



সম্পাদকীয়
চতুর্দিকের বিক্ষিপ্ত ঘটনার পরে বাংলার জীববৈচিত্রের পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে মনে হয়। অঞ্চল বিছিয়ে বসে বাংলার মা। আমাদের আধুনিক রূপকথা গল্প আজ থেকে ১০০ বছর পর যারা পড়বে তারা আতঙ্কে বিস্মিত হবে। কারণ হবে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকা বিক্রিত বুদ্ধিজীবীগণ। আর কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় কিছু উঠতি বুদ্ধিজীবী। তারা নিজেদের মহান বলেই উল্লেখ করতে বাঁধেন না। নিজের নাম নিজেই ফোঁটান। আর কোমর ধরে নাচতে উঠেন মঞ্চে। আমাদের আধুনিক রুপকথায় মানিয়েছেও তাদের। এগুলোই লিখবেন বলবেন তবে সব স্বভাব-সুলভ শান্ত দিন আসবে তারপর। দেখা যাবে কালো ফিতে বেঁধে বছর যাপন হচ্ছে। তখন হাস্যময় এবং রহস্যময় মনে হবে। বছর বছর বাদ উৎপাদন হবে মিথ্যের গাড়ি বাহক অক্ষরগুলো। আর আজ বিশ্বের অক্ষর শিল্পীরা যারা শব্দ ক্ষয় করছেন তাঁদের কোনও সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এর মাঝেই উত্তম ও অধম পাওয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত যতদিন পর্যন্ত এই সময় কালের মানুষ জীবিত থাকবে।
বেশ কিছু লেখক কবিদের কবিতা লিমেরিক গদ্যে ইতি মধ্যেই প্রতিবাদ দেশের প্রতি প্রেম অনুভব করতে পেরেছি। এটাও ভাল দিক। আগামীর সৈনিক হয়ে যারা শব্দ ক্ষয় বাঁচিয়ে দিতে চান অন্তত একবারের জন্যও প্রকাশ করুন এই নির্মম বিক্রিত পরিহাসের কথা। 🍁
🦋কবিতা /১
অরুণ কুমার চক্রবর্তী
নৈশব্দের কবিতা
কলঙ্কিত তর্জনী
আমাদের স্বপ্নেরা
সোনালী রুপোলী চারুকারু মাছ
সুদৃশ্য এ্যাকোয়ারিয়াম থেকে
ঘোলা জলে ছিটকে পড়েছে,
ঘোলা চোখে, ঘোলাটে হৃদয়ে ঘুলিয়ে-ওঠা মস্তিস্কের প্রসিদ্ধ প্রন্তরে নক্ষত্র নামে না আর,
চাঁদেরও হম্ভীতম্ভী শেষ,
বনলতা সেন আজ মৃত, যারা আজও একটুআধটু ভাবেটাবে, প্রেম চায়, তাদের বলিষ্ঠ তর্জনী
এ-ওর-দিকে তাক করে আছে, অথচ জানে না
মধ্যমা-অনামিকা-কনিষ্ঠরা তাকেই লক্ষ্য করছে, অসহায় বৃদ্ধ আঙুল উর্দ্ধে-বামে- ডানে ঘুরে, ঘি তোলার নামে, কখন যে বেঁকে যায় নিজেই জানে না,
আর বেচারা তর্জনী, প্রথমে
একটু বেগনে, তারপর কালোকলঙ্ক ছড়াতে ছড়াতে,
সারাটা গাঁ-গঞ্জ, শহর, হাটমাঠঘাট মাড়িয়ে আরও অনেক পবিত্র তর্জনীর খোঁজ করতে থাকে,…
কৃষ্ণা বসু
মেয়ে মানুষের লাশ
সাঁকোর কিনারে এসে আটকে আছে লাশ,
মেয়ে মানুষের লাশ;
আটকে আছে, বেরুতে পারছে না।
তার মুখ ফেরানো রয়েছে সন্তানের দিকে,
তার মুখ ফেরানো রয়েছে সংসারের দিকে,
তার মুখ ফেরানো রয়েছে পুরুষের দিকে,
প্রহারে প্রহারে তাকে পর্যুদস্ত করে গেছে যে পুরুষ
তার মুখ ফেরানো রয়েছে তার দিকে
বোকা, অভিমানী, আদর-কাঙালী মুখ
ফেরানো রয়েছে আছো জীবনের দিকে।
সাঁকোর কিনারে এসে আটকে আছে লাশ,
মেয়ে মানুষের লাশ,
আটকে আছে, বেরুতে পারছে না।
রেহানা বীথি
শুধু ভেতরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠুক
এই যে বসে আছি
কেউ এসে বলল না, কে তুমি?
পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময়
উৎসুক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল না কেউ-ই
যেন সবাই আমাকে চেনে
সবাই আমার নামও জানে
জানে, কোথা থেকেই বা এসেছি!
আমার বেশ লাগল
প্রশ্ন এবং উত্তরহীন এই বসে থাকা
যেন এক ডুব
কিন্তু এই বৃক্ষটি
যে বৃক্ষের বুক খোলা শেকড়ের ওপর
নিঃস্ব ঊরু পেতে বসে আছি
সেই বৃক্ষটি থেকে ভেসে আসছে
কিছু শব্দের আয়োজন
আমি কান দিচ্ছি না
ইদানিং কথা বলতে ভালো লাগে না
কেউ বলতে চাইলেও
কান পেতে দিই অন্ধকারে
মনে মনে বলি-
থেমে যাক সকল শব্দকল
বন্ধ হোক হাওয়ার নিঃশ্বাসটুকুও
শুধু ভেতরাত্মা কেঁপে কেঁপে উঠুক
শুধু জানান দিক-
কেউ একজন সংহার করেছে এ-প্রাণ
অমিতাভ সেনগুপ্ত
ঈশ্বরীর পদাবলী ও তিস্তার জল
তিস্তার জলে শুনি দূরাগত ধামসা মাদল,
প্রাচীন ছন্দে দুলে ওঠে শরীর মন
টুসু ও তিস্তার অনবদ্য জল।
পদাবলী গায় যদি তিস্তার জল
শুনি দূরাগত ধামসা মাদল,
কটাক্ষ ও গ্রীবায় দুলে ওঠে
মৃদু দুই টুসু ও ঝুমুর,
অজস্র রুপোর মতো ছড়িয়ে পড়ে
তীব্র দ্বিপ্রহর
যেন বিস্তৃত জলে ভাসে প্রখর চাঁদ
অবহেলায় তার তীব্র ছলাৎ,
নিমীলিত ওষ্ঠে লেগে থাকে কার
আলুলায়িত জল
শঙ্খ মিত্র
নিয়ম
এই সময় শুধু জানে নিয়মের ব্যত্যয়
না-শব্দের দৌরাত্ম্যে অদ্ভুত কলরোল
আজকাল হিসেব বহির্ভূত রোদ আসে বিছানায়
এই অনাহূত দাগটুকু সম্বল
সবকিছু তো অতিক্রম করা যায় না
পিষ্ট হতে হয়, পুনর্জন্ম হয়
তারপর আবার, বিবর্তনের সূত্র মেনে
এগিয়ে চলে হলুদ শুঁয়োপোকা
🦋গল্প/১
ধীরপায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। মৃদু ঢেউয়ের শান্ত-নদী রাতের মতো ঢিলেঢালা শব্দে বয়ে চলেছে। নদীর দু’কূল জুড়ে রাজহংসের পালকের মতো ধবধবে সাদা কাশফুল হালকা হাওয়ায় তিরতির করে দুলছে। আকাশ থেকে রূপালীধারায় চন্দ্রকিরণ ঝর ঝরিয়ে ঝরে পড়ছে, ফকফকে জ্যোৎস্না স্রোতে ভেসে চলেছে বিশ্বচরাচর, জগৎসংসার। গালকাটা আব্দুল মতিন উদাস হয়ে উঠে। জাকিয়া শিমু-এর গল্প ‘ফেরিওয়ালা’
ফেরিওয়ালা
জাকিয়া শিমু
আশ্বিন মাসের পড়ন্তবেলায় ঢাকা-মাওয়াগামী লক্কড় ঝক্কর ‘ইছামতী’ নামধারী বাস- নিমতলা বাসঘাটে এসে খানিকক্ষণের বিরতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। গালকাটা আব্দুল মতিন কাঁধেরঝোলা ডানহাতে শক্তভাবে চেপে অন্যহাতে বাক্সপেটারা নিয়ে ধীরপায়ে বাস থেকে নেমে আসে।
ঢাকার অদূরের-স্থান হলেও এখানকার বায়ু শহরের মতো ধুঁয়া-ধূলোয় মাখামাখি নয়, বেশ হালকা- গায়ে লাগতে তার বেশ আরামবোধ হল। শীতলবায়ু নীরবে বইছে, শীত আগমনের পূর্বাভাস। বুকপকেটে কুঁচকানো কাগজটায় আরও একবার চোখ রাখল,গালকাটা আব্দুল মতিন। নীল বলপয়েন্টে অভিজ্ঞ ডা.প্রেসক্রিপশনের আদলে দুর্ভেদ্য-হস্তাক্ষরে ঠিকানা লেখা! সে কাগজের ভাঁজ খোলে সামনের দিকে ঝুকে, চোখ-কপালে যৎসামান্য ভাঁজ ফেলে মনোযোগে পড়ে ঠিকানা উদ্ধারে চেষ্টা চালায়।
বাসঘাট থেকে মাইল দু’য়েক উত্তর দিকে এগুতে পথ তিনভাগে ভাগ হয়ে সাপেরদেহের মতো একেবেঁকে সবুজ মাঠের ভিতর দিয়ে অজানায় গিয়ে ঠেকেছে। হাতের ডান-বাঁ’য়ের পথ রেখে নাক বরাবর আরও মাইলখানেক হেঁটে নজরে পড়বে- প্রাচীন-বয়োঃবৃদ্ধ এক বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালে সমুখে দেখা মিলবে- বহুপুরনো প্রাচীর ক্ষয়ে পড়া আধভাঙা-মাথার অতীতকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক-মঠ। মঠ দাঁড়িয়ে আছে সেকেলের এক মজা-দিঘিরপাড় ঘেঁষে।
গালকাটা আব্দুল মতিন এ-পর্যায়ে এসে দমফুরিয়ে যাওয়া নিঃশ্বাস ফিরে পেতে আকাশের দিকে তাকিয়ে যতদূর দম থাকে বড়ো করে নিঃশ্বাস টানে। খানিকটা হলেও যেন দম ফিরে পায়। এরপর আবার কাগজে চোখ বুলায়- দিঘিরপাড়ের উত্তরকোনার বাড়িটিই তার গন্তব্য। গালকাটা আব্দুল মতিনের কাছে গন্তব্যের-ঠিকানা’ অনেকটা স্কুলের শেষবর্ষের পাটিগণিতের মতো অযথা জটিল কিছু মনে হল! যেন ঠিকানা উদ্ধারে মস্তিষ্কের খোঁদলের নিউরনগুলো কেমন জীবন্ত নড়েচড়ে উঠল! কপালে দুধের সরের মতো কুঁচকানো ভাবটা কাটল তো না-ই, আরও একপ্রস্ত যেন বেড়ে গেল। তারপরও গন্তব্যের সুরাহা করা গেল না। তার প্যান্টের পকেটে যোগাযোগের অমূল্য মাধ্যম একটা ফোন রয়েছে কিন্তু ফোনটা বিশেষ কারণে বন্ধ করে রাখা আছে। সে আবার শুরু থেকে ভাঁজ-কাগজ পড়তে শুরু করল। একহাতে লেস ফিতার চৌকোণা ভারি কাচ-কাঠের বাক্স, অপর কাঁধে ঝুলানো গোপন জিনিসপাতিতে ঠাঁসা সাদাকাপড়ের ঝোলাটা বড্ড যন্ত্রণা ধরিয়ে দেয়। মনে হয় যেন কেউ তার দু’বাহু ধরে বানরের মতো ঝুলে আছে। সে বার-ক’য়েক দু’হাতের জিনিস অদলবদল করে, তারপরও স্বস্তি মেলে না। গালকাটা আব্দুল মতিনের পেটে ভোকও লেগেছে। সকাল সকাল তার খাওরার অভ্যাস নাই। বাসঘাটের দু’পাশে নানানপদের দোকানপাট। খাবারের দোকান চোখে পড়তে ভোকেরমাত্রা চৈত্রমাসের রোদের মতো যেন তেতিয়ে উঠে!
অজপাড়াগাঁ, সবেমাত্র পল্লী-বিদ্যুতের সুবিধা পেতে শুরু করেছে। পল্লীর প্রকৃতদশা এই পল্লী-বিদ্যুতে স্পষ্ট ধরা দিয়েছে। দিনেরবেলায় বিজলিবাতি কুপিবাতির আদলে নিভুনিভু জ্বললেও রাতে তারও খোঁজ পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। তারপরও সবার ভাগ্যে তা জুটে না। ‘মায়ের দোয়া’ ভাতের হোটেলের দুয়ারে দাঁড়িয়ে আধ-নেংটা এক ছোকরা, বিদ্যুৎ-ব্যবস্থার বাহাদুরি হাঁকিয়ে খদ্দের ডাকাডাকি করছে। যাদের দোকানে পল্লী-বিদ্যুতের নামকাওয়াস্তে ফ্যান-বাতি ঝুলছে তাদের বেচাবিক্রি একটু বেশিই বাড়তি মনে হল। আব্দুল মতিন হোটেলের নিকটে এসে হাতে-কাঁধে ভারি বোঝার ভারে কুঁজো হয়ে দাঁড়িয় পড়ে। ভারি বোচকার টানে শীতেরসকালে দূর্বাঘাসের ডগায় যেমন ফোঁটায় ফোঁটায় শিশির জমে থাকে তার আদলে সারা শরীরে ঘাম জমে উঠেছে। বৈদ্যুতিক পাখার হাওয়া যদি একটু কপালে জোটে সে-ভরসায় সে ‘মায়ের দোয়া’ নামের ভাতের হোটেলে ঢুকে পড়ে। হোটেলে ঢুকতে তার মনটা নেতিয়ে পড়া ফুলের মতো মিইয়ে যায়, অসহায় চোখে মাথার উপর ঝুলে থাকা অনড়-স্থির ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওদিকে হোটেলের দরজার সঙ্গে লাগোয়া খদ্দেরদের হাত ধোয়ার সুব্যবস্থা যদিও বা রয়েছে। বাধ্যগতের মতো হাত পরিষ্কার করতে আব্দুল মতিন এগিয়ে যেতে-দেয়ালজুড়া আয়নায় নিজের ছদ্মবেশী প্রতিবিম্ব দেখে সহসা কেমন আনমনা হয়ে উঠে!
ছিপছিপে গড়নের বারোমাস্যা অম্বলরোগী গালকাটা আব্দুল মতিনের পক্ষে ভারি বাক্সপেটারা নিয়ে হেঁটে এতখানি পথ পেরনো চাট্টিখানি কথা নয়। তাও সোজাসাপটা পথ হলে কথা ছিল। এবড়ো-থেবড়ো,ভাঙাচোরা, খানাখন্দকে- বন্ধুর মেটেপথ। সবে বর্ষাকাল গত হয়েছে। রাস্তার ফাঁকে ফাঁকে বর্ষাকালের জমাপানির গর্ত শুকিয়ে মাটি শক্ত পাথর হয়ে আছে। হাঁটতে গেলে খালি পায়ে আঘাত লাগে।
তারপরও পথের দু’ধারের দৃশ্যপটে চোখ রাখতে সমস্ত ধকল যেন পুষিয়ে নেওয়া গেল অনায়াসে। একপাশে নদী অন্যপাশটায় দিগন্তছুঁয়া খোলা মাঠ। মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে পটেআঁকা ছবির মতো বসত বাড়িঘর। পথের দু’ধারের ঢোলকলমির ঝোপ। ঝোপের ফাঁকফোঁকরে নানান পদের নাম অজানা গাছগাছড়া-বনফুলে ঠাঁসা। ঘন কালচে সবুজে কলমির এলানো ডালধরে বাঁদরঝোলা হয়ে ঝুলে আছে সতেজ সাদা-বেগুনি কলমির ফুল। ওদিকটায় চোখ পড়তে গালকাটা আব্দুল মতিনের মনটা প্রচ্ছন্নতায় ভরে উঠে। ঢোল কলমির শরীরজুরে সোনালি আঁকশিলতা জড়াজড়ি করে ধরে আছে মায়ের আঁচলে যেরূপে আটকে থাকে অবুঝসন্তান, সেরূপে। সেদৃশ্য দেখে মনে পড়ে যায় মৃত-মায়ের মুখখানা, তার শৈশবকাল- তাদের দখিনের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা কুলবরই গাছটার কথা। কণ্টকযুক্ত গাছটার শাখা-পাতায় জড়িয়ে থাকত গুচ্ছগুচ্ছ স্বর্ণলতা। স্বর্ণলতায় দেহ মুড়িয়ে বন্ধুরা দিনভর ছুটে বেড়াত মাঠে- ঘাটে, বনবাদারে কিংবা ঘাঘট নদীরপাড়ে। সেইসবের কিছুই আজ আর নেই- শৈশব, মা কিংবা কুলবরই গাছটা! নদীটাও মরে গেছে! শুধু ধূসর স্মৃতিরা মাথার খোলের ভিতরে নীরবে লুকিয়ে আছে। সময়ে- অসময়ে বেরিয়ে এসে মনোঃকষ্টের জোগান দেয়।
কোন কারণে, কে জানে! এতক্ষণের মাথায় বাজ-পড়া ধারণার সমস্যাটা তার মাথা থেকে সহসাই উড়ে চলে গেছে। যেন এমন পথে সারাজীবন হেঁটে পার করা যায়। শরীরে ঘাম ঝরছে, গন্তব্যের ঠিকানার সুরাহা হয় নাই তারপরও সে হেঁটে চলে সামনের দিকে। তাছাড়া গ্রামাঞ্চলে ফেরিওয়ালা রিকসায় চড়ে সদাইপাতি বিক্রি করে না। তাতে গাঁয়ের সহজসরল লোকও সন্দেহ করবে। হেলাল বেপারীর সঙ্গে সে নিজেবুদ্ধিতে এপথ বাতলেছে। গালকাটা আব্দুল মতিন কাঁচা কাজ করে না। কাজে বিন্দুমাত্র ফাঁক-ফোকর সে রাখে না। সে অতিমাত্রায় ধুরন্ধর এবং চতুর। তার অবয়বেও তা প্রকাশ পায়। দাড়িগোঁফে জঞ্জাল মুখখানায় গাম্ভীর্যের কঠিন আচ্ছাদন। লালচে কমলারঙের চোখজোড়ায় দৃষ্টিপড়লে রাজ্যের আতঙ্ক এসে ভর করে মনে। ঘনঘন কাজ সে করে না তবে যে কাজটা সে হাতে নেয় সেটা বেশ চতুরতার সঙ্গে এবং নাটকীয়ভাবে করে। নিজে ইচ্ছেমতো নাটক সাজিয়ে সুনিপুণ অভিনয় অবলীলায় করে যায়। এ-অবধি জাঁদরেল পুলিশ-দারোগাও তার কাজের হদিস খোঁজে পায়নি। হেলাল বেপারি বহু চেষ্টা তদবিরের পরে তাকে পেয়েছে। এসব কাজে নির্ভরতার অভাব হলে কঠিন ঝামেলায় পড়তে হয়। কাজেই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে পাকাদস্তুর ফেরিওয়ালা’র পাঠ করে যেতে হবে। চুক্তির অর্ধেক টাকা তার পকেটে জমা হয়ে আছে, বাকিটা কাজ শেষে পাওয়া যাবে। এতসবের পর হাত গুঁটিয়ে নেওয়া যায় না।
হেলাল বেপারির ক্রিয়াকলাপ বেশিজলের জলজপ্রাণীর মতো। তার খুব কাছের মানুষও তার গতিবিধি বুঝতে পারে না। সারাদিন ঘুরেফিরে, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে বেড়ায়। সে অবশ্য তার এহেন ভবঘুরে স্বভাবচরিতের দায়, বেশ গর্বভরে তার বংশের পূর্বপুরুষের ওপর চাপিয়ে দেয়। পূর্বপুরুষ এই ঘরনার ছিল বলেই তার চরিত্রে এইস্বভাব রয়ে গেছে। এটা দোষ কিংবা গুণ যাই হউক তা-সে নিজের নয়, বংশধারা থেকে এসেছে।
হেলাল বেপারীর যুক্তি অবশ্য একবাক্যে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার মতোও নয়। বংশপরম্পরায় এমন আমলও বেশ রয়ে গেছে। তার বড়দাদা, একদিন বলা নাই কওয়া নাই একতারা হাতে সেই যে গানের দলের সঙ্গে দেশ ছাড়লেন আর কখনও বাড়ি ফিরলেন না। বাকি জীবনে কেউ তার হদিস পেল না।
হালের ছোট চাচা, সেও একই কাজ করল। বয়স ষাট পেরিয়ে গেছে তা-ও বছর দুই হল। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে যাত্রাদলের সঙ্গে দেশের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি ঘুরে বেড়িয়েছেন। গান-বাজনা জীবনের ব্রত করেছেন। একটা সময়ে এদেশে যাত্রাপালার সুসময় ছিল। দাপটও ছিল। গাঁয়ে-গঞ্জে অহরহ যাত্রাপালা হত। ছোট চাচার গা-গতর অনেকটা প্রাচীন মিশর দেশের রাজাদের মতো ছিল। শরীরের গঠন সুপারিগাছের মতো লম্বা-পাতলা মেদশূন্য। চোখ-নাক খাড়াখাড়া। কবি কাজী নজরুলের ইসলামের মতো একগুচ্ছ ঝাঁকড়াচুল কাধ অবধি এসে ঝুলে আছে। গলারস্বরে গাম্ভীর্যের কমতি নেই। পুরোদস্তুর নায়কের প্রতিচ্ছবি। দুর্দান্তভাবে যাত্রাপালায় নায়কের পাঠ করে গেছেন যুগের পর যুগ। মাঝে-মধ্যে বছর ঘুরতে একবার বাড়ি এসে ঘুরে যেতেন বটে কিন্তু ঘরসংসার তাকে কখনও বাঁধতে পারেনি।
শেষমেশ গত প্রায় বছর-পাঁচেক হয় ছোট চাচা বাড়িতে পাকাপোক্তভাবে ফিরে এসেছেন। যাত্রাপালার সেই সুদিন আর নেই। এখন দেশেরমানুষ যাত্রাপালায় আকৃষ্ট হতে পারছে না। নানানপদের সস্তা বিনোদনের বিপরীতে যাত্রাপালার মতো ঐতিহ্যবাহী বিনোদন অতীত ইতিহাসের অংশ হয়ে ইতিহাসের বইয়ে জায়গা করে নিয়েছে। বলতে গেলে খুব দ্রুত প্রেক্ষাপট, পাল্টে গেল। ছোট চাচা আফসোস করে প্রায়ই একটা কথা বলেন- ‘নতুনপ্রজন্ম জানবেও না যাত্রাপালা’ নামক একপ্রকার বিনোদনে এককালে তার পূর্বপুরুষগণ আনন্দ-উৎসবে ডুবে ছিল’। তিনি কথা সত্য বলেছেন।
যাহোক এবার ছোট চাচার বর্তমান অবস্থার দিকে ফেরা যাক। ছোটচাচা যখন বাড়ি-ছাড়েন তখনকার বাড়ির চিত্র এখনকার মতো ছিল না বলাবাহুল্য। দাদা-দাদি, চাচা-ফুফু এবং তার নিজের মা-বাবা ভাইবোন তো ছিলই আশেপাশের পড়শিদের সাথেও সেকালে নিজপরিবারের মতো অতিশয় ঘন- সম্পর্ক থাকত। যাত্রাপালা’র মতো এখানেও ঢের পরিবর্তন এসেছে। তার এই দীর্ঘ অনুপস্থিতির সময়ের মাঝে একেএকে প্রায় সবাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। হেলাল বেপারির বাবা-মাও বেঁচে নেই। বাবার পক্ষের একমাত্র ছোট চাচা ছাড়া হেলাল বেপারির ধরাধামে আর কেউ নেই। মানুষগুলো না থাকলেও তাদের বিষয়-সম্পদ ওয়ারিশ মাফিক ভাগ-বাটোয়ার হয়েছে। চাচার অংশও রয়েছে। চাচা অবশ্য ফিরে এসে হেলাল বেপারির সংসারে সাদরে যুক্ত হয়েছেন।
হেলাল বেপারির বাবার কর্কট রোগ ছিল। নিশ্চিত মৃত্যুরোগ। এরোগে মানুষটা যখন পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, অনিচ্ছা সত্বেও বিষয়-সম্পত্তি নিঃশেষ করে পরিবারকে পথে বসিয়ে তবেই সে চলে যায়। তদ্রুপ তার বাবাও চিকিৎসায় নিজের অংশের জমিজিরত প্রায় সব-ই খুইয়ে গেছেন। হেলাল বেপারির নিজের বলতে কিছুই নেই। ভোগ-দখলে যা-কিছু আছে এসবই ছোট চাচার। চাচা যখন ফিরে এল তখন তার মধ্যে সম্পদ হারানোর একটা ভয় ছিল। কিন্তু আজঅবধি ছোট চাচা তার বিষয়আশায় স্বেচ্ছায় বুঝে নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি এমনকি কখনও তার সম্পদের হিসেবটা পর্যন্ত জানতে চাননি। জীবনভর এসব দূরে সরিয়ে গানবাজনা নিয়েই পড়ে থেকেছেন। সে অভ্যাস এখনও থেকে গেছে। নিজের মনে গান-বাজনা করেন, ঘুরে বেড়ান, মন চাইলে বাড়ি ফিরেন নয়ত ফেরেন না। এতদিন সবকিছু ঠিকঠাক এমনভাবেই চলছিল।
কিন্তু গতবছর হুট করে ছোট চাচা এক হুলস্থুল কাণ্ড বাঁধিয়ে বসল। শুধু হেলাল বেপারি নয় গাঁয়ের সকলে তার এই কাণ্ডে থ মেরে গেল। বাড়িতে চাচার যাত্রাদলের এক পুরনো বন্ধু বেড়াতে আসে। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়। প্রায়ই চাচার বন্ধুবান্ধব বেড়াতে আসে, একত্রে তারা গানবাজনা করে, মনের আনন্দে ঘুরেফিরে আবার চলেও যায়। চাচাও হরহামেশা এমনভাবে বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া-আসা করেন। তো চাচা একসময় বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। এরপর মাস ঘুরে মাস আসে কিন্তু চাচা ফিরে আসেন না। বাড়ির কেউ বন্ধুর ঠিকানা জানত না তাই চাচার খোঁজ করা হয়ে উঠে না। প্রথম প্রথম বাড়ির সবার মধ্যে তাকে নিয়ে উৎকণ্ঠা কাজ করলেও একসময় তা অভ্যস্ততায় পরিণত হয়।
প্রায় পাঁচমাস পর আশ্বিন মাসের ভর সন্ধ্যেবেলায় হেলাল বেপারী দাওয়ায় বসে আছে। হাতে আকিজবিড়ির প্যাকেট, বুকপকেট থেকে আনমনে ম্যাচের বাক্স বের করে আনেন। রাতের খাওয়ার পর নিরালায় বসে আয়েশ করে একখানা বিড়িতে সুখটান দেওয়া তার বহুকালের অভ্যাস। তো রাত বাড়তে রাতেরগায়ে আঁধারের প্রলেপ বেশ গাঢ় হয়ে পড়তে শুরু করে। বাড়ির উত্তর সীমানাঘেঁষা ঝুপজঙ্গল হতে দলেদলে জুনি-পোকারা বেরিয়ে আসে। অন্ধকার গাঢ় হতে এদের আনন্দ যেন আর ধরে না। দল বেঁধে হাওয়ায় উড়ে উড়ে বেড়ায়। রাত যত বাড়ে ঝিঁঝি পোকার গলার আওয়াজ সমান তালে বাড়ে। বাড়ির সম্মুখের কদম গাছটায় বাদুর ঝুলে আছে। ওরা কালো চকচকে চোখে হেলাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে থাকে। হেলাল বেপারী সারাদিন উঁচিয়ে থাকে রাতের এসব নিখুঁত সৌন্দর্য উপভোগ করতে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
হেলাল বেপারী আয়েশি মেজাজে বিড়ি ধরায়। মনের সুখে বিড়িতে লম্বা একটা টান দেয়। মুখ থেকে একদলা অশুদ্ধ-ধোঁয়া, আশ্বিনী হালকা কুয়াশা-ভরা হাওয়ার সাথে মিলেমিশে একাকার হতে, অন্ধকার রাতের মুগ্ধতায় অমাবস্যার চাঁদের মতো সেও ডুবে যায়। এমন সময়ে তার খুব নিকটে দাঁড়ানো দু’জন মানুষের ফিসফাস আওয়াজে তার ধ্যান ভাঙে। বিড়ির আগায় জমে থাকা আগুনের ফুলকি আর জুনিপোকার মৃদু আলো ছাড়া চারপাশে কোনও আলো নেই।
হেলাল বেপারী আচমকা উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তাদের ঠাহর করতে পারে না। একসময় ছোট চাচা নিজের উপস্থিতি জানাতে মৃদু-শব্দে কাশি দেওয়ার ভান করলে, হেলাল বেপারী চাচাকে ফিরে পেয়ে খুশিতে তাকে ঝাঁপটে ধরে। চাচা অবশেষে ফিরে এসেছেন, তবে, তিনি একা নন। নিজের বয়সের অর্ধেক-বয়সী এক কন্যা তার সঙ্গে। কন্যা লাল বেনারসির ভেতর জড়োসড়ো হয়ে ছোট চাচার গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চাচা স্বভাবতই এহেন কর্মে অনভ্যস্ত। সেও বউর সঙ্গে লজ্জাবনত চোখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।
হুট করে এমন অকল্পনীয় দৃশ্য দেখে হেলাল বেপারী প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ে। তার কপালে মিহি ঘাম জমে উঠে। মুখ ছেয়ে যায় ঘুটঘুঁটে আঁধারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হল, তার মাথায় বুঝি ঝুরঝুর করে আস্তআকাশটা ভেঙেচুরে আছড়ে পড়ল। চাচির বয়েস অল্প, তা সে যদ্দুর ঘোমটার আড়াল থেকে দেখতে পেয়েছে তাতে বয়স আন্দাজ করতে মোটেও বেগ পেতে হয়নি। তার নিজ-বউয়ের চেয়েও বয়সে কম করে হলেও বছর দশকের ছোট হবে, তা সে নিশ্চিত। ভবিষ্যৎ ভাবনায় হেলাল বেপারী চূড়া-ভেঙে পড়া পাহাড়ের মতো ভগ্ন-হৃদয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
নির্ঘুম রাতশেষে ভোরসকালে মৃদু অন্ধকারে হেলাল বেপারীকে দাওয়ায় পরে বাঁশের মুড়া পেতে চুপচাপ বসে থাকতে দেখা যায়। মাথার উপর তার বিশাল চিন্তার-বোঝা চেপে বসে আছে স্বভাবতই ঘুম তার চোখ থেকে উবে গেছে। অবশ্য হেলাল বেপারীর ভাবনাচিন্তা মোটেও অবান্তর ছিল না। চাচির শরীর জুড়ে গর্ভধারণের পরিস্ফুট ছাপ-চিহ্ন বাড়ির সবার নজরে পড়ে। হেলাল বেপারীর চোখের কোণায় ছায়াছবির দৃশ্যের মতো তার নিজের ভবিষ্যতের করুণ পরিণতি একের পর এক ভেসে উঠছে। আশ্বিনের ভোরবেলাকার হাওয়ায় শীতের আমেজ বেশ সরবর হলেও দুশ্চিন্তায় হেলাল বেপারী ঘেমে উঠে। এতকাল চাচার বিষয়-সম্পদ নিজের ভেবে হাঁটুভাঁজে বসে-বসে খেয়েছে। চাচা অবধারিতভাবে সম্পদ ফিরিয়ে নিবেন, কারণ তার নিজের একটা সংসার হয়েছে। কিন্তু তার নিজের সংসারের কী হবে!
ভবিষ্যতের ভাবনায় সে অতিশয় অস্থির-দিশেহারা হয়ে উঠে। রাতে ঘুমাতে পারে না। দিনের বেলায় চুপচাপ বসে ঝিমোয়। সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া হয়ে দিনরাত ভাবনায় ডুবে থাকে। কিন্তু কোনও পথই তার ভবিষ্যৎ দুশ্চিন্তার সুরাহা দিতে পারে না। এরইমাঝে একদিন হুটকরে বহুদিন আগের এক ঘটনা মনে পড়ে যায়।
চৈত্রমাসের ফকফকা এক চাঁদনীরাতে- হেলাল বেপারি পাশেরগাঁয়ে বন্ধুর এক পরিচিতের বাড়ি বেড়াতে যায়। পরিচিত শহুরে-মানুষ, মাঝেমধ্যে গ্রামেরবাড়িতে আসে। বিশাল জমিদার বাড়ি। একসময়ে তার দাদা নামেমাত্র টাকায় দলিলপত্র নিজের নামে করিয়ে নিয়েছিল। পৈত্রিকসুত্রে বিশাল সেই সম্পদের মালিক এখন সেই লোক। ভোগদখল ঠিকঠাক রাখতে মাঝেমধ্যে সে আশপাশের অকর্মা ছেলেপুলেদের ডেকে নিয়ে আমুদ-ফুর্তির সুযোগ করে দেয়।
শহরের নানান বর্ণের নানার স্বাদের পানীয়ের স্বাদ হেলাল বেপারী প্রথম সেই বাড়িতে পায়। তার অবশ্য আগে থেকেই দেশিয় নেশা-ভাঙয়ের এক-আধটু অভ্যাস ছিল। এরমধ্যে এমন আস্কারা পেয়ে সে বেজায় খুশি হয়। তারপর থেকে সে নিয়মিত সেই লোকের আঁকড়ায় যেত। একসময়ে ঘনঘন যাতায়াতের সুবাদে সেই লোকের সাথে তার বেশ সখ্যতা তৈরি হয়। একদিন কি-মনে করে কে জানে, মাতাল অবস্থায় সে গালকাটা আব্দুল মতিনের খোঁজ, হেলাল বেপারীকে দেয়। সেদিন তার কাছে গালকাটা আব্দুল মতিনের ঠিকানা অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও আজকের পরিস্থিতিতে তার কাছে এই একটিমাত্র পথকেই যথোপযুক্ত মনে হল। এবং তিনি এই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেতে গালকাটা মতিনকে ভাড়া করে আনতে মনস্থির করলেন।
হেলাল বেপারির বাইরবাড়িতে দাদাকালানের একখানা আধভাঙ্গা-পলেস্তারা খোয়া বাংলাঘর। বাড়ির অতীত আভিজাত্য ধরে রাখতে কোনও মতে আজও কোমরভাঙা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে-আমলে অবশ্য অবস্থাপন্ন প্রায় সববাড়িতে মূলবাড়ির বাইরের অংশে বাংলাঘর থাকার প্রচলন ছিল। মূল ঘরের চেয়ে বাংলাঘরের গঠনশৈলী উন্নত করা হত। আগেরদিনে উন্নাকালে এঅঞ্চলের মানুষের একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম ছিল পায়ে হাঁটাপথ। বহুপথ হেঁটে এসে পথিক ক্লান্ত হয়ে এসব বাড়ির বাংলাঘরে বিশ্রাম নিত। তাদের আপন মেহমানের মতো সন্মান এবং খাদিমদারী করা হত। দূর দেশের পথিক নির্ভয়ে বাংলাঘরে গৃহস্থের আপ্যায়নে রাত কাটাত। হেলাল বেপারির বাড়ি সে-প্রথা আজও রয়ে গেছে। যদিও এখন প্রকৃত পথিকের দেখা মেলা ভার। শহরের মতো গ্রামাঞ্চলেও মানুষ পায়েহাঁটার অভ্যাস ভুলে গেছে। তারপরও হকার, ফকির ধরনের লোক প্রায়ই তাদের বাংলাঘরে রাত কাটায়। হেলাল বেপারি কৌশলী লোক। গালকাটা মতিনকে সে হকার সাজিয়ে তার বাড়িতে ঢুকানোর ব্যবস্থা করে রেখেছে।
ওদিকে গালকাটা আব্দুল মতিনের মূল অভিনয় শুরু হয়ে যায়। ঠিকানা মোতাবেক সে হেলাল বেপারির বাড়ি পৌঁছে যায় এবং তা দিনের আলো থাকতেই। সারাদিনের বিক্রিবাট্টায় মেহনত করে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে হেলাল বেপারির বাড়ি ঢুকে। বাংলাঘরের খোলা বারান্দায় কাঁধেরঝোলয় শিথান পেতে আধশোয়া হয়ে শুয়ে পড়ে। এটা অবশ্য অভিনয় নয়, সে আসলেই ক্লান্ত। এতদূরের পথ পদব্রজে তারওপর হাতে-কাঁধে অনভ্যস্ত বোঝার ঝক্কি শরীরটাকে কাহিল করে দিয়েছে। ঘর্মাক্ত দেহে বারান্দার পাকামেঝের শীতলভাব শরীরটাতে কেমন আরাম-স্রোত বয়ে যায়। আরামে গালকাটা আব্দুল মতিনের চোখ বুজে আসে। এবং সে খুব আল্প সময়ে সত্যি সত্যি ঘুমিয়েও পড়ে।
ছোট চাচা শেষবেলায় গোসল সেরে বাইরবাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো ভেজা গামছা নিঙড়ানো জল পায়ে ঢালতে ঢালতে চোখে রাখে, বাংলাঘরের বারান্দায়। তিনি আব্দুল মতিনকে গা-হাতপা ছড়ায়-ছিটায়ে পড়ে থাকতে দেখেন। ছোটচাচা-ই সচরাচর এসব পথিকের দেখাশুনা করেন। তিনি অভ্যাস মতো পথিকের যত্নআত্তিতে তৎপর হয়ে পড়েন। হেলাল বেপারি অন্দরবাড়িতে ছিল। সে বেরিয়ে এসে ছোট চাচার এহেন কাজকারবার নিয়ে বরাবরের মতো বিরক্ত হওয়ার ভান করে। সে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে চড়া গলায় বলতে শুরু করে- ‘অচিন মানুষ, এত যত্ন-আত্তি করতে নাই। দিনকাল ভাল না! সুই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবে’ ছোটচাচার কানে এসব কথা ঢুকলেও বরাবরের মতো তাতে সে তেমন পাত্তা দেয় না।
ওদিকে ছোটচাচাকে দেখামাত্র গালকাটা আব্দুল মতিন একঝটকায় শোয়া থেকে উঠে দাঁড়ায়। পথিকের এহেন আচরণে ছোট চাচা যারপরানই ভড়কে যান। অবশ্য দ্রুত আব্দুল মতিন নিজেকে শান্ত করে আবার তার অভিনয়ের খোলসে ফেরত যান।
ঘটনাকাল প্রায় কুড়িবছর পেছনকার। আব্দুল মতিনের বাবা একদিন বিয়ানবেলায় দাওয়ার পরে শীতলপাটি বিছিয়ে সবার সাথে নাস্তা খেতে বসেছেন। প্রতিদিন যেমন বসেন। আব্দুল মতিনের বয়স তখন দশ বারো হবে হয়তো। সেও বাবার সাথে বসা ছিল। সহসা বাবা মাটির পরে ঢুলে পড়লেন। এবং ঢুলে পড়ার সাথে সাথেই তিনি নাই হয়ে গেলেন। চোখের পলকে ঘটে গেল এমনতরো ঘটনা। লোকে বলল, সন্ন্যাস রোগ, এ রোগে ডা-বোদ্দি ডাকার সুযোগ হয় না। বাবার মৃত্যুর পর অল্পবয়সের পিঠাপিঠি চার ভাইবোন নিয়ে তার মা পড়লেন মহা মুছিবতে।
ছোট চাচা সেসময়ে তাদের অঞ্চলে বেশ দাপটের সঙ্গে যাত্রাদলে নায়কের পাঠ করে বেড়ান। গালকাটা আব্দুল মতিনের বাবাও সে-পালায় ছোটখাটো এক চরিত্রের পাঠ করত। নাস্তা সেরে ছোট চাচার সঙ্গে একত্রে বাবার সেই পালায় যাওয়ার কথা ছিল। সেসুত্রে ছোটচাচার সাথে তাদের বাড়ির একটা সম্পর্ক ছিল। তার বাবা ছিলেন ভবঘুরে। ঠিকঠাক মতো পরিবারকে দু’বেলা ভাতের জোগান দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মা, ছুটাছাঁটা কাজ করে বাবার সাথে সংসারের হাল ধরে ছিলেন। বাবা চলে যাওয়ায় মায়ের-সংসার অবধারিতভাবে পড়ল চরম দুঃসময়ে।
সে সময়ে মায়ের পাশে আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের ভুমিয়ায় ছোট চাচা এসে দাঁড়ালেন। প্রায় চারপাঁচ মাস তিনি অত্র এলাকায় ছিলেন। বাবার ভূমিকা পুরোটাই সে একহাতে করেছেন। এবং এরপর সে তাদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার পরও বহুকাল পোষ্টঅফিসে মায়ের-নামে টাকা পাঠাতেন। লোকটা মানুষ না, সাক্ষাত ফেরেশতা। গালকাটা আব্দুল মতিনের ছোট্টবেলার সেসব স্মৃতিতে ছোটচাচার মুখটা আজও শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে দ্রুতি ছড়াচ্ছে। মানুষটা দেখতে সেই আগের মতোই রয়ে গেছেন। ভালো মানুষের শরীরের গঠন সহজে নষ্ট হয় না। মন্দ লোকের চেহারা দ্রুত ভেঙ্গেচূড়ে খাটাশের মতো রূপ নেয়। তার নিজের চেহারা আয়নায় দেখলে তার নিজের কাছেই বড় অচেনা ঠেকে। হেলাল বেপারীর সঙ্গে চুক্তি মোতাবেক আজ রাতে গালকাটা আব্দুল মতিন নিজহাতে ছোটচাচাকে খুন করবে।
নিশুতি অমাবস্যার রাত। চারপাশ কালো আঁধারের ঘন প্রলেপে ডুবে আছে। ঝোপঝার থেকে দলে দলে জুনিপোকা বেরিয়ে আসছে এবং টিমটিম আলো জ্বেলে এদিক-ওদিক অকারণ ছোটোছুটি করছে। দূরের বনজঙ্গল থেকে রাতজাগা পাখির ভয়ধরানো কাঁপাকাঁপা কণ্ঠের আওয়াজ কানে ভেসে আসে। গাঁয়ের গরস্থান থেকে শিয়াল খাটাশ ক্ষণেক্ষণে ডেকে উঠে রাতের প্রহরের জানান দেয়। বাংলাঘরের দুয়ারে বাড়িরসীমানা ঘেঁষা ঝাঁকড়া-মাথায় নির্ভীক দাঁড়িয়ে থাকা কদমগাছটায় বাদুর ঝুলে আছে। আব্দুল মতিন ধীরপায়ে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। বাদুরের চোখে চোখ পড়তে কেমন যেন একটা ভয়ের স্রোত পুরো-দেহটাকে অসাড় করে দেয়। চোখগুলো মানুষের চোখের মনির মতো কুচকুচে কালো। এরআগে বাদুর এত সামনে থেকে দেখা হয় নাই। রাতের এতসব নিস্তব্দ রহস্যময়তার মাঝে, নিজেকে কোথায় যেন হারিয়ে ফেলে গালকাটা আব্দুল মতিন। আদতে আজ পূর্ণিমার তিথি,কৃষ্ণপক্ষ নয়। সে নিরবচ্ছিন্ন ভাবনার-ঘোরে পুরোপুরি আচ্ছন্ন হয়ে আছে। এরপর শান দেওয়া ছুরিটা হাতে নিয়ে সে নদীরপাড়ের দিকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে যায়।
হেলাল বেপারি পূর্বপরিকল্পনা মতো ছোট চাচাকে চোখমুখ বেঁধে নদীরপাড়ে কাশবনের ঝোপে এনে দাঁড় করায়। এসময় ছোটচাচার বন্ধ-গলা দিয়ে অনবরত বিড়বিড় আওয়াজ বেরিয়ে আসে। তার কপালে সারিসারি ভাঁজের রেখা অতিশয় স্পষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। শেষরাতে ছোটচাচার বাহ্যে করার অভ্যাস আছে। সেসময়ে কৌশলে হেলাল বেপারী তাকে বাড়ির শেষপ্রান্তে ডেকে নিয়ে আসে। এবং হুট করে চোখ-মুখ গামছা দিয়ে শক্ত আঁটে বেঁধে ফেলে। টেনেহিঁচড়ে নদীর দিকে নিয়ে আসে। ছোট চাচা এখনও কিছু আঁচ করতে পারছে না। সে অবাক হয়ে হেলাল বেপারীর দিকে তাকিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করছে।
গালকাটা আব্দুল মতিন জায়গা মতো এখনও এসে পৌঁছেনি। হেলাল বেপারী অপেক্ষা করে। অপেক্ষার সময় বড় দীর্ঘ হয়। হেলাল বেপারী ঘেমে উঠেছে।
এসময়ে গালকাটা আব্দুল মতিন ধীরপায়ে নদীর তীরে এসে দাঁড়ায়। মৃদু ঢেউয়ের শান্ত-নদী রাতের মতো ঢিলেঢালা শব্দে বয়ে চলেছে। নদীর দু’কূল জুড়ে রাজহংসের পালকের মতো ধবধবে সাদা কাশফুল হালকা হাওয়ায় তিরতির করে দুলছে। আকাশ থেকে রূপালীধারায় চন্দ্রকিরণ ঝর ঝরিয়ে ঝরে পড়ছে, ফকফকে জ্যোৎস্না স্রোতে ভেসে চলেছে বিশ্বচরাচর, জগৎসংসার। গালকাটা আব্দুল মতিন উদাস হয়ে উঠে। সহসা তার হাতেধরা ধাঁরালো ড্যাগার ছুরিটা প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে যায়! এরপর…
ভোর সকালে কাশবনে কে বা কারা বাহ্যে সারতে গেলে, হেলাল বেপারির পেটকাটা-মড়া পড়ে থাকতে দেখে। এবং নদীর অদূরে শিমুলগাছের তলা থেকে ছোট চাচাকে হাত-মুখ বাঁধা কিন্তু অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
🦋কবিতা/২
অমিত কাশ্যপ
নবীনচন্দ্র প্রাথমিক বিদ্যালয়
দক্ষিণায়নের রোদে ভেসে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষ
বার্ষিক পরীক্ষা এখনো অনেক দেরি
রবীনবাবু ইতিহাস পড়ান, বণিকবাবু ভূগোল
একজন অতীত, অন্যজন পৃথিবীর চিত্র
ভিন্নধর্মী, বন্ধুত্বে হরিহর আত্মা
বাংলা স্যার নলিনীবাবু অনুপস্থিত হতে
এলেন পড়াতে বণিকবাবু, অদ্ভুত প্রশ্নের মুখে-
কোন লেখকের লেখা পড়ে কান্না পায়
নীরব ক্লাসে ঘরে তখন সাবালক রোদ
এ ওর মুখ দেখি, দেখি বণিকবাবুর মুখ
ভারী চশমা টেবিলে, ধ্যানমগ্ন, গম্ভীর গলা
বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী পড়নি কেউ
দুর্গার চলে যাওয়া, সেই ঝড়ের রাতের কথা
মন্ত্রমুগ্ধর মতো বলে চললেন সেই মর্মস্পর্শি কাহিনি
আমরা সেদিন ভেতরে ভেতরে কেঁদেছিলাম
আজও বোধহয় সে কান্না থামেনি, উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু
নিশ্চিতিপুর সেই গ্রামের ঐতিহ্যে বর্তমান
দীপান্বিতা রায় সরকার
ডুব-জন্ম
আখ্যানের এই কিয়দংশ, স্বল্প পরিসরে।
খণ্ডনের এই তথ্যকথা, সমান বাষ্প ভাপে।
বরফ সমান নিরেট হবে? ফুরিয়ে যাবে শেষে!
বৃষ্টি নাকি ঝড়ো বাতাস! নাকি বজ্রপাতে?
কে আর খবর রাখে, যে বুকে ডুব জন্ম থাকে
তারাই শুধু খণ্ডিত হয়, সমান বাষ্প ভাপে।
এসব কথার কিয়দংশ, ক’জনেই বা জানে
ক’জনেই বা সঙ্গ মিলায়, একলা হবার গানে।
একটা মানুষ, কখন একা! নিজের ভেতর টানে।
তারাই শুধু বুঝবে যারা ডুব জন্ম জানে।
সত্যিই কি তারা কিয়দংশ, বিশাল অংশ থেকে?
নিজেকে টুকরো করার স্পর্ধা যাদের থাকে।
বানীব্রত
বিয়ে করবে আমায়
বিয়ে করবে আমায়
হাঁটু হাঁটু গেঁড়ে বসে হাতে লাল গোলাপ নিয়ে
প্রেম নিবেদন করল ছেলেটি।
মেয়েটি হতবাক কী উত্তর দেবে সে
মাত্র ক’য়েকদিন আগে বাসে আলাপ
তারপর আজ প্রথম এই পার্কে দেখা করা।
আচমকা এই প্রস্তাবে হতবাক মেয়েটি
অস্ফুটে বলে উঠল ভাবতে হবে আমাকে
ভাবুন আপনি ভাবুন, বলে ছেলেটা উঠে দাঁড়াল
মেয়েটির হাতটা ধরে গোলাপটা দিয়ে ছেলেটি বলে গেল…
তিন দিন পর আবার এই পার্কে আসব উত্তর জানতে।
কথাটা কানে এল মেয়েটির,
উওর দিতে পারল না। তবে যে স্পর্শ অনুভব করল সেটা যেন খুব চেনা।
ভাবতে ভাবতে তিনটে দিন কেটে গেল মেয়েটির
মনে যেন প্রশ্ন দানা বাঁধছে কত কিছু
পার্কে এসে দেখে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে উত্তর এর অপেক্ষায়।
মেয়েটি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কেন বিয়ে করবে আমায়?
ছেলেটা বলল ভালবেসে ফেলেছি যে
ভালবাসা কি এতই সহজ বলো
জানি না তো। তবে বুঝি তোমায় না দেখলে কষ্ট হয়, ছুটে যেতে ইচ্ছে করে যে
একবার বলো কি ভাবলে তূমি, কাতর আবেদন ছেলেটার,
আবারও বলে ওঠে বিয়ে করবে আমায়?
বলত আগে কি কোথাও আমাদের দেখা হয়েছিল? মেয়েটি বলল
উত্তর দিল ছেলেটা মনে নেই তো, তবে এখনও তোমার উত্তর পেলাম না যে
অনেক ভেবে মেয়েটি বলল আমাদের বোধয়য় পুর্ব জন্মের না পাওয়া হবে হয়ত
ছেলেটার হাত টা ধরে বলল কোথায় যাবে নিয়ে চলো।
পাপড়ি দাস সরকার
নির্জনতা
একা নই
কিছু ভাবনা হেঁটে চলেছে
সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ অবধি
হেঁটে চলেছে, বাড়ি ঘর দোর -স্বজন সুজন
সমাজ সংস্কৃতি, কিছু শব্দ
কিছু গন্ধ
ধর্ম ছিল ঘরে এখন হাতিয়ার
একা নই
হেঁটে চলেছে মানুষ, আগুনের ফণায় পুড়ছে
চাদ্দিকে পোড়া গন্ধ, নিঃশব্দে
উড়ছে
কিছু একটা পুড়ছে।
দীপ্তি চক্রবর্তী
এ কেমন বৃষ্টি
নীল আঁচলের মেঘ জমেছে শিশিরের গায়ে গায়ে
হাতের ঘাম মুছলে শত শত সোনালী ভোর
আকাশের পালক খুলে খুলে পড়ে
নন্দিত ধরার বুকে
একদিন ঠিক বৃষ্টি হবো
তোরই মতো
ভিজিয়ে দিয়ে আলোর সাথে
সারা বেলার সুখ
দুঃখের পাথর গলিয়ে দেবার সময়
ভরবে নদীর বুক
বারান্দার বাগানে গোলাপ জুঁই
জুলাই ফুল
দেখিস একদিন ঠিক নদী হবো
তোরই মতো
ভাঙাগড়া
দিন শেষ হয় আঁধার ঘনায়
এখনো আছে বাকি
কেউ জানে না কখন কেমন
উড়ে যাবে এ পাখি
জীর্ণ খাঁচা হয় বিকল
বিষয় সাধনা বিষ
ভালোবাসাটুকু রয়ে যাবে জেনো
বাকি সব অবশেষ।
শম্পা ঘোষ
একঘেয়েমি
সকালে বেখেয়াল হঠাৎ তারকাটা-
হিমাঙ্গিনী আর চন্দ্রমুখী তখন মিলেমিশে একাকার
বাজারের ব্যাগে উঁকি দেয় পলতার ডগা,
কখনো নিয়তি কপালে জুটে যায় এক প্রস্থ লিফট
স্বার্থসিদ্ধির অছিলায় নীরব মুখোশে
বাউণ্ডুলে মন সার বেঁধে ঢুকে যায়
ভাঙ্গা শিকলের মাঝে,
খিদের সাথে রাস্তার বিরিয়ানি কি আশ্চর্য সম্বন্ধ তাই না!
হতাশার ভেতর যেন স্বপ্নের ফোয়ারা,
চির ধরা রাতে নথিভুক্ত হতে পারে কি রঙিন?
অতঃপর গোলগাপ্পাই চলুক
আর নতুন কোনও কথা নয়।
যতন কুমার দেবনাথ
তালকানা
একেতো তালকানা, তালার চাবি তার হাতেই
মাতালের পাতাল পাওয়া চিৎকার
পেয়েছি… পেয়েছি…
ঝুঁকে পড়ে সকলেই মেঘের আয়নায় দেখে নিচ্ছে
যার যার আঁ’শ-ফাটা মুখ
আমি তখন বেলুন ফুলিয়ে ‘ফুটো করা’ খেলায়
এক লেজ কটা খেলোয়াড়-
কাটা ঘা-এ নুন ছিটা’তে ভীষণ ব্যস্ত।
আকলিমা আঁখি
ব্যাকুল ঝিঁঝিঁ
শহর-নগর থেকে পালিয়ে বাঁচা যে ঝিঁঝিঁ পোকা
জোনাকির আলোতে মশগুল,
ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ গোনা
নিশিযাপনে যে নির্ভুল,
সায়রের ঢেউ শোনা সে শার্দূলী
তক্ষক পোষা যে রাখালী,
বুকে বিছিয়ে রাখা অপরিমেয় মায়া
শ্রাবণ ধারায় ধুয়ে দেয় পরম আদরে
অপর প্রান্তের রোদ-রক্তের ছায়া;
শোক ধানের বীজ বুনে গুনে,
এ ফসলী গোলা উজার হোক,
অসময়ের বলদ স্ফটিক কানা চোখে
চেয়ে করুক উপোস, সে প্রার্থনা—
নিশিতে পাওয়া আত্না ছুটছে কোন্ হাসপাতালে
যেন মুমূর্ষু সিঁথানে মুখ চেপে ককিয়ে উঠা কুহু।
বেঁচে ফেরা শের সাবক খুলুক চোখের বেল কাঁটা,
পরানে পরুক বরই পাতার বর্ম; ঢাল স্বরূপ:
আমৃত্যু মেঠোপথে সে ঝিঁঝিঁ পোকা গাইবে জ্বী, জ্বী, জ্বী।
ইভা আলমাস
এ কালের হোসাইন
(শহীদ আবু সাইদকে সামান্য শ্রদ্ধাঞ্জলি)
দেশের স্বপ্ন বুকে তুলে নিয়েছিলে
প্রাপ্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলে বুক চিতিয়ে
চোখে ছিল বিজয়ের হাতছানি
পাখির আদলে তোমার হিমালয় দেহ
ঢাল যেন সকল অপকর্মের
তুমি দাঁড়িয়ে আছ, আল্পস পর্বত হয়ে।
বন্ধুরা তাগাদা দিচ্ছে ফিরে আসার
তুমি অনড়, অচল, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ
বিজয় নিয়ে ঘরে ফিরবে আজ
বন্ধুদের গলে তুলে দিবে বিজয়ের বরমাল্য
কী এক অন্নপূর্ণার দাপাদাপি তোমার অকুতোভয় বুকখানি জুড়ে!
দ্রিম!দ্রিম! দ্রিম!
বাতাস ভেদ করে ছুটে এলো পিশাচের খুন
অবিশ্বাসী দৃষ্টি তোমার
এক দু’বার কেঁপে উঠল বুঝি হিমালয়
স্বাধীন দেশে নিরস্ত্র মেঘনাদকে আক্রমণ!
বুঝে উঠার আগেই লক্ষ্যভেদী শকুন
ছিনিয়ে নিল অবিচল অরিন্দম আর
অনাগত দীপ্রতা!
ধুলোয় লুটোয় হিমালয়!
ধুলোয় লুটোয় আল্পস!
পাথুরে শোক ভূলুণ্ঠিত স্বাধীনতায়।
শত বর্ষ পরে আবার প্রকৃতি কেঁদে উঠল,
‘হায় হোসাইন’ ‘হায় হোসাইন’ ‘হায় হোসাইন’…
মমতা রায় চৌধুরী
বাঁচার মত বাঁচুন
বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচুন
যত অন্যায় অবিচার আছে
এক লহমায় পাল্টে দিতে তো পারেন না।
যা পারেন প্রতিবাদী হয়ে উঠতে
বিন্দু বিন্দু করে এই প্রতিবাদগুলো
একদিন বারুদের আকারে ফেটে পড়বে
জ্বালিয়ে খাঁক করে দেবে মুখোশধারীর দম্ভ।
বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচুন
প্রতিনিয়ত মার খেতে খেতে
আর উমেদারী করতে করতে
একদিন দেয়ালে পিঠ থেকে যাবে
তাই ঘুরে দাঁড়ান, প্রতিবাদী হয়ে।
বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচুন
নদীর জল বয়ে চলুক আপন বেগে
পাহাড়ি ঝর্ণা নেমে আসুক আপন বেগে
সমতলের ভূমিতে ফস ল ফলাক কৃষকেরা।
বাঁচতে হলে বাঁচার মত বাঁচুন
প্রেম ভালবাসা বিশ্বাসগুলো
অটুট থাকুক সূর্যমুখী ভোরের আলোয়।
কুয়াশাগুলো সরে সরে ভেসে উঠুক
নতুন মুখ, প্রতিবাদী উদ্যত হাত,
তাই বলি বাঁচতে হলে বাঁচার মতো বাঁচুন।
আমি যাকে ভালবেসেছি
আমি যাকে ভালবেসেছি
তাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছি
তোমার আমার হৃদয় বাঁধা পড়েছে
এক তারে।
সে মানুষটি উদাসী শিল্পী
তার ভালবাসার বাহুতে
উষ্ণতায় ঘেরা ক্যানভাসে
বারবার ছবি হয়ে ফুটে উঠেছি।
আমি যাকে ভালবেসেছি
সে মানুষটি যে শিল্পী
নারী শরীরের ড্রইং করে গেছে
কখনো ফুল কখনও ফিগার
আমি যেন সেই নারী প্রতিমা
কালো আকাশে আমি কোটি কোটি তারা
জ্বলজ্বল করে জ্বলে উঠতাম ওর
তুলির আঁচড়ে।
আমি যাকে ভালবেসেছি সে যে শিল্পী
বারবার দেখেছি
দেয়ালের ওভারল্যাপ করা এক নারী মুখ
শরীরে ছুঁয়ে গেছে সদ্য ফেলে আসা
কিশোরীবেলা।
শৈল্পিক সত্তার বোধের বাইরে বেরিয়ে
আমি তো তাকে চেয়েছিলাম
আমার সমস্ত সত্তা দিয়ে হৃদয়ের পরশে
মন থেকে মনে, শরীর থেকে শরীর ছুঁতে
এক অনঘ্র্যাতা ঘ্রাণ ঠোঁট ছুঁয়ে
মিলে যাব এক অনাবিল আনন্দে
সোনাঝুড়ি বিকেলের একরাশ
পড়ন্ত রোদ্দুর মেখে নেব বলে।
কোনও এক বিকেল হবে
আমাদের চিরন্তন ভালবাসার প্রতীক
একবার মাটির দিকে তাকিয়ে
বৃষ্টি ভেজা সোদা গন্ধ নেব দু’জনে
কিন্তু আমি যে ভালবেসেছি
সে মানুষটি যে শিল্পী…
ফটিক চৌধুরী
উদারতা
মনে মনে যে ছবিটি আঁকি
বাস্তবের সঙ্গে কি তা মেলে?
আমি জ্যোৎস্না আঁকতে চেষ্টা
করলেও তা কি আঁকতে পারি!
আকাশের সবটুকু নীল ঢেলে
দিলেও আমার জামার রং
হয়ে ওঠে না আকাশী নীল
আসলে আকাশ ছুঁতে গেলে
উদারতা দেখাতে হয়, তখন
আকাশ নিজেই সবটুকু রং
ঢেলে দেবে তোমার মনে।
গোলাম কবির
দোষটা কিন্তু পাখিটারই
উড়তে চেয়েছিল বলে
প্রথমে পাখিটার
একটা ডানা ছেঁটে দেয়া হল!
তারপর আবারও
পাখিটা উড়তে চেয়েছিল বলে
তাকে বন্দী করা হল খাঁচায়!
পাখিটা এখন আর উড়তে পারে না!
তাই হৃদয়ে জমানো কষ্টগুলো
প্রকাশের জন্য গাইতে চেয়ে
শুধুমাত্র শীষ দেয়ার চেষ্টা করেছিল!
ওকে এবার গাইতে নিষেধ করা হলো
তবুও ও শুনল না নিষেধ,
বলল- সে গাইবেই তার গান!
অতঃপর তাকে মেরে ফেলা হল!
এই মরে যাবার জন্য
দোষটা কিন্তু পাখিটারই,
কেনো যে সে তার
গান গাইতে চেয়েছিল!
কণিকা বিশ্বাস
বিহারিণী
বৃষ্টি পড়লেই সেই পুরনো দিনগুলোতে টো টো করে ঘুরে বেড়াই।
আকাশ জোড়া রামধনু কেমন নুইয়ে পড়েছে-
বন বাদাড়ে, যেখানে দিনে প্রজাপতির দল খেলা করে।
সন্ধ্যায় জোনাকীরা আলো দেয়।
কবেকার পুরানো ঝুড়িওয়ালা
বট গাছের ছায়া-
দু-দণ্ড বসলেই প্রশান্তির বাতাস।
ডালে ডালে কত পাখিদের কথাকলি।
তারপরই মনে হয়- এই তো জীবন!
একাকীত্ব নির্জনতায় উঠে দাঁড়াই
দেখি নিজের বিম্বিত মুখ।
শুনি বিনিদ্র রাতের বুক চাপা শব্দ।
দেখি ক্ষয়ে যাওয়া সুড়কিতে বিদগ্ধ স্বপ্ন,
অদৃশ্য ক্রুশ কাঁটা পরাধীন যাপনের বেড়ি,
জীবন ছিপ বড়শিঁ গেঁথে দমফাটা নাভিশ্বাস।
একসাথে বেড়ে ওঠা মানুষদের দলছুট- একা-
ঠোঁট কাঁপার অনুভবে গরম বাতাস, নির্বাক সংলাপ।
মনের ভেতর বৃষ্টি নামে।
বৃষ্টি শেষে খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে-
পুরনো দিনের কাছে হাতের তালু পেতে দিই,
দেখি চোখের জলে বৃষ্টি নামে।
রুমানা আকতার
শেষের অংশ
রাতের নিকষ কালো অন্ধকারে,
জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে
সমস্ত কিছু…!
হারিয়ে ফেলেছি নিজেকে।
আমার আবেগ,
কতো স্বপ্ন, কতো অনুভূতি
কতো স্মৃতি, বিষন্নতা মায়া মমতা,
হারিয়ে ফেলেছি পথ…!
ভুলে গেছি তোমার হাসি,
তোমার চোখের ভাষা,
তোমার পছন্দের রং,
তোমার চুলের সুবাস ,
শুধু মনে পড়ে-
“তুমি আমায় ভালোবেসে অনিক বলতে…
আর বলতে তুমি এতো বোকা কেন…?”
আমি ভুলে গেছি সেই খামের চিঠিতে,
কি লেখা ছিল…!
শুধু মনে আছে,
শেষ লাইনে গোটা গোটা অক্ষরের বাক্যটুকু
” অনিক আমায় ক্ষমা করো….”
আমি সব ভুলেছি
শুধু থেকে গেছে-
” তোমার চলে যাবার শেষ সময়ের স্মৃতি…!”
শুধুই স্মৃতিটুকু,
আর কিছু না,
আর কিচ্ছু না…!
🦋ধারাবাহিক উপন্যাস /১১
সোমা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেই বলে, ‘কোথায় গেছিলে তুমি? ঘুমোও নি? কটা বাজে?’
অনঙ্গ কথা বলতে পারেন না। এত কথার উত্তর দিতে গেলে শুধু ছাদ থেকেই নয়, তাঁর কল্পনার জগৎ থেকে, কবিতার জগৎ থেকেও নেমে আসতে হবে।
শুধু বলেন, ‘ঘুমোও। এখনও ওঠার সময় হয়নি।’ সুজিত চট্টোপাধ্যায়-এর ধারবাহিক উপন্যাস ‘অনেকটা গল্পের মতো।’ আজ একাদশ পর্ব।
অনেকটা গল্পের মতো
সুজিত চট্টোপাধ্যায়
না, “কেউ কথা রাখেনি” এমনটাও ঠিক নয়। সবাইই তো আর নাদের আলি নয় বা সেই বোষ্টুমী। আগের পর্বে কথা দিয়েছিলাম, খুব শীঘ্র ফিরব একাদশ পর্ব নিয়ে, কথা রাখলাম। তবে সেও কি আর এমনি এমনি! আসলে না পাবার যন্ত্রণাকে তবুও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু পেয়ে হারাবার যন্ত্রণাকে মেনে নেওয়া বড়োই কঠিন। তাই আমার পাঠকেরা আমায় ছেড়ে যাবেন, আমি ব্রাত্য হব তাঁদের কাছে… এই ভয়েই তড়িঘড়ি ফিরে আসা।
“হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে,
ময়ূরীর মতো নাচে রে “…
রাত গভীর। একটু আগেই সব কিছু মিটিয়ে বাড়ী ফিরে এসেছেন অনঙ্গ সেন।” সব কিছু মেটানো” শব্দবন্ধগুলোর সাথে কোথায় যেন একটা মৃত্যুগন্ধী ব্যাপার থাকে।
‘শ্মশানের দাহকাজ’ সেরে আসার মতো একটা আবহ তৈরি হয়। না, এই ‘সব কিছু মেটানো’ -এর মধ্যে কোনও মৃত্যুগন্ধ নেই। ফুল আছে, তবে সেখানে লাল গোলাপের আধিক্যই বেশি আর আছে কিছু রজনীগন্ধা। সেগুলো এখন কিছু ফ্লাওয়ার ভাসে, কিছু কাঁচের গ্লাসে, কিছু ইতস্তত এখানে ওখানে, সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে অগোছাল শোভা দিচ্ছে সুন্দরী নারীর কেয়ারলেস বিউটির মতো আর গন্ধও দিচ্ছে যেন কোন সুদূরের ওপার থেকে আষাঢ় নেমে এসেছে এই গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে। আজ অনঙ্গ সেন ও সোমার জীবনের একটা বিশেষ দিন। উহু! ঠিক আজ নয়, সময়ের হিসেবে সেটা গতকাল চলে গেছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখ বদলে গেছে। অনঙ্গ জনা পঁয়ত্রিশেক খুব কাছের মানুষদের আজ ডেকেছিলেন। সংখ্যাটা আরও বাড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও সম্ভব ছিল না বলেই বাড়ানো যায়নি। আসলে তার আয় বলতে গেলে তো এখন আর তেমন কিছু নয়। লাগসই উদাহরণ লাগালে বেশ হাসি পায়। আয় তো নয়, যেন নিম্নবিত্ত আটপৌরে পরিবারের বউয়ের আটহাতি কাপড়, ভাসুর শ্বশুরের সামনে ঘোমটা দিতে গেলে পেছনের কাপড় উঠে যায়। তা হোক, তাবলে কি কুঁজো কোনওদিনই চিৎ হয়ে শোবে না? পিঠে যেমন লাগবে, তেমন আকাশ দেখার আনন্দটাও তো পাবে। তাই বাড়ীতে নয়, তাঁদের ডেকেছিলেন মফসসলের একটা মাঝারিমানের হোটেল কাম রেস্টুরেন্টে। তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রিত অতিথিদের ডেকে তাঁদের কষ্ট দেওয়া ছাড়া আর কিছুই তাঁর মনে হয় না। তাছাড়াও, ভীষণ লোডশেডিং, তাণ্ডব গরমে মানুষকে ডাকা… ভাল লাগেনি অনঙ্গের। এর আগেও এমনই কোনও একদিনে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অছিলায় নিমন্ত্রিতদের ডেকে বুঝেছিলেন, তার বাড়িতে বড়ো কোনও অনুষ্ঠান করা যায় না। তাঁরা সুখাদ্যের রসাস্বাদন করতে পারেন না। অনঙ্গর কিছু বিশেষ ‘অপছন্দ’ আছে। তার মধ্যে একটা হল নিমন্ত্রিত ব্যক্তিদের হাতে উপহারের প্যাকেট। তাই অনেক নিমন্ত্রিতকেই সঠিক কারণ বলেননি। কারণ, তার নিমন্ত্রিতদের মধ্যে সবাইই সমান অবস্থানে আছেন এমনটাও নয়। কেউই কোনও রকম অস্বস্তিতে পড়েন, সেটা অনঙ্গ চাননি। কারণ, তিনি নিজেকে দিয়েই বোঝেন, কখনও কখনও নিমন্ত্রণ কতটা গলার কাঁটা হয়ে যায়! কেউ কেউ প্রশ্ন করলে বিভিন্নজনকে বিভিন্ন উত্তর দিয়েছেন। তবুও কিছু নাছোড় মানুষ যারা জানে এই বিশেষ দিনটাকে, তারা ফুল, উপহার নিয়ে এসেছেন তার ভাবনাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। সব মিলিয়ে দিনটাকে একেবারে চেটে পুটে নিয়েছেন অনঙ্গ সেন। তাই তাঁর মন আজ কেবলই গেয়ে উঠছে…
‘হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরীর মতো নাচে রে’।
সোমা ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্ষীণজীবি-দূর্বল শারীরিক টানাপোড়েন নিতে অনভ্যস্ত শরীর সারাদিনের পর আর ধকল নিতে পারেনি। এখন অনঙ্গ একেবারেই নিজের মুখোমুখি। ওর ঘরের লাগোয়া বারান্দা, যেটাকে স্টাডি বলে একপ্রকার আত্মসুখ উপভোগ করেন, সেখানেই সারাদিনটাকে একবার আউরে নেওয়া। দিনটা মন্দ কাটেনি। সকালে উঠে কথা ছিল দু’জনে মিলে মন্দিরে পূজো দিতে যাবার, কিন্তু সোমার একটু জ্বর সর্দি থাকায় সকালে স্নানের ঝক্কি নিতে তিনিই নিষেধ করেছেন এবং একাই গিয়ে পুজো দিয়ে, দুপুরে বাড়ির দু’চারজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে খাবার জন্য ভোগপ্রসাদের টিকিট কেটে নিয়ে এসেছেন, যথাসময়ে তার সদগতি করেছেন। এসবই সোমাকে একটু দৈনন্দিনতা, একঘেয়েমি থেকে মুক্তি দেবার জন্য। সন্ধ্যে থেকে প্রচুর আনন্দ করেছেন। সারা ব্যাঙ্কোয়েট জুড়ে কতো রঙিন প্রজাপতির ওড়াউড়ি। বাইরের প্রবল গরমকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ট দেখিয়ে সুবিশাল ঘরে হালকা শীতের আমেজ… সুখাদ্যের ঘ্রাণ। সন্ধ্যেটাকে একটা অন্য আমেজে নিয়ে যাওয়া। একটু পয়সা খরচ করতে পারলে কত আনন্দের উপাদান ছড়িয়ে আছে। এমনটাই মনে হয়েছে অনঙ্গ সেনের।
টেবিল থেকে কিং সাইজ সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে একটা সিগারেট ধরালেন। হ্যাঁ, এটাও তাঁকে দেওয়া বন্ধুর উপহার। না হলে ছোট মাপের, ছোট আয়ের মানুষ অনঙ্গের ছোট মাপের সিগারেটেই দিব্যি চলে যায়। এই একটা ব্যাপারে কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ করে কোয়ান্টিটিকেই প্রাধান্য দেন অনঙ্গ। সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেই দামী তামাকের মৃদু সুগন্ধ বুঝিয়ে দিলো ‘মুড়ি মুড়কি দোকানে পাশাপাশি বস্তায় থাকলেও একই দামে বিকোয় না’।
ঘুম আসছে না। এটাও নতুন কিছু নয়, শেষ রাতে যখন ভোর ফুটি ফুটি করে গুটি গুটি টালমাটাল পায়ে শিশুর মতো বেরিয়ে আসে, তখন অনঙ্গ ঘুমোতে যান। পাখির ডাকে দিন শুরু হবার সময়ে অনঙ্গ দিন শেষ করেন। ঘরের গুমোট গরম থেকে দরজা খুলে ছাদে এসে দাঁড়ান। মেঘমুক্ত নীল আকাশ এখন আর কলকাতায় বা মফসসলে কোথাওই দেখা যায় না, সবটাই ঘোলাটে, শহুরে মানুষের মনের মতো। তার জন্য পাহাড়ে যেতে হয়। কিন্তু রাতের আকাশে মেঘ নেই আর একটা আস্ত গোল, প্রায় পূর্ণ যুবতী হয়ে ওঠা চাঁদ আকাশে জ্বলজ্বল করছে। দুটো একটা পাখি ভোর হয়েছে ভুল করে ডেকে উঠলো। চাঁদ দেখে অনঙ্গর মাথায় কবিতার দু এক ছত্র উঁকি দেয়…
‘বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ ডেকে বলেছিলো আমায়…
দুরন্ত যৌবন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
তোরই, শুধু তোরই অপেক্ষায়।
চাঁদের দিকে তাকিয়ে আমি বলি… আমারও তো প্রতীক্ষায় কেটেছে সময়;
তোমার ঠিকানায় আমার ভালোবাসা
রাখা ছিলো যতো;
জ্যোৎস্নাভরা পীনোন্নত
বুকে মুখ রেখে ভেবেছি করবো পান ;
কিন্তু ঐ বুঝি ভোর নেমে আসে
অকরুন নিষ্ঠুর প্রহরীর মতো
বিচ্ছিন্ন করে তোমায় আমায়…
তখনই নৈঃশব্দ্য ভেঙে পাখিদের কলতান বুঝিয়ে দেয়…
সময় পেরিয়ে গেছে,
দূরাগত ধ্বনিতে দখিনা হাওয়ায়
কোনো এক মসজিদে শুরু হয়
ফজরের নামাজী আজান’।
কবিতার লাইনগুলো বেশ মনে ধরে অনঙ্গর।
এখনই লিখে ফেলতে হবে, না হলে সকালের কোলাহলময়তা, জটিল জীবনচর্যা ভুলিয়ে দেবে সবটাই। অনঙ্গ নেমে আসেন ছাদ থেকে। তখনই সোমা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেই বলে, ‘কোথায় গেছিলে তুমি? ঘুমোও নি? কটা বাজে?’ অনঙ্গ কথা বলতে পারেন না। এত কথার উত্তর দিতে গেলে শুধু ছাদ থেকেই নয়, তাঁর কল্পনার জগৎ থেকে, কবিতার জগৎ থেকেও নেমে আসতে হবে।
শুধু বলেন, ‘ঘুমোও। এখনও ওঠার সময় হয়নি।
ঘর পেরিয়ে বারান্দা কাম স্টাডিতে ঢুকে টেবিলের খাতা পেন নিয়ে লিখতে শুরু করেন… (ক্রমশঃ)
🦋কবিতা/৩
সুপ্রভাত মেট্যা
ভাতের জন্মকথা
মায়ের আশ্চর্য হাত
মাটি সরলতার নিপুন ভাস্কর্য হয়ে ফুটে উঠল দাওয়ায়।
আলো তখন খাতা খুলে
তোমার দৃশ্য ভরে দেওয়া গ্রামের সকালবেলায়
নতুন কবিতা তুলছে একটি-দু’টি।
ভাতের প্রশ্ন নিয়ে হাওয়া বইছে তখন।
ঝুঁকে পড়ছে সময়।
আমার মাতন কাকিমা বলে উঠছেন:
ভাতের জন্মকথা অত সহজ নয় জীবন।
তিনি আরও বলছেন: একদিন এতটা অন্ধকার আসবে যে
অদূর ভবিষ্যতে ভাতের সামর্থ্যহীন হয়ে দাঁড়াবে
বিষয়ী মানুষেরাও।
প্রতিটি বয়স মাপা হয়ে দাঁড়াবে মানুষের তখন।
সব থেকেও, তবু তার চলে যাওয়ার ভয়
মানুষকে অন্ধকার করে রাখবে সারাক্ষণ।
নিজস্বতা না থাকলে কি কখনও
টিকে থাকার বয়স ধরে রাখা যায়? তিনি বলছেন।
সুমিত্রা পাল
স্থির চিত্রে জীবন
আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণে
প্রবহমান জীবন একটু থমকে দাঁড়ায়
যেন এক স্থির চিত্র!
এই স্থির চিত্রের পটভূমিকায়
অপসারিত কিছু ছিন্ন মুহূর্ত
সহসা যেন হয়ে ওঠে মনসামঙ্গল কাব্য
লখিন্দরের শব হয়ে ভেসে বেড়ায়
বেহুলার কান্নানদীতে।
হৃদয়ের গহন প্রান্তে চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে
যতই পরিব্যপ্ত থাকুক অনন্ত আকাশ,
স্নিগ্ধ সান্নিধ্য
আর স্পর্শ উপচারের মন্ত্র…
মাঝে মাঝে বিনা মেঘে বজ্রপাতে
সবকিছু হয়ে যায় কেমন এলোমেলো
শুধু দূরে, অনেক দূরে, তুলসী মঞ্চে
নির্বিকার জ্বলে যায়
নিস্তরঙ্গ গৃহস্থ দেউটিখানি।
অষ্টপদ মালিক
লম্বা হাত
সিঁড়ি ভেঙে যত উপর দিকে উঠে যাওয়া যায়
জীবনের অংকটা ক্রমশ কঠিন হয়
যারা যত উপরে বসে আছে
তাদের হাত ক্রমান্বয়ে অধিকতর লম্বা
আর লম্বা হাত দিয়ে তারা লুটে নিচ্ছে
না ফুটে ওঠা ফুলেদের সবুজ প্রাণ।
ক্রমশ অন্ধকার ঘনীভূত হচ্ছে
আগামী ভবিষ্যতের কপালে।
পরাণ মাঝি
কবিতাদের বাড়ি
তেমন করে চোখ রাখা হয়নি তার চোখে
পদ্মপাতায় তাই জল টলোমলো
এক রবিবারের লেজ ধরে সোজা চলে এলাম হাওয়ার বাড়ি
ঘরগুলো সব শব্দের মতো
ঝুল বারান্দায় নদী এসে যেন কথা বলে দেদার
আর পংক্তি পংক্তি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গেলে ভাবনা প্রেমের সে এক অপূর্ব বাস্তব মহিমা
চারদিকে সবুজের কলজে ; অক্সিজেনের ঘণ্টা বাজে সকাল সন্ধ্যে
মাথার ওপর স্তবক স্তবক নীল সাদা কুমারী মেঘ
সাথে-যুবতি দুপুরে মন ভরে মনোহারি ভোজন
এভাবে মনের গাড়ি
অজান্তেই একদিন চলে এল কৈশোরের স্বপ্নে দ্যাখা শ্রেয়সী কবিতাদের বাড়ি
শুধু লেখা হল না- মনোরমা অভিধানের পাতায় পাতায় চন্দ্রবিন্দুর সু-রঙ্গ
কাসেম আলী রানা
তাঁতের শাড়ী
এত টানপোড়নের জীবনে মাস শেষে যা রাখতে পারি, তা একদিন ফুঁলে- ফেঁপে বড় হলে, ভেবে রেখেছি- তোমার জন্য একটা তাঁতের শাড়ী কিনব।
সাদা জমিনে ছোট ছোট নীল ফুলের সবুজ পাড়ের শাড়ী।
ভেবেছিলাম, এই মাসেই বেতন পেলে দুই একদিনের মধ্যে টেরি বাজার গিয়ে অনেক শাড়ীর আড়ত ঘুরে ঘুরে তোমার জন্য আমার পছন্দের তাঁতের শাড়ীটা কিনে ফেলব।
নীলফুল, সাদা জমিন, সবুজ পাড়ের শাড়ীটা শরীরে জড়িয়ে তুমি যখন অভিসারে আসবে,
তখন তোমাকে কাশের বাগানে একখণ্ড আকাশ জন্ম জন্মান্তর পাহারা দিয়ে রাখবে।
তুমি একটা বড় লাল টিপ পরে খোলা চুলে চঞ্চল হরিণীর মতো ছটফট করবে কাশের বনে বনে।
আমিও তোমের এমন রূপে দেখে দেখে নিথর হয়ে থাকবো অনন্ত ছুঁয়ে যাওয়া জীবনে।
হটাৎ করে সেদিন এক বর্ষাতে আমার বুকে কফ বসে গেল।
জ্বর, কাশি শ্বাসকষ্ট, অক্সিজেনের অভাব, কত রকমের কষ্ট সহ্য করে ডাক্তার বাড়ি থেকে যমকে বিদায় দিয়ে আগের জীবনে ফিরে এলাম।
এর মধ্যে আরও কত কিছু হয়ে গেল, তেল, চাল, আটা, পাট, সুতা, সবজির দাম বেড়ে গেল।
চারিদিকে সব শূন্যতা, আমি আগের চেয়ে আরও শূন্য হয়ে গেলাম।
তোমার জন্য তাঁতের শাড়ীটা আর কেনা হল না।
আমার চাকরিটা গেল, তুমিও চলে গেলে অন্য ঠিকানায়।
মন খারাপ করো না মেয়ে,দেখো ; একদিন ঠিকই তোমার জন্য আমি তাঁতের শাড়ীটা কিনে ফেলব!
নীল ফুল-সাদা জমিন-সবুজ পাড়-
হামিদুল ইসলাম
বিচ্ছেদ
সরে যেতে চাইনি
তবু মন খারাপের দিনগুলো আবার ফিরে আসে
বুঝে নিই গাছের শেকড়ে ঘুণ
ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ছে আমাদের
বিষণ্ণ ঘর বাড়ি
পলেস্তেরা খসে পড়ে দেয়ালের
ফুলদানিতে শুকনো ফুল
বৃষ্টি নেই
বিবর্ণ মেজাজ
যা চাই না তাই হয়
কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম
আমি সয়ে নিই বিষণ্ণতা অন্ধকার
তবু মনে হয় আমাদের বিচ্ছেদ অনিবার্য
মিতা নূর
আবু সাঈদ
আবু সাইদ তুমি শিখিয়ে গেলে,
দেশপ্রেমের শব্দ।
অনুভূতি রয়ে বিশ্বাসে,
মিথ্যেরা হয় জব্দ।
আবু সাইদ তুমি দিয়ে গেলে,
নিত্যদিনের যন্ত্রণা, বিষাদ ভরা বুকে।
প্রতিনিয়ত হয় দেহের মরণ,
অগ্নি জ্বলে চোখে।
দেবাশিস সাহা
বাড়ি ও বিজ্ঞাপন
আর পাঁচ জনের মতো
আমাদেরও বাড়ি হয় অবশেষে
কে যেন এসে বলে যায়
বাড়িতে সবসময়ের থাকা বধির মা’কে
নীল সাদা রঙ করে দেবে
বিনা পয়সার রঙ করা বাড়িটা
দূর থেকে মনে হয়
সরকারি হাসপাতাল
আমি নীল সাদা দেয়ালের পাহারাদার
প্রতি মুহূর্তে চিৎকার করছি
এখানে কেউ বিজ্ঞাপন মারিবেন না।
🦋গল্প /২
এই দ্বীপে চার হাজার পুরুষ যারা নারী মুখ দর্শন করেনি শৈশবের পর থেকে। এদের বিশ্বাস, সাধনা চলাকালীন নারীদর্শন মহাপাপ। ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত দ্বীপটিব চর্তুদিকে সশস্ত্র প্রহরী। এজেন সাগরের উপর এই দ্বীপটি সোলেনিকা শহড় থেকে ২৪০ মাইল দূরে। গ্রীস প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন মূল দ্বীপের নাম মাউন্ট এথোস। শ্রী কুণাল কান্তি দে -এর গল্প ‘সবুজ দ্বীপের রাণী’
সবুজ দ্বীপের রাণী
শ্রী কুণাল কান্তি দে
চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবার হুকুমনামা পেয়ে চমকে গেছে চার্লি। প্রধান স্বামিজীর কাছ থেকে চিঠি এবং ছবি দেখতে দেখতে ক্ষোভে দুঃখে উন্মত্ত হয়ে উঠল। এতবড় প্রতারণা। চার্লি জানে তাকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এই দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যেতে হবে অনিশ্চিতের মধ্যে, তারই সামান্য গাফিলতিতে নারীবর্জিত দ্বীপে নারীর পদার্পণ হয়েছে। দীর্ঘ এক হাজার সাতশো বছরের সাধনা এই প্রথম ধাক্কা খেলো। কেননা, যে দ্বীপে প্রায় দুহাজার বছর ধরে কোনও নারীর পদার্পণ হয়নি; রক্ষীবাহিনীর ভুলে নারীর প্রবেশ; শতাব্দীর কলংকময় ঘটনা ছাড়া আর কি হতে পারে? সাধনা বিঘ্নিত হতে পারে বলেই চরম শাস্তি স্বরূপ দ্বীপ্ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আদেশ জারি হয়েছে। এই অপমান ভয়ঙ্কর। শরীরের লোমকূপে অসহ্য জ্বালা। উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠছে চিঠিটা পড়ে। স্বামীজীর চিঠির নীচে ছবি সহ নারীর চিঠিটি –
সুহৃদ চার্লি,
তুমি ভীষণ বুদ্ধিমান এবং চালাক হয়েও একঘণ্টা আলাপে বুঝতে পারলে না আমি কিশোরী? কিশোর এক সহ নাবিকের পোশাক পরে তোমাদের সঙ্গে কাটালাম। তোমার সুক্ষ চোখকে ফাঁকি দিয়ে তোমার নিবিড় সান্নিধ্যে ছবিও তুলেছি। পুনরায় ফিরেও এসেছি। তোমাদের বিধি নিষেধের বেড়া ভেঙ্গে দিলাম এবং বিশ্ববাসীকে জানিয়েও দিলাম আমার ওই কৃত্তিত্বের কথা। তোমাদের আশ্রমের চার দেওয়ালের গণ্ডীতে প্রবেশ করে, প্রাচীন ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে দিলাম কি বল? পৃথিবীতে এমন কোনও ভূ-খণ্ড নেই যেখানে নারীর প্রবেশাধিকার নেই। তবে তোমাদের ভূ-খণ্ডেই বা থাকবে কেন? এই জিদ আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। পৃথিবীতে এমন পুরুষ আছে কি, যে নারীর গর্ভে জন্ম নেয়নি? তোমাদের মঙ্গল কামনা করে আজ শেষ করলাম। ঠিকানা সহ শুভেচ্ছা।
মিস্ ডিপলার-কো।
দ্বীপ ছেড়ে যেতে হবে এই যন্ত্রনায় কাতর চার্লি। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সমস্ত দ্বীপের ছবি।
কেনিথ এথোস। পৃথিবীর এক আশ্চর্য দেশ। ভৌগলিক নাম এথোনিক রিপাবলিক। ছবির মতো সুন্দর ভূ-খণ্ড এই দ্বীপে নারীকুলের প্রবেশ কঠোরভাবে নিষেধ। ১৭০০ বছর ধরে এ প্রথা চলে আসেছে। এই দ্বীপে চার হাজার পুরুষ যারা নারী মুখ দর্শন করেনি শৈশবের পর থেকে। এদের বিশ্বাস, সাধনা চলাকালীন নারীদর্শন মহাপাপ। ইউরোপ মহাদেশে অবস্থিত দ্বীপটির চর্তুদিকে সশস্ত্র প্রহরী। এজেন সাগরের উপর এই দ্বীপটি সোলেনিকা শহড় থেকে ২৪০ মাইল দূরে। গ্রীস প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন মূল দ্বীপের নাম মাউন্ট এথোস। ব্রহ্মচর্য এবং কৃচ্ছ সাধনের মাধ্যমে পরম করুণাময়কে পাওয়ার জনাই সাধনা। এখানে নারী পুরুষ মিলনের সম্ভাবনা নেই। নারী অনুপস্থিত যেখানে সেখানে শিশু ভূমিষ্ট হবে না। অথচ পুরুষ চাই ধর্ম ও আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য। তাই গ্রীসের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাল্যবস্থায় অবৈধ শিশুদেরই নিয়ে আসা হয়। সভ্যজগতের সঙ্গে যোগাযোগও নেই। বেতার দূরদর্শন এমনকি সংবাপত্র প্রবেশের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। দ্বীপে পুরুষদের প্রবেশাধিকার থাকলেও সন্দেহ হলে শারিরীক পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। নারীর লেলিহান শিখা পুরুষের কামনাকে উস্কে দিতে পারে বলেই এত সতর্কতা।
– কি এত ভাবছো চার্লি। অগ্রজ সহকারী ইমারসনের ডাকে চার্লি বাস্তবে ফিরে আসে। এতক্ষন দ্বীপের চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিল সে। ছদ্মবেশী কিশোরীর স্মৃতি বারবার ফিরে আসেছে তার মনে।
-তেমন কিছু ভাবছি নাতো। সুখ অতীতে ডুব দিয়ে জাবর কাটছিলাম। চার্লির সংক্ষিপ্ত উত্তর।
২.
অতীত জানা আমাদের কাজ নয়। পরম করুণাময়কে পাবার লাভে এগোতে হবে। আধ্যাত্ম জগৎ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প রাস্তা নেই। প্রধান স্বামিজীর আদেশ তোমায় মানতেই হবে। দ্বীপে বাস করার যোগ্যতা অর্জনে তুমি ব্যর্থ। লোকালয়ে তুমি ফিরে যাও।
ইমারসনের কথাগুলোতে কেমন যেন বিষ। মরে মধ্যে প্রচণ্ড এক আলোড়ন। ক্ষোভে যন্ত্রণায় উন্মত্ত চার্লি। এক কিশোরীর হঠকারিতার জন্য কাল প্রত্যুষে তাকে দ্বীপে ছেড়ে যেতে হবে। ত্যাগ, মায়া, মমতা, করুণার পরিবর্তে তার মনে জন্ম নিয়েছে প্রতিহিংসার বীজ। প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহায়বদ্ধপরিকর চার্লি। যেমন করেই হোক সমুদ্রের ওপারে পৌঁছে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করে কৈফিয়ৎ নেবে কোন্ অপরাধে তাকে এত বড় শাস্তি পেতে হল? নির্জন শান্ত দ্বীপ ছেড়ে তার নির্বাসন লোকালয়ের মাঝখানে।
ঝললে সূর্যের আলো জাহাজের ডেকে আছড়ে পড়েছে। কেমন বিস্বাদ লাগছে সমস্ত প্রকৃতিকে। মিনিট কয়েক আগে চিরজীবনের মতো দ্বীপ ছেড়ে পাড়ি দিয়েছে চার্লি অজানার উদ্দেশ্যে। মিস্ ডিপলারকোর ঠিকানা সহ তার ছবি। স্মৃতি ধূসর তবু কেমন যেন সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে কিশোরীর সঙ্গে। অহরহ তারা চিন্তায় মনটা আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে। লোকালয়ের জনারণ্যে কোনদিনই সে আসেনি। বাকী জীবনটা কোথায় কীভাবে কাটাবে কিছুই মাথায় আসছে না। ভাবনায় পোকাগুলো মাথার মধ্যে কিলবিল করছে শুধু… হঠাৎ জাহাজের চিৎকারে ঘুমন্ত চার্লি জেগে উঠল।
আকাশ পাতাল ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল এতক্ষণ।
**
নূতন পৃথিবীর বুকের উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলেছে চার্লি। কোলাহল আর কলরব। পরমকরুণাময়ের কি অপূর্ব সৃষ্টি স্বর্গ তবে কি লোকালয়ের মাঝখানে? বিচিত্র পোশাকে বিচিত্র মানুষ। চোখ যেন বঝলসে যাচ্ছে। কবে কোন্ দুর অতীতে এই শহরে তার জন্ম হয়ে ছিল অবৈধভাবে সে জানে না। হয়ত কোনও সহৃদয় ব্যক্তি স্বামীজীদের হাতে তুলে দিয়েছিল লালন পালনের জন্য সে ইতিহাসও জানে না। সে পৃথিবীর কোমল স্নিগ্ধ রূপ দেখে মুগ্ধ। এখানে নেই বিধি-নিষেধের বেড়া। কিশোর কিশোরী যুবক যুবতীদের অবাধ চরণ। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছে চার্লি। এখানেই বুঝি মানব জীবনের চরম পূর্ণতা। মনে প্রশ্ন আসে তবে কেন নারী বর্জিত দ্বীপের প্রয়োজন? আধ্যত্ম সাধনায় পরমকরুণাময়ের কৃপা লাভ কি এই লোকালয়ে সম্ভব নয়? মাটির দুনিয়ায় যদি স্বর্গ কোথাও থাকে তবে এইখানে তা এইখানেই।
‘অগর ফীরদূস্ বাররুই জমীনস্ত
হামেনস্ত উহামেনস্ত উহামেনস্ত।’
কবিতার লাইন দুটো আওড়াতে থাকে চার্লি।
দেখতে দেখতে দু’টোদিন কেটে গেছে। ঠিকানাটা গ্রঙ্গে নিয়ে তৃতীয়দিনে আবার শুরু করে পথচলা কিশোরী নারীর খোঁজে। তার জীবনের ধারা যে বদল করেছে তার মুখোমুখি হতেই হবে। দুটো দিনে পৃথিবীর বিচিত্র রঙ দেখলেও মনটা শান্ত হয়নি। পথ চলতি মানুষদের ঠিকানাটা দেখায় এবং এগিয়ে চলে মিস্ ডিপলারকোর সন্ধানে।
বিশালাকার বাড়ির সামনে প্রশস্ত বাগান। নেম প্লেটে অনেকের নামের সঙ্গে কিশোরীটির নাম দেখে চোখে ঝলসে উঠে। মুখটা কেমন যেন কঠিন কঠোর হয়ে উঠে। ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢোকে। ক্লান্ত অবসন্ন গৈরীক বসনধারীকে বাড়ির মালী ড্রইংরুমে আপ্যায়ণ করেন। চার্লি এক টুকরো কাগজ এগিয়ে ডিপলারকোর সাক্ষাৎ প্রার্থী হতে চান। সুসজ্জিত ঘরের চারদিকে চোখ বুলায়। প্রহর গোনে অধীরভাবে। ভিতরের প্রতিহিংসা জেগে উঠে। পরক্ষনে ভয় লোকালয়ের লোকাচার জানে না। মাসিক যন্ত্রনায় বিধ্বস্ত চার্লি ঘেমে উঠে। হঠাৎ জুতোর শব্দে প্রকৃতিস্থ হয় মুখ তুলে তাকায়। আগন্তুক কিশোরীকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখে চার্লি।
পরনে স্বর্গের পরীদের পোশাক। অদ্ভুত এক মহিলা গন্ধ নাখে এস লাগে। কিশোরীর চোখ দু’টিতে স্বপ্নালু দৃষ্টি। কিশোরীটিও থমকে দাঁড়ায়। কয়েক মুহূর্ত নীরবতা। গভীর দৃষ্টি বিনিময় দু’জনের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী যেন গতিবেগ হারিয়ে অসীম স্তব্ধতায় ডুবে গেছে। নিঃশব্দে চার্লি চিঠিটা এগিয়ে দেয় ডিপলারকোর হাতে। যে কারণে তাকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে দ্বীপ থেকে। গ্রোগ্রাসে চিঠিটা পড়তে থাকে ডিপলারকোর চোখের সামনে ভেসে উঠল। দ্বীপের ছবি; বান্ধবীদের সঙ্গে বাজী রেখে নিবিড় দ্বীপের মাটিতে পা রাখতে চেয়েছিল, এর বেশি কিছু নয়। অথচ তার খামখেয়ালীর জন্য একজন সারাজীবনের মত অনাথ নিঃসঙ্গ হয়ে গেল এর জন্য দায়ী তো সে নিজেই। ক্রমশ পাপবোধের জালায় মনটা বিক্ষত হতে শুরু করল। দেহমন অসহ্য পীড়ায় পীড়িত। এত প্রতারণা। অনুশোচনায় দগ্ধ অনুশোচনায় দগ্ধ হতে থাকল। মুখটা সামান্য তুলতেই চার্লি প্রশ্ন রাখল।
-আপনি কিছু বলুন।
কী উত্তর দেবে ডিপলারকো? তার জীবন যৌবন ছাড়া এত বড় ক্ষতি পূরণের আর কিই বা থাকতে পারে? বিদেশীর রক্তে তবে কি কাঁপন ধরিয়ে দেবে? আশমানের তারার মতো খুবসুরৎ রোশনীদার যদি নিঃশেষে নিঙড়ে দেয় তবে স্বর্গের আর দরজা হয়ত খুলে যাবে চার্লির জীবনে। কড়বে ফ্রি তো? 🍁
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব, সুচিতা সরকার ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
