



সম্পাদকীয়
কিছু লেখা যদি প্রেম ভালোবাসায় জমে থাকতো তাহলে হয়তো কোন অনুভূতি প্রকাশ হত রোমকুপে, মনের সুতোয় অথবা প্রাণের শহরে। কিন্তু কষ্ট আজ। বড্ড কষ্ট। কারণ মানুষ তার নিজস্বসত্ত্বাকেই হারাতে বসেছে। ধীর গতি নিয়েছে। আরো আরো গতিময় করে তুলবে নতুন প্রাণের ভিতরে। সবুজ অভিনন্দন এগিয়ে আসবে হয়তো কিন্ত, মেধা থাকবে না। মেধা গিলে খাবে প্রতি নিয়ত। আর একটি নির্দিষ্ট শ্রেণী পর্যন্ত উপলব্ধি থাকবে অথচ কর্মহীনতা প্রকাশ ঘটবে আর ঘটবেই। কারণ আবিষ্কার জানে না যে সৃষ্টি করেছে সেই অদৃশ্য। তাহলে যে বাঁচিয় রেখেছে! সেও অদৃশ্য। বেঁচে থাকার রহস্য খুঁজতে গিয়ে গভীরে ডুব দিলে তলিয়ে যেতে হয়। গভীরে যেতে হলে তো সাঁতার জানতে হবে না হলে তো পৌঁছুনোই হবে না। আর কোন স্রোতে ধাক্কায় পৌঁছে গেলেও শরীর না নড়ালে টিকতেও পারবে না। তাহলে এখানে বুঝে নিতে হবে। সাঁতার কাটার সময় সঙ্গে কেউ থাকবে না। একাই সাঁতরে যেতে হবে গভীর জলে গিয়ে শরীর দুলিয়ে প্রাণ রক্ষা করবার কৌশল জানতে হবে। তবে পৃথিবীতে জ্ঞান এলে প্রাণ রক্ষা করবার দায়িত্ব নিজেরই। এই কথা ভুলে গেলে চলবে না। অর্থ প্রাণ রক্ষা করতে পারে না। প্রাণ রক্ষা করতে পারে সংযোম। তাহলে প্রথমেই আমাদের সংযম হতে হবে।
কতটা হতে হবে ঠিক যতটা বেগতিক স্রোত বয়বে ততোটাই। মনে রাখতে হবে জীবনের প্রথম ও শেষ শ্বাসের নাম অলৌকিক। কারণ কেউ জানেই না পৃথিবীতে সে থাকবে না যাবে। প্রকৃতির বজ্র বৃষ্টি ঝড় ইত্যাদির মত। কিন্তু এটা ভুলে গেলেও চলবে না যে, এই অলৌকিক ক্ষমতাকেও কেউ বন্দী করে নিতে পারে তা! জীবনের রহস্য অতীব গভীর অনুভূতি সম্পূর্ণ। ভালোবাসায় প্রেমে যে শক্তি রয়েছে তাকি আজকের তথ্যপ্রয়ুক্তিতে থাকবে? কখনোই না। কারণ ভালোবাসা প্রেম দ্বারাই তথ্যপ্রয়ুক্তির নির্মাণ হয়েছে। এই নির্মাণের মধ্যেই মেধা রেখেছে কিছুটা। এই মেধাই চুরি করবে ঘরে ঘরে। কবি থেকে লেখক, শিল্পী থেকে সাহিত্যিক, সংসার থেকে সমাজ, বিজ্ঞান থেকে দর্শন , ইতিহাস থেকে ভূগোল এগুলো সর্বোপরী বিষয়। এই বিষয় চুরি যেদিন থেকে চুরি হয়ে আসছে সেইদিন থেকেই ধ্বংস শুরু হয়ে গেছে। একদিন শেষ হয়ে যাবে। কথাটি অতি সত্যি। যার জন্ম আছে তার মৃত্যু আছে— সে পাথর হোক বা প্রাণ। কখনোই ভুলে গেলে চলবে না যে, সৃষ্টি-জন্মের ইতিহাসে প্রথম কিন্ত প্রেম ভালোবাসার গল্প জুড়ে যায়। এই গল্প একটি প্রাণের মূল্য বোঝায়। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। রিপুর স্বাদের মধ্যে ভালবাসা ও প্রেমের গভীর বোধ কাজ করে।🍁
🍁মহামিলনের কথা
শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
শিব বলেছেন— যাঁরা কৃষ্ণনাম গান করেন,কৃষ্ণের সেবা করেন,তাঁরা পরম অব্যয় বাসুদেবের স্থানে গমন করে থাকেন।
ভুলে যাই,অন্যমনস্ক হয়ে যাই,তার উপায় কি?
তার উপায়ও নাম। নামসঙ্কীর্ত্তন কর্। নাম তোকে নাম স্মরণ করিয়ে দেবে। নাম তোকে সমনস্ক করে আনন্দ দিতে দিতে আমার কাছে নিয়ে আসবে। নামে যে মানুষ পরমানন্দময় আমাকে লাভ করে,তা নামকারী সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করে থাকে। নাম করতে করতে সমস্ত মন-প্রাণ আনন্দে ভরে যায়,শরীর কম্পিত হতে থাকে,কখন নৃত্য করে,শরীরের সঙ্গে সঙ্গে সাড়ে তিনকোটি লোমও নৃত্য করতে থাকে। তারা নৃত্য করতে করতে বায়ুকে লয় করে দেয়। বাহাত্তর কোটি,বাহাত্তর লক্ষ,দশ হাজার দুশো এক শিরায় নামের প্রবাহ ছুটতে থাকে। প্রাণ, অপান, সমান, ব্যান, উদান আপন কার্য্য ত্যাগ করে নামে মিলিত হয়ে যায়। প্রাণ মনকে সঙ্গে নিয়ে পরম আনন্দ পারাবারে নিমজ্জিত হয়। জ্যোতিপ্রবাহ অন্তরে বাহিরে খেলা করতে থাকে। কত বেণু,বীণা মুরজ আদির প্রাণমন বিমোহনকারী ধ্বনি সকল ভেসে আসে। নামকারীর চতুর্দ্দিকে আনন্দের প্রাচীর উঠে। নামকারী আনন্দসাগরে ডুবে যায়।
নাম কর্। কেবল নাম কর্। কোন সাধনা,তপস্যা,যোগ-যাগ,ধ্যান-ধারণা কিছু করতে হবে না। কেবলমাত্র নাম অবলম্বন করে থাক্—আমি তোকে বুকে করে আমার আনন্দময় ধামে নিয়ে যাবো। তুই কিছুর জন্য চিন্তা করিস্ না। তোর যা চাই না চাই,তোর কখন কি প্রয়োজন—সে ব্যবস্থা আমি করবো। আমি তোর আছি—তুই নাম কর্ নাম কর্। আমি তোর আছি—আমি তোর আছি—আমি তোর আছি।🍁
ঋণ : শ্রীশ্রীনামামৃত লহরী ★ শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী
প্রবন্ধ
২০১৯–২০২৫: বায়বীয় যুদ্ধে করোনার প্রভাব— বিশ্ব ও ভারতবর্ষের বিস্ময়
তনুজা বন্দ্যোপাধ্যায় : ২০১৯ সালের শেষ প্রান্তিকে চীনের উহানে উদ্ভূত হওয়া করোনাভাইরাস (COVID-19) বিশ্বজুড়ে এক অভূতপূর্ব সংকটের সূচনা করে। ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এই মহামারী বৈশ্বিক অর্থনীতি, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, শিক্ষা ও সামাজিক কাঠামোতে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই সময়কালে, বায়বীয় যুদ্ধের মতো, অদৃশ্য এক শত্রুর বিরুদ্ধে মানবজাতি লড়াই করেছে। এই প্রবন্ধে, আমরা ২০১৯-২০২৫ সময়কালে করোনার প্রভাব বিশ্লেষণ করব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন, এবং ৭০৪ মিলিয়নেরও বেশি নিশ্চিত সংক্রমণ ঘটেছে। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে সংক্রমণের প্রভাব কিছুটা কমলেও, নতুন ভ্যারিয়েন্টের উদ্ভব এবং দীর্ঘস্থায়ী কোভিড (Long COVID) বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে ।
অর্থনৈতিক বিপর্যয়
করোনার প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২২ ট্রিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে। সরকারগুলো জনকল্যাণ রক্ষায় রেকর্ড পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করে, যার ফলে বৈশ্বিক সরকারী ঋণ ১২ শতাংশ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। মহামারীর কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়, যার ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াতে বাধ্য হয়।
শিক্ষা ও সামাজিক জীবনে প্রভাব
মহামারীকালীন সময়ে বিশ্বজুড়ে ১.৬ বিলিয়ন শিক্ষার্থী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। অনলাইন শিক্ষার প্রসার ঘটলেও, ডিজিটাল বিভাজন এবং মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সামাজিকভাবে, লকডাউন ও সামাজিক দূরত্বের কারণে মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়।
ভারতের প্রেক্ষাপট: বিস্ময়কর বাস্তবতা
২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত, ভারত সরকারী পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪.৫ কোটি নিশ্চিত সংক্রমণ এবং ৫.৩৩ লাখ মৃত্যু রেকর্ড করেছে। তবে, WHO-এর মতে, ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অতিরিক্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৪.৭ মিলিয়ন হতে পারে, যা সরাসরি ও পরোক্ষভাবে করোনার সাথে সম্পর্কিত।
লকডাউনের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, যার ফলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত করোনা ভাইরাস মহামারী বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই সময়কালে, মানবজাতি এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যা বায়বীয় যুদ্ধের মতো
স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ
ভারতে দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় অক্সিজেন সংকট, হাসপাতালের শয্যার অভাব এবং ওষুধের ঘাটতি দেখা দেয়। ২০২৫ সালে নতুন ভ্যারিয়েন্ট NB.1.8.1 এবং LF.7-এর কারণে দক্ষিণ ভারতে সংক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে কেরালা, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লিতে। যদিও বর্তমান সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে হালকা, তবে স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সতর্কতা অবলম্বন করছে।
অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতের অর্থনীতি মহামারীর কারণে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে GDP ৭.৩% হ্রাস পায়, যা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে সর্বোচ্চ পতন। বিশেষ করে, নির্মাণ, পর্যটন এবং খুচরা খাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
শিক্ষা ও ডিজিটাল বিভাজন
লকডাউনের কারণে স্কুল ও কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তবে, ডিজিটাল অবকাঠামোর অভাব এবং ইন্টারনেট সংযোগের সীমাবদ্ধতার কারণে গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে পড়ে।
সমাজ ও অভিবাসন
মহামারীর সময় অভিবাসী শ্রমিকদের দুর্দশা ভারতের সামাজিক কাঠামোর দুর্বলতা প্রকাশ করে। লকডাউনের কারণে হাজার হাজার শ্রমিক পায়ে হেঁটে নিজ নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হয়, যার ফলে মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়। ২০১৯ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত করোনা ভাইরাস মহামারী বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, শিক্ষা এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলেছে। এই সময়কালে, মানবজাতি এক অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যা বায়বীয় যুদ্ধের মতো। এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে আরও সুসংগঠিত, সহানুভূতিশীল এবং প্রস্তুত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
🍂কবিতা
স্বপন দত্ত-এর একটি কবিতা
আলোর পথে, নাকি অমিতার পথে, নাকি কাবার পথে
ধবধবে সত্ত্বার…
কী? আমি কে? কী পরিচয়?
কোথায় যাব বলে চলতে শুরু করেছিলাম!
এখন কোথায়?
নিজের নাম,ধাম ভুলে গেছি।
কী ভাষায় কথা বলছি, জানি না।
তবে বলছি, তাহলে এটাও একটা ভাষা।
সেই ভাষাতেই ভেসে আছি…
তবে, আমি নিজেকেই বুঝতে পারি না!
অন্যকে কী বুঝব!
তবু মনে হয়, ও-ই সব।
ওর মত এত শীর্ষ দেশ মহীয়সী—
না মহীয়ান, কী বলব? কেউ নয়।
যেদিকে দেখতে চাই ওঁকে ছাড়া কিছু দেখি না।
যেদিকে শুনতে চাই ওঁকে ছাড়া কিছু শুনি না।
যেদিকে ভাবতে চাই ওঁকে ছাড়া কোনও ভাবনা নেই।
এইভাবেই এক খিদেয় মিটে যাওয়া।
তাহলে খিদেটা কী?
ওঁর জন্যেই খিদেটাই বা কী?
আমার নিজেকে নিয়ে খেলার খিদে…
নাকি ওঁকে নিয়ে খেলার খিদে!
কিন্তু ওঁকে নিয়ে তো খেলা যায় না।
ওঁকে নিয়ে পরশেও পৌঁছনো যায় না।
শুধু শোনা যায়, একটা ধাতব শব্দ—
চাই-চাই-চাই…
কী চাই? কেন চাই?
তাহলে কী পকেট ভরাতে চাই!
তাহলে কী চোখ ভরাতে চাই!
তাহলে কী নাকে গন্ধ পাতি-পাতি খুঁজে বেড়াই?
কার গন্ধ— গায়ের, ফুলের, ভাষার?
এবার বুঝেছি, মা’য়ের গন্ধ।
কোন মা? দেশ?
দ-এ একার তলেবর শ বললেই চারিদিকে চারধারে জমা হয়
দ-এ ব-এ একার মূর্ধাণ্ণ ষ— তাহলে?
না না। দেশ নয়। আবার দ্বেষ মানে শেষ।
তাহলে দ্বেষ দরকার নেই।
দরকার নেই মানচিত্র, তাহলে কী দরকার?
জানতে পারছি না।
আমাকে ছিঁড়ে বের করে যদি জানতে চাই
তাহলে কী আবার ফেরা যাবে—
একটা ঠিকানা চাই…
কোন ঠিকানা? যাওয়াটা কী আসা হয়?
আচ্ছা, আলো ব্যাক গিয়ার করতে পারে?
এই পর্যন্ত যতটুকু জানা— কতটুকু আর…
তাতে মনে হয়, পারে না।
তাহলে প্রাণজ্যোতি যায় যায়, ফেরে না।
তাহলে আমি চলছি চলছি ফিরছি না! ফিরছি না!
পারিজাত গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
বাতাসের ভিতর
একটা বিকেলের আলো ভাঙে মুখের উপর
আমি দেখেছি—তোমার হাসির রেখা
একবার জন্ম নিয়েছিল আমার আঙুলের ফাঁকে
তারপর হারিয়ে গেছে—বাতাসের ভিতর।
কিছু শব্দ ভেসে যায়
ভালো আছো?
ভালো থেকো
শুধু এই
ঘরের দেয়ালে টিকটিকির দাগের মতো
আমাদের গল্প আঁকাবাঁকা হয়ে পড়ে থাকে
আমি ছুঁতে চাই, কিন্তু পাথরের মত ঠাণ্ডা
তুমি কি কখনও ফিরে আসবে? না, আসবে না,
আমি জানি
তোমার কণ্ঠস্বরের রেশ এখনও ভাসে জানালার ফ্রেম
কোনও জানালা নেই, শুধু ফ্রেমের রেখা
একটা চিঠি লিখেছিলাম, পকেটে রাখিনি
জলে ভিজে গেছে, অক্ষর মুছে গেছে
তবুও তুমি আছো, কোনও বাতাসের ভিতর
আমাদের গল্পটা কি সত্যি ছিল
না, হয়তো না। শুধু একটা শ্বাস, একটু আলোর দাগ,
আর কয়েকটা অচেনা পায়ের ছাপ
আমার কাঁধের উপর ভর করে থাকা
শেষে, সব ফাঁকা হয়ে যায়
শুধু তুমি থেকে যাও, হয়তো থেকে যাও না
একটা দীর্ঘশ্বাসের মত, অদেখা, অমলিন
শ্বেতা বসু-এর একটা কবিতা
ভোর নামে তোমার মতো
এই কটেজে শব্দ ধোয়া, জানালায় নামে কুয়াশা
তোমার চোখে ঘুম পোহায়, ঠোঁট ছুঁয়ে যায় ভাষা।
চায়ের কাপে ঠান্ডা শ্বাস, কেউ রেখে গেছে স্পর্শ
তুমি বলো না, তবু বুঝি—এই রাত ছিলো পরশ।
পাহাড় বুকে চাঁদ থেমে, আমরাও কি থেমেছি?
তোমার চুলে ছায়া হয়ে, ভালোবেসে কেঁদেছি।
ভোর নামে তোমার মতো, নিঃশব্দে, ধীরে ধীরে—
তুমি গেলে—আমি রইলাম, প্রেম কুয়াশায় ঘিরে।
কোয়েল সেন-এর একটি কবিতা
হারিয়ে যাওয়া নামের ভিতর
একটা নামের ভেতর হারিয়ে যায় আলো, ভাঙা কাঁচের মত ছড়িয়ে পড়ে চাঁদ।
আমরা কথা বলি না, শব্দেরা শুকিয়ে যায়, বাতাসে ভাসে নীরবতা।
তোমার চোখের ভেতর কিছু ছিল, হয়তো অন্ধকার, হয়তো একটি চিঠির ছায়া।
আমি হাত বাড়াই, পায়ের নিচে মেঝে ফেটে যায়, জানালার ফ্রেম ভাঙে না।
একটা বিকেলের শেষ আলো পড়ে থাকে আমার কাঁধে, তুমি আর ফিরে আসো না।
চেয়ারের পেছনে রাখা ছিল তোমার চুলের গন্ধ, ধীরে মুছে যায়, হারায়।
ঘরের কোণে ধুলোর আস্তরণ জমে, তোমার স্পর্শের প্রতীক্ষায় বোবা দেয়াল কাঁদে।
ঘড়ির কাঁটা থেমে যায় না, কিন্তু সময় চলে যায়, ঠোঁটে মিশে যায় না।
একটি শ্বাস, একটি দীর্ঘশ্বাস, বাতাসে মিলিয়ে যায়, জানালার ফ্রেম কাঁপে না।
তুমি কি ছিলে, নাকি কেবল স্বপ্নের ছায়া, রাতের ভিতরে হারানো আলো?
প্রেমের গল্প লেখা হয় না, শুধু ভাঙা শব্দেরা মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে।
একটি মুখ মনে পড়ে, ফ্রেমবিহীন, শূন্যের ভিতর, আমি স্পর্শ করি না আর।
তোমার হাসির প্রতিধ্বনি ফেটে যায় বাতাসে, একবার, দু’বার, হারিয়ে যায় অচিনপুরে।
শেষে শুধু নীরবতা, শব্দহীন নাম, আর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আমার বুকের ভিতর।
দেবমৃতা গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটি কবিতা
অভিমানী আকাশ
বৃষ্টি পড়ে না। শুধু আকাশ ফেটে যায় নিঃশব্দে
মেঘ জমে, হাওয়া বয়ে যায়
তুমি ছিলে একবার
তোমার ঠোঁটের লালচে রেখা
এখনো আমার আঙুলের শেষ প্রান্তে
ছুঁতে গেলে কেটে যায়, মুছে যায়…
তবুও আমি ছুঁতে চাই
একটা ফাঁকা ঘর, ভিতর থেকে গাছ জন্মায়
তার পাতাগুলো তোমার নামের মতো ভেঙে যায়
আমি ঠোঁটে তুলে বলি : ভালবাসা শব্দটা ফেটে যায় বাতাসে
তোমার মুখের ছায়া আঁধারে মিশে যায়
জানালা খুলে দিই, কোনো আলো আসে না
শুধু বাতাসের দাগ পড়ে গায়ে— তুমি ছিলে?
ছিলে কি সত্যিই?
নাকি আমার রাতের ভেতরকার কোনো পুরনো ব্যথা
ঘড়ি থেমে যায়, কিন্তু সময় থামে না
হাতে রাখা চিঠির কাগজে
তোমার নাম ধীরে ধীরে মুছে যায়
শুধু একটা দাগ রেখে যায়
যেখানে আঙুল ছুঁয়েছিল তোমার কপাল
আমি দাঁড়িয়ে থাকি, একটা ভাঙা দরজার সামনে
না, দরজা নয়—দরজার ফাঁক দিয়ে হারিয়ে যাওয়া
তোমার গন্ধ
প্রেম শব্দটা মাটি খুঁড়ে ফেলে—একটা পুরনো ঘ্রাণ
একটা ধুলোর পরত, একটা শূন্যতা
শেষে সবকিছু থেমে যায়— শুধু বুকের ভেতর
একটা শব্দ কেঁপে ওঠে— ‘তুমি’
সূর্য মিত্র-এর একটি কবিতা
নীরবতার ভিতর
একটা বালির ঘর ছিল। দেয়ালে হাত রাখলে টের পেতাম
ভেতরটা ফাঁপা, মুঠো ভর্তি ধুলো। তুমি কি জানলে?
না, জানার প্রয়োজনও হয়তো ছিল না।
একটা আলো জ্বলে উঠত সন্ধ্যায়,
তোমার চোখের ভেতর, আর আমি ভেবেছিলাম—
আমরা বেঁচে আছি, একসঙ্গে, নিঃশ্বাসের পর নিঃশ্বাসে।
কিন্তু বাতাসের কোনো প্রতিশ্রুতি থাকে না,
শুধু ফাঁকা ঘরটা থাকে। যেখানে আমাদের কথা উড়ে উড়ে দেয়ালে লেগে। অদ্ভুত এক শব্দের মত—অর্থহীন।
আমি একদিন হেঁটে গিয়েছিলাম দূর কোথাও।
ফিরে এসে দেখি, ঘরটা নেই। জানালা নেই, তোমার হাসির ছায়া নেই।
শুধু একটা গন্ধ—ভেজা মাটির,
একটু কাঁচের টুকরোর মত খচখচে।
তুমি ছিলে? ছিলে কি সত্যিই?
নাকি আমি নিজেই আমার কল্পনার ঘরে
একটা মুখ এঁকে রেখেছিলাম?
একটা পিঁপড়ে হেঁটে যায়। আমাদের ফেলে রাখা আড়ালে।
তার পায়ের নিচে শব্দ চাপা পড়ে, প্রেম।
অর্থহীন শব্দের মত গুঁড়িয়ে যায়।
শেষে, একটা বাতাস বয়ে যায় : না, চলে যায়—
সব কিছুর শেষে শুধু একটা শূন্যতা থাকে, যেখানে আমরা ছিলাম!
হয়তো ছিলাম না।
আদিত্য মুখোপাধ্যায় (আদি)-এর একটি কবিতা
জল এসো; পবিত্র
ব্যথা বেশি প্রেমে ; কষ্ট বেশি সংসারে ; কত আপনজন ভুবনডাঙা জুড়ে….
অযুত লক্ষ্য ; ভ্রষ্টও প্রায় তত
আঙুলে গোনা কিছু সুখকর মূহুর্ত ছাড়া বাকিটা বৃত্তাকার হাহাকার
আর্তনাদ নাচে….
জল তুমি এসো ; পবিত্র
ধুয়ে দাও দিনগত ক্ষয় এবং অবৈধতার
পরাণ মাঝি-এর একটি কবিতা
শ্রেয়সী ঢেউ পেরিয়ে
বৈভব পেরিয়ে তুমি আসাতে পারবে না সোনা ;এত সোনালি শ্রেয়সী ঢেউ পেরিয়ে কেউ আসতে পারে না
বৃষ্টির জলের মতো অশ্রু গড়িয়ে যায় ; শরীরময়। কেউ কী কারো জন্য চিরকাল বসে থাকে
প্রতিটি অপেক্ষা আসলে প্রার্থনা ঢেকে রাখে
🍂ধারাবাহিক উপন্যাস
শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।
একটি বিষণ্ণরাতের তারা
তৈমুর খান
উনত্রিশ.
অসহিষ্ণু ভঙ্গুর এক জীবনদর্শন
এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে। বাড়িতে চিঠিও পৌঁছে গেছে ইন্টারভিউয়ের। এত কষ্টের মধ্যেও কিছুটা আশার আলো জেগে উঠেছে। কিন্তু তবুও এক বিষণ্ণতা আমাকে ঘিরে আছে। আগেও এসএসসি পরীক্ষায় পাশ করে পূর্বাঞ্চল জোনে চাকরি পাইনি। বন্যার কারণে পৌঁছাতে পারিনি ইন্টারভিউয়ের জন্য। আরেকবার ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম, কিন্তু আমাকে যেভাবে প্রশ্ন করা হয়েছিল তা খুব সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। বিশেষ করে আমার নামের কারণে আমার প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছিল। তাই বোর্ডে আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমার মাতৃভাষা কী। আমার নামের পদবী দেখে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের আসল বাসস্থান কোথায়। এসব প্রশ্ন ছিল আমার কাছে খুবই অপমানজনক। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মাতৃভাষা বাংলা এবং আমি বাংলা ভাষার শিক্ষক হিসেবেই ইন্টারভিউ দিতে এসেছি। তবুও কেন ওদের সংশয় ছিল আমার প্রতি তা ভেবে পাইনি। সেবার আমার চাকরি হয়নি। এত নাম্বার এত ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও কেন আমি প্যানেলে আসিনি তার কারণ জানতে পারিনি। তখন বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল পশ্চিমবঙ্গে। যে সরকার উদার মানবতাবাদী বলে দাবি করতো। কিন্তু কেন এমন প্রশ্ন আমাকে করেছিল, কোনো বিদ্বেষবশত নাকি এর উত্তর আমি পাইনি। তাই মনের মধ্যে অভিমান নিয়ে নর্থ জোনে পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ইন্টারভিউ এর একদিন আগে আমাকে সেখানে যেতেই হয়েছিল। মালদহতে বি-এড ট্রেনিং করেছিলাম বলে শহরের সব স্থানগুলোই আমি চিনতাম। মসজিদ বাড়ির তালতলা গলিতে এক পরিচিতের বাড়িতে সে রাত্রে ছিলাম। সারারাত ঘুম হয়নি বলে চোখমুখ জ্বালা করছিল এবং একটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। সকাল সকাল স্নান করেই সাইট ব্যাগে সব কাগজপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম ইন্টারভিউ এর উদ্দেশ্যে। যখন মালদহ ইন্টারভিউ অফিসে এসে উপস্থিত হলাম তখনও পর্যন্ত কেউ কোথাও নেই। গেটে তালা লাগানো। নিচে একটা গাছতলায় গিয়ে বসলাম। মনে মনে একটাই প্রশ্ন: চাকরি কি হবে? না হওয়ারই কথা। পূর্বাঞ্চল জোনের মতো যদি ব্যবহার করে তাহলে আর কিছুই করার থাকবে না। সকাল থেকে এক কাপ চা পর্যন্ত গলা দিয়ে নামেনি। অপেক্ষা করছিলাম কখন দরজা খুলে ডাকবে। আকাশের দিকে একবার চেয়ে দেখলাম, অনেকটা বিষণ্ণতা ছেয়ে আছে চারিদিকে। কয়েকটা পাখি উড়ে যাচ্ছে সুদূরের কোনো টানে। হাওয়া নেই বললেই চলে। একে একে অনেকেই জুটতে শুরু করেছে। কম বয়সী যুবক-যুবতীও এসেছে অনেকেই। সকলেই চাকুরী প্রার্থী।
হ্যাঁ রুমা, এবার সত্যি সত্যি আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। এখন যদি তুমি থাকতে তাহলে তোমাকে বলতে পারতাম: “চলো রুমা, ঘর বাঁধবো, আর কেউ কিছু করতে পারবে না; আমি স্বনির্ভর হয়ে গেছি।”
সকাল এগারোটা নাগাদ শুরু হলো ইন্টারভিউ। কয়েকজনের পরেই ডাক পড়লো আমার। সামনে যারা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ হলেও মাঝের জন একজন সুন্দরী অধ্যাপিকা। বয়স পঞ্চাশ অতিক্রম করেছে সকলেরই। গিয়েই আমাকে বসতে বললেন। নমস্কার জানিয়ে আমিও তাদের নির্দেশমতো বসলাম। খুব সহজভাবেই জানতে চাইলেন:
—এবারের ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘ঘাসকাটা’ কবিতাটি কি আপনারই ছিল?
—হ্যাঁ, আমারই ছিল। ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত এটিই আমার প্রথম কবিতা।
—কবিতাটা কোন দিক দিয়ে এইসময়ের একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় বলে আপনি মনে করেন?
—কবিতাটি আমার জীবনের এক সত্যতা নিয়েই লেখা হয়েছে। সেই সত্যতাটি হলো আমার দারিদ্র্য, অথবা অভাব। আর দ্বিতীয় সত্যতাটি হলো বামফ্রন্টের শাসনে সাধারণ মানুষের জীবনের মান পরিবর্তন হয়নি। এখনো সমাজের বহু মানুষ এই দারিদ্র্যের মধ্যে জীবন কাটায়। তাই রাজনীতি থেকে মুখও ফিরিয়ে নিচ্ছে।
—তাহলে আপনি কি বামফ্রন্ট শাসনে সন্তুষ্ট নন?
—বামফ্রন্ট শাসনে সন্তুষ্ট কিনা এই বিচার করিনি, তবে শাসনের পরিবর্তন করে তাকে বাস্তবমুখী হতে হবে। শুধু স্লোগান আর মিছিল-মুখী রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমার উত্তর শুনে অধ্যাপিকাটি এবং উপস্থিত আরও দুজন অধ্যাপক সন্তুষ্ট হয়েছিলেন কিনা বুঝতে পারিনি। তবে কথা বলার মধ্য দিয়ে আমার সত্য উচ্চারণকে অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয়। তাই পরে অধ্যাপিকাটি বলেছিলেন, “আগের দুটি পরীক্ষায় আপনি চাকরি কেন পাননি?”
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা হয়েছিল। কেন আমাকে বাদ দিয়েছিল আগে তা আমিও জানি না সে কথা ওদের বললাম। ওরা দেখলেন আমার মার্কশিট, শিক্ষাগত যোগ্যতার যাবতীয় প্রমাণ। তারপর বললেন, “যে এটা ওরা ঠিক করেনি।”
শেষে আর তেমন প্রশ্ন করেননি, শুধু দুটি কথা বলেছিলেন আরো দুইজন অধ্যাপক। বাংলা সাহিত্যে গৌড়বঙ্গের অবদান কী ছিল এবং মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করতে হলে বর্তমান সিলেবাস আপনার জানা আছে কিনা। দুটিরই উত্তর দিতে কার্পণ্য করিনি। বেরিয়ে এসেছিলাম শুকনো মুখেই। বাইরে এসে রওনা দিয়েছিলাম একটা খাবারের দোকানের দিকে। ইন্টারভিউ এর পর মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গিয়েছিল।
বাসস্ট্যান্ডে বাস ধরতে এসে বারবার মনে পড়ছিল মালদহের পূর্বের বহু স্মৃতি। বি-এড ট্রেনিং করতে এসে পেয়েছিলাম মৃদুলাদিকে। পেয়েছিলাম রফিকুল হককে। পেয়েছিলাম গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের ‘জোয়ার’ পত্রিকার সম্পাদক পুষ্পজিৎ রায়কে। এবি গণি খান চৌধুরীর বাড়ির পাশ দিয়ে বারবার যেতে যেতে উঁকি মেরে মেরে দেখতাম তাঁর ঐতিহ্য ও আভিজাত্যকে। মালঞ্চ পল্লির হোস্টেলে আব্দুল বাকী ও কালাচাঁদ মালোর কথাও খুব মনে পড়লো। যদি সত্যি সত্যিই চাকরিটা হয়ে যায়, তাহলে? আবার আসবো আমি মালদহতে। যাদের বাড়িতে থাকলাম তাদেরও দেখা করে যাব। কেমন আছে মৃদুলাদি? সেও কি চাকরি পায়নি? না সেসবের আর কোনো খবর আমার জানা নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে, বিয়ে হয়েছে কিনা হয়তো আর কখনো জানতেও পারবো না। মনে মনে শুধু বললাম, ভালো থেকো মৃদুলাদি।
তোমাকে ভুলতে পারবো না কোনোদিন। কবিতা লেখার প্রথম সবচেয়ে বড় পুরস্কার তুমিই আমাকে দিয়েছিলে। সে ছিল একটি চুম্বন। চুম্বন স্নেহের হোক অথবা প্রেমের হোক, চুম্বনের প্রতিটি মুহূর্তই এক পবিত্র আবেগের প্রকাশ বলে আমি মনে করি। তুমি আমার কবিতার শব্দে শব্দে বসে আছো। তুমি আমার হৃদয়ের ছায়াছবি হয়ে চিরদিনই রয়ে গেছো। চললাম মৃদুলাদি, তুমি ভালো থেকো।
বাসে আসতে আসতেই নিজের মনেই কত কথা বলে যাচ্ছি। যে আমার কাছে নেই, সম্মুখে নেই, কোথায় আছে তাও জানি না, অথচ তার সঙ্গেই কথা বলে চলেছি। সে কথা আর ফুরাতে চায় না। বাস দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। বেলা ফুরিয়ে আসছে। একটু পর অন্ধকার নেমে আসবে। আজ হয়তো আর বাড়ি পৌঁছাতে পারবো না। ওমরপুরে নেমে আমাকে অপেক্ষা করতে হবে ভোরের জন্য। ভোরের দিকে ওখান থেকেই বাস পেয়ে যাব রামপুরহাট পৌঁছানোর।
হঠাৎ করে একবার মনের মধ্যে উঁকি দিল রুমার মুখ। আর কি দেখা হবে না রুমার সঙ্গে। আজকে যদি একবার দেখা হতো! হ্যাঁ রুমা, এবার সত্যি সত্যি আমার চাকরিটা হয়ে যাবে। এখন যদি তুমি থাকতে তাহলে তোমাকে বলতে পারতাম: “চলো রুমা, ঘর বাঁধবো, আর কেউ কিছু করতে পারবে না; আমি স্বনির্ভর হয়ে গেছি।” মনে পড়লো কলেজ ছাত্রী পাপিয়ার কথাও। চাকরি পেলে তাকেও তো বলা যেতে পারে! পুরুষ জীবনে এমন একটি বয়সে এসে পৌঁছেছি যে, আর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করা চলে না। ২০০২-ও প্রায় শেষ হতে চললো। আর কয়েকদিন পর এই ২০০৩ প্রবেশ করবে। তারুণ্যের সেই আবেগ আর নেই, অনেকটাই থিতিয়ে এসেছে। চারিদিক থেকেই কবিতা চেয়ে আমন্ত্রণ আসছে। ‘বৃষ্টিতরু’ নামে আরেকটি কাব্য প্রকাশ করেছে দৌড় পত্রিকা প্রকাশন। ছোট সাইজের কাব্যটি অনেকের কাছেই গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। ‘বৃষ্টিতরু’ নামটিতেও নাকি নতুনত্ব আছে। মালদহ ট্রেনিং কলেজে থাকার সময় লেখা এই কাব্যের কবিতাগুলি। নরম পেলব অথচ অসহিষ্ণু ভঙ্গুর এক জীবনদর্শন বৃষ্টিতরুরই রূপকের আশ্রয়ে রচিত এই কাব্য। শূন্যতাজীবী এক কবির আত্মভাঙনের প্লাবনে ভাসমান জীবন। যে জীবনের স্থিতি নেই, এলোমেলো স্বপ্ন, মৃত্যুর বিষণ্ণতায় কাতর হয়ে উঠেছে। 🍁(চলবে)
লিমেরিক
রণজিৎ সরকার-এর লিমেরিক
ঘোড়াড্ডিমের ছড়া
১.
ঘোড়াড্ডিমের বড়া করে ধরা পড়ি ঘোড়ার চালে
আড়াই চালে ঘোড়া মারা বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে
পিণ্ডিরামের পিণ্ডি চটকাই
সাতঘোড়ার হণ্ডা চাই
ঘোড়া টিপে বোড়া মারি সাতকাহনের সাঁঝসকালে
২.
আগডিম বাগডিম ঘোড়াড্ডিম রইল মাঝে
পাঁচুখুড়ো ছোটেন মাঠে সকাল সন্ধ্যা সাঁঝে
উঁকিঝুকি দিয়ে টুকি
পাঁচুখুড়ো নেন শুঁকি
ঘোড়া হয়ে বসেন তায়ে মুখটি তার অরুণ-লাজে
৩.
ঘোড়ার ডিমের প্রচ্ছদ হয়েছে দেখ কী বাহার
ডিম ফুটে বেরোল চেতক আহা বাহা তেজ তাহার
টগোবগো টগোবগো টক
ঘোড়া তো?নেই কোন শক
হ্রেষা রবে বলল হেঁকে রাখলে কোথায় আহার আমার
৪.
ঘোড়াড্ডিমের লেখায় ভরা লিমেরিকের ওয়াল
লিখিয়েরা আস্তাবলে দেয় উঁকি বাদ থাকে না গোয়াল
শুনেছি, আছে নাকি গোডিম
মোবাইলে ঢোকে গাছের সিম
ঘোড়াড্ডিমের সম্পাদকের ঘোড়ারোগে হচ্ছে ভারী পোয়াল
🍂অণুগল্প
স্ত্রীকে বোঝাতে পারে না, তার কষ্টের কথা। একটা বাইসাইকেল নিয়ে এ বাড়ি, ওবাড়ি টিউশন পড়িয়ে বেড়ানো,তারও ভালো লাগে না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য করতেই হয়। অহনা মুখে অনেক কিছু বললেও, অন্তরে কষ্ট উপলব্ধি করে অভিনন্দনের জন্য।
উঞ্ছবৃত্তি
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
অভিনন্দনের জীবনটা পরগাছার মতোই কাটলো।
উপদ্রুত কৈশোরে কিছুই চায়নি। চায়নি ঠিক নয়, পায়নি। বাবা ছিল লাঙল ঠেলা চাষা। সামান্য জমিজিরেত। টানাপোড়েনেই কেটে যেত অভাবি বিকেলগুলো। কাউকে বুঝতে দেয়নি , বুকের গোপন ক্ষতস্থানটা।
যৌবনে পা রাখতেই উচাটনের নগ্ন দুপুর। সাইকেল ঠেলে কলেজ যাওয়া, ব্যাকবেঞ্চার জীবন। এ সময় শোভনা জীবনে এসেছিল, কয়েকটা মাসের জন্য। সব তোলপাড় করে দিয়ে, পশ্চিমা অলিন্দের শেষ বিকেলের পাখির মত উড়ে গেল। রেখে গেলে, অবাঞ্চিত আয়োজনের স্মৃতি।
অহনা মুখে অনেক কিছু বললেও, অন্তরে কষ্ট উপলব্ধি করে অভিনন্দনের জন্য। শিক্ষিত হয়েও মানুষ তো একটা চাকুরী জোগাড় করতে পারেনি। বিনে পুঁজির এই রোজগারই রয়ে গেছে এ যাবৎ।
জীবনটা বিষন্ন সমুদ্রের মগ্নচূড়া।
এতগুলো বছর অতিবাহিতের পর আজও কেউ যখন অভিনন্দনকে জিজ্ঞেস করে, ভালো থাকার কথা। মনের সমস্ত নির্যাস ঢেলে সে বলতে পারে না, ভালো আছি। ভালো থাকাটাও এক ধরনের অধ্যয়ন। ভালো থাকার চর্চা কোনদিনই করেনি অভিনন্দন।
বরাবরই লেখালেখি, পড়াশুনো আর টিউশন এই নিয়েই কাটলো এতগুলো বছর। সামান্য কটা টাকার টিউশনি। তার উপর নির্ভর করে এই সোমত্ত সংসার। ভেসে থাকার চেয়ে ভরাডুবি বেশি।
অভিভাবকরা দুদিন কামাই করলে তিন দিনের দিন কথা শোনায়। টিউশন জীবিকাটা যেন কাজের মাসির মত। কথা শোনানোর তালে থাকেন অভিভাবকরা।
উপায় নেই, তাই এই জীবিকাটা নিয়েই পড়ে থাকা। মাসের শেষে পারিশ্রমিকটুকু চাইতে হয় কাউকে কাউকে। ভালো লাগে না এইসব উঞ্ছ বৃত্তি। তবুও এইসব বেসামাল সংসার সামলাতে এটাকে মেনেই নিতে হয় অভিনন্দনের।
অহনা বলেছিল,”এই কাজ ছেড়ে, অন্য কাজ খোঁজো। এভাবে জীবন চলে না। টানাপোড়েনে প্রয়োজনে মেটাতে পারিনা।”
নিরুত্তর হয়ে থেকেছে অভিনন্দন। ও স্ত্রীকে বোঝাতে পারে না, তার কষ্টের কথা। একটা বাইসাইকেল নিয়ে এ বাড়ি, ওবাড়ি টিউশন পড়িয়ে বেড়ানো,তারও ভালো লাগে না। কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য করতেই হয়।
অহনা মুখে অনেক কিছু বললেও, অন্তরে কষ্ট উপলব্ধি করে অভিনন্দনের জন্য। শিক্ষিত হয়েও মানুষ তো একটা চাকুরী জোগাড় করতে পারেনি। বিনে পুঁজির এই রোজগারই রয়ে গেছে এ যাবৎ।
অস্তিত্বের লড়াই নিয়ে মনের মধ্যে যুদ্ধ চলেছে সর্বদা। রোজ সাইকেলে সেই এক পথ ভাঙ্গা, অভিভাবকদের তাচ্ছিল্য নিয়ে বেঁচে থাকা। এইসব ভাবতে ভাবতে একদিন সকালে সাইকেল চালাচ্ছিল অভিনন্দন।
অতর্কিতে উল্টো দিক থেকে আসা একটি ট্রেকার গাড়ি ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তারপর বাকিটা ইতিহাস হয়ে গেল অভিনন্দনের জীবনে।🍁
🍂ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।
কিশাণগঞ্জের ফেলুদা
তাপস রায়
পর্ব ৫.
ফেলুদা চাইছিলেনই পাহাড়ে যেতে। সেখান থেকে একটা পাহাড়ী কুকুরের বন্দোবস্ত হয়ে যেতে পারে। উসমানি সাহেব আগেই যদি পঞ্চায়েতের টিকিট টা ধরিয়ে দিতেন, এত টেনশন হত না। কিন্তু নিজের মনোভঙ্গি টের পেতে না দিয়ে কথা ঘুরিয়ে দিতে ফেলুদা বললেন, “ আচ্ছা মালবাবু, যদি কিছু মনে না করেন, আপনার ব্যাঙ্কের পাস বইগুলো একটু দেখাবেন?”
বোঁদের খারাপ লাগল। এইসব ছিঁচকে গোয়েন্দাগিরি সে নিজে করবে। ফেলুদা কেন করবে! গুরু কেন এই সব ছোটোখাট ব্যাপারে মাথা গলাবে! সবাই ফেলুদাকে ঈশ্বরের সন্তানের মতো ভাবে। মানে যেকোনো অসাধ্য সাধন ফেলুদার তুড়িতে সম্ভব। এরকম গোয়েন্দার মতো প্রশ্ন করা গুরুর উচিত হয়নি। ফেলুদা যা কিছু করে তা, তার নিজের ইন্ট্যুইশন থেকে করে । আর সেসব ক্লিক করে একশ তে একশ। ব্যাংকের বই-টই তো দেখে থানার লোকেরা। তার গুরু অত নীচে নামবে কেন! ভাল লাগে না বোঁদের।
সুর করে পড়া ছাড়া আর কোনো বিলাসিতা তার নেই। হ্যাঁ টিভি একটা ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা দেখার সময় হয় না। সকালবেলায় ‘ওম’ টিভি চালিয়ে বাবা রামদেবকে বকর বকর করতে দিয়ে চানুমতি বাসন মাজা ঘর মোছার কাজ করে ফেলে। তারপর মালবাবু ঘুম থেকে ওঠার আগেই ছাগলের দুধের ঘন এক গ্লাস চা আর গোল গোল ঝুড়িভাজার দু’খানি ঘরের বাইরের খাটিয়ার সামনে একখানি কাঠের টুলের পরে রেখে সে স্নানে যায়। তারপর স্নান থেকে ফিরে সেই যে হেঁসেলে ঢুকল, আর নিস্তার নেই।
**
ঋতব্রত ফোনে বলেছে, “ বাবা, তিন লাখ টাকা দরকার হবে। ওটা একাউন্টে পাঠিও না। যদি হাতে হাতে দিয়ে যাও তো ভালো হয়। প্রাক্টিক্যাল আর কীসব কাজে স্কুল চাইছে।”
“ এই তো গত মাসে আমার অফিসের ছেলেটার হাতে একগাদা টাকা পাঠালাম। আবার এখন চাইছিস কেন?”
“ হ্যাঁ দিয়েছ, তাতে কি? তোমার টাকায় তো ছ্যাতলা ধরে যাবে! ” স্বরে যেন একটু রুক্ষ্মতা। মালবাবু বিচলিত হলেন। তার তুলতুলে ছেলেটা বোর্ডিং-এ গিয়ে যেন আজকাল একটু পালটে গেছে ! মনে হচ্ছে যেন অনেক বড়ো হয়ে গেছে।
কিন্তু এইসব টাকার খবর কে দিচ্ছে! চানুমতি মাঝেমধ্যে ঘরে টাকা গুনতে দেখলেও, সে তো কখনও কিছু জিজ্ঞাসা করে না। না না সে জানেও না কিছু। নিজের মনে বিড়বিড় করলেন মালবাবু।
মালবাবু সরকারের ঘর থেকে কত টাকা ঘরে আনে কোনোদিন জিজ্ঞাসা করেনি চানুমতি। চাল-ডাল নুন-তেলের অভাব নেই। বাজারঘাটের অভাব নেই। ফলে তার স্কুলফাইনাল পাশ না-করা মাথা বেশি খাটাতে চায় না চানুমতি, পারেও না। পারে ঘরে বসে গাধার মতো দিনভর সংসারের কাজ করতে। ভোরভোর ঘুম থেকে উঠে সেই তো ঘুমোতে যায় রাত এগারোটায়। এর ভেতর এক ঘন্টা স্নান আর এক ঘন্টা তুলসিদাসের রামচরিত মানসের দুই পাতা
সুর করে পড়া ছাড়া আর কোনো বিলাসিতা তার নেই। হ্যাঁ টিভি একটা ঘরে আছে বটে, কিন্তু তা দেখার সময় হয় না। সকালবেলায় ‘ওম’ টিভি চালিয়ে বাবা রামদেবকে বকর বকর করতে দিয়ে চানুমতি বাসন মাজা ঘর মোছার কাজ করে ফেলে। তারপর মালবাবু ঘুম থেকে ওঠার আগেই ছাগলের দুধের ঘন এক গ্লাস চা আর গোল গোল ঝুড়িভাজার দু’খানি ঘরের বাইরের খাটিয়ার সামনে একখানি কাঠের টুলের পরে রেখে সে স্নানে যায়। তারপর স্নান থেকে ফিরে সেই যে হেঁসেলে ঢুকল, আর নিস্তার নেই।
হ্যাঁ। তাহলে চানুমতির পক্ষে অন্য বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় থাকার কথা নয়। কিন্তু ছেলেকে টাকার খবর কে দিচ্ছে! চানুমতির যে সাহস হবে না তা-ও তিনি জানেন। মালবাবু খুব একটা ভাবতে চান না। এমনিতেই দু’দিন তিনি গঙ্গারামকে খাওয়াতে পারেননি। নিত্যকার কর্মপদ্ধতিতে ধাক্কা। আবার এই লাল খাতাগুলো উধাও হলো! শনির দশা ধরল না কি! না না বাজারের মোড়ে অশত্থতলায় এই শনিবারেই বড়ঠাকুরের পুজো বড় করে দিতে হবে। পুজোর শেষে থাকবে খিচুড়ির ব্যাবস্থা। খাইয়ে দিতে হবে। তাতে যদি গঙ্গারামের কোনো উপকার হয়। আর গঙ্গারাম প্যাড়া সন্দেশ খেতে ভালবাসে। খিচুড়ির সাথে আলু-কুমড়োর সবজি শুধু নয়, মালবাবু ঠিক করলেন প্যারা সন্দেশও এক-জোড়া করে দেবেন। তাঁর নিজের মনে ক্ষীন আশা গঙ্গারাম আশেপাসে কোথাও আচ্ছে। প্যারা-সন্দেশের গন্ধে ও যদি চলে আসে!
ফ্রি খিচুড়ির উপর ভরসা করে অনেক অল্প বৃত্তিধারী জীবন কাটিয়ে দেয়। ইসলামপুরের ইটভাঁটার ছ’জন লেবার চলে এসেছে প্রসাদ খেতে। না এমনি এমনি অতদূর থেকে আসেনি, পঁচিশ হাজার ইট ফেলার কথা। উসমানি সাহেবকে বলে বোঁদেকে পূর্বপাড়া উচ্চমাধ্যমিক স্কুল বিল্ডিং এর দোতলা বানানোর বরাত পাইয়ে দিয়েছেন ফেলুদা। পুরো পঁচিশ হাজার ফেলতে ফেলতে দুপুর হয়ে এসেছে কুলিদের। অনেকক্ষন থেকেই রান্নার গন্ধ নাকে আসছিল ইঁটের পাঁজা ফেলতে ফেলতে । দুপুরে সবাই মিলে ইটের ধুলো গা থেকে ঝেড়ে , পুকুরে হাত-পা ধুয়ে শনি মন্দিরের সামনে এসে দেখল, সস্তার টেবল চেয়ার পেতে শালপাতায় অনেক লোক খেতে লেগেছে। ওরাও বসে পড়ল। পেট পুরে খিচুড়ি, কুমড়োর তরকারি আর টমাটোর চাটনি খেয়ে উঠতে যাবে, তখনই একজন বড় একটা ঠোঙা হাতে সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ আহা, রোসো। আর একটু বাকি। শেষ পাতে মিষ্টি না হলে মানায় ! এই প্যারাসন্দেশ না দিলে মালবাবু খুবই রেগে যাবেন। তাঁর পুণ্য পূর্ণ হবে না যে ভাই। নাও নাও।”
চমকে উঠল নামটা শুনে। যে নামের বাপান্ত না করে দু’বেলা মুখে কিছুই কাটে না সুশান্ত, আজ তার দানের খাবার মুখে তুলতে হল! শালা বমিও আসছে না। বমি করে উগড়ে দিলে খানিকটা শান্তি হত। গা জ্বলে যাচ্ছে খুব। নিজের অজান্তে ডান হাত বাম কাঁধে উঠে এল। জামার নীচে আঙুল ঢুকে গেল কিছুদূর। খিচুড়ি খাওয়ার পর অন্য কুলিরা ট্রাকের দিকে চলে গেলেও সুশান্ত নন্দী শনি মন্দিরের চত্বরে ঘুরঘুর করতে লাগল। কিছু একটা ক্ষতি না করে পা সরছে না তার। একবার ভেবেছে সামনের মুদি দোকান থেকে একটু তুঁতে কিনে এনে যেখানে খিচুড়ি চড়েছে, সেই অস্থায়ী হেঁসেলে গিয়ে মিশিয়ে দেবে কিনা। তারপর পাবলিককে উস্কে মালবাবুকে পেটান খাওয়াতে পারলে তার হাড়ের জ্বালা জুড়োবে। কিন্তু হেঁসেলের দিকে দু-এক পা এগোতেই নোংড়া কাপড় জামা দেখে ভবঘুরে ভেবে কোনও কর্মকর্তা গোছের কেউ সুশান্তকে তাড়িয়ে দিল। সুশান্ত মনে মনে ঠিক করল, আজকে না হোক একদিন না একদিন দান আমার হাতে আসবেই, ঠিক শোধ নিয়ে নেব। মালবাবুকে না পাই ওর ছেলের উপর প্রতিশোধ তুলব। সুশান্ত খোঁজখবর নিচ্ছে অনেকদিন ধরে। মালবাবুর ছেলেটা কিশানগঞ্জে নয়, পাহাড়ে থাকে। ভেবেছে একদিন পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে মালবাবুর ছেলেকে। মালবাবুর বুকে শক্তিশেল পাঠানো যাবে তাতে।
কিশানগঞ্জের এই ছেলেটি, মানে ঋতব্রত চক্রবর্তী এগারো ক্লাসের অ্যাসেসমেন্ট-এ খুব খারাপ রেজাল্ট করেছে। অঙ্ক ঋতব্রতর প্রিয় বিষয়। ক্লাস এইট থেকে একশ তে একশ পায়, সে কিনা কুড়ি তে ছয়, সাত, আট পাচ্ছে!
ফিজিক্স-এ আট, অঙ্কে ছয়, কেমিস্ট্রি-তে সাত পেয়েছে। হেড মাস্টার নেল মন্টেরিও ভাবলেন একবার সুপারইন্টেন্ডেন্ট এস কে তামাং-কে ফোন করবেন কি না। ঋতব্রতর মতো এত ভালো আর মেধাবী ছেলেটা এমন করল কেন! মন্টেরিও তাঁর চাকরি জীবনের শুরু থেকেই প্রত্যেক ছাত্রের উপর নিয়ম মতো নজরদারি চালান। তাঁর নজরদারির ফলেই গ্রাহামস হোমের নামডাক গত পনেরো বছরে কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ো ছুঁতে গেছে। কত বদ ছেলে মেয়েকে যে তিনি সাসপেণ্ড করে দিয়েছেন। এমন কি পাস মার্কস পঁয়ত্রিস এর নীচে দু’বার কেউ যদি একই ক্লাসে পায়, তাড়িয়ে দিয়েছেন। স্কুলের নামের সামনে প্রভাব প্রতিপত্তি তিনি তেমন রেয়াৎ করেননি। এইতো গত বছরই প্রভাষ ছেত্রীর মেয়ে মণিকাকে ডিসচার্জ করে দিয়েছিলেন। মেয়েটা তুখোড় সুন্দরী। কিন্তু ক্লাস নাইন-এ দুটো হাফেই সব সাবজেক্টে ফেল করেছে সে। বাবা নাকি মুক্তি মোর্চার বড় নেতা। অনেকেই ভয় দেখিয়েছিল হেডমাস্টার মশাইকে। কিন্তু না নড়াতে পারেনি সিদ্ধান্ত থেকে।
ঋতব্রত সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। তিন লাখ টাকা জোগাড় করে ফেলেছে বাবাকে ভুজুং ভাজুং দিয়ে। মানে অসাধ্য সাধনের প্রথম স্টেজ কাটিয়ে উঠেছে। তাকে চিন্তায় ফেলেছে, ক্লাস এইট-এ ভর্তি হবার পর থেকে এই বোর্ডিং-এর কটেজে এই প্রথম বাবা এলো। আসবেই। সে-ই ফোনে বলেছে টাকাটা হাতে হাতে দিতে। কিন্তু ওই লোকটাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে কেন! সে তো পুলিশের মতো নানা প্রশ্ন করছে। তাহলে বাবা কি তাকে সন্দেহ করছে! কিন্তু ঋতব্রত জানে বাবা অন্ধ ছেলে ভক্ত। ছেলের কথার বাইরে তার ভাবার মতো কোনো ক্ষমতাই নেই। ছেলেকে সুন্দর করে মানুষ করার জন্যই তো বিহারের বোর্ডের স্কুল ছাড়িয়ে এই কালিম্পং-এ কনভেন্টে রেখে গেছে। 🍁(চলবে)
🍂ছোটগল্প
সিক্তার ঠোঁটে তখন ধরা এক চুপচাপ হাসি। ছুটির সকাল। হোমস্টের কাঠের বারান্দায় বসে ও দুধ-কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। পরাগ পাশেই বসে—চোখে-মুখে নিখাদ প্রশান্তি। দূরে চা-বাগানের শিশিরে ধুয়ে যাওয়া রোদ ঠিকরে পড়ছে তার চোখে।
“কি দেখছ?” সিক্তা জিজ্ঞেস করে।
তোমার চোখে জঙ্গলের সবুজ
সানি সরকার
কলেজের প্রথম দিনটা ছিল বর্ষার মতো—একেবারে হঠাৎ নেমে আসা, ভিজিয়ে দেওয়া। সেই ভিজেই দেখা হয়েছিল সিক্তা আর পরাগের। কলেজের করিডোরে দাঁড়িয়ে, হাতে ছাতা, মুখে অচেনা একটা আতঙ্ক। নতুন শহর, নতুন মানুষ, আর সেই ভিড়ের মধ্যে পরাগ—বাঁকা হাসি, কাঁধে ব্যাগ, কানে ইয়ারফোন ঝুলছে। তখনই প্রথম কথা হয়েছিল। পরাগ বলেছিল, “কলকাতার ট্রাফিক আর এমএনসি-এর প্রেসার—দু’টোই ভয়ানক। তবে গান আর পাহাড় এই দুই জিনিস আছে বলে বেঁচে আছি।”
সিক্তা হেসে বলেছিল, “তোমার চোখে পাহাড় কি রং?”
“সবুজ, নীল আর একটা ঘন নিঃশ্বাসের মত,” উত্তরটা এসেছিল অনায়াসে।
সেই থেকে শুরু। প্রেমটা হয়েছিল ধীরে ধীরে নয়, বরং একটা পাহাড়ি জলের মত—ধাঁ করে নেমে এসেছিল দু’জনের জীবনে। কলেজ পার করে চাকরি। কাজের চাপ। রাত জেগে প্রেজেন্টেশন বানানো। ক্লায়েন্টের হেনস্থা। মেট্রো। শেষ ট্রেন—সব কিছুর মধ্যেও রয়ে গিয়েছিল সেই প্রথম দিনের কথোপকথন।
পরাগ এখন চালায় একটি ছোট্ট অ্যাড এজেন্সি—নাম দিয়েছে ‘রঙিন’। কারণ সে বিশ্বাস করে, রঙ দিয়ে সব কিছু সাজানো যায়। রোজকার কাজের মধ্যে গান তার জীবনসঙ্গী—কখনও ‘পিঙ্ক ফ্লয়েড’, কখনও ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’। একটা গিটার রয়েছে, নাম দিয়েছে ‘তরাই’। সিক্তা এখন একটি নামজাদা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিনিয়র ম্যানেজার। চারপাশের কর্পোরেট কোলাহল আর কাজের ঠাসবুনোনের মধ্যেও তার ফোনে ‘হোয়াইট নয়েজ’ না, বাজে জলধ্বনি। সেই প্রথম দেখা থেকে এখনও তারা দু’জনে সন্ধেবেলা ভিডিও কলে গল্প করে। জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে—কোথাও হয়ত জঙ্গল, কোথাও শহরের বাতি।
তাদের সঙ্গে আরও ছিল মায়া আর তন্ময়। মায়া এক ছুটন্ত রিপোর্টার, খবরের পেছনে ছুটতে ছুটতে নিজের খবরটা প্রায় ভুলে গিয়েছে। আর তন্ময়? সে এক যাযাবর কোডার—স্টার্টআপে কাজ করে, আবার কাজ ফেলে পাহাড়ে চলে যায়। এই চারজন মিলে একটা বৃত্ত বানিয়েছিল—যেখানে ঘোরাঘুরি, প্রেম, বাস্তব আর রোমান্সের আঁচ মেশানো এক বুনন।
কলকাতা তাদের শিকড়। কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গন্ধ। গড়িয়ার ক্যাফের কফি। প্রিন্সেপ ঘাটে বসে হাওয়ার মধ্যে গানের খাতা খুলে ফেলা। কিংবা ভবানীপুরের পুরনো বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রোদ গায়ে মাখা—সবই ওঁদের রোজনামচা।
**
এক বিকেলে, পরাগ তার অফিসে বসে ক্লায়েন্ট মিটিং-এর মাঝপথে সিক্তার মেসেজ পেল—”চা খেতে ইচ্ছে করছে। পাহাড়ি চা। এই উইকএন্ডে পালাই?”
পরাগ হেসে বলল, “অবশ্যই। তরাই না হলে মাথা ধরে যায়।”
তন্ময় আর মায়াও রাজি হয়ে গেল। তারা ঠিক করল—’উড়ছে’’। উত্তরবঙ্গে। এক পুরনো হোমস্টে বুক করা হল—দার্জিলিং থেকে একটু নিচে, লেপচাজগৎ-এর পাশে। চারদিকে চা বাগান, কুয়াশা, আর রাতের নিস্তব্ধতা।
**
ট্রেন ছাড়ল নিউ জলপাইগুড়ির দিকে। জানালার ধারে বসে সিক্তা কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গুনগুন করছিল, “তুমি রবে নীরবে…” পাশে বসে পরাগ ছবি তুলছিল—ওঁর ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়ছিল সিক্তার চুলে বাতাসের খেলাগুলি।
এভাবে সময় ছুটল।
হোমস্টেতে পৌঁছে ওঁরা যেন এক অন্য জগতে পা দিল। ছিমছাম কাঠের ঘর, জানালার বাইরে পাহাড়ের ঢেউ, নিচে সবুজ চা বাগানের চাদর। মায়া বলল, “এখানে থেকেই যদি রিপোর্টিং করতাম!”
তন্ময় হাসল, “তাহলে আমিও পাহাড়ে কোড করতাম।” মায়া ফোড়ন কাটল, “ইন্টারনেট থাকলে তো!”
সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বসে গিটার হাতে নিল পরাগ। সিক্তা তার পাশে বসে রঙিন ওড়নাটা গায়ে মুড়িয়ে বলল, “একটা গান শোনাও।”
পরাগ গাইতে শুরু করল, “এই পথ যদি না শেষ হয়…”
সিক্তার চোখে জল টলটল করছিল। পরাগ জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
সিক্তা বলল, “ভেবেছিলাম কর্পোরেট লাইফে আমরা হারিয়ে যাব। তুমি যে এখনও এমন করে গান গাও, ভালবাসো, সেটাই আমার পাওনা।”
ওরা কখন কীভাবে দু’জন দু’জনকে সম্বোধন করে ভুলে যায়! পরাগ ওর হাত ধরল। “তুই যতই কর্পোরেট জগতে ঘোর, তোর ভিতরের সিক্তা তো পাহাড়েরই মেয়ে।”
ওঁরা নির্জনে হেঁটে বেড়াল—চা বাগানের মাঝের পথ ধরে, পাখির ডাকে থেমে থেমে। মায়া আর তন্ময় ছবি তুলছিল। হাসছিল। মাঝে মাঝে ঝগড়া করছিল। পাহাড়ের বাতাসে প্রেম ভেসে বেড়াচ্ছিল—সেই প্রেম যা শহরের কংক্রিটের নিচে চাপা পড়ে থাকে।
রাত নামলে তারা চারজন মিলে ক্যাম্পফায়ার করল। কাঠের আগুনে গরম হয়ে উঠছিল আঙুল, আর মনের ভিতরে জমে থাকা ঠাণ্ডা। সিক্তা বলল, “কলকাতায় ফিরে আবার কাজ, মিটিং, স্ট্যাটাস রিপোর্ট…”
পরাগ গম্ভীর হয়ে বলল, “তবে কেন ফিরি?”
তন্ময় হাসল, “আমরা কি পাহাড়ে বসেই একটা হোমস্টে চালাতে পারি না?”
মায়া বলল, “আর আমি সেখানে স্থানীয়দের জীবন নিয়ে রিপোর্ট করব। রোজকার শহুরে চেঁচামেচি থেকে দূরে। একটা শান্তির ঠিকানা।”
সিক্তা একটু চুপ করে থেকে বলল, “তবে কি আমরা একটা দ্বিতীয় জীবন ভাবতে পারি না?”
কেউ কিছু বলল না। আগুনের ধোঁয়া উঠতে থাকল আকাশের দিকে।
সকালবেলা সিক্তা ঘুম থেকে উঠে দেখল, পরাগ জানালার বাইরে তাকিয়ে। তার কাঁধে গিটার, ঠোঁটে গান।
সিক্তা পিছন থেকে জড়িয়ে ধরল। “চলো না, সত্যিই পালিয়ে যাই”।
পরাগ বলল, “চলো। কিন্তু পালিয়ে নয়—থাকতেই।”
ওঁদের চোখে তখন শহরের আলো নেই। ছিল কুয়াশার ভিতর একটা নতুন ঠিকানা খোঁজার যাত্রা।
ফেরার ট্রেনের টিকিট তারা ক্যানসেল করল। তন্ময় বলল, “আমার ল্যাপটপ আছে। কোড করব এখানেই।”
মায়া বলল, “আমার ক্যামেরা আছে। খবরের কাহিনি এখানেই খুঁজে পাব।”
সিক্তা আর পরাগ নতুন করে হোমস্টে-র প্ল্যান করল—নাম রাখল “নীল রঙ”। যেখানে থাকবে বই, গান, পাহাড় আর প্রেম।
শহর থেকে পালানো নয়—নিজেদের কাছে ফিরে আসার গল্প ছিল ওদের। আজ তারা হোয়াইট বোর্ডে টার্গেট সেট করে না। বরং জানালার পাশে বসে অতিথিদের কফি বানায়। পাহাড়ের গল্প বলে।
কখনও কখনও প্রেম শহর ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে গড়ায়—আর সেই গড়ানোই হয় জীবনের প্রকৃত গতিপথ। সিক্তা আর পরাগের গল্পটিও তা-ই। কলকাতার গলি থেকে শুরু। পাহাড়ের কুয়াশায় শেষ নয়—চিরকালীন হয়ে রয়ে যাওয়া।
কারণ, প্রেম যখন প্রকৃত হয়, তখন সে জঙ্গল, পাহাড়, শহর—সব পেরিয়ে নিজের ঠিকানা খুঁজে নেয়। দু’টি চোখ–!
পাহাড়ে হালকা কুয়াশা পড়ে। সময় বয়ে চলে ধীরে ধীরে। শহর ডাকে না আর। মোবাইলে মেসেজ আসে, মেইল ঢোকে, কাজের প্রস্তাব আসে—কিন্তু সিক্তা আর পরাগ জানে, তারা যা পেয়েছে, সেটা দামী পদ আর বড় বাড়ির চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
একটা গাছের নিচে বসে, চুপ করে শুধু হাত ধরা। অথবা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গিয়ে “তুই জানিস?” দিয়ে শুরু হওয়া গোপন কথা।
২.
সিক্তার ঠোঁটে তখন ধরা এক চুপচাপ হাসি। ছুটির সকাল। হোমস্টের কাঠের বারান্দায় বসে ও দুধ-কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। পরাগ পাশেই বসে—চোখে-মুখে নিখাদ প্রশান্তি। দূরে চা-বাগানের শিশিরে ধুয়ে যাওয়া রোদ ঠিকরে পড়ছে তার চোখে।
“কি দেখছ?” সিক্তা জিজ্ঞেস করে।
“তোমার মুখে সকালটা,” পরাগ গম্ভীর মুখে বলে।
সিক্তা হেসে ফেলে। “তুমি এখন অ্যাডের ছাঁচে কথা বলো।”
পরাগ সিগারেটটা নিভিয়ে দেয়। “না রে, তোকে দেখলে মাথার শব্দ থেমে যায়। সেই ‘ক্রিয়েটিভ ব্লক’ যেটা শহরে বসে কষ্ট করে আনা যেত না, সেটা এখানে তোকে দেখলেই হয়ে যায়। আমি নতুন করে ভাবতে পারি, গাইতে পারি, বাঁচতে পারি।”
সিক্তা চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। একটু লজ্জা পায়। কিন্তু পরাগ জানে, ওর ভেতরটা ঠিক আগুনের মতো জ্বলছে।
ওরা এখন পাহাড়েই থাকে। হোমস্টে চালায়, অতিথি আপ্যায়ন করে, সন্ধ্যায় গিটার বাজায়। কাজ চলে অনলাইনে, কিন্তু জীবন চলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে।
সেই রাতে সিক্তা ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়।
মেঝেতে টুকরো টুকরো পাপড়ি। খাটের ওপরে একখানা কাগজ। পরাগের হাতের লেখা—
“আজ আমি শুধু তোকে চাই—
পাহাড়ের মতো স্থির হয়ে,
জঙ্গলের মতো রহস্যময় হয়ে,
আর জলের মতো আমার চারপাশে।
থাকবি?”
সিক্তার বুক ধকধক করে। পরাগ জানালার ধারে দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা হালকা কুর্তা। হাতে তার সেই পুরনো গিটার ‘তরাই’। সে সুর তোলে, ধীরে ধীরে— যেন গানের ভিতরেই ওদের পুরনো দিনগুলো ঘুরে আসে।
“তুই জানিস?” পরাগ বলে, “তোকে প্রথম যেদিন দেখি, তখনই বুঝেছিলাম তুই শহরের মেয়ে হলেও তোর ভিতরে একটা গাছ আছে। যেটা সবুজে বাঁচতে চায়।”
সিক্তা ধীরে হাঁটে, কাছে গিয়ে পরাগের কাঁধে মাথা রাখে। “আর তুই?”
“আমি তোর ছায়া হতে চাই,” পরাগ ফিসফিস করে।
বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ছে। জানালার কাচ বেয়ে বৃষ্টি-ফোঁটা গড়িয়ে নামছে। ঠিক যেমন পরাগের হাতে তখন সিক্তার আঙুলগুলো— ধীরে ধীরে মিশে যাচ্ছে তার হাতের তালুতে।
রাত গভীর হয়। সেই রাত শহরের রাত নয়—কোনও শব্দ নেই। শুধু নিঃশ্বাসের গতি। পাখির ডানা ঝাপটার আওয়াজ। আর মাঝে মাঝে একে অপরের ঠোঁটের কাছে চলে আসা গোপন প্রতিজ্ঞা।
সিক্তা বলে, “আমরা কি সত্যিই ভালবাসি?”
পরাগ তার কপালে চুমু দিয়ে বলে, “তুই না থাকলে আমার গান ভুল হয়ে যেত। সেটা কি ভালবাসা নয়?”
সিক্তা বলে, “আমার সব ক্লান্তি তোর চোখে গলে যায়। সেটা কি ভালবাসা নয়?”
ওরা জানে, ভালবাসা মানে শুধু কবিতা নয়। কখনও পাহাড়ে সাইকেল চালাতে গিয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়া। অথবা অতিথিদের কমপ্লেন শুনে রাত জাগা। তবু, সেই পরিশ্রমের মাঝে যে দু’মুঠো হাঁসফাঁস করা সময় থাকে, সেটা তাদের প্রেমের কেন্দ্রবিন্দু।
সেদিন সকালে, তারা দুজনে চা বাগানের ভিতর হাঁটছিল। হঠাৎ সিক্তা থেমে দাঁড়ায়।
“তুই যদি একদিন চলে যাস?” ওর কণ্ঠে ভয়।
পরাগ ওর হাত ধরে বলে, “তুই কোথাও যাবি না, আমি যাব না। আমরা যদি যাইও, একসঙ্গে যাব। যেমন এসেছিলাম।”
সিক্তা চোখ বন্ধ করে বলে, “তুই আমার জলের মতো। আমি যেদিকে যাব, তুই আমাকে ঘিরে থাকবি?”
পরাগ হাসে। “তুই নদী হলে আমি তোর পাথর হব। তোকে বয়ে নিয়ে যাব, কাঁপিয়ে তুলব, আবার শান্ত করব।”
সেই বিকেল, তারা ধরা পড়েছিল এক কাপল হিসেবে—not just in love, but in sync. শহরের ব্যস্ত প্রেম না, বা মোবাইল স্ক্রিনে আটকে থাকা মেসেজের প্রেমও না—এটা ছিল নিঃশব্দের প্রেম। পাহাড়ের বুকের গভীরে কুয়াশার ভেতর হারিয়ে যাওয়ার প্রেম।
রাত নামলে তারা জানলার কাছে দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় নিজেদের ছায়া দেখে। সিক্তা ধীরে বলে, “তুই কি জানিস? তোকে ছুঁতে গেলেই আমার ভিতরটা জঙ্গল হয়ে ওঠে—আলোছায়া, শব্দহীনতা আর রহস্যে ভরা।”
পরাগ তার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে বলে, “তোর ভালবাসা আমার শ্বাস। তোকে ছাড়া আমি নিঃশ্বাস ফেলতে ভুলে যাই।”
হঠাৎ দূরে বাজ পড়ে, আকাশে বিদ্যুৎ ছুটে যায়। সিক্তা একটু কেঁপে ওঠে। পরাগ ওকে জড়িয়ে ধরে। ওদের ভালবাসা তখন যেন প্রকৃতির মত—রুক্ষ, গভীর, অথচ কোমল। কিংবা তার থেকেও স্নিগ্ধ…
সেই রাতে বৃষ্টির শব্দে ঢেকে গিয়েছিল তাদের সমস্ত কথা। শুধু দুটো নিঃশ্বাস একসঙ্গে মিশে গিয়েছিল, চুপিচুপি, ধীরে ধীরে।
৩.
শীতের সকাল। চা বাগানের ধারের সেই ছোট্ট হোমস্টেটির রোদেলা বারান্দায় এক কাপ গরম দুধ চা আর মাটির টবে বসে থাকা বাগান গাঁদার পাশে বসে আছে সিক্তা। লাল চাদর মুড়ি দিয়ে, মুখে একরাশ শান্তি। বারান্দার বাঁ-দিকে রাখা সেই কাঠের বেঞ্চিতে গিটার কোলে নিয়ে বসে পরাগ, গুনগুন করে গাইছে—
“তুমি আমার আকাশে চন্দ্রবদন,
তুমি আমার নির্জন সকালের ধ্বনি…”
সিক্তা হাসে। “তুমি আবার রবীন্দ্রসঙ্গীতে ফিরলে কবে?”
পরাগ বলে, “তুই পাহাড়ে থাকলে, রবীন্দ্রনাথ নিজেই গলায় এসে বসে পড়েন।”
সিক্তা এক চুমুকে চা শেষ করে বলে, “তুই জানিস, এই বাড়িটা এখন আমার শরীরের মতো হয়ে গেছে। যে জানালায় তুই দাঁড়াস, সেটা আমার চোখের মতো। আর যে বাগানে আমি গাছ লাগাই, সেটা আমার বুক।”
পরাগ ওর পাশে এসে বসে। ওর হাতে হাত রাখে। “আর তুই আমার সময়। তুই না থাকলে সকাল নামে না, সন্ধ্যা নামে না।”
এই কথাগুলো আজকাল তারা প্রায়ই বলে। অথচ একটুও ক্লিশে লাগে না। কারণ, এগুলো তাদের প্রতিদিনকার ছোট ছোট অনুভব।
ভালবাসা এখন তাদের কাছে নতুন কিছু নয়। বরং পুরনো, চেনা, আর একেবারে শরীরের অভ্যাসের মতো।
রাতে সিক্তা রান্না করে। পরাগ থালা সাজায়। মাঝে মাঝে পরাগ গুনগুন করতে করতে বলে, “এই যে ডালটা করলি, জানিস এর মধ্যে ঠিক সেই গন্ধটা আছে যেদিন কলেজের ক্যান্টিনে প্রথম তোর হাতের রান্না খেলাম।”
সিক্তা হেসে বলে, “তুই তো সবকিছুর মধ্যে প্রেম খুঁজে নিস।”
পরাগ চোখে চোখ রাখে। “না রে, আমি প্রেমের মধ্যে সবকিছু খুঁজি। তোর পাশে থাকলে ঘাসও গোলাপ মনে হয়।”
সেই রাতে বৃষ্টির পর আকাশ পরিষ্কার। তারা দু’জনে ছাদে উঠল। মাথার উপর একখানা বিশাল তারা ভরা আকাশ। সিক্তা বলে, “তুই কি জানিস? আমি তোকে নিয়ে কোনওদিন কোনও ভয় পাই না। কারণ আমি জানি, তুই সবটুকু আমায় দিয়ে দিয়েছিস।”
পরাগ তার গাল ছুঁয়ে বলে, “আর তুই আমাকে ধৈর্য কী সেটা শিখিয়েছিস। ভালবাসা তো শুধু ছোঁয়া নয়। ভালবাসা হল, তুই কাজ করতে করতে মাথা নিচু করে থাকলেও, আমি তোর চুলের গন্ধে শান্তি পাই।”
টুকটাক কথা। নীরবের মাঝে আলোড়িত হওয়া। তার ভেতর ওরা ছাদের মধ্যে একেঅপরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকে। কুয়াশা ধীরে ধীরে নেমে আসে। ওরা কথা বলে না। শুধু পরস্পরের উপস্থিতি উপভোগ করে।
ভোরের দিকে ঠাণ্ডা বেড়ে যায়। সিক্তা ঘুমঘুম চোখে বলে, “চল, ঘরে যাই?”
পরাগ জড়িয়ে ধরে বলে, “চল, তোর কাঁথার ভাঁজে ঢুকে পড়ি।”
আর সেই কাঁথার নিচেই, গায়ের গন্ধে, নিঃশ্বাসের ভিতর ভালবাসা আরও পেকে ওঠে—ধীরে ধীরে, যেমন শীতের রাতে ধোঁয়া ওঠা কফির কাপটা উষ্ণতা ছড়ায়!
সিক্তা জানে, পরাগ তার চিরকাল। পরাগ জানে, সিক্তা তার গান হয়ে গিয়েছে। এখন সে নতুন কিছু লেখে না। শুধু সিক্তার চোখে তাকিয়ে পুরনো সুরগুলোতেই নতুন রং খুঁজে পায়।
একদিন সকালে, ঘুম ভাঙার সময়, সিক্তা বলল, “তুই জানিস, আমি তোর পাশে ঘুমাতে গিয়ে ঘুমাতে ভুলে যাই অনেক রাত?”
পরাগ চমকে তাকাল, “মানে?”
“মানে, আমি তোকে দেখি। তোর নিঃশ্বাস, তোর ঘুমের ভঙ্গি, তোর বুকের ওঠানামা—সব দেখি। আর ভাবি, জীবনে এমন করে যদি কাউকে পেয়ে যাওয়া যায়, তাহলে আর কিছু চাওয়ার থাকে?”
পরাগ ওর কপালে চুমু দেয়। “তুই না থাকলে আমি এসব বুঝতাম না। তুই ভালবাসা মানে শিখিয়েছিস।”
পাহাড়ে হালকা কুয়াশা পড়ে। সময় বয়ে চলে ধীরে ধীরে। শহর ডাকে না আর। মোবাইলে মেসেজ আসে, মেইল ঢোকে, কাজের প্রস্তাব আসে—কিন্তু সিক্তা আর পরাগ জানে, তারা যা পেয়েছে, সেটা দামী পদ আর বড় বাড়ির চেয়ে অনেক অনেক বেশি।
একটা গাছের নিচে বসে, চুপ করে শুধু হাত ধরা। অথবা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থেমে গিয়ে “তুই জানিস?” দিয়ে শুরু হওয়া গোপন কথা। অথবা রাতে চাঁদের আলোয় জানালায় দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে চুপ করে থাকা। সেটাই তাদের প্রেম।
এটাই শেষ নয়।
এটাই অনন্ত।
ভালবাসা এমনই হয় যখন দুই মানুষ শুধু একে অপরকে চায়—not for fixing each other, but simply for being there. সিক্তা আর পরাগ শুধু একে অপরের প্রেমিক নয়, তারা একে অপরের রোদ, বৃষ্টি, ঘুম, শ্বাস।
তারা এখন জানে—
সব ঠিকানা হারিয়ে গেলেও,
পাহাড় বা জঙ্গল বদলে গেলেও,
একটা ঠিকানা রয়ে যাবে চিরকাল—
দু’টি প্রাণের ভেতর একটি ঘন জঙ্গল, সবুজ। অনন্ত।🍁
সম্পাদক : দেবব্রত সরকার, কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার, অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
