Sasraya News

Sasraya News : সাশ্রয় নিউজ।। পুজো ২০২৩

Listen

সম্পাদকীয়… 

মাখো বৃষ্টির আড়ালে শরতের আনাগোনায় নদীজলতীরের কাশবন ছুঁয়ে আসা শারদের মাখোচোখ দৃষ্টিতে ছুঁয়ে আসা মানব-মনবীর এক আনন্দমেলা। যেখানে আত্মা, মন, অনর্গল বসন্তের ঝরা পাতার মতো খেলা করে। সেখানে আমাদের পরিচিত মহাকাশ চোখে দেখা চাঁদ-সূর্য-তারা এমনকী পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রাণ, বস্তু, তথা পঞ্চভূত ( জল, বায়ূ, অগ্নি, মাটি, আকাশ) সমস্ত উপাদনগুলি শান্তিপ্রিয় হোক।

সাশ্রয় নিউজ-এর পক্ষ থেকে সমস্ত লেখক লেখিকা সহ সাশ্রয় নিউজ-এর সাংবাদিকবৃন্দ এবং ডেস্ককর্মী ও টেকনিক্যাল কর্মীদের হৃদয়ের মণিকোঠার এক আকাশ ভালবাসার সবুজ শারদ শুভেচ্ছায় ভরিয়ে দিলাম।

 

 

 

শারদ কবিতা /এক 

গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়

ভালোবাসা সন্ধ্যাতারার মতো

কি রকম ভালোবাসা দিয়েছ তুমি যাকে কোনোদিন তলিয়ে ভাবিনি
আকাশের গায়ে সেই সন্ধ্যাতারা
এখনও একা ওঠে
এক মনে আলো দেয় ভাবে অন্যদের কথা
বর্ষার বেশি দেরী নেই তাই পিঁপড়েরা একজোট হয়ে
এক মনে সঞ্চয়ের দানা মুখে নিয়ে ফিরছে বাসায়

তোমাকে না জানিয়ে করিনি কিছুই
রেখেছি প্রতিশ্রুতি তার যতটুকু পেয়েছি তবু
দেখি অসময়ে পড়েছে কেন চোখের পলক
হয়ত আমাদের বিপদের কোনও অনুভব সংকেত
হতে পারে এ-সবই কেবল অলীক চিন্তা
যার পরিসীমা কখনও বুঝতে পারিনি
কেবলই ভেবেছি আমাদের ভালোবাসা যেন
চিরদিন সন্ধ্যাতারার মতো জ্বলে

 

তুষার ভট্টাচাৰ্য 

নদীর পাড়ে 

হেমন্তের পর্যটক এসে দেখে গেছে
সূর্যাস্তের ঘুরঘুট্টি অন্ধকারে
ব্যর্থ অসফল কবি
ঘুমিয়ে রয়েছে পাণ্ডুলিপি
বুকে নিয়ে নির্জন নদীর পাড়ে;
তার না কামানো দাড়ি, চুল
রোগাতে শরীর ঢেকে গেছে
মনস্তাপের অশ্রু অক্ষরে l

ভোরের স্বপ্ন 

ক্ষুধার চারণভূমিতে আমি ঝকঝকে
চাঁদের থালায় করে জুঁইফুলের মতন
সাদা ধবধবে গরমভাতের স্বপ্ন
দু’হাতের মুঠোয় উড়িয়ে এনে
ছড়িয়ে দিই হাড়হাভাতে
বুভুক্ষু মানুষের দুঃখী ম্লান চোখে মুখে  ;
তারপর সবাই নিরাশার ঝুলকালি
ঝেড়ে ফেলে জেগে ওঠে ভোরের স্বপ্ন
বুকে নিয়ে l

 

নদীর জলে 

হৃদয় শূন্য হলে মনের উঠোনে কখনও উড়ে আসে না
শিশিরের গন্ধ গায়ে মেখে ভোরের শালিক পাখি
জোছনার বৃষ্টিতে ভিজে বুনো ঝোঁপে জ্বলে না
সবুজ জোনাকি;
হৃদয় শূন্য হলে বিজন রাত্তিরে আধো ঘুমের
ভিতরে নীরবে ভেসে আসে পাতা ঝরার মর্মর গান
আবছা স্মৃতির আয়নায় ফুটে ওঠে দুঃখের খড়কুটো
আর না বলা সব গোপন অভিমান ;
হৃদয় শূন্য হলে আমি নদীর জলে ছুঁড়ে মারি
একমুঠো মাটি সাদা বালি
তারপর ভালবাসা বেদনার অশ্রুটুকু
দু’চোখে মেখে কেটে যায় ধূসর দিনগুলি রাতগুলি।

 

অভিমানী মুখ 

নিঝুম রাত্তিরে ঝরা শিশিরের কান্না জলের ভিতরে
যার অভিমানী ম্লান মুখ ভেসে ওঠে
তাকে আমি চিনি ;
সে ছিল অমল কৈশোরের
রূপকথা স্বপ্ন সহচরী ;
তাকে আমি আজও  নীরবে খুঁজি
মায়া মৃদঙ্গ জোছনায়
ওই দীঘল আকাশ দিগন্ত রেখায়।

 

তাহমিনা শিল্পী 

শিকড়ের জড়তা ভেঙে কথা বলে মায়াবৃক্ষ

ভোরের বৃষ্টির সুরে সুর মিলে যায়
বাতাসের ঢেউয়ের সাথে একাত্ম করে
কোনও এক নদী, নিয়ে যায় পূর্বপুরুষের ভিটায়।
দৃশ্যপটে পাখির কণ্ঠ শোনা যায়
ওরা ভালবাসার কষ্টের গান করে
কাছেই কোথাও মাদল বাজার শব্দ
প্রথম প্রেম হারিয়ে ফেলেছে যে তরুণী
যেন তার বুকের ধুকধুক স্পন্দন
হৃদয় কেঁপে কেঁপে ওঠে।
ছায়ারা জড়ো হয় দেবদারু বনে
দিঘির জলের গভীরে বোনা হয়েছে সঙ্গীত
ফিসফাস করে গাইছে, পালাও…..
পালাও এখনই
এখানে মাটির গায়ে দীর্ঘশ্বাস
ডালিম গাছে ঝুলে আছে অগ্নিশিখা
তোমাদের বিস্মৃতিকে অভিশাপ দেবে।
মস্তিষ্কের ভিতরে একটি মায়াবৃক্ষ
শিকড়ের জড়তা ভেঙে কথা বলে
ফিরে যেও না

 

আমিনা তাবাসসুম

ছুটছে একটা রাত

একটা রাত ছুটছে
তীব্র অন্ধকার বুকের ভেতর পুষে নিয়ে
ছুটে যাচ্ছে একটা রাত

এই গভীর অনুভবের সঙ্গে প্রেমিকের কোনও সম্পর্ক নেই
রাতের ভেতর অগুনতি রহস্য
রহস্যের ভেতর কবিতা

কবিতার পোশাক এখন শতছিদ্র
এমন সময়
অনন্ত ছোট বড় চিন্তার সূত্র ধরে
একটা পেঁচা ডেকে উঠল

একটা রাত ছুটে যাচ্ছে
তীব্র নির্জনতার গোপন কুঠুরি ছেড়ে
ফিরে যাচ্ছে নদী, নৌকো, মানুষ

ফুরিয়ে আসছে সময়
একটা রাত
হ্যাঁ, একটা রাত ঠিকই ছুটে যাচ্ছে

 

তাহমিনা কোরাইশী

গাংচিলের ওড়াউড়ি

গাঙ্গচিলের ওড়াউড়ি বন্ধ হয়ে যেত, যদি
জলের বুকে মাছেরা না করত ফালাফলি
একটি পা’ও কি ফেলেছে কেউ মাটিতে, বিনা তরিকায়!
কিন্তু সে’ই, দিয়ে চলেছে আগ পাছ না ভেবে
তবে কি ভাবেছি সে নির্বোধ হাবাগোবা!
নিঃস্বার্থ প্রেম তাকে প্রতিনিয়ত কলুর বলদ করে রাখে।
প্রেম একলাই পথ চেনে, কেউ কি তাকে রাস্তার
দাঁড়ি-কমা-সেমিকোলন শেখায়!
বিড়ালের মত চোখ বন্ধ করে
না বুঝে গিলে যাওয়া এ জীবন!

বুকের জমিন উদাম করে ভালোবাসার গল্প ক’জনা করে!
আজ কাল সাবই বুঝি যন্ত্র-মন্ত্র-তন্ত্রের পন্থায় হাঁটে
বুঝিনি তো আজও বিভৎস তরিকা হাটের এবং ঘাটের
আমার মত কাঙ্গাল ভালবেসে ফতুর হতে জানে!
প্রেমহীন জলের বুকে গাঙ্গচিলও ওড়ে না।

 

বিপ্লব চক্রবর্তী 

দহন কথা 

পুড়ে যাওয়ার একটা ব্যক্তিগত অনুভব আছে
ছাই হওয়া যন্ত্রণাটা ধূপ হয়ে মিশে যায় স্বজনে
নিজের হৄদয় ছাড়া অন্যরা দেখতে পায়না বলেই
আমাকে খুঁটে খায় কটা শকুন নির্বান্ধব নির্জনে।

জ্বালানি ছাড়া আগুন দেখিনা বলেই আমাদের
বাড়ি ও আসবাবপত্র ভয়ে কাঁদতে থাকে যন্ত্রণায়
দাহ্য তরলের মতো মসৃন সম্পর্কগুলো সেখানে
বণিকি ষড়যন্ত্র হয়ে কালোজাদুর ভয়ে কাতরায়

ভাবি কোনও একদিন জ্বলনটা শেষ হয়ে যাবে
সমস্ত মাথাটাকে বলি আজ ক্ষত নিরাময়ের দিন
সেদিনই আগুন ধূপের অভাবে নিভে নিভে যায়
অযথাই ভেবে চলি পরদিন থেকে নিশ্চিত সুদিন।

 

উত্তম চৌধুরী

ঝাড়ন

কিছু কিছু সময় থাকে- না ঘরকা, না ঘাটকা।
কোথায় দাঁড়াবে গিয়ে এই নিয়ে দ্বিধান্বিত মন।

কিছু কিছু দৃশ্য থাকে দোলাচলের- হওয়া বা না হওয়ার,
এবং তোমার হাতের মুঠোয় অস্থিরতা গুঁজে দিয়ে
নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে কেউ।

কিছু কিছু ভাষ্য থাকে শাঁখের করাত- যেতে কাটে, আসতেও কাটে
আর গুজবের তল্লাটে
ছড়িয়ে যায় দানাশস্য বিভ্রান্তির।

কিছু রাগ, কিছু ক্ষোভ আর কিছু গাঢ় অভিমান
বহুদূর ছুটিয়ে নিয়ে ঝেড়ে দিলাম
কোনও এক তীব্র নদীস্রোতে- তাহারা ভাসুক।

আমার চোখের ঊর্ধ্বে থাক জাগরুক
মাস মাস, বছর বছর খণ্ডহীন আহা নীলাকাশ।

 

একটি নদী

একটি নদী দুঃখে হাঁটে, বিষণ্ণ।
আমি কি তার সুখের জন্য
হাত বাড়াই!

আমি কি তার পথের সীমায় পানশালা!
ডেকে আনি হওয়ার পাখা মুহূর্তে!

কেউ থাকে তার নিজের মতে
একগুঁয়ে,
স্বেচ্ছাচারী চোখ রাখে সে অগ্নিতে।

ভুলক্রমে ফিরে তাকায় যদিও,
ছড়িয়ে দেয় ‘আর ডেকো না ‘মন থেকে।

একটি নদী সেতুবিহীন, খুব একা।

 

প্রতিদিন 

প্রতিদিন নদীকে ভেজাই।

প্রতিদিন আগুনের গায়ে
হৃদয়ের উষ্মবর্ণ মাখি।

প্রতিদিন আকাশ নাড়াই,
তারাফুল ঝরে পড়ে নীচে
শরতের শেফালির মতো।

প্রতিদিন বাড়ে ক্রমাগত
অনুরাগ, অনুযোগ আর
সময়ের সরাণে বিছাই
অনন্য কথন প্রতিভার।

 

কিশোর মজুমদার 

কবিতার কুচি

শান বাঁধানো ঘাটে নিথর রোদ, পাশে
ছায়ার নিস্তব্ধ শোক – অব্যক্ত শীত
কবিতার কুচি পড়ে আছে পাশে ;
কাঁকনের খুনসুটি- স্নানের দুপুর
ফেরিওয়ালার হাঁকের সঙ্গে চলে গেছে দূরে-

মনা ঘোষ এসে বসে। অন্ধ বিলাপ।
বিজ্ঞাপনের মতো ভেসে ওঠে গোটা দুই
কাতলা কি ঘেসো রুই
হাতব্যাগে শৈলেন মাঝির জমানো খিদে
পুরনো অতীত, ঝাপসাটা সাদা-কালো ফ্রেম ;
পৃথিবী গিয়েছে আরও অরবিট ঘুরে
আস্তিনে কলম গোঁজা, মাথায় রকেট
পড়ে থাকা কবিতার কুচি তোমার নিকুচি করেছে।
আড় চোখে দেখে নাও জাস্ট
সে কুচি তোমার কিনা!

 

চক্রব্যূহ 

নের গলাধাক্কা খেল মেঘ
মুঠোয় ভরেছি রোদ্দুর অতি খাসা

সাবলীল গতি চুরি করে নেয় বালি
শোকের নদীতে দুঃস্বপ্নের বাসা।

তোমাকে রেখেছি শত সমুদ্র দূরে
তুমি ফিরো না শ্যামলিমা হাতে নিয়ে
তন্দ্রা কাটলে আমিই আসব ফিরে
খালি হাত , তবু সামনে দাঁড়াব গিয়ে;

এখানে গুটানো পলায়নবাদী মনে
ঢেউ কি ওঠেনি? বোঝোনি তুমিও কিছু!
গুলির শব্দে তাল কোকিলের মিহি গানে
ছুটে গেছিলাম কিছুটা তোমারই পিছু।

কড়িকাঠে দেখো আষ্টেপৃষ্ঠে গলা
সেঁধে আছে, করবার কিছু নেই
তবু তুমি ওখানেই থাকো সারাবেলা
আমি রয়ে যাব মুখ ঢেকে এখানেই।

রোরুদ্যমান

পেন্ডুলামের মতো
তোমার আমার প্রেম
ঘৃণা-ভালবাসায় দোদুল্যমান

আজও পৃথিবীর ক্ষত
ঢেকেছে ভিডিও-গেম
ক্ষীণ আলো আশায় রোরুদ্যমান

 

ছাব্বির আহমেদ 

শিকেয় ব্যথার বাগান

শব্দ সুখেই ভাসিয়ে দিয়েছি যত কষ্ট
যত ছিল আশা, সবই
একটা একটা করে কালো রাত্রিযাপন করে চলেছি
আগুনে ঘী ঢালার মতো

তোমার তুখোড় দৃষ্টি
তুখোড় বুকের পাটা
আমাকে উৎফুল্ল করে তোলে
কিন্তু এখন সেই চোখের দিকে তাকালে
মনের গভীরে যাই না আর
বুকের মাঝে পর্দা টাঙানো
তবুও কোনও রঙিন আকাশ দেখতে পাই না

সবকিছুই গরম হয়ে আছে এখন
শুধু দেশলাই ঠোকার অপেক্ষা
ছাতি পোড়া গন্ধটা ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে যায়
তবে কিছু প্রগাঢ় ব্যথাকে শিকেই তুলে রেখে
তিলে তিলে আমি বড় হচ্ছি
তাই নতুন গোলাপ লাগানোর আশা ছেড়ে দিয়েছি

 

নাফিউল হক

উমা 

কাশফুল ফুটলেই পল্লীবালার চোখেমুখে-
আনন্দ ভেসে ওঠে।
উমা আসবে…
শিউলিতলায় গেলেই
উমার গন্ধ পায় পল্লীবালা।
আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে
এক নিঃশ্বাসে।
উমা আসছে…
পল্লীবালার উঠোনে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলে
তুলসী গাছটা মাথা নুইয়ে রাখে
উমা এলো…

 

অর্ণব কর্মকার 

সালোকসংশ্লেষ 

১.

এবার আমাদের খাবার 

তৈরি করব আমরাই…

এটা একটা স্লোগান হতে চলেছে

আমাদের সারা শরীর সবুজ
আমরা এবার উদ্ভিদ হতে চলেছি।

২.

খবরের কাগজে আজ ছাপা হল

শূন্যপদের সংখ্যা ৪০০,
অথচ কাজের দরকার ছিল
তার দশগুণ ছেলেমেয়ের…

এ’সব খবরে আর মাথাব্যথা নেই
আমদের মাথার ভেতর
ক্লোরোফিল চাষ করে ফেলছি।

৩. 

বারবার আবেদন করছি
চিঠি লিখছি, মেল করছি, ছুটে যাচ্ছি
অথচ ডাক্তার মিলছে না
বাড়ছেনা বেড সংখ্যাও…

তবুও আমাদের ভয় নেই
মাটির অনেক নিচে
আমাদের শিকড় চলে গেছে
ছড়িয়ে রয়েছে ডালপালা।
ফাঁকা মাঠ, উপরে আকাশ দেখে দেখে
আমরাই হয়ে উঠছি
এক-একটি অশ্বত্থ বট।

৪.

এবার হাইয়ার স্টাডিজ থেকে ছুটি নিলাম
যে বইয়ের দাম হয়ে ছিল মাত্র ১৫০০ টাকা
তা কিনছি না
সেই বই এতদিন যারা পড়েছিল
তারাও তো আজ দিশেহারা…

আমার উঠোন জুড়ে শাক বোনা আছে
কীভাবে বৃষ্টি এলে কচু পাতাটির নিচে
ছুটে গিয়ে আশ্র‍য় নেয় ছোট্ট পাখিটি,
সেসব বইয়ের কথা চারিদিকে লেখা আছে
তা এবার আমরা নিজেরাই শিখে নেব।

৫.

ঠিক কোন সময় আমরা পাতা ঝরিয়ে ফেলব
ঠিক কোন সময় ভরে উঠবে কিশলয়
তার নিয়ম আমরা ঠিক করে ফেলছি।

নরম মাটি পেলে তাকে আঁকড়ে ধরতে হয়
শক্ত হলে, তাকে ভেদ করে গিয়ে
অনেক দূর ছড়িয়ে যেতে হয়…

ফুল ফোটানোর পর
কাছে ডাকতে হবে পতঙ্গদের
তাদের পায়ে পায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে
হলুদ রঙের পরাগ
সেই সংক্রান্ত বিল পাস করিয়ে নিয়েছি।

এইভাবে আমাদের রাজনৈতিক আদর্শ
ঠিক করে ফেলা হলো

আমাদের সালোকসংশ্লেষ থেকে শুরু করে
ফল তৈরি করার
আমাদের প্রত্যেকের জানা…

আমাদের পৃথক কোনও দেশ নেই।

 

রজব বকশী 

এই বিষন্ন মনের ঢেউ  

এই বিষন্ন মনের বাঁকে ক্ষীণস্রোতা নদী
হাঁটুজল বয়ে চলে নীল কষ্ট ঢেউ
উজানী মাছের মত ছটফট নেই
কত নদীর জীবন ছিঁড়ে পড়ে আছে
তার স্মৃতি বুকে নিয়ে ধুধু বালিচর

প্রেম অথবা দ্রোহের মধ্যে উঁকি দেয়
অনুভূতির প্রফুল্ল রোদফুল
ডানা ঝাড়া বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে
গন্ধ আকুলতা

বুক পকেটে খুচরো ভাবনার এলোমেলো ঢেউ
চূর্ণ বিচূর্ণ একটি মুখ ভেসে ওঠে
যার কথা মেঘে মেঘে রংধনু আঁকে
হঠাৎ ঝলসে  ফিরে
বৃষ্টির ফোঁটায়
তার জলছবি
দীর্ঘশ্বাসের স্মারক গ্রন্থ

এই বিষন্ন মনের বাঁকাচোরা ঢেউ
একটা অদৃশ্য সেতুর উপর দিয়ে বয়ে যায়
সে যে এখন ধূলির ডানা মেলে ওড়ে
দিনরাত্রির ভেতর তার উপস্থিতি টের পাই

স্বগতোক্তি 

একটা নির্জন মাঠে দাঁড়িয়েছিলাম
নিজেকেই জানবার জন্য বারবার
চিৎকার করে উঠলাম

সেই চিৎকার শুনতে পেল না কেউ
অথচ যখন আমি নিজেকে খুলতে শুরু করলাম
বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে সেই আওয়াজ

একটা বিস্ময়কর অনুভূতি উঁকি দিয়ে যায়
আমি সমুদ্রের কাছে সমর্পিত হয়ে জেগে উঠি
পাহাড় আমার মধ্যে ঝর্ণাগান করে

আমি আমার প্রতিটি কথার সঙ্গে নিজেকে দেখতে পেলাম
চূর্ণবিচূর্ণ অসংখ্য টুকরো পাখনা মেলে উড়তে লাগল
যেভাবে আঁধার রাতে জোনাকিরা ঝিলমিল করে

সভ্যতার ইতিহাস আমাকে বিভিন্নভাবে রূপান্তর করে
ইঙ্গিতে সঙ্গীতে লেখা ও রেখায় নানামুখি জীবনের ঢেউ
ভাঙাগড়ার ভেতর দিয়ে গড়ে তোলে স্বপ্ননীড়

আমার আমিকে কতভাবে খুঁজে বেড়াই সতত
নৈঃশব্দ্যনিবিড় এক বিরল মুহূর্তে অনুভব করলাম
আমি ও প্রকৃতি পরস্পর গভীরভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছি

 

রাজীব পাল

আগস্ট

১.
ঘাসে সব ঢেকে আছে
খুব বেশি যাতায়াত নেই কোনও দিকে
রোগা নদীর শরীরে সামান্য ভিনদেশি জলের সুখ

মুখ না ফিরিয়েও চোখ সরে যেতে পারে
অনাবৃষ্টির ভিতর হলদে ধানের চারা
নীল সাদার ছুটোছুটি আর ঘষামাজা রোদ

২.
বেশ কয়েকটি পেঁপে গাছ মৃতপ্রায় ঝুঁকে পড়েছে
সজনে পাতার আড়াল থেকে কাঠবিড়ালির উঁকিঝুঁকি
সামান্য বৃষ্টির বিকেলে জানালার কাচ আবছা

এডেনিয়ামগুলোর শরীরে শরীর আঁকা চলছে
চঞ্চলতাসকল আতপ গন্ধের বন্ধু হতে চায়
কিছু বলার না থাকলেও ফুল ছুঁয়ে থাকে আঙুল

৩.
কাঁকড়ার রূপোলী ডিমের মতো থোকা থোকা বিস্ময়
স্বচ্ছতার ভিতর অসংখ্য চুনোপুঁটি খেলছে
এমন দৃশ্যে ধস নেমেছে

ফুরফুরে বাতাস ফড়িং ফড়িং খেলে
কাঁকুড়ে পথ দুপাশের জন্মের কাঁটা গাছ, কাশফুল প্রস্তুতি
পদ্ম পাতার উপর ডাহুক এর দৌড়

৪.
এত তারা, আকাশের গভীরতা শোকের কালো সামলায়
রোজ দেখা হয় না
একাকিত্বের আশ্রয়ে এলোমেলো গুটিয়ে নিতে চাওয়া

পিঁপড়েদের মুখে মুখে সাদা ডিম
আর কত নিচে নামা যায়, না ওদের ভাবনা উপরের দিকে
পূর্বাভাস ছড়িয়ে পড়ছে গৃহস্থের উঠোনে

৫.
ছড়ানো ইচ্ছের মত পচে যাওয়ার গন্ধে
খুব বাতাস উড়ে আসে
মুঠোর শূন্যতা, স্মৃতির উপদ্রব

খাঁ খাঁ, রংহীন হয়ে ওঠে দু’চোখ আগস্ট
আজও দু’ফোঁটা রক্ত, গানের
অথবা ভাবতে শুরু করবে সময়…

 

ফিচার/এক
______________

 

ফ্রেমিংহ্যাম শুধুমাত্র একটি শহরের নাম নয়

মেঘশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়

ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত শহরগুলির মধ্যে বোস্টনের অনতিদূরে অবস্থিত ফ্রেমিংহ্যাম অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। এই শহরের গোড়াপত্তন হয় ১৬৪৭ খ্রিস্টাব্দে জন স্টোন নামক জনৈক ভুট্টা ব্যবসায়ীর হাত ধরে। সাডবেরি নদীর ধারে তাঁর নব নির্মিত ভুট্টা-মিল আশেপাশের গ্রাম ও শহর থেকে বহু মানুষেকে টেনে আনে কর্ম সংস্থানের আশায়। বিশেষতঃ নারকীয় ‘উইচ ট্রায়াল’ -এর হাত থেকে বাঁচতে সালেমের বহু বাসিন্দা এই নতুন গড়ে ওঠা শহরে থিতু হতে শুরু করে।

১৭০০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেমিংহ্যামকে সুচারু রূপে নির্মাণ করার জন্য সরকারের তরফ থেকে থমাস ড্যানফোর্থকে প্রায় পনেরো হাজার একর জমি প্রদান করা হয়। সেই সময়ে ভুট্টা-মিলে কাজ করা ছাড়াও ছিয়াত্তরটি পরিবার প্রধানত চাষবাস করে অন্ন সংস্থান করত। ধীরে ধীরে নানাবিধ কল-কারখানা গড়ে উঠতে থাকে। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ‘প্যারা রাবার স্যু’ কোম্পানি অধিকাংশ ফ্রেমিংহ্যামবাসীর নিয়োগকর্তা হয়ে ওঠে। নির্মিত হয় রেইল রোড। পরবর্তীতে ‘জেনেরাল মোটরস’, ‘বোস’, ‘আভেরী-ডেনিসন’ এর মতো পণ্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি এই শহরকে অর্থনৈতিক দিক থেকে ক্রমশ অত্যন্ত বলীয়ান করে তুলেছে। এখন ফ্রেমিংহ্যাম ইস্ট-কোস্টের অন্যতম প্রধান রিটেইল সেন্টার এবং আইটি-হাব।

________________________________________

যে কোনও যুদ্ধ আসলে ধ্বংসের আগ্রাসী কবল। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলো আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে নৃশংসতম। হাজার হাজার অসুস্থ ও জখম সেনায় ক্রমে ভরে উঠতে লাগল নব নির্মিত হাসপাতাল। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বেডের সংখ্যা বাড়িয়ে আড়াই হাজার করা হল।

________________________________________

শুধুমাত্র অর্থনীতির উত্তরণের নিরিখেই যে শহরটি গুরুত্বপূর্ণ তা নয়। আজকে শহরের পশ্চিমদিক ঘেঁষে প্রায় পঁচানব্বই একর জুড়ে শ্যামল গালিচার মতো বিছিয়ে থাকা যে পার্কটিতে বিকেলে বাচ্চারা প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়ায় অথবা সকাল-সন্ধে যুবা থেকে বয়স্ক সমস্ত মানুষ প্রকৃতির কোলে মুক্ত বাতাসে শরীরচর্চা করেন, হেঁটে বেড়ান অথবা বিশ্রাম নেন – সেই কুশিং পার্ক এক রোমাঞ্চকর ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য মুক্তামালার মতো বুকে বহন করে চলেছে। পথিক চাইলেই অলস বিকেলে পায়চারি করতে করতে কিঞ্চিৎ বিরামের অছিলায় পার্কের বীথিকুঞ্জের মধ্যে সযত্নে সাজিয়ে রাখা ব্যুলেটিন বোর্ডে চোখ বুলিয়ে সেই কাহিনীর এক আঁজলা পান করে তৃপ্ত হতে পারেন। এই শহরের অতীত বৃত্তান্ত আঞ্চলিক সীমানা অতিক্রম করে বিশ্ব-ইতিহাসের পাতায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। অদ্যাবধি পৃথিবীর অন্যতম ভয়ঙ্কর ও স্মরণীয় ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞে আচমকাই জড়িয়ে পড়ে এই ছোট্ট শহরটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতেই আমেরিকা আন্দাজ করতে পারে যে আগামী দিনের বীভৎস ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে তাদের মিলিটারি হাসপাতালগুলো যথেষ্ট নয়। সেই অনুযায়ী মহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু অস্থায়ী হাসপাতাল গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ফার্ম পন্ডের ধারে কুশিঙের এই জমি কৃষিকাজ ও গবাদি পশু চারণ ভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হত। ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি তদানীন্তন জমির ভারপ্রাপ্ত রিচার্ড এইচ লং এবং মেলবোর্ন ডোরের কাছ থেকে এই ভূ-খন্ড অধিগ্রহণ করে। সাজ সাজ রবে শুরু হয়ে যায় একটি ১৭৫০ বেডের হাসপাতাল নির্মাণের কাজ। মাত্র ন’মাসের মধ্যে পঁচানব্বইটি বিল্ডিং দাঁড় করানো হয় যার মধ্যে বিভিন্ন ওয়ার্ডস, অস্ত্রোপচার বিভাগ, এক্স-রে ফেসিলিটি, প্রস্থেটিক বিভাগ, ফিজিওথেরাপি বিভাগ, থাকার জন্য গেস্ট হাউস, সেন্ট্রাল স্টিম হিটিং প্ল্যান্ট এবং ডাক্তার ও নার্সদের থাকার জন্য আলাদা বাড়ি বানানো হয়। হসপিটালকে কেন্দ্র করে আশেপাশে একটি দমকল বাহিনী, একটি গীর্জা যেমন গড়ে তোলা হয়, তেমনই উপস্থিত রেইল রোডটিকে প্রশস্ত করা হয় যাতায়াতের প্রভুত সুবিধার জন্য। ক্যাম্পাসের একেবারে মাঝখানে নির্মিত হয় টেলিফোন বুথ, ডাকঘর, পাঠাগার, রোগীদের মেস, রেস্তোরাঁ, নাপিত এমন কী দর্জির দোকানও। এই অ-চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রাণকেন্দ্রটি ‘টাইমস স্কোয়্যার’ নামে চিহ্নিত ছিল। ‘কুশিং জেনেরাল হসপিটাল’ এর নামকরণ করা হয় প্রখ্যাত আমেরিকান নিউরোসার্জন ডক্টর হার্ভে কুশিঙের নামে।

“When after many battles past,
Both tir’d with blows,
Make peace at last,
What is it, after all, the people get?
Why! taxes, widows, wooden legs, and debt.”

–ফ্রান্সিস মুর

যে কোনও যুদ্ধ আসলে ধ্বংসের আগ্রাসী কবল। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হলো আজ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সমস্ত যুদ্ধের মধ্যে নৃশংসতম। হাজার হাজার অসুস্থ ও জখম সেনায় ক্রমে ভরে উঠতে লাগল নব নির্মিত হাসপাতাল। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে বেডের সংখ্যা বাড়িয়ে আড়াই হাজার করা হল। হাসপাতাল নিয়োজিত ডাক্তার বা নার্স ছাড়াও এলাকার সাধারণ মানুষও স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। বেনি গুডম্যান, হেলেন কেলারের মতো তারকারা নৈতিক সমর্থনের জন্য সেনাদের সঙ্গে হাসপাতালে দেখা করতে আসতেন। পরে সকল আবাসিক ও চিকিৎসাধীন সেনাদের বিনোদনের জন্য তৈরি করা হয় সুইমিং পুল, জিমন্যাসিয়াম, টেনিস কোর্ট, রেডিও স্টেশন ইত্যাদি। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত কুশিং জেনেরাল হসপিটালে রোগীর সংখ্যা ক্রমাগতই বাড়তে থাকে। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও ১৯৪৬ পর্যন্ত প্রায় চোদ্দ হাজার যুদ্ধ ফেরত সেনার চিকিৎসা করা হয়েছিল এই হাসপাতালে। তাদের মধ্যে অন্যতম এক সৈনিক কর্পোরাল স্ট্যানলি স্মিথের জবানবন্দী পাওয়া যায় অধুনা কুশিং পার্কের ব্যুলেটিন বোর্ডে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে ইটালিতে এঞ্জিওর যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাঁর জ্ঞান ফেরে কুশিং জেনেরাল হসপিটালে। দু’বছর দফায় দফায় ছ’টি অস্ত্রোপচার ও অন্যান্য চিকিৎসা চলার পর অবশেষে ১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বরে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। তিনিই ছিলেন সেনা পদে কায়েম থাকা কুশিং জেনেরাল হসপিটালের সর্বশেষ রোগী।

________________________________________

শুধুই পার্ক নয়, বাচ্চাদের খেলার জন্য রীতিমতো প্লে-এরিয়া বানানো হয়, তৈরি হয় একটি স্কুল বিল্ডিং, সমগ্র অঞ্চলকে ঘিরে একটি পেল্লায় হাঁটা-পথ, যেখানে অক্লেশে সাইক্লিংও করা চলে। স্থানে স্থানে গড়ে ওঠে বসার জায়গা, তিনফুটের ছোট্ট লাইব্রেরিও। কুশিং পার্ক প্রকৃত অর্থেই শহরের প্রাণ

________________________________________

এরপর ইউনাইটেড স্টেটস আর্মির কাছ থেকে ‘ভেটেরানস এডমিনিস্ট্রেশন’ হাসপাতালটির ভার গ্রহণ করে। কুশিং জেনেরাল হসপিটালের নাম পাল্টে হয় কুশিং ভেটেরানস হসপিটাল। যুদ্ধ শেষ হলেও বারুদের গন্ধ তখনও ফ্রেমিংহ্যাম শহরের বাতাসে। ভেটেরান, মানে প্রাক্তন সেনানীদের চিকিৎসা চলতে লাগল এই হাসপাতালে। এবারের চিকিৎসকরা সকলেই মিলিটারির প্রাক্তন ডাক্তার। তবে প্রায় সাতশো জন স্থানীয় মানুষকে হাসপাতালের অন্যান্য কাজের জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে স্বয়ং জেনেরাল ডাগলাস ম্যাকআর্থার কোরিয়ার যুদ্ধ কবলিত প্রাক্তন সেনাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এই ভিজিট গোটা একালায় সাড়া জাগিয়েছিল। যুদ্ধ ফেরত সেনানীদের কাটা হাত-পা বা পূর্বের মানসিক স্থিতি যদিও আর ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না, তবু যে দেশ ভক্তির আদর্শ নিয়ে তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণপণ লড়াই করেছেন, ডাগলাস ম্যাকআর্থারের উপস্থিতি সেই আদর্শকে নিশ্চিত রূপে সম্মান প্রদর্শন করে।

তবে হাসপাতালে রোগীর ক্রমশঃ কমতে শুরু করল। অবশেষে ১৯৫৩ এর ১৫ই অক্টোবর হাসপাতালটিকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। শুধুমাত্র যুদ্ধের কারণে গড়ে ওঠা একটি অস্থায়ী হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাওয়া একদিকে যেমন শান্তির বার্তা বয়ে আনে, তেমনই আরেকদিকে বয়ে আনে কয়েক হাজার আঞ্চলিক মানুষের রোজগারহীন হয়ে পড়ার আশঙ্কা। সেই যাত্রায় জীবিকা হননের আশঙ্কাকে সামাল দিতে কিছু সংস্কারের পরে আয়তনে ছোট করে ভেটেরান হসপিটালকে ‘এল্ডারলি কেয়ার ইউনিটে’ পরিণত করা হয়। তিন বছর পরে আরও একবার হাসপাতালের দ্বারোদ্ঘাটন হয় ‘কুশিং স্টেট হসপিটাল’ হিসাবে। ফেডেরাল ফান্ডিঙের সঙ্গে সঙ্গে প্রাইভেট ডোনেশন, আঞ্চলের মানুষের স্বেচ্ছা শ্রম – সবে মিলে এই স্টেট হসপিটালকে জিইয়ে রাখার অনেক চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাময়িকভাবে গড়ে তোলা এই বিল্ডিঙের স্থায়িত্ব ছিল মোটামুটি কুড়ি বছর। তারপর পরিস্থিতি হলো কিছুটা ঢাকের দায়ে মনসা বিকিয়ে যাওয়ার মতো। সংরক্ষণের পাহাড় প্রমাণ খরচার বোঝায় ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল উচ্চমানের পরিসেবা। অবশেষে ১৯৯১ খ্রীস্টাব্দে চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কুশিং হসপিটাল। চোখের সামনে ভাঙা হতে লাগল বয়সের ভারে ন্যুব্জ অথচ গরিমাণ্বিত হসপিটাল বিল্ডিং। স্থানীয় মানুষেরা চাকরি হারিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেন। কিন্তু তাদের চেষ্টা বৃথা গেল। তবু সকলের মিলিত প্রতিবাদে ও প্রচেষ্টায় হাসপাতালের জন্মলগ্নে গড়ে ওঠা পুরনো গীর্জাটি ভূ-পতিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পেল।

হঠাৎ করে পঁচানব্বই একর জমি আবার খালি পেতে তাকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সেই নিয়ে শুরু হলো নানান জল্পনা। গড়ে উঠল ‘কুশিং হসপিটাল মাস্টার প্ল্যানিং কমিটি’। ১৯৯৪ খ্রীস্টাব্দে সাড়ে ঊনত্রিশ একর জমি বরাদ্দ করা হয় এক বৃদ্ধাবাস কেন্দ্রকে। অনেক আলাপ আলোচনার ও বহু পরিকল্পনা বাতিল করার পর বাকি জমিকে মুক্তাঞ্চল হিসেবেই রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যা ক্রমে পরিণত হয় শহরের প্রাণকেন্দ্রে। বিভিন্ন দফায় ছোট-বড় নির্মাণ কাজ চালিয়ে মুক্তাঞ্চলটিকে একটি পার্কের আকার দেওয়া হয়। শুধুই পার্ক নয়, বাচ্চাদের খেলার জন্য রীতিমতো প্লে-এরিয়া বানানো হয়, তৈরি হয় একটি স্কুল বিল্ডিং, সমগ্র অঞ্চলকে ঘিরে একটি পেল্লায় হাঁটা-পথ, যেখানে অক্লেশে সাইক্লিংও করা চলে। স্থানে স্থানে গড়ে ওঠে বসার জায়গা, তিনফুটের ছোট্ট লাইব্রেরিও। কুশিং পার্ক প্রকৃত অর্থেই শহরের প্রাণ। খেলাধুলা, শরীরচর্চা থেকে শুরু করে বাচ্চাদের জন্মদিন পালন হোক বা গ্রীষ্মকালীন পিকনিক, সবুজে মোড়া এমন উপভোগ্য জায়গা শহরে আর দ্বিতীয়টি নেই।

আজ যা কিছু বর্তমান, যা কিছু ভীষণভাবে জীবিত আগামীকালই তা হয়ে যাবে অতীত। সেই অতীতের আবার বেশিরভাগই গতানুগতিক। সমস্ত ঘটনা মনে রাখার বা মনে করিয়ে দেওয়ার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা নেই। কালের গর্ভে তাকে হারিয়ে যেতে দেওয়াই ভালো। তাই বিগত মুহূর্ত মাত্রই যে ইতিহাস হয়ে উঠবে, এমন নয়। তবে অতীতের বিশেষ বিশেষ ঘটনার থেকে জ্ঞান ও শিক্ষা অর্জন না করলে ভবিষ্যতের পদক্ষেপ অর্থহীন হয়ে পড়ে। তাই অতীতকে নথীবদ্ধ করে রাখার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। আর ফ্রেমিংহ্যাম শহর সযত্নে সেই কাজটি করে আসছে গত তিনশো পচাত্তর বছর ধরে। গোড়াপত্তন থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত শহরের ইতিকথা নথীবদ্ধ করা আছে ‘ফ্রেমিংহ্যাম হিস্ট্রি সেন্টারে’। মৃত সময়ের জীবন্ত এই দলিল থেকে জানা যায় শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই নয়, তারও আগে শহরটি ভাগ নিয়েছে দাসপ্রথা বিরোধী বিপ্লবেও। ‘এন্টি স্লেভারি সোশাইটি’ ফ্রেমিংহ্যাম শহরের ‘হারমোনি গ্রোভ’ অঞ্চলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে এক মস্ত মিছিল বের করে। এই মিছিলে উইলিয়াম লয়েড গ্যারিসনের ‘ফিউজিটিভ স্লেভ ল’ এর কপি প্রকাশ্যে পুড়িয়ে ফেলা ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

ফ্রেমিংহ্যাম শহরটি হেলথ স্টাডির ক্ষেত্রেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে টিউবারকিউলোসিস সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কেন্দ্র হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এই শহরকে। আবার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পাঁচ হাজার দু’শ শহরবাসীকে নিয়ে শুরু হওয়া ‘কার্ডিও-ভ্যাস্কুলার কোহর্ট স্টাডি’ বিগত তিন প্রজন্ম ধরে চলে আসছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের আঙিনায় ফ্রেমিংহ্যাম শহরটি নিশ্চিত রূপেই তার ছাপ রেখে চলেছে অবিরত। উন্নত প্রযুক্তি ও বলিষ্ঠ অর্থনীতির যষ্টিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ঝকঝকে ছবির মতো শহর ফ্রেমিংহ্যাম তার ইতিহাসকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছে, কালের গর্ভে হারিয়ে যেতে দেয়নি কোনওভাবেই। 🦋 ছবি: লেখক

 

 

ফিচার/দুই 
______________

 

আমাদের নিজেদের ঘর

অর্পিতা আচার্য
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

ভার্জিনিয়া উল্ফ সারাজীবন একটি ঘরের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই ঘর সম্পূর্ণ নিজের ঘর, ‘one’s own room’। একজন লেখিকার জীবনে এই ব্যক্তিগত স্থানের সংকুলান কতটুকু? অনুপম মুখোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিকতম একটি ফেসবুক পোস্টে পড়েছিলাম তিনি লিখেছিলেন, “আমার লেখার পথে বাধা হতে পারে এমন যে কোনও কিছুকে আমি ছেঁটে দিই জীবন থেকে।” একথা লেখার জন্য কলিজার জোর লাগে। আর, একজন সফল লেখকের এমন কথাই হয়তো বলা উচিত।

বলছিলাম নারী লেখক-কবিদের কথা। শারদীয়া পত্রিকাগুলো হাতে নিলেই দেখা যাবে, কতজন নারী লেখক আর কতজন পুরুষ লেখক কলম ধরেছেন। নোবেল সাহিত্য পুরস্কারের এযাবৎ কালের তালিকা দেখুন! একই ছবি পেয়ে যাবেন। তবে কি লেখালেখির মানের দিক থেকে মেয়েরা পিছিয়ে আছে? মেয়েরা কি কবিতা লিখতে জানে না? একটা আলাদা ক্যাটাগরিতে রাখা হয় মেয়েদের, যেন রিজার্ভড ক্যাটাগরি। তাদের লেখাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় ‘মেয়ে কবিদের কবিতা’ বলে । এই পিছিয়ে পড়া, এই বিভাজন, এই লুকিয়ে থাকা, এর উৎস কি? একেকটা সাহিত্য আসরে এত যে মেয়ে কবি, তবে কি তারা শুধু সভার সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী?

________________________________________

যৌনতা, শরীর , স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে লিখলে পারিবারিক বাধা আসতে পারে। সমাজ তাকে আড়ালে বা সামনে নিন্দামন্দ করতে পারে। একজন পুরুষ কিন্তু এসব নিন্দার মুখোমুখি হন না সাধারণত। একটি শব্দ কবিতায় লিখতে গিয়ে দশবার মনে মনে ভাবতে হয় মেয়েদের । অবিবাহিতা মেয়ে হলে একরকম নিন্দা, বিবাহিতা হলে অন্যরকম।

________________________________________

মেয়েদের লেখাপড়া শেখার ইতিহাসের শুরুটা পুরুষদের তুলনায় দেরিতে। এখনো মেয়েরা পিছিয়ে আছে সামাজিক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে, বহুদিকে। এসব সত্য মেনে নিয়েও, আধুনিকতম নগর সভ্যতাতেও, সমস্ত রকম সুযোগ-সুবিধা হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও, একজন লেখিকা ঠিক কী কারণে ক্রমশ পিছিয়ে যায়? এখনও কেন তারাবাজির মত জ্বলে উঠেই বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যায় কোনো কোনো নারী কবি? জীবনের সবচেয়ে উর্বর সময়, তারুণ্য ও যৌবন, পর্দার আড়ালে কাটিয়ে কেন প্রৌঢ় বয়সে এসে দাঁড়ায় কেউ কেউ সাহিত্যের আলোকিত জগতে? কমলা দাস একবার বলেছিলেন, “Like other woman writers of my class, I am expected to fame by talent to suit the comfort of my family.” মনস্তত্ত্ববিদ কাল গুস্তভ ইয়ুং নারীর কিছু আর্কিটাইপের কথা উল্লেখ করেছিলেন। এই আর্কিটাইপগুলি আমাদের সামাজিক অবচেতনের অংশ। মেয়েরা হল মায়ের জাত, ‘মা’ পৃথিবীর মত সর্বংসহা। দেবীর প্রতিমূর্তি। মায়েদের খিদে নেই, শরীর নেই, যৌনতা বা ক্রোধ নেই। আবার উল্টোদিকে যে মেয়ে এই নিয়ম মানে না, সে হলো মেডুসার মত ক্রুর, উচ্ছন্নে যাওয়া মেয়ে। সিলভিয়া প্লাথের কবিতা মনে আছে তো?

“Herr God, Herr Lucifer
Beaware
Beaware
Out of the Ash
I rise with my red hair
And I eat man like air!”

যে নারী মাতৃপ্রতিম, স্নেহ মায়া মমতা প্রেম নিয়ে লিখবে, সে নারী হল ‘সেন্টিমেন্টাল পোয়েট’, আর যে নারী তার বিপরীতে লিখবে পুরুষতন্ত্র, শরীর, যৌনতা বা নারীর বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া হিংস্র রাষ্ট্রনীতি নিয়ে, সে হল ‘ফেমিনিস্ট’। দুটোই চলে, তবে দুটোর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। নেতিবাচকতা ও ইতিবাচকতার পরিমাণ আলাদা। ফেমিনিস্ট যেন কখনও কখনও একটি গালাগাল মাত্র!
যৌনতা, শরীর , স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে লিখলে পারিবারিক বাধা আসতে পারে। সমাজ তাকে আড়ালে বা সামনে নিন্দামন্দ করতে পারে। একজন পুরুষ কিন্তু এসব নিন্দার মুখোমুখি হন না সাধারণত। একটি শব্দ কবিতায় লিখতে গিয়ে দশবার মনে মনে ভাবতে হয় মেয়েদের । অবিবাহিতা মেয়ে হলে একরকম নিন্দা, বিবাহিতা হলে অন্যরকম। মেয়ে কবিরা (সবাই নয়) মনে মনে ভাবুন তো, কত শব্দ আপনার মনে এসেও ব্যবহারের সময় তাকে এড়িয়ে গেছেন, এডিট করেছেন, শুধু লোকে কী বলবে এ কথা ভেবে? আমার এক সহকর্মী আমাকে একদিন খুব সরল ভাবেই বলেছিলেন, “লিখুন দিদি। এখন তো বাচ্চাকাচ্চা বড় করে ফেলেছেন। কী বা করবেন? লেখালেখি নিয়ে থাকলে সময় ভালো কাটবে।” মেয়েদের লেখালেখি সাংসারিক পরিসরে আজও শুধু সময় কাটানোর উপকরণ। সব দায়িত্ব পালন করার পর অবসরকালীন এন্টারটেইনমেন্ট মাত্র।

তবে এসব সমস্যা ছাড়াও ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা ও তার উত্তরণও নারীদের লেখার জন্য জরুরী।
মেয়েরা প্রধানত লেখে সংসার নিয়ে, প্রেম, সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে । এর বাইরে কিছু লেখা তাদের পক্ষে অসুবিধা হয়, কারণ বেশির ভাগ মেয়েই জীবনকে দেখেছে বন্ধ ঘরের ভিতর থেকে। একটা পারিবারিক ও সামাজিক খোলসে আবদ্ধ ভারতীয় নারীর পক্ষে খোলা আকাশের নিচে জীবনকে দেখা এখনো ততটা সুলভ নয়। একজন পুরুষ কবি ত্রিপুরার গ্রামে, পাহাড়ে, মাঠে, ঘুরে বেড়াতে পারেন একটা বাইক নিয়ে। দু-রাত কাটিয়ে আসতে পারেন প্রত্যন্ত গ্রামে। ফিরে এসে জীবনকে নিয়ে ক’লাইন কবিতা লিখতে পারেন। কিন্তু একটা মেয়ের পক্ষে সেটা কতটা সম্ভব? আশাপূর্ণা দেবী চার দেয়ালের মধ্যে বসেও কত কী লিখেছেন, এ কথা অনেকে বলতে পারেন। কিন্তু এখনকার বিস্তৃত সাহিত্য পরিসরে, যেখানে নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখা হচ্ছে প্রতিনিয়ত, বিষয়ের বৈচিত্র্য যেখানে অসীম, সেখানে এ কতটা সম্ভব? জীবনকে কাছের থেকে না দেখলে জীবনকে কি লেখা যায়? ছেলের জ্বর, মেয়ের কাশি, ছোটটির ক্লাস টেস্ট ফেলে আপনি ঘুরবেন কী করে? একা একাই বা ঘুরবেন কী করে? আপনার নিরাপত্তার প্রশ্ন কি নেই?

বলা যেতে পারে, পারছেন না কি মেয়েরা? অনেক মেয়ে তো লিখছেন দু-হাত ভরে। অবশ্যই! কিন্তু সংখ্যায় তারা ক’জন? তাদের জীবনের যুদ্ধের খবর নিলে দেখা যাবে, কত বাধা তাদের প্রতি মুহূর্তে পেরোতে হয়েছে, হচ্ছে। তাদের মনের জোর আছে। আছে সাহস। এবং তারা নির্মোহ। তাই হয়ত তারা পেরেছেন। সবাই কি পারে? যুদ্ধ করতে গিয়ে হারিয়ে যায়, সময়কে তাড়া করতে গিয়ে হারিয়ে যায়, ভালবাসার দায়ে হারিয়ে যায়, সমালোচনা নিন্দায় হারিয়ে যায়, হারিয়ে যায় প্রলোভনে। পুরুষদের ক্ষেত্রে সমস্যা নেই বলবো না, তবে তুলনায় অনেক গুণ কম।

মেয়েদের আরেকটি সমস্যা হল, তারা যখন প্রথম লিখতে আসে, এবং তাদের বয়স যদি কম হয়, তবে বহুজন তাদের প্রথম অবস্থাতেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে ফেলে। কথায় কথায় মঞ্চে উঠিয়ে দেওয়া, পুরস্কার ঘোষণা, যেমন তেমন কবিতায় প্রশংসা করা, বিভিন্ন ম্যাগাজিনে অপরিণত কবিতাও ছাপিয়ে দেওয়া, ইত্যাদির ফলে মেয়েটির মনে হতে থাকে সে বোধ হয় অনেক বড় কবি হয়ে গেছে। সঙ্গে কমবয়সী নারী কবি হলে, ফেসবুকে লাইক কমেন্ট এর আধিক্য তো আছেই। কিন্তু তাকে বুঝতে হবে, এসবই তার সৌন্দর্য, বয়স, নারী বলে তার অতিরিক্ত পাওয়া সুবিধার ফল। আসলে যারা তাকে এভাবে এগিয়ে দিচ্ছে, তারা তাকে শোষণ করছে। একদিন যখন তার মধ্যে আর সারাংশ অবশিষ্ট থাকবে না, তখন তারাই তাকে ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করবে না। অনেক নতুন লেখিকা এভাবেই হারিয়ে যায়। আর যদি সে সত্যি সত্যি ভালো লেখে, তবে এই পুরুষরাই কিন্তু তাকে প্রতিযোগী মনে করবে এবং হঠিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। ফলে নতুন নারী কবিদের এই অপ্রত্যক্ষ শোষণ থেকে সাবধান থাকা দরকার।

মনোবৈজ্ঞানিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের খুঁটিনাটি মনে রাখার ক্ষমতা পুরুষদের তুলনায় বেশি। তাদের মৌখিক ক্ষমতাও (verbal ability) বেশি। যে কোনও কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মনে রেখে তাকে সুন্দরভাবে গুছিয়ে লেখা মেয়েদের পক্ষে তাদের বিশেষ মনোগত ক্ষমতার জন্যই ভালোভাবে করা সম্ভব। কিন্তু যেদিক দিয়ে মেয়েরা পিছিয়ে আছে, তা হলো তাদের আত্মবিশ্বাসের অভাব। এক্সটার্নাল লোকাস অফ কন্ট্রোল নারী কবিদের বেশি এমনই দেখা গেছে মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায়। এর ফলে অন্যদের মন্তব্য ও ভাবনা দিয়ে সে চালিত হয়। কে কি বলবে, লেখা ভালো হলো কি মন্দ হলো, অন্যরা প্রশংসা করল কি করল না, এসব নিয়ে তারা খুব বেশি মাথা ঘামায়।
পুরুষদের কিন্তু ইন্টারনাল লোকাস অব কন্ট্রোল বেশি। ফলে তারা অন্যদের কথা নিয়ে ততটা ভাবে না। নিজের মনের ইচ্ছা দিয়ে তারা নিয়ন্ত্রিত হয় বেশি। নিন্দা করলে আহত হয়ে লেখা ছেড়ে দেয় বহু মেয়ে। সেই নিন্দুক পরিবারের হতে পারে, সমাজের হতে পারে, হতে পারে আত্মীয় স্বজন বা কাব্য জগতের কেউকেটা কেউ। ‘পাছে লোকে কিছু বলে’ এই চিন্তায় নারী লেখকদের অনেকেই পিছিয়ে যায় তার স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ থেকে। এই দূর্বলতা নারীকে কাটিয়ে উঠতে হবে। মনের কথা বলতে শিখতে হবে মন খুলে। বাঁচতে হবে নিজের মতো। মনের অর্গল না খুললে কলমের অর্গল খুলবে কি করে? এসব বাধাকে জয় করে এগিয়ে যেতে পারলেই নারী, কবিতায় তৈরি করতে পারবে তার নিজস্ব ভাষ্য। 🦋

 

 

শারদ কবিতা /দুই 
______________________

সুবীর সরকার 

ধারাভাষ্য

ফাঁকা রাস্তা ফাঁকাই পড়ে থাকে। আমাদের অবসাদপর্ব শেষ হয়।সাইকেল পেরচ্ছে দীর্ঘ
সেতু। যোগ বিয়োগের এই যে জীবন,তাকে ঘিরে
রাখে দু’ চারটে কলাগাছ।হাটবার জুড়ে থাকে
মাটির পুতুল। এভাবেই তো শূন্যতার জন্ম হয়।
বিনির্মিত হয় চিরদিনের সেই বাঘের ডাক! ভয় ও ভ্রম
থেকে সরে আসি। মৃত্যুর গন্ধ থেকে সরে আসি।
আর ফাঁকা রাস্তায় উড়ে আসে ভোরের মোরগ।

 

পিয়াংকী

মহাকাল এবং একটি এপিডেমিক

১.

ঈশ্বরকণা এবং যত্রতত্র ছায়া, নির্বিকার

ওঁ আকৃতি ধারণ করে আছে যাঁরা
গায়ের ভিতর নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ল্যাম্পপোস্ট
লুটিয়ে পড়ছে চাঁদ চাঁদ সুখ

শান্তির জল ছিটিয়ে গেছে উপবীতধারী
থার্ড আইতে হলুদ তিলক ঘিয়ের ফোঁটা

এখন উপবাসভঙ্গ শুভসন্ধ্যা
বুকের খাঁজে উষ্ণমুখ
পথ প্রসারিত হচ্ছে ক্রমশ

অদৃশ্য শত্রু। কলসি কাঁখে দাঁড়িয়ে আছে সেই কৃষ্ণকলি কন্যা

অনেক হল। উঠে বসুন, গিঁট খুলতে এসেছি
আমি…

২.

জিরাফের গলায় একটান রাস্তা
সরল সহজ।
মানুষের গলায় পাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই রাস্তাই
এবড়োখেবড়ো ভাঙাচোরা-

রাস্তাটায় মোড় আছে, নারীর সিঁথির মতো ভোরও
সন্ন্যাস আর রাজকন্যার উদ্বায়ী সংবাদ

ধ্যান থেকে সরে গেছে যে সময়
মূলাধার চক্রে মুঠোভরা মাটি
বসতি গড়ে উঠবে, সময় সাপেক্ষ
আসন্ন আর্যপূজা, রোদজলে পুড়ে যাচ্ছে পরজীবি

এককুশি নাকি একঘরা?

৩. 

ভয়? হিসেব মেলাতে পারোনি?
বেশুমার তারারন্ধ্রে রবির দশা
গ্রহণ আর অন্ধকার-
কয়েনের কাছে বন্ধকি আছে তোমার পূর্বজন্ম

একা হাঁটাকে অপমান বলেছিলে যেদিন
আমি তোমার একনিষ্ঠ পাঠিকা সেই থেকে

কোন ব্লকেজকে মজবুরি বলে সংজ্ঞায়িত করেছ
‘লেট দেম গো’

আমি শরীরের সর্বত্র পুঁতে রেখেছি ডালিমচারা

৪.

যোগ- একটি নি:শ্বাসের চলতিপথ
বিয়োগ- ত্যাগের বিনিময়

চন্দ্রের অবস্থান। অন্তর্মুখিতা আসলে আমার লজ্জা
পরিবর্তন কী নির্দেশ করে?
নদী নামকরণে দ্বিচারণ করিনি বলে আজও
সাধনা একটি একমূখী পাথর,
নৌকাবিহার অথবা পালক সাজানো বিছানা

নিজের সাথে নিজের এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হোঁচট আছে,
আছে ষড়রিপুর গাজন

ইনটিউশন খুলে রেখেছি
মন্দিরে প্রবেশ অবাধ

৫.
এপিডেমিক সিচুয়েশন একটি সিরিজ
রিহ্যাব থেকে অবসর- বৃহত্তম জার্নি
দূরত্বর একক দিয়ে মেপে দেখেন তাঁরা যাদের পিঠে ঝুলে আছে ফলন্ত গাছ

কোথায় কুঁজো কোথায় রূদ্রাক্ষ
সবটুকু ভ্রম। ভ্রম টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি
মহাদেব ধ্যানী। সোল কানেকশন থেকে তিনিই তুলে আনেন প্রকৃত পাখি

কৃতজ্ঞতা জানালাম আপনাকে
আমি মহাবিশ্বের আদিমতম অণু
আমি তৃপ্ত
দুঃখিতও…

 

সীমান্ত হেলাল

মাইগ্রেন

শরীরজুড়ে এক বিষম ব্যথার উৎসব কাড়াকাড়ি খেলছে নির্দিধায়! কি এক রাত কেটেছে অসহ্য যাতনায় কাতরাতে কাতরাতে! ব্যথা কত প্রকার কি কি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি মুহুর্মুহু…!

উঠতে-বসতে; হাঁটতে-চলতে; শু’তে-ঘুমোতে! অনাকাঙ্খিত চঞ্চলতায় লাগামহীন উদভ্রান্ত ঘোড়ার মতোন ছুটে বেড়াই…!

এই ব্যথাটা জন্মগত! এই ব্যথাটা মাইগ্রেনের! যন্ত্রনাটা প্রাত্যহিক! জমে আছে মজ্জায় সংবেদনশীল এক সুখের অসুখ!

স্বর্গের যত সুখ; মর্তের যত অসুখ―হার মানায় যাপনের বাহুল্য আরোগ্যতায়…!

অথচ; বেরসিক এ ব্যথার যন্ত্রনা থেকে শুশ্রুষার প্রার্থনায় নত হই রোজ! কাতর বিছানায় ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের রোজনামচায় লিখে রাখি সব জন্মগত বিষন্নতা…!

 

অবরুদ্ধ বোধের চিৎকার-৯

কাটা নদীর নির্মান ব্যয়ে ঢুকে যাচ্ছে বোধের আমিষ! অতলের প্রত্নমাটিতে ঢেউ খেলানো জল জানে পদ্মপুকুরের নিউরন।

হেক্সিকর্ডে শুকোতে দেয়া নাভীর মধ্যাকর্ষন কতটা ঘোরাতে পারে―ভরকেন্দ্রের ইলাস্ট্রেশন!

হুইসেলের বিপরীতে লোহাট্রেন আবিষ্কার করলো চুম্বকের গতিবিজ্ঞান।

সকল অন্যমনষ্কতা দুরে ফেলে রেলের সমান্তরালে ছুটে চলে বোহেমিয়ান জীবন…

 

স্বপন পাল

যাই-৩ 

একটা ফোঁটা পড়লো কোথাও জলের পিঠে
একটা ফোঁটা সটান গাছের পাতা ছুঁলো
একটা ফোঁটা চাতক ঠোঁটে তৃষ্ণা ছিটে
গোপন সুখে এক ফোঁটা কি ভুল শোনালো?
যাচ্ছি বলেও আসছে কোথায় যাবার বেলা
আসছি বলে বাইরে যে যায় অন্যকালে
কোথায় যাবো এই তো ভালো জপের মালা
আসা যাওয়া প্রকাশ্যে ও অন্তরালে।
একটা ফোঁটা খসলে যখন হিসাবে ভুল
গড় অজগর ঘুম সরিয়ে উঠে বসে
কে যাও তুমি, ফিরিয়ে আনার কেমন মাশুল
যাবে কেন, বলছে না তো কেউ সাহসে?

সাগরিকা 

সানগ্লাসে পিছলে যাওয়া রোদের জ্যামিতি
এই নিয়ে ওই মেয়ে হাঁটে খুব একা,
ওকে ঘিরে রাখে তবু মরুৎ আকাশ ক্ষিতি
যেহেতু হৃদয়ে তার আগুনের সখা,
মাথা বেয়ে নেমে আসা আষাঢ়ে প্রস্তুতি।

মেয়ে তুমি কোথা গিয়ে বিশ্রাম নেবে,
এ শহরে অলিগলি সব চেনো বুঝি?
কার হাতে হাত রেখে বন্ধু পাতাবে,
কার কার কাছে আছে তোমার ঠিকুজি?

রোদ সরে গেলে মেয়ে কাছে এসো তবে,
এ পথে শান্ত এক সমুদ্র পেয়ে যাবে তুমি,
অপেক্ষায় কবি এক নীরব উৎসবে
নোনাজলে ঋতুহীন ভিজেছে আভূমি।

প্রেম-২ 

কতদূরে যাবে?
যেখানেই যাও
আমাকেই পাবে।
বাতাসের অনুগত আমি,
যে বাতাস নিয়ে যাবে
সুগন্ধ আমার,
সেই গন্ধ রাত্রিদিন
তোমাকে পরাবে,
মনে পড়ে যাবে,
আমাকেই মনে পড়ে যাবে।
এতদূর পৃথিবীতে নেই
তুমি যাবে।

বাঁশিওয়ালার খোঁজে 

আমার খুব জিলিপি খাওয়ার ইচ্ছে হলে
মনে মনে জিলিপি এঁকে নিই।
তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে
একটা গাছতলা আঁকি প্রথমে,
তারপর সেখানেই অপেক্ষা করতে থাকি।
সব শহরে তো গাছতলা হয় না
তাই মনের মতো একটা শহর
বানাতে চাই আগে,
সব আকাশের নীচে তেমন শহর
গড়ে তোলা যায় না।
গাছতলার একটা আকাশ থাকলেও
সব শহরের আকাশ থাকে না।
জিলিপি খাওয়ার ইচ্ছে হলে
একটা গোটা মেলা ডেকে আনবে
এমন বাঁশিওয়ালা অনেকদিন হলো নেই।

বিপজ্জনক 

অতোটা বুক খোলা রেখে নির্জন এই
রাস্তাটার বাঁকে কেউ দাঁড়ায় বলো,
তোমার মতো,
দুর্ঘটনা ঘটতে কতক্ষণ ?
তোমার পালিশ করা মেহগনি বুক
দেখতে দেখতে গাড়ির চালক
বাঁক ভুলে যেতে পারে।
মর্ষকামী বাতাস তোমাকে দুলিয়ে যায়,
বৃষ্টি এসে নিন্দে-মন্দ ধুলো ধুয়ে দেয়,
রোদ শুধু ছুঁয়ে থাকে
দিনের নির্দিষ্ট করা ঘন্টা কয়েক।
বিজ্ঞাপন হয়ে তুমি লাস্যে দেখতে থাকো
বাঁক মুখে, দুর্ঘটনা এড়িয়ে চলা গাড়ি।

 

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী 

ডিজনিল্যাণ্ডের প্যাণ্ডেলে

আয়না অপার আকাশের মতো মেলে ধরে
পরিনগরীর জনপদ
সেই পদে এক একটি পুষ্করিণী
এক এক বিন্দু মুক্তোর বিন্দুর মতো!
পরিনগরীতে নেমে আসে মায়ালু যুগল
আড়ালে চুম্বনরত ঠোঁট ধরে ফেলি
আকাশে আতসবাজি সেজে ওঠে চিতার মতো
হাহাকার আলোর রোশনাইয়ের মতোই বুক চাপড়ায়
আমার নিয়তি। আমার প্রশস্তি টুকু
একলা চৌমাথার ঘড়িমিনারের মতো
থেমে থাকতে চায়। মিকি মাউজের ঢঙে

 

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

ঘরে ফেরার আগে 

পিলাকের মৃতভূমিতে দাঁড়িয়ে
জীবনের স্পন্দন অনুভব
করেছিলাম কোনও একদিন
সমুদ্রের তলদেশ থেকে উঠে এল
এক জীবন্ত নারী, সে নির্জনতাকে
প্রতিদিন ঝাঁট দেয়, পাইপের জলে
ধোয়ায়… মোছে খাঁজে খাঁজে
আধুনিক মানুষেরা আসে যায়
বিকাল যখন সন্ধ্যার কাছাকাছি
মনে পড়ে কতগুলো প্রিয়মুখ
পাতার আগুনের চারধারে গোল হয়ে
ফুটন্ত ভাতের ভাপ নেবে তারা
ছটফট করে তার ভেতর বাহির
কেউ কেউ খোঁড়ে জমাট দেহ
লোলুপ চোখে, – কয়টা জন্ম
দিয়েছে এ শরীর! চোখ ভিজে ওঠে
দেহের ঘড়ি তাড়া দেয়… ঘরে চলো এবার।

 

কবির জন্মদিনে

নীলাদ্রি দেব

কবির জন্য মেঘের বাড়ি
স্বচ্ছ একটা সিঁড়ি
যাতায়াতে চৌপথ নেই,
হঠাৎ করেই দেখা
আস্ত ছায়াপথের পাশে
পলাশ পাতা রাখা
জমতে থাকুক
জমে যখন ডায়েরি মতো
দুয়েক পশলা বৃষ্টি
আলোর ভেতর আলো
খুঁজতে থাকি,
ভিজতে থাকি
গানের জন্য গান
পথের উপর দৃষ্টি
জড়িয়েছে বিন্দু ভালোবাসা
যত্নে রেখো

 

দেবব্রত রায়

ধর্মযুদ্ধ 

যারা বলেন মাটি জল
ও বাতাসের মিশেলে ঈশ্বর
তিলে তিলে পশু পাখি
এবং মানুষ তৈরি করেন
তারা ঠিকই বলেন
কারণ, মাটি জল ও বায়ু
ছাড়া এরা কেউই বেঁচে
থাকতে পারেনা
পৃথিবীকে কর্দমাক্ত
করার জন্য মানুষ
কখনো কখনো মাটি
জল ও বায়ুর ধর্ম নষ্ট করে
তিল থেকে একটি তালপুকুর
বানিয়ে ফেলে

 

গল্প  

কচিপাতা রঙে ভালবাসা

রোকেয়া ইসলাম

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

ফেসবুকের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে অরণি।
তৎকালীন কয়েকজন ছাত্রীর ছবি, কমেন্টগুলো পড়ে সবার মানসিকতা বুঝতে চেষ্টা করে। ইতিবাচক চিন্তার সাথে নেতিবাচক চিন্তার মানুষও আছে ওর ফেন্ডলিস্টে। অবাক হয় না। আলো আর অন্ধকার নিয়েই তো পৃথিবী এগিয়ে চলছেে। নারীরাও এগিয়ে চলছে! এগিয়ে চলছে ভাবতে গিয়ে ভাবনাটা থমকে থাকে। ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে ১৯৭২ সালের ছবি। মেয়েগুলো তখন ভার্সিটিতে পড়ে আর ও ক্লাস নাইনে পড়ে। ওর চেয়ে পাঁচ ছ বছরের বড় তো হবেই।
চুলের স্টাইল শাড়িও পিনআপ করা ব্লাউজের হাতাও কুনুইয়ের একটু উপরে অবধি। চোখে কাজল সাদাকালো ছবি বলে ঠোঁটের লিপস্টিক বোঝা যাচ্ছে না। অরণিদের সময় তো এমনই পোশাক ছিল।
অরণি নিজেও এমনই পোশাকই পরতো। এখনও এমনই পোশাক ওর পরনে। অবশ্য পোশাক নিয়ে কখনও মাথা ব্যথা আগেও ছিলও না এখনও নেই।
ওর চার ভাড়াটিয়ারাই তো চার রকমের পোশাক পড়ে, কেউ বোরখায় নিজের সর্বাঙ্গ কালো করে রাখে কেউ বিচিত্র রঙের হিজাব পড়ে কেউ সালোয়ার-কামিজের নিজেকে স্টাইলিস্ট করে তোলে কেউ জিনস্ ফতুয়া টিশার্ট পরে ছিমছাম থাকে। কখনও পোশাক বিষয়ে ওদের কিছু বলে না অরণি। পোশাক তো রুচির বিষয়। দেশপ্রেম ইতিহাস ঐতিহ্য আধুনিকতারও প্রকাশ থাকে পোশাকে।
আবার ছবিটার দিকে তাকায়, ডানদিকের তৃতীয়জনের চেহারায় চোখ আঁটকে থাকে। কেমন যেন চেনা লাগছে। চশমা মুছে আবার তাকায়। না মেলাতে পারে না কারো চেহারার সঙ্গে, তবে চেনা লাগছে খুব!
কে হতে পারে! কে? কে?
ঝাপসা একটা ছবি ভেসে ওঠে মনের আয়নায়, নাহ! কিকরে সম্ভব!
ছবিটার বয়স গুণে উনারা তো অরণি থেকে প্রায় পাঁচ বছর এগিয়ে। তাহলে!
পুরানো এ্যলবাম বের করে অরণি।
একেবারে একই স্টাইল একই চেহারা।
অরণি তখন পড়তো ময়মনসিংহের মমিনুন্নেছা কলেজে। থাকতো হোস্টেল।
খুব প্রিয় বান্ধবী ছিল আবিদা।
ষোল সতের বছরের একটা মেয়ে স্বজন পরিত্যাক্ত হয়ে স্বজনহীন মমতাহীন শহরে একাকী একা থাকতো, খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরেছিল আবিদাকে। আবিদার পরিবারও ভালবাসতো অরণিকে।
আবিদার মাকে নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি মনে হতো।
তার হাতের কোরমা পোলায়ের স্বাদ বহুদিন সতেজ ছিল জিহবায়।
খালাম্মা বলে জড়িয়ে ধরতো।
আরেকটা টুকরা নেও অরণি।
না খালাম্মা আর পারব না।
স্বাদ হয় নাই তরকারি।
কি যে কন না আপনে, খুব মজা হইছে।
খালাম্মার আদর ভুলিয়ে দিতো শহরের স্নেহহীন শহরের বাতাস।
আবিদাদের বাসাতেই পরিচয় হয় আবিদার খালাতো ভাই হাসেমের সঙ্গে। এক বিকেলে হাসেম ভাই অরণিকে বলে,
আমরা যেতে চাই তোমার বকুলগন্ধা শহরে রসে ভেজা চমচম খেতে চাই পাব তো অরণি।
কেন নয় চলুন।
দেখ আবার পিছিয়ে যেও না। সাহস আছে আমাদের নিয়ে যেতে।
তরুণী বুক জুড়ে তোলপাড় সাহস অরণির।
এগিয়ে আছি, আপনারা পিছিয়ে যাবেন না তো।
অরণির কন্ঠ জুড়ে নবীন সাহস।
ওরা যেতে চায় অরণির স্বপ্নময় শহরে।
সানন্দে সম্মতি তো দিল তবে ছোট্ট একটা দ্বিধা নিজের কাছে রইল, কি বলবে মাবাবাকে। বাবা আধুনিক মানুষ তিনি রক্ষনশীল মাকে বোঝাতে পারবে কিন্তু আত্মীয়স্বজন পাড়া প্রতিবেশীদের মসৃণ জিহ্বার চাবুক কষা জিজ্ঞাসাকে মোকাবিলা করাটা কঠিন।

____________________________________________

প্রাণ খুলে কাঁদে অরণি, কার জন্য ফিরে এলো!
বিকেলে একা একা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ে গাছের শাখা থেকে বের হচ্ছে নধর বরণে নবীন পাতা। ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। দুটো নখ নিষ্ঠুর অস্ত্রের রূপ নিয়ে এগিয়ে যায় নরম পাতাগুলোর দিকে। পট পট ছিঁড়ে ফেলে কয়েকটা, আরেকটা কুশির দিকে নখ সমেত হাত এগিয়ে যেতেই কানে বাজে রাগ ভৈরবী সুরে ভালবাসি ভালবাসি… 
না কেউ কোথায়ও নেই অরণিকে ভালবাসার।

____________________________________________

বাবাকে সব জানিয়ে চিঠি দেয় অরণি। বাবাও সম্মতি দিয়ে ওদের আসার তারিখ জানতে চায়। আবিদা হাসেম হাসেমের বন্ধু কাজলকে নিয়ে অরণি সন্ধ্যার মুখে ঢুকে ওদের বকুলগন্ধা জেলা শহরের বাড়িতে।
ওরা হৈ হৈ করে ঘুরে বেড়ায় পুরো শহর, মজা করে অরণির মায়ের রান্না করা টেবিলের সব খাবার সাবড়ে দেয়। রাত জেগে বাগানে বসে গল্প করে। এক সকালে অরণি আবিষ্কার করে আবিদা আর হাসেম তোলপড় প্রেমে খাবি খাচ্ছে।
ধরা পড়ে গেছ বন্ধু।
এতদিন বুঝলি বুদ্ধ। ক্লাস এইট থেকে ভালবাসি হাসেমকে।
বি এ ফাইনাল ইয়ারের একটা ছেলেকে কি অবলীলায় নাম ধরে ডাকছে আবিদা।
হাসেম ভাইও এতো ছোটবেলায় ভালবাসতো।
না ও তখন এসএসসি দিয়েছে। হাসেম বি এ পাশ করলেই বিয়ে করব আমরা।
আর লেখাপড়া।
আমি তো তোমার মত মেধাবী নই, বিয়ের পরদিন বইখাতা পুরানো কাগজ কেনে ওদের কাছে বিক্রি করে বাচ্চাকাচ্চার মা হব।
লজ্জায় এতোটুকু হয়ে যায় অরণি, অথচ আবিদা কত সহজে কথাগুলো বললো।
প্রেমের চেয়ে সত্য কিছু নেইরে অরণি। আমার সমস্ত পৃথিবী জুড়ে হাসেম।
অরণি তাকিয়ে থাকে আবিদার চোখে। স্বপ্ন গলে গলে ঝরছে শ্রাবণের বারিধারার মত। অরণির চেনা পৃথিবীতে এতো সুন্দর নারী কখনও দেখেনি। কত সুখী আবিদা। অরণি ওর বায়োলজি আর কেমিস্টি বইয়ের পাতায় এমন কোনও সূত্র পায়নি যা দিয়ে সমীকরণ করে এই মুখের। ফেরার আগের রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো কাজলের। উথাল পাথাল জ্বর। বাবা ডাক্তার ডেকে আনলেন, তিনদিন তিনরাত ঝাড়া জ্বরের পর শেষ রাতেরদিকে জ্বর বাবাজির উর্ধমূখী যাত্রা থামিয়ে দেয়। আবিদা আর হাসেমের থাকার সময় পার হয়ে গেছে আগেই শুধু কাজলের জ্বরের বাড়াবড়ি আঁটকে রেখেছিল ওদের।
বাবা শর্ত সাপেক্ষে ওদের যাবার অনুমতি দিল, যেয়েই যেন কাজলের বাড়িতে খবর জানায় ওরা। ব্যাস্ততায় চিঠি আর টেলিগ্রাম করা হয়নি। কাজল থেকে গেল, জ্বর পুরোপুরি সেরে গেলে ও একাই যাবে।
পুরোপুরি জ্বর সারলো আরও তিনদিন পর।
দুপুরে কাচকলা দিয়ে মাগুর মাছের ঝোল মেখে ভাত খাচ্ছিল কাজল তখনই গেটের কাছে রিকশা থেকে নামে কাজলের বাবা।
সব শুনেছে হাসেমের কাছে অরণির বাবা মায়ের সেবাযত্নে যে তার ছেলেটি এ যাত্রা রক্ষা পেল, যতটুকু বুঝতে পেরেছিল এখানে এসে দেখলো অনেক বেশি।
কিভাবে কৃতজ্ঞতা জানাবে ভাষা খুঁজে পায় না।
পুত্র তো সুস্থই হয়ে গেছে কাজলের বাবাকে তখুনি ছেড়ে দিলেন না। একটাদিন ওরা থাকলো অরণিদের বাড়িতে।
বিকেলে শাড়ির দোকানে গিয়ে কাজল টাংগাইল তাঁতের শাড়ি কিনে আনে চমচম কিনে আনে।
অরণি শুধু কষ্টই দিয়ে গেলাম।
বিছানার চাদর পাল্টাতে গিয়ে চোখ তুলে তাকায় কাজলের দিকে।
পাশাপাশি দুটো মায়াবী সাগরের তল খুঁজতে থাকে কাজল।
যা দিয়ে গেলেন সেটা এই ছোট্ট জীবনের পরম প্রাপ্তি।
অরণি শাড়িটা পছন্দ হয় তোমার। আমার খুব প্রিয় রঙ।
নতুন পাতা রঙের শাড়ির প্রান্ত ছুঁয়ে আছে সোনালি পাড়।
আরে খুব সুন্দর তো। কার জন্য এটা।
তোমার জন্য।
দু-পা পিছিয়ে আসে অরনি, তিরতির করে কাঁপছে ওর চোখের পাতা, বুকের রক্ত দ্রুত বইতে থাকে, অনিবার্য দ্বিধা ওকে জড়িয়ে ধরে তবে নিরিড় ভালবাসার স্বর্গীয় সূধা ছড়িয়ে পড়ে।
নেবে না নাও।
আমি!
হ্যা তুমি।
কেন নেব।
হ্যা তাই তো কেন নেবে। ময়মনসিংহ আসছো যেন কবে। হ্যা আগামী সপ্তাহে তো। ব্রম্মপুত্রের বহমান জলের দিকে তাকিয়ে আমি জানাব তুমি কেন নেবে শাড়িটা, তখন তোমার পরনে থাকবে এই শাড়ি।
ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরণি ওর সামনে দাঁড়ানো এক প্রেম দূতের দিকে অরণির ভেতর থেকে হৃদয় উথালপাতাল করে বের হচ্ছে দীর্ঘদিনের জমে থাকা এক নিবিড় আশা।
নাও শাড়িটা।
প্রেম বাতাসে উড়তে থাকা অরণি দাঁড়ায় কাজলের সামনে, সচেতন হয়ে পড়ে।
আজ না, শাড়িটা থাকুক আপনার কাছে, এখন বাড়ি ভরা মানুষ কথা ওঠবে।
একদিন আগে শাড়িটা দিয়ে যাবেন আমি পরে যাব ব্রম্মপুত্রের তীরে, প্রকৃতি সাক্ষি থাকবে কেন আমি আপনার দেয়া উপহার নেব ।
এক সপ্তাহ আর ফুরায় না অরণির, কবে পরবে কচি পাতা রঙের শাড়িটা। কবে ওর হাত দুখানা ধরবে কাজল। কে আগে জানাবে ভালবাসার কথা।
অরণি কিভাবে বলবে কাজল তোমাকে ভালবাসি।
কি লজ্জা কি লজ্জা!!
মরি মরি!!
থাক তারচেয়ে কচিপাতা সবুজ শাড়িতে ঘোমটা টেনে ডানহাতটা এগিয়ে দেবে কাজলের দিকে যা বোঝার বুঝে নেবে কাজল।
হোষ্টেলে এসেছে কলেজ খোলার আগেরদিন বিকেলে,
কাটবে না করেও ঠেলে ঠেলে বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়েছে, সন্ধ্যা রাতের চাকা ঠেলে দিনের দোরগোড়ায় এনেছে সময়ের গাড়ি।
আবিদার দেখা নেই।
কি হল, ওর অসুখ করলো নাকি? না হাসেম ভাইয়ের সাথে বিয়ে হয়ে গেল।
পরদিন সকালেই খুশিতে ঝলমল করতে করতে অরণির পাশে এসে বসে আবিদা।
পুরো তিনটা দিন যা আনন্দে কেটেছে আবিদার। আরে শুধু কি আনন্দ প্রচন্ড ব্যস্তও ছিল।
আবিদার খালাতো বোন মানে হাসেমের বোন এই শহরের সেরা সুন্দরীর সাথে কাজলের বিয়ে হয়েছে তিনদিন আগে।
কার বিয়ে?
কাজল ভাই আর হিমু আপুর বিয়ে।
সমস্ত পৃথিবী দুলে ওঠে অরণির সামনে , আকাশ গুড়ো গুড়ো হয়ে চূর্ণ হয়ে পড়ে ওর শুষ্ক সাগরে।
সরে যায় আবিদার সামনে থেকে একেবারে হোষ্টেলে নিজের রুমে।
কেউ রুমে ছিল না,
প্রাণ খুলে কাঁদে অরণি, কার জন্য ফিরে এলো!
বিকেলে একা একা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে চোখ পড়ে গাছের শাখা থেকে বের হচ্ছে নধর বরণে নবীন পাতা। ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। দুটো নখ নিষ্ঠুর অস্ত্রের রূপ নিয়ে এগিয়ে যায় নরম পাতাগুলোর দিকে। পট পট ছিঁড়ে ফেলে কয়েকটা, আরেকটা কুশির দিকে নখ সমেত হাত এগিয়ে যেতেই কানে বাজে রাগ ভৈরবী সুরে ভালবাসি ভালবাসি… না কেউ কোথায়ও নেই অরণিকে ভালবাসার। কে বলে ভালবাসি।
চারদিকে তাকিয়ে দেখে আশেপাশে কেউ নেই দূরে ছাত্রীরা সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যাস্ত।
তাহলে কে বললো ভালবাসি।
ওর সামনে অলকানন্দার গাছ। প্রতিটি পল্লব থেকে কুশি বের হচ্ছে।
তাহলে কে বললো ভালবাসি!
হঠাৎ মনে পড়ে ওর কাছে একটা ক্যরোলিনের ওড়না আছে খুবই শক্ত একবারে দড়ির মত শক্ত।
একবার ঠিকঠাক মত পরলে মুহূর্তেই শেষ হয়ে এই পৃথিবী। এই কঠিন পৃথিবীতে কেউ আর ওর ভালবাসি শব্দটা অলকানন্দা গাছের কুশির মত দু’নখে ছিঁড়ে ফেলতে পারবে না।
দু’হাতে দু’কান ধরে
দৌড়ে রুমে এসে টিনের ট্রাঙ্ক খুলতেই বের হয় অ্যালবাম তার নিচে ওড়না। ওড়না বের করার জন্য টান দিতেই এ্যলবাম খুলে যায়। দোলনা আপার ছবি। হাসছে। ছবিটার নিচে তার ভার্সিটির বন্ধুদের ছবি।
ওড়নার নিচে একটা ফাইল।
তিনটি বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেয়ে এসএসসির দ্বার পেরিয়েছে ও।
দোলনা আপার ছবি আর মার্ক সিটের তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওড়নাটা ট্রাঙ্কের নিচের দিকে ঠেসেগুঁজে রেখে দেয়।
দোলন আপা হাসছে ওর চোখে চোখ রেখে, ওদের পাড়ার সবচেয়ে মেধাবী মেয়ে। অরণির আইডল।
মার্ক সিটে মায়াময় হাতের পরশ রাখতেই ওর শিরদাঁড়া দিয়ে সাহসের স্রোত বইতে থাকে।
ওর জন্য আছে আগামীর পৃথিবী। আছে অলকানন্দার ভালবাসি।

ছবিটার দিকে তাকায় অরণি, এই ছবিটাই তো সেদিন ওকে পথ দেখাতে বাতি উঁচু করে ধরেছিল।
এ্যলবাম রেখে আলমারি খুলে বের করে নতুন একটা শাড়ি।
কচি পাতা রঙের সোনালি জরি পাড় শাড়ি।
আজ পরবে অরণি ওর ভালবাসা রঙের শাড়িটা…🦋

 

 

 শারদ কবিতা /তিন 

দেবারতি দে 

ছবি 

অগত্যা
ছবি আঁকতে চাই –

একটা আমলকী
একটা চন্দন বৃক্ষ
একটা প্রত্যাখ্যাতা নদী

জলরঙে লেখা থাকবে ডাক নাম।

 

জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়

আত্মজা 

স্রোতকে ধরিনি, যদিবা ধরেছি
গলে যায় অজস্র ফাঁকে ছবিরা অস্থির
অস্থায়ী চপল বাতাসের আঙুল
অজানা আবহ-অবরোহে ভোলায় রাগমালা
কোন চলন বাদী- সমবাদী স্বর
যার জন্য বসে উজ্জ্বল জানালা উদাস কপাট
ছুটে চলা পাহাড় নদী সমুদ্রের মুখোমুখি
ভাবনা ও ভাবের রহস্য গভীর তবুও
অধরা হতাশে একটিও কবিতা হয় না

ঘরের কবিতাটি স্টিকারবিহীন
কেউ এসে দাঁড়ায় শুধু রাগ শুধু হাসি
নির্ভুল শাসনবাক্য
আপাতকঠোর সেই এক মায়াবী কবিতা
অদ্ভুত মায়াটান মায়ামুখ

জনয়িতার শ্রেষ্ঠ কবিতাটির নাম দুহিতা

 

রথীন বন্দ্যোপাধ্যায়

শিরোনামহীন কবিতা 

১.

মাংসের দাম বেড়েছে।

তবুও মানুষ মাংস খাচ্ছে।

মানুষেরা তাদের উপার্জিত সব অর্থ মাংস ও মশলা কিনতে ব্যয় করছে।

মশলার ঝাঁঝ হাওয়ায় ভাসছে।

মটন চিকেন সবদিকেই সেই ঝাঁঝ উড়ে যাচ্ছে।

মানুষেরা নিজের মাংসের সাথে অন্যের মাংস এবং ছাগল মুরগি ইত্যাদি নিরামিষাশীদের মাংস নিয়েও ঘোরাফেরা করে।

ছাগল মুরগিরা তা করে না।

২.

সদ্য একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেল এই চৌরাস্তার মোড়ে।

এইখান থেকে যে রাস্তাটি সোজা উদ্যানের দিকে চলে গেছে সেইদিকে মেঘ নীচু হয়ে এসেছিল।

উদ্যানে কোনও ফুলগাছ না থাকায় বৃষ্টি হয়নি।

উদ্যানে বেশ কয়েকটি হুইলচেয়ার ছিল বলে অনেকটাই ঝুঁকে এসেছিল মেঘ অভ্যাসবশত।

বৃষ্টি হয়নি।

চৌরাস্তার মোড় থেকে জীর্ণ ফুলবাগিচার দিকে যে রাস্তাটি গেছে সেদিকে এখন আর কোনও প্রতিবন্ধী যায় না।

৩.

কান্না এগিয়ে যায় সূর্যোদয় থেকে যতদূর হাইওয়ে।

ঘেমে নেয়ে ট্রাকগুলো যতদূর যায় ততদূরই ছায়া।

সূর্যাস্তের পরে কোনও ছায়া থাকে না।

সূর্যাস্তের পরে শুধুই অন্ধকার।

কান্না এগিয়ে যায় যতদূর অন্ধকার।

যে কোনও অন্ধকার মানেই ছায়া নয়।

৪.

আমার চুম্বন গ্রহণ করো লাল শৌখিন মাছের মতো ঠোঁট।

এ কথা বলতেই অ্যাক্যুরিয়ামের মাছ আরও রঙিন হয়ে উঠলো।

চুম্বনাগ্রাসী এই ঠোঁট তবুও বারবার অ্যাক্যুরিয়ামের স্বচ্ছ কাচে প্রতিরুদ্ধ হয় মায়াবশত।

রঙিন মাছেরা জলকেলি করে মায়াবী কাচের আড়ালে।

ফলত পরিণামে আমাদের সবকিছুই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।

৫.

চৌকো শহরটিতে আমার ছিল নিখুঁত পিথাগোরাসীয় রাস্তা পার্ক আবাসন সিনেমাহল।

চারকোণা বাসযোগ্য ঘর শপিংমল ছিল সরলরৈখিক সান্ধ্য ও প্রাতঃকালীন ভ্রমণ।

আয়তকার এই শহরবাসী আমার ছিল নির্দিষ্ট ব্যসার্ধের শান্ত দিন ও রাত্রিযাপন।

এভাবেই বেশ চলছিল।

আচমকা একদিন একটি সরু অথচ বেপরোয়া নদী ঢুকে পড়ল এই শহরে।

ভারী বৃষ্টি হলে এখন আমার শহরে বন্যা হয় রাতারাতি ওলোটপালোট হয়ে যায় যাবতীয় জ্যামিতি।

 

রাহুল শীল

ডারউইন 

যদি এমনও দিন আসে আবার অশ্রুগ্রন্থি ভিজে যাবে
আপনার কারণে,
তাহলেও কোনো অপবাদের কাছে আশ্রয় নেব না
এই আমার প্রতিশ্রুতি কোনও দিন গোপনেও লিখব না
আপনার ভেতরের হিংস্রতা,
এমন কোনও কৌশল নেব না যাতে বোঝা যাবে
যন্ত্রণার পেছনের মানুষটি স্বয়ং কে!

এবার আপনি শান্ত হোন,
ঘুমান ,সময়মতো সুগার-প্রেশারের টেবলেট নিন
দুশ্চিন্তার টানেল থেকে বের হয়ে মুক্ত নিঃশ্বাস ফেলুন
দেখবেন ভালো লাগবে পৃথিবী।

ভয়ানক পরিণতির ছকে
নীরবতার সুযোগে ,
যে নিপুণতা দেখিয়েছেন
তা এখনো প্রশংসা করি।

মনে রাখবেন ডারউইন এখন আর বেঁচে নেই,
কিন্তু তাঁর আন্তঃপ্রজাতিক সংগ্রামে লেখা আছে
আমাদেরকে যেভাবে খাচ্ছেন, একদিন
আপনিও খাবার হবেন কোনো বিশেষ শক্তিশালীর কাছে।।

অক্ষত

দুঃখপরবর্তী দৃশ্যে চেয়েছি তোমাদেরকে
শোক প্রকাশের মতো দয়া দেখাওনি কেউ,
এই উন্মাদ বালক সুড়ঙ্গের ভেতরে হেঁটেছিল
আলো হাতে কেউ দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবে !
দেখেছে আলোর উৎসে দাঁড়ানো আছে যে প্রাচীর
তার গায়ে লেখা আছে পৃথিবীতে কেউ কারোর নয়!!
তবুও
আমার সমস্ত অক্ষরকে অক্ষত রেখো তোমরা।।

 

বন্দনা বর্ধন  

স্মৃতির রৌদ্র 

 

টি র্শাটের রঙটি গভীর আঁধার ঘেরা
গা ঘেঁষে বসতেই  ইতিহাস সামনে
পুরোনো দিনের একটা অংশ
মেঠো গন্ধ মোহ মৌমাছির দলের অন্যতম

এখন প্রাক্তন প্রেম কাহিনির গল্প
বারো বাই ষোলোর বন্ধ দরজার ভিতর
আলমারির খাঁজে একটা পাঠ ভাঙা শাড়ি
স্মৃতি হয়ে আজও রয়ে গেছে

দুয়ারে খোলা রৌদ্র আলতো ছোঁয়া
উড়ো চিঠি লেখা আছে সেই সব দিনের জাদু মাখা মাখনের ব্রেকফাস্ট
আদরের আবডালে গভীর রাতে ভালো লাগা

 

তাহমিনা সুলতানা

তবুও জীবন 

সন্ধ্যা শেষে রাতের খামে
আকাশ থেকে গল্প নামে
নীড়হারা চোখ যদি সজল
আকাশ মেঘে কালো কাজল

মেঘের জলে নৌকা কে বায়?
বারেবারে হারিয়ে যায়
ঝর্ণা যেন রানী সেজে
নদী হয়ে চলছে বেজে

মুখগুলো যে পাখির মতন
বৃষ্টি এলেই দিঘি তখন
এই দিঘিযে আপন আমার
সময় যখন জলে নামার

রোদ্দুরের এই কেমন করা
মন -পবন যে দিচ্ছে নাড়া
ভালোবাসার প্রবল তাড়া
তবুও জীবন স্বপ্ন ছাড়া।

জল ছুঁয়েছি

ভুলে যাবো তোমার মতো
বৃষ্টি ছিল সেই বিকেলে
মনে আছে সেই বিকেলটা?
ভুলে গেছ সবটাই শেষে?

একটা রাতে মনে পড়ে
চাঁদের ছায়া বুকের ‘পরে।
বজ্রপাতে ঝলসে যাওয়া
রাতের ঘোরে সন্ধ্যা ঝরে।

আজ আমিতো আবার একা
ছায়াটুকু হারিয়েছি
পেন্সিলে তাও একটা নদী
হাত দিয়ে তার জল ছুঁয়েছি।

হঠাৎ

কি পেয়েছি এই জীবনে?
কেন চিন্তা ঘুরছে আবার!
আলো দিয়ে সাজাই সময়
মৃত্যু এসে দেয় অন্ধকার!

তবুও কেন চাইছে এই মন
শুধু শুধু চাইছে জীবন
বাবুই বাসা বুনছে গোপন
কি আশ্চর্য মনের পবন!

কিছুই পাইনি এই জীবনে?
সত্য কিংবা কল্পনাতে
সুখের দহন আনেনি কি-
দিনের সূর্য মধ্য রাতে?

ধ্যাত্তুরি ছাই, ভাবছি কি সব
তবুও চাইছি একচালা ঘর
সন্ধ্যা হলে, হোক্ হঠাৎ ঝড়
সবটা তছনছ, সবটা নিথর।

 

বাবলু সরকার 

অধিকার

১.
ওর সামনে গেলেই
গাছগুলো কেমন ভরাট হয়ে ওঠে

জানি এই গাছকে ছোঁয়ার
আমার কোনও বৈধতা নেই

তবু তাকে পাবার আশায় রোজ
নতুন নতুন ঢোং রচনা করি ওর পেটে

ওর গুড়ি ওর ডালপালা কী করব
কোনও প্রতিজ্ঞাই খাটে না যে আমার

ভেজা অথবা শুকনো পাতা বাল্কল ত্বক
তরুনাস্থি আমাকে পাগল করে দেয়

তাই কোনও বৈধতা নেই জেনেও
বৃষ্টি সর্দি উপেক্ষা করেই আমি
গাছের সাথে স্নানে নেমে পড়ি আমি

তার বাকলে আঁটা দেহটাকে নিয়ে
ভালোবাসার স্নানের ঢোং রচনা করি

২.
ঘুমের মধ্যেও
গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াই
তার পাতা ছিঁড়ি গন্ধ শুঁকি খুনসুটি করি

ঘুমাই
ঘুমাই না বারে বারেই জেগে উঠি
জাগিয়ে দেয় গাছটার ডাগর ডাগর চোখ
স্তনের মতো তার ছাল বাকল ওয়ালা
কান্ড গুড়ি রোম

মধ্য রাত হোক কিংবা ভোর
যখন তখনই আমার ঘুম ভেঙে যায়
ঘুম ভাঙলেই আমি এক ছুটে চলে যাই
গাছটার নিচে গাছকে জড়িয়ে ধরি

মনে হয় কোন ষোল বর্ষীয় তরুণী কিশোরী
আমার সম্মুখে আমার প্রেমের পাত্রী হয়ে
মিটি মিটি চোখ নামাচ্ছে আমার দিকে মাঝরাতে

.
তুমি হাঁটো
আর রাস্ত তৈরি হয় আমার

তুমি আদর দাও
আর হৃদয় বড়ো হয় আমার

সন্ধ্যে হলে ও পথে
বাড়ি ফিরে আসি আমি

অন্ধকার কে লুকিয়ে রাখি পথে
শুধু তোমার মুখের আলোটুকু নিয়ে আসি ঘরে

কাকে ভালোবাসবো বেশি আমি
তোমাকে নাকি তোমার মুখের থেকে
নিয়ে আসা আলোকে অথবা তোমার
হাঁটা পথে তৈরি হওয়া আমার রাস্তাকে

তাই যা পাই তাই নিয়ে থাকি
সারাদিন তোমার কথা ভাবতে ভাবতে
দিন গড়িয়ে বিকেল হয় আর
শব্দ সাজাই আমি এবার বলো

এই আমাকে ভালোবাসো তুমি
কেউ বলুক বা না বলুক আমি যে ভালোবাসি
তোমার পাগলামি আর রোদ জল ঝড়ে
সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকা আমার
ছোট্ট ছোট্ট আদরের গাছটি হয়ে

.
একদিন আদর না দিলে
রাতে বাড়ি ফিরে ঘুম আসে না

আর আকাশের নক্ষত্রগুলো
ছুটে ছুটে হাহাকার জাগায় মনে

সারাদিনে যে কতবার তোর বুকে
হাত ও মুখ দিই ঘেটে দিই হস্তীর মতো
পদ দুটো আর তোর শরীরে বেড়ে ওঠা
যৌন পিঁপড়ে গুলো কে খুঁটে খুঁটে খাই

বর্ষায় মাটির মতো তোর প্রকৃতি
আমি ইচ্ছামতোন ধান রুয়ে দিই

আর বছর শেষে তোর শরীরে
ফসলে ফসলে অগ্রহায়ণের মাঠ
হয়ে যায় আমার দেহ মন শরীর

৫.
আমি নিমিত্ত মাত্র
আমার আমিকে আজই বিসর্জন
ওর জতু গৃহে

গনগনে আঁচের আগুন নিয়ে
কী নির্বিকার বসে থাকে একটা
হাঁড়ির সমান তাল গাছটা

লম্বা মাথায় বাবুই যেতে পারে
আমি নিমিত্ত মাত্র যাব কী প্রকারে

অসহায় ওর মুখের দিকে মুখ করে
বসে থাকি কখন একটু দয়া করে
কাছে ডেকে নেয় হাতটা ধরে নিয়ে
ওই গনগনে আগুন আমাকে পুড়িয়ে দেয়

নিমিত্ত মাত্র আমি আমার আমিকে
বিসর্জন দিতে চাই ওর ওই
পাললিক শিলার সাংঘাতিক আগুনে

যা জীবাশ্ম থেকে ঘেঁটে এনেছিল
সেই অস্ট্রালোপিথেকাস মানুষ

৬.
না একবারও কাছে আসেনি
আসার চেষ্টাও করেনি

আমি মৃদু দুএকবার চেষ্টা করলাম
কিন্তু না বৃথাই চেষ্টা কালো গম্ভীর
মুখ পুরো উত্তর মুখো হয়ে দক্ষিণ
মেরুতে অবস্থান করলো ঘন্টা দু’য়েক

এরপর মনে হয় না উত্তর বা দক্ষিণ
মেরুর বনিবনা হবে কখনো

অন্তত আমার তো আর ইচ্ছে নেই
ওর মুখো দর্শন করি কখনো
বা চেয়ারটাকে কাছে টেনে নিয়ে

ওর গালে নাকে ঠোঁটে পেটে ঊরতে
হাত বুলিয়ে দিই ওকে উত্তেজিত করি

স্থবির পাথর মূর্তি আমার
আমার প্রাক্তন কষ্টিপাথর
কষ্টিপাথর হয়েই থাক প্রাক্তন
প্রেমিকার মতো মাঝরাতে

৭.
ঠিক আছে দরোজাটা খোলাই থাকবে
আমিও দূরে থাকবো

শাখাপ্রশাখা থেকে অনেক দূরে

ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল
যাতে তোর পাতা বেয়ে বেয়ে
আমার মাথায় না পড়ে

শুকনো মরু মাটির মতো তাপ প্রবাহে
দাঁড়িয়ে থাকবো সারাদিন

চাতক পাখির মতো চাইব না জল
তুই কাছে থেকেও
অনেক দূরে বসে থেকে দেখবি
আমার মৃত্যুর মৃত্যু ক্ণা

ভীষ্মের মতো শুকনো গলায়
একটু একটু করে ঢলে পড়বো
আমি মৃত্যু শলাকায় আর তুই তোর
গাছ বাবা গাছ মা হাতের তালির
মধ্যে দিয়ে আমার মৃত্যু কে

স্যালুট জানাবি তবু তোর
জলকে আমি স্পর্শ করবো না

 

 

তপনকান্তি মুখার্জি

দৃষ্টি

নিশীথ রাতের আধমরা চাঁদে আমি মায়ের রক্তহীন ফ্যাকাশে মুখ দেখি। সে মুখ জেগে জাগে রুমালে আঁকা প্রজাপতির মতো। যখন সঙ্গী থাকে তখনও, যখন নিঃসঙ্গ তখন তো আরও আরও।

অশ্রু

চোখের জল শুকিয়ে আসছে। চেয়ে থাকি অন্তর গহনে। ভাঙতে ভাঙতে কখনও হলুদপাখি, কখনও মৎস্যকন্যা। যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ মাথায় ঢোকে না কিছুই। নড়ে ওঠে অক্ষিগোলক। আনন্দ-বেদনায় খটখট বুকের অন্দর। চোরাস্রোতে ভাসে দুই চোখ। তবু ভাসমান শূন্যতা ছলছল হয় না কখনও।

বিশল্যকরণী

শিয়রে সোনার কাঠি আছে ভেবে প্রতিরাতে ঘুমে যাই আমি। নীলপরি, চাঁদ ঘিরে থাকে আমাকে। তারপর শূন্য দুহাত মুঠিভরে তুলে নেয় স্বপ্ন। স্বপ্নশেষে শরীর ঠান্ডা,বুক খাঁ খাঁ। বিশল্যকরণীর সন্ধানে উঠে দাঁড়াই। শরীর থেকে যদি খসে হাভাতে অভাবের দিন।

আগমন

মা চলে যাবার পর সংসারের ধর্মীয় পরম্পরা রক্ষার ভার পড়েছে স্ত্রীর ওপর। পুজোর ঘট মাথায় নিয়ে স্ত্রী যখন নদী থেকে বাড়ি ঢোকে, তখন প্রতিবারই মাকে দেখি পিছন পিছন আসছে গংগার মতো নাচতে নাচতে।

 

কামরুল বাহার আরিফ

পথটাকে চিনে রেখো

পথটাকে চিনে রেখ
এই পথ হয়ত বদলে যাবে
এখানেই একটা দরজা ছিল
শিউলি বৃক্ষ তলে।
শরৎ হয়ে আসতে যখন
তোমার চুলে ঝরা শিউলিরা আটকে থাকত।
সুরভে সৌরভে তুমি আকাশ হয়ে যেতে
আমি উড়তাম অসংখ্য ডানায়…

একদিন শিউলির মত আমার ডানা থেকে
খসে পড়তে থাকে পালকেরা
পালকগুলো জড়িয়ে নিতে নিতে
তুমি বহমান নদী হয়ে গেলে;
আমি তখন আকাশের দূরত্বে
পালকহীন এক অচিন পাখি।
পাখিটার এক চোখে নদীর ঢেউ
অন্য চোখে পথ
নদী ও পথ ভিন্নতায় বয়ে যায়
তবু দু’টো চোখ নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে—
অনন্ত অপেক্ষায়।

চোখটা ঘোলা হয়ে গেলে পথটা বদলে যায়
নদীও বাঁক বদলায় নদীর নিয়মে।
তবু, পথটাকে চিনে রেখ
কখনো যদি প্লাবনের জোয়ারে ভেসে আসো,
এই স্বপ্নবোনা দরজা
খুলে যেতে পারে ফের। তারপর
ফিরে যেতে চাইলে— যাবে
শুধু ঢেউ থেকে পালকগুলো তুলে
আবার বুনে দিয়ো পাখির ডানায়।

 

ফাল্গুনী চক্রবর্তী 

মার্চ ফার্স্ট 

 

সবুজের মার্চ ফার্স্টে

স্মিথ সাজানো শিলং কন্যা

কলার ছড়িয়ে যেটুকু

খোসা মন

তার আলাপন নিয়ে নামে

বৃষ্টির রামধনু

পাহাড়ের জিয়া

এই জল তরঙ্গের সংক্রান্তি ঘিরে

চল শ্রাবণের সিলসিলা

ফুলের পাঁপড়িতুল

নকশা হয়ে নামে

ইচ্ছার তারাপক্ষ

হরিয়াল জ্যামিতি ফাইলে

ঢেকে যায় লেইটলুমে’র গ্রাম

আকাশে রাখা ময়ূরী পালক

 

ফটিক চৌধুরী

মায়াকাজল

তুমি ঘুমিয়ে পড়লে গাছের ছায়ায়
ক্লান্তি শুষে নেয় গাছ নিজের মায়ায়।

গাছ দিয়ে যায় শুদ্ধবায়ু ফুল ও ফল
মনুষ্য আমরা পরে থাকি মায়াকাজল
গাছ নিয়ে যা কিছু চর্চিত সব পণ্ডশ্রম
আমাদের মগজে এখনও মায়াবিভ্রম!

বনবাস

বাসা বদল করেছি অনেক
শেষে পেয়েছি নিজস্ব ঠাঁই
কোথাও থেকেছি ক্ষণেক
স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াই।

আর ফেলে যাই শুধুই দীর্ঘশ্বাস
শরীর আসলে কিছু না, বনবাস।

উদাসীন

দুর্বল মেধা নিয়ে জন্মেছে পৃথিবী
নিজের কথা সে যায় যে ভুলে
কথা জমে জমে হয়েছে উইঢিবি
দিয়েছে কেউ কথা তার কর্ণমূলে!

পৃথিবী এ সব নিয়ে খুব উদাসীন
তবু তার কাছে আমাদের কত ঋণ।

মহাকাল

মেঠোবাড়ি পেরিয়ে আমাদের মেঠো ঘর
লীন হয়ে থাকতো যেখানে সবুজ প্রান্তর।

এখন কি সেরকম আছে আমাদের গ্রাম
আছে সেই দড়ি দিয়ে বাঁধা খোড়োচাল?
অনেকদিন পর সেখানে গিয়ে শুধালাম
কালের গহ্বরে ঢুকে গেছে মহাকাল।

ফিরে ফিরে আসা

কেন তবে যাই যাই করো
কেউ কি সত্যিই যেতে পারে?
তুমি যদি শব্দের অর্থ ধরো
কেউ কি দরজায় কড়া নাড়ে!

যাই মানে তো ফিরে ফিরে আসা
লুকিয়ে থাকে গভীর ভালোবাসা।

চন্দনকৃষ্ণ পাল

তোমার জন্য শব্দ গাঁথা

 

ছদ্মনামটাও ঠিকঠাক নিতে পারলে না?
শূন্য পরিচিতি নিয়ে যত্রতত্র বড়াই তোমার!
এর ওর ছিদ্র খোঁজ সকাল দুপুর রাত
খোঁচানোর অস্ত্রটাও মরচে পড়া,ভোঁতা।

গভীরতা না থাকলে নীল জল পাবে না কোথাও
আমরা ওসব বুঝি-
পাণ্ডিত্য অন্য জিনিসি,তোমার কলসিখানা শূন্য হয়ে আছে
জলপূর্ণ করে তবে সাড়া দাও
তা না হলে শব্দ দূষণ নিয়ে আরো বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হবেে
এর ফল রক্ত চক্ষু,পারবে কী সেই হিম
ছুঁয়ে ছুঁয়ে পেরোনোর পথ বের করে
নিজেকে নিরাপদ স্থাপত্যে নিতে,পণ্ডিত প্রবর?

আর শব্দবন্ধ আমি তোমার জন্য ব্যয় করবো না জেনো
পাশ কাটিয়ে যাবো সবুজের দিকে
ধূসরকে বিসর্জন দিয়ে যদি সবুজকে পাই
হোক তা শিশুতোষ-
ওটাই আমার প্রিয়,তুমি থাকো মরুভূমি নিয়ে।

 

অপেক্ষা মাঝে মাঝে স্বস্তি এনে দেয়

ভাঙা কাচ ছুঁতে নেই,ওখানে ভয় জেগে থাকে
রক্ত পানের লাগি উন্মুখ হয়ে থাকে ধারালো সে ঠোঁট
ছুঁয়ে দেখলেই হলো,টকটকে লাল…

তাড়াহুড়ো করা ভালো নয়
এতে ভাঙচুর ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকে
না না মনের ভাঙচুর নয়,
সে এক অন্য কাহিনী
তার চোখে মাদকতা তোমাকে উৎসাহ দিলে
তোমারই তো দূরে থাকা শ্রেয়-
হৃদয়ের ভাঙচুর স্বাস্থ্যকর নয় জেনেও
ফিরে ফিরে দেখো,গন্ধ নাও অচেনা ডিওর
আবার উত্তাল হও,ভাঙচুর বাড়ে আর
রক্ত প্রবাহে পায় গতি।

সময়টা ভালো নয়,সবুজ অন্তর্হিত
ধূসরের প্রাবল্যে খাক হয়ে গেছে চারদিক
ক্রান্তিকালে পৌঁছে গেছে তোমার সময়
তাই ধীর পায়ে চলা ভালো,বলা ভালো ধীর কণ্ঠে
একটু সবুজ জড়িয়ে-

পরিবেশ ভালো হলে আবার সবুজ পাবে
অপেক্ষা মাঝে মাঝে স্বস্তি এনে দেয়।

উপলব্দি-১

তোমার চেহারাতে সেই ছাপ দেখি-
না বোধক বাক্যের এতো ছড়াছড়ি
কী করে মগজে রাখো এতো ঘৃণা,এতো অন্ধকার?

বিজয়ের ছায়া রেখে নামের সব অক্ষরে
ভালো কিছু হবে ভেবে যুক্ত করি নিজস্ব মননে
তারপর ক্রমশঃ প্রকাশিত হও-
শ্রাবণ অমাবস্যাকে হার মানিয়ে তুমি
আরো বেশি অন্ধকার ধারন করে আছ নিজস্ব মগজে।

কী বোকা, কী বোকা আমি
এখনও মানুষকে বিশ্বাস করি!
আলোকে আলোই ভাবি, মুখোশ ভাবি না
অযোগ্য দেহ নিয়ে বেঁচে বর্তে থাকা ভালো নয়
আজকাল মূল্যায়নে বুঝে গেছি
সন্ন্যাসব্রত নিয়ে জঙ্গলে চলে যাওয়া ভালো-

প্রস্তুতি নিতে হবে খুব দ্রুত লয়ে।

 

লিপি কাজী

বুকের বাঁ পাশে একটা ঘর 

বুকের বাঁ পাশে একটা ঘর
সাদা ডুপ্লেক্স, দখিনা জানালা
ইয়া বড় দুটো বারান্দা,
বেলীফুলের উন্মাতাল ঘ্রাণ।
সারাক্ষণ কাঁপে কেন?
কাঁপেনা জপে,দু’জনকে!
থাকব না।
এখানেও সাব্লেট?
না!
পারমানেন্ট?
হ্যা
চলে যাচ্ছি,
খাবার কুকুরের সাথে শেয়ার করি
শোবার ঘরটা চাই মন্দির হোক।
থাকুক পূজারীর দখলে।
সত্যি?
হু
তন্ত্র মন্ত্র শিখেছ?
হু
শেখনি
কেন?
শিখলে জানতে পারতে,
কি
হৃদবিদ্যা।
দেখতে পারতে
বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলা
প্রবাহমান নদী, রক্তের ধারা
শিরা উপশিরায়
দুটো নাম।
আবারও?
হুম
যাচ্ছি,
যাও
ফেরাবে না?
না।
মিথ্যে বলেছিলে ভালবাসো!
না
তাহলে?
দিব্যবিদ্যা শিখে এস
আসবনা।
আসবে।
পূজারী বীষমন্ত্র শিখলে
মন্দির ছাড়া বাঁচেনা।
ইচ্ছামৃত্যু নেব,ফিরব না।
ভুল করবে।
কী তার যোগ্যতা?
যাকে আমার জায়গা দিলে?
তাঁর যোগ্যতা অসীম, ব্রহ্মাণ্ড ছাড়িয়ে।
বুকের বাঁ পাশে একটা ঘর
দুটো বারান্দা।।

 

ইন্দ্রনীল গাঙ্গুলী

মনোরথ

এই ছিন্ন ভিন্ন সময়ে এত কাছে এসো না,
যতটা কাছে এলে লোকে কলঙ্ক দিতে পারে।
এই ছিন্ন ভিন্ন সময়ে এতো দূরে যেও না,
যতটা দূরে গেলে লোকে বিচ্ছেদ মনে করে।
আমার খুব ইচ্ছে করছে, দূরে চলে যেতে,
আমার খুব বেশি ইচ্ছে করছে, তোমারই কাছে থেকে যেতে আজন্ম কাল।

পিছু ডাক

হয়ত তোমাকে আটকানো প্রয়োজন।
এই যে তুমি আলু থালু শাড়ি গুছিয়ে,
সান্ধ্য কালীন বৃষ্টি পাত মাথায় করে,
এক বুক অভিমান নিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছ?
এবার হয়তো তোমাকে আটকানো প্রয়োজন।
অথচ তোমাকে পিছু ডাক ডাকতে আমার বাঁধছে,
কারণ ছেলে বেলায় মা শিখিয়েছিলেন,
পেছন থেকে ডাকলে নাকি অমঙ্গল হয়!

 

নাহারফরিদ খান 

অমাবস্যায় করো রাত্রিবাস

জোছনায় এমন নির্লিপ্ততা
অমাবস্যায় করো রাত্রিবাস
বিষাদ শিশির ঝরে টুপটাপ
নদী চোখে ধুয়ে যায় সন্তাপ!
সমান্তরাল হয়নাতো পথ
সোনালী রোদে যাপিত সময়
তবু কেন অমাবস্যায় প্রলাপ
প্রেম তৃষ্ণায় ঝরাও বিলাপ!
হাতের মুঠোয় পাবেনা জেনে
বৃক্ষের কাছে রাখো অনুনয়
বপন করো সোনালী স্বপন
মনকে বশ করো,করো সাধন।
ষোলআনা পাওয়া কেবা পায়
কারবা থাকে মুঠোবন্দি সুখ !
রবীসুরে সাজাও সান্ধ্য আসর
চাঁদনী আলোয় স্বপ্ন বাসর।

 

শোভন মণ্ডল 

সামাজিক অবক্ষয় বিষয়ক সভা

সামাজিক অবক্ষয় বিষয়ক আলোচনা সভায়
দর্শক সামান্যই
বক্তা পাঁচ-ছয় জন
নিটোল চিন্তার আগ্নেয়গিরি ভেদ করে ছড়িয়ে পড়তে চাইছে গরম শ্বাস

এখানে আলো কম
সারা সভা জুড়ে চাপা গুঞ্জন
ভাদ্রের উষ্ণতা অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ

প্রথম দু’জনের বক্তৃতা শেষে দর্শক গুটিকয়
উদ্যোক্তা মঞ্চ থেকে নেমে সিগারেট ধরালেন
বক্তারা বললেন অনেক কিছুই
প্রায় ফাঁকা সভায়

শেষ বক্তা  বলে গেলেন,  আশা করি এরপর আমাদের কেউ দোষ দেবেন না !

 

নিমাই জানা

তিন শরীর ও মেসোপটেমিয়ার জীবিত আত্মা সমগ্র

শরীরের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ২৯ কোটি মেসোপটেমিয়ার মতো কোন তরল পানীয় আগুনে গলিয়ে দিচ্ছে অ্যানারেইক্টাল অ্যানথ্রাসাইট কোকশাস্ত্রের স্নায়ুতন্ত্র ,

একটা মৃত পুস্তকালের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম উৎক্ষিপ্ত ২π কোয়ার্টজ আগুনের খনিজ গর্তে আমার মতো ১৪ জন একসাথে আগুনের বমি রেখে গেছে
মিথ্যা শুক্লপক্ষের আর কোনও যন্ত্রণা নেই, একটা জেলুশিল অ্যান্টাসিড গ্রানাইট পাথর খালি রক্ত জমার ধমনী আর টক্সিক পদার্থের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি কিছু বিভাজিকাহীন স্তনগ্রন্থির চারপাশে ফুটে ওঠা চর্ম রোগের বৌদ্ধভূমিতে হত্যা করি তিনজন কাপালিককে,
প্রমাণ সাপেক্ষে আমি কাটা মুণ্ডুটা জমা দিয়ে এসেছিলাম পাতালের কোন কসাই খানার কাছে, লাল ক্যাকটাস আমাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে এক অঘোষিত ক্রুসেডের শেষে
মায়াবী খেলার কাছে আর কোনও গন্ধ পুষ্প নেই,
একটা মেটাবলিজমহীন নারী চাকু দিয়ে নিজের প্রোক্যাম্বিয়াম ছিঁড়ে ফেলল, উচ্চ রক্তচাপ শুধু উচ্চ রক্তচাপ আর ঘোড়া ফাঁসির দড়ি ঝুলছে অথচ লাল পাতা বাহারের মৃত্যু হয়েছে গতকাল, আমি এইমাত্র নিজের আত্মাকে শক্ত করে বেঁধে রেখেছি একটা ফাঁসির দণ্ডের নিচে, যারা সাদা জামরুল খাওয়ার নামে পচা মাংসের টুকরোগুলো খেয়ে ফেলেছিল তাদের লিঙ্গদণ্ডের চারপাশে ভারখায়ানক্স ঝুলছিল,  আমি অবৈধ হয়ে যাওয়ার পর নিষ্ঠুর জলপ্রপাতে অবৈধ শাঁখামুটি সাপেদের সঙ্গম দেখেছি

 

শীর্ষেন্দু সেনগুপ্ত 

যাত্রা 

অনন্ত যাত্রা পথে নীল ডানা মেলার অপেক্ষা।

মৌলিক বেদনা এখন শুধু একক চাওয়ার নামান্তর।
ভিড় করে আসা আশাগুলো ক্রমশ হাতছানি দেয় –
ভাঙা মুহূর্ত গুলোর জুড়ে যাওয়ার ব্যর্থ আবেদন।
এখন শুধু তিল তিল করে গড়ে তোলা মুহূর্তের বিসর্জন।
যেতে এবার হবেই-
শেষের প্রতি এতো আকর্ষণ-
এ যেন কোনো এক শুরুর নামান্তর মাত্র।
যাব যাব করেও যাওয়া না হয়ে ওঠা-
একাকীনি বিরহী প্রেমের শীর্ণতা-
টানে শুধুই টানে এক বাধা হয়ে।
আমার আমিত্ব হারিয়ে যায় তার করুণ পরিণতি ‘পরে।
গুমরে কেঁদে ওঠে ক্ষত বিক্ষত মন।
তবু অনন্ত এর পথে যাত্রার অমোঘ আকর্ষণ।

শর্মিষ্ঠা ঘোষ 

টুকরো 

বাস্তবে তোমার কোন স্থায়ী ট্যাটু নেই
চরিত্রের প্রয়োজনে ডান ঠোঁট বা ঠোঁটের তিল
তোমার কোন রগরগে প্রেম ঘিনঘিনে অপ্রেমও নেই
আসলেই কোন স্থায়ী ইমেজ নেই তোমার
তারপরও যা আছে তারপরও যেটুকু মালিকানা
কিছু কিছু তালকানা আজীবন ভজে যাব
সেটুকুই কানাকড়ি বিশ্বাস সেটুকুই নামমাত্র ঈশ্বর

*

গলার কাছে গুটলি পাকা কিসব
ক্ষোভ অভিমান দুঃখ যা-ই বল
রোদ সেঁকেছি বিমর্ষ ঘরবাড়ি
সুখেই আছি বললে বলতে পার

*

চিতার আগেই পুড়ে যাচ্ছে শব
অর্ধ দেহ আগুন আদর পাবে
এর জন্যই এত্ত কলরব!
এর জন্যই প্রাণের মহোৎসবে ?

*

দু একটি কলমবাজি ভালোবেসে কিম্বা মন্দবাসায়
এই নিছক নেশা নেশা দোলাচল তীব্র আত্মরতিময়
কিছু অবসর ঝর্না ক্ষোভ দুঃখ ব্যথা অন্ধকার
উল্লাসে ছড়ানো ধুলো বসন্তের কোকিল বিলাপ
আদতে কিছু নয় ব্যক্তিগত অথচ দু বাহু ছড়ানো
আলিঙ্গন আগুন বিছানার অস্তিত্বের ঝুটা প্রদর্শন

*

আলোচনা শুরু হতেই ফেরার আভাস
লুফে নিচ্ছি প্রতিটা সুযোগ
কিছু নেই কিছু আছে কিছু থাকে পাতার খসায়
বুঝি কেউ সাথে সাথে ছিল আমিও তো সাথেই ছিলাম

 

 

 

 

 

গল্প 
___________

 

গন্তব্যহীন পথের যাত্রী

নাহিদ হাসান রবিন

 

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

দুঃখের সাগরে সাঁতার কাটতে কাটতে কোনও মানুষ যখন নরক যন্ত্রনায় ছটফট করে, তখন সে সুখের আশা ছেড়ে দেয়। আর এই সুখের আশা ছেড়ে দেয়া যে শুধুই কথার কথা, এটাও আমরা জানি। আসলে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই চায় একটু সুখ আর একটু শান্তি। এর জন্যই মানুষ যুদ্ধ করে যায় সমাজের সঙ্গে।  নিজের সঙ্গে। কেউ কেউ সুখের দেখা পায় আবার কেউ পায় না। তবে আশা ছাড়ে না কেউই। পোড় খাওয়া জীবনের ছন্দা কি কখনও ভেবেছিল, তার জীবন এমন নরকময় হবে। সেও তো কোনও বাবা-মায়ের আদর সোহাগ নিয়েই এই ধরণীতে এসেছিল। পরিবারের সাধ্যের মধ্যে ছন্দাকেও তো তার স্বাধ পুরণের চেষ্টা করেছে বাবা-মা। ভাই-বোন, বাবা-মা সবার সঙ্গে হেসে খেলে শিশু থেকে কৈশোর তারপর যৌবনে পা রেখেছিল ছন্দা। সে কি জানতো তার জীবনের এই ছন্দ একদিন বিষাদে রূপ নেবে।

অনার্সে পড়া অবস্থায় বলতে গেলে অনাকাক্সিক্ষতভাবেই একটি চাকরি হয়ে যায় ছন্দার। অনাকাক্সিক্ষত বলছি এ কারণে যে, চাকরির জন্য সেভাবে কোনও প্রস্তুতি ছিল না। চাকরি পাওয়ার কিছুদিন পর কিছুটা ইচ্ছায়, আবার কিছুটা অনিচ্ছায় শিশিরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শিশির আর ছন্দা একসঙ্গে পড়ে। শুরু থেকে সম্পর্কের মধ্যে ছোটখাটো ঝুট-ঝামেলা দেখা দিলেও, ছন্দাকে বিয়ে করার ব্যাপারে শিশিরের সিদ্ধান্ত ছিল পাকা। ছন্দা শিশিরের প্রতি কিছুটা আগ্রহহীন হলেও বন্ধু-বান্ধবদের চাপ আর শিশিরের পাগলামীর কাছে হেরে গিয়ে শিশিরকেই বিয়ে করে। জীবনের স্বপ্ন পুরণের আশা অনেকটা মলিন হয়ে যায় বিয়ের পর। নিজে আয় করলেও, মনে মনে স্বামীর কাছে বাঙালি নারীদের কিছু চাওয়া থাকে। স্বামী নিজেই ছাত্র। তাই বউকে কিছু দিতে পারা তো দূরের কথা, নিজের চলার জন্য বউয়ের টাকার উপর নির্ভর করতে হয়। এতে অবশ্য ছন্দার ভিতরে ভালোলাগাই কাজ করে। তবে শিশিরের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর যখন কোন চাকরির ব্যবস্থা হচ্ছিল না, বসে বসে ছন্দার আয়ের টাকায় চলছিল, তখন মাঝে মাঝেই দুজনের হালকা কথা কাটাকাটি হতো। দু’জনের পড়ালেখা শেষ হলেও, শিশির ছন্দাকে তার বাড়িতে নিতে পারে না পারিবারিক চাপে। মেসে থাকতে হয় ছন্দাকে। দুর্বিসহ হয়ে ওঠে জীবন। শিশির না পারে বউকে বাড়িতে নিতে, না পারে বউকে নিয়ে আলাদা বাসায় থাকতে।

____________________________________________

জীবনের মাঝপথে এসে ছন্দার জীবন ওলটপালট করে দেয় রাজন। ছন্দা রাজনের মাঝে খুঁজে পায় এক অনাবিল তৃপ্তির ছোঁয়া। রাজনের নমনীয় কথা, ভদ্রতা, দায়িত্ববোধ এসব ভীষণরকম ভালোলাগে ছন্দার। ভালোবাসার বন্ধনে জড়ানোর পর রাজন প্রথম যেদিন ছন্দার মুখোমুখী হয়েছিল, ছন্দার ভেজা চুলের ঘ্রাণ রাজনকে মাতোয়ারা করে তুলেছিল।

____________________________________________

একটা সময়ে শিশিরের একটি চাকরি হয়। ছন্দাকে রেখে শিশির চলে যায় ঢাকায় চাকরি করতে। জেলা শহরে মেসে থেকে চাকরি করা ছন্দার কাছে শোভনীয় দেখায় না। এই শহরে শ্বশুড়বাড়ি হলেও, সেখানে থাকার সুযোগ নেই। অগত্যা সামাজিকতা রক্ষার জন্য চলে আসে বাবার বাড়িতে। সেখানে থেকে চাকরি করে। কিন্তু বিয়ের পর বাবার বাড়িতে মেয়েদেরকে আসলে মানায় না। পাড়া প্রতিবেশি বা নিজের ভাইবোনদের মাঝেও এটা নিয়ে কানাঘুষা হয়। ছন্দা এসব বুঝে বাবার বাড়ির পাশে একটি বাড়ি কিনে সেখানে থাকে। এদিকে স্বামী বেচারা প্রতি সপ্তাহে তার শারীরিক ক্ষুধা মেটাতে বাড়িতে এলেও, সংসারের প্রতি তার কোনও মনোযোগ নেই। কখনো বউয়ের জন্য এক সেট পোশাক বা সখের কোনও কিছু কিনে দেয়া তো দূরের কথা, নিত্যদিনের কাঁচাবাজারও কখনও করে দেয় না। একটা যন্ত্রনাকাতর জীবন নিয়ে ছন্দার দিন কাটতে থাকে।

ছন্দার ঘরে এখন দুটো বাচ্চা। স্বামী বেচারা এখনও বউ বাচ্চার জন্য কোনও খরচ বহন করে না। মাঝে মাঝে একটু আধটু বাজার করলেও, তা উদাহরণ দেবার মতো না। তার আয়ের পুরো টাকা সে মা আর ভাইবোনদের পেছনে খরচ করে। মা বলতে সৎ মা। সৎ মায়ের প্রতি এতটা দুর্বলতা একটি বিরল ঘটনা। নিজের আয়ের টাকা বউ বাচ্চার পিছনে খরচ করা তো দূরের কথা, মাঝে মাঝেই বিভিন্ন অজুহাতে বউয়ের কাছেই টাকা দাবী করে। সময় মতো সেই টাকা না পেলেও, অত্যাচারের শেষ থাকে না। শুধুমাত্র সামাজিকতার ভয়ে স্বামীর এমন অত্যাচার মেনে নেয় ছন্দা। পৃথিবীর কোনও নারী চায় না সংসার ভাঙতে।  তাই অত্যাচার মেনে নিয়েই চলতে হয় ছন্দাকে। ছন্দা এখন নিজের সুখের কথা ভুলে, দুটো বাচ্চাকে নিয়ে ভাবে কেবল। নিজের জন্য ভাবনা বলতে এবাদত বন্দেগী করে। ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলে।

জীবনের মাঝপথে এসে দেখা মেলে ছোটবেলার পরিচিত ছন্দার ভাইয়ের বন্ধু রাজন এর সাথে। ছন্দা যখন অনেক ছোট, রাজন তখন ছন্দাদের বাড়িতে যাতায়াত করত। তারপর অনেক বছর কোনও দেখা সাক্ষাৎ বা যোগাযোগ ছিল না। চলার পথে কোনওভাবে আবার রাজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ছন্দার। সেই থেকে যোগাযোগ হতে থাকে দু’জনের। দুজনের সম্পর্কটা এক সময় বন্ধুত্বে গড়ায়। অতঃপর প্রণয়ে পরিনত হয়।

ছন্দার সংসার অনেকটা নরকীয়। সংসারে সুখ না পেলেও, কিছু নারী নিষ্ঠুর হতে পারে না। ছন্দাও তেমনি নরকীয় সংসার ছেড়ে অন্য কিছু ভাবতে পারে না। পরিচিত দু-চারজন ডিভোর্সি নারীর করুণ জীবনযাপন দেখে আর পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে স্বামীর নানান অত্যাচার, জুলুম সহ্য করে সংসারের ঘানি টানতে থাকে। কিন্তু কথায় আছে না, নারীর মন! জীবনের মাঝপথে এসে ছন্দার জীবন ওলটপালট করে দেয় রাজন। ছন্দা রাজনের মাঝে খুঁজে পায় এক অনাবিল তৃপ্তির ছোঁয়া। রাজনের নমনীয় কথা, ভদ্রতা, দায়িত্ববোধ এসব ভীষণরকম ভালোলাগে ছন্দার। ভালোবাসার বন্ধনে জড়ানোর পর রাজন প্রথম যেদিন ছন্দার মুখোমুখী হয়েছিল, ছন্দার ভেজা চুলের ঘ্রাণ রাজনকে মাতোয়ারা করে তুলেছিল। হালকা প্রসাধনীতে সুরমা রঙের একটা সালোয়ার কামিজে জড়ানো ছন্দাকে দেখে বুকে নেয়ার লোভ সামলাতে পারছিল না রাজন। অবশেষে সকল ভয়, লাজ-লজ্জা উড়িয়ে দিয়ে ছন্দাকে বুকে টেনে নিয়েছিল রাজন। ছন্দাও কি এক মোহে রাজনের প্রস্তাবে তার বুকে গিয়েছিল। রাজনের বুকে ছন্দাও খুঁজে পেয়েছিল এক পরম তৃপ্তি। সংসার জীবনের কিছু অপ্রাপ্তির কষ্ট দূর হয় রাজনের। অপ্রাপ্তির জায়গাটুকু ভরে যায় ছন্দার সরল ভালোবাসার প্রলেপে।

ছন্দার হৃদয় জুড়ে এখন শুধু রাজন আর রাজনের হৃদয় জুড়ে শুধু ছন্দার অবস্থান। দু’জনের সংসারে সন্তান থাকায়, তারা বিয়ের চিন্তা করতে পারে না। দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে যায় দুজনের মন। এই প্রণয়ের ফলাফল ভয়াবহ রকমের খারাপ হবে এটা জেনেও, তারা সরে দাঁড়ানোর কোন সরু পথও খুঁজে পায় না। তারা এখন গন্তব্যহীন পথের যাত্রী। 🦋

 

 

 

 

গল্প 
___________

 

বলয় বন্ধনে

গোপা দেবনাথ

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

জ মহাষ্টমী, নিপা দুর্গাষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলী দিয়ে থালা হাতে তাড়াতাড়ি হাটা লাগালো বাড়ির দিকে। মেয়েকে নিয়ে যাবে তার মামার বাড়ি। প্রত্যেক বছর পুজোয় তার মামার বাড়ি যাওয়া চাই-ই। দাদু দিদার আদর তো আছেই, তাছাড়া মামার বাড়ির সামনেই বড়  প্যান্ডেলের পুজোর মজাই আলাদা। ফিরে নিপা পুজোর প্রসাদের থালা ঘরের ভিতরে রাখতে গিয়ে আবছা আলোতে দেখল কে যেন বসে আছে। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে জানালা খুলে আলো জ্বালিয়ে দিল। নিপা বসে থাকা লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই তার চেনা চেনা মনে হল, কিন্তু কোথায় দেখেছে কিছুতেই মনে করতে পারল না।

_____________________________________________

নিপা সম্বিত হারিয়ে অসারের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো অতীতের আরও কিছু কথা তার মনে পড়ছিল। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে নিজেও জানে না।হঠাৎ করে মেয়ের নাড়া খেয়ে নিজেকে ফিরে পেল সে

_____________________________________________

নিপা মনে করার আগেই অপর প্রান্ত থেকে প্রশ্ন এল, “চিনতে পারছো”? মনে হচ্ছে তোমার একটু অসুবিধে হচ্ছে, আমি বলি, তোমাদের বাড়িতে কাজ করত যে মালতি মাসি, আমি তার ছেলে সত্য। নিপা বলল,  হ্যাঁ,হ্যাঁ চিনেছি। তা তুমি এখানে? এতদিন পরে? মালতি মাসি তো তোমার কাছেই ছিল, এখন কেমন আছে? সত্য বলল, ‘মা নেই’ সেই জন্যই তো আমি তোমার কাছে এসেছি, মায়ের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে। মায়ের কাজ আগামী পরশু দশমীতে, সময় পেলে একবার এসো। এটাই তো আমার শেষ কাজ। তারপর বলল, আমাকে দেখে মনে হয় তুমি অবাক হচ্ছ, কোনও ধরাকাছা কিছু নিই নি। মা মারা যাওয়ার আগে বলেছিল কোনও নিয়ম পালন না করতে। প্রতিবেশীদের কারণে শুধু শ্রাদ্ধটাই করব। তোমার মেয়েকে দেখলাম, তোমার মতই হয়েছে। বেশ মিষ্টি মেয়ে। সে আমাকে ঘর খুলে দিয়ে বলল, কাকু বসো, মা এক্ষুনি এসে যাবে। আর বলল, মা এলে বলবে পাশে বুবলিদের বাড়িতে আমি আছি। নিপা মনে মনে ভাবল, দেখো মেয়ের কাণ্ড! যদি চেনা না হয়ে অচেনা কেউ হতো তাহলে? সত্য পকেট থেকে কিছু বার করে বিছানার ওপর রাখল, বললে,  ‘মা তোমাকে দিতে বলেছে’। নিপা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল- কেন? সত্য বলল, কাকেই বা দিতেন, আমি তো বিয়ে করিনি। আমি ভবঘুরেদের দলে নাম লিখিয়েছি। মায়ের কাজ শেষ হলেই বেরিয়ে পড়ব বিভিন্ন তীর্থস্থানে ,আশ্রমে, কখন কোথায় থাকব নিজেই জানিনা। নিপা বলল, তোমাদের বাড়িটা? সত্য বলল,  এক গৃহহীন গরীবকে দেব ঠিক করেছি, সেও এক অভাগী, কেউ নেই তার, আমার মা’র মত। বলা শেষ হতেই কোনও দিকে না তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সত্য।
নিপা নিঃশব্দে আনমনা হয়ে কি যেন ভাবতে লাগল।  নিপার পর পর মনে পড়তে লাগল ছোটবেলায় ফেলে আসা দিনগুলির কথা, মালতি মাসির কথা। নিপা শুনেছিল মালতি মাসি ভালো পরিবারের বউ ছিল।লেখাপড়া খুব একটা জানত না, তবে বাংলাটা ভালোভাবে পড়তে পারত। বড় সাধ করে মাসি তার একমাত্র ছেলের নাম রেখেছিল সত্যজিৎ।ডাক নাম ছিল সত্য। মালতি মাসির কাছ থেকে শুনেছিল সত্য পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। সত্য র বাবা মারা যাওয়ার পর সত্যর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর মাসি কাজ নিয়েছিল নিপাদের বাড়িতে। মাসি দেখতেও খুব ভালো ছিল। মাসি নিপাকে খুব ভালোবাসতো। না খেলে জোর করে খাইয়ে দিত। প্রায় রোজ স্কুল যাবার সময় নিপার চুল বেঁধে দিত। সত্য মাঝে মাঝে নিপাদের বাড়ি আসত। বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হলে এটা ওটা আনা বা দেওয়ার কাজও করে দিত। সত্য খুব ভালো ছেলে ছিল,হয়তো নিপার থেকে দু-চার বছরের বড়ই হবে। নিপার সত্যকে খুব ভালো লাগত। মাঝে মাঝে নিপা সত্যর সঙ্গে কথাও বলত। সত্যর সঙ্গে কথা বলা নিপার মা একেবারেই পছন্দ করত না। নিপাকে সত্যর সঙ্গে কথা বলার জন্য বকাবকি করত। কতদিন এমন হয়েছে মা’র কথায় রাগ করে নিপা রাতে খায়নি। নিপা তার মাকে বলত,  ‘কথা বললে কি হয়? এতে এত বকার কি আছে?’
মাধ্যমিক পাস করার সঙ্গে সঙ্গেই নিপাকে তার মামার বাড়ি পড়শুনো করার জন্য পাঠিয়ে দিল। যেদিন নিপা তার মামার বাড়ি যাবে, সেদিন সকালে মাসি একজোড়া সোনার বালা নিপার হাতে পড়িয়ে দিয়েছিল। নিপার মা প্রচন্ড রাগ করে সেই বালা নিপার হাত থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল।
নিপা দৌড়ে যায় খাটের সামনে। খাটের ওপর উপুর হয়ে হাতে তুলে নেয় বালা জোড়া। সেই চেনা বালাজোড়া দেখতে দেখতে নিপার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে। মামার বাড়ি থেকে পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরে আসে নিপা। নিপার মা নিপার বিয়ের সম্বন্ধ পাকা করে তবেই নিপাকে বাড়িতে আনেন। নিপার স্পষ্ট মনে আছে, বিয়ের পর নিপার বিদায়ের সময় মালতী মাসি কেঁদে ভাসিয়েছিল।পরে নিপা বাপের বাড়িতে এসে মালতি মাসিকে আর দেখতে পায়নি। জেনেছিল নিপার বিয়ের পর মাসি কাজ ছেড়ে দিয়েছিল।
নিপা সম্বিত হারিয়ে অসারের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। হয়তো অতীতের আরো কিছু কথা তার মনে পড়ছিল। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে নিজেও জানে না।হঠাৎ করে মেয়ের নাড়া খেয়ে নিজেকে ফিরে পেল সে। মেয়ে বলল, ‘মা,মা, ও-মা তুমি আজ মামার বাড়ি যাবে না?’ নিপা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে জলভরা চোখে বলল,  যাব মা, ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করে দে- সেদিন ছিল মহাষ্টমী, কিন্তু নিপার বুকে বেজে উঠল বিজয়া দশমীর বিসর্জনের বাজনা। 🦋

 

গল্প 
___________

 

মাটি

মিলা মাহফুজা

অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

ছোট্ট একটা হুইসেল বাজিয়ে ট্রেনটা স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ল। অল্প সময়ের যাত্রা বিরতি এখানে। যাত্রীর ওঠা-নামা একেবারেই কম। এখন কেউ ট্রেনে ওঠার ছিল না, শুধু একজন মাত্র যাত্রী নামল। আর নেমে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই ট্রেন ছেড়ে দিল। খুব ধীরে ধীরে স্টেশন পার হচ্ছে ট্রেনটা। যেন কাউকে ফেলে যেতে তার বড় কষ্ট হচ্ছে। অথবা আরও কেউ যেন আছে ট্রেনে উঠবার। যতক্ষণ ট্রেনটা দৃষ্টির আড়াল না হল ততক্ষণ সেদিকেই তিনি তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আরও কতক্ষণ থাকতেন জানেন না। হঠাৎ ‘আপনি কি ট্রেন থেকে নামলেন?’ প্রশ্নটা কানে যেতে সামনে তাকিয়ে দেখেন, তার থেকে হাত খানেক খাটো একজন লোক তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে তাকেই প্রশ্নটা করছেন।
তিনি মাথা দোলালেন, একই সঙ্গে মুখেও অস্ফুটে বললেন, হুম।
শুনসান প্লাটফর্মে যে কেবল তারা দুজনই রয়েছেন এই প্রথম খেয়াল করলেন আবিদ রেজা। লোকটার হাতে একটা লম্বা খাতা জাতীয় কিছু ধরা রয়েছে। অনুমান করলেন স্টেশনের কোনও কর্মচারি হবেন। কিন্তু নিজে থেকে সে বিষয়ে কোন প্রশ্ন করলেন না। লোকটা প্রায় ঘুরে গিয়ে হাঁটতে থাকলে তাকে অনুসরণ করবেন কিনা ভেবে ওঠার আগে লোকটাই আবার ঘুরে তার দিকে তাকালেন। এবং সন্দিগ্ধ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, যাবেন না?
আবিদ রেজা নিজেকে একই প্রশ্ন করলেন। যাবেন না ফিরে যাবেন? সতের বছরের নিস্পৃহতা, যা খুব কষ্ট করে রপ্ত করেছিলেন, কতটুকু দূর হয়েছে? গত কয়দিন যত বারই মনে পড়েছে তত বারই অবাক হয়েছেন। নিজের কাছেই প্রশ্ন করেছেন, কী করে পারলেন? উচিৎ অনুচিত পরের কথা, যা একদিনের জন্যেও অসম্ভব ছিল, তা সতের বছর পর্যন্ত টেনে নিলেন! কী বিশাল পাথর চাপা দিয়ে ছিলেন! যা নিজে থেকে নড়ে নি সতের বছরেও! তবু শেষপর্যন্ত সে অচলায়ন ভাঙবেন বলে মনস্থির করে আবার দ্বিধা কেন?
খানিক চুপ থেকে আগের মতোই মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, যাব।
লোকটা আবারও ঘুরে হাঁটা শুরু করার আগে বললেন, রিকশাগুলো সব চলে গেল বোধহয়। রাতে আর কোন ট্রেন থামবে না এখানে।
আবিদ রেজা ভাবলেন, আচ্ছা লোকটা তাকে নিয়ে চিন্তিত কেন? এখানে তার উপস্থিতি কি খুব বেশি অস্বাভাবিক?
ততক্ষণে বেশ কয়েক কদম এগিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। প্লাটফর্ম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকালেন। কাঁধ দুটো একটু ঝাঁকিয়ে এবার সোজা হেঁটে আবিদ রেজার চোখের আড়ালে চলে গেলেন।

______________________________________________

কৌতুহলী চোখগুলোকে উপেক্ষা করে আবিদ রেজা পা বাড়ালেন উত্তর পানে। তার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে ইজিবাইক। হিজাব মোড়া কলমুখর স্কুল ছাত্রীরা। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকান, কোথাও কোন মাটির ঘর চোখে পড়ে না। আদতে চোখই চলে না বেশি দূর।

______________________________________________

এবার নীরব স্টেশনের চারদিকটা ভাল করে দেখলেন আবিদ রেজা। অনুজ্বল আলোয় যেন ঝিমাচ্ছে। কয়েকটা কুকুর শুয়ে আছে। বেঞ্চের উপর একজন মানুষও বোধহয়। স্টেশনটার বয়স তা প্রায় ১০০ বছর, তবে ততটা জ্বরাগ্রস্ত হয়নি। কোনও পরিবর্তনই হয়নি। বৃটিশ স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছে পুরোপুরি। তিনি পা বাড়ালেন লোকটা যেদিকে গেছে সেদিকে। যা ভেবেছিলেন, স্টেশনের বাইরে চায়ের একটা দোকানে তখনও চুলোয় কেটলি চাপানো রয়েছে। স্টেশন এলাকায় গভীর রাতেও চায়ের পিপাসা পায় কারও কারও। তবে এখন দোকানটা একদম ফাঁকা। তার দিকে উৎসুক মুখে তাকাল চাওয়ালা। হয়ত তাকে খদ্দের মনে করছে। তিনি সেদিকে না গিয়ে বাঁয়ের পথে এগোলেন। একটু এগোতে আচমকা স্টেশনের লোকটা খাতা হাতে পাশে এসে পড়ল।
তাকে বেশিক্ষণ কৌতুহলে পুড়তে না দিয়ে আবিদ রেজা বললেন, অনেকদিন পর এলাম। কাছেই সুবর্ণপুর যাব।
এত রাতে সুবর্ণপুর যাবেন? কেন কোন খারাপ খবর?
-না, ট্রেনটাই তো এলো এখন। রাত তো বেশি হয়নি। হেঁটে যেতে ঘণ্টাখানেকের বেশি লাগার কথা না।
-তা-ও এতটা পথ এই রাতে একা হেঁটে যাবেন? এবার রাগ রাগ নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আপনি কে জানতে পারি? সুবর্ণপুরে কেন যাচ্ছেন?
লোকটার অযাচিত এই অন্তরঙ্গতায় বিরক্ত হবার বদলে আবিদ রেজা মৃদু হাসলেন। সেটা অবশ্য লোকটার গোচরে পড়ল না। তবে একটা উত্তর আশা করছেন দম আটকে তা বুঝতে পারেন আবিদ রেজা। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোনদিকে যাচ্ছেন?
-আমি কোনদিকে যাচ্ছি তা জেনে আপনার লাভ হবে না কোনও?
-কিন্তু আপনি তো আমাকে ফলো করছেন।
আমি ফলো করছি? আপনাকে কেন ফলো করতে যাবো আমি? আশ্চর্য!
-আপনি কিন্তু রেগে উঠেছেন। রাগ করবেন না। আপনি আছেন সেটা আমার ভাল লাগছে। শুধু বুঝতে পারছি না… না মানে আপনি অন্যদিন নিশ্চয় এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যেতেন।
এতক্ষণে আটকে রাখা দম জোরে ছেড়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, আপনি অচেনা জায়গায় এসেছেন। তাও আবার একা। এবং এত রাতে। আপনাকে ঠিক খারাপ লোক বলে মনে হচ্ছে না। তাই ছেড়ে যেতে পারছি না। আমাদের এলাকায় এসেছেন, কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে পরে নিজের কাছে খারাপ লাগবে। তাই আপনাকে সুবর্ণপুরগ্রামে পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।
-মানে? বিস্ময়ে বিমুঢ় হন আবিদ রেজা। কিছু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, তার কোনই দরকার নেই। আমার কাছে দামী কিছু নেই। আর অনেকদিন পরে আসছি সত্যি কিন্তু এলাকা আমার অচেনা নয় পুরোপুরি। কতটা বদলেছে জানি না, তবু স্মৃতিতে যা আছে তা দিয়ে বাড়ি পৌঁছে যেতে পারব। রাস্তা তো একটাই, বেশি অসুবিধা হবে না মনে হয়।
আশ্চর্য লোক তো আপনি? এত রাতে আপনি একা হেঁটে যাবেন কেউ আপনাকে সন্দেহ করবে না, চ্যালেঞ্জ করবে না- ভাবলেন কী করে?
এবার আবিদ রেজা থমকে যান। ঠিক এই ব্যাপারটা তিনি চিন্তাই করেন নি। রাত নয়টায় একা শহরতলির পথে তিনি তো নিতান্তই আগন্তুক। সন্দেহ করতেই পারে স্থানীয়রা। এই লোকের প্রস্তাব এখন মেনে না নিয়ে উপায় নেই। কিন্তু পরে ইনিই বা একা ফিরবেন কী করে? উনারও তো বিপদ হতে পারে!
তাকে এতক্ষণে চিন্তিত হতে দেখে যেন ভদ্রলোকের উদ্বেগ দূর হল। বললেন, চিন্তা করবেন না, পথে আমার ছোট শালার বাড়ি পড়বে, ওকে সঙ্গে নিয়ে নেব। আমাকে তাহলে একা ফিরতে হবে না।
আবিদ রেজা টিমটিমে আলোয় রাস্তার খানা-খন্দগুলো এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন বলে চোখ দুটো পায়ের দিকেই থাকছে সারাক্ষণ। এবার মুখ তুলে বললেন, আমার নাম আবিদ রেজা। ঢাকা থেকে আসছি। এখন অবসরে আছি।
ভদ্রলোকের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, তিনি হাতটা ভালো করে ধরে বললেন, আহমেদ আলী। স্টেশন মাস্টার। ওদিকে রেল কোয়ার্টারে থাকি।
শুনে মনে পড়ল তার ছোটবেলায় স্টেশনমাস্টার ছিল তাদের কাছে হিরো। স্টেশনের টিকিটবাবু, মাল বাবু, টিসি, কুলি সকলে যাকে মাস্টারবাবু বলে ডাকত। মান্য করত। বিশাল একটা টেবিলের পেছনে উঁচু চেয়ারে বসে কাজ করত। স্টেশনে এলেই তাকে দেখা বাদ যেত না কিশোর আবিদের।
এখন সামনের সাদামাটা পোশাক পরা সাধারণ চেহারার মানুষটার মধ্যে কোনও জৌলুস পেলেন না। আপনমনে ছেলেবেলার সরলতার কথা মনে করে একটু হেসে বললেন, সে তো সেই ষ্টেশনের কাছেই কোয়ার্টার, আপনি আমার জন্যে এত পথ হাঁটছেন। আপনিই তো দেখি পুরো আশ্চর্যজনক মানুষ।
কথা শুনে আহমেদ আলী নির্জন রাস্তা কাঁপিয়ে হাহা করে হেসে উঠলেন। ‘ওই পাগলে পাগল চিনেছে আরকি। সামনের বছর আমিও রিটায়ারমেন্টে যাব।’
এইসব কথার মাঝেই তারা নামাপাড়ায় আহমেদ আলীর ছোট শালার বাড়ি পৌঁছে গেলেন। শালা রফিক ইসলামকে ডেকে আহমেদ আলী পরিচয় করিয়ে দিয়ে কানে কানে কিছু বললেন। রফিক মাথা কাত করে সম্মতি জানাল। মুখটা একটু অন্যদিকে ঘোরানো থাকলেও আবিদ রেজা তা টের পেয়ে গেলেন। তাই বাড়ির ভেতর ঢোকা আর দুটো ডাল ভাত খাওয়ার অনুরোধ শুনে বিস্মিত হলেন না। এবং খুব আপত্তিও করলেন না। খিদে পেয়েছে, রাতে খাওয়া পাওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। কিছু একটা খেয়ে রাত কাটাবেন ভেবেছিলেন, এখন খেতে বসে এতোটা খেলেন যে পরে মনে মনে লজ্জা পেলেন। হয়ত বাড়ির কাউকে অভুক্ত থাকতে হবে এই অযাচিত অতিথির জন্যে।
খেয়ে-দেয়ে বিদায় নেয়ার জন্যে উঠোনে নামতে গিয়ে আচমকা উল্টে পড়লেন আহমেদ আলী। তাঁকে টেনে তুলতে গেলে দেখা গেল পায়ে ভর দিয়ে তিনি দাঁড়াতে পারছেন না মোটেও। একেই বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। রফিক ইসলাম দুলাভাইয়ের পা ধরে টানাটানি করেও সেটা চলনদার করে তুলতে ব্যর্থ হল।
এবং এর অনিবার্য পরিণতি হল আহমেদ আলী রাতে সেখানেই থেকে যেতে বাধ্য হলেন। আবিদ রেজা অনেকক্ষণ আগেই ঘড়ি দেখা বাদ দিয়েছেন। ব্যথায় কাতর আহমেদ আলীকে বিছানা ওঠানোর পর তিনি কুণ্ঠিত হয়ে বললেন, আপনি ঝামেলায় পড়ে গেলেন আমার জন্যে। দুঃখিত, খুবই দুঃখিত আমি। সকালে যত তাড়াতাড়ি পারেন ডাক্তার দেখাবেন। আচ্ছা আসি তাহলে।
আবিদ রেজা কথা শেষ করার আগেই রফিক ইসলাম প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, আপনি কোথায় যাবেন? আর এতো রাতে গিয়েই বা কী করবেন? আমাদের এখানে রাত কাটিয়ে কাল সকালে চলে যাবেন। কষ্ট হবে আপনার। আমাদের তো ব্যবস্থা-ট্যবস্থা তেমন ভাল নয়।
ক্লান্তির জন্যেই হয়ত ভেতর থেকে প্রতিবাদের তাগাদা পেলেন না আবিদ রেজা। তিনি নিস্তেজ কণ্ঠে সামান্য আপত্তি জানিয়ে বসেই পড়লেন আলী আহমেদের বিছানার একপাশে। ঘুম আসার আগে, আলী আহমেদের কাতরানিতে সেটা সহজ হচ্ছিল না, তিনি ভাবছিলেন, একেই বলে ভবিতব্য। তার এখন কোথায় থাকার কথা আর কোথায় আছেন!
অঘোরে ঘুমিয়েছেন, রফিক ইসলামের ডাকে চোখ মেলেই টের পেলেন সূর্য আকাশের গায়ে গা ঘষতে শুরু করেছে অনেকক্ষণ আগেই।
আলী আহমেদ তখনও ঘুমিয়ে। রফিক ইসলাম বললেন, দুলাভাইকে ডাকছি না। ডাক্তার বিকেলের আগে পাওয়া যাবে না। যখন ইচ্ছে উঠবেন। আপনি নাস্তা করে নেন।
দরকার ছিল না- বলতে গিয়েও বলতে পারলেন না। একদম অচেনা একটা মানুষের জন্যে যারা একরাত অভুক্ত থাকতে কুণ্ঠা করেন না, তাদেরকে না বলা অপমান করার সামিল হবে।
ঢলঢলে খিঁচুড়ি আর চাকা করে কাটা বেগুন ভাজা। আর সুতোর মতো চিকন আলু ভাজা। আলু ভাজা মুখে দেবার আগে এর দৈর্ঘ্য প্রস্থের পরিমাপের সৌন্দর্যে চোখ আটকে থাকল কতক্ষণ। সকালে এত ভারি খাওয়ার অভ্যাস নেই। তবু হাতটাত ধুয়ে এমন সাড়ম্বরে বসলেন যে মনে হচ্ছে খাবারটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম ধোয়াওঠা খিঁচুড়ি। মুখে পুরতেই ঘিয়ের স্বাদ পেলেন। নরম খিঁচুড়ি মাখনের মতো টের পাওয়ার আগেই চলে গেল পেটে। এমন চিকণ আর মুচমুচে আলু ভাজা আগে কখনও খাননি। সত্যি খেতে খুব ভাল লাগল।
এই অপ্রত্যাশিত আপ্যায়নের বিপরীতে কী করা যায় ভেবে না পেয়ে আলী আহমেদের হাতে কিছু টাকা দিলেন, বললেন, সবটাই আমার কারণে ঘটেছে। আমি লজ্জিত ও দুঃখিত। ডাক্তারের কাছে যাবেন অবশ্যই।
আলী আহমেদ বিমুঢ় চেহারায় নীরব থাকলেন।
আবিদ রেজা তাকে ফোন নম্বর দিয়ে সবিশেষ খবর জানানোর অনুরোধ করে বেরিয়ে পড়লেন কয়েক ঘণ্টার নিবাস থেকে। রফিক ইসলাম বলেছিল, এখন আর হেঁটে না গেলেও চলে, ইজিবাইক সহজেই মিলবে। বাসও চলে। তিনি হাঁটবেন জানালে তাকে রাস্তার হদিস ভাল করে বুঝিয়ে দিয়েছে। না দিলেও হতো। মনে আছে অনেকটাই, যদি না খুব বদলে থাকে চিনতে অসুবিধা হবে না। এ পথের প্রতিটা ধুলি কণাও যে তাকে চিনত ভাল মতোই একসময়।
কাল রাতে যেমনটা মনে হয়েছিল, আজ দিনের আলোয় বুঝলেন তা ঠিক ছিল না। চারদিকে বদলে যাওয়ার চিহ্ন বেশ স্পষ্ট। পায়ের নিচে জেলা শহরের রাস্তা বেশ মসৃণ ও প্রশস্ত। ইজি বাইক, বাস চলছে অনবরত। রাস্তার একপাশ ধরে সাবধানে চলতে হচ্ছে তাকে। রাস্তার দুপাশে আগে বয়সী রেইনট্রি ছিল, তার চিহ্নই নেই। কোথাও মেহগনি, কোথাও আকাশি, কোথাও নিম, কোথাও তাল গাছের সারি। তাল গাছগুলো তেমন বড় হয়নি। বাজ পড়া ঠেকাতে তাল গাছের দরকার-ইদানিং বেশ আলোচিত হচ্ছে। তার জের হবে।
সবচেয়ে যেটা বিস্মিত করল, মাঠে চলছে ট্রাক্টর। জমিতে চাষ দিচ্ছে। কৃষি কাজ করা লোকের সংখ্যা ক্রমেই কমছে। ধান কাটার মজুর মেলে না। শুনেছেন ধান কাটার মেশিনও এসে গেছে বাংলার মাঠে। সকালের হালকা রোদ খুব দ্রæতই চড়ে উঠল। তবু দ্রুত হাঁটার জন্য ব্যস্ত হলেন না। গ্রাম বাংলা দেখতে যে কত সুন্দর তা কী ক্যামেরায় বোঝা যায়?
তাড়াই বা কী তার?
জেলা শহরের রাস্তায় উঠেছিলেন অনেকটাই আগে। রাস্তার পাশে কলার স্তূপ দেখে বুঝলেন, এটা কোন কলার হাঁট। এই সকালেই বেজায় শোরগোলময়। দু’একটা খালি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাপারী আর চাষীর মধ্যে দর কষাকষিও দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ শুনলেন আবিদ রেজা।
হাঁটটা পেরনোর পরই হঠাৎ থমকে গেলেন, ডানে ওই তো বাড়ির পথ। রাস্তার ধারে সড়ক বিভাগের নির্দেশনা বেশ স্পষ্ট। রাস্তা থেকে একটু ঢালুভাবে নেমে গেছে পথটা। সেটাও এখানে পাকা। তার দু-পাশে তৈজসপত্র, চাল-ডাল, মোবাইল আর চায়ের দোকান সার দিয়ে। চায়ের দোকানে ‘তু বাড়ি আনজানি হ্যায়’ গান বাজছে লাউডস্পিকারে। পথ চলতি তরুণদের অধিকাংশই কানে ধরে আছে মোবাইল। কথা বলতে বলতে তারা হাসছে রোমান্টিক হাসি। পরণে জিনসের প্যান্ট। টিশার্ট। কেডস পায়ে হাঁটছে সাবলীল। এরা কৃষিকাজ করে না বোঝাই যায়। শরীরে কায়িক পরিশ্রমের পোক্তা নেই। দোকান পেরিয়ে গঙ্গা ব্রিজ। ছোট্ট। নিচে নবগঙ্গার মরা স্রোত, কচুরিপানায় যা প্রায় অদৃশ্য। কোন নৌকা নেই, ডোঙাও নেই। রেলিংয়ে ঝুঁকে তবু সেই কালচে জলের ধারার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মনের ছবিটাই তুলে নিলেন চোখে। স্বচ্ছ কাকচক্ষু জলের নদী নবগঙ্গা। কুঠিবাড়ির ঘাট থেকে সাঁতরে চলে আসতেন ব্রিজ ঘাটে। বেলে, পাঁচরঙা খলসে, ঝাঁয়া আর পুটির ঝাঁক পাশ কেটে যেতো। ঝাঁকের তলায় গামছা ঢুকিয়ে ঝটিতে তুলে ফেললেই এক কোচড় মাছ। আবার ফিরেও যেতেন সাঁতরে। কোন কোন দিন পরনের ভেজা লুঙ্গি খুলে মাথায় জড়ানো শুকনো লুঙ্গি আর হাফ শার্ট পরে বাজার গিয়ে বসতেন। তখন চায়ের দোকান একটাই, হাবলুর। বুদ্ধি কম বলে তার ওই নাম। সেই বুদ্ধি নিয়ে চায়ের দোকান দিয়ে পাকা দোতালা বাড়ি, ধানের দু’বিঘে জমির মালিক হয়েছিল হাবলু। আজ তাকে চোখে পড়েনি। বেঁচে আছে তো?
কত বছর আগের কথা সে? হিসেব করতে ইচ্ছে করে না। পাপের হিসেব করে লাভ কী?
ব্রিজের উপর তার দিকে ফিরে ফিরে তাকায় পথ চলতি মানুষ। তারা কি এখনও গ্রামে যে কোন আগন্তুককে দেখেই ঠাহর করে উঠতে পারে ভিনদেশি বলে। ঠাহর শব্দটা মনে আসায় বিস্মিত হন আবিদ রেজা। এসব গ্রামজ শব্দ কত যতেœই না মুছে ফেলেছেন মনের শ্লেট থেকে। তাও ছিটকে পড়লে আজ! আসলে অতীত মোছা যায় না। অতীত ঘুমিয়ে থাকে অন্তরে।
কৌতুহলী চোখগুলোকে উপেক্ষা করে আবিদ রেজা পা বাড়ালেন উত্তর পানে। তার পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে ইজিবাইক। হিজাব মোড়া কলমুখর স্কুল ছাত্রীরা। হাঁটতে হাঁটতে চারপাশে তাকান, কোথাও কোন মাটির ঘর চোখে পড়ে না। আদতে চোখই চলে না বেশি দূর। রাস্তার দুধারে কেবল বাড়ি আর বাড়ি। নানা রঙের। একতলা বা দোতালা। বাড়ির প্রাচীরে রঙিন বড় বড় গেট। পকেট গেট কোনটার খোলা কোনটার বন্ধ। বোধহয় এখন আর কারও বাড়িতে হুটহাট ঢুকে পড়া যায় না।
ক’য়েককদম পরেই সুবর্ণপুরগ্রাম।
রোকেয়া মঞ্জিলের সদর দরজা হাট করে খোলা। প্রাচীরের উপর দিয়ে দালানবাড়ির ছাদের রেলিং চোখে পড়ছে। বিবর্ণ ভাঙাচোরা দশা। ডান দিকে পানিহীন শুষ্ক পুকুর, পুকুরের পাশে আমের নতুন চারা। একপাশে একটা কদবেল গাছে কদবেল ঝুলছে।
আবিদ রেজার ভেতর দ্বিধা ঢুকে পড়ে। বুঝে উঠতে পারেন না, ভেতরে সরাসরি ঢুকে পড়া ঠিক হবে কিনা। মানুষ জনের সাড়া শব্দও নেই। তবু গলা খাকারি দিলেন দু’বার। ‘কাকে খোঁজছেন?’ প্রশ্নটা আসে পেছন থেকে। আবিদ রেজা পিছনে ঘুরে দাঁড়ান। চিনতে পারেন না প্রশ্নকারীকে। ইতস্তত করে বলেন, ঢাকা থেকে আসছি।
কয়েক মুহূর্ত তার মুখের উপর চোখ গেঁথে রাখে প্রশ্নকারী। তারপর কিছু না বলে আবিদ রেজাকে অতিক্রম করে সামনের দিকে গিয়ে, ‘আসেন, ভেতরে আসেন’ বলে নিস্পৃহ গলায় আহ্বান জানায়। উঠোনে ঢুকে কয়েককদম এগিয়ে জোর গলায় বলে, ‘ও দাদি দ্যাখেন কে এয়েছে!
পাড় ছাড়া সাদা শাড়ি পরে শীর্ণকায় এক দেহ লাঠি ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসে, আবিদ রেজার সামনে এগিয়ে আসে অতীত। বিহ্বল চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি। সত্তর বছর বয়সে এক কথায় আয়েশের জীবন ফেলে চলে এসেছিলেন দৃঢ় পায়ে। এখন সেই পা বড় দুর্বল দেখায়।
কাছে এসে চশমাটা সরিয়ে আবিদ রেজার মুখে রাখেন দৃষ্টি। বলিরেখাময় মুখে না আনন্দ না বিষাদ কিছুই টের পাওয়া যায় না। আবিদ রেজা কিছু বলে ওঠার আগে ধীরে ধীরে রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আসছ? 🦋

 

 

গল্প
___________

 

পংক্তিরা

রেহানা বীথি 
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

 

রিক্সা থেকে নামতেই একজনের চোখে চোখ পড়ল। বছর ত্রিশ-এর একটি ছেলে। ভীষণ স্মার্ট। চোখে চোখ পড়তেই পরিচিতির হাসি ছড়িয়ে সালাম দিল। ইশারায় উত্তর দিয়ে আমি এগোলাম। কিন্তু পেছনে কারও হাঁটার শব্দ। ফিরে তাকাতেই দেখি, সেই ছেলেটি। বলল,

“আমাকে চিনতে পারেননি, তাই তো?”

অবাক হয়ে বললাম, “চিনতে পারার কথা তো নয়! তুমি আমার পরিচিত নও।”

“তাই মনে হয় আপনার?”

“নিশ্চয়ই। আমি তোমাকে কখনও দেখিনি।”

“কিন্তু একদিন আমরা একসঙ্গে কফি খেয়েছিলাম। সেটি ছিল এক ভয়ংকর সুন্দর সন্ধ্যা। আমরা মুখোমুখি বসে দীর্ঘক্ষণ গল্প করেছিলাম এবং কফি খেয়েছিলাম।”

“কিন্তু আমার কিছুই মনে পড়ছে না।”

“মনে না পড়ার কোনও কারণ দেখছি না। নিশ্চয়ই মনে পড়ছে। আপনি স্বীকার করছেন না, এই যা।”

আশ্চর্য তো! ছেলেটিকে আমি সত্যিই চিনি-ই না। ওর আত্মবিশ্বাস আমাকে বিভ্রান্ত করে তুলছে বটে, তবে চিনি না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

____________________________________________

ছেলেটি কিছু বোধহয় বলার চেষ্টা করছিল। কানে ঢোকেনি। যতটা দ্রুততার সঙ্গে বাড়ি ফেরা সম্ভব, ফিরেছিলাম। ফিরে মেয়েকে সব খুলে বলেছিলাম। ওরা দু’জন বোধহয় আর যোগাযোগ করেনি। কিংবা হয়ত করেছিল, আমি জানি না।

____________________________________________

অযথা সময় নষ্ট না করে হাঁটতে থাকলাম। দুপুরের পর আচমকা এক পশলা বৃষ্টিতে পথ ভিজে আছে। হাঁটতে গিয়ে আমার স্যান্ডেলের আঘাতে সেই বৃষ্টিজল ছিটে ছিটে শাড়িতে লাগছে। বিশ্রী অবস্থা। বাড়ি গিয়ে দেখব, পরনের সাদা শাড়িটার বারোটা বেজে গেছে।
পংক্তি বলবে, “মা, আর সাদা শাড়ি পরো না তো। আগেও কতবার বলেছি। দেখো না, সাদায় কত সহজে দাগ লাগে, নষ্ট হয়?”
কিন্তু মেয়েকে কে বোঝাবে, সাদায় আমার মন বসে আছে! সাদা ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ?

সদর দরজার কাছে আসতেই মাধবীলতা আর শিউলির সুবাস ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলাম। মেয়ে বাইরের বাতিটা জ্বালায়নি এখনও। কি করছে একা একা, এই সন্ধ্যেবেলায়?
ইদানীং ভীষণ মনমরা হয়ে থাকে। বলি, বাইরে যা, বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাঘুরি কর। না, যাবে না। ঘরেই থাকবে। কিছুদিন চাকরি-বাকরির চেষ্টা করছিল। এখন সেটাও বন্ধ করে বসে আছে। কী যে হয়েছে মেয়েটার! সদর দরজা খুলে বাগানে পা রাখতেই শুনতে পেলাম, “আপনার মেয়ের কী হয়েছে আপনি জানেন না?”

ঘুরে দাঁড়ালাম। গলির মোড় থেকে এ পর্যন্ত আসতেই একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে। তারওপর বাড়ির সামনের রোডলাইটটাও জ্বলছে না। তবে অবয়ব এবং কণ্ঠস্বর বলে দিচ্ছে,  কিছুক্ষণ আগে আমি যাকে চিনতে পারিনি,  এ-সেই ছেলে। কিন্তু… আমি মনে মনে কি ভাবছি, ছেলেটি জানল কেমন করে? আশ্চর্য তো!

“অবাক হচ্ছেন কেন? অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

হঠাৎ প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এ ছেলে বলে কী! সেই থেকে আমার পেছনে পেছনে আসছে। এখন আবার তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো করে কথা বলছে!
অন্ধকারের মধ্যে সোজা ওর চোখের দিকে তাকালাম। গাছের পাতারা শিরশির করে উঠল। হিসহিস করে বললাম, “কী চাও? কেন এসেছ?”

“দুটো প্রশ্নের উত্তরই আপনার জানা।”

হ্যাঁ, প্রশ্নগুলোর উত্তর আমার জানা। আর জানা বলেই ছেলেটিকে চিনতে পারিনি। মানে, চিনতে চাইনি। কিন্তু এ-কথা ওকে বুঝতে দিলে তো চলবে না। ওকে এড়িয়েই যেতে হবে। আমার একটি মাত্র মেয়ে। আমি চাই না, ওর জীবনটা তছনছ হোক। চাই না, আমার মতো সধবা অবস্থাতেই বৈধব্য এসে ওর জীবনের সব রঙ কেড়ে নিক।

ছেলেটি দাঁড়িয়েই আছে। বাগানে সন্ধ্যা গাঢ় হচ্ছে। বাগান পেরিয়ে আমি বারান্দার কাছে এলাম। ব্যাগ হাতড়ে চাবি বের করে দরজা খুললাম। শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে পংক্তি এসে বলল,
“দেখেছ, বারান্দার আলোটা জ্বালাতে ভুলেই গেছি। তুমি ভয় পাওনি তো মা?”

“তোমার মা ভয় পেয়েছেন পংক্তি। ভীষণ ভয় পেয়েছেন। দ্যাখো না, আমি কি দেখতে এতই ভয়ঙ্কর?”

ছেলেটির মুখে আলো পড়ে ঝলমল করছে। ছেলেটি হাসছেও ঝলমল করে। মনে হচ্ছে এ-হাসিতে কোনও পাপ নেই। শিউলি আর মাধবীলতার মিলিত সৌরভ আছে।
পংক্তি কি এখনও ভালবাসে ওকে? আজ, এই মুহূর্তে যদি ছেলেটি বলে,
পংক্তি, চলো, আমরা ঘর বাঁধি। তিন বছর আগে যে ঘর বাঁধা হয়নি, সে ঘরটা আমরা আজ থেকেই বাঁধব, চলো!”
বলতেই পারে। এবং এটা বলার জন্যেই ও-এসেছে। তিনবছর পর এসে আবারও তোলপাড় করতে চাইছে। সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর সন্ধ্যার মতো আমাকে, আমার মেয়েকে কাঁদাতে চাইছে।
সেদিনও এসেছিল একই প্রস্তাব নিয়ে। সেদিনের আগে ওদের ঘনিষ্ঠতা হয়। পংক্তি বলেছিল, ছেলেটি ভীষণ ভালো। ওকে খুব ভালবাসে। পংক্তিও।
আমি দেখতে চেয়েছিলাম, কথা বলতে চেয়েছিলাম। কফিশপে আমরা বসি। সন্ধেটা অদ্ভুত মায়াবী ছিল। পংক্তির গালে ছিল সেই মায়াবী আলোর আদুরে আভা। মনে হচ্ছিল বুঝি আকাশ থেকে কোনও পরি নেমে এসেছে। ছেলেটি পলকহীন দেখছিল ওকে। জানতে চাইলাম,
“তোমার নাম?”

বলল, “রুদ্র। বাবার নাম,  সাজ্জাদুর রহমান।”

আকাশ থেকে পড়লাম। আমাকে ধারণ করা চেয়ারটা যেন দুলে উঠল। কফির কাপ থেকে ধোঁয়া উড়তে উড়তে যেন ফেটে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বললাম,
“পংক্তি, বাড়ি চলো। এ-ছেলে তো মুসলিম।”

“তো কি হয়েছে মা? তুমিও তো মুসলিমকে বিয়ে করেছিলে। আমি তো তাঁরই সন্তান।”

পংক্তির কথাগুলো কানে বড় বেশি আঘাত করল। মেয়েটা কিছুই জানে না! মেয়েটা অনেক কিছুই জানে না আমার ও ওর বাবার সম্পর্কে। ওর বাবার পরিবার, সমাজ আমাকে মেনে নেয়নি। নানাভাবে অপমান, অপদস্ত করে আমাকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়।  স্বামী হিসেবে ওর বাবা আমার পক্ষে দাঁড়ায়নি। এমন ভাব করেছিল, যেন ওর কিছুই করার নেই। বললাম, 

“তুমি কিছু জানো না পংক্তি। বাড়ি চলো।”

ছেলেটি কিছু বোধহয় বলার চেষ্টা করছিল। কানে ঢোকেনি। যতটা দ্রুততার সঙ্গে বাড়ি ফেরা সম্ভব, ফিরেছিলাম। ফিরে মেয়েকে সব খুলে বলেছিলাম। ওরা দু’জন বোধহয় আর যোগাযোগ করেনি। কিংবা হয়ত করেছিল, আমি জানি না।

“মা, সবার জীবনে একই ঘটনা ঘটবে তার কোনও মানে নেই। তুমি নতুন করে আরেকবার ভেবে দেখো।”

পংক্তির কথাগুলো আমার মস্তিষ্কে মৃদু আলোড়ন তুলল। আমি কি ভুল করেছিলাম? তা নাহলে আমার মেয়েটা কেন আগের মতো আনন্দে নেই? থাকে না?

রুদ্র কখন যেন বারান্দায় উঠে এসে আমাদের মা-মেয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গলির মোড়ের মন্দিরে ঢাকে কাঠির আওয়াজ তরঙ্গায়িত হচ্ছে ধীরে ধীরে। পুজোর গন্ধ কুয়াশার মতো আমাদেরকে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ঢেকে দিচ্ছ। 🦋

 

 

গল্প 
___________

মনে পড়ে সেই সব দিনগুলি

মমতা রায় চৌধুরী
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব
র্ষার রেশ কাটতে না কাটতেই শরতের নীল আকাশে  পেজা তুলোর মতো শুভ্র মেঘের আনাগোনা, কাশফুলের সমাহার, বাঙালির আপনজনদের হৃদয়ে দোলা দেয় ঢাকের কাঠি বাদ্যি আর মায়ের আগমনী বার্তা। এই আগমনী বার্তা যেন প্রকৃতি জুড়ে। এসব ভাবতে ভাবতেই আগমনী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস আর মিষ্টি একটা গন্ধ তার শরীরের ক্লান্তি এক নিমিষে উধাও করে দেয়।
আজ শরীরটা ভালো নেই, মনটাও না। তারপর শরৎ বাড়িতে নেই। অফিসের কাছে ক’দিনের জন্য বাইরে গেছে আর আগমনী আজ স্কুলে যায়নি। সারাটা দিন যে কি করে কাটল মেঘ, বৃষ্টি, ঝড়-বাদলের সঙ্গে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না! এখন ওরা একটু বিশ্রাম নিচ্ছে। এই সময়টুকুতে যেন শৈশবের স্মৃতিগুলো ঘুরে  ফিরে পাক খাচ্ছে মনের ভেতরে। যেন রঙিন দিনগুলো রঙিন কৌশিক ধ্বজা উড়িয়ে নীলাকাশে পাড়ি জমিয়েছ পানসিতে। এ যেন মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় পিছু ডাকে আমাকে স্মৃতি ব্যাকুল করে তোলে।ছোটবেলায় কত দিঘির পা ড় জুড়ে কাশফুলের সমারোহ, পাশেই ছিল আমবাগান আর তার পাশে ছিল একটা ছোট্ট পুকুর তাতে পদ্ম ফুলের সমারোহ, উন্মুক্ত আকাশ। আর এরকম ধরিত্রীর অপরূপ সাজ সত্যি মন-মুগ্ধকর দৃশ্য। কাশফুলকে স্বাগত জানাতে মনের মধ্যেও যেন কেমন একটা পুজোর ঢেউ আসতে শুরু করত অপেক্ষার আর বেশিদিন নেই। তারপর বারোয়ারি পুজোতে আমাদের শৈশবের বন্ধুরা সবাই মিলে ঠাকুর দেখা অঞ্জলি দেওয়া সেই সঙ্গে চলত ধুনুচি নাচ। পলাশদা কি অপরূপ ধুনুচি নাচ নাচত।  শিমুলের সঙ্গে তো পলাশদার একটা আলাদা মাখোমাখো ব্যাপার ছিল। কিন্তু তারপরও পলাশদা যেন অনেকের মনেই একটা ক্রাশ ছিল। আমরা পলাশদাকে ছোট থেকেই দাদার মতো ভালবাসতাম। পলাশদা আমাদের সকলের জন্য আনত নারকেলের নাড়ু আর তিলের নাড়ু মাসিমার গড়ানো। আমাদের বায়নাই ছিল এটা। শিমুলের সঙ্গে কথা বলতে দেখলেই বলতাম,
“বলে দেব।” আর পলাশদা কাছে টেনে চুপি চুপি বলত,
“এই তো নাড়ু।” এগুলো টিপস। তারপর মুখে আঙ্গুল দিলেই বুঝতাম, কি বলতে চাইছে। আমরা মহা আনন্দে চলে আসতাম আর পলাশদা আর শিমুলদি  ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত। পরে ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। এই নিয়ে কম জলঘোলাও হয়নি!
_____________________________________________
ঘোষ পুকুরে বড় দিঘির পারে সবেদা গাছের ডালে ইমু পাখি দেখার কথা ক্লাসে এসে বলাতে কি অপ্রস্তুতি না হতে হয়েছিল। কিন্তু হীরক মাস্টারমশাই বলেছিলেন “এই খোলা মেলা পৃথিবী-ই সবচেয়ে বড়ো বই।”
_____________________________________________
কিন্তু পলাশদার একটাই আর্জি ছিল, শিমুলকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। পরে অবশ্য দুই পরিবার রাজি হয়ে গেছিল কিন্তু পলাশদার কিছু একটা না হলে শিমুলির বাড়ি থেকে চার হাত এক হবে না বলেই দিয়েছিল আর পলাশদাও এই নিয়ে কম টেনশন করেনি।
“তুমি একটু তাড়াতাড়ি কিছু করার চেষ্টা করো আমার বাড়ি থেকে কিন্তু বারবার বিয়ের কথা বলছে।”
“হ্যাঁ চেষ্টা তো করছি “, বলেই পলাশদা শিমুলের হাতটা ধরল।
পলাশদা ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল কিন্তু পলাশদার মাঝখান থেকে বাবা মারা যাবার পর তার উপর সংসারের সমস্ত দায়িত্বটা এসে পড়াতে একটু নিজের  লক্ষ্য থেকে দূরে সরে এসেছিল। শিমুলদিরও বিয়ে হয়ে গেল। পলাশদা শিমুলদির এই বিয়োগান্ত দৃশ্য আমরা কেউ মেনে নিতে পারিনি। আসলে আমরা ছোট ছিলাম। তবুও আমরা পলাশদা শিমুলদিকে হাসিখুশিতে দেখলে প্রাণটা জুড়িয়ে যেত। দু’জনে খুব ভালো মনের মানুষ ছিল। আজ কেন এসব মনে পড়ছে? আসলে শরতের আকাশ দেখেই যেন মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়। মনে পড়ে ইন্দুদের বাড়ি একটা বড় শিউলি গাছ ছিল আমরা শিউলি ফুল তুলতে যেতাম। তোলা ঠিক বলব না আসলে এত ফুল মাটিতে পড়ে থাকত। সেগুলো তুলে নিলেই হয়ে যেত কিন্তু শিমুলদির ঠাকুমা লাঠি হাতে বসে থাকতেন। আর আমরাও তেমন ত্যাদর ছিলাম, কখন ঠাকুমার একটু চোখ লাগবে শিউলি ফুল আনার জন্য আমাদের ঘুমই হত না। আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে পালা করে করে রাত জাগতাম। শুধুমাত্র ওই ঠাকুমাকে জব্দ করব বলে। তাই আজও সেই শিউলি ফুলের গন্ধ আর শরতের নীল আকাশ দেখলে মনটার ভেতরে কেমন ধুকপুক করে  আমাদের সেই আনন্দের দিনগুলো আজ কোথায় গেল? কাশফুল তুলে নিয়ে আমরা অপু দুর্গার মতো ছুট দিতাম দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে। সেই মাঠ-ই বা কোথায়! এখন আর সেই কাশফুলের সমারোহ-ই বা কোথায়? কমই দেখা যায়। আর একবার মনে পড়ে ঘোষ পুকুরে বড় দিঘির পারে সবেদা গাছের ডালে ইমু পাখি দেখার কথা ক্লাসে এসে বলাতে কি অপ্রস্তুতি না হতে হয়েছিল। কিন্তু হীরক মাস্টারমশাই বলেছিলেন “এই খোলা মেলা পৃথিবী-ই সবচেয়ে বড়ো বই।” অথচ এই মাস্টার মশাই বিভীষিকা স্বরূপ ছিলেন। মনে পড়ে আরও কত কথা। বিস্মৃতির অন্তরালে কত না সুখ দুঃখের স্মৃতি হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবুও গ্রামের ভিতর যেন আলদা একটা প্রাণ ছিল। যদিও এখন আমরা গ্রামে গিয়ে সেই সুখ পাই না। গ্রামের ভেতরে কত পরিবর্তন গ্রামের ভেতরে শহুরে বেনো জল এসে সহজ সারল্য মনোভাব কেড়ে নিয়েছে। আজ আর তার নিজস্বতা চোখে পড়ে না। তার  জৌলুস হারিয়ে  কৃত্রিম প্রসাধনী গায়ে মাখতে শুরু করেছে।
আমাদের দিনগুলো ভালই কাটছিল তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য আমরা শহরমুখী হলাম। শহরে গিয়ে তো প্রথম দিকে  গ্রাম বাংলার আটপৌরে স্বভাবগুলোকে আমরা ছাড়তেই পারছিলাম না তার জন্য আমাদের কম হাসির খোরাক হতে হয়নি। তাতে কি হয়েছে। তাকে আমরা বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছি। আজকে পাশের বাড়ীর জবাদের শিউলী গাছের ফুলের গন্ধ একটা মাদকতা ছড়িয়ে দিল সন্ধ্যের সময়টাকে। আর মনে পড়ে শিউলি কি কান্নাটাই না করত পুজোর দিনগুলোতে ওর বাবা যত ভালো জামাই এনে দিক না কেন সব সময় আমাদের জামার দিকে ওর নজর ছিল। তাই সারা পুজোটাই ওর চোখের জলে কাটত একবার তো আমার মা বলেই দিলেন
“এবার থেকে দাদা আপনি আপনাদের দাদাকে টাকাটা দিয়ে দেবেন। ও বাজার করে নিয়ে আসবে ।”
কিন্তু ওর মা একটু অন্যরকম ছিল কখনও চাইতেন না অন্য কেউ  জামাটা এনে দিক শিউলির চোখের জলের ধারা তাই বহমান থাকত আর আমরা নতুন জামা আনলেই পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম। নতুন জামা দেখার জন্য আমাদের নিজের জামাগুলো আগে দেখাব না, অন্যের জামা দেখে নেব তারপর নিজের জামা দেখাব, যদি পুরনো হয়ে যায়।
এসব মনে পড়তেই খিল খিল করে হেসে ওঠে আগমনী হাসির ঝর্ণা দেখে ছুটে আসে মেঘ বৃষ্টি ঝড় বাদল ওরা তাকিয়ে থাকে কেন? মনের ভেতর এরকম হচ্ছে আর লেজ নাড়তে থাকে ওরা! আগমনী বলে কি  বোকা বোকা ভাবনার মধ্যে দুবে ছিল তারা।
শুধু কি তা-ই আর রান্না বাটি, কিত কিত খেলা গোল্লাছুট। মনে পড়ে সেই শিউলীদের ভাঙা পাঁচিলের ধারে পাথরকুচি, কন্টিকারীর জঙ্গল সেখান থেকে সব্জি তুলে মিছিমিছি রান্নার আয়োজন। পুতুলের বিয়ে গোটা পাড়া নেমতন্ন আহা পুতুল বানাত শিমূলদির দিদি। লাইন পরে যেত। সেই আনন্দঘন সময়ের ইতি ঘটল উঁচু ক্লাসে ওঠার জন্য। মায়েরা ঘোর ষড়যন্ত্র করল আগমনীরা ঘুনাক্ষরে আঁচও করতে পারিনি।আর পারলেও বোধহয় তাদের শক্তি হার মানত।
সে দিনটার কথা আজও ভোলে। সেদিন ছিল দীপার মেয়ের সঙ্গে তার ছেলের বিয়ে কত কিছু ভেবেছিল ওরা স্কুল থেকে ফিরেই বিয়ের সব আয়োজন সম্পন্ন করবে। বাড়ইওভাতে ছাই। সেদিন সবাই মরা কান্না জুড়েছিল যেন মনে হয়েছে পাড়া শুদ্ধ শোকের মিছিল চলছে। মা তো কড়া ধমকের সুরে বলেছেন
“আর পুতুল পুতুল খেলা নয়। এবার নিজের পড়াশোনার দিকে ধ্যান দাও, নইলে আস্ত চেলা কাঠ এবার তোমার  পিঠে ভাঙব। মায়ের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কাকিমা, জেঠিমারাও এক কথা অন্যদেরকে বললেন। কে কার কথা শোনে! তাদের কান্নার রোল আরও হাজার গুণ বেশি হল কিন্তু কিছুই করার ছিল না। ভগ্ন মনে আবার যে যার নিজের ঘরে গিয়ে পড়তে বসেছিল। আর মনে মনে ঠিক করেছিল আবার শিমুলদির দিদির কাছে গিয়ে পুতুল বানিয়ে আনবে।আবার তারা পুতুলের খেলাঘর তৈরি করবে। কিন্তু না শিমূলদির দিদি আর পুতুল বানিয়ে দিল না। বুঝলাম ষড়যন্ত্রের শিকড় অনেকদূর এগিয়েছে।
কত কিছু মনের অজান্তে আজ ভিড় করতে শুরু করেছে এরই মধ্যে মেঘ বৃষ্টি ঝড় বাদল উচ্চস্বরের চেঁচাতে লাগল কিউ কিউ করে। তখন বুঝল ওদের দুধ খাবার সময় হয়েছে। আগমনী দুধ গরম করতে গেল ঠিক সেই সময়ে পাশের বাড়ি কান্নার রোল ভেসে আসল।
কানটা একটু খাড়া করে শুনল হঠাৎ কান্নার রোল কেন তবে কি মাসীমার কিছু হল? সে ওদের তাড়াতাড়ি করে গ্যাস চুল্লিতে দুধটা গরম করে নিয়ে দুধ খেতে দিল। তারপর জানলাটা খুলে বোঝার চেষ্টা করল, দেখল, ইতিমধ্যেই লোকে লোকারণ্য। তখন আর সে ঘরের ভেতরে বসে না থেকে নিজেই বেরিয়ে পড়লাম।  তালা চাবি লাগিয়ে কিন্তু একি শুনল পাপানদা মারা গেছে ছি ছি ভাবতেই পারছে না। তাহলে বৌদির কী হবে? ছেলে মেয়েটার কি হবে? শেষ পর্যন্ত কি তাহলে এখানেও সেই ষড়যন্ত্র উনিশ বছর আগে যে ঘটনা ঘটেছিল তারই কি পরিণতি। পাপ কখনও ছাড়ে না কিন্তু তা হলেও যে যাই করুক না কেন এত অল্প বয়সে চলে যাওয়াটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিল না। আগমনী সান্ত্বনার সুরে বলল, “বৌদি তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমার মেয়ে আছে, ছেলে আছে।”
“এভাবে চলে যেতে হল আমি একটু বুঝতে পারলাম না। আমি তো তোমাকে ওষুধ দিয়েছি পরপর খেতে। কেন এরকম হল আমার সঙ্গে? কেন এরকম হল মা জগদ্ধাত্রী এটা ঠিক করলে না।”
এরপর বাড়িতে লোকের লোকারণ্য হয়ে গেল আত্মীয়-স্বজনের ভর্তি হয়ে গেল। আগমনী ওখান থেকে চলে আসল। বাড়িতে এসে ভাবতে লাগল। এরকম দিনেই তো এই ঘটনা ঘটেছিল যেটা তারা মেনে নিতে পারেনি। আজও মেনে নিতে হচ্ছে সত্যি কি পরিণতি! কি স্ট্রাগল করতে হবে জীবনে বাবা ছাড়া পৃথিবীতে নিজের সংগ্রামের রাস্তা নিজেকেই তৈরি করে নিজের লক্ষ্যে যেতে হবে ।বর্ষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের জীবনের কথা আর একবার মনে পড়ে গেল। গতকালের যে মানুষটাকে দেখেছিল মিষ্টির দোকান থেকে কত রকমের মিষ্টি কিনে নিয়ে গেল সেই মানুষটারই আজকে এই পরিণতি? ঈশ্বর যে কার কপালে কি লিখে রাখেন ভগবানই জানে। শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলির সঙ্গে আজকের পিতৃ হারা বর্ষার শৈশবের কথাগুলো মনে পড়ছে। এরপর ওর জীবনটা কোন খাতে বইবে? কলিংবেলের আওয়াজ শুনে আগমনী যায় দরজা খুলতেই।
আগমনী দেখে শরৎ। শরৎ বলল,
“কি সব শুনছি?”
“হ্যাঁ ভাবা যাচ্ছে না।”
আগমনী দরজা বন্ধ করতে করতে কথা বলল।
শরৎ বলল, “দরজা বন্ধ ক’রো না, আমি একবার ঘুরে আসি। যতই হোক আমরা একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, একটু দেখে আসি ওকে।”
আগমনী আর কথা না বাড়িয়ে শরতের হাত থেকে  অফিসের ব্যাগটা নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখে। শরৎ বেরিয়ে যায় আগমনীও কেমন যেন আনমনা হয়ে যায়। আজ যেন হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। তাই মনে পড়ে “তোমায় নতুন করে পাবো বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণে।”
আজ বড্ড বাবার কথা মন জুড়ে, কাশফুলের মত দোলা দিচ্ছে মনাকাশে।আর বাবা যেন বলছে “আয় খুকু আয়…।”🦋

 

সাশ্রয় নিউজ পুজো ২০২৩ সংখ্যায় 

👉কার্যনির্বাহী সম্পাদক : সানি সরকার 

👉সহযোগী সম্পাদক : রাজেশচন্দ্র দেবনাথ, তাহমিনা শিল্পী 

👉ফটোগ্রাফি : তন্ময় দত্ত, সৌমিক দাস 

👉গল্প, কবিতা ও অন্যান্য অলঙ্করণ : প্রীতি দেব

সাশ্রয় নিউজ, ৫৭ বি.পি রোড। কলকাতা ৭০০০৪১, পশ্চিমববঙ্গ, ভারত।

স্থানীয় খবর পাঠান : ই-মেল : sasrayanews@gmail.com 

News Desk : 9734480882

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment