



সম্পাদকীয়
পৃথিবী প্রেমের হোক
প্রেম। এটা শুধু দু’জন মানুষের পারস্পরিক আকর্ষণ নয়। বরং মানবতা, প্রকৃতি, জীবন ও সৃষ্টির প্রতি এক গভীর মমতা। যখন পৃথিবী জর্জরিত হিংসা, যুদ্ধ, বৈষম্য, লোভ ও অমানবিকতার বোঝায়, তখন সত্যিকারের প্রেমই হয়ে উঠতে পারে একমাত্র মুক্তির পথ। তাই আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে জরুরি হয়ে উঠেছে প্রেম। একটি সর্বজনীন, উদার, নির্মল প্রেম। যা সীমান্তের গণ্ডি মানে না। বিভাজন করে না। বরং সমস্ত জীব ও জগতকে একসঙ্গে নিয়ে চলতে শেখায়। আমরা যদি মানুষকে ভালবাসি, তবে মানুষ কখনও ক্ষতি করতে পারে না মানুষের। যদি প্রাণীদের প্রতিও থাকে আমাদের শ্রদ্ধা, তাহলে আমরা আর নির্মমভাবে তাদের শিকার করব না। যদি প্রকৃতিকে ভালবাসতে শিখি, তাহলে আর গাছ কাটা, নদী দূষণ, আবহাওয়ার ভারসাম্য নষ্ট করার মতো এইসব কাজগুলি আমরা করতে পারি না। সবকিছুর মূলেই রয়েছে প্রেম। সেই প্রেমই মানুষকে সুন্দর করে, সেই প্রেমেই আছে পৃথিবী বাঁচানোর মন্ত্র।
বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হল হৃদয়ের শূন্যতা। এই শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলতে পারে ভালবাসা। আমরা যত বেশি ভালবাসা ছড়িয়ে দিতে পারব, তত বেশি শান্তি ও সহমর্মিতা ফিরে আসবে সমাজে। একজন পথশিশুকে একটু আদর, বৃদ্ধাশ্রমের কোনও কোণায় থাকা একজন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাকে একটু মনোযোগ, অসুস্থ বন্ধুর খোঁজ এইসব ছোট ছোট ভালবাসার প্রকাশই আসলে গড়ে তোলে এক মহৎ প্রেমভিত্তিক সমাজ। তবে মনে রাখতে হবে যে, প্রেম কোনও দুর্বলতা নয়। এক প্রবল শক্তি। যা মানুষের মনকে নরম করে। চোখে জলের মতো সহানুভূতি আনে, এবং হাত বাড়িয়ে দেয় সাহায্যের জন্য। এই প্রেম যদি মানুষে মানুষে, মানুষে প্রকৃতিতে, প্রাণে প্রাণে প্রবাহিত হতে পারে, তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠবে একটি নির্মল, নিরাপদ ও সৌন্দর্য-ভরা আবাসস্থল।
তাই ঘৃণাকে নয়, সকলের বেছে নেওয়া উচিৎ, ভালবাসাকে। হিংসাকে নয়, আকাঙ্ক্ষা হোক সহমর্মিতার। আসুন একে অপরকে জড়িয়ে ধরি প্রেমের বাঁধনে। এই সময়, এই পৃথিবীর, সবচেয়ে বড় প্রয়োজন প্রেম। প্রেমই হোক এই পৃথিবীর চালিকা শক্তি।🍁
🍂মহামিলনের কথা
চঞ্চলতাহীন মন অমৃত, তা তপস্যা, শাস্ত্র সিদ্ধান্তে তাহাই মোক্ষ। মনকে স্থির করতে হলে সত্ত্বগুণকে বাড়াতে হয়। তার উপায় : সদ্ গ্রন্থ, সৎসঙ্গ, শুদ্ধ আহার, যথাকালে সন্ধ্যা উপাসনা, তুলসী সেবা, তুলসীর রসপান, সাধুসঙ্গ লাভ। “সাধুদর্শনমাত্রেন তীর্থকোরটিফলং লভেৎ” সাধুর চরণ যে আশ্রয় করতে পারে, সে অনায়াসে সংসার সাগর হ’তে উত্তীর্ণ হয়ে যায়।
🍂ঋণ : শ্রীওঙ্কারনাথ-রচনাবলী। শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী
🍂কবিতা
গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
অনন্ত নির্জন
সম্পূর্ণ পৃথিবী যেদিন বদলে যাবে
সেদিন আমরা আর কেউ থাকব না
কিছু মুগ্ধ নিবিড় সান্নিধ্য
কিছু হাওয়ার ফিসফাস আর অনন্ত নির্জন
কিছুদিন নন্দিত হয়ে থাকবে
তারপর রাত্রির অন্তরাল
আর সংবেদন সমগ্রতাই থেকে যাবে
তন্বী মুখোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
নিরেট বোবা
ছুরিতে শান, যদি বসিয়ে দেয়,
শব্দ করবো না- পিছমোড়া হাত—
গাল ফেটে পড়ল চড়ের পর চড়ে
শব্দ করবো না–
জীবন স্ফটিক, হবে স্বর বরফের নদী
পুড়ে গেছে নখের ভেতর বলবো না
কাউকে না।
দুরাশার ভেতরে বলতে চাওয়া
পঞ্জরে নিরেট নিজের শোক-
রব রিক্ত রেখে শুরু থেকে কাজ
করবো না
কাঁপা ডানা কেটে ফেলেছে তারা-
শুকনো জিভে দেয় নি জল
উপর্যুপরি পরীক্ষান্ত কত রাত বাকি আর
নিঃশব্দের কাল!
আর কি পড়বে না তবে যাদুমাখা
দিন নিরক্ষর শাদা ধোয়া প্যাম্ফলেটখানা-
অদূরে মুখ ভ্যাঙায় উত্তর দেবে না বোবাটা-
মুখে কাপড়- ইচ্ছের ইতি
কুন্তল দাশগুপ্ত-এর দু’টি কবিতা
কুসুমাগুন
কুসুম এবার সোনালি ডানার পাখি হয়ে উড়ে যাও…
দূরে— আরও দূরে।
খুঁজে নাও নিজের ঠিকানা।
পুড়িয়ে দিচ্ছে ডানা
কাল বৈশাখী রোদ।
ক্রোধ
করো এত এত,
রোদের অজ্ঞাত
আজও যে ক্ষমতা
আদপে রম্যতা
সে তোমার হোক।
আগুনের শ্লোক
হয়তো পুড়িয়ে দেবে পুরোনো পালক,
ক্ষতি নেই,
সবেতেই
অধিকার
থাকে না সবার।
তবে,
সেই কবে
চন্দ্রবিন্দু চরে
অতুল আকাঙ্ক্ষা ভরে
চেয়েছিল যে,
সে— আজও আছে
হয়তো দূরে অথবা কাছে।
অগ্নিমিত্রা,
তোমার উপহার
বর্ষার
যত চাষবাস
আর, বৈশাখী রোদেলা আকাশ।
উত্তর তো জানা
সকলে বলছে নতুন বছর ভালো কাটুক…
এই কাটা শব্দটাকে তুমি বিশ্বাস করো?
করো!
ওই বাক্যে কর্তা কি বছর?
তা সে যাই হোক, কাটা মোটে ভালো নয়।
কী বলছ?
ভুল হলে কাটবে বইকি?
তা ভুল হয় শেখানোর দোষে।
তাহলে বোঝাই গেল পৃথিবীর সব ভুল শিক্ষক ঝোলায়।
ভুল শিখে, সিঁড়ি ভাঙা অঙ্কের শেষে ছাদমিতি আসে।
উত্তরমালা ছেঁড়া অঙ্কের বই শিক্ষানবিশের হাতে দেয় চোষ্য পেনসিল।
যত পেন কিল না ক’রে সিল করে মোহর বাজিয়ে যত কিলের গোঁসাই, যাদের বিভীষণ গোঁ ঠিকঠাক শিখিয়েছে অশিক্ষকে।
এবার বলোতো কুসুম, এই ফুটন্ত পর্বে ভুল নাকি ঠিক কোনটা শিখেছ ফুটতে?
মমতা রায়চৌধুরী-এর একটি কবিতা
মন ছুঁয়ে যায় আজও
আজও কেন জানি কার জন্য
মনটা আকুলি বিকুলি করে
সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছু
বিস্মৃতির তলে গেছে ডুবে
কোথায় যেন একটা শূন্যতা
একটা অপূর্ণতার হাহাকার
মাঝে মাঝে পানকৌরির মতো
জলে ডুব দিই কিছু পেতে।
তখন দেখি আজ ও
আমার মনে বৃষ্টির জলের ছিটে
হৃদয়ের পিঞ্জরে গোপন কুঠিরে আঘাত করে
বৃষ্টির ছাটগুলো কেমন যেন এলোমেলো করে
শ্রাবণের দুপুর বেলা কদম ফুল আর কৃষ্ণচূড়া
সবকিছু কেমন একাকার হয়ে যায় তোমার কথা
মনে পড়ে আর চোখের কোনে জল আসে
তার হিসেব কাউকে দিতে পারি নে।
বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ আজো মাতাল হই
চোখ বন্ধ ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ বুকের ভেতরে ঝড় তোলে
নদীসাগর একাকার হয় পাহাড়ের দুর্গমতা হয় আপন
কোন এক মন খারাপের মুহূর্ত অনেক বেশি দামী হয়ে ওঠে
পড়ন্ত বিকেলে ছাদের চিলেকোঠাতে
আজ এতদিন পরেও কেন মন ছুঁয়ে যাও…
পরাণ মাঝি-এর একটি কবিতা
সাদা সাদা মেঘ ফুল
দ্যাখে না কেউ ; কেউ কী দ্যাখে অন্তর আগলে
মিঠে কথার জৌলুস বেজে ওঠে নিরবধি
আড়াল করা আঁধার
একা কাঁদে শোকগান
ছলনার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ আছড়ে পড়ে প্রেমল বুকে
‘ হেলাল’ শব্দ রেখায় লুকায় দ্বৈরথ
সুবর্ণ সে মহিয়ান ; মনোনদে দ্রোহের পংক্তি নাচে
আমি তাঁর চরণে রাখি সাদা সাদা মেঘ ফুল
কপিল কুমার ভট্টাচার্য্য-এর একটি কবিতা
গ্রীষ্মের কবি
তীব্র গরমে ফাটছে মাটি
গ্রীষ্ম দেখছি ভীষণ খাঁটি,
অবশেষে কাটল বেলা
সময়টা আর নয় যে হেলা,
সাজছে মঞ্চ তাড়াতাড়ি
হই হুল্লোর বাড়াবাড়ি,
কবিতা গানে কাড়াকাড়ি
মঞ্চকে নয় ছাড়াছাড়ি,
শুনবে সকলে পদ্য-গীত
হৃদয় তখন হবে প্রীত।
জ্যোৎস্না মণ্ডল-এর একটি কবিতা
প্রেমের ছায়া
হেমন্তের হাওয়া বয়ে যায় ধীরে,
তোমার স্মৃতি মেঘের ছায়া হয়ে মিলে,
হৃদয়ের আকাশে উড়ে যায়,
প্রেমের রঙিন পাখি, কোথায় যে হারিয়ে যায়।
চোখের পাতায় মিশে থাকে অশ্রুর সাগর,
তুমি যে ছিলে আমার জীবনের একান্ত প্রহর,
আলোর প্রদীপ জ্বালিয়েছিলে যেদিন,
অন্ধকারে সেই আলো নিভে গেছে হঠাৎ বিনা কারণেই।
তোমার কথা বলেছিল গোধূলির বাতাস,
ফুলের সুবাসে মিশেছিল তোমার হাসি,
কিন্তু আজ সেই হাসির প্রতিধ্বনি
শুধুই এক দীর্ঘশ্বাসের সুর,
অচেনা, অব্যক্ত, অনিঃশেষ বেদনা।
আমি জানি, তুমি ফিরবে না আর,
আমার স্বপ্নের বাগানে বসন্ত আসবে না আর,
তবুও প্রতীক্ষার পাখি ডানা মেলে,
অচিনপুরের পথে চেয়ে থাকে নিঃসঙ্গ হৃদয়।
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস |পর্ব ৩০
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
তিরিশ.
ইলেকশনের ডিউটিতে গেলে কত টাকা পাওয়া যায়
কলেজে তখন সকলেরই ইলেকশন ডিউটির চিঠি আসতে শুরু করেছে। আমরা তো পার্টটাইম শিক্ষক, আমাদেরও কি চিঠি আসবে? জিজ্ঞেস করলাম আমাদের প্রিন্সিপাল জগন্নাথ রায়চৌধুরীকে। তিনি জানালেন, “না, তোমাদের কারো আসবে না।”
—ইলেকশন ডিউটিতে গেলে কত টাকা পাওয়া যায় স্যার?
—তা ওই পাঁচ শো মতো! তুমি যাবে নাকি?
—তা স্যার সুযোগ পেলে যেতাম, পাঁচশো টাকা কি কম?
—তা আমি বলে দিচ্ছি। প্রভাত বাবু যেতে চান না, তার বদলে তুমি যেয়ো।
হ্যাঁ প্রভাত মুখার্জি কলেজের অ্যাকাউন্টেন্সির অধ্যাপক। তিনি ইলেকশনের ডিউটি করতে চান না। তাঁকে ডেকে প্রিন্সিপাল বললেন আমার কথা। সেদিনই সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে এসডিও অফিসে নিয়ে গিয়ে নিজের নামটি কেটে আমার নামটি লিখিয়ে দিলেন। বললেন, “আমাদের সহকর্মী ইলেকশনের ডিউটিতে যেতে আগ্রহী।”
পাঁচশো টাকা বাড়তি ইনকামের আশায় আমিও আহ্লাদিত হলাম। ইলেকশনের ডিউটিতে যাওয়া এমন আর কী কাজ! তাই অভিজ্ঞতা ছাড়াই রাজি হয়েছিলাম।
সে সময় ছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন। সময়টা ২০০৩ সাল। জুন-জুলাই মাস হবে। দু’দিন ট্রেনিং দিয়েছিল বিডিও অফিসে। আমি ছিলাম প্রিজাইডিং অফিসার। পরবর্তী পোলিং অফিসাররা ছিলেন বিভিন্ন হাইস্কুল ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ। আমি পার্টটাইম শিক্ষক এবং একেবারেই আনাড়ি। তাই সেই পোলিং পার্টিতে অনেকটাই বেমানান লাগছিল নিজেকেই। সব কথাই জানিয়েছিলাম, আমি শুধু টাকার জন্য এসেছি। আপনারাই চালিয়ে নেবেন। কোনো অভিজ্ঞতা নেই। যতটুকু পারি আপ্রাণ চেষ্টা করবো কাজ করার। ফাস্ট পোলিং অফিসার ছিলেন অংকের শিক্ষক। তিনি অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “কোনো চিন্তা করবেন না। ঠিক পেরিয়ে যাবেন।”
সাঁওতাল এলাকায় ভোট নেওয়ার জন্য প্রত্যেক ভোটারকেই দাবি মতো মদ পরিবেশন করতে হয়। মদ পেলেই তারা তাকেই ভোট দিতে চায়। হাঙ্গামা বা বুথ জ্যাম করে দু-একটা ভোট বাড়ানো গেলেও পঞ্চায়েতে জেতার পক্ষে সুবিধা হয়। তাই এই বুথে প্রতিবারই গন্ডগোলের রেওয়াজ চলে আসছে। আমরাও এই প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হতে পারবো না। কথাগুলি পরে শুনলাম এক মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে।
ইলেকশনের দিন পোলিং সেন্টারে গিয়ে ভোটের যাবতীয় সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছিলাম। তারপর একটা মাটিকাটা লরি দিয়ে আমাদের কর্মস্থলে পৌঁছানো হয়েছিল। ব্রহ্মাণী নদীর তীরবর্তী বৈধড়া নামে একটি গ্রামের পঞ্চায়েত নির্বাচনে আমাদের ডিউটি পড়েছিল। একেবারে সাঁওতালি এলাকা। ভোটাররা ছিল অধিকাংশই সাঁওতাল। একদিন আগে থেকেই সমস্ত কাজ গুছিয়ে রাখার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তিনটি স্তরে ভোট অর্থাৎ যাকে ত্রিস্তরীয় বলা হয়। একজন ভোটার তিনটি ভোট দিতে পারবেন—ঘ্রাণ পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদ। প্রায় নয় শত ভোটার ছিল। তিন ধরনের ব্যালট পেপার সই করে রাখতে বেশ রাত হয়ে গেল। অন্যান্য সরঞ্জাম গুছিয়ে ঠিক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। সারাদিনের ভ্যাপসা গরম। ঠিকমতো জলও পান করা হয়নি, খাবারও জোটেনি। একটা উদ্বেগ ও ক্লান্তির মধ্যে সময় কাটাচ্ছি। সঙ্গে দু’জন বন্দুকধারী পুলিশ আছে, তবুও ওরা সতর্ক করে গেছে কোন সময় ব্যালট পেপার লুট না হয়ে যায়। বামফ্রন্টের যুগ। স্থানীয় কয়েকজন কমরেড বেশ কয়েকবার এসেছেন। আমাদের সামান্যতম হেলদোল হলে প্রাণ হাতে করে ফিরতে পারবো না তারা জানিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং আমার তো কম্পিত দশা। ইলেকশন করতে এলে এরকম আতঙ্কিত হতে হয় তা কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।
পরের দিন সকাল সাতটায় ভোট শুরু করা গেল। কিছুক্ষণ চললোও। প্রথমদিকে বেশিরভাগ মেয়েরাই ভোট দিতে এলেন। বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ তারপর ঢুকতে লাগলো সাঁওতাল পুরুষেরা। অধিকাংশ ভোটাররাই টলতে টলতে এলেন। মুখে মদের গন্ধ। কেউ কেউ খিস্তি-খেউড়ও করতে লাগলেন। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন: “আমরা লাল পার্টির লোক বটে, কোনো শালাকে ভয় পাই না। কেদ্যা-হাতুড়িতেই ভোট দিব। সবার সামনেই দিব। যাদের নুন খেয়েছি তাদের গুণ গাইবো। তোদের আইন আমরা মানি না।”
ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যই ভোট দিতে লাগল। অন্য দলের এজেন্টরা আমাদের প্রতি দোষারোপ করলো। এবং একটা হাঙ্গামার সৃষ্টি হতে চললো। পুলিশকে ডাকতে গিয়ে দেখি তারা বন্দুক নিয়ে কোথায় উধাও হয়ে গেছে। কেউ কোথাও নেই। সবাই বলতে লাগলো, “এ আবার কেমন প্রিজাইডিং! ধমকানি চমকানি শাসন কিছুই বোঝে না! যে যা ইচ্ছা তাই বলে, তাই করে!”
ভয়ে আমার থরথরো অবস্থা। ফাস্ট পোলিংকে বললাম, “আপনি নিয়ন্ত্রণ করুন।”
এর মাঝেই আরও একটি গন্ডগোল, একজন সাঁওতালের ভোট আরেকজন সাঁওতাল দিয়ে চলে গেছে। ভোটার কার্ড দেখে তার ছবি বুঝতে পারেনি আমাদের অফিসাররা। পরবর্তীতে প্রকৃত ভোটার এসেছে। সে কিছুতেই মানতে চাচ্ছে না। টেন্ডার ভোটও দিতে চায় না। তাকেও সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। বুথ জুড়েই একটা হাঙ্গামার আভাস টের পাচ্ছি। বাধ্য হয়ে কন্ট্রোলরুমে ফোন করলাম। কিন্তু সেখান থেকেও সাহায্য আসতে অনেক দেরি।
সাঁওতাল এলাকায় ভোট নেওয়ার জন্য প্রত্যেক ভোটারকেই দাবি মতো মদ পরিবেশন করতে হয়। মদ পেলেই তারা তাকেই ভোট দিতে চায়। হাঙ্গামা বা বুথ জ্যাম করে দু-একটা ভোট বাড়ানো গেলেও পঞ্চায়েতে জেতার পক্ষে সুবিধা হয়। তাই এই বুথে প্রতিবারই গন্ডগোলের রেওয়াজ চলে আসছে। আমরাও এই প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্ত হতে পারবো না। কথাগুলি পরে শুনলাম এক মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে। এই অঞ্চলে তিনি নাকি দীর্ঘদিন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। তাই এদের আচার-আচরণ এবং তাৎক্ষণিক লাভ-লোকসানের কথা বোঝেন। সুতরাং আমাদেরকেও কোনোরকম সেসব ম্যানেজ করতে হলো। টেন্ডার ভোট না দিয়েই তাকে ভোট দিতে বলা হলো। যারা প্রকাশ্য ভোট দিতে চায় তারাও দিতে পারে এরকম একটি নির্দেশ জারি করতে হলো। গালিগালাজ করলেও সেভাবে আর তাদের কথায় সাড়া না দিয়ে চুপচাপ কাজ করে যেতে লাগলাম।
সেদিন ভোট শেষ করতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেছিল। তারপর কাগজপত্র শেষ করারও সময় পাইনি। কেননা সেখানে থাকলেই বিপদ। তাই সবকিছু ভ’রে নিয়ে মাটিকাটা লরিতে চেপেই জমা দেওয়ার সেন্টারে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম। সেইখানে বসেই সবকিছু করতে করতে প্রায় অর্ধেক রাত্রি পার হয়ে গিয়েছিল। সারাদিনের ক্লান্তি আর ধকলে শরীর আর প্রায় চলছিল না। ঠিকমতো খাবারও জোটেনি। কয়েকবার গরম করা চা খেয়ে জিভেও কোনো স্বাদ ছিল না। পোলিং পার্টির কাছে বিদায় নিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সকাল হয়ে গিয়েছিল। রামপুরহাট থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছিল অনেকটা পথ গ্রামের বাড়িতে। গ্রামে ঢোকার মুখে কয়েকটা কুকুর দল বেঁধে সজোরে চিৎকার করেছিল। আমার পিছনে পিছনে তারা ছুটেও এসেছিল। কিন্তু আমার পালাবার কোনো সামর্থ্য ছিল না, তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম রাস্তার মাঝখানে। গ্রামে ঢোকার মুখেই দেখা হয়ে গেল সদ্য বিয়ে হওয়া পছন্দের ছাত্রীটির পিতার সঙ্গে। কথা বলার কোনো সামর্থ্য ছিল না আমার।
—পাগলের মতো কোথা থেকে আসছো এত সকালে?
—এইতো ইলেকশনের ডিউটিতে গিয়েছিলাম!
—তা সারারাত কেটে গেল!
—হ্যাঁ কাজ করে ফিরতে ফিরতে প্রায় সারারাতই কেটে গেল।
—তোমরা তো পার্টটাইম করো তবুও তোমাদের ডিউটি থাকে?
—না, ডিউটি থাকে না, আমিই শুধু ডিউটি নিয়েছিলাম ইচ্ছে করেই।
—তা কত টাকা পেলে?
—ওই পাঁচশো মতো।
—পার্টটাইমে কত টাকা বেতন পাও?
—তা ওই দু’হাজার হবে!
—একটা প্রাইমারি চাকরি পেলেও ভালো হতো! লেখাপড়া করে কী পেলে!
—না, কিছুই পেলাম না!
জিভ টেনে ধরেছে ভেতর থেকে। মুখেও আর কথা সরছে না। তবুও মনের বিরুদ্ধে বলে যাচ্ছি। মাথা ঘুরে হয়তো পড়ে যাব। আর দাঁড়িয়ে থাকারও সামর্থ্য নেই। কিন্তু এই অসহায়তা কে বুঝবে?
মেয়ের বাপটি হয়ত জানতেন, তার মেয়েকে আমি পছন্দ করি। তিনিও চাইতেন চাকরি পেলে তারো কোনো আপত্তি থাকতো না। কিন্তু চাকরি যখন হলো না তখন আর অপেক্ষাও করলেন না। এক কোয়াক ডাক্তার দেখেই দিয়ে দিলেন বিয়ে। আর পাঁচশো টাকার জন্য আমি ফিরছি দু’রাত জেগে ইলেকশনের ডিউটি করে। এটা কি কম হাস্যকর? সুতরাং কুকুর লাগবে আমার পেছনে না তো কার পেছনে লাগবে? ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, গ্রামে কোনো ভিক্ষুক অথবা ল্যাংড়া নুলো এলে তার পেছনে কুকুর তেড়ে যায়। কিন্তু কোনো ভদ্রলোক বুটহ্যাটকোট পরে এলে কুকুরেরা চেয়েও দেখে না। সময় কতখানি খারাপ হলে এরকম অবস্থা হয়। পার্টটাইমারদের বেতন জিজ্ঞেস করা হয়। ইলেকশনের ডিউটিতে গেলে কত টাকা পাওয়া যায় তাও জানতে চাওয়া হয়। জীবন আমার সঙ্গে যে কত রঙ্গরসিকতা আর করবে ভেবে পাই না। সেদিন বাড়ি এসে দরজা বন্ধ করে একনাগাড়ে কতক্ষণ কেঁদেছিলাম তা আর বলতে পারবো না। (চলবে)
🍂অণুগল্প
কোনও শব্দ নেই ঘরে। একটা ঘড়ি টিকটিক করে চলে, কিন্তু কোনও সময় বাজে না। আমি জানালার দিকে তাকাই। রোদের রেখা ধীরে ধীরে চলে যায়, টেবিলের কাপের ধারে।
ছায়ার ঘর
জয়ন্ত দত্ত
ঘরটা ফাঁকা। জানালার পাশের টেবিলে রাখা আছে একটা কাপ, ঠাণ্ডা চা। রোদ এসে পড়ে তাতে, একটুকরো সোনালি ছায়া হয়ে। সেখানে তুমি বসেছিলে একদিন, জানালার ধারে। হেসেছিলে খুব ছোট করে। আমি ভেবেছিলাম, এই হাসি বোধহয় থেকে যাবে। এখন আর হাসি নেই, শুধু তোমার চুলের গন্ধটা জড়িয়ে আছে বাতাসে, আস্তে আস্তে হালকা হয়ে যাচ্ছে। কোনও শব্দ নেই ঘরে। একটা ঘড়ি টিকটিক করে চলে, কিন্তু কোনও সময় বাজে না।
আমি জানালার দিকে তাকাই। রোদের রেখা ধীরে ধীরে চলে যায়, টেবিলের কাপের ধারে।
চা-টা আর গরম নয়, ছুঁয়ে দেখি। ঠাণ্ডা।
তুমি আর আসবে না।
তবু, আমি প্রতিদিন জানালার ধারে বসে থাকি,
তোমার হালকা ছায়ার জন্য।
🍂ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।
কিশানগঞ্জের ফেলুদা
তাপস রায়
পর্ব ৬.
সকালের ট্রেনে আসতে আসতে বোঁদে ইচ্ছে করে গুরুকে মালবাবুর কাছ থেকে একটু দূরে সড়িয়ে নিয়ে বসেছে। কিশানগঞ্জ থেকে জলপাইগুড়ি এক ঘন্টার দূরত্ব। মালবাবু রেলের লোক। তার পাশ সারা বছরের। তিনটে সাধারণ টিকিট এ জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠেছেন। দার্জিলিং মেলের জেনেরাল কম্পার্টমেন্ট খুব ভাল। অন্য ট্রেনের স্লিপার কামরার মতো। আর সকাল ছ’টা পাঁচ-এ ছেড়ে গাড়ি সাতটা নাগাদ জলপাইগুড়ি পৌঁছে যাবে। সেখান থেকে ট্রেকারে কালিম্পং আর এক ঘন্টা। মানে দিনে দিনে সব কাজ হয়ে যাবে।
বোঁদে গুরুকে সেদিনের মালবাবুর বউ-এর সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল। চানুমতি পাহাড়ের কোনও একটা গাঁয়েরই মেয়ে। তবে বাপের বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগ নেই। তা প্রায় বছর কুড়ি হবেই। চানুমতির বাবা ত্যাজ্য করেছে চানুমতিকে। বাবা গনেশ ছেত্রী রেলের লাইনম্যান, খাঁটি নেপালি ব্রাহ্মণ। শিলিগুড়ির ছোকরা ক্লার্ক কী এমন বড় যে তার মেয়েকে বিয়ে করবে! তার উপর বাঙালি!
কিশানগঞ্জে ট্রান্সফারের চিঠি হাতে পেয়েই ঋতব্রতর বাবা শিবপ্রসাদ চক্রবর্তী চানুমতিকে সিঁদুর পরিয়ে নিয়ে ধা। সেবক রোডের বিখ্যাত কালিবাড়ির পুরুতই জানল শুধু। তারপর মেয়ের ফোন কিশানগঞ্জ থেকে। তো মেয়ের বাপ মেনে নেবে! সম্পর্ক কাট। চানুমতিও ঋতব্রতর বাপ এখনকার মালবাবুকে নিয়েই কাটিয়ে দিল সারাজীবন। ঘরের ভেতর মুখ গুঁজে কাজ করতে করতে সে এক কলে পড়া জন্তুর জীবন কাটায়।
আর এই খেলায় একটা লোককে ও দেখতে পাচ্ছে, যে আবার বাংলাও বলে। ফলে ভয় নেই। আগের অনেকগুলো টাস্ক ঋতব্রত সাফল্যের সঙ্গে করে ফেলেছে। সাতটা হরর ছবি দেখেছে সাত দিনে। লোকটা বলে দিয়েছিল কী কী দেখতে হবে। প্রথমেই দেখেছে ‘দ্য থিঙ্গ।’ সেদিন নেটফ্লিক্স-এ এই মুভি দেখার পর রাতে বাথরুমে যেতেও পারেনি। ঘুমোতেও পারেনি।
**
বাবা হোটেলে ফিরে যাবার পর ঋতব্রতর মনে হল বাবার সঙ্গের লম্বা লোকটা তাদের কটেজ নিয়ে অনেক প্রশ্ন করছিল। অত প্রশ্নের কি আছে! কেন সে বাইরের লোককে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে করা প্রশ্নের উত্তর দিতে যাবে! আর গ্রাহামস হাউসের বোর্ডিং-এ এসে সে বাংলা প্রায়ই ভুলেছে। ইংরেজিতে কথা বলা এখানকার নিয়ম। লোকটার অনেক বাংলা তো সে বুঝতেই পারছিল না।
আজকাল অবশ্য কিছুটা বাংলা বলা শিখছে কলকাতা থেকে আসা সিদ্ধার্থ মাইতি-র কাছ থেকে। সিদ্ধার্থ ঋতব্রতর ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। কটেজে শরীর-টরীর খারাপ হলে খুব করে। হস্টেল সুপারইন্টেন্ডেন্ট তো ডাক্তার ডেকে খালাস। কিন্তু মাথায় জলটল দেওয়া, ওষুধ খাইয়ে দেওয়া— সেসব কে করে! সিদ্ধার্থ একেবারে মায়ের মতো সেবা করে। গত আগস্ট মাসের আট দিনের জ্বরে ওকে যা সেবা করেছে! ঋতব্রতর মনের কাছাকাছির বন্ধু এই সিদ্ধার্থ।
ঋতব্রতকে বাংলা পড়া শিখিয়েছে সে। অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আংলা পড়ে ফেলে কী যে আনন্দ হয়েছিল! সিদ্ধার্থকে জড়িয়ে চুমু খেয়েছিল ঋতব্রত। আম-আঁটির ভেঁপু ঋতব্রতকে পড়িয়ে সিদ্ধার্থ বুঝিয়েছে কে বিভূতিভূষণ। বুঝিয়েছে বাঙালি হয়ে একটু বাঙালি সংস্কৃতির টাচ থাকা ভাল। দু’জনে ছুটির দিনে যখন কটেজের বারান্দায় বসে অঙ্ক করে, তখন সিদ্ধার্থ ঋতব্রতর কান থেকে মোবাইলের হেডফোন খুলে নিয়ে অঙ্ক করতে করতে রবীন্দ্রনাথের কবিতা শোনায় —- “তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে কেমন করে সইব/ বাতাস আলো গেল মরে এ কি রে দুর্দৈব!” আরও কত কি। কখনও ছড়া শোনায়, “তেলের শিশি ভাঙলো বলে খুকুর পড়ে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেঁড়ে খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো/ তার বেলা?” অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া।
গীর্জার ঘড়িতে ঢাং ঢাং ঢাং করে তিনটের ঘন্টা বাজল। লোকটার মুখ দেখা যায় না বটে কিন্তু বেশ রাগী। গলার স্বর থেকে তো গাম্ভীর্য ভাঙে না কখনও। মানে খুলে কথা বলে না লোকটা। একটু জ্বড়ানো স্বর। মাথার হেলমেটও কখনও খোলে না। এই লোকটা কম্পিউটরে ওয়েব ক্যামেরা চালিয়ে ভিডিও কলে ঢোকে এই সময়েই। রোজ নয়। প্রতি বৃহস্পতিবার। তার আগে অবশ্য এক সপ্তাহের টাস্ক করে রাখতে হয়। বৃহস্পতিবার লোকটাকে আগের সপ্তাহের টাস্ক দেখাতে হয়, আর নতুন সাত দিনের টাস্ক নিয়ে নিতে হয়। এই খেলাটা মোট পঞ্চাশ দিনের। এই খেলাটার জন্যই একদিন বাবাকে লুকিয়ে বাড়ি যেতে হয়েছিল। জানে শুধু মা চানুমতি।
ব্লু হোয়েলের মতো জীবনের ঝুঁকি থাকলে ঋতব্রত ঢুকত না এই খেলায়। আর এই খেলায় একটা লোককে ও দেখতে পাচ্ছে, যে আবার বাংলাও বলে। ফলে ভয় নেই। আগের অনেকগুলো টাস্ক ঋতব্রত সাফল্যের সঙ্গে করে ফেলেছে। সাতটা হরর ছবি দেখেছে সাত দিনে। লোকটা বলে দিয়েছিল কী কী দেখতে হবে। প্রথমেই দেখেছে ‘দ্য থিঙ্গ।’ সেদিন নেটফ্লিক্স-এ এই মুভি দেখার পর রাতে বাথরুমে যেতেও পারেনি। ঘুমোতেও পারেনি। কিন্তু নির্দেশ মতো পরের দিন আবার সে দেখেছে ভ্যাম্পায়ার মুভি ‘নিয়ার ডার্ক’। লোকটা চাইছিল অচেতন্ মনের ভেতর থেকে আদিম ভয়কে তুলে আনতে। যাতে সহজে ভয় পায় আর নির্দেশ মানে। তৃতীয় ছবিটি ছিল আমেরিকান হরর। ‘দ্য হিলস হ্যাভ আইজ’। এর পরের ছবি দেখতে দেখতে নার্ভ তৈরি করে ফেলেছে ঋতব্রত। উইলিয়াম ফ্রেদকিনের মুভি ‘দ্য এক্সরসিস্ট’ দেখে ফেলেছে আগের থেকে অনেক অনায়াসে। শেষ ছবিটি ছিল, আলফ্রেড হিচকক-এর ‘সাইকো’। এই ছবিতে দেখিয়েছে কেউই সেফ নয়। কোথাও পালানোর জায়গা নেই। ঋতব্রত এই সাতদিনে যেন অনেক বড় হয়ে গেল।
দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্দেশ এল সাতদিন রাত দুটো থেকে তিনটে্র ভেতর হেরোইন নিতে হবে এক গ্রাম করে। অ্যালুমিনিয়াম ফয়েলের উপর সাদা গুঁড়ো রেখে তলায় লাইটার জ্বালিয়ে গরম করে ধোঁয়া বানানো, তারপর সিগারেটের ভেতর থেকে তামাক ফেলে দিয়ে সেই ফাঁকা সিগারেটের নল দিয়ে টেনে নেওয়া।
সে যে কী আনন্দ, বলে বোঝানো যাবে না। প্রথমদিন ঋতব্রতর মনে হচ্ছিল তার চারপাশের জগত সব থেমে আছে। ভারি এক আনন্দ হাজির। চোখ বুজে আসছে। কিন্তু কিছু পরে বমি পেয়েছিল। পরের দিন ওই বমির ভয়ে সে প্রথমে নিতে চায়নি। কিন্তু খেলার শর্ত অনুযায়ি তো না নিলে চলবে না। তাই আবার সে নিয়েছে। আবার একই আনন্দ। কিন্তু দ্বিতীয় দিনে আর বমি হয়নি। তবে ঋতব্রতর ট্যাঁক থেকে রোজ ন’শো, হাজার টাকা করে চলে গেছে ওই এক গ্রাম কেনার জন্য।
পরের সাতদিন এই খেলায় জিততে দিনে একজন করে গ্রাহামস-এর ছাত্রদের হেরোইনের নেশা ধরাতে হবে। কালিম্পং-এর বাজারে কোন কোন পানের দোকানে হেরোইন পাওয়া যায়, বলে দিয়েছিল লোকটা। একদম ঠিকঠাক
করেছে সে। সাতদিনে সাতজনকে হেরোইন দিতে সফল। কাকপক্ষীও টের পায়নি। কিন্তু সোমবার অফ দিনে বাজারে গিয়ে হেরোইন কেনার সময় তার নজরে পড়েছে একটা বৃদ্ধ লোক যেন তাকে নজর করছিল। না ভুল ভেঙেছে।
লোকটা পাশের চায়ের দোকানের মালিক। জিজ্ঞাসা করায় নাম বলল, বীরবাহাদুর লিম্বু। কিন্তু লোকটাকে কেন যেন তার চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছে এ মুখ।
চতুর্থ সপ্তাহে এসে যে টাস্ক দিয়েছিল তা শুনে ক্ষিপ্ত হয়ে যায় সে। না পারবে না। লোকটা বলেছিল খেলার মাঝামাঝি জায়গায় এসে ছেড়ে দিলে লোকসান। তুমি একদিনের ডন হতে পারবে না। একদিনে তোমার নির্দেশে চলবে গোটা উত্তর-পূর্বাঞ্চচলের ক্রাইম সাম্রাজ্য। এই রাজ্যের রাজাকে ট্রাম্পও ছুঁতে পারে না। ভয় পায়। গোটা পৃথিবী চলে এই অন্ধকার জগতের টাকায়। একদিনের রাজা হয়ে তুমি যা ভেট পাবে, একজন শিল্পপতি সারা জীবনেও হয়ত তা করে উঠতে পারে না।
ঋতব্রত চেঁচিয়ে উঠেছে, “আই ডু নট ওয়ানট টু বি।”
উল্টো ছবিও চেঁচিয়েছে, “না, বাংলা বলো। খেলার শুরুতে শর্তগুলির ভেতর ছিল ইংরেজি বলা যাবে না। বাংলা বলো। ইংরেজি বললে ধরে ফেলবে ক্রাইম ডিটেকশন সফটওয়ার।” ঋতব্রত ঠান্ডা স্বরে বলেছিল, “না আমি টাকা চাই না। তোমার শর্তে সাতদিন ধরে মাস্টারবেট করতে পারব না।”
“পারবে পারবে। না পারলে চলবে! তোমার ওই গার্ল ফ্রেন্ড, ওই যে গত বছর দার্জিলিং-এ আউটিং-এ গিয়ে খুব স্মার্ট হয়ে শুধোলে – “তিমরো নাম কে হো? সে বলল, মেরো নাম মোণিকা লেপচা হো। তুমি আধো আধো নেপালী বলে তার আরো কাছে গেলে। বললে, তাপাইলাই ভেটর খুশি লাগো। —ভেবেছ শুনিনি?” (চলবে)
সম্পাদক : দেবব্রত সরকার, কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার, অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
