Sasraya News

Thursday, February 13, 2025

Sasraya News | Sunday’s Literature Special | 29th December 2024 | Issue 45 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৫

Listen

সম্পাদকীয় ✍️

হাতে গোনা কয়েকটি রহস্যমাখা দিন। এই দিন নিয়ে যত কিছু খেলা। আজ আর কালের পার্থক্যগুলো কেউ খুঁজে বার করতে পারবে না। কারণ সময়ের জন্য জীবনে প্রতিটি ন্যানো সেকেন্ডে কি অপেক্ষা করে সত্যিই কেউ আমরা জানিনা। আর জানিনা বলেই হয়ত জীবনের বেঁচে থাকার স্বাদ অন্যরকম।
আমরা প্রত্যেকেই তার বিচার করবার চেষ্টা করতে গিয়ে অসফল হয়েছি । আর আগামীতেও হতে হবে। এই মায়া রহস্যে ঘেরা পৃথিবীলোকে আমাদের জীবনদশা প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভিন্নরকম। তবুও আমরা কিন্তু সব কিছুই বুঝতে বা মানিয়ে নিতে শিখেছি সামাজিক তত্ত্বাবব্যধানে যা কিছু শিখি তাই দিয়ে।
জীবনের সঙ্গম স্থল মন। এই মনের দ্বারা মৈথুনক্রিয়া প্রতি নিয়ত ঘটতে থাকে ফলে প্রাণ শক্তি এক গভীর অনুভূতি। যাঁরা যাঁরা বিশ্রাম নেই না। তাঁদের জন্য নতুন বছর বা সময় বলে কিছুই ঘুরেফিরে না। তাঁরা শুধুই চলমান তাঁরা শুধুই বহমান। প্রতিটি মানুষের ভিড়ে আমরা শান্তি,সুখ সমৃদ্ধি, কামনা ও বাসনা খুঁজি। কিন্তু জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এক বিশেষ আকর্ষণের বন্ধনের প্রয়োজনে আটকে যায়। কিন্তু নিঃশ্বাস শেষ হলেই পথের ধুলো যা সেই দেহ তাই। এটা বড়ো হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা সকলেই বুঝে উঠতে শিখেছি। কিন্তু মোহ ত্যাগ করতে হয় জেনেও ঐ যে মায়া রহস্য আর আমিত্বের জালে ঘিরে এলোমেলো।

 

 

 

আমাদের পরিচিতির জন্য একটি সুন্দর নাম, ব্যবহার হয়ে থাকে। এই নামের অর্থ কিন্তু চিহ্ন। মানে পরিষ্কার যে আমাকে যখনিই নামের ছত্রে ফেলা হয় তখন আমাকে বোঝাতে চিহ্ন ব্যবহার করতে হয়। এই সমস্ত খেলায় হল “মাসলেশ ম্যজিক” যা ভরহীন জাদুতত্বের একটি উদাহরণ। যার মধ্যেই সমস্ত কিছু প্রবাহমান। বয়ে চলেছে। মন স্থির করলেই আমরা সবটাই পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। কিন্তু মন স্থির হবে কি করে! তার জন্য অনেক অনেক পরিষ্কার হতেই হবে।
প্রতিটি মুহূর্ত আসে নতুনের খোঁজে। আর বহমান নতুন চলে যায় বয়তে বয়তে। আমাদের বয়স কমতে কমতে হারিয়ে যায়।
আবার নতুনকে স্বাগতম করে উঠি।

 

 

 

 

ঈশ্বর মঙ্গলময়। মঙ্গল হোক সকলের সুস্থতা কামনা করি সুখ শান্তি দুঃখ এগুলি যাদের সঙ্গে আড্ডা মস্করায় ভাগ করে নিতে পারি তারাই তো আসলে বন্ধু। আর এই বন্ধু প্রেমের সম্বোধন। প্রীতির সম্বোধন। ভালোবাসার সম্বোধন। এই সম্পর্ক চিরটুট বন্ধন।
সাশ্রয় নিউজ এর সকল বন্ধু ভালো থাকুন। পৃথিবীর সকলেই ভালো থাকুন । শুভ ইংরেজি নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি শুভেচ্ছা অভিনন্দন ও ভালোবাসা জানাই।🍁

 

 

 

🍂আত্ম-জিজ্ঞাসা

 

 

 

বিবেক কথা

 

মি বাল্যকাল হইতে সত্যের সন্ধান করিতাম, বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের সভায় যাইতাম। যখন দেখিতাম, কোন ধর্মপ্রচারক বক্তৃতা- মঞ্চে দাঁড়াইয়া অতি মনোহর উপদেশ দিতেছেন, তাঁহার নিকট বক্তৃতার শেষে গিয়া জিজ্ঞাসা করিতাম,
“এই যে সব কথা বলিলেন, তাহা কি আপনি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি দ্বারা জানিয়াছেন, অথবা উহা কেবল আপনার বিশ্বাসমাত্র? ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে আপনি নিশ্চিতরূপে কি কিছু জানিয়াছেন?”
তাঁহারা উত্তরে বলিতেন, “এ- সকল আমার মত ও বিশ্বাস। অনেককে আমি এই প্রশ্ন করিতাম,
“আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করিয়াছেন?”
কিন্তু তাঁহাদের উত্তর শুনিয়া ও তাঁহাদের ভাব দেখিয়া আমি সিদ্ধান্ত করিলাম যে, তাঁহারা ধর্মের নামে লোক ঠকাইতেছেন মাত্র। এখানে ভগবান শঙ্করাচার্যের একটি কথা আমার মনে পড়িতেছেঃ
” বিভিন্ন প্রকার বাক্যযোজনার রীতি, শাস্ত্রব্যাখ্যার কৌশল পণ্ডিতদিগের ভোগের জন্য; উহা দ্বারা কখনও মুক্তি হইতে পারে না।”

 

 

 

 

এইরূপে আমি ক্রমশঃ নাস্তিক হইয়া পড়িতেছিলাম, এমন সময় এই আধ্যাত্মিক জ্যোতিষ্ক
আমার ভাগ্যগগনে উদিত হইলেন। আমি এই ব্যক্তির কথা শুনিয়া তাঁহাকে দর্শন করিতে গেলাম। তাঁহাকে একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায়
কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন? আমি সারাজীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাঁহার নিকট গিয়া তাঁহাকেও জিজ্ঞাসা করিলাম,
“মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?
তিনি উত্তর দিলেন-
“হ্যাঁ।”
“মহাশয়, আপনি কি তাঁহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন?”
“হ্যাঁ।”
“কি প্রমাণ?”
“আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাঁহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরও স্পষ্টতর, আরও উজ্জ্বলতররূপে দেখি।”
আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম। এই প্রথম আমি একজনকে দেখিলাম, যিনি সাহস করিয়া বলিতে পারেন,
“আমি ঈশ্বর দেখিয়াছি, ধর্ম সত্য, উহা অনুভব করা যাইতে পারে- আমরা এই জগৎ যেমন প্রত্যক্ষ করিতে পারি, তাহা অপেক্ষা ঈশ্বরকে অনন্তগুণ স্পষ্টরূপে প্রত্যক্ষ করা যাইতে পারে।”
ইহা একটা তামাসার কথা নয়, বা মানুষের তৈরি কোন গল্প নয়, ইহা বাস্তবিক সত্য। আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম। অবশ্য সকল কথা আমি এখন বলিতে পারি না, তবে এইটুকু বলিতে পারি- ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে।

মদীয় আচার্যদেব বলিতেন,
“জগতের অন্যান্য জিনিস যেমন দেওয়া-নেওয়া যায়, ধর্ম তদপেক্ষা অধিকতর প্রত্যক্ষভাবে
দেওয়া-নেওয়া যাইতে পারে।”

অতএব, আগে ধার্মিক হও, দিবার মতো কিছু অর্জন কর, তারপর জগতের সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহা বিতরণ কর। ধর্ম বাক্যাড়ম্বর নহে, মতবাদ বিশেষ নহে, অথবা সাম্প্রদায়িকতা নহে।…
মন্দির বা চার্চ নির্মাণ অথবা সমবেত উপাসনায় ধর্ম হয় না ; কোন গ্রন্থে, বচনে, অনুষ্ঠানে বা সমিতিতেও ধর্ম পাওয়া যায় না ; ধর্মের আসলকথা-অপরোক্ষানুভূতি।
আর আমরা সকলেই দেখিতেছি- যতক্ষণ না সত্যকে জানা যায়, ততক্ষণ কিছুতেই তৃপ্তি হয় না।
আমরা যতই তর্ক করি না কেন, যতই উপদেশ শুনি না কেন, কেবল একটি জিনিসেই আমাদের তৃপ্তি হইতে পারে- সেটি আমাদের নিজেদের প্রত্যক্ষানুভূতি, আর এই
প্রত্যক্ষানুভূতি সকলের পক্ষেই সম্ভব, কেবল উহা লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে। এইরূপে
ধর্মকে প্রত্যক্ষ অনুভব করিবার প্রথম সোপান-
ত্যাগ। যতদূর সাধ্য ত্যাগ করিতে হইবে। অন্ধকার ও আলোক, বিষয়ানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ- দুই-ই কখনও একসঙ্গে অবস্থান করিতে পারে না।
“তোমরা ঈশ্বর এবং ধনদেবতার সেবা
একসঙ্গে করিতে পার না।…

ঋণ : স্বামীজীর বাণী ও রচনাঃ সংকলন || মদীয় আচার্যদেবউদ্বোধন কার্যালয়

 

 

 

🍂গল্প

 

______________________________________________

তোমার এই গ্রামে মন টেকে না আমি জানি।‌ ভেবেছি তোমাকে নিয়ে শহরে চলে যাব। এখানে আমারও আর ভাল লাগে না”। একথা শুনে অরুন্ধতী যেন আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়েছিল সেদিন রাত্রে।

______________________________________________

 

কোমললতা ঠাকরুন

হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

ভৈরবনাথ মুখোপাধ্যায় সবেমাত্র গয়া ফেরত বাতাসপুর স্টেশনে এসে নেমেছেন। স্টেশনে হাত মুখ ধুয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, এমন সময় হঠাৎ টের পেলেন কেউ যেন পিছু পিছু আসছেন। এরপর শুনলেন সেই চেনা ককণ্ঠস্বর… “ঠাকুরপো, তুমি আমাকে গয়ায় দিতে গিয়েছিলে ঠিক। আমি থাকিনি… এ বাড়ি থেকে কোথাও নড়ব না..”।

বীরভূম জেলার আহমেদপুরের নিকট নিরিশা গ্রামে মুখার্জী পরিবারের বসবাস তিনপুরুষ ধরে। শোনা যায় এদের আদি গ্রাম ছিল মুর্শিদাবাদ জেলার চন্দহাটে, কোনো এক সময় এদের জমিজায়গা প্রতিপত্তি ছিল বেশ অনেকখানি। কিন্তু তখন দেশে ঠগবাজ লোকজনের অভাবও কম ছিল না। কোনো এক অবস্থাসম্পন্ন ব্যাক্তির দ্বারা তাঁরা প্রতারিত হন। ফলস্বরূপ জ্ঞাতিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। এভাবেই একসময় নিরিশা গ্রামে এসে পড়ে এই পরিবার। সেখানে কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, তার দুই ছেলে ভৈরবনাথ আর বৈদ্যনাথকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এখানেও তাদের জমিজমা ভালোই ছিল। চাষবাস নির্ভর স্বচ্ছল ব্রাহ্মণ পরিবার যেমনটা হয় আর কী। কিছুদিনের মধ্যেই বৈদ্যনাথ বিবাহযোগ্য হয়ে ওঠে। চারিদিকে পাত্রী দেখা শুরু হয়। অবশেষে বীরভূম জেলার দাইহাটা গ্রামের একটি মেয়ের সঙ্গে বৈদ্যনাথের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মেয়েটির নাম কোমললতা। বছর এগারোর মেয়েটি দেখতে বড় ফুটফুটে , এইটুকু বয়সেই সমস্ত কাজকর্মে পারদর্শী। কালিপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়ের তখন সবেমাত্র স্ত্রী গত হয়েছেন। এমতাবস্থায় মেয়েটি সংসারে গৃহে স্বয়ং মালক্ষ্মী হয়ে এলেন।

কথাপ্রসঙ্গে বলে রাখি, মেয়েটির নাম এবং চেহারার সঙ্গে তার কণ্ঠের বিন্দুমাত্র মিল ছিল না। গলাখানি বড় কর্কশ। মজা করে বৈদ্যনাথ বন্ধুদের বলতেন, এ গ্রামের কাক, চিলেরা বুঝি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তবে যাইহোক ঢেঁকিশাল থেকে গোয়াল সমস্তটা ছিল এই কোমললতার নখদর্পণে।এক চুল নড়চড় হলে চেঁচিয়ে মাত করতেন সারা পাড়া। সংসার চলছিল বেশ গতিতে। এরমধ্যে ছোটোপুত্র ভৈরবনাথের বিবাহের জন্য মনস্থির করলেন কালি প্রসন্ন। বীরভূম জেলার ঝলকা গ্রামের মেয়ে যশোমতীর তখন বয়স সবে মাত্র নয়। মেয়েটি বড় বুদ্ধিমতী। তখনকার দিনে কিভাবে সকলের চোখকে এড়িয়ে কেলাসের পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়েছিলেন। ওই মেয়েটিকে কালীপ্রসন্ন পছন্দ করে বসে, তার ছোটোছেলে ভৈরবনাথের জন্য। ছেলে পড়াশোনা জানে, পুলিশে চাকরি পেয়েছে। যশোমতী তার উপযুক্ত পাত্রী বলেই মনে হয়। যা ভাবা তাই কাজ। কোনো এক ফাল্গুন পূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে বিবাহ সম্পন্ন হয়। কোমললতা কিন্তু লেখাপড়া কিছুই জানে না। স্বভাবতই লেখাপড়া জানা দেবরের বউকে জব্দ করতে, চোখ রাঙিয়ে কাজ শেখাতে শুরু করে। কথায় কথায় খোঁটা দেয় নেকাপড়া কোনো কাজে লাগবে না। শ্বশুরবাড়ির ভাত খেতে হলে কাজকর্মে নিপুণ হতে হবে। যশোমতীও নিজের দিদির মত তার সব কথা মন দিয়ে শোনে। বুদ্ধিমতী এই মেয়েটি বুঝে ফেলে এ বাড়িতে টিকে থাকতে হলে বিদ্যে নয় বরং কোমললতার খোসামোদ করা খুব দরকার। এতদিনে, কালীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায় কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ছেলেদের বিবাহ দেওয়া শেষ। এখন তারও বয়স হচ্ছে। ঘাড় থেকে এই সংসারের জোয়াল কিছুটা হলেও নামিয়ে রাখবেন। এই ভাবতে ভাবতে গড়গড়ে টানছেন বৈঠকখানায়।

বাবু মশাই সর্বনাশ হয়ে গেছে একটিবার ঘর দিকে, বলে, মাইনদার উমাপদ ছুটে এল। অন্তঃপুরে ততক্ষণে কান্নার রোল। বাইশে ভাদ্র কোমললতা মারা গেলেন। সর্বনাশ এই ছোট্ট মেয়ে যশোমতী কিভাবে একা এই সংসারের হাল ধরবে এইভেবে কালিপ্রসন্ন চিন্তিত হয়ে পড়লেন। শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে যাওয়ার পর আত্মীয়স্বজন সকলেই পরামর্শ দিলেন বৈদ্যনাথের যেন দ্বিতীয়বার বিবাহের কথা ভাবা হয়। পিসীমা যাওয়ার কালে হাত ধরে পই-পই করে বলে গিয়েছেন, “বদুর মুখখানার দিকে তাকানো যাচ্ছে না”। আঠারো বছর বয়সেই পত্নী বিয়োগের ব্যথা, কথাখানা অমান্য করার নয়। কালিপ্রসন্ন স্থির করলেন ছেলের আবার বিয়ে দেবেন। এই ভাবনার শুরুর দিন থেকেই শুরু হল আসল কাণ্ড। মাটির বাড়ির দোতলায় দুখানি ঘর। সিঁড়িতে উঠেই লোহার চাপা কপাট। সেইদিন থেকেই হঠাৎ হঠাৎ সেই কপাট মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়, কিছুক্ষণ পর আপনা থেকেই খুলে যায়। ভৌতিক কাণ্ড। সকলেই ভয় পেয়ে যায় এই ঘটনায়‌। এরপর একদিন হরিনাম সংকীর্তন দেওয়ার মনস্থির করেন বাড়ির কর্তা কালিপ্রসন্ন। হঠাৎ দেখলেন কীর্তনীয়া গান ধরার সঙ্গে সঙ্গে মোটা মোটা মাটির ঢেলা পড়তে শুরু করল। সকলেই ভয়ে ছুটে পালালো। গ্রামে গ্রামে এই খবর রটে গেল মুখার্জী বাড়িতে ভূতের বাস শুরু হয়েছে। সন্ধ্যা বেলায় খুব প্রয়োজন না হলে কেউ আসতে চায় না। যদি বা কারুর ডাক পড়ে রামনাম করতে করতে আসেন। বাড়িতে লোকজন খেতে বসেছেন, এমন সময় নর্দমার পঁচা গন্ধ কোথা থেকে যেন ধেয়ে আসছে। সকলেই নাকে কাপড় দিয়ে, খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। কখনও কখনও সামনের বাঁশ ঝাড়েে, একটি বাঁশ ওঠানামা করছে।

এমতাবস্থায় বীরভূম জেলার সিউড়ির নিকট গোবরা গ্রাম থেকে একটি মেয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে একজন ঘটক। বৈদ্যনাথের আবার বিবাহ স্থির হয়। নতুন কুটুমদের এসব কথা গোপন রাখা হয়। যদিও আগেকার দিনে এইসব ভৌতিক ঘটনা তেমন কোনো আশ্চর্য বা হাসির বিষয় ছিল না বরং যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল এসবের। বরং এরজন্য যত ঝাড়ফুঁক বাবার উদয় হয়েছিল। বলা ভালো প্রকোপ ছিল। কিন্তু বিবাহের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে এদিকে কোমললতার অত্যাচার তত অসহ্য হয়ে ওঠে।

শোনা যায় বৌভাতের দিন এত মাটির ঢিল পড়তে থাকে কন্যেযাত্রী প্রায় না খেয়েই উঠে পড়ে। এরপর অতি উৎসুক কোনো আত্মীয় আসল ঘটনা জেনে ফেলে কালিপ্রসন্ন বাবুকে আশ্বস্ত করে বলেন, “আরে মশাই গয়ায় গিয়ে পিন্ডি দান করলে ভূতের বাবাও আর আসবে না। অবিলম্বে কাউকে দিয়ে গয়ায় পিন্ডি দানের ব্যবস্থা করুন”।

লজ্জিত কালি প্রসন্ন বাবু ঘাড় নেড়ে একথার পূর্ণ সম্মতি জানালেন। এরপর অষ্টমঙ্গলা সেরে উষারানী শ্বশুরবাড়িতে পা রাখলেন। এই আটদিনে তিনি হাজার কথা শুনেছেন কোমললতাকে নিয়ে। পাড়াপ্রতিবেশী থেকে শুরু করে ঘরের আত্মীয় জ্ঞাতিগুষ্টিরা সমস্ত কথা ফাঁস করে দিলেন।

স্বভাবতই উষা বড় ভয়ে ভয়ে থাকে। কিন্তু উষা বড় ভালো মেয়ে। ভাবখানা এমন কোমললতা যেন তার সতীন। সতীনকে মেনে নিয়েই তাকে ঘর করতে হবে এমনটা যেন কেউ বলে দিয়েছে। সে কারণেই সদা সর্বদা সে বৈদ্যনাথকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বৈদ্যনাথের এতে ভীষণ রাগ হয় । উষা তাকে কখনও ভাত বেড়ে দেন না, তার কাছে বসে পাখা করে না। হাতের কাছে কাজের জিনিসপত্র গুছিয়ে দেন না, এমনকি স্নান করে আহ্নিক করার সময় কম্বলের আসন এবং কোশা-কুশীটা রেখে দৌড় দেয় সে। যেন বৈদ্যনাথ স্বয়ং ভূত। কিন্তু একদিন বৈদ্যনাথ তাকে জিজ্ঞাসা করে বসে, “উষার সম্ভবত তাকে অপছন্দ। “ছোটো উষা তখন বলে, “ও পাড়ার খুড়িমা বলেছেন দিদির আপনার উপর খুব মায়া ছিল তাই আমার উচিত আপনার থেকে দূরে থাকা নইলে আমাকেও উনি মেরে দেবেন। তাই যতদিন উনি মায়া কাটিয়ে এ’বাড়ি থেকে না যাচ্ছেন ততদিন এভাবেই থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।” বৈদ্যনাথ ভীষণ হাসতে থাকে। তিনি সেকথা শুনে‌ মজা করে বলেন, “ঠিক আছে আমি তোমাকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। তুমি যখন আমার কাছে আসবে তখন বলবে, ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম- লক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমার কী?” উষা বাধ্য মেয়ের মত ঘাড় নাড়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই বৈদ্যনাথের সঙ্গে উষার বেশ ভাব ভালোবাসা জন্মে। কিন্তু যশোমতী লক্ষ্য করতে থাকে যত ভাসুরের সঙ্গে উষার ভাব বাড়ে তত বাড়িতে ভৌতিক অত্যাচার বাড়তে থাকে। হঠাৎ সেদিন সন্ধ্যায় একটি কালো বিড়াল উঠোনের পাশ দিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ মিলিয়ে গেল।
কেউ কোত্থাও নেই, উঠোনে কয়েক বিন্দু রক্তের ফোঁটা।

ঠিক তার পরেরদিনই ঘটে গেল সেই দুর্ঘটনা। সকালে দুয়ারে মারুলী দেওয়ার জন্য জল আনতে গিয়ে, ঘরের লাগোয়া গড়েতে পড়ে মৃত্যু হয় উষার।

মেয়ের বাবা খবর পেয়ে ছুটে এসে ডুকরে কেঁদে উঠলেন,এই বলে, “সকাল বেলা উষা আমার ডুব দিল”। যাহোক অপঘাতে মৃত্যু। তিনদিনে শ্রাদ্ধ শান্তি শেষ হল। গ্রামের সকলে এ ঘটনায় বড় ভয় পেল। মুখার্জী বাড়িতে সচারাচর এখন আর কেউ ঢুকতে চায় না। ভূতের বাড়ি বলেই এখন সকলে সম্বোধন করে। কালিপ্রসন্ন দিন দিন ভেঙে পড়লেন এবং মনস্থির করলেন গয়া দেওয়ার। এরমধ্যে কী যে হল, লাভপুর অঞ্চলের কোনো এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের পিতা কৌলিন্য বজায় রাখতে তার দশ বছরের প্রতিমার সঙ্গে বৈদ্যনাথের বিবাহের প্রস্তাব রাখলেন। কালিপ্রসন্ন এবার সব সত্য কথা খুলে বললেন, তার ছেলের বিবাহ দেওয়া মাত্রই বউ টেকে না, অনুরোধ করব, আপনি অন্যত্র পাত্রস্থ করুন মেয়েকে। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা বললেন, “আমি গোটা গ্রামে খোঁজ নিয়ে দেখেছি এই পরিবারের লোকজন বড় সজ্জন। বাড়ির বউরা মেয়ের মত থাকে দয়াকরে আমার এই অভাগী মা’ মরা মেয়েটিকে আপনার শ্রীচরণে ঠাঁই দিন।”
অগত্যা কালিপ্রসন্ন আর অমত করলেন না। একেই তো দু’ দুটো অঘটনের পর এভাবে মেয়ে দিতে আসা পিতা জুটবে কী না সন্দেহ! হয়ত ঈশ্বরের এই ইচ্ছা। যাহোক সামনের অগ্রহায়ণে বিবাহ সম্পন্ন হয় প্রতিমা এবং বৈদ্যনাথের।

তবে কোমললতার সঙ্গে ভাব ভালোবাসা না জন্মালেও উষার সঙ্গে বৈদ্যনাথের ভাব বেশ জমে উঠেছিল ফলে প্রতিমার দিকে তিনি ফিরেও তাকালেন না। এমনভাব, যেন সংসারের প্রতি দায়বদ্ধতায় এ বিবাহ। কিন্তু তাতেও প্রতিমার কপালেও সুখ জুটলো না। কোমললতার অত্যাচার দ্বিগুণ বেড়ে গেল। প্রতিমা ভয়ে ভয়ে থাকে কখন ভূত এসে তার ঘাড় মটকায়।

যাহোক, একবছর পর বৈদ্যনাথের মনে হল, ‘যে গেছে সে তো আর ফিরবে না। প্রতিমার প্রতি অবিচার করা হচ্ছে। প্রতিমাকে কাছে টেনে নেয় সে। কিন্তু এই টেনে নেওয়াই কাল হল প্রতিমার জীবনে। মাত্র তিনদিনের জ্বরে মারা গেল প্রতিমা। আবার শোকের ছায়া নেমে এল মুখার্জী পরিবারে। এবার যেন সংসারের সকলেই নড়েচড়ে বসেছেন। লক্ষ্য করা হয়েছে, প্রতিমার মৃত্যুর ঠিক আগেও বাড়িতে থাকা একটা মস্ত ফলন্ত আতাগাছ ভেঙে পড়ল। সকলে মৃত্যুর খবর শুনে বললেন, “এ কাজ আর কারুর নয়…।”

এই ঘটনার পর বৈদ্যনাথ নিজেও ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থির হয়, ছোটো ছেলে ভৈরবনাথ‌ গয়া যাবে। এই গয়া গিয়ে পিন্ড দান করলে না কী মৃত আত্মা আর ফিরতে পারেন না। কারণ সেসময় ভূত নিয়ে সংসার করা যেন একটা সাধারণ সমস্যা ছিল। চিকিৎসা ব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না ফলে মানুষের মৃত্যুর হার ছিল বেশি এবং মনে করা হয় সে কারণেই চারিদিকে অতৃপ্ত আত্মার প্রকোপটাও বেশি। এইসব সমস্যা সমাধানের জন্য গয়ায় গিয়ে পিন্ডদানে কিছুটা রেহাই মিলত। এটাই ছিল মুক্তির একমাত্র পথ।

ভৈরব নাথ মুখোপাধ্যায় গয়া চলেছেন। কালিপ্রসন্নের এই ছোটো ছেলের অদম্য সাহস। তিন সন্ধ্যা আহ্নিক করতেন। কিন্তু যখন তিনি গয়ার টিকিট কাটছেন‌ বুঝতে পারছেন কেউ যেন তার সঙ্গে সঙ্গে যাচ্ছেন এবং স্টেশনে নামা মাত্র বিভিন্ন ঝড়ের সম্মুখীন হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি লক্ষ্যে অবিচল। পিন্ডদান সেরে এবং ওখানে পুজো দিয়ে ফেরার টিকিট কাটেন।

ট্রেনে আসতে আসতে তিনি ভাবলেন এবার বাড়িতে শান্তি আসবে এবং দাদার একটা ভালো মেয়ে দেখে বিবাহ দেবে, পিতার বয়স হচ্ছে তারমধ্যে এই অশান্তি।

যাইহোক ট্রেন এসে বাতাসপুর স্টেশনে থামল। ভৈরব নাথ হাত, মুখ ধুয়ে বাড়ির পথ ধরেছেন… এমন সময়… সেই চেনা গলা… ঠাকুরপো!

এর বহুদিন পর শোনা গিয়েছিল বৈদ্যনাথের চতুর্থ নম্বর বিবাহ হয়েছিল কল্পনা নামে এক মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু সে মেয়েটিও মারা গিয়েছিল কোনো এক অজ্ঞাত কারণে…। কিন্তু মারা যাওয়ার আগের রাতে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। চারিদিকে বালি উড়ছে, ভীষণ অন্ধকার। কিন্তু পরেরদিন উঠে ঝড়ের কথা বলতেই গ্রামের লোকজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে, ওদের চাহনি বলে দেয় গ্রামের লোকজন সেই ঝড় দেখতে পাইনি। এরপর এই পরিবার একদিন জানতে পারে, বোলপুরের নিকট সাঁওতা নামে একটি গ্রাম রয়েছে। সেখানে একটি জিন আছে। সেই জিন না কি মানুষের উপর ভর করে সমস্ত রকম ভূতকে তাড়াতে সমর্থ। যাইহোক সেই জিন নির্দেশ দিয়েছিলেন আগামী অমাবস্যায় বাড়ির সব সদস্যদের বাড়ির বাইরে থাকতে হবে এবং ঘরে কেউ থাকবে না। শুধুমাত্র একটি আসন পেতে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখে চলে যাবে। পরদিন সকালে এসে সবাই দেখল, প্রদীপটা নিভে গেছে আর আসনখানি ভাঁজ করা। এরপর একমাস যাবত কোনো আওয়াজ, ভৌতিক কাণ্ড কিছুই দেখা যায় না।

তখন মনস্থির হয় বৈদ্যনাথের এবার বিবাহ দেওয়া যেতে পারে। পাশের গ্রামের হারাধন চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে অরুন্ধতীর সঙ্গে বিবাহ স্থির হয়। যদিও এ বিয়ের বিষয়ে সকলের ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু মেয়ের বাড়ির লোকজন বলে, “এ মেয়েকে পাথরে ছুঁড়ে দিলেও মরবে না”।
স্বভাবতই সকলের সম্মতি এবং ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে বিয়ে দেবেন মনস্থির করলেন বৃদ্ধ কালিপ্রসন্ন। বিয়ের কিছুদিন যেতে না যেতেই মারা গেলেন কালিপ্রসন্ন। বিয়ের বছর ঘুরতে চলল কোনো সন্তানাদি জন্ম নিল না বৈদ্যনাথের ঘরে। তবুও অরুন্ধতীকে আঁকড়ে ধরে বৈদ্যনাথ বিষয় সম্পত্তি বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন।
তবে অরুন্ধতীর এই গ্রামটাকে কোনোদিন আপনার করতে পারেননি।
কী যেন এক অতৃপ্তি! তবুও বৈদ্যনাথ সুখী করতে চেয়েছিল অরুন্ধতীকে। একদিন রাতে এসে সে বলে, “তোমার এই গ্রামে মন টেকে না আমি জানি।‌ ভেবেছি তোমাকে নিয়ে শহরে চলে যাব। এখানে আমারও আর ভাল লাগে না”। একথা শুনে অরুন্ধতী যেন আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে শুয়েছিল সেদিন রাত্রে। হঠাৎ কালো করে মেঘ ঘনিয়ে এল। চারিদিকে প্রচণ্ড বৃষ্টি শুরু হল। সকালে ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে অরুন্ধতী স্বামীকে ডাকতে লাগল। এমন সময় সাড়া না পেয়ে ঠাকুরপো করে কেঁদে উঠল। ভৈরবনাথ পাশের ঘর থেকে ছুটে গিয়ে দেখলেন দাদা আর নেই! মুখ দিয়ে ফেনা উঠে আছে। তড়িঘড়ি গ্রামের সকলকে খবর দিতে গিয়ে বাইরের সদর দরজার কাছে এল। দেখল, দরজার সামনে একটা কালো খরিশ সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আওয়াজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোথাও কোনো‌ গর্তে সম্ভবত ঢুকে পড়েছে। আর দেখা গেল না। ভৈরবনাথ তখন লোকজন ডাকাডাকি শুরু করেছে।

এরপর বহু বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। একে একে পরিবারের সকলেই চলে গেলেন। কেবলমাত্র বৈদ্যনাথের পঞ্চম স্ত্রী বেঁচে রইল। অন্য দিকে ভৈরনাথের দুই ছেলে দুই মেয়ে। ছেলেরা দুজনেই বাইরে থাকেন। মেয়েদের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। এই ভুতুড়ে বাড়িতে বৈদ্যনাথের স্ত্রী অরুন্ধতী একা আর থাকতে চাইলেন না। গ্রামেই তার ভাইপোর সংসারে থেকে গেলেন আমৃত্যু। শোনা যায় তিনি একশো বছর বেঁচে ছিলেন।

এরও অনেকবছর পরে ভৈরব নাথের ছোট পুত্রবধূ রত্নাদেবী এলেন আদি শ্বশুরবাড়িতে। এইসব অলৌকিক ঘটনা গ্রামের মানুষের মুখেই শোনেন তিনি। তার মুখেই শোনা সেসব ঘটনা।

তিনি শুনেছিলেন কোনো এক অজ্ঞাত নারীর ছায়া মুর্তি আজও না কি প্রতি সন্ধ্যায় এসে মুখার্জী বাড়ির ঘরে প্রদীপ জ্বেলে যান…। একদা জমকালো বাড়ি আজ ভগ্ন স্তুপের মত দাঁড়িয়ে রয়েছে…। সুযোগসন্ধানী লোকজন আশেপাশের জায়গা দখল নিয়ে নিচ্ছে…‌। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শোনা যায় এখনও সে ছায়া মুর্তি ঘুরে বেড়ায় প্রতিরাতে…! (চলবে)

 

 

🍂ফিরে পড়া | কবিতা 

 

 

 

 

জীবনানন্দ দাশ -এর কবিতা 

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে

 

এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে— সবচেয়ে সুন্দর করুণ :
সেখানে সবুজ ডাঙা ভ’রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;
সেখানে গাছের নাম : কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;
সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;
সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে,— সেখানে বরুণ
কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা জলাঙ্গীরে দেয় অবিরল জল;
সেইখানে শঙ্খচিল পানের বনের মতো হাওয়ায় চঞ্চল,
সেইখানে লক্ষ্মীপেঁচা ধানের গন্ধের মতো অস্ফুট, তরুণ;

সেখানে লেবুর শাখা নুয়ে থাকে অন্ধকারে ঘাসের উপর;
সুদর্শন উড়ে যায় ঘরে তার অন্ধকার সন্ধ্যার বাতাসে;
সেখানে হলুদ শাড়ি লেগে থাকে রূপসীর শরীরের ’পর—
শঙ্খমালা নাম তার : এ-বিশাল পৃথিবীর কোনো নদী ঘাসে
তারে আর খুঁজে তুমি পাবে নাকো বিশালাক্ষী দিয়েছিল বর,
তাই সে জন্মেছে বাংলার ঘাস আর ধানের ভিতর।

 

 

 

🍂ফিরে পড়া | গল্প 

 

______________________________________________

অর্থাৎ গত তিন বছর ধরেই অনীতা সুরভির মৃত্যুকামনা করে এসেছে৷ বুকের মধ্যে একটা ঘা মারার শব্দ শুনল অনিমেষ৷ সে শব্দ কি তারও আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি! না, তা কি করে হয়! সুরভি বেঁচেছিল বলেই তো অনীতার প্রতি তার আকর্ষণ এত জ্বলন্ত ছিল জীবন্ত ছিল৷

______________________________________________

 

রক্তের ফোঁটা

অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত

 

 

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠাৎ পা হড়কে পড়ে যাচ্ছিল অনিমেষ৷ মুহূর্তে রেলিংটা ধরে ফেলে সামলাল নিজেকে৷

নিজের দিকে তাকাল৷ কই কিছুই পড়ে-টড়ে নেই তো! কলার খোসা, আমের চোকলা, নারকেলের ছোবড়া—কিছু নেই তো! জলও তো নেই এক ফোঁটা৷ শুকনো খটখটে সিঁড়ি৷ জুতোর তলাটাও দেখল একবার৷ সেখানেও কিছু লেগে নেই৷

মনে মনে হাসল অনিমেষ৷ খুব তাড়াতাড়ি করছিল বলেই হয়তো পা বেচাল হয়ে পড়েছিল৷ ছন্দ রাখতে পারেনি ঠিকমতো৷

চক্ষের পলকে কী দুর্ঘটনাই না হতে পারত৷ ভাঙতে পারত হাড়গোড়, মাথা, মেরুদণ্ড৷ এতক্ষণে তাহলে রেল স্টেশনের পথে না হয়ে হাসপাতালের পথে৷ ট্যাক্সিতে না হয়ে এ্যাম্বুলেন্সে৷ সত্যি, এক চুলের ফারাক একটা সূতোর এদিক-ওদিক৷

এত তাড়াহুড়োর কোনো মানে হয় না৷ অনিমেষের এখন বয়স হয়েছে৷ তার ধীর-স্থির হওয়া উচিত৷

কিন্তু কী আশ্চর্য, ঠিক সময়ে, সমর্থ হাতে রেলিংটা ধরে ফেলতে পারল৷ ঠিক অত দূরে রেলিং, পড়বার সময় হাতের হিসেব থাকল কী করে? মনে হল কে যেন হাতের কাছে রেলিংটা এগিয়ে এনে দিয়েছে৷

কিছু বলেনি, তবু ট্যাক্সিটাও ছুটেছে প্রাণপণ৷ যেন ড্রাইভারেরও ভীষণ তাড়া৷ কিন্তু বেগে ছুটলেই আগে পৌঁছুনো যায় না সব সময়৷
মনে হচ্ছিল, ট্যাক্সিটাই অ্যাকসিডেন্ট করে বসবে৷ হয় কাউকে চাপা দেবে নয়তো হুমড়ি খেয়ে পড়বে কোনো গাড়ির উপর, নয়ত কোনো মুখোমুখি সংঘর্ষ৷ অত শত না হয়, নির্ঘাৎ জ্যাম হবে রাস্তায়৷ ট্যাক্সিটা পৌঁছুতে পারবে না৷ ট্রেন ছেড়ে দেবে৷
যেন এত সুখ সহ্য করবার নয়৷ ভাগ্য ঠিক বাদ সাধবে৷ বাগড়া দেবে৷ না, হন্তদন্ত ট্যাক্সি শেষে পর্যন্ত এসে পৌঁচেছে৷ ট্রেনটা ছাড়েনি৷ কামরার খোলা দরজার উপর অনীতা দাঁড়িয়ে৷
‘বাবাঃ আসতে পারলে!’ অনীতা খুশিতে ঝলমল করে উঠল৷
‘কত বাধা, কত বিপদ—’
‘বাঃ, আর বাধা-বিপদ কোথায়! সব তো খোলসা হয়ে গিয়েছে!’ অনীতা নির্মুক্ত মনে হাসল : ‘এখন তো ফাঁকা মাঠ৷’
‘যাকে বলে, লাইন ক্লিয়ার৷’ অনিমেষও হাসল স্বচ্ছন্দে৷ হঠাৎ ইঞ্জিনটা হুইসল দিয়ে উঠল৷
অনিমেষ বুঝি উঠতে যাচ্ছিল, অনীতা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললে, ‘আর উঠে কি হবে? না, ওটা অন্য প্ল্যাটফর্মের ইঞ্জিন৷
‘যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল!’ বললে অনিমেষ৷
‘তোমার সবতাতেই ভয়৷’ একটু-বা ব্যঙ্গ মেশাল অনীতা৷
‘না, ভয় আর কোথায়?’ কামরাতে উঠল অনিমেষ৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সামান্য কয়েক মিনিট বাকি আছে৷ বললে, ‘কিছুক্ষণ বাকি৷’
‘কিন্তু কতক্ষণ?’
‘ধরো এক বছর৷’ কথাটাকে অন্য অর্থে নিয়ে গেল অনিমেষ৷
‘না না, অতদিন কেন? এ কি আমরা ডিভোর্সের পর বিয়ে করতে যাচ্ছি যে এক বছর অপেক্ষা করতে হবে!’
‘না, তা নয়, তবে’—অনিমেষ আমতা-আমতা করতে লাগল৷
‘তবে-টবে নয়৷’ অনীতা অসহিষ্ণু হয়ে বললে,—‘শ্রাদ্ধ-শান্তি হয়ে গিয়েছে, এখন আর তোমার দ্বিধা কী?
‘তবু লোকে বলে, এক বছর অপেক্ষা করা ভালো৷’
‘ছাই বলে, কেউ বলে না৷ আমি কত বছর অপেক্ষা করে আছি বলো তো!’ কণ্ঠস্বরে অভিমান আনল অনীতা : ‘আর আমি দেরি করতে প্রস্তুত নই৷’’
‘কিন্তু চলেছ তো কলকাতার বাইরে৷’
‘কী করব! হঠাৎ বদলি করে দিল! তাতে কী হয়েছে, তুমি দিনক্ষণ ঠিক করে চিঠি লিখলেই আমি ঝপ করে চলে আসব৷’ লঘুভার হাসল অনীতা : বিয়ে করতে আর হাঙ্গামা কী!’
‘শুনছি আমাকেও নাকি বাইরে ঠেলে দেবে৷’
‘দিক না৷ তাহলে মফঃস্বলে যাব৷ আর যদি না দেয়, কলকাতায়ই থাকো, চলে আসব এখানে৷ মোট কথা, চোখে তীক্ষ্ন আকুতি নিয়ে তাকাল অনীতা : ‘শুভস্য শীঘ্রম৷’
‘লোকে কী বলবে!’
‘লোকের কথা ছেড়ে দাও৷’
‘লোকে বলবে বউ মারা যাবার এক মাস পরেই বিয়ে করল৷’
‘এক বছর পরে করলেও বলবে৷’ একটু-বা তপ্ত হল অনীতা : ‘লোকের হাতে সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের ভার নেই৷ লোকে কী জানে আমার তপস্যার কথা!’
‘তপস্যা?’
‘হ্যাঁ, প্রতীক্ষা আর প্রার্থনাই তপস্যা৷’ অনীতা ঘড়ির দিকে তাকাল : ‘তোমার বিয়ের প্রায় দু’বছর পর আমাদের দেখা৷ তুমি আমাকে বললে, তুমি আমার পরম হয়ে এলে তো প্রথম হয়ে এলে না কেন? সেই থেকেই প্রার্থনা করছি, প্রতীক্ষা করে আছি, কবে সে চরম দিন আসবে, কবে পথ পরিষ্কার হবে৷ তিন বছরের পর সেই সুযোগ আজ এল৷ এই তিন বছর সমানে আকাঙ্ক্ষা করে এসেছি আমাদের স্বাধীনতা৷’

অর্থাৎ গত তিন বছর ধরেই অনীতা সুরভির মৃত্যুকামনা করে এসেছে৷ বুকের মধ্যে একটা ঘা মারার শব্দ শুনল অনিমেষ৷ সে শব্দ কি তারও আকাঙ্ক্ষার প্রতিধ্বনি! না, তা কি করে হয়! সুরভি বেঁচেছিল বলেই তো অনীতার প্রতি তার আকর্ষণ এত জ্বলন্ত ছিল জীবন্ত ছিল৷ সুরভি আজ বেঁচে নেই, তাই কি অনীতাও আজ স্তিমিত, নিষ্প্রভ?
‘এ কী, ট্রেন ছাড়ছে না কেন?’ সময় কখন হয়ে গেছে, তবু ছাড়বার নাম নেই৷ ছাড়বার ঘণ্টা পড়লেই তো অনিমেষ নেমে যেতে পারে৷ রুমাল নেড়ে দিতে পারে বিদায়৷
কি একটা গোলমালে ট্রেনটা থেমে আছে, ছাড়ছে না৷ দীর্ঘতর হচ্ছে এই নিষ্ফল সান্নিধ্য৷
সব ট্রেনই ছাড়ে, ছেড়ে যায়, শেষ পর্যন্ত অনীতাটারও ছাড়ল৷
নামতে গিয়ে অনিমেষ আবার পড়ল নাকি পা হড়কে? না, সে অত অপোগণ্ড নয়৷ তার পায়ের নিচে মোলায়েম প্ল্যাটফর্ম কে ঠিক পৌঁছে দিয়েছে৷
মফঃস্বলে বদলি হয়ে এসেছে অনিমেষ৷
ভালোই হয়েছে৷ বদল হয়েছে পরিবেশের৷ মেঝেতে পায়ে-পায়ে আলতার দাগ ফেলা নেই, নেই আর স্মৃতির রক্তাক্ত কন্টক৷

ছোট ছাতওলা বাড়ি, উপরে দুখানা মোটে ঘর৷ একটা শোবার আরেকটা বসবার৷ নিচে বাবুর্চি-চাকর৷ এর চেয়ে আরো ছোট হলে চলে কি করে? তবু অনিমেষের যেন কি রকম ফাঁকা-ফাঁকা লাগে৷ এদিক-ওদিক প্রতিবেশীদের বাড়িঘরগুলি কেমন দূর-দূর মনে হয়৷ মনে হয় বাড়িটাকে ঘিরে যেন অনেক গাছপালা, অনেক হাওয়া, অনেক অন্ধকার৷ গাড়িঘোড়ার আওয়াজ অনেক পর-পর শোনা যায়, ফিরিওয়ালারা এদিকে কম আসে৷ অথচ নদী কত দূরে, মধ্যরাত্রে একটু হাওয়া উঠলেই শোনা যায় গোঙানি৷
কাজে-কর্মে লোকজন আসে কিন্তু তাদেরও আসার মানেই হচ্ছে চলে যাওয়া৷ সমস্ত ভিতর-বার আশ-পাশ একটা শূন্যতার শ্বাস দিয়ে ভরা৷
না, আসুক অনীতা৷ ঘরদোর ভরে তুলুক৷
আশ্চর্য সেই রকমই চিঠি লিখেছে অনীতা৷ এই মফঃস্বল শহরেই সে একটা উচ্চতর চাকরির জন্যে আবেদন করেছে৷ কদিন পরেই ইনটারভিউ৷
হ্যাঁ, কোথায় আর উঠবে, অনিমেষেরই অতিথি হবে অনীতা৷
চিঠি লিখে বারণ করল অনিমেষ৷ তুমি এস, থাকো, চাকরি করো কিন্তু আমার বাড়িতে উঠো না৷ অন্তত এখন নয়, একেবারে আজকেই নয়৷ জানোই তো, আমার বাড়িতে মেয়েছেলে কেউ নেই৷ তোমার অসুবিধে হবে৷ তা ছাড়া আমি দুর্বার একা৷

আগে অধিষ্ঠিত হও, পরে প্রতিষ্ঠিত হবে৷

পাল্টা জবাব দিল অনীতা৷ প্রায় তিরস্কারের ভঙ্গিতে৷ লিখলে, আমি একজন সম্ভ্রান্ত, পদস্থ শিক্ষিকা, একটা চাকরির সম্পর্কেই তোমার কাছে একদিনের সাময়িক আশ্রয় চাইছি, অন্য কোনো উদ্দেশ্যে নয়৷ আর, নিজেকে অত দুর্বার বলে স্পর্ধা করো না৷ ভাববে আমার প্রতিরোধও দুঃসাধ্য৷ অন্তত যতক্ষণ আমি সম্ভ্রান্ত, পদস্থ শিক্ষিকা৷
না, তুমি এস৷ ঝগড়াঝাঁটির কী দরকার! তুমি এলে কত গল্প করা যাবে৷ কত হাসা যাবে মন খুলে৷ স্তব্ধতাকেও কত মনে হবে রমণীয়৷

আজ সন্ধের ট্রেনে আসবে অনীতা৷ শুধু রাতটুকু থাকবে৷ কাল সকালে ইন্টারভিউ দিয়েই দুপুরের ট্রেনে ফিরে যাবে নিজের জায়গায়৷
সকাল থেকেই মেঘ-মেঘ বৃষ্টি-বৃষ্টি৷ দুপুরে ঘনঘোর করে বর্ষা নেমেছে৷ সন্ধের দিকে তোড়টা কমলেও হাওয়াটা পড়েনি৷ চলেছে জোলো হাওয়ার ঝাপটা৷
স্টেশনে এসে অনিমেষ শুনল গাড়ি তিন ঘণ্টার উপর লেট৷
ভীষণ দমে গেল শুনে৷ বাইরে দুর্যোগ থাকলেও অন্তরে বুঝি একটা আগুনের ভাণ্ড ছিল৷ সেটা নিবে গেল ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে৷
রাস্তায় জনমানব নেই৷ দোকানপাট বন্ধ৷ শুধু একলা এক পথহারা হাওয়া এলোমেলো ঘুরে বেড়াচ্ছে৷

সাইকেল রিকসা করে বাড়ি ফিরল অনিমেষ৷
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখল, এ কী! তার শোবার ঘরে আলো জ্বলছে৷ দরজা তালাবন্ধ৷ হাওয়ার দাপটে দরজার পাল্লা দুটো ফাঁক হয়েছে, তারই মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে আলো৷ তবে কি ঘর বন্ধ করে বেরুবার আগে ভুলে সুইচটা অন করি রেখেছিল? তাই হবে, নইলে আলো জ্বলে কী করে? পথে আসতে দেখছিল, স্টেশনেও তাই, ঝড়ের উৎপাতে সারা শহরের কারেন্ট অফ হয়ে গিয়েছিল৷ কে জানে, কারেন্ট হয়তো ফিরে এসেছে এতক্ষণে৷ বারান্দার সুইচটা টিপল, আলো জ্বলল না৷ হয়তো বারান্দার বালবটা ফিউজ হয়ে গিয়েছে৷
দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই ঘরে আর আলো নেই৷
মুখস্থ জায়গায় হাত রেখে সুইচ পেল অনিমেষ৷ সুইচ টিপল৷ আলো জ্বলল না৷ না, আসে নি কারেন্ট৷ কিংবা এসে এখন আবার অফ হয়েছে৷
হাতের টর্চ টিপল অনিমেষ৷ মনে হল ঘরের মধ্যে অন্ধকার যেন নড়ছে-চড়ছে, ঘোরাঘুরি করছে! অন্ধকার কোথায়! একটা লোক৷
‘কে?’ ভয়ার্ত চিৎকার করে উঠল অনিমেষ৷
দরজা খোলা পেয়ে লোকটা পালিয়ে গেল বুঝি! অনিমেষ প্রবল শক্তিতে দরজা বন্ধ করল৷ প্রায়ই কারেন্ট বন্ধ হয় বলে ক্যান্ডেল আর দেশলাই হাতের কাছে মজুত রাখে৷ তাই জ্বালাল এখন৷ হোক মৃদু, একটা স্থির অবিচ্ছিন্ন আলো দরকার৷
কই, লোকটা যায় নি তো! খাটের বাজু ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে!
‘এ কে?’ একটা বোবা আতঙ্ক অনিমেষের গলা টিপে ধরল৷ ‘এ যে সুরভি!’
পরনে কস্তাপাড় শাড়ি, সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর, খালি পায়ে টুকটুকে আলতা, ঠোঁট দুখানি চুনে-খয়েরে রঙিন করা—সুরভি ডান হাতের তর্জনী তার ঠোঁটের উপর রাখল৷ যেন ইঙ্গিত করল, অনিমেষ যেন না চেঁচায়, না কথা বলে৷
তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে হেঁটে দেয়ালের দিকে সরে গেল সুরভি৷ সরে গেল যেখানে একটা ক্যালেন্ডার ঝুলছে৷ একটা তারিখের উপর আঙুল রাখল৷ দুই চোখে ক্রুদ্ধ ভর্ৎসনা পুরে তাকাল অনিমেষের দিকে৷
সেই চিহ্নিত তারিখে টর্চের আলো ফেলল অনিমেষ৷ দেখল, আঙুলের ডগায় করে এক ফোঁটা রক্তের দাগ রেখেছে তারিখে৷
কোন তারিখ? এ তো আজকের তারিখ৷ বাংলা আঠাশে আষাঢ়৷ বেস্পতিবার৷
আঠাশে আষাঢ় কী? আঠাশে আষাঢ় অনিমেষ-সুরভির বিয়ের দিন৷ একদম ভুলে গিয়েছিল৷ আর আর বছর সুরভিই মনে করিয়ে দিত, এবারও তেমনি মনে করিয়ে দিতে এসেছে৷
অদূরে দাঁড়িয়ে হাসছে সুরভি৷ কেমন মজা৷ যেতে না যেতেই মুছে দিয়েছ মন থেকে৷ মুছে দিয়েছ দেয়াল থেকে৷ ঘুরে ঘুরে চারদিকের দেয়ালের দিকে তাকাতে লাগল৷ আমার একটা ছবিও কোথাও রাখ নি৷

‘সুরভি:’ তাকে ব্যাকুল হাতে ধরতে গেল অনিমেষ৷

হা-হা-হা করে একটা বাতাস ছুটে গেল ঘরের মধ্যে৷ বন্ধ দরজা-জানলা ঝরঝর ঝরঝর করে উঠল৷ সিঁড়িতে শোনা গেল নেমে যাবার পায়ের শব্দ৷ শুধু যেন সুরভি একা নয়, তার সঙ্গে আছে আরো অনেকে৷ একসঙ্গে নেমে যাচ্ছে৷ কেবল নেমে যাচ্ছে৷ ভারী পায়ে ক্লান্ত পায়ে নেমে যাচ্ছে৷
ভয়ে আপাদমস্তক ঘেমে উঠল অনিমেষ৷
হঠাৎ আলো জ্বলে উঠল৷ মনে হল এ আলো নয়, কে যেন সহসা হেসে উঠেছে খিলখিল করে৷
তাড়াতাড়ি অল্প-স্বল্প খেয়ে শুয়ে পড়ল অনিমেষ৷ টর্চ, ছাতি, ওয়াটারপ্রুফ দিয়ে চাকরকে পাঠালো স্টেশনে৷ যত টাকা লাগুক যেন রিক্সা ঠিক রাখে৷ যত দেরিই হোক, ঠিকমতো আসতে পারে যেন অনীতা৷
ঘড়িতে রাত বেশি হয় নি, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন অনন্ত রাত৷ গাছগাছালির মধ্যে বাড়িটাকে মনে হচ্ছে যেন রুদ্ধশ্বাস কবরের স্তূপ৷ কেবল বাতাসের হা-হা, ডালপালার কাতরতা৷

বিছানায় জেগে বই পড়ছে অনিমেষ৷ জাগ্রত সমর্থ বন্ধুর মতো আলোটা রয়েছে চোখের উপর৷

খট-খট খট-খট৷ দরজায় কে আঙুলের শব্দ করল৷

চমকে উঠল অনিমেষ৷ নিশ্চয় মানুষ৷ অন্য কেউ হলে আলো নিবে যেত, হাওয়া উঠে দরজা-জানলা কাঁপাত, সিঁড়িতে পায়ের শব্দ হত, নয়ত কুকুর কোথাও কাঁদত মরাকান্না৷ মানুষ বলেই বারান্দার আলোটাও নেবে নি৷
ভয়ের জন্যে লজ্জা হতে লাগল অনিমেষের৷ বালিশের নিচে হাত দিয়ে রিভলবারটা একবার অনুভব করল৷
ধীরে ধীরে খুলে দিল দরজা৷
‘এ কী! তুমি—অনীতা?’
‘উঃ, কী ভীষণ লেট তোমাদের গাড়ি৷ আর তারপর কী জঘন্য বৃষ্টি!’
‘তোমার জন্যে স্টেশনে চাকর পাঠিয়েছিলাম, সে কোথায়?’
‘কই কারু সঙ্গে দেখা হয় নি তো৷ একাই চলে এলাম৷’ ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল অনীতা৷
‘তোমার মালপত্র কোথায়?’
‘সব স্টেশনে পড়ে আছে৷ শোনো, আমি ভীষণ ক্লান্ত৷ এক গ্লাস জল খাব৷’
টেবিলের উপর ঢাকা গ্লাসে জল ছিল, তাই ঢক ঢক করে খেয়ে নিল অনীতা৷ বললে, ‘শোবার জায়গা করেছ কোথায়?’
‘পাশের ঘরে৷’
‘আমি যাই, শুয়ে পড়ি গে৷ দাঁড়াতে পারছি না৷’ ম্লানরেখায় হাসল অনীতা : ‘নিদারুণ ঘুম পেয়েছে৷’
‘বাঃ, সে কী! খাবে না?’
‘না, পথে অনেক খাওয়া হয়েছে৷ আচ্ছা আসি৷’ পাশের ঘরে গিয়ে দ্রুত হাতে দরজায় খিল চাপাল অনীতা৷
তবু দরজায় মুখ রেখে বলল অনিমেষ, ‘ঘরের আলোটা জ্বেলে রেখো৷ আর দেখো, নতুন জায়গায় যেন ভয় পেয়ো না৷ ভয় পেলে আমাকে ডেকো৷’
অনীতার যেন আর কিছুতে ভয় নেই, তার বুঝি অনিমেষকেই ভয়৷
কেন, কেন দুজনে আজ ঝড়ের রাতে একসঙ্গে একঘরে থাকবে না? থাকলে জীবন্ত লোকের সংস্পর্শে পরস্পরের আর ভয় থাকত না৷ আর যে ভয়ের কথা অনীতা ভেবেছে সে যে কত অবাস্তব গায়ের উত্তাপে বুঝিয়ে দিত৷

তখন কত রাত কে জানে? দু’ঘরের মাঝের দরজায় টুক করে একটা শব্দ হল৷ সে শব্দ স্পষ্ট চিনল অনিমেষ৷ সে খিল খোলার শব্দ৷
রুদ্ধ নিশ্বাসে বিছানায় বসে রইল অনিমেষ৷
কই অনীতা এল না এ ঘরে৷
না, অনিমেষকেই ডাকছে অনীতা৷ এক নির্জনতা ডাকছে এক নিঃসঙ্গতাকে৷ এক ভয় আরেক ভয়কে৷
পা টিপে টিপে অনিমেষই উঠে গেল৷ খোলা দরজায় ঠেলা দিয়ে ঢুকল ওঘরে৷
দেখল, আলোতে দেখল, একি, অনীতা কোথায়? তার বদলে খাটে পাতা বিছানায়, বিলোল ভঙ্গিতে সুরভি শুয়ে আছে!
‘অনীতা, অনীতা কোথায়?’ চিৎকার করে উঠল অনিমেষ৷ টলে পড়ে গেল মাটিতে৷

পরদিন সকালে হাসপাতালে অনিমেষের জ্ঞান হল৷ একটু সুস্থ হলে শুনল গতরাত্রে ট্রেন অ্যাকসিডেন্টে অনীতা মারা গেছে আর ক্যালেন্ডারের তারিখে যে রক্তবিন্দুটা দেখেছিল সেটা আসলে লালকালির চিহ্ন, মরবার অনেক আগেই তারিখটা দাগিয়ে রেখেছিল সুরভি৷🍁

 

 

🍂কবিতা | এক 

 

 

 

 

অমিত কাশ্যপ

মেয়েটি

ঘুমিয়ে আছে যে মেয়েটি
তার মাথার কাছে বসে আছি
নিশ্চুপে, দুঃখ যা কিছু ছিল
নিশ্চুপে, তাও সঁপে আছি, ঈশ্বরে

শুনেছি ঈশ্বর থাকেন দেউলে
যার চারিদিকে ফাটল চিহ্ন মেঝে
যার পড়ন্তবেলায় একটু রশ্মিচ্ছটায়
মুখ যে বড়ই মলিন, হয়তো কালিমা

থাক ওই ঈশ্বর কথা, থাক ওই মেয়েটির কথা
মেয়েটিকে আর ঘুম থেকে তুল না
বাবা-মা’কে বল না ওর ঘুমের কথা
নিশ্চুপে দুঃখগুলো মুছে নাও রাত্রির চাদরে

কেন এই রাত্রি চাপ চাপ অন্ধকারে
কেন এই মুছে ফেলা রাত্রির চাদরে
কেন হবে না সুন্দরের জন্ম প্রতিটি ভোরে
কেন বসে থাকতে হবে মৃত মেয়েটির কাছে

 

 

 

 

কুন্তল দাশগুপ্ত

ভ্রান্তি

জানো,
আসলে পাষাণ-ই ছিল
তুমি শুধু ভেবেছো সলিল।

ঝুঁকে মুখ দেখবার
কাকচক্ষুজল
বিম্ব ফেরায় শুধু
গ্রহণ করার তার কোনও দায় নেই।

আলো ছুঁয়ে দিলে,
হিরে হয়ে ঝলকায় বিন্দুমাত্র
জলও।
গভীর হবার থেকে চোখ ধাঁধানোতে তার বেশী
মনোযোগ।

যে কেবল গভীর- আরও গভীর হতেই শিখে নিল-
গভীরতা মাপিবার রীতি তার জানবার কথা নয়।
কিশোরগঞ্জে তাই ভরপুর
বন্যায়
গভীরতা মাপা বড় দায়।

ভুল হয়- হয়ে যায়…

 

 

 

ফাল্গুনী চক্রবর্তী

প্রেম ফাইল ২০

মুছে দাও সেই সব লেখা যা বৃষ্টি আসলেই ধুয়ে যায়… সমুদ্রের ঢেউ
এ বুক রেখে… বুকের ঢেউকে চঞ্চল কর… শব্দের রফতার
রাখ আঁখের খোসায়… চিবিয়ে চিবিয়ে
রস পাণ কর আকণ্ঠ মোহ কাটলে যে বিষাদ বাঁধ ভাঙে তার জলকে বেঁধে আন প্রেম এসো পূজোর বেদীতে ফুল হই বিপ্লব রাখি বসন্তের জপমালায় আতরের অদৃশ্যতায় সিলসিলা হউক জীবনের যান… তুমি শুধু কথা রেখো…

 

 

 

 

আমিনা তাবাসসুম

চোখ সমুদ্রে

তুমি নদী হতে চাও
চোখের সমুদ্র ঘিরে
নদী হওয়া যায়?

চোখ তো রহস্য কেবল
আলো আর অন্ধকারে লুটোপুটি খেলা

নদী ভুলে যাও
নাবিক হও
নাবিক হলে ডুবে যাওয়া যায়

জীবনের তরঙ্গ জুড়ে শুধু বলিরেখা
চোখে তো তারই আলোড়ন

চোখ তো সমুদ্র কেবল
সৈকত ছেড়ে দিয়ে
তুমি কেবল নদী হতে চাও

নদী হয়ো না
একবার নাবিক হয়ে দেখো
একবার সমুদ্রে ডুবে দেখো

 

 

 

 

গীতা চক্রবর্তী

স্বচ্ছতা

ভালোবাসাকে স্ফটিক জল হতে হয়
চাইলেই পেয়ে যাওয়া ভেসে থাকার মতো।
তল নেই মাঝ পথেই ঘোলা জল,
সেতো ঢেউয়েই ভেসে যায় জোয়ার ভাটার টানে।
তার পর উদাসী বাউল গান গেয়ে
যতই প্রলাপ উগরে দাও যত বিষাদ কীর্ত্তন
পোড়া কাঠ নয় পুড়ে পুড়েই শুদ্ধিকরণ
ভালোবাসার জীবন্ত প্রতিমূর্তি।

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ৮

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ ‘একটি বিষণ্ণরাতের তারা’ উপন্যাসের পর্ব ৮।

 

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 

আট.

যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম 

টিউশান পড়ানোটাই শেষপর্যন্ত জীবিকা হয়ে উঠলো। নিজেও পড়ি, অন্যকেও পড়াই। রুমার সঙ্গে বেশ কয়েকদিন কথা বন্ধ। কেন আমি ওকে চিঠি লিখিনি? কেন ওকে বলিনি আমার মুম্বাই যাওয়ার কথা? এতদিন ধরে কেন চুপচাপ থেকে গেছি? এসব একরাশ প্রশ্নের কোনো উত্তর আমি দিতে পারিনি। রুমার যে এত অভিমান তা এই প্রথম জানলাম। তবে হ্যাঁ, দুজনেই ভর্তি হয়েছি বাংলা সাহিত্যে অনার্স নিয়ে। উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় দুজনেরই একই নাম্বার। ভর্তির পর জানতে পারলাম আমাদের রোল নাম্বারও পরপর হয়েছে। কয়েকদিন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম রুমা মাথা নিচু করে পালালো যেন সে আমাকে চেনেই না এরকমই ভাব। আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম সে পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে চলে গেল। অভিমান যে এত ঘন হয়ে উঠবে এবং কষ্ট যে এত বিপরীত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে সে অভিজ্ঞতা আমার কখনোই হয়নি। একদিন অভিমান ভাঙানোর সুযোগ এলো, ক্লাসে গিয়ে দেখি সে-ই কেবল একাকী বসে আছে। ঝটপট বইটি রেখে তার সামনে গিয়ে কান ধরে দাঁড়ালাম। ভেজা ভেজা গলায় কারুণ্য মিশ্রিত স্বরে বললাম : ক্ষমা করে দাও, এমনটি আর কোনোদিন হবে না!
তবু সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। অভিমান যে খুবই গভীর পর্বতের মতো তা বুঝতে পারলাম। তখনও ‘স্মরগরল খণ্ডনং, মম শিরসি মণ্ডনং, দেহি পদপল্লবমুদারম্’ (গীতগোবিন্দ) পড়া হয়নি। তবু তার পা স্পর্শ করবার জন্য মাথা নিচু করে দুই হাত বাড়ালাম। অমনি সে দুই হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিল। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল দুই গাল। সেই উষ্ণ চুম্বনের কতখানি আকর্ষণ আজও মনে করলে শিউরে উঠি। একটি ভরা যৌবনের পাত্র থেকে আরেকটি যৌবনের পাত্রে যে তরঙ্গ অভিঘাত দুই কূল প্লাবিত করে চলেছে তাতে কোনো দিকেই আর ভ্রূক্ষেপ নেই। বুকের দুই চূড়া আমার বুকে আশ্রয় খুঁজতে ব্যস্ত। দুই ঠোঁট আমার ঠোঁটে সেই উষ্ণতা বিনিময় করে চলেছে। কতক্ষণ এই ভাবে ছিলাম এবং দরজা থেকে কেউ এসব দেখে গেছে কিনা তার কিছুই বুঝতে পারিনি। হাত ছেড়ে যখন দুই পাশে দাঁড়ালাম তখন দেখলাম রুমার দুই চোখ ভিজে গেছে। এই যে আনন্দের বর্ষণ, উষ্ণতার গলন, অভিমানের মেঘ ভেঙে বৃষ্টির পতন তা বুঝতে বাকি রইল না। কণ্ঠস্বর নিচু করেই রুমা বলতে লাগলো: জানো আমি কত কষ্ট পেয়েছি! কয়েকদিন থেকে ঠিক মতো খাবারও খেতে পারিনি। কতরাত একা একা জেগে জেগে কাটিয়েছি। তুমি কি তা কিছুই বুঝতে পারোনি?
রুমার অভিযোগ যে মিথ্যে নয় তা আমিও টের পেয়েছি, কিন্তু নিজের অসামর্থ্য কী করে বোঝাই ওকে? যে পরিবার থেকে আমি কলেজে পৌঁছেছি এবং আমি যে ফার্স্ট লার্নার এক শ্রমিকের ঘরের সন্তান তা কিছুতেই বলতে পারিনি। দুঃখময় জীবনের একবেলা খেয়ে আর দু’বেলা উপোস দিয়ে লেখাপড়া করতে হয়। হিসেব করে চলতে হয় খরচের ব্যাপারে। সুতরাং শখ-তামাশা আনন্দ করার ফুরসত কোথায়? কিন্তু রুমাকে এসব কিছুই বলতে পারলাম না। অপরাধীর মতো হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বললাম: আমি জানি রুমা, তোমার কষ্টের কথা সবই অনুভব করতে পারি। কিন্তু বড্ড নিরুপায় ছিলাম, আমার কিছুই করার ছিল না। হঠাৎ করেই পালাতে হয়েছিল আমার বাড়ির বিরুদ্ধেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাই রাগে দুঃখে চুপচাপ থেকেছি। তোমার কথা ভেবেও কেঁদেছি তবু চিঠি লিখিনি। এবার আর কোথাও যাচ্ছি না। যদি যেতেই হয় কোথাও তবে তোমাকে জানিয়ে যাব।
রুমা বিশ্বাস করলো। হাত বাড়িয়ে বলল, প্রমিস!
আমিও ডান হাতখানা তার হাতে দিয়ে বললাম: প্রমিস!
সেদিন আর আমরা ক্লাস করতে পারিনি। কলেজের সামনেই সিনেমা হলের বাইরে একটি খাবারের দোকানে দু’জনেই সারাদিন বসে থেকেছি। বারবার খেয়েছি চা ও কফি। মাঝে একবার সিঙাড়া। তবু যেন কথা ফুরোতে চাইনি আমাদের। অতীত জীবনের কত কথা বলেছে রুমা। তার বড়দা ও মেজদা নানা সময়ে কী কী উপহার দিয়েছে এবং কত টাকা দামের তা যেমন একে একে জানিয়েছে, তেমনি তার বৌদিরা যে এ ব্যাপারে কিছুই বলেনি সেই কারণে তাদেরও সুনাম করেছে। রুমার বাবা-মা দুজনেই গত হয়েছেন অনেকদিন।
তাই তাকে দাদাদের কাছেই থাকতে হয়। ছোট বোন হিসেবে দাদারা তার শখ আহ্লাদ পূরণ করতে কিছুই বাকি রাখেনি। কয়েকবার বিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছে। এমনকি পাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়িতেও এসেছে। কিন্তু রুমা সেইসব পাত্রকে দেখেই বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বলে দিয়েছে এম এ পাস না করা পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না। রুমা যে খুব জেদি মেয়ে তা তার দাদারাও জানে। তাই জোর করে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসাতে চায়নি। স্বাভাবিকভাবেই রুমার স্বাধীনতা রয়েছে পাত্র নির্বাচন করারও। তার এসব কথা শুনতে শুনতেই প্রায় সারাদিনই কেটে গেছে আমার। আমার কথা শোনার জন্য রুমা বেশ কয়েকবার জোর জুলুমও করেছে, কিন্তু আমি কিছুই বলতে পারিনি।
আমার জীবনের শখ-আহ্লাদ বলতে কিছুই নেই । রোমান্টিক হবার হাতছানি বৃথাই তা কী করে বোঝাবো? তবু যেটুকু না বললেই নয় তা বলতে হয়েছে। জানো তো রুমা, বাড়ির আমিই সবথেকে বড়। আমার পরে আরো তিন ভাই আছে। তিন বোনও আছে। এক বোনের মাত্র বিয়ে হয়েছে তা খুব ছোটবেলায়। ভাইয়েরা কেউ বড় হয়নি অথচ আমাদের সংসারটা বড় হয়ে গেছে। আমাকে অনেক কাজ করেই পড়াশোনা করতে হয়। কলেজ থেকে ফিরে গিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় টিউশানি পড়াতে যাই। পড়ার সময়ও পাই কম। সামান্য জমি থাকলেও ভালো ফসল হয় না। গ্রামের একটা নিম্নবিত্ত পরিবার। ভেবে দেখো সেই পরিবার থেকেই আমি এসেছি আর আজ তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।
রুমা বলেছিল, এতে লজ্জার কী আছে! সব মানুষের কি সবকিছু থাকে? বড় হওয়ার স্বপ্ন থাকতে হয়। আর বড় হতে গেলে লড়াই করে বড় হতে হয়। সবকিছুই কি সহজে পাওয়া যায়?
—কিন্তু লড়াই করার মতো শক্তি ও বুদ্ধি কি আমার আছে?
—পরিস্থিতি মানুষকে সবকিছু শেখায়। যখন যেমন পরিস্থিতি আসবে তখন তেমনি কৌশলও অবলম্বন করতে হবে। তুমি শুধু ভয় পাও কেন? আমিও তো তোমার সঙ্গে আছি!
—সে তো আমি জানি! কাজী নজরুল ইসলাম এই কারণেই লিখেছিলেন:
“কোনো কালে একা হয়নি জয়ী পুরুষের তরবারি
শক্তি দিয়েছে, সাহস দিয়েছে বিজয়লক্ষ্মী নারী।”

কথাটি শুনে রুমা ভীষণ খুশি হয়েছিল। আগামীকাল আবার দেখা হবে এই আশ্বাস দিয়েই স্টেশনের দিকে চলে গেছিল ট্রেন ধরার জন্য। আমি বাস ধরার জন্য বাসস্ট্যান্ডে এসে পার্থ নামের লোকাল বাসটিতে উঠে জানালার ধারে বসেছিলাম। আষাঢ়ের শেষ বিকেলের বিষণ্ণতা ভেদ করে বাস ছুটে চলেছিল লজ্ঝড় একটি গ্রাম্য রাস্তায়। আমার মনের মধ্যে শুরু হয়েছিল সংঘাত। কঠোর কঠিন বাস্তবে যেখানে বেঁচে থাকাই কঠিন, সেখানে রোমান্টিক স্বপ্নের বাতাবরণ কতটা জরুরি? রুমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া আমার পক্ষে কি ঠিক হবে? যদি ঠিক না হয় তাহলে কিভাবেই বা বেরিয়ে আসবো? রোজ রোজ ওর পয়সায় কত কী খাই। মুখটা শুকনো দেখলেই ওর কত কাতরতা ঝরে পড়ে। কিন্তু আমাদের সময়টা তো কেরিয়ার তৈরি করার। এইসব বাঁধনের মধ্যে বন্দী হলে কী করেই বা তা সম্ভব? কিছুতেই কোনো কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। ভাবতে ভাবতেই বাসের খালাসি কখন চেঁচাতে শুরু করেছে: বাতাসপুর! বাতাসপুর! নেমে যান! পড়িমরি করে নামতে গিয়েই হঠাৎ পড়ে গেলাম নিচে। ডান পায়ের পাতা গেল দুমড়ে। ওহ কী লেগেছে গো! বলে চেঁচিয়ে উঠেই অনেকটা দূরে ছিটকে পড়েছি। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোজান চাচা টেনে তুললেন। কিন্তু কিছুতেই দাঁড়াতে পারলাম না। মাথাটা বোঁ-বোঁ করে ঘুরে গেল। চোখে আঁধার দেখতে লাগলাম। অবশেষে তিনিই আমাকে পিঠে করে এনে ঘরে পৌঁছে দিলেন। ধীরে ধীরে পা গেল ফুলে। মা কাঁচা হলুদ বেটে তার সঙ্গে আর কী কী সব মধু ও চুন মিশিয়ে সেঁক দিতে লাগলো। পাশের বাড়ির ইদ্রিশ চাচারা দেখতে এসে বললো, ভাগ্য ভালো পা-টা ভেঙে যায়নি! মচকে গেছে। কয়েকদিন সেঁক দিলেই সেরে যাবে।
কিন্তু আমি আর থামতে পারলাম না। যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলাম। মা আমার ছোট ভাইকে ডেকে বললো, বীরেন ডাক্তারকে ডেকে আনো, ওষুধ না দিলেই হবে না। (চলবে) 🍁

 

 

🍂কবিতা | দুই 

 

 

 

 

মিঠুন চক্রবর্তী

কবির প্রেম, কেবলই কল্পনা

ঘরে ছড়ানো নরম অন্ধকারের ভিতর
তোমার মেঘলা হাতের উপত্যকায় রাখলাম
আমার খসখসে ফাটামাটির করতল,
ঠোঁট দিয়ে আলতো করে কামড়ে ধরলাম তোমার উষ্ণ ঠোঁট

তারপর তোমার খোলা চুলের মতন নেমে এল ঘন বর্ষা

ভেজা কদম ফুলের গন্ধ চুলে গুঁজে
তুমি তখন উন্মত্ত নদীর ভঙ্গিমায় ফুঁসে উঠলে তরঙ্গে তরঙ্গে
আমারও কাষ্ঠল শরীর কুপিয়ে কুপিয়ে
নৌকা বানিয়েছে কোন কারিগর, ভেসে যায় খরস্রোতে…

ডুবে যাওয়ার গল্প পরের পাতায়। যেমন চাঁদ ডুবে যায় দিনের আলোয়।
তিন ঘন্টা বিয়াল্লিশ মিনিট পর সমুদ্র থেকে উঠে আসে নিথর পোশাক।
সারা ঘর খুঁজে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই,
কাকে দেখাব অনুর্বর দিন ! কে জলপটিতে শুষে নেবে অভিশপ্ত জ্বর!

বাস্তবে তো কেউ ছিল না কখনও, কবির প্রেম, কেবলই কল্পনা

 

 

 

 

অসীম দাস

রোমে প্রশ্বাস

তোমার ভাবনা বরে আমি কামধেনু
তোমার পাঠানো মেঘে মুঠি কলোকল,
তোমার বানানো সাজে সাজি পাঞ্চালি
পদ্ম ফোটাবে কবে প্রেমে টলোমল?

তোমার দ্বারকা দাঁড়ে আমার বিরহ
ভাসালে গাঙুর ভেলা, মরণ প্রহরী
মেকং -এ পেখম হলে, পালকের পাতা
শিরায় জাগাবে কবে ফাগুন লহরী?

তোমার প্রতিভা গড়ে আমার প্রতিমা
সাধারণ স্রোতে দাও সাগর আহ্লাদ,
আমিও তোমার চাওয়া পেতে পেতে ছায়া
ওষ্ঠে বুনবে কবে চুম্বন স্বাদ?

মননের সিঁড়ি গেঁথে করেছো কবিতা
ছোঁয়ার বাইরে ঘোরে শব্দের শ্বাস,
আঁধারে ছুটিয়ে তারা করেছো সুদূর
জড়িয়ে জ্বালাবে কবে রোমে প্রশ্বাস?

 

 

 

 

শেখ কাকলী

শুদ্ধ আলোর বিপরীতে

ল্যাম্পপোস্টের লাইটের আলো বড় বিচিত্র!
চারিদিক আলো করে রাখে,
ঝকঝকে আলো দেয় সবাইকেই।
আমি ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে
রোজ রাতে ওর আলো পোহাতাম।
শুধু আমার ভেবে ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে
সেই আলোয় স্নান সেরে শুদ্ধ হতাম প্রতিরাতে।
আচানক একদিন চেয়ে দেখি,-
আলোটা আমার থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে।
ধীরে, ধীরে… ক্রমশঃ…!
যেমন চলে যায় স্টেশন থেকে ট্রেনের লাইটটা।
আমি অচল, অটল দাঁড়িয়ে থেকে
ল্যাম্পপোস্টের চলে যাওয়া দেখি…
এ যেন উল্টো রথে, উল্টো পথে, উল্টোর সাথে
তার চলে যাওয়া অথবা আমার চলে আসা…

 

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী

কি লিখি তোমায়

কি লিখি তোমায় বারবার ভাবি
তোমার মুখের আলতো হাসি
তোমার দৃপ্ত চোখের ভাষা
তোমার সাহসী প্রত্যয়
আজও কেমন মনের ভেতর
রামধনু রঙের ছটায়
বসন্তের বুকে আগুন লাগায়।
কি লিখি তোমায় বারবার
ঢেউ তোলে মনের আয়নায়
পড়ন্ত বিকেলে স্কুল থেকে
ফেরার সময় তোমার জানলার
ধারে দাঁড়ানো তোমার সেই
আগুনঝরা চাউনি আমার
পড়ন্ত বিকেলে আজও বসন্ত আসে
বারে বারে।
আজ লিখতে গিয়ে হাত কাঁপে
বয়স পেরিয়ে এসছি অনেকটা
তবুও কেমন যেন লিখতে গিয়ে
চলে গেছি সেই ষোড়শীবেলা।

 

 

 

 

সুচিতা সরকার

সন্ধান 

কি খুঁজছো? আগের মতো কিছু?
বিশ্বাস করো, পাবে না!

পৃথিবী যেমন পায় না,
ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অতিক্রম করে আসা পথটা
আবার এক ভাবে ফিরে পেতে।
এক পলকে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড নিজের জায়গা বদলে নেয়।

একবার ভেঙ্গে গিয়ে
আবার উঠে দাঁড়ানোর মধ্যে,
আমরা অনেকটাই খরচা হয়ে যাই।
অস্তিত্বের টুকরোগুলো নিজেদের মতো আকার পরিবর্তন করে এক নতুন আমিকে জন্ম দেয়।

সত্তার পুনঃপ্রাপ্তি! সেটা আবার হয় না কি।
সবটাই নতুন অভ্যাসের মুখাপেক্ষী হয়ে
বেঁচে থাকা মাত্র।

 

 

 

 

বানীব্রত

আগন্তুক

এক আগন্তুকের মনের দোরে কড়া নাড়া
কিছুটা দ্বিধা কিছুটা ভালোলাগার আবেশে মোরা।
দীপের গায়ে জ্বলে ওঠা শিখা।
নিরবিচ্ছিন্ন আবেগে বাঁশির সুর বাজে
কানে শোনা যায় নূপুরের রিনিঝিনি।
সে যে আগন্তুক হারিয়ে পাওয়ার বার্তাবহ।
দু’টি মনের কিছু না পাওয়ার আর্তি
আসে বসন্ত বাতাসের আঁচলে।
পাওয়া বা না পাওয়ার হিসেব নিকেশ চলে সর্বক্ষণ,
পাওয়ার চেয়ে হারিয়ে ফেলার ভয় জাগে, সর্বক্ষণ হিসেব নিকেশ ঠিক ভুলের
তবুও জাগে বন্ধুত্ব, প্রেমালু আর্তি
কাছে পাওয়ার আকুল বাসনা।
মিলন হোক শত বাঁধার গণ্ডি পার করে
নিরবে নিভৃতে ভালোবাসার অর্ঘ হাতে একান্তে।
থাক অপেক্ষা
অপেক্ষা আর অপেক্ষা…

 

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ৮

 

দাহার সাহেবের কাছেই হাই সাহেবের সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি হয়। মূলতঃ তাঁর কাছ থেকেই লেখার ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে তিনি মাদ্রাসার পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষকের অনুপ্রেরণা তাঁকে পরবর্তী জীবনে গভীর জ্ঞানান্বেষণের দিকেও পরিচালিত করে। পরবর্তীতে বাংলা ভাষার দিকপাল বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর সান্নিধ্য প্রফেসর হাই-এর জীবনকে আরও বেশি বর্ণময় করে তোলে। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘’ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’ -কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজকে পর্ব ৮।

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি

 

 

 

হাই সাহেবের পূর্বপুরুষ মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত পীর হযরত শাহ্ চাঁদ-এর বংশধর ছিলেন। আর তাঁর মায়ের পিতৃপুরুষ নবাব আলীবর্দি খাঁ-এর আমলে মুর্শিদাবাদ জেলার মরিচা ও রাণীনগর এলাকার বিস্তীর্ণ পরগণার জায়গীরদার ছিলেন। বিশ শতকের প্রথম দিকে এই বিষয় সম্পত্তি পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পিতৃকুল ও মাতৃকুল উভয় বংশই নিষ্ঠাবান ধার্মিক মুসলমান ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর পিতামহ সলিমুল্লাহ ও প্রপিতামহ ওসিউল্লাহ সাহেব কুরআনের হাফেজ ছিলেন এবং তাঁরা হজ্ব করে এসেছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষাদানকে তাঁরা জীবনের ব্রত হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। আর হাই সাহেবের পিতা পোরশা গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। তাই বলা যায়, শিক্ষকতা হাই সাহেবের ঐতিহ্যসূত্রেই প্রাপ্ত।

এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, হাই সাহেবের বাল্যজীবন যদিও ইসলামিক আবহাওয়ায় অতিবাহিত হয় কিন্তু সে পরিবেশে গোঁড়ামি আর সংকীর্ণতা ছিল না। ধর্মভিরুতার সঙ্গে সম্মিলন ঘটেছিল যুক্তি ও সাহসিকতার। ইসলামি শিক্ষার প্রাথমিক পাঠ তাঁর বাড়িতেই হয়। তারপর তিনি মরিচা গ্রামের নিকটবর্তী বর্ধনপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেই সময় মুসলমান পরিবার উর্দু ভাষাকে খানদানি ভাষা বলে মনে করত। সে জন্যে তাঁর মায়ের ইচ্ছানুসারে মাতৃভাষারূপে উর্দুকে নিতে হয় এবং মাদ্রাসায় ভর্তি হতে হয়। এখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করে রাজশাহী হাই মাদ্রাসায় ভর্তি হন ১৯৩২ সালে। ওই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন ড. এ.এস.এম. সেরাজউদ্দাহার। দাহার সাহেবের কাছেই হাই সাহেবের সাহিত্য জীবনের হাতেখড়ি হয়। মূলতঃ তাঁর কাছ থেকেই লেখার ব্যাপারে উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে তিনি মাদ্রাসার পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন। শ্রদ্ধেয় এই শিক্ষকের অনুপ্রেরণা তাঁকে পরবর্তী জীবনে গভীর জ্ঞানান্বেষণের দিকেও পরিচালিত করে।
পরবর্তীতে বাংলা ভাষার দিকপাল বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-এর সান্নিধ্য প্রফেসর হাই-এর জীবনকে আরও বেশি বর্ণময় করে তোলে। তাঁদের সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ট।

প্রকৃতপক্ষে শহীদুল্লাহ সাহেবের অনুপ্রেরণায় তিনি বাংলায় অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত আরবি ও ইসলামিক সংস্কৃতি অধ্যয়ন করেছেন। বাংলায় অনার্স নিয়ে পড়তে হলে সংস্কৃত ও হিন্দু সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক। প্রথম দিকে তাঁর বেশ অসুবিধে হতো, কিন্তু শহীদুল্লাহ সাহেবের স্নেহপূর্ণ সহযোগিতায় তিনি অল্পদিনের মধ্যেই সংস্কৃত ভাষা আয়ত্ত করে নেন। মেধাবী ও পরিশ্রমী ছাত্র হিসেবে শহীদুল্লাহ সাহেবের খুবই প্রিয় পাত্র ছিলেন তিনি। শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিষয়ে তিনি বলেছেন : “ছেলেবেলায় শহীদুল্লাহ সাহেবের লেখা পাঠ্যবই পড়ে তাঁর প্রতি আমার আকর্ষণ জাগে। তাঁকে চাক্ষুষ প্রথম দেখার সৌভাগ্য হয় ১৯৩৬ সালে ঢাকার ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে পড়বার সময়। এক মিলাদ মাহফিলে তাঁকে প্রথম দেখি। প্রথম দর্শনে আমার আশাভঙ্গ হলেও তাঁর রাশভারি গম্ভীর চেহারা থেকে মনে হলো, পাণ্ডিত্যের সাথে দেহের বোধহয় কোনো সম্পর্ক নেই। আরও মনে হলো, তাঁর সাহচর্য পেলে জ্ঞান আহরণের পথ প্রশস্ত হবে। সত্যি কথা বলতে কি শহীদুল্লাহ সাহেবের আকর্ষণেই ১৯৩৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্স ক্লাসে ভর্তি হই এবং মানুষ হই তাঁরই স্নেহছায়ায়”। (ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহঃ শহীদুল্লাহ সংবর্ধনা গ্রন্থ)

ভাষাতত্ত্বের প্রতি তাঁর আকর্ষণ মূলত শহীদুল্লাহ সাহেবের সান্নিধ্যেরই ফল। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের সর্বব্যাপী মনীষা ও জ্ঞানান্বেষণের স্পৃহা হাই সাহেবের জীবনের গতিপথকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তাঁর অপার স্নেহ ও ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ থেকেই হাই সাহেব নিজের লক্ষ্য স্থির করেছেন। (চলবে) 🍁

 

 

 

 

🍂অঙ্কন : প্রীতি দেবআন্তর্জালিক 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাসকবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি।) গল্পপ্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

🍁সম্পাদকীয় ঋণ : স্বামী বিবেকানন্দ-এর লেখা, অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত-এরগল্প, জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত। 

Sasraya News
Author: Sasraya News

3 thoughts on “Sasraya News | Sunday’s Literature Special | 29th December 2024 | Issue 45 || সাশ্রয় নিউজ | রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৫”

  1. এত ভালো লাগলো পড়ে । সত্যিই সুন্দর হয়েছে সাহিত্য পেজ
    ধন্যবাদ আপনাদের ।

    Reply

Leave a Comment