



সম্পাদকীয়
জীবনের মানে আমরা সবাই খুঁজি। খুঁজতে চাই। এবার শেষ কথাটি বলব – খুঁজে যাবো। কারণ কোন কিছু পাওয়া থেকে ওর শেষ খোঁজায় জ্ঞান অর্জন করতে করতে চলা। যেমন সুন্দর ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে “আমি কে” এটাই খোঁজার কথা বা বাচ্চাদের খুঁজে যাওয়ার কৌশল। যেমন একটি বাচ্চা তার কৌতূহল থেকে এটা কি ওটা কি সেটা কি কেন খাই না কেন খাই মন্ত্র কি যায় কেন মজা কি ইত্যাদি সবটাই তার কৌতূহল থেকে শুরু হয় জ্ঞান। আর এই সমস্ত কিছু শিখে নেওয়া কেই সহজ ভাষায় বলি জ্ঞান অর্জন।
এত জীবনের একটা অধ্যায়। প্রশ্নগুলো উত্তর সাজাতে সাজাতে চলে। আমাদের চারপাশে বায়ু ঘোরে, ঠিক আমাদের শরীরে ভেতরেও বায়ু ঘোরে। দেখতে দেখতে মানুষ হয়ে ওঠার কৌশল ধারায় যাঁরা নিজেদের বিলিয়ে দেয় এবং বিলচ্ছেন আবার বিলোবেন তারাই কাল জয়ের অক্ষরের তরঙ্গে উচ্চারিত হয়ে লেখা থাকে। এই এতো কিছু বলবার দরকার হয় না যদি মন চঞ্চল না হত। মন চঞ্চল ও অস্থির। এই মনকে শান্ত করবার জন্য অসংখ্য রকমের পক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু আপনি লক্ষ্য করলেই পরিষ্কার বুঝতে পারবেন যে সকলেই কিন্তু ধ্যানের উপর জোর দিয়ে থাকেন। কারণ ঐ স্থির চিত্ত চিরন্তন। আমাদের যা কিছুই করিনা কেন ঘুরতে তোমাকে হবেই। না ঘুরে কোন কিছুই সম্ভব নয়।
এই পরিষ্কার উক্তির কারণ উল্লেখ করলে বলতে পারি যে যেমন এই শরীর একই দিনে সৃষ্টি হয়নি। বিভিন্ন ভাবে মর্দন কর্ষণ বর্ষণ ভর্ষণ দর্শন বা সর্ষণ এমন কি ধর্ষণ দ্বারা সৃষ্টি হয়ে থাকে। ধর্ষণ শব্দটি আমরা বড্ডো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েই দেখি ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে দেখলেই এর অনেক কিছুই উদহারণ রয়েছে। যাক প্রসঙ্গে সে সব ভালো মন্দ আসল যে বিষয় তা হলো – একটা শরীরের প্রাণ। প্রাণ না থাকলে আত্মা কোথায় আত্মা না থাকলে মন কোথায় এগুলি চোখে দেখা যায় না। আরও যদি বলি এই সবের সঙ্গে জড়িত বায়ু। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে এর মধ্যে এই চারজনকেই আমরা দেখতে পাইনা। আমাদের জীবনের উদ্দেশ্যগুলি মনের দ্বারা স্থির করা হয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। 🍁
🍂কবিতা
সৌমিত বসু
সতীন
বন্ধুত্বের ভেতর ছোটো ছোটো বর্শা লুকোনো থাকে।
এতো ছোট যে
খালি চোখে দেখাই যায় না।
ঠিক রক্তক্ষরণের সময়
আমাদের মনে পড়ে
তার সূঁচালো ফলাগুলোর কথা
যেগুলো বিঁধে গেলে
চোখ বেয়ে নেমে আসে আরব সাগর।
আর ডানা ঝাপটানোর সুযোগই থাকেনা।
বন্ধুত্বের কোনো দিকচিহ্ন নেই
নেই প্রত্মগমন
যেন কোটের পকেটে ঢুকে যাওয়া সিকি বা আধুলি
যেন ছাতের কার্নিশে আটকে থাকা মেঘ
তুমি চাও বা না চাও যে কোনো সময়
ঝরে পড়তে পারে বন্ধুত্বের টুপির ওপর।
কোটের পকেটে লুকিয়ে রাখা বৃষ্টি
আমি সন্তর্পণে ঢেলে দিই বর্শার ডগায়
যাতে ঢুকে যাওয়ার আগে একবার সে কান্না দেখে থমকে দাঁড়ায়।
রণজিৎ সরকার
সরল নয়
যেহেতু পৃথিবী তার
অক্ষপথে ঘূর্ণনকাল কমিয়ে নিচ্ছে
সেই হেতু প্রতিটি সচেতন মানুষ
চতুর চবুতরায় খুঁজে নিচ্ছে একটি বক্রতল
বক্রতল প্রাপ্ত মানুষ সম্বর্ধিত হচ্ছেন যত্রতত্র
অথচ আমার জন্য কোন সম্বর্ধনা সভা নেই
নেই কোন রিংটোন
কেননা আমি সেই মানুষ
যে, সরলরেখিয় সারল্যে বুঁদ হয়ে থাকি
কুন্তল দাশগুপ্ত
মা নিষাদ
তোমাকে এমন ক’রে বলো প্রীতিমন
অক্ষরে অক্ষরে কে আর সেধেছে!
কেউ কি কখনো বলো এত সাজিয়েছে
সু-বর্ণমালা দিয়ে তোমার শ্রাবণ!
প্রীতিমন প্রীতিমন- সুলেখা তোমার
গেঁথে রেখো নিবিষ্ট সু-বর্ণ মেধায়।
যাতে ক’রে কোন মন- শ্রাবণ ধারায়
তুমুল ভিজতে পারে সাগর বেলায়।
সাগর হবার পালা তোমার তখন
ঢেউ দিয়ে দিয়ে ধুয়ো দুঃখ কথন
অনন্ত লোনাজলে তোমার বুকের
অযূত অশ্রু ফোঁটা দুঃখ-সুখের
ধারণ করতে শিখো অরব সোহাগে
বিষাদ বাতাস বাঁশি বাজবে বেহাগে।
প্রীতিমন এঁকে চলো গভীর বিষাদ
পৃথিবীর বাতাসেরা বলতে শেখাক,
মা নিষাদ
মা নিষাদ
আর-
মা নিষাদ…
আবদুস সালাম
সময়ের ঘরবাড়ি
আলো কমে আসছে যেন
পাড়ায় এখন আর সহজে সুখবর ঢোকে না
চোখের জলে ধুয়ে নিচ্ছি প্রতিবেশীর লাশ
মূর্খ আমরা সব ছুটে চলেছি রাজনৈতিক মঞ্চের দিকে
গর্জন ছুটে আসছে সম্মিলনী পাড়ায়
সময়ের ইঁদুর ফুটো করে দিচ্ছে সময়ের ঘরবাড়ি
ধারাপাত পড়ে পড়ে যন্ত্রণারা ঋদ্ধ হয়
উদাসী সুখ চেয়ে থাকে সারা রাত
হাউমাউ করে কাঁদি
রাতের বেলায় বেজে ওঠে বেহাগের সুর
চৈতন্য লোপাট হয়
ধর্মের আশকারায় লালিত হয় রাজনীতি
নিখুঁত পরিকল্পনায় উপত্যকা রং বদলায়,
লাল থেকে নীল, নীল থেকে সবুজ
বিধ্বস্ত পাড়ায় নেমে আসে রাত
শাকচুন্নিরা ডানা মেলে পাড়ায় আসে
নৈঃশব্দের মুর্ছনায় নিরবিচ্ছিন্ন ক্ষতে লাগায় প্রলেপ
দেখি বিষাক্ত রঙের পলেস্তারা মেখে পড়ে আছে ভারতবর্ষ
অন্ধকারের নীচে জড়ো হচ্ছে সন্দেহের লাশ
সুচিতা সরকার
উষ্ণ কোলাহল
আমার বারান্দায় আজ রোদ আসেনি।
সূর্য হয়তো ছুটিতে।
একটা কুয়াশাচ্ছন্ন গোলাকৃতি দেখা যায়,
লেগে আছে আকাশের গায়ে।
অসংখ্য বৃষ্টি বুকে নিয়ে একঝাক ধূসর এসে জমা হয়েছে আমার বাড়ির ছাদে।
জানি না, কেন যে ওরা চুপ করে দাঁড়িয়ে?
আজ বহুকাল হল, আমার গাছে ফুল আসেনি।
সবুজ পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ে।
ডালে নতুন পাতা লাগে।
কে জানে,
কিসের জন্য সবকিছু থমকে দাঁড়িয়ে?
কিসের অপেক্ষায়, ওরা যে সব প্রহর গোনে?
মনের ব্যাকুলতা অসীম গভীরে ডুবে যায়।
কালো শীতল রাতে কাঁপন ধরে কায়ায়।
বুঝতে পারি না, কেন যে চোখ দু’টো শুধু,
এক টুকরো উষ্ণতা খুঁজে বেড়ায় নিশ্ছিদ্র অবহেলায়?
🍂গল্প
_____________________________________________
অভয়ার মা-বাবা কি বুঝেছিল, তার কন্যা দেশের জাতীয় সম্পদ। অন্যের জীবন রক্ষা করাই যার মহান ব্রত। অথচ তাকেই কি না হাসপাতালের সেমিনার ঘরে নৃশংস, নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে চলে যেতে হল। অকালে ঝরে গেল গোলাপের পাঁপড়ি অথচ নর দানবেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজে। তার বিচারের জন্য আর কতদিন তার মা-বাবা অপেক্ষা করবেন কে জানে? আর কতদিন চোখের জল সাগরে পরিণত করবেন?
_____________________________________________
মমতা রায় চৌধুরী
সব দুগ্গার ঘরে ফেরা হয় না
বাঙালি সনাতনীরা উৎসব প্রিয় জাতি। উৎসবের মধ্যে দিয়ে প্রাণ চঞ্চল বাঙালি চিত্ত আনন্দঘন মুহূর্তে জেগে ওঠে, নিজেকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করে। জীবনের আনাচে কানাচে, অলি-গলিতে যে কালো অন্ধকার জমা হয়ে থাকে, একটা বছর ধরে জাতি অপেক্ষা করে সেই দুঃখের পাহাড়কে সরিয়ে আবার নতুন করে ক্ষণিকের সুখ শান্তি সমৃদ্ধির লক্ষ্যে অসুর বিনাশী মা দুর্গার আগমনীতে সবাইকে নিয়ে মেতে উঠতে। শরতের নীল আকাশ পেজা তুলোর মত মেঘের আনাগোনা, কাশ,শিউলি, পদ্মের সমারোহ বাঙালি চিত্তকে মোথিত করে। কেমন যেন একটা অন্য মাত্রা যোগ হয় বাঙালির শরীরে মননে।
মা দুর্গা যেন কোনও স্বর্গীয় দেবী নন এ যেন বাঙালির ঘরের মেয়ে। তাই প্রতিটি পিতা-মাতা তার গৌরীর জন্য এই বিশেষ দিনগুলোতে অপেক্ষা করেন যতই বিষাদঘন মুহূর্ত আসুক না কেন সবকিছুকে দূরে ঠেলে দিয়ে মেয়ের আগমনীকে কেন্দ্র করে উৎসবে তাঁরা মেতে ওঠেন। এই চারটে দিন দেবী দুর্গার আরাধনার মধ্যে দিয়ে বিজয়া দশমীতে গিয়ে শেষ হয়। শুভ বিজয়া দশমীতে মাকে সিঁদুর খেলার মধ্যে দিয়ে বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে সকলের মন খুশিতে আনন্দে ভোরে ওঠে। যেন সর্বত্রই আলোয় আলোয় ভরা আকাশ।এই খুশির ঢেউ আমরা ভাগ করে নিই সকলের সঙ্গে বিভিন্ন মিষ্টি দ্রব্য উপহারের মধ্যে দিয়ে। তার সাথে বড়দের প্রণাম, ছোটদের ভালবাসা, আলিঙ্গন, শুভেচ্ছা বিনিমায়ের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় বিজয়া পর্ব।
এবারের পুজোটা যেন একটু অন্যরকম মা নিজেও যেন ম্রিয়মাণ। মা দুর্গা অসুর বিনাশিনী। দেবী দানবকে উপযুক্ত শাস্তি দিয়ে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তির সূচনা করেন। কিন্তু এবারের এই আরাধনাতে ঘটে গেছে এক বড়সড়ো নির্মম, নৃশংস ঘটনা। উৎসবপ্রিয় বাঙালি জীবনপাতে, বাঙালির ঘরের দুর্গাকে প্রতিনিয়তই নির্যাতিত হতে হয়। এ কারোর অজানা নয়। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে এবার দুর্গার বিসর্জন হল। আগস্টের ৯ তারিখে যেন হল অকালবোধন কিন্তু এ অকালবোধনে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে এক বিষাদ ঘন নির্মমতার ক্ষত চিহ্ন রয়ে গেল! বাঙালি হাসিমুখে তাদের শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব কতটা উদযাপন করল সেটা তো বাঙালি হৃদয় তটেই লেখা আছে। এ যেন মা-মেয়ের শোকে বিষাদ মাখা পুজো।
প্রত্যেক মা-বাবা চান তার সন্তান বিশেষত কন্যা সন্তান মা দুর্গার দশভুজা রূপ নিয়ে গড়ে উঠুক। আসলে সেই সন্তান সত্যিই কি তার সেই স্বাধীন সত্তা থাকে। তবে কেন আজও দুর্গাকে যখন তখন বেরোতে গেলে বাড়ির বাইরে হাজারো কথা শুনতে হয়। এটা বোধহয় চিরস্থায়ী রূপে রয়ে গেল পরিবার তন্ত্রে। নারী মানে তার সব জায়গায় সব সময় যাওয়া যাবে না। হাজারো প্রতিবন্ধকতা। তুমি এটা ক’রো না। তুমি ওটা ক’রো না। এই বিধি নিষিধের বেড়াজালে আবদ্ধ রাখা। তার মনেও যে ইতিউতি কল্পনার বাস সেও যে উড়তে চায় দূর দিগন্তে। সেও যে প্রতিবাদী হতে চায়। বলতে চায় এটা অন্যায় ,এটা করা ঠিক নয়, আর সেই ক্ষেত্রে যদি সাহসী রূপটা সেই অশুভচক্রের গতিপথে এসে পড়ে। যদি সমাজের পরতে পরতে অন্যায় অনাচার, দুরাচার, দুর্নীতির জমতে থাকা পাহাড় সম্পর্কে প্রতিবাদী কোনএ নারী যদি গলা তুলে বলে, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?’’
তাহলে তো কোন প্রশ্নই নেই!
নারীর এত বড় স্পর্ধা যাকে আজ অসহায় অবলা রূপে থাকার কথা সে যদি হয়ে ওঠে প্রতিবাদী। কেন মেনে নেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
তবে এখানে সব পুরুষের কথা বলছি না। সব পুরুষ মানুষের ভেতর যে দানব শক্তি রয়েছে এটা ঠিক বিশ্বাস করা যায় না ।যদি তাই হত তাহলে রামমোহন, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মতো ব্যক্তিত্বরা এত শ্রদ্ধার আসনে থাকতে পারতেন না। উনারা ছিলেন বলেই আজ নারীরা একটু হলেও আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। কিন্তু এখনও তো সমাজে নরখেকো অসুরেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নইলে মেয়েদের বাইরে যেতে হলে এখনও কেন গা টা ছমছম করে, মা বাবার চিন্তায় ঘুম উড়ে যায়! কি জানি কোথায় ওৎ পেতে আছে নর দানবেরা। অভয়ার মা-বাবা কি বুঝেছিল, তার কন্যা দেশের জাতীয় সম্পদ। অন্যের জীবন রক্ষা করাই যার মহান ব্রত। অথচ তাকেই কি না হাসপাতালের সেমিনার ঘরে নৃশংস, নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে চলে যেতে হল। অকালে ঝরে গেল গোলাপের পাঁপড়ি অথচ নর দানবেরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সমাজে। তার বিচারের জন্য আর কতদিন তার মা-বাবা অপেক্ষা করবেন কে জানে? আর কতদিন চোখের জল সাগরে পরিণত করবেন?
আবার কখনও দেখা যায় নান্দুরের মাঠে কোনও এক দুর্গার গলার নলি কাটা দেহ। কুলতুলির দুর্গা রক্ত স্রোতে ভিজে গেছে সেই মাটি। এভাবে দুর্গার হচ্ছে অকালে বিসর্জন। কেন এভাবে অকালে ঝরে যেতে হয় দুর্গাদের? কেন আজও সমাজে নারীর গন্ধ পেলে নরপিচাশরা খুবলে খাবলে তার যৌনাঙ্গ শানায়!
এ তো গেল বাইরের ঘটনা নিজের পরিবারের ভেতরেও ছোট্ট ছোট্ট দুর্গাদের ক্রমাগত নির্যাতিত হতে হয়। নির্যাতিত হয় ছোট দুর্গাদের স্কুল বাসে, স্কুল রুমে, শৌচালয়ে। এভাবেই নারীদের প্রতিনিয়ত বিজয়া হয়। আর কত নিচে নামবে মানুষের মানসিকতা। তাই যদি এই অসুর প্রবৃত্তি নাশ করতে হয় তাহলে মানসিকতারই পরিবর্তন করতে হবে। আইন করে ভয় দেখিয়ে কোনও লাভই হবে না। হ্যাঁ, অবশ্যই একটা আইন থাকা দরকার। তার সঙ্গে সঙ্গে দরকার সমাজের রন্ধে রন্ধে মানসিকতার পরিবর্তন, মনের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরী নইলে ভয়টা থেকেই যাবে। যদি কোনও সামান্য পোষাক কাউকে উত্তেজিত করে তাকে ধর্ষিতা হতে হয়। তাহলে আর বলার কিছুই থাকে না। তাই যতই প্রতিবাদ হোক কিছুটা বদল হতে পারে। সেটা সাময়িক ,এর জন্য চাই দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন। নইলে যে মেয়েটি মানুষ হতে গেল সেই মেয়েটির আর মানুষ হয়ে ওঠা হবে না।
তবে এ কথা বলতেই হয় সমাজের সর্বস্তরে মানুষের বিবেকবোধ যদি জাগ্রত না হয় তাহলে যতই নারী উচ্চ শিক্ষিত হোক তাকে কর্মস্থলে খেলার মাঠ, বাস, ট্রেন ইত্যাদি ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রেই এই লোলুপ দৃষ্টির সম্মুখে পড়তে হবে। তাতে অবশ্য ভয় পেলে চলবে না এই অসুর দমনের জন্য শুধুমাত্র ঈশ্বরের ওপর ভরসা না করে শক্তি-রূপিনী নারীকে দশভূজা হয়ে উঠতে হবে। তাই আজ বিজয়া দশমীর পরে মিষ্টি মুখের যে সোনালী দিনগুলো আমরা অতিবাহিত করি আজ যেন উৎসবের এই বছরভর অপেক্ষার বিষাদমাখা বিসর্জনের ছবি ফুটে ওঠে। কিছুতেই ভোলা যায় না আগস্টের সেই অভয়া দুর্গার বিসর্জন। এ যেন আজকের এই উৎসবের দিনে বাইরে ঢাকের বোলে বুকে হাতুড়ির ঘা। মানুষের মনের ভেতরে সে ক্ষতটা রয়েই যাবে যতই তারা উৎসব করুন, আনন্দ করুন, এক চিরকালীন ক্ষতচিহ্ন জাতিকে কুঁকড়ে কুঁকড়ে খাবে। চলতে থাকবে আন্দোলন, প্রতীকী অনশন, অরন্ধন, মানববন্ধন। আর কতদিন আর কতদিন চলবে এভাবে বিজয়া। শরতের আকাশ যখন জানান দেয় মা দুর্গার আগমন। প্রতি বছর এই দিনটির বিসর্জনের মধ্যে দিয়েই আবাহনের সুর বেজে ওঠে। তাই সমাজে ঘটতে থাকা দুর্গাদের ওপর যে অত্যাচার সেই নির্যাতিতা দুর্গার যখন বিসর্জন হয় সেই বিজয়া শুভ হয় না। কিছু বিজয়া মনের ভেতরে ক্ষত সৃষ্টি করে প্রতিবাদী আন্দোলনে সামিল হতে বাধ্য করে। তখনই মনে হয় “আয় মোরা হাতে হাত রেখে চলি।” আর আমরা এই আশায় দিনগুনি, “মেঘ দেখে তুই করিস নে ভয় আড়ালে তার সূর্য হাসে।” 🍁
🍂কবিতা
যতন কুমার দেবনাথ
পিড়ল ডাঙার মোড়
পিড়ল ডাঙার মোড়। মরার উপর খাড়ার ঘা
ঘটনার পর টনক নড়ে – গা করে না
প্রচ্ছন্ন স্নেহে ডালপালা বিছিয়ে
ছায়া দিচ্ছে গাছ
মুখোমুখি বেহারারা। বিড়ি-মুখে আগুন।
পুড়ে ছাই পরিকল্পনাহীন অনিশ্চিত আগামী
বাঘের মতো হা করে তেড়ে আসা ট্রাক
লেজের ঢেউয়ে নাড়াচ্ছে অজানা সুখ
হর্ণ বাজতেই পালকির বউ বেড়াল
কুকুরের তাড়ায় গাছে।
দীপ্তি চক্রবর্তী
শুন্যতা যখন
শুন্যতা কাকে বলে তুমি জানো?
শুন্য পথে হেঁটে যেতে যেতে
তুমি তো ভুলেই গেছো
পেয়ে হারানোর শোক
পাওয়ার আশা রাখি একদিন
যেভাবে হেঁটে যায় পথিক পথ
শুন্যতা তারই আরেক নাম
কোলের সন্তান বুকে জড়িয়ে আছে
যে মেয়েটা রোজ সকালে বিকেলে
পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর
সেবা দিতে দিতে ক্লান্ত দেহ
একবারও কেউ জানার ইচ্ছে করেনা
সে কেমন আছে
শুন্যতা তারই আরেক নাম।
ডাকঘর ফিরে যায়
চিঠির আশায় দিন কাটে
যে সন্তান বিদেশে বানায় ঘর
তার পিতামাতার থেকে কে বা জানে
শুন্যতা কি!
নীলমণি দাস
অধিকার
রুখে দাড়াও।
গড়ে তোলো ব্যারিকেড।
কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলো,
মুঠিবদ্ধ হাত ধরো তুলে উঁচুতে আরো উঁচুতে
তোলো আওয়াজ।
প্রতিবাদের ভাষায়,
প্রতিরোধের আগুনে নিজেকে ছুঁড়ে দাও,
শান দাও,
অধিকারটুকু ছিনিয়ে আনার সামর্থ্যটাকে করে তোলো দুর্বার।
শোষিতের স্পর্ধায় ভেঙ্গে যাক যত আলিশান ইমারত,
কু-মগজের শিরা বেয়ে নেমে পরুক
চিকন ঘাম।
শোভন মণ্ডল
শূন্য এ বুকে...
যত এগোই জীবনের দিকে
মৃত্যু ছায়া ফেলে পায়ের নিচে
যতই আলোর দিকে মুখ করে থাকি
অন্ধ করে দিতে চায় এই প্রিয় চোখ
আমাদের চলা আসলে হেঁটে যাওয়া হোঁচট খেতে খেতে
বিছানো লাল-নীল মার্বেল পাথরে ঘষে নেওয়া এ শরীর
ঝলমল করে, সারা জীবন ধরে
কোথাও কি আঁচল ভরে গেছে উপহারে?
কোথাও কি মুঠোর মধ্যে ধরা আছে স্নেহ আর ভালবাসাখানি?
এ প্রশ্ন করতেই হবে
যতই এগিয়ে যাই মৃত্যুর দিকে
জীবন আলিঙ্গন করে শূন্য এ বুকে
শম্পা ঘোষ
চলমানতার গতিসূত্র
জীবনের রোজনামচায় রোজ কুঠার হানছে ক্রমাগত বেড়ে চড়া কোন ঠাসা অস্বস্তি বোধ,
ভালো থাকার প্রয়োজনে চাঁদের উত্তাপে গা সেঁকে নিতে নিতে-ই
মনে পড়ে যায়, ডাইনোসরাসের জন্মকথা,
কবিতার খসড়া লিখতে গিয়ে পরিশ্রান্ত ভাবনা ভৌগোলিক অবস্থানের মাপ বুঝে ফেলে,
আবেগের ইশতেহার নাকি নির্দোষ অর্থহীন ভালো থাকা কোনটা বেশি জরুরী এই ভাবনা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ জৈবিক ক্রিয়ায় মন পড়ে
চলমানো তার গতিসূত্র জড় বস্তুর আঁধারে কেমন করে যেন সত্যি হয়ে ওঠে।
ভুবনেশ্বর মণ্ডল
বিচ্ছেদ-বিষাদ
চেনা মুখ বড় অচেনা এখন
যে ভূখণ্ডের উপর ছিল পৃথিবী ডোবাচ্ছে সমুদ্রস্রোত
ভালবাসার জাহাজ গতিহীন গন্তব্যহীন
নদীর এপারে ওপারে সংযোগহীন দু’টি ভুবন
যাবতীয় চাওয়া পাওয়া শূন্যতার সাথে খেলে
রোজই তো দেখা হয় তবু সেতু ভাসে জলে
আমরা এখন চলে যেতে পারি যে কোন অভিমুখে
জীবনের স্রোত বুঝি এরকমই হয়
যা কিছু চিনি যা কিছু বুঝি হয়তো সত্য নয়
আবহাওয়া থাকে না এক বদলায় প্রতিটি মুহূর্তে
হাজার ভাঙাগড়া রোজই সম্পর্ক-ইমারতে
তবু জোড়া-তালি দিয়ে বয়ে চলি সম্পর্ক-শব
মর্গে রোজ কাটা-ছেঁড়া উপলব্ধি অনুভব।
অনিদ্য পাল
চাকা
গতির মানসপুত্র
জীবনের আশ্চর্যমলম মেখে
একান্ত অদৃষ্ট ছুঁয়ে দৌড়ায়
দৌড়ায় সময়কে কোলে নিয়ে
সামনে এবং পিছনে
ত্বরণে মন্দনে
প্রতি স্টপেজে অ্যালভিওলাস
ভরে ওঠে নতুন বারুদে
ধ্বংসই যেন তার শেষ গন্তব্য।
স্বপন কুমার ধর
জলরাশি
সফেন জলরাশি আছড়ে পড়ে যে,
বেলাভূমিতে তা স্পষ্ট,
ক্ষণকাল পড়ে হাতড়ে চললেও,
চোখে পড়ে না অবশিষ্ট।
ঢেউ এর পরে ঢেউ আসে যায়,
থামে না সে কারো তরে,
সময়ের ঘড়িটা এগিয়েই চলে,
দেখেনা তো পিছু ফিরে।
বায়ু বয়ে যায় এদিক-ওদিক,
জুড়ায় মন ও প্রাণ,
থাকে না সে থেমে,কারো কথা শুনে,
চলে সে মেনে বিধান।
জীবের জীবন ও এগোয় প্রতি পলে,
প্রান্ত সীমানার দিকে,
থামানো যায় না,থামবে ও না সে,
এগিয়ে চলে নির্দিষ্ট অভিমুখে।
পার্থসারথি মহাপাত্র
স্বাধীনতা
বাসে চাপতেই দেখি প্রচণ্ড ভীড়
কন্ডাক্টর বলল ‘পিছনের দিকে
এগিয়ে যান’। এগচ্ছি না পেছচ্ছি
বুঝি না ছাই। সময়ের ঘূর্ণন গতিতে
আবর্তিত মাছঘরের জলে আবদ্ধ
একটি তেলাপোকা। গণতান্ত্রিক
অধিকারে ভোট দিই। বিনিময়ে
জোটে ভিক্ষান্ন আর মাসোহারা।
স্বাধীনতা কি? চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য,
পেয় তা জানবার অধিকার নেই।
হুকুম- তালি দাও থালি বাজাও।
কৃত্রিম আলোর এ রোশনাই ভুলে
পূব আকাশে দেখো রক্তিম ছটা
গণ্ডি ভেঙ্গে হোক ঘামের ক্ষরণ
স্ব-অর্জনে যাপিত হোক স্বাধীনতা।
🍂ধারাবাহিক গদ্য
বাংলা ভাষার বরেণ্য ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুল হাই। বাংলাভাষা ও সাহিত্য ওঁর পাণ্ডিত্যে পুষ্টিলাভ করে। প্রফেসর হাই শিক্ষা ও শিক্ষাজীবনকে কীভাবে আত্মস্থকরণ করেছেন? দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে বেড়ে ওঠে তাঁর শিক্ষা জীবন ও শিক্ষক জীবন। এগিয়ে চলে শিক্ষা। তারপর তৎকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে কীভাবে তিনি বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণাধর্মী অজস্র কাজ করলেন? যা দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাবিদদের ভেতর সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে! আজ থেকে শুরু হল নতুন ধারাবাহিক গদ্য…
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর আব্দুল হাই
রেহানা বীথি
দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে হল দেশভাগ। ১৯৪৭ সালের ব্রিটিশদের সেই চাল পুরোপুরিভাবে কার্যকর হল পাকিস্তানের দুটি অংশের মধ্যে। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যে শুধু পথেরই দূরত্ব ছিল তাই নয়, দূরত্ব ছিল ভাষা, সংস্কৃতি, আচার আচরণ, এমনকি পোশাকেও। বিরোধ অনিবার্য। শুধুমাত্র ধর্মের দোহাই দিয়েই দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন মতবাদের জনপদকে এক করে মূলত বিরোধ জিইয়ে রাখাই যে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল তা তো বলাই বাহুল্য। ব্রিটিশদের সেই কূটচাল ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে ওঠে। সববিষয়ে পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। কিন্তু ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। প্রথম আঘাতটা করে তারা ভাষার ওপর। ঊর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির আবেগকে নাড়িয়ে দেয় ভীষণভাবে। বাংলা ভাষার ওপর আঘাত মানে বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর আঘাত। এ আঘাত মেনে নেয়নি বাঙালি। তীব্র প্রতিবাদের পর বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রক্ষা করে বাংলা ভাষার মর্যাদা, বাঙালির মর্যাদা। কিন্তু ষড়যন্ত্র তো থেমে থাকেনি! নানাভাবে নানা দিক দিয়ে প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে পশ্চিম পাকিস্তান। আর এই ষড়যন্ত্রের অন্যতম লক্ষ্য ছিল যে মানুষটি, সেই মানুষটির উপস্থিতি যে বাংলা ভাষার জন্য কতটা জরুরি ছিল সেটা তাঁর জীবনইতিহাসেই স্পষ্ট। ধীরে ধীরে সেদিকে আলোকপাত আলো ছড়াবে আমাদের মনে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
তাঁর জন্ম, শিক্ষা এবং কর্মজীবন
১৯১৯ সালের ২৬ নভেম্বর। দিনটি স্বরণীয় হয়ে রইল একজন ক্ষণজন্মা মানুষের এ ধরণীতে আগমনের দিন হিসেবে। সেই মানুষটির আগমন না হলে হয়তো আমরা আমাদের প্রাণের ভাষা, এই বাংলা ভাষাকে আজ যে রূপে ধারণ করে এগিয়ে চলছি ভবিষ্যতের দিকে, সে পথটা এতটা সহজ হতো না। তাঁর গবেষণা, বাংলা ভাষার খুঁটিনাটি নিয়ে তাঁর বিশ্লেষণ সুদীর্ঘ সময় ধরে আলো দেখিয়ে আসছে আমাদের। সেই মানুষটি আর কেউ নন, আমাদের সর্বজন শ্রদ্ধেয়, চিরস্মরণীয় ভাষাবিজ্ঞানী আব্দুল হাই। (চলবে) 🍁
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একাধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি ও ছবি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী।
অবশ্যই লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা দয়া করে পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
