



রতন টাটার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল মানুষ ও মানবতা। শিল্প জগতের শীর্ষে থেকেও মানুষটি কোনওদিন ‘শো অফ’ করেননি। কারণ, তাঁর কাছে জীবনের আসল সৌন্দর্য ছিল বিনয়, সততা আর নিঃশব্দে ভালবাসা বিলিয়ে দেওয়া। লিখেছেন : মেধা পাল

রতন টাটা শুধু শিল্পপতিই নন, একজন সাধারণ মানুষ
রতন টাটা (Ratan Tata) এই নামটি ভারতবাসীর হৃদয়ে শুধু একজন শিল্পপতির পরিচয়ে নয় এক নির্লোভ, নীতিবান, সংবেদনশীল মানুষের প্রতিচ্ছবিতে আঁকা। সদ্য প্রয়াত এই কিংবদন্তীর জীবন ছিল অসাধারণ সাফল্যে ভরপুর। অথচ তিনি নিজে ছিলেন অভূতপূর্ব সরল্যে গড়া একজন মানুষ। বিলিয়ন ডলারের সাম্রাজ্য সামলে চলা টাটা গোষ্ঠীর (Tata Group of Companies) কর্ণধার হয়েও রতন টাটাকে (Ratan Tata) কোনওদিন প্রাইভেট জেট বা অতিরিক্ত বিলাসিতায় দেখেননি কোনও দেশবাসী।তিনি নিজেই বলতেন, “আপনার গায়ে কত দামি স্যুট, সেটা নয় পরিচয় নয়, আপনি কীভাবে অন্যদের সম্মান দেন, সেটাই আপনার আসল পরিচয়।” এই মূল্যবোধ নিয়েই তিনি অতিবাহিত করে গিয়েছেন নিজের জীবন। টাটা গোষ্ঠীকেও। ল মুম্বইয়ের এক সাধারণ অ্যাপার্টমেন্টে থাকা, নিজেই গাড়ি চালানো, নিজের কুকুরদের সঙ্গে সকাল-বিকেল সময় কাটানো এসবই ছিল তাঁর রোজকার অভ্যাস। বহুবার তাঁকে সাধারণ চায়ের দোকানে, রাস্তার ধারের রেস্তোরাঁয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে গল্প করতে দেখা গিয়েছে। সত্যি বলতে গেলে, রতন টাটার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিল মানুষ ও মানবতা। শিল্প জগতের শীর্ষে থেকেও মানুষটি কোনওদিন ‘শো অফ’ করেননি। কারণ, তাঁর কাছে জীবনের আসল সৌন্দর্য ছিল বিনয়, সততা আর নিঃশব্দে ভালবাসা বিলিয়ে দেওয়া।
প্রেম অধরা থেকে গিয়েছে রতন টাটা-এর জীবনে
রতন টাটার জীবনের সবচেয়ে রহস্যঘেরা দিক তাঁর প্রেমজীবন। ব্যক্তিগত জীবন সবসময়েই আড়ালে রেখেছেন।

কখনও কোনও সম্পর্ককে মিডিয়ার সামনে আনেননি। তবে একাধিক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন, তাঁর জীবনে প্রেম ছিল। একবার একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি একসময় প্রেমে পড়েছিলাম। খুব গভীরভাবে।” শোনা যায়, আমেরিকায় পড়াশোনা করার সময় তাঁর একটি মেয়ের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিয়ের কথাও নাকি প্রায় ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ রতন টাটাকে পরিবারের একটি অসুস্থতার কারণে ওই সময় দেশে ফিরতে হয়। তিনি বলেছিলেন দিয়েছিলেন, জনৈক মেয়েটি যেন ভারতে এসে তাঁর সঙ্গে থাকেন। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ভারত-চীন যুদ্ধ শুরু হয় (১৯৬২), এবং সেই মেয়ে ও তার পরিবার ভারত আসতে চাননি ওই পরিস্থিতিতে। অবাক হলেও সত্যি, এটাই ছিল রতন টাটার জীবনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত। এরপর কখনও আর তিনি বিয়ে করেননি। চারবার প্রেমে পড়েছিলেন। এমনটিই এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তিনি নিজেই। কিন্তু কেন সম্পর্কগুলি বিয়েতে গড়ায়নি? উত্তর খুব সহজ। সময়, পরিস্থিতি ও দায়িত্ব। হয়ত শিল্পের মহীরুহ হয়ে উঠতে গিয়ে কোথাও নিজের ব্যক্তিগত সুখকে উৎসর্গ করেছিলেন রতন টাটা। তিনি কখনও একাকীত্ব সম্পর্কে অভিযোগ করেননি। বরং বলেন, “আমি কখনও একা ছিলাম না। আমার কাজ, আমার কুকুর, আমার চারপাশের মানুষজন এরা সবসময় আমার জীবন পূর্ণ রেখেছে।”
রতন টাটার কুকুরদের প্রতি ভালবাসা : মানবিক অধ্যায়
রতন টাটার জীবনে কুকুরেরা ছিল নীরব সঙ্গী। টাটা গ্রুপের বহু অফিস বিল্ডিংয়ের প্রবেশ দ্বারে যে পথকুকুরেরা ঘোরাঘুরি করে তাঁদের তিনি নাম দিয়ে ডাকতেন। খাবার দিতেন। এমনকী তাঁর উদ্যোগেই মুম্বইয়ের ‘বম্বে হাউস’-এ কুকুরদের জন্য আলাদা ‘kennel zone’ তৈরি হয়েছিল।

কিংবদন্তী মানুষটি বহুবার বহু কুকুর দত্তক নিয়েছেন। তাঁর ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুক পেজে একাধিকবার দেখা গিয়েছে কুকুরদের সঙ্গে তোলা স্নেহভরা ছবি। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “ওরা কথা বলে না, কিন্তু বোঝে। এবং ওরাই সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে পারে।” এই ভালবাসা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়। তাঁর বহু সমাজসেবামূলক কাজে প্রাণী সুরক্ষা ছিল অগ্রাধিকারভুক্ত বিষয় এটি অনেকেই অবগত। রতন টাটা ট্রাস্টের মাধ্যমে বহু পশু হাসপাতাল, আশ্রয় কেন্দ্র, ও চিকিৎসা কেন্দ্রে অনুদান পৌঁছেছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই চারপেয়ে বন্ধুদের পাশে থেকেছেন।
রতন টাটা একটি নিঃশব্দ বিপ্লববের নাম এবং উত্তরাধুনিক ভারত গড়ার কারিগর
রতন টাটার শিল্পদৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতা ভারতীয় কর্পোরেট জগতের মানচিত্র পাল্টে দিয়েছে। যেদিন তিনি মুম্বইয়ে সস্তায় একটি ছোট গাড়ি তৈরির কথা বললেন (Nano) সেদিন বিশ্বের চোখে তিনি হয়ে উঠলেন মধ্যবিত্ত ভারতের স্বপ্নদ্রষ্টা।
“সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চাই” — এই দর্শন থেকেই জন্ম নিয়েছিল ‘ন্যানো কার’। এটি তাঁর একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
তাঁর অফিসের সহকর্মীরা বলতেন, “তিনি কখনও চিৎকার করেন না, কখনও কাউকে ছোট করেন না। বরং ভুলের মধ্যেও তিনি শেখান।”

২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে যখন সন্ত্রাসবাদী হামলা ঘটে, তখন রতন টাটা নিজে হোটেলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। এবং ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন কোনও মিডিয়া কভারেজ ছাড়াই।
এই সমস্ত কর্মকাণ্ডই তাঁকে এক অনন্য মানবিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। আর তাঁর চলে যাওয়ায় শুধু এক শিল্পপতি নয়, ভারত হারায় এক অন্তর্মুখী, নৈতিক ও ইতিবাচক দৃষ্টির স্বপ্নবিলাসী প্রিয়বন্ধুকে।
রূপকথার মতোই নিঃশব্দ রতন টাটা কখনও নায়ক হতে চাননি। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে চিরকাল নায়ক হয়ে থাকবেন।

ওঁর জীবনের প্রেম ছিল নীরব। জীবনযাপন ছিল সরল। কুকুরদের প্রতি ছিল অতল ভালবাসা, আর শিল্পদর্শন ছিল জনসেবার স্বর্ণপ্রতীক। রতন টাটার জীবনের গল্প সেই রূপকথা : যেখানে রাজপ্রাসাদ আছে কিন্তু রাজা থাকেন মাটিতে পা রেখে। যেখানে প্রেম আছে, কিন্তু তা সময়ের অশ্রুত সুরে লেখা। যখন তিনি সশরীরে নেই, তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শ, ভালবাসা আর নীরব সহানুভূতি চিরকাল ভারতের ভবিষ্যৎকে পথ দেখাবে।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Singer Arijit Singh : অরিজিৎ সিং : জিয়াগঞ্জ থেকে বিশ্বমঞ্চে সুরের যাদুকর
