



সম্পাদকীয়
জীবনের চলার পথে নানাবিধি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। চিত্ত কখনও কখনও চঞ্চল হয়ে ওঠে। অস্থির হয়ে ওঠে। এই চঞ্চলতার ফলে সঠিক বুদ্ধির প্রয়োগ না ঘটলে সমস্যার জটিলতা আরও বৃদ্ধি পায়। অনেকে সমাধানের রাস্তা না পেয়ে প্রাণত্যাগের প্রচেষ্টা চালায়। মনকে স্থির করবার প্রক্রিয়া না জানার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বিকশিত হবাদ ক্ষমতা থাকলেও আটকে গেছে। যেমন বলতে পারি, একটি সুন্দর গাছে পরিচর্যা বাগানের মালিক খুব ভালভাবেই করল। তার ফলে গাছটির বৃদ্ধি ঘটল এবং পুষ্টাল ঘটল। যখন অন্যান্য গাছগুলি ফল দেওয়া শুরু করেছে তখন বাগানের এই গাছটি আরও অধিক মনে মনে সেবা-শুশ্রূষা চাইল মালিকের কাছে। নিজেকে আরও অন্যান্য গাছেদের থেকে বৃদ্ধি ঘটিয়ে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বৃহৎ হওয়ার প্রয়াস করল। কিন্তু বাগানের মালিক চারদিকে তাকিয়ে যখন দেখল, অন্যান্য যে সমস্ত গাছগুলিতে ফুল এসেছে, ফল এসেছে, কিন্তু যে গাছটির প্রতি তাঁর মায়া সৃষ্টি হয়েছিল, সেই গাছটির প্রতি যে গাছটির প্রতি সে সবচেয়ে পরিশ্রম বেশি প্রদান করেছিলেন মালিক। গাছটি সবার থেকে উচ্চতায় বৃদ্ধি ঘটলেও, পুষ্টাল শাখা-প্রশাখা বিস্তার করলেও কেবলমাত্র সেই গাছটিই তাঁকে (মালিককে) ফুল-ফল প্রদান করেনি। এতে বাগানের মালিক দুঃখিত হল। ফলে প্রতিটি গাছের শাখা-প্রশাখা কেটে নামানো হলেও প্রিয় গাছটির শাখা-প্রশাখা কাটা (ঝুড়ে দেওয়া) হল না। কারণ মনে মনে স্থির করল, অন্যান্য গাছেদের মতোই তার পরিচর্যা হবে। দেখা গেল, আগামী বছরের ফুল-ফলের অপেক্ষায় অন্যান্য গাছেদের মতোই এই গাছটিকেও পরিচর্যা করা হল। তাতে গাছটি মনে মনে কষ্ট অনুভব করল যে মালিক প্রায় প্রতিদিনই আমার কাছে এসে জল, সার, এমনকী গাছের ছায়ায় বসত, সেই মালিক অন্যান্য গাছেদের মতো আমার প্রতি এই রকম বিরূপ আচরণ করল। আগামী বছর এল ফুল-ফলের সময় এলেও বাগানের সব ফুল-ফল প্রদান করতে অক্ষম ছিল। মালিক চমকে গিয়ে বারবার গাছটার দিকে চেয়ে থাকল। মনে মনে বলতে থাকল, তোকে আমি এত পরিচর্যা করলাম, এত ভালবাসলাম অথচ তু-ই আমাকে প্রদান করলাম অথচ তুই আমাকে ফুল-ফল প্রদান করলি না। যদি আগামী বছর ফুল-ফল প্রদান না করিস তাহলে আমি আগামী বছর তোকে বাগান থেকে কেটে ফেলব। গাছটি তাঁর মালিকের চোখের দিকে তাকিয়েই এই বিষয়টি অনুভব করতে পারল। কিন্তু মালিক বুঝতে পারল না। গাছটি খুব চিন্তায় পড়ল এবং ধীরে ধীরে শুকিয়ে উঠতে লাগল। মনে মনে গাছটি প্রার্থনা করতে থাকল ঈশ্বরের প্রতি। এবং ঈশ্বরকে বলল, হে ঈশ্বর আমার মালিক আমার প্রতি ক্ষুদ্ধ। এবছর আমাকে এই বাগান থেকে সরিয়ে দেবে। আমি এই বাগানের সমস্ত গাছেদের খুব খুব ভালবাসি। ঠিক যতটা ভালবাসি আমার মালিককে। আমাকে কেটে সরিয়ে দিলে অন্যান্য গাছেরাও কষ্ট পাবে। হে ঈশ্বর আমাকে পথ দেখাও। গাছটি এক মনে ঈশ্বরের জপ করতে থাকল। কিছুদিন পর অকস্মাৎ একটি ঝড় এল। ঝড় আসার ফলে গাছটির একদিকের শাখা-প্রশাখা ঝড়ে ভেঙে গেল। গাছটি ঈশ্বরকে বলল, হে ঈশ্বর, আমার যে সমস্যা হয়েছিল তার সমাধান চেয়েছিলাম। অথচ আপনি আমার একদিক এইভাবে ঝড় উৎপাদন করে ভেঙে দিলেন! কিন্তু আপনি আমাকে যতই পরীক্ষা নিন, আমার মনকে আপনি চঞ্চল করতে পারবেন না। আপনার ধ্যানেই আমি মগ্ন থাকব। ক’য়েক মাস পর ভেঙে যাওয়া স্থানে নতুন শাখা-প্রশাখা গজাল এবং অন্যান্য গাছে নতুন শাখা-প্রশাখা গজিয়ে ফুল আসছে। কিন্তু মালিক বাগানে এসে এই গাছটির দিকে লক্ষ্য করল কোনও দিকেই ফুল আসার সম্ভাবনা নেই। তখন মনে মনে গাছটির তলায় দাঁড়িয়ে কাঠুরিয়া ডেকে গাছটি কেটে ফেলার পরিকল্পনা নিল। গাছটি মালিকের মনের কথা জানতে পারল, তারপর গাছটি ঈশ্বরকে বলল, হে ঈশ্বর আমি তোমার ধ্যানে মগ্ন থেকেও মালিকের কাছ থেকে এত বেদনা কেন পাচ্ছি? এদিকে মালিকে মালিকের কাঠুরিয়া খুঁজতে বিস্তর সময় লেগে গেল। আবারও তিনি বাগানে এলেন। এবং সমস্ত গাছের দিকে তাকালেন কিন্তু ওই গাছটির দিকেই তাকালেন না। এদিকে করাত-কুড়ুল নিয়ে যথারীতি গাছটি কাটবার জন্য কাঠুরিয়া এসে উপস্থিত। বাগানের মালিক কাঠুরিয়াকে বাগানে নিয়ে এসে গাছটিকে দূর থেকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। বললেন, এই গাছটি কাটতে হবে। কাঠুরিয়া গাছটির কাছে গেলেন এবং গাছটির দিকে চেয়ে দেখলেন, এত সুন্দর গাছ আর উনি বলছেন কেটে ফেলতে! কারণ কী! তখন বাগানের মালিককে দূর থেকে চেয়ে বললেন, এই গাছটিই তো? মালিক অন্যান্য তাকিয়ে দেখে ঘাড় নেড়ে বললেন, হ্যাঁ। এদিকে গাছটি আতঙ্কিত হল। কোথা থেকে একটি কাটা ঘুড়ি উড়তে উড়তে গাছটির ভেঙে যাওয়া অংশে গজানো নতুন শাখা-প্রশাখার ওপরে আটকে গেল। ক’য়েকটি বালক ঘুড়িটির দিকেই তাকিয়ে থাকল। এদিকে মালিক বাগানে বালকদের দেখে গাছটির কাছে এল। গাছটি কাটবে বলে যন্ত্রপাতি বের করছে কাঠুরিয়ারা। গাছটির তলায় মালিল এসে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে তোমাদের? বালকরা আঙুল দেখিয়ে বলল ঝড়ে ভেঙে যাওয়া নতুন শাখা-প্রশাখা গজানো অংশের দিকে ঘুড়িটি আটকে আছে। এদিকে করাৎ বের করেছেন কাঠুরিয়া। এদিকে মালিক সাইডে গিয়ে ঘুড়িটির দিকে তাকাতেই থমকে উঠলেন। এবং কাঠুরিয়াকে থামতে বললেন। মালিক ভেঙে যাওয়া অংশে গজানো নতুন শাখা-প্রশাখার দিকে চেয়ে আনন্দিত হলেন। এবং দেখতে পেলেন সেই অংশে অনেক ফুল এসেছে। তিনটি গাছ মিলে যা ফুল এসেছে ঠিক ততধিক ফুল ওই গাছটির এক অংশেই এসেছে। ওই ফুল দেখতে দেখতে মালিক আনন্দ অশ্রু ঝরিয়ে ফেললেন। কাঠুরিয়াকে ডেকে বললেন, দেখ এই অংশটুকুতে এত ফুল এসেছে আমি লক্ষ্য করিনি। তখন কাঠুরিয়া বাগানের মালিককে বললেন, আমি তো এসেই গাছটির চতুর্দিক ঘুরে এই অংশটাও দেখেছি। এখানে এত ফুল কিন্তু কেন কাটবে? এর উত্তর আমি পাচ্ছিলাম না। তা-ই গাছটির প্রতি আমারও মায়া বসে গেছিল। তাই মায়া বসে যাওয়ায়, গাছটি কাটতে আমার বিলম্ব হচ্ছিল। তখন বাগানের মালিক জিজ্ঞেস করলেন, যে এই অংশটুকুতেই কেন ফুল এল আর বাকী অংশটুকুতে কেন ফুল এল না? তখন কাঠুরিয়া বললেন, আপনি কখনও ভেবে দেখেছেন যে কোনও শিশু জন্মানোর পরে মাথায় গোছা গোছা চুল রেখে দিতে। বা আপনাদের মাথায় বছর বছর ধরে চুল রেখে দিতে? বা কোনও মায়েদের এভাবে চুল রেখে দিতে? তাঁরা তাঁদের চুলের বৃদ্ধি ঘটবে বলে চুলের ডগাটিও ছেঁটেছেন। আপনিও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে মাথায় ঠাণ্ডা হাওয়া খেলবে বলেও চুল খেটেছেন। আবার ওই শিশুটির সুন্দর চুল গজাবে বলে তাঁর মাথাটি চেঁছে পরিষ্কার করা হয়েছে। তাহলে ভাবুন তো, এই গাছটি জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত শুধু সোজা হয়ে উঠবে বলে গাছটির গোড়ার ডাল কটায় কেটেছেন। কিন্তু তাঁর মাথার ডাল-পালাগুলি কী পরিষ্কার করেছেন? দেখুন, যে অংশটি ঝড়ে ভেঙে গেছিল ঠিক সেই অংশে নতুন শাখা-প্রশাখা গজিয়ে ফুলে পূর্ণতা লাভ করেছে। গাছটি কাঠুরিয়ার এই সমস্ত কথা শুনে আনন্দিত হল। এবং কাঠুরিয়া সহ বালকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করল। কাঠুরিয়ার কথায় সমস্তটা বোঝার পরে মালিক গাছটির গড়ায় গিয়ে মনে মনে বলল, আমাদে ক্ষমা করে দিস। গাছটি তৎক্ষনাৎ খুশিতে নড়ে উঠল। তখনই বালকদের ঘুড়িটি নিচে পড়ে গেল। বালকরা ঘুড়িটি পেয়ে মহা আনন্দে চলে গেল। আর ঈশ্বরকে বলতে লাগল, হে ঈশ্বর আপনি আমার ডাক শুনে পরম উপকার করলেন। আপনাকে আমার কোটি কোটি নমস্কার।
কাঠুরিয়ার কথায় গাছের ফল পাবার সমাধান পেলেন ওই বাগানের মালিক। ফল আসার পর যথারীতি শাখা-প্রশাখা কেটে পরিষ্কার করা হল। এবং পরবর্তী বছরে গাছটি ওই বাগানে যত গাছ ছিল তার থেকেও বেশি ফুল-ফল প্রদান করল তাঁর মালিককে।
সমস্যার সৃষ্টি হয় সমাধানের জন্য।
জীবনের চলার পথে এমন নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় প্রত্যেককেই। কিন্তু মনকে স্থির রেখে বুদ্ধির সমাধান করতে হয়। প্রাণ দেওয়া বা নেওয়া কখনও-ই আমাদের হাতে থাকে না। এটি ঈশ্বরের চক্র। কার কখন মৃত্যু বা জন্ম হবে আমরা কেউ-ই জানি না। নচেৎ আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবনে চলার পথে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, কারণ তার সমাধান আছে বলেই। 🍁
🍁গদ্য
তৈমুর খান
মর্মসঞ্চারী বিষাদের কবি কবিরুল
এক
দিন যায়রে বিষাদে
তুমি কী নির্মল, দিন যায় রে বিষাদে
কেন, একী কোনও শোকোৎসব,নাকি উৎসবের শ্লোক
যেন আদিবাসিনীর স্তন শিল্পীর উল্কিতে
আরও সুসম্পন্ন ঋদ্ধ হয়েছিল
এবং যা যোনির কারুণ্য ফুঁড়ে বসন্ত-উৎসব…. যখন বয়স ছিলো ডানাওয়ালা অক্ষরের মতো হাতের আঙুলে ছিলো জাদুদণ্ড
দীপ্র বাহুমূলে ছিলো উদ্গত রেশম
তবু দিন যায় রে বিষাদে
যে-বিষাদ কবির শিরোপা
আর সুন্দরের প্রসূতি সদন।।
কবিরুল ইসলাম ২০০২ সালে ‘অনন্ত কুয়াশা’ কাব্যে এই কবিতাটি লিখেছেন। কবিজীবনের সমূহ বৈশিষ্ট্যে এটি একটি প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা। সমূহ সৃষ্টির মূলেই কি থাকে বিষাদ? সমূহ শোকই কি শ্লোকের জন্ম দেয়? রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক বোধে তো বারবার এসব প্রশ্নেরও উদয় হয়েছিল আর সেই কারণেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো
সেই তো তোমার আলো।’
টি.এস. এলিয়টও যেন একই কথা বলেছিলেন: ‘So, the darkness shall be the light. and the stillness the dancing.”
এই আলোকের সাধনা কবিরুল ইসলামেরও ছিল, কিন্তু সমস্ত সুন্দরেরই ‘প্রসূতিসদন’ যে শোক আর বিষাদ, বিরহ আর বেদনার তাপে দগ্ধ তা কবি জানতেন। তাই আদি কবি বাল্মীকির ক্রৌঞ্চমিথুনের সময় তিরবিদ্ধ হওয়া ক্রৌঞ্চের যন্ত্রণায় ব্যাকুল হয়ে কবির শ্লোক রচনার মুহূর্তটি যেন কবিরুল তাঁর প্রতিটি কবিতা রচনার ভূমিকা হিসেবেই উপলব্ধি করেন। আদি কবি যখন স্বয়ংক্রিয় ভাবে প্রকাশ করলেন:
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তুমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
তখন দেখতে পাই আমাদেরও ‘কামমোহিতম’ জীবনেও অনবরত ব্যাধ তিরবিদ্ধ করে চলেছেন। এই যন্ত্রণার বোধি শ্লোক বা কবিতা রচনায় প্রবৃত্তি দান করছে প্রতিটি প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিকে। কবিরুল সেই উৎস থেকেই কবিতার সংকেত পান। তাই একদিকে নির্মল, অন্যদিকে বিষাদ অনন্ত কুয়াশার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। ‘শোকোৎসব’ থেকে ‘উৎসবের শ্লোক’ লিখতে ‘নাকি’ সংশয় সূচক অব্যয়টি ব্যবহার করে এই কুয়াশার অনন্তকে জটিলতায় ভরিয়ে দিয়েছেন। দুঃখকে যেমন সুখের পাশে রেখে, দিনকে যেমন রাতের পাশে রেখে, শোককে যেমন আনন্দের পাশে রেখে এবং অন্ধকারকে যেমন আলোর পাশে রেখে আমরা উপলব্ধি করতে চাই, কবিও তা-ই করেছেন। আর সেই কারণেই বহুল প্রচলিত কীটসের কথাটিও ভাবনায় উদয় হয়েছে : Our sweetest songs are those that tell of saddest thoughts.— ‘তুমি কী নির্মল, দিন যায়রে বিষাদে’।
_____________________________________________
আমরা যেমন আমাদের গৃহবাসে তাঁকে পাই, তেমনি আমাদের ঘরের নারীটির রূপেও তাঁর অরূপ সঞ্চারী রমণীর রূপ দেখি। দেহ কখনও কখনও দেহহীনতায় পৌঁছে দেয়। জীবন জন্মান্তরে ঘুরপাক খেতে থাকে। এক মেধাবী আলোকের রশ্মি ক্ষীণ হলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
_____________________________________________
শোকোৎসবই উৎসবের শ্লোক।
বাল্মীকি এই কাব্য-কুসুমই প্রস্ফুটিত করেছেন। শোকে জন্ম হলেও তা উৎসবে পর্যবসিত। কবিতা যদি উত্তরণ হয়, সহিতের তত্ত্ব হয়, আনন্দের আধার হয় তা হলে তো ‘উৎসবেরই শ্লোক’ বলা যুক্তিযুক্ত। আর এখানেই শিল্পের গরিমা, বোধের ‘শাশ্বতীঃ সমাঃ’। যে কবিরুল জানেন: ‘সুন্দরের চোখে জল, সে জলও সুন্দর’ সে-কবি এও জানেন: ‘মিশ্রণ ভিন্ন কোনও শিল্প শিখর জানে না।’ সুতরাং শোক বা বিষাদ, আনন্দ বা জীবনের মিশ্রণ শিল্পে একান্ত কাম্য। এই শিল্প যে আলোক সাধনার প্রত্যাবর্তনে বারবার মানবজন্মে ফিরে আসে এই বোধি তো কবি শৈশবেই পেয়েছিলেন। ‘কুশল সংলাপ’ কাব্যের একটি কবিতায় তাই লিখেছেন :
‘প্রত্যেকেই নিজ নিজ সূর্য-সন্নিধানে যেতে চায় কেউ কেউ যেতে পারে। অন্য সকলেই আবর্তনে
অন্ধকার হয়ে আছে। কবে কত আলোকবর্ষ পরে
প্রত্যেকে পৃথিবী হয়ে সূর্য সন্নিধানে চলে যাবে।’
এই সূর্য সন্নিধানের শেষ নেই। সাধনার তারতম্য আছে, শিল্পের ভিন্নতা আছে, কিন্তু প্রত্যেকেই এক একটি পৃথিবী। প্রত্যেকেই ঘুরছে, কখন সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হবে সেই আকাঙ্ক্ষা নিয়েই তাদের পথ চলা। এই আলোক প্রাপ্তিতেই আসবে পূর্ণতা। শিল্পও Perfection এ পৌঁছাবে। কবি বলেন:
‘প্রত্যেকটি মানুষ কবে এক একটি গাছে
স্বধর্মে সুস্থির হবে সূর্যের সমীপে।’
‘বিদায় কোন্নগর’ কাব্যেও এই প্রতীতি কবিকে সমারূঢ় এক সমান্তরালে পৌঁছে দিয়েছে।
দুই
‘দিন যায়রে বিষাদে’— ‘রে’ প্লুতস্বরের মধ্যে যে দীর্ঘতা ছুঁয়ে আছে তা এক-একজন সহজিয়া মরমি বাউলেরই কন্ঠস্বর মনে হবে। কবিরুল বীরভূমের সুফি বা বাউল-সম্প্রদায়ের মনন রসায়নে সম্পৃক্ত একজন কবি। তাঁর প্রতিটি কবিতার দার্শনিক ভাবনার উত্তরণে একজন বাউল সাধককেই খুঁজে পাই। রাঙামাটির পথ অতিক্রম করে কোনও শাশ্বত অবেলায় যে বাউল বাড়ি ফিরছেন, একতারায় সুর তুলছেন তাঁর কণ্ঠে মিশে যায় কবিকলের কণ্ঠ:
‘কথা ছিলো দেখা হবে। কথা আছে
একদিন দেখা হবে। একটি প্রদীপ
আজও জ্বলে যায় সন্তর্পণে
আড়ালে আড়ালে।’
‘দেখা হবে’ এই অন্বেষণ কখনও ফুরিয়ে যায় না। মনের মানুষ তো মনেই থাকে, তবু তাকে খুঁজতে হয় আর নিভৃতে নিজেকে দগ্ধ করতে হয়—এই সাধনার-ই আত্মপর্যটন সর্বদা ব্যাপৃত হয়ে আছে কবিরুলের কবিতায়। মায়াময় নশ্বর জগতের কাছে কবির কিছুই পাওয়ারও নেই। নিজের বলতে যেমন নিজেই কবি, যাবতীয় সম্পর্ক সবই অহেতুক বন্ধন মাত্র, তা-ও বুঝে নিতে সক্ষম হয়েছেন:
‘আমার নিজের বলে কিছু নেই
কখনও ছিল কি?
যেমন নিজের বাড়ি,শৌখিন আসবাবপত্র
বইয়ের আলমারি
প্রিয়জন বন্ধু কিংবা নারী—
আমার নিজের বলে কিছু নেই’
কিছু না-থাকার শূন্যবোধে পৌঁছানো একজ দার্শনিকের পক্ষেই সম্ভব। এই বোধ যখন চূড়ান্ত রূপে আমাদের কাছে ধরা দেয় তখন-ই ‘দিন যায়রে বিষাদে আর ‘বিষাদ কবির-ই শিরোপা।’
এই বিষাদ নিজেকে খুঁজে পাওয়ার বিষাদ, এই বিষাদ আত্ম-অভিসারে জীবন অতিক্রম করার বিষাদ, এই বিষাদ সৃষ্টি-তত্ত্বের রহস্য উম্মোচনে পৌঁছানোর বিষাদ, এই বিষাদ নশ্বর থেকে অবিনশ্বরতায় উত্তরণের বিষাদ। এই বিষাদ থেকেই সুফি সাধকরা সর্বদা পথ অন্বেষণ করেছেন। তাঁদের ঘরের ভেতরে ঘর বা মনের ভেতরে মন এবং দেহাতীত দেহের সাধনায় কবিরুলও অভিসিক্ত হয়েছেন। সুফি সাধক ফরিদউদ্দিন আক্তারের মতো তিনিও ঈশ্বরের আয়নায় নিজেকে দেখেছেন, নিজের আয়নায় দেখেছেন ঈশ্বরের মুখ।ভালোবাসাকে ঈশ্বর করে নিয়েছেন, আবার ঈশ্বরকে করেছেন ভালোবাসা। মান-অভিমান, বিচ্ছেদ-বিরহের কখনও ছেদ পড়েনি। সমূহ সাধনাতেই মিশে গেছে এক অপার্থিব বেদনা ও না-পাওয়ার শূন্যতা। পেয়েও সেই না-পাওয়া যেন আরও গভীর হয়ে বেজেছে কবির অন্তরে। ‘বিবাহ বার্ষিকী’ কাব্যগ্রন্থে এই পাওয়া ও না-পাওয়ার শূন্যতা এবং ভালোবাসা ও ঈশ্বরীর স্বরূপ তিনি বারবার বুঝিয়ে দিয়েছেন:
১. ‘তুমি রোদ্দুরের দিকে ঈশ্বরীর মতো
আমি সমস্ত দুপুরময় হেঁটে যাবো।।’
২. ‘তোমারই মুখ দেখেছি নানা ছলে
তোমারে জেনে নিজের জানি তাই।’
‘তুমি-আমি’র সমস্ত তফাত ঘুচিয়ে দিয়ে যে মিশ্রণ তিনি গড়েছেন তা যে Prophetic Vision যা মিস্টিক চেতনার কবিতাতেই সম্ভব এবং তা Sufiism-এরই মূল কথা একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘তুমিই অসুখ, তুমিই বিশল্যকরণী’ যখন উচ্চারণ করেন, তখন তাঁর প্রেমের দ্বৈত মাধুরী আর সাধারণ মানুষের মতো থাকে না; চিরন্তন সাধকের মতো দীপ্তি পায়, অপার্থিব নেশার ঘোরে তা জেগে ওঠে। ‘দিগন্ত জুড়ে তখন একটিই সকাল’ লক্ষ করি। এই ‘সকাল’ সাধকের সাধনার সময়কাল, এই সকাল চকাস হওয়া আলোক সাম্যের বিস্তৃত দিগন্ত, অথবা এই সকাল আত্মিক জীবনের অন্বয় সাধনের পরমাপ্রকৃতি। কবি বলেন:
‘তোমার জানালা খুলে প্রত্যহ ডেকেছি: ভালোবাসা, হে আমার দর্পিত দুপুর,
হে আমার রক্তের গোলাপ!
দিন আসে। দিন যায়। রাত্রির আকাশ
ভরে ওঠে নক্ষত্রের কথোপকথনে—
সারারাত্রি কুশল সংলাপ।’
এই সংলাপ নিজের সঙ্গে নিজের, অন্তের সঙ্গে অনন্তের, পার্থিবের সঙ্গে অপার্থিবের, ঈশ্বরের সঙ্গে কবিরও। এই সংলাপের কখনও শেষ হবে না। স্বপ্ন যেমন মৃত্যুহীন তেমনি সংলাপ ও মৃত্যুহীন। কাঙাল সাধক যেমন সারাজীবন সাধনায় সিদ্ধি পেতে চান আর নিভৃতে তাঁর আত্মোৎসর্গ রচনা করেন, কবিরুলও সেই কাজটিই করেছেন। তাঁর কবিতাও সাধকেরই নিভৃত মন্ত্রোচ্চারণ।
তিন.
যৌবন যে শিল্পেরই প্রতীক কবিরুল একথাও জানতেন; জানতেন বলেই যৌবন জল উচ্ছলতায় সর্বদা তিনি তরঙ্গ তুলতে চেয়েছেন। তাঁরও বাঁশি বাজেনি, বাঁশি কেঁদেছে ঠিকই, কিন্তু সে-কান্নাও বাজনা হয়ে গেছে। বিষাদের ভঙ্গুর তিক্ত নিঃশ্বাস কখনও-ই কবিকে সৃষ্টিহীনতায় পর্যবসিত করেনি। অপার্থিব শোকের ভূষণে নিয়ত এক উদ্ভিন্ন শিল্প কবি নির্মাণ করতে পেরেছেন। যা উদ্ভিন্ন যৌবনের মতো অমোঘ ও ঐশ্বর্যময়। পার্থিবের ধূলোমলিন স্বরূপেও তা সর্বদা পবিত্র ও চিরন্তন মহিমা পেয়েছে। একদিকে নারী রূপের দেহসর্বস্ব বিন্যাস, যৌবনের প্রতীকতায় বিমুগ্ধ প্রেমিকের কামার্ত আবেদন; অন্যদিকে অপার্থিব আলোকে সাধকের পরম অধ্যাত্মলোকে পৌঁছানোর সোপান যা মূর্ত থেকে বিমূর্তের ধারণায় সম্পৃক্ত। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ‘উদাসীন সঙ্গমের’ প্রার্থনায় ক্রিয়াসঞ্জাত বিনয় এবং সৃষ্টির আদিলীলায় প্রবিষ্ট হওয়ার প্রস্তুতি পর্ব—দেহ থেকে দেহহীনতায়, ইন্দ্রিয় থেকে ইন্দ্রিয়াতীত হবার সাধনায় ব্রহ্মজীবনের অন্বয়ে নিবিষ্ট হওয়ার প্রাকমুহূর্ত। কবিরুল সেই প্রজ্ঞা থেকেই নারী অঙ্গের উল্লেখ করে সেগুলিকে শিল্প সমুন্নতি দান করেছেন।
নারী অঙ্গ=শিল্প সমুন্নতি
১. আদিবাসিনীর স্তন=শিল্পীর উল্কিতে সুসম্পন্ন,ঋদ্ধ
২. যোনির কারুণ্য=ফুঁড়ে ওঠা বসন্ত উৎসব
এই নারী অঙ্গের পাশাপাশি পুরুষ অঙ্গ যা সাধন জীবনের প্রাচুর্যের সমন্বয়ে স্বয়ংঋদ্ধ এবং দীপ্তিময়, সেই পুরুষ অঙ্গেরও উল্লেখ করতে ভোলেন না কবি:
পুরুষ অঙ্গ= শিল্প সমুন্নতি
১. বয়স= ডানাওয়ালা অক্ষর
২. হাতের আঙুল=জাদুদণ্ড
৩. দীপ্র বাহুমূল=উদ্গত রেশমে ঢাকা
সাধক যেমন, তেমনি তার শিল্প। যৌবন যেমন, তেমনি তার প্রকাশ। আদিবাসিনীর স্তন, যোনির কারুণ্য সবই আর্ত করে, কাছে ডাকে, কিন্তু ভোগ বা স্থূলচেতনায় মাংসল মোহে নয়, সৃষ্টির আদিতম সারল্যে যা একমাত্র সাধকের বা প্রেমিকেরই নৈকট্য ভজনা বলা যায়। বয়স তো ডানাওয়ালা অক্ষর হবেই, তার ব্যগ্রতা, স্বয়ংক্রিয়তা, অস্থিরতা এবং প্রদীপ্ততা সর্বদা এই কাজে চালনা করে। কবি যে অন্বেষণে নিজেকে খুঁজেছেন সেই বাতুল প্রজ্ঞাতেই নিজের চিরযৌবনত্বকে বোঝাতে ‘দীপ্র বহুমূল’ ও ‘উদ্গত রেশম’ কথাগুলি ব্যবহার করেছেন। তাঁর সাধনার পথ যে প্রেমিকের পথ, যৌবনের পথ, ব্রহ্ম আত্মার কাছে পৌঁছানোর সাধনা তা সমস্ত কবিতাতেই তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু তবু কি পৌঁছাতে পেরেছেন? না, পারেননি। সাধনায় সিদ্ধি এলেও কবির অনন্ত স্বরূপ দেখা কখনও ফুরিয়ে যায় না। ব্যক্তি কবি তো খণ্ডিত, অংশ মাত্র। তিনি মিলিত হতে চান সমগ্রের সাথে। এই মিলিত হবার পথটিই বিভিন্নভাবে তিনি আন্বেষণ করেন। সমগ্র জীবন জুড়ে তাই তাঁর যুদ্ধ, তাই তাঁর সংশয়। বিষাদের কাছেই কবি চাবি খোঁজেন। সেই ঘরের চাবি—যে ঘরে কবি নিজেই বাস করেন, যে ঘর ‘সুন্দরের প্রসূতি সদন’।
এই সুন্দরের প্রসূতি সদন কাব্যকুসুম রচনার এবং জীবনকে শিল্প করে তুলবার আশ্চর্য সাধন ক্ষেত্র। শুধু দেখা আর দৃষ্ট বস্তুর বর্ণনা দেওয়া এবং ছন্দ ঠিক রাখাই একমাত্র কবির কাজ নয়। কবি জীবনকে দেখেন, জীবনের বাহিরকেও দেখেন। আকাশকেও দেখেন, আকাশের ওপারকেও দেখেন। এই দেখার শেষ নেই। দেখতে দেখতেই নিজের মধ্যে ঢুকে পড়েন। যখন তিনি লেখেন: ‘আমি নিত্য বাড়ির সন্ধানে আছি’। তখন সহজেই বোঝা যায় কোন্ অসীমলোকের কথা কবি বলছেন। পৃথিবীর মধ্যেই কবির বা সাধকের আর এক পৃথিবী বিরাজ করে—সেই পৃথিবীর জন্যই ব্যাকুল হন তিনি। নিজের ঘরে বাস করেও তাই নিজেকে দূর প্রবাসী মনে হতে পারে। কবি লিখেছেন:
‘মানুষ অজানা থাকে ঘরে পরে দুস্তর প্রবাসে’
এই দূরত্বের বিরহ নিয়ে, নিজেকে অচেনার বিষাদ নিয়েই চলে দিনপাত। যাবতীয় কাজকর্ম আর সম্পর্কের বাঁধনে নিজেকে বেঁধে রেখেও একক সত্তার বিনির্মাণে আবিষ্কার করে চলেন। কবিতা তাই বহুমুখী জীবনের বহুরৈখিক গতি পায়। সবকিছুর মধ্যেই থাকে ‘fare forward’ অথবা বৃহত্তর আনন্দলোকে পৌঁছানোর উদ্যম। কবিরুল জীবনের ঘ্রাণ নিয়েছেন খুব মাটির কাছ থেকে। কিন্তু সেই ঘ্রাণেই অসীমলোকের ইংগিত পেয়েছেন। ‘নারী’ তাঁর কবিতার বিষয় হলেও ভাবকে বিস্তৃত করার বা মুক্তি দেবার মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আজীবন সেই পথেই নিজেকে যোগ্য করে তুলতে চেয়েছেন। ‘কবিতার জন্ম’ কাব্যে ‘বাঁচা’ নামক কবিতায় তিনি লিখেছেন:
‘অন্তত জীবন-গঙ্গা যাপনের যোগ্য হোক যোগ্যতর হোক।’
নিজেকে যে দূষণ মুক্ত করে নাব্য করে তুলতে চেয়েছেন এবং স্রোতস্বিনীর মতো প্রবাহযুক্ত স্বচ্ছ তোয়া দর্পণের মতো দেখতে চেয়েছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর ‘বাঁচা’ নামকরণে ‘অনন্ত মানব’-কেই বোঝাতে চেয়েছেন। তাঁর আলোর সাধনায় জগৎ-জীবনের মর্মরিত সংলাপ ভাষাময় হয়ে উঠেছে।
মানব জীবনের বৈরাগ্য, ভালোবাসা, তাপ-অনুতাপ, নির্ভরতা, গৃহযাপনের মধ্যেও কবিরুল এক সহজিয়ার প্রসন্ন নিবেদনে নিজেকে সর্বদা ঊর্ধ্বমুখী সাধনায় চালিত করতে পেরেছেন। তাঁর কবিতায় তত্ত্ব মুখ্য হয়েও গৌণ, জীবনই সামনে এসে দাঁড়ায়। তাঁর ‘Wisdom of humility’ বৈষ্ণবের নম্রতার সঙ্গে সর্বধর্ম সমন্বয়ের পথে সুফিবাদে পৌঁছে গেছে। এখানেই তাঁর প্রতিভার সার্থকতা। আমরা যেমন আমাদের গৃহবাসে তাঁকে পাই, তেমনি আমাদের ঘরের নারীটির রূপেও তাঁর অরূপ সঞ্চারী রমণীর রূপ দেখি। দেহ কখনও কখনও দেহহীনতায় পৌঁছে দেয়। জীবন জন্মান্তরে ঘুরপাক খেতে থাকে। এক মেধাবী আলোকের রশ্মি ক্ষীণ হলেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুভেচ্ছা, সুসময় এবং যাবতীয় সদর্থক আকাঙ্ক্ষায় যে পূজা তিনি করে গেছেন আমাদের কাছে তার আবেদন কখনও ফুরিয়ে যাবে না। ‘একদিন আমাদের শাপমুক্তি হবে।’ আমরা মানুষ হব, বৃহত্তর মানুষ। 🦋
🍁কবিতা
সঞ্জয় আচার্য
মেনে নেব না
আমি তোমাকে আসন দিতে পারি
আমাদের মহিমা খুড়ির হাতে বোনা,
কিন্তু গিলতে দেব না আমার মায়ের ভাষা।
দুপুর রোদ বিয়োগ করে দিতে পারি
চাপাকল থেকে ভরে আনা এক গ্লাস নরম জল
আর রতনপুরের সিতু ময়রার ফুলকো বাতাসা
কিন্তু ১লা বৈশাখ আমি কিছুতেই দেব না।
নেব না,
দুর্গাকে বাদ দিয়ে নবরাত্রি আমি নেব না
বরিগি পুকুরে স্নানে নামা
দোল পূর্ণিমার গোটা চাঁদ বিনিময় করে
একটা হোলির মতো রাহুকে আমি নেব না,
ইডলি ধোসা অধিকন্তু
কিন্তু পাটি সাপ্টার বিনিময়ে আমি কিছুতেই তা নেব না।
ধুলোমাখা বাউলের একগাছি সোনার তার তাও দিতে পারি,
ভুবন ভোলানো আমাদের রবীন্দ্রপংক্তি তোমাকে দিতে পারি
কিন্তু বিকৃত উচ্চারণ কিছুতেই নেব না,
নেব না, নেব না, আমি বলছি তো
কিছুতেই মেনে নেব না।
[কবি সুবোধ সরকারের একটি নিবন্ধ (04.04.2021) এ কবিতার প্রেরণা। ]
গোলাম কবির
বাংলা ১৪৩০ এর শেষ কবিতা
আমার উন্নিদ্র চোখ আকাশে মেলে দেখি,
আকাশটাও আমারই মতো
প্রায় একাই বলা যায়!
ম্নান জ্যোৎস্নার আলো ক্ষয়ে ক্ষয়ে
পড়ছে নদীর জলের ওপর,
বাঁশঝাড়ের ফাঁক গলিয়ে
ওকে তেমনই ম্লান মুখে
রাস্তার মোড়ে বসে থাকা
বৃদ্ধা ভিক্ষুকের মতো মনে হচ্ছে!
একটুও আলো নেই আশার,
বেঁচে থাকার সাধ যেন কবেই
ফুরিয়ে গেছে পৃথিবীর সবচেয়ে
প্রবীণ মানুষটার মতো!
চারিদিকে শুধু তথাকথিত মানুষ
নামের পশুদের দাপটে
প্রকৃত মানুষেরা অস্তিত্ব সংকটে
পড়ে দিশেহারা!
এভাবেই দিন যায়, মাস যায়,
ফুরিয়ে যায় বছর!
আবারও নতুন বছর আসে!
মানুষ তবুও আশায় বুক বাঁধে
জীবনের জয়গান গেয়ে
বেঁচে থাকার সাধে ছোট্ট পোনামাছের মতো কিলবিল করে শহর, নগর,
বন্দর কিংবা গ্রাম থেকে গ্রামে।
স্বপন পাল
নখ ও ছেলেটা
কে তোমাকে বাধা দেয়, ওই যে ছেলেটি
পিঠে ব্যাগ, আঙুলের নখ কাটছে দাঁতে
ওকে ভাল লেগে গেছে বুঝি,
কে বাধা দিয়েছে?
যাও তুমি ওর কাছে, বলো ভাল লাগে,
চমকে দিতে ওকে, ভাল লাগে বলে দাও।
দাঁত দিয়ে নখ কাটা ভাল নয়
পনেরো মিনিট পর বোলো।
জিজ্ঞাসা কোরো, কোনখানে ফের দেখা হবে,
কে তোমাকে বাধা দেয়?
খবরে শুনেছ যতো কথা, শোনোনি অনেক,
গভীর খবর কত গোপনেই রয়ে যায়,
গভীর খবর কত কোনদিন আলোই দেখে না।
আলো হতে পারো তুমি, কে দিয়েছে বাধা
হাত ধরো ছেলেটার, ভালবাসা পেলে ঠিক
দাঁতে নখ কাটবে না ও,
ভালবাসা পেলে দেখে নিয়ো
বাড়বে না অহেতুক ওর নখগুলো।
তূয়া নূর
দুঃস্বপ্ন
তোমার স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে
ভীষণ দুঃস্বপ্ন হয়ে যায়
অঙ্কগুলো মেলে না আর।
দেয়ালের ছত্রাক গুলো যেমন ঝরে পড়ে প্রতিকূল পরিবেশে
কপট ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে থাকা
তোমার মূর্তির মুখ থেকে খসে পড়ে আবরণ
খসে পড়ে হাত
খসে পড়ে পা, মুখ থুবড়ে পড়ে শরীর।
সব মানুষের জীবন ঘনিষ্ঠ কিছু স্বপ্ন থাকে
নিজ হাতে তুলে দেয় সে তার অবিনাশী যৌবন
সযত্নে বপন করে স্বপ্নের বীজ।
চার দিগন্তে বিদ্রোহী কৃষকেরা বর্ণময় আল্পনা আঁকে
ভ্যান গগের মত বর্ণালী রঙে
শুদ্ধ বর্ণমালায় উচ্চারিত হয় বিরূপ ভাষণ
বাড়ির নিকানো উঠোনে মুখরা রমণীরা কথার ঝড় তোলে।
তোমার স্বপ্ন এখন চার দেয়ালের মধ্যে বদ্ধ
এ দেয়াল ভাঙার মতো একটি বিশুদ্ধ যৌবন পাবে তুমি কই?
মানুষের সাহসী হাঁটার ভঙ্গিমার কাছে
নুয়ে পড়ে শোষণের বীভৎস শরীর।
অর্পিতা আচার্য
অন্যজন
একসঙ্গে আমরা পার হতে পারি শেষ পর্যন্ত
শেষ দিন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে
শেষদিন, একদিন, একসঙ্গে…
পিঁপড়ের লাইনের খিদে পেটে নিয়ে
খেতে পারি আত্মার নির্যাস
চিনির শিরার মতো সাদা কঙ্কালের গুঁড়ো
ভাসে অসময় এই বন্যার স্রোতে
কারো ফেলে যাওয়া পুরোনো টিকিট
রেল লাইনে, বলেছিল পার হবে একসঙ্গে
ট্রেন এসে কেটে দিল একটি শরীর
অন্যজন পকেটের সিগারেট নতুন ধরালো!
প্রদীপ সেন
আশ্চর্য!
নামের কী মাহাত্ম্য!
পর্ণমোচী! চিরহরিৎ! জাঙ্গল উদ্ভিদ! ম্যানগ্রোভ!
কষে ধরলাম উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞকে-
পাতা ঝরে কার কার? কার পাতা অঝরা থাকে?
জ্ঞানের ঝোলা থেকে কত ব্যাখ্যা, কত তত্ত্ব!
শেষমেশ শাশ্বত সিদ্ধান্ত-
সব গাছের পাতাই ঝরে বছরভর-
কারোর একটা দুটো করে
কারোর বা পাইকেরি হারে, হেমন্তে।
নাম দিয়ে কী হয়?
সব মাছই যে ময়লা ঘাঁটে, জানে তা সবাই
বদনাম রটে শুধু গেছো আর ল্যাটার!
🍁গল্প
হেলাল চৌধুরী
ঘূর্ণিঝড়ের পরে
অফিস থেকে ফিরে বাসায় ঢুকছি…কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলল আমার মেয়ে রোদশী। সে তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। রোদশী দরজা খোলায় কিছুটা অবাক হলাম। কারণ, এই সময়ে আমার মেয়ে পড়ার টেবিলে থাকে। সবসময়ই দরজা খোলে আমার বউ সিমি। দরজায় দাঁড়িয়েই রোদশী আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করল… সে কানে কানে কিছু বলতে চায়। আমি বাধ্য ছেলের মতো মাথা এগিয়ে দিলাম। সে কানে কানে ফিসফিস করে বলল, আব্বু, ঘরের পরিস্থিতি কিন্তু খুবই খারাপ। পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত আপনাকে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাবধান!
_____________________________________________
ওর চোখ ভিজে উঠেছে। সে খুব দ্রুত আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বিছানার উপর রাখা শুকানো কাপড়গুলো গুছাতে গুছাতে বলল, আমি ভেবেছিলাম আজ তোমার সাথে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করব। কিন্তু তুমি আমাকে কোনও সুযোগই দিলে না। খুব খারাপ মানুষ তুমি।
_____________________________________________
আমি ভীত গলায় ততোধিক ফিসফিস করে বললাম, বলিস কী! কী হয়েছে? আমি কী করেছি!
আমার মেয়ে বলল, আব্বু, সেটা তো আপনিই ভালো জানেন। তবে আম্মুর মেজাজ খুব খারাপ। আপনার উপর প্রচণদ ক্ষেপে আছে।
আমি চিন্তিত ভঙ্গীতে বললাম, তাহলে তো খুব চিন্তার কথা মা। কী করি বলতো!
সরি আব্বু, আপনার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া এই মুহূর্তে আমার আর কিছুই করার নেই। আই অ্যাম অ্যাফ্ররেইড এনাফ, আজ আপনার কপালে দুঃখ আছে। আমি কপাল কুঁচকে বললাম, এই… তুই কি আমাকে ইচ্ছে করে বেশি বেশি ভয় দেখাচ্ছিস? আমার মেয়ে দরজার হুক লাগাতে লাগাতে বলল, আপনার একজন ওয়েল উইশার হিসেবে আমি আপনাকে সতর্ক করছি মাত্র। আপনি রুমে যান। রুমে গেলেই বুঝবেন, ভয় কাকে বলে, উহা কত প্রকার!
আমি আমার মেয়ের মাথায় হালকা টোকা দিয়ে বললাম… দুষ্টু মেয়ে, সুযোগ পেয়ে বাপকে অকারণ ভয় দেখানো হচ্ছে! রোদশী একটা রহস্যময় হাসি দিল। এবার আমি সত্যিই কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। মনে করার চেষ্টা করলাম, আজ সারাদিনে আমি কী কী করেছি। হিসেব মিলাতে না পেরে আমার মেয়েকে ফিসফিস করে বললাম… আচ্ছা, বলনা মা, কী হয়েছে…! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মনে হয় ফেসবুক রিলেটেড কিছু হবে। আপনি রুমে যান আব্বু।
এবার আমার মনে হল, আজ সত্যিই কপালে দুঃখ আছে।
আমি আস্তে আস্তে আমার রুমের দিকে যেতে শুরু করলাম। আর মনে মনে ফেসবুকের অ্যাক্টিভিটি লগ এবং সিকিউরিটি সেটিংসটা রিকল করার চেষ্টা করছি। এমন সময় আমার মেয়ে আবার ফিসফিস করে পেছন থেকে ডাকল, “আব্বু”…
আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। সে ফিসফিস করে বলল, আব্বু, আপনি একদম ভয় পাবেন না। মনে সাহস রাখবেন। আমি পাশের রুমেই আছি এবং পরিস্থিতির উপর তীব্র নজর রাখছি। অবস্থা বেগতিক দেখলে আমার হেল্প চাইতে পারেন। আপনার বিপদের দিনে আপনার পাশে থাকতে পারলে আমার ভালো লাগবে।
চেহারায় বুদ্ধিজীবির মতো একটা এক্সপ্রেশন দিয়ে একটানা কথাগুলো বলে আমার মেয়ে হাসল। আমি চোখ কটমট করে ওর দিকে তাকালাম। আমার মেয়েটা আর এক দফা ফিক করে হেসে দিল। হাসতে হাসতেই বলল, আব্বু, দোয়া দুরুদ কিছু জানা আছে আপনার? থাকলে ওগুলো রিসাইট করতে পারেন। গুড লাক আব্বু। আমি পাশের রুমেই আছি।
মেয়েটা আমাকে নিয়ে মজা করছে!
বাপের সঙ্গে মজা করা হচ্ছে, ফাজিল মেয়ে! এটা বলে আমি কপট রাগ দেখিয়ে ওর দিকে তেড়ে গেলাম। আমার মেয়ে হাসতে হাসতে দৌড়ে ওর পড়ার রুমে ঢুকে গেল। আমি আমার রুমে ঢুকলাম। দেখি, আমার বউ সিমি বিছানার ঠিক মাঝখানে পা ছড়িয়ে বসে কপাল কুঁচকে মোবাইল টিপছে। আমাকে রুমে ঢুকতে দেখে সে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে একবার তাকাল। যেন দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ মানুষটাকে দেখল। চোখে মুখে রাজ্যের যত ক্ষোভ। তারপরেই অগ্নিঝরা কণ্ঠে বলল, শোন, আমি ঠিক করেছি, আমি আর তোমার সাথে থাকব না।
আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাইয়ের নট খুলতে খুলতে বললাম, সেটা ঠিক আছে, সমস্যা নাই। তোমাকে ছাড়া আমি আর আমার মেয়ের একটু কষ্ট হবে বটে, বাট ইটস ওকে, আমরা ম্যানেজ করে নেব।
মনে মনে বললাম, মাই জব ইজ ডান।
ও… তুমি চাও আমি না থাকি! আমি না থাকলে তো তোমার সুবিধা হয়। তুমি যা ইচ্ছে করতে পারো।
…বলতে বলতে সে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। হাতে মোবাইল। এবার আমাকে এক ঝটকায় ওর দিকে ফিরিয়ে মোবাইল দেখিয়ে বলল, এসব কী!
ততক্ষণে আমার গলা মোটামুটি শুকিয়ে গেছে। আমি ভীতভাবে মোবাইলটা হাতে নিলাম। বুঝলাম, সে এতক্ষণ যাবৎ আমার ফেসবুক ওয়ালের পোষ্টমর্টেম করেছে। ক্ষয়ক্ষতির তীব্রতা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।ফেসবুকে আমার একটা ছবি ছিল এরকম… শার্টের বোতাম খোলা। বুকের লোম দেখা যাচ্ছে। সেটাও সমস্যা ছিল না। কিন্তু আমার এক দুষ্টু বান্ধবী সেখানে কমেন্ট করেছে… “ইউ আর লুকিং হট! উ..ম…ম্মা”। কমেন্টটা দেখে খুব বিব্রতবোধ করলাম। কখন করল এই কমেন্ট! আমার চোখই বা এড়াল কীভাবে! আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সিমি বলল, আজ তুমি যে কোনও একটা বেছে নেবে। হয় আমি, নয় ফেসবুক।
আমি আসন্ন ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছিলাম। তাই, কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে আমার মোবাইল ফোন থেকে তাৎক্ষনিকভাবে আমার ফেসবুক ডি অ্যাক্টিভ করে দিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিছুটা হতবিহ্বল হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। সে কল্পনাও করতে পারেনি, প্রচণ্ড ফেসবুক অ্যাডিক্টেড একজন মানুষ এক সেকেণ্ডও চিন্তা না করে তার ফেসবুক ডিঅ্যাক্টিভ করে দেবে। অবাক কাণ্ড! এটা কীভাবে সম্ভব! এবার আমি মোলায়েম চোখে সিমির দিকে তাকালাম। বললাম, ফেসবুক অথবা তুমি, যে-কোনও একটা বেছে নিতে বলেছিলে। আমি তোমাকে বেছে নিলাম। ইটস এ ট্রিবিউট টু মাই ওয়াইফ।
দেখলাম, ওর চোখ ভিজে উঠেছে। সে খুব দ্রুত আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। বিছানার উপর রাখা শুকানো কাপড়গুলো গুছাতে গুছাতে বলল, আমি ভেবেছিলাম আজ তোমার সাথে কোমড় বেঁধে ঝগড়া করব। কিন্তু তুমি আমাকে কোনও সুযোগই দিলে না। খুব খারাপ মানুষ তুমি।
আমি হাসতে হাসতে উচ্চস্বরে আমার মেয়েকে ডেকে বললাম… মা, তুই নির্ভয়ে রুমে আয়। প্রচণ্ড বেগে ধেয়ে আসা প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়টি ক্রমশ দূর্বল হয়ে আমাদের বাসা অতিক্রম করেছে। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি, আমার বউ মুখ লুকিয়ে মুচকি হাসছে।🦋
🍁কবিতা
সৈয়দ নূরুল আলম
নদী কি রাস্তা
তুমি যেদিন চলে গেলে সুনসান রাস্তা বেয়ে, একটিবারও তাকাওনি, জানো না পেছনে কী ফেলে গেলে। তুমি কি নদী? নদীর স্রোত?
নদী দু’কুল ভাসিয়ে, সব সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে যায় বহুদূর। একবারও ফিরে তাকাবার কথা ভাবে না।
রাস্তা কি পারবে নদীকে ছুঁতে কিংবা নদী কী উজান ঢেলে ফিরে আসবে রাস্তাকে ভালো বেসে?
রাস্তা ও নদী, ক্রমাগত ছুটে চলাই যাদের পাণ্ডুলিপি। সেখানে আমি সূচিপত্রে কীভাবে থাকি?
নীলম সামন্ত
মিথ্যে মিথ্যে মাথুর
শ্রেষ্ঠত্বের বিচারে পেয়ারা ফুল নিজের মহিমায় লিখেছেন
অনভ্যস্ত মৌনতা।
মিথ্যে মিথ্যে মাথুর-
বুক ঝুঁকিয়ে চুঁয়ে দিচ্ছে লাল খন্ডচিত্র।
তাই কি?
মাথা বোঝাই জনপদে
এমব্রয়ডারি করা রুমালই যথেষ্ট।
আকাশ দেখো-
সময় হয়েছে,
ধ্রুবক পরিবেদনা পাশ কাটিয়ে বিচারালয়ে
টুকটুকে চেরী, চুম্বন ও বিভিন্ন ইত্যাদি।
ভোলা দেবনাথ
আমার বসবাস
আসিব যেথায়, সেথায় বাস প্রাণী
প্রাণীসব- মেরুদণ্ড এবং মেরুদণ্ডহীন
স্থল ও জলে সবার একত্রে যাপিত জীবন
প্রকৃতির সুযোগ-সুবিধায়
তুমি, আমি ও আমরা একই মাত্রায়
ভিন্নতায়
প্রবেশ করে কালান্তরে যাপিত জীবন।
বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র মানদণ্ড- বিবেক।
হয় যদি বিবেক আভা কিংবা বাতাস
স্পর্শে স্পন্দিত প্রাণ দোলায় হৃদয়
মেরুদণ্ড প্রাণী আমি, শ্রেষ্ঠ জীব-
মৃত যে জনে বিবেক এ ব্রহ্মাণ্ডময়
বিবেকহীন এ পৃথিবী মানদণ্ডহীন
অসহায়
মান-দণ্ডহীন শূন্যে শূন্যতায় ব্রহ্মাণ্ড।
মেরুদণ্ডহীনে হাঁটছি জগৎ জুড়ে।
শর্মিষ্ঠা ঘোষ
তোমার নয়, রেবন্ত
পাতাল খুঁড়ে খুঁড়ে দ্যাখা আছে জন্ম দাগ
অপরিবর্তনীয় অন্তর্ঘাত রক্তের বিতৃষ্ণা
হতাশ লিখে গেছি পুনর্জন্ম প্রার্থনা সঙ্গীত
সংশোধনী পাণ্ডুলিপি ছিঁড়েছে বিড়ম্বনা
দ্বিতীয়বার তাকাওনি ফিরে
লয়কারি কেটে অন্ধকার নেমেছে চোখে
চরম অভ্যাস জানে, নই অদ্বিতীয়া কোন
কাজেই এ লজ্জা তোমার নয়, রেবন্ত
কামনা সাধ্যাতীত ভূতগ্রস্ত টান দূরের প্রলোভন
ক্যাসানোভা বৃত্তে আমাকে মানায় না
ফ্যাদম না ভেবেই নির্দ্বিধায় জল চল
এ বেউকুফি তোমার নয়, রেবন্ত
ভঙ্গুর খুঁতো ফ্রেমে চড়িয়েছি মেকওভার
ভালগার অতিক্রমের নাটক দুর্লঙ্ঘ্য ক্যারিশ্মা
একচুল যাইনি কোথাও সিসিফাস প্রচেষ্টায়
এ পণ্ডশ্রম তোমার নয়, রেবন্ত
এমন অনেক স্বীকারোক্তিই রোজ রোজ
পরক্ষণে মুদ্রাদোষে লিথি নদী জলে স্নান
এভাবেই ছদ্মদূর থেকে ভাবি ক্রমাগত
এইসব মাথা-ব্যথা তোমার নয়, রেবন্ত
দেবারতি দে
হাসপাতাল থেকে বলছি
ভূমিকার চেয়ে উপসংহার বেশি পছন্দের
তাই জানতে চাই,
মহাসড়কের গতি দেখবে?
নাকি অদূর গ্রামের
জল ভরে হেঁটে যাওয়া বৌটির
ফর্সা পায়ে লেপ্টে থাকা
শাড়ির ভেজা লালপাড়…
ভাঁটফুল-এর মতো
এক স্থবির প্রাণ তুমি
আর কতকাল
তোমার অসহায়ত্ব উদগীরণ করবে?
অষ্টপদ মালিক
বে-লাইন
পথ চলতে শেখেনি ওরা
কেউ কেউ আবার ভুল পথে
চলে
পথে কত
বেপরোয়া গাড়ি চলে
বিপর্যয় নামে।
মৌন প্রতিবাদ
তারারা নিভে যায়।
মমতা রায় চৌধুরী
অস্তিত্ব
রুক্ষ বাস্তবের গ্রীষ্ম যখন সামনে দাঁড়ায়
মনে পড়ে জন্মভূমির স্নেহ মাখা স্পর্শ,
হিম শীতল জড়ানো ভালোবাসার আখর
আর বারবার নাম লিখি নিজের অস্তিত্বের।
রুজি রোজগারে ছেড়েছি ভালোবাসার ভিটে
শহুরে সভ্যতার শিকল বেঁধেছে আষ্টেপিষ্টে।
তবুও পোড়ামন যায় বুনো ঘাস গজানো জমিতে
সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাওয়া
রাখালের ধুলি ওড়ানো পথের মাঝে।
মনে পড়ে কৃষকের মিষ্টি হাসিখানি
ঘাম মুছে ফসলের পানে তাকিয়ে
দিন গোনে ফসল কাটার মরশুমের।
কৃষক বউ জল আনতে আনমনা ঘোমটা তুলে একবুক ঘ্রাণ নেয় রাঙা ফসলের
নবান্নে মাতবে সকল ক্লান্তি, দুঃখ- কষ্ট ভুলে।
মনে পড়ে, সেই দিনরাতগুলির কথা
চৈত্রের সুরে বাধা মধু মাসের মেঘ ও মায়া
কোকিলের কুহুতান পলাশ শিমুল রঙে রাঙা।
ভালোবাসা প্রেম জড়ানো অস্তিত্বের তারখানি আজ একটু ঝাপসা নাগরিকতায়।
তবুও চৈত্রের মধুমাসের মেঘ মায়া
অস্তিত্ব জুড়ে জন্মভূমির অকৃত্রিম ভালোবাসা।
হীরক বন্দ্যোপাধ্যায়
আশা নিরাশার মাঝে
আশা মুছে গেলে জীবনে আর করার কিছুই থাকে না
তাই মানুষ তখন যতদূর সম্ভব ছুঁয়ে থাকে
স্বপ্নের বেদনা… লড়াই সংগ্রাম সব বৃথা মনে হয়
রোজ রোজ নতজানু হতে হতে
যখন শুধুমাত্র পড়ে থাকে অবশিষ্ট হিসেবে
নিরাশার ছাই, আর ঠিক তখনি গলায় বসে থাকা
বকলস খোলার জন্য সে ছটফট করে
আর তারপর মধ্যরাতে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়, দেখে তার পরাজিত মুখাবয়ব… অন্তত একবার হলেও দেখা চায়…
নদীর নিকটে গিয়ে দেখি, পাহাড়ে জঙ্গলে
এই সত্য চিরকাল
বাকি সব নানান সম্পর্কের মাঝে মলিন কুয়াশা
মূল্যবান বাসমতি চাল…
শোভন মণ্ডল
এই সব যাপন
সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র শেষ হয়ে গেলে আমরা ফিরে আসব নিজস্ব কোটরে
গুনে নেবো থাকা না-থাকার হিসেব
প্রিয় আলো সরিয়ে নিয়ে
জড়ো করে আনব কঠিন বরফ
তার তলদেশে আশ্রয় নেবো
আর ঢুকে পড়বো পরিকল্পিত শীত-ঘুমে
যখন চোখ জুড়িয়ে আসে
এইভাবে আমাদের বেলা বাড়ে, মুখে রেখা জমে
জীবন যাপিত হয়
অনায়াসে…
শীর্ষেন্দু সেনগুপ্ত
স্বপ্ননীলে কুহেলিকা
নীল একদমই নীল নীলিমার দিকে চেয়ে চেয়ে প্রহর গোনা-
সকালের প্রতিভাসে আহ্লাদিত নীলকণ্ঠ পাখিটাও সেই নিলে গিয়ে মিশে যেতে চায়।
ক্লান্তি, শুধুই প্রতিটি দিবসের মাঝে-
ক্লান্তিহীনতার একটি দিন খোঁজা নীল দুটি চোখে
শূন্য নিস্তব্ধ, নির্বাক মুহূর্তে একটু চাওয়া অবকাশের।
একাকী মুহূর্তরা শান্তির আশ্রয় খুঁজে খুঁজে শ্রান্ত,
মেলে না সেই আশ্রয়ের প্রতিশ্রুতি টুকুও-
তবুও একটু একটু করে স্বপ্ননীলের কুহেলিকাতে হারানো।
🍁গদ্য
দর্পণা গঙ্গোপাধ্যায়
গ্রীষ্মের সেকাল একাল

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সারা দালানের মেজে জুড়ে পূজোর আয়োজন। এক পাশে পূর্ব দিক ঘেঁষে খড়ের বিঁড়ের ওপরে বসানো পাঁচখানা পরপর মাটির কলসি। মুখে মাটির সরা চাপা। কলসি গুলোর গলায় রজনীগন্ধার মালা পরানো, কলসির মাথায় একখানা করে লাল টুকটুকে গামছা, সঙ্গে একখানা করে তালপাতার পাখা। প্রত্যেক কলসির সামনে একখানা করে শালপাতার থালা, তাতে এক ফালি করে তরমুজ গোটা কতক শসা কুঁচো পেয়ারা কুঁচো আপেল কুঁচো গোটা কত আঙ্গুর। একপাশে শালপাতার বাটিতে বেশ কিছু বাতাসা, আর একটা বাটিতে গোটা কত নারকেল নাড়ু তার ওপর বসানো একখানা বড় জলভরা তালসাঁস সন্দেশ। তারপর কোশাকুশি আসন। তার দক্ষিণ দিক করে আরেকটা আসন। এসব দেখে বুঝলাম, আজ বাড়িতে নানা প্রকার খাবারের আমদানি হয়েছে। কিছু কিছু আমিও পাব এই পুজোকে বলে কলসি দান।
_____________________________________________
ভোরবেলা যখন ডি.ডি. মণ্ডল ঘাট রোড ধরে যাই মোড়ল ঘাটে, রাস্তায় কোনও লোক থাকে না গাড়ি ঘোড়া কিছু চলে না, আমরা মাঠ ভেবে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে কখনও বা ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যাই। জোয়ারের জল টলটল করে, ডুবে স্নান করার আলাদা মজা, দিদা বলে কত পাপ করেছি ঠাকুর সব পাপ ধুয়ে দাও।
_____________________________________________
যথাসময়ে পুরুত মশাই এসে জোরে জোরে মন্ত্র পাঠ শুরু করে দিল একে সব মন্ত্র শেষ করে দিদাকেও ডাকল ওই দক্ষিণ দিকের আসনে বসতে, দিদা দক্ষিণ দিকের আসনে, উত্তর দিকে মুখ করে বসে কলসিগুলো উৎসর্গ করতে শুরু করল। এক একটা কলসির জন্য বারবার একই মন্ত্র পাঠ করে যেতে লাগলো- এভাবে তারা দু’জনেই খুব ঘামতে লাগল, দারুণ রোদের তাপ, প্রদীপ নিভে যাবে বলে, জানলা আবার পাখা দুটোকেই বন্ধ করে রেখেছে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসব চলার পর আরতি শুরু হল, ঘুরে ঘুরে পঞ্চ প্রদীপের তাপ সবার মাথায় দেয়া হল। তারপর শান্তির জল নিয়ে- পুজোর সমাপ্তি।
পুজো শেষে পুরোহিত মশাই প্রণামী ও একখানা কলসির সবকিছু অর্থাৎ বিঁড়ে হাতপাখা গামছা শালপাতাতে থাকা নৈবেদ্য সবই ছাঁদা বেঁধে ফিরে যাবার সময় বললে, এই গঙ্গা জল আমার খুব কাজে আসবে, এত জল গঙ্গা থেকে কে বয়ে নিয়ে এলো? এর উত্তরে আমি বললাম, কেন? আমি আর দিদা তো রোজ গঙ্গায় ভোরবেলা স্নানে যাই, তখনই নিয়ে এসেছি, ভোরবেলা যখন ডি.ডি. মণ্ডল ঘাট রোড ধরে যাই মোড়ল ঘাটে, রাস্তায় কোনও লোক থাকে না গাড়ি ঘোড়া কিছু চলে না, আমরা মাঠ ভেবে জোরে জোরে হাঁটতে হাঁটতে কখনও বা ছুটতে ছুটতে পৌঁছে যাই। জোয়ারের জল টলটল করে, ডুবে স্নান করার আলাদা মজা, দিদা বলে কত পাপ করেছি ঠাকুর সব পাপ ধুয়ে দাও। এ কথা শুনে আমার মনে প্রশ্ন জাগত পাপ মানে কি? (মিথ্যাচার চুরি এগুলোই তো পাপ) দিদাকে তো এসব কিছুই করতে দেখিনি। জল ছেড়ে উঠে বৈশাখী কচি বেলপাতা আর কল্কে ফুল পেড়ে শিবের মাথায় জল দেওয়া শুরু- ওখানে দু’টো শিব, তারপর রাস্তার দু’ধারে বট অসত্থের গাছের গোড়ায় নুড়ি পাথরের শিব, প্রত্যেক গাছের গোড়ায় ফুল আর গঙ্গাজল ছুঁড়ে ছুঁড়ে বাড়ি পৌঁছে যেতাম। তখন মনটা বেশ ভালো লাগত! মনে হত পুণ্য অর্জন করেছি! বলাই বাহুল্য ডি. ডি. মণ্ডল ঘাট রোডে এখনও পর্যন্ত বেশ ক’য়েকটি বট ও অশত্থের গাছ রয়েছে। আজ বড় হয়ে বেশ বুঝতে পারি, গাছের গোড়ার নুড়ি শিবের মাথায় জল দিলে, সে জল গাছের গোড়াতেই পড়ত। ওই গাছগুলো খুবই প্রয়োজনীয়।
এরই মধ্যে বাকি কলসির মধ্যে দিদার মেজ দেবরের ছেলে ও ছোটে দেবর এসে গেল উঠোনেই দিদা ওদের কলস সমেত সকল জিনিস দিয়ে দিল ওরা পুরনো গামছার মাঝখানে বসিয়ে ওপরটা বেঁধে ঝুলিয়ে নিল। দিদা ওদের হাতে প্রণামী দিয়ে প্রণাম করলে ওরা চলে গেল। এরপর এলো দিদার বড় ভাই সেও একটু চা বিস্কুট খেলো, তারপর রিসকায় বসিয়ে নিয়ে বাড়ি চলে গেল। সবশেষে এলো ছোট ভাই সেও চা বিস্কুট খেয়ে ওগুলো একটা বড় ব্যাগে পুরে বাসে উঠে চলে গেল।
সকলের আসা যাওয়ার আর পুজোর মাঝে দিনটা কেটে গেল। তখন মানুষ মানুষকে সামান্য জিনিস দান করলেও তা গ্রহণে সবাই আগ্রহী হত এবং পেয়ে খুশি হত। আজ ৫০ বছর পর অনেক বদলেছে, তখনকার গরমের চেয়ে তিনগুণ গরম বেড়েছে। গাছপালা বন জঙ্গল একেবারেই নেই। চারিদিকে শুধু উঁচু উঁচু বাড়ি। গাছপালা বন জঙ্গল শান্ত পরিবেশ নেই, মানুষে মানুষে বেড়েছে ঈর্ষা-হিংসা আকাশ দেখতে না পাওয়ার কান্না মানুষকে মানবিক থেকে অমানবিক করেছে, কেউ কেউ মানসিক রোগীও হয়ে উঠেছে। তার ওপর উন্নত ইলেকট্রনিক্স গুডস মানুষের পরিবেশ নষ্ট করছে এসি একটা ঘর ঠাণ্ডা করতে বাইরের পরিবেশ দ্বিগুণ গরম করে তুলছে গাছ কেটে বাড়ি ঘর ঘেঁষাঘেঁষি হাওয়ায় প্রাইভেসি নষ্ট হচ্ছে।
সিসি ক্যামেরায় মানুষকে মানুষ বন্দী করে ফেলছে, ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের ব্যবহার আচার-আচরণ সব মেকি হয়ে উঠছে। এ থেকে মানসিক চাপ বেশি দেখা দিচ্ছে। মানবিকতা হারিয়ে ফেলছে। দ্রুত সকলের উচিত গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা। 🦋
🍁 অলঙ্করণ : প্রীতি দেব, দেবব্রত সরকার ও অন্তার্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
