



দশকের নিরিখে নব্বইয়ের অন্যতম কবি তৈমুর খানের জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। পিতা ও মাতার নাম : জিকির খান ও নওরাতুন বিবি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশুনো। কবি প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি করেন। বর্তমানে শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে, দৌড় প্রকাশনা সংস্থা থেকে। কাব্যগ্রন্থের নাম ‘কোথায় পা রাখি’। এছাড়াও কবি তৈমুর খান-এর ক’য়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ : বৃত্তের ভেতরে জল, জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা, উন্মাদ বিকেলের জংশন, স্তব্ধতার ভেতর এক নিরুত্তর হাসি, নির্ঘুমের হ্রস্ব ধ্বনি, আকাঙ্ক্ষার ঘরের জানালা, সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে, সর্বনাশের ডায়েরি ইত্যাদি। এখন পর্যন্ত তাঁর মোট প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ২২ টি। তাঁর গদ্যের উল্লেখযোগ্য বইগুলি হল: কবির ভাঁড়ারের চাবি, মুক্তির দশক নব্বইয়ের কবি ও কবিতা, কবিতার বাঁক ও অভিঘাত এক অন্বেষার পরিক্রমা, আত্মসংগ্রহ, আত্মক্ষরণ, আত্মস্বর, এই কবিতাজীবন ইত্যাদি। পুরস্কার পেয়েছেন : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার, দৌড় সাহিত্য পুরস্কার, নতুনগতি সাহিত্য পুরস্কার, আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার, অক্সিজেন সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি। সাশ্রয় নিউজ-এর আজকের পাতায় রইল কবির কবিতাগুচ্ছ।
তৈমুর খান
বিশ্বাস
আমরা বিশ্বাস পুষে রাখি
বিশ্বাস এসে আলো জ্বালে
আলোকিত ঘরে
আমাদের শিশুরা চাঁদ দ্যাখে।
চাঁদ কি টিক দিয়ে যায় তাদের কপালে?
দুধ নেই। দুধ খাওয়ার বাটি নেই।
তবুও বিশ্বাস আছে আমাদের।
হাত
অনেক অনেক হাত
হাতে হাতে বন্ধুত্বের স্পর্শ ফিরে আসে
কিন্তু নির্ভরতা আসে কি কখনো?
রোজ সন্ধেবেলা গলাদড়ি ঝুলতে থাকা
গাছটির পানে তাকাতে পারি না—
বউটি একাকী যেন শূন্যে ঝুলে আছে
গোধূলি রঙের শাড়ি তার লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে
একটিও হাত তার দিকে কেউ বাড়িয়ে দেয়নি
আমাদের কোনো রাস্তা নেই
সবাই ভেঙে যাচ্ছি আর নিয়তির কথা বলছি সবাই
আমরা সারাজীবন ঘর বানাচ্ছি
আর জামরঙের জামদানি কিনে দিচ্ছি
আর মর্নিংওয়াক থেকে ফিরে
চিনি ছাড়া চা খেতে খেতে
ভাঙা জীবনকে মেপে নিচ্ছি
খুব পরিষ্কার আমাদের ভাবনা,
কিন্তু জীবনচক্র জুড়ে শুধু গর্ত
আর প্রতিটি গর্তেই একেকটি সর্প
বেরিয়ে আসছে,আবার ঢুকে যাচ্ছে,জিভ দেখাচ্ছে
আবার ফণা তুলছে, ফণা নামিয়ে নিচ্ছে
নিয়তি ওদের রাস্তা করে দিয়েছে
অথচ আমাদের কোনো রাস্তা নেই
সামাজিক যানবাহনগুলি প্রাচীনত্ব নিয়ে স্থবির হয়ে জেগে আছে
ক্ষীণ আয়ুরেখায় দু-একটা উড়ে আসা প্রজাপতি বসেছে
আগামীর স্বপ্নেরা সবাই শুঁয়োপোকা
আমরা কতটুকু অপেক্ষা করলে তবে সেতু পার হবো?
ভেঙে যেতে যেতে কাঁচা বাদামে আমাদেরও বদল করে নেবে!
বিবেক ঘুমাল
রাত বাড়লে বিবেক ঘুমাল এবার
এখন যেমন ইচ্ছে বেরিয়ে পড়ো
ধর্ষণ খুন অগ্নিসংযোগে তুমিও বাহবা পাবে
রাজনৈতিক চাঁদ উঠছে
তোমাকে আলো দেবে।
রাজনৈতিক সূর্য উঠবে
তোমাকে পথ দেখাবে।
সব আলোই তোমার আলো—
সব পথই তোমার পথ—
তুমি হেসে উঠছ
তোমার মরচে ধরা অস্ত্রগুলি চকচক করছে!
ইতিহাসের কালো মানুষ
কীসে কার জয় কেউই জানে না
গায়ের জোরে পতাকা ওড়ে
ইজ্জতও লুঠ হয়ে যায়
চাবুক খেয়ে ঘোড়াগুলি ছোটে
জনগণ রাস্তা ছেড়ে দাঁড়ায়
ইতিহাস দূর থেকে লুফে নেয়
তিল ও তুলসী চন্দনে বরণ করে
মানুষের ঘাম আর অশ্রুদ্বীপের
মনোরম বাগানে বসিয়ে রাখে
জনগণ আশ্চর্য হয়ে হাততালি দেয়!
আত্মরক্ষা
নৌকা ভেসে গেছে
বন্যা আসক্ত নদীও
প্রেমের বৈঠারা কে কোথায় ?
হাসিকান্নার জলে বিস্ময় তরঙ্গ তট ভাঙে
সততার বিকল্প ছিল না যদিও
এসময় ভেসে গেছে সেও
নিজের ছায়ার কল্পনায়
এখনও ভেসে আছি
এই তীব্র প্রবাহে যতক্ষণ ভেসে থাকা যায়
নীলবর্ণা
কোনও নীলবর্ণার কাছে
আমার সাহসী বিশ্বাস রোজ যায়
কী কথা বলতে চায়?
বলা হয় না কথা তার
প্রপীড়িত উল্লাস নীরব দহনের গান গায়
নীলবর্ণা নিসর্গ হয়
শস্যক্ষেত হয়
নীলবর্ণা তবু এক পাখি
আমার অনন্তলোকে তার ডাক শুনতে থাকি
সম্পর্ক
আমিও পুরোনো শব্দের কাছে আসি
উলঙ্গ হই
সব ইন্দ্রিয় মরে গেলেও চৈতন্য মরে না
জেগে থাকে নিশিরাত, একাকী মুহূর্তগুলি
কথা ও কথার সূর্য সব ডুবে যায় একে একে
তবু আঁধারে খেলা পাতি
ইচ্ছা গড়াই রোজ কুসুমের কাছে
কথা নেই, কথা নেই আর— তবু মনে হয় কথা আছে
উলঙ্গ হই
বিষাদ আমাকে দ্যাখে
তার সঙ্গেই শয্যা পাতি
কেউ আর অবৈধ ভাবে না
আমরা চৈতন্যের ঘরে আছি
সংসারী নই তবুও সংসার হয়
পুরোনো সম্পর্কগুলি এভাবেই বাঁচে।
মৃত সম্রাট
রোজ মুকুট পরছি
রোজ ঘোষণা করছি
তবু ক্যামন চুপচাপ দ্যাখো
বাতাসও কেঁপে উঠছে না
গৃহিণী চুড়ি ভেঙে ফেলছে
উনুন নিভিয়ে দিচ্ছে
আলতার শিশি উল্টে দিয়ে
চলে যেতে চাইছে সোজা
আমি দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি নিজেকে
মৃত এক পুরুষ
মৃত এক সম্রাট
পুরনো প্রেমিক
কত তির বিঁধে আছে বুকে
তবুও নতুন আলোর গানের কাছে
সুর চাইতে এসেছি
সব ক্ষত ঢেকে আবার জ্যোৎস্নায়
কিছুটা উপশম চেয়েছি
ওদের বারান্দায় নেমেছে কত সাদা পাখি
রোদের সুস্পষ্ট উচ্চারণগুলি তাদের ঠোঁটে ঠোঁটে স্বরলিপি
গড়ে যাচ্ছে শূন্যতায়, উচ্ছ্বাসে
ভোরবেলার দিকে কোনও নক্ষত্রের কাছে
নিজের জাগরণ লুকিয়ে
ভুবন
ভুবনের রাস্তায় ভুবন দোলাচ্ছে কারা এসে?
আমি ভ্রমণে এসেছি আবার ভ্রমণে চলে যাব
যেতে যেতে ভুবনকে দেখে নিচ্ছি দু’দণ্ড ছায়ায় বসে
পাখিরা উড়ে যাচ্ছে গান ভরা ঠোঁটে
মৃদু মেঘের কম্পনে বৃষ্টি দুলছে
বাতাস তবুও মৃদু হেসে কী বলে যাচ্ছে কানে কানে!
ধর্মের বিষাদে অন্ধকার আটচালা বাড়ি
থেকে থেকে গভীর শোক উথাল-পাথাল করে
নিভে যাওয়া প্রদীপের নিচে ওরা তবুও সংসারী
ডাইনে-বাঁয়ে কোথাও পাঠশালা আছে
বিদ্যা-অবিদ্যা সেখানে পড়ে, পড়তে পড়তে বড় হয়
তারপর শীতে সোনালি কাঁথা বোনে
এখানে চুপচাপ থাকে, কিছুটা দূরে হইচইদের পাড়া
চেনাজানা কল্পনারা রোজ আসে স্বর্গে-নিসর্গে উঠে পড়ে,
যদিও তাদের লাগে না তেমন কোনো মই
দাঁড়ি-কমাবিহীন এই সাম্রাজ্যের বিজ্ঞাপনের পাশে
ঈশ্বরকে খুঁজতে খুঁজতে আমার শুধু অভিমান পাইঅভিমানে অভিমানে ভুবন ভরে যায়…
নিবেদন
রোজ নিবেদন লিখে যাই
জীবনের ঝরাপাতা কুড়োতে আসে না কেউ
বাতাস ওড়ায় শুধু, বহুদূর
নিদাঘের আকাশ ঘিরে ভরসার মেঘ আসে
হয়তো করুণা, হয়তো বিস্ময়
নিয়তির রুখাশুখা মাটি পাতে বুক
রোজ নিবেদন ওড়ে
বাতাসে বাতাসে পোড়া ছাই
কালপ্রবাহ
একটি নদীর তীরে সূর্য হারাই রোজ
খালি হাতে ফিরে আসি বাড়ি
নদীর ঢেউয়ের গুঞ্জন
গোধূলির নিসর্গ রূপকথা
অন্ধকার মেখে ঘুমোতে যায়
আড়মোড়া ভাঙে নদী
নক্ষত্র বেদীতে কারা জেগে থাকে ?
এশহর জানে না—
মাই নেম ইজ খান এর পর
আবার কারা তাঁবু ফেলবে এখানে আবার!
স্রোতের বিহঙ্গগুলি কেবলই ডানা ঝাপ্টায়…
আত্মপরিচয়
ঘুরপাক খেতে খেতে
ঘুরপাক খেতে খেতে
একটা আধা শহরে বাড়ি
অবেলার কাক, হাটুরে ফেরিওয়ালা
আর বিক্রি হওয়া মেয়ে
একে একে ফিরে এলে দেখা হয়
যে যার মতন জল মাপে
দু’একটা রাজনৈতিক শিকারি
মোড়ে মোড়ে কথা কাটাকাটি করে
মেয়ে পাচার হওয়া সংবাদে
মেতে ওঠে চায়ের দোকান
চোখের সামনে যেটুকু সামান্য আলো
তাও অন্ধকার হয়ে যায়
ছেঁড়া আত্মাটুকু রিফু করতে বসি
ঐশ্বরিক বিশ্বাসের সুতো নষ্ট হয়ে গেলে
কোথায় পাব আর?
বিজ্ঞাপনে দেখি সব তিল তাল হয়ে ঝরে
কোথাও নেই সুসমাচার!
তবুও শহর
গ্রাম থেকে বাবা নদী আনে
মা সেই নদীতে ধরা পড়া মাছ
আমি ও আমার বউ মৎস্যগন্ধা
লুকিয়ে রাখি সমূহ গোপন সংবাদ!
অলঙ্করণ : প্রীতি দেব, সৌমিক দাস ও আন্তর্জালিক
এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com
