



সম্পাদকীয়
চারদিকের পরিস্থিতি দেখে ভালো লাগছে না। সময় এর সমস্যা হল কঠিন। প্রতিটি মুহূর্ত যেন খামচে ধরছে। লেখকরা লিখতে গিয়ে আটকে পড়ছে। বাঁধ ভেঙেছে সমাজের। সামাজিক সুরক্ষা নিয়ে আলোচনা দরকার। এই অসময় বড়োই অস্থির। চঞ্চল। লেখার জন্য অনেকেই কলম তুললেও মন তুলতে পারেননি। নির্জীব হয়ে উঠেছে। জ্বলন্ত সিগারেটের মতো আলো জ্বলছে আর নিভছে। কখন যে অজান্তেই শেষ হয়ে যাবে কেউই জানেনা। কিংবা ওয়াইন বোতলে ঝাঁকুনি মেরে ওয়াইন খুলছে। অপরিবর্তিত সময়। আতঙ্কিত। বাঙালিরা এখন খেতে পারছেনা। খাবারের থালা আটকে যায়। বড়োই অস্থির সময়। সাহিত্য সঠিক পথে চলেনা। কবিতা মিথ্যে কথা বলতে শেখেনি। যদিও কেউ লিখে তা নির্মাণ ছাড়া অন্য কিছু নয়। গভীর আত্মউপলব্ধি। চিন্তার ভাঁজ পরতে পরতে। আবিষ্কার করছি ভরহীন যাদুতত্ত্ব। এটাই মূলত কাজ। সবার মাঝেই এই তত্ত্ব কাজ করে থাকে। আবিষ্কার এমন ভাবেই হয়। আজেকের সময়েও প্রতিটি মুহূর্ত যেন এই তত্ত্বের সাক্ষী। শুধু মানুষ নিজেদের মতো খেতে বসতে কর্ম শুতে মানে বিশ্রামে জীবনচক্রে আমার ভিন্ন অন্য কিছুই লক্ষ্য করিনা। বন্ধুস্বজন বা আত্মীয় পরিজন অথবা পথচলতি মানুষকে লক্ষ্য করেছি। অনেক কিছুই করেছি। করছি। আগামীতেও করবো। কিন্তু সমাজের পক্ষে। প্রকৃতি যেমন আকাশ বাতাস আলো গাছ মাটি আগুন। সবই মানব কল্যাণের শান্তির জন্য। এর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা ঢুকিয়ে সামাজিক ক্ষয়ের মাত্রা অতি থেকে অতিতম। আমার তোমার বলে সংশয়। আসলেই সকলেই মিলে আমরা। এই সামান্য বিষয় নিয়ে তোলপাড় মন্দির মসজিদ গীর্জা মঠ সমস্ত ক্ষেত্রেই। এই বিষয়ের সমাধান কিভাবে হবে এর উত্তর নেই বুদ্ধিজীবী মহলে। কিভাবে যুদ্ধ লাগানো যায়। কিভাবে পরিবর্তন করা যায়। কিভাবে একে অপরের শত্রু তৈরী করা যায় তার খেলায় মত্ত। কিন্তু ভেবে দ্যাখেননি সেই সমস্ত মানুষেরা যে, তিনি কতদিন আছেন এই পৃথিবীতে। এই সন্ত্রাস মনে বাসা বাঁধে। অথচ কেউ কি ভেবে দেখেছেন যে, মন সব কিছুর পাণ্ডা। যাকে দেখাই যায় না অথচ যুদ্ধ শান্তি নিয়ে খেলে যায়। আসল সত্য এই প্রাণের যে সব কিছুরই প্রধান তাকেই দেখা যায় না। এই বিষয়টি মানুষের জেনেও অজানার মতো বিস্ময়। ভালোবাসা বিষয়টিও নির্ধারণ করে মন। খাদ্যটিও নির্ধারণ করে মন। তাহলে প্রাণের সঙ্গে শ্বাস আর মন যুক্ত হয়ে এক অদৃশ্য মিলন তৈরী করেছে।
আসলে মানব জীবনের মায়ার বন্ধন বড়ো কঠিন বন্ধন। এই বন্ধনে আসার জন্য প্রতিটি প্রাণ লড়াই চালিয়ে যায়। ঠিক সমাজে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেইভাবে লড়াই চালিয়ে যায়।
তাই আজ মন খারাপ। মন ভেঙে যায়। মন দুর্বল। চারদিকের পরিস্থিতি দেখে ভালোই লাগছে না। কোন দিকে দেশের বিভ্রান্তকর বিভ্রাট, বন্যা, রাজ্যের মহিলাদের ন্যায্য দাবির লড়াই। দেশের পরিস্থিতি, বিদেশের পরিস্থিতি, বিশ্বের বৃহত্তম অসুবিধা।
কবি লেখকেরা মানবিক। তাই মানবিকভাবেই কলম ধরে তাঁদের মত করেই প্রতিবাদ চালিয়ে যায়। চালিয়ে যাচ্ছে। চালিয়ে যাবে। 🦋
🍁কবিতা
তৈমুর খান
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
তোমার অসুখের বিছানার পাশে
আমার কবিতারা বসে আছে
কোথাও যায়নি ওরা
জানালার চাঁদে হাত বাড়ায়নি ওরা
স্নেহান্ধ পিচ্ছিল কান্না চেপে
সারারাত জেগে জেগে আছে।
কী বলল ডাক্তার?
হয়তো সেরে যাবে
তিনমাস বিশ্রামে তারপর একটু একটু করে
কে দেখবে সংসার? আমরা সবাই হাওয়া খাব?
ছেলেমেয়ে আর শীতের কুয়াশার হাত ধরে
রোদের অপেক্ষা করে করে আমরা কি বিপ্লবী হব?
মৃত্যুকে পুষে পুষে রোজ বড় করি
মৃত্যু কি কোনও দিন আলো হতে পারে?
ডাক্তারের কাছে কোনও সমাধান নেই
শুধু অ্যানাস্থেসিয়া আর ডেটলের গন্ধ ঘরময়
সেলাইন চুপচাপ শরীরে ঢোকে
যন্ত্রণারা উপশম চায় আমার শব্দের কাছে
কবিতারা উঠে দাঁড়াতে চায়
সুসংবাদ এসে যদি দরজা খুলে ডাকে!
জানোয়ার
আমরা স্বর্গের দিকে যেতে যেতে দুইপাশে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম
আমরা সবাই দেবতা—চারিপাশে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল
চারিপাশে সবাই আমাদের দেখছিল আর ফুল ছুঁড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল
আমাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না সেদিকে
হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলাম স্বর্গযানে
দুইপাশে মরচেধরা প্রাণী—ক্ষুধার্ত—ভঙ্গুর—তৃষ্ণার্ত—হাহাকারপ্রিয়…
দুইপাশে কসাইয়ের দোকান—
নিরন্তর ছুরি শান দেওয়ার শব্দ
নিরন্তর দুর্বোধ্য ভাষার চিৎকার…
আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা
স্বর্গে যেতে যেতে দেখছি এসব;
আমাদের গাড়ির চালক জানাল:
এরা সবাই বিভিন্ন জাতের প্রাণী—
পৃথিবীতে এদের জানোয়ার নামে ডাকা হয়!
দুপুরের ডাকঘর
দুপুর এসেছে, একটু পর চলে যাবে
তাকে কিছুই বলার নেই
অনেক মৃত সকাল, শিশির ভেজা ভোর
স্মৃতির আলোয় পড়ে আছে
পাখিদের কলতান উড়ছে কোথাও
কোথাও বিগতা কুমারী শিস দেয় আজও
শরতের শালুক ফোটা দিঘি আর নেই
দিঘির বকেরা সব মৃত! মাছগুলি চলে গেছে অন্যকোনও সমুদ্রের দিকে….
এখন হৃদয় পেতে ছায়া খোঁজা দিন
বিশ্রামে নীরব হয়ে থাকা
মাটি ফাটা তাপে বয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস
শীত আর কুয়াশায় লেখা জীবনের শেষ চিঠি
নিয়ে এসেছে দুপুরের ম্লান ডাকঘর
পাপড়ি দাস সরকার
অলিখিত ভোর
এই যে অসুখ বাসা বেঁধেছে দেহে
খসে পড়ছে রোজকার বাহুবন্ধন
যত্রতত্র শুয়োপোকার উৎপাত
শরীর জানে না সে গুপ্ত কথা
তার চেয়ে অধিক অসুস্হ মন
আলোর নীচে যেখানে মৃত্যুর ন্যায়
মন অন্ধকারের বসবাস দিনরাত
চলে দেহকে সুস্থ করে তোলার
প্লাজমা ফুসফুস ছেঁড়া আয়োজন
সবাই চার জন্মের প্রজাপতি ব্রহ্ম
কিন্ত মনের কোণে অদৃশ্য শুয়োটাকে
আটকে রাখে জিভের তলায়, লালসার আঠায়
সুপ্রভাত মেট্যা
ক্ষুধার্তের সন্তানের জন্য
প্রচলিত আড়াল সরে গেলে পরিষ্কার লাগে সব।
বিস্ফোরক আলো এসে পড়ে ধুলায়।
সকাল হয় ক্রমশ জানলার পাল্লা খুলে গিয়ে
আর বালক হয় সময়।
বিগলিত গল্প ও সমুদ্রের ধারা বয়ে যায়
অন্ধের চক্ষু বেয়ে, উঠে আসে লেখা।
কষ্টস্নাত পথ। লবন শ্লোক, ধুলো,
দুইদিকে তালবৃক্ষের ছায়া, আর বাবলা সারির
কন্টক পাহারায় পথিক হেঁটে যায় দূর।
ধানের গন্ধে ক্ষুধা বেড়ে ওঠে তার।
দুপুর ছুঁই-ছুঁই আকাশ মাথার উপরে।
গনগনে অগুনের হালকা হাওয়া গায়ে এসে লাগে।
ধোঁয়ার চোখ, লক্ষ্যপূরণের জীবন,
রোজ একটা মিটে না-যাওয়া ক্ষুধার্তের সন্তানের জন্য
পিতা সমৃদ্ধ হৃদয়ের জল ছড়াতে ছড়াতে
অন্ধকার সমষ্টির শীর্ষ দেশের এক রাজার কাছে পৌঁছে যায়।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
মুখ্যমন্ত্রী আপনাকে
এই তো আপনার সাজানো সুরোভিত উদ্যান
বয়ে যাচ্ছে, পারিজাতের সৌরভ
অথচ অদূরে থেমে গেছে আমার নয়ের দশক…
ভুলে গেছি, শেষ কবে শকুনির পাশায়
তছনছ হয়েছিলাম দুর্বিনীত সন্ন্যাসীর উচ্চারণে
ভেবেছিলাম—এই বুঝি আপনার কোন সমীচিন চিঠি বেয়ে নেমে আসবে আমার সন্তানদের লেখা
মাশরুম সকাল
অথচ দেখুন, আমার সামনে অবাধ্য দরজা এঁকে
পাহারা দিচ্ছে একদল প্রহরী
আর আমি হু হু জ্বলে যাচ্ছি, নিন্দার অনলে…
কে দেবে- প্রশান্তি আঁকা দু’মুঠো নীলরোদ?
আপনি তো আলোকবর্ষ দূরের সুপারনোভা…
আমার ম্রিয়মান বিকেলে সাজাচ্ছি, আপনাকে
লেখা উর্ণপত্র
আপনার সাজানো, মা মাটির সংসারে
আর কত শুনবো, অসংযত সংলাপ?
তার চেয়ে কোনদিন আকাশ দড়ি মেখে
ঝুলে পড়বো, আত্মহত্যার অন্ধকারে
চাকুরি নামের প্রহসনে-
ততক্ষণে বেড়ে যাক, আরো দীর্ঘ চিনের প্রাচীর
যতন কুমার দেবনাথ
না, থাক
ধবধবে লজ্জার সাদা কথা
-বলবো ?
-না, থাক
থাক মানে – বাঁশঝাড়, চিপা চাপা
কিংবা টয়লেটে নিঃস্বার্থ ত্যাগ নয়!
তন্দ্রার মধ্যে জেগে ঘুমানো কিংবা
ঘুমের মধ্যে আঙুল ঝিমুনি নয়
পথের ঢেউয়ে শরীর দুলিয়ে কেউ যায় যাক
-বলবো?
-না, থাক
শ্রাবণী সরকার
যেদিন ঝড় উঠে
১.
যেদিন ঝড় উঠে,
ছাইয়ের মত ঝাপসা সব, দিগন্ত জলের মাঠ
বৃষ্টিধোয়া দৃশ্যগুলো অস্পষ্ট হতে থাকলেও
মোহন সম্মোহনে,
ঝুলবারান্দার ভিজে গা মুছে যায় আপনা থেকেই
বৃষ্টিভেজা বুলবুলি, তোমার একলার মতোন…
২.
আমি ঘুমিয়ে গেলে সাতজন্ম তপস্যাও
ঘুমিয়ে পড়ে আমার
এখন জাগাবার কেউ নেই মহাদেশে
প্রিয় জ্যোৎস্না নরম করে রেখেছে চারপাশ
জাতিষ্মর চন্দন
কাঠের বন
সেও যোজনব্যাপী জঙ্গলে…
রবীন বসু
কবিতা খোলস ছাড়ে
হাত ফসকে অক্ষর যদি বেরিয়ে যায়
তিন আঙুলে মেপে নাও বর্ণমালা;
কবিতাকাঙ্ক্ষিত স্বর নিম্নে রেখে বল
হে চারণভূমি, তুমি গোষ্ঠবদ্ধ হও—
পাচনবাড়ি হাতে দিগ্বিদিক ছুটছে মহিমা
অক্ষরের পাল আজ অপার দাক্ষিণ্য দ্যাখে।
শীতঘুম ভেঙে ক্ষুধার্ত সাপের মত
কবিতা লাফিয়ে চলে, আছাড়িপিছাড়ি খায়
খোলস ছাড়ে, তারপর নতুন চিকন ধরে
বসন্ত-বাতাসের দিকে ধেয়ে যায়…
অর্পিতা আচার্য
গ্রাস
যত আমার কবিতারা ছড়িয়ে যাচ্ছে
ততোই কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি
যেন গ্রাস করে নিচ্ছে আমাকে সে
খেয়ে নিচ্ছে আমার দিন ও রাত
আমার ঘুম ও স্বপ্ন
আমার তুচ্ছতম সন্ধ্যার ঘণ্টাধ্বনি
তোমার হাত ও হাতের দূরত্ব
আমাকে নিতে নিতে নিতে নিতে
সে ক্রমশঃ আমি হয়ে যাচ্ছে
সে আমার কথা নিচ্ছে,
কন্ঠস্বর থেকে কেড়ে নিচ্ছে শব্দ
নাভি ও ঊরু গ্রাস করছে
নিয়ে নিচ্ছে কামনা ও রতি
গর্ভ থেকে নিচ্ছে সন্তান
বুক নিচ্ছে, নিচ্ছে স্তন থেকে দুধ
ক্ষুধা তৃষ্ণা গিলে গিলে খাচ্ছে
খাচ্ছে অন্ন সংস্থান ও বাসস্থান স্পৃহা
নিঃশ্বাস থেকে অহংকার
আর পোশাক থেকে মঞ্চমুখোশ খুলে ফেলছে
সে আমাকে চিবিয়ে খাচ্ছে, চুষছে এবং আঁচড়াচ্ছে
দাঁতে ঢালছে বিষ, আর, আহ্ চুম্বনে তীব্র মধু !
তার হিংস্র ভালবাসায়
আমি ক্রমশঃ গলে যাচ্ছি আদরের মতো
জ্যোৎস্নার লালায়, পৃথিবীর প্রথম নদী পাথারে।
🍁গল্প
অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে নিশাকে ফোন করল উজান। নিশা অফিসে নেই। অন্য ব্রাঞ্চে গেছে। ফোনে উত্তর এলো, “তুমি খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।” উজানের আজ খুব ইচ্ছে ছিল এক সঙ্গে খাবে। দিদি বানিয়ে দিয়েছে ভাত ডাল আর আলু পাস্ত। খেতে ভাল লাগল না। চা অর্ডার করল উজান। হঠাৎ সুনন্দর কথা মনে পড়ে গেল। গল্প লিখেছেন তন্ময় কবিরাজ
পাখি উড়ছে
তন্ময় কবিরাজ
ক.
“তুমি আমাকে কোনদিন ভালোবাসলে না উজান”। সকালে চায়ে প্রথম চুমুক দিয়ে নিশা বলল। পাশের চেয়ারে বসে ছিল উজান। ঘন কুয়াশায় ঢেকেছে কুড়ি তোলার ব্যালকনি। মানি প্লান্টের পাতায় জমেছে মাঘের আদ্রতা। নিশার দিকে তাকাল উজান। “এ প্রশ্ন তো আমিও তোমাকে করতে পারি?”
হাসলো নিশা। “করতেই পারো। অভিযোগের আর দোষ কোথায়?”
“দোষটা আমাদের। আমরাই বোধহয় এই রকম করে বাঁচতে চেয়েছি।”
“আমার আর ভালো লাগছে না উজান।” চায়ের কাপটা রেখে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশা। রেলিংয়ে হাত রাখল। ব্যস্ত শহর আজ ঝাপসা। মন চাইলেও চেনা ব্যস্ততাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। উজানের দিকে ঘুরল নিশা। “জানো, তোমার বন্ধু সমরের ছেলেটা বেশ বড়ো হয়ে গেছে।”
“কোথায় দেখলে?” জানতে চাইল উজান।
“সমরের বউ পোস্ট করেছিল।” কথার শেষে চুপ করে গেল নিশা। উজানও কথা বাড়ালো না। নিশা বলল, ”আমি মা হতে চাই উজান।” উজান জানত নিশা এই কথাটাই বলবে। তাই চুপ করে ছিল।
“আমিও তো তাই চাই। কিন্তু অফিসের কাজ সামলে পারবে?”
“আমি অফিস ছেড়ে দেবো। পারলে তুমিও ছেড়ে দাও।”
“আমি একটা ডিসিশন অলরেডি নিয়েছি নিশা।”
“কি?” গভীর কৌতুহল নিশার।
“হয় আমি কাজটা ছেড়ে দেবো, নয়তো দেশের বাড়ির নিয়ারেস্ট লোকেশনে পোস্টিং নেবো। বসকে অরালি একবার বলেও দিয়েছি।”
“ওটাই করো। আমাদেরও একটা জীবন আছে। আমাদেরকেও তো সুস্থভাবে বাঁচতে হবে।” কিছুটা স্বস্তি পেল নিশা।
“আমাদের যা আছে তাতে বাকি জীবন চলে যাবে। দেশের বাড়িটাও ফাঁকা পড়ে আছে। জমি জমার কি অবস্থা কে জানে? ওখানে থাকলে জমিগুলো দেখা শোনা করা যাবে। কাকারা আছে। তোমারও কোনও অসুবিধা হবে না।”
কুয়াশাটা যেন সবে ফিকে হতে শুরু করেছে। দু’টি শালিক উড়ে গেল। নিশা দেখতে চাইল কিন্তু ওরা মিলিয়ে গেল মেঘের দেশে।
রান্নাঘর থেকে দিদি হাঁক দিলো,”রান্না হয়ে গেছে।”
নিশা বলল, “আমি রেডি হতে যাচ্ছি। যা করার তাড়াতাড়ি করো। আমার আর ভালো লাগছে না। এতো প্রেশার হ্যান্ডল করা যাচ্ছে না।”
নিশাকে বুকে টেনে নিল উজান। “সাতদিন সময় দাও। আমরা দেশের বাড়ি চলে যাবো। সবুজ মাঠ, বড়ো বড়ো পুকুর। সকাল হলে আমাদের বারান্দায় অনেক পাখি আসে। তোমাকে তখন আর পাখি দেখার জন্য এতো কষ্ট করতে হবে না।”
উজান নিশা একই অফিসে চাকরি করে। কর্পোরেট অফিস। মোটা মাইনে। অফিসের একটা প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে দু’জনের আলাপ। তারপর বন্ধুত্ব। দিয়ে ভালবাসা, তারপর বিয়ে। নিশাদের বাড়িতেও উজানকে সবার পছন্দ। তিন বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে। অফিস হোক বা বাড়ি কোথাও ভাল করে গল্প হয় না। দুজনের ডিপার্টমেন্ট আলাদা। কে কখন বাড়ি ফিরবে কেউ জানে না। অনেক সময় আগে বাড়ি ফিরে নিশা ঘুমিয়ে যায়, বুঝতেও পারেনা কখন উজান এল। আবার উল্টোটাও হয়। দেখা বলতে ওই সকালে চায়ের টেবিলে। তাও সবদিন নয়। যেদিন কাজের চাপ থাকে সেদিন সকালে ল্যাপটপ খুলে বসে পড়তে হয়। বিয়ের পর এখনও হানিমুনে কোথাও যায়নি। বাড়িতে কাজের জন্য দিদি আছে। নিশার খুব একা লাগে। কাজের মধ্যে থাকে তাই ভুলে যায়। উজানকেও কাছে পায়না সেভাবে। বাকি বন্ধুরা সবাই জীবনকে উপভোগ করছে। ভ্যালেন্টাইন ডেতে একটা ক্যামেরা গিফট করেছিল উজান। আজও সেটা খোলা হয়নি।
খ.
সকালে চিনি মুড়ি খেয়ে মাঠে যায় সমর। বাড়িতে কলা থাকলে সবিতা মুড়িতে মাখিয়ে দেয়। বাড়ি কখন ফিরবে কে জানে? “এভাবে খাওয়া দাওয়া করলে তোমার শরীর টিকবে না?”
“কী করব বল? চাষ থেকে যা হয় তাতে সংসারটা চলে। বাবু বড়ো হচ্ছে। তবু জমিগুলো নিজে করি বলে কিছু হাতে আসে।” কথাগুলো বলতে কষ্ট হল সমরের। আজ সমর উপরের মাঠে যাবে।
“প্রাইমারীর চাকরিতে যেতে পারতে।”
“বাবা বারন করলো।” বলল সমর।
“জানো সেদিন দাদা ফোন করেছিল।” নিচু গলায় বলল সবিতা।
“কী বলল?”
“দাদার খারাপ লাগছে। তোকে প্রাইমারীর চাকরি দেখে বিয়ে দিলাম। আর জামাই চাকরি ছেড়ে দিল।” কথাগুলো বলতেও খারাপ লাগছিল সবিতার।
“তুমি বলতে পারতে ও-ছাড়তে চায়নি।”
“বলেছি। দাদা বলছে, বাবার সময় চাষে আয় হতো। এখন সেই অবস্থা নেই। এই বছরেই বৃষ্টিতে আলুর ব্যাপক ক্ষতি হল।”
সমর প্রশ্ন করল, “আর কি বললো?”
“দাদা বলছে, আমি যে ডিপ্লোমা করলাম তার কি হলো? তুমি নাকি বিয়ের সময় দাদাকে বলেছিলে, আমি চাকরি করলে তোমার কোনো আপত্তি নেই।”
সমর চুপ করে গেল। গত বছরের ধার এখনও শোধ হয়নি। এ বছরও ফলন ভাল হয়নি। চাকরিটা করলে ভাল হতো। সবিতাও রেলের গ্রুপ ডি পাস করেছিল। সমরের বাবা বাড়ির বউকে মাঠ পাস করার অনুমতি দেয়নি। মাঝে মধ্যে খারাপও লাগে। উজান অত ভাল ছেলে ছিল না। সে শহরে চলে গেল। জীবনে দাঁড়িয়ে গেল। সমর বলল, “জানো সেদিন উজান ফোন করেছিলো।”
“হুঁ।ওর বউ অনেক কিছু পোষ্ট করে। তা কি বলছে তোমার বন্ধু?”
“ওরা গ্রামে আসবে। ওর বউয়ের ইচ্ছে।”
“বারণ করো আসতে।”
“শুনবে না।”
“তাহলে বলতে হবে ভালো পয়সা করেছে। ওদের কাজ না করলেও চলে যাবে। ফালতু ওদের কথা বাদ দাও।” বলল সবিতা।
“সেতো ঠিক কথা। আমাদেরটা আমাদেরকেই ভাবতে হবে।”
“দেখো কি করবে? আমি বললেই তো তুমি শুনবে না।” সবিতার গলায় অভিমান।
সবিতার কাছে গেল সমর। “রাগ করছো কেন?”
সমরের চোখের চোখ রাখল সবিতা। “আমাদের স্বপ্ন নেই? আমাদের বাঁচার ইচ্ছে করে না? এতো চেপে বাঁচা যায়?” চোখের কোনটা ভারি হয়ে গেল সবিতার। চোখ মুছিয়ে দিল সমর।
“দাঁড়াও দেখছি।” বলে সবিতার কপালে চুমু দিল সমর।
“কী দেখবে শুনি?”
“বর্ধমানে চলে যাবো। চাকরিতে এখনও রিজাইন দিইনি। এক বার দরখাস্ত করবো। ওখানে গেলে তুমিও আবার রেলের জন্য খাটতে পারবে। দু’জনের একজনের কিছু একটা ব্যবস্থা হলে আমাদের আর চিন্তা থাকবে না। দেখি বাবাকে আজ বলবো। সপ্তাহে সপ্তাহে আসবো। লোকজন তো সবাই এখানে রয়েছে সমস্যা হবে না। উজানও চলে আসছে। আসলে বাবা চায় ছেলে বাড়িতে থাকুক।”
“তোমার ছেলের কথাটাও তোমাকে ভাবতে হবে। গ্রামের স্কুলের যা অবস্থা তাতে কেউ এখানে পড়ছে না।” বলল সবিতা।
“আজ বাড়ি ফিরেই বাবার সঙ্গে কথা বলবো।”
সমর বেড়িয়ে গেল। দরজা খোলাই রইল। সবিতা রান্নাঘরে ফিরে গেল। অনেকক্ষণ পরে সমরের বাবা দরজা বন্ধ করল।
গ.
অফিসের লাঞ্চ ব্রেকে নিশাকে ফোন করল উজান। নিশা অফিসে নেই। অন্য ব্রাঞ্চে গেছে। ফোনে উত্তর এলো, “তুমি খেয়ে নাও। আমার ফিরতে দেরি হবে।” উজানের আজ খুব ইচ্ছে ছিল এক সঙ্গে খাবে। দিদি বানিয়ে দিয়েছে ভাত ডাল আর আলু পাস্ত। খেতে ভাল লাগল না। চা অর্ডার করল উজান। হঠাৎ সুনন্দর কথা মনে পড়ে গেল। একই কলেজে পড়ত। এখন গুয়াহাটিতে পোস্টিং। ফোন করল উজান। “কেমন আছিস ভাই?”
“আরে বন্ধু অনেকদিন পর। এই চলছে। তোমার কি খবর?” ফোনের উপরে সুনন্দ জানতে চাইল।
“দেশের বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। আর ভাল লাগছে না। নিশাও তাই চায়। এই জাস্ট বসকে ফাইনালি জানিয়ে দিলাম।” বলল উজান।
“গ্রামে কি পাখির ছবি তুলবি?” হালকা রসিকতার পরে সুনন্দ গম্ভীরভাবে প্রশ্ন করল, “বস কি বলল?”
“বস বলছে অ্যাস ইউ উইশ। আমার বস খুব ভাল।বলল, যদি ফিরে আসো, কোম্পানিতে এস। আমার জন্য কোম্পানি অলটাইম ওপেন।”
“বস জানে তোমার মত লোক পাবে না। যা দেশের বাড়ি।ভালো করে থাকতে পারবি। অ্যাটলিস্ট প্রেসার থেকে বাঁচবি।” উজানকে বোঝার চেষ্টা করল।
“তুই কি করবি?” কিছু না ভেবেই প্রশ্নটা করল উজান।
“আমি আর কি করবো বল? তোদের দেশের বাড়ি আছে, তোরা ফিরে যাবি। আমি মধ্য কলকাতার ছেলে। আজ আসামে আছি। সামনের মাসে সিডনি যাচ্ছি।”
“ফিরবি না?” জানতে চায় উজান।
“কোথায় ফিরবো? সব এক। ফেরার কোনো জায়গা নেই ভাই।” বলল সুনন্দ।
“কতদিন দেখা হয়নি। একদিন আসিস। গল্প হবে।”
“মিস্টার উজান, আমাদের এখন কারো কোনো ঠিকানা নেই। আমরা সবাই ছুটছি। যখন থেমে যাবো, তখন আবার দেখা হবে।”
ফোনটা কেটে গেল। দ্বিতীয়বার আর চেষ্টা করল না উজান। বাইরের আকাশে পাখিরা দল বেঁধে বাসায় ফিরছে। ফোনের ক্যামেরায় ছবি তোলার চেষ্টা করল। উজান। ঝাপসা এল।
🍁কবিতা
আবদুস সালাম
কোলাহল
ইতিহাসের সব আয়োজন ডুবে যায় অন্ধকারে
শতাব্দীর দুয়ারে কড়া নাড়ছে মহাকাল
সভ্যতার ফসিলে খুঁজে পাই ইতিহাসের ঠিকানা
বৈষয়িক বিকেলে পড়ে আছে রাজধানীর ছিন্ন বীণা
দাউ দাউ করে জ্বলছে বিদ্বেষের আগুন
পুড়ে যাচ্ছে গণতন্ত্রের ঘর বাড়ি
বিচ্ছিন্নতাবাদী রোদ ঝলসে দেয় সম্প্রীতির উঠোন
শকুনেরা পাহারা দেয় বিশ্বাসের পাড়া
মৃত বিবেক কৌশলী মগ্নতায় ডুগডুগী বাজায়
ভুলে যায় প্রতিবাদের ভাষা
সহানুভূতির দরজায় কার পায়ের ছাপ কে জানে
মনুষ্য চামড়া দিয়ে সাজায় উৎসবের বাড়ি
আকাঙ্খারা গান শোনায় বাঁকা চাঁদের
সর্বনাশী জ্বরে পুড়ে যায় সম্প্রীতির উঠোন
ঘরে ঘরে বাজে ধর্ষিতার গান
মৃত বিবেক ভুলে গেছে বেঁচে থাকার মানে
পাড়ার মোড়ে মোড়ে জেগে আছে কোলাহল
কণিকা বিশ্বাস
অনুভব
সূর্যাস্তের ডানায় নেমে আসে পিয়াল শাখার আঁধার।
পুকুর ধারে কলমীলতা কুঁচবরণা-
মাটির পিদিমের টিমটিমে আলোয়
ঘোমটা মায়ের তুলসীতলা রক্তিম আভা।
ওই দূরে ঝোঁপে ঝাড়ে
জোনাকীর ঝাঁক এলোমেলো-
উত্তর আকাশে স্থির নক্ষত্র
ধ্রুব সত্য ছিল দু’জনের তারার মতো।
এক আশ্চর্য প্রদীপ-জ্বলে উঠেছিল
দু’টো হৃদ স্পন্দনে।
ফটিক চৌধুরী
সাফল্যের ঘ্রাণ
অনেক ব্যর্থতার সিঁড়ি
ভাঙতে
ভাঙতে
যে সাফল্য
তার মূল্য তো অপরিসীম।
তাতে যে ক্লেদ জমা হয়
তা আসলে সাফল্যের ঘ্রাণ।
ইভা আলমাস
অপ্রেমিক তুমি আমার
ঢেউ এর পরে ঢেউ আসে
আছড়ে পড়ে সাগরের বেলাভূমে
ভেঙে চুরচুর হয় তীরের হৃদয়
তা দেখার সময় কই উদভ্রান্ত ঢেউয়ের!
সে শুধু জানে তীর ভাঙতে।
তুমিও প্রেমিক,
উহু অপ্রেমিক তুমি আমার
স্রোতের অনুকূলে ভেসে বেড়াও শুধু,
কাঁটার ভয়ে গোলাপ ছুঁতে চাও না
কখনো নির্বাক চোখে চোখ রেখে
কাঁধ ছুঁয়ে বলতে পারলে না ‘ভালবাসি’,
অথচ প্রেমিক মাত্রই প্রতিকূলতার প্রতীক।
নশ্বর জীবনে আর কত অপেক্ষা করবো কতটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হবে
কতটাই বা উদগত তৃষ্ণার গলা চেপে ধরবো
শুধু তোমাকে চেয়ে, তোমাকে ভালবেসে?
খড়কুটোর মতোই অসাধারণ জীবন আমার
পিছুটান নেই, প্রেম নেই, ভালবাসা নেই,
আছে শুধু একবুক তৃষ্ণা
তোমাকে কাছে পাবার
তোমাকে ছুঁয়ে দেবার…
শহীদুল ইসলাম জিতু
পূর্ণচ্ছেদ
তোমাকে খুঁড়ে আমি পৃথিবী পাই
পাই, ঘর-দুয়ার থালা-বাটি
সংসার-গল্প
অতঃপর আগুন
পুড়ে ভস্ম হই, হই ছাই
আলো নি়ভে এলে
তুমি হাওয়ায় মেলে ধরো মাটির শরীর
অক্ষরমালা দিয়ে গাঁথো উলুধ্বনি
গভীরে বাজো
মৃত্যুর মত একা হয়ে।
চোখ দু’টোতে চৈত্রের-খরা
বহুকাল বৃষ্টি হয় না
তবুও তুমি মেঘ আনো;
তৎক্ষনাৎ বেদনারা প্রত্যবিভাদনে মত্ত হয়
তোমাকে খুঁড়লে
আমি আগুনের মাঝে গোলাপ পাই
পাই রাতের হৃদয়।
নির্বেদে যাক; সব
উড়ে আসুক,
জীবন্ত ক্ষত
তবুও
অন্ধকার পাশে দাঁড়ালে
তুমি হও আলো
তোমাকে খুঁড়ে আমি জীবন পাই
পাই পূর্ণচ্ছেদ
তোমাতেই শুরু আমার
তোমাতেই শেষ।
রাজ কুমার সরকার
জীবন
অদ্ভুত মানব জীবন
জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি
অনেক কিছুই দেখায়; শেখায় আমাদের
বিশ্ব ইতিহাস খুলে দেখলে দেখতে পাবেন খুব শান্তিতে কেউ কাটাতে পারেননি। পুরুষই বলুন বা নারী…
ঝড় এসেছে। থেমে গেছে। কখনও আবার থামেনি।
সুখ উঁকি মেরে গেছে কিন্তু সুখ দেয়নি। তা দিলেও শান্তি উধাও।
শান্তি বরাবর ছটফটে গোছের… আশা-নিরাশা, ভালো-মন্দ পাশাপাশিই খেলা করে গেছে। প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি দুটোই জীবন-জুড়ে।
মোদ্দা কথা – যে কোনো পরিস্থিতি সামলে নেওয়ার নামই – জীবন।
মমতা রায়চৌধুরী
লজ্জা
এখনো যদি বিবেক খানি
ঘুমিয়ে থাকে অন্তরে
তাহলে বোধহয় মানুষ হলাম না
বেআব্রু দেখে নারীকে।
মাংস খেকো রাক্ষসেরা
লুটেছে নারীর সর্বস্ব
মরেও তার শান্তি নেই
নখের আঁচড় সর্বত্র।
এখনো যদি বিবেক খানি
ঘুমিয়ে থাকে অন্তরে
তাহলে বোধহয় মানুষ হলাম না
অমানুষের দলে পড়ে।
আঠারো থেকে কুড়িটি পুরুষ উল্লাস করে
একটি নারীর যোনিকে ঘিরে
উচ্ছ্বাস তার থেমেছে যখন
সেই মেয়েটি গেছে চিরতরে থেমে।
প্রাণখানি তার আকুলি বিকুলি
করছিল কেমন বাঁচার তরে
সহকর্মীবন্ধু ধরল সযত্নে হাত দু’টি যে
মৃত্যু পথযাত্রী নারীটি তখন
চোখের ইশারায় বুঝাতে চাইছিল
তুমিও নারী আমিও নারী
আমারও যে বাঁচতে ইচ্ছে করে
আমারও যে ইচ্ছে করে
এ পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ নিয়ে
হাজারটা পথ ভালবাসার
মানুষের সাথে চলতে।
কাতর আকুতি সত্বেও
মেয়েটিও মেতেছিল যে
নরখেকো রাক্ষস পুরুষের সাথে
কি সুখের জন্য আদিম উচ্ছ্বাসে
মেতেছিল তারা আমরা জানি না তা
বুঝি শুধু এভাবে নারী
যদি হয় লাঞ্ছিতা নির্যাতিতা
তবে প্রতিবাদের আগুনে পুড়ে
ছারখার হয়ে যাক রাক্ষসরেরা।
এখনো যদি বিবেকখানি
ঘুমিয়ে থাকে অন্তরে
তবে কেন শিল্পী আমরা
কেনই বা লেখালেখি
কেনই বা আঁকাআঁকি।
আমরা সকলে প্রতিবাদে লড়ি
হাতে হাত রেখে নতুন সমাজ গড়ি।
🍁ধারাবাহিক উপন্যাস /পর্ব : ১৩
সন্ধ্যের মুখে যখন ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ, ডাক্তারের রুটিন চেকআপের সময় ডাক্তারের সঙ্গে এসেছিল ঊর্মি। ডাক্তার পাশের কেবিনে রুগী দেখছেন। এখানে তাকে দেখতে তেমন কেউ আসার নেই, তাই মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিলেন। একটু কি তন্দ্রাচ্ছন্নও ছিলেন ঘুমের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়! তন্দ্রা ভেঙেছিল নার্সের ডাকে, ‘এই যে! ঘুরে শুন। ডাক্তারবাবু রাউন্ডে এসেছেন। কি কষ্ট হচ্ছে এখন আপনার’? সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অনেকটা গল্পের মতো’ -এর আজকে ত্রয়োদশপর্ব।
অনেকটা গল্পের মতো
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
‘এসেছিলে,তবু আসো নাই,
জানায়ে গেলে,
সমুখের পথ দিয়ে
পলাতকা ছায়া ফেলে…
তোমার সে উদাসীনতা
সত্য কিনা জানি না সে,
চঞ্চল চরণ গেল ভাসে ভাসে
বেদনা মেলে।
এসেছিলে, তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে’…
এ তো আর আজকের কথা নয়। চল্লিশ বেয়াল্লিশ বছর আগের কথা। অমৃত তার নতুন সংসারে, না, এখন আর নিজের সংসার বলে কিছু দাবী করেন না অমৃত। ছেলের সংসারে এসে ওঠা ইস্তক ঘরের বাইরের হাতায় চেয়ারেই অনেকটা সময় কাটিয়ে দেন। তিনি নিজেও জানেন, এই সংসারে তার অস্তিত্বের মূল্য কতটুকু! সময়ে যাদের সময় দেননি, তারা যে আজ তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় নি, ‘এই অনেক’ ভেবেই নিজেকে আসবাবের মতোই সংসারে এসে ঘরের এক জায়গায় ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। বয়স হয়েছে ভেবে ছেলে, ছেলের বৌ এবং প্রতিমা রাজী হয়েছে বলেই আবার ফিরে আসতে পেরেছেন। শুধুই কি বয়স হয়েছে বলেই অমৃতকে সবাই মেনে নিয়েছে? প্রশ্নটা এই এক দেড়মাসে অনেকবার অনেকভাবে তাকে মনে করতে বাধ্য করেছে।
সারাদিনে প্রচুর সময়। সন্ধ্যেয় একটা দুটো সিরিয়াল বসে দ্যাখেন, যেগুলো একসময় ঊর্মির সঙ্গে বসে দেখতেন। এই সময়টুকুই সারাদিনে ঊর্মিকে একটু হলেও মনে করার সুযোগ করে দেয়। সময় কাটতেই চায় না। তাই ঐ বাড়ির হাতায় চেয়ারে বসে সারাদিন গরুর মতো জাবর কাটেন তার ফেলে আসা বেয়াল্লিশ বছরের স্মৃতির।
অমৃতর বয়স হয়েছে বলেই হয়তো নির্লজ্জের মতো সবকিছুর কাটাছেঁড়া করে দেখতে চান। সাধে কি এরাও তাকে এককথায় মেনে নিয়েছে? মৃতা ঊর্মির পেনশনভোগী স্বামী হিসেবে তারও একটা অর্থনৈতিক গুরুত্ব পেয়েছে ওদের কাছে। ছেলে প্রীতম তো তেমন কিছুই করে না। যা করে তার আয়ে বৌ, বাচ্চা মা নিয়ে সংসার খুঁড়িয়ে চলা তো দুর অস্ত, বসে যাবার সামিল। তাই হয়ত ছেলের বউও কিছুটা বহির্মুখী। অমৃত এটা বোঝেন, পুরুষ মানুষের সংসারে পয়সা না দিতে পারলে, সাংসারিক রাশ টানার ক্ষেত্রে অনেক শৈথিল্য এসে যায়। আনতে বাধ্য হয়।
‘কর্তৃত্ব’ শব্দটা পুরুষের ক্ষেত্রে অর্থের যোগানের সঙ্গে সমানুপাতিক। তাই প্রীতমকে অন্ততঃপক্ষে এই শেষ জীবনে এসেও বাবার কর্তব্যকে মাথায় রেখে কিছুটা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য দিয়েছেন অমৃত। শেষ বয়সে পয়সার বিনিময়ে একটা সংসার কিনেছেন। হোক না কেন ঝুটো সংসার, ঝুটো গয়নাও তো সর্বসমক্ষে, অনুষ্ঠানবাড়িতে মেয়ে-বউরা পড়ে যায়, যাদের সত্যিকারের সোনার গহনা থাকে না বা আজকালকার দিনে বিপদের কথা মাথায় রেখেও তো অনেকেই হাত, কান গলা নিরাভরণ থাকার চেয়ে তো তবুও সুশোভন।
প্রায় আশিতে পা দেওয়া অমৃত এখন তার চিন্তা ভাবনায় ঠিক খেই ধরে রাখতে পারেন না। এক ভাবনা থেকে অন্যভাবনায় চলে যান বড়ো অনায়াসে।
সেই সাতের দশকে এমন ব্যাঙের ছাতার মতো নার্সিংহোম অলিতে গলিতে তৈরি হয়নি। কোচবিহারে তখন হাসপাতালই ভরসা। চিলাপাতা ফরেস্টে কাজ করতে গিয়ে কীভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন অমৃত। তার ব্যবসার কাজে তার সঙ্গে জড়িত লোকেরা চেয়েছিল অমৃতকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে। কিন্তু অমৃত তার এই জ্বর এবং একইসঙ্গে পেটের সমস্যাকে তেমন গুরুত্ব দিতে চাননি। কারণ, তার কাছে ব্যবসাই তখন বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল। টেন্ডার হাতছাড়া হবার চিন্তায় তিনি থেকে গিয়েছিলেন কোচবিহারে। ঈশ্বরের পরিকল্পনায় কী ছিল তা যদি তিনি বুঝতেন! যদিও বুঝেও কোনও লাভ হত কী? ক্রমশঃ জ্বর এবং অস্বাভাবিক পেট ব্যথা নিয়ে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল কোচবিহারের সরকারী এম. জে. এন হাসপাতালে। টাকা পয়সা থাকায় পেয়িং বেড, কেবিন, দু’বেলার আয়া কোনও কিছুই অভাব হয়নি। অর্থ অনেক কিছুতে সরল গতি আনে, এ আর নতুন কথা কি! কিছু কথা, কিছু সময় মানুষের জীবনে এমনভাবে দাগ কেটে যায়, যেন পাথরে খোদাই!
বেশ ক’য়েকদিন যমে মানুষে টানাটানির পর অমৃত জিতে নিয়েছিলেন জীবন। এভাবেই তার আচ্ছন্ন অবস্থা কাটার পর আলাপ হয়েছিল স্টাফ নার্স ঊর্মির সঙ্গে।
সন্ধ্যের মুখে যখন ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ, ডাক্তারের রুটিন চেকআপের সময় ডাক্তারের সঙ্গে এসেছিল ঊর্মি। ডাক্তার পাশের কেবিনে রুগী দেখছেন। এখানে তাকে দেখতে তেমন কেউ আসার নেই, তাই মুখ ঘুরিয়ে শুয়েছিলেন। একটু কি তন্দ্রাচ্ছন্নও ছিলেন ঘুমের ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়! তন্দ্রা ভেঙেছিল নার্সের ডাকে, ‘এই যে! ঘুরে শুন। ডাক্তারবাবু রাউন্ডে এসেছেন। কি কষ্ট হচ্ছে এখন আপনার’? একসঙ্গে প্রায় রুটিন কথাগুলো বলে থেমেছিল ঊর্মি। তার হাতের পেশেন্ট রিপোর্টগুলো চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। আর প্রথমবার এমন সুন্দর কাটাকাটা চোখ-মুখের, স্বাভাবিক মেয়েদের তুলনায় বেশি উচ্চতার নার্স ঊর্মিকে দেখে একটু বোধহয় হারিয়ে গেছিলেন অমৃত। ঊর্মি আবার প্রশ্ন করেছিল, ‘কি হোলো! কি কষ্ট এখন আপনার’? অমৃত মজা করার সুযোগ ছাড়তে না পেরে বলেছিলেন, ‘কষ্ট তো ছিল, কিন্তু কোথায় যে আপনাকে দেখে লুকোলো, খুঁজে পাচ্ছি না’। ঊর্মি কঠিন হতে গিয়েও হতে পারেননি সেদিন। এইজন্যই বোধহয় বলে, ‘পহেলে দর্শনধারী, পিছে কূলবিচারী’। ছয় ফিট হাইটের সুদর্শন অমৃতকে কঠিন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি, উপরন্তু হেসে বলেছিল, ‘তাই-ই! তাহলে ডাক্তারবাবুকে তাই বলবেন, কিন্তু আমার যে রিপোর্ট লেখা মুশকিল হয়ে গেল’। তারপরই স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের বর্মটা পড়ে নিয়েছিল ঊর্মি।
বলেছিল, ‘দু’দিন আগে তো মরতে বসেছিলেন। এতো রস এখনও বলুন, কোথায় অসুবিধা হচ্ছে?’ মানুষ চরিয়ে খাওয়া অমৃত বুঝেছিলেন, ‘এ তো রাগ নয়, এ যে অভিমান। ঐ মুখে যে মুখোশটি পড়া। সেটা মোটেই লোহার নয়। একেবারেই শোলার বা কাগজের। তাই একঘেয়ে রোগ যন্ত্রণাময় সময়কে উপেক্ষা করতেই বলেছিলেন, ‘একটা কথা বলবো’? বলেই অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলেছিলেন, ‘আপনার মুখে রাগটা ঠিক আসে না বুঝলেন! এটা বোধহয় আগে আপনাকে কেউ বলেনি’।
ঊর্মি রাগতে গিয়েও হেসে উঠেছিলেন আর সেই মুহূর্তেই মূর্তিমান অশান্তির মত ভিজিটিং ডাক্তার এসে ঢুকেছিলেন, কি হোলো সিস্টার! পেশেন্ট কি বলছে? কেমন আছে? দেখি ওনার কাগজপত্র’। ঊর্মি হাসতে হাসতেই বলেছিল, ‘স্যার! পেশেন্ট তো অনেক কিছুই বলছে। বলছে খাবার পর আর খিদে পায় না, ঘুম থেকে ওঠার পর আর ঘুম হতেই চায় না’। ডাক্তার কি বুঝেছিলেন কে জানে, শুধু একবার চোখ সরু করে ঊর্মির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘দ্যাটস গুড! পেশেন্ট সিস্টার রিলেশান শুড বী লাইক দিস। রোগ আপনিই পালিয়ে যাবে’। তারপর রুটিন চেকআপ করে বেরিয়ে গেছিলেন। ঊর্মিও বেরিয়ে গেছিল সেদিনের মতো। অনেকদিন পর যন্ত্রণাক্লিষ্ট শরীরেও ঘুরে শুয়ে গুনগুন করে গেয়ে উঠেছিলেন অমৃত তার প্রিয় রবিঠাকুরের গান :
‘এসেছিলে, তবু আসো নাই, জানায়ে গেলে, এসেছিলে…
সমুখের পথ দিয়ে
পলাতকা ছায়া ফেলে…
তোমার সে উদাসীনতা
সত্য কিনা জানি না সে,
চঞ্চল চরণ গেল ভাসে ভাসে
বেদনা মেলে’… 🦋 (ক্রমশঃ)
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব, সুহিতা সরকার ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
