Sasraya News

Thursday, February 13, 2025

Poet Bikash Sarkar : কবি বিকাশ সরকার এর কবিতাগুচ্ছ

Listen

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যে ক’জন হাতে গোনা শুদ্ধস্বরের লেখককে আমরা দেখতে পাই, কবি বিকাশ সরকার তাঁদের ভেতরে একজন। শুধু কবিতা নয়, তাঁকে তাঁর পাঠক বুকের খুব গভীরে গুঁজে রাখেন একজন নিপাট গদ্যশিল্পী হিসেবে। ওঁর ছোটগল্পের টান ও উপন্যাসের শৈল্পিক চমক একজন নিভৃতিচারী ও শক্তিশালী সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করেছে। 
সাম্প্রতিক সাহিত্যে অনেক লেখকের ভেতরই যখন শিল্পের রস ভাটার দিকে যাচ্ছে, সেই সময় এই কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক ও শিল্পী ওঁর সৃষ্টির ভেতর দিয়ে শিল্পের ভাষা ও ধ্বনিকে নিরলস পুনর্জীবন দিয়ে চলেছেন। সাশ্রয় নিউজ -এর আজকের পাতায় কবি বিকাশ সরকার -এর একগুচ্ছ কবিতা।

 

 

কবির প্রাণখোলা আনন্দের মুহূর্তের ছবি

 

বিকাশ সরকার 

কালিয়া

 

বহুদিন পর আজ কালিয়াকে নিকটে পেলাম, হৃদয়ের খুব কাছাকাছি
‘দূরে থাকি বটে, তবু দেখ, তোর সাথে আজও আমি রঙ্গরসে আছি’
কালিয়া হেসেছে খুব, তার মুখ-অবয়বজুড়ে হরিৎ হরিৎ বড় আলো
‘ড্ৰাইভার হই নাই এখনও’; ঠিক আছে ঠিক আছে খালাসিই ভালো

হরিৎ হরিৎ বড় আলো যেন কালিয়ার আবহমানের যত জাদুক্ৰীড়া
যেন অরণ্যের যাবতীয় বুনোসংগীতে ভরা তার শিরা-উপশিরা
হাটবাসে ঝুলে ঝুলে, বনের ঘ্ৰাণ নিতে নিতে সে আসে ও যায়
একটি আস্ত অরণ্য যেন লীন হয়ে আছে এই কালো কালিয়ায়

আমি তার হাতদুটি ধরি, দেখি শিরা ফেটে উঁকি দেয় টকটকে বন
আমার দুহাত সবুজ হয়েছে তাই, যেন আমিও তেমন বনবাসীজন
আমিও তেমন এক ব্যাধ, তূণে আছে বকের পালক আঁটা তির

চালক হয়নি, খালাসিই রয়ে গেল সে, মাথাউঁচু এক সবুজ দ্ৰাবিড়

 

 

 

 

 

দমনপুর

 

তুমি তো টগর, তোমার পাপড়ি ছুঁয়ে মৃদু এক বুনোসুর বাজে
আমরা দুজন তবে দমনপুরেই যাব হিমবন্ত শরতের মাঝে

রেললাইন পাশে রেখে হাঁটি, একটিবারও হাত ছুঁইনি তো
শুধু ভাটগাছ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাই, আমি যেন আত্মবিস্মৃত
এইখানে বহু দূর দূর কাশফুল শুধু, পাশে পাশে এক ব্রাত্য আমি
জঙ্গল ঘনসংবদ্ধ হয়ে আসে, টিলা বেয়ে উঠি আর নামি
ভাবো তো, কত রাত গভীর হয়েছে দমনপুর ভ্রমণ বিষয়ে
শীতে শুরু, বসন্ত-গ্রীষ্ম গেল, শরৎ এসেছে অবশেষে ঘন বর্ষা হয়ে
ভেজা রোদ এখন কুয়াশাসংকুল, সরে গেছে বিষাদবাতাস
তুমি আরও ফরসা হয়েছ, শরীরজুড়ে শুধু আশ্চর্য টগরের চাষ
তবু তো ছুঁইনি তোমার শরীর, শুধু চেয়েছি ছুঁতে শিশিরহৃদয়
চেয়েছি পৃথিবীর সকল জঙ্গল যেন আরও ঘন হয়, সবুজাভ হয়
আরও যেন উঁচু হয় বৃক্ষগুলি, আরও বেশি চঞ্চল শাখাপ্রশাখা
আর জমকালো পাখি, আরও বেশি উড়ানসক্ষম তাহাদের পাখা
সব প্রজাপতি তো তোমাকেই দেবো, সব পাখিদের ডাক, সকল ময়ূর
সব বুনোফুল, লতাগুল্ম, হরিণেরা, ঝিঁঝিদের একটানা সুর

এত যে বলেছি, ছোঁব না, তবু তো আমাকে তুমি ভেবেছ আবিল
দমনপুর তাই ইচ্ছে হয়ে আছে, তুমি তো যাত্রা কবেই করেছ বাতিল

 

 

 

 

মেঘমালাদের রানি

 

তোমার পা, পায়ের সূক্ষ্ম যত রোম ভিজিয়ে দিচ্ছে হাতিঝরনার জল
এমন অমোঘ দৃশ্য, জাদুহাতছানি, আমার প্ৰেমের হলো প্ৰকৃত সম্বল
যেন জন্মজন্মান্তর পার করে স্বপ্নে আসে এমন নরম ভেজা ছবিখানি
ওই যে ছড়ানোছিটানো সব সবুজ পাহাড়, তুমি এই পাহাড়ের রানি
বৃক্ষজুড়ে পরজীবী যত বৰ্ণময় ফুল, উদ্বাস্তু প্ৰজাপতিগুলি, ধ্যানস্থ বন
মেঘেরা ছুটছে ছুটছে ইতিউতি কুয়াশাপ্ৰতিম, যেন সব তোমার বাহন

জলের ভেতর তোমার পা দুটো, যেন চকিতে ফুটে ওঠা কোনও বুনোফুল
হাওয়ায় হাওয়ায় ওড়ে যৌনফিসফিস, যেন মেঘে ও বাদলে ভেজা চুল
তোমাকে জড়াই আর মনে হয় এ-পাহাড়ের, ঝরনার, অরণ্যের রহস্য জানি
আমি এক নাঙাভুখা রাখালবালক, উমিয়ামে থাকি, আর তুমি মেঘেদের রানি

এই স্যাঁতসেতে ভেজা ভেজা প্ৰেম, সাক্ষী সব কুয়াশার ঝরনাপাহাড়
এই জন্মে না হলেও পরজন্মে, রানি, মেঘেদের রথে চড়ে আসব আবার

 

 

 

 

তুমিগাছ

 

অপেক্ষা করি। রোজ রোজ সে-ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াই
এ-শহরে এক আদ্যন্ত অপরচিতের মতো
রক্ত মুছে দেবে, নিরাময় করে দেবে জীবনের যত ছিল ক্ষত
শুধু এইটুকু আশা নিয়ে, ভোরবেলা নিয়ে
গাছটির তলায় দাঁড়াই
ব্যৰ্থতাজৰ্জর এ-জীবনে যদি এতটুকু অমলিন ভালোবাসা পাই

রোজ ভোরের পর অল্প-অল্প জেগে আসে আলো
এই তো খিন্ন হকার সংবাদপত্ৰ নিয়ে একটু দাঁড়াল
খসে পড়ে একটা-দুটো বিশুষ্ক পাতা
শহর উতলা হচ্ছে, সাজছে বৈধব্যসম্বল মহিলার চায়ের দোকান
খুলছে জীবনের চিত্ৰবিচিত্ৰ সব হিসেবের খাতা

অপেক্ষা করি। গাছের তলায় গিয়ে
জীবনবিরক্ত এক ফুলওয়ালার পাশে
এই বুঝি এলো, এই তো, এই বুঝি ভালোবাসা আসে
কেটেছে অনিদ্ৰ, ক্লান্ত খুব প্ৰাণ, খসছে বিজীৰ্ণ যত পাতা
এসো, এসো ভালোবাসা, শোব আমি কোলে রেখে মাথা

দিন যায়, বৰ্ষ যায়, ক্ষত বৃদ্ধ হয়, পাকল বেদনা
আমি একাকী অপেক্ষা করি
এই গাছ তুমিগাছ, ভালোবাসাগাছ, আমার ঈশ্বরী

 

 

 

 

হিম আজ এক্কার বউ

 

চায়ের চিকন পাতা ছিঁড়ি ফ্ৰান্সিস এক্কার সাথে; তখন সকাল
হিম এসে লেগে যায় হাতে, অতএব চুপচাপ খাব গরম নুন চা
তারপর ছায়াগাছে সূৰ্য উঠবে জেগে আড়মোড়া ভেঙে, হাই তুলে
দাঁতনকাঠি নিয়ে বিগুলঝোরার দিকে চলে যাবে এক্কার বউ
দাঁত মেজে, কুলকুচো করে, তুলে আনবে আঁচল ভরে জলগুগলি
ঠিক দশটায় গুগলির ঝোল দিয়ে আমরা সকলে খাব মারুয়ার রুটি

ডবলির হাটে আমিও গজা কিনি সকলের সাথে; তখন বিকেল
ভাতের পচাই খাব নিঝঝুম রাতে, এখন চলবে শুধু তার পচনের খেলা
জোনাকি আসবে উড়ে একটাদুটো এক্কার বউটির সোমত্থ স্তনে
গোসাপের মাংস কি তার চেয়ে সুস্বাদু হয়? জোনাকিরা জানে
মাদল বাজাব ঘণ্টাখানেক, ততক্ষণে জেগে যাবে যত ছিল কাম

তারপর বিশাল জরায়ু হয়ে জেগে উঠছে হিন্দুপাড়ার সুনশান মাঠ
তারপর দূরে এক গণিকাবাড়িতে জ্বলে উঠছে আলতো লন্ঠন
তারপর একটি আস্ত ডবলির হাট ঘিলুতে পুরে আমি একা একা হাঁটি
আমি হাঁটি অন্ধকার মঙরির সাথে; তখন খুব অতর্কিতে রাত হয়ে যায়
হিম এসে লেগে যায় ফ্রান্সিসের হাতে, বুঝেছি এখন, হিম হল এক্কার বউ

 

 

 

 

সবুজের ধূসর ঈশ্বর

 

ফুলগুলি শাদা-শাদা সব ফুটে আছে চায়ের ধূলিধূসর গাছে-গাছে
একদা হরিৎ পাতাগুলি কেমন আজ বিষণ্ণ ফ্যাকাশে হয়ে আছে
মংরি এক্কা, এতোয়ার বোন, ঠোঙাভরে ফুলগুলি তোলে একাকিনী
তখন মনে হয়, ‘ধূসর তো কী, এই হরিৎহৃদয়পিণ্ড আমি আজও চিনি’

মংরি এতকাল পাতা তুলেছে, নরম সহজ পাতা, সযতনে বেছে
গাছগুলি পরমাত্মীয়, ‘সেসব দিন কি তবে সত্যি চলে গেছে?’
ওই তো বুধনি, কমলা, শান্তি, ওই এলো শাদা-শাদা ফুল তুলবে বলে
অথচ একদা পিঠে ঝুরি বেঁধে হরিতের ভালোবাসা তুলেছে সকলে
এতোয়া বনে গেছে, যদি ঝোরা ঢুঁড়ে কিছু পাওয়া যায় মাছ
কিংবা যদি চুরি করে আনা যায় জঙ্গলের কোনো কচি শালগাছ

‘লকডাউন’ লিখে দিয়ে বাবুরা চলে গেছে কবে, পাতা সব হয়েছে ধূসর
আজ তো ফুলভাজা দিয়ে খাবে ভাইবোন, কাল কী হবে জানেন ঈশ্বর

 

 

 

 

অন্ধকার জাগছে এখন আলোর সন্ত্রাসে

 

আকাশের দিকে উঠে গেছে যে-নদীটি, আমি মাঝি তার
আকাশসরিৎ থেকে পাহাড় চুম্বন করে তার নিত্য পারাপার
এও এক জাদুকরি নাও, মাঝিকেই বৈঠা দিয়ে বায়
স্রোতও জাদুর, ঘিলুরক্তে ঢেউ তুলে সেই স্রোত বহে যায়
আমাকে বাইতে থাকে আর পিছে পড়ে থাকে মনোবিকলন
সরে সরে যায় স্মৃতিগুলি, সরে সরে যায় যত বিস্মৃতির বন
আলো পড়ে, অন্ধকার পড়ে, মাঝির মনে পড়ে শুধু নদীটির কথা
অনন্ত আকাশে অপেক্ষা করে থাকে উপেক্ষার গূঢ় নীরবতা

আকাশের দিকে উঠে গেছে যে-মাঝিটি, তার নদী বাষ্প হয়ে আসে
চোখদুটি বন্ধ হলো যেন, অন্ধকার জাগছে এখন আলোর সন্ত্রাসে

 

🍁অলংকরণ : প্রীতি দেব

 

 

এক নজরে 👉 সাশ্রয় নিউজ-এ আপনিও পাঠাতে পারেন স্থানীয় সংবাদ। এছাড়াও রবিবারের সাহিত্য স্পেশাল-এর জন্য উপন্যাস, কবিতা (একধিক কবিতা পাঠালে ভালো হয়। সঙ্গে একটি লেখক পরিচিতি। গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য, পুস্তক আলোচনা (আলোচনার জন্য দুই কপি বই পাঠাতে হবে), ভ্রমণ কাহিনী। লেখার সঙ্গে সম্পূর্ণ ঠিকানা ও যোগাযোগ নম্বর থাকতে হবে। অবশ্যই কোনও প্রিন্ট বা ডিজিটাল মাধ্যমে এমনকী কোনও সোশ্যাল মিডিয়াতে বা পোর্টালে পূর্ব প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ই-মেল করে লেখা পাঠান। ই-মেল আই ডি : editor.sasrayanews@gmail.com

 

Sasraya News
Author: Sasraya News

Leave a Comment