



সূর্য মিত্র ★ সাশ্রয় নিউজ : শতাধিক সন্তান, তবু জীবনে একটিও বিবাহ হয়নি। নিজের নামে নেই কোনও পারিবারিক ছাদ। এমনকী নেই কোনও ঘোষিত উত্তরাধিকারীও। অথচ তাঁর হাতে রয়েছে ১৩৯০ কোটি ডলারের বিশাল সাম্রাজ্য, যা ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার কোটি টাকারও বেশি। পাভেল দুরভ (Pavel Durov) বিশ্বখ্যাত মেসেজিং অ্যাপ ‘টেলিগ্রাম’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও।

শুধু প্রযুক্তি বা বিতর্কে নয়, এবার বিশ্বজুড়ে চর্চার কেন্দ্রে এসেছেন নিজের ব্যক্তিগত জীবন ও সম্পত্তি বণ্টন পরিকল্পনার কারণে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে পাভেল দুরভ জানিয়েছেন, তাঁর ঔরসজাত ১০৬ সন্তান রয়েছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। এই সন্তানেরাই ভবিষ্যতে তাঁর বিপুল সম্পত্তির একমাত্র দাবিদার। তবে, সেই উত্তরাধিকার পাওয়ার শর্ত সহজ নয়। দুরভের ভাষায়, ‘‘পরবর্তী ৩০ বছর আমি কোনও সম্পত্তি কাউকে দিচ্ছি না। আমার সন্তানরা যেন নিজের মতো করে বড় হয়। নিজের জীবনে সফল হয়। তারা যেন শুধু ব্যাঙ্ক ব্যালান্স দেখে দিশেহারা না হয়ে পড়ে।’’

অনেকেই এই ঘোষণা শুনে বিস্মিত। কারণ পাভেল দুরভ নিজে কখনও ‘বাবা’ হিসেবে প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। অথচ এখন তিনি জানাচ্ছেন, বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশে তাঁর সন্তানরা রয়েছে। যাঁদের বেশির ভাগই জন্মেছে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (IVF) পদ্ধতির মাধ্যমে। আইভিএফ ক্লিনিকে শুক্রাণু দান করার অভ্যাস শুরু হয়েছিল প্রায় ১৫ বছর আগে, এক বন্ধুদম্পতির অনুরোধে।

সেই শুরু, তারপর রাশিয়ার একাধিক আইভিএফ ক্লিনিক থেকে বারবার অনুরোধ এসেছে। দুরভ রাজিও হয়েছেন। শর্ত একটাই, গর্ভধারণকারী মহিলার বয়স ৩৭-এর নিচে হতে হবে ও তাঁকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।রাশিয়া, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এই তিন দেশের নাগরিকত্ব রয়েছে পাভেলের। একসময় নিজের দেশ রাশিয়ায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ‘ভিকে’ (VK)-এর মাধ্যমে। পরে ২০১৩ সালে ভাই নিকোলাই দুরভ (Nikolai Durov)-এর সঙ্গে শুরু করেন ‘টেলিগ্রাম’। প্রথমে ইউক্রেন ও রাশিয়ায় জনপ্রিয় হলেও দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। পাভেলের জীবন কখনওই সরল পথে চলেনি। ২০১৪ সালে রুশ সরকারের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে তাঁকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়।অভিযোগ, রুশ প্রশাসন ‘টেলিগ্রাম’-এর ইউজার ডেটা চাইছিল, যা দিতে অস্বীকার করেন পাভেল। এরপর শুরু হয় তাঁর পরিযায়ী জীবন। বার্লিন, লন্ডন, সান ফ্রান্সিসকো, সিঙ্গাপুর পেরিয়ে শেষে টেলিগ্রামের সদর দফতর হিসেবে তিনি দুবাইকে বেছে নেন।

ব্যক্তিগত জীবনে দুরভের সম্পর্ক ঘিরেও নানা গল্প। কলেজজীবনে দারিয়া বনদারেনকো (Daria Bondarenko) নামে এক তরুণীর সঙ্গে সম্পর্ক, এমনকী গোপনে বিয়ের গুঞ্জনও। সেই সম্পর্ক থেকে নাকি তাঁদের দু’টি সন্তানও রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও দুই তরুণীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে তিনি আরও সন্তান জন্ম দেন বলে সূত্রের খবর। কিন্তু শুধুমাত্র সেই সম্পর্কগুলোর ফলেই ১০৬ সন্তান, তা তো হতে পারে না বলেই মনে করেন ওয়াকিবহাল মহল। এখানেই বিরল হয়ে ওঠে পাভেলের গল্প। সন্তানদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একবার পাভেল বলেছিলেন, ‘‘শুধু পিতৃত্ব নয়, আমি চাই প্রত্যেক সন্তান যেন নিজের পরিচয় তৈরি করে। শুধু আমার নাম থাকলেই চলবে না, তাঁদের মধ্যে থাকতে হবে আমার মতো সাহস, উদ্ভাবনী শক্তি ও দায়িত্ববোধ।’’ এই মুহূর্তে তিনি সন্তানদের জন্য যে সম্পত্তি রেখে যেতে চান, তার অঙ্ক চোখ ধাঁধানো। ব্লুমবার্গ বিলিয়নেয়ার্স ইনডেক্স অনুসারে, তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ প্রায় ১৩৯০ কোটি মার্কিন ডলার। পাভেল জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে এই সম্পত্তি তাঁর ১০৬ সন্তানদের মধ্যে সমানভাবে ভাগ হবে। যদিও এই ভাগ পাওয়ার পূর্বশর্ত হল, সন্তানকে নিজের পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠা পেতে হবে। এ যেন আধুনিক রাজর্ষি ধৃতরাষ্ট্রের নব সংস্করণ, যেখানে বংশ নয়, মূল্যবোধই উত্তরাধিকার নির্ধারণ করে।

পাভেলের জীবনের বিতর্ক এখানেই থেমে নেই। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে প্যারিসে গ্রেফতার হন দুরভ। অভিযোগ, টেলিগ্রাম অ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধচক্র মাদক পাচার, শিশু পর্নোগ্রাফি-সহ নানা বেআইনি কাজ চালাচ্ছে। তদন্তকারী সংস্থার দাবি, পাভেল সেই কার্যকলাপ ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যক্তিগত বিমানে আজারবাইজানের বাকু থেকে ফ্রান্সে যাওয়ার সময় বান্ধবী জুলি ভ্যাভিলোভা (Julie Vavilova)-র সামনে তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ। জুলি নিজে একজন ক্রিপ্টো বিশারদ, গেমার ও বহু ভাষায় পারদর্শী। চার দিনের মধ্যেই জামিন পেয়ে যান দুরভ। ৫০ লক্ষ ইউরোর বিনিময়ে মুক্তি পেলেও আদালতের নির্দেশ ছিল, ফ্রান্স ছাড়তে পারবেন না।

চলতি বছরের মার্চে প্রথমবারের মতো সেই নিষেধাজ্ঞা শিথিল হয়। পাভেল এখন রয়েছেন দুবাইয়ে।এখন তিনি কোনও আইভিএফ ক্লিনিকে শুক্রাণু দান করেন না। বরং নিজের জীবন ও ব্যবসার বিস্তার নিয়েই ব্যস্ত। তবে তাঁর ‘বংশবৃদ্ধির’ কাহিনি থেকে বহু প্রশ্ন উঠছে, জীবনের অর্থ কী? একজন পিতার দায় কতটা? আর সম্পত্তির প্রকৃত উত্তরাধিকার কীভাবে নির্ধারিত হওয়া উচিত?কিন্তু, পাভেল দুরভের জীবন যেন এক আধুনিক উপন্যাস। যেখানে আছে বিতর্ক, বিস্ময়, সাহস ও সৃষ্টির গভীর টানাপড়েন। তিনি কি ভবিষ্যতের ধনকুবেরদের নতুন দিক নির্দেশ করছেন? না কি, এক নিঃসঙ্গ স্রষ্টার জগৎসংসারে উত্তরাধিকার তৈরি করার শেষ প্রচেষ্টা? উত্তর হয়ত সময়ই দেবে। তবে একথা নিশ্চিত যে, পাভেলের গল্প ইতিহাসের পাতায় অনন্য স্থান নিয়েই থাকবে।
ছবি : সংগৃহীত
আরও পড়ুন : Fake relationships | নতুন মানুষের খোঁজে, কেন কাছের মানুষও হয়ে ওঠে প্রতারক?
