



তনুজা বন্দ্যোপাধ্যায় ★ সাশ্রয় নিউজ : এই সময়টাকে যেন এক শব্দে ব্যাখ্যা করা যায়, অস্থির (Restless)। না, শুধু বাহ্যিক ব্যস্ততা বা কাজের চাপ নয়, এটি এক গভীর, নীরব অস্থিরতা।আমাদের চেতনার অভ্যন্তরে গেঁথে বসেছে।

আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, তা কেবল আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সময় নয়। বরং এক অস্তিত্বগত দ্বন্দ্বের সময়। মানুষ এখন আর শুধু জীবিকার জন্য বেঁচে নেই, বেঁচে আছে একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ সত্তার দ্বন্দ্বে। মানুষ এই সময় নিজেকেই চিনতে পারছে না। এই অস্থিরতার উৎস কোথায়? কেন আজ পৃথিবীর সব সুযোগ-সুবিধা, প্রযুক্তি, ভোগ ও সম্পদের মধ্যে থেকেও মানুষ এতটা শূন্য বোধ করছে? তথ্য প্রযুক্তির বিকাশ মানুষের জীবনযাত্রাকে যেভাবে বদলে দিয়েছে, তা অভূতপূর্ব। এক ক্লিকে পৌঁছে যাওয়া যায় যে কোনও জায়গায়। এক সেকেন্ডে জানা যায় পৃথিবীর খবর। এক মুহূর্তেই কোনও সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় আবার ভেঙেও ফেলা যায়।
অস্থিরতার মধ্যে দিয়েই কি জন্ম নিচ্ছে নতুন এক উপলব্ধি? ইতিহাস বলছে, সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের পরেই আসে আলোর সন্ধান। হয়ত এই অস্থিরতাই আমাদের বাধ্য করছে নিজের ভেতরে ফিরে যেতে। বাইরে যখন কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, তখন মানুষ প্রশ্ন তোলে”স্থায়িত্ব কোথায়?”, “শান্তি কোথায়?”, “অর্থ কী?” এই প্রশ্নগুলো থেকেই শুরু হয় এক নতুন যাত্রা যেটা বাইরের দিকে নয়, ভেতরের দিকে। আর সেই ভেতরের যাত্রাই পারে মানুষকে স্থির করতে, গভীর করতে, নির্ভার করতে। এই সময় অস্থির, কারণ এই সময় আত্মিক শূন্যতায় আক্রান্ত।
এই গতিশীলতা একদিকে যেমন আমাদের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা এনে দিয়েছে, অন্যদিকে কেড়ে নিয়েছে গভীরতা, ধৈর্য, মন্থরতা। মানুষ এখন কেবল ‘দ্রুত’ চায় : তথ্য, সাফল্য, প্রেম, অর্থ, পরিচিতি। সব কিছু যেন ‘তাড়াতাড়ি’ চাই। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে সত্য অনুভবগুলো কি তাড়াহুড়ো করে পাওয়া যায়? প্রেম, উপলব্ধি, শান্তি এই শব্দগুলো সময় চায়, নীরবতা চায়, নিজের সঙ্গে থাকার সুযোগ চায়। কিন্তু আমরা কি সেই সময়টুকু রাখছি? আমাদের জীবনে এখন একটা অস্পষ্ট চাপ বিরাজ করছে ‘কিছু একটা করতে হবে’, ‘অন্যদের চেয়ে ভাল হতে হবে’, ‘সফল হতে হবে’। এই চাপ সমাজের, পরিবারের, আত্মীয়দের, সোশ্যাল মিডিয়ার। যেখানেই তাকাই, এক তুলনার ছায়া। কে কত দূর এগিয়েছে, কার জীবনে কী হয়েছে, কে কেমন ‘স্টেটাস’ দিয়েছে এসব নিয়ে দিন শুরু ও শেষ। অথচ এই তুলনার রাজনীতি এক ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তৈরি করে। আমি কে, আমি কী চাই? এই মৌলিক প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যায় ‘আমি কী করে অন্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারি’-এর উত্তেজনায়।

আরও গভীরে গেলে দেখা যায়, সম্পর্কগুলোও আজকাল খুব ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে। আমরা বলি ‘কমিউনিকেশন বেড়েছে’, কিন্তু তা কি সত্যিকারের বোঝাপড়াকে বাড়িয়েছে? মানুষ এখন যত কথা বলে, ততটা শোনে না। আমরা মেসেজ করি, ইমোজি পাঠাই, কিন্তু অনুভব ভাগ করি না। ফলে সম্পর্কগুলো হয়ে উঠছে পৃষ্ঠর নিচে গভীরতাবর্জিত। কোনও জটিলতা এলেই মানুষ বেরিয়ে যায়, পালিয়ে যায়, সম্পর্ক ভেঙে যায়। বন্ধুত্ব, প্রেম, পরিবারের বন্ধন সব কিছু যেন ক্লান্ত এক আত্মার ভার বইছে। এই ভাঙনের শব্দ আমরা শুনতে পাই না, কিন্তু এর রেশ থেকে যায় আমাদের মানসিক দেহে অস্থিরতা হয়ে, ঘুমহীনতা হয়ে, বিষণ্ণতা হয়ে।
আর এই সবকিছুর মধ্যে রয়েছে একটি মৌলিক সঙ্কট।আত্ম-সংযোগের বিচ্ছিন্নতা। মানুষ প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গিয়েছে। নিজের মন ও শরীরের থেকে দূরে সরে গিয়েছে। এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্করভাবে, নিজের আত্মার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আমরা আর নিজের সঙ্গে একা থাকতে পারি না। এক মুহূর্ত নীরবতা এলেই আমরা ফোন হাতে নিই, গান চালাই, স্ক্রল করি। যেন চুপ করে থাকা মানেই বিপদ। অথচ সমস্ত অন্তর্দৃষ্টি, সমস্ত উপলব্ধি, সমস্ত অন্তরের আলো জন্মায় নীরবতায়। সেই নীরবতাকে ভুলে গিয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি এক অন্তহীন শব্দের মরুভূমিতে। চারপাশে প্রচুর শব্দ, কিন্তু নেই এক বিন্দু জল। এই অস্থিরতার আরেকটি বড় কারণ হল নিরাপত্তাহীনতা।শুধু বাহ্যিক অর্থে নয়, অস্তিত্বগত অর্থেও। আমরা জানি না আগামী দিনে কী হবে, আমরা জানি না সম্পর্কগুলো টিকবে কি না, আমরা জানি না নিজের স্বপ্ন পূরণ হবে কি না! এমনকি আমরা নিজের অনুভূতিগুলোকেও পুরোপুরি বুঝি না। এই অনিশ্চয়তা এক অদৃশ্য কুয়াশার মতো ঘিরে ধরে মনকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় জলবায়ুর পরিবর্তন, বিশ্ব রাজনীতির অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট, যুদ্ধ, উদ্বাস্তু সমস্যা সব মিলিয়ে বিশ্ব এক ছিন্ন-সংলগ্ন চিত্রে দাঁড়িয়ে আছে।

মানুষ নিজের ভিতর ও বাইরের দুই জগতেই নিরাপদ নয়। তবে এই অস্থিরতার মধ্যে দিয়েই কি জন্ম নিচ্ছে নতুন এক উপলব্ধি? ইতিহাস বলছে, সবচেয়ে অন্ধকার সময়ের পরেই আসে আলোর সন্ধান। হয়ত এই অস্থিরতাই আমাদের বাধ্য করছে নিজের ভেতরে ফিরে যেতে। বাইরে যখন কোনও কিছুই স্থায়ী নয়, তখন মানুষ প্রশ্ন তোলে “স্থায়িত্ব কোথায়?”, “শান্তি কোথায়?”, “অর্থ কী?” এই প্রশ্নগুলো থেকেই শুরু হয় এক নতুন যাত্রা যেটা বাইরের দিকে নয়, ভেতরের দিকে। আর সেই ভেতরের যাত্রাই পারে মানুষকে স্থির করতে, গভীর করতে, নির্ভার করতে। এই সময় অস্থির, কারণ এই সময় আত্মিক শূন্যতায় আক্রান্ত। কিন্তু সেই শূন্যতাই আমাদের ডাকে এক নতুন উপলব্ধির দিকে। যদি আমরা প্রতিদিন কিছু সময় নিঃশব্দ থাকি, প্রকৃতির দিকে তাকাই, নিজের মনকে শুনি, তাহলে হয়ত আমরা আবার বুঝে উঠব : কোনটা সত্য, আর কোনটা কেবলই অস্থায়ী এক অস্থিরতার রূপ।
আমরা যেন আবার শিখি ধীরে হাঁটতে, শিখি চুপ থাকতে, শিখি গভীরভাবে ভালবাসতে। অস্থিরতা আসবে, কিন্তু স্থিরতা তখনই জন্মাবে—যখন আমরা নিজের হৃদয়ের দিকে তাকাব। এই সময় আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে, এবং সেই পরীক্ষার উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের নিজস্ব, মৌন, অন্তর্জগতের গভীরে।
ছবি : প্রতীকী ও সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Virat Kohli : আরসিবির প্রথম আইপিএল জয়ের আবেগঘন মুহূর্তে কোহলির চোখের জল মোছালেন অনুষ্কা
