



সম্পাদকীয়
গাঢ় নীল সবুজ আর লালের মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া কালো দাগ। হলুদ বর্ণ বিশ্লেষণ করে উদাহরণ দেওয়া হচ্ছে। উদাহারণ দিচ্ছে চোখ। সবটাই সাদার উপর নির্ভর এক চরমতম সত্য। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষের সাথে বন্ধুত্ব প্রেম আর ভালোবাসার মর্যাদা রক্ষা করতে পারে একমাত্র অদৃশ্য শক্তি। দুই দিন আগেই একজন বলছিলেন এটা ভুল কথা। আমি বললাম ভুল কি করে! তিনি বললেন – ভুল না? আমি আবারো বললাম, ভুল কি করে? সে বলল, আপনি যত টাকা-পয়সা ধন-দউলত জিনিসপত্র দিতে পারবেন তত ভালো হবেন তাদের কাছে। আমি একটু হাসলাম আর বললাম। আসলে আমি কি বলেছি তুমি বুঝতে পারোনি। তিনি যথারীতি রেগেই গেলেন। রেগে গিয়ে বললেন – সব আপনিই বোঝেন আমরা কিছুই বুঝিনে।
শরীরটা খারাপ। ডাক্তারের বারণ আছে কথা বলা। তবুও বললাম, বলি শুনুন। বায়ু কি দৃশ্যমান? মন কি দৃশ্যমান, আরো অনেক কিছুই আছে যা বলছিনে। কারণ যে সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছি তা এই অদৃশ্য শক্তি মনেই রূপায়িত। আর এই মনের অদৃশ্য শক্তির ক্ষমতা তোমার আমার জন্য বিচার্জ নয়। এটাও ঠিক অন্য কারোর জন্য। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই ব্যবহার করতে পারি। বিশেষ ব্যক্তিরা অবশ্যই এর চেয়ে বেশি। তবে কতটা বেশি এটারও বিচার্জ আমার তোমার নয়। শুধু জানো, এই অদৃশ্য শক্তি এমন ব্রহ্মাণ্ড বানাতে পারে। উনি বললেন – ও ও ও এটা তো ভাবিনি। আমি একটু হাসি দিয়েই বললাম- অদৃশ্য শক্তি বন্ধু প্রেম ভালোবাসার মুক্তি ঘটল তাহলে! তিনিও হাসলেন আমার সুরে। হা হা হা। 🍁
🌞কবিতা
সুপ্রভাত মেট্যা
ধুলো ময়লার মেয়ে
তুমি জলের মতো সহজ হয়ে দাঁড়াও।
আমার ডুব খেলে যায় লেখা।
সামনে-পিছনে যাওয়া-আসার মধ্যবিন্দু চাঁদে আমাদের ঘর
জন্ম নেয়। আমরা ভেসে বেড়াই। ঘর মানে কি সংসার?
ভাত ফুটে ওঠা কাঠের আগুনে কোনও?
ধুলো ময়লার মেয়ে, বলে লোকে।
লোকে বলে পাথুরে কালো, রাতে মিশে গেলে আর চেনাই যায় না!
নষ্ট হয়ে, নষ্টে গিয়ে হারায়।
দ্যাখো, ওই খারাপী রাতের শরীরে যত পারো মন্দ ঢালো তুমি,
অন্ধ সে কিন্তু নয়; তারও চোখ সুচেতনাষুর, সুখমণ্ডলচমকিতের…
অথচ ওই শহর, গ্রামে এলে তুমি হাওয়া করো, পেন্নাম ঠুকে, বসতে দাও। আর গ্রাম শহরে গেলে? তখন?
কেন এই জল যেদিকে ভাল, সেদিকে গড়িয়ে যাওয়ার নেশা?
কেন এই শীর্ষকারিতা, মর্দনতৈলের?
তৈমুর খান
জানোয়ার
আমরা স্বর্গের দিকে যেতে যেতে দুইপাশে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিলাম
আমরা সবাই দেবতা—চারিপাশে আমাদের শরীরের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ছিল
চারিপাশে সবাই আমাদের দেখছিল আর ফুল ছুঁড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল
আমাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ ছিল না সেদিকে
হাসতে হাসতে চলে যাচ্ছিলাম স্বর্গযানে
দুইপাশে মরচেধরা প্রাণী—ক্ষুধার্ত—ভঙ্গুর—তৃষ্ণার্ত—হাহাকারপ্রিয়…
দুইপাশে কসাইয়ের দোকান—
নিরন্তর ছুরি শান দেওয়ার শব্দ
নিরন্তর দুর্বোধ্য ভাষার চিৎকার…
আমরা সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা
স্বর্গে যেতে যেতে দেখছি এসব;
আমাদের গাড়ির চালক জানাল:
এরা সবাই বিভিন্ন জাতের প্রাণী—
পৃথিবীতে এদের জানোয়ার নামে ডাকা হয়!
দুপুরের ডাকঘর
দুপুর এসেছে, একটু পর চলে যাবে
তাকে কিছুই বলার নেই
অনেক মৃত সকাল, শিশির ভেজা ভোর
স্মৃতির আলোয় পড়ে আছে
পাখিদের কলতান উড়ছে কোথাও
কোথাও বিগতা কুমারী শিস দেয় আজও
শরতের শালুক ফোটা দিঘি আর নেই
দিঘির বকেরা সব মৃত! মাছগুলি চলে গেছে অন্যকোনও সমুদ্রের দিকে….
এখন হৃদয় পেতে ছায়া খোঁজা দিন
বিশ্রামে নীরব হয়ে থাকা
মাটি ফাটা তাপে বয়ে যায় দীর্ঘশ্বাস
শীত আর কুয়াশায় লেখা জীবনের শেষ চিঠি
নিয়ে এসেছে দুপুরের ম্লান ডাকঘর
স্পর্শ
এই হাত, আমারই হাত, আমিই স্পর্শ করি
সমস্ত শরীর জুড়ে এখনও সেই স্পর্শের শিহরণ পাই
যে আলো নিভে গেছে বহুদিন
এখনও তার উজ্জ্বলতা আছে
এখনও অক্ষরগুলি পড়ে নিতে পারি
হৃদয় পাথর হয়ে গেছে, যে শোকে পাথর হয়
সব বেদনার অশ্রুগুলি
পথও হারায় পথে
ঠিকানাও বদল হয় অন্য কোনও ঠিকানায়
একটা শূন্যের মতো পৃথিবী গড়াতে গড়াতে
দিনরাত্রি প্রসব করে শুধু
ফেল করা ছাত্রের মতো আমরা শুধু অংকে শূন্য পাই
ঘর বানাতে বানাতে প্রতিদিন ঘর ভেঙে ফেলি
প্রদীপ জ্বালাতে জ্বালাতে প্রতিদিন ডাকি অন্ধকার
স্মৃতির কাচ মুছতে মুছতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়
শুধু হাতখানি স্পর্শ ধরে রাখে
যে স্পর্শ তার একান্ত ঈশ্বরীর…
সোনার মঙ্গলকাব্য
রাতদিন সোনার হরিণ শিকার করি
আর হরিণের মাংস আনি ঘরে
ফুল্লরা রান্না করে দেয়
আমি ও আমার সন্তান মিলে খাই
সোনার সংসারে আমরাও সোনার মানুষ
রোদ্দুরে চিকচিক করে শরীর আমাদের
অরণ্য প্রত্যহ হরিণ প্রসব করে
সোনার তির-ধনুক হাতে যখন দাঁড়াই
আমাদের গল্পগুলি পাখা মেলে ওড়ে
গল্পগুলি খুঁজে ফেরে মুকুন্দরামের ঘর
কত যুগ পার হচ্ছে, সোনার হরিণ হচ্ছে মায়া
আমরাও বদলে যাচ্ছি লোহায় পেতলে
ফুল্লরাও পাল্টে হচ্ছে ফেলু-ফেলানিতে
তির-ধনুকগুলি এখন বন্দুক-পিস্তল
অরণ্য নগর-রাষ্ট্র সমূহ শিকারভূমি এই সভ্যতার
সন্তান-সন্ততি মিলে আমরা সব মরীচিকা খাই
রোকসানা রহমান
খড়কুটো হাতে
আমার কষ্টের জানালায় বৃষ্টি কেন আছড়ে পরে।
তাহলে কি শার্শির ভিতর আমার স্বপ্নরা
শরৎ- গোধুলির স্শর্শময় খেলা করে।
তবে কেন সম্পর্কের পানপাত্রে এতো কষ্টের
রঙ দ্রবিভূত হয়ে কালছে আকার ধারণ
করে আছে…!?
কেনইবা এই পৃথিরীর বুকে জানালার শার্সিতে
ছড়িয়ে দিতে চায় আবেগ।
অথছো একদিন এই সমাজ – সংসারের ভিতরই
ছিল আমার আকাশ-আবেগ-অনুভূতির স্বাপ্নিক হৃদয়।
আজ,দীর্ঘ সময়ের পর আরও বৃষ্টি
ধূসরহৃদয়ে গুন্জন তুলে স্পর্শ করছ ফাটল
আরশির ফ্রেমে।
কোথায় সেই উজ্জ্বল রোদেলা রক্তিম আকাশ
যেদিন প্রতিধ্বনিত – ঘন্টার মত স্বপ্নরা হারিয়ে
গিয়েছিল ছিনিয়ে নিয়েছিল আমার স্বপ্নের
ভূমি।
সেই থেকে আমি আষাঢ়ের সকালে
দাঁড়িয়ে আছি অন্তিম বর্ষার বৃষ্টিস্নাত
রাতে একাকী খড়কুটো হাতে…!
সুফিয়া শিউলি
টাকা আর কাকা
মামা খুব প্রাণখোলা
মামি খুব ভালো
কাকা খুব রগচটা
কাকি খুবি কালো।
মামা খুব ভালোবাসে
মামি করে দোয়া
কাকাবাড়ি গেলে কাকি
চোখে দেয় ধোঁয়া।
যদু তবু কাকাকেই
বেশি দেয় দাম….
বকা দেয় তবু করে
কাকিকে প্রণাম।
কেন যদু করে এটা
ভেবে মরি হায়
শুধালেই যদু হেসে
গড়াগড়ি যায়।
হেসে হেসে বলে শেষে
সাধে করি কা কা আছে…
তার গাড়িবাড়ি
কাঁড়িকাঁড়ি টাকা,
কাকা নয়, টাকাকেই
করি যে প্রণাম…
টাকা ছাড়া দুনিয়াতে
নেই কারো দাম।
ফটিক চৌধুরী
আয়ু
একমাস না যেতেই ভুলে যাব সব?
মানুষের স্মৃতির এত অল্প আয়ু!
পাখির ডানায় নতুন পালক গজায়
ভুলে যায় সে ঝরা পালকের কথা।
বিষাদের আয়ু যেন সকালের শিশির
রামধনু কিংবা সূর্যাস্তের শেষ রং!
স্থায়ী কিছুই নয়
মুহূর্তেরা প্রতি মুহূর্তে বদলায়।
আবদুস সালাম
ওরা বড্ড বকম বকম করে
গণতন্ত্রের চাঁদ ওঠে টোটোর ছাদে
সংখ্যালঘুর বারান্দায় নেচে ওঠে তাচ্ছিল্যের ইমাম ভাতা
দরদী নেতৃত্ব বাজায় সি এ এ’ র ডুগডুগি
দেশ ভক্তির ময়দানে ডুবে গেছে স্বাধীনতার সূর্য
ভ্রান্ত আসকারায় ডানা মেলে দাড়ি টুপির উপাখ্যান
প্রতিবন্ধী সেতুর রেলিং এ দোল খায় শ্বাসকষ্টের গণতন্ত্র
খয়রাতির লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে
পুড়ে যায় সম্প্রতির পালঙ্ক
ফি-বছর ভোট গেলে বাঁশি বাজে গণতন্ত্রের
শুরু হয় মাতন
বাজে গাজনের বাজনা
বাজি ফোটানোর উৎসবে মাতে আ-সমুদ্র-হিমাচল
কালো ধোঁয়ায় রঙিন হয় আকাশ
গণতন্ত্রের হাততালিতে কেঁপে ওঠে সহিষ্ণুতার ভিত্
ডানা ছাঁটা হয় শ্বেতপায়রাদের
ওরা বড্ড বকম বকম করে-
বিশ্বজিৎ মণ্ডল
নদীর কাছে যাব
১.
পক্ষাঘাতে দুষ্ট দুটি পায়ে আর চলতে পারি না
সমীচীন গন্তব্য…
জল তরঙ্গের আশ্চর্য বাদনে নেচে উঠতে পারি না
কাষ্ঠল ক্র্যাচের ওপর
প্রান্তিক বিকেলের ম্লান আলোয় বসে থাকি
পশ্চিমা বারান্দার তৃতীয় অলিন্দে
প্রতিদিন একটা মুনিয়া পাখি এসে, বলে যায়-
এইসব পরিযায়ী জীবন…
২.
মিথ্যাবাদী নই
কখনো ভুল জ্যোৎস্নায় গেয়ে উঠিনি__
ক্লান্ত জোনাকির গান
কখনো ধ্বসে পড়া নাবিকের মত, একান্ত বলিনি
নদীর কাছে যাব
তন্ময় কবিরাজ
বৃষ্টি এলো
পদ্মপাতায় যে বৃষ্টির সংসার
আমি সেখানে সুখ ধার করেছি
যে বৃষ্টি অবিরাম
তার বাউলে গান ধরেছি
যে বৃষ্টি ঝাপসা
আমি সে পথের সন্ধান পেয়েছি
রাস্তা কেন শুকনো?
বৃষ্টি হলো যে কাল রাতে!
দীপ্তি চক্রবর্তী
মৃত্যুকে যে সামনে থেকে দেখেছে
মৃত্যুকে যে সামনে থেকে দেখেছে
সে কৈশোর জানে না
চেনা বালুতটে
আঁকতে জানে না সে
জীবনের প্রতিচ্ছবি
তবুও
কোনো একটি বিকেল শেষে
সে উঠে দাঁড়ায়
উঠে দাঁড়ায়
কখনো তার কঠিন হাতে গুটিয়ে নেয়
বজ্রকঠিন বিষাদ জীবন।
সুচিতা সরকার
নিস্তব্ধতার ওপাড়ে
হাজার বছরের নিস্তব্ধতার হাত ছাড়িয়ে,
আজ আরেকবার খোয়ই-য়ের মুখোমুখি।
সময়ের ঘূর্ণিস্রোতে পড়ে,
অক্ষরগুলো অস্পষ্ট হয়ে এসেছে;
লেখাগুলো প্রায়, অবক্ষয়ের পথে।
দুটো কথা ভিক্ষের আশায়,
ভিখারির বেশে, ভাঙা বাটি হাতে-
মন আজ আমার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে।
আমার শব্দ ভান্ডার যে শূন্য!
এতটা অসহায় হয়তো আগে কখনও হইনি।
চোখের কোণদুটো মাঝে মাঝেই,
চিক্ চিক্ করে উঠছে।
নোনা জলে ধীরে ধীরে,
গোটা পৃথিবী গড়ে উঠছে।
ভাগ্যিস, ওদের শব্দের প্রয়োজন পড়ে না!
বাণীব্রত
কবিতা প্রহর গোনা কালবৈশাখী
হৃদয়ের ফুলদালিতে রাখা
কাঁটা ছাড়া রক্তিম গোলাপ
সুখের গন্ধ ছড়িয়ে যাক
হৃদয় কুঠুরির দেয়ালে,
স্মৃতির পাতায় রাখা ছেঁড়া সময়
অনন্ত সুখের বাসনায়
উষ্ণতা ছোঁয় ঠোঁট
পাগলপারা মনে
ধুকপুকানির খেলা ঘর
বাইরের সর্বনাশা গরমের মতো
পুড়ে যায় সমস্ত শরীর
প্রহর গোনে কালবৈশাখী।
ঈশান বিশ্বাস
ঘোর
কিছু ঘোর থাকা ভাল
কিছু ঘোর আঁটকে রাখে জন্ম-জন্মান্তর…
ভোরের ফুলের মতো গন্ধ ছড়িয়ে দেয়
কিছু ঘোর তোমাকে বৃত্তের চক্রান্ত
চিনিয়ে দেবে
কিছু ঘোর নিয়ে যাবে প্রকৃত আলোর কাছে
🌞ধারাবাহিক উপন্যাস /পর্ব ৬
কিন্তু ক্রমশঃ তিনিও বুঝতে শিখছিলেন, অন্ততঃপক্ষে চেষ্টা করছিলেন তার বিয়ে হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসা পরিবার ও তার মানুষগুলোকে একটু একটু করে বুঝতে। কষ্ট হত রান্নায় ঝাল তেল মশলার প্রাধান্য। তবুও মুখ বুজে মেনে নিয়ে চলতে চেষ্টা করেছেন। শুঁটকি মাছ রান্না ও খাওয়া অভ্যাস করেছেন দখিনা হাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে।… সুজিত চট্টোপাধ্যায় -এর ধারাবাহিক উপন্যাস ‘অনেকটা গল্পের মতো’। আজ ষষ্ঠ পর্ব।
অনেকটা গল্পের মতো
“ছায়া ঘনাইছে বনে বনে
গগনে গগনে ডাকে দেয়া”…
অমৃত দত্ত যদিও ব্যবসায়ী মানুষ, কিন্তু মানুষ তো, তাই প্রথম কয়েকটা মাস তার কলকাতার বাড়িতে আসা কিঞ্চিৎ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কাজে অকাজে মাঝেমধ্যেই চলে আসতেন কলকাতায়। প্রভাবতী দেবী তাতে আনন্দই পাচ্ছিলেন। ভেবেছিলেন, মেজ ছেলেকে বুঝি ঘরমুখো করতে পারলেন। কিছুটা নিজের প্রতি উদাসীন পুত্রবধূ প্রতিমাকে পুরুষমানুষকে বেঁধে রাখার ঘরোয়া টিপস্ দিতে লজ্জার মাথা খেয়ে বলতেন… “ও বৌমা! পুরুষ মাইনষেরে বান্ধনের লেইগ্যা নিজেরেও কিসু কেরামতি করন লাগে। পুরুষ মাইনষের মন বোঝন লাগে, বুঝলা! হ্যারা বউয়ের মইধ্যে সব চায়। মায়ের লাখান মমতা খোঁজে, একখান বন্ধুর লাখান ভালোবাসা খোঁজে আবার বাজারী মাইয়্যা মাইনষের লাখান লাস্য খোঁজে। হেই সবডা তারে দেবার লাগে, বোঝলা? তয় একখান বউ হইয়া ওঠন যায় “।
শোভাবাজারের একান্নবর্তী এদেশী পরিবারের পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা প্রতিমা প্রথম প্রথম বুঝতেই পারতেন না তাঁর বাঙাল ভাষায় বলা কোনও কথাই। কারন, তাঁদের বাড়িতে মা, জেঠিমা কাকীমাদের কাউকেই কখনও এমনভাবে কথা বলতে শোনেননি। তাঁরা সবসময়ই ছেলেমেয়েদের সম্ভ্রম দূরত্বের মধ্যে রেখেই বড় করেছেন। তারাও সেভাবেই বেড়ে উঠেছেন। তাই এমন সব কথায় তার কোথায় যেন লজ্জাবোধ হত। কিন্তু ক্রমশঃ তিনিও বুঝতে শিখছিলেন, অন্ততঃপক্ষে চেষ্টা করছিলেন তার বিয়ে হয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে আসা পরিবার ও তার মানুষগুলোকে একটু একটু করে বুঝতে। কষ্ট হত রান্নায় ঝাল তেল মশলার প্রাধান্য। তবুও মুখ বুজে মেনে নিয়ে চলতে চেষ্টা করেছেন। শুঁটকি মাছ রান্না ও খাওয়া অভ্যাস করেছেন দখিনা হাওয়ার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে। তবুও কতটা পেরেছিলেন? আদপেই পেরেছিলেন কি? ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে ঘোরা পোড়খাওয়া ব্যবসায়ী অমৃত দত্তের মুখে বাঙাল ভাষা না থাকলেও তার কথাতেও বোধহয় পেয়েছিলেন শাশুড়ি প্রভাবতী দেবীর উপদেশের আভাস। কোনও একদিন বলেছিলেন, ”এমন উলোঝুলো হয়ে থাকো কেন? তোমার কি নেই? নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে পারো না? এমনভাবে থাকলে তোমার কাছে আসার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে যাবে “। প্রতিমা চেষ্টা করেছিলেন হয়ত অমৃতর মনের মতো হয়ে ওঠার। কিন্তু পেরেছিলেন কি?
এরই মধ্যে গুমোট গরমে দমকা হাওয়ার মতো বাড়িতে আসতেন অমর্ত্য দত্ত, তাঁর ছোট দেওর। সে আসা এবং থাকার দিনগুলো হাওয়ার বেগে উড়ত। খুনসুটি, মজা এসব নিয়ে কোথা দিয়ে কেটে যেত অমর্ত্যর ছুটির দিনগুলো। যেদিন অমর্ত্য চলে যেতেন শিবপুরের হোস্টেলে, সেদিন এবং তার পরের কটা দিন সময় যেন থম মেরে বসে থাকত বারান্দার থামের আড়ালে বা ছাদের কার্নিশে। প্রভাবতী দেবী বয়সে প্রাচীন হলেও তার উন্নত মানসিকতায় দেওর বৌদির এই মিষ্টি সম্পর্ককে শুধু উপভোগ করতেন এমনই নয়, কোথাও যেন একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় দিয়ে রেখেছিলেন। যদিও তার রাশ ধরে রাখতে চাইতেন নিজের হাতেই। ঘি ও আগুনের মধ্যে যে এক চুম্বকত্ব শক্তি কাজ করে, তা তিনিও বিলক্ষণ জানতেন। তবুও স্বামী ছেড়ে থাকা প্রতিমাকে এবং তাঁর ছোটো ছেলের প্রতি বিশ্বাস বোধহয় তাঁকে ওদের দুজনের নির্মল সম্পর্ককে কালিমালিপ্ত করতে চাননি।
দাম্পত্য প্রবাহে একসময় বছরখানেকের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়েছিলো ঋতুস্রাব। খাওয়ায় অরুচি। খুব ঘাবড়ে গিয়ে দিন ক’য়েক পরে শাশুড়িকেই বলেছিলেন তার সেই অবস্থার কথা। তখন অমৃত কলকাতার বাইরে কোথাও আছেন। প্রভাবতী দেবী তাঁর সাংসারিক বুদ্ধিতে যা বোঝার বুঝেছিলেন এবং সেইমতো প্রাথমিক ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। পাড়ার আশুতোষ ডাক্তারকে ডেকে নিশ্চিত হবার পর প্রতিমাকে হাতের তালুতে রেখে দিয়েছিলেন। সে ছিল প্রতিমার জীবনের কিছু স্বর্ণময় দিন। প্রতিমা অপেক্ষার দিন গুনছিলেন অমৃত বাড়িতে আসার। অমৃত আসার আগেই অমর্ত্য এসেছেন। আবার কয়েকটা দিন “ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায়” কেটেছে। তারই মধ্যে অমর্ত্যর প্রতিমার ওপর খবরদারি কখনও কখনও দৃষ্টিকটূ মনে হয়েছে প্রভাবতী দেবীর। কিন্তু কুণ্ঠাবোধে কিছু বলতে পারেননি।
প্রতিমার সুদীর্ঘ অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অমৃত বাড়ি এসেছেন এবং সবকিছু শুনে তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, “আর একটু সাবধান হতে পারনি? এত তাড়াতাড়ি কি খুব দরকার ছিল এসবের?”
প্রতিমা হতবাক হয়েছেন। তার জীবনের প্রথম মাতৃত্বের স্বাদকে যে এমনভাবে তিক্ত করে দেবেন অমৃত, এ ছিল তার ভাবনার বাইরে। সারারাত বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে, বালিশ ভিজিয়ে শুধু পার্থক্য খুঁজেছেন দুইভাই অমৃত ও অমর্ত্য দত্তের মধ্যে। ভোরের মুখে একটা ক্ষীণ পঙ্কিল জলধারা দেখতে পেয়েছেন স্বচ্ছ জলধারার মধ্যে। সকালে উঠে বাথরুম থেকে ঘুরে এসে দেখেছেন অমৃত বেরিয়ে গ্যাছেন, তাকে কিছু না বলেই।
প্রভাবতী দেবী বুঝতে পারেননি অমৃতর জটিল উপপাদ্যের সমাধান। অমৃত তারপরও এসেছেন। অর্থের যোগান দিয়েছেন। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গ্যাছেন। কিন্তু সবটাই যেন দায় সামলানোর মতো। অন্যদিকে অমর্ত্য এসেছেন তার ভালবাসা নিয়ে। দু’টো মানুষের মধ্যে প্রভেদ প্রকট হয়েছে। প্রতিমা একসময় রাগে দুঃখে ভেবেছেন কোনও অঘটন ঘটিয়ে তার প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে না আসার ব্যবস্থা করতে। যেখানে এতো নির্লিপ্ততা, এত দায়িত্বহীনতা, ভালবাসাহীনতা, সেখানে তাকে আনতে কুণ্ঠা বোধ করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই ভেবেছেন, যে আসছে তার দোষ কোথায়? অবশেষে একটা নতুন জীবন অনেক বেশী প্রাধান্য অর্জন করেছে ঘৃণার কাছে, ভালবাসাহীনতার কাছে। শিশুমঙ্গল হাসপাতালে সময় তার আপন নিয়মে উগড়ে দিয়েছে একটা নতুন জীবন। (ক্রমশঃ)
🌱অলঙ্করণ : প্রীতি দেব ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
