



ঠিক তৎক্ষণাৎ মুখার্জী বাড়ির রূপা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। সকলের সামনে বলে উঠল ,”জেম্মা আজ তুমি বিরিয়ানি খেয়ে যে হাড়গুলো ফেলেছো, সেটা আমার মিনু খেতে গিয়ে গলায় আটকে গেছে। তাড়াতাড়ি আমার মিনুকে ঠিক করে দাও। হাউমাউ করে কেঁদে গড়াগড়ি খেতে লাগল। উপস্থিত সকলেই তো হতবাক! লিখেছেন : হৈমন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
১৫৪০ খ্রীষ্টাব্দে হঠাৎ ভাগীরথী নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেল ফলস্বরূপ সরস্বতী নদীর তীরের বন্দর সপ্তগ্রামের বাণিজ্য হ্রাস পেতে থাকে। এইসময় ১৬৩১ খ্রীষ্টাব্দে থেকে কাশিমবাজার ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হয়। এসময় কাশিমবাজার রাজবাড়ির কিছু পূর্বে একটি বিরাট জঙ্গলাকীর্ণ শশ্মান ছিল। শোনা যায়, এসময় নবাব সরফরাজ খানের আমলে সুদূর মহারাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণানন্দ হোতা নামে এক ব্রাহ্মণ কাজের সন্ধানে এখানে উপস্থিত হন। ধর্মভীরু মানুষটি নিঃসন্তান ছিলেন। এরপর একদিন দেশে ফিরে যাবেন মনস্থির করলেন। এসময় তিনি স্বপ্নাদেশ পেলেন এবং তার ঘরে একটি কন্যাসন্তান আসে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর কন্যাসন্তানকে রক্ষা করতে পারলেন না। কথিত আছে, ঘাট পারাপারের সময় সেই কন্যা সন্তানটি জলে ডুবে যায় এবং স্থানীয় শাঁখারীকে শাঁখা পরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। আসলে ১২৬ বছরের এই প্রাচীন মন্দিরের আসল রহস্য উন্মোচন হয়নি বলেই অনেকে মনে করেন। কোথাও কোথাও আবার শোনা যায়, দক্ষিণ ভারতে কালাপাহাড় যখন হিন্দুদের দেবদেবী ধ্বংস করে দিচ্ছিলেন তখন জনৈক ব্রাহ্মণ মা করুনাময়ীকে রক্ষা করার অভিপ্রায়ে দক্ষিণ ভারত থেকে উড়িষ্যায় নিয়ে এসেছিলেন এবং পুরী যাওয়ার পথে এটিকে আর রক্ষা করতে পারবেন না এইভেবে নদীতে নিক্ষেপ করেন এবং জলপ্রবাহের পর মুর্তিটি বিষ্ণুপুর শশ্মান ঘাটে উপস্থিত হয়। খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, দক্ষিণ ভারতের ভাস্কর্যের সঙ্গে এই কালীর সাদৃশ্য অনেকখানি। এসময় কাশিমবাজার ইংরেজ কুঠির গোমেস্তা ছিলেন কৃষ্ণানন্দ হোতা। ঐতিহাসিক নিখিলনাথ রায়ের মতে, এই ব্রাহ্মণ সন্তান কৃষ্ণানন্দ হোতা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন। যেভাবেই হোক দক্ষিণ ভারতের পুরোহিতের হাতে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা সেও এক মহামিলন কী না সেও এক রহস্য! শোনা যায়, স্বয়ং বামাক্ষেপা একটিবার এসেছিলেন এই মায়ের মন্দিরে। পরবর্তীতে কাশিমবাজারের রানী এবং লালগোলার রাজা যোগীন্দ্র নারায়ণ রায়ের তত্বাবধানে এই মন্দিরের সংস্কার হয়। বিঘা পাঁচেক জমির ওপর এই মন্দিরের অবস্থান। বহু দূর দূর থেকে মানুষজন আসেন এই মায়ের দর্শনার্থী হয়ে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে এবার একটু থামলেন নরহরি বাবু।
-কলকেতা থেকে এক গাড়ি অফিসের লোকজন এসেছেন বহরমপুরের মধুপুর এলাকার বাসিন্দা গোবিন্দ দাসের বাড়িতে। গোবিন্দ দাস কলকেতার টাঁকশালে কাজ করেন। মুর্শিদাবাদ পর্যটন জেলার মধ্যে পড়ে। কাজেই অফিসের লোকজন হাড় কৃপণ গোবিন্দ বাবুর বাড়িতে যাওয়ার হুজুগ তুললেন।
-আগেরদিন রাতে পরিবারের সঙ্গে আলোচনায় বসে ঠিক করে নিয়েছেন যে দু’দিন এখানে আপিসের লোকজন থাকবেন বাড়িতে আমিষপদ হবে না। দাস গিন্নী ঠিক বুঝতে পেরেছেন স্বামীর আদতে মতলবটা কী। তিনি ঘাড় নেড়ে রান্নার মাসি পাঁচুর মাকে ডেকে বলে দিলেন বাড়িতে এই দু’দিন নিরামীষ রান্না হবে।
-পাঁচুর মা জিজ্ঞাসা করলেন, “বৌদি আপনাদের কী জ্ঞাতি মারা গেছেন”? দাস গিন্নী ধমকের সুরে বললেন, “এত কথা কিসের আর প্রশ্নই বা কেন? যা বলা হয়েছে তাই কর”।
-গজগজ করতে করতে ঘরে ঢুকলেন দাস গিন্নী। স্বামীর সামনে এসে ক্ষোভ উপড়ে দিলেন এখন বোঝো ঠ্যালা এই নিরামীষ রান্নার চোটে পাঁচুর মা আমার আত্মীয়কে মেরেই ছাড়বে।
-দাড়ি কামাতে কামাতে এই আইডিয়াটা বড় ক্লিক করে যায় গোবিন্দ বাবুর মাথায়। হঠাৎ বলে উঠলেন, “যাই বল গিন্নী, পাঁচুর মায়ের মাথায় বুদ্ধি আছে মানতে হবে। আমি তো রাত থেকেই ভাবছিলাম এই মাংসাশী লোকজনগুলোকে কি করে নিরামীষপদ গেলাবো”।
-মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দাস গিন্নী বললেন, মরণ। দুটো দিন মানুষজন আসবে তাতেও এরকম, বাপের জম্মে দেখিনি।
-কলকাতা থেকে আপিস কলিগরা আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের জানানো হল, দূর সম্পর্কের আত্মীয় মারা গেছেন তাই এই দু’দিন বাড়িতে নিরামীষ। আপনাদের যদি কারুর খুব অসুবিধে হয় বাইরের হোটেলে খেয়ে আসতে পারেন কিন্তু আত্মীয় বলে কথা কেউ আর এই অবস্থায় ভালো খাবার কথা ভাবলেন না সকলেই নিরামীষ আহারে সম্মত হলেন।
-বাড়িতে লোকজন বলতে দাস গিন্নী আর দাস বাবু। ছেলে, মেয়ে বিদেশে সেটেলড। কিন্তু এখনও গোবিন্দ বাবু নিজের কৃপণতা ছাড়তে পারলেন না। প্রথম প্রথম দাস গিন্নী রত্না ভাবতেন ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই মানুষটি এইরকম কিন্তু শেষ পর্যন্ত এক থেকে গেলেন এ নিয়েও ভারি অভিমান রয়েছে রত্নার মনে।
-প্রথমদিন মুগের ডাল, আলুসেদ্ধ আর পোস্ত দিয়ে দুপুরের ভোজন শেষ হল। এরপর সকলে ঠিক করে বিষ্ণুপুর মেলায় যাবেন। মেলায় রকমারি জিনিস, পাছে মেলায় গিয়ে খরচ হয় সেই ভয়ে নরহরি পুরোহিতকে সঙ্গে দিয়ে দিয়েছেন গাইড হিসেবে এছাড়া তার আত্মীয় মারা গেছেন। ফলে মন্দিরে ঢোকা যাবে না এই শর্তে সকলেই এসেছেন মেলায় এক গোবিন্দবাবু ছাড়া।
-নরহরি বাবু তার সাধ্যমতো ইতিহাস, ভূগোল আর পৌরোহিত্য বিদ্যার সকল পাণ্ডিত্য প্রকাশ করেছেন। সকলেই ভীষণ খুশি এমন ভাল গাইড পাওয়ার জন্য। এখান থেকে ভালো দক্ষিণাও জুটেছে।
-দ্বিতীয় দিন সকলেই বলে উঠলেন, “আজ নবাবের দেশে নবাবী বিরিয়ানী আর চিকেন চাপ খাওয়া-দাওয়া হবে। বাইরেই খেয়ে নেবেন বাড়িতে আর ঝামেলা করার দরকার নেই”। গোবিন্দ বাবু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। একবেলার খাবার তবু বাঁচনো গেল। কিন্তু ওরা বারবার দাস বাবু এবং তার গিন্নীকে যেতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু উপায় তো নেই সেপথ আগেই মেরে রেখেছেন স্বয়ং গোবিন্দ বাবু। অশৌচ গায়ে বাইরে যাবেন না।
-দুর্গা, দুর্গা বলে লোকজন হৈ হৈ করতে করতে গাড়িতে উঠলেন। গোবিন্দ বাবু ওদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়েই বাড়ি ঢুকেই বুঝলেন আজ এই শীতকালেও কাল বৈশাখীর ঝড় বইতে পারে! কারণ স্ত্রী রত্না এই একটি বিষয়ে ভীষণ দুর্বল। বিরিয়ানি নাম শুনলেই তিনি আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। যা ভেবেছেন ঠিক তাই । রত্নার মুখে একরাশ বিরক্তি। মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, আজ যদি এটুকু কিপ্টেমি না করতে তাহলে এই শীতকালে ঘোরা এবং খাওয়া দুটোই ফ্রী হয়ে যেত। নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারলে ! আজ আর কিছুই হবে না।
-গোবিন্দ বাবু অগত্যা নিজের স্ত্রী রত্নার জন্য তৎক্ষণাৎ বিরিয়ানি আনতে ছুটলেন। এক প্যাকেট বিরিয়ানি এনে গিন্নীর হাতে দিলেন। বললেন, “নাও এবেলা পেটপুরে খেয়ে নাও। বিকেলে কিন্তু ওদের সামনে নিরামীষ খেতে হবে”। রত্না সম্মত হলেন এবং পেটভরে বিরিয়ানি খেয়ে একটা লম্বা ঢেঁকুর তুললেন। এরপর পানের ডিব্বা থেকে একটি পান বের করে চিবোতে চিবোতে বললেন আজ বোস গিন্নীর গেটের সামনে এঁটো গুলো ফেলতে ফেলতে বলে এসেছি বিরিয়ানি আমরাও খায় বটে তবে পাড়ায় পাড়ায় বলতে যায় না। গোবিন্দ বাবু মুচকি হাসলেন বললেন, “তোমরা পারোও বটে”! ওমনি মুখ বেঁকিয়ে পিক ফেলতে ফেলতে রত্না বলে উঠল,” কেন, তুমি বা কম কিসে? এতগুলো লোককে ঘোল খাইয়ে দিলে তো! আত্মীয় মারা যাওয়ার ফাঁদ পেতে”।
-ইতিমধ্যেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এল আপিসের লোকজন ফিরে এল সকলে। ঠিক তৎক্ষণাৎ মুখার্জী বাড়ির রূপা কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। সকলের সামনে বলে উঠল, “জেম্মা আজ তুমি বিরিয়ানি খেয়ে যে হাড়গুলো ফেলেছো, সেটা আমার মিনু খেতে গিয়ে গলায় আটকে গেছে। তাড়াতাড়ি আমার মিনুকে ঠিক করে দাও। হাউমাউ করে কেঁদে গড়াগড়ি খেতে লাগল। উপস্থিত সকলেই তো হতবাক! বিরিয়ানি কোথা থেকে এল। গোবিন্দ বাবুর চোখমুখ লাল হয়ে গেছে, রত্না তাড়াতাড়ি রূপাকে শান্ত করার জন্য রান্না ঘরের দিকে নিয়ে গেলেন। পরিস্থিতি বড় গম্ভীর। এক নিমেষে যেন শোকের ছায়া নেমে এল বাড়িতে। এইসময় উপস্থিত হলেন নরহরি বাবু। গোবিন্দ বাবু তখন বলে উঠলেন, আরে নরহরি তোমার কাছেই যাব ভাবছিলাম আমার যে আত্মীয় মারা গেছেন খবর এসেছিল আজ দুপুরে জানতে পারলাম তিনি দু’দিন কোমায় আচ্ছন্ন ছিলেন। বাড়ির লোকজন এই অবস্থায় মৃত বলে ভেবে বসেছিলেন আজ তাঁর জ্ঞান ফিরেছে। বাড়িতে উপস্থিত সকলের মনে যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল তার সঠিক উত্তর পেয়ে যান। এমন সময় নরহরি বলেন, সবই ভবের খেলা। মা কালী স্বয়ং রক্ষা করেছেন। গোবিন্দ বাবু সেই সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, ঠিক তাই তিনিই মুখ রক্ষা করলেন।🍁
