ শূন্যতায় ভরা
নিস্পত্র একাকার বৃক্ষপ্রেম জ্বলে
প্রভাতে পাইনা খুঁজে আলোর পশরা।
(২৩/ ১২ / ১৯৭২)

আমার হাতে কপি করে সনেটটি নিয়ে প্রথমে বন্ধুবর আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে গেলাম। তখন তার পত্রিকা ‘কণ্ঠস্বর’ তরুণ সমাজে সবচেয়ে জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন। সে সময় আবু সায়ীদ থাকতো গ্রীণরোডের পাশে স্টাফ কোয়ার্টারে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বেশ কিছু পরিবর্তন করে দিল। তার পরিবর্তনের পর সনেট দাঁড়ালো এমনঃ

মরিচা, মুর্শিদাবাদঃ জন্মভূমি তাঁর
আমৃত্যু রবীন্দ্রপ্রেমে দীপ্তিমান শিখা।
এবং পাণিনি ধ্যানে সম্পন্ন দীপিকা।
ধ্বনিতত্ত্বে কীর্তিমান; একান্ত সবার
স্মৃতিমান্য; মিতবাক, সকৃত, সুজন।
বিপুলবিত্ত প্রাণ অধ্যাপক – যাঁর
প্রীতস্বর বিদ্যাঙ্গনে ঝরেছে অপার।
অনন্য ব্যক্তিত্ব দীপ্ত সুস্মিত আনন।

বাংলার অমেয় কৃষ্টি সংশয়িত হলে
প্রতিকূল শক্তিনাশী অতন্দ্র প্রহরা
দিয়েছেন বারংবার; তবু অশ্রুতলে
বিদ্যার তীর্থ আজ শূন্যতায় ভরা;
পত্রহীন একাকার বৃক্ষপ্রেম জ্বলে;
আলোর আকাশজুড়ে বেদনার খরা।

এরপর ভাবলাম সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদকে দেখাই। উনি তখন আজিমপুর কলোনিতে থাকতেন এবং তাঁকে সনেটটি দিয়ে আসলাম। এরপর অনেকদিন লেখাটি তাঁর কাছে ছিল। মাঝে মাঝেই খবর নিতে যেয়ে চা খেয়ে ফেরৎ আসতাম। শেষে একদিন সকালে উনি পৃষ্ঠাটি আমার হাতে দিলেন এবং দেখলাম শেষের দুই লাইনে অপূর্ব পরিবর্তন। তাঁর পরিবর্তনের ফলে শেষের দুই লাইন দাঁড়ালো এমনঃ

আগন্তক ঋতু স্বপ্নে বৃক্ষপ্রেম জ্বলে;
তোমার নিঃশ্বাস বুঝি ফুলের পশরা?

আমার ছাত্রকালে কবি আব্দুল কাদির আমাদের বাসায় বেড়াতে আসলে আমার লেখাপড়ার কথা জিজ্ঞাসা করতেন এবং তাঁর চেহারাটা আমার কাছে মনে হতো নির্মল কবির চেহারা। একদিন তাঁর কাছে সনেটটি নিয়ে গেলাম। উনি রেখে যেতে বললেন। কয়েকদিন পরে আমার হাতের লেখায় কপি করা সনেটটির উপরে তাঁর বলিষ্ঠ হস্তাক্ষরে বিবিধ পরিবর্তন দেখলাম। তাঁর পরিবর্তন সুন্দর ও বলিষ্ঠ ছিল তবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ আর আলাউদ্দিন আল আজাদের আধুনিকতা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। মনিরুজ্জামানের চতুর্দশপদী কবিতার নয় থেকে বার লাইন আমাদের সকলের ভালো লেগেছিল।
কবি আব্দুল কাদির -এর পরিবর্তনে সনেটটির রূপ ছিল এমনঃ

মরিচা, মুর্শিদাবাদঃ জন্মভূমি তাঁর।
আমৃত্যু রৈবিক প্রেমে চিত্ত দীপ্তিমান,
প্রসন্ন পাণিনি-ধ্যানে যুক্তিনিষ্ঠ জ্ঞান,
ধ্বনিতত্ত্বে কৃতবিদ্য, – কীর্তি চমৎকার!
প্রাণের সম্পদে মুগ্ধ স্বজন সংসার;
সর্বমান্য; মিতবাক, সুকৃত, সুজন।
বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব-স্নিগ্ধ সুস্মিত আনন,
কণ্ঠসুধা বিদ্যাঙ্গনে চরছে অপার।

বাংলার শ্বাশ্বত কৃষ্টি সংশয়িত হলে
সত্যের শাণিত অস্ত্রে অতন্দ্র প্রহরা
দিয়েছেন অহরহ; তবু হলাহলে
বিদ্যাতীর্থে বোধিকুম্ভ হেরি আজো ভরা।
ভবিষ্যতের আশা-স্বপ্নে বৃক্ষপ্রেম জ্বলে—
তোমার নিঃশ্বাস বুঝি ফুলের পশরা!

কবরের শিলালিপির তৃতীয় লাইনে কবি আব্দুল কাদিরের ‘প্রসন্ন’ শব্দটি খোদিত হয়েছে। মাঝে সাহিত্য রসিক মনজুরে মওলাকে সনেটটি দেখিয়েছিলাম এবং মওলা, আবু সায়ীদের মত ‘রৈবিক প্রেমে’র জায়গায় ‘রবীন্দ্র প্রেমে’ বেশি ভালো উল্লেখ করেছিলেন।

সনেটটির চূড়ান্ত রূপায়ণের ফাঁকে আমি একটি দীর্ঘ মাপের মার্বেল পাথরের সন্ধানে ছিলাম। বেশ কিছুদিন ঘোরাঘুরির পর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগে পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে নিয়ে আসা ঢাকার শ্যামলীতে এক মার্বেল পাথর সরবরাহকারীর প্রতিষ্ঠান থেকে পাথরটি সংগ্রহ করি। পরে শাখাঁরি বাজারে এক শিল্প কারিগর দীর্ঘ লাইনগুলি নিখুঁতভাবে খোদাই করে ১৯৭৩ সালের জুলাই মাসে।

কবরটির সবকিছু সম্পন্ন হবার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিসের তরুণ ফটোগ্রাফার মুহম্মদ মুনীর হোসেন কবরটির ছবি তুলে দেন। যে ছবিটি পরে আজহারউদ্দিন খান -এর ‘বাংলা সাহিত্যে মুহম্মদ আব্দুল হাই’ বইতে জানুয়ারী ১৯৭৬ সালে ছাপানো হয়েছিল।
গোরস্তানের কবরটি দেখার পর একজন সাহিত্যিক আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন যে “হাই স্যার তো কবি ছিলেন না। তাই অত দীর্ঘ কবিতা বা সনেট সমাধিতে দিলেন কেন?”
শেষ অবধি সমাধিলিপিটা এমন রূপ নেবে তা আমরা কেউ আগে থেকে ভাবিনি। আমার পিতার মৃত্যুও এমন আকস্মিক এবং অকালে হবে তাও আমরা কেউ কল্পনা করিনি। আমার দাদা এবং দাদী পরিণত বয়সে বৃদ্ধ অবস্থায় পৃথিবী ছেড়ে গেছেন। দাদা এক শুক্রবারে ফজরের সেজদায় সবার অলক্ষ্যে চলে গেছেন আর আমার রূপসী দাদী রাতে ঘুমের মধ্যে সবার অগোচরে চলে গেছেন। আমার পিতা তাই মনে করতেন বৃদ্ধ অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হবে। একদিন আমাদের বলেছিলেন যে মৃত্যুর সময় আমরা সবাই অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানেরা মৃত্যুশয্যার পাশে উপস্থিত থাকবে, তাঁর লেখা বইগুলো পাশে থাকবে এবং তিনি কালেমা পড়তে পড়তে বিদায় নেবেন। কিন্তু তেমনটা হয়নি। এপিটাফ অবশ্য তাঁর কবরে একটা হতো, তবে সনেটটি হঠাৎই তাঁর কবরে স্থান করে নিয়েছে এবং ভালোলাগে এই ভেবে যে তাঁর সমাধিলিপিতে বেশ কয়েকজন গুণীজনের সমাবেশ ঘটেছে এবং সম্ভবত এটি একটি দুর্লভ ঘটনা।

এটি সনেট হওয়ায় প্রথম আট লাইনে একটি ভাব ফুটে উঠেছে এবং পরের ছয় লাইনে ফুটে উঠেছে তাঁর মৃত্যুর পরের অবস্থান। প্রায় সিকি শতাব্দী আগে অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় বাংলাদেশের এপিটাফের উপর একটা সংখ্যা বেরিয়েছিল, তাতে এই কবরটি অন্যতম বলে বিবেচিত হয়েছিল।

আজ থেকে শতবর্ষ পরে বা কয়েকশ বছর পরে যদি এই নতুন আজিমপুর গোরস্তান এইভাবে রক্ষিত থাকে, তখন হয়তো এখানে এসে দাঁড়াবে কেউ এবং খোদিত সনেটটির দিকে তাকিয়ে দেখবে ভালোবেসেছিলেন তিনি রবীন্দ্রনাথকে। ধ্যান করেছিলেন এই উপমহাদেশের আড়াই হাজার বছর আগের বিশ্বশ্রেষ্ঠ ধ্বনিবিজ্ঞানী পাণিনির। একদা বাংলার অমেয় কৃষ্টি সংশয়িত হলে কেউ দিয়েছিলেন অতন্দ্র প্রহরা। তাকিয়ে দেখবেঃ

মুহম্মদ আব্দুল হাই
অধ্যাপক, বাংলা বিভগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জন্ম – ২৬ শে নভেম্বর, ১৯১৯
মৃত্যু – ৩রা জুন, ১৯৬৯

মরিচা, মুর্শিদাবাদঃ জন্মভূমি তাঁর।
আমৃত্যু রবীন্দ্রপ্রেমে দীপ্তিমান শিখা;
প্রসন্ন পাণিনি ধ্যানে সম্পন্ন দীপিকা।
ধ্বনিতত্ত্বে কীর্তিমান; একান্ত সবার
স্মৃতিমান্য; মিতবাক, সুকৃত, সুজন।
বিপুলচিত্ত প্রাণ অধ্যাপক – যাঁর
প্রীতকণ্ঠ বিদ্যাঙ্গনে ঝরছে অপার।
অনন্য ব্যক্তিত্ব-স্নিগ্ধ সুস্মিত আনন।
বাংলার অমেয় কৃষ্টি সংশয়িত হলে
প্রতিকূল- শক্তিনাশী অতন্দ্র প্রহরা
দিয়েছেন বারংবার; তবু অশ্রুতলে
বিদ্যার তীর্থ আজ শূন্যতায় ভরা ;
আগন্তুক ঋতু স্বপ্নে বৃক্ষপ্রেম জ্বলে;
তোমার নিঃশ্বাস বুঝি ফুলের পশরা!

আজ, তাঁর মৃত্যুর এতবছর পর, আমরা আশা করতেই পারি অধ্যাপক মুহম্মদ আব্দুল হাই -এর নির্দেশিত পথে আমাদের ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি এগিয়ে গেছে অনেক। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে? দেখে অবাক হই, কেমন যেন অস্থিরতা বিরাজ করছে সবকিছুতেই। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে যেন অনেকটাই সরে এসেছি আমরা। যে আদর্শ বুকে ধারণ করে প্রফেসর হাই দৃঢ়চিত্তে কাজ করে গেছেন, রেখে গেছেন অমূল্য সব সম্পদ, সেগুলো যেন ভুলতে বসেছি আমরা। নতুন প্রজন্মের দিকে যখন তাকাই, দেখি তাদের সিংহভাগই জানে না প্রফেসর হাইয়ের যুগান্তকারী সৃষ্টির কথা। ভীষণ ব্যথিত হই, হই লজ্জিতও। নিজস্ব সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্য ভুলে গিয়ে কিংবা তা থেকে দূরে সরে গিয়ে কেউ কখনও এগিয়ে যেতে পারে না সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে। আমরাও পারবো না। বাঙালি হিসেবে আমাদের কর্তব্য, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির এমন নিবেদিতপ্রাণ সেবক সম্পর্কে জানা, তাঁর আদর্শকে অনুসরণ করা। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করে আমরাও হয়ে উঠতে পারবো এক একজন সেবক। তাঁর সৃষ্টিকে সঠিকভাবে অনুসরণ করেই পেতে পারি তাঁর সান্নিধ্য। জানাতে পারি সম্মান কীর্তিমানের অসামান্য কীর্তির প্রতি।🍁 (সমাপ্ত)

 

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার | কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকারঅঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : ফিরে পড়া : প্রবন্ধ, মহামিলনের কথা বিভাগের লেখা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত।

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment