Sasraya News

Saturday, February 15, 2025

Sasraya News, Sunday’s Literature Special || 18th August 2024, Issue 29 | সাশ্রয় নিউজ, রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৮ আগষ্ট ২০২৪, সংখ্যা ২৯

Listen

সম্পাদকীয়

 

পুলিশ কখনোই আন্দোলনে বাধা দেয়নি। তারা জনগণের সেবাই করেন। আপনি আন্দোলন করুন। কিন্তু কারোর উপর হামলা বা ভাঙচুর না করেই। আর জি কর-এ ১৪ আগস্ট রাত্রির একটি ভিডিও ফুটেজ ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশ’র ফেসবুক পেজে পোস্টে যা দেখলাম তাতে পুলিশ রক্ষা করবার কাজই করেছেন। কারোর উপর হাত বা লাঠিচার্জও করেননি। খুব ভালো লেগেছে। তবে যারা ভাঙচুর চালালো তাদের বোঝা উচিৎ যে পুলিশই তাদেরই সুরক্ষার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা ডিউটিতে থাকেন। সব পুলিশ অফিসার কখনোই খারাপ হতে পারে না। যেমন সব সমাজসেবক সেবক নয়। পুলিশের সঙ্গে শক্তির অপ্রয়োজন ঘটিয়ে ব্যারিকেড ভেঙে আর জি কর-এ ঢুকে যে ভাঙচুর তাণ্ডব দেখলাম তাতে এই ভাঙচুরে আমাদেরই অর্থনৈতিক ক্ষতি। সেদিন এহেন পরিস্থিতি হওয়া উচিৎ ছিল না। আগামীতে পুলিশই এর তদন্ত করবেন। আমরা মিডিয়া মারফত সব জানি আর জি কর ঘটনা।

 

 

 

 

অনেকেই ভিউ পেতে ভিডিও কনটেন্ট বানাচ্ছেন সেই সব ফেক মিডিয়াতে কান দেওয়া উচিৎ না। সোশ্যাল মিডিয়ায় সত্য প্রতিবাদ গর্জে উঠবেই। এটা পুলিশ আধিকারিকরা জানেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদ ঘটবেই নিজের নিজের মত বিনিময় করবে গণতন্ত্রের অধিকারে। বাক স্বাধীনতা আছে। সেখানে প্রতিবাদ করছে যে যার মতো। ওখানে ফেক প্রতিবাদ করে সন্ত্রাস করবেন না। একটা স্বাভাবিক চিত্র তৈরী করা উচিৎ।

এদিন মোমবাতি জ্বালিয়ে অনেক জায়গাতেই মৌন মিছিল করা হয়। এটা একজন মেয়ের সম্মান অধিকারের লড়াইয়ের মিছিল। এখানে সকলেই প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। কিন্তু টুকরো ঘটনা যে মেয়েদের সম্মানের মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে রাস্তায় জনগণের প্রতিরক্ষার কাজ করছিলেন সেইখানেই একজন মহিলা পুলিশ কর্মীর মাথা ও চোখ পাথর ইঁট ছুঁড়ে ফাটিয়ে দিয়েছে। সে রক্তাত্ত!  তবুও সে নিজের ডিউটিতে গাফিলতি করেননি!  তাহলে আমার প্রশ্ন সেই নারী স্বাধীনতা। ওই মহিলা পুলিশকর্মীর উপর চড়াও হওয়া কি উচিৎ ছিল ১৪ আগস্ট? এটাও আমাদের কাছে বেদনার। চরম থেকে চরমতম অমানবিক শিকার অভয়া! যা হবার ছিল না। ৩৬ ঘন্টা ডিউটির পর তাকে নিজের সিকিউর চত্বরে এ হেন শিকার হতে হবে এটা কারওর কল্পনাতেও আসে না। কিন্তু যা ঘটল তাতে কলকাতা রাজ্য দেশ বিদেশ এই ভাবে আজকে গর্জে উঠল।

হোক প্রতিবাদ। ন্যায় এবং সত্যের পক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দাবি করি।

তবে আবারও বলছি, ভাঙচুর করা আর পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করা এটা খুব খারাপ লাগছে। কারণ আর জি কর-এ যে ঘটনাটি ঘটেছে তাতে পুলিশের উপর উত্তেজনা ছড়িয়ে আন্দোলন করা উচিৎ নয়। এটা মেনে নেওয়াই যায় না। যে পুলিশ ছাড়া আমরা নিরাপদ নই। তাদের কাছে বাহুর বল দেখিয়ে লাভ কি! এর মানেই বাড়ির অভিভাবকের উপর বাহুরবল দেখানো সমান। কর্তব্যরত পুলিশ সব সময় সেই অভিভাবক কাজটি করে থাকেন। 🍁

 

 

🦋কবিতা 

 

 

 

রণজিৎ সরকার

ঘুনপোকা

 

আপনি তো কিছু বললেন না!
আশা ছিল অশেষ
ভাবিইনি আপনি বুড়ো হতে পারেন
ভাবিইনি আপনার চোখে এমন চালশে
আপনার দুরবিন তো ছিল
সেটা হারিয়ে গেছে?
নাকি ঘুনপোকায় চিবলো!
আপনার হাতে ছিল একটা লাঠি
কাদের হাতে থাকে যেন?
ঋত্বিক!
ওটার মানে আপনার ঠাকুর বলেননি?

পোড়ারুটিতে যোনিভাঙা রক্ত…
এতটাই মিষ্টি?

আশা ছিল অনেক, অন্তত একবার
নেমে আসবেন
মহিরুহছায়া ঘন পল্লবে
অথচ দেখলাম কদর্য ঝোপ-বিলাস
অর্গলরুদ্ধ স্বর দুয়ারে ভিখারি কাঙাল

 

 

 

 

 

ফাল্গুনী চক্রবর্তী

প্রেম ফাইল ১২

পিঁয়াজ হাঁট শরীরের বর্ণমালায় ওপারে শুখা। মেঘের আতিথেয়তা জেনে ও মৌন। রংয়ে পাথর গলছে কোনো শব্দ রথি নয়। শিমুল ফুলে সাজাও মনের বন উপবন ফের কোনো বাসন্তী রাতে এসো ইচ্ছের দেশে। তোমার যাওয়া আসা টুকে রাখি। শক্ত গাছের গোড়া থেকে সরে যাক যাবতীয় প্রত্যাখ্যান সহজ হই প্রেম রাখি কুয়াশা মাখা ঘর বাড়ির দেয়ালে খুলে যাক গিট বাঁধা আবেগের পাতিল সংগে মর্মর হউক মায়ার নাগর।

 

 

 

 

 

 

 

পরাণ মাঝি

পরাণ মাঝি

 

 

বেশ তো চালিয়ে দিচ্ছ তমসার রাজা
আমরা পাখিও নই কিম্বা পাথরও নই; কেবলমাত্র মানুষ
প্রহসনের একটা সীমা থাকে ভাই

সব জেনে বুঝে বারবার একই পথে হাঁটলে
পরিকল্পিত মাজা ঘষা শেষে একদিন নিজেকেই পেতে হবে সাজা
এখনো সময় আছে পাল্টে ফ্যালো পুরানো জামা

রক্তে রাঙা রোমন্থনে
পথে পথে নেমে এসো বন্ধু স্বজনে

যে গেছে সে তো ফিরবে না আর
তবু বুঝিয়ে দিতে হবে গর্হিত কাজ কেন বারবার

শহর জুড়ে রাস্তায় কেন শুধু ডাক্তার
বুদ্ধিজীবীরা গেল কোন পারাবার??

পথ নেই আর পালাবার; সবকিছু ধামাচাপা দেওয়ার
শুনে রাখ যত চাটুকার
আর সাহস দেখাবি না নারীকে অসম্মান করিবার
অনেক হল – এবার সময় এসেছে থামাবার

এসো সবাই –সেই শপথ নিই
নারীর হাতে অস্ত্র তুলে সাজিয়ে দিই

যেমন করে দূর্গা মা অসুর নিধন করেছিলেন ভাই,
দুহাতে আত্মরক্ষার অস্ত্র তুলে নেওয়া ছাড়া
রাজাকে সাজা দেওয়ার আর কোনো মন্ত্র নাই…

 

 

 

 

 

 

সুফিয়া শিউলি

ঐ বুজুর্গি ভাববাক্য কাকের শব্দমাত্র

 

এখন আমার কানে তোমাদের ঐ বুজুর্গি ভাববাক্য
কাকের শব্দমাত্র; যাও তোমরা ইচ্ছেমতো স্বর্গে ও বেহেশতে
লোভটা তো ঐ হুরপরী আর সুরার জাম বাটি!
লাভ কি আমার ও সব শুনে… লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু
ভুললে কি তোমরা সবে?
কাকের চিৎকারগুলো এখন আমার শুধু আলসে সকাল
বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে থাকে ইচ্ছেমতো…
ভানুমামা তেজ দেখিয়ে যতই উঠুক চোখ রাঙিয়ে
উঠব আমি… যখন শুধু জাগবে মানুষ ঘুম ভাঙিয়ে…

 

 

 

 

 

 

গোবিন্দ ধর

আমি বধির হয়ে আছি

 

একটি লাইন লিখতে পারছি না
বিশ্বাস করেন এক পঙতিও লিখতে পারছি না।

চারপাশের দুনিয়ায় ইতিমধ্যে পালাবদল হলো একটি রাষ্ট্র ক্ষমতার।
দেশের পিতার মূর্তগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছেন সংস্কারপন্থী জনগণ।
অতি উৎসাহী জনতা তাঁর কণ্ঠে পাদুকামালা পরিয়ে উল্লাসে মত্ত।
এতো ঘৃণা তবে কোথায় লুকানো ছিলো?

বিকৃত আর বিক্রিত মানুষের মগজ থেকে
৫২ মুছে গেলো?
৭১ ভুলে বসে আছে!
৭৫ এর শোকেও কেউ নতজানু হতে লজ্জিত!
ইতিহাস মাড়িয়ে আবার ইতিহাস হতে পারে ক্ষতি নেই
পরম্পরা ভুলে গেলে জাতির পরিচয় প্রশ্নবিদ্ধ হয়
একথা তর্জনী তুলে বলে দিতে পারেন
এমন একজনও উপমহাদেশে নেই এই লজ্জায়
আমি বহুদিন ঘুমাতে পারছি না।
কিচ্ছু পারছি না। আমি মরে গেছি। আমি জড় হয়ে গেছি।
আমার আমি দুন্দুবুড়ির মতো গুটিয়ে গেছি বহুদিন।

তারপর উপমহাদেশের মানচিত্রে অনেক নদীজল গড়িয়ে গেছে।
মানচিত্রে রক্তের দাগ শুকায়নি কদিনেও।
আমাদের অঙ্গরাজ্য বাংলায় ঘটে গেলো ন্যাক্কারজনক ঘটনা।
আর জি কর হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তারকে গণধর্ষণ শেষে খুন করে দিলো নরপিশাচেরা!

আজ স্বাধীনতা দিবস।
আজ ১৫ ই আগষ্ট।
৪৭ এ দীর্ঘ দাসত্ব থেকে মুক্তির মাস।
আজ আমাদের উৎসব।
আজ স্বাধীনতা দিবস।
আজ স্বাধীনতার আটাত্তর বছর
ডামাডোলে উদযাপন হলো ভারতজুড়ে।
হরঘর তেরঙ্গা পতাকা উড়লো তিনদিন ধরে।
অথচ স্বাধীনতা মানে শুধু লেবেন চুষ নয়।
স্বাধীনতা মানে শুধু হরঘর তিরঙা ফতফৎ উড়ানোই নয়।

স্বাধীনতা মানে সকলের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান
স্বাস্থ্য পরিসেবা অন্তীম ব্যক্তি অব্দি পৌঁছে দেওয়া
মা মেয়ে রাতের পৃথিবীতে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসা
আমার কন্যার মুখে সারে জাহা সে আচ্ছার প্রতিচ্ছবি ফুটে থাকা।
স্বাধীনতা মানে মোটা চাল আর মোটা কাপড়।
স্বাধীনতা মানে সকলের হাসিমুখ।
স্বাধীনতা মানে ভোরের কিচিরমিচির কলকাকলীতে চারপাশ মুখরিত বন্দেমাতরম।

বিশ্বাস করেন আমি একটি লাইন লিখতে পারছি না।
আমি খাচ্ছি দাচ্ছি অফিস যাচ্ছি।
আমি পতাকা উত্তোলন করে চকলেট বিলি করছি
কোমলমতি শিশুদের মধ্যে।
আমি বাজার করছি।স্নান নাওয়া খাওয়া সব করছি।

অথচ আমি আমার বোনের ইজ্জত রক্ষা করতে পারিনি।
আমার মায়ের শরীরে মোটা কাপড় নেই।
আমার প্রতিবেশীর ঘরে উনুন চড়ে না হররোজ।
আমার বাক স্বাধীনতা এখনো প্রকৃতপক্ষে নেই।
আমাদের ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছেনি।
স্বাস্থ্য পরিসেবা অন্তীম ব্যক্তি অব্দি দেওয়া সম্ভব হয়নি।

আমার প্রিয় পেশার মানুষেরা না খেয়ে অভুক্ত
রক্ত চোখের শাসন আর শোষণে শোষিত
হাড়গোড় ভেঙ্গে দেওয়ার নিদান আসে।
কেউ কেউ অপঘাতে মৃত্যুর কাছে পরাজিত।
১০৩২৩ আজ শুধু একটি সংখ্যা
মৃত্যু মিছিলে সংখ্যাটি ছোট হচ্ছে।
অথচ আমার ভেতর থেকে সিংহের গর্জন নেই।
আমি টু শব্দ করছি না।
আমি নিজেকে এরকমই বাঁচিয়ে রাখি
কারো সাতেপাঁচে নেই।
কিচ্ছুতে নেই। শুধু খাই দাই অফিস যাই।
চুপ থাকি। যেন কিচ্ছু হয়নি কোথাও।

সবই করছি।আমি কি তাহলে বেঁচে আছি?
বেঁচে থাকার কৌশল অবলম্বন করে
কতদিন বেঁচে থাকা যায়?
সাবলীল হাঁটতে পারছি কই?
আমি কি তাহলে মরে গেছি?
আমি কি চারপাশের দুনিয়া দেখছি?
নিজেই নিজেকে প্রশ্নবিদ্ধ করি।নিরুত্তর আমি।

গতকাল মধ্যরাত শাসন করতে যাওয়া মেয়েদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্য পুরণ হোক
কায়মনোবাক্যে চাইছি।
বিশ্বাস করেন তথাপি আমি একটি লাইন লিখতে পারছি না।
নিজের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দিই।
লাশের গন্ধে আমার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
আমি কি তাহলে মরে গেছি?

আমার মনের ভেতর কে যেন অসংখ্য প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে।
যার প্রকৃতপক্ষে কোনো সমাধান এই সময়ের নিকট নেই।
বারুদের ধুঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশ অন্ধকার করে আছে।
অথচ কালখণ্ড লিখে দেবে সকল ঘটনার প্রকৃত ইতিহাস।

আমি বধির হয়ে আছি।
আমি মানসিক অসুস্থ বোধ করছি।
আমি অসুস্থ অনুভব করছি।
একটি কবিতাও লিখতে পারছি না।
আমি প্রতিবাদ করতে পারছি না।
আমি কিচ্ছু পারছি না।
আমি এই সময়কে ঠিকঠাক চিনতে পারছি না।
আমি আমার সাথে বড় অচেনা মানুষের মতো ব্যবহার করছি।

আমি একটি লাইন লিখতে পারছি না।
আমি জড় হয়ে গেছি।
অথচ আমি গর্জে ওঠার কথা ছিলো।
আমি প্রতিবাদ করার কথা ছিলো।
আমি কিচ্ছু পারছি না।
আমার হাত পা শেকলে বাঁধা।
আমি হিটলারের ছায়ার নিকট অদৃশ্য ছায়ামানব।
সাতেপাঁচে নেই এরকম এক কঠিন সময়ে
আমি কোনো প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছি না।
অন্ধকার আমাকে গিলে ফেলতে চায়।
আমি গভীর অন্ধকারে পড়ে খাবি খাচ্ছি।

আমি বধির হয়ে আছি
অথচ কালখণ্ড লিখে দেবে একদিন
আলোকিত হবে কৃষ্ণগহ্বরে ঢাকা
এই সব বুলেট খুন ধর্ষণ আর যত অবিচারের ইতিহাস।

 

 

 

 

 

 

গোলাম কবির

জনবিচ্ছিন্ন রাজা কিংবা রাণীমা

 

 

কতোটা তিমির রাত
ভোর হয়ে গেছে,
রাণীমা আয়নায়
নিজেকে দেখতে
সময় পাননি, আহা!

শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা এবং
মোসাহেবি করা গুটিকয়েক বন্ধু
নামের শত্রু, সভাসদ ও দলবাজি
করা ধান্দাবাজের ধোকায় পড়ে
আন্দাজেই করে গিয়ে সাধন!

কেউ তাকে বলেনি রাণীমা,
“এবার নিজের দিকে
তাকানোর জন্য আয়নাটা দেখ!”

হয়তো হতে পারে-
কেউ সাহস করে বলেনি অথবা
বললেও রাণীমা শুনতেন না তাই!

অবশেষে একদিন যখন
শোষণ বঞ্চিত বিক্ষোভে
ফেটে পড়া তরুণ প্রজন্মের রক্তের
নদীতে সাঁতার কেটে তিনি
এতোদিনের গোছানো সংসারের
বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি
স্বচক্ষে দেখলেন তখন রাণীমা
ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন কিন্তু
যে রক্ত নদী পেরিয়ে আসলেন
সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করলেন না!
যুগে যুগে জনবিচ্ছিন্ন রাজা কিংবা
রাণীমা’রা বোধহয় এমনই হয়!

 

 

 

 

 

 

ফটিক চৌধুরী

পৌষ্য

 

 

একটা দুঃখ আছে আমার
সে আমার শৌখিন পোষ্য
পোষ্যকে কে না ভালোবাসে?
সেই শৌখিন দুঃখ থাকে
আমার খাঁচায়, আমার বুকের
একটি প্রকোষ্ঠে, আর অন্য
একটি প্রকোষ্ঠে থাকে সুখ।
তারা পাশাপাশি থাকে, কথা বলে।

কিন্তু আমার পৌষ্যের শেখানো বুলি
সুখ বুঝতেই পারে না।

 

 

 

🦋গল্প 

 

 

প্রথমেই বলি আমাদের কোন দাবি–দাওয়া নেই। আপনার মেয়েকে যদি সাজিয়ে দিতে না পারেন। কোনও ব্যাপার না। বিয়ের আগে আমরা গয়নাগাটি দিয়ে সাজিয়ে নেব। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী খুব ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করবেন। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, অতি সামান্য খরচে রেজিষ্ট্রি করিয়ে আমরা পিয়াকে আমার ঘরে পুত্রবধু করে নিয়ে আসব। স্বপন শর্মা-এর গল্প ‘ছাগলের বাড়ি ফেরা’। 

 

 

ছাগলের বাড়িফেরা

স্বপন শর্মা

 

 

 

 

 

পনারা কবে আসছেন? পিয়ার বাবার কৌতূহলভরা জিজ্ঞাসা।
-আমরা ফোনে জানিয়ে দেব কে কে যাবে এবং কখন যাবে।
-আমার মেয়েকে পছন্দ জেনে ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ, দীপেনবাবু।
-ধন্যবাদের কী আছে? আপনার মেয়ে ইতিহাসে এম এ এবং সুশ্রী। সবচেয়ে ভালো লাগল ওর আঁকার হাত। ভাল গান গায়। অত্যন্ত গুণী মেয়ে। আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলে আপনাকে জানিয়ে দিচ্ছি। তবে এটা জেনে রাখুন রবিবার বিকেল ছাড়া মনে হয় সম্ভব হবে না।
-ঠিক আছে, আসুন না। আমি আপনাদের বাড়ি যে আপ্যায়ন পেয়েছি, তা কোনদিন ভুলব না। আপনাদের দোতলা সাজানো গুছানো বাড়ি। আমার বাড়ি তো দেখেছেন। একেবারে অতি সাধারণ বলতে যা বোঝায় তাই।
-সে তো আমি দেখেই এসেছি। তাতে কি এসে যায়। আমরা তো আর বাড়ি দেখতে যাইনি। আপনার মেয়েকে দেখতে গিয়েছি। এবং মেয়েকে আমাদের পছন্দ। ব্যস।
-কি বলে ধন্যবাদ জানাব, ভেবে পাচ্ছি না। রূপকের সঙ্গে কথা বলেও খুব ভাল লাগল। মনেই হয় না অর্থনীতিতে পিএইচডি করা একজন বিডিওর সঙ্গে কথা বলছি। কি অমায়িক ব্যবহার। আর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আমাকেই তো লজ্জায় ফেলে দিল আপনার ছেলে। ভাবি, এই না হলে শিক্ষা!
-আপনি গুরুজন। আপনাকে প্রণাম তো করবেই।
-একটা কথা বলি, আমরা একটি অতি সাধারণ পরিবার। আমার একটা সামান্য জুতোর দোকান। বাড়িঘরও তেমন কিছু নয়। আয় সামান্যই। আমার ছেলেও ভালো আঁকে। শিমুলতলা এলাকাতেই তিনটি আঁকার স্কুল। চাকরি পায়নি বলে এটাই ওর পেশা ও নেশা। তো আমাদের দু’জনের আয়েই আমাদের সংসার। পিয়া চাকরির চেষ্টা করছে। এখন জানি না…
-আপনি কী বলতে চান, আমি বুঝে গেছি। আমার ছেলে যদি সবুজ সংকেত দেয়, আমি আপনাদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে আগ্রহী। সে ক্ষেত্রে আর কোন কিছুতেই আটকাবে না। আপনি যে জন্য চিন্তা করছেন, বুঝতে পেরেছি। আর্থিক ব্যাপার–স্যাপার তো? প্রথমেই বলি আমাদের কোন দাবি–দাওয়া নেই। আপনার মেয়েকে যদি সাজিয়ে দিতে না পারেন। কোনও ব্যাপার না। বিয়ের আগে আমরা গয়নাগাটি দিয়ে সাজিয়ে নেব। আপনার সামর্থ্য অনুযায়ী খুব ছোট করে একটা অনুষ্ঠান করবেন। আর তাও যদি সম্ভব না হয়, অতি সামান্য খরচে রেজিষ্ট্রি করিয়ে আমরা পিয়াকে আমার ঘরে পুত্রবধু করে নিয়ে আসব। আমরা অনুষ্ঠান করব। এটাই তো আমার শেষ কাজ। আমার মেয়ে রিমার বিয়ে দিয়েই আমি রিটায়ার করেছি। এখন এই কাজটি মিটে গেলে আমরা স্বামী-স্ত্রী নিশ্চিন্ত।
-যাক, আমাকে দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচালেন। আপনারা অমায়িক মানুষ, এমন উদার মনোভাব আজকাল সত্যিই দেখা যায় না। কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব, ভাবতে পারছি না। অনুষ্ঠান করব ঠিকই, তবে খুব যে একটা আড়ম্বর করে করতে পারব না। আমাদের ভুল-ভ্রান্তি একটু মানিয়ে নেবেন।
-বললাম তো, আপনার কোনও চিন্তা নেই। বরযাত্রী হিসেবে ক’জন গেলে আপনার সুবিধে হয়, তাও জানিয়ে দেবেন। সে ক’জনই যাবে।
-আচ্ছা বেশ, রাখলাম।
-একটু ধরবেন, আমি এখনই জানিয়ে দিচ্ছি ক’জন যাবে এবং কখন যাবে। রূপক আমার কাছে এসেছে।
-ঠিক আছে দীপেনবাবু, আমি ধরছি। আপনি কথা বলে জানিয়ে দিন।
রূপকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়ে দীপেনবাবু বলেন, সুবীরবাবু আগামী রবিবারই ওরা যাবে। আমার বড় মেয়ে রিমা, রূপক এবং রূপকের বন্ধু দেবরাজ যাবে বিকেল চারটে নাগাদ ।
-আচ্ছা বেশ, খুশি হলাম। আমি শিমুলপুর স্টেশনেই ওঁদের জন্য অপেক্ষা করব।
-খুব ভাল হবে। তাহলে ওদের চিনতে অসুবিধে হবে না। ঠিক আছে ভাল থাকবেন। নমস্কার, রাখলাম।
-নমস্কার, রাখুন। সুবীরবাবু ফোন রাখেন। উদ্বেগহীন এক লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। দোকান খোলার পর এই সুখবরে মনটা তৃপ্তিতে ভরে যায়। বাড়িতে ফোন করে স্ত্রীকে বিস্তারিত জানান।

দুই.

হালিশহর থেকে শিমুলপুর ট্রেনে মাত্র কুড়ি মিনিটের জার্নি। রূপক তার প্রিয় বন্ধু দেবরাজের জন্য অপেক্ষা করে। দেবরাজ নয়াপাড়ায় থাকে। একসঙ্গে ওরা কল্যাণী বিশ্ববিদ্যলয় থেকে মাষ্টার ডিগ্রি করেছে। দেবরাজ তার ক্লাসমেট কবিতাকেই বিয়ে করেছে। তাও বছর দুই হয়ে গেল। এই ব্যাংক অফিসার বন্ধুটি রূপককে নানাভাবে সাহায্য করে। একে অন্যের বাড়িতে যাতায়াত করে মাঝে মাঝেই। ফলে পারিবারিক একটা বন্ধুত্বও আছে। রিমা আর রূপক দেবরাজকে আসতে দেখে খুশি হয়।
দেবরাজ এসেই বলে, কীরে গাড়ি নিয়ে গেলেই হত। ট্রেনের ভিড়ে ঠেলাঠেলি করে যাবার কি দরকার ছিল?
-কারণ দু’টো। প্রথম কারণ আমি ঐ এলাকার বিডিও। আমার গাড়ি দেখেই অনেক পাব্লিক জেনে যাবে আমি ওখানে গেছিলাম। ওখানকার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী আমার চেনা। গাড়ি দেখেই ঠিক চিনে যাবে। ফলে যদি হেঁটে স্টেশনে নেমে হেঁটে যাওয়াই ঠিক করছি।
-তাতে কী আছে? তুই আমাকে বললেই পারতিস। আমার মারুতিঅল্ট্রো নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম।
-গাড়ি নিয়ে যেতে বাবাই বারণ করেছে।
-কেন?
-তাহলে দ্বিতীয় কারণটা বলি। যে বাড়িতে যাচ্ছি, পরিবারটি একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত। গরিব বললেও চলে । ফলে গাড়ি নিয়ে যেতে বাবা বারণ করেছে। আমিও ভেবে দেখলাম-
-হ্যাঁ, দেবরাজ। এটাই আসল কারণ। রিমা মাঝখান থেকে বলে ওঠে।
-তা ছাড়া আমার হবু শ্বশুরমশাই শিমুলপুর ষ্টেশনে থাকবেন বলেছেন চল একটু ঠেলাঠেলি করেই যাই। ভিড় ট্রেনে তো অনেকদিন যাতায়াত করি না। একটা অভিজ্ঞতাও হবে।
-ঠিক আছে, চল।
শান্তিপুর লোক্যাল ধরে ওরা শিমুলপুর স্টেশনে নামে। রবিবার বলে ভিড় একটু কম। তিনজনেই ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে শিমুলপুর স্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায় যেখানে পিয়ার বাবার অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু ওরা উপস্থিত হয়ে দেখে ওখানে পিয়ার বাবা নেই।
মিনিট পনেরো অপেক্ষা করার পর রূপক নিজেই সুবীরবাবুকে ফোন করে।
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আমি রূপক বলছি। আমরা স্টেশন টিকিট কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করছি।
-আচ্ছা, অপেক্ষা করতে হবে না। কাউন্টারের সামনে যে রাস্তাটা, সেই রাস্তা ধরে বাঁদিকে চলে এসো। আমি আমার দোকানেই আছি।

-আচ্ছা বেশ। ফোনে কথা শেষ করে রূপক দেবরাজকে বলে, চল, ভদ্রলোক কাছেই দোকানে অপেক্ষা করছে।
-মানে? এটা কী হল? টিকিট কাউন্টারের সামনে থাকবেন, বলছিলেন না?
-বলছিলেন তো। চল এগিয়ে যাই। এই বলে ওরা এগোয়। সামনে এক কাউন্সিলরের সঙ্গে হঠাৎ দেখা। সে রূপককে জিগ্যেস করে, স্যর এখানে?
-হ্যাঁ, একটা ব্যক্তিগত দরকারে এখানে আসা।
-আমি এই এলাকারই কাউন্সিলর। আমি কি সঙ্গে যাব? কার বাড়ি যাবেন?
-আরে নানা। সঙ্গে যাবার প্রয়োজন নেই। বললাম তো একান্তই ব্যক্তিগত একটা ব্যাপার।
-ঠিক আছে স্যর, প্রয়োজন হলে জানাবেন। পৌঁছে যাব।
-প্রয়োজন হবে না। রূপকের আবেগহীন নীরস উচ্চারণের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু না বলে কাউন্সিলর চলে যায়।
রূপক, দেবরাজ আর রিমা জুতোর দোকানের সামনে দাঁড়ায়। সুবীরবাবু দোকানেই ছিলেন।দোকানটি বেশ ছোট। পরিসরও কম। বুঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোকের আয়ের বহর। তিনি দোকানে বসে কীভাবে তাঁর বাড়ি যেতে হবে বলে দেন। পাত্র নিজে এসেছে জেনেও দোকান ছেড়ে ওঠেননি। যে উচ্ছ্বাস নিয়ে তিনি রূপকের বাবার সঙ্গে কথা বলছিলেন, সেটাও চোখে পড়ল না। ওরা হাঁটতে হাঁটতে যখন সুবীরবাবুর বাড়ির দিকে রওনা দেয়, দেবরাজ প্রথম বলে, কীরে, ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে দেবেন, অথচ ওঁর মধ্যে কোনও রকম সৌজন্যতা দেখতে পেলাম না। কোনও হেলদোল নেই। এরকম হয় না কি!
-হয়ত ব্যস্ততার কারণে পারেননি। রূপক ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও দেবরাজকে আশ্বস্ত করে।
-ভাই, আমি দেবরাজের সঙ্গে একমত। রিমার মৃদু ক্ষোভ।
-চলনা দিদি, এসেছি যখন ফিরে যাব?
-ঠিক আছে। চল।
ছ’সাত মিনিট হাঁটার পর সুবীরবাবুর বাড়ি ওরা পৌঁছে যায়। পিয়ার ভাই পিন্টু ও তার মা বেরিয়ে এসে ওদের ঘরে বসতে দেন। পিন্টুই প্রথমে সবার সঙ্গে পরিচয় বিনিময় করে। ফ্যানটা চালিয়ে বলে, আপনারা বসুন। আমি মাকে ডেকে দিচ্ছি, এই বলে ভেতরে চলে যেতে উদ্যাত হয়। রিমা তখন বলে আমি কি ভেতরে যাব?
-হ্যাঁ, আসুন না? এই বলে পিন্টু রিমাকে ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়। দুই কামরার ঘর। রান্না ঘর ও বাথরুম আলাদা। ওপরে টিনের ছাউনি। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো গোছানো। দেওয়ালে টানানো পিয়া ও পিন্টুর আঁকা বড় বড় দু’টি ছবি। রয়েছে দু’টি পেন্টিং। একটি টেবিলে প্রচুর আঁকার সরঞ্জাম।
বইয়ের আলমারিতে রবীন্দ্র রচনাবলী এবং ইতিহাসের বেশ কিছু বই। চায়ের টেবিলে আনন্দবাজার পত্রিকা ও সানন্দার সর্বশেষ সংখ্যা। পিয়ার মা ইতিমধ্যে ভেতরে ঢোকেন। রূপক ও দেবরাজ দু’জনেই ওঁকে প্রণাম করে।
-থাক, থাক বাবা। প্রণাম করা তো ইদানীং উঠে গেছে। তোমরা এসব করছ কেন? পিয়ার মায়ের প্রশ্ন।
-ছোটবেলা থেকে বাবা ও মা আমাদের শিখিয়েছেন গুরুজনদের প্রণাম করা।
-খুব ভাল। আমাদের বাড়ি চিনতে অসুবিধে হয়নি তো?
-এই এলাকার প্রত্যেক ওয়ার্ড আমার চেনা। আমার অফিস তো এখানেই।
-ও তাই তো। ভুলেই গেছিলাম। এই বলে পিয়ার মা নিজেদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন সম্পর্কে বিস্তারিত বলে ওঁদের সম্পর্কে একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করেন। তখন রূপকের বন্ধু দেবরাজও নিজের বন্ধু সম্পর্কে এবং ওদের পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানায়। ইতিমধ্যে রিমা ভেতর থেকে এসে বলে, কাকিমা, আমরা উঠব। পিয়াকে একটু ডাকুন।
-বেশ। এই বলে তিনি ভেতরে ঢুকে গেলে পিন্টু এবং পিয়ার বোন রিয়া প্লেটে করে মিষ্টি ও জল নিয়ে হাজির।
-এসবের কী প্রয়োজন ছিল! রিমা বলে।
তিনটি প্লেটে দু’টো করে রসোগোল্লা আর কাঁচের গ্লাসে জল রেখে ওরা কোনও কথা না বলে চলে যায়। কারও মুখে হাসি নেই। কোনও জিজ্ঞাসা নেই। এমনকি নিজেদের পরিচয় দিয়ে একটু সৌজন্যসুলভ কথা বলা –না সেটাও করেনি। বিষয়টা রূপকের ভালো লাগেনি। একটা দায়সারা আচরণ বলে রূপকের মনে হয়। ওরা তিনজনে একটি করে মিষ্টি খেয়ে যখন অন্য প্লেটে বাকি মিষ্টিগুলো রাখছিল, পিয়ার মা পিয়াকে নিয়ে হাজির। নমস্কার ও প্রতিনমস্কারের পালা শেষ হলে রিমাই প্রথমে কথা বলে। পিয়ার পরনে একটা ছাপা কমদামি শাড়ি। কোন সাজগোজ নেই। এমনকি চুলও এলোমেলো। পিয়াকে সুন্দরী বলা যায় না। তবে শ্যামবর্ণা চব্বিশ বছরের স্নাতকোত্তর ডিগ্রিপ্রাপ্ত পিয়ার লম্বা ও ছিপছিপে গড়্ন ও চোখ দুটো বেশ সুন্দর। রিমা যদিও ভেতরে গিয়ে কথা বলে এসেছে, তবু সে ই জিগ্যেস করে এমএ কোন ইয়ারে করেছ?
-দু’হাজার পনেরো। পিয়া মাথা নিচু করে উত্তর দেয় ।
-কোন ইউনিভারসিটি?
-কল্যাণী।
-তোমার হবি কি?
-আঁকা।
-বি এডও তো করেছ। চাকরি করতে চাও নিশ্চয়ই।
-হ্যাঁ।
রিমাদি, তুমি দেখছি ইন্টারভিউ নিচ্ছ। এই বলে দেবরাজ হাসে। সবাই হাসে। কিন্তু পিয়ার মুখে হাসি নেই। সে মাথা নিচু করে থাকে। তখন রিমা বলে, দেবরাজ চল, আমরা বাইরে যাই। রূপক আলাদা করে ওর সঙ্গে কথা বলুক। এই বলে ওরা দু’জন বাইরে চলে যায়। রূপক প্রথমে একটু অস্বস্তিতে পড়লেও কিছুক্ষণ নীরব থেকে জিগ্যেস করে, আপনি আমার কথা শুনেছেন? আমি কে এবং কি করি। কোন উত্তর না পেয়ে ফের জিজ্ঞাসা, আমাদের পরিবারকে আপনার কেমন লাগল? পিয়া মাথা নিচু করে থাকে। কোন কথা বলে না। আপনার আঁকার হাত দারুণ। এই শিল্পটাকে আমি খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখি। কত রকমের মানে একটা ছবির মধ্যে ভেসে ওঠে। পিয়ার মধ্যে কোনএ প্রতিক্রিয়া না দেখে এবং কোনও উত্তর না পেয়ে রূপক কিছুটা হতবাক। সত্যি বলতে কি সে অপমানিত বোধ করে। সে বলে, ঠিক আছে, আসুন। আপনাকে অযথা বিরক্ত করলাম ।
নির্বাক পিয়া ঘরে চলে যায়। রূপক বাইরে এসে বলে, চল, ফিরি।
-এত কম সময়ে কথা বলা হয়ে গেল?
-হ্যাঁ। চল।

রিমা পিয়ার মাকে ডাকে। এবং বিদায় জানিয়ে প্রশ্নাক্রান্ত ওরা বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ ওরা কেউ কিছু বলে না । বাড়ি ফিরতে ফিরতে নিজেকে এক ছাগলের মতো মনে হয় রূপকের, যে ছাগল অন্যের ক্ষতে স্বেচ্ছায় ফসল খেতে যায়, কৃষকের তাড়া খেয়ে ছুটে পালায়। পিয়ার বাবার উদাসীনতা ও পিয়ার ইচ্ছাকৃত মৌনতা রূপককে একটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। পিয়ার বাবার মেয়ে বিয়ে দেবার ইচ্ছে। ফোনে পাত্রের বাবাকে ছেলে পাঠাবার জন্য অনুরোধ করেন অথচ এক সুযোগ্য পাত্র নিজে উপস্থিত হলেও একটা অসৌজন্যমূলক আচরণের শিকার হবে—এসবের মানে খুঁজে পায় না রূপক। অথচ তার বাবা-মা ও মামা এসে পিয়াকে প্রথমে দেখে গেছে। পছন্দের কথা জানানো হয়েছে। তার আগে পিয়ার বাবা রূপকেদের বাড়ি গিয়ে পরিচিত হয়ে এসেছেন। দেখাশোনা করে বিয়ের ক্ষেত্রে যা হয়, তা ই হয়েছে। ফলে সুশিক্ষিত রূপক এরকম আচরণের মানে খোঁজার চেষ্টা করে।🍁

 

 

 

 

🦋কবিতা 

 

 

 

 

 

 

নির্মাল্য ঘোষ

অক্সিজেন

 

এ ঘরে অক্সিজেন ক্রমশঃ কমছে…
অথচ আমি বসবাস করি এ ঘরে।
অরণ্য হতে চেয়েছিলাম। পারিনি।

ক্রমশঃ কমছে অক্সিজেন…

শেষ রাত্রে হ্রদের তলায় ছায়া দেখা যায়। আমার খুঁটি নড়ে ওঠে। ক্রমশঃ কমে চলেছে অক্সিজেন। সহনশীলতা।

অথচ, মাঠ টপকে হাওয়া ছুটে চলে অবিরত – বনে, বাদাড়ে,জলে, জঙ্গলে, শহরে ও গ্রামে। আমি বন্ধ ঘরে বসে দেখি – হা হুতাস করি।

তবুও, অক্সিজেন কিন্তু কমেই চলেছে ক্রমশঃ…
আমার একমাত্র বন্ধ ঘরে।

এত কিছুর পরেও…

 

 

 

 

 

 

 

মুন চক্রবর্তী

এক চিলতে উঠোন

 

 

যাপন কথার রৌদ্দুর খেলা করত
উঠোনে বিছানো হতো সযত্নে পাকা ধান
বিস্ময় আনন্দে ছুঁয়ে দেখা সুগন্ধ চালের ইতিকথা
ডালা আর কোলায় চলত পানের বাটায় গল্প কথা
এক চিলতে উঠোন জুড়ে এক্কা দুক্কার ঘর, যাপনের আনন্দ সংগ্রাম।
বিকালের বারান্দায় বসত প্রতিবেশির আত্মীয়তা
বাউল বাতাসে চলত ছুটাছুটির শৈশব, কিশোর কিশোরীর দুরন্তপনা।
মৈ থেকে সিড়ি বেয়ে লিফ্টে লেখা হল নাগরিক উন্নয়ন
রাস্তায় অ্যাসিড বারুদে পুড়ল যৌবনের প্রেম
সস্তায় বিক্রি হল হালের চাষ গুদামে সিন্ডিকেট
গরীবের দরজায় কড়া নাড়ল আত্মঘাতী সভ্যতা
পাহাড়ের গায়ে আচড় কেটে উষ্ণতায় এসি এলো
যাপন কথার জোছনার উঠানে পড়ে রইল কিছু যন্ত্রণা।
অন্বেষনের তাগিদে দেশান্তরে ঘুরছে বিশ্বায়ণ
আরও চাই আরও চাই বলতে বলতে নিঃশেষ হল
গল্প কথা।
অজান্তেই মায়ার বাঁধন কেটে বেড়িয়ে আসল যত্নের রত্ন সম্ভার
স্বাধীনতার উন্মদনায় রাতের গোপন যন্ত্রণায় খুন হল মনুষত্ব,
বাড়ির উঠোন পাড় করে যে ঘরটি ছিল শত ছিদ্র
সেই ঘরে লাল পাড় সস্তার শাড়িতে মা থাকত, সস্তার ধুতিতে বাবা।
যাপন কথার কাক ভোরে ডাক দেওয়ার লোকটি আজ অকেজো, আর্বজনা।
মৈ থেকে লিফ্টের তফাৎ বুঝে উঠার আগেই ইসরোর চন্দ্রযান সফলতায়,ঘরের বন্ধ দরজায়
বিজ্ঞানে আহ্লাদিত-বিফলতায় দাঁড়িয়ে উঠোনে খুঁজে এক্কা দুক্কার শৈশব, ধানের গন্ধ যদি পায়!

 

 

 

 

 

 

পঙ্কজ বণিক

সুন্দর

 

সুন্দরের মধ্যে সামান্য খুঁত থাকা শ্রেয়
খুঁতটি বড় জাগতিক, সুন্দর মহাজাগতিক

এই জগতে যদি থাকতে হয়
খাকব খুঁত নিয়ে চিরদিন,
সুন্দরের প্যানোরামিক দৃশ্যের সামনে
এই দেহ ও মন যথেষ্ট নয়,
প্রকৃত সুন্দরের স্বরূপ ব্রহ্মবিগ্রহে আকীর্ণ
মহাকাশে সওয়ার হয় যে- নভশ্চর
মহাসমুদ্রে যাত্রা করে যে-নাবিক
তারা জানে সামনে করুণ মহাপ্রস্থান,
সৌন্দর্যের অনিশ্চিত স্বর্গ অভিমুখে…

জগতে যদি থাকতে হয়
থাকব তোমার ওষ্ঠে সৌন্দর্যের তিলটি নিয়ে
এই খুঁত মনে থাকা শ্রেয়, সহ্যের তবু,
খুঁতখুঁতে প্রাণ নিয়ে প্রত্যহ ফিরে আসতে হয় ঘরেই।

 

 

 

 

 

যতন কুমার দেবনাথ 

বনমালী বাবু 

 

 

মানুষের মন মান্ধাতা আমল
বিতর্ক নয়
আপোষের ঘানিতে মাথা পিষে বুদ্ধি বাড়াও

বাইক চালিয়ে বাতাস ধরা?
শক্ত করো হাত

হাইবারনেশন ভেঙে উঠে এসো
সময়ের আয়নায় নিজেকে মেলাও
মালীই আজ বনমালী বাবু।

 

 

 

 

 

 

কাসেম আলী রানা

পঁচা শামুক

 

 

পঁচা শামুকের মতো মুখ থুবড়ে পড়ে থাকি;
সোয়া দুই ইঞ্চি জানালার পাশে!
তোমার এতো কিসের অহংকার?
তুমি ঐটুকুই জায়গার মালিক জন্ম থেকে জন্মান্তর।

 

 

ঠাকুরমার অনুগল্প

 

রাজা সাহেব নগ্ন হয়ে-
প্রজাকূলের মাথার উপর ক্রমশঃ জল ঢালেন।
গরম জলে-
প্রজাদের দেহের চামড়া পুড়ে পুড়ে ঝলসে যায়,
লাল মাংসে ক্ষত হয়,ক্ষতের পুঁচ রসের লোভে
পৃথীবির যাবতীয় পোকা-মাকড় সেখানে স্হায়ী ভাবে বসত করে।
রাজা সাহেব এতো কিছু বোঝেন না।
মোসাহেবি মালিশে তিনি ঘুমান, দীর্ঘ ঘুম।
এই রাজ্যের সকল সুখ
বিলীন হয় পৃথিবীর গর্ভে আদিম সভ্যতার মতো।

একদিন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে এক নতুন প্রজন্ম।
তারা রাজা সাহেবের নগ্নতাকে হত্যা করে।

 

 

খাস

 

তুমি ফুল তুমি ঘাস তুমি সুখ বারোমাস
তুমি ফড়িং তুমি পাখি তুমি সাদা কাশ।
তুমি উছল তুমি উতলা
তুমি উর্বর তুমি উজলা।
তুমি সাগর, তুমি ঢেউ, তুমি আমার খাস!

 

 

 

 

 

 

রুমানা আকতার 

ছোঁয়ার বাইরে

 

 

আমার কিছু কথা ছিল,
তোমায় বলার ছিল।
আমার কিছু অভিমান ছিল,
তোমার কাছে ছোট্ট কিছু আবদার ছিল।

তোমার উপর রাগ ছিল,
ভেবেছিলাম ভুলিয়ে দেবে আদর দিয়ে।
তোমার সাথে রাতভোর গল্প করার ছিল,
একটা রাত চেয়েছিলাম তোমার থেকে।

আমার কিছু স্বপ্ন ছিল,
তোমার বুকে মাথা রাখার ছিল,
একটু জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে ছিল,
একটু বৃষ্টি ভেজার শখ ছিল,
একটু আল্লাদী কন্ঠে বায়না করার ছিল,
আর ছিল তোমার ভালোবাসার…

তুমি আর আমার স্বপ্নরা,
আজ আমার থেকে দূরে ।
না, হয়তো আমি তোমাদের থেকে দূরে-
দূর বহু দূরে…!

 

 

 

 

 

 

পার্বতী রায়

অক্ষত

 

 

তোমাকে অক্ষত রাখি
ভেতরে বৃষ্টি পড়ে

নিভে যাওয়ার আগে
নিভে যাওয়ার পরে
খেয়াল রেখো ছন্দ

প্রিয় বিষয়ের ওপর লিখতে গিয়ে দেখি
পাখি উড়ে গ্যাছে

 

 

 

 

 

কণিকা বিশ্বাস

মৃত্যু

 

 

ব্রহ্মকালে শিউলি ঝড়া
যেন শেষ অতিথির কড়া নাড়া।
মৃত্যু চেনে পুরোনো পোষাক
পোষাক জানে আরশি ঘাট।

আরশি ঘাটে বিম্বিত নিষ্ঠুর আলো
কত উতরোল কত বিনিদ্র রাত জমকালো।
সে কালো আকাশ গঙ্গার মতো
ফুলকি হয়ে ফোটে অতৃপ্ত বাসনা যত।
ঝড়াফুল গন্ধের আয়ুটুকু ক্ষীণ
সত্তাটুকু হোক একদিন গন্ধের মতো বিলীন

 

 

 

 

 

 

পাপড়ি দাস সরকার

উৎসর্গ

 

 

অবাধ্য এবং বাধ্যতার মধ্যেই
উৎসর্গকৃত প্রাণীদের রক্ত ছড়িয়ে পড়ে
সবুজ সব ঘাসে, মাটিতে।
তারপরে মাংসে, হাড়ে, অস্থি ও মজ্জায়
আমাদের খুন করা হাত ;
পশুত্বের লজ্জা বাড়ে,
দ্বিধানিত প্রাণ কাঁপে।
যুগের পর যুগ ঐতিহ্যর লাল সূর্য ওঠে
আমাদের আঙিনায়।

 

 

 

 

🦋ধারাবাহিক উপন্যাস/১২ 

 

 

সোমার স্বরপ্রক্ষেপণ নকল করে। অনঙ্গর বলার ভঙ্গীতে সোমা হেসে উঠতেই আশপাশের হাওয়া যেন এই উত্তাপেও শৈত্য খুঁজে পেল। অনঙ্গও হেসে উঠলেন। ‘ও… ব্যাসদেব কি তাহলে আজ লিখতে বসবেন?’ সোমা কখনও কখনও মজা করেই অনঙ্গকে ‘ব্যাসদেব’ বলে ডেকে থাকেন। হ্যাঁ, মজা করেই, বিদ্রুপ করে নয়। সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অনেকটা গল্পের মতো’। আজ দ্বাদশ পর্ব।  

 

 

 

অনেকটা গল্পের মতো

সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

 

”কি করি আজ ভেবে না পাই
পথ হারিয়ে কোন বনে যাই
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই
সকল ছেলে জুটি!
আ হা হা হা হা”…

 

অমৃত কথা:

অনেকদিন ধারাবাহিক লেখাটায় হাত দেননি অনঙ্গ। ক’টাদিন ব্যক্তিগত জীবনের আনন্দের স্রোতে ভেসেছিলেন। পাশের পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তী, বিবাহবার্ষিকী এসব নিয়ে কাটিয়েছেন। অবসর জীবন বোধহয় দুশ্চিন্তাহীন ব্যস্ততা চায়। আবার এটুকু তো না করলেও নয়, জীবনের জন্যও তো এসবই একটু আধটু জরুরী। সেসব করতে করতেই দেরী হয়ে গেল। একা মানুষ, কাজও তো কিছু কম নয়। লোকে অনেক কিছু বলে, ‘হেহ ! তোমার আবার কি হে। ঝাড়া হাত পায়ের সংসার!’ অনঙ্গ উত্তর দেন না, মৃদু হাসেন, তারপরই ‘চলি গো’ বলে হাঁটা দেন নিজের পথে। একটা শিক্ষা উনি জীবন থেকে পেয়েছেন। মানুষ যখন কোনও মন্তব্য করে, তার অনেক আগেই সে সেটা সম্মন্ধে নিজের মনের কাছে নিশ্চিত থাকে যে, সে একশো শতাংশ সঠিক বলছে। অতএব, তার সঙ্গে তর্কে মেতে ওঠা নিছকই মূর্খামি। ঐ বাঁশের দৈর্ঘ্য মাপার গল্পের মতো, বেশিরভাগ মানুষই দৃশ্যমান অংশটুকুই মেপে তার পরিমাপ বলে দেয়। খুব কম মানুষই আছেন, বাঁশটার প্রোথিত অংশটুকুও মেপে তারপর সম্পূর্ণ পরিমাপটা বলে থাকেন।
এখন বড়ো ভয় হয় অনঙ্গর। যদি শেষ করতে না পারেন! যদি অসমাপ্ত থেকে যায়! যদিও নিজেও জানেন যে, উনি এমন কোনও ব্যক্তিত্ব নয় যে, তার সম্মন্ধে লেখা হবে… “উনি তার সাহিত্য জীবনে পাঁচ শতাধিক কবিতা, একশোর বেশি ছোটগল্প, কিছু ভ্রমণ বিষয়ক লেখা, রম্যরচনা ও একটি অসমাপ্ত উপন্যাস রচনা করে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে রেখে গেছেন অগণিত বন্ধু। তবুও কোনও কাজই ফেলে রাখা কাজের কথা নয়। চাকরী জীবনে শুধুমাত্র এই কারণেও তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সুনজরে থেকে এসেছেন। তাহলে এই গড়িমসি কেন?
সকালের জলখাবার খেয়ে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। জরিপ করলেন তার অগোছালো জীবনের মতোই অগোছালো টেবিলের ভদ্রস্থ রূপ। বহুবার সোমাকে তাঁর টেবিলে হাত দিতে নিষেধ করলেও ‘কে শোনে কার কথা!’ তার রাইটিং প্যাড, কলম, ক্লীপ সব পেনস্ট্যান্ডে এবং টেবিলে দেখে আশ্বস্ত হলেন। না, কোথাও কোনো ফাঁক নেই। তাহলে এবার বসা যেতেই পারে। চেয়ার টেনে বসতে যাবেন, সোমার গলা কলিং বেলের মতো বেজে উঠল। এগিয়ে আসতে থাকল তার কথনের শব্দ, ‘এই শোনো না, তুমি বাজার যাবে তো ! একটু ‘! প্রায় থামিয়ে দিয়ে অনঙ্গ বলে উঠলেন, ‘এই শোনো না! এই চড়চড়ে রোদ্দুরে আমি আজ বাজার যাবো না গো ‘। প্রায় সোমার স্বরপ্রক্ষেপণ নকল করে। অনঙ্গর বলার ভঙ্গীতে সোমা হেসে উঠতেই আশপাশের হাওয়া যেন এই উত্তাপেও শৈত্য খুঁজে পেল। অনঙ্গও হেসে উঠলেন। ‘ও… ব্যাসদেব কি তাহলে আজ লিখতে বসবেন?’ সোমা কখনও কখনও মজা করেই অনঙ্গকে ‘ব্যাসদেব’ বলে ডেকে থাকেন। হ্যাঁ, মজা করেই, বিদ্রুপ করে নয়। সোমা বিশেষ সাহিত্যানুরাগী নয়, কিন্তু লোকমুখে অনঙ্গর লেখালেখির হাত নিয়ে অল্প বিস্তর প্রশংসা শুনে শুনে কখন যেন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, তার বাড়িতেও একজন সাহিত্যিক থাকে এবং সেই ধারণা থেকেই এই নামের উৎপত্তি।
‘না, বলছিলাম কি, তুমি বাজারে গেলে একটা জিনিস আনতে বলতাম…’।
অনঙ্গ প্রমাদ গোনেন। তাহলে বোধহয় আজ আর লেখাটা নিয়ে বসা হল না। শেষ চেষ্টা করার মতো করে বলেন, খুব দরকার না থাকলে বোলো না। সোমা নিমরাজী হয় কিন্তু তার বক্তব্য পেশ করে, ভাবছিলাম ঘরে পোস্ত তো আছেই, তুমি ভালবাসো, তাই একটু বিউলির ডাল করব। মৌরীটা নেই দেখলাম, বিউলির ডাল মৌরী ছাড়া… তবে থাক, আজ আর বিউলির ডাল করব না। টক ডাল দিয়ে পোস্ত ভালো লাগে না… স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করতে থাকে। আসলে ভাবতে থাকে নিরামিষভোজী অনঙ্গকে আজ কি দিয়ে খেতে দেবেন। অনঙ্গ বোঝেন। তাদের এই অভাবের সংসারে অভাব বুঝতে না পারার এবং লোক লৌকিকতা সব সামলে চলার এক এবং একমাত্র মানুষ সোমা। নিজের জন্য কোনও বায়নাক্কা নেই। শুধু অনঙ্গকে চিন্তামুক্ত ও সুখী রাখতে পারলেই সে সুখী। কোথায় যেন সোমার জন্য বুকের মধ্যে একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করেন অনঙ্গ। কিছুই না দিতে পারার ব্যথা। কারণ, সোমার দিক থেকে কোনো চাওয়া নেই বলেই বোধহয় এই ব্যাথার বোধ। সোমা ঘর থেকে বেরোতে যাবার জন্য ঘুরতেই অনঙ্গ সোমার হাত টেনে ধরেন। ঘুরে তাকায় সোমা। ‘কি হোলো? ছাড়ো! এখন অনেক কাজ আমার।’ অনঙ্গ ছাড়েন না। বরং কিছুটা হ্যাঁচকা টানে বুকের কাছে টেনে নেন, অনেকটা তপ্ত নিঃশ্বাস ঢেলে দেন সোমার ঠোঁটে, মুখে বুকে অনেকদিন পর। তারপর মুখ তুলে সোমার চিবুকে হাত রেখে বলেন, এটা তোমার বিশেষ দিনের বকেয়া পাওনা মেটালাম। বলেই হাসতে হাসতে আবার বলতে থাকেন, ‘বিউলির ডাল, শুকনো ঝালঝাল আলুপোস্ত আর গন্ধরাজ লেবু আমার ভীষন প্রিয়, কিন্তু তার চেয়েও প্রিয় যে আমার এই মানুষটা। তাকে দিয়ে এই গরমে রান্না করানো খাবার যে আমার মুখে রুচবে না। শোনো না, ফ্রীজে লেফট ওভার যা আছে, তাই দিয়েই আজ চালিয়ে নাও। দুপুরে দু’টো ভাত ফুটিয়ে নিও। আজ তোমার রান্নাবাটি থেকে ছুটি। সন্ধ্যেয় দু’জনে বেরিয়ে সব কিনে আনব’খন। তোমার সেদিনের আইসক্রিমটাও তো পাওনা আছে। শরীর খারাপের জন্য তো সেদিন খেতেই পারলে না। তোমার জন্যই স্কুপ বাটারস্কচ অর্ডার করেছিলাম। চলো, আর যা যা বকেয়া পাওনা আছে, সব আজ মিটিয়ে দেব। ধার বাকী রাখব না। ঐ যে বলেছে না,
“বাকী রাখা খাজনা
মোটে ভালো কাজ না।” বলেই এক চোখ টিপে ইসারায় দুষ্টু কিছুর ইঙ্গিত করলেন। ‘তুমি বরং আর এককাপ চা দাও দেখি।’
অনঙ্গ লক্ষ্য করলেন সোমার মুখে হাজার ওয়াটের আলো।
এই যাঃ! অনঙ্গ তো আজ অমৃত কথা লিখবেন ঠিক করেছিলেন, তার জায়গায় অনঙ্গর রান্নাঘরে যে পাঠককে উঁকি দেবার ব্যবস্থা করে দিলেন। কথাটা ভেবেই মনে মনে হেসে উঠলেন।
অনঙ্গ রাইটিং প্যাড, পেন সব হাতের সামনে গুছিয়ে বসে আগের পর্বগুলো একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। সোমা তার রিনরিনে গলায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গুনগুন করে গাইতে গাইতে ঢুকছে শুনতে পেলেন অনঙ্গ। গানটা অন্তরা থেকে ধরেছে না অনঙ্গর কাছেই অন্তরা এসে পৌঁছল সেটা বুঝতে পারলেন না কিন্তু খুশি খুশি গলায় গেয়ে ওঠা গানটা সোমার গলায় এই সকালে শুনে বেশ ভালো লাগল,
”কি করি আজ ভেবে না পাই,
পথ হারিয়ে কোন বনে যাই
কোন মাঠে যে ছুটে বেড়াই
সকল ছেলে জুটি… আ হা হা হা হা…”
চাটা টেবিলে রেখেই অনঙ্গর গলা জড়িয়ে ধরল সোমা।
এই হঠাৎ করে রান্না থেকে ছুটি পাওয়াতেই ওর খুশি
একটা মুক্তির স্বাদ। এমন ছোটখাটো মুক্তির, আনন্দের জায়গাগুলো অনঙ্গ বিলক্ষণ জানেন আর জানেন বলেই… সোমার ছোটখাটো খুশির দরজাগুলো মাঝেমাঝেই হাট করে খুলে দেন। কখনও একটা ক্যাডবারিস চকোলেটের বার, কখনও একগুচ্ছ গোলাপ, এসবই সোমাকে তার মনের কুঠুরী থেকে বের করে আনতে পারে। অনঙ্গ সব জেনেও নিজেকে সোমার থেকে আলগা করে নিয়ে বলেন, হঠাৎ মনে এতো পুলক জাগলনকিসে? তোমার মধ্যে দেখছি রবিঠাকুরের সেই গান : “প্রাণে খুশীর তুফান উঠেছে, উঠেছে এ এ…” নিজেই এক কলি গেয়ে উঠলেন। সোমা উত্তর দিল না। শুধু নিজের আনন্দে বিভোর হয়ে গানটা গুনগুন করতে করতে বেরিয়ে গেল।

**

অনঙ্গ চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরালেন। চোখ বুজে মনের মধ্যে নিজেকে আত্মস্থ করলেন। সিগারেটটা অ্যাস্ট্রেতে গুঁজে দিয়ে কাগজ পেন টেনে নিয়ে লিখতে শুরু করলেন অমৃত কথা।
না, এই অমৃত কথা কোনও ধর্মীয় বানী নয়, তাঁর উপন্যাসের কোনও এক পরিবারের একটি চরিত্র।
…সেই যে অমৃত দত্ত, মা প্রভাবতী দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ পড়া না পারা বাচ্চা ছেলের মতো দাঁড়িয়ে, তারপর একসময় প্রায় ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর আর মায়ের সঙ্গে দেখা করা হয়নি। শর্মির বাসায় সেই যে এসে উঠেছেন, খুব প্রয়োজন ব্যতিরেকে বিশেষ বাইরে বের হন নি। সবসময়ই মনে হয়েছে, এই বুঝি পরিচিত কারুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাহলে কি অমৃত অপরাধ বোধে ভুগছেন? অমৃত এতো কিছু বোঝেন না। তার পরিবারে লেখাপড়ায় একমাত্র তিনিই অন্যদের ধারপাশ দিয়েও যাননি। তবে ব্যবসাবুদ্ধিতে তার ক্ষমতা অপরিসীম। ব্যবসায় কোথা থেকে, কি দিয়ে নয়কে হয় এবং নয়কে ছয় করতে হয়, সে ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত বললে কোনোভাবেই সত্যের অপলাপ বা অত্যুক্তি করা হবে না। মাত্র কয়েকশো টাকা পুঁজি নিয়ে বেরিয়ে অমৃত দত্ত কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছে একটা সুপরিচিত নাম হয়েছিলেন মাত্রই কয়েকটা বছরে। টিম্বার মার্চেন্ট অমৃত দত্ত তখন বাংলা, বিহার উড়িষ্যার জঙ্গলে অঘোষিত বা স্বঘোষিত রাজা। আর একটা ব্যাপারে অমৃত দত্ত নিজের কাছে পরিষ্কার… যেভাবেই হোক আর্থিক স্থিতি ঠিক রাখতে হবে। সে যে কোনো মূল্যেই। তাই হঠাৎ করে যখন ব্যবসায় মন্দা এলো, যখন দু-দু’টো চালানের বেআইনী মেহগিনি কাঠের গাড়ী বন দপ্তর থেকে ধরা পড়ল। নিজেও ক’দিন শ্রীঘর বাস করে এলেন। সেইসময় তিনি প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। ক’য়েকমাসে নাওয়া খাওয়া মাথায় ওঠায় শারীরিক অসুস্থ হয়ে কোচবিহারের হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানেই পরিচয় স্টাফ নার্স ঊর্মি সান্যালের সাথে। (ক্রমশঃ)

 

 

অঙ্কন : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক 

 

 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। -মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment