



🍂মহামিলনের কথা
আরে ! যখন বিবশভাবে নাম উচ্চারণ করলে কোটি জন্মের পাপ নষ্ট হয়ে যায়, তখন তুমি আগ্রহের সহিত নাম করতে চেষ্টা করছো—তোমার সে পাপ সূর্যোদয়ের অন্ধকারের মতো, ঝড়ের কাছে শুকনো পাতার মতো—কোথায় উড়ে চলে যাবে।

কোনো চিন্তা নাই, চালাও নাম। কাম ক্রোধ বলছো? যখন নাম করতে আরম্ভ করেছ তখন তুলোর গাদায় আগুন লেগে গেছে। নাম করতে করতে তোমাকেই খুঁজে পাওয়া যাবেনা—তা তোমার পাপ কাম ক্রোধ।
জগতে যত মধুর দ্রব্য আছে তা সকল হতে মধুর,সমস্ত মঙ্গলের মঙ্গল, নিখিল পবিত্রকারক বস্তুর পবিত্রকারক একমাত্র হরির নাম, ব্রহ্মা হতে তৃণগুচ্ছ পর্যন্ত অখিল সংসার মায়াময়। সত্য সত্য পুনরায় বলছি একমাত্র হরিনামই সত্য। –—শ্রীশ্রীঠাকুর সীতারামদাস ওঙ্কারনাথদেব
ঋণ : শ্রী ওঙ্কারনাথ-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড)
🍂গদ্য
কাজী নজরুল ইসলাম : জীবন, কর্ম ও প্রাসঙ্গিকতা
‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরেবিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী নজরুলকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন। লিখেছেন : অভিজিৎ দত্ত
২০২৫-এর ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলাম-এর ১২৭তম জন্মদিন উদযাপিত হচ্ছে।কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ। কাজী নজরুল ইসলাম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। পিতা ছিলেন মসজিদের ইমাম, মাতা গৃহবধূ। বাল্যকালে পিতাকে হারানোর পর নজরুলকে জীবনে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের মুখোমুখি হতে হয়। এইজন্য গ্রামবাসীরা তাঁর নাম দিয়েছিলেন দুখু মিয়া।
১৯২১ সালে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা হয়। তাঁদের এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন বজায় ছিল। শুধু তা-ই নয়, দুই কিংবদন্তী একে-অপরকে খুব শ্রদ্ধা করতেন।
যাই হোক, অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে প্রথাগত পড়াশোনা সেরকম হয়নি। কিন্ত সাহিত্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ থাকার জন্য সময় পেলেই তিনি বিভিন্ন ধরনের বইয়ের ভেতরে একাগ্রভাবে নিজেকে মনোনিবেশ করেছেন। কাজের জন্য তিনি বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমায় যান। এবং মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে একটি রুটির দোকানে কাজ নেন। সেখানেই আলাপ হয় দারোগা কাজী রফিকউদ্দিনের সঙ্গে। সে নজরুলের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে নজরুলকে স্কুলে ভর্তি করে দেন ও নানাভাবে সহযোগিতা করেন। প্রসঙ্গত, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় কবি নজরুল ইসলাম সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯১৯ সালে, ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২০ সালে সেনাবাহিনী ত্যাগ করে কবি কলকাতায় ফিরে আসেন ও যোগ দেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতিতে। সেখান থেকেই তার প্রথম কবিতা, ‘বাঁধনহারা’, প্রকাশিত হয়।১৯২৩ সালে বিদ্রোহী শিরোনামে কবিতা লেখেন যা ‘বিজলি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এরপরেই চারিদিকে নজরুলের নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে রাজনৈতিক কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। রাজদ্রোহিতার অপরাধে ইংরেজ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে। কারাবন্দী অবস্হায় নজরুল অনেক কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর ‘অগ্নিবীণা’ কবিতাটি বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করেছিল। পরাধীনতা, ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য নজরুলকে ‘বিদ্রোহী’ কবি বলা হয়। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকাশের পরে
বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী নজরুলকে বিদ্রোহী কবি উপাধি দেন।
১৯২১ সালে বোলপুরের শান্তিনিকেতনে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেখা হয়। তাঁদের এই সম্পর্ক দীর্ঘদিন বজায় ছিল। শুধু তা-ই নয়, দুই কিংবদন্তী একে-অপরকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। নজরুলের প্রথম বিয়ে বেশিদিন টেকেনি।এরপর প্রমীলাদেবী নামে এক হিন্দু মহিলার সঙ্গে তার আলাপ। আলাপ থেকে প্রেম ও বিয়ে। তাঁদের চার সন্তান হয়েছিল। নজরুল জীবিত অবস্হায় অনেক সম্মান পেয়েছিলেন। স্বর্ণপদক, পদ্মভূষণ, ডিলিট থেকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির সম্মানে ভূষিত হন। রোমান্টিক, বিদ্রোহী, মানবতাবাদী, সবধরনের ধর্মীয় গোঁড়ামী মুক্ত ও মুক্ত চিন্তার অধিকারী এই কবির শেষ জীবন খুব কষ্টে কেটেছে। তিনি বাকশক্তি রহিত হয়ে যান। কবিকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নিয়ে যাওয়া হয়। পিকস নামে একটি দুরারোগ্য মানসিক রোগে তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। কবির পুত্রবধূ তাঁকে যথেষ্ট সেবা করেছিলেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালের ২৯ আগষ্ট বাংলাদেশের ঢাকায় কবির মহাপ্রয়াণ হয়। কবি জীবনে অনেক আঘাত পেয়েছিলেন। জীবিত অবস্থায় সন্তান শোক, পত্নী বিয়োগের ব্যথা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি চিরকাল ছিলেন আপোষহীন এক যোদ্ধা।শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে চিরকালই তার কলম ছিল খড়্গহস্ত। আজ যখন শোষণ, দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার বিষের বাঁশি মানুষকে শেষ করে দিচ্ছে তখন নজরুল ইসলামের মত মহামানবদের কাছ থেকে আমরা কি কিছুই শিখব না?এই মহামানবের জন্মদিন পালন তখনই সার্থক হবে যখন আমরা নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের সঙ্গে পরিচিত হব। যাঁরা শুধু দিয়েই গেল, পেল না কিছুই, আমরা সেই মহামানব নজরুল ইসলামের আদর্শকে যেদিন আমরা আমাদের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারব সেইদিনই হবে তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আসুন সকলে সেই চেষ্টাই করি।🍁
🍂ফিরেপড়া | কবিতা
অমিতাভ মৈত্র-এর একটি কবিতা
বীজ ও মহাবিশ্ব
১.
প্রতি ছিয়াত্তর বছর
শুধু দু ঘন্টার জন্য
আকাশ নিঃশব্দে খুলে দেয় নিজেকে।
যখন হারেম তাঁর কুকুরকে বাইরে হাঁটাতে নিয়ে যায়
২.
সারাজীবন এই লাল ওসিরিস চেয়েছে
একজন ঘড়ি নির্মাতার সহযোগী হয়ে থাকতে
যিনি শুধু ঘড়ির যন্ত্রাংশ সারাবেন নিখুঁতভাবে
আর সময়কে মেরামত করবে সে
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
আঠাশ.
দেশ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়ে গেছে
২০০২ এর নভেম্বরেই ‘দেশ’ পত্রিকায় কবিতা বেরিয়ে গেছে। কবিতাটি তখন অধ্যাপক, ছাত্র-ছাত্রী, সাধারণ মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে। সমাজে নিজের পরিচিতি বেড়েছে একটা কবিতাতেই। বন্ধুরা বলতে শুরু করেছে ‘ঘাসকাটা’ কবি। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী কবি। সুকান্ত ছিলেন কিশোর কবি। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন নির্জনতার কবি। কিন্তু ‘ঘাসকাটা’ কবি কেউ ছিলেন না। ‘ডানা’ পত্রিকার সম্পাদক আমাদের জেঠু সত্যসাধন চট্টোপাধ্যায় বললেন, “হ্যাঁ, একটা কবিতা বটে। কবিতায় যে সত্য উচ্চারণ থাকে তা এটা তারই প্রমাণ।” জেঠুকে প্রণাম করে বাড়ি ফিরছি রাস্তাতেই দেখা রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ের ফিজিক্স বিভাগের প্রধান তপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি ডেকেই কবিতাটি মুখে মুখে আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিলেন। লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন, “একটা সময়ের নিরিখে প্রকৃত ইতিহাসের উচ্চারণ এই কবিতাটি। শুধু সাহিত্যশিল্পে নয়, আমাদের রাজনীতি, সমাজজীবনেও এর অমোঘ সত্য কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।” তপন স্যারকে আমরা ভীষণ সমীহ করে চলতাম। তিনি বিজ্ঞানের অধ্যাপক হলেও বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যগুলি পাঠ করতেন। বিভিন্ন ভাষায় তাঁর দখল ছিল। যে-কোনো বিষয় তাৎক্ষণিকভাবেই তিনি ব্যাখ্যা করতে পারতেন। এই বিস্ময়কর প্রতিভাধর মানুষটি কখনো কলম ধরে কিছু লেখেননি, কিন্তু পাঠ করেছেন অজস্র। তাঁর কথা শুনে আমার চোখ দিয়ে আনন্দে অশ্রু বিগলিত হলো। তারপর তিনি বললেন, “এসো আমার বাড়ি একদিন, অনেক কথা আছে।”
যে কবিতাটি নিয়ে এত কথা, এত পরিচিতি, আসুন সেই কবিতাটি পড়া যাক আরেকবার:
“দু’বেলাই ঘাস কাটি মজুরের ছেলে
কাঠখড়ের উষ্ণতায় রাত্রি করি পার
তবুও পার্টির লোক আমার দরজায়
না বাপু , কামাই হলে আমিই উপোস
কী খাই, কী খাই সারাদিন….
মিছিলের লাল ধুলো, ঘুরবে আকাশ
আর একটু দাঁড়াও কার্ল মার্কস,
কয়েক শতাব্দী আরও কেটে নিই ঘাস।”
সেদিন হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরেছিলাম। কবিতা লিখে এত সম্মান, এত উপহার, এত আশীর্বাদ আমাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল। সাইকেল নিয়ে ফিরতে ফিরতেই দেখেছিলাম, সদ্য বিয়ে হওয়া আমার পছন্দের ছাত্রীটি ফিরে এসেছে তাদের বাড়িতে। বিয়ের পর ওকে এত সুন্দরী লাগছিল যে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কলতলায় কাপড়গুলো কেচে নিচ্ছিল আর থালা মেজে নিচ্ছিল। ঝকঝকে থালায় এক-কবার মুখও দেখে নিচ্ছিল।
কবিতার নামই ছিল ‘ঘাসকাটা’। তখন বামফ্রন্টের সরকার। তাদের মিছিলে, স্লোগানে যেতে হতো বিভিন্ন সময়। এক-আধবেলা খাবার পাওয়ার লোভে যেতামও। তাই তাদের নামকরা লোক হয়ে গেছিলাম ‘মিছিলের লোক’। কিন্তু অভাবের দিনে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ছেড়ে যেতে পারতাম না। স্কুলজীবনে স্কুল কামাই করেও কাজ করতে হতো শুধু খাবার যোগাড় করার জন্য। তখন বাবা ও আমি মাঠে মাঠে ঘাস কেটে গেরস্থ বাড়িতে বিক্রি করতাম। এক-এক বস্তা ঘাস ওরা কিনে নিত গাই গরুকে খাওয়ানোর জন্য। তার বদলে পেতাম দু কেজি খুদ কিংবা দু কেজি গম। তাই দিয়ে অবেলায় আমাদের পেটের খিদে মিটতো। খুদের সঙ্গে তালের মাড়ি মিশিয়ে মা তৈরি করতো পোড়া পিঠে। কখনো শুধু খুদের জাউ, কিংবা গমের জাউ। বনকচুর ডাঁটা সিদ্ধ করে তাই দিয়ে খেয়ে নিতাম। কখনো গাছের কদম রান্না হতো। সারাদিন পর তাই ছিল অমৃত। সুতরাং মিছিলে যাওয়ার আগ্রহ কমে গেছিল। মনে হয়েছিল সারাজীবন ঘাস কেটেই আমাদের পার করতে হবে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তন না হলে সমাজেও পরিবর্তন আসবে না। কবিতাটি বেরোনোর কয়েকদিনের মধ্যেই অনেকগুলি চিঠি পেয়েছিলাম। জয় গোস্বামী স্বয়ং চিঠি লিখেছিলেন এবং অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। বেশিরভাগ দূরের লোকেরাই চিঠিতে জানিয়েছিলেন, কবিতাটি একটি ঐতিহাসিক যুগসন্ধির বার্তা নিয়ে এসেছে। রাজনীতিতে ক্ষমতা পরিবর্তনের একটা আভাস যে জরুরি হয়ে উঠেছে তার উচ্চারণ এই কবিতাটি। কবিতা যে আমি কল্পনা করে লিখতে পারি না, আমার জীবনের যা বাস্তব উপলব্ধি এবং যার মধ্যে আমি আমার যাপনক্রিয়া সম্পন্ন করে চলেছি, কবিতা তো তা-ই। এতদিন পত্র-পত্রিকায় কবিতা লিখেও মানুষের নজরে আসতে পারিনি, শুধুমাত্র একটা কবিতা ‘দেশ’ পত্রিকায় লিখেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছি তাই আমার দায়িত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কলেজে অধ্যাপকদের কাছেও আমার সম্মান বেড়ে গেছে। ছাত্র-ছাত্রীরাও জেনে গেছে আমার কবিতা লেখার খবর। সকলের কাছেই আমি ‘ঘাসকাটা’র প্রতিনিধি।
সব থেকে আরো ভালো খবর সেই বছরই জয় গোস্বামী আরেকটি চিঠিতে আমাকে শারদীয় ‘দেশে’ লেখার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ‘দেশ’ দপ্তর থেকে পাওয়া চিঠি যে কত আনন্দের হতে পারে অন্তত ২০০২ সালে তা বলে বোঝাতে পারবো না। আর স্বয়ং সেই চিঠি লিখছেন কবি জয় গোস্বামী। তিনি তখন আমার স্বপ্নের কবি। যতগুলো পুরনো ‘দেশ’ পত্রিকা সংগ্রহ করে পড়েছি, বেশিরভাগ সংখ্যাতেই দেখেছি জয়কে। তাঁর কবিতার শব্দস্রোত, বাগধ্বনি কোথায় যেন ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে। টাকা জমিয়ে জমিয়ে কিনে ফেলেছি তাঁর কবিতার সংগ্রহ প্রথম খণ্ড। রাত্রে ঘুমিয়ে যাবার আগে বইখানা মাথার কাছে রেখে দিই। মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখি প্রিয় কবিকে। তাঁর হাতের লেখা চিঠিখানি কয়েকবার চুম্বন করে আমার সাইড ব্যাগে রেখে দিলাম। এই চিঠি মনে হলো একটি শক্তি, একটি প্রাচুর্য, একটি ঈশ্বরের ছাড়পত্র।
সেই সময় কবিতা লিখলেও গল্প লেখাকে আমি উপেক্ষা করিনি। ‘দেশ’ পত্রিকাতেই পড়ে চলেছি কত গল্প। আবুল বাশারের গল্পগুলি মনের মধ্যে দাগ কাটছে। গ্রামবাংলার কত চিত্র, কত জীবনের মর্মবিদারী হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস তাঁর গল্পে প্রতিফলিত হচ্ছে। রাজনৈতিক চক্রান্ত থেকে অমানবিক নানা ঘটনার প্রতিফলন আমাকেও অস্থির করে তুলছে। ‘অদলবদল’ পত্রিকাটি তখন কলকাতার সল্টলেক থেকে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। দলিত সাহিত্যিকদের মুখপত্র হিসেবে তখনকার দিনে নামকরা একটি পত্রিকা। ‘অস্পৃশ্য’ নামে নিজের জীবনকথা লিখেই পাঠিয়ে দিলাম দপ্তরে। নিজের জীবনের টানাপোড়েন, দারিদ্র আর আত্মহত্যাপ্রবণ ভাবনা এই গল্পটির মূল বিষয়। শুধু শেষ দিকটা একটু পরিবর্তন করে ফেললাম। ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়েও পড়া অসমাপ্ত রেখে দিলাম। যদিও পড়া অসমাপ্ত রাখারই কথা ছিল আমার টাকার অভাবে। সুতরাং গল্পের বাস্তবতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু পরিবর্তন করে ফেললাম প্রেমিকার নামটি। আসুন গল্পটি আরেকবার পড়া যাক :
“অস্পৃশ্য
মনের ভিতর অন্ধকারের রাজত্ব। অন্ধকারের ভিতর জীবনের অস্তিত্বের বুদবুদ। এই আছি। কখন থাকব না। দু’চোখে কুয়াশা মেখেছি। রক্ত ফিকে হয়ে গেল।
—যম, কপাট খোল্!
—এত ভোরবেলায় কী দরকার? আসতে চাইছিস্ কেন?
—ঘুরে ঘুরে কিছুই পেলাম না বলে।
—কেন তোর প্রেমটা কী হল?
—ছেড়ে গিয়েছে।
—চাকরি?
—হয়নি।
—লেখাপড়া?
—আর এগোয়নি।
—আমার কাছে তো কিছুই নেই ভাই। মাত্র দুটো জিনিষ পড়ে আছে। সবাইকে দিই না। তুই যখন এতদূর কষ্ট করে এলি, তখন একটা নিয়ে যা। শান্তি পাবি।
—দেখা তো আগে কী জিনিষ?
—এই নে একগাছা দড়ি অথবা এক শিশি বিষ। এই দুটোই তো মহৌষধ। কাজ হবে।
—আমি যে কোনোটাই ছুঁতে পারছি না।
কেঁপে কেঁপে যাচ্ছে হাত! ওঃ বড়ো অন্ধকার! কে কোথায় আছো—বাঁচাও!
—কেউ নেই। ছোটোবেলা থেকে আমিই তোর সঙ্গে ছিলাম। শোন্ তবে, বলি।
চতুর্থ শ্রেণিতে তুই যখন বৃত্তি পেলি বুদ্ধির পরীক্ষা দিয়ে, তখন আমার দারুণ রাগ হয়েছিল। কী সব আজেবাজে কথা বলছিল হেডমাস্টার তোকে নিয়ে। তখন আমি দূরে সরে গেলাম। তুই আবদার পেলি বাবা-মায়ের। স্কুলে তখন তোর কী সম্মান! আমাকে একবারও ডাকলি না। তারপর দীর্ঘ চার বছর পরে অষ্টম শ্রেণিতে তোর সঙ্গে একদিন দেখা হল। তোর স্কুল ভাঙার সেই বটগাছ তলায়। তখন তোর প্রথম প্রণয় চলছিল পূর্ণিমার সঙ্গে। পূর্ণিমা যেমন পড়া ছাড়ল তোর সঙ্গেও ঘটল বিচ্ছেদ। তুই বেঁকে বসলি। কিছুই খাব না। ওকে না গেলে জীবন বৃথা। রাত্রে ঘুম এল না। তখন আমিই তোকে সান্ত্বনা দিয়েছি। সেই বটতলায় আমার সঙ্গে সঙ্গে এসে ঘুরে গেলি। দড়ি ছিঁড়ে পড়লি বলে আর একবার চেষ্টা করলি না। সেদিন আমায় কত মন খারাপ হল, তা আর কাকে বলি?
তারপর তুই মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করলি। একটু ভালো রেজাল্ট হল। আর লাফিয়ে উঠলি। ভর্তি হলি কলেজে। সেই সময় একদিন নেমন্তন্ন পেলাম। তোর বাবা বলল— আর লেখাপড়া হবে না। মুনিষ খাট। মাটি কেটে খা। তখন তু লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে ঘর ভর্তি একদল লোকের সামনেই আমাকে ডেকে অপমান করলি। তারপর বাহাদুরি দেখিয়ে মুম্বই শহরে এসে নিলি কুলিবৃত্তি। একদিন আমার ইচ্ছা হল, ছ’তলার ওপর থেকে তোকে নামিয়ে নিয়ে পালাই। পায়ের তলার ইট খুলে ফেললাম। ওপরের কড়িকাঠ ধরে তুই ঝুলতে থাকলি। তোর শক্তি তখন প্রচণ্ড। আমি আর টানতে পারলাম না। ফিরে এসে শুরু করলি পড়াশুনা।। হায়রে ব্যক্তিত্ব। সারাদিন অনাহার। মাঠের ছিঁড়ে আনা কচুর শাক। গমের জাউ। পরের বাড়িয় ভাতের ফ্যান। এই খাওয়া না খাওয়া জীবন। তবু আমার শরণ নিলি না। গোলাম চাচার বাড়ি ভাতের ফ্যান চাইতে এসে কম অপমান হ’সনি। গোলাম চাচা বলেছিল, আমার কুকুরে খাবে তাও ভালো।। মানুষকে দিয়ে কোনো ফল নাই।
তবু তোর লজ্জা হয়নি। মূর্খ! তুই ঘরের কোণে অঝোর ধারায় কেঁদে কেঁদে চুপ করলি। যখন বিপ্লব মেহেনা গমের ভুঁই থেকে বেথো শাক তোলার লেগে তোর বোনকে বলল, শুয়োরের পোঁ,ওটে আবার আমার জমিনে গম ভাঙতে আলি!পুঁদির চামড়া তুলব!
তখনও তুই চুপ করে রইলি। বখন তোর ঘরের লোকে কাপড় পরতে পায় না, বাইরের লোকের চোখকে ইজ্জত বিক্রি করে। ঘরে দু’বেলা ঝগড়া হয়। অসুখের ঔষধ নাই। পথ্য নাই। বাবাটা চিঁ চিঁ করে সারারাত কাশে। হাঁপায়। সেই দুর্যোগ আর মহামারী মাথায় নিয়ে তুই পাশ করলি উচ্চ-মাধ্যমিক। রেজাল্ট ভালোই হল। নোনা জলে চোখ ভিজিয়ে আকাশ দেখলি। সারি সারি ঝিকি-মিকি করছে তারা। চাঁদ উঠেছে। আহা কী বাহারের জ্যোৎস্না! গাছে গাছে ফুল ফুটেছে। তুই মনে করলি বসন্ত এল। রঙিন ডানাওয়ালী একটা পরির কাছে গেলি। পরি মানে গৌতমী। নীল খামের ভিতর প্রেম পাঠালি। সিনেমা দেখলি। স্বপ্ন দেখলি। তারপর একদিন ওর দিক থেকেই রেজিস্ট্রির প্রস্তাব এল। তোর তখন শেকড় বাকড় নেই। দাঁড়াবি কোথা? ভাবতে লাগলি। পারলি না। হেরে গেলি। গৌতমী বিয়ে করল এক প্রফেসরকে। আর তুই? বি, এ পাশ করে পথের কুকুর হয়ে ঘুরতে লাগলি। টিউশ্যানিও ভালো চলে না। বাড়িতে ভাত নাই। দামড়া হয়ে কতদিন বসে খাবি! দু-দুটো বোনকে পরক্ষেত্তর করতে হবে। চোখের সামনে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। আগুনে পা পুড়তে লাগল। শিরাগুলি জড়তায় অবসন্ন। পথে ঘাটে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কেউ আর সহ্য করতে পারে না। বাবার ভিক্ষান্নে ভাগ বসিয়ে খেয়ে চল্লি। আবার এই অবস্থায় এম, এ-তেও অ্যাডমিশন নিলি। পূর্বাপর চিন্তা করলি না। ক্লাসে বন্ধুরা ঠাট্টার খোরাক পেল। ফাটা প্যান্ট আর পুরনো খদ্দরের পাঞ্জাবি। মুখ ভর্তি দাড়ি। অস্বাভাবিক সঙ্ লাগত দেখে। বন্ধুরা বলল, হতচ্ছাড়া প্রেমিক! কেউ বা বলল, পাগল! কেউ বা বলল, গুণ্ডা গুণ্ডা লাগে!
প্রতিদিনের ঠাট্টা মস্করায় আর টেঁকা গেল না। এদিকে পকেটও শূন্য। শীতে কাঁপছিলি, একটা চাদরও ছিল না। তখন বুঝতে পারলি স্কুলজীবন যে-ভাবে কাটিয়েছিলি ইউনিভারসিটি জীবন সেভাবে কাটানো যাবে না। এখানে আর কিছু না হোক টাকা থাকতেই হবে। তাই নিরুপায় হয়ে ফিরেও এলি। পরীক্ষা দিতে পারলি না।
এতদিন পর আমার কাছে আসতে চাইলি। হ্যাঁ, আমি তৈরিই ছিলাম। এই তো মালা, চন্দন সবই এনেছি। সাগ্রহেই তোকে বরণ করে নেব। আয়। আশা করি আজ আর ফিরিয়ে দিবি নে।
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে আমি বললাম, থাম একটু! একটা সিগারেট ধরাই!
—এত দামি সিগারেট কোথায় পেলি?
—মানে, মানে গতকাল বাসের ওপরে একটা
লোকের পকেট মেরেছিলাম।
—এত অধম তুই?
-—আরো বলছি। আমি কয়েকদিন থেকে ঘর ছাড়া। ওঃ বাড়ির লোকদের কী কষ্ট! চোখে দেখা যায় না। তিন দিন থেকে কিছুই খেতে পাইনি। শেষে মনে হল তোর কথা।
—তারপর?
—তোর কাছে আসার পথেই নদীর ধারে একটি মরা গোরু দেখতে পেয়ে ধীরে ধীরে তার কাছে গেলাম। দু-একটা কুকুর ও শকুন জুটছিল। তখনও চামড়াটা অক্ষত। একাই ছাড়িয়ে ফেললাম। সেটাই বিক্রি করে ক’দিনের মদ খাবার দাম হল!
—ছি! ছি! এ কাজও তুই করেছিস্? তুই ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য, অশুচি! তোকে আর আমি ছোঁব না তই ওখানেই দাঁড়িয়ে থাক্। আমি ফিরে যাচ্ছি।
ওঃ পৃথিবীটা আরো অন্ধকার। মাথাটা ঘুরছে; পৃথিবীটাও ঘুরছে বন্ বন্ করে। যমেরও অস্পৃশ্য আমি। আমার ঠাঁই কোথায় বলতে পারো তোমরা?”
এই গল্পটি লেখার আগে আরো কয়েকটি গল্প আমি লিখে ফেলেছিলাম তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘স্বপ্ন ভাঙা রাতের আলো’, ‘ছিঁড়ে গেছে তার’ ইত্যাদি। সব গল্পগুলিই প্রান্তিক জীবনের কথা। গল্পগুলিতে এতই বাস্তবতা রয়েছে যে মাঝে মাঝে আমাকে হেনস্থাও হতে হয়েছে। আজও অনেকেই এ প্রশ্ন আমাকে করেন, আমি কেন বেশি বেশি কথা সাহিত্য লিখিনি? এই প্রশ্নের উত্তরে আমি একটা কথাই বলি, আমি ঠিক কল্পনা করে লিখতে পারি না, যার মধ্যে আমি আছি, যা আমার জীবনের, যা আমার চোখের সামনের ঘটনা—আমি তাকেই লিখতে ভালবাসি। তাই কথাসাহিত্য সেইভাবে লেখা হয়ে ওঠেনি। আমার যা কষ্ট, আমার যা না-বলা কথা, কবিতার শব্দ ও পংক্তিতে দীর্ঘশ্বাসের মতো বেরিয়ে আসে। আমাকে তা লিখতে হয় না, তারাই লিখিয়ে নেয়। তাই কবিতা লেখাতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
যাইহোক এই কবিতা ও গল্প অনেকেই পাঠ করেছিলেন। এক রবিবার সাইকেল নিয়ে জয়কৃষ্ণপুরের দিকে রওনা হয়েছিলাম। নজির আহমেদ ও মোয়াজ্জেম হোসেনের বাড়ির দিকে। নজির আহমেদ সাহিত্যচর্চা করতেন ছাদে ফুলের বাগানও করেছিলেন, আবার সাহিত্যিকদের সমাজদারও ছিলেন। তাই ভালো কিছু খবর বা মতবিনিময় হলে তার কাছে গিয়ে হাজির হতাম। মোয়াজ্জেম হোসেন ছিলেন নগর হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক। রবিবারের দিন তাঁর ছুটি বলে বাড়িতে আসতেন। ছয়ের দশকে তিনিও পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেদিন দুজনকেই সঙ্গে পেয়েছিলাম। বাড়ি থেকে ফিরে এসেছিলাম রামপুরহাট শহরে। পান্থশালা নামে মিষ্টির দোকানে এসেই মোয়াজ্জেম হোসেন বললেন, “আজ তোমাকে খাওয়াবো, কেন খাওয়াবো তা বুঝতেই পারছো, তোমার কবিতা লেখার পুরস্কার!”
হ্যাঁ, সেদিন ভালোই খাইয়ে ছিলেন। তিনজনেই আমরা পেটপুরে খেয়েছিলাম কত রকমের মিঠাই। তারপর নজির আহমদ কিনে দিয়েছিলেন একটা বড় খাতা ও একটা ভালো কলম। বলেছিলেন, “এটা আমার তরফ থেকেও কবিতা লেখার উপহার!”
সেদিন হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরেছিলাম। কবিতা লিখে এত সম্মান, এত উপহার, এত আশীর্বাদ আমাকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছিল। সাইকেল নিয়ে ফিরতে ফিরতেই দেখেছিলাম, সদ্য বিয়ে হওয়া আমার পছন্দের ছাত্রীটি ফিরে এসেছে তাদের বাড়িতে। বিয়ের পর ওকে এত সুন্দরী লাগছিল যে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। কলতলায় কাপড়গুলো কেচে নিচ্ছিল আর থালা মেজে নিচ্ছিল। ঝকঝকে থালায় এক-কবার মুখও দেখে নিচ্ছিল। ঘরের ভেতরে টেপে তখন হিন্দি গান বাজছিল: ডোলি সাজাকে রক্ না, মেহেদি লাগাকে রক্ না…
তখন আমার মাথায় ঘুরতে লাগলো কয়েকটি লাইন:
“ঝকঝকে থালায় মুখ।
স্বপ্নে ঢুকে যাব—
তোমার পেটের ভ্রূণ হয়ে
ফিরে আসব আজকে রাতেই।” 🍁(চলবে)
🍂কবিতা
ঈশান বিশ্বাস-এর একটি কবিতা
ঘোর
কিছু ঘোর থাকা ভালো
কিছু ঘোর আঁটকে রাখে জন্ম-জন্মান্তর…
ভোরের ফুলের মতো গন্ধ ছড়িয়ে দেয়
কিছু ঘোর তোমাকে বৃত্তের চক্রান্ত
চিনিয়ে দেবে
দর্পনা গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
নজরুল
অঞ্জলি নাও তুমি আমার
গানে ছন্দে বিদ্রোহে,
তুমি থাকো আমার জীবনে
বিরহী পাপিয়ার বিরহে।
তোমার গানের ডালিতে ভরা
বিদায় সন্ধ্যা বেলা
সেই গানেতেই আজও জেগে
স্মৃতি বিজড়িত খেলা।
তোমার কবিতায় একই বৃন্তে
ফোটে হিন্দু – মুসলমান
তোমার কবিতায় তরুণের তারুণ্য
লৌহ কপাট গান।
শিশুরা পেয়েছে ছড়া কবিতা
পেয়েছে প্রজাপতি গান।
কাঠবেড়ালির পেয়ারা চুরি
তোমার অভিনব অভিযান।
দুঃখে কাটিয়ে লড়াই চালিয়ে
সংগ্রামে দিয়েছ জীবন।
শেষ বারে তুমি নীরব হয়েছ
শ্রদ্ধায় করি স্মরণ।।
গোলাম কবির-এর একটি কবিতা
ভালবাসার ঘোরের মধ্যে
ভালবাসার ঘোরের মধ্যে
আমি আমাকেই ভুলে যাই!
ঘোরের মধ্যে আমি শুধু একটা
ভাঙনপ্রবণ নদীর স্বপ্ন দেখি!
ভালবাসার ঘোরের মধ্যে
দেখি আমার বিস্তীর্ণ সবুজ উপকূলের
পাড় ভাঙছে শুধু, পাড় ভেঙে
জলে তলিয়ে যাবার আগে
ঝপ্ করে পড়ার শব্দে
আমার আকুলতা তোমার দরজায়
মাথা কুটে মরছে, তুমি দেখেও
না দেখার ভাণ করে হৃদয়ের দরজায়
খিল এঁটে শীতনিদ্রা যাপন করছ!
ভালোবাসার ঘোরের মধ্যে
এক একদিন মনে হয়
আমি যেন কোনও একটা
তীব্র স্রোতস্বিনী নদীর ঘুর্ণিপাকে
স্বেচ্ছায় ঘুরতে ঘুরতে তলিয়ে যাচ্ছি
অনন্তকালের আনন্দধামে যাত্রাপথে
গান গাইতে গাইতে!
ভালবাসার ঘোরের মধ্যে
আমি যে কোথায় আছি ভুলে গিয়ে
তোমার মধ্যেই অনন্তকাল
বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি।
শর্বাণীরঞ্জন কুন্ডু-এর দু’টি কবিতা
নিষ্কৃতি
কিছু কিছু মানুষ আছে
যারা কোনওদিন কিছু শেখে না।
নিয়তি তাদের অমোঘ পরিণতির দিকে টেনে নিয়ে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে জীবন দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু না।
নজরুলের ভাষায় ঈশ্বর এক বিরাট শিশু
যে আনমনে খেলা করে।
তা না হলে মানুষ কেন যুদ্ধ করে,
কেন পরস্পরকে হত্যা করে?
কেন মানুষের এত বিদ্বেষ?
আসলে আকাঙ্খার ভুত মাথায় সওয়ার হলে
মানুষ সুধবুধ ভুলে যায়।
একের পর এক অন্যায় করতে থাকে।
অন্তর্যামী তো সব দেখেন!
মানুষের পদচারণা, মানুষের মিথ্যাচারিতা, মানুষের ব্যভিচার,
সব লিপিবদ্ধ হতে থাকে।
একসময় সব তালগোল পাকিয়ে যায়।
নিজেকে সেই সব জট থেকে মুক্ত করা কঠিন হয়ে যায়।
কিছু জিনিস বাহ্যিক দেখা যায়,
কিছু ঘটে ভেতরে ভেতরে।
তবে যা ভেতরে ভেতরে ঘটে
নিজেকে সেই জাল থেকে মুক্ত করা বড় কঠিন কাজ।
সব মানুষের ভেতরে যে পবিত্র আত্মা থাকে
সে কিন্তু মিথ্যাচারিতা ভালবাসে না।
তবে সব মানুষ এসব বোঝে না।
তাই অসাধুতার বসে পড়ে কত কি যে করে!
একদিন মিথ্যাচারিতার বোঝা থেকে সে নিজেই নিষ্কৃতি চায়।
মানুষের মৃত্যু হয়।
ছোট মন মানুষ
ছোট মন কি নিয়ে থাকবে বল?
সে কেবল নিজের কথাই ভাববে।
কেউ শুধু নিজের পরিবারের কথা ভাবে।
সেখানে কেউ কেউ সফল হয়, কেউ হয় না।
কেউ পাড়ার কথা ভাবে, কেউ গ্রামের কথা।
এই ভাবে ধাপে ধাপে মানুষের উত্তরণ হয়।
সব ধাপেরই পরিসীমা থাকে।
বাক ও আচরণ খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যপার।
কারও ধী তাকে দেয় সেটা,
কাউকে কষ্ট করে শিখতে হয়।
আমি ভাবলাম এটা পারি,
সেটাই যথেষ্ট নয়।
সমাজ থেকে সবাইকেই নিতে হয়।
অনেক কিছু সমাজ অযাচিত দেয়।
সেটা প্রাপ্য মনে করলেই ভুল করে ফেললে।
যা পাচ্ছ তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে হয়।
অকৃতজ্ঞ হলে কি গেলে।
আজ নয়ত কাল খেসারৎ দিতেই হবে।
অধিকার ও কর্তব্য হাত ধরাধরি করে চলে।
ছোট মন এসব ভাবে না।
সে কেবল প্রাপ্য নিয়ে চিৎকার করে।
সমাজকে ধ্বংস করে, পরিবারকে ধ্বংস করে,
শেষে নিজেকেই শেষ করে দেয়।
তুমি যে কখনও কান পাতনি,
চক্ষু মেলিয়া দেখনি কিছু।
কেবল ভক্ষণ করেছ।
ওটা বেঁচে থাকা নয়
যদি তুমি মানুষ হয়ে থাকো।
বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর একটি কবিতা
দেবতার সর্বনাশ
দেবতাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে…
হাত থেকে ব্রহ্ম কমল উড়ে গেছে, জাহান্নামের দিকে
শোনা গেল, ওদের পদবি নেই
ভুল রঙের মাস্কারায় ওদের চোখে আগুন
দেবভূমি তছনছ করে এগিয়ে যাচ্ছে, শাসকের অপ্রাসঙ্গিক ক্যারাভ্যন
মর্ত্য জুড়ে তোলপাড়,”ফিরিয়ে দাও”
রাজপথ জুড়ে ছড়িয়ে আছে, শিক্ষার লাশ
আর অর্জিত প্রগতিপত্রের নিশ্চুপ কান্না
কারোর ভুল ইশারায়, আজও বেড়ে যাচ্ছে—-
অপরাধের কর্ডন
এরপর হয়তো তামাম জনপদ জুড়ে নেমে আসবে
শিশুদের ভুল শতকিয়ার উচ্চারণ
আজ প্রতিবাদে ভরে যাওয়া এ শহরে
দেবতাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে…
বৃন্দাবন দাস-এর একটি কবিতা
দাসের জগত
যে ‘অচেনা’ হবার চেষ্টা করে তাকে চিনতে যাইও না
যে ‘অজ্ঞাত’ হবার কসরত্ করে
তাকে জ্ঞাত হবার চেষ্টা কইরো না
দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া নিজেকে হয়রানি করে
বিখ্যাত হইবার কসরত্ কইরো না
মিথ্যে সখা চাইও না, ছলনার সখী চাইও না
ঘোট পাকাইয়া দন্ডমুন্ডের অধিকারী হইতে যাইওনা
তুমি সোজাসাপ্টা একটা ভোটের অধিকারমাত্র
দিন গত পাপ ক্ষয় এটা ঠিক না
সংক্রমণও নয় ছোঁয়াচে দূরত্বও নয়
মানুষের সঙ্গে ‘সুপ্রভাত’ চাওয়ার লম্বা পংক্তিতেই আছি
ঐতিহ্যের ধ্বজায় রং মাখাতে মাখাতে
জমিদারি বনেদিয়ানা দেখাতে দেখাতে
প্রসাদের গন্ধে দৌড়তে থাকে তো থাকেই
পুজো আসে, যার পুজো সেই জানে না
এরা কার পুজো করে
মিসাইল এর পর মিসাইল তৈরি হয়ে যাচ্ছে
চণ্ডীপাঠেরও বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে
আমার তিনবছরের নাতি অপ্রতিম
গতরাতে ওর বাবাকে বললে, “বাবা দেখো, দাদু নাম লিখছে– দাদু দাস”—
তারক মণ্ডল-এর একটি কবিতা
সময়ের ছায়া
সময়ের ছায়া নামে ধীরে,
নীরবতার গায়ে হেলে,
চোখ রাখে অতীত খাতায়,
ভবিষ্যতের স্বপ্ন মেলে।
রোদ আসে, বৃষ্টি ভেজায়,
জীবনের এই ছন্দে,
হারায় কিছু, ফেরাই কিছু,
তবু চলি প্রতিদিন প্রতিবন্ধে।
পথের শেষে আলো জ্বলে,
আঁধার যদি ছায়া বোনে,
হৃদয় তখন গান গায়,
নতুন কোন রঙের মনে।
তাই জেগে থাকি এখন,
স্বপ্ন বুনি নিঃশব্দে,
সময়ের সাথে সখ্য করি,
জীবন লিখি, শব্দবন্ধে…
🍂গল্প | এক
শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা থেকে নামখানা লোকাল ছাড়ছে দেখে একটা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে বসেন। ট্রেন ছুটে যায় আপন গতিতে। সকালের দিকে বেশি ভিড় নেই। কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। কিন্তু কোথায় যাবে! কোথায় থাকবে! তা স্পষ্ট জানা নেই। নিজের অভিমান থেকে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। এবার দেখতে চান জীবন তাঁকে কোথায় নিয়ে যায়!
কুড়িয়ে পাওয়া বাবা
রবীন বসু
না আর পারছে না সুখময়। আর সহ্য হচ্ছে না নিত্যদিনের এই অপমান অসম্মান তাচ্ছিল্য। শুধু তাচ্ছিল্য না, তার সঙ্গে ইদানিং জুটেছে শারীরিক নির্যাতন।
গত কালের ব্যাপারটা যেমন। ছেলে সুজয় তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। শরীরটা ভাল নেই, কেমন জ্বর জ্বর ভাব। বিকেল থেকে বসে আছেন এক কাপ চায়ের জন্য। শীতকালের সন্ধে পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। প্রায় সাতটা বাজে। সুখময় উঠে বউমার ঘরে যায়। “আজ চা হবে না, বৌমা?”
আগুনে ঘি পড়ার মতো বৌমা অরুণিমা দপ্ করে জ্বলে উঠল। “বলি, চোখের মাথা কি খেয়েছেন? দেখছেন না আমি ছেলেকে পড়াচ্ছি। এখন চা হবে না। আপনার ছেলে ফিরলে একসঙ্গে দেব।”
“শরীরটা ভাল নেই, বৌমা। জ্বর এসছে বোধহয়। মাথাটায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। আদা দিয়ে একটু চা পেলে ভাল হত।”
“বায়নার শেষ নেই! ধান্দাবাজ বুড়ো। যান এখন—”
অকস্মাৎ বৌমা দৌড়ে এসে দড়াম করে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। শক্ত কাঠের কপাট সজোরে লাগল সুখময়ের কপালে ও নাকে। ‘ওঃ মাগো’ বলে দরজার সামনে বসে পড়েন। নিজের কষ্টের রোজগারে করা বাড়িতে দাঁড়িয়ে তাকে শুনতে হচ্ছে ধান্দাবাজ! কে বলছে, না ছেলের বউ! আর যে সহ্য হয় না এই চরম অপমান।
একটু ধাতস্থ হতে উঠে টলতে টলতে নিজের ঘরে চলে এসেছিলেন। নিজের ঘরই-বা বলেন কেন! বৌমার বাপের বাড়ির লোকজন এলে তাকে বারান্দায় সোফাতে গিয়ে শুতে হয়। তখন তার ঘর হয়ে যায় গেস্ট হাউস। যত রাজ্যের পুরনো বাতিল জিনিস তাঁর ঘরে ডাঁই করা। দম বন্ধ হয়ে আসে। স্ত্রী যতদিন বেঁচে ছিলেন তবু সময় মতো খাবার ও চা পেতেন। এখন তো বৌমার দয়ার উপর নির্ভর করতে হয়। ভাগ্যিস পেনশনের টাকা ক’টা ছিল, না হলে কবে যে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত!
এখন মনে পড়ে কত কষ্ট করে এই একতলা বাড়িটা তিনি করেছিলেন। পোস্ট অফিসে সামান্য মাইনের চাকরি। অভার টাইম ছিল বলে কিছুটা বেঁচে গেছেন। ছেলে-মেয়েকে নিয়ে তাদের চার জনের সংসার সামলে পাই পাই করে কিছু জমিয়ে ছিলেন, সেই টাকা আর মোটা একটা ব্যাঙ্ক-লোন নিয়ে এই বাড়ি। পরে ছেলে-মেয়েকে পড়াতে আর ব্যাঙ্কের ইএমআই দিতে চাকরির টাকা কুলোচ্ছিল না। ছুটির দিনে টিউশনি ধরে ছিলেন। অবসরের পর হাতে কিছু টাকা আসতে মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর ছেলে চাকরি পেতে তারও বিয়ে হল। পাত্রী আগে থেকে পছন্দ। খরচের কথা বলতে সুজয় বলেছিল, “বাবা আমার তো সবে চাকরি। হাতে জমা কিছুই নেই। তুমি সামলে নাও। আমি পরে দিয়ে দেব।” বিয়ের পর ছেলেরও ছেলে এসে গেল, তার বয়সও হল ছ’বছর। বাবাকে সে টাকা আজও ফেরত দেয়নি রোজগেরে ছেলে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু হেঁটে গেলে একটা পার্ক আছে। বিকেলে সেখানে গিয়ে ক’য়েক পাক ঘুরে বেঞ্চে বসেন সুখময়। তার মতো আরও অনেকে যারা অবসর নিয়েছে তারা আসে। পাড়া ও পাশের পাড়ার। কুশল বিনিময় হয় পরস্পর। গল্প করে, দেশের হালচাল নিয়ে কথা হয়। আজ সুখময়ের মন ভাল নেই। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে গল্প করতে আর ভাল লাগে না। ভাল নেই, অথচ খুব ভাল আছে, এই ভান করতে আর পাচ্ছেন না। তাই ওদের আড্ডায় না বসে দূরে অন্য একটা বেঞ্চে বসেছেন। শীত বিকেলের নরম রোদ পার্কের ঘাসে। বাচ্চারা কলকাকলিতে খেলছে নিজেদের মধ্যে। সুখময়ের মনে পড়ে, ছেলে সুজয় যখন ছোট ছিল, ছুটির দিন তাকে এই পার্কে নিয়ে আসতেন। ও দোলনা চড়তে খুব ভালবাসত। যখন টেনে দোলনা ছেড়ে দিত কচি মুখে কী নিষ্পাপ হাসি ছড়িয়ে পড়ত। আনন্দে তাঁরও বুকটা ভরে উঠত। সেই নিষ্পাপ সরল ছেলেটা কেমন বদলে গেল বিয়ের পর। এখন বৌমা আর তার বাপের বাড়ির লোকেরা যা বলে তাই শোনে। বৌমা অকারণে অসভ্যতা করলে যদি নালিশ করে, বিরক্ত হয়। বলে, “অ্যাডজাস্ট করতে শেখো বাবা। সব তোমার মনের মতো হবে না। অরুণিমার মন জুগিয়ে চল। তাহলে তুমিও ভাল থাকবে আর আমিও।”
পুতুল কেমন অনায়াসে তাঁকে আপন করে নিল। বার বার চোখে জল ভরে আসে।
রাতে গরম রুটি আর আলুর তরকারি করে দিল পুতুল। খিদেও পেয়েছিল। খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। খাওয়ার পর ব্যাগ থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে মুখে দিয়ে জল খেলেন। কলতলা ঘুরে এসে দেখেন পুতুল মশারি টাঙিয়ে দিয়েছে। “আচ্ছা বাবু, আপনি তাহলে শুয়ে পড়ুন। রাতের ছোট লাইটটা জ্বালা থাক। বোতলে জল রেখেছি টুলের ওপর। রাতে যদি কিছু দরকার পড়ে, ডাকবেন।
সেই থেকে ছেলের কাছে আর নালিশ জানায় না সুখময়। শুধু স্ত্রী রমার মুখটা মনে পড়ে। ও-তো এমন ছিল না। সবাইকে নিয়ে বেশ মানিয়ে-গুছিয়ে সংসার করেছে। নিজের মতামত জানিয়েছে কিন্তু অন্যায় ভাবে অবাধ্য হয়নি। ছেলে সুজয়ের প্রতি এখন অভিমান হয়। আর সেই অভিমান থেকে বড় হতাশ, একা লাগে নিজেকে।
“কী ব্যাপার, একা এদিকে বসে আছ!” সুখময় দেখে তার ছোটবেলার বন্ধু বিমল। “শরীর ভাল আছে তো!”
“হ্যাঁ, শরীর মোটামুটি। তবে একটু জ্বর জ্বর ভাব।” বন্ধুকে উত্তর দেয়।
বিমল এসে সুখময়ের পাশে বসে। এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কপাল আলু হল কী করে?”
সুখময় প্রমাদ গোনে। একবার হাত বুলিয়ে দেখে। কপালটা বেশ ফুলে আছে। ব্যথাও। আসলে অত ভারি দরজাটা কপালে আঘাত করেছে, তাই রক্ত জমে আছে। কাল যদি একটু বরফ ঘসে দিত, ভাল হত। সে কথা মনে আসেনি। এলেও কিছুতেই বৌমার কাছে গিয়ে বরফ চাইতেন না। গতকাল রাগ করে চা আর খাননি। রাতের খাবারও না। বকুনি খাবার ভয়ে আজ সকালে খেয়েছেন। এখন বন্ধুকে কী বলবে! কেন তার কপাল ফোলা! মরে গেলেও নিজের লজ্জার কথা তিনি বন্ধুকে বলতে পারবেন না যে, বৌমা অসভ্যের মতো মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। আর তাতেই তিনি কপালে আঘাত পেয়েছেন!
জীবনে কত অকথিত কথা থাকে, কত পরাজয়ের গ্লানি, কত অনাদর নিকট জনের কাছ থেকে—যা ঘনিষ্ঠ বন্ধুকেও বলা যায় না। বিমলের সঙ্গে দু’চার কথা বলে সুখময় উঠে পড়ে। “আজ চলি ভাই। শরীরটা ঠিক নেই। তুমি একটু আড্ডা দিয়ে এসো।”
বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে বসেছিল সুখময়। তার ঘরে টিভি নেই। খবর শুনতে বা দেখতে পারে না। তাই ফোনেই কিছুটা দেখা ও শোনার চেষ্টা করে। আজ তাও ভাল লাগছে না। ইউটিউবে গিয়ে একটা গান চালিয়ে দিল।… ‘সখি, বয়ে গেল বেলা, শুধু হাসি খেলা / একি আর ভাল লাগে।’
২.
তখন ভাল করে আলো ফোটেনি। নিজের আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, ব্যাঙ্কের পাশবই, এটিএম কার্ড—সব একটা ব্যাগে ভরে নেন। ভরে নেন কিছু জামা-কাপড় ও শীতের পোশাক। ড্রয়ারে রাখা কিছু খুচরো টাকা পার্সে ভরে প্যান্টের পকেটে নিলেন। সঙ্গে প্রেসার ও জ্বরের ওষুধ। তারপর দেওয়াল থেকে স্ত্রীর ছবিটা নামিয়ে সেটাও ব্যাগে ভরে নিলেন। টেবিল থেকে একটা কাগজ টেনে নিয়ে লিখলেন, আমি স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়লাম। কেউ আমার খোঁজ-খবর নেবে না বা পুলিশে রিপোর্ট করবে না। যদি কোনও দিন মনে হয় ফিরে আসব, না হলে না। নিচে নিজের নাম সই করলেন ও তারিখ লিখলেন। এবার আলতো করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। রাস্তায় এসে একবার পিছন ফিরে বাড়িটা দেখলেন। রাতে শোনা রবীন্দ্র সংগীত মনে পড়ল। ‘তরল কোমল নয়নের জল, নয়নে উঠিবে ভাসি’—। চোখের জল সামলে সুখময় এগিয়ে যান।
শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখা থেকে নামখানা লোকাল ছাড়ছে দেখে একটা টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে বসেন। ট্রেন ছুটে যায় আপন গতিতে। সকালের দিকে বেশি ভিড় নেই। কিছু লোক ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। নিজেকে খুব হালকা লাগছে। কিন্তু কোথায় যাবে! কোথায় থাকবে! তা স্পষ্ট জানা নেই। নিজের অভিমান থেকে তিনি বাড়ি ছেড়েছেন। এবার দেখতে চান জীবন তাঁকে কোথায় নিয়ে যায়!
বেলা দশটা নাগাদ ট্রেন শেষ স্টেশন নামখানা এসে গেল। দু’পাশের ধানি জমিতে শীতের সবজি ফলেছে। মাঠ এখন সবুজ হয়ে আছে। ছোট স্টেশন। প্ল্যাটফর্মে ক’য়েকটা মাত্র চায়ের দোকান। একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চে এসে বসে সুখময়। এদিকটা ভিড় কম। ব্যাগটা পাশে রেখে দোকানের ছেলেটাকে চা দিতে বলে। সুজয়ের বয়সি হবে। মাঝারি উচ্চতা। গায়ের রঙ কালো। মুখে একটা সারল্যের ছাপ। ছেলেটা একবার মুখ তুলে সূখময়কে দেখে বলে, “বসেন বাবু, দিচ্ছি। সঙ্গে বিস্কুট দেব?”
সকালে কিছু না খেয়ে বেরিয়েছে। খিদে পেয়েছে। প্রেসারের ওষুধটা খেতে হবে। জানতে চাইলেন, “কিছু খাবার আছে তোমার দোকানে?”
“হ্যাঁ বাবু। ঘুগনি আর পাঁউরুটি।”
“তাহলে এক প্লেট ঘুগনি আর পাঁউরুটি দাও। রুটিটা সেঁকে দিও।”
“ঠিক আছে, বাবু দিচ্ছি।”
ছেলেটা অভ্যস্ত হাতে ঘুগনি গরম করে রুটি সেঁকে সুখময়ের হাতে দেয়। “বাবু কি বকখালি বেড়াতে যাবেন ?” ছেলেটা মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
সুখময় কী উত্তর দেবেন। তিনি তো বেড়াতে আসেননি। একেবারে বাড়ি ছেড়েছেন। কিন্তু বলা তো যাবে না! “দেখি, যেতেও পারি।”
ছেলেটা একবার সুখময়কে দেখে চায়ের গ্লাসে গরম জল ঢেলে ধুতে লাগল।
“ঘুগনি মুখে দিয়ে ভাল লাগে সুখময়ের। বেশ টেস্টি। মুখ তুলে বলেন, ঘুগনিটা ভাল হয়েছে।”
“আমার বউ বানায়। ওর হাতের রান্না খুব ভাল, বাবু।” ছেলেটার মুখে তৃপ্তির হাসি।
“তোমার নাম?” সুখময় জানতে চায়।
“আজ্ঞে, দিলীপ। ওই যে বাঁ-দিকে যে রাস্তাটা নেমে গেছে গাঁয়ের দিকে, ওটা ধরে মাইল খানেক গেলে আমাদের গাঁ ঝিঙেখালি। টেনে-টুনে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলুম। কিন্তু কোনও চাকরি জোটাতে পারিনি। কলকাতায় গেলে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি হত, কিন্তু বাড়িতে বয়স্ক মা-বাবা ছিল। আমি চলে গেলে তাদের দেখবে কে! তাই যাইনি। বাবা-মা অবশ্য দু’বছরের ফারাকে মারা গেছে। বাবার জমানো কিছু টাকা ছিল, সেটা পার্টির লোকাল সেক্রেটারি ও থানাতে দিয়ে শেষে এই স্টেশনে চায়ের দোকান দিয়েছি।” দিলীপ নিজের কথা বলে।
সুখময় ভাবেন, তার ছেলে সুজয় যদি দিলীপের মতো বিবেচক আর কেয়ারি হত, তাহলে তাঁকে হয়ত বাড়ি ছাড়তে হত না! খাওয়া শেষ হতে জলের জগটা এগিয়ে দেয় দিলীপ। জল খেয়ে ব্যাগ থেকে প্রেসারের ওষুধ বের করে আর একবার জল খায়। দিলীপ কাঁচের গ্লাস ভাল করে ধুয়ে চা বানিয়ে হাতে দেয়। চুমুক দিয়ে সুখময় বলেন, “বাহ্! চমৎকার চা বানিয়েছ। খুব ভাল।”
দিলীপের মুখে হাসি। “হ্যাঁ বাবু, সবাই বলে আমার হাতের চা ভাল। তাই ডেলিপ্যাসেঞ্জারের অনেকে ট্রেন থেকে নেমে আমার হাতের চা খেয়ে তবে বাড়ি যায়। আমি বাবু ওই করে রাখা চা ফুটিয়ে দিতে পারি না। খদ্দের এলে বানিয়েই দিই। ওতে তাদেরও মন ভরে, আমি তৃপ্তি পাই।”
দিলীপ বেশ কথা বলে। সারাদিন দোকানে একা থাকে, তাই হয়ত শোনার মানুষ পেলেই কথা বলে। দিলীপকে বেশ ভাল লেগেছে সুখময়ের। চা ও খাবারের দাম মিটিয়ে উঠে পড়েন। ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যান ডানপাশের রাস্তা দিয়ে। শুনেছেন নামখানাতে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী আছে। ওই নদী পেরিয়ে বকখালি যেতে হয়। এখন অবশ্য নদীর উপর ব্রীজ হয়েছে। নামখানা ব্রীজ। কলকাতা থেকে সড়ক পথে বকখালি বেড়াতে যাচ্ছে মানুষজন। সুখময় একটু এগিয়ে গিয়ে একজনকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা, নদীটা কতদূর হবে?”
“দূর আছে। টোটোতে যান।”
একটা টোটোতে উঠে বসে সুখময় বলেন, “ভাই, আমাকে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদীর ধারে নিয়ে চল। যা ভাড়া লাগে দেব।”
মাঝবয়সি টোটোওলা বলে, “একটু বসুন। আর একজন হলেই ছেড়ে দেব।”
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। আর একজন প্যাসেঞ্জার হল। টোটোওলা গাড়ি ছেড়ে দিল। সরু ইট বিছনো পাকা রাস্তা দিয়ে টোটো এগিয়ে চলে। দু’পাশের মাঠঘাট ঝাঁপিয়ে শীতের উত্তুরে বাতাস গায়ে লাগে। গতকাল শরীরটা ভাল ছিল না। আজ জ্বরটা একটু বেশি মনে হচ্ছে। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। বাড়ি ছাড়ার উত্তেজনায় এতক্ষণ বুঝতে পারেনি। চারপাশ দেখতে দেখতে এক সময় নদীর পাড় এসে গেল।
“এই হল আপনের নদী। ওই দেখুন জেটি।”
টোটোওলার ভাড়া মিটিয়ে সুখময় এগিয়ে যায় জেটিঘাটের দিকে। দেখে ভেসেল দাঁড়িয়ে। গাড়ি পারাপার হয়। দূরে দূরে লাল রঙ করা অনেক ট্রলার দাঁড়িয়ে। ওরা এখন আড়তে মাছ দিয়ে রান্নাবাড়া করে খাচ্ছে। দুপুরের পরে আবার পাড়ি দেবে বড় গাঙের দিকে মাছ ধরতে। ছোট-ছোট ডিঙি নৌকো নিয়ে অনেক জেলে মাছ ধরছে। সরকারি লঞ্চ ও পণ্যবাহী ছোট জাহাজ ভেসে যাচ্ছে। সম্ভবত জোয়ার এসেছে। নদীতে জল বেশ। কিছুক্ষণ বসে বসে এই সব দৃশ্য দেখেন সুখময়। কিন্তু আর বসতে পাচ্ছেন না। গা-হাত কামড়াচ্ছে। জ্বর বেশ জোরে এসেছে। কী করবেন এখন। তাড়াতাড়ি উঠে পড়েন। স্টেশনে ফিরে গিয়ে একটা বেঞ্চে শুয়ে পড়বে ভাবলেন। রাতটা তো কাটাতে হবে। কত মানুষ তো রাতে ফুটপাতে শুয়ে থাকে। একটা প্যারাসিটামল খেলে ভাল হতো। অটো-টোটো স্ট্যান্ডে এসে এক বোতল জল আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট কেনেন। সেই দোকানের বেঞ্চে বসে দু’তিনটে বিস্কুট খেয়ে, সঙ্গে আনা প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খেলেন। তারপর একটা অটো ধরে স্টেশনে ফিরে এসে দিলীপের চা-দোকানে আর না গিয়ে কিছুটা এগিয়ে শেডের তলায় ফাঁকা সিমেন্টের বেঞ্চে ব্যাগ মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়েন। ওষুধ খাওয়ার জেরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন বুঝতে পারেননি। কার ঠেলায় যেন ঘুম ভাঙে। অল্প আলোয় দেখেন সকালের চায়ের দোকানের দিলীপ। উঠে বসেন। গলায় বুকে কপালে বেশ ঘাম। মনে হয় ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছেড়েছে।
“আপনি এখানে শুয়ে আছেন কেন, বাবু? বকখালি যাননি!” দিলীপ বেশ উদ্বিগ্ন।
কী বলবেন এবার সুখময়! তিনি তো বকখালিতে বেড়াতে আসেননি। বাড়ি ছেড়ে এসেছেন।
অনেকটা কৈফিয়ৎ দেবার ভঙ্গিতে নিষ্প্রভ গলায় সুখময় উত্তর দেন, “না, বকখালি যেতে আজ ভাল লাগল না। শরীর ভাল নেই, জ্বর এসেছে। তাই প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে ছিলুম। রাতটা স্টেশনে কাটিয়ে কাল সকালে বকখালি যাব।”
দিলীপ অবাক হয়। বাবুর মাথায় কী গণ্ডগোল আছে! দেখে তো শিক্ষিত লোক মনে হয়। তাহলে স্টেশনে রাত কাটাবেন কেন! তার মনে ধন্দ।
“আপনি কি পাগল হলেন! এই স্টেশনে রাত কাটাবেন! জানেন, আপনার সব জিনিসপত্র, কাছের টাকাপয়সা লুঠ হয়ে যাবে! এমনকি মেরেও দিতে পারে।” দিলীপ আকুল হয়।
সত্যি তো। সুখময় এমনভাবে তো ভাবেননি! বিপদ আছে। তবু স্বাভাবিক হতে বলেন, “তুমি ভেব না দিলীপ, বাড়ি যাও। আমার কিচ্ছু হবে না। কত মানুষ তো স্টেশনে শুয়ে থাকে। না হয় জেগেই রাত কাটিয়ে দেব।”
“না বাবু, দোহাই আপনার। বিপদ আছে। তার উপর বলছেন শরীর ভাল নেই। আপনাকে একা ফেলে বাড়ি যেতে পারবুনি। আমার ঘুম হবেনি রাতে। ভাগ্যিস বাড়ি ফেরার পথে দেখতি পেলুম।”
সুখময় এবার কী করবেন! অচেনা অজানা একটা ছেলে তাঁর জন্য এত ভাবছে! এত আন্তরিকতা! চোখ ফেটে জল আসে।
“ওঠেন, চলুন আমার সঙ্গে। দোকান বন্ধ করে দিয়েছি। এবার বাড়ি যাব। বাইরে নকুলের ভ্যান আছে। ওই আমাকে প্রতিদিন পৌঁছে দেয়। ওর বাড়ি আমাদের গাঁয়ে।”
দিলীপ একহাতে ব্যাগ নেয়, অন্য হাতে সুখময়কে টেনে তোলে। জোরে নকুলকে ডাকে। নকুল আসতে বলে, “বাবুকে নিয়ে গাড়িতে বসা। আর এই নে ব্যাগ।” ব্যাগ নকুলের হাতে দিয়ে দিলীপ তার দোকানের জিনিসপত্র মাথায় তোলে।
৩
“পুতুল ! পুতুল!” ডাকতে ডাকতে দিলীপ বাড়ির মধ্যে ঢোকে। পিছনে সুখময়। স্বামীর গলা শুনে বউ পুতুল উঠোনে বেরিয়ে আসে।
“আজ এত দেরি হল!” দিলীপ উত্তর দেবার আগে অচেনা সুখময়কে দেখে মাথায় ঘোমটা তুলে দেয়। তারপর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে চেয়ে থাকে।
দিলীপ বলে, “বাবু কোলকাতা থেকে এয়েচেন। বকখালি বেড়াতে যাবেন। শরীর খারাপ হওয়ায় স্টেশনে একা শুয়েছিলেন। আমি দেখে নিয়ে এলুম। বয়স্ক মানুষ, তা-ও আবার অসুস্থ। স্টেশনে ঠান্ডায় পড়ে থাকলে শরীর আরও খারাপ হবে।”
“ঠিক করেছ। আসেন বাবু। আসেন।” পুতুল এগিয়ে এসে সুখময়ের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলে, “ওই সামনে কলতলা। বালতিতে জল আর মগ আছে। আপনি হাত-পা ধুয়ে নিন। আমি গামছা এনে দিচ্ছি।”
পুতুল দৌড়ে গিয়ে দাওয়া থেকে গামছা এনে দেয়। দিলীপ বলে, “তুমি গিয়ে আমাদের ছোট ঘরের বিছানা ঠিক করে দাও। গায়ের একটা কম্বল দেবে। আমি দোকানের বাসনপত্রগুলো রেখে আসি।
সুখময় তাকিয়ে দেখেন। বড় না হলেও মাঝারি বাড়ি। ইটের গাঁথুনি আর টালির চাল। তিনটে ঘর। বড় উঠোন, পাশে বাগান, তার লাগোয়া একটা পুকুর। পুকুরের দিক বাদ দিয়ে বাড়ি, বুক সমান পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সুখময় হাত-পা ধুয়ে উঠোন থেকে দাওয়ায় উঠে আসেন। দিলীপ বলে, “এদিকে আসুন বাবু। এই ঘরে আপনি থাকবেন।”
সুখময় ঘরে ঢোকে। এরমধ্যে পুতুল বিছানা ঝেড়ে কাচা বেডকভার পেতে দিয়েছে। পরিচ্ছন্ন বিছানা। কতদিন পর এমন সুন্দর করে কেউ বিছানা পেতে দিল। বিছানায় না বসে ঘরে একটা কাঠের চেয়ার ছিল, সেটাতে বসলেন সুখময়। পুতুল হাতে চায়ের কাপ আর একটা বাটিতে মুড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে, “আদা দিয়ে চা করে এনেচি বাবু, সঙ্গে সরষের তেল দিয়ে মুড়ি মেখেছি, খান, ভাল লাগবে। আপনার তো জ্বর।” পাশের ছোট্ট কাঠের টুলে চায়ের কাপ ও মুড়ির বাটি রাখে।
চায়ে চুমুক দিয়ে খুব ভাল লাগে সুখময়ের। তিনি তৃপ্তিতে চোখ বুঁজিয়ে বলেন, “আঃ!” জ্বর শরীরে এই আদা-চা যেন অমৃত। তিনি কৃতজ্ঞ হলেন পুতুল ও দিলীপের প্রতি। এত যত্ন আর মমতায় স্ত্রী মারা যাবার পর কেউ তাঁকে চা খেতে দেয়নি। নিজের রক্তের সম্পর্ক কেমন দূর হয়ে গেল। অপরিচিত অনাত্মীয় এই গ্রাম্য দিলীপ ও তার বউ।
পুতুল কেমন অনায়াসে তাঁকে আপন করে নিল। বার বার চোখে জল ভরে আসে।
রাতে গরম রুটি আর আলুর তরকারি করে দিল পুতুল। খিদেও পেয়েছিল। খুব তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। খাওয়ার পর ব্যাগ থেকে একটা প্যারাসিটামল বের করে মুখে দিয়ে জল খেলেন। কলতলা ঘুরে এসে দেখেন পুতুল মশারি টাঙিয়ে দিয়েছে। “আচ্ছা বাবু, আপনি তাহলে শুয়ে পড়ুন। রাতের ছোট লাইটটা জ্বালা থাক। বোতলে জল রেখেছি টুলের ওপর। রাতে যদি কিছু দরকার পড়ে, ডাকবেন। আমরা পাশের ঘরে আছি।”
সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে। সুখময় বিছানায় উঠে বসেন। জানালা দিয়ে দেখেন বাগানে কত রকম পাখি। তারা নিজেদের মতো ডাকাডাকি করছে আর নবীন সূর্যের নরম রোদ পিঠে নিয়ে উড়ছে বসছে গাছের ডালে ডালে। আজ শরীরটা বেশ ভাল লাগছে। জ্বর নেই মনে হচ্ছে। গায়ে ক্লান্তিও কম। বিছানা ছেড়ে আস্তে আস্তে বাইরের উঠোনে এসে দেখেন, পুতুল ঝাঁটা হাতে উঠোন ঝাঁট দিচ্ছে। কাল রাতে অল্প আলোয় পুতুলকে ভাল করে দেখেননি। এখন প্রভাতের উজ্জ্বল আলোয় পুতুলকে দেবী প্রতিমার মতো মনে হল। কী সুন্দর মায়ামাখা ঢল ঢল মুখ। ডাগর চোখ। কাল আসা থেকে কী যত্ন না করছে মেয়েটা। কত আন্তরিক ভাবে তাঁকে গ্রহণ করেছে। যদি নিজের এমন একটা মেয়ে থাকত, হয়ত বাড়ি ছাড়তে হতো না।
সুখময়কে দেখে পুতুল ঝাঁটা ফেলে এগিয়ে আসে। কলতলায় গিয়ে হাত ধুয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। “আপনি গুরুজন। কাল রাতে প্রণাম করতে ভুলে গেছি। আশীর্বাদ করুন, যেন সুখে থাকি ”
“নিশ্চয়ই। তুমি খুব ভাল মেয়ে। আশীর্বাদ করি তুমি সুখী হও। তোমার সংসার ভরে উঠুক।”
এমন সময় দিলীপ পুকুরের দিক থেকে ফিরল। পুকুরের দু’পাড়ে কপি, মুলো, বেগুন টমেটো, সবজি লাগিয়েছে, তাতে জল দিয়ে ফিরল। সুখময়কে দেখে বলে, “উঠে পড়েছেন। শরীর আজ কেমন? রাতে ঘুম হয়েছিল?”
সুখময় উত্তর দেন, “হ্যাঁ, ভাল ঘুম হয়েছে। জ্বরের ওষুধ খেয়েছিলুম, আজ আর জ্বর নেই।”
“আমি তো বাবু এক্ষুনি দোকানে চলে যাব। আপনি চা টিফিন খেয়ে বিশ্রাম নিন। শরীর ভাল থাকলে কাল বকখালি যাবেন।”
সুখময় কিছু বলল না। দিলীপ আবার বলল, “পুকুর পাড়ে ঢাকা পায়খানা আছে। আপনি ফাঁকা থেকে ঘুরে আসুন। আমি দোকানে যাই।”
নকুল তার ভ্যান নিয়ে সদর দরজায় এসে হর্ন দেয়। দিলীপ দোকানের সব জিনিসপত্র নিয়ে ভ্যানে তোলে। তারপর বউ পুতুলকে ডেকে বলে, “দেখিস বাবুর যেন কোনও অসুবিধা না হয়। সময় মতো খেতে দিস। আর ঘুঘনির হাঁড়ি ভ্যানে তুলে দে।
পুতুল ঘাড় নেড়ে চলে যায় ঘুগনির হাঁড়ি আনতে। সুখময় বাইরের কাজ সেরে পুকুরের ঘাটে নেমে হাত-পা-মুখ ধোয়। বেশ ভাল লাগছে তার এই গ্রাম্য পরিবেশ। সরল দুই মানব-মানবীকে। সুখময় বাড়ির ভিতরে এলে পুতুল এগিয়ে আসে। “এখন একটু উঠোনের রোদে বসুন, বাবু। আমি চা করে আনি। চা খেয়ে ঘরে যাবেন।” বলে একটা মোড়া এনে দেয় বসতে। সুখময় বসে। মন্দ বলেনি মেয়েটি। সকালের মিঠে রোদ পিঠে পড়ে বেশ আরাম লাগছে। আর কী সুন্দর হাসি মুখে পুতুল বলল। ওর মায়াভরা প্রতিমা-মুখ কেমন আপন মনে হয়। অজান্তে তুলনা চলে আসে নিজের বৌমার সঙ্গে। অরুণিমার মুখে সব সময় বিরক্তি। মেজাজ তিরিক্ষে। কোনও শ্রদ্ধা যত্নের স্পর্শটুকু নেই তার ব্যবহারে। যদি একটু মমত্ব থাকত তাহলে হয়ত তাঁকে ঘর ছাড়তে হতো না। পুতুল চা আনতে, হাত বাড়িয়ে কাপ নিয়ে গরম চায়ে চমুক দিলেন। আদা দিয়ে লিকার চা করেছে মেয়েটি। চমৎকার হয়েছে। চোখ বুঁজে ‘আঃ’ করে শব্দ করেন সুখময়। পুতুল বলে, “চা ভাল হয়েছে বাবু?”
“খুব ভাল।” কিন্তু তুমি আমাকে আর বাবু বলবে না। তুমি তো আমার মেয়ের মতো।” সুখময় আনুযোগ করে।
“ঠিক আছে, আপনি তো আমাকে মেয়ে বললেন, তাহলে আমি আপনাকে নতুন বাবা বলব।”
“বেশ তো, আজ থেকে তুই আমার মেয়ে। আমি তোর নতুন বাবা।”
রাতে দিলীপ দোকান থেকে ফিরলে, খাওয়ার পর সুখময় তাদের নিজের ঘরে ডাকেন। “তোমাদের কিছু কথা বলার আছে আমার। বিছানায় এসে বসো।” সুখময় পুতুল ও দিলীপের মুখের দিকে তাকায়। তারা বিস্মিত মুখে বিছানার পাশে এসে বসে। সুখময় একে একে নিজের ঘর ছাড়ার গল্প বলে যায়। কোন্ অভিমানে তিনি ঘর ছেড়েছেন। বলেন, তিনি বকখালি বেড়াতে আসেননি। এদিকে এই গ্রামের নির্জনতায় তিনি একা থাকবেন। সম্পূর্ণ একা হয়ে। বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবেন না। যারা তাঁর সুখ-দুঃখ বোঝে না, তাঁর মতো বিপত্নীক অসহায় বৃদ্ধকে ক্রমাগত অসম্মান ও অনাদর করে, তাদের কাছে আর ফিরবেন না। “আমি আগামীকাল সকালে এখান থেকে চলে যাব। তোমরা বাধা দেবে না।”
পুতুল দিলীপ দু’জনেই স্তম্ভিত! জলভরা চোখে হতভম্বের মতো চেয়ে থাকে। তারপর এক সময় পুতুল জানতে চায়, “তা’লে কোতায় যাবেন?”
সুখময়ের উদাস উত্তর, “যে দিকে দু’চোখ যায়—”
দিলীপ বলে, “বাবু, এই বয়সে অকূলে ভাসবেন?”
“কী করি বল। অসম্মান আর অমর্যাদার মধ্যে কি বাঁচা যায়!” সুখময় বেশ বিষণ্ণ।
পুতুল উঠে এসে সুখময়ের হাত ধরে। বলে, “তুমি তো আমাকে মেয়ে বলেছ। মেয়ের বাড়িতে থাকো। আমি তোমার কোনও অমর্যাদা করব না। তোমার ছেলে যতদিন নিতে না আসছে তুমি আমার নতুন বাবা হয়ে আমার ঘরে থাকো। আমার নিজের বাবা কে জানি না।”
“কেন?” সুখময় জানতে চান।
এবার দিলীপ বলে, “সে এক গল্প বাবু। পুতুল জ্ঞান হওয়া থেকে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছে। কে তার বাবা-মা ও জানে না। বড় হতে একটা এনজিও থেকে ওদের গণবিবাহের ব্যবস্থা করে। আমার দোকানে চা খায়, এক পরিচিত দাদা, একদিন এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে আসেন। তিনি আমাকে আনুরোধ করেন, তাঁদের গণবিবাহের অনুষ্ঠানে আমি যেন অংশগ্রহণ করি। আর একটি অনাথ মেয়েকে বিয়ে করে, ওদের সমাজের মূলস্রোতে ফেরাতে সাহায্য করি। তারপর তিনি অনেকগুলো ছবি দেখান। পুতুলকে আমার পছন্দ হয়। ওর সরল দৃষ্টি আর মমতাভরা মুখ আমার ভাল লাগে। দিদিমণির কথাও। তাই রাজি হয়ে যাই। বিয়ের সব খরচ ওই এনজিও করে। পুতুলের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে যায়। এখন ওকে বিয়ে করে আমি খুব সুখী।”
সুখময় পুতুলকে নিজের বুকে টেনে নেন। “তুই আজ থেকে শুধু দিলীপের বউ না, আমার নিজের মেয়ে।”
“তাহলে আমাকে একটা কথা দাও, আমার বাবা হয়ে আমার বাড়িতে থাকবে। আমার কুড়িয়ে পাওয়া বাবা!”
সুখময় জানলা দিয়ে দেখলেন, অন্ধকার আকাশে নক্ষত্রেরা যেন অন্যদিনের থেকে বেশি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে!🍁
🍂ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।
কিশাণগঞ্জের ফেলুদা
তাপস রায়
পর্ব : চার
সামনে পঞ্চায়েতের টিকিট বন্টন একটা ইস্যু হতে যাচ্ছে। বিলো ম্যাট্রিক ফেলুকে টিকিট দেয়াতে বেশ বেগ উসমানি সাহেবের। ধরমশালা থেকে দাঁড়াতে চাইছে চাঁদ ভাই। সে শুধু বলছে, তুমি মুসলমান হয়ে মুসলমানকে দেখছ না। ওই হিন্দুটার পেছনে পড়ে আছ। উসমানি সাহেব যুক্তি দিয়েছেন,“ওর খ্যাতির নখের যুগ্যি তুমি! ওর মানুষের উপকার করা কাজের একটাও আগে করে দেখাও।”
এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ওই চুলকেই তিনি মাথার ভেতর বাইরের জল-বাতাস খেলতে দেন। খানিকটা চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “না, তেমন বেশি টাকা কাউকে দেয়া হয়নি। চা-বাগানের কুলিরা, বাজারের সবজি ব্যাবসায়ীরা, মাছের আরতের দু-একজন দুহাজার, পাঁচ হাজার যেমন নেয়,তেমন নিয়েছে।”
কবরখানার মাঠে বসে সন্ধ্যা কাবার করে দিয়েও কোনও হিল্লে হয়নি। বোঁদে বস্তির সব কুকুরের ছবি তুলে এনে মোবাইলের জিবি প্রায় শেষ করে এনেছে। কিন্তু ফেলুদা মাঠের পাশে লাগানো বড় ভ্যাপার ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসেও গঙ্গারামের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে একটাকেও খুঁজে পায়নি। এখানে সব কুকুরই নেড়ি আর তস্য নেড়ি। ফেলুদা অবশ্য জানে গঙ্গারামের মতো কুকুর দার্জিলিং-এ পাহাড়ের রাস্তায় মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। ভাবেনি যে তা নয়, ভেবে রেখেছে বোঁদেকে নিয়ে বুধবার তিস্তার বালিখাদানের কাজ দেখে চলে যাবে দার্জিলিং। সেখানে একদিন ভুটিয়া বস্তিতে কাটিয়ে আসবে।
মাতা গুজরী মেমোরিয়াল মেডিক্যাল কলেজের সামনে বাঁধানো চাতালে বসে কথা-বার্তা, আড্ডা চলছিল। বোঁদেকে আসতে দেখে চায়ের গ্লাস নামিয়ে উঠে এল ফেলুদা। বোঁদের তো এখানে আসার কথা নয়। দুপুর বেলায় বাড়িতে যাবে। মালবাবুর খাতা-পত্তর বাড়িতে বসেই দেখবে। এখানে খাতা-পত্তর দেখলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে না! তাছাড়া বোঁদে অধিকাংশ দিন ফেলুদার সঙ্গেই লাঞ্চটা করে। দোকান থেকে খাবার কিনে নিয়ে যায় বোঁদেই। পরে অবশ্য ফেলুদা টাকা-পয়সা দিয়ে দেয়। কিন্তু আজ এখানে!
মালবাবুর কুকুরের সঙ্গে হিসেবের খাতাও যে গায়েব হবে, তা আন্দাজ করেনি ফেলুদা। ফেলুদা ভেবেছিল হিসেবের খাতা থেকে মালবাবুর চেনা-অচেনা লোকজনের নাম জানবে কিছু। তারপর যেসব নামে সন্দেহ লাগবে, তার একটা শর্ট লিস্ট বানিয়ে ছেঁকে তুলবে একটা দু’টো। ঠিক পেয়ে যাবে। যেমন দীঘল ব্যাঙ্কের কেসটায় হয়েছিল।
দীঘল ব্যাঙ্ক হল নেপাল আর বিহারের বর্ডার। দীঘল ব্যাঙ্কের পিসিও বুথগুলো সব চলে নেপালের টাকায়। লক্ষ লক্ষ টাকা সেখানে বাকি আছে পিসিও বুথগুলির। আদায় হবে বলে লাইনও কাটেনি। বুথ চলেছে, কিন্তু আউটস্টান্ডিং কমেনি। উকিলের ফি নিয়ে সিং সাহেব আদালতের নোটিশ পাঠাচ্ছে, কিন্তু সে সব ফিরে আসছে। টিডিএম অখিলেশ সাহেব একদিন কথায় কথায় বলছিলেনও। কেন ধরা ছোঁয়া যাচ্ছে না। লোকে পিসিও ব্যবহার করছে, অথচ মালিককে পাওয়া যাচ্ছে না!
ফেলুদা টিডিএম সাহেবকে বলেছিলেন, আপনার দীঘল ব্যাঙ্ক এক্সচেঞ্জে আমি যেতে চাই। আপনি একবার লোকাল এস ডি ই সাহেবকে বলে রাখবেন।
ফেলুদা সারা মাসের কললিস্ট ঘেঁটে দু’টি দুবাইয়ের নাম্বার আইডেন্টিফাই করে। আর ওই নাম্বার দু’টি ট্যাপ করতে বলে দেয়। তারপর দেখা যায় নেপালের একজন লোকই ওই কল করে। তারপর নেপালে চলে যায়। জানা যায় এই পিসিও-র মালিক নেপালেরই বাসিন্দা। ওই লোকটি তার আত্মীয়। নাম ভাঁড়িয়ে এখানে পিসিও খুলেছে। নেপালে কলরেট অনেক বেশি আর টেকনোলজিও খারাপ। ভাল কথা হয় না। ফলে অধিকাংশ সীমান্তের লোকজন ভারতের পিসিও ব্যবহার করে।
আইডেন্টিফাই তো হল। কিন্তু পিসিও-র মালিককে ধরবে কী করে? ফেলুদা আবার বুদ্ধি লাগায়। শঠে শাঠ্যাং করতে হবে। লোকাল পুলিশকে দিয়ে ওই দুবাইয়ে কল করা লোকটিকে সীমান্ত পার হবার জন্য গ্রেপ্তার করতে হবে। তারপর কান টানলে মাথা। টেলিফোনের টিডিএম সাহেব রেজাল্ট হাতে হাতে পায়। পুরো চার লাখ টাকার আউটস্টান্ডিং জমা পড়ে। আর পাটনায় হেড অফিসে টিডিএম-এর নাম ফাটে।
ফেলুদা চায়ের নতুন গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দেখল কুকুর কেস ক্রমে জটিল হয়ে যাচ্ছে। তাহলে হিসেবের খাতা হারান মানে কুকুরের সঙ্গে পয়সা-কড়ির ব্যাপার জড়িয়ে গেল। মানে কুকুর যে হাপিস করেছে, সে খাতা হাপিসও করতে পারে। কিন্তু খাটের তলা থেকে ট্যাঙ্ক খুলে খাতা হাপিস করা যে সে লোকের কম্ম নয়! চেনা লোক হতে হবে।
মালবাবুর বাড়ির খাবার সেদিন ভাল লেগেছিল বোঁদের। রোজ রোজ দুপুরে রেস্তোঁরার খাবার ভাল লাগে না। চানুমতি নেপালী। সে নেপালের রান্না খাওয়ায়। টেসট আলাদা। টমাটোর চাটনিতে এমন শুকনো লঙ্কা ভাজা দেয় না! গন্ধে প্রাণ আকুল করে। মিষ্টিও যেমন ঝালও তেমন। চাটতে চাটতে জিভ ছুলে যায়। মালবাবুর বাড়ি থেকে আসার সময়, সে-ই উপযাজক হয়ে বলে এসেছে, ফেলুদাকে নিয়ে আসছে। কেস তো ক্রমে বেড়ে যাচ্ছে। একটার জায়গায় দু’টো হল। মাথা খাটাতে হবে। দুপুরের খাবার আয়োজনটা যেন করেই রাখে।
আজ পাঁঠার মাংস হয়েছে। মালবাবু অফিস থেকে চলে এসেছেন। রোজই দুপুরে তিনি লাঞ্চ করতে আসেন কোয়ার্টারে। ট্রেন চালানো আর টিকিট বিক্রির সঙ্গে যারা যুক্ত নয়, প্রত্যেকেই দুপুরে খেতে আসে। এখানে দুপুর একটা থেকে তিনটে অঘোষিত নিত্যকার ছুটি।
পাঁঠার মাংসের জব্বর স্বাদ হয়েছে। রেঁধেছে মালবাবুর বউ চানুমতি। এ তল্লাটে এখনও ঘরের খাবার ঘরে রেঁধেই খাওয়ানোর রেওয়াজ। লোকজনকে নেমন্তন্ন করে দোকান থেকে কিনে আনা খাবার কেউই খাওয়ায় না। ফেলুদা বোঁদেকে পাঠিয়েছেন চানুমতির খবরা-খবর নিতে। এখনই সহজ সুযোগ। রান্নার প্রশংসা করতে গিয়ে দু-চার কথা বলতে বলতে যদি অন্য কিছু চোখে পড়ে বা কানে আসে। ফেলুদা বলেছেন গোপনে যেন চানুমতির একখান ছবিও সে তুলে নিয়ে আসে।
নিমগাছের নিচে বিকেলের রোদ মন্দ লাগছে না। ভরপেট খাওয়ার পর শরীরে একটু আলস্য এসে লাগছে। দড়ির খাটিয়া মালবাবুর ভার বয়ে খানিকটা মাঝখানের দিকে ঝুঁকে গেছে। ফেলুদার পাতলা শরীর সেদিকেই পিছলে পিছলে যাচ্ছে। সুস্থির বসতে পারছেন না ফেলুদা। মালবাবু যেন চুম্বকের মতো করে নিজের কাছে ফেলুদাকে টেনে নিচ্ছেন।
তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়াল ফেলুদা। দু’দুটো জিনিস গায়েব হওয়ার উৎসে কী সেই অমোঘ টান! এত বছর ধরে সমস্যা মেটাতে গিয়ে মোটের উপর ফেলুদা দেখেছে, সব সমস্যার উৎসেই থাকে হয় টাকা, নয় নারী। নাইন থেকে টেনে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু এখনও তার মনে আছে স্কুলের সব ক্লাস আর ক্লাস রুমের কথা। মন খুব কাঁদে স্কুলের জন্য। খুব ইচ্ছে করে ক্লাস টেন পাশ করে গ্রাজুয়েট হতে। এক্ষুনি মনে পড়ল, ইতিহাসের ক্লাসে রামবাবু রসিয়ে রসিয়ে ক্লাস নাইনে হেলেন নামে এক অসাধারণ সুন্দরী নারীর বর্ণনা দিয়ে তারপর বোঝাতেন কীভাবে দু’টো দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছিল ওই নারী। গ্রীসের কথা বলতে বলতে তিনি চলে আসতেন ভারতের মহাভারতে। সেখানে দ্রৌপদীর অপমানের উপর কুরুক্ষত্রের যুদ্ধ কীভাবে জমে উঠছে, তার ঝমঝমে বর্ণনা করতেন।
ফলে সমস্যায় নারী যুক্ত কিনা জানতে বোঁদেকে চানুমতীর কাছে পাঠাতে হল। বাকি যেটা পড়ে আছে তা হল, টাকা। কঠিন মেঝেতে ঠন্ করে টাকা ফেলে শব্দ তোলার ভঙ্গিতে আচমকা ফেলুদা শুধোলেন, “আচ্ছা মালবাবু, কাছাকাছি সময়ে আপনি কাকে সবচে বেশি টাকা ধার দিয়েছেন, মনে পড়ছে?”
মাথা চুলকোলেন মালবাবু। এটা তার দীর্ঘদিনের অভ্যাস। ওই চুলকেই তিনি মাথার ভেতর বাইরের জল-বাতাস খেলতে দেন। খানিকটা চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “না, তেমন বেশি টাকা কাউকে দেয়া হয়নি। চা-বাগানের কুলিরা, বাজারের সবজি ব্যবসায়ীরা, মাছের আরতের দু-একজন দুহাজার, পাঁচ হাজার যেমন নেয়,তেমন নিয়েছে।”
“মানে আপনি বলছেন, নভেম্বর মাসে আপনার কোনো বড় অংকের টাকা খরচ হয়নি!” স্বরে খানিকটা গাম্ভীর্য আর সত্য উদ্ঘাটনের জন্য চাপ বহমান থাকে।
“না হয়নি।”
তারপর আবার একটু মাথা চুলকে মালবাবু তড়িঘড়ি জানালেন, “হ্যাঁ হয়েছে, আমার ছেলের স্কুল ফি ১৮৮৫০ টাকা নিফটি করেছি আকাউন্ট থেকে।”
“ও! আপনার ছেলে তো বাইরে থাকে! কোথায় থাকে যেন?”
“গ্রাহামস হোমস বোর্ডিং-এ থাকে।”
“সেটা কোথায়, দার্জিলিং-এ? আমি তো মাঝে মধ্যে যাই তো সেখানে। একবার আপনার ছেলেকে দেখে আসতে তো পারি।” ফেলুদা নিজের গলার স্বরে খানিকটা লজ্জিত। এটা সেই অপরাধ স্খালনের স্বর। অনেকখানি আত্মীয়তায় মোড়া।
“না না গ্রাহামস হোম তো কালিম্পং-এ।” এখন আর মালবাবু মাথা চুলকোচ্ছেন না। এটা তার স্বাভাবিক চলন। মানে কুণ্ঠা নেই। বরং ছেলের কথা ওঠায় স্বরে তার খানিকটা ভাললাগা চালু হয়ে গেছে। এখানেই তার প্রাণের আরাম যেন। তিনি খুশি মনে বললেন, “চলুন না, একবার ঘুরে আসি। আমি তো ভাবছিলাম একবার যাব। অনেকদিন যাওয়া হয় না। সোমবার ওদের অফ থাকে। চলুন না সোমবার যাই। আপনি সাথে থাকলে মনটা ভাল থাকবে। বিদেশ-বিভুঁই, বল ভরসাও পাব”
ফেলুদা কিছু না বলে একবার বোঁদের দিকে তাকাল। বোঁদে ভেতর থেকে নিজের কাজ সেরে চলে এসেছে। আর সমজদারকে লিয়ে ইশারাই যে কাফি, তা শিরোধার্য করে মালবাবু বললেন, “হ্যাঁ, বোঁদেবাবুও আমাদের সঙ্গে চলুন না। কোনও সমস্যা নেই।” 🍁(চলবে)
🍂গল্প | দুই
এত কাল ও কত জায়গায় আমাকে নিয়ে গেছে এখন বয়স হয়ে গেছে বলে ওকে বিক্রি করে দেব জলের দরে আর ওরই সামনে ওকে ভাঙবে একটা একটা করে ওর অঙ্গগুলোকে তুলবে সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না ।কারণ যা গাড়ির অবস্থা হয়েছে সেটা বেশি দামে বিক্রিও হবে না।
যাচ্ছেতাই
মমতা রায়চৌধুরী
‘কি গো হল।’
সাড়া না পেয়ে আবার রক্তিম ডাকলো ‘কি গো, এসো এর পরে কিন্তু দেরি হয়ে যাবে পরে আবার তুমি আমাকে বোলো না।
তিথি ভেতর থেকে সাড়া দিল আসছি।
ঋদ্ধি, সিদ্ধি তোমরা সরো আমাকে যেতে দাও।
ওরা শুনবে কেন সুন্দরভাবে সেজেগুজে বেরোলেই বুঝতে পারে কোথাও না কোথাও যাচ্ছে। ওদেরকে ফেলে চলে যাবে সেটা হবে না ওরাও নাছোড়বান্দা।
একজন তো শাড়ির আঁচল ধরেছে আবার অন্যজন তো পা জড়িয়ে ধরেছে। কি করিস এখন ঋদ্ধি? যতবারই কোথাও না কোথাও বেরোতে যায় এরা এমন বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। উফ এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোরা এখান থেকে যা বলে দিলাম খুব জ্বালাচ্ছিস।
এবার তো গাড়ির হর্ন বাজাতে শুরু করেছে ।নিজের আর কি? ঘরে তালাও লাগাতে হয় না। কোন কিছু নেবার ও থাকে না সব একা আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারপরে যত কুকুরতাড়া দেওয়া।
গাড়িতে চেপে একটা নিশ্চিন্ত মনোভাব নিয়ে বেশ রোমান্টিক মুডে রয়েছে দুজনে। আশেপাশে যারা চেনাজানা তারা প্রত্যেকে তাকিয়ে দেখছেন । তিথি র বেশ মজাই লাগছে। প্রত্যেকবার পাশের বাড়ির বুম্বাদার বউ বলে ‘কি গাড়িতে চাপো তোমরা। প্রায় ই তোমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে যায় আমি হলে বাবা ও গাড়িতে কখনো চাপতাম না ।
এজন্যই কোথাও বেরোতে ইচ্ছে করে না ।যাচ্ছেতাই অবস্থা আমার। এবার জোর করে ওদেরকে ছাড়িয়ে নিল।
‘কিগো এখনো হয়নি তোমার তৈরি হতে কত সময় লাগে
বাবা যেন বিয়ে বাড়ি যাচ্ছো, যাচ্ছ তো বাবা বাইকে করে একটু ঘুরতে’।
এবার মেজাজ হারিয়ে ফেলল তিথি ‘হ্যাঁ আমি তো তৈরি
হচ্ছিলাম এতক্ষণ ধরে। আর ঘরের তালা দেওয়া ঘরের মধ্যে যারা আছে তাদেরকে সরানো সেসব তো আর তোমাকে কিছু করতে হয় না। সব সময় খোঁচা দেয়া কথাবার্তা ভালো লাগে না।’
‘আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে চলো। সরি বাবা,আর ঝগড়া ক’রো না।
রক্তিম দেখল হোম মিনিস্টার কে এখন চটানো যাবে না নইলে যা মুডি এক্ষুনি হয়তো বলবে আমি যাব না রইলো ঝোলা চলল ভোলা।’
”হ্যাঁ ,শুধু তো আমিই ঝগড়া করি।”
“পৃথিবীতে আছে এমন কেউ বিনা কারণে ঝগড়া করে তাহলে জানিও আমাকে।”
”তবে যাই বল ঝগড়ার মুডে তোমাকে কিন্তু হেবি লাগে দেখতে।”
এবার তিথি হেসে ফেলল।
“আচ্ছা চলো মেলা বকিও না।”
বাইকে উঠতে গিয়ে হঠাৎ তিথি বলে উঠল, “এই তোমার বাইক মাঝ রাস্তায় গিয়ে বিগড়োবে না তো।
সেবার যা অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছিল।”
”না গো, আমি গতকাল আমাদের এলাকার সেরা মিস্ত্রি দলাই মলাইকে দেখিয়েছি।”
‘হ্যাঁ তিথি দলাই মলাই এর নাম বেশ শুনেছে।
এবার অন্তত ঠিকঠাক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে, হাস্যকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে না।”
তিথি নিশ্চিন্তে বাইকের পেছনে উঠল এবার রক্তিম বাইক স্টার্ট দিল যেন মনে হল রাজাধিরাজ যাচ্ছে।
কি জানি এই গাড়িটার প্রতি এত কিসের মোহ রক্তিমের তিথি বুঝতেই পারেনা, কতবার নিজেকে প্রশ্ন করেছে কেন কিসের এত মোহ গাড়িটার প্রতি। তাছাড়া হাস্যকর পরিস্থিতির জন্য কতবার গাড়ি চেঞ্জ করার কথা বলেছে তিথি কিন্তু রক্তিম তিথির এসব কথা কানেই তোলে না। এক কান দিয়ে শোনে অন্য কান দিয়ে বের করে।
তবে যাই হোক রক্তিম যখন বলেছে মানে আশ্বাস দিয়েছে এবার সেরকম কিছু হবে না তাহলে আজকের পড়ন্ত বিকেলটা অন্তত উত্তম-সুচিত্রার মত বাইকে অনেকটা সময় নিজেদের মতো করে কাটাতে পারবে। এমনিতে তো বেরোতে পারে না কোথাও। বাড়িতে ঋদ্ধি, সিদ্ধি,অরণ্য, পাখি, চন্দ্র, শিব, দুর্গা, কালী গুডলু গুডলি, পাইলট, তুতু, ভুতু, গজ। এদের ছেড়ে কোথায় যাবে। কোথাও যাবার নাম করলেই ওদের অসহায় চাওনি বুকের ভেতর বড্ড ব্যথা দেয়। তাই এই আধ ঘন্টা এক ঘন্টার কাছে পিঠে কোথাও বেরিয়ে পড়ে। যা গরম পড়েছে, কোথাও বেরোনোই যাচ্ছিল না। তবে মাঝে কদিন বৃষ্টি হয়েছে একটু প্রকৃতি ঠান্ডা আর এর মাঝে হালকা রোদ তাই বেরিয়ে পড়েছে দুজনে। আজ গাড়িতে চেপে একটা নিশ্চিন্ত মনোভাব নিয়ে বেশ রোমান্টিক মুডে রয়েছে দুজনে। আশেপাশে যারা চেনাজানা তারা প্রত্যেকে তাকিয়ে দেখছেন । তিথি র বেশ মজাই লাগছে। প্রত্যেকবার পাশের বাড়ির বুম্বাদার বউ বলে ‘কি গাড়িতে চাপো তোমরা। প্রায় ই তোমাদের গাড়ি খারাপ হয়ে যায় আমি হলে বাবা ও গাড়িতে কখনো চাপতাম না ।তুমি তিথি কি করে ওই গাড়িতে চাপো গো।’ বলে ই কেমন যেন একটা বিদ্রুপের হাসি হাসতে থাকে।
তিথির খারাপ লাগে কিন্তু সেটা মনের ভেতরে রাখে রক্তিমকে প্রকাশ করে না। সত্যি তবে কখনো কখনো বিরক্ত হয়েছে। তাই আজকে গাড়িতে ওঠার আগে বারবার জিজ্ঞেস করেছে গাড়ি বিগড়োবে না তো। আজ যেন তিথি সবার মুখে ঝামা ঘষে দিতে পারবে মনে মনে এটাই ভাবছে ।একটু পরে জোর দিয়ে
তিথিকে বলল “তোমাকে বলেছি না গাড়িতে চাপলে তুমি আমাকে দুহাত দিয়ে বেশ জাপটে ধরবে। এটা আমার মনের ভেতরে একটা আলাদা স্প্রিট জাগে”।
বলার সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরে কিন্তু মাঝে মাঝে ছেড়েও দিচ্ছে ।
” কি হলো।”
“আরে বাবা চেনা জায়গায় কেমন একটু বাঁধো বাঁধো লাগেনা।”
“কেন আমি কি পরকীয়া করছি নাকি বা তুমি করছ নাকি পরকীয়া যে বাঁধো বাঁধো লাগবে।”
“এসব ন্যাকামো কথা আমাকে বলো না তো, ভাল লাগে না ।”
‘আরে বাবা চক্ষু লজ্জা বলে কিছু একটা ব্যাপার আছে তো নাকি।”
”লে হালুয়া নিজের বউয়ের সাথে একটু প্রেম করব সেটারও উপায় নেই।
‘হ্যাঁ তুমি থাকো এসব নিয়ে।”
”আমার কপালটাই এরকম।”
”আজ কোথায় যাবে।”
”চলো আজকে তোমাকে একটা পাঞ্জাবি হিন্দুস্থান ধাবা নিয়ে যাব।”
“সত্যি অনেকদিন তন্দুরি রুটি আর তরকা পালং পনির খাওয়া হয়নি পাঞ্জাবীদের হাতের রান্নাটাই অন্যরকম।”
“তবে মেরি জান তোমাকে বলেছিলাম না আজকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাব।
“এই তার আগে চলো কটা ছবি তুলি। কি সুন্দর নেচার দেখো। হাই রোডে ওঠার আগে ছবিগুলো তুলে নিই”।
“তোমার ছবি তোলার বাতিক আর গেল না।”
“বাহ রে সব সময় কি ভালো ছবি তোলার জায়গা পাওয়া যায় বলো, আরে এগুলোই তো স্মৃতি হয়ে থাকবে।”
“তা অবশ্য ঠিক আজকে তোমাকে লাগছেও খুব সুন্দর। লাল ডুরে কাটা ঢাকাই শাড়িতে অনবদ্য লাগছে আজকে যে কেউ তোমার প্রেমে পড়ে যাবে।”
“যা, কি সব বলো না, যাচ্ছেতাই তুমি।”
“ও সত্যি কথা বললেই আমি যাচ্ছেতাই? অবশ্য তুমিও মনে মনে এটাই ভাবছিলে।”
“বলো ঠিক বলেছি না ।”
“ভালো হবে না কিন্তু রক্তিম।”
“দাঁড়াও এই গাছটার কাছে দাঁড়াও।
স্মাইল।
দারুণ দারুণ শট।”
“এসো না তুমি এসে দাঁড়াও একসঙ্গে তুলি সেলফি।”
“দাঁড়াও আগে ফটাফট কটা তোমার ছবি তুলিনি।” “তারপর একসঙ্গে তুলছি।”
“রাস্তায় যেতে যেতে কতজন হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে রক্তিম তিথির এই খুনসুটি।”
“কতজন দেখছে দেখো।”
“দেখেছি দেখ এটা কি তোমার চেনা জায়গা নাকি তাই।
“নাও বল বল সবাই দেখছে লজ্জা লাগছে।”
“আচ্ছা বেশ একসঙ্গে সেলফি। দারুন এসেছে।”
“আজকে এটা ডিপি করব।”
“আর একটা রিল বানাবো।”
“তার সাথে অসাধারণ একটা গান দেব কিশোর কুমার লতা মঙ্গেশকরের।”
“কি গান দেবে?”
“দেবো দেবো যখন ছাড়বো তখন দেখবে।”
“আচ্ছা বলোই না”।
“হাম দোনো দো প্রেমী দুনিয়া ছোড় চলে জীবন কি হাম সারি রাস মে তোর চলে”…
“রোমান্টিক গান!”
“বেশ চলো দেরি হয়ে যাবে।”
সূর্য ঢলে পড়েছে রক্তিম আভা এসে পড়েছে দু’জনার চোখে মুখে যেন অনন্ত প্রেম বয়ে চলেছে। রক্তিম তিথির মধ্যে মনে হচ্ছে না ওরা স্বামী-স্ত্রী মনে হচ্ছে ঠিক প্রেমিক-প্রেমিকা ঠিক বিয়ের আগে যেভাবে এরা কিছুটা সময় কাটাতো আজ অনেকদিন পর সেটাই মনে হচ্ছে। একজন অপরদিকে তাকিয়ে আছে কত জিজ্ঞাসা কত প্রশ্ন সব একাকার হয়ে যাচ্ছে মনেই হচ্ছে না যে এদের কত ঝগড়া ঝাটি আবার কখনও কখনও এমন মিল আজ সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এরা শুধুই প্রেমিক প্রেমিকা অনন্ত প্রেম।
তিথি রক্তিমকে ধাক্কা মারলো, “এই কি দেখছ এত, “চলো।”
”চলো।”
আমি তোমাকে দেখেছি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম ঠিক সেই দিনটার কথা ভাবছিলাম অপরূপ লাগছিল তোমাকে, আজকেও ঠিক সেরকমই মনে হচ্ছে। এত বছর পরেও সবকিছু যেন একই আছে সবাই বলে বিয়ের পর প্রেমটা যেন নাকি অনেকটা নষ্ট হয়ে যায়, আমার কাছে সেটা মনে হয় না।
”বাপরে আমার রোমান্টিক প্রেমিক।”
“হ্যাঁ গো।”
“তবে মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয়।”
“কিসের?”
“এই যে দেশজুড়ে কি চলছে।
ভারতকে কিভাবে ঝামেলায় ফেলার চেষ্টা করছে প্রতিবেশী দেশগুলো।”
“কিচ্ছু হবে না ভারতবর্ষ এখন অনেক বেশি শক্তিশালী দেখছো না কিছুদিন আগে পাকিস্তানকে নাজেহাল অবস্থায় ছেড়েছে।”
“পাশাপাশি বাংলাদেশ যেভাবে শুরু করেছে চিন তো রয়েছেই।”
“বাংলাদেশ ও তার যোগ্য জবাব পাচ্ছে তাদের কোটি কোটি টাকার ব্যবসা মার খাচ্ছে বিশেষত রেডিমেড গার্মেন্টস।’
“সত্যিই তাই এটা করাই দরকার পহেলগামের ঘটনাকে ঘিরে যে নিন্দনীয় কাজ করেছে সন্ত্রাসবাদীরা তার জবাব এভাবেই দিতে হয়। যাতে কখনো ভারতের দিকে চোখ তুলে তাকাতে না পারে।”
“হ্যাঁ।”
“আবার কিছু গদ্দার দেখেছো? কেমন পাকিস্তান প্রেমী।
যা না পাকিস্তনে চলে যা।ভারতবর্ষে থাকবে খাবে অথচ ভারতবর্ষকেই লাথি মারবে সেটা তো হতে পারে না।”
“ঠিকই তাই ।এই সমস্ত গদ্দারগুলোর জন্যই দেশের এই হাল।”
“তবে কিছু ধরাও পড়েছে।”
‘চলো চলো এরপর আবার বাড়ি ফেরার আছে।’
“আচ্ছা যাব জান।”
“ওই দেখো মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে ।”
“ভালোই তো বৃষ্টিতে ভিজবো আর ওই গানটা গাইবো
“রিমঝিম গিরে সায়ওন সুলগ সুলগ যায়ে মন ভিগে আজ ইস মসম মে লাগি ক্যাইসি ইয়ে আগন।
রিমঝিম গিরে সায়ওন…।”
“কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না “কি বলছ তুমি ?”
“দাঁড়াও ঘাবড়িও না।”
“ধেততেরি ভালো লাগেনা।”
উনি আমাকে পাঞ্জাবি রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাবে খাওয়াতে এইতো তোমার গাড়ির অবস্থা। একটা দিনও কি শান্তিতে কোথাও যেতে পারবো না। কতদিন বলেছি তোমাকে গাড়িটা চেঞ্জ করো”।
“এই তিথি রাগ করো না। দেখো ঠিক হয়ে যাবে।”
“দেখি কেমন ঠিক হয়ে যায় আর তোমায় সেই দলাই মলাই যে কিনা সেরা মিস্ত্রী তোমাদের এলাকার।”
তিথি রাগ করে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো চোখ দিয়ে জল পড়ছে।
কত কি ভেবেছিল আর কি হল।
রক্তিম মাঝে মাঝে দেখছে তিথির দিকে তাকিয়ে।
কিন্তু গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না কেন এটাই ভেবে পাচ্ছে না।
সত্যি তো যদি রাগ করেই সেটা তো ওর হক। বেচারা কোথাও যেতে পারে না। একটা দু’টো দিন বের হয় ওকে নিয়ে সেটাও যদি এরকম হাল হয়।
কিন্তু কি করব? ওকে কি করে বোঝাবো? এটা আমার মায়ের স্মৃতি, মা নেই আমি স্মৃতিটাকে আগলে রাখতে চাই।
যতই পুরনো হোক ওকে তো আর ফেলে দিতে পারি না।
এত কাল ও কত জায়গায় আমাকে নিয়ে গেছে এখন বয়স হয়ে গেছে বলে ওকে বিক্রি করে দেব জলের দরে আর ওরই সামনে ওকে ভাঙবে একটা একটা করে ওর অঙ্গ গুলোকে তুলবে সেটা ও কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না ।কারণ যা গাড়ির অবস্থা হয়েছে সেটা বেশি দামে বিক্রিও হবে না।
ও দলাই মলাই কে ফোন লাগাল।
“হ্যালো ”
“হ্যাঁ দাদা বলুন”
“দলাই দা, আমরা মাঝ রাস্তায় এসে ফেঁসে গেছি।
গাড়ি স্টার্ট নিচ্ছে না।”
“কিন্তু আমি যখন গাড়িটাকে সরালাম তখন তো সব ঠিকঠাকই ছিল তাহলে দাদা ওই এক্সিলেটরে আর কোন কাজ হবে না।”
“”কিন্তু ফিরবো কি করে?”
আমিও তো এই মুহূর্তে যেতে পারব না
আপনি একটা কাজ করুন একটা ভ্যান দেখে গাড়িটাকে তুলে নিয়ে চলে আসুন আমার দোকানে ফেলে দিয়ে যান।”
”বেচারা তিথির মুখটার দিকে তাকিয়ে রক্তিমের চোখে জল আসলো। কত কিছু ভেবেছিল আজকে। সত্যিই রক্তিম একটা যাচ্ছেতাই ছেলে। কোনও কিছুই তিথির জন্য ভালো কিছু করতে পারে না। কি করবে? এখন তিথিকে গিয়ে কি বলবে!”
ইতিমধ্যে একটা ভ্যান যাচ্ছে দেখতে পেয়ে “ও দাদা ও দাদা ,বলছি আমার এই গাড়িটা ভ্যানে করে পৌঁছে দিতে পারবেন। ”
“কোথায় যাবেন মেমারি। ”
“ঠিক আছে।”
এবার রক্তিম তিথির কাছে গেল দু’টো হাত ধরে ক্ষমা চাইলো।” তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। এখানে আর কিছু আমাকে বলো না প্লিজ চলো আজকে যাওয়া হবে না। বাড়ি ফিরে চলো। তিথি কি একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু রক্তিমে চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো রক্তিম এর অসহায়তা কোথায় যেন গাড়ির প্রতি একটা অসাধারণ মমত্ববোধ। যার থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। সেখানে তিথির ভালোবাসা ও যেন তুচ্ছ হয়ে যায়। তবে তার ভেতরে ছিল একটা আলাদা সম্মান।
তিথি শুধু বলল ”তবু তুমি গাড়িটার মায়া ছাড়তে পারবে না।”
আর বারবার এরকম যাচ্ছেতাই অবস্থার মধ্যে পড়তে হবে।🍁
সম্পাদক : দেবব্রত সরকার, কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার, কভার : প্রীতি দেব, অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
