



সৌমি নন্দ ★ শ্রীরামপুর : শ্রীরামপুরের (Serampore) মাহেশে ৬২৯ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য বহন করা জগন্নাথদেবের (Jagannath) রথযাত্রা উৎসবের প্রাক্কালে মঙ্গলবার পালিত হল নবযৌবন উৎসব। মন্দিরের পুরোহিত থেকে শুরু করে সাধারণ ভক্ত, সকলেই এই বিশেষ দিনে মাহেশ মন্দির প্রাঙ্গণে উপচে পড়া ভিড় জমিয়েছেন। দীর্ঘ ১৫ দিনের নিভৃতবাস শেষে এদিনই প্রথম ভক্তরা মহাপ্রভুর (Mahaprabhu) দর্শন পেলেন। আর সেই দর্শন যে কেবলমাত্র চোখের নয়, তা যেন বলেই দিলেন বহু দূর থেকে আসা ভক্তরা, “এই দিনটা বাঁচার রসদ দেয়, যেন চোখে দেখা ঈশ্বরের জীবন্ত অভিব্যক্তি!” পুরাণ মতে, স্নানযাত্রার (Snanyatra) পর জগন্নাথদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কাঁপুনির সঙ্গে আসে জ্বর। তখন তাঁকে গর্ভগৃহে একান্তে নিভৃতবাসে রাখা হয়। মন্দিরের সমস্ত দরজা বন্ধ থাকে। এমনকি সেই সময় কোনও নামকীর্তনও হয় না। ১৫ দিন পর সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে পুনরায় ভক্তদের সামনে আনা হয় নবযৌবন উৎসবের দিনে। ঠিক এই দিনেই দেখা যায় জগন্নাথদেবের রূপোর হাত। সারা বছরে এটাই একমাত্র দিন যখন মাহেশের দেবতার এই বিরল রূপ দেখা যায়। “এই হাতই আমাদের আশীর্বাদের উৎস। রাজবেশে সাজানো জগন্নাথ যেন রাজাধিরাজ হয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান,” বলছিলেন অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় (Arindam Chattopadhyay), একজন স্থানীয় ভক্ত যিনি টানা ২৫ বছর ধরে নবযৌবন উৎসবে অংশ নিচ্ছেন।

এদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই মন্দির চত্বর মুখর হয়ে ওঠে ঘণ্টা, শঙ্খ ও মন্ত্রপাঠে। সকাল সাতটার মধ্যে খুলে যায় গর্ভগৃহের দরজা। ভক্তদের ঢল নামে গর্ভগৃহে। পুরোহিতেরা জানান, স্নানযাত্রার পর জ্বরের কারণে যাঁকে নিভৃত রাখা হয়েছিল, সেই মহাপ্রভুই আজ রাজবেশে ফিরে এসেছেন। পরানো হয়েছে রূপোর হাত, অলঙ্কার, এবং নতুন পোশাক। সঙ্গে নিবেদন করা হয়েছে ৫৬ রকমের ভোগ। “এই দিনটাই আলাদা,” বলেন জগন্নাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সত্যব্রত ভট্টাচার্য (Satyabrata Bhattacharya)। “পুরীর (Puri) নবকলেবর উৎসবের ছায়ায় মাহেশের এই উৎসবও যেন ঐতিহ্য আর অনুভূতির মিলনস্থল।” পুরীর রীতিকে অনুকরণ করেই মাহেশে পালিত হয় এই উৎসব, যদিও মাহেশের উৎসবের নিজস্ব পৃথক মাহাত্ম্য রয়েছে। কারণ এখানেই একমাত্র দেখা যায় জগন্নাথদেবের হাত। এবং এই দিনেই তাঁর শরীরে ভক্তদের ছোঁয়া যায়, যা বিশ্বাস করা হয় অশেষ আশীর্বাদের আধার।উৎসবকে ঘিরে মন্দির চত্বরের বাইরেও ছিল বিপুল প্রস্তুতি। পুরনো পুজো কমিটির সদস্য শ্যামল দে (Shyamal De) বলেন, “এই দিন মাহেশে যেন ভক্তিময় এক নবজন্মের চেহারা নেয়। যাঁরা আজ আসেন, তাঁদের অনেকেই আসেন শুধুমাত্র এই একটি রূপ দেখার জন্য।” নবযৌবন উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে রথযাত্রার প্রস্তুতিও তুঙ্গে। আগামীকাল রথযাত্রার দিন। কথিত আছে, এই নবযৌবন উৎসব শেষ হলেই পরদিনই মহাপ্রভু রথে চড়ে বেরিয়ে পড়েন তাঁর মাসির বাড়ির উদ্দেশে। রথ প্রস্তুত, সাজসজ্জা চূড়ান্ত। পুণ্যার্থী ও দর্শনার্থীদের ভিড়ে থিক থিক করছে শহর।
পুজো উদ্যোক্তা পার্থসারথি বন্দ্যোপাধ্যায় (Parthasarathi Bandyopadhyay) বলেন, “নবযৌবন মানেই যেন এক নবপ্রাণের আবাহন। আজকের দিনটা আমাদের কাছে ঈশ্বরের পুনর্জন্মের মতন।” শুধু মাহেশ বা শ্রীরামপুর নয়, আশপাশের গ্রাম ও শহর থেকেও হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছেন এই নবযৌবন উৎসব উপলক্ষে। রীতিমতো মেলা বসেছে মন্দিরের চারপাশে। খাবারদাবার থেকে শুরু করে ধর্মীয় উপকরণ, সবকিছুর দোকানেই জমজমাট বেচাকেনা। এদিনের অপরূপ রাজবেশে জগন্নাথদেব যেন শাসকের মত নয়, স্নেহময় পিতার মত সবার আশীর্বাদ বিলিয়ে দিচ্ছেন। চোখে চোখ পড়লেই যেন মনের ভার হালকা হয়ে যায়—এটাই নবযৌবনের আধ্যাত্মিকতা। ভক্তদের চোখে জল, হাতে প্রণাম আর মনে শান্তি। এই একদিন, এই এক দর্শন, এই এক রূপ, যার টানেই শত শত বছর ধরে মানুষ ছুটে আসে মাহেশে।
ছবি: সংগৃহীত
আরও পড়ুন : CM Mamata Banerjee |দীঘায় রথযাত্রার ঢাকে কাঠি, পৌঁছলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
