



সম্পাদকীয়ের পরিবর্তে…
বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হল সত্যকে উপলব্ধি করা। বুদ্ধ বলেছেন, সমুদ্রের যেমন একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ লবণ, আমার ধর্মেরও তেমনি একটিমাত্র লক্ষ্য এবং তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা। বুদ্ধের মতে, মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে। জন্মলাভ করে জীবকে কর্ম করতে হয়। কর্ম থেকে আসে ‘আসত্তি’। আসত্তি নিয়ে আসে ‘দুঃখ’। পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই দুঃখ ভোগ করতে হয়। কর্মফলজনিত পুনর্জন্ম রদ করে দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভের একমাত্র পথ হল কামনা, বাসনা ও আসক্তি ইত্যাদি দূর করা।
গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বৌদ্ধধর্ম
বুদ্ধের জীবনী: আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ অব্দে কপিলাবস্তু নগরের কাছে ‘লুম্বিনী’ উদ্যানে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জন্ম হয়। তাঁর পিতা শুদ্ধোধন ছিলেন ক্ষত্রিয় শাক্য-জাতির রাজা। তাঁর মাতার নাম মায়াদেবী। বুদ্ধের বাল্য নাম সিদ্ধার্থ। বাল্যকালেই তাঁর মা মারা গেলে বিমাতা ও মাতৃম্বসা গৌতমী তাঁকে লালনপালন করেন। তাই তাঁর আর-এক নাম গৌতম। মাত্র ষোলো বছর বয়সে গোপা বা যশোধরা নামে এক রাজকন্যার সঙ্গে গৌতমের বিবাহ হয়।
বাল্যকাল থেকে সংসারের ভোগবিলাসের প্রতি গৌতম উদাসীন ছিলেন। মানব-জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়তই তাঁকে পীড়া দিতে থাকে এবং কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই চিন্তাতেই ব্যাকুল ছিলেন। অবশেষে ২৯ বছর বয়সে যেদিন তাঁর পুত্র রাহুলের জন্ম হয়, সেদিনই রাত্রে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। বৌদ্ধগ্রন্থে তাঁর গৃহত্যাগের ঘটনা মহাভিনিষ্ক্রমণ নামে খ্যাত।
বুদ্ধত্ব বা বোধিসত্ত্ব লাভ: গৃহত্যাগের পর গৌতম আলারা কালামা নামে এক ঋষির শিষ্যত্ব নেন। তাঁর কাছে ধ্যানের পদ্ধতি ও উপনিষদের ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভের সঠিক পথ সম্বন্ধে তাঁর জিজ্ঞাসা তখনও অপূর্ণ থেকে যায়। তাই ওই ঋষির সঙ্গ ত্যাগ করে গৌতম পাঁচজন তপস্বীর সঙ্গে যোগ দেন। এঁদের সঙ্গে তিনি কঠোর কৃষ্ণসাধনে রত হন। ক্রমে তিনি একটি চলমান কঙ্কালে পরিণত হন। কিন্তু তবুও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, কেবল শরীরকে কষ্ট দিয়ে প্রকৃত সত্য উপলখি সম্ভব নয়। অতঃপর তপস্বীদের সঙ্গ ত্যাগ করে বর্তমান বুদ্ধগয়ার কাছে উরুবিল্ব নামক স্থানে এক অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। একাসনে যোগারূঢ় অবস্থায় ৪৯ দিন থাকার পর তিনি বোধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। এই সময় থেকে তিনি বুদ্ধ (জ্ঞানী) এবং তথাগত (যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন) নামে পরিচিত হন। যে স্থানে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন তার নাম হয় ‘বোধগয়া’ বা ‘বুদ্ধগয়া’ এবং যে বৃক্ষটির নীচে ধ্যানরত হয়ে তিনি বুঝত্ব অর্জন করেন তার নাম হয় ‘বোধদ্রুম’ বা ‘বোধিবৃক্ষ’।
গৌতমবুদ্ধের ধর্মমত: বুদ্ধত্ব লাভ করার পর বুদ্ধ বারাণসীর কাছে সারনাথে পঞ্চভিক্ষু অর্থাৎ পাঁচজন শিষ্যের কাছে তিনি তাঁর ধর্মমত বিতরণ করেন। এই ঘটনা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। এরপর ৪৫ বছর ধরে তিনি কাশী, কোশল, মগধ প্রভৃতি স্থানে ধর্মপ্রচার করেন। মগধরাজ বিম্বিসার, অজাতশত্রু, কোশলরাজ প্রসেনজিৎ-সহ বহু পুরুষ ও নারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অবশেষে প্রায় ৮০ বছর বয়সে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেন (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ)। একদিন বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী উদ্যানে যে মহাজীবনের সূচনা হয়েছিল, ৮০ বছর পর আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা ঔ তিথিতে তার অবসান ঘটল। এই ঘটনা ‘মহাপরিনির্বাণ’ নামে খ্যাত।
আর্যসত্য: বুদ্ধ সহজ ও সরল ভাষায় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হল সত্যকে উপলব্ধি করা। বুদ্ধ বলেছেন, সমুদ্রের যেমন একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ লবণ, আমার ধর্মেরও তেমনি একটিমাত্র লক্ষ্য এবং তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা। বুদ্ধের মতে, মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে। জন্মলাভ করে জীবকে কর্ম করতে হয়। কর্ম থেকে আসে ‘আসত্তি’। আসত্তি নিয়ে আসে ‘দুঃখ’। পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই দুঃখ ভোগ করতে হয়। কর্মফলজনিত পুনর্জন্ম রদ করে দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভের একমাত্র পথ হল কামনা, বাসনা ও আসক্তি ইত্যাদি দূর করা। এজন্য বুদ্ধদেব মানুষকে চারটি ‘আর্যসত্য’ উপলব্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন। চারটি আর্যসত্য হল – (i) জগৎ দুঃখময়, (ii) কামনা বাসনা ও আসক্তি থেকেই দুঃখের সৃষ্টি হয়, (iii) দুঃখের কারণ গুলি ধ্বংস করে দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং (iv) এই কারণগুলির ধ্বংসের উপায় আছে।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ: মানুষকে আসক্তিমুক্ত হয়ে নির্বাণলাভের জন্য বুদ্ধ আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে বলেছেন। এই আটটি পথ হল–সং বাক্য, সৎ-কর্ম, সৎ-সংকল্প, সং-চেষ্টা, সৎ-জীবিকা, সং-চিন্তা, সৎ-চেতনা ও সৎ-সমাধি।
বুদ্ধের মতে, চরম ভোগবিলাস ও চরম কৃচ্ছ্রসাধন, এই দুই পন্থাই আত্মার উন্নতিতে বিঘ্ন ঘটায়। তাই এই দুটি চরম পন্থা পরিত্যাগ করে মানুষকে যে মধ্যপন্থা অনুসরণের নির্দেশ তিনি দিয়েছেন তাকে ‘মঝ্ঝিম পন্থা’ বা ‘মধ্যপন্থা’ বলা হয়।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও মধ্যপন্থা ছাড়াও বৌদ্ধধর্মে কয়েকটি নৈতিক উপদেশও দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল— (1) পঞ্চশীল অর্থাৎ অহিংসা, পরধন আত্মসাৎ না করা, ব্যভিচারী না হওয়া, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা না বলা। (ii) সমাধি অর্থাৎ মনঃসংযোগ এবং (iii) প্রজ্ঞা অর্থাৎ অন্তদৃষ্টি।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ: বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর কোন বাণী লিপিবদ্ধ হয় নি। তাঁর নির্বাণ লাভের কয়েক সপ্তাহ পর মগধ রাজ অজাতশত্রুর উদ্যোগে বুদ্ধদেবের শিষ্যরা মগধের রাজধানী রাজগৃহ সম্মেলনে (বৌদ্ধ সংগীতি) মিলিত হয়ে তাঁর উপদেশাবলী পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। পালি ভাষায় রচিত এই ধর্মগ্রন্থের নাম ‘ত্রিপিটক’। ‘পিটক’কথার অর্থ পাত্র বা ঝুড়ি।বৌদ্ধ শাস্ত্রের তিনটি ভাগ—তাই ত্রিপিটক। ত্রিপিটক হল : সূত্ত-পিটক, বিনয়-পিটক ও অভিধর্ম-পিটক। সূত্ত-পিটকে বুদ্ধের উপদেশাবলী, বিনয়-পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের পালনীয় বিধিসমূহ ও সঙ্ঘের নিয়মাবলী এবং অভিধর্ম-পিটকে বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বসমূহ আলোচিত হয়েছে।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের অভ্যন্তরে বা মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে বৈশালী (৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), পাটলিপুত্র বুদ্ধদেবে (২৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক-এর উদ্যোগে) ও কাশ্মীরে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি আহ্বান করা হয়। কুষাণ-রাজ কণিষ্কের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বা শেষ বৌদ্ধ সংগীতির অধিবেশনে বৌদ্ধরা মহাযান ও হীনযান নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। যে সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধরা নিরাকার বুদ্ধের উপাসনা করতেন তাঁরা হীনযান নামে পরিচিত। যে সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধরা বুদ্ধের মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা মহাযান নামে পরিচিত। 🍁
[ঋণ : সহজ এক্সাম ডট ইন- থেকে পুনঃ প্রকাশ করা হল। লেখাটির বানান সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত। -সম্পাদকমণ্ডলী ]
🍂কবিতা /এক
তাপস রায়
‘ক্রমে আলো নিভিয়া আসিতেছে’
আমি এক নষ্ট সারেং। জল ও মাটির টানাটানি চিহ্ন নিয়ে ভেসে আছি
কত কি হিসেব রাখি- কুলির সর্দার, ক্যাপ্টেন, বন্দরের মালবাবু
প্রত্যেকের আলাদা হিসেব। আমার হাওয়ারা নোনাকথা বয়ে আনে
আমাকে শিখতে হয় খচ্চরের চোখের চাউনি আর সবজান্তা হাসি
এ-দেহ ভৌতিক হয়, দূরে রাখি যমুনার বাঁশি
এক একটা রোদের আয়ু আমি চিনি। ভ্রমতৎপর হাতছানি থাকে
যেহেতু জলের ধ্বংসস্তুপের সাথে যোগসাজসরত
ঘৃণা ও থুতুরা উত্তালতা পেলে আমি খুব দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর মতো
আনত ভঙ্গিকে নিই, চা-বিস্কুটের পাশে তাদেরও টেনে এনে
শান্ত করি, আমার ফুসফুসে গোলাবারুদেরা জমা হতে থাকে
এতদিন বাদে দূর-দূরান্ত হারিয়ে ফেলেছি যেই, স্মৃতি ছাড়খার করে
সটকে পড়েছে যেই স্মৃতিকীট আমি শীতকাল মেলে লেপ ও তোষক
খুনসুটি দেখি, আমের মুকুল ধরা চোখে পড়ে
অমলেন্দু বিশ্বাস
জাগতিক
মাথাটা এলানো থাকে পেছনের দিকে
অথচ গাড়িটি চলে পশ্চাদ্ অভিমুখে।
চেয়ার কারের সিট, মৈত্রী এক্সপ্রেস-
নিয়ে যাচ্ছে আমাকেও হিমানী সকালে।
ডানের কোনার সিটে জিন্স পরা মেয়েটি
আশ্চর্য ঘুমের পাশে বিস্রস্ত কুন্তল
চূর্ণরাশি মুখপাশে চেয়েছে সোহাগ!
কী করে বুঝলে তার আদুরে গালের পাশে
সকালের রাঙা আলো ঝুলে আছে
আমার আঙুল স্পর্শে বিমর্ষবিহীন
ঘুম ছেড়ে জেগে ওঠা অক্ষয় অক্ষর।
মাথাটা এলিয়ে গেলে দৃশ্যমান গাছপালা
ক্রমান্বয়ে সরে যেতে যেতে পেছনের
পর্দার মতন লৌকিক আড়ালে ঢাকে
আমাদের যাবতীয় জাগতিক মায়ারাত!
আমিনা তাবাসসুম
রাহুগ্রস্ত প্রেম ও সংকরায়ণ
ছুটন্ত ট্রেনের ভেতর অনন্তের ডাক থাকতে পারে না
অথচ বাইরের ফেলে ফেলে আসা রাজপথ
ঘর সংসার আলো রেখে
আমরা অনন্তের ডাক শুনছি
সীমার একধাপ নিচে থেকেই
আকাশ এখন শুভ্র নীল চাদর বিছিয়ে রেখেছে
যেন তোমার কোমল হৃদয়ের কোথাও
আঘাত না লাগে
অভাব না বোঝ
তোমার ঠোঁটের পাড়ে ছুঁয়ে যাওয়া
অদ্ভুত মোলায়েম হাসি
স্টেশনের স্থিরতায় দাঁড়িয়ে থাকতে শেখেনি
আর শেখেনি বলেই
তোমার কাছে এলে বুঝতে পারি
প্রেমে মিলিয়ে যাবার কোনো আশঙ্কা নেই
থাকতেও পারে না
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস /পর্ব ৫
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পাঠকদের জন্য পেশ করা হল পঞ্চম পর্ব।
একটি বিষণ্ণ রাতের তারা
তৈমুর খান
পাঁচ.
“আমাদের বেঁচে থাকার জীবনও একটি প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা”
দুঃখের সংসারে একবেলা ভাত হয় তো আর এক বেলা উপোস দিতে হয়। বাবা সারাদিন মজুর খেটে সন্ধ্যায় ফেরে। কোনো কোনো দিন আমাকেও যেতে হয় মজুর খাটতে। মজুর খাটতে গিয়ে প্রতিমার সঙ্গে দেখা হলেই ভীষণ লজ্জা লাগে। টেস্ট পরীক্ষার পর স্কুল প্রায় যাওয়া বন্ধ। তাই সুযোগ পেলে বাবার সঙ্গে কাজ করতে যাই। রাস্তাঘাটে দেখতে পেলে প্রতিমাকে এড়িয়ে যাই। একবার ঘাটে থালা-বাসন মাজার সময় আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হেসেছিল। নিঃশব্দ সেই হাসির মাধুর্য আমি ভুলতে পারিনি। কিন্তু কেন হেসেছিল? সে উত্তরও বের করতে পারিনি। দীর্ঘ চিঠি লিখেও তার কাছে পৌঁছানোর সাহস হয়নি। আমার মুগ্ধতার কথা তাকে কোনোদিন বলতেও পারিনি। বাড়ি ফিরে এসে কতবার ভেবেছিলাম তার কথা। একটা ছোট্ট কবিতায় লিখেছিলাম:
বলতে গিয়েও হয়নি বলা
সেদিনের সেই গোপন কথা
কতই না ছিল ভালোলাগা!
একটি গানের সুরেই তুমি
বইয়ে দিলে ঝরনাধারা।
স্বপ্নেই সেদিন এসেছিলে
আকাশে হয়েছিলে তারা
তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
একটা পথিক দিশেহারা।
স্বপ্ন যে স্বপ্নেই থেকে গেছে তা কোনোদিন প্রকাশ পায়নি। কত পঁচিশে বৈশাখ এসেছে, কত অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে দিন। কিন্তু কৈশোরের ওই একটি পঁচিশে বৈশাখ কিছুতেই ভুলতে পারিনি।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। দ্রুত সাইকেল চালাতে গিয়ে পিছল রাস্তা পার হয়ে যেতেই পড়ে গেলাম গোবর সার ফেলা একটি গর্তে। সাইকেলসহ আমি প্রায় ডুবে গেলাম। বইপত্তর সব পচা জলে ভিজে একসা। আমার এই অবস্থা দেখে সেদিনও সবাই খুব হাসাহাসি করলো। মারাত্মক অপমানিত বোধ করে বাড়ি এসে কাঁদতে লাগলাম কিন্তু কাউকেই বলতে পারলাম না। খালের নোংরা জল এত দুর্গন্ধময় ছিল যে ভালো করে স্নান করেও শরীর থেকে গন্ধ দূর হলো না। পরের দিনই ভীষণ জ্বরে আক্রান্ত হলাম।
জ্বরের ঘোরে মনে হতে লাগলো—একটা বড় শিংওয়ালা ষাঁড় আমাকে তেড়ে আসছে। খুব ছোটার চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই ছুটতে পারছি না। বারবার পড়ে যাচ্ছি। ষাঁড়টি এগিয়ে আসছে….ছেড়ে দাও আমাকে….যেতে দাও….এখনই মেরে ফেলবে!
মা মাথার কাছে বসে একটা ন্যাকড়া ভিজিয়ে বারবার মুছে দিচ্ছে। প্রচণ্ড তাপ। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠেছি—কেন ওরা হাসে? আমি আর স্কুল যাব না!
—বাবা, অমন করে না! গা পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। ওষুধ আনতে গেছে, এখুনি চলে আসবে!
কিন্তু মায়ের সান্ত্বনা কিছুতেই কানে ঢুকছে না। কতক্ষণ এভাবেই বকাবকি করেছিলাম তা আর মনে নেই। অবশেষে বাবা ওষুধ এনেছিল। দুটাকার মিক্সচার ওষুধ। যতবার পান করতাম, গলা থেকে পেট পর্যন্ত যেতে যেতে জ্বালা করতো। প্রায় সাতদিন পর শয্যা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শরীর একবারেই অচল হয়ে পড়েছিল। পেঁপে সেদ্ধ দিয়ে ভাত খেতে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুই খেতে পারিনি। দুর্বল শরীরে এমনি করেই কয়েকদিন কাটতে লাগলো।
এমনি সময়ে একদিন একটা কালো বেটেখাটো লোক আমাদের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। এর আগে কখনো ওকে দেখিনি। মাকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটি কে মা?
মা বললো, তোর বোনের বিয়ের জন্য এসেছে। বিয়ে দেবো না বলেছি, এখনো মেয়ের বয়স হয়নি, তবু নাছোড় বান্দা। কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না!
আমি আর কী বলবো কিছুই ভেবে পেলাম না। আমার তখন বয়সপনেরো বছর পার হয়েছে আর বোনের বয়স এগারো। লম্বা ছিপছিপে গড়ন। স্কুলে পড়লে ষষ্ঠ শ্রেণি হতো। কিন্তু নুন আনতে পান্তা ফুরোনো ঘরে মেয়েদের পড়াশোনা বিলাসিতা ছাড়া কিছু নয় এরকমই ভাবনা ছিল সেইসময়ের। তাই অসময়েই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল। সংসারের কাজে নানা ফাইফরমাস খাটতে শুরু করেছিল। তাই দেখতাম গাছের ঝরাপাতা কুড়িয়ে আনে, পুকুর ধার থেকে তুলে নিয়ে হেলেঞ্চার শাক। পরের বাড়িতে একবেলা কাজ করেও কয়েক পাই মুড়ি পায়। পুকুর থেকে কলসি কলসি জল তোলে। ওইটুকু মেয়ে হলেও তার অনেক কাজ। তার বিয়ে হয়ে গেলে আমাদের সংসারও প্রায় অচল হয়ে যাবে। মা আরো বলতে লাগলো— মেয়ে দেখে ওদের পছন্দ হয়েছে। তাই বিনাপণেই বিয়ে দিতে চায়। আমি সব বলেছি। আমরা গরিব, এক পয়সাও দেবার ক্ষমতা নেই। তবুও ওরা রাজি হয়েছে।
—তাহলে কি সত্যিই বিয়ে দিয়ে দিবে?
—আমরা একবার দেখবো, আরো পাঁচজনকে জিজ্ঞেস করবো, যদি সেরকম হয় তো দিয়ে দেবো।
সেদিন ওই লোকটি আমাদের বাড়িতে শুধু এক কাপ চা খেয়েই বিদায় নিয়েছিল। কয়েকদিন পরেই আমার বাবা ও এক পিসতুতো দাদা সেই লোকটির ছেলে অর্থাৎ বরকে দেখে এসেছিল। শুধু বরকে দেখে আসাই নয়, রীতিমতো পাকা কথাও করে এসেছিল। বিয়ের পণ হিসেবে একখানা সাইকেল, একখানা হাত ঘড়ি এবং নগদ চারশত টাকা কবুল করে এসেছিল।
১৯৮৩ সালে মাত্র এগারো বছর বয়সেই বোনটির বিয়ে হয়ে গেল। সেই সময় এক টাকাও বের করার সামর্থ্য ছিল না আমাদের। মায়ের নামে মাত্র তিন শতক জমি ছিল। সেই জমিটিই বিক্রি করতে হয়েছিল। তাতেই সমস্ত বিয়ের দেনাপাওনা মিটেছিল ঠিকই, কিন্তু বিয়ের খরচের জন্য অনেক ধারদেনা করতে হয়েছিল। অবশ্য এপাড়া ওপাড়া মিলে কিছু চাল-গম দিয়ে অনেকেই সাহায্য করেছিল। কাপড়চোপড় কেনার জন্য কেউ কেউ নগদ টাকাও দিয়েছিল।
বিয়ে হয়েছিল আষাঢ় মাসে। সেদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি। বরযাত্রীদের বসার জায়গাও ঠিকমতো হচ্ছিল না। আমাদের পাড়ারই এক বাংলো বাড়িতে তাদের বসতে দেওয়া হয়েছিল। রাত জেগে ভাজা হয়েছিল লুচি ও আলুর দম। কিন্তু বরযাত্রীর সংখ্যা এত বেশি ছিল যে এসবের সংকুলান হয়নি। তারপর মাংস রান্না করতে গিয়ে বাবুর্চি মাংসকে একেবারে গলিয়ে ডালনায় পরিণত করেছিল। বরযাত্রীরা খেতে বসে হাঁকডাকে অনেক কুকথা অকথা শুনিয়ে ছেড়েছিল। কেউ কেউ বলছিল—কোন্ ঘরে বিয়ে করলি ব্যা, খাওয়াইতে পারলে না! মাংস না ডাল খাওয়ালে!
কেউ কেউ বলছিল—যেমন খাওয়ালে, তেমনি খাওয়াবো!
চারিদিকেই হই হই শব্দ। অঝোর ধারায় বৃষ্টি। গ্রামের ছেলেরা ভিজে ভিজেই সবকিছু পরিবেশন করছিল। সেদিন আমিই ঠিক মতো খেতে পাইনি। সবকিছু দেখতে দেখতেই সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। বর-কনেকে একসঙ্গে দেখেও অনেকে অনেক কথাই বলছিল। কনের তুলনায় বরের হাইট বেশ ছোট। গায়ের রংও বেশ কালো। চেহারাতে কোনো জৌলুস ছিল না। তাই যুবকরা হাসতে হাসতে বলছিল—বর তো নয় যেন কোন্ রাখাল! না আছে রূপ, না আছে গুণ, কী দেখে যে বিয়ে হলো কে জানে!
এদের কথার জবাবে আরেকদল বলছিল—গরিবের ঘরে কি ময়ূর চেপে কার্তিক আসবে? যেমন পক্ষী তেমনি বাসা, মানুষের মন ভালো হলেই হলো।
এসব শুনতে শুনতেই আমার মন খারাপ করছিল খুব। কাদা রাস্তায় গরুর গাড়িতে বর-কনেকে চাপিয়ে পেছন দিক দিয়ে প্রায় ঠেলতে ঠেলতেই গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলাম। স্টেশনে গিয়ে ট্রেন ধরাতে হবে। তারপরেই বিশ্রাম। কিন্তু পা আর উঠছিল না। বোনটি কাঁদছিল। আমার চোখেও জল আসছিল বারবার। তখন প্রায় সূর্যও ডুবতে যাচ্ছিল। সেই ম্লান আলোয় আবছা অন্ধকারে সারাদিন না-খাওয়া ক্লান্ত অবসন্ন একটি কিশোর যেন জীবনের কোনো এক গুরু দায়িত্ব পালন করতে চলেছে। বোনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতে হবে। টিকিট কেটে ট্রেনে বসিয়ে দিতে হবে। তারপর আবার পাড়ার এক মোড়লের গরুর গাড়িটি ফিরিয়ে এনে জমা দিতে হবে। কিন্তু আজ যে বোনটিকে এইভাবে বিদায় দিতে চলেছি, কত কষ্টে যে চোখের জলকে থামিয়ে রেখেছি তা বোঝাতে পারবো না। আমাদের কষ্টের সংসারে কতদিন এই বোনটিই সবার মুখে আহার তুলে দিয়েছে। পরের বাড়িতে জল তুলে তার বিনিময়ে এনেছে মুড়ি। পরের জমি থেকে কুড়িয়ে এনেছে কচু শাক ও কচুর লতি। কাটকুঠো কুড়িয়ে এনে জ্বালানির যোগান দিয়েছে। উঠতে-বসতে মায়ের হুকুম শুনেছে। আগামীকাল থেকে এসব কে করবে? আমি স্কুল থেকে ফিরে রোজই বোনটিকে বলতাম আমার কাপড়চোপড় কেচে দিতে। কাল থেকে আর কাকে বলবো? সব ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ভিড় করে আসতে লাগলো আর চোখ দিয়ে ঝরতে লাগলো নীরবে গরম অশ্রু।
গ্রাম থেকে সাদীনপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসতে প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। সাড়ে ছয়টা নাগাদ আজিমগঞ্জ লোকাল আসবে ইতিমধ্যে অ্যালাউন্সও হয়ে গেছে। বরযাত্রীরা হই হই করে চলে এসেছে আগেই। আমি বর-কনের টিকিট কেটে প্লাটফর্মে অপেক্ষা করছি। বৃষ্টি থামলেও আকাশ থমথমে। ভ্যাপসা গরম। আমার এই প্রথম মনে হলো— আমাদের এক একটি বেঁচে থাকার জীবনও এই একটা প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকার মতো। বাঁশি বাজলেই ট্রেন ছেড়ে দেবে। আর আমরা সবাই উঠে যাব। মাত্র এগারো বছর কত মারামারি খুনসুটি করেই কাটালাম। এই সামান্য সময়টুকু! তারপর কোথায় হারিয়ে যাবে বোনটি। আমিও একরাশ অন্ধকার নিয়ে গরুর দুটির ঘাড়ে গাড়ির জোয়াল তুলে দেবো। তারপর বলতে থাকবো— হ্যাট্… হ্যাট্… হ্যাট্… 🍁 (চলবে)
🍂গল্প /এক
ছেলেটি আবার মুচকি হাসে, আর বলে এই তো জীবন রহস্য। এটাই ওর ডেস্টিনি ম্যাডাম। যেমন তোমার আমার এই রাস্তায় ঘর বেঁধে চলা এটাও এক ডেস্টিনি।
ঘরের মধ্যে যে ঘর…
হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
ভাগীরথীর পূর্ব পাড়ে ফরাসডাঙা ঘাট পেরিয়ে বাম দিকে একটি রাস্তা ঢুকে গেছে। প্রচলিত লোকজন যেটিকে ঘোষপাড়া হিসেবেই চেনেন। আদতে সেটি একটি দিয়ার অঞ্চল। যার নাম আমানিগঞ্জ। মাঝেমধ্যেই ওই রাস্তা আমাকে বড় টানে। কেন এত আকর্ষণ জানি না তবে বারবার ওই অঞ্চলের চারপাশ ঘুরে আসতে আমার বেশ লাগে। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্তে এই জায়গার আকর্ষণ যেন কিছুটা বেশি।
বিকেলে অথবা সন্ধ্যা নামার পূর্ব মুহূর্তে ওই জায়গার এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। এক লহমায় সবকিছু ভৌতিক মনে হলেও এখানে দাঁড়িয়ে যুক্তি দিয়ে বোঝা যায় ভূত বলে কিছু নেই। পিচ ঢালা রাস্তার দু’ধারে জঙ্গল। ঝোপঝাড় জাতীয় কিছু গাছের মধ্যে কিছু বড় বট অশ্বত্থ এবং ভেটুলও আছে।পথে ঢুকতেই একটি গাছ দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একটি তালগাছকে আদরে জড়িয়ে আছে একটি শিশুবট। শৈশবে গল্প শুনেছিলাম যদি কোনো সন্তান মায়ের ঋণ শোধ করবার কথা উচ্চারণ করে তাহলে পরের জন্মে এভাবেই বারোটামাস মাকে জড়িয়ে থেকে ঋণ শোধ করতে হয়। কারণ মাতৃঋণ শোধ করা যায় না একথা মুখে উচ্চারণ করাও পাপ। জানি না আসল কারণ তবে কল্পনা করতে ক্ষতি কী! ছোটো ছোটো পার্থেনিয়াম ফুলগুলো দেখতে অনেকটা মহিলাদের নাকছাবির মত। ওই রাস্তায় কিছু পুটুস ফুল আছে রঙ বেরঙের। সাধারণত জঙ্গলে ফুটে থাকা পুটুস ফুলগলোতে হাল্কা গোলাপী, বেগুনী হাল্কা হলুদের কিছু ছোঁয়া থাকে। কিন্তু এখানে রঙগুলো গাঢ় কমলা,লাল, হলুদে মেশানো হঠাৎ একটি নারী চিৎকার করে বলে উঠল-
-অরিন্দম আই এম সরি! ইউ আর রাইট।
-খুব অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অরিন্দম বলল, ফর হোয়াট!
-খুব আদুরে গলায় মেয়েটি বলল আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করেছিলাম তুমি যেদিন আমাকে গুডমর্নিং এ কালারফুল পুটুসফুল পাঠিয়েছিলে, আমি বলেছিলাম এগুলো কম্পিউটারের কারসাজি। আসল রঙের বদলে চোখ ধাঁধানো রং দিয়ে আকর্ষণীয় করার বৃথা চেষ্টা। সমস্ত অরিজিন্যালিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। আসলে এরসঙ্গে আমার শৈশবের অনেক অনেক ছবি জড়ানো আছে। কিন্তু তাকিয়ে দেখো তোমার পাঠানো পুটুসের সঙ্গে সেম কালার।
-উজ্জয়িনী তুমি ভীষণ ইমোশনাল। কতবার বলেছি খোলা চোখে পৃথিবীকে দেখার চেষ্টা কর। এই পৃথিবীতে অনেক ভালো, মন্দ আছে, বিভিন্ন মানসিকতার লোকজন আছে… চোখ খোলো, অনুভব করো তবে তো লিখবে এই পৃথিবীর কথা, এখানকার মানুষের কথা।
-হয়েছে, হয়েছে কিছুমাত্র মাথা নামিয়েছি কী জ্ঞান দেওয়া শুরু। আশেপাশের লোকজন তোমার জ্ঞান শুনতে পাবে। আমি কিছুটা না দেখার ভান করে এগিয়ে গেলাম। বুঝলাম দু’জনেই লেখালেখি করে। মনের মধ্যে কৌতুহল দ্বিগুণ বেড়ে গেল। ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করার অছিলায় খুব ধীরগতিতে চলতে শুরু করলাম।
-আমার তেমন কোনো উদ্দেশ্য ছিল না কিন্তু কৌতুহলের বশেই জায়গাটা ঘুরতে এসেছিলাম।
-কিছুদূর যেতেই মেয়েটি আবার চিৎকার করে ওঠে,” ইউরেকা, ইউরেকা…।
-খুব হাসতে হাসতে ছেলেটি বলল নাহ্লে, ডি কলম্বাসকে এবার মান্যতা দিতেই হয়। চলো তাহলে। ওরা দুজনে সরু একটা আলপথ ধরে গঙ্গার পাড়ের দিকে নেমে যাচ্ছে দেখে আমিও কিছুটা পথ এগিয়ে গেলাম।
-ওখানে মোষ, গরু, ভেড়া আর দু’ একজন ওদের পালক ছাড়া কেউ নেই। শহরের মাঝখানে এত নিরিবিলি পরিবেশ পাব ভাবতেই পারিনি। তুমি যাই বল রেস্তোরাঁর ভিড়ের চেয়ে নিভৃতের এই অভিসার কিন্তু ভেরি ইন্টারেস্টিং! মেয়েটি বলেই চলেছে। সূর্য অস্ত যাচ্ছে সে মুহূর্তে। ছেলেটি তখন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে মেয়েটির লাল টিপের দিকে।
-কি মশাই! পথ হারালেন বুঝি? ছেলেটি মুচকি হেসে উত্তর দিল লেডি কলম্বাস সাথ মে যো হ্যায়। ওদের ওই কথাবার্তা শুনে আমি কিন্তু ওই জায়গায় বসে পড়লাম। সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আজকাল। গল্পের, উপন্যাসের প্লট খুঁজে ফিরি। এমন একটা লোভ সামলাতে পারলাম না। ছেলেমেয়ে দু’টির কিন্তু কোনও দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই এতক্ষণে ওরা হয়তো বুঝতে পেরেছে সম্ভবত আমি এই অঞ্চলের মানুষ। আমিও নিজের ঝোলায় রাখা বইপত্র নিয়ে বসে পড়লাম।
-এই শোনো না আমি তোমার জন্য আজ নিজের হাতে খাবার বানিয়ে এনেছি দ্যাখো না…! যা এনেছো দাও তুমি বিষ আনলেও আমি অমৃত ভেবে খেয়ে নেব!
-মেয়েটি ভ্রু পল্লবে ঢেউ তুলে দিয়ে বললো, “অসভ্যতা হচ্ছে না! আমি তোমার জন্য বিষ আনব, দরকার নেই খেতে হবে না যাও”।
-সুন্দরী রাগলে তোমাকে দারুন লাগে, কেন যে অবুঝ হয়ে ওঠো। ইদানিং কিন্তু তুমি ভীষণরকম অবুঝ হয়ে পড়ছ। ঠিক আছে এই কান ধরছি, তোমাকে আর রাগাবো না।
-হয়েছে, এবার খাও। দাঁড়াও আগে জল দিয়ে চামচটা ধুয়ে দিই। তোমার তো আবার হাত ধোয়ার অভ্যেস নেই।
-একটা সত্যি কথা বলব, তোমার হাতে নিজেকে সঁপে দিয়েছি এই শুধু জানি, বলেই মেয়েটির হাত দু’টোতে খুব গাঢ়ভাবে চাপ দেয় ছেলেটি।
-আশেপাশের লোকজন দেখলে কি ভাববে শুনি! আমাদের তো সেই টিন এজ নেই।
-ছেলেটি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী। আর আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে যা খুশি করতে পারি। বুঝছ… লেডি কলম্বাস।
-কপট রাগ দেখিয়ে মেয়েটি বলে, বারবার লেডি কলম্বাস বলার মত কিছু হয়নি এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই এতগুলো নির্জন জায়গা আমি খুঁজে বের করেছি।
-অনেকক্ষণ পর আমি লক্ষ্য করলাম এতক্ষণ যাদের আমি প্রেমিক প্রেমিকা বলে ভুল করছিলাম তারা আসলে স্বামী- স্ত্রী। কিন্তু বিয়ের পরেও এতখানি দাম্পত্য প্রেম। খুব কম বয়স বলেও তো মনে হচ্ছে না। তবে মেয়েটি বেশ তন্বী, ফর্সা, সুন্দরী বলা ভালো। ছেলেটি দেখতেও বেশ সুন্দর। মোটামুটি সুপুরুষ না হলেও প্রেমিক বলা চলে। তবুও এই ডিজিটালের দুনিয়ায় এমন স্বর্গীয় প্রেম তাও দুটো অ্যাডাল্ট নরনারীর। বেশ ভালো লাগলো।
-ভাবলাম কাজের চাপে হয়ত কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে নিরিবিলি পরিবেশে নিজেদের মধ্যে মিটমাট করে নিতে চাইছে। ওখান থেকে উঠে সোজা হাঁটতে শুরু করলাম।
-কিছু পথ যেতেই প্রকান্ড এক মন্দির লক্ষ্য করে দাঁড়ালাম। বাঙলোর গেটের মত লোহার কারুকার্য করা বাহারি এক গেট।
২.
-গেটে ঢুকতেই পরপর সব মন্দির। প্রথমে দুর্গা, এরপর হনুমানজী, শিব, মনসা। মজার বিষয় দেখে যেন মনে হল বর্তমান যুগের মলগুলোর মত। সবকিছু এক ছাদের নীচে। এখানেও সব ঠাকুরের অবস্থান এক কম্পাউণ্ড। সব মন্দিরগুলো ইঁটের তৈরি। তবে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল এই অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ির পয়সায় এক একটি মন্দির গড়ে উঠেছে। তবে সার্বজনীন পুজো কমিটির তরফ থেকেই পুজোর সময় পুজো হয়। এই অঞ্চলের সমস্ত লোকজন এইখানে পুজো দিতে আসে। এরমধ্যে দেখলাম এক দেহাতি বৌ মাথায় অনেকটা কাপড় টেনে শিবমন্দিরে ঢুকে ছোটো ঘটিতে দুধ আর জল দিয়ে গেলেন সঙ্গে প্রসাদ হিসেবে কিছু নকুল দানা, বাতাসা। একটি বাচ্চা ছেলে এসে আমার হাতে ওই প্রসাদ দিয়ে গেল। মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগে ভরে নিলাম। এরপর দেখলাম মন্দিরের পাশে অনেকটা ফাঁকা মাঠ পড়ে আছে। সেই মাঠের এককোণে একটা প্রকান্ড বট এবং একটি প্রকান্ড অশ্বত্থ একসঙ্গে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। গাছের গুঁড়িতে বেশ কিছু কমলা রঙের সিঁদুর দিয়ে লেপা রয়েছে। এরতলে প্রদীপ জ্বেলে গেলেন কিছু মহিলা। চারিদিকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দুর্গা মন্দিরে একটি টিভি চলছে কিন্তু সেখানে রামানন্দ সাগরের রামায়ণ চলছে দেখে বুঝলাম কোনো ক্যাসেটের ব্যবস্থা আছে। বয়স্ক কিছু দেহাতি মানুষ ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন। তাদের কেউ কেউ আলোচনা করছে নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে। কিছু মানুষ ওই রামায়ণ দেখতে ব্যস্ত। এরইমধ্যে কিছু ছেলেমেয়ে খেলাধূলা করছে। একটু পরে দেখলাম বাচ্চারা সকলেই চলে গেল। কিছু বয়স্ক মানুষ আর কিছু অল্পবয়সী ছেলে ছোকরা। ছেলেদের হাতে মোবাইল। হঠাৎ করেই স্থানটা আরও নির্জন হয়ে উঠল। কিন্তু মন্দিরের পেছনে ওটা কি? হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়তেই দেখলাম ইলেকট্রনিক্স আরতির ঘন্টা বাজতে শুরু করল। এই শব্দটা আমি একেবারেই সহ্য করতে পারি না। ভাবছি বেরিয়ে যাব ঠিক এরমধ্যে দেখি ওই কপোতকপোতী মন্দিরে হাজির। বুঝতে পারলাম ওদিকটা সন্ধ্যা নেমেছে মাঠ অন্ধকার হয়ে এসেছে তাই এখানে আলোয় বসতে চাইছে অথবা মন্দির দর্শন করবে। হঠাৎ উঠে আসছি, ছেলেটি আবার বলে উঠলো… কাল আসছ তো?
-ভীষণ খটকা লাগলো কানে, এবার খুব সচেতনভাবে শোনার চেষ্টা করলাম।
-মেয়েটি বলল, ” পাগল না কি! কাল আমার বাড়ি থেকে কোনোভাবেই বেরিয়ে আসা সম্ভব হবে না”। কাল বাড়িতে লোকজন আসছেন। ছেলেটি কিছু বলতে যাবে এমন সময় মেয়েটির সঙ্গে হঠাৎ দৃষ্টি বিনিময় হল। মেয়েটির গলার স্বর দেখে বুঝতে অসুবিধে হল না এঁরা আসলে স্বামী- স্ত্রী নয়। তবে কি পরকীয়া! নাহ্ আর তো এদের পিছু ছাড়া যায় না। উপন্যাস না হোক একটা গল্প তো উঠে আসবেই। ওরা কিন্তু আমাকে এখানে বসে থাকতে দেখে এই অঞ্চলের মানুষ স্থির জেনে নিয়েছে।
-মেয়েটি বলে উঠল, একদিন আমি ঠিক এই রহস্যের উদঘাটন করব। ছেলেটি হেসে বলে উঠল, “আমি জানি তো মিতিন মাসি”।
-আবার!. আমার স্থির বিশ্বাস এখানে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে। দেখছো না নিত্য নতুন নামিদামী গাড়ি আসে সে কী এমনি এমনি। মেয়েটির কথা শেষ হতে না হতেই, আমার মনে হল মেয়েটি খুব ভুল বলছে না ওই যে একটি মন্দির জঙ্গলে ঘেরা ওটা আদতে কী?
-বসে থাকা মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম একজন সাধুবাবা থাকেন। মা কালীর পুজো করেন,
পঞ্চমুন্ডির আসন আছে। দূর দূর থেকে লোকজন আসে শণি, মঙ্গলবার ভর ওঠে সেখানে। এই দিয়ারের বাচ্চাদের জলপোড়া থেকে শুরু করে মেয়েদের নানারকম ছোটোখাটো সমস্যার সমাধান করে দেন সাধুবাবা। এতখানি জায়গা কী তাহলে আপনারা দিয়েছেন?
প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিতেই এ ওর মুখের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করল। বুঝতে পারলাম কিছুটা অপ্রস্তুত করে ফেলেছি এরপর একজন বললেন না, বেলডাঙার কোন ছেলে এই জায়গাটি দান করেন।
-হঠাৎ দেখলাম দু’জনেই মন্দিরে ঢুকে পড়েছে। আমি দূর থেকে নজর রাখছি। দেখলাম দু’জনেই কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এল। মেয়েটির মাথায় সিঁদুরের টিপ। বুঝতে অসুবিধে হল না, ওরা ওখানে পুজো দিয়েছে।
-মেয়েটি বেরিয়ে এসে বলল, আর কোনোদিন ওখানে ঢুকবে না। দমবন্ধ হয়ে আসছিল, বুড়ো কুকুর, বুড়ো কচ্ছপ, অ্যাকোরিয়ামে রাখা বুড়ো প্যারট ফিস্ আর পাকা কাঁঠালের গন্ধ মিলেমিশে এক বীভৎস পরিবেশ সেখানে। ছেলেটি আবার মুচকি হাসে, আর বলে এই তো জীবন রহস্য। এটাই ওর ডেস্টিনি ম্যাডাম। যেমন তোমার আমার এই রাস্তায় ঘর বেঁধে চলা এটাও এক ডেস্টিনি।
-মেয়েটি সজোরে চিমটি কাটে ছেলেটির হাতে, সত্যি। এক ঢ্যাড়া নিয়ে এসে দিচ্ছি পিটিয়ে পিটিয়ে বল আমি তুমি কেউই পরস্পর স্বামী -স্ত্রী নই ।
-উহু সে তো বলতে পারি না। রীতিমত স্বজ্ঞানে তোমাকে আমার করে নিয়েছি এ জীবনে। এক ছাদের তলায় না হোক এক আকাশের তলায় তো আছি। ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে রাঙিয়ে দিয়েছি তোমার সিঁথি। চোখ পাকিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে, চুপ করবে! আরে না, না ফুলসজ্জার কথা তো বলছি না।
-আমার বুঝতে অসুবিধে হল না ছেলেমেয়ে দু’টির পারস্পরিক সম্পর্ক। কিন্তু তবুও বড় পবিত্র মনে হল। দেহের প্রতি আকর্ষণ বশত এক হওয়া বলে মনে হল না। কেন জানি না বড় ভালো লাগছে ওদের এই সম্পর্ক।
-কিন্তু কিছু পরেই দেখলাম দু’জনে মটোরবাইকে চেপে চলে যাচ্ছে।
-আমিও বাইক নিয়েই বেরিয়েছিলাম। কি মনে হল পিছু নিলাম। দেখলাম দিয়ারের ভেতরে দু’দিকেই ফাঁকা মাঠে রয়েছে বাবলা গাছের সারি, মাঠের মধ্যে গমা গাছের প্রাধান্য বেশি। আসলে গবাদিপশুর খাদ্যের জন্য অঞ্চলে এসব গাছপালা বুঝতে অসুবিধে হল না। একটু দূরে থেকে ভেসে আসছে গোবরের গন্ধ।শুনতে পাচ্ছি ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। দেখলাম মেঠো ব্যাঙ ধরতে উদ্যত হয়ে আছে হেলে সাপ, চারিদিকে নিঝুম সন্ধ্যার রেশ… একফালি চাঁদ আকাশে। এরমাঝে ওদের বাইকটা আমাকে ক্রশ করে বেরিয়ে গেল। মেয়েটি আলতো করে ছেলেটির ঘাড়ে হাত দিয়ে আছে…! ওদের বাইক চলছে।
-উপন্যাসটা থাক। স্মৃতি হিসেবে মনেই রেখে দেব বরং। এই স্বার্থপর দুনিয়ায় সব তো মেকী। এই পবিত্র প্রেমটা থাক আমার স্মৃতির মণিকোটায়। বড় পবিত্র মনে হল। বরং কী মনে হল, গুনগুন করে গাইতে শুরু করলাম , ‘এই যে পথের এই দেখা হয়ত পথেই শেষ হবে তবুও হৃদয় মোর বলে সঞ্চয় কিছু যেন রবে’ …🍁
🍂গল্প/দুই
সোনালি তার ঘরে বসে ছিল। জানালার বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো চমকাচ্ছিল, আর ঘরের ভেতরে চায়ের ধোঁয়া পাক খাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নড়ল। সাধারণত এ সময় তার ঘরে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ আসে। কিন্তু এবার দরজা খুলে দেখে, একজন বালক দাঁড়িয়ে আছে। বয়স বড়জোর পনের কি ষোল। তার মুখে কৌতূহল।
অনিমন্ত্রিত অতিথি
তাহমিনা শিল্পী
বিনিদ্র জেগে থাকা মনের একান্ত কথাগুলো উড়ে যায় বাতাসে। কেউ জানে না রেশমি কাঁচের চুড়ির রিনিঝিনি শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকা না বলা কথা।শুনতে পায় না গুমোট ব্যথায় বুকের হাড় ভেঙে যাবার শব্দ। শুধু দিনের শেষ প্রান্তে মনের একান্ত আপন অনুভবেরা চোখ গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে যায়। পাওয়া না পাওয়ার বিশুদ্ধ সমীকরণ না মিললেও অদৃশ্য এক ঢেউয়ের দোলায় ভালোলাগারা জেগে ওঠে।বুকের পরিত্যক্ত বাগান সজীব হয়ে ওঠে। গোলাপ হয়ে ফুটে ওঠে সমস্ত অভিমান। সদ্য সন্ধে নামা ল্যাম্পপোষ্টের আলো ব্যালকনি বাগানে পাতার ফাঁকে ফাঁকে ছড়ায় বিন্দু-বিন্দু মুগ্ধতার ফুল।
ব্যালকনির রঙিন শতরঞ্জিতে বসে বসে বিনুনি বাঁধা শেষ করে ডান কানের পাশে গুঁজে দেয় কাঁঠালচাঁপা ফুল।তারপর গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কারও আসার অপেক্ষায় থাকে। ধোঁয়া ওড়া এক কাপ গরম চা তখন তার একমাত্র সঙ্গী।
শহরের এক কোণে একটা বদ্ধ, পুরনো ভবনের একটি ঘর। ঘরটা যতটা ছোট, তার চেয়েও বেশি ভারী তার পরিবেশ। সোনালি, প্রায় পয়ত্রিশ বছরের এক নারী, সেই ঘরেই বাস করে। ছোটবেলার সুখময় দিনগুলো এখন স্মৃতির ধূসর পাতায় রয়ে গেছে। তার জীবনের সমস্ত রঙ যেন একে একে ঝরে পড়েছে।
সোনালির জীবনের গল্পটা এতটা করুণ, শুনলে যে কেউ নীরবে কাঁদবে। কিন্তু তার গল্প শোনার লোক নেই। এখন আর সোনালিও চায় না কাউকে তার জীবনের গল্প শোনাতে। সে ভাবে, অন্ধকার যতই আড়ালে থাকে ততই ভালো। ব্যালকনির রঙিন শতরঞ্জিতে বসে বসে বিনুনি বাঁধা শেষ করে ডান কানের পাশে গুঁজে দেয় কাঁঠালচাঁপা ফুল। তারপর গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে কারও আসার অপেক্ষায় থাকে। ধোঁয়া ওড়া এক কাপ গরম চা তখন তার একমাত্র সঙ্গী।
শহরের এক কোণে একটা বদ্ধ, পুরনো ভবনের একটি ঘর। ঘরটা যতটা ছোট, তার চেয়েও বেশি ভারী তার পরিবেশ। সোনালি, প্রায় পয়ত্রিশ বছরের এক নারী, সেই ঘরেই বাস করে। ছোটবেলার সুখময় দিনগুলো এখন স্মৃতির ধূসর পাতায় রয়ে গেছে। তার জীবনের সমস্ত রঙ যেন একে একে ঝরে পড়েছে।
সোনালির জীবনের গল্পটা এতটা করুণ, শুনলে যে কেউ নিরবে কাঁদবে।কিন্তু তার গল্প শোনার লোক নেই। এখন আর সোনালিও চায় না কাউকে তার জীবনের গল্প শোনাতে। সে ভাবে, অন্ধকার যতই আড়ালে থাকে ততই ভালো।
বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে সোনালি, পরপর তিন ভাইয়ের জন্মের পর সোনালির জন্ম। ছোটবেলায় খুব আদরে বড় হয়েছিল। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা তার জীবন বদলে দেয়।
আলোর বেশ ধরে এক ভুল মানুষ তার জীবনে এসেছিল।সেই ভুল মানুষের খপ্পরে পড়ে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবন একেবারে পাল্টে যায়। সে এক নিষ্ঠুর চক্রে বন্দী হয়ে পড়ে, যেখান থেকে বের হওয়া প্রায় অসম্ভব। জীবনের এই অন্ধকারে ঢোকার পর সোনালির ভেতরটা একেবারে শূন্য হয়ে গিয়েছিল। একসময় সে এই জীবনকে তার নিয়তি বলে মেনে নেয়।
একদিন সন্ধ্যায়, সোনালি তার ঘরে বসে ছিল। জানালার বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো চমকাচ্ছিল, আর ঘরের ভেতরে চায়ের ধোঁয়া পাক খাচ্ছিল। এমন সময় দরজায় কড়া নড়ল। সাধারণত এ সময় তার ঘরে নির্দিষ্ট কিছু মানুষ আসে। কিন্তু এবার দরজা খুলে দেখে, একজন বালক দাঁড়িয়ে আছে। বয়স বড়জোর পনের কি ষোল। তার মুখে কৌতূহল আর চোখে ভয়। সোনালি প্রথমে কিছুটা অবাক হল। সে বলল, তুমি এখানে কীভাবে এলে?
ছেলেটি মাথা নিচু করে মৃদুস্বরে বলল, আমার বন্ধুরা আসতে বলেছে।
কেন? এখানে কেন এলে? সোনালি জানতে চাইলে ছেলেটি বলল, বন্ধুরা বলল, এখানে এলে নাকি বড়দের মত সব কিছু জানতে পারব।তারপর গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, আমি কিন্তু খালি হাতে আসিনি, টাকা নিয়ে এসেছি।
সোনালি ধীরে ধীরে ছেলেটিকে ঘরে ডেকে নিল। বসিয়ে রেখে সোনালি তার জন্য এক কাপ চা বানিয়ে আনল। তারপর বলল, তোমার নাম কী? বাড়ি কোথায়? বাবা-মায়ের পরিচয় কি?
ছেলেটি নাম বলল রাহুল। তার বাবা ব্যবসায়ী সানাউল হক। সারাক্ষণ কাজে ব্যস্ত।প্রায়ই ব্যবসার কাজে বিদেশে যায়। মা ব্যস্ত সমাজ সেবায়।ছেলেকে দেবার মত সময় তাদের হাতে নেই। বাড়ি গাড়ি টেককেয়ার করার লোকসহ কোনও কিছুরই অভাব নেই রাহুলের। তার শুধু বাবা-মায়ের সঙ্গের বড় অভাব।
বাবা-মা তাকে ভালোবাসে না, এই ভেবে রাহুল সারাক্ষণ মন খারাপ করে থাকে। সম্প্রতি রাহুলের বাবা বিদেশ থেকে তার জন্য নতুন একটি মোবাইল ফোন কিনে এনেছে। আই ফোন ফিফটিন প্রো-ম্যাক্স। এটি রাহুলের চাওয়া ছিল। তাই সে খুব খুশি হল।
নতুন মোবাইল পেয়ে রাহুল যারপরনাই আনন্দিত। বন্ধুদের দেখাতে স্কুলে নিয়ে গেল। রনি তার বেষ্টফ্রেন্ড, মোবাইলে কিছু গেমস ও কিছু অ্যাপস ডাউনলোড করে দিল। ফেসবুকে আইডি খুলে দিল। ম্যাসেঞ্জারে ইউটিউবের কিছু ভিডিও লিঙ্ক দিল।
ভিডিওগুলো দেখে রাহুল প্রথমে লজ্জা পেলেও ধীরে ধীরে তার দেখতে ভালো লাগতে শুরু করে।
একদিন রনি রাহুলকে বলে, এসব যদি বাস্তবে জানতে চাস, তাহলে তারও ব্যবস্থা আছে। তুই বড়লোকের ছেলে, টাকা-পয়সার অভাব নাই। চাইলেই তো ব্যবস্থা করে নিতে পারিস।
রাহুলের কৌতূহল জন্মাল। কিছুটা আগ্রহ হল। রনির থেকেই ঠিকানা জেনে রাহুল চলে এসেছে সোনালির কাছে। যেন সে বড়দের মতো কিছু শিখতে পারে। এতে করে বাবা-মা যে তাকে সময় দিচ্ছে না, তারজন্য রাহুলের যে কষ্ট তা ভুলতে পারবে।
কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেল সোনালি। সানাউল হক নামটা বারবার তার কানে বাজতে শুরু করল। এই সানাউল তার জীবনের সেই ভুল মানুষ, যার কারণে আজ সোনালি অন্ধকার জীবনে।মুহূর্তেই তার মনে প্রতিহিংসা জেগে উঠল। মনে মনে ভাবল, তবে নষ্ট হোক তার ছেলের জীবন! এরচেয়ে ভালো প্রতিশোধ আর কিছু হতে পারে না।
পরক্ষণেই সোনালির বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। ছেলেটির সরল চেহারায় যেন নিজেকেই ওর মায়ের রূপে এক ঝলক দেখতে পেল। বেদনা সোনালির ভেতরটা চুরমার করে দিল।
পরিবার রাহুলকে ভালোবাসে না! তার মনে হল, এই বালকের জীবনটা তার মতো হয়ে যাবে। এভাবে কি আ’রেকটি জীবন নষ্ট হতে চলেছে?
সোনালির মনের গভীরে মাতৃস্নেহ জেগে উঠল। সে রাহুলকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।
রাহুল অবাক হল। কান্নার কোনও কারণ না জানলেও সোনালির জন্য তার মায়া হল! রাহুলও জড়িয়ে ধরল সোনালিকে।
সোনালির গায়ে কাঁঠালিচাঁপার মিষ্টি ঘ্রাণ! মায়ের কথা মনে হল, রাহুলের। সোনালি যেন তার মায়ের প্রিয় ফুল সমস্ত শরীরে মেখেছে।*
রাহুল সোনালিকে বলল, এভাবে কাঁদছেন কেন?
সোনালি বলল, বাবা, আমার অনেক কষ্ট। সেই কষ্টের গল্প শোনার কেউ নেই। আজ তোমাকে শোনাতে চাই।
রাহুল বলল, আমাকে বলুন। আমি শুনব আপনার গল্প।
সোনালি সেই ভুল মানুষের নাম আড়াল রেখে নিজের জীবনের গল্প রাহুলের সামনে তুলে ধরল। একে একে জানাল, পরিবারের কত আদরের ছিল সে। তারপর কীভাবে একজন ভুল মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় হল। কীভাবে সেই মানুষটির প্রতারনায় ভুল পথে পা বাড়িয়ে তার জীবন ধ্বংস হল!
রাহুলের প্রথমে কিছুটা অস্বস্তি হলেও পরে সব কথা মন দিয়ে শুনল।
সোনালির ভেতর একটা পরিবর্তন ঘটল। এতদিন সে নিজের প্রতি দুঃখ আর ঘৃণার বাইরে কিছু ভাবতে পারেনি। কিন্তু এই রাহুল ছেলেটির জন্য তার ভেতর এক অদ্ভুত মমতা জাগল। সে ঠিক করল, এই রাহুলের জীবন সে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দিবে না।
সোনালি রাহুলকে বুঝিয়ে বলল, তোমার জীবনটা অনেক মূল্যবান। ছোট ছোট ভুলগুলো বড় হয়ে গেলে, পুরো জীবনটাই নষ্ট হয়ে যায়। ফিরে যাও তোমার মায়ের কাছে। তুমি তাকে যতটাই ভালোবাসো না কেন, বিশ্বাস করো, সে তোমাকে তার থেকেও বেশি ভালোবাসে। তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ তুমি। তুমি ভুল পথে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে তোমার মা। তুমি তার সঙ্গে তোমার সব সমস্যা, রাগ-অভিমান শেয়ার করো, দেখবে তিনি সব সমাধান করে দিবেন। জীবন দিয়ে হলেও তিনি তোমাকে আগলে রাখবেন। আর তোমার বাবা, সে তো কত কষ্ট করে। সব কষ্ট তোমার ও তোমাদের সুখের জন্যই। তোমার জীবন ভুলে ডুবে গেলে তার ভীষণ অপমান হবে।
রাহুলের চোখে জল চলে এল। সে বলল, সবাই আপনাকে কত খারাপ বলে।অথচ, আপনি খারাপ মানুষ নয়। আমার এত খারাপ সময়েও আমাকে ভালো পথ দেখাচ্ছেন। কিন্তু আপনার এত কষ্ট! আমাকে মাফ করে দেন। আমি আর কোন ভুল করতে চাই না। কিন্তু আমাকে ভুল থেকে ফিরিয়েছেন, আপনাকে একটা পুরষ্কার দিতে চাই।
সোনালি মৃদু হেসে বলল, যদি তুমি আমার আরও কষ্টের কারণ হতে না চাও, তাহলে লক্ষ্মী ছেলের মত বাড়ি ফিরে যাও। মায়ের কাছে আপাতত মোবাইল জমা দিয়ে দাও। আর কখনও আমার এখানে এসো না। আমার ভুলকে তোমার জীবনের শিক্ষা হিসেবে গ্রহণ করো। মন দিয়ে পড়াশুনা করে, অনেক বড় হও। যদি সত্যিই তুমি তা পারো, সেটাই আমার পুরষ্কার।
রাহুল উঠে দাঁড়াল, আর যাওয়ার আগে বলল, আপনার মতো একজন মা যদি আমার জীবনে থাকত, তাহলে আমি কখনও ভুল করতাম না।
সোনালি জানে তার আর মা হবার সুযোগ নেই। তার আর আলোয় ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। কিন্তু রাহুলের এই ছোট ঘটনা তার ভেতরে একটা নতুন আলো জ্বালিয়ে দিল।
রাহুল চলে যাওয়ার পর সোনালি জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়াল। ল্যাম্পপোস্টের আলো তার মুখটা আলতো করে স্পর্শ করল। বাইরের মৃদু হাওয়ায় পাতার ফাঁক দিয়ে আলো-ছায়ার খেলা চলছিল। সেই ছায়ায় সোনালির চোখের সামনে ভেসে উঠল রাহুলের মুখ। ছেলেটির সরল চোখ, ভয়ার্ত চাহনি, এসব তার ভেতরে এক অদ্ভুত পরিবর্তন এনে দিল।
সোনালি তার নিজের ছেলেবেলার কথা ভাবল। সে সময়টুকু যখন তার জীবনে কোনও অন্ধকার ছিল না। সে জানে, বাড়ির লোকেরা তাকে ঘৃণা করে। কেউ তার জন্য অপেক্ষা করে না। সে বুঝল, আজ সে কিছু একটা করেছে যা এতদিনের বেঁচে থাকার ভেতর একমাত্র অর্থপূর্ণ কাজ। যা তার নিজের আত্মার পুনর্জন্ম ঘটাল।
সোনালি নিজের জন্য দারুণ করে চা বানাল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ব্যালকনির গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। না, আর কারও অপেক্ষায় নয়। আজ দাঁড়াল নিজের জন্য। চাঁদের মুগ্ধতায় ডুবে যেতে।
চাঁদটা পূর্ণ জোছনা হয়ে উঠেছে। মৃদু বাতাসে কাঁঠালচাঁপার গন্ধ ভেসে আসছে। তার মনে হল, এ জীবন যতই নিষ্ঠুর হোক, মানুষের ভালো কাজের শক্তি কখনও মুছে যায় না।
সে মৃদুস্বরে বলল, আমার জন্য কোথাও কেউ নেই। কিন্তু রাহুল হয়ত একদিন তার জীবনে ভালো কিছু করবে। তখন হয়ত কোনও এক দুঃখী নারীর কথা মনে পড়বে, যে তাকে সেদিন একটি ভুল থেকে বাঁচিয়েছিল। সেই মনে রাখাটুকুই তো জীবনের সত্যিকারের বাঁচা।
হঠাৎ দূরে কে যেন একটা ছোট্ট কাগজের ঘুড়ি উড়াল। রূপার চোখ তার পিছু নিল। ঘুড়িটা ধীরে ধীরে আকাশে মিলিয়ে গেল। তার মনে হল, সে নিজেও যেন সেই ঘুড়ির মতো মুক্ত হয়ে উঠছে, অন্তত তার হৃদয়ে।
ভোর হয়ে এলো। ঘরের বাইরে ল্যাম্পপোস্টের আলো ম্লান হতে শুরু করল। সোনালি ব্যালকনি ছাড়ল, ধীরে ধীরে ঘরের ভিতর চলে গেল। সে জানে, পৃথিবী তাকে কখনও গ্রহণ করবে না। কিন্তু তার থেকে কিছু কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতাও আর এই পৃথিবীর নেই।
নিস্তব্ধতা ভেঙে ঘরের এক কোণ থেকে ভেসে এল চুড়ির হালকা রিনিঝিনি শব্দ। তার বুকের জমে থাকা অভিমানগুলো যেন সেই শব্দের তালে মিশে কোথাও হারিয়ে গেল।
পর্দার ফাঁক দিয়ে শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপা ভাবল, আমার জীবনের সব আঁধারের ভেতরেও আজ একটা মৃদু আলো জ্বলে উঠেছে। এটুকুই তো চাওয়া ছিল…
সেই রাতের পর রূপার জীবন কোথায় গিয়ে থেমেছিল, কেউ জানে না। তবে কেউ কেউ বলে, সেই ঘরে আর কোনো দিন কোনো চুড়ির রিনিঝিনি শোনা যায়নি।🍁
🍂কবিতা
কবিরুল ইসলাম কঙ্ক
এটাই খবরের হেডলাইন
কেউ রাখে না উড়ে যাওয়ার খবর
কেউ রাখে না বিধ্বস্ততার সংবাদ
আপনবৃত্তে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা
হৃদয় চত্বরে ফেলে যায় উচ্ছিষ্ট পালক।
ছায়ালু বিকেলে বাতাসের আলাপী ওড়া
ছুঁয়ে যায় বৃষ্টিগন্ধ মেঠো আলপথ
দূর-দূরান্তরে আকাশের তারার মতো
কোথাও জ্বলতে থাকে অপেক্ষার প্রিয় মুখ।
কেউ রাখে না হারিয়ে যাওয়ার খবর
কেউ রাখে না ভেসে যাওয়ার সংবাদ
খোলা বুকের চৌহদ্দিতে বিষের আল্পনা
কেউ শোনে না যন্ত্রণার অব্যক্ত চিৎকার।
নিয়ম মেনেই খেলা শুরু হয় হৃদয় গলিতে
তারপর নিষিদ্ধ রাজ্যে কাঁপা ঠোঁটের স্পর্শ
কখনো হয়ে ওঠে দিক-ভুল কম্পাস
বাঞ্ছিত খবরেরা হয় নিখোঁজ সংবাদ।
এখানেই হোক কাহিনির ক্লাইম্যাক্স
জ্বলে যায় যাক বুক, পুড়ে যায় যাক সুখ।
পরাণ মাঝি
সবচেয়ে সত্যি
হ্যালো জননী!
সব তো বলেছে গল্প ছলে ; তবু কেন গোপন রেখেছো শেষ সত্যটি –
সন্তান প্রসবের ব্যথাটি।
সে যাতনা বোঝার ক্ষমতা কারো কী আছে? বোঝে কোন পুরুষটি?
সহজে জানা কী যায়
কতটা অসহায় সেই মহানুভবটি…
সুচিতা সরকার
একটি নির্মম উপন্যাস
তারপর এসে দাঁড়ালাম শীতের দোর গোড়ায়।
গল্পের সাথে গল্প মিলিয়ে কবিতা লিখব বলে,
ধরা দিলাম রুক্ষতার কাছে।
কিছু শব্দের খোঁজে
শুষ্ক পাতার স্তূপে হাত ডোবালাম।
উত্তুরে হাওয়া গায়ে লাগতেই বুঝলাম
এতো উষ্ণতার প্রলোভন।
এ খেলায় হার যে নিশ্চিত।
অননুগত প্রেমিকের মতো
একদিন সব বাজি জিতে
সে হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যাবে
একমুঠো অভিতাপ।
তারপর?
উপহাস!
এক নির্মম উপন্যাস।
সুশান্ত কুমার দে
ঘুঘু পাখির বিয়ে
রাত নেই, দিন নেই, নেই কাজ কর্ম
মুখোমুখি দুটি পাখি বোঝে কি মর্ম?
উঁচু ডালে, ভরা গালে বসে ঘুঘু দুটি
সঙ্গোপণে দু’জনে হেসেই কুটিকুটি?
গান গায়, হাসি পাই -নাই তার মানে
মানে টানে হয়তো ঘুঘু দুটোই জানে!
কুয়াশা টুপটাপ বসে থাকে চুপচাপ
শীত, গ্রীষ্মের একই- যেন সম ভাব।
খোকা- খুকি চল, পাখি জুটিকে বল
মাছ, ভাত খাবিরে আমার বাড়ি চল?
ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে যায়,পেল কী ভয়
অন্য ডালে উড়ে গিয়ে-কি কথা হয়?
এদিক, ওদিক তাকায় দু’চোখ রাঙা
মাথা টাক রাগঢাক- সুরে কণ্ঠ ভাঙা,
খোকা ডাকে, খুকি ডাকে দিল সাড়া
জলদি করে আন, মাইক্রো টি ভাড়া।
খোকার হাতে ধান, চাল- খুকু নেয় খৈ
হঠাৎ করে গাছের তলায় পড়ল হৈচৈ,
ঘুঘু দুটির বিয়ে দিতে এত আয়োজন
বনের সব পাখপাখালির হল নিমন্ত্রণ!
পাপড়ি ভট্টাচার্য
আদি ভ্যালেন্টাইন
অনেক বছর পর এক অচেনা সমুদ্র দেখলাম
তুলে আনলাম অফুরন্ত ঢেউয়ের সাথে একরাশ আনন্দ
অনেক প্রতীক্ষা শেষে মরুভূমি বুকে
মরুদ্যান পেলে যেমন
এক আশ্চর্য লুকোনো সবুজ পাওয়া যায় অভ্যন্তরে
তেমন অনেক অচেনা কক্ষপথ পার হয়ে
জীবন পরিক্রমা সৌরজগতে ঘুরতে ঘুরতে ভাসমান।
এই তুমি এই আমি অতীতের পাতা থেকে তুলে এনেছি স্বয়ং সম্পূর্ণ নিজস্বতাকে
যার আদি পর্বে একমাত্র অবলম্বন ছিল
ভালোবাসা আর ভালোবাসা।
এখন ঘোর লাগা আবেগের দরজা খুলে
দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেই আদি ভ্যালেনটাইন
যার জন্ম লগ্ন রচিত হয়েছিল রাধা কৃষ্ণের
ফুল্লকুসুমিত কুঞ্জবনে চতুরঙ্গ মিলনে।
তীর্থঙ্কর সুমিত
মৃত্যু কোল
একটা মৃত্যু চাই
সময় করে সব আবদার মেনে নেবো
উড়ন্ত পায়ারার ওঁম ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞারত।
আমার আমি এখন…
একটা মৃত্যু চাই
কথা ভোলানো পথ আজ সবুজ হারিয়ে
নিরুদ্দেশ পথযাত্রী।
সময়মত একটু রঙ ছিটিয়ো আমার বুকে।
নীল, সবুজ কিম্বা লাল নয়
একটু অন্ধকার দিও।
একটা মৃত্যু চাই
জীবন মানে তো একটা ধাঁধার সমীক্ষা
এর থেকে আর কিছু নয়
বিশ্বাস করো চোখ বুঝে
একটা নিশ্চিন্ত কোল চাই।
নরম কোল…
মোফাক হোসেন
মুখোশ
গোটা শরীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেশ সুন্দর শীতের রোদ শুষে নিচ্ছিলে।
সেই রোদ হলো কাল
তীব্র আলোতে শরীরের কি যন্ত্রনা সত্যের আঙিনায় পায়চারি করছে প্রতিনিয়ত।
যে ধুলোবালি থেকে বাঁচতে,
শীতের চাদর আর নেই,
দেখা গেছে তাকে একাধিক মাঠে।
মেঘের কার্নিশে নিচে বসে একাধিক বৃষ্টিতে ভিজতে।
আহা কি যন্ত্রণা
সত্যের সিঁড়ি ভাঙ্গা…।
মমতা রায় চৌধুরী
বিষণ্ণ বিকেল
আবার একটা বিষণ্ণ বিকেল তবুও হাতছানি দেয়
প্রতি পরতে পরতে ছবি আঁকি স্মৃতির ক্যানভাসে
যদি একবার উড়ান দিতাম তোমার নীল আকাশে
মুক্ত পাখি হয়ে বিকেলে ফিরতাম একরাশ ক্লান্তির সাথে সোনালী স্বপ্নগুলোকে হৃদয়ের পরশ এঁকে
তোমাকে পাঠাতাম নীল খামেতে নিমন্ত্রণ
হেমন্তের ঝরাপাতা রুক্ষতার কাঠিন্যে তোমাকে
বরণ করতাম সদ্য শীতের কুয়াশায়।
আর উষ্ণতায় ভরে দিতাম সূর্যমুখী সকালের রোদ্দুর।
কেমন হতো বল তো, কি দারুণ তাই না?
আমার বসন্তের গায়ে হলুদ শুধু তোমার জন্য
শীতের কুয়াশার চাদর সরিয়ে অপেক্ষায় আছি আরেকটি বিষন্ন বিকেলের নীল আকাশের ছাদে
দু’টি হাত পরস্পরের হাতে দু’টি মন উন্মুখ কথা বলাতে
সব গল্পের ইতিকথা সেই বিষণ্ণ বিকেল।
পাপড়ি দাস সরকার
হৃদকমল
চেনা চৌকাঠ পেরিয়ে পিছ ফিরে দাঁড়াই
ঘরের কোণে জমাট অন্ধকার
ছায়া মূর্তি পিছু নিয়েছে আমার,
নিভু নিভু ধোঁয়া ওঠা তুলসীতলার বাতি।
সুষনি সজনে ঘুমিয়ে পড়েছে পুকুর ধারে
একটানা অসহ্য শব্দ করে চলেছে
মাটি কুড়ুনি পোকা
আকাশের কান ফাটিয়ে উড়ে গেল চিৎকার
পাখিস্বর মিলিয়ে গেল কামরাঙ্গা বিকেলে।
আদুরে দিনগুলো থেকে বেরিয়ে এসেও
নিপুন নুপুরের অশ্রু দেখি থ হয়ে
হারিয়ে যাওয়া স্পর্শ থেকে খসে খসে পড়ে
ভগ্ন ভালোবাসার ঝুরোমাটি।
🍂ধারাবাহিক গদ্য / পর্ব ৫
হাই সাহেবকে শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে বিরাট। তিনি ছিলেন মাতৃভাষা প্রেমিক সাহিত্যিকও। মাতৃভাষার অধিকার ক্ষুণ্ন করার জন্য যখনই কোনও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা চাঁড়া দিতে চেয়েছে, তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। কোনও কিছুর বিনিময়েই আপোষ করেননি। অধ্যাপক ও সাহিত্যসেবী হিসেবেই তিনি সারাজীবন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা প্রকাশ করে গিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। শুধু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেই মাতৃভাষাকে না রেখে অফিস আদালতের কাজকর্মেও সমানভাবে মাতৃভাষা চালু হোক, এটি ছিল তাঁর আন্তরিক ইচ্ছে। আর এই ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’- সম্পর্কীত ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পঞ্চম পর্ব।
ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই
মেধা এবং মেধার অনবদ্য প্রয়োগ একজন মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিতে পারে, মুহম্মদ আব্দুল হাই তার সর্বোত্তম প্রমাণ। তিনি শুধুমাত্র মেধা আর নিজের ইচ্ছাশক্তির বলে আসিন হয়েছিলেন শ্রেষ্ঠদের আসনে। বাংলা ভাষার প্রতি ভালবাসা আর প্রবল দেশপ্রম নিয়ে তিনি অসাধ্য সাধন করেছেন বলা যায়। আগেই বলেছি, মাত্র সতেরো বছর বয়সেই তিনি আবদ্ধ হয়েছিলেন বিবাহবন্ধনে এবং সেই সময়ে তিনি ছিলেন ছাত্র। এই বিয়ের পটভূমিতে দেখলে দেখা যায় সেসময়ের সমাজচিত্র। নানার (মায়ের বাবা) বাড়ি মুর্শিদাবাদের মরিচা গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। সেখানকারই কন্যা আনিসা বেগমের সাথে তাঁর বিয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে জড়িত ছিল আরেকটি প্রস্তাব। সেটা হল, শ্বশুর তাঁর লেখাপড়ার খরচ বহন করবেন। মেধাবী অথচ দরিদ্র, এমন ছেলেদের বৈবাহিক এ- লেনদেন সেই সময়ে আমাদের দেশে আশ্চর্যের কিছু নয়। অতি স্বাভাবিকভাবেই চলত এই প্রক্রিয়া। আজকের এই সময়ে এসেও যে এমনটি হয় না, তা নয়। তবে সেই সময়ে অনেক বেশি হতো। গ্রামগুলোতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, হয়ত পাশের গ্রামে কিংবা দু’তিন গ্রাম পরে রয়েছে কোনও ভাল স্কুল, মেধাবী যারা তারা সেই অন্যগাঁয়ে কোনও ধনী পরিবারে লজিং থেকে লেখাপড়া করত। বিনিময়ে হয়ত পড়াতে হতো সেই বাড়ির দুরন্ত কোনও ছেলেকে। মেধাবীর ছোঁয়ায় সেই দুরন্ত ছেলেটি হয়ত আশাতীত ফলাফল করে ফেলত পরীক্ষায়। এমন উদাহরণ প্রচুর আছে। মুহম্মদ আব্দুল হাই-এর লেখাপড়া যখন ঊর্ধ্বগামী সে সময়ই আসে এমন একটি প্রস্তাব। কন্যা আনিসা বেগমের পিতা “হীরে” চিনতে ভুল করেননি মোটেও। বিয়ে হয়ে যায় মুহম্মদ আব্দুল হাই এবং আনিসা বেগমের। এগিয়ে যায় হীরের টুকরো ছেলে আব্দুল হাই -এর লেখাপড়া। শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পরীক্ষাতেই রাখেন অসাধারণ মেধার সাক্ষর।
পুরো জীবনে তাঁর যা অর্জন, সেটা কি শুধুই মেধার জোরে? এ প্রশ্নটি মনে এসেছে, উত্তরও পেয়ে গিয়েছি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। শুধুমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা একজন মানুষকে “মানুষ” হিসেবে হয়ত গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু একজন মানুষকে “ভালো মানুষ” হিসেবে আমরা আখ্যায়িত করি তখনই যখন তার মধ্যে মানবিক গুণাবলিরও সমন্বয় হয় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে। মুহম্মদ আব্দুল হাই ছিলেন তেমনই একজন অসাধারণ ব্যক্তি। নিজের দেশ, দেশের মানুষ, নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি, সর্বোপরি আপন দেশের প্রতি ছিল তাঁর অন্তহীন দেশপ্রেম। আর ছিলেন নির্ভীক ও দৃঢ়চিত্ত। দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসনে যখন হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল আমাদের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি, সেই সময়ে তিনি নিঃশঙ্ক চিত্তে কাজ করে গিয়েছেন বাংলা ভাষার জন্য। হাই সাহেবকে শুধুমাত্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে গণ্য করলে ভুল হবে বিরাট। তিনি ছিলেন মাতৃভাষা প্রেমিক সাহিত্যিকও। মাতৃভাষার অধিকার ক্ষুণ্ন করার জন্য যখনই কোনও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মাথা চাঁড়া দিতে চেয়েছে, তিনি তার বিরোধিতা করেছেন। কোনও কিছুর বিনিময়েই আপোষ করেননি। অধ্যাপক ও সাহিত্যসেবী হিসেবেই তিনি সারাজীবন বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অপরিসীম মমতা প্রকাশ করে গিয়েছেন। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে আন্দোলন, সে আন্দোলনের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। শুধু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবেই মাতৃভাষাকে না রেখে অফিস আদালতের কাজকর্মেও সমানভাবে মাতৃভাষা চালু হোক, এটি ছিল তাঁর আন্তরিক ইচ্ছে। আর এই ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছেন। জনসাধারণের মধ্যে মাতৃভাষার প্রতি জেগে উঠুক অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ, এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ১৯৬৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পালিত হয় “ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ”। এই সেমিনার করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রদর্শনী ও আলোচনার মাধ্যমে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎপত্তি ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা। (চলবে)🍁
অঙ্কন : প্রীতি দেব ও অন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

2 thoughts on “Sasraya News Sunday’s Literature Special | 8th December 2024 | Issue 42 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪২”
bookmarked!!, I like your blog! http://boyarka-inform.com/