Sasraya News

Sasraya News Sunday’s Literature Special | 18th May 2025| Sunday, Issue 65| সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৮ মে ২০২৫, রবিবার | সংখ্যা ৬৫

Listen

 

🍂মহামিলনের কথা 

শ্রীশ্রীগুরবে নমঃ
সীতারাম! তোমার কিছু ভাবতে হবে না, শুধু রাম রাম করে যাও, কোথা দিয়ে কি হয়ে যাবে টেরও পাবে না। উদ্বিগ্ন হয়ো না, কেবল রাম রাম কর,জয়গুরু, সোহহং শোন আরও কত কি মা গান গাচ্ছেন শোন, রাম রাম কর।।
সীতারাম! দিনের পর রাত আসে, দিনকে কোন চেষ্টা, কোন সাধনা করতে হয় না; আপনা আপনি রাত এসে তাকে বিশ্রাম দেয়। তেমনি যা প্রয়োজন কোথা দিয়ে কেমন করে আসবে তা জানতেও পারবে না, কেবল রাম রাম কর।।
সীতারাম! শীতের পর বসন্ত ঋতু আসে, গাছের পাতা ঝরে যায়, আবার আপনা আপনি পাতা গজায়। পাতা ঝরা বা গজাবার জন্য গাছদের কোন চেষ্টা করতে হয় না—মা আমার আপনি সব করে দেন, তোমার সেই মা আছেন। তুমি রাম রাম কর, কি করে কি হবে বুঝতেও পারবে না।।
সীতারাম! রামনাম রসায়ন। মন প্রাণ দেহ সকলকে সুস্থ রাখতে এমন রসায়ন আর হয় নাই, এ মূল্য দিয়ে কিনতে হয় না, এর অনুপান কিছু নাই, দেশকালের কোন নিয়ম নাই, তুমি পান কর, যত পার পান কর, একবারে রোগ সেরে যাবে। কেবল রাম রাম কর।।
সীতারাম! রোগ তো বহুদর্শন! এক ঠাকুরটি বহু সেজে খেলা করছেন,সব সেজে তিনিই আছেন এই সত্যকে ধরতে পারলেই ছুটি হয়ে গেল, কেবল রাম রাম কর।।
সীতারাম! মাটির হাঁড়ি,কলসী,সরা মাটি ছাড়া কিছু নয়। সোনার হার, মাকড়ী, অনন্ত, বালা সোনা ভিন্ন অন্য কিছু নয়, তেমনি জগতে যা কিছু দেখছো সেই একজন। সেই মা,সেই বাবা,তুমি রাম রাম কর।।
🍁ঋণ : শ্রীউজ্জীবন || শ্রীওঙ্কারনাথ রচনাবলী

 

 

 

🍂ফিরেপড়া | গল্প 

 

 

জলধরকে বললাম, ‘কি হে ডিটেকটিভ। এই বেলা যে তোমার চোরধরা বুদ্ধি খোলে না, তার মানেটা কি বল দেখি?’ জলধর বলল, ‘আমি কি আর বুদ্ধি খাটাচ্ছি না? সবুর করো-না।’ তখন সেখুব সাবধানে আমাদের কানে কানে একথা জানিয়ে দিল যে স্কুলের যে নতুন ছোকরা বেয়ারা এসেছে তাকেই সেচোর বলে সন্দেহ করে, কারণ সেআসবার পর থেকেই চুরি আরম্ভ হয়েছে।

 

 

ডিটেকটিভ

সুকুমার রায়

সুকুমার রায়

জলধরের মামা পুলিশের চাকরি করেন, আর তার পিসেমশাই লেখেন ডিটেকটিভ উপন্যাস। সেইজন্য জলধরের বিশ্বাস যে, চোর-ডাকাত, জাল-জুয়াচোর জব্দ করবার সবরকম সংকেত সেযেমন জানে, এমনটি তার মামা আর পিসেমশাই ছাড়া কেউ জানে না। কারও বাড়িতে চুরিটুরি হলে জলধর সকলের আগে সেখানে হাজির হয়। আর কে চুরি করল, কী করে চুরি হল, সেথাকলে অমন অবস্থায় কী করত এ-সব বিষয়ে খুব বিজ্ঞের মতো কথা বলতে থাকে। যোগেশবাবুর বাড়িতে যখন বাসন চুরি হল, তখন জলধর তাদের বলল, ‘আপনারা এইটুকু সাবধান হতে জানেন না— চুরি তো হবেই। দেখুন তো ভাঁড়ার ঘরের পাশেই অন্ধকার গলি, তার ওপর জানলার গরাদ নেই। এক‘টু সেয়ানা লোক হলে এখান দিয়ে বাসন নিয়ে পালাতে কতক্ষণ। আমাদের বাড়িতে ও-সব হবার জো নেই। আমি রামদিনকে বলে রেখেছি, রোজ রাত্রে জানলার কাছে চাতালের উপর বাসনগুলো রেখে দিতে। চোরের বাছা যদি আসতে চান, জানলা খুলতে গেলেই বাসনপত্র সব ঝন ঝন করে মাটিতে পড়বে। চোর জব্দ করতে হলে এ-সব কায়দা জানতে হয়।’ সেসময়ে আমরা সকলেই জলধরের বুদ্ধির খুব প্রশংসা করেছিলাম। কিন্তু পরের ‘দিন যখন শুনলাম সেই রাত্রেই জলধরদের বাড়িতে মস্ত চুরি হয়ে গেছে, তখন মনে হল আগের দিন অতটা প্রশংসা করা উচিত হয়নি।

এমন সময়ে হঠাৎ ঘরের বাঁদিকের জানলাটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভেতর থেকে ঠেলছে। তারপরেই সাদা মতন কী—একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম একটা মোটা হুলো বেড়াল, তার মুখে জলধরের সরভাজা।

জলধর কিন্তু তাতেও কিছুমাত্র দমেনি। সে বলল, ‘আমি যেরকম প্ল্যান করেছিলাম, তাতে চোর একবার বাড়িতে ঢুকলে তাকে আর পালাতে হত না কিন্তু ওই আহাম্মক রামদিনটার বোকামিতে সব মাটি হয়ে গেল। যাক, আমার জিনিস চুরি করে তাকে আর হজম করতে হবে না। বাছাধন যেদিন আমার হাতে ধরা পড়বেন, সেদিন বুঝবেন ডিটেকটিভ কাকে বলে। কিন্তু যাহোক চোরটা খুব সেয়ানা বলতে হবে। যোগেশবাবুদের বাড়িতে যেটা গেছিল সেটা আনাড়ির একশেষ। আমাদের বাড়িতে এলে সেব্যাটা টের পেত।’ কিন্তু দুমাস গেল, চারমাস গেল, ক্রমে প্রায় বছরও কেটে গেল, কিন্তু সেচোর আর ধরা পড়ল না।

চোরের উপদ্রবের কথা আমরা সবাই ভুলে গেছি, এমন সময়ে হঠাৎ আমাদের স্কুলে আবার চুরির হাঙ্গামা শুরু হল। ছেলেরা অনেকে টিফিন নিয়ে আসে, তা থেকে খাবার চুরি যেতে লাগল। প্রথমদিন রামপদর খাবার চুরি যায়। সেবেঞ্চির উপর খানিক টা রাবড়ি আর লুচি রেখে হাত ধুয়ে আসতে গেছে—এর মধ্যে কে এসে লুচিটুচি বেমালুম খেয়ে গিয়েছে। তারপর ক্রমে আরো দু-চারটি ছেলের খাবার চুরি হল। তখন আমরা জলধরকে বললাম, ‘কি হে ডিটেকটিভ। এই বেলা যে তোমার চোরধরা বুদ্ধি খোলে না, তার মানেটা কি বল দেখি?’ জলধর বলল, ‘আমি কি আর বুদ্ধি খাটাচ্ছি না? সবুর করো-না।’ তখন সেখুব সাবধানে আমাদের কানে কানে একথা জানিয়ে দিল যে স্কুলের যে নতুন ছোকরা বেয়ারা এসেছে তাকেই সেচোর বলে সন্দেহ করে, কারণ সেআসবার পর থেকেই চুরি আরম্ভ হয়েছে।

আমরা সবাই সেদিন তার উপর চোখ রাখতে শুরু করলাম। কিন্তু দুদিন না যেতেই আবার চুরি। পাগলা দাশু বেচারা বাড়ি থেকে মাংসের চপ এনে টিফিন ঘরের বেঞ্চের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, কে এসে তার আধখানা খেয়ে বাকিটুকু ধুলোয় ফেলে নষ্ট করে দিয়েছে। পাগলা তখন রাগের চোটে চিৎকার করে, গাল দিয়ে ইস্কুলবাড়ি মাথায় করে তুলল। আমরা সবাই বললাম, ‘আরে চুপ চুপ, অত চেঁচাস নে। তা হলে চোর ধরা পড়বে কি করে?’ কিন্তু পাগলা কি সেকথা শোনে? তখন জলধর তাকে বুঝিয়ে বলল, ‘আর দুদিন সবুর কর, ওই নতুন ছোকরাটাকে আমি হাতেনাতে ধরিয়ে দিচ্ছি—এ সমস্ত ওরই কারসাজি।’ শুনে দাশু বলল, ‘তোমার যেমন বুদ্ধি ওরা হল পশ্চিমা ব্রাহ্মণ, ওরা আবার মাংস খায় নাকি? দারোয়ানজিকে জিজ্ঞাসা কর তো?’ সত্যিই তো। আমাদের তো সেখেয়াল হয়নি। ও ছোকরা তো কতদিন রুটি পাকিয়ে খায়, কই, একদিনও তো ওকে মাছ-মাংস খেতে দেখি না। দাশু পাগলা হোক আর যাইহোক, তার কথা‘টা সবাইকে মানতে হল।

জলধর কিন্তু অপ্রস্তুত হবার ছেলেই নয়। সেএকগাল হেসে বলল, ‘আমি ইচ্ছে করে তোদের ভুল বুঝিয়ে ছিলাম। আরে, চোরকে না ধরা পর্যন্ত কি কিছু বলতে আছে—কোনো পাকা ডিকেটটিভ ওরকম করে না। আমি মনে মনে যাকে চোর বলে ধরেছি, সেআমিই জানি।’

তারপর ক-দিন আমরা খুব হুঁশিয়ার ছিলাম; আট-দশ দিন আর চুরি হয়নি। তখন জলধর বললে, ‘তোমরা গোলমাল করেই তো সব মাটি করলে। ‘চোরটা টের পেয়ে গেল যে আমি তার পেছনে লেগেছি। আর কি সেচুরি করতে সাহস পায়? তবু ভাগ্যিস তোমাদের কাছে আসল নামটা ফাঁস করি নি।’ কিন্তু সেইদিনই আবার শোনা গেল স্বয়ং হেডমাস্টার মহাশয়ের ঘর থেকে তার টিফিনের খাবার চুরি হয়ে গেছে। আমরা বললাম, ‘কই হে? চোর না তোমার ভয়ে ‘চুরি করতে পারছিল না? তার ভয় যে ঘুচে গেল দেখছি।’

তারপর দুদিন ধরে জলধরের মুখে আর হাসি দেখা গেল না। চোরের ভাবনা ভেবে ভেবে তার পড়াশুনা সব এমনি ঘুলিয়ে গেল যে পন্ডিতমশায়ের ক্লাশে সেআরেকটু হলেই মার খেত আর কি! দুদিন পরে সেআমাদের সকলকে ডেকে একত্র করল আর বলল তার চোর ধরবার বন্দোবস্ত সব ঠিক হয়েছে। টিফিনের সময়ে সেএকটা ঠোঙায় করে সরভাজা লুচি আর আলুর দম রেখে চলে আসবে। তারপর কেউ যেন সেদিকে না যায়। ইস্কুলের বাইরে যে জিমন্যাস্টিকের ঘর আছে সেখানে থেকে লুকিয়ে টিফিনের ঘরটা দেখা যায়। আমরা কয়েকজন বাড়ি যাবার ভান করে সেখানে থাকব। আর কয়েকজন থাকবে উঠোনের পশ্চিম কোণের ছোটো ঘরটাতে। সুতরাং চোর যেদিক থেকেই আসুক, টিফিন ঘরে ঢুকতে গেলেই তাকে দেখা যাবে।

সেদিন টিফিনের পর পর্যন্ত কারও আর পড়ায় মন বসে না। সবাই ভাবছে কতক্ষণে ছুটি হবে আর চোর কতক্ষণে ধরা পড়বে। চোর ধরা পড়লে তাকে নিয়ে কী করা যাবে সেবিষয়েও কথাবার্তা হতে লাগল। মাস্টারমহাশয় বিরক্ত হয়ে ধমক দিতে লাগলেন, পরেশ আর বিশ্বনাথকে বেঞ্চির উপর দাঁড়াতে হল—কিন্তু সময়টা যেন কাটতেই চায় না। টিফিনে ছুটি হতেই জলধর তার খাবারের ঠোঙাটি টিফিন ঘরে রেখে এল। জলধর, আমি আর দশ-বারোজন উঠোনের কোণের ঘরে রইলাম আর একদল ছেলে বাইরে জিমন্যাস্টিকের ঘরে লুকিয়ে থাকল। জলধর বলল, ‘দেখ, চোরটা যেরকম সেয়ানা দেখছি আর তার যেরকম সাহস, তাকে মারধর করা ঠিক হবে না। লোকটা নিশ্চয়ই খুব ষন্ডা হবে। আমি বলি সেযদি এদিকে আসে তাহলে সবাই মিলে তার গায়ে কালি ছিটিয়ে দেব আর চেঁচিয়ে উঠব। তা হলে দারোয়ান-টারোয়ান সব ছুটে আসবে। আর লোকটা পালাতে গেলেও ওই কালির চিহ্ন দেখে ঠিক ধরা যাবে।’ আমাদের রামপদ বলে উঠল, ‘কেন? সেযে খুব ষন্ডা হবে তার মানে কী? সেতো কিছু রাক্ষসের মতো খায় বলে মনে হয় না। যা চুরি করে নিচ্ছে—সেতো কোনোদিনই খুব বেশি নয়।’ জলধর বলল, ‘তুমিও যেমন পন্ডিত রাক্ষসের মতো খুব খানিকটা খেলেই বুঝি খুব ষন্ডা হয়। তা হলে তো আমাদের শ্যামাদাসকেই সকলের চেয়ে ষন্ডা বলতে হয়। সেদিন ঘোষেদের নেমতন্নে ওর খাওয়া দেখেছিলে তো! বাপু হে, আমি যা বলেছি তার ওপর ফোড়ন দিতে যেয়ো না; আর তোমার যদি নেহাত বেশি সাহস থাকে, তুমি গিয়ে চোরের সঙ্গে লড়াই কোরো। আমরা কেউ তাতে আপত্তি করব না। আমি জানি, এ-সমস্ত নেহাত যেমন-তেমন চোরের সাধ্য নয়—আমার খুব বিশ্বাস, যে লোকটা আমাদের বাড়িতে চুরি করেছিল, এ-সব তারই কান্ড।’

এমন সময়ে হঠাৎ ঘরের বাঁদিকের জানলাটা ফাঁক হয়ে গেল, যেন কেউ ভেতর থেকে ঠেলছে। তারপরেই সাদা মতন কী—একটা ঝুপ করে উঠোনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। আমরা চেয়ে দেখলাম একটা মোটা হুলো বেড়াল, তার মুখে জলধরের সরভাজা। তখন যদি জলধরের মুখখানা দেখতে, সেএক বিঘৎ উঁচু হাঁ করে উঠোনের দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন হে ডিটেকটিভ। ওই ষন্ডা চোরটাই তো তোমার বাড়িতে চুরি করেছিল? তা হলে এখন ওকেই পুলিসে দেই?’🍁

 

 

🍂কবিতা 

 

অশোক কুমার রায়-এর দু’টি কবিতা 

যাযাবর যাত্রা

যখন ছিলাম সবার মাঝে
ছিলাম বেশ।
যখন থাকবো না আর
সবার মন থেকে মুছে যাবে
রেশ।
দু’দিনের দুপা হাঁটার
এইতো জীবন।
কি হবে সতরঞ্চি বিছিয়ে?
এযে পরদেশ!
ওপারে দেখা যায়
কুটির ঘরে আলো
প্রিয়া বোধ হয় ওইখানেতে
সাজিয়ে রাখে ধান দুব্বা
আরো কত আয়োজন‌ও।
যাব যাব চলে
সুখ দুঃখ বেদনার দেশ ছেড়ে।
পড়ে থাকে শুধু স্মৃতির বোঝা
অনাদরে।
এ যেন অনন্ত যাত্রা
যাযাবর বেশে।
কোথায় তাঁবু ফেলি
কোন যে দেশে।

 

সুজাতা বিকলাঙ্গ

কেন যে চিনলাম না নিজেকে
বৃষ্টির জলে জেগে উঠলেও উর্বর কামনা
শরীর মনে এ কোন ব্যাধি বাঁধে বাসা।
জেগে ওঠে সাম্রাজ্য বাসনা।
যে খেতে বেড়ে উঠে বিচালি
বাছতে পারি না পুষে রাখি।
যেন কালিদাস বোকা!
খায় আপন শরীর নানা কীটপোকা।
কবে আর জেগে উঠবো
জাগতে পারিনা যেন মৃত লাশ।
স্খলিত বৌদ্ধ সংগ্রহ
কে বিলোবে?
সুজাতা যে বিকলাঙ্গ হায়রে পরিহাস।

 

 

সুদীপ বাগ-এর কবিতাগুচ্ছ

চাতুর্য

চাতুর্য আকর্ষণ ব্যর্থতা উভয় পক্ষে
নষ্টামী অবৈধ বিষাক্ত লালার ফসল
বিলাসী ধর্ষিতার কঙ্কাল সে কথা বলেনি
কলঙ্কিত কুৎসিত পৌরুষের ব্যর্থ সাফল্য
বেদনায় কাতর প্রসব যন্ত্রনায় শান্তি মাতৃত্বে

 

চমকায়

ঠাওর করতে পারেনি জিহ্বা ভাতের স্বাদ
দাবদাহ চাঙ্গর পোড়ায় সবজ ডগা
স্বাদহীন দারিদ্র্যের স্বস্তির একমুঠো ভাতে
স্বপ্ন ভেসে আসে পর্দায় বাতাসে তারে
আকাশ কুসুম কল্পনা আকাশে ওড়ে

 

চলন

অম্লান প্রতিবিম্ব বন্দি খাঁচায় প্রজাপতি
কোষে উচ্চ স্বরে সোনালী ধান ক্ষেতে
গৈরিক বসন্তে অঙ্গে অঙ্গে ফুলে ফুলে মাখে রেনু
ভুবন ভোলানো দৌড় প্রতিযোগিতায় যাত্রাপথ শুরু

 

ঘুরে ফিরে

সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রগাঢ় অনুভূতি চুম্বন রেখায়
বর্ষার মেঘে ঢাকা আকাশ কুসুম স্বপ্নের জাল
স্বার্থ চিন্তা লোভের লালসা কাঁপায় অন্ধকারে পাথর
জীবনের জানালা খোলা অন্ধকার চোরা গলিতেই

 

 

সুদীপা বসু-এর তিনটি কবিতা 

অনুভবে

কেউ কথা রাখেনা
সব্বাই ভুলে যায় স্রোতের তাগিদে
মনুষ্যত্ব লুকিয়ে পড়ে আস্তিনের খাঁজে
আমরা দিন রাত এক করে
ফেরি করি প্রতিদিনের যাবতীয় স…ব
শুধু অবহেলায় প্রতিশ্রুতির চিরকুটখানা!

কোনো ভ্রক্ষেপ নেই
কালরাতে—
ঝড়ের দাপটে যে পাখিটা মারা গেছে
শোকের আবহে প্রকৃতি চঞ্চল
সমুদ্র, পাহাড়, ঝর্ণার জল ঝরে গেছে অবিরত
শুধু মনুষ্যত্ব সরে গেছে অনায়াসে
একা পড়ে আছে সে-ই!

তবু ও মানুষ বাঁচে
প্রেম আসে অতি সন্তর্পনে
হাওয়ায় হাওয়ায় তার গতি বদলায়
দেশ কাল ভেদ করে জটাজাল ছিঁড়ে
মিলিত স্রোতের ধারা সাগর সঙ্গমে
দূর্বারবেগে নৈকট্যের শ্বাসে।

জড়ানো নিবিড় অনুভবে
জীবন তো চলমান
গতি অনবরত স্রোতের বিরুদ্ধে
কখনো শিশিরে কখনো ঝর্ণায়
কখনো মেঘমল্লার সুরে উজ্জয়িনী ছায়া।

 

গভীর আঁধার

তোমার পাওনা
তুমি বুঝে নেবে নিজে;
তোমার রাস্তা ঠিক না বেঠিক
তোমার চিন্তা কতটা সঠিক
প্রশ্ন করো নিজেই নিজেকে
উত্তর সহজে।

ঠিক মতো যদি শোন কানপেতে
ফিসফাস সব আকাশে বাতাসে
বুঝতে পারবে নীতি দূর্নীতি
ভীষন যুদ্ধ চলছে;
রাস্তায় যারা কাটাচ্ছে দিন
স্বপ্ন যাদের ছিল সীমাহীন
চুরি হয়ে গেছে সে সব স্বপ্ন
মিডিয়া খবরে বলছে।

চোরাকারবারী যেখানে সেখানে
ফাঁদ পেতে আছে গোপনে গোপনে
সেই ফাঁদেতে পা দাও যদি
তাহলে সর্বনাশ;
কঠিন সময়ে পা ফেলাটাই
বুদ্ধিমানের কাজ।

 

অস্তিত্ব

তুমি যদি ভাবো
সব ঠিক আছে
দণ্ডী কেটে কেটে জীবনের গান গাইবে
তাহলে, ঐ যে শুকনো ঝরা পাতারা
ঝড়ো হাওয়ায় ধুন্দুমার ক’রে
তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে
তাদের অনুসরণ করতে পারো।
ঐ যে চামড়া ওঠা পথে
পড়ে থাকা ধূলো ময়লা
ঝড়ের সাথে পাঞ্জা ল’ড়ে
তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে
তাদেরও অনুসরণ ক’রে
তোমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারো।
কারণ,যারা আমাদের আবর্জনা ভাবে
সেই আমরা–
একদিন হাওয়ায় হাওয়ায় ধূমায়িত হয়ে
তাদেরও অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারি।

 

 

স্বপন দত্ত-এর দু’টি কবিতা

আমি ওই ইউনিফর্ম পরিধান করতে পারব না

সামনেই প্যারেড গ্রাউন্ড
ক্রমশঃ ক্ষয়ে যাওয়া হিটলারের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতে থাকা
এখন সুনিশ্চয় উপলব্ধ হিটলার…
হ্যাঁ… হ্যাঁ… আত্মরক্ষার জন্য, অভিনয়ের জন্য
এই অভিশপ্ত সৃষ্টির ছাড়পত্রের দিকে
তীব্র আবেগ ভরা চোখে, সাদা দাড়ি এবং জোব্বা নিয়ে—
তিনি জোব্বা এবং দাড়ি খুলে ফের যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবেন
নিজস্ব ভাব, নিজস্ব ভার দেয়ালের কথা
সমাপ্তি টেনে তিনি সে কত যুগ আগে—
পঁচিশে বিরাট সব কাণ্ডকারখানা হচ্ছে
অপছন্দের রঙগুলোতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে
ক্রমেই দলভারি গিরগিটিরা মজার সার্কাস দেখতে
আনন্দে রক্তপাতের শিস দিচ্ছে
দৃঢ় প্রত্যয়, নিষ্ঠা এবং অভিজ্ঞ— ছাপিতে উঠছে
তীব্র-তীক্ষ্ম লেলিহান শিখার সুর
রাস্তায় এবং কারাগারে এবং দেয়ালের যাতায়াতের ভেতর
গান এবং মানুষ প্রত্যাহার করার চেষ্টা চলমান

বৈশাখের যেন মনে হল, ভুলে যাওয়া কাঁদনের গানের মার্চিং সুর
ভয় এবং ক্রমাগত ভয়ের নদীতে
আত্মপরিচয় আশাহীন গোপন অধিষ্ঠিত হচ্ছে
দীর্ঘ দুঃস্বপ্নের সমাপ্তিহীন, সঙ্গীহীন, সীমাহীন প্রতিযোগিতায় হারানো বন্ধু নিখোঁজ—
প্রেমিকা গীতাঞ্জলির জন্য— তিনি সম্পূর্ণ
দেখছেন একটা আলাদা কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প
তবুও তিনি সম্পূর্ণ একটা ময়লা কাগজ টেনে নিলেন,
খুঁজে নিলেন একটা ক্ষয়ে যাওয়া পেন্সিল
লিখতে শুরু করলেন— প্রিয় মানুষ…

 

 

রমণীর নিরাময় সিঁড়ি ধরা মুঠিতে পরাধীন শিরদাঁড়া খিদে ভেজা ফসিল ক্রমেই স্পষ্ট হয় 

ময়নামতি ও-ময়নামতি, *নকশা হো*
যুদ্ধ কিংবা চুমু যে কোনও বাগান হলেই চলবে
মাজতে মাজতে, ভাবতে ভাবতে
যে-কোনও সহজ কোকিল অগুরু কুকুর
ভাববাবেলা ধুলো, হ্যাঁ ধুলো
যদি আঁচড় কাটেই আর
আমি অসীম নির্মম দরজা ভাঙে
ভাঙে একমুঠি দখল আপেক্ষা
তখন কিন্তু গোধূলি ক্লাবে আমি নেই
তিনি কিন্তু আলোর মৃত্যু ছটায়
এগিয়ে আসা স্বাধীনতা কৃত্তিম কলিজার
উদযাপনেও ভাব রাখছেন
তবুও, হ্যাঁ, তবুও তাঁতেই চাঁদমারি

কী করা হল—
কারণ কাপুরুষের যন্ত্রণাবিদ্ধ দ্বিধা
চুপিচুপি সরিয়ে ফেলছেন
কানু সময়ের প্রতিবন্ধী বীক্ষণ
কোষাকুষি থেকে— ওগো নরম মাংস আমি তোমার দিকে ছুটছি
তোমাকে ডুবিয়ে দিয়েই আমার বেতন উপরি এবং ছুটি
এবং তখন আদিম রবির ঊরুতে
প্রবল খিস্তি ও… ও কেনা চাঁদের অক্ষরে না-অসীম যাপন

 

 

মানিক সাহা-এর দু’টি কবিতা

গান

গান এক অদ্ভুত মায়া।
গান পাপীকেও পূন্যবান বানায় – এমন শুনেছি।

যে গান গায় তার জায়গা দেবস্থানের পাশে রাখা থাকে।

গান বড় অদ্ভুত মায়া—
বুকের ভেতরে মানুষ বা নদী মরে গেলে
গানই তাকে বাঁচিয়ে তুলতে পারে।

 

মূল্যহীন

যে বস্তুর বাজারে কোন মূল্য নেই
আমি তাকে অধিক মূল্য দিয়ে কিনে নিতে চাই

বাজারে অন্ধ ও বধিরের ভীড়
প্রকৃত মূল্যবান কোনকিছুই এখানে বিক্রয় হয়না
অকেজো হিসেবে পরে থাকে।

 

 

বিশ্বজিৎ মণ্ডল-এর একটি কবিতা 

নষ্ট ডানার পতঙ্গ

অবিশ্রান্ত আগুনটা জ্বলছে…

প্রতিবেশীদের ফিসফাসে সংবরণ করি, মৃত্যু ঘুম
অসময় বলে তো কিছু নেই, এইসব দহনযুগে
রাত নামলেই প্রহরীর মতো জেগে থাকে চোখ

ঘুম আসে না
মনের সীমান্ত পেরিয়ে উড়ে আসে, সংযমী ক্ষেপণাস্ত্র
জেগে থাকি, সন্তানের বুক আগলে

সকাল হলেই শুরু হয়, আমাদের গুজরান
কথা বিক্রির ফেরিওয়ালার মতো পর্যটন সাজাই
দুই চাকার অভ্রান্ত সাইকেলে
টিটকিরিতে ভরে ওঠা ডায়েরির পৃষ্ঠায়
প্রতিবেলা আহত হই

অথচ পরম ব্রহ্মের মত দু-দন্ডের আশ্বাস এঁকে দিয়ে
আজও কেউ জিজ্ঞাসা করল না— আমাদের শ্রমজীবী
অন্ধকারের কথা

 

 

দীপা চৌধুরী-এর একটি কবিতা

মুখ আর মুখোশ

ছাদের আলসেতে হেলান দিয়ে
এলোচুলে রোদ মেখে— সুমনা দাঁড়িয়ে,

পাশের বাড়ির ছাদে—
কাঁচা পাকা চুলে বাঁকাচোরা মুখ,
উঁকি ঝুঁকি দিয়ে চলে প্রতিনিয়ত!

দুরে রাস্তা দিয়ে হেঁকে চলে চুড়িওয়ালা

সুমনার খুব ইচ্ছে করে, দু-গাছা চুরি পড়তে
একটু সাজতে, ভালো জামা পড়তে,

নিজেকে ভিন্ন রুচিতে বাঁধে সে
প্রতিনিয়ত বুলি ফোঁটায়, ভালো মানুষের ছন্দে
তবু বেহিসাবি মন তাকে নিয়ে চলে অতল খাদে।

চোরা বালির স্রোতে ভেসে যাওয়ার আগেও
আলমারির তাকে রাখা সেই সময়ের মুখোশটা
বের করে আর পরে নেয়।

হিসেব মেলাতে থাকে, মুখোশের ছন্দে।।

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

সাতাশ.

একটা ঘোরের মধ্যে তাড়া খেয়ে চলেছি

নলহাটি হীরালাল ভকত কলেজে থেকেই সাহিত্যচর্চার সুযোগ এসেছিল। বেশ কয়েকজন কলিগও পেয়েছিলাম। পার্মানেন্ট চাকরি না পেয়ে সকলেই এই পার্টটাইম শিক্ষকের চাকরিতে যোগদান করেছিল। এটা এমন একটা চাকরি যার বেতনে সংসার চলে না, তাই বিয়ে করাও সম্ভব হয় না। সকলেই যেন নদীর ঘাটে নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করছি, কিন্তু কোনো যাত্রীর দেখা নেই। বলার মতো কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না “তোমায় সখি পার করিতে নেবো কানের সোনা!” সুতরাং হাতের কাছে ভরা কলস থাকলেও জল পান করার উপায় নেই। কিংবা টগবগে ফুটন্ত ফুলের বাগানের মালি হলেও একটা ফুল ভাঙারও উপায় নেই। ক্লাসে ক্লাসে যৌবনের উচ্ছল আবেগ। আঁখিপল্লবে হাতছানি। একরাশ চুল খুলে যেন বর্ষার কালো মেঘ বর্ষণের জন্য অপেক্ষা করছে। যে কোনো মুহূর্তে ভিজে যেতে পারি। কিন্তু খবরদার! নিজেকে নিজেই সাবধান করি, তুমি না শিক্ষক! পড়াতে এসেছ, পড়িয়ে বাড়ি যাও। সমাজে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকো কাউকে আঙুল তোলার সুযোগ দিও না। কলঙ্কের দাগ একবার লাগলে কিছুতেই তা মোছা সম্ভব নয়।
তাহলে কি কিছুই করণীয় নেই?
শুধু স্বপ্ন দেখতে থাকো। স্বপ্ন দেখে দেখে, স্বপ্ন দেখে দেখে কখন পূর্ণতা পাবে তার অপেক্ষা করো। অপেক্ষাই তোমার জীবন।
নিজের উপদেশ নিজের কাছেই শুনতে হয়। ঘন্টা পড়ে তারপর মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসি। মিষ্টি সুগন্ধী বাতাসে মন ভরে যায়।

 

রুবিয়া আমার কথা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে। তার সৌন্দর্যের আড়ালে কী আগুন যেন লুকিয়ে আছে আমি উপলব্ধি করলাম। তাই বেশিক্ষণ আর ওর দিকে তাকাতে পারলাম না। তারপর নিজেই মুখে আঙুল দিয়ে আমাকে সতর্ক থাকতে বললো।

 

কলেজ থেকে বেরিয়ে এসেই টিউশান পড়ানোর জন্য প্রবেশ করি। দেখি আমার রুমটিতে একাই বসে আছে রুবিয়া। আজ অন্যরা কেউ আসেনি এখনো কেন? মনে মনে প্রশ্ন করলাম। অবশ্য এখনও সময় হয়নি। রুবিয়াকে বললাম, “আজকে তুমি আগেই চলে এসেছ! কী ব্যাপার?”
রুবিয়া বললো, “স্যার একটি কথা জানানোর জন্য এসেছি সবার সামনে বলতে পারছিলাম না।”
“কী কথা বলতে চাও?” বললাম রুবিয়াকে।
রুবিয়া বললো, “স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমার জীবনটা একটু অন্যরকম। বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু সেই স্বামীটিকে আমার পছন্দ ছিল না। পূর্বেই একটি ছেলেকে ভালোবাসতাম। আমি সেই সংসার ফেলে তার সঙ্গে চলে এসেছি। এসে এই দু’বছর কাটানোর পর আমার মনে হলো, একেও ভালোবাসা ভুল হয়েছিল। তাই পুনরায় আর একজনের সঙ্গে চলে যাব আমাদের সব কথাবার্তা ঠিক হয়ে গেছে।”
রুবিয়ার কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, এ তো ভয়ংকর ব্যাপার! এরকম মেয়েও সংসারে থাকে! একজন ২১-২২ বছরের মেয়ে হয়েও বারবার সুখের খোঁজে স্বামী পরিবর্তন করতে পারে? ইতিপূর্বে এরকম অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। কী বলে তাকে উত্তর দেবো সেটাও ভাবতে পারলাম না। অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে বললাম, “আমি তো কিছুই বলতে পারছি না, তোমার নিজের ভালো-মন্দ নিজেই বোঝো। আমি তো এখনও বিয়েই করিনি সুতরাং নারী চরিত্র সম্পর্কে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত।”
রুবিয়া আমার কথা শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালো আমার দিকে। তার সৌন্দর্যের আড়ালে কী আগুন যেন লুকিয়ে আছে আমি উপলব্ধি করলাম। তাই বেশিক্ষণ আর ওর দিকে তাকাতে পারলাম না। তারপর নিজেই মুখে আঙুল দিয়ে আমাকে সতর্ক থাকতে বললো। কারণ তখন অন্যান্য ছাত্র-ছাত্রীরা প্রবেশ করছে পড়ার জন্য।
সেদিন আর ভালো করে পড়ানোতে তেমন মন বসাতে পারিনি। শুধু ভেবেছি রুবিয়ার কথা। কত অনায়াসে সে পুরুষ পরিবর্তন করতে পারে। ভালোবাসার নামে ভুলিয়ে দিতে পারে যে কোনো পুরুষকে। এরকম একজন নারীকে আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি তাই আমার বিস্ময়ের শেষ নেই। মনে পড়লো নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাদের গাঁয়ের বহু মেয়েকে উত্তরপ্রদেশের অচেনা অজানা পুরুষেরা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে বিয়ে করে নিয়ে গেছিল। বিয়েতে সব পুরুষেরা পণ নেয়, কিন্তু তারা মেয়ের বাপকেই পণ দিয়েছিল। বয়স্ক পুরুষদের সঙ্গেই সেইসব গরিব-দুঃখী মেয়ের বাপেরা তাদের মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তারা আর কেউ ফিরে আসেনি। কিছুদিন চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেছিল। সেইসব চিঠিপত্র পড়তে পড়তে জানতে পেরেছিলাম, যারা বিয়ে করে নিয়ে গিয়েছিল আসলে তারা সবাই বিবাহিত, তাদের সংসার-সন্তান রয়েছে। শুধুমাত্র বিয়ে করার অভিনয় করে বিয়ে করে তারা মেয়েগুলোকে অন্য সব প্রতিষ্ঠানে ও পুরুষের কাছে বিক্রি করেছিল। দিনরাত তাদের যৌবনকে শোষণ করে সেইসব পুরুষেরা আবার অন্য পুরুষদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এভাবে বিক্রি হতে হতে একসময় তারা সময়ের স্রোতে কোথায় হারিয়ে যায়। আর চিঠি লিখে সংবাদ দেয়ারও সামর্থ্য থাকে না। মেয়ের বাবা-মায়েরা বাকি জীবনটা মেয়েদের জন্য হাহুতাশ করে কেঁদে-কঁকিয়ে কাটিয়ে দেয়। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যেবেলায় সেইসব মেয়ের মায়েরা তার মেয়েদের চিঠিগুলি নিয়ে আমার কাছে আসতেন। চিঠি পড়ার পর, চিঠিতে উত্তর লিখেও দিতে হতো। গরিব বাড়ির মেয়েদের যে কত দুর্দশা তা তখন অনুভব করেছিলাম। আর আজকে রুবিয়াকে দেখে অনেকটাই স্বেচ্ছাচারিনি বলে আমার মনে হয়েছে। যাক এত ভেবে কী দরকার? মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের একটি গানের ক’য়েক লাইন :
“ওরে ভীরু, তোমার হাতে নেই ভুবনের ভার।

হালের কাছে মাঝি আছে, করবে তরী পার।

তুফান যদি আসে তোমার কিসের দায়—

চেয়ে দেখো ঢেউয়ের খেলা, কাজ কী ভাবনায়?”

সুতরাং ভুবনের ভার তাঁর উপরেই ছেড়ে দিলাম যিনি এই ভুবনের মালিক।

জোর সাইকেল ছেড়ে দিয়ে বাড়ি পৌছাবার তাগিদ অনুভব করলাম। সাইকেলের হ্যান্ডেলে দু’টি থলিতে রয়েছে সবজি ও আনাজপাতি। নলহাটির বাজারে সবজি বেশ সস্তা। মাসের বেতন পেয়েই বেশ কয়েক দিনের জন্য কিনে নিয়েছি অনেক কিছুই। কিছু মিষ্টিও কিনেছি প্রথম মাসের বেতনে পিতামহীকে দেবো বলে। তিনি এখন মৃত্যু শয্যায়। নভেম্বর মাসে বেশ শীত। মাটির ঘরটির একধারে খড় বিছিয়ে তার ওপর তালাই পেতে তাঁকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সারাজীবন তিনি আমাকে আগলে রেখেছেন। ছোট থেকে সেবাযত্নে বড় করে তুলেছেন। আজ প্রথম বেতনের টাকা পেয়ে চার পিস মিষ্টি ওর জন্য আলাদা করে নিয়েছি। গিয়েই তাকে দিতে হবে। সাইকেল ছুটছে। ব্রহ্মাণী নদী পেরিয়েই রাস্তায় এক ছাত্রীর সঙ্গে দেখা।
—তোমাকে চেনা চেনা লাগছে তো! কে বলতো?
—স্যার আমার নাম চৈতালি, বল্লা গ্রামে বাড়ি, আপনারই ছাত্রী!
—হ্যাঁ আমি কলেজে দেখেছি। তা এখানে কেন?
—এদিকেই তো রাস্তা স্যার! নদীর তীরে তীরে গিয়েই আমাদের গ্রাম। জমিদারের পুরনো গ্রাম।
—হ্যাঁ আমি বুঝতে পেরেছি। আমি একদিন তোমাদের গ্রাম গিয়েছিলাম। দেখে এসেছি জমিদারের ধ্বংসাবশেষ।
—আজকেও চলুন স্যার আমাদের ঘরে, দেখে আসবেন।
—আজ আর হবে না অনেক বাজার করেছি। পরে আরেকদিন যাব।
—আচ্ছা স্যার আসি তাহলে।
চৈতালি চলে গেল। লম্বা লিকলিকে একটি মেয়ে। সামনে চুলগুলো গোছা হয়ে ফণাওয়ালা সাপের মতো কপালে পড়েছে। মুখের হাসিতে ওর বিদ্যুৎচমক এর মতো একটা আকর্ষণ অনুভব করলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাববার সময় নেই। আজ অনেক তাড়া আছে।
সেদিন আমার বৃদ্ধা পিতামহী আমার মুখের স্বর শুনেই উঠে বসেছিলেন। চার পিস মিষ্টির মধ্যে প্রায় দুই পিস খেয়ে নিয়ে বাকি দুই পিস আমাকে রেখে দিতে বললেন ওর একটি কৌটোতে ভরে পরে খাবেন বলে। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন: “অনেক রোজগার করো, অনেক বড় হও, অনেক মান-সম্মান হোক তোমার।”
এই খাওয়াটিই ছিল আমার দেওয়া শেষ খাওয়া। তার ক’য়েকদিন পরেই তিনি মারা যান। তার মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়ে দিয়েছিল। ছোটবেলায় সব থেকে যাকে বেশি জ্বালিয়েছিলাম, যার কাছে বেশি আবদার করেছিলাম তিনিই হচ্ছেন আমার পিতামহী। সেই সময়ই এক পয়সা, দু-পয়সা, তিন-পয়সা, পাঁচ-পয়সা, ছ-পয়সার যুগ ছিল। বড় সংসার চালিয়েও তিনি কিছু কিছু এই পয়সাগুলো জমিয়ে রাখতেন। তার কাছ থেকেই এগুলো আদায় করতাম। একবার কান্না ধরলে কিছুতেই থামতাম না, আর তিনিও ধৈর্য ধরতে পারতেন না। অনেক কবরের ভিড়ে তাঁর কবর মাটিতে মিশে গেলেও এখনো গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াই। এখনো যেন কোনো অদৃশ্য স্বরের আওয়াজ পাই : “কেমন আছো!”
না, কিছুতেই বলতে পারি না “ভালো আছি!”
শুধু হাওয়া বয়ে যায়, আর কতগুলো পাখি উড়ে যায়। মাথার ওপর একখণ্ড মেঘ ভেসে আসে। দেখা হবে, পরকালে দেখা হবে তোমার সঙ্গে।

বাড়িতে একটাই কুলগাছ। থোকা থোকা ডাসা ডাসা বহুকুল ধরে আছে। শুধুমাত্র কুল পেড়েই লবণ-লঙ্কা দিয়ে থেঁতো করে বাবা ও আমরা ভাই-বোন মিলে খাই। বাবা বেরিয়ে যান মাঠে-ঘাটে ঘাস কাটার জন্য। অথবা ব্যাংকের কোনো পত্র বিলি করার জন্য। আমিও কলেজ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিই। রাস্তার ধারের পাঁচিলখানা ভেঙে পড়ে গিয়েছে। আসলে তালপাতার বেড়া দেওয়া ছিল তাই বেশি দিন টিকলো না। আবার নতুন করে বেড়া বাঁধতে হবে। রাস্তার লোকগুলো উঁকি মারছে। সম্ভ্রম রক্ষা করা মুশকিল। গ্রাম থেকে একটা মেয়ে টিউশানি পড়তে আসে। সেও বড় ইতস্তত করে ফাঁকা ঘরে একটা চৌকি পেতে পড়ানোর কারণে।
২০০২ সাল তখন প্রবেশ করে গেছে। ১৯৯৮ থেকে এই পর্যন্ত সময়টুকু যেন একটা ঘোরের মধ্যে তাড়া খেয়ে চলেছি। দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত জীবনের চাবুক যেমন মেরুদণ্ড সোজা করতে দেয়নি, তেমনি কোনো স্বপ্নও এই জীবনে স্থির হয়ে থাকেনি। এবার এসএসসি পরীক্ষা দিতে হলে নর্থ-জোন থেকেই দেবো ঠিক করে নিয়েছি। বিজ্ঞাপনও বেরিয়ে গেছে। ভোর ভোর ছুটতে হবে বহরমপুর শহরে। ফর্ম তুলে ফিলাপ করে জমা দিতে হবে। বিশাল লাইন। চলুন, এগিয়ে যাই। 🍁(চলবে)

 

 

🍂ধারাবাহিক রহস্য উপন্যাস
সাহিত্যিক তাপস রায়। সাম্প্রতিককালের একজন বিশিষ্ট কথাশিল্পী ও কবি। লেখকের প্রকাশিত ভিন্নধর্মী পুস্তকগুলি পাঠকদের মনে জাগরণ তৈরি করে। রহস্য কাহিনিতে লেখক প্রাণের ছোঁয়া পান। তেমনি একটি রহস্য উপন্যাস সাশ্রয় নিউজ-এর রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর পাঠকদের জন্য।

কিষাণগঞ্জের ফেলুদা

তাপস রায়

 

পর্ব ৩

একটা টান দেবার পর বিড়িটা আপনা থেকেই জ্বলে জ্বলে নিভে গেছে। নভেম্বরের বিকেলে গরম লাগার কথা নয়। কিন্তু ফেলুদার কপালে ঘামের বিন্দু দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এ বিপদটা বেশ জাঁদরেল। পঞ্চায়েতের নমিনেশনের টিকিট বিলি শুরু হবে মাস খানেকের মধ্যে। উসমানি সাহেব জানিয়েছেন পাওয়া একেবারে নিশ্চিত। সিএম-এর অফিস জানে ফেলুদার কথা। এমনকি ফেলুদার ফোন নম্বরও পাটনায় পার্টি অফিসে দেওয়া আছে। এসময় এরকম একটা খ্যাঁচাকলে পড়া! নাম খারাপ হলে উসমানি সাহেবের গায়ে লাগবে তা।
বেশ বিরক্ত লাগছে। সমস্যাটা হল এই কুকুরটার সৃষ্টিছাড়া চেহারা আর মেজাজ নিয়ে। পাই টু পাই চেহারা মিলিয়ে অন্য কোনও একটা কুকুর পাওয়া খুব মুশকিল নয়। চাই কি শোনপুরের মেলায় গিয়েও নিয়ে আসা যাবে। এখন মাছের বাজারের মতো মেলা সারা বছর ধরে পড়ে থাকে সেখানে। শীতকালে ফেব্রুয়ারি মাসে গিয়ে তা জমজমাটি হয়।
ছোটখাটো ছাগল চুরির কিনারা করতে একদিনের খেল। পাটনায় ছাগলের মার্কেটে গিয়ে একটা মাপমতো কিনে এনে দিয়ে দিলেই গৃহস্থ্য খুশি। সে আর খুঁটিয়ে পরখ করতে থোড়াই যায়! ট্যাকের পয়সা একটু খরচা হয় বটে, কিন্তু নাম— সে তো অনেক খানি হয়। ধন্য ধন্য পড়ে যায়। তাকে কি আর পয়সা দিয়ে মাপা যায়!
পকেটমারির কেস সরাসরি সলভ হয়। তাড়াতাড়ি খবর পৌঁছালে মাল পুরোটা পাওয়া যায়। রেলের পকেটমারের গ্যাং-লিডার হরিরাম মুচি থাকে মালদায়। ফেলুদাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করে সে। মাঝে মাঝে দু’জনে একসঙ্গে বসে মালও খায়। তো সে কচিৎ কদাচিৎ দু-একটা কেসে মাল ফেরৎ এনে দিলে কী এমন! গত মাসেই তো একটা খুনের কেস কিনারা হল। এমনি এমনি। ফেলুদার কপালের জোর-ও বলতে হবে। তার কাছে সমস্যা এলে সমাধানও পায়ে পায়ে চলে আসে।
বাড়িতে পাকা পায়খানা থাকলেও ছেলেবেলার অভ্যাস বশত প্রকৃতির ডাক প্রকৃতিতেই করতে পছন্দ করে ফেলুদা। সেদিন কুয়াশার ভেতর ভোর ভোরে মাঠ কাজ করার পর নয়ান জুলির জলে নিজেকে পরিষ্কার করে নিতেই চোখে পড়েছিল বেশ বড়-সড় কুড়োল আর একটা করাত নয়ান জুলির জলে পড়ে আছে। মনে হচ্ছে ভোরবেলায় তারও আগে মাঠ কাজ করতে এসে রেখেছিল কেউ, ধুয়ে-টুয়ে নিয়ে যাবে বলে। কিন্তু ফেলুদাকে অত সকালে বাতকর্ম করতে দেখে পিঠটান দিয়েছে এগুলোর মালিক। পরে এসে নিয়ে যাবে ওই কুড়োল করাত। ফেলুদার চোখে পড়েছে কুড়োলের হাতলে লাগানো ঘন রক্তের চামরা ভাসছে জলে। মানে তখনও পরিষ্কার করা হয়নি। আগের দিন রাতেই খবর এসেছিল, আসিফের ঈদের জন্য রাখা গরু হাওয়া। ফেলুদার মাথায় দুয়ে দুয়ে চার হতে সময় লাগে না। সারা বছর গাছকাটার জন খাটে কোচাধামনের মুসাফির। বড় বড় গাছের গুঁড়ি আর শ’মিলে পাঠাতে হয় না। জায়গাতেই দোফালা করে দেয়, এমন তাকত মুসাফিরের।

গনেশবাবার দয়া না হলে কেউ কখনও টাকার মুখ দেখেছে! কারবার জাঁকিয়ে করার প্রথম বছরেই আটঘাট বেঁধে শুরু। মানে হালখাতার খাতা মহরত করিয়ে এনে নিজের অফিসে মুখে মুখে টাকা ধার দেবার ধান্দাকে খাতায় কলমে নিয়ে ব্যবসার শুরু। শুরু সেই পাহাড়ের চা বাগানে ধর্মঘট শুরু হয়ার সময় থেকে। মুক্তি মোর্চার বন্ধের কারবারে ফেঁসে অনেক ছোটো-বড় ব্যবসায়ীর কপালে হাত।

মনে পড়তেই বোঁদেকে তলব। বাইকের পেছনে ওঠা। ভোর ভোর বোঁদেকে যথারীতি মুসাফিরের পাড়ায় পাঠিয়ে কোচাধামনের চার রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে বসে বিড়ি খেতে খেতে দোকানির কয়লার উনুন ধরানো দেখা আর তারপর মোষের দুধের চা তৃপ্তি করে খেতে খেতে আলাপ করছিল সিং সাহেবের সঙ্গে। সিং সাহেবের মুদির দোকান কাম জেরক্সের দোকান কাম টেলিফোন বুথ। সকালে এক কাপ চা না খেয়ে সিং সাহেব দোকান খোলে না। সকাল সকাল ফেলুদাকে পেয়ে—মানে ফেলুদার মতো একজন সেলিব্রিটিকে হাতের নাগালে পেয়ে সে তো ছাড়তেই চায় না। আগডুম বাগডুম গল্পের সঙ্গে রাজনীতির হাল হকিকতও জানতে চায়। তা হলোও বেশ গল্প-সল্প। ঘন্টাখানেকের ভেতর বোঁদে ফিরে এসে চায়ের দোকানের বেঞ্চ থেকে তুলে এনে গুরুকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে শোনালো গরু বেত্তান্ত। ফলে ফেলুদা আবার বোঁদের বাইকের পেছনে। কোথাও কিছু নেই। কিন্তু ওর ছিটেবেড়ার পাকের ঘর থেকে দুম দুম করে গন্ধ এসে নাকে ধাক্কা দিচ্ছে যে! তারপর ওর পাকের ঘরের সামনে যেতেই গোস্তের গন্ধ ম ম করছে। সারা বছর ছ’খানা লেন্ডিবেন্ডিকে ফ্যান-ভাত জোগাতেই মুসাফিরের প্রাণ ওষ্ঠাগত তো তার ঘরের ভেতর থেকে বের হবে দুই বালতি গোস্ত। ব্যাস, আড়ং ধোলাই শুরু হচ্ছিল আরকি! ফেলুদাই বাঁচায়। ফেলুদা-র শিখিয়ে দেওয়া

**

কথা আসিফের পায়ের কাছে বসে বলল মুসাফির। “ভাইজান আমারে বাঁচায় দাও। তোমারে হাট থেকে একটা ইদের গরু আনে দেবানে।”
শুধু মুসাফিরই জানে গরু কেনার টাকা ফেলুদা দিয়েছে।
এখন বিকেলের রোদকে গায়ে বসতে দিয়ে ফেলুদা ভাবছে সেই অঙ্কে ফেল করে স্কুল ছুট হবার পর থেকে নাম করার লোভে কত কী যে সে করেছে! এবার বোধ হয় আর সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। বোঁদে অনেক্ষণ গিয়েছে, ফিরছে না। মাঠের ভেতর সূর্যের শেষ রং পোড়া আগুন ফেলছে। ফেলুদার মন পুড়ছে। কত লোক তাকে চেনে, কিন্তু সত্যি সত্যি একজনও তো তার জন্য বসে থাকবে না রাতের বেলায়। দরজা খুলে দেবে না। এই ঊনপঞ্চাশ বছরের জীবন পুরোটা তো ফেল হয়ে গেল। মনে মনে হাসল ফেলুদা, কে আর জেনে শুনে পাশ নয় ফেল-এর সঙ্গে হাত মেলাবে। একটি শান্ত আশ্রয় বিছিয়ে দেবে!

দশ দশখানা লাল খেরো খাতা উধাও। ফেলুদাকে এবছরের খাতকদের খাতা দেবে বলে ঘরে এসে নিজের খাটের তলায় ওই ভারি গতর নিয়ে অনেক কসরত করে ঢুকে টিনের ট্যাঙ্ক বের করে আনতে হয়েছে। কিন্তু চাবি ঘুরিয়ে ডালা খুলে মালবাবু তো হতবাক। এবছরের খাতা শুধু নয়, বাক্সের ভেতর লালের কোনও ছিটে-ফোঁটাও পড়ে নেই। কারবার চালু হবার পর প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে কালিঘাটে গিয়ে রীতিমত গায়ের ঘাম পায়ে ঝরিয়েই উড়ে বামুনকে দিয়ে খাতা মহরত। তারপর রাত ১০টা পাঁচের দার্জিলিং মেল-এ চেপে ভোর ভোর পরের দিন *কিশানগঞ্জে* ঢোকেন মালবাবু। এই মালের ব্যাবসা তো আর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে করা যায় না। অফিস জানলে চাকরি নট করে দেবে। পারলে ভিজিল্যান্স লাগিয়ে জীবন জেরবার করে দেবে। ফলে সবসময়ই মালবাবু চোর দায়ে ধরা থাকে্ন। খুব গোপনে সব কিছু চলে। হালখাতাটাও তাই কলকাতায় করিয়ে আনা হয়। একটা দিনের জন্য চানুমতির কাছে গঙ্গারামকে রেখে জেতেও মালবাবুর মন কাঁপে। কিন্তু কী করবেন! কারবার গোপন বলে খাতা মহরত তো বন্ধ রাখা যায় না।! সেসব দা্মি খাতা। গনেশবাবার দয়া না হলে কেউ কখনো টাকার মুখ দেখেছে! কারবার জাঁকিয়ে করার প্রথম বছরেই আটঘাট বেঁধে শুরু। মানে হালখাতার খাতা মহরত করিয়ে এনে নিজের অফিসে মুখে মুখে টাকা ধার দেবার ধান্দাকে খাতায় কলমে নিয়ে ব্যবসার শুরু। শুরু সেই পাহাড়ের চা বাগানে ধর্মঘট শুরু হয়ার সময় থেকে। মুক্তি মোর্চার বন্ধের কারবারে ফেঁসে অনেক ছোটো-বড় ব্যবসায়ীর কপালে হাত। আর বাঙালি ব্যাবসায়ীদের উৎখাত করতে এই সুযোগে সব লেগে পড়েছে। তারা সব নিচে নেমে আসছে। ধানের জমি কিনে চা-বাগান। কিন্তু পুঁজি কম তাদের। মালবাবুকে টাকা খাটানোর পরামর্শ দেয় বনবিহারী। তা সে দু’হাজার ছয়-টয় সাল হবে।
সেই থেকে আগে বছরের প্রথম দিন কালিঘাটে খাতা পুজো করা। তারপর সব। নিরঞ্জন মহান্তি একটু টাকা বেশি নেয় বটে, কিন্তু সব কাজটা দায়িত্ব নিয়ে করিয়ে দেয়। দিনে দিনে এই খাতা যে আয় দিয়েছে তা মালবাবুই শুধু জানেন, অন্য কেউ নয়। একদিকে কালীঘাটের কালীর কৃপা করা, তার খাস পূজারী নিরঞ্জন মহান্তির হাতের ছোঁয়া লাগানো গাঁদা, বেলপাতা আর দুর্বোর স্টাফ পাতার ভাঁজে ভাঁজে না থাকলে যে ধারের টাকা ছাপিয়ে উসুলের টাকা পাঁচগুন হয়ে ফিরে আসত না তা মালবাবু ভালো করেই জানেন। সেইসব ঈশ্বরলাগা খাতা একখানাও নেই!
মাথায় হাত পড়বে না! মালবাবুর মাথায় হাত। এর জন্য অবশ্য ফেলুদাকে আলাদা করে মাংস ভাত খাওয়াতে হবে না। ফেলুদাই খবর পাঠিয়েছে বোঁদেকে দিয়ে। বোঁদে এসেছে খাতকের খাতা একটিবার দেখতে চায় ফেলুদা। কোনো ক্লু মেলে কিনা! দু’দিন হয়ে গেল, এখনও গঙ্গারামকে পাওয়া যায়নি। উসমানি সাহেবও অবাক, তার রাজত্বে চুরি-চামারি নেই বললেই চলে। তাছাড়া ফেলু থাকতে গায়েব হওয়া মাল উদ্ধারে এতখানি দেরি ! 🍁(চলবে)

 

 

 

 

সম্পাদক : দেবব্রত সরকার |   কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : ফিরে পড়া : গল্প , এবং মহামিলনের কথা বিভাগের লেখা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment

Also Read