Sasraya News

Wednesday, April 23, 2025

Sasraya News Sunday’s literature Special | 15th December 2024 | Issue 43 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৩

Listen

সম্পাদকীয় 

মৃত্যু হচ্ছে মায়া! একথা আমরা সকলেই জানি। আরও জানি যে জন্ম নিলে মৃত্যু হবে। জেনেও আমাদের মধ্যে “কিন্তু” থেকে যায়! ভোগ বিলাসিতা হিংসা তছরূপ রাহাজানি ছিনতাই সবরকম সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে। অর্থ আমাদের সমাজকে একে অপরের থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি একজন মানুষ হয়ে উঠবার স্বপ্ন দেখলেও তার মর্যদা নেই কারণ একটাই একটাই অর্থ। ১০০ কোটিতে যদি একজন উদাহরণ হয়ে ওঠে তাহলে সাড়ে সাতশো কোটিতে ৭ জন উদাহরণ হয়ে দাঁড়ায়। এটা হাস্যকর বিষয়। কারণ অকারণ না ভেবেই ও পাড়লো তুই কেন পারবি না; সে পারলো তুই কেন পারবি না! এই বিষয় টিও না বিবেচনা করেই বলে থাকি আমরা। আসলেই ভুল। এই ভুল স্বীকার করবার ক্ষমতা আমাদের নেই। আর থাকবেই বা কি ভাবে। আমিও তো ঐ ভাবেই ছোট থেকে কুড়িয়ে এসেছি সমস্ত শব্দ। তাহলে আমাদের প্রথাগত ভাবেই দুর্বল হয়ে থাকি। এই বিষয় থেকে বেরিয়ে এসে।

 

 

প্রকৃত প্রতিভার বিকাশ ঘটান প্রয়োজন। না হলেই ধর্ম নিয়ে যা চলছে তা লজ্জার বিষয়। যদি ঈশ্বর সামনে থাকতেন তাহলে অবশ্যই তিনি এই সমাজ থেকে দূরত্ব তৈরী করে চলে যেতেন। তিনি তো কাউকেই ধর্ম বিশ্বাস যোগ্যতা অর্জন করতে সৃষ্টি করেননি। তিনিও একটি সুন্দর সৃষ্টির আনন্দ নিতে চেয়েছেন। অথচ কাল জয়ের রহস্যের পার্থক্য তৈরী করছেন মানুষ। 🍁

 

 

🍂স্মরণ : কবি হেলাল হাফিজ

 

 

 

হেলাল হাফিজ এর কবিতাগুচ্ছ 

উৎসর্গ

 

আমার কবিতা আমি দিয়ে যাবো
আপনাকে, তোমাকে ও তোকে।

কবিতা কি কেবল শব্দের মেলা, সংগীতের লীলা?
কবিতা কি ছেলেখেলা, অবহেলা রঙিন বেলুন?
কবিতা কি নোটবই, টু-ইন-ওয়ান, অভিজাত মহিলা -সেলুন?

কবিতা তো অবিকল মানুষের মতো
চোখ-মুখ-মন আছে, সেও বিবেক শাসিত,
তারও আছে বিরহে পুষ্পিত কিছু লাল নীল ক্ষত।

কবিতা তো রূপান্তরিত শিলা, গবেষণাগারে নিয়ে
খুলে দেখো তার সব অণু-পরমাণু জুড়ে
কেবলি জড়িয়ে আছে মানুষের মৌলিক কাহিনী।
মানুষের মতো সেও সভ্যতার চাষাবাদ করে,
সেও চায় শিল্প আর স্লোগানের শৈল্পিক মিলন,
তার তা ভূমিকা চায় যতোটুকু যার উৎপাদন।

কবিতা তো কেঁদে ওঠে মানুষের যে কোনো অ-সুখে,
নষ্ট সময় এলে উঠানে দাঁড়িয়ে বলে,–
পথিক এ পথে নয়
‘ভালোবাসা এই পথে গেছে’।

 

 

যাতায়াত

 

কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না
রাত কাটে তো ভোর দেখি না,
কেন আমার হাতের মাঝে হাত থাকে না; কেউ জানেনা।

নষ্ট রাখীর কষ্ট নিয়ে অতোটা পথ একলা এলাম
পেছন থেকে কেউ বলেনি করুণ পথিক
দুপুর রোদে গাছের নিচে একটু বসে জিরিয়ে নিও,
কেই বলেনি ভালো থেকো সুখেই থেকো।
যুগল চোখে জলের ভাষায় আসার সময় কেউ বলেনি
মাথার কসম আবার এসো।
জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।

লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম।
ক্যাঙ্গারু তার শাবক নিয়ে যেমন করে বিপদ পেরোয়
আমিও ঠিক তেমনি করে সভ্যতা আর
শুভ্রতাকে বুকে নিয়েই দুঃসময়ে এতোটা পথ
একলা এলাম শুশ্রূষাহীন।
কেউ ডাকেনি তবু এলাম, বলতে এলাম ভালোবাসি।

 

 

তুমি ডাক দিলে

 

একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতোটা কাঙাল,
কতো হুলুস্থুল অনটন আজন্ম ভেতরে আমার।
তুমি ডাক দিলে
নষ্ট কষ্ট সব নিমেষেই ঝেড়ে মুছে
শব্দের অধিক দ্রুত গতিতে পৌছুবো
পরিণত প্রণয়ের উৎসমূল ছোঁব
পথে এতোটুকু দেরিও করবো না
তুমি ডাক দিলে
সীমাহীন খাঁ খাঁ নিয়ে মরুদ্যান হবো,
তুমি রাজি হলে
যুগল আহলাদে এক মনোরম আশ্রম বানাবো।
একবার আমন্ত্রণ পেলে
সব কিছু ফেলে
তোমার উদ্দেশ্যে দেব উজাড় উড়াল,
অভয়ারণ্য হবে কথা দিলে
লোকালয়ে থাকবো না আর
আমরণ পাখি হয়ে যাব, – খাবো মৌনতা তোমার।

 

আমার সকল আয়োজন 

 

আমার শৈশব বলে কিছু নেই
আমার কৈশোর বলে কিছু নেই,
আছে শুধু বিষাদের গহীন বিস্তার।
দুঃখ তো আমার হাত–হাতের আঙুন–আঙুলের নখ
দুঃখের নিখুঁত চিত্র এ কবির আপাদমস্তক।

আমার দুঃখ আছে কিন্তু আমি দুখী নই,
দুঃখ তো সুখের মতো নীচ নয়, যে আমাকে দুঃখ দেবে।
আমার একেকটি দুঃখ একেকটি দেশলাই কাঠির মতন,
অবয়ব সাজিয়েছে ভয়ঙ্কর সুন্দরের কালো কালো অগ্নিতিলকে,
পাঁজরের নাম করে ওসব সংগোপনে
সাজিয়ে রেখেছি আমি সেফ্‌টি-ম্যাচের মতো বুকে।

 

 

 

🍂ধারাবাহিক উপন্যাস | পর্ব ৬ 

 

শুরু হয়েছে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। কবি তৈমুর খানের জীবন। বাল্য-কৈশোরের দিনগুলি কেমন ভাবে কেটেছিল। মননে চেতনায় কিভাবে বয়ে গেছিল উপলব্ধির স্রোত। কেমন করে প্রকৃতি ও জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন। কেমন করে জীবনে এলো ব্যর্থতা। সেসব নিয়েই নানা পর্ব। আজ পর্ব ৬।

 

একটি বিষণ্ণরাতের তারা

তৈমুর খান

 

 


রুমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল

 

কত রাত জেগে আর পড়াশোনা করা যাবে? সারাদিন কাজ করার পর রাতে পড়াশোনার সমর্থ্য থাকে না। কিছুক্ষণ পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে যাই। দেয়ালে অজস্র ফাটল।।বৃষ্টি হলে চালের ফুটো দিয়ে জল পড়ে। তখন আধ ভেজা অবস্থায় জেগে উঠে কোনো পাত্র পেতে দিতে হয় না হলে সম্পূর্ণ ঘরটিই স্যাঁতসেঁতে হয়ে যাবে। সে রাতে আর ভালো ঘুম হয় না। একদিন একটি কালাচ সাপ আমার বালিশের তলায় আত্মগোপন করে ছিল। হঠাৎ তাকে দেখে বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। তবুও সেখানেই আমাকে ঘুমোতে হয়। জায়গার সংকটের জন্য।
মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি বলতে তেমন কিছুই নেই। টিউশন পড়ার মতো সময় ও টাকার বড়োই অভাব। কোথা থেকে টাকা আসবে? বোনের বিবাহ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে যে ধার-দেনা হয়েছে তা পরিশোধ করাই কঠিন। তাই মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়। কতগুলো কঠিন অংক সমাধান করার জন্য কারো কারো কাছে যেতে হয়। কিন্তু তাতেও বিশেষ কিছু লাভ হয় না। ১৯৮৩ সালের সেই সব বিপন্ন দিনগুলিতে তখনো স্বপ্ন দেখার অভ্যাস তৈরি হয়নি। জীবন এক ছেঁড়াখোঁড়া মরচে পড়া লোহার মতো। নিজের কতটুকু ইস্পাত আছে তা বোঝার ক্ষমতা ছিল না। শুধু একটা ধারণা শক্তি জন্মেছিল মনে। যার ফলে মনে হতো সবকিছু যেন ডিঙিয়ে যেতে পারবো। কিন্তু সেই সময় একটি অঘটন ঘটে গেল। আমার সবচেয়ে প্রিয় এবং সবচেয়ে আপন দাদুর মৃত্যু ঘটলো। খুব ছোটবেলা থেকেই দাদুর সঙ্গে বিভিন্ন গ্রাম-গ্রামান্তরে ঘুরতাম। হাটে-মাঠে দোকান-বাজারে সবাই তাঁর আপন ছিল। সবার সঙ্গেই কোনো না কোনো সম্পর্ক নিয়েই দাদু কথা বলতো। দূরের কোথাও গেলে পরিচিত কোনো বাড়িতে ঢুকে জলখাবার চেয়ে নেওয়ার জন্য কোনো দ্বিধা করতো না। সারাদিন মাঠেই কাজে মেতে থাকতো। ঘাস কাটা থেকে ধানের বীজ রোপন, ধান কাটা, মাড়াই করা এবং ইক্ষু চাষেও দাদু খুব দক্ষ ছিল। পক্ষাঘাত রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রায় বছর পাঁচেক শয্যশায়ী। সেই সময়ই আমাকে বেশি দেখাশোনা করতে হতো। একটা হাত আমার ঘাড়ে চাপিয়ে অন্য হাতে একটা লাঠি নিয়ে বাইরে বসাতাম। আত্মীয়-স্বজনেরা কেউ দেখা করতে এলে দাদু তাঁদের পুরনো দিনের কথা শোনাতো। ব্রিটিশদের শাসন কেমন ছিল, গান্ধীজী কখন এসেছিলেন, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ভাগ হওয়ার সময় মানুষের উপর কেমন অত্যাচার হয়েছিল সেসব ইতিহাস ঝর ঝর করে বলতো। আমিও শুনতে শুনতে চোখের সামনে সেই সব দিনগুলি কল্পনা করে নিতে পারতাম। কেউ কিছু খাবার দাদুকে দিলে, তৎক্ষণাৎ দাদু তা খেতো না, আগে আমাকে খাওয়ানোর পর খেতো। মিথ্যেবাদী এবং ময়লা পোশাক পরিহিত কোনো ব্যক্তি দাদুর কাছে এলে দাদু তাকে সহ্য করতে পারতো না। নিরীহ একটি নির্ভেজাল মানুষ হিসেবেই সারা তল্লাটে তাঁর পরিচয় ছিল। তাঁর আদর্শ মানুষ ছিলেন গান্ধীজী। লেখাপড়া না জানলেও নাম সই করতে বললে বড় বড় অক্ষরে দাদু লিখে ফেলতো ‘নবির খান’। অসুস্থতার সময় নিঃসঙ্গ দিনগুলিতে দাদুর কন্ঠে ছিল আক্ষেপ ও হতাশার সুর। প্রায়ই মাঝে মাঝে গাইতো:
সুখের সময় আইলি রে কোকিলা
দুঃখের সময় আইলি না।
সুখের কথা শুনলি রে কোকিলা
দুঃখের কথা শুনলি না।
দাদুর কষ্ট দেখে চোখ দিয়ে জল পড়তো। সান্ত্বনা দেবার মতো কিছুই পেতাম না। যে দাদু মানুষের সঙ্গে মানুষের কত ভালো সম্পর্ক হতে পারে তা শিখিয়েছিল, সকলকে আপন করে নেওয়ার মন্ত্র দিয়েছিল—এই দাদুকেই হারালাম। একদিন রোগশয্যা থেকেই দাদু আমাকে ডেকে বললো:
—আমি যখন থাকবো না, তখন তুই আমার মতো হবি। কারো সঙ্গে কখনো ঝগড়া করবি না। দুঃখ পেলেও পিছিয়ে যাবি না। কষ্টের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবি।
—আমি কি তা পারবো?
—এগুলো পারার জন্য শুধু মনের দরকার। টাকাকড়ি লাগে না। শুধু একজনের উপরেই ভরসা রাখিস।
আজও সেই একজনের উপরেই ভরসা রেখে চলি তিনি বিশ্বনিয়ন্তা। কিন্তু তবু তো দুঃখের গান গাইতে হয়। একাকিত্বের অন্ধকারে নিজেকেই খুঁজতে হয় কোথায় আমার সেই দৃঢ় সত্তা। এক একবার দাদুকে দেখি। তাঁর কথাগুলো এখনো উচ্চারিত হয় আমার অগোচরে। শেষদিন যখন খাটিয়াতে করে নিয়ে গিয়ে গোরস্থানে দাদুকে নামানো হলো, তখনকার ছবিটি কিছুতেই ভুলতে পারি না। কবরের গর্তের মধ্যে উত্তর দিকে মাথা করে দাদুকে শোয়ানো হলো। সাদা কাফনের ওড়নাটা খুলে দেখানো হলো মুখমণ্ডল। দেখলাম সেই শান্ত নিরীহ মুখ চোখ বুজে আমাকেই ইঙ্গিতে কী বলতে চাইছে। সামান্য কবরের গর্তটুকুকেই আমার মনে হচ্ছিল পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। দাদু যেন বলছে: —চললাম আমি! অনেকদূর চলে যাচ্ছি! আর দেখা হবে না!
তারপর মাটি দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো সেই মুখটিও। শূন্য হয়ে ঘরে ফিরলাম। সেই কবরস্থানের পাশ দিয়ে গেলে দাদুর ডাক যেন আজও শুনতে পাই: চললাম আমি….!
আশ্বিন মাসে আমাদের বেশি কষ্ট হতো। মাঠের সবুজ ধানগুলির শিষ তখনো পুষ্ট হতো না। সেই কাঁচা ধানই কেটে এনে সিদ্ধ করে চাল বের করা হতো। এবং সেই চালই মাড়ভাত রান্না করে খাওয়া হতো। আর সেই সময়েই হয়েছিল আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষা। ভিন গ্রামের স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাওয়াও একটা হাঙ্গামার ব্যাপার ছিল। তবু কষ্ট করতেই হতো। সেই ভাবেই পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসেছিলাম। পরীক্ষাহলটি ছিল নলহাটি হরিপ্রসাদ হাইস্কুল। প্রথম দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত পরীক্ষা হলের প্রতিটি রুম তটস্থ করে রেখেছিলেন সেই সময়ের প্রধান শিক্ষক বিশ্বরূপ কাঁঠাল। পরীক্ষাহল না পুলিশের আবাসভূমি তাই ভাবতাম। ধমক এর পর ধমক। ভয়ে কারো কারো পেচ্ছাপ পর্যন্ত বেরিয়ে যেত। কারো সঙ্গে যেমন কথা বলার জো ছিল না, তেমনি কোথাও ঘাড় ঘোরাবার অবসর ছিল না। দীর্ঘশ্বাস ফেললেও চেপে চেপে ফেলতে হতো যাতে শব্দ না হয়। এভাবেই পেরিয়ে গেছিল পরীক্ষার সময়টুকু।
কেমন পরীক্ষা দিয়েছিলাম? খুব ভালো যে দিতে পারবো না তা আগে থেকেই জানতাম। তবু লেখার ক্ষমতা ছিল বিশেষ করে বাংলা ভাষা সাহিত্য, ইতিহাস, ভূগোল এবং বিজ্ঞানের কিছু কিছু অংশ। ইংরেজিতে লিখেছিলাম our favourite hero নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসকে নিয়ে একটি প্রবন্ধ। ওয়ার্ডস ওয়ার্থের We are seven কবিতাটির কথা এখনো মনে আছে। বাংলার উৎসব নিয়ে বাংলায় লেখা রচনাও আমার কাছে ছিল খুব সদর্থক এবং উল্লেখযোগ্য বিষয়। যাইহোক পরীক্ষার রেজাল্ট যে সেকেন্ড ক্লাস হবে তা কখনো ভাবতে পারিনি। কিন্তু তার প্রমাণ পেলাম তিন মাস পর যেদিন ফল প্রকাশিত হলো। পাশের তালিকায় মাত্র কয়েকজনই ছিলাম। সেখানে আমার নামটিও জ্বলজ্বল করছিল। পুরনো একটি পাজামা আর হাফ-হাতা একটি শার্ট পরে খালি পায়ে পরীক্ষার মার্কশিট নিয়ে সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আবার পড়বো কিনা তখনো তার কোনো ভরসা ছিল না। পাড়ার লোকে আমার পাশ করা শুনে অনেকেই বলেছিল ‘ওরকম পাশ দেওয়া ছেলে এখন ঘরে ঘরে অনেক আছে।’
এই বছরই রামপুরহাট মহাবিদ্যালয়ে কলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। পুরনো সেই সাইকেল চেপেই রামপুরহাট আসতে হতো। পকেটে থাকতো বাবার দেওয়া দু-চার আনা পয়সা। গ্রাম থেকে আসা ছাত্র শহরের পরিবেশে অনেকটাই বেমানান ছিলাম। সস্তা একখানা জামা গায়ে আর পরনে সাদা পাজামা। ঘাড়ে একখানা সাইড ব্যাগ। ব্যাগে শুধু একখানা খাতা। কারো সঙ্গে মিশতে পারি না। কথা বলতে পারি না। জড়োসড়ো হয়ে ক্লাসের একধারে বসি। রঙিন মেয়েদের আনাগোনা চলতে থাকে। আমাকে দেখেও হাসাহাসি করে। চোখ নাচায়। মুখটি রাঙা হয়ে ওঠে লজ্জায়। মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি।
একদিন রুমা এসে বলে, তুমি গাঁয়ের ছেলে? আমিও গ্রাম থেকে আসি। কারো সঙ্গে মিশতে পারি না। তুমি একা একা থাকো তাই তোমার সঙ্গে পরিচয় করতে এলাম।
সেই দিনই রুমার সঙ্গে প্রথম কথা বললাম। কালো রংয়ের ছিপছিপে গড়নের মেয়েটি সদা হাস্যময়ী। মাথার চুলগুলি এলোমেলো হয়ে চারিদিকে ছিটকে পড়েছে। সাদা শাড়িতে ওকে অপূর্ব মানিয়েছে। তবুও ওর চোখের দিকে তাকাতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে বললাম, হ্যাঁ আমি গ্রাম থেকে আসি। অনেকটা দূর। রাস্তাও ভালো নয়।
রুমা জিজ্ঞেস করলো, বাড়িতে কে কে আছে?
বললাম, বাবা-মা, আমার পরের দু ভাই ও এক বোন।
রুমা বললো, আমি পাঁচ ভাইয়ের সবথেকে ছোট বোন। দু’ভাই চাকরি করে আর দু’ভাই কৃষি কাজ। এক ভাই ব্যবসা।
আমি উত্তর দিলাম, বাহ খুব ভালো!
সেদিন আরো অনেক কথাই হয়েছিল রুমার সঙ্গে। একটি মেয়ের সঙ্গে সেই ভাবেই পরিচিত হয়েছিলাম। সেইদিন থেকেই আমাদের কথা বলার, গল্প করার জন্য দুজনেই মুখিয়ে থাকতাম। একটু একটু করে আমরা পরস্পরের অভাবও বোধ করতাম। একদিন কথায় কথায় রুমা জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার কি কাউকে ভালো লাগে না?
আমি উত্তর দিতে পারিনি, প্রায় নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ কেটে গেলে, রুমা বলেছিল, আমার কিন্তু একজনকে ভালো লাগে!
জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কে?
রুমা বলেছিল, আজ বলবো না, একদিন বলবো ঠিক সময়ে।
কথা বলতে বলতেই দু’জনে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম। কখন ছুটি হয়ে গেছিল এবং ক্লাস প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছিল তা বুঝতে পারিনি। রুমা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কী যেন বলতে চাইলো। কিন্তু আমারআর শোনার কোনো ধৈর্য ছিল না।🍁

 

 

 

🍂ফিরে পড়া | গল্প
_______________________________________
উঁচু-উঁচু টুঙ গাছ। নীচটা অন্ধকার হয়ে আছে। ঝিরঝির করে ঝর্না ঝরছে ছায়ায় ছায়ায়। ছুমুক। চুমুক। এই ঝর্নার পাশে রতুকাকা সোনাচিতা মেরেছিলেন। জায়গাটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। পচা পাতার সোঁদা গন্ধ। জার্মান জঙ্গলের অসভ্য সুবাস। উঁচু ডালে বসে একটি খয়েরি ঢাব পাখি ডাকছে ঢাব-ঢাব-ঢাব। ডাকটা শুনে বিন্তি হাসল, বলল ভাব-ভাব-ভাব-ভাব। আমি বলাম, কার সঙ্গে?

_____________________________________________

 

 

কাঁচপোকার দিন

বুদ্ধদেব গুহ

 

 

 

বৈশাখের দুপুরের একটা নিজস্ব গায়ের গন্ধ আছে। সে গন্ধ সাবান, পাউডার কি আতরের গন্ধের মতো নয়। এ গন্ধ কোথাও খুঁজে ফিরতে হয় না, এ গন্ধ আপনিই ভাসে। নিকানো দাওয়ার উপর হলুদ কাঁঠাল পাতা ঝরে পড়ে, ধুলো ওড়ে, বেতবনে সড়সড় শব্দ ওঠে, বসন্তবৌরি পাখি কচি। বাঁশের সবুজ পাতার দোলনা ছেড়ে উড়ে যেতে যেতে ডেকে ওঠে। যখন হাওয়া বয়, টুঙবাগানে পাতা নড়ে এমনি করে একটু একটু করে যখন আকাশে বাতাসে, রোদুরে, বসন্তবৌরি পাখির ডানায় এক গন্ধ ছড়িয়ে যেতে থাকে, ছড়িয়ে যেতে যেতে, এক সময়ে হঠাৎই সুগন্ধ সমস্ত সত্তাময় মাখামাখি হয়ে যায়।

রাঙামাটি পাহাড়ের উত্তরে, মেচ সর্দারের বাড়ির মাটির ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেছিলাম। বিন্তি, সখী পাতিয়েছে মেচ সর্দারের মেয়ের সঙ্গে। সখী তো নয়, হাসন-সখী। খালি হাসে। মিটি মিটি হাসে। হাতে-বোনা মেখলার নীচে দু-টি নরম সুড়োল পবিত্র পা দেখা। যায়। খয়েরি রঙা চুল এক মাথা তাতে কাঠের কাঁকই গোঁজা। সমস্ত শরীরের রং তামার মতো। ওর চোখের দিকে চেয়ে ওর হাসতে-থাকা গালের টলটলে টোলের দিকে তাকিয়ে ভালো লাগায় মরে যাই। অবাক হয়ে বিন্তির হাসন-সখীর দিকে চেয়ে থাকি। বিন্তির কথা মনেও পড়ে না।

মেচ সর্দারের বউ দাওয়ার বাইরে কাঁঠালতলায় বসে সারা দুপুর তাঁত বসিয়ে মেখলা বোনে–আরও কত কী বোনে। মেচ সর্দার পোড়ামাটির মতো মুখে সহস্র অভিজ্ঞতার ফ্রেসকোর। আঁকিবুকি নিয়ে বসে বসে হুরুৎ-গুরুৎ করে হুঁকোয় টান দেয়। বেলা পড়ে আসে। মেঠো ইঁদুরের গন্ধ ডানায় মেখে চতুর চিল, চৈতালি ফসলের মাঠের উপরে ঘুরে ঘুরে ওড়ে। কাঁঠালতলার শব্দ মাথার মধ্যে চুড়ির মতো বাজতে থাকে যখন, তখন বিন্তি আর হাসন-সখীকে বাঁশের চিকের চিরুনির আড়ালে চা করতে ব্যস্ত দেখতে পাই।

মেচ সর্দার মজা সুপুরি আর পান এগিয়ে দেয় আবার। বিড়বিড় করে বলে, গুয়া-পান। আবার বলি না, না। হাসি। হেসে বলি, পরে। আসলে বলতে পারি না যে, মজা সুপুরির গন্ধে বমি হয়ে যাবে।

আজ আমরা সাত-বোশেখির মেলায় গেছিলাম। আজ ৭বৈশাখ। সমস্ত সকালটা চোখের সামনে একটা রঙিন স্বপ্নের মতো ভাসছে।

আলোকঝারি পাহাড়ে মায়ের থান। সেখানে পুজো হয়। আগের রাত থেকে সাঁওতাল মেচ এবং রাজবংশীরা জড়ো হতে থাকে পাহাড়ের নীচে। মায়ের থানের পথে পথে। কেউ কবুতর নিয়ে। বসে থাকে, কেউ ছাগল নিয়ে বসে থাকে, কেউ-বা আনে জবাফুলের মতো ঝুঁটিওয়ালা মোরগ। এই দিনটিতে আলোক-ঝারি পাহাড়ের সমস্ত বন মোরগাও বুঝি বুঝতে পারে, যে দিনটি কোনো বিশেষ দিন। থেকে থেকেই তারা উলু দিয়ে ওঠে। এই পাহাড়েই একদিন আমি একটি পাতাঝরা শিমুল গাছে ফুলের মতো অগুনতি মুরগি ফুটে থাকতে দেখেছিলাম। কালো শুকনো ডালে মোরগ-মুরগিদের লাল-হলুদের সমারোহ এমন করে চোখ ও মনকে অবাক করেছিল যে, বলার নয়।

হলুদ শাড়িতে মেয়েরা চলেছে। ওরা সকালে চান করেছে। কলকল করতে করতে নতুন-পাতা গজানো বৈশাখের জঙ্গলে-পাহাড়ে ওরা চলেছে। বাচ্চারা চলেছে হই-রই করতে করতে। পেছনে পেছনে গাঁয়ের কালো কি লাল কুকুর চলেছে। ওরাও বুঝি পুজো চড়াবে মহামায়ার থানে, সকালের মিষ্টি রোদ এসে ফুলে-পাতায় ভরা আঁকাবাঁকা পথের ফাঁকে ফাঁকে-জাফরানি-কালোয় মেশানো গালচে বিছিয়েছে। একটা কুকুর হঠাৎ বাঁ-দিকের খাদে, পাতার সঙ্গে মিশে-থাকা একটি সোনারঙা কোটরা হরিণের বাচ্চার দিকে চোখ পড়তে লাফিয়ে লাফিয়ে দৌড়ে গেল। মেয়েটি বলল, লালু, আ, লালু–আ-আ–আ। অমনি লালু সংযমের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে দৌড়ে ফিরে এল। ফিরে এসে লালায়-ভেজা গোলাপি জিভটা বের করে আবার দুলকি চালে চলতে লাগল। জিভ দিয়ে টস টস করে নাল গড়াল।

লালু বলল–হ্যাঃ হাঃ হাঃ।

শিশু গাছের পাতার আড়াল থেকে একটি বাঁদর ছানা হঠাৎ একটি আপেলের মতো মুখ বের করে ভেংচি কাটল। লালুর মালকিন বলল, একদম নয়।

লালু বলল, হ্যাঃ–হ্যাঃ-হ্যাঃ হ্যাঃ।

এমনি ওরা সকলে দুলতে-দুলতে হলুদ শাড়িতে ঢেউ তুলে, খাদে, পাহাড়ে প্রতিধবনি তুলে, হাসিতে ফুলতে ফুলতে, ফুল তুলতে-তুলতে, উলের বলের মতো খুলতে খুলতে এক সময় মায়ের থানে এসে পৌঁছে গেল।

সে জায়গাটা যেন একটা সুর ছড়ানো পাতাবাহারের ঝাড় হয়ে গেল। হাসি, পুরোহিতের গম্ভীর মন্ত্র, কালোপাথরে কবুতরের রক্ত, সাঁওতাল ছেলের নিকষ কালো চুল, মেচ মেয়ের ফিকে-হলুদ, বাতাবি-বুক পাখির কিচির-মিচির, বাঁদরের হুপহাপ, কুকুরের ভুভুক এতসব মিলে সমস্ত সকালটা আমার মনে একটা রঙিন ঝুমঝুমির মতো বাজতে লাগল।

হাসন-সখী আর বিন্তি আমার দিকে চেয়ে বলল, বাড়ি যাবি না? আমি ওদের দুজনকে দু-হাতে জড়িয়ে ধরে বললাম, আজ বাড়ি যাব না, আজ আমরা এই আলোকঝারির বনে বনে ইচ্ছে করে হারিয়ে যাব।

ওদের দুজনকেই বললাম, যাবি? এই যাবি?

ওরা কেউ কথা বলল না। বিন্তি শুধু ছোঁওয়া-লাগা লজ্জাবতীর লতার মতো ভালো লাগায় বুজে এল। বিন্তি ওর পাখির মতো চিকন মুখ তুলে বলল, উঃম-ম-ম–নাঃ। বাড়ি চল।

অতএব আমরা তিন জনে আবার মেচ সর্দারের বাড়ির পথ ধরলাম। বাড়ি ফেরার পথে জংলি কুল পাড়লাম, প্রজাপতি ধরলাম, কাঁচপোকার পেছনে দৌড়লাম, ফিঙের পালক কুড়েলাম, তারপর উলের বলের মতো যে মনটাকে খুলতে খুলতে পাহাড়ে চড়েছিলাম, সে মনটাকে আবার গুটোতে গুটোতে ফিরে এলাম, সাত বোশেখীর মেলা থেকে ফিরে এলাম।

বিন্তি বলল, নে বুদুস চা ধর। কী ভাবিস আকাশের দিকে চেয়ে? সব সময়? কার কথা ভাবিস?

হাসন-সখী চুল ঝাঁকিয়ে বলল, তোকে বলবে কেন? তারপর হেসে বলল তোর নিজের ভাবনা অন্য কাউকে দেখাস না রে বুদুস!

আমি মাথা নাড়লাম।

কেউ কি ইচ্ছে করলেই নিজের ভাবনা অন্যকে দেখাতে পারে?

বিন্তি বলল, তুই ঠিক জানিস যে, তুই মেলার ভীড়ে হারিয়ে যাসনি?

আমি হাসলাম, বললাম, কী জানিরে! সেইটেই হয়তো ভাবছিলাম বসে।

বিন্তি বলল, কাব্যি করিস না। চল বিকেলে টুঙবাগানে বেড়িয়ে আসি। যাবি?

লাফিয়ে উঠলাম, বললাম, সত্যি যাবি? আর তোর সখী?

সখী কথা না বলে আমলকি গাছের মতো সিধে দাঁড়িয়ে বাদামী চুল ঝাড়ল। তার পর তার বুড়ো বাবার দিকে চাইল। বাবা কথা বলল না। তার হুঁকো বলল, হুরুৎ-গুরুৎ।

আমরা তিন জনে হাত ধরাধরি করে দৌড়োতে দৌড়োতে চিতল হরিণের তিনটি চঞ্চল ছানার মতো লাফাতে লাফাতে লাল মাটির পথে ধুলো উড়িয়ে, ঝরে-পড়া লাল পাতা মাড়িয়ে, হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে এক সময় টুঙবাগানে এসে পৌঁছোলাম।

উঁচু-উঁচু টুঙ গাছ। নীচটা অন্ধকার হয়ে আছে। ঝিরঝির করে ঝর্না ঝরছে ছায়ায় ছায়ায়। ছুমুক। চুমুক। এই ঝর্নার পাশে রতুকাকা সোনাচিতা মেরেছিলেন। জায়গাটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা। পচা পাতার সোঁদা গন্ধ। জার্মান জঙ্গলের অসভ্য সুবাস। উঁচু ডালে বসে একটি খয়েরি ঢাব পাখি ডাকছে ঢাব-ঢাব-ঢাব। ডাকটা শুনে বিন্তি হাসল, বলল ভাব-ভাব-ভাব-ভাব। আমি বলাম, কার সঙ্গে?

ও বলল, তা দিয়ে তোর দরকার কী?

রোদটা পড়ে গেছিল। সমস্ত টুঙবাগানের উঁচু উঁচু ডালের পাতায় একটা জোলো সোনালি আভা লেগেছিল। দূরে স্নিগ্ধ নীল আকাশে লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে সন্ধ্যাতারার মিষ্টি মুখটি এক এক ঝিলিক দেখা দিয়েই মিলিয়ে যাচ্ছিল।

টুঙবাগানে হাঁটতে হাঁটতে, সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে নিতে নিতে, আমার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, সমস্ত দিনের হলুদ উষ্ণতাটা কেমন ধূসর শীতে রূপান্তরিত হয়ে গেল।

বিন্তিকে বললাম, এখানে কেন এলি-রে?

বিন্তি জবাব দিল না।

বিন্তির মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল বিন্তি যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে। কালো ডুরে শাড়িটা টান টান করে পরেছে। গাছ-কোমর করে জড়িয়েছে শাড়িটা। বিন্তির নতুন নরম নরম। খোঁপাটা ওর ঘাসের উপর লুটিয়ে আছে। বিন্তি ঘেমে গেছে। বিন্তি জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। বিন্তি আমার চোখের দিকে তাকাল। হঠাৎ তাকাল। আমার মনে হল, এর আগে বিন্তি কখনো আমার দিকে তাকায়নি। বিন্তির কালো চোখ দুটি সেই প্রায়ান্ধকারে চিতাবাঘের চোখের মতো জ্বলতে লাগল।

বিন্তি বলল, এখানে এলাম একটি খেলা খেলব বলে।

হাসন-সখী এগিয়ে এল। বাধো বাধো বাংলায় বলল, কী খেলা। কী খেলারে বিন্তি?

বিন্তি, বলল, একটা মজার খেলা। বলেই বিন্তি আমাকে এক ঠেলা দিয়ে সামনে সরিয়ে ওর সখীর। পাশে দাঁড়াল। চোদ্দো বছরের বিন্তি চাবুকের মতো মুখ তুলে আমার দিকে চেয়ে বলল, বুদুস। আমাদের দিকে তাকা।

তাকালাম।

বিন্তি বলল, ভালো করে তাকা।

বললাম, তাকিয়েছি তো।

বিন্তি বলল, কী দেখছিস?

দুজনকেই দেখছি।

না। একজনকে দেখতে হবে।

তার মানে?

বিন্তি চুপ করে থেকে বলল, মানে নেই।

তারপরই বিন্তি বলল, আয় আমরা লুকোচুরি খেলি। তুই হারিয়ে যাবি, আর আমরা তোকে খুঁজব। যে তোকে আগে পাবে, তারই হাত ধরে তুই বাড়ি ফিরবি। শুধু তার হাত ধরে।

আমি বললাম, ভাগ এটা একটা কী খেলা?

বললাম, আর যাকে খুঁজে পাব না?

সে পেছনে পেছনে আসবে। একা একা।

বললাম, বিন্তি, এখানে চিতা বাঘ আছে কিন্তু। রতুকাকা এই তো সেদিনই…

বিন্তি বলল, আছে তো আছে। তোর তাতে কী। তুই তো লুকিয়ে বসে থাকবি–খুঁজব তো আমরা। মরব আমরা মরব। তোর তাতে কী। যারা খোঁজে, তারাই তো মরে এসেছে চিরদিন। নতুন কী।

তারপর বিন্তি আর হাসন-সখী পিছন ফিরে চোখ বন্ধ করে অনেকদূর এগিয়ে গেল বড়ো রাস্তা ধরে। তারপরই দাঁড়িয়ে পড়ে বিন্তি বলল। বুদুস তুই হারিয়ে যা।

পা-টিপে, পা-টিপে পচা পাতার উপর পা-ফেলে ফেলে কিছুদুর এগিয়ে আমি ঝর্নাটার পেছনে। একটা বড়ো পাথরের আড়ালে, বালির উপরে মুখ নীচু করে বসে পড়লাম। ওরা তো দূরের কথা, আমি নিজেই নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। এমন করেও হারানো যে যায়, তা জানতাম না।

দূর থেকে বিন্তির গলা শুনলাম। আমরা পঞ্চাশ গুনছি, তারপর তোকে খুঁজব।

কখন ওদের পঞ্চাশ গোনা শেষ হল জানি না। হঠাৎ চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেল। গাছের নীচে নদীর ধারে অন্ধকার নেমে এল। শুধু ঢাব পাখিটা ডাকতে লাগল ঢাব-ঢাব-ঢাব-ঢাব। মাথা নীচু করে হঠাৎ দেখলাম, বালির উপরে চিতা বাঘের পায়ের দাগ। বেশ ভয় করতে লাগল।

অনেক অনেকক্ষণ কেটে গেল, একটা পেঁচা ডাকল টুঙবাগানের ম্যানেজারের বাংলোর কাছ থেকে। তারপর সব চুপচাপ।

হঠাৎ আমার পেছনে বালিতে পাতায় একটা মৃদু খসখসানি শুনতে পেলাম। ভয়ে ভয়ে ঘাড় ফেরাতেই দেখি বিন্তি। বিন্তি আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাঘিনীর মতো। আমি পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলাম। বললাম, এ কী?

বিন্তি আমার বুকের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এসে দু-হাতে আমাকে সমানে কিল-চড়-ঘুষি মারতে লাগল। নিঃশব্দে। তারপরই দেখলাম, বিন্তি কাঁদছে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বিন্তি মারতে মারতে বলতে লাগল। পাজি, বদমাইস, অসভ্য।

অবাক হয়ে বললাম, কী করছিস তুই? কী হল?

বিন্তি হাউ হাউ করে কেঁদে আমার দুটো কান দু-হাতে ধরে বলল, তুই আমাকে ভালোবাসিস না। কেন, বল? তুই আমাকে ছাড়া ভালোবাসতে পারবি না। কাউকে–কাউকে–কাউকে না। বলে, বিন্তি অঝোরে কাঁদতে লাগল। বিন্তি পাগলির মতো হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। বিড় বিড় করে বলল, তুই, আমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারবি না।

সেই সায়ান্ধকারে ওর দু-কাঁধে হাত রেখে আমার কাঁধ থেকে ওর হাত ছাড়িয়ে ওর মুখের দিকে ভালো করে তাকালাম। হয়তো এই প্রথম ভালো করে ওর দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম বিন্তি অনেক বড়ো হয়ে গেছে।

মনে হল, নীচুতলায় আমাদের এক্কা-দোক্কা খেলার দিন শেষ হয়ে গেছে, প্রজাপতি ধরার দিন শেষ হয়ে গেছে, কাঁচপোকার পেছনে আর দু-জনে আমরা কখনো ছুটব না।

আমার ভীষণ খারাপ লাগতে লাগল, আবার ভালোও লাগতে লাগল। নিজেকে সাহসীও মনে হল, আবার ভীষণ ভয়ও করতে লাগল। বিন্তি তখনও কাঁদছিল। বিন্তিকে বললাম, ওঠো বিন্তি।

জীবনে এই প্রথম বিন্তিকে তুই বলতে পারলাম না।

বললাম, ওঠো বিন্তি। বাড়ি চলো। বাড়ি যাবে না? বিন্তির হাত আমার হাতে নিয়ে আমরা ঝর্নাতলা থেকে টুঙবাগানের রাস্তায় এসে পড়লাম।

পেছন থেকে, মনে হল অনেক দূর থেকে, বিন্তির সখী ডাকছিল বিন্তি–বি–ন্তি। গাছে পাতায় হাওয়ায় সেই ডাক কাঁপছিল। বিন্তি সাড়া দিল না।

হাত ধরে আমরা দুজনে টুঙ ছড়ানো রাস্তায় হাঁটছিলাম। একটি একটি করে ঝিঝি ডেকে উঠছিল। অন্ধকারে।

আমি জানতাম, বিন্তি সাড়া দেবে না। বিন্তি নামে যে অভিমানী, ঝগড়াটি, গেছো-মেয়েটি ছিল, যে কথায় কথায় ছেলেদের সঙ্গে মারামারি করত, সে হাডুডু খেলত ওই নামের ডাকে আর কোনোদিন, কোনোদিন সাড়া দেবে না।

আমার হঠাৎ মনে হল, কাঁচপোকার দিন পেছনে ফেলে আমরা দুজনে এগিয়ে চলেছি। নতুন কোনো অস্বস্তিভরা দিনের দিকে। জীবনের দিকে। বেশ কাটছিল খেলায় খেলায়, বেলা। কেন যে বিন্তি বড়ো হয়ে গেল!🍁

 

 

🍂ফিরে পড়া | কবিতা 

 

 

 

জীবনানন্দ দাশ -এর দু’টি কবিতা 

অনন্ত জীবন যদি পাই

 

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি তাহ’লে অনন্তকাল একা
পৃথিবীর পথে আমি ফিরি যদি দেখিবো সবুজ ঘাস ফুটে উঠে
দেখিবো হলুদ ঘাস ঝরে যায় দেখিবো আকাশ শাদা হয়ে উঠে ভোরে-
ছেঁড়া মুনিয়ার মত রাঙা রক্ত—রেখা লেগে থাকে বুকে
তার সন্ধ্যায়—বারবার নক্ষত্রের দেখা পাবো আমি;
দেখিবো অচেনা নারী আলগা খোঁপার ফাঁস খুলে ফেলে চলে যায়
মুখে তার নাই আহা গোধূলির নরম আভাস।

অনন্ত জীবন যদি পাই আমি—তাহ’লে অসীমকাল একা
পৃথিবীর পথে যদি ফিরি আমি—ট্রাম বাস ধুলো দেখিবো অনেক আমি—
দেখিবো অনেকগুলো বস্তি, হাট—এঁদো গলি, ভাঙ্গা কলকী হাড়ী
মারামারি, গালাগালি, ট্যারা চোখ, পচা চিংড়ি—কত কি দেখিব নাহি লেখা
তবুও তোমার সাথে অনন্তকালেও আর হবে নাকো’ দেখা।

 

 

শীত রাত

 

এই সব শীতের রাতে আমার হৃদয়ে মৃত্যু আসে;
বাইরে হয়তো শিশির ঝরছে, কিংবা পাতা,
কিংবা প্যাঁচার গান; সেও শিশিরের মতো, হলুদ পাতার মতো।
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে –
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
এদিকে কোকিল ডাকছে – পউষের মধ্য রাতে;
কোনো-একদিন বসন্ত আসবে ব’লে?
কোনো-একদিন বসন্ত ছিলো, তারই পিপাসিত প্রচার?
তুমি স্থবির কোকিল নও? কত কোকিলকে স্থবির হ’য়ে যেতে দেখেছি,
তারা কিশোর নয়,
কিশোরী নয় আর;
কোকিলের গান ব্যবহৃত হ’য়ে গেছে।
সিংহ হুঙ্কার ক’রে উঠছে:
সার্কাসের ব্যথিত সিংহ,
স্থবির সিংহ এক – আফিমের সিংহ – অন্ধ – অন্ধকার।
চারদিককার আবছায়া-সমুদ্রের ভিতর জীবনকে স্মরণ করতে গিয়ে
মৃত মাছের পুচ্ছের শৈবালে, অন্ধকার জলে, কুয়াশার পঞ্জরে হারিয়ে যায় সব।
সিংহ অরন্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মত খ’শে খ’শে
চুম্বক পাহাড়ে নিস্তব্ধ।
হে পৃথিবী,
হে বিপাশামদির নাগপাশ, – তুমি
পাশ ফিরে শোও,
কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর।

 

 

 

 

সুভাষ মুখোপাধ্যায় -এর কবিতাগুচ্ছ 

 

পাথরের ফুল

 


ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল জমতে জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।

এখন আর
আমি সেই দশাসই জোয়ান নই।
রোদ না, জল না,হাওয়া না–
এ শরীরে আর
কিছুই সয় না।

মনে রেখো
এখন আমি মা-র আদুরে ছেলে–
একটুতেই গলে যাবো।

যাবো বলে
সেই কোন সকালে বেরিয়েছি–
উঠতে উঠতে সন্ধে হল।
রাস্তায়
আর কেন আমায় দাঁড় করাও?

অনেকক্ষণ থেমে থাকার পর
গাড়ি এখন ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে চলছে।
মোড়ে ফুলের দোকানে ভিড়।
লোকটা আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল?

 

ঠিক যা ভেবেছিলাম
হুবহু মিলে গেল।
সেই ধূপ , সেই ধুনো, সেই মালা,সেই মিছিল–
রাত পোহালে
সভা-টভাও হবে।
( একমাত্র ফুলের গলা-জড়ানো কাগজে লেখা
নামগুলো বাদে)
সমস্তই হুবহু মিলে গেল।

মনগুলো এখন নরম-
এবং এই হচ্ছে সময়।
হাত একটু বাড়াতে পারলেই
ঘাট-খরচাটা উঠে আসবে।

এক কোনে ছেঁড়া জামা পরে
শুকনো চোখে
দাঁতে দাঁত দিয়ে

ছেলেটা আমার
পুঁটুলি পাকিয়ে ব’সে।
বোকা ছেলে আমার,
ছি ছি,এই তুই বীরপুরুষ?
শীতের তো সবে শুরু–
এখনই কি কাঁপলে আমাদের চলে?

ফুলগুলো সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।
মালা
জমে জমে পাহাড় হয়
ফুল
জমতে জমতে পাথর।

পাথরটা সরিয়ে নাও,
আমার লাগছে।

 

ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনোদিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি
যা দিয়ে কোনোদিন কারো মুখোশ হয় না।

ঠিক এমনটাই যে হবে,
আমি জানতাম।
ভালোবাসার ফেনাগুলো একদিন উথলে উঠবে
এ আমি জানতাম।
যে-বুকের
যে আধারেই ভরে রাখি না কেন
ভালোবাসাগুলো আমার
আমারই থাকবে।

রাতের পর রাত আমি জেগে থেকে দেখেছি
কতক্ষনে কীভাবে সকাল হয়;
আমার দিনমান গেছে
অন্ধকারের রহস্য ভেদ করতে।
আমি এক দিন, এক মুহূর্তের জন্যেও
থামিনি।
জীবন থেকে রস নিংড়ে নিয়ে
বুকের ঘটে ঘটে আমি ঢেলে রেখেছিলাম
আজ তা উথলে উঠল।

না।
আমি আর শুধু কথায় তুষ্ট নই;
যেখান থেকে সমস্ত কথা উঠে আসে
যেখানে যায়
কথার সেই উৎসে
নামের সেই পরিনামে,
জল-মাটি-হাওয়ায়
আমি নিজেকে মিশিয়ে দিতে চাই।

কাঁধ বদল করো।
এবার
স্তুপাকার কাঠ আমাকে নিক।
আগুনের একটি রমণীয় ফুলকি
আমাকে ফুলের সমস্ত ব্যথা
ভুলিয়ে দিক॥

 

 

ছাপ

 

 

কেউ দেয় নি কো উলু
কেউ বাজায় নি শাঁখ,
কিছু মুখ কিছু ফুল
দিয়েছিল পিছুডাক।

পরনে ছিল না চেলি
গলায় দোলেনি হার,
মাটিতে রঙীন আশা
পেতেছিল সংসার।

আকাশের নীল গায়ে
শপথের ইস্পাত,
দরজায় পিঠ দিয়ে
বাইরে গভীর রাত।

সারা বাড়ি থমথমে
সিঁড়ি একদম চুপ,
দেয়ালে নাচায় ধোঁয়া
জানলায় রাখা ধূপ।

মুঠো মুঠো তারা নিয়ে
কড়ি খেলছিল মেঘ,
ভুলে গেছে বুঝি হাওয়া
ঝড়ঝঞ্ঝার বেগ।

হঠাৎ যে কোথা থেকে
ছুটে এসেছিল ঝড়,
ঢেউয়ের চূড়ায় উঠে
দুলে উঠেছিল ঘর।

দু জোড়া বন্ধ ঠোঁটে
থেমে গিয়েছিল গান,
চোখে রেখেছিল হাত
টেবিলের বাতিদান।

জীবনের হ্রদে স্মৃতি
চোখ বুজে দিল ঝাঁপ,
ভিজিয়ে সে জলছবি
তুলে নিল এই ছাপ।।

 

কেন এল না 

 

সারাটা দিন ছেলেটা নেচে নেচে বেড়িয়েছে।
রাস্তায় আলো জ্বলছে অনেকক্ষণ এখনও
বাবা কেন এল না, মা?
বলে গেল
মাইনে নিয়ে সকাল- সকাল ফিরবে।
পুজোর যা কেনাকাটা
এইবেলা সেরে ফেলতে হবে।
বলে গেল।
সেই মানুষ এখনও এলো না।
কড়ার গায়ে খুন্তিটা
আজ একটু বেশি রকম নড়ছে।
ফ্যান গালতে গিয়ে
পা-টা পুড়ে গেল।
জানালার দিকে মুখ করে
ছেলেটা বই নিয়ে বসল মাদুরে
সামনে ইতিহাসের পাতা খোলা-
ঘড়িতে টিকটিক শব্দ।
কলে জল পড়ছে।
ও- বাড়ির পাঁচিলটা থেকে লাফিয়ে নামল
একটা গোঁফঅলা বেড়াল।
বাপের- আদরে-মাখা- খাওয়া ছেলের মত
হিজিবিজি অক্ষরগুলো একগুঁয়ে
অবাধ্য–
যতক্ষণ পুজোর জামা কেনা না হচ্ছে
নড়বে না।
এখনও
বাবা কেন এল না, মা?
রান্না কোন্ কালে শেষ
গা ধোয়াও সারা
মা এখন বুনতে বসে
কেবলি ঘর ভুল করছে।
খুট করে একটা শব্দ-
ছিটকিনি খোলার।
কে?
মা, আমি খোকা।
গলির দরজায় ছেলেটা দাঁড়িয়ে।
এখন রেডিওয় খবর বলছে।
মানুষটা এখনও কেন এল না?
একটু এগিয়ে দেখবে বলে
ছেলেটা রাস্তায় পা দিল।
মোড়ে ভিড়;
একটা কালো গাড়ি;
আর খুব বাজি ফুটছে।
কিসের পুজো আজ?
ছেলেটা দেখে আসতে গেল।
তারপর অনেক রাত্তিরে
বারুদের গন্ধে-ভরা রাস্তা দিয়ে
অনেক অলিগলি ঘুরে
মৃত্যুর পাশ কাটিয়ে
বাবা এল।
ছেলে এল না।।

 

 

 

 

 

তারাপদ রায় -এর দু’টি কবিতা 

এক জন্ম

 

অনেকদিন দেখা হবে না
তারপর একদিন দেখা হবে।
দুজনেই দুজনকে বলবো,
‘অনেকদিন দেখা হয় নি’।
এইভাবে যাবে দিনের পর দিন
বৎসরের পর বৎসর।
তারপর একদিন হয়ত জানা যাবে
বা হয়ত জানা যাবে না,
যে তোমার সঙ্গে আমার
অথবা আমার সঙ্গে তোমার
আর দেখা হবে না।

 

 

তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলাই হলো না!

 

একটা জন্ম এমনি এমনি কেটে গেলো।
একটা জীবন দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।

একটা জন্ম রেখেছিলাম তোমার সঙ্গে কথা বলার,
একটা জীবন রেখেছিলাম কাঁঠালতলায় মাদুর পেতে
তোমার পাশে কাটিয়ে দেবো।
একটা জন্ম রেখেছিলাম বাঁশকাগজে স্টিলের নিবে
এমনি এমনি পদ্য লেখার,
একটা জীবন রেখেছিলাম তোমার জন্যে পদ্য লেখার
একটা জীবন এমনি এমনি চলে গেলো।

একটা জন্ম জোড়াতালির, ভাত কাপড়ের তক্কে তক্কে
একটা জীবন মাথা গোঁজার ফন্দি খুঁজে,
একটা জীবন বাক্স মাথায় ভুল শহরে
ভুল ঠিকানায় ঘুরে ঘুরে,
একটা জন্ম এমনি এমনি কেটে গেলো,
একটা জীবন দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।

তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলাই হলো না।

 

 

 

 

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী -এর দু’টি কবিতা 

আড়ি নয়

 

আড়ি দিয়ে দূরে গিয়ে
থাকা যায় নাকি?
তাই ফের কাছে এসে
হাতে হাত রাখি।
যে দিয়েছে আড়ি, তার
মনে নেই সুখ,
চোখে তার চাপ রাগ,
হাঁড়িপানা মুখ।।
আড়ি দিলে আকাশটা
মেঘে ঢেকে যায়,
আর তাতে বিদ্যুৎ
খুব চমকায়।
তাই বলি, আড়ি তুলে
ভাব করে নাও,
কাছে এসে হাতে ফের
হাতটি মিলাও।

 

মন, তুমি

 

মন, তুমি কোন দিকে চেয়ো না, চেয়ো না…
অনেক ঠকেছ তুমি, তবু সাবধানে
পারো না থাকতে! নীল নয়নের টানে
শুধুই তো সুধা নেই, কিছু নীল বিষ
রয়েছে লুকোনো। মন, এখানে-ওখানে
যা-কিছু সোনালি দ্যাখো তা-ই নয় সোনা,
খানিকটা সোনা তার, খানিক পালিশ।
মন, তুমি কোন দিকে চেয়ো না, চেয়ো না।
মন তুমি কোন দিকে যেয়ো না, যেয়ো না।
কোথায় সোনার দ্বীপ ! ঢেউ ভেঙ্গে পড়ে
চারদিকে শুধু ; মন, এই জল ঝড়ে
পথের প্রখর নেশা হারিয়ে গেলেই
নিবু-নিবু আলো লেগে ঢেউয়ের শিখরে
যে সোনা ঠিকরে ওঠে তা-ই খাঁটি সোনা,
তা ছাড়া কোথাও কিছু নেই, কিছু নেই।
মন, তুমি কোন দিকে যেয়ো না যেয়ো না।

 

 

 

 

শঙ্খ ঘোষ

মধ্যরাত

 

আজ আর কেউ নেই, ঘুমন্ত ঘরের নীল জল,
ঠান্ডা বারান্দায় গায়ে মধ্যরাত দেবতার দীপে-
হাতে খেলে যায় হাওয়া।

আজ চুপ করে ভাবো, এই রাত মৃদুজলঢেউ,
বড়ো একাকিনী গাছ , মাঝে মাঝে কার কাছে যাব,
ঘুমায় ঘরের গায়ে ছায়াময় বাহিত প্রপাত
বুকে খেলে যায় হাওয়া ।

দুইজনে পাশাপশি,মাঝে কি পথিক নেই কোনো,
এখন বসন খোলো, দেবতা দেখুক দুই নয়নে,
শিশিরে পায়ের ধবনি সুদূরতা অধীর জলধি
শুধু বয়ে যায় হাওয়া।

আজ আর কেউ নেই , মাঝে মাঝে কার কাছে যাব।

 

 

 

 

শক্তি চট্টোপাধ্যায়

প্রেম 

 

অবশ্য রোদ্দুরে তাকে রাখবো না আর
ভিনদেশি গাছপালার ছায়ায় ঢাকবো না আর
তাকে শুধুই বইবো বুকের গোপন ঘরে
তার পরিচয়? মনে পড়ে মনেই পড়ে।

চিরটাকাল সঙ্গে আছে–জড়িয়ে লতা
শাখার, বাহুর নিমন্ত্রনকে ব্যাপকতা
বলার সময় হয় নি আজো ক্ষেমংকরে-
তার পরিচয়? মনে পড়ে মনেই পড়ে।

গোপন রাখলে থাকবে না আর-
বাইরে যাবে
পারলে হৃদয় দুর্বলতা দেশ জ্বালাবে
মিছেই আমায় জব্দ করে
তার পরিচয়? মনে পড়ে মনেই পড়ে।

 

 

 

 

রফিক আজাদ 

যদি ভালোবাসা পাই

 

যদি ভালোবাসা পাই
আবার শুধরে নেবো ভুলগুলি ;
যদি ভালোবাসা পাই
ব্যাপক দীর্ঘপথে তুলে নেব ঝোলাঝুলি।
যদি ভালবাসা পাই
শীতের রাতের শেষে মখমল দিন পাব;
যদি ভালবাসা পাই
পাহাড় ডিঙ্গাবো আর সমুদ্র সাঁতরাবো।
যদি ভালবাসা পাই
আমার আকাশ হবে দ্রুত শরতের নীল;
যদি ভালবাসা পাই
জীবনে আমিও পাব মধ্য-অন্ত মিল।
যদি ভালবাসা পাই
আবার শুধরে নেবো ভুলগুলি
যদি ভালবাসা পাই
শিল্প- দীর্ঘ পথে ব’য়ে যাবো কাঁথাগুলি।

 

 

 

 

 

পূর্ণেন্দু পত্রী

সেই গল্পটা

 

আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি। শোনো।

পাহাড়টা, আগেই বলেছি ভালোবেসেছিল মেঘকে আর মেঘ কী ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা সে তো আগেই শুনেছো।

সেদিন ছিল পাহাড়টার জন্মদিন। পাহাড় মেঘেকে বললে আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।

মেঘ পাহাড়কে বললে আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।

ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।

সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে পাহাড় ছিল মেঘের ঢেউ-জলে।

হঠাৎ,

আকাশ জুড়ে বেজে উঠল ঝড়ের জগঝম্প ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাইয়ের ভঙ্গিতে ছুটে এল এক ঝাঁক হাওয়া মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে ওঠ ছুড়ি! তোর বিয়ে। এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।

বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেল ঠিকই কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিনই ভুলতে পারল না।

বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতো পারো পাহাড়টার হাড় পাঁজর, ভিতরে থৈ থৈ করছে শত ঝর্ণার জল।

 

 

 

 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর কবিতাগুচ্ছ 

মন ভালো নেই

 

মন ভালো নেই
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়

এখন আমার ওষ্ঠে লাগে না কোনো প্রিয় স্বাদ
এমনকি নারী এমনকি নারী এমনকি নারী
এমনকি সুরা এমনকি ভাষা

মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
বিকেল বেলায় একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে
একলা একলা পথে ঘুরে ঘুরে পথে ঘুরে ঘুরে
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না কারুকে চাইনি
কিছুই খুঁজি না কোথাও যাই না
আমিও মানুষ আমার কী আছে অথবা কী ছিল
আমার কী আছে অথবা কী ছিল

ফুলের ভিতরে বীজের ভিতরে ঘুণের ভিতরে
যেমন আগুন আগুন আগুন আগুন আগুন
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
তবু দিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়
আশায় আশায় আশায় আশায়…

 

 

মনে পড়ে যায়

 

ভালোবাসার জন্য কাঙালপনা আমার গেল না এ জীবনে
আমার গেল না কাঙালপনা এ জীবনে ভালোবাসার জন্য
যে-সব নদী শুকিয়ে গেছে, মরে ভূত হয়ে হারিয়ে গেছে
যে-সব আগাছা ভরা দুঃখী মাঠ উধাও হয়ে গেছে জনারণ্যে
ছেলেবেলায় শিউলি ফুল, কার্নিশে আটকানো ছেঁড়া ঘুড়ির
ফরফর শব্দ
কিছুই হারাতে দিতে ইচ্ছে করে না, যেন সবাই ফিরে আসবে
অন্ধকার সুড়ঙ্গের ওপাশে আলো যেমন ফিরে আসে স্মৃতির মধ্যে
যেমন নব যৌবনা নারীদের উপহাস ঝনঝন করে বাজে ঝর্নায়
কোনোদিন হারায় না, অবিরল পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে
কত রকম রং মেলানো দেশে
পুরোনো বাড়ির অন্ধকার ঘরে শূন্যতার মধ্যেও এক
বিশাল হাঁ করা শূন্যতা চেয়ে থাকে
আকাশ মিলিয়ে যায়, জোয়ারে ভেসে যায় বন্ধুত্ব, আয়ু
এরই মধ্যে এক দমকা হাওয়া এসে সান্ধ্য ভাষায় প্রশ্ন করে :
মনে আছে?
তখনই ছটফটিয়ে ওঠে বুক, সমস্ত বিচ্ছেদের দুঃখ
মনে পড়ে যায়।

 

 

ভালোবাসার পাশেই

 

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে
ওকে আমি কেমন করে যেতে বলি
ও কি কোনো ভদ্রতা মানবে না?
মাঝে মাঝেই চোখ কেড়ে নেয়,
শিউরে ওঠে গা
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

দু’হাত দিয়ে আড়াল করা আলোর শিখাটুকু
যখন তখন কাঁপার মতন তুমি আমার গোপন
তার ভেতরেও ঈর্ষা আছে, রেফের মতন
তীক্ষ্ম ফলা
ছেলেবেলার মতন জেদী
এদিক ওদিক তাকাই তবু মন তো মানে না
ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

তোময় আমি আদর করি, পায়ের কাছে লুটোই
সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে আগুন নিয়ে খেলি
তবু নিজের বুক পুড়ে যায়, বুক পুড়ে যায়
বুক পুড়ে যায়
কেউ তা বোঝে না

ভালোবাসার পাশেই একটা অসুখ শুয়ে আছে।

 

 

কই, কেউ তো ছিলো না

 

কেউ কেউ ভালোবেসে ভুল করে, কেউ কেউ
ভালোই বাসেনা
কেউ কেউ চতুরতা দিয়ে খায় পৃথিবীকে, কেউ
কেউ বেলা যায়
ফিরেও আসে না।
ওপরে চাঁদের কাছে মেঘ জমে পাহাড়ের মেষ
তৃণে আগুন লেগেছে
যাদের বাঁচার কথা ছিল, নেই, ভুল
মানুষেরা আছে বেঁচে।
স্বপ্ন বারবার ভাঙে, তবু ফের স্বপ্ন উপাদান দেয়
অচেনা নারীরা
তাদের গলায় দোলে রক্তমাখা অত্যুজ্জল ধাতুমালা,
পান্না কিংবা হীরা!
আমার যা ভালোবাসা, কাঙালের ভালোবাসা,
এর কোন মূল্য আছে নাকি?
এ যেন জলের ঝারি, কেউ
দেখা দেবে বলে হঠাৎ মিলিয়ে যায়
বাবলা কাটার ঝোপে
যেমন জোনাকী!
সুধা ভ্রমে বিষ খাই, বিষ এত মিষ্টি বুঝি?
তবে যে সকলে
বলো লোনা?
আমাকে মৃত্যুর হাতে ফেলে ওরা চলে যায়,
বারবার
ওরা মানে কারা?
কই, কেউ তো ছিলো না!

 

এখনো সময় আছে

 

তখন তোমার বয়স আশী, দাঁড়াবে গিয়ে আয়নায়
নিজেই ভীষণ চমকে যাবে, ভাববে এ কে ? সামনে এ কোন ডাইনী?
মাথা ভর্তি শনের নুড়ি, চামড়া যেন চোত-বোশেখের মাটি
চক্ষু দুটি মজা-পুকুর, আঙুলগুলো পাকা সজনে ডাটা!

তোমার দীর্ঘশ্বাস পড়বে, চোখের কোণে ঘোলা জলের ফোটায়
মনে পড়বে পুরনো দিন, ফিসফিসিয়ে বলবে তুমি,
আমারও রূপ ছিল!
আমার রূপের সুনাম গাইত কত শিল্পী-কবি!
তাই না শুনে পেছন থেকে তোমার বাড়ির অতি ফচকে দাসী
হেসে উঠবে ফিকফিকিয়ে
রাগে তোমার শরীর জ্বলবে! আজকাল আর ঝি-চাকরের নেই কোন
ভব্যতা!
মুখের উপর হাসে? এত সাহস? তুমি গজগজিয়ে যাবে অন্য ঘরে
আবার ঠিক ফিরে আসবে, ডেকে বলবে, কেন?
কেন রে তুই হাসিস? তোর বিশ্বাস হলো না?
আমারও রূপ ছিল, এবং সেই রূপ দেখে পাগল
হয়েছিলেন অনেক লোকই, এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়?

সবাই যাকে শ্রদ্ধা করে, যার কবিতা সবার ঠোঁটে ঠোঁটে
প্রতিবছএর জন্মদিনে যার নামে হয় কয়েক ঘন্টা বেতারে গান বাজনা
সেই তিনি, সেই কবি এমন বুড়ীর জন্য পাগল
হয়েছিলেন? হি হি হি হি এবং হি হি হি হি
রাগে তোমার মুখের চামড়া হয়ে উঠবে চিংড়ি মাছের খোসা
তুমি ভাববে এক্ষুনি সুনীলকে ডেকে যদি সবার
সামনে এনে প্রমাণ করা যেত।
কিন্তু হায়, কি করে তা হবে?
সেই সুনীল তো মরেই ভূত পঁচিশ বছর আগে
কেওড়াতলার চুল্লীতে যার নাভীর চিহ্ন খুঁজেও পাওয়া যায়নি!

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
এখন তুমি সাতাশ এবং সুনীলও বেশ যুবক
এখনও তার নাম হয়নি, বদনামটাই বেশি
সবাই বলে ছোকরা বড় অসহিষ্ণু এবং মতিচ্ছন্ন
লেখার হাত ছিল খানিক, কিন্তু কিছুই হলো না।

তাই তো বলি, আজও সময় আছে
দাঁড়াও তুমি অখ্যাত বা কুখ্যাত সেই কবির সামনে
সোনার মতো তোমার ঐ হাত দু’খানি যেন ম্যাজিক দন্ড
বলা যায় না, তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে একদিন সে হতেও পারে
দ্বিতীয় রবিঠাকুর!
তোমার সব রূপ খুলে দাও, রূপের বিভায় বন্দী করো
তোমার রূপের অরূপ রঙ্গ তাকে সত্যিই পাগল করবে
তোমার চোখ, তোমার ওষ্ঠ, তোমার বুক, তোমার নাভি…
তোমার হাসি, অভিমানে গুচ্ছ গুচ্ছ অশোক পুষ্প…
কিন্তু তুমি তখনই সেই সুনীল, সেই তোমার রূপের পূজারীর
চুলের মুঠি চেপে ধরবে, বলবে , আগে লেখো!
শুধু মুখের কথায় নয়, রক্ত লেখা ভাষায়
কাব্য হোক রূপের, শ্লোক, অমর ভালোবাসায়।

 

 

 

 

নাসের হোসেন

ডাক

 

 

পশ্চিম আকাশ থেকে ভেসে এলো ডাক, এবার বিদায়

এইবার কষ্ট শুরু হলো প্রকৃত, ডেক্সভরা চিঠি
ছিঁড়, প্রস্রবণ
উড়ে যায় চোখের সামনে, ভালবাসা
বহুদিন ঘড়ি ছুটে গেছে তোমাদের বাড়ি-
আক্রোশভরে উঠে যাই তোমার বুকের গভীরে

পশ্চিম আকাশ থেকে ভেসে এলো ডাক, এবার বিদায়

 

 

🍂ধারাবাহিক গদ্য | পর্ব ৬ 

 

 

যাদের মেধার জোর ছিল তারা কলেজ অব্দি যেতো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতো দুই একজন। গাঁয়ের কোনো ছেলে যদি বিএ পাশ করতো তো বাড়ি বয়ে দূর দূরান্তের লোকজন দেখতে আসতো সেই মেধাবীকে। রেহানা বীথি-এর লেখা ‘ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই’-কে নিয়ে ধারাবাহিক গদ্যের আজ পর্ব ৬

 

 

ভাষা বিজ্ঞানী প্রফেসর মুহাম্মদ আব্দুল হাই

রেহানা বীথি

 

 

 

কটি রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও পেয়েছেন উদারতার শিক্ষা। আর এই উদার মনোভাবেরই প্রতিফলন ঘটেছে তাঁর সমস্ত কর্মকাণ্ডে। নিজস্ব ভাষা -সাহিত্য -সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের মহান ব্রতটি নিজ দায়িত্বে কাঁধে তুলে নেয়া এবং তা নিয়ে তাঁর আপোষহীন মনোভাব পছন্দ হয়নি শাসকশ্রেণীর। তাঁর প্রতি শাসকশ্রেণীর বিরূপ মনোভাবের সুযোগ গ্রহন করে অনেকে সুবিধা লাভ করেছেন। কিন্তু তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে টলানো যায়নি একচুলও। যদি তিনি শাসকশ্রেণীর আস্থাভাজন হয়ে তাদের কথামত চলতেন, তাহলে বিত্ত-বৈভব আর বিলাসিতার মধ্যে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। বাধা এসেছে, বাধাকে অতিক্রম করেছেন বলিষ্ঠতার সঙ্গে। তবে ষড়যন্ত্র? সে তো হয়েছে তলে তলে, গোপনে। বুঝতে পেরেছেন তিনি, কিন্তু রুখতে পারেননি। আর সে কারণেই হয়তো বড় অসময়ে চলে গেলেন তিনি। নিজের অনেক কষ্টের ফসল, তাঁর গবেষণা, তাঁর অসংখ্য অপ্রকাশিত লেখা, সব এলোমেলো রেখে একেবারে হঠাৎ করেই চলে গেলেন তিনি। চলে গেলেন অনেককিছুই না গুছিয়ে। যেগুলো পরবর্তিতে হারিয়েই যায় একেবারে। তাঁর মৃত্যুর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাসভবনটিতে তাঁর স্ত্রী সন্তানেরা বাস করতেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় সে বাড়িটিতে আগুন দেয়া হয়। আর সে আগুনে পুড়ে যায় অমূল্য সম্পদ তাঁর লিখিত কিন্তু অপ্রকাশিত লেখাসমূহ। যেগুলো তিনি গুছিয়ে যেতে কিংবা সেসব সম্পর্কে কাউকে কোনো নির্দেশনাও দিয়ে যেতে পারেননি।

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষ কেমন ছিল, কেমন ছিল তখনকার শিক্ষাজীবন, গ্রাম আর শহরের পার্থক্য, মানুষের জীবনযাত্রা, এসব আমরা কিছু কিছু জানি। হয় কোনো লেখা পড়ে, নয়তো গল্প শুনে। এখন যেমন গ্রামগুলো প্রায় শহরের মতই। শহরের সবরকম সুযোগ সুবিধা গ্রামেও বিদ্যমান। বর্ষাকালে এটেলমাটির আঠালো কাদায় পা আটকে যায় না, আটকে যায় না গরুরগাড়ির চাকাও। পিচঢালা কালো পথে রিক্সা, অটো, কার বাস, প্রয়োজনে ট্রাকও যাতায়াত করে। রয়েছে বিদ্যুৎসংযোগ, হাতে হাতে মোবাইল, ইন্টারনেটের বিশাল উন্মুক্ত আকাশ। নিঝ্ঝুম দুপুরে বাঁশ বাগানের ওপারের দীঘিটার পাড়ে ছপাছপ কাপড় কাঁচার আওয়াজ খুব বেশি শোনা যায় না। বাড়িতেই টিউবওয়েল নয়তো পৌরসভার ওয়াটার সাপ্লাইয়ের ট্যাপ। সন্ধ্যেবেলায় ঝিঁঝিঁর ডাক কান অব্দি পৌঁছাবে কেমন করে? মনোনিবেশ তো টিভিতে, সেখানে রকমারি আয়োজন। বর্তমানের চিত্র এটা। কিন্তু সেই সময়? একটু যারা অবস্থাশালী, তাদের বাড়িতে হারিকেন বা লণ্ঠনের দেখা মিলতো। বাকিদের বাড়িতে পিদিমের শিখাই ভরসা। তাও যত্ন করে তেলের খরচ বাঁচানোর প্রয়াস তো ছিলোই। তেল, সাবান, খাদ্যসামগ্রী সঙ্গে কাপড়-চোপড়ও সহজলভ্য ছিল না মোটেই। দূর দূরান্তে হাট, হাটবারে কেনাকাটা করতে যেতে হতো পায়ে হেঁটেই নয়তো গরুর গাড়িতে। যে দুই একজনের সাইকেল থাকতো, তাদেরকে মনে করা হতো পরম সৌভাগ্যবান। আর এরকম একটা সময়ে লেখাপড়ার চর্চা করা কিংবা সন্তানকে শিক্ষিত করার মত ইচ্ছে গাঁয়ের বেশিরভাগ পরিবারে ছিল না বললেই চলে। যারা লেখাপড়া করতো ভীষণ কষ্টকর অবস্থার মধ্য দিয়েই করতো। পায়ে হেঁটে দূরের স্কুল কিংবা ভিনগাঁয়ে কারো বাড়িতে লজিং থেকে অথবা কোনও আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করতে হতো। যাদের মেধার জোর ছিল তারা কলেজ অব্দি যেতো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যেতো দুই একজন। গাঁয়ের কোনো ছেলে যদি বিএ পাশ করতো তো বাড়ি বয়ে দূর দূরান্তের লোকজন দেখতে আসতো সেই মেধাবীকে। আমাদের এলাকায় এ নিয়ে একটা মজার ঘটনা লোকমুখে শোনা যায়, একবার গাঁয়ের এক ছেলে বি কম পাশ করেছে। তাকে দেখতে আসা লোকজনের মধ্য থেকে একজন জানতে চাইলো, “বাবা, তুমি কি পাশ করেছো?” ছেলেটি বললো, বি কম। এই শুনে লোকটি ভীষণই মন খারাপ করে বললো, “এ্যাদ্দিন ধরে লেখাপড়া শিখে তবুও বি কম!” (চলবে) 🍁

 

 

🍂কবিতা 

 

 

 

 

মহাদেব সাহা -এর দু’টি কবিতা 

এক কোটি বছর তোমাকে দেখি না

 

এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না
একবার তোমাকে দেখতে পাবো
এই নিশ্চয়তাটুকু পেলে-
বিদ্যাসাগরের মতো আমিও সাঁতরে পার
হবো ভরা দামোদর
…কয়েক হাজার বার পাড়ি দেবো ইংলিশ চ্যানেল;
তোমাকে একটিবার দেখতে পাবো এটুকু ভরসা পেলে
অনায়াসে ডিঙাবো এই কারার প্রাচীর,
ছুটে যবো নাগরাজ্যে পাতালপুরীতে
কিংবা বোমারু বিমান ওড়া
শঙ্কিত শহরে।
যদি জানি একবার দেখা পাবো তাহলে উত্তপ্ত মরুভূমি
অনায়াসে হেঁটে পাড়ি দেবো,
কাঁটাতার ডিঙাবো সহজে, লোকলজ্জা ঝেড়ে মুছে
ফেলে যাবো যে কোনো সভায়
কিংবা পার্কে ও মেলায়;
একবার দেখা পাবো শুধু এই আশ্বাস পেলে
এক পৃথিবীর এটুকু দূরত্ব
আমি অবলীলাক্রমে পাড়ি দেবো।
তোমাকে দেখেছি কবে, সেই কবে, কোন বৃহস্পতিবার
আর এক কোটি বছর হয় তোমাকে দেখি না।

 

 

তোমার অভিমান

 

কেবল তোমার জন্য
কত সহস্র রাত জেগে কাটালাম
কতো দীর্ঘ শীতরাত্রি পাড়ি দিলাম,
সমুদ্রে ভাসালাম ভেলা
কিন্তু তোমার অভিমান ঘুচলো না,
অভিমান ঘুচলো না।

সেই যে তুমি গেলে
আসবো আসবো করে
আর ফিরে এলে না,
আমার বুকে কত পাথর গলে জল হলো
ফুল ফুটলো, ঝরে গেলো,
শিশির ঝরে ঝরে ভিজিয়ে দিলো মাটির তপ্ত বুক
কিন্তু তুমি সেই যে গেলে ফিরে এলে না,
ফিরে এলে না।

কেবল তোমার জন্য
কত সহস্র শীতরাত্রি
এভাবে জেগে কাটালাম,
পাড়ি দিলাম কতো বরফযুগ
সমুদ্রে ভাসিয়ে দিলাম এই ছোট্ট ভেলা,
কিন্তু তোমার অভিমান ভাঙলো না
অভিমান ভাঙলো না।

 

 

 

 

 

জয় গোস্বামী 

সম্পর্ক

 

তুমি তো জানোই আমি সামাজিক ভাবে
কোনও দিন পুরোপুরি তোমার হব না।
আমিও তো জানি তুমি আমার একার জন্য নও।
তা হোক না। তা আমার বেশি।
আমি কী কী চাই?
সুর কানে প্রবেশ করবে।
হাত সে শান্ত হবে হাতে।
শরীর কখনও হবে, কখনও হবে না।
সামাজিক ভাবে, বলো,
কারো কিছু ক্ষতি আছে তাতে?
মনে মনে সঙ্গে থাকি।
যে-পথে কলেজ থেকে ফেরো
সে-রাস্তায় মনে মনে যাই
বাস্তবেও গেছি দু’একবার।
তোমার ছাত্রীকে তুমি বললে কি আমার কথা?
বলো তো কী পরিচয় দিয়েছ আমার?

 

 

 

 

তসলিমা নাসরিন –এর তিনটি কবিতা 

ভালবাসায় আজকাল মন বসে না

 

ভালবাসায় আজকাল মন বসে না
মনে হয় কিছু যেন কাজ আছে,
মনে হয় কোথাও যেন যাবার কথা, দূরে কোথাও। ভালবাসা আজকাল আমাকে তেমন করে মালার মতাে গাঁথে না।
যেমন গাঁথে বেদনার দীর্ঘ সুতাে।

যারা বেঁচে না থাকার মতাে বেঁচে আছে, তাদের জন্য মন কেমন করে আমার।
সারাদিন যদি মন কেমন করে,
সারাদিন যদি সুচ ফোটে গায়ে-
আমি কি পাগল যে ভালবাসার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ব!

আগে তাে খড়কুটো দিতে হবে তাদের—যারা ভাসছে, আগে তাে হাতখানা বাড়াতে হবে তাদের হাতের
দিকে—যারা ডুবছে।
তারপর নিজে যদি বাঁচি তাে বাঁচব, ভালবাসি তাে বাসব।

 

 

খালি খালি লাগে

 

সেই যে গেলে, জন্মের মত গেলে
ঘর দোর ফেলে।
আমাকে একলা রেখে বিজন বনবাসে
কে এখন ভাল বাসে,
তুমি নেই, কেউ নেই পাশে।

কে এখন দেখে রাখে তোমার বাগান
তুমিহীন রোদুরে গা কারা পোহায়
কে গায় গান পূর্ণিমায়
তুমিহীন ঘরটিতে কি জানি কে ঘুমোয় কে জাগে।
জীবন যায়, যেতে থাকে
যেখানেই যাই যে পথে বা যে বাঁকে দাঁড়াই
যে ঘাটে বা যে হাটে, বড় খালি খালি লাগে।

 

 

কারো কারো জন্য এমন লাগে কেন!

 

জানি না কেন হঠাৎ কোনও কারণ নেই, কিছু নেই, কারও কারও জন্য খুব অন্যরকম লাগে,
অন্য রকম লাগে।
কোনও কারণ নেই, তারপরও বুকের মধ্যে চিনচিনে কষ্ট হতে থাকে,
কারুকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয়, পেতে ইচ্ছে হয়, কারুর সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে
বসতে ইচ্ছে হয়,
সারাজীবন ধরে সারাজীবনের গল্প করতে ইচ্ছে হয়,
ইচ্ছে হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও ইচ্ছে হয়।

ইচ্ছের কোনও লাগাম থাকে না। ইচ্ছেগুলো এক সকাল থেকে আরেক সকাল পর্যন্ত
জ্বালাতে থাকে। প্রতিদিন।
ইচ্ছেগুলো পুরণ হয় না, তারপরও ইচ্ছেগুলো বেশরমের মত পড়ে থাকে,
আশায় আশায় থাকে।
কষ্ট হতে থাকে, কষ্ট হওয়ার কোনও কারণ নেই, তারপরও হতে থাকে,
সময়গুলো নষ্ট হতে থাকে।

কারও কারও জন্য জানি না জীবনের শেষ বয়সে এসেও সেই কিশোরীর মত
কেন অনুভব করি।
কিশোরী বয়সেও যেমন লুকিয়ে রাখতে হত ইচ্ছেগুলো, এখনও হয়।
কি জানি সে, যার জন্য অন্যরকমটি লাগে, যদি
ইচ্ছেগুলো দেখে হাসে!
সেই ভয়ে লুকিয়ে রাখি ইচ্ছে, সেই ভয়ে আড়াল করে রাখি কষ্ট।
হেঁটে যাই, যেন কিছুই হয়নি, যেন আর সবার মত সুখী মানুষ আমিও, হেঁটে যাই।
যাই, কত কোথাও যাই, কিন্তু তার কাছেই কেবল যাই না, যার জন্য লাগে।

কারও কারও জন্য এমন অদ্ভুত অসময়ে বুক ছিঁড়ে যেতে থাকে কেন!
জীবনের কত কাজ বাকি, কত তাড়া!
তারপরও সব কিছু সরিয়ে রেখে তাকে ভাবি, তাকে না পেয়ে কষ্ট আমাকে কেটে কেটে
টুকরো করবে জেনেও তাকে ভাবি। তাকে ভেবে কোনও লাভ নেই জেনেও ভাবি।
তাকে কোনওদিন পাবো না জেনেও তাকে পেতে চাই।

 

 

 

 

মিতা নূর 

তবু গাছ বুঝবে না

 

চারপাশে যত মানুষই থাকুক না কেন, মনে হয় কেউই আমার না,
একাকীত্ব হঠাৎ আমায় একলা করে দেয়।
সারাদিন নিজের ভেতরে কেমন একটা অসুস্থতা অনুভব করি,
শরীরটা বেঁচে থাকে, কিন্তু মনের গভীরে কিছুই যেন অবশিষ্ট নেই।
কথা বলি হাসি মুখে, কিন্তু সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে অগণিত দুঃখ, যন্ত্রণা।

প্রতিদিন, সকাল হয়, দুপুর আসে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা আসে,
সন্ধ্যার সঙ্গ ধরে আসে রাত।
রাত হলেই মনে হয়, আমার পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে গেছে,
কেবল আমি আর আমার শূন্যতা গুলো জেগে আছে নিঃশব্দে।
কত কথা জমে থাকে, কত অনুভূতি ভাসে মনে,
কিন্তু বলার মতো কাউকে খুঁজে পাই না।
শুধু নিঃশব্দে চোখের জল মুছে একমুঠো শান্তির ছোঁয়া খুঁজি।
সবাই ভাবে আমি বেশ ভালোই আছি, সুখী আছি,
কিন্তু ক’জন বোঝে আমার ভেতরের এই নাম না জানা কষ্টগুলো!
কিছু অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করা যায় না,
এই দুঃখগুলো হয়তো কখনো বলা হয়ে ওঠে না।
এভাবেই চলতে থাকে জীবন আমার,
নিজেকে প্রতিদিন হারিয়ে আবার খুঁজে পাই।
বেঁচে থাকা যেন শুধুই বেঁচে থাকতে হয় বলেই, হয়তো একদিন সব ঝড় থেমে যাবে,
একটু শান্তির আলো ফুটবে আমার মনের ছোট্ট চিলেকোঠায়।
সেদিন হয়তো আমার নিশ্বাস থেমে যাবে,
আঁধারে মিলিয়ে যাবে আমার জীবনের আলো।
জানি, তবু আমাকে কেউ বুঝবে না…
ধীরে ধীরে আমি হারিয়ে যাবো, হারিয়ে যাবে চিরতরে, হারিয়ে যাবে আমার একা একলা এই যন্ত্রণাময় জীবন।
তবু কেউ বুঝবে না আমায়।

 

 

 

 

ফাল্গুনী চক্রবর্তী

প্রেম ফাইল-১৭

 

টিয়া রং-এর ঘরে দূরত্ব মিটে যায় বাতাসে মাংসের গন্ধ-পাথর সরিয়ে দিতেই বেরিয়ে আসে অযত্নে পড়ে থাকা পতঙ্গের সাম্রাজ্য ঠিক যেমন কখন ও আমাদের মগজ…. দেয়ালে ছায়ার অনায়াস অধিকার খননের কথা ভাবতে পারছি না… লুকিয়ে থাকা হীরা পান্না চুন্নীর শরীরে এখনও লেগে আছে জল শুশ্রূষার অজস্র টিপ… টিপের শামিয়ানায় তোমার বিশ্রামের ঘর… স্বপ্নের মহল চোখের রং কে এবার প্রশ্রয় দিই বন্ধ জানালা খুলে দিতেই ফুসফুসের ভেতর ঢুকে পড়ে প্রণয়ের কুলফি অনেক দিন জমানো ছিল মুহূর্তের দাবী… আগুন ভাঙতে ভাঙতে বেরিয়ে এল এক অবাক জলদূত… গণিত না জানলেও সময়ের ধারাপাতে অস্ত্র রাখলাম

 

 

 

 

মমতা রায় চৌধুরী

আমি তোমাকে সেই ‘সুরঞ্জনা’ হতে বলিনি

 

‘সুরঞ্জনা’,  আমি তোমাকে জীবনানন্দ দাশের ‘সুরঞ্জনা ‘হতে বলিনি
তাই ‘নক্ষত্রালোকের’ উজ্জ্বল দিগন্তে আমি তোমাকে চাই না।
‘সুরঞ্জনা’, আমি তোমাকে আমার অস্তিত্বের শিকড়ে বেঁধেছি
আমার নিঃশ্বাস তোমার বুকের উপর পড়ে
তপ্ত হাওয়ায় আমায় মাতাল করে।

‘সুরঞ্জনা’, আমি তোমাকে মেঘের মতো ভেসে যেতে দেব না
আমার প্রতিটা পলক তোমায় জুড়ে জুড়ে
তোমার চোখে আমার ভাষা খুঁজি প্রতি পরতে পরতে।

‘সুরঞ্জনা’, ঘাসের উপর বসে নদীর ধারে কলতান শুনে হারিয়ে যাব একই দেহে লীন হয়ে
আমি সেই ‘সুরঞ্জনা’ চাই।

‘সুরঞ্জনা’, আমার ভাষার প্রতিটা অক্ষরে ছত্রে
ভালোবাসায় আঁকো আমার প্রতিটা পরব
বছরের সমস্ত দিনগুলো তাই উৎসব মুখর।

‘সুরঞ্জনা’ আমি তোমাকে সেই’ সুরঞ্জনা’ হতে বলছি
এসো দেখি হাত ধরে একসাথে হাজারটা পথ চলি
সুখে- দুখে, প্রেম ভালবাসায় প্রতিটা দিন বসন্তের আগুন লাগুক।

 

 

 

 

 

🍂ছবি : আন্তর্জালিক 

🍂অঙ্কন : প্রীতি দেবআন্তর্জালিক 

 

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

বি: দ্র: সমস্ত লেখা লেখকের নিজস্ব। দায় লেখকের নিজস্ব। কোনও বিতর্কিত বিষয় হলে সংবাদ সংস্থা কোনওভাবেই দায়ী থাকবে না এবং সমর্থন করে না। কোনও আইনি জটিলতায় সাশ্রয় নিউজ চ্যানেল থাকে না। লেখক লেখিকা প্রত্যেকেই লেখার প্রতি দ্বায়িত্ববান হয়ে উঠুন। লেখা নির্বাচনে (মনোনয়ন ও অমনোনয়ন) সম্পাদকমণ্ডলীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।

 

সম্পাদকীয় ঋণ : হেলাল হাফিজ-এর কবিতা সহ ফিরে পড়া বিভাগের লেখকদের গল্প, কবিতা আন্তর্জাল থেকে সংকলিত। 

Sasraya News
Author: Sasraya News

2 thoughts on “Sasraya News Sunday’s literature Special | 15th December 2024 | Issue 43 || সাশ্রয় নিউজ রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল | ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | সংখ্যা ৪৩”

  1. অসাধারণ সংখ্যা। এটি মুদ্রিত হলে খুব ভালো হতো।
    সুন্দর ভাবনা।
    অনেক অনেক অনেক শুভেচ্ছা

    Reply

Leave a Comment